ইট’স কমপ্লিকেটেড – ১৫

১৫

ড্রইংরুমে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে নবনী। টিভিতে হিন্দি সিরিয়াল চলছে। বাসার সবাই খুব গভীর মনোযোগে দেখছে। জানামতে, পুরুষ মানুষ প্রচন্ড রকমের সিরিয়াল বিদ্বেষী হয়, তবে এখানকার চিত্র ভিন্ন। এরশাদ চাচা ভীষণ মনোযোগে সিরিয়াল দেখছে। আশ্চর্য ব্যাপার! আবার সিরিয়ালে ঘটে যাওয়া সিনগুলো নিয়ে চাচীর সঙ্গে গভীর আলোচনাও করছে। উনাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন রাজ্য সভার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করছেন। চাচা মানুষটা ভীষণ রসিক, সদা হাস্যোজ্জ্বল সে কথা ছোট থেকেই জানা ছিল। অন্যসব পুরুষদের মতো এতটা গাম্ভীর্য, অহংকার কিংবা আধিপত্য খাটানোর অভ্যেস কখনোই তার মাঝে ছিল না। বরাবরই মা-চাচীরা বলতো এরশাদ ভাই অন্যসব পুরুষদের চেয়ে খুব আলাদা। তবে তিনি সিরিয়াল প্রেমী হবার মতো এতটাও আলাদা হবেন সে কথা কখনো ভাবেনি নবনী। নিজে সিরিয়াল প্রেমী না হবার কারণে বোধহয় পুরো ঘটনাটা একটু বেশিই উদ্ভট লাগছে। এখানে এসে বসার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার ছিল না। অনি আর চাচী এসে ডেকে গেল ড্রইংরুমে তাদের সঙ্গে এসে টিভি দেখতে। না এলে খারাপ দেখায়, তাই এখানে আসা। নয়তো ঘরে একা বসে থাকাই ভালো ছিল। এরশাদ চাচার বাসায় খুব একটা যাতায়াত কখনো ছিল না নবনীর। ভিন্ন শহরে থাকার দরুন ঈদে গ্রামে বেড়াতে গেলে, কিংবা কারো বিয়েশাদীতে দেখা হতো দুই পরিবারের। এতগুলো বছরে শুধু এরশাদ চাচা ৭-৮ বার গিয়েছিল তাদের বাসায়। চাচীও হয়তো গিয়েছিল ১-২ বার। কিন্তু অনি কিংবা অমিত এই কয়বছরে কখনোই তাদের বাসায় যায়নি। ঢাকায় ফ্ল্যাট নেবার পর চাচা-চাচী বহুবার কল করে বলেছিল বাবাকে, স্ব-পরিবারে যেন একবার এসে বেড়িয়ে যায়। বাসা এত কাছাকাছি হওয়া সত্ত্বেও কখনো আসা হয়নি ওদের। বাবা-মা যদিও একবার এসেছিলো ঢাকার এই ফ্ল্যাটটাতে, কিন্তু ওরা দুইবোন আসেনি কখনো। আসার ইচ্ছেই হয়নি। অনি অমিতের সঙ্গে খুব একটা সখ্যতা তাদের নেই। অনির সঙ্গে বিয়ে শাদীতে বসে একটু আধটু গল্প করা কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় টুকটাক হাই হ্যালো চললেও, অমিতের সঙ্গে অতটুকুও নেই। ছোটবেলায় গ্রামের ঈদগুলোতে তার সঙ্গে মাঝেমধ্যে দেখা হলেও, বড় হওয়ার পর সেটুকুও আর হয়নি। গ্রামে সবাই একত্রিত হয়ে ঈদ করা হয় না পনের বছরেরও বেশি সময় পেরোলো। পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলোতেও তার বিচরণ নেই। গত আট দশ বছরে অমিতকে কোনো অনুষ্ঠানে নবনী দেখেছে বলে মনে করতে পারে না। এবার রওনকের বিয়েতে মা পরিচয় না করিয়ে দিলে হয়তো চিনতেই পারতো না। বলা যেতে পারে এরশাদ চাচার পরিবার তার জন্য মোটামুটি অপরিচিত। অথচ এমন একটা পরিবারে বিশাল এক লাগেজ গুছিয়ে সে চলে এল তাদের সঙ্গে থাকবে বলে। কিভাবে থাকবে সে এখানে? কিভাবে হবে তাদের সঙ্গে সখ্যতা? এই বাড়িতে পা রাখার পর থেকে বারবার মনে পড়ছে সেদিনের ঘটনা। যত মনে পড়ছে ততই বুঝি হাত-পা অসার হয়ে আসছে। কী নোংরা একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে তার এই বাসায় আসা! আর অমিত? তার মুখোমুখি হলে কী হবে? মাটি গর্ত করে নিচে চলে যেতে ইচ্ছে হবে না? নাতাশাকে সঙ্গে নিয়ে এলে ভালো হতো। ও পাশে থাকলে হয়তো সবকিছু একটুখানি সহজ হতো। এখানে আসার আগে মা আর নানী বারবার বলছিল নাতাশাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে। তখন কেন যেন মন সায় দিলো না। এখন ভীষণ আফসোস হচ্ছে, ধুর! 

