ইট’স কমপ্লিকেটেড – ২০

২০

— “রোদ্দুর…”

— “হুম?” 

— “ঘুম আসছে না?” 

— “মন খারাপ লাগছে।”

— “না ঘুমালে শরীরটাও খারাপ করবে।” 

— “সামি…” 

— “হুম?” 

— “একজন মানুষের এত ভালোবাসা ঠেলে দেবার সাধ্য কী করে হয়?” 

— “পৃথিবীতে সবাই কি ভালোবাসা খোঁজে? কেউ কেউ টাকা খোঁজে, খ্যাতি খোঁজে, পৃথিবীটা রাজত্ব করার নেশায় বুঁদ থাকে। যে ভালোবাসা চায় না তার কাছে একবিন্দু ভালোবাসা কিংবা অসীম ভালোবাসা, সবটাই এক।” 

— “বেচারা বোধহয় মরেই যাবে!” 

— “চোখে চোখে রাখতে হবে। ওকে দেখে রাখার দায়িত্ব শুধু অনির না, দায়িত্ব তোমারও। বাসায় এখন তুমিও আছো। ওকে ব্যস্ত রাখবে, বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করবে।” 

— “যতক্ষণ আছি ততক্ষণ না হয় খেয়াল রাখতে পারবো। কিন্তু উনার ব্যক্তিগত ব্যাপার এটা। উনার সঙ্গে আমি খুব একটা ক্লোজ না। মুনিয়ার ব্যাপারে কিছু বলা কি উনি পছন্দ করবেন? আজ যা দেখলাম মনে হয় না পাগলামি সহজে বন্ধ হবে। কত কিই করতে চাইবে। বারবার আমি বাঁধা দিলে রেগে যাবে না?” 

— “তো আর কী করার আছে? চোখের সামনে একজন মানসিক যন্ত্রণায় ছটফট করছে দেখেও হাত-পা গুটিয়ে বসে তো আর থাকা যাবে না। উল্টাপাল্টা বকবে হয়তো, কিছুদিন পর ঠিক হয়ে যাবে। একটুখানি নাহয় সয়েই গেলে।”

— “কারখানায় এত কাজ! আমাকে যেতেই হবে। অনি একা কিভাবে সামলাবে বুঝে পাচ্ছি না।” 

— “চাচা-চাচীকে আসতে বলো।” 

— “চাচী অলরেডি অসুস্থ হয়ে গেছে ছেলের কান্ড শুনে। চোখের সামনে এসব দেখতে পেলে অবস্থা আরো খারাপ হবে না?” 

— “নাতাশাকে বলবে?” 

— “কল করেছিলাম। রিসিভ করেনি। ঘুমাচ্ছে বোধহয়।” 

— “কপাল খুব বেশি কেটেছে?” 

— “হ্যাঁ। প্রথমে বুঝিনি। দেয়ালে পেরেকের উপর কপাল লেগেছে, ডিপকাট ছিল।”

— “ইশ!” 

— “সেন্সলেস হওয়ার পর অনি উনার এক ফ্রেন্ডকে কল করলো। উনি এসেছিল বাসায়। স্টিচ লাগলো দুইটা। হার্ট রেট বেশি, ব্লাড প্রেশার হাই।” – “ইচ্ছেমতো মদ গিলেছে বোধহয়।” 

— “অনি খুব কাঁদছিল। এখনও কাঁদছে বোধহয়।” 

— “কোথায় ও? অমিতের ঘরে?” 

— “হুম।” 

— “সেন্স ফেরার পর বমি করলো। মাথায় নাকি প্রচন্ড ব্যাথা হচ্ছে, মাথা তুলে বসতে পারছে না। ঘুমাচ্ছে এখন। অনি বললো ঐ ঘরেই থাকবে, কখন কোন প্রয়োজন হয়!” 

— “কাল কারখানায় না গেলে হয় না?” 

— “অনেক কাজ জমেছে। আমি না গেলে চলবে?” 

— “তাহলে ঘুমাও, কয়েকদিন ধরে খুব খাটাখাটুনি যাচ্ছে। রাতে না ঘুমালে বিছানায় পড়ে যাবে না?” 

সামির কথায় নবনী না কোনো সায় দিলো, না কোনো উত্তর। বারান্দার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে সে। উত্তরের হাঁড় কাঁপানো বাতাস গায়ে লাগছে। ভারী সোয়েটারেও শীত মানছে না। ঠান্ডার চেয়ে তীব্র বিষণ্নতাই নবনীকে জেঁকে ধরেছে। ওসব হীম শীতল বাতাস আজ যেন নবনীকে স্পর্শ করতে পারছে না। রাত গভীরে গোটা শহর ঘুমিয়ে। ঘুমুচ্ছে বোধহয় মুনিয়াও, নিশ্চিন্তে! একবার তাকে ডেকে নবনীর খুব বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, একটা মানুষ তোমাকে ভালোবেসে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে, পরিবার তাদের ছেলের যন্ত্রণা দেখে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। শুধু শুধু কেন কষ্ট দিলে তাকে? শুধু ভালোই তো বেসেছিল। তোমাকে ভালোবাসা কি পাপ? 

২১

মাথার উপর শত কাজের চাপ, এমন সময়ে পুরোনো দক্ষ তিনজন কর্মী দল পাকিয়ে চলে গেল কারখানা ছেড়ে। অগত্যা নতুন তিনজনকে নিতে হলো কারখানায়। দু’জন কাজে পটু হলেও, একটা মেয়ে একটুখানি আনাড়ি। কাজ শিখিয়ে নিতে নিতে মাসখানেক কেটে যাবে বোধহয়! তবুও ভালো, একদিনের তলবে কর্মী তো পাওয়া গেল। নতুন মেয়েটাকে সেলাই ফোঁড়ের ধরন দেখিয়ে দিচ্ছে নবনী, ঠিক তখনই কল এল বাসা থেকে।

— “হ্যাঁ আম্মু বলো?” 

— “ব্যস্ত তুই? 

— “হ্যাঁ। তুমি বলো না কী বলবে?” 

— “নাতাশা সকালে বলে গেল ভার্সিটিতে যাচ্ছে। এখন আবার কল করে বলছে অমিতের বাসায় নাকি আছে। ড্রাইভারকে দিয়ে যেন ওখানে ওর কাপড়-টাপড় পাঠিয়ে দেই। হঠাৎ তোর ওখানে কেন গেল?” 

— “আমি আসতে বলেছি।” 

— “কেন?” 

— “কেন আবার? ও কি আমার কাছে আসতে পারে না?” 

— “অবশ্যই পারে। কিন্তু হঠাৎ কেন? কোনো সমস্যা? ঐ বাসায় সব ঠিক আছে?” 

— “সব ঠিক আছে। শুধু শুধু ভাবছো। নতুন চারটা সিরিজ রিলিজ হয়েছে নেটফ্লিক্স আর এ্যামাজন প্রাইমে। অনি, আমি আর নাতাশা মিলে দেখব। তাই ওকে আসতে বলেছি।” 

— “একটা সমস্যা হয়েছে। 

— “কী?”

— “তোর ফুফু বিশাল ব্যাগ নিয়ে আধঘন্টা আগে এখানে এসেছে।” 

— “হঠাৎ?” 

— “তোর বিয়ের পর থেকেই রাশেদ ভাইয়ের সঙ্গে খুব তুলকালাম চলছে। প্রতিদিন ত্রিশ বছরের সব অপ্রাপ্তি, অপমানের কড়ায় গন্ডায় হিসেব নাকি চায়। কবে থেকেই সংসার ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছিল, এতদিন তোর ফুফা আটকে রেখেছে। গতকাল রাতে নাকি ঝগড়ার ফাঁকে বললো, চলে যাও যেখানে খুশি, তোমার এত হিসেব ফেরত দেবার কোনো ঠ্যাকা আমার নেই। ব্যস, ভোরে সবাই জাগার আগে তোর ফুফু বেরিয়ে এসেছে ঘর ছেড়ে। বলছে ডিভোর্স দেবে। তোর কথা বলে বলে কেঁদেই চলছে। আমার কাছে মাফ চাইছে, আম্মার কাছে, তোর আব্বুর কাছে মাফ চাইছে। কান্নাকাটি করে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে বেচারী।” 

— “ফুফা জানে?” 

— “তোর ফুফার অবস্থা শোচনীয়। রাগের মাথায় বলে ফেলেছে তখন। ভাবতে পারেনি সত্যিই ও চলে যাবে। সকালে কল করেছিল। বললো, আমার এখানে এলে যেন উনাকে জানাই। তোর আব্বু একটু আগে কল করে জানিয়ে দিয়েছে তোর ফুফাকে। সেই থেকে কান্নাকাটির মাত্রা বেড়েছে। বারবার বলছে আমি তোমাদের ঘরে কাজের বুয়া হয়ে থাকবো, তবুও প্লিজ আমাকে বাসা থেকে বের করে দিও না। ঐ লোকের সংসারে আমি যাব না।” 

— “ফুফু কি পাগল হয়ে গেছে! কাজের বুয়া কেন হতে যাবে?” 

— “অনেকগুলো বছর পেরোলো। যন্ত্রণা তো আর কম সয়ে যায়নি। তিক্ততা বেড়ে গেছে খুব। কী থেকে কী বলছে, নিজেও বুঝে পাচ্ছে না। তোর সঙ্গে দেখা করতে চাইছে। অমিত আর তোর কাছে ক্ষমা চাইবে। খুব করে বলছে আমাকে। রাতের দিকে নিয়ে আসবো একবার তোর ওখানে? ওকে একটু বুঝিয়ে শুনিয়ে দিলি!”

— “না আম্মু। উনি গতকাল রাত থেকে খুব অসুস্থ। এই মুহূর্তে বাসায় এসব কথা উঠানো ঠিক হবে না।

— “কার কথা বলছিস? কে অসুস্থ? অমিত?”

— “হ্যাঁ। 

— “কী হয়েছে?” 

— “প্রেশার হাই।” 

— “বয়স কত ওর? ৩৪-৩৫ হবে। এরবেশি তো না। এই বয়সে হাই প্রেশার বাঁধিয়ে ফেললো!” 

— “ঐ তো হলো আরকি।

— “কিছুদিন আগেই না ওর বাবা বললো ওর প্রেশার লো, মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না; ওর মাও বলেছিল। বেশি স্ট্রেস ও নিতে পারে না, বিপি লো হয়ে যায়। এখন আবার হঠাৎ করে কেন হাই হলো?” 

— “কী জানি আম্মু!” 

— “সত্যিই কোনো সমস্যা নেই তো?” 

— “উহুম। সব ঠিকাছে।” 

— “আমি কি আসবো ওকে দেখতে?” 

— “আসতে হবে না। উনি ঠিক হয়ে যাবে। আর ফুফুর দিকে খেয়াল রেখো। এসেছে যেহেতু, থাকুক সপ্তাহখানেক। রাখছি আম্মু, পরে কথা হবে।” 

হরেক রকম দুশ্চিন্তায় মাথা ধরে যাচ্ছে নবনীর। তারউপর মা যদি সত্যিই চলে আসে তখন কি হবে? মা-বাবার তাকে নিয়ে তো আর দুশ্চিন্তার শেষ নেই। দেয়ালের রক্ত, ভাঙা টিভি, অমিতের কপালের ব্যান্ডেজ দেখে নতুন করে আবার দুশ্চিন্তায় পড়ে যাবে না? 

সবকিছু কেমন অসহ্য লাগছে নবনীর। একটুখানি বেখেয়ালিপনার জন্য এতকিছু দেখতে হবে তাকে! কাজে আর বিন্দুমাত্র মন বসছে না তার। খানিকবাদেই মাগরিবের আজান দেবে। রাত দশটা পর্যন্ত কাজ করার কথা ছিল আজ, সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে, কারখানার সবচেয়ে পুরোনো বিশ্বস্ত কর্মী সাবেরার কাছে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লো নবনী। 

.

অনি কিচেনে, নাতাশা ওয়াশরুমে। দু’জনের চোখ ফাঁকি দিয়ে পা টিপে টিপে বাসা থেকে বেরিয়ে এল অমিত। মাথায় এখনো থেমে থেমে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। অসুস্থতার দোহাই দিয়ে গোটা দিন অনি তাকে ঘরে আটকে রেখেছে, বাড়তি পাহারাদার হিসেবে নাতাশাকে ডেকে আনা হয়েছে। অথচ মেয়েগুলো জানেই না এই যন্ত্রণার চেয়েও আরো কতবড় যন্ত্রণা সে বুকে বয়ে বেড়াচ্ছে! ঘরে শুয়ে-বসে শরীরের কষ্ট সেড়ে যাবে, কিন্তু মুনিয়াকে হারাবার কষ্ট! তার কী হবে? কে সারিয়ে তুলবে তাকে অসহ্য যন্ত্রণা থেকে? আছে কি কেউ? আছে কোনো উপায়? লিফটের দরজায় এসে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল অমিত-নবনীর। পাশ কাটিয়ে অমিত চলে যাচ্ছিল, শক্ত করে তার হাত ধরে ফেললো নবনী। 

— “কোথায় যাচ্ছেন?” 

— “কাজ আছে।” 

— “কী কাজ?” 

— “আপনাকে কৈফিয়ত দিতে হবে?” 

— “আপনি না অসুস্থ? অসুস্থ মানুষ কথা বলবে নরম স্বরে। আপনি এত রেগে উত্তর দিচ্ছেন কেন?”

— “হাত ছাড়ুন।

— “বাসায় চলুন।” 

— “বলছি তো কাজ আছে।” 

— “করতে হবে না কাজ। চলুন আমার সঙ্গে।” 

নবনীর মুঠো থেকে এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিলো অমিত। সামনের দিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে আবারও তার হাত চেপে ধরলো নবনী। 

— “গাড়ির চাবি কেন আপনার হাতে? এই অবস্থায় ড্রাইভ করবেন আপনি?” 

— “বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু!” 

— “আপনি করছেন না?” 

— “আমি যা খুশি করব তাতে আপনার কী?” 

— “আপনি এখনও স্ট্যাবল না, ঠিকমতো হাঁটতে পর্যন্ত পারছেন না। হ্যাংওভার এখনো কাটেনি সে তো বোঝাই যাচ্ছে। ড্রাইভ করতে গিয়ে কোন বিপদ ঘটাবেন কে জানে?”

— “ঘটুক, তাতে কার কী?” 

— “অবশ্যই অনেকের অনেককিছু। আপনি এখন কোথাও যাবেন না ব্যস। আর নিজে ড্রাইভ করে তো মোটেও না।

— “খুব বউ বউ অধিকার খাটাচ্ছেন হ্যাঁ? মুনিয়ার সঙ্গে আমার ঝামেলা হয়েছে শুনে ভাবছেন আপনার পথ খোলা? এবার নিজের অধিকার চাইবেন, বউ হয়ে সংসার করতে চাইবেন? ওসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। মুনিয়া আমার জীবনে থাকুক বা না থাকুক, এই জীবনে আর কখনো দ্বিতীয় কাউকে স্থান আমি দেবো না।’ অট্টহাসি হেসে উঠলো নবনী। সন্ধ্যেবেলার এই নির্জন সময়ে নবনীর হাসি যেন এ্যাপার্টমেন্টের গ্রাউন্ড ফ্লোর ছাপিয়ে ছড়িয়ে গেল বাইরের গলি অব্ধি। একরাশ বিরক্তি নিয়ে নবনীর দিকে তাকিয়ে রইলো অমিত। সে ভেবে পায় না, একটা মানুষের হাসি কেমন করে এত বিশ্রী হতে পারে! 

অমিতের দিকে খানিকটা ঝুঁকে দাঁড়ালো নবনী। বললো, 

— “ভীষণ ট্যালেন্ট আপনি! মাত্র দুই মিনিটে আমার কূটচাল ধরে ফেলেলেন?”

— “আপনি হাসছেন? আমার অবস্থা দেখে হাসি পাচ্ছে আপনার?” 

— “মদের নেশা এখনো কাটেনি, মুনিয়ার শোক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি তাই আপনার কথা শুনে হেসেছি। নয়তো কানের নিচে ঠাস ঠাস দু’টো মেরে দিতাম।” 

— “কী চান আপনি? কেন টানাটানি করছেন আমাকে?” 

— “কোথায় যেতে চান? বলুন আমাকে। আমি নিয়ে যাবো।” 

— “বারে যাবো। বাসায় প্রচন্ড সাফোকেট ফিল হচ্ছে।” 

— “আবার ড্রিংক করতে চান? গতকাল রাতে কী কী করেছেন জানেন?” 

— “তো কী করব? মরার মতো অবস্থাও তো নেই। বাসায় যত ছুরি, ব্লেড, পয়জনাস জিনিস আছে সব কোথায় সরিয়ে রেখেছে কে জানে! এখন আমি ড্রিংকও করতে পারবো না? আমার পেইন কেন কেউ বোঝার চেষ্টা করছে না? সহ্য করতে পারছি না আর।” 

— “বেশিই কষ্ট হচ্ছে?” 

অসহায় চোখে নবনীর দিকে তাকিয়ে রইলো অমিত। অমিতের হাত ছেড়ে দিলো নবনী। পথ ছেড়ে দাঁড়িয়ে বললো, 

— “চলুন, আমিও যাবো আপনার সঙ্গে।” 

— “আপনি কোথায় যাবেন?” 

— “আপনি যেখানে যাচ্ছেন।

— “ওখানে আপনার কী কাজ?” 

— “আগেও বহুবার শুনেছি ড্রিংক করার পর দুনিয়ার কোনো খবর থাকে না। অনেকে বলে অ্যালকোহল হলো স্ট্রেস ফ্রি হওয়ার টনিক। খুব মেন্টাল স্ট্রেসে আছি। দেখি আপনার সঙ্গে এক দুইবোতল খেয়ে, শান্তি পাই কি না। চলুন, চলুন।”

— “আমি আপনাকে নেবো না।” 

— “আমি ওসব চিনি না। যাইনি কখনো। আপনি সঙ্গে না নিলে একা কিভাবে যাবো?”

— “কী আশ্চর্য!” 

— “আসলেই তো, কী আশ্চর্য! আপনি আমাকে সঙ্গে কেন নিতে চাইছেন না?” 

— “আপনার ওসব খেতে হবে না।” 

— “কেন? কী সমস্যা?” 

— “পাগল নাকি? কিসের এত স্ট্রেস আপনার যে বারে গিয়ে ড্রিংক করতে হবে?” 

— “আপনার এত কিসের স্ট্রেস? মরতে কেন চান? আপনার প্রেশার হাই ছিল গতরাতে। ডক্টর স্ট্রিক্টলি বলে গেছে খাবার দাবারের ব্যাপারে সাবধান হতে, আর এ্যালকোহল তো একদমই না। অথচ আপনি বিপি নরমাল হওয়ার আগে আবার যেতে চাইছেন! আপনি জানেন কত কী বিপদ হতে পারে?”

— “কী হবে? খুবজোের মরেই যাবো।” 

— “সামান্য একটা প্রেমের জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিতে চাইছেন? আপনার জীবনের মূল্য এত কম?” 

— “সামান্য? আমার ভালোবাসা সামান্য মনে হয় আপনার কাছে?” 

— “দেখুন, আমি ওভাবে বলতে চাইনি। স্যরি।”

— “সবাই একই কথা বলে। মা-বাবা, বন্ধু-বান্ধব সবাই। কেউ আমাকে বুঝতে কেন চায় না? মুনকে আমি নিজের চেয়েও বেশি ভালোবেসেছি। ওর আর আমার সম্পর্ক সামান্য কিছু না।” 

— “স্যরি। আ’ম এক্সট্রিমলি স্যরি। আপনি কখন কী করে বসেন সেসব ভাবতে ভাবতেই মুখ ফস্কে কথাটা বেরিয়ে গেল। মুনিয়ার সঙ্গে আপনার সম্পর্কের গভীরতা কেমন তা আমি জানি না। উনি দেখতে কেমন তাও জানি না। এখন কেনই বা আপনি পাগলামি করছেন তাও জানি না। বলেননি তো কিছু কখনো আমাকে।”

— “আমাকে কেউ বোঝে না। বলে কী লাভ? অন্য সবার মতো আমার কাঁধেই সব দোষ চাপিয়ে বলবেন, সবকিছু মেনে নিয়ে সম্পর্ক টেনে নেয়ার মানে কী?” 

— “অন্য সবার মতো আমিও এমনটাই বলবো সে কথা ভেবে নেয়া বোকামি। বলেই দেখুন না আমাকে, প্লিজ!”

  • ……………..

— “নানী বলে, কথা পেটে চেপে রাখলে বুকে সমস্যা হয়। বলছেন না অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে? কথা সব পেটে চেপে রেখেছেন তাই কষ্ট হচ্ছে। কারো সঙ্গে শেয়ার করুন দেখবেন কিছুটা হলেও রিলিফ পাবেন। আমার সঙ্গেও করতে পারেন। প্রমিজ করছি, আপনাকে আমি একদম জাজ করবো না। চুপ করে শুধু শুনবো। যদি সম্ভব হয় তবে অবশ্যই একটা সলিউশন দেয়ার চেষ্টা করবো।” 

— “আপনাকে কেন বলবো আমি?” 

— “নিজের স্বার্থে। কষ্ট আপনি পাচ্ছেন, চান না এই কষ্ট থেকে বেরিয়ে আসতে?” 

— “বাইরে কোথাও বসি?” 

— “আপনি অসুস্থ। বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না। তাছাড়া আরো একটা সমস্যা আছে। ধরুন, মুনিয়ার গল্প করতে করতে হঠাৎ আপনার কান্না পেলো তখন? বাইরে কত মানুষ! এত মানুষের ভীড়ে কাঁদবেন আপনি? তার চেয়ে বরং চলুন আমরা ছাদে বসি নয়তো আমার ঘরের বারান্দায়।” 

— “ঘরে বসে এত কথা বলবো না আমি। অনিকে সব কথা শোনানো যাবে না।”

— “তাহলে ছাদেই বসি। কেমন?” 

.

ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে নবনী। হাঁটু ভাজ করে রেলিংয়ে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে অমিত। মাথার উপর কুয়াশা ঝরছে। বাসা থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরোবার সময় মাথায় ভালোভাবে ওড়না পেঁচিয়ে নিয়েছে নবনী। ঠান্ডায় হাত-পা জমে যাচ্ছে। মাঘের শীত অগ্রহায়ণে এসে কেন জেঁকে ধরছে সে হিসেব মেলাতে পারছে না সে। শুধুমাত্র অমিতের কথা ভেবে এই সময়ে তার ছাদে উঠা, নয়তো টেনে হিঁচড়ে কেউ এই ঠান্ডায় তাকে ছাদে উঠাতে পারতো না। অমিতের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নবনী। কিছু বলছে না লোকটা। একটু পরপর মাথার দু’পাশ চেপে ধরছে শুধু। ব্যথা করছে নিশ্চয়ই! শীতের দিনে সামান্য ব্যথাই সহ্য হয় না। আর এই লোক তো কপালে সেলাই নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ব্যথা কেমন হতে পারে সে কথা ভাবতেই আফসোস হতে লাগলো নবনীর। — 

— “কষ্ট হচ্ছে? বাসায় যাবেন?” 

— “না ঠিক আছি।”

— “গতকালের পর মুনিয়ার সঙ্গে কথা হয়েছে?” 

— “না। কল করেছিলাম। রিসিভ করেনি।” 

— “আপনাদের রিলেশন খুব একটা ভালো না সেটা কিন্তু আমি আগেই আন্দাজ করেছি।” 

— “কিভাবে?” 

— “আপনার মুখ দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবে আপনার মন কখন ভালো থাকে, কখন খারাপ। এক মাসের বেশি সময় হলো এখানে এসেছি। প্রতিদিন দেখছি আপনাকে। এই এক মাসে খুব কম সময়ই দেখেছি আপনি ফুরফুরে মেজাজে আছেন। যখন মন খারাপ থাকতো, তখন দেখতাম বারবার কাকে যেন কল করেই যাচ্ছেন। বারবার স্ক্রিন অন করে চেক করছেন কেউ টেক্সট করলো কি না। খেতে বসে আপনার খাওয়ায় মনোযোগ নেই, টিভি দেখতে বসে মন পড়ে থাকতো অন্য কোথাও। সর্বক্ষণ কী এক বিষন্নতা লেগেই থাকে আপনার চোখে মুখে। এতবার একটা মানুষ প্রেমিকা ছাড়া আর কাকে কল করবে?” 

— “মুনের সমস্ত কথা ফুরিয়ে গেছে। আমার সঙ্গে বলার মতো আর কিছুই বাকি নেই। কিন্তু আমার তো কথা ফুরায়নি। অনেক অনেক কথা জমিয়ে রাখি ওর অবসরে শোনাবো বলে। আমি ওকে কল করতে থাকি, ওর কন্ঠস্বরের তৃষ্ণায় মরতে থাকি অথচ ওর সময়ই হয় না আমার সঙ্গে কথা বলার। সময় না ঠিক, ওর ইচ্ছে হয় না।” 

— “সম্পর্কের এই টানাপোড়েন কবে থেকে চলছে?” 