.

বাসার কলিংবেল বাজছে। অনি গিয়ে দরজা খুললো। অমিত এসেছে। জুতা খুলে ঘরে পা রাখতেই চোখাচোখি হলো দু’জনের। অমিতের চেহারা জুড়ে যেন রাজ্যের মেঘ নেমে এল। চোখ ফিরিয়ে দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে চলে গেল সে। অমিতের কুঁচকানো চেহারায় নবনীর অস্বস্তি দ্বিগুন হলো। কিছুই চোখ এড়ালো না অনির। না ভাইয়ের বিরক্তিভরা চোখ-মুখ, না নবনীর অস্বস্তিতে ফ্যাকাশে চেহারা। বাবাও চেয়ে আছে নবনীর দিকে। বাম কানে ফিসফিসিয়ে অনি বললো, 

— “ভাইয়া খুব রিএ্যাক্ট করবে মনে হচ্ছে। এমন চলতে থাকলে ওদের সম্পর্ক ভালো হওয়া দূরের কথা, আপু দুদিন পরই চলে যাবে।” 

— “আরেহ আমরা আছি না! সব ঠিক করে ফেলবো।” 

— “কোথায় আছো আব্বু? কাল তো চলেই যাচ্ছো।” 

— “তুই আছিস না! আমরা ওখান থেকে সব শিখিয়ে দেবো, তুই করবি। এখন এসব ছাড়। চল আমরা বাইরে যাই, কাচ্চি রোস্ট খেয়ে আসি।” 

— “মা তো আজ পোলাও-রোস্ট রান্না করলোই।” 

— “কাচ্চি তো আর করেনি।” 

— “নবনী আপুকে নিবে না?” 

— “আরেহ যার সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর বাহানায় একটু খাতির জমাবো তাকেই নেবো না?” 

— “ভাইয়া? ও যাবে বলে তো মনে হয় না।” 

— “ঐ গাধাটা বাসায়ই থাকুক। বসে বসে মুনিয়ার শোকে আধপাগল হোক। বাসায় ওর জন্য পোলাও-কোর্মা আছে। যা জলদি করে জামা কাপড় বদলে নে। নবনী, আমরা রাতে বাইরে ডিনার করবো। যাও, রেডি হয়ে নাও।” 

***** 

নবনীকে অকারণে খাবার প্লেটে নাড়াচাড়া করতে দেখে শামীমা জিজ্ঞেস করলেন, 

— “তুমি খাচ্ছো না কেন? কাচ্চি তোমার পছন্দ না?” 

— “না না! আমার পছন্দ 

— “তো?”

— “এমনি।”

— “আমার এখানে আসার পর থেকে দেখছি কেমন জড়োসড়ো হয়ে আছো। একটু স্বাভাবিক হও। আমরা কি তোমার অপরিচিত?” 