— “দুই বছরেরও বেশি। আড়াই বছর আগে টিভিতে মেগা সিরিয়াল শুরু হয়েছিল, ফেরারী মন। নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই!”

— “উহুম। ঠিক মনে পড়ছে না। আমি আসলে সিরিয়াল টিরিয়াল দেখি না।” 

— “ওহ্! ঐ সিরিয়ালে মুন ছিল লিড এক্ট্রেস। আর সেটাই ছিল মুনের প্রথম 

সিরিয়াল। এর আগে ও র‍্যাম্প শো করতো, টিভিসি করতো। এখনও করে, তবে নাটকই বেশি করা হয়।” 

— “মুনিয়া মডেল? কোন মুনিয়া একটু বলুন তো? সোপের এড করে ভাইরাল হয়েছিল, ঐ মেয়েটা?” — 

— “হ্যাঁ।”

— “মাই গড! এত ফেমাস মডেলের বয়ফ্রেন্ড আপনি! কী মিষ্টি চেহারা ওর! গতকাল এতক্ষণ কথা বললাম, কই চাচী তো কিছু বললো না যে মুনিয়া মডেল? অনিও তো বলেনি কখনো!” 

— “মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছিল ওর ব্যাপারে?” 

মুখ আড়াল করে জিভ কাটলো নবনী। মুখ ফস্কে কী বলতে কী বলে দিলো! মা ঘন্টা বেঁধে অন্য কারো সঙ্গে তার নামে একগাদা বদনাম করেছে সে কথা শুনলে লোকটা রেগে বোম হয়ে যাবে না? 

— “মুখ লুকিয়ে রেখেছেন কেন?” 

— “কই না তো!” 

— “মা, অনি দু’জনই মুনের উপর প্রচুর ক্ষ্যাপা। ওর নামে ভালো কিছু বলবে না সেই কথা আমি জানি। — 

— “না না, ভুল বুঝছেন। খারাপ কেন বলতে যাবে?” 

— “ওকে কেউ পছন্দ করে না তাই।” 

— “বাদ দিন না ওসব কথা। ছেলেমেয়ের প্রেম থাকলে মা-বাবারা একটু আধটু কথা শোনায়। এসব কিছু না। যে কথায় ছিলাম আমরা, শুরু করুন আবার।” 

— “শুরু থেকে বলি, মাঝ থেকে বললে গল্প এলোমেলো লাগবে।” 

— “হ্যাঁ, হ্যাঁ বলুন না!” 

— “চার বছর আগে একটা ফ্যাশন হাউজের র‍্যাম্প শো অর্গানাইজ করেছিলাম 

আমি। অফিসিয়াল ছিল না, পারসোনালি করেছিলাম কাজটা। ক্লায়েন্ট হচ্ছে আমার ক্লাসমেটের মা। মডেলদের মাঝে মুনও ছিল একজন। তখন সবে ঢাকায় এসেছে ও। মডেলিং জগতে নিজের একটা শক্তপোক্ত জায়গা তৈরীর জন্য জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করছে। তখনও ওকে কেউ চেনে না। টুকটাক র‍্যাম্প শো করে, এডভারটাইজে সাইড রোল করে। প্রজেক্ট এক্সিকিউট করার জন্য আলাদা টিম থাকে। আমারও আছে। সেখানে অফিসের কিছু ছেলে থাকে, ফ্রিল্যান্সারও থাকে। একটা ছেলে ছিল রবিন, ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করতো। আমার টিমের হয়ে কাজ করেছে মাস দুয়েক হবে তখন। ও রেকমেন্ড করলো মুনকে। বললো, ওর বান্ধবী। ছবি দেখলাম, আগের করা র‍্যাম্প শোগুলোর ভিডিও দেখলাম। ভালোই লাগলো। মডেল লিস্টে ওকে এড করা হলো। ওদের রিহার্সাল একদিন দেখতে গিয়েছিলাম। তখন শুধু নাম, কোথায় থাকে এতটুকুই কথা হয়েছে। তারচেয়ে বেশি কিছু না। তারপর দেখা হলো একেবারে প্রোগামের দিন। স্টেজে উঠে ভালোই হাঁটছিল। হঠাৎ হিল ভেঙে মুন পড়ে গেল। ও আর উঠে দাঁড়াতে পারছে না। পা মচকে গেছে ওর। সে এক বাজে অবস্থা! চটজলদি টিম মেম্বাররা ওকে স্টেজ থেকে নামিয়ে আনলো। শো কোনোভাবেই থামানো চলবে না। টিমের প্রত্যেকটা ছেলে তখন কাজে ব্যস্ত। রবিনের সেদিন জ্বর ছিল, ও কাজে আসেনি। বাধ্য হয়ে আমিই ওকে নিয়ে গেলাম হসপিটাল।” 

— “কিভাবে? কোলে করে?” 

নবনীর দিকে তাকালো অমিত। মুখ টিপে হাসছে মেয়েটা। নবনীর দুষ্ট হাসিতে হেসে ফেললো অমিতও। 

— “কিসের মধ্যে কী!” 

— “সিরিয়াস ঘটনার মাঝে একটুখানি জোক। 

  • …… 

— “আরেকটু হাসুন তো, আপনার একটা ছবি তুলে রাখি।” 

— “ফাজলামি রাখুন।” 

— “আচ্ছা রাখলাম। তারপর?” 

— “সেই থেকে মুনিয়ার সঙ্গে আমার আলাপ। হসপিটাল থেকে গেলাম ওর বাসায়। তখন ও সাবলেট থাকতো। কয়েকজন মেয়ে মিলে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিল। বাসার দরজা পর্যন্ত দিয়ে এলাম। আমাদের ফোন নাম্বার দেয়া-নেয়া হলো।” 

— “ওর পড়াশোনা?” 

— “হ্যাঁ পড়তো তো। অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে তখন ও। হসপিটালে বসে জানতে পেরেছিলাম এখানে ওর কেউ থাকে না। মফস্বল থেকে আসা ছোট একটা মেয়ে, তার উপর একা থাকছে। আমার বেশ মায়া হলো। কেন যেন বারবার মনে হচ্ছিল, আমার প্রোগ্রামে এসে ওর এই অবস্থা হয়েছে, এরজন্য আমিই দায়ী। ও সুস্থ হওয়া অব্দি ওর সব দায়িত্ব আমার।” 

— “এত দায়িত্বজ্ঞান আপনার!”

— “খোঁচা দিয়ে বললেন?” 

— “নেগেটিভ মাইন্ড আপনার! ভালো কিছু ভাবতে পারেন না? 

— “ভালো কিছু কি ঘটছে আমার সঙ্গে?” 

— “হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝেছি। প্রেম হলো কিভাবে সেটা বলুন?”

— “কথা হতো প্রতিদিন নিয়ম করে, সকালে, বিকেলে, রাতে। মুন সুস্থ হলো কিন্তু আমাদের কথা বন্ধ হলো না। ওর পা ঠিক হওয়ার পর আমি কল করা প্রায় বন্ধ করে দিলাম। মুনই তখন কল করতো প্রতিদিন তিন চারবার করে। আমি ব্যস্ত থাকলে রিসিভ করতাম না। ফ্রি টাইমে রিসিভ করলেও খুব একটা কথা বলতাম না। এভাবে মাসখানেক কেটে যাবার পর একদিন সারাদিন কেটে গেল মুন কল করেনি। আমিও সেদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম, মুনের কথা আমার একদম খেয়ালে আসেনি। সারাদিন পর যখন বাসায় ফিরলাম, দেখলাম মুন কল করছে। আমি তখনও ফ্রেশ হইনি। ক্লান্তি, ঘুম, ক্ষুধা সব মিলিয়ে আমার দিন দুনিয়ার কোনো খবর নেই। একটা শাওয়ার নিয়ে, ডিনার করে লম্বা ঘুম দিতে পারলে বাঁচি। মুনের কল আমি কেটে দিলাম। ও আবার কল করলো। খুব বিরক্ত হলাম আমি। মোবাইল রেখে আমি চলে গেলাম শাওয়ার নিতে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে এসে দেখি মুনের বাইশটা মিসডকল! ভাবলাম ইমার্জেন্সি কিছু হয়তো। তড়িঘড়ি করে কল ব্যাক করলাম। রিসিভ করে ও কোনো কথা বলছিল না। আমি জাস্ট ওর ফোঁপানোর শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।” 

— “কাঁদছিল?” 

— “হ্যাঁ।” 

— “কেন?” 

— “আমি হঠাৎ ওর কান্নার শব্দ শুনে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কোনো বিপদ-আপদ হলো কি না কে জানে! কাঁদছে কেন জিজ্ঞেস করলাম, উত্তর দিলো না। ও শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। অনেকক্ষণ পর বললো, আমি তোমার বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছি। একটু নামবে প্লিজ! আমি দরজা লক না করেই দৌড়াতে দৌড়াতে নিচে গেলাম। তখন বাজে এগারোটা কিংবা সোয়া এগারোটা। এত রাতে একা একটা মেয়ে আমার বাসার নিচে দাঁড়ানো। আমাকে দেখামাত্রই ছুটে এসে মাঝরাস্তায় আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি স্পিচলেস হয়ে গেলাম ওর কান্ডে।” 

— “আমিও হচ্ছি। নিজেকে ছাড়িয়ে নেননি?” 

— “উহুম। কেউ আমাদের দেখছে বা কে কী বলছে ওসব কিছুই তখন মাথায় আসেনি। কিংবা নিজেকে ওর কাছ থেকে ছাড়াতে হবে সে কথাও মাথায় আসেনি। মুন আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে ঐ কথাটাই শুধু মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। তারপর ওর কী অভিমান! নাক টানতে টানতে বললো, বাড়ি গিয়েছিলাম একসপ্তাহ থাকবো বলে। হঠাৎ তোমার জন্য মন খারাপ লাগছে। খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল। বিকেলের বাস ধরে চলে এসেছি। বাসায় ব্যাগ রেখেই চলে এলাম এখানে তোমাকে দেখতে। সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি, অথচ তুমি আমার কলই রিসিভ করছো না।” 

— “ভালোবাসা তাহলে মুনিয়ার তরফ থেকেই শুরু হয়েছিল?” 

— “হুম। আমি বুঝে গিয়েছিলাম মুন আমাকে কী বলতে চাইছে। তবুও আমি ওর মুখ থেকে শুনতে চাইছিলাম কথাগুলো। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে দেখতে এতদূর থেকে ছুটে এলে কেন? ও ঠিক আমার চোখে চোখ রেখে বললো, ভালোবাসি, তাই ছুটে এসেছি। আজ ঢাকা ছেড়ে যাবার সময় মনে হচ্ছিল আমি আমার কোনো একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ ফেলে যাচ্ছি। অনেকক্ষণ খুঁজেছি জানো? বাড়ি গিয়ে মনে পড়লো আমি তোমাকে ঢাকায় ফেলে এসেছি। পুরো রাস্তায় আর তো কাউকে মনে পড়েনি তোমাকে ছাড়া। আর কখনো তোমার কাছ থেকে দূরে যেতে পারবো না। এখন থেকে ছায়ার মতো তোমার সঙ্গে লেপ্টে থাকবো। আমি বললাম, যদি আমার ছায়া হয়ে লেপ্টে থাকার অনুমতি না দেই? উত্তরে মুন বলল, তোমার জন্য পৃথিবীতে পাহাড়সমান অভিশাপ রেখে আমি চিরতরে বিলীন হবো। আমাকে ফিরিয়ে দিলে ভালোবাসা খুঁজে খুঁজে তুমি ক্লান্ত হবে, পৃথিবীর কোথাও একবিন্দু ভালোবাসা তুমি পাবে না। অসীম ভালোবাসা যে ফিরিয়ে দেয়, উপরওয়ালা কি কখনও তাকে ভালো রাখে? আমি মুনকে ফেরাতে পারিনি। অনেক অনেক মেয়েদের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। কিন্তু প্রেম কখনো আমার জীবনে আসেনি। একটা বেপরোয়া প্রেমিকা আমি খুব করে চাইতাম যে আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসবে। পৃথিবীর কোনো নিয়ম, কোনো মানুষের ধার ধারবে না। আমার ত্রিশ বছরে এসে অবশেষে আমি সেই মেয়ে খুঁজে পেলাম। মাঝ রাস্তায় রাত বিরাতে এসে কাউকে জড়িয়ে ধরার সাহস সবার থাকে না। পাগলাটে ভালোবাসা থাকলেই এই কাজ সম্ভব।” 

— “প্রেম তবে হয়েই গেল?” 

— “হ্যাঁ।” 

— “লাভ লাইফ কেমন ছিল আপনাদের?” 

— “অসাধারণ! আমার মনে হতো আমি অসম্ভব রকমে সুন্দর কোনো স্বপ্নে বাস করছি। কারো বাস্তব জীবন কখনো এত সুন্দর হয় নাকি?” 

— “যেমন?” 

— “ও প্রচন্ড আহ্লাদী স্বভাবের ছিল। সকালে ঘুম ভাঙতো মুনের কল পেয়ে। কথা বলতে বলতে রাতে ঘুমাতাম। সারাদিনে চার পাঁচবার ভিডিওকল তো আছেই। খুব যত্ন করতো আমার। কখন কী খাচ্ছি, কাজের ফাঁকে একটু আধটু রেস্ট নিচ্ছি কি না, বাসার রান্নাবান্না ঠিকভাবে হচ্ছে কি না… যেদিন ঠিকঠাক সময় দিতে পারতাম না, খুব পাগলামি করতো। কান্নাকাটি, অভিমান, অভিযোগ কত কী! আমার পছন্দের বাইরে কখনো একটা ড্রেসও কিনতো না। রিলেশনের পর সমস্ত শপিং আমিই ওকে করে দিতাম। তবুও মাঝেমধ্যে একা কোথাও গেলে, কিছু একটা পছন্দ হলে আমাকে জিজ্ঞেস না করে কিনতো না। বলতো, যেই জিনিসটা তোমার পছন্দ না সেই জিনিস আমার কাছে আমি রাখবোই না। প্রায়ই আমার প্রিয় সব খাবার রান্না করে নিয়ে চলে আসতো অফিসে। আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়া ছিল ওর সবচাইতে প্রিয় কাজ। আমি ওর মাঝে পুরোপুরি ডুবে গিয়েছিলাম। সর্বক্ষণ কী এক মায়ায় আমাকে ডুবিয়ে রাখতো মেয়েটা। আমি চাইতাম পৃথিবীর সমস্ত সুখ ওকে দিতে। দেশের টপ মডেল হওয়া ছিল মুনের স্বপ্ন। এইযে আজকের মুনকে দেখতে পাচ্ছেন, ঐ পথটা আমার তৈরী করে দেয়া। বিভিন্ন ডিরেক্টর, এডভারটাইসমেন্ট এজেন্সিতে আমার অনেক পরিচিত লোক আছে। বিভিন্ন ব্র্যান্ড ওনারদের সঙ্গেও ভালো আলাপ আছে। মাস দেড়েকের মধ্যে মুনের জন্য সাত আটটা ভালো কাজের বন্দোবস্ত করে ফেললাম। কাজের প্রতি ওর প্রচুর ডেডিকেশন ছিল। মিডিয়াপাড়ায় খ্যাতি পেয়ে গেল প্রথম দুটো এড করেই। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক কাজ মুনের চলতে থাকলো। নামীদামী সব ব্র্যান্ড, ম্যাগাজিনে তখন শুধু মুন। আমাদের সম্পর্কে অন্তরঙ্গতা ছিল শুরু থেকেই। কিন্তু আরো বেশি গভীর হলো পাঁচমাস পর। রুমমেটের সঙ্গে কী নিয়ে ঝগড়া করে সোজা আমার অফিসে চলে এল। বললো, আর ওখানে থাকবে না। বন্ধুর বাসায় ওর থাকার বন্দোবস্ত করে, সাত দিনের মধ্যে বাসা খুঁজে ভাড়া নিলাম। প্রয়োজনীয় ফার্নিচার যা লাগে সব কিনে দিলাম। মুন ঐ বাসায় যাওয়ার পর ওর বাসায় আমার অবাধ যাতায়াত শুরু হলো। ভালোবাসা বিছানা অব্দি চলে গেল। মন খারাপ হলেই মুনের আমার কাছে ছুটে আসা ছিল পুরোনো অভ্যেস। আলাদা বাসা হওয়ার পর মন খারাপের সময়গুলোতে আমাকে কল করে নিয়ে যেত ওর বাসায়। একরাত, দুইরাত, তিনরাত কাটাতে কাটাতে আমি ওর বাসার পার্মানেন্ট বাসিন্দা হয়ে গেলাম। ঐ এলাকার সবাই জানতো আমরা হাজবেন্ড-ওয়াইফ। মুনও আমাকে সেভাবেই ট্রিট করতো। আমি বাইরে থেকে আসার আগে নিজে সেজেগুজে রেডি থাকতো। ওয়াশরুমে গরম পানি, ট্রাউজার, টাওয়েল দেয়া থাকতো। টেবিলে গরম খাবার সাজানো থাকতো। আমি বাসায় ফেরার পর আমার জুতা খুলে দিতো, শার্ট খুলে কাঁধে, ঘাড়ে কিছুক্ষণ ম্যাসাজ করে দিতো। আমি শাওয়ার নেয়ার পর ও আমার মুখে তুলে খাইয়ে দিতো। রাতে ঘুমানোর সময় মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো। দুজনের ছুটির দিনগুলোতে একসঙ্গে রান্না করতাম, ঘর সাজাতাম। বৃষ্টির দিনে ও শাড়ী পরতো, আমরা একসঙ্গে ছাদে ভিজতাম। শীতের রাতগুলোতে লেপ মুড়ি দিয়ে বারান্দায় বসে গল্প করতে করতে পুরো রাত কাটিয়ে দিতাম। মুনের এত এত যত্নের পরও কোনো একভাবে যদি অসুস্থ হতাম, ওর টেনশন কে দেখে! কাজ, খাওয়াদাওয়া, ঘুম সব ফেলে আমার পেছনে লেগে থাকতো। খুব ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট ছিল। আমার এই ফ্ল্যাটের তিনগুন ছোট। অথচ মায়ার কোনো কমতি ছিল না, সুখের অভাব ছিল না। আমার জীবনের স্বর্গীয় দেড় বছর কেটেছে ঐ বাসায়।”

— “এ তো দেখছি হিন্দি সিরিয়ালের নায়িকা! এত প্রেম! বিয়ে করা হাজবেন্ড হলেও মেনে নিতাম। কিন্তু বয়ফ্রেন্ডের জন্য এত কে করে?” 

— “আম্মুও এই কথা বলতো আমাকে।” 

— “চাচী জানতো আপনাদের লিভ টুগেদারের ব্যাপারে?” 

— “নাহ্। বাসার কাউকে জানাইনি।” 

— “অনি তখন এখানে থাকতো না?” 

— “উহুম। অনি এসেছে বছর দুই হলো। ততদিনে আমি মুনের বাসা ছেড়েছি।” 

— “চাচী কি প্রথম থেকেই মুনিয়াকে পছন্দ করতো না?” 

— “পছন্দ করতো না, ঠিক তা না। আমার কিংবা অনির পছন্দে নিজের মতামত চাপিয়ে দেয়ার মতো মানুষ আম্মু-আব্বু না। আম্মুকে আমি মুনের কথা প্রথম জানাই রিলেশনের আট মাস পর। জানাতাম না, আমাদের এক রিলেটিভ দেখেছিল ওর সঙ্গে আমাকে। এর আগে আম্মু অসংখ্যবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছে কারো সঙ্গে প্রেম করছি কি না। রিলেশনের আগ পর্যন্ত পুরো পৃথিবীতে সবচেয়ে ক্লোজ ছিলাম আমি আমার মায়ের সঙ্গে। সব কথা শেয়ার করতাম, ছুটির দিনে ঘন্টা বেঁধে আমাদের আলাপ চলতো। অন্যরকম বন্ডিং ছিল আমাদের। মুনের সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ার পর আম্মুর সঙ্গে খুব একটা কথা হতো না। আমাদের সম্পর্কে দূরত্ব চলে এল। আম্মু আন্দাজ করেছিল আগেই। এতবার অস্বীকার করার পর যখন সেই রিলেটিভের কাছে জানতে পারলো আমার রিলেশনের কথা, আম্মু খুব মন খারাপ করেছিল। উনার ধারণা ছিল যদি কখনো আমার জীবনে প্রেম আসে সর্বপ্রথম আম্মুকেই আমি জানাবো। আম্মু জানার পর মুনের পরিচয় দিলাম। টিভিতে হরহামেশা দেখছেই, তাই ঘটা করে আর ছবি পাঠাইনি। ওর পারিবারিক অবস্থা কোনোকিছুই আম্মুর কাছে লুকাইনি। সব বলেছি। আম্মু কোনো আপত্তিই করেনি। তখন প্রায়ই ফোনে বলতাম মুন আমার কতটা কেয়ার করে। আম্মু হাসতো আর বলতো, অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ।” 

— “চাচীকে আগে কেন জানাননি?” 

— “মুন চাইতো না এত জলদি আমাদের রিলেশনের ব্যাপারটা ডিসক্লোজ হোক।”

— “কেন?” 

— “উঠতি ক্যারিয়ার ওর। এখনই প্রেম-বিয়ে সবার সামনে চলে এলে ক্যারিয়ারে বাজে প্রভাব পড়তো না?” 

— “লিভ টুগেদারে ছিলেন দু’জন। আপনাকে হাজবেন্ডের মতই ট্রিট করতো। তাহলে সবাই জানলেই বা আপত্তি কী? বিয়ে তো আর করছেন না। আর কোনো মডেল বা এক্ট্রেসরা কি প্রেম করছে না? এসব প্রেম-টেম এখন খুব কমন একটা ব্যাপার। সে কথা আপনি নিজেও জানেন। তবুও কেন মুনিয়ার এমন আপত্তি আপনার অস্বাভাবিক মনে হয়নি?” 

— “আমি ওর মোহে অন্ধ ছিলাম।ও যা বলতো, যেভাবে বোঝাতো তাই বিশ্বাস করতাম। কখনো মনে হয়নি মুন আমাকে মিথ্যা বলছে।”

— “আর সেই অগাধ বিশ্বাস ভাঙলো কবে?” 

— “ওর প্রথম মেগা সিরিয়ালের কথা বলছিলাম?”

— “হুম।” 

— “তখন মুন মডেল হিসেবে বেশ ফেমাস। অভিনয় জগতে পা রাখার পর তার খ্যাতি হয়ে গেল আকাশছোঁয়া। মানুষের মুখে মুখে তখন শুধু মুন আর মুন। দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে মিডিয়া পাড়ায়, দর্শকদের মনে আলাদা জায়গা তৈরী করে ফেললো ও। কত কত ডিরেক্টরের কল আসতে শুরু করলো, বিজ্ঞাপনে মুনের চাহিদা আরো বাড়লো। ছেলে ফ্যানদের অভাব হলো না। তার মাঝে অনেক প্রডিউসার, বিজনেসম্যানদের নজরে চলে এল। বাসায় প্রায়ই গিফট, ফুল আসতে লাগলো। আননোন নাম্বার থেকে কল আসতে লাগলো। মুন আর আমার সম্পর্কে দূরত্ব একটু একটু করে জায়গা দখল করতে লাগলো।” 

— “আগের মত আর প্যাম্পার করতো না?”

— “ওর আর আমার মাঝে দূরত্ব জায়গা করে নিচ্ছে সেটা আমি প্রথম থেকে খুব ভালোই টের পাচ্ছিলাম। এসব খ্যাতি, রিচ ওয়েল উইশারস, দামী গিফটসে মুন ডুবে যাচ্ছিল। আমি স্পষ্ট দেখতে পেতাম। আগের মতো প্যাম্পার দূরের কথা, ওর আর আমার মাঝে কথাবার্তাই হওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। সকালে বের হতো, ফিরতো অনেক রাতে। ক্লান্তির বাহানায় আমার সঙ্গে একটুখানি সময়ও কাটাতে চাইতো না। ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়তো। তবুও ওকে আমি কিছু বলিনি। নিজেকে নিজে স্বান্তনা দিতাম মুন সত্যিই ক্লান্ত। কত খাটাখাটুনি যায় সারাদিন। তাই হয়তো এমন হচ্ছে। আর কিছুদিন বাদে ও এই নতুন ব্যস্ত জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

— “আপনি পাগল? নিজেই বলছেন চোখের সামনে সবকিছু দেখতে পাচ্ছিলেন। তবুও কেন নিজেকে মিথ্যা স্বান্তনা দেবেন?”