— “তেমন কিছু না।” মেকি হাসলো নবনী 

— “দেখছি তো আমি। তুমি না করলেই চলবে?” 

বোরহানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে এরশাদ সাহেব বললেন, 

— “দেখো মা, যে ক’টাদিন আছো আমার ছেলে মেয়ের সঙ্গে মিলেমিশে না থাকলে তোমারই লস। একা একা বোর হবে। তারচেয়ে বরং কয়েকমাস কাজিনরা হেসেখেলে সময় কাটাও। এমনিতে তো কারো সঙ্গে তোমাদের খুব একটা দেখা হয়না। ব্যস্ত তোমরা সবাই। এক উছিলায় না হয় তোমাদের একসঙ্গে ভালো একটা সময় কাটানো হবে।” 

— “জি।” 

— “যা কিছু হয়েছে সেসব মাথায় রেখো না। আমরা মন থেকে সব ঝেড়ে ফেলেছি। ধরে নাও তুমি তোমার চাচার বাসায় কয়েক মাসের জন্য বেড়াতে এসেছো। এখানে তোমার যেভাবে খুশি থাকো, যা ইচ্ছে রান্না করে খাও। অমিতের বাজার পছন্দ না হলে আমাকে কল করবে। আমি টাকা পাঠাবো, তুমি তোমার ইচ্ছেমতো কিনে নিও।” 

— “লাগবে না চাচা, আমিই কিনে নেবো। আপনি এত পেরেশান হবেন না প্লিজ।”

— “না, না। খবরদার ওসব চলবে না। আছোই মাত্র কয়েক মাস। আমাকেও একটু তোমার যত্নআত্তি করতে দাও।”

— “ফ্রিজে আমি কয়েকদিনের রান্না করে রেখে যাচ্ছি। রান্না নিয়ে ২-৪ দিন ভাবতে হবে না। বুয়া সব কেটে রেখে যায়। তুমি আর অনি মিলে বাকিটা সেরে নিও।”

— “আপনারা চলে যাবেন?”

— “হ্যাঁ কালই।” 

— “আমি একা থাকবো?” 

— “একা কোথায়? অনি আছে না? তোমারও কারখানায় কাজ থাকে। তুমি বাসায় ফিরতে ফিরতে অনি ভার্সিটি থেকে চলে আসবে। তাছাড়া অমিত তো আছেই। আমি তো বলেছিলাম নাতাশাকেও সঙ্গে করে নিয়ে আসতে।”

— “হ্যাঁ ওকে আজই বলবো কিছুদিন আমার সঙ্গে এসে থাকতে। 

অনি খুশি হয়ে বলল,

— “খুব ভালো হবে। আমি একা একা খুব বোর হতাম জানো। এখন থেকে আর হবো না। তুমি আছো, নাতাশাও আসবে, তিনজনে মিলে কী দারুণ সময় কাটবে! আমি তোমার আর নাতাশা আপুর লাইভ দেখতাম জানো? ভাবতাম, ইশ্ কী সুন্দর করে কথা বলে! আমিও অনলাইনে টুকটাক বিজনেস করব ভাবছি। তোমরা থাকলে আমার জন্য সব সহজ হবে। অনির ব্যবসায়ের প্রসঙ্গ একপাশে সরিয়ে ছেলেকে নিয়ে বলতে লাগলেন শামীমা,

— “অমিতকে নিয়ে জরুরী একটা কথা শোনো।” 

— “জি!” 

— “ও প্রায়ই বাসায় মুনিয়াকে নিয়ে পাগলামি করে। ভয় পেও না, সম্ভব হলে ওকে একটু বোঝানোর চেষ্টা করো।” 

— “আমি?” 

— “আমাদের কথা তো শোনে না। দেখি তোমার কথায় কাজ হয় কি না?” 