— “আমাদের সম্পর্কটা ভেসে যাচ্ছে সে কথা মেনে নেবার মতো সাহস আমার ছিল না। ওকে ছাড়া কিভাবে বাঁচতাম আমি? নিঃশ্বাস আটকে আসতো আমার। আমাদের সম্পর্কের হিসেব কষতে গিয়ে আমি আর নিঃশ্বাসই নিতে পারতাম না। এমন হয়েছে বহুবার আমার সঙ্গে। চোখের সামনে আমি আমার মৃত্যু দেখতে পেতাম। ও আমার কতটা জুড়ে দখল করে রেখেছিল, কতটা আগলে রেখেছিল তা শুধু আমি জানি। বিলীন হওয়া বোঝেন? আমি হয়েছিলাম বিলীন। নিজের সবটা সঁপে দিয়েছিলাম ওকে। মুনকে ছাড়া আমার বাঁচতে হবে এমনটা ভাবিনি কখনো। ভেবেছিলাম আমৃত্যু রয়ে যাবে আমাদের ভালোবাসা। ওর চুলে নাক ডুবিয়ে ঘুমানোর অভ্যেস ছিল আমার। ঐ ফ্ল্যাট ছেড়ে আসার পর আমার ঘুম হতো না। ভয়াবহ ইনসমনিয়ায় ভুগতে লাগলাম। মুনের সঙ্গে আমার ব্রেকআপ হয়নি, সম্পর্কের সুতো তখনও কিছুটা আমার নাগালে রয়ে গেছে তবুও সেপারেট বাসায় আমরা থাকবো তা আমি মেনে নিতে পারিনি। বাজেভাবে ডিপ্রেশনে ভুগতে লাগলাম। সাইকিয়াট্রিস্টের হেল্পও তখন নিতে হয়েছিল আমাকে।” 

— “বাসা ছেড়ে ফিরে এলেন কেন?” 

— “মুন অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে গেল। এলাকার মানুষজন ওকে চিনতো। সাংবাদিকরা নিয়ম করে ওর খবর ছাপতো। মাঝে একবার নিউজ হলো মুন বিবাহিত। নিউজ দেখে ও কেঁদেকেটে প্রায় বেহুঁশ হওয়ার দশা! মিডিয়ায় খুব চর্চা হতে লাগলো এই ব্যাপারে। ওর ক্যারিয়ারের কী হবে সেসব ভাবতে ভাবতে অসুস্থ হয়ে হসপিটালাইজড হলো। হসপিটালের বেডে শুয়ে আমাকে রিকোয়েষ্ট করলো, আমি যেন আমার ফ্ল্যাটে ফিরে যাই। এখন থেকে আমরা একসঙ্গে থাকবো না।”

— “মেনে নিলেন?” 

— “আর কোনো পথ খোলা ছিল? আমি ওকে ভালোবাসি, মেয়েটা হসপিটালাইজড। ওর মেন্টাল কন্ডিশন দেখে মনে হচ্ছিল যখন তখন সুইসাইড এটেম্পট নেবে। এমন সিচুয়েশনে ওর কথা মেনে নেয়া ছাড়া আর কিই বা করার ছিল? তখন ওর মেন্টাল স্ট্যাবিলিটিই আমার কাছে বেশি ইম্পরট্যান্ট ছিল।”

— “আর আপনি? উনার কাছ থেকে দূরে সরে এসে নিজে মরে যাচ্ছেন তার কী হবে?” 

— “সয়ে গেছি আমি সবটা। মুনের জন্য আমি সব করতে পারি। ওর একেকটা এচিভমেন্ট আমাকে ওর কাছ থেকে একশো হাত দূরে সরিয়ে নিচ্ছিলো। আমার জন্য অসহনীয় ছিল তবু আমি অভিযোগ করিনি। কারণ মুন তার এচিভমেন্টে হ্যাপি ছিল। ওর ভালো থাকা আমার কাছে বিশাল কিছু।”

— “অদ্ভুত যুক্তি আপনার! 

— “সবাই তাই বলে। মা-বাবা, ফ্রেন্ড সার্কেল সবাই খুব বিরক্ত আমার উপর। একটা মেয়ে ব্রেকআপ করার জন্য যা কিছু করা দরকার সব করছে তবুও আমি তার পিছু ছাড়ছি না। সবাই প্রথমে খুব বোঝাতো ওর চেয়ে ভালো লক্ষী মেয়ে আমি পাবো। আমি সেসব মানতে পারিনি। এখন ওরা আমাকে গালি গালাজ করে।”

— “ব্রেকআপের কথা জানালো কবে?” 

— “বাসা আলাদা হওয়ার ছয়মাস পর। এক শিল্পপতির ছেলের সঙ্গে বেশ সখ্যতা হলো ওর। একদিন বিকেলে ওর কাছে সময় চাইলাম। কাজের বাহানা দেখালো আমাকে, মেনেও নিলাম। তারপর প্ল্যান করলাম আমি আর অনি। ততদিনে অনি চলে এসেছে এখানে থাকবে বলে। ওকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম মুভি দেখতে। মুভি দেখে বের হবার সময় দেখি মুন ঐ ছেলের হাত ধরে হল থেকে বেরোচ্ছে। প্রচন্ড রেগে গিয়েছিলাম। ওর হাত ধরে টানতে টানতে নিচে নেমে গেলাম। মানুষ আমাদের দেখছে, অনিকে উপরে একা রেখে এসেছি সেসব কিছু আমার মাথায় তখন আসেনি। মাথায় শুধু ঘুরছিল মুন আমাকে ঠকাচ্ছে। এর জবাব আমি চাই।”

— “যাক, অবশেষে কিছু একটা স্টেপ আপনার নিতে ইচ্ছে হলো।” 

— “নিজের কপালে শনি ডেকে এনেছিলাম সেদিনই।” 

— “কিভাবে?” 

— “এতগুলো দিনে মুন সরাসরি ব্রেকআপের কথা আমাকে বলেনি। অন্য ছেলেদের সঙ্গে ওর উঠাবসা, সখ্যতা যা কিছু ছিল সবটাই আমার আড়ালে। আমাকে এড়িয়ে চললেও মিসবিহেভ কখনো করেনি। দিনশেষে মিথ্যে হলেও অন্তত একবার আই লাভ ইউ বলতো। সেই ঘটনার পর মুন আমার নাগালের বাইরে চলে গেল পুরোপুরি। কোনো উত্তর তো আমি পাইনি, বরং বাসায় ফেরার পথে সেই শিল্পপতির ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে থানায় আমার নামে মামলা করলো। লোকজনের করা ভিডিও ততক্ষনে ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে গেছে। প্রমাণস্বরূপ পুলিশকে সেই ভিডিও দেখালো। সেই রাতে পুলিশ আমাকে এরেস্ট করলো।” 

— “মানে কী!” 

— “হ্যাঁ, এটাই হয়েছিল সেদিন আমার সঙ্গে।

— “কী আশ্চর্য! মামলা কেন করলো?” 

— “ওর রেপুটেশন জড়িয়ে ছিল যে! অসংখ্য মানুষ প্রত্যক্ষদর্শী ছিল। জার্নালিস্টরা, সোশ্যাল মিডিয়ায় ওর ভক্তরা তোলপাড় করছিল আমার সঙ্গে ওর সম্পর্ক কী? নিজের নাম বাঁচাতে আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল ও। সেই যাত্রায় কোর্টে চালান হতে হয়নি শুধু আমার ছোট মামার জন্য। ল’ইয়ার উনি। প্রচন্ড ট্যালেন্ট একটা মানুষ। মুন, থানা উনি কিভাবে ম্যানেজ করলো জানি না। তবে থানায় সবার সামনে মুনের কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছে আমাকে। পুরো একসপ্তাহ জুড়ে চললো পত্রিকায় আমার আর মুনের নিউজ। মা-বাবাকে কত শত প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল! আব্বু এত প্রেশার নিতে পারেনি। হসপিটালাইজড হতে হয়েছিল সেবার। মুনের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা এখন শুধু একতরফা তখনই সবাই জানতে পেরেছিল। সেই থেকে সবার সঙ্গে আমার দূরত্ব আরো বেড়ে গেল।” 

— “ওদের সঙ্গে কেন দূরত্ব বাড়বে?” 

— “মুনকে ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করতে বলতো। আমি ওদের কথা শুনতাম না, বরং মুনের রাগ ওদের উপর ঝাড়তাম।” 

— “মুনিয়া ঐ ঘটনার পর খুব রেগে ছিল। তারপর ওর সঙ্গে আবার সম্পর্ক কন্টিনিউ করলেন কিভাবে? মানে ও কথা বলতে রাজি হলো?” 

— “ওর বাসায় গিয়ে পা ধরে বসেছিলাম। অনেক কান্নাকাটি, রিকুয়েষ্টের পর কথা বললো আমার সঙ্গে। কিন্তু সম্পর্ক একতরফাই রয়ে গেল। অবনতিও হলো। সেই থেকে ওর ইচ্ছে হলে কল রিসিভ করে, নয়তো না। ছয়মাস পরপর নতুন নতুন প্রেমিকরূপী বন্ধুদের সঙ্গে আমি ওকে দেখি। ওদের সঙ্গে খুব গল্প করছে, হাসতে হাসতে গায়ে ঢলে পড়ছে, হাত ধরে শপিং করছে। যখন তখন অকারণে আমাকে গালি দিচ্ছে। সবকিছু মুখ বুজে সয়ে যাই আমি। যেতে হয়। নয়তো সম্পর্ক একতরফা বাঁচিয়ে রাখার অনুমতিটুকুও আর পাবো না। মুনের সঙ্গে আর কখনো কথা বলার ভাগ্যটাও যে শেষ হয়ে যাবে। ও আমাকে কী বলে, জানেন?” 

— “কী?” 

— “পা চাটা কুত্তা হইতে পারলে আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারবি, নয়তো তোরে লাত্থি মাইরা সরাইতে আমার দুই সেকেন্ড লাগবে না।”

— “এতকিছুর পরও আপনার রুচি কিভাবে হয় এই টক্সিক মেয়েটার সঙ্গে রিলেশন রাখার?”

— “অনেক চেষ্টা করেছি আমি। একবছর ধরে চেষ্টা করেই যাচ্ছি ওকে ভুলে নতুন করে সবকিছু শুরু করতে। আমি পারছি না। ওর স্মৃতি, ওকে ঘিরে আমার সব অনুভূতি, মায়া, ওর স্পর্শ, ওর যত্ন, আমাদের ঐ ছোট্ট বাসায় সাজানো সংসার কোনোকিছুই আমি ভুলতে পারি না। কোন অসহ্য যন্ত্রণার সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে আমি যুদ্ধ করে যাচ্ছি, তা আপনাকে বোঝাতে পারবো না আমি।”

— “এত নির্লজ্জ কেন আপনি?” 

— “আপনি বলেছিলেন আমাকে জাজ করবেন না।” 

— “স্যরি বাট না বলে পারছি না। আপনি কেন এত টর্চার সয়ে যাবেন? স্লো পয়জন চেনেন? ও আপনাকে একটু একটু করে বিষ দিয়ে মারছে। ওর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখলে এই যন্ত্রণা নিয়েই মরতে হবে আপনাকে। একটা অসভ্য ফালতু মেয়েকে ভালোবেসে নিজেকে শেষ করে দেবেন?” 

— “মুনের শূন্যতা মিটবে কিসে? এর কোনো সমাধান আছে আপনার কাছে? থাকলে বলুন না! আমিও তো চাই একটা সমাধান হোক। তিল তিল করে শেষ হতে কে চায়?”

— “এখনো কি পূর্ণতা পাচ্ছেন? মুনের শূন্যতায় কি ভুগছেন না? ও কি আপনার কাছে ধরা দিচ্ছে?” 

— “উহুম।”

— “পৃথিবীতে কেউ কখনো কারো শূন্যস্থান পূরণ করতে পারে না। শূন্যস্থান আজীবন শূন্যই থাকে। আমাদের কী করতে হয় জানেন? তাকে ঘিরে সমস্ত অভ্যেসগুলো একটু একটু করে বদলে ফেলতে হয়। জীবনের কোনো এক জায়গায় এসে ছন্দপতন হলে, নতুন করে আবার ছন্দ তৈরী করে নিতে হয়। মানুষ তো আপনি, বেঁচে তো থাকতে হবে। বাঁচার জন্য যা করা দরকার তাই করতে হবে। মুনের ভালোবাসা, যত্ন সবকিছু অতীত হয়ে গেছে আরো দুইবছর আগে। এই দুইবছরে কি মরে গেছেন আপনি? মরেননি তো, সয়ে নিয়ে বেঁচে আছেন। ভাবুন তো, দুইবছর আগের কথা। তখন যদি আপনাকে বলা হতো মুনের ভালোবাসা, যত্ন ছাড়া তোমাকে জীবন কাটাতে হবে, মেনে নিতে পারতেন? পারতেন না। এখন যেমনটা ভাবছেন মুনকে ছাড়া, মুনের সঙ্গে যোগাযোগ না রেখে বেঁচে থাকা অসম্ভব, তখনও ঠিক তেমনটাই মনে হতো। মুন আপনার জীবনে আর নেই, এটা মেনে নিন। অন্তত একটাবারের জন্য মনটা শক্ত করে যোগাযোগ বন্ধ করেই দেখুন না? মৃত্যুপথযাত্রীর জীবনযাত্রায় ফিরে আসা কিন্তু সহজ না। যমদূতের সঙ্গে লড়াই করে তবেই ফিরতে পারে। আপনিও তো এক প্রকার মৃত্যুযন্ত্রনাতেই ভুগছেন। স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে একটু তো লড়াই করতেই হবে। পারবেন না মনের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে?”

— “মুনের সঙ্গে আমার খুব কথা বলতে ইচ্ছে হয়। ওর কথা মনে পড়লে আমার আর কিচ্ছু ভালো লাগে না। কতবার ভেবেছি আর কল করবো না, হয় না আমাকে দিয়ে।”

— “চাচী বলছিল আগে উনার সঙ্গে ঘন্টা বেঁধে কথা বলতেন। এখন আর বলেন না। অনিকে নিয়ে আগে কত জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। এখন আর কোথাও ওকে নিয়ে যান না। দেখুন, ভালো ওরাও কিন্তু আপনাকে বাসে। অনেক বেশিই ভালোবাসে। আপনার ভালোবাসার মূল্য মুনিয়া আপনাকে দিচ্ছে না, আপনিও তো মা আর বোনের ভালোবাসার মূল্য দিচ্ছেন না। এক হিসেবে মুনিয়া আর আপনি একইভাবে দোষী। আপনি মুনিয়ার অবহেলায় যতটা কষ্ট পান, ওরাও পায়। শুধু একজনকে ভালোবেসে সমস্ত সম্পর্ক এভাবে তুচ্ছ করে দেয়ার মানে আছে? যে আপনাকে তুচ্ছ করে ছুঁড়ে ফেললো তাকে ভুলে, মলিন সম্পর্কগুলো আবার মায়ায় জড়িয়ে নিন। 

জীবন সহজ হবে, সুন্দর হবে। অনি বলছিল একদিন বন্ধুমহলে খুব ফেমাস ছিলেন আপনি। সেই বন্ধুগুলোর সঙ্গেও খুব একটা ভালো সম্পর্ক নেই আজকাল। কী অদ্ভুত আপনি! যে ভালোবাসে না তার জন্য মরে যাচ্ছেন, অথচ যারা এক সমুদ্র ভালোবাসা নিয়ে বসে আছে তাদের নিয়ে আপনার ভাবতেই ইচ্ছে হয় না।”

  • ………………..

— “ভালোবাসার কদর করলে তবেই ভালোবাসা মেলে। কদর করতে শিখুন, দেখবেন কেউ একজন আপনার ভালোবাসাও মনের কোনে সযত্নে আগলে রাখবে। আপনার স্বস্তি হয়ে পাশে রয়ে যাবে আজীবন।”

— “মুনের সঙ্গে কথা না বলে থাকতে পারব আমি? এটা কখনো সম্ভব?” 

— “অবশ্যই সম্ভব। মনটা শুধু একটু শক্ত করতে হবে ব্যস। একটু আগে বললাম না, মুনের অযত্নে অবহেলায় যদি বেঁচে থাকতে পারেন, মুনের সঙ্গে কথা না বলেও থাকতে পারবেন। অন্তত এক সপ্তাহের জন্য ট্রাই করুন। আর আমরা তো আছিই। মুনের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হলে আমাদের কল করবেন। আমি, চাচী, চাচা, অনি, নাতাশা কিংবা আপনার কোনো বন্ধু। যার সঙ্গে কথা বলে কমফোর্ট ফিল করবেন তাকেই কল করবেন। আমরা এটলিস্ট মুনের মতো মিসবিহেভ করবো না। আপনার মনও খারাপ হবে না। নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করুন। কী চমৎকার একটা ফ্যামিলি আছে আপনার! ওদের নিয়ে ভাবুন, সময় দিন। এত কিউট ফ্যামিলি যার আছে তার আবার এত ডিপ্রেশন কিসের? শুনেছি আপনি খুব প্রাণোচ্ছল হাসি খুশি একটা মানুষ ছিলেন। মিস করেন না আগের অমিতকে?” 

— “খুব।”

— “তাহলে মুন মুন করে মরছেন কেন? ফিরে যান আগের অমিতের মাঝে, যে অমিতের মাঝে মুনিয়া ছিল না। অমিত শুধুমাত্র অমিতই ছিল। মুনিয়ার শূন্যস্থান কখনো পূরন হবে কি না সেসব নিয়ে আর ভাববেন না। অন্যদের মতো আমি বলবোও না নতুন কেউ আপনার জীবনে আসবে, অনেক ভালো লক্ষী মেয়ে পাবেন। আমি শুধু বলবো যেই অমিত মুনিয়ার মাঝে বিলীন হয়েছে সেই অমিতকে খুঁজে বের করুন। নিজেকে সময় দিন, নিজের সঙ্গে অনেকটা সময় নিয়ে বোঝাপড়া করুন। জীবনে নারীসঙ্গ, ভালোবাসা অনেক আসবে যাবে কিন্তু নিজেকে হারালে আর ফিরে পাবেন না। লাভ ইউরসেল্ফ।” 

অমিত কিছু বললো না। উপরে নিচে মাথা নাড়ালো শুধু। কাছে এগিয়ে এল নবনী। অমিতের দিকে খানিকটা ঝুঁকে বললো, 

— “ফিলিং বেটার?” 

— “মাচ বেটার।” 

— “এইবার নিচে চলেন ভাই। পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে আমার। গতকাল আপনার হাঙ্কিপাঙ্কি দেখে আজ টেনশনে ঠিকঠাক খেতে পারিনি। এবার কিছু খেতে হবে, নয়তো আমিই আপনার মতো বেহুঁশ হবো।” 

— “আমারও সারাদিন কিছু খেতে ইচ্ছে হয়নি। এখন খিদা খিদা পাচ্ছে।” 

— “ভালো লক্ষণ। মুনিয়ার ভূত মাথা থেকে নেমে আসছে বোধহয়।” 

২২

তিনদিন অফিস কামাই করে আজ সকালে বিধ্বস্থ প্রায় চেহারা নিয়ে কাজে ফিরেছে অমিত। পনের দিন পর বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর বার্ষিক সমুদ্র মহড়া উদযাপিত হবে। তাদের ইভেন্ট এক্সিকিউট করতে হবে অমিতকে। কাজ চলছে আরো একমাস আগে থেকেই। অফিস থেকে এক সপ্তাহের সিক লিভ নিলেও গতকাল রাতে অফিস থেকে কল এল সম্ভব হলে আগামীকালই সে যেন অফিস জয়েন করে। এমনিতেও ঘরে বসে খুব একটা ফায়দা হচ্ছিল না, বরং বারবার মুনিয়াকে মনে পড়ছিল। নিজেকে ব্যস্ত রেখে যদি মুনিয়াকে ভুলে থাকা যায়, তাতে মন্দ কী? তাই অসুস্থ শরীরেই সকাল সকাল রেডি হয়ে রওয়ানা হলো অফিসে। রাত সাড়ে দশটা বেজে গেছে এখনো বাসায় ফেরেনি সে। অফিসে কাজের চাপ খুব বেশি থাকলে রাতে বাসায় ফেরে না অমিত, রয়ে যায় সেখানেই। কখনো কখনো দুই-তিনদিন পর বাসায় ফেরে। আজও তেমনটা হবে কি না জানা নেই অনির। বিকেলের পর অমিতের সঙ্গে আর কথা হয়নি তার। নয়টার পর কল করেছিল দুইবার, অমিত রিসিভ করেনি। অসুস্থ শরীরে অমিতের রাত জেগে অফিসে কাজ করা বড্ড ভাবাচ্ছে অনিকে। অস্থির হয়ে একটু পরপর একাই বিড়বিড় করছে, কাজ আছে বুঝলাম, শরীরটাও তো দেখতে হবে। অফিসের লোকজনগুলোও যে কী, আমি বুঝি না! কপালে ব্যান্ডেজ, অসুস্থ শরীর দেখেও কি বাসায় পাঠিয়ে দিতে পারছে না? 

টিভির সামনে বসে আছে নাতাশা। প্রিয় মুভি চলছে অথচ মনোযোগই দিতে পারছে না সে। অনি ভীষণ অস্থির হয়ে আছে। চোখের সামনে কেউ দুশ্চিন্তায় থাকলে মনোরঞ্জন মুশকিল হয়ে যায়। নাতাশা বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। তার বোনও এখনও কারখানা থেকে ফেরেনি। একঘন্টা আগে বলেছে দশ মিনিটের ভেতর বাসায় ফিরছি। নবনী ফেরেনি। বিশ মিনিট আগে নাতাশা আবারও কল করলে একই কথা বলে তাড়াহুড়োয় লাইন কেটে দিলো সে। নাতাশা জানে, আগামী একঘন্টায়ও নবনীর দশ মিনিট ফুরোবে না। কারখানায় অর্ডার বেশি হলেই দিনরাত সব ছেড়ে ছুড়ে কাজ করতে থাকে সে। নিজেও সময়মতো বাসায় ফেরে না, কর্মীদেরও ফিরতে দেয় না। আজ ফিরতে ফিরতে কয়টা বাজবে কে জানে! 

.

বাসার কলিংবেল বাজলো। দু’জনই খুব আগ্রহে দৌড়ে গেল দরজার কাছে। অমিত এসেছে। প্রচন্ড ঘুমে দুই চোখ তার মেলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। এক প্রকার টলতে টলতে সোফায় এসে গা এলিয়ে দিলো অমিত। 

— “আপনি ঠিক আছেন ভাইয়া?” 

— “হ্যাঁ ঠিক আছি। টায়ার্ড খুব। সারাদিন এখানে ওখানে ছুটতে হয়েছে।” 

— “অনি কল করলো, আপনি রিসিভ করেননি। বেচারী টেনশন করছিল খুব।”

— “বিজি ছিলাম। কল রিসিভ করে কথা বলবো ঐ সময়টুকুও পাইনি।” 

পাশ থেকে অনি বলে উঠলো, 

— “অসুস্থ তুমি। এত প্রেশার কে নিতে বলে? যাও ফ্রেশ হয়ে এসো। টেবিলে খাবার দিচ্ছি।” 

— “খেয়েছিস তোরা?” 

— “না। নবনী আপুর জন্য ওয়েট করছি। ও আসলে একসঙ্গে খাবো।” 

চমকে উঠলো অমিত। চোখ থেকে তার ঘুম পালালো যেন! 

— “মানে কী? পৌনে এগারোটা বাজে। ও এখনও ফেরেনি?” 

— “না।”

— “আছে কোথায়?” 

— “কারখানায়। 

— “ও সকালে আমার আগে বেরিয়েছে। এত রাতে কারখানায় কী কাজ ওর?”

— “অর্ডার প্রেশার খুব বেশি। সময়মতো ডেলিভারি করতে হবে। 

— “তাই বলে এত রাত পর্যন্ত কাজ করতে হবে?”

— “আপু সবসময় এমনই করে। দেশের বাইরে থেকে যখনই অর্ডার আসে, শর্ট নোটিশে সেগুলো ডেলিভারি করতে হয়। কত বলি এসব অর্ডার নেয়ার প্রয়োজন নেই। ও কথাই শোনে না। আম্মু, নানু এই ব্যাপারে খুব বিরক্ত আপুর উপর।”

— “অনি, খাবার গরম করে টেবিল সাজা। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে ওকে নিয়ে আসছি।” 

তড়িঘড়ি করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল অমিত। দরজা আটকে নাতাশার পাশে এসে বসলো অনি। 

— “দেখেছো আপু, দুজন দুজনের খেয়াল রাখতে শুরু করেছে।” 

— “হুম দেখছি।”

— “ভাইয়াকে আমরা সবাই অনেক বুঝিয়েছি। ও কখনো আমাদের কথা শুনতেই চায়নি। নবনী আপু কী বললো কে জানে! কাজ হচ্ছে মনে হয়।”

— “ভাইয়ার মাঝে পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছো?”