— “কিসব যে বলেন না চাচী! আমার বোকামির জন্য কতবড় কান্ড হয়ে গেছে। আমি কোন মুখে উনার সামনে দাঁড়িয়ে এসব বলবো?” 

— “ধুর! তোমার চাচা কী বললো শোনোনি? সব ঝেড়ে ফেলো। আরেকটা কথা, মুনিয়ারও এই বাসায় যাতায়াত। তোমাকে দেখলে শ’খানেক প্রশ্ন করবে। খুব একটা কথা বলার প্রয়োজন নেই। অসভ্য একটা মেয়ে, কথাবার্তার কোনো লাইন টাইন নেই।’ ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ধরে রাখলেও ভেতরে ভেতরে আতংকে ফেটে পড়ছে নবনী। কিসের ইঙ্গিত করলো চাচী? বয়ফ্রেন্ডকে বিয়ে করবার দায়ে মুনিয়া মেয়েটা তাকে অকথ্য ভাষায় গালি দেবে নাকি চড়-থাপ্পড় মেরে বাসা থেকে বের করবে? 

বাসা থেকে যাবার আগে টেবিলে খাবার সাজিয়ে গেছেন শামীমা। প্লেটে খাবার বেড়ে মাত্রই খেতে বসেছিল অমিত, তখনই চোখ গেল অনির ঘরে। এককোনায় বড় দুইটা লাগেজ রাখা। ওগুলো নিশ্চয়ই নবনীর! তীব্র বিতৃষ্ণায় খাওয়ার রুচিটাই চলে গেল তার। জীবনে কত ঝড় তুফান বয়ে গেল, কিন্তু এমন কিছু কখনো ঘটেনি। বহু বহু দিন বাদে মুনিয়া আজ দুদিন ধরে ঠিকঠাক কথা বলছে তার সঙ্গে। এত খুশির মুহূর্তেও খুশি ঠিক অনুভব করতে পারছে না শুধুমাত্র নবনী নামক আতংকের কারণে। মুনিয়ার কাছ থেকে কতদিন এতবড় ঘটনা চেপে রাখা যাবে কে জানে! আতংকে গলা শুকিয়ে আসে অমিতের। সব ছেড়ে তার পালাতে ইচ্ছে হয়। এক মুহূর্তে মস্তিষ্কের সমস্তটা উল্টেপাল্টে লুকানোর জায়গা সে খুঁজে বের করতে চায়। অথচ আশ্চর্য! এতবড় পৃথিবীতে একটুখানি লুকানোর জায়গা কোথাও নেই যেখানে স্বস্তি মেলে। 

১৬

— “এখানে আমার কেমন যেন লাগে। দম আটকে আসে, জানো?” 

— “সবে তো চারদিন পেরোলো। এখনই হাঁপিয়ে গেলে চলবে? থাকতে হবে তো মাস ছয়েক।” 

— “ছয়মাস থাকতে হবে সে কথা ভাবলেই আমার মন চায় ছুটে পালাই। এখন কী মনে হচ্ছে, জানো? রাজি কেন হতে গেলাম, আরেকটু ভাবলেই বোধ হয় একটা গতি বেরোতো। নানীর পাল্লায় পড়ে অদ্ভুত এক বুদ্ধিতে আমি সায় দিয়ে চলে এলাম এই বাসায়।” 

— “কোনো গতিই বেরোতো না। ভাবোনি তুমি? কতকিছুই তো ভাবলে।”

— “তো আর কী বলবো বলো? ভালো লাগে না আমার।” 

— “সমস্যা কী? অনির সঙ্গে বেশ ভালোই তো বন্ধুত্ব হলো এই চারদিনে। তুমি নিজেকে কোথাও খাপ খাওয়াতে পারছো না এটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার।” 

— “কথা বোঝো সামি। এখানে শুধু অনি থাকে না, অমিতও থাকে। ফ্ল্যাটটা তো তার। উনার মুখ দেখলে কী মনে হয়, জানো? আমি ইচ্ছে করে ওকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করেছি। আমাকে দেখলেই ভ্রু কুঁচকে রাখে। বুঝতেই পারি সে আমার উপর মহাবিরক্ত।”

— “ওর জায়গায় আমি থাকলে হয়তো এমনই ভাবতাম। কেমন একটা ফিল্মি কান্ড হয়ে গেল না সেদিন রাতে? অমন একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষকে তুমি দেখোনি সে কথা কে বিশ্বাস করবে, বলো?” 

— “কেন করবে না? আমাকে কি ওসব ছলচাতুরী জানা মেয়েদের মতন দেখায়?” 

— “না রে পাগলী! চেহারা দেখে কে কবে কার মনটা পড়ে ফেলেছে, বলো দেখি? অমিত তোমাকে চেনে না, ও জানে না আমার কথা। আমাদের ব্যাপারটা জানলে হয়তো তোমার বলা সব কথা বিশ্বাস করে নিতো। তুমি এখানে এসেছো তাই হয়তো ইনসিকিউর ফিল করছে। কখন আবার স্ত্রীর দাবি চেয়ে বসো!” 

— “পাগল নাকি! কে যাবে ওর কাছে?”

— “উফ! ছেলেটার সঙ্গে যা কিছু ঝড়ের গতিতে ঘটে গেল, ও এখন কত কিই ভাববে। ওসব গায়ে লাগানো চলবে না। তাছাড়া তুমি তো বললে তার গার্লফ্রেন্ডের এই বাসায় যাতায়াত আছে। মেয়েটা তোমাকে দেখলে কিভাবে রিএ্যাক্ট করবে সেটা বাড়তি চিন্তা না, বলো?” 

— “হুম তা তো চিন্তাই। 

— “তুমি অমিতের সঙ্গে সরাসরি এই ব্যাপারে কথা কেন বলছো না?” 

— “ওকে বুঝিয়ে বলো তুমি শুধু দুই পরিবারের কথা ভেবে এই বাসায় এসেছো। কয়েকমাস পর চলে যাবে। এছাড়া আর কোনো পরিকল্পনা তোমার নেই কিংবা সংসার করার কোনো ইচ্ছেও নেই। তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসো। এসব শোনার পর আশা করি অমিত তোমাকে স্বাভাবিকভাবে নেবে। তোমারও সাফোকেট ফিল হবে না।

— “কিভাবে বলবো? উনার সঙ্গে আমার কথা হয় নাকি? বললাম না, আমাকে দেখলেই মুখ কালো হয়ে যায় উনার। আর আমারও না কেমন লাগে! খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া কথা তো আমরা কেউ কারো সঙ্গে বলি না।”

— “এটা কি অপ্রয়োজনীয় কথা? এভাবে একই ফ্ল্যাটে থেকে ছয়মাস কাটাতে পারবে?” 

— “না, তা পারবো না। তাহলে কবে বলবো? কিভাবে কথা শুরু করবো?” বাসার কলিংবেল বাজছে। শব্দ পেয়ে সামির দিকে তাকালো নবনী। 

— “অমিত এসেছে হয়তো। কথা বলে নাও এখনই।’ দ্রুত পায়ে দরজা খুলতেই নবনী দেখতে পেলো অমিত দাঁড়িয়ে। ভেতরে একবার উঁকি দিয়ে অমিত জিজ্ঞেস করলো, 

— “অনি ফেরেনি?” 

— “না। কল করে বললো ফিরতে দেরী হবে।”

— “ওহ!” 

— “আপনি চলে যাচ্ছেন কেন?” 

— “এমনি। আসবো একটু পর।”

নবনীকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই লিফটে উঠে গেল অমিত। দরজা আটকে পেছন ফিরতেই দেখলো সামি মুখ চেপে হাসছে। ভ্রু কোঁচকালো নবনী। 

— “হাসছো কেন?” 

— “তোমার সঙ্গে খালি ফ্ল্যাটে থাকতে ভয় পাচ্ছে বোধহয়। কখন আবার শার্ট- প্যান