— “হ্যাঁ। এটা প্রায় অসম্ভব ছিল জানো? আম্মু, আমি প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। মুনিয়াকে যখনই কোনো ছেলের সঙ্গে ক্লোজলি দেখতো সপ্তাহ বেঁধে পাগলের মতো আচরণ করতো ও। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ, ঘুমাতো না। সারারাত এই ঘর, ঐ ঘর ঘুরঘুর করতো। হুটহাট এটা সেটা ভেঙে ফেলতো। বাসার সামনে যে হসপিটাল, ওখানে ভাইয়া পরিচিত মুখ। প্রায়ই বিপি ড্রপ হয়ে হসপিটাল ছুটতে হতো। কত কী ফেইস করতে হয়েছে ভাইয়াকে নিয়ে! এবারের পরিস্থিতি বেশ ভিন্ন। ভাইয়া পাগলামি করেনি তা না, কিন্তু আগের মতো না। ভাইয়াকে আমি পরদিন থেকে বেশ নরমাল দেখছি। খাওয়া-দাওয়া করছে, মুভি দেখছে, গল্প করছে। যদিও নিজের সঙ্গে জোর করে এসব করছে সেটা ওর মুখ দেখে ভালোই বুঝতে পারছি। তাও কম কী? চেষ্টা তো করছে। এতেই আমি খুশি। আম্মুকে বলেছিলাম। এত এত দোয়া করেছে আম্মু আপুর জন্য। বাবা আর নানু মিলে ওদের দুজনকে নিয়ে কী অদ্ভুত ফন্দি আঁটলো, আমি তখন বিশ্বাসই করিনি। এখন মনে হচ্ছে বুদ্ধি কাজে লাগছে।”

— “অমিত ভাইয়ার ব্যাপারটা যত সহজে হয়ে গেছে কেন জানো? ভাইয়া নিজেও এসব ভুলে নতুন করে বাঁচতে চাইছিল। মুনিয়ার দেয়া পাহাড় সমান নোংরা সব স্মৃতি আছে ভাইয়ার কাছে। একটা মানুষকে ভুলতে এই’ই যথেষ্ট। বরং আমি বলবো যথেষ্ট থেকে আরো অনেক বেশি। কিন্তু আপুর বেলায় এত সহজে হবে বলে মনে হয় না। সামি ভাইয়াকে নিয়ে একটা খারাপ স্মৃতিও আপুর কাছে নেই। খুব কাছ থেকে দেখেছি আমি ওদের। এত চমৎকার সম্পর্ক আমি আজ পর্যন্ত কোথাও দেখিনি, কোনোদিন হয়তো দেখবোও না। কী ভালোবাসতো ওরা দুজন দুজনকে! কারো ভাগ্য এত নির্মম হতে পারে, আপুকে না দেখলে হয়তো আমার কখনো জানা হতো না। সামি ভাইয়া ওকে যতটা ভালোবাসতো ততখানি ভালো ওকে কেউ বাসতে পারবে? আমার মনে হয় না। এত সহজে আপু সামি ভাইয়াকে ভুলতেও পারবে না।”

— “অতীত ধরে রেখে আর কতদিন?” 

— “আমিও তো চাই আপুর ঘর-সংসার হোক। ভালোবাসার একটা মানুষ হোক। 

আপুর জন্য এসবকিছু এত সহজ না। তবুও নানুর মতো আমিও নিঃশ্বাস ধরে বসে আছি, ওদের এই সম্পর্কটা টিকে যাক। দুজন দুজনকে আঁকড়ে বেঁচে থাকুক।” 

.

অমিত এসে যখন কারখানার সামনে দাঁড়ালো, তখন নবনী কারখানার গেইটে তালা লাগাচ্ছে। অমিতের গাড়ি দেখে অবাক হলো নবনী। 

গাড়ির দরজা খুলে ভেতর থেকে ডাকলো অমিত, 

— “উঠে এসো।” 

— “আপনি এলেন যে!” 

— “রাত কয়টা বাজে?” 

— “এগারোটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি।” 

— “এতরাতে একা কিভাবে বাসায় ফিরবে? তাই তোমাকে পিক করতে এসেছি।”

— “ব্যাপার না। অভ্যাস আছে আমার।” 

— “কচু আছে। বাবার গাড়িতে করে বাসায় ফিরতে, সে কথার সব জানি আমি। রিকশায় চড়ে, পায়ে হেঁটে এত রাতে ফিরেছো কখনো?” 

— “কাছেই তো, সমস্যা হতো না খুব একটা।” 

— “দিনকাল খুব একটা সুবিধার না। তার উপর শীতের রাত। সবাই যার যার বাসায় দরজা জানালা আটকে লেপের ভেতর ঢুকে আছে। এমন সময়ে একা যাতায়াত করার প্রশ্নই উঠে না। যতদিন রাতে কাজ থাকবে আমাকে কল করে বলে দিও। পিক করতে আসবো।” 

— “ইশ্! খুব চিন্তা, তাই না? একদিন পায়ে ব্যথা ছিল, অনি বললো আমাকে ড্রপ করে দিতে। গার্লফ্রেন্ডের ভয়ে মুখের উপর বারণ করলেন। আর এখন বলছেন প্রতিদিন আমাকে পিক করতে আসবেন! যাবো না আমি আপনার সঙ্গে।” 

— “মুনিয়া আমাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে চাল ধোয়ার ঝাঁঝড়ি বানিয়ে ফেললো। এখন আবার তুমিও থ্যাংকস দেয়ার বদলে খোঁচাচ্ছো। নিরীহ মানুষটার সঙ্গে খুব অবিচার হচ্ছে।” 

হেসে ফেললো নবনী। দুই পা উঠিয়ে আয়েশ করে বসতে বসতে বললো, 

— “সামি কী বলেছিল জানেন?” 

— “সামি কে?” 

— “আমি যাকে ভালোবাসি।” 

— “আচ্ছা তোমার বয়ফ্রেন্ড!” 

— “হুম।” 

— “কী বলেছে?” 

— “আপনি প্রচন্ড লয়্যাল একজন প্রেমিক।”

— “তার সঙ্গে আমার গল্প করো?” 

— “হ্যাঁ করি। কিচ্ছু লুকাই না ওর কাছে আমি। ও আমার ডায়েরি। ওর কাছে আমার সমস্ত কথা জমা থাকে।” 

— “খুব ভালোবাসো, তাই না?” 

— “সামির চেয়ে বেশি না। আমাদের দুজনের মাঝে ও আমাকে বেশি ভালোবাসে।” 

— “ভদ্রলোক তোমাকে খুব বিশ্বাসও করে। নয়তো গার্লফ্রেন্ডকে বিয়ে করার বুদ্ধি কে দেয়? হ্যাঁ মানছি সিচুয়েশন খারাপ ছিল, তবুও তো! আমি কখনোই মুনকে এই কাজ করার বুদ্ধি দিতাম না।” 

— “হ্যাঁ, তা করে।”

— “তুমি যখন তার কাছে আমার গল্প করো, সে জেলাস ফিল করে না? কিংবা ধরো তুমি আমার সঙ্গে বাসায় ফিরছো, এটা শুনে উনি রাগ করবেন না?” 

— “কী আশ্চর্য! রাগ কেন করবে? অন্য সব কাজিনদের মতো আপনিও আমার কাজিন। এর বাইরে না আপনি আমাকে কিছু ভাবেন, না আমি আপনাকে নিয়ে কিছু ভাবি। রাগ করার প্রশ্নই আসে না। ও খুব ওপেন মাইন্ডেড। আর আমার কাজিনদের সঙ্গে ওর বন্ডিং খুব ভালো। আমার চেয়েও বেশি।” 

— “উনি তো মহাপুরুষ দেখছি! উনার সঙ্গে একদিন দেখা করতে হবে।” 

আর কথা বাড়ালো না নবনী। মুচকি হাসিতে আলাপনের ইতি টানলো। শূন্য চোখে তাকিয়ে রইলো দূর আকাশে। 

— “আচ্ছা শোনো না? তোমাকে আর আপনি আপনি বলতে ভালো লাগছিল না, তাই তুমি করে বলছি। আপত্তি নেই তো, তাই না?” 

— “আপত্তি কেন হতে যাবে? বরং আপনি শুনতে অদ্ভুত লাগছিল। বয়সে ছোট কাজিনকে আপনি কেন এতদিন আপনি আপনি করে বলেছেন, কে জানে!”

হাসলো অমিত। চোখ টিপে বললো, 

— “লয়্যাল প্রেমিকরা পরনারীকে আপনি করেই ডাকে।” 

২৩

ড্রইংরুমে বসে মুভি দেখছে ওরা চারজন। বাকি তিনজন টিভির স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকলেও অনির মনোযোগ টিভিস্ক্রিনে নেই। বারবার সে দেখছে অমিত-নবনীকে। ছুটির দিন আজ। নবনী কারখানায় যায়নি। অমিত সকালে ইমার্জেন্সি কী এক কাজে অফিসে গিয়ে ফিরে এল দুপুরের আগেই। এমনিতে কাজের ব্যস্ততায় খুব একটা সময় কাটানো হয় না দুজনের। মা বলছিল তিনদিন আগে, দু’জনকে বেশি বেশি একসঙ্গে সময় কাটাবার সুযোগ করে দিস। আমার ছেলেটা এখন কঠিন সময় পার করছে। মনের অবস্থা বেশ দুর্বল। নবনী যত ওর কাছে কাছে থাকবে, তত জলদি মেয়েটাকে ওর মনে জায়গা দিয়ে দেবে। মুভি শেষ হতে এখনো একঘন্টা বাকি। নাতাশাকে সঙ্গে করে অন্য ঘরে চলে গেলে দুজন আলাদা সময় কাটাবার সুযোগ পাবে। মায়ের কথা, নিজস্ব ভাবনা ভাবতে ভাবতেই আড়মোড়া দিয়ে সোফা ছাড়লো অনি। 

— “আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমারও ঘুম পাচ্ছে নাতাশা আপু। ঘুমাবে নাকি?” 

অনির কথায় মনোযোগ ভাঙলো অমিত-নবনীর। দুজনই একবার অনির দিকে তাকাচ্ছে অন্যবার নাতাশার দিকে। অনির ইঙ্গিত বুঝলো নাতাশা। মিথ্যামিথ্যি হাই তুলতে তুলতে বললো, 

— “হ্যাঁ তা তো লাগছেই। বেশি খেয়ে ফেলেছি আজ। এত খাই নাকি আমি?”

— “হ্যাঁ, সত্যিই নাতাশা বাসায় এত ভাত খায় না। আজ কিভাবে যেন খেয়ে নিলো। আম্মু শুনলে খুব অবাক হবে।” 

— “চলো আপু আমরা ঘুমাই।” 

অনি, নাতাশাকে নিয়ে চলে গেল নিজের ঘরে। ড্রইংরুমে বসে রইলো অমিত, নবনী। অমিতের দিকে বারবার তাকাচ্ছে নবনী। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে টিভি স্ক্রিনে। অথচ মন পড়ে আছে অন্য কোথাও। অমিতের চোখে তাকিয়ে নবনী যেন স্পষ্ট পড়তে পারছে আজ তার মন ভালো নেই। মনের ভেতর কোনো এক ঝড় বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু নিজেকে সামলে রেখেছে খুব সাবধানে। টিভির ভলিউম কমিয়ে অমিতকে ডাকলো নবনী। 

— “শুনছেন?” 

— “হুম…” 

— “মনটা এত খারাপ কেন?” 

— “কই?” 

— “দেখছি তো।” 

— “জানি না।

— “সকালে বাসা থেকে বেরোনোর আগেও তো ভালো মুডে ছিলেন। গতকাল কত রাত পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে বসে আড্ডা দিলেন। বাইরে থেকে ফেরার পর দেখছি আপনার মুড অফ। কী হয়েছে? অফিসে কোনো সমস্যা?”

— “মুনের সঙ্গে আজ দেখা হয়েছিল।” 

— “কোথায়?” 

— “অফিস থেকে বেরোচ্ছি, তখন।” 

— “কথা হয়েছে?” 

— “উহুম। সঙ্গে ঐ ছেলেটা ছিল, যার সঙ্গে ওর ভিডিও দেখলাম বারো দিন আগে।” 

— “কথা বলতে ইচ্ছে করছিল?”

— “উহুম।” 

— “তাহলে মন খারাপ কেন?” 

— “মুনের বিভিন্ন ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক আছে আমি আগে থেকেই জানতাম। গা ঘেঁষে ছবি তুলতো, হাত ধরে কিংবা কাঁধে হাত রেখে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতো। আমি দেখেছি সেসব। কষ্ট পেতাম খুব, কিন্তু ঘৃণা কখনো হয়নি। সেদিন শাহরিয়ারকে ও লিপকিস করছে দেখে আমার কেমন গা গুলিয়ে উঠলো। তারপর থেকে ও শুধু আমার এই কথাটা আর ভাবতে ইচ্ছে হয় না। ঘৃণা জন্মে গেছে। কিন্তু মায়া এখনো ছেড়ে যায়নি। ভীষণ ভালোবাসতাম তো! গলার কাঁটার মতো লাগে ওকে। না পারছি বের করতে, না পারছি গিলতে। আজ যখন ওর সঙ্গে দেখা হলো বুকে মোচড় কেটে ব্যথা শুরু হলো অথচ ওকে একটাবার কাছে টেনে নিতে ইচ্ছে হলো না। কথা বলতে ইচ্ছে হলো না।” 

— “পুরোনো স্মৃতি মনে পড়ছে খুব?” 

— “হুম। জানো, যখন তখন আমার বুকে এসে লেপ্টে থাকা ছিল মুনের অভ্যাস। সম্পর্কের একদম শুরু থেকে ও আমাকে জড়িয়ে ধরতো নির্দ্বিধায়, নিঃসংকোচে শুনেছি এসব ক্ষেত্রে সব মেয়েদের মাঝেই নাকি সংকোচ কাজ করে। মুনের বেলায় এমনটা ছিল না। হাত ধরা থেকে শুরু করে আমাদের ফিজিক্যাল ইন্টিমেসি সবকিছুই প্রথম হয়েছিল মুনের তরফ থেকে। এবং সবকিছু যেন খুব দ্রুত হচ্ছিল। ভেবেছিলাম আমাকে ও বিশ্বাস করে, পাগলের মতো ভালোবাসে, তাই নিজেকে এভাবে সঁপে দিচ্ছে। তাছাড়া আমিও তো ওকে নিয়ে সিরিয়াস ছিলাম। দায়িত্ব নেবার জন্য রাজিও ছিলাম। যদি ও তখন বলতো বিয়ে করতে চায়, ওর এক কথাতেই সেদিনই ওকে বিয়ে করে নিতাম আমি।” 

— “ঝুলিতে অনেক স্মৃতি জমা রয়ে গেছে, তাই না?” 

— “ওর সঙ্গে আমার শুধু প্রেম ছিল না, নবনী। এক প্রকার সংসার করেছি ওর সঙ্গে দুই বছর। সবচেয়ে বেশি কী মনে পড়ে, জানো?” 

— “কী?” 

— “মুন হ্যাংলা-পাতলা ছিল আগে থেকেই। সাইজে একটু খাটোও। একদম গুটিসুটি মেরে পাখির বাচ্চার মতো বুকের সঙ্গে লেপ্টে বসে থাকতো। আমি এক হাতে ওকে জড়িয়ে, অন্য হাত মাথায় বুলিয়ে দিতাম। মুনের সঙ্গে সেপারেশনের পর সবচেয়ে বেশি মিস করতাম আমাদের এই মুহূর্তটা। ঐ ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে আসার পর মুন আর কখনো আমার বুকের সঙ্গে লেপ্টে বসেনি।” 

— “পাখির বাচ্চা তো উড়াল দেবেই। বুকে জড়িয়ে ধরতে হবে আমার মতো হাতির বাচ্চা। শরীর নিয়ে নড়াচড়া করাই মুশকিল, উড়াল আর দিবে কখন?” 

— “মানে?” 

— “আমি আগে মোটা ছিলাম। ওজন ছিল পঁচাশি কেজি। সামিকে জড়িয়ে ধরলেই বলতো, মা গো, হাতির বাচ্চা আমার বুক ব্যথা করে দিলো।” 

সজোরে হেসে উঠলো অমিত। 

— “হাসবেন না, হাসবেন না। এটা কিন্তু খুব সিরিয়াস ব্যাপার। বুকে আগলে ধরতে হবে হাতির বাচ্চা সাইজের মানুষ যে আপনার সমস্ত বুক দখল করে ফেলবে। এসব মানুষ জড়িয়ে ধরে শান্তি। বুক ভরা ভরা ফিল হবে, বুক জুড়ে তার গায়ের উষ্ণতায় মাখামাখি হবে। এসব পাখির বাচ্চাকাচ্চা বুকে জড়িয়ে শান্তি আছে নাকি? বুকের এক কোনা কোনরকমে ভরাপুরা হবে, বাকি অংশ খোলা ঘাসহীন মাঠ হয়ে পড়ে থাকবে। ধুর!” 

— “কে শেখায় তোমাকে এসব?” 

— “কে আবার? সামি। আমি আগে খুব ভালো ছিলাম, জানেন? ওর সঙ্গে এত বছর প্রেম করে একেবারে বরবাদ হয়ে গেছি। 

— “কত বছরের প্রেম তোমার?” 

— “পনের বছর।” 

— “তোমার বয়স কত নবনী?”

— “ত্রিশ হবে আর কয়দিন পর।”

— “মাই গড! সেই ১৪ বছর বয়স থেকে প্রেম করছো?” 

— “হ্যাঁ, ইঁচড়েপাকা ছিলাম। আমাকে প্রপোজ করলো, আমিও নাচতে নাচতে হ্যাঁ বলে দিলাম।” 

— “তোমরা সমবয়সী?” 

— “নাহ্। সামি আপনার বয়সী।” 

— “এত বছর হলো বিয়ে কেন করোনি তোমরা?” 

— “ভাগ্যে আপনার সঙ্গে বিয়ে লেখা ছিল, তাই ওর সঙ্গে বিয়ে হয়নি। 

— “ওকে বিয়ে করে নিলেই তো আজ আমার সঙ্গে বিয়ে হতো না।”

— “হ্যাঁ বলেছি তো সামিকে। আটবছর আগে একবার ওর খুব ঝোঁক উঠলো বিয়ে করার। নতুন চাকরিতে জয়েন করেছে তখন। আব্বু বললো নবনীর গ্র্যাজুয়েশন শেষ হোক। শুনলোই না। জেদ ধরলো আসছে পূর্নিমায় আমাকে বিয়ে করবে। আমি তো প্রতিদিন লাল জামদানীতে বউ সাজে নিজেকে কল্পনা করতে করতে ঘুমাতাম। যেই না সামি বললো বিয়ে করবে আমার খুশি দেখে কে! নানী শুনেই বললো, এই যে দিলো! নাচুনী বুড়ির সামনে ঢোলের বাড়ি দিলো। তারপর আমার এক্সাইটমেন্ট আর সামির পীড়াপীড়িতে আব্বু রাজি হলো বিয়েতে।’ 

— “তারপর? বিয়ে হলো না কেন?”

— “সামি বিশাল এক ঝামেলা বাঁধালো। আমাদের বিয়েটাই ভেঙে গেল!” 

— “যাহ্! ভাঙলো কেন? আচ্ছা মাঝ থেকে গল্প শুনে কাজ নেই। একদম শুরু থেকে বলো।

— “ও বাবা! এত লম্বা কাহিনী কিভাবে বলবো? বলার আগেই তো টায়ার্ড লাগছে আমার।

— “এতগুলো দিন ধরে শুধু আমার কথাই বলে যাচ্ছি। এত বিরহ আর ভালো লাগছে না। এবার মন ভালো হওয়ার মতো কিছু শুনি। বলো তোমার গল্প। কিভাবে সম্পর্ক শুরু হলো তোমাদের?” 

— “আরেকদিন বলবো। এখন ঘুমাতে যাবো।”

২৪

সন্ধ্যার চায়ের আসর বসেছে আজ জামিলা বেগমের ঘরে। চায়ের খুব একটা অভ্যেস নেই জামিলার। বাসার অন্যরা যখন চা নিয়ে ব্যস্ত, তখন তিনি সযত্নে এক খিলি পান বানিয়ে মুখে পুড়েন। আজও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। খাটে হেলান দিয়ে পান চিবুচ্ছেন জামিলা। শফিক-নীতু এসেছেন তার ঘরে। আসছে বুধবার নবনীর জন্মদিনে কী আয়োজন হবে সে ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে নীতু বললেন, — 

— “শফিক বলছে বড় আয়োজন করতে।

— “দেখতে দেখতে ছোট্ট গুদুম-গাদুম নবনীর ত্রিশ বছর হইয়া গেল, এ্যা?” 

— “হ্যাঁ আম্মা। শফিক যখন বললো মেয়ের তো ত্রিশতম জন্মদিন, এবার চলো ঘটা করে আয়োজন করি। আমার ভেতরে কেমন ধুক করে উঠলো। নবনীর এত জলদি ত্রিশ হয়ে যাচ্ছে কেমন করে?” 

— “হ রে মা। সময় কই দিয়া যায়গা! আইচ্ছা এখন কামের কতা কই। তুই কী চাস? ঘটা কইরা আয়োজন না করতে?”

— “না।” 

মন খারাপ করলেন শফিক সাহেব। — “সমস্যা কী নীতু? সেই কতবছর আগে নবনীর বার্থডে পার্টি ভালোভাবে করেছি, বলো তো?” 

— “তুমি কাদের নিয়ে বড় আয়োজন করতে চাইছো? আমাদের আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে, যারা আমার মেয়ের এমন বাজে মুহূর্তে উল্টাপাল্টা কথা বলতে ছাড়েনি? মাত্রই একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে আমাদের সঙ্গে, আত্নীয়দের চেহারা আমি চিনে গেছি। আপাতত ওদের কাউকে নিয়ে ফূর্তি করার ইচ্ছা কিংবা রুচি কোনোটাই আমার নেই। 

— “ওদেরকে আসতে বলবো না। বিয়ের পর মেয়ের প্রথম জন্মদিন। অমিত তো এখনও আমাদের বাসায় আসেনি, আপ্যায়নও করতে পারিনি। এক উছিলায় আসা হবে আমাদের এখানে। ওর মা-বাবা, ওর মায়ের পক্ষের আত্মীয়দের আসতে বলবো। আমার তোমার বন্ধু-বান্ধব, দুই মেয়ের ফ্রেন্ড সার্কেল, কয়েকজন প্রতিবেশী এদের নিয়ে আয়োজন হবে। অমিতের সঙ্গে সবার পরিচিত হবার দরকার আছে না?” 

— “সময় কি উড়ে যাচ্ছে? অমিতকে পরেও সবার সঙ্গে পরিচয় করানো যাবে। এখন শুধু অমিতের ফ্যামিলি আসুক। তুমি এরশাদ ভাইকে কল করে বলে দাও উনারা দুজন যেন চলে আসে। দুই ফ্যামিলি মিলে ছোট্ট করে মেয়ের বার্থডে সেলিব্রেট করবো।” 

— “আমিও নীতুর লগে সহমত।” 

— “নীতুকে কেন সাপোর্ট করছেন আম্মা? আমি কি খারাপ কিছু বলেছি?” 

— “খারাপ কও নাই। তবে ব্যাপারটা আরেকটু ভালো করা যায়। দেখো, অমিত কখনো এই বাসায় আসে নাই। এইখানে আইসা যেন সে কোনো অস্বস্তিতে না পইড়া যায় সেইটা দেখতে হইবো। আমরা ওর পরিচিত মুখ, আমগো সামনে ও খুব একটা শরম পাইব না। কিন্তু তুমি যদি একগাট্টি মেহমানের মাঝখানে ওরে বসাও তাইলে ও শরম পাইবো। তার উপর কইতাছো জামাই বইলা পরিচয় করাইবা, এইটা কি হয় নাকি? ওরা কেউই এই বিয়া মানে না। মাইনা নেওনের আগ পর্যন্ত এসব কতা না কওয়াই ভালো। জামাই এই ব্যাপারটায় নারাজ হইতে পারে।” 

— “আমিও ঠিক এই কথাগুলোই তোমাকে বুঝাতে চাইছি।” 

— “তার চেয়ে বরং এখন খালি অমিত আর ওর মা, বাপ, বইন আসুক। আমরা ভালোভাবে ওগো আদর আপ্যায়ন করি, অমিতের লগে ভালো কইরা আন্তরিকতা জমানোর চেষ্টা করি যাতে ও আমগোরে নিজের মানুষ ভাবে। এইটা ভালো হইবো।” 

— “কথা মন্দ বলেননি। ঠিক আছে, এটাই হবে।” 

— “আজকা তো ছুটির দিন। জামাই বাসায়ই আছে মনে হয়। দেও, ওরে ফোন দেও। ওর আব্বারেও ফোন দিয়া দাওয়াত করো।” 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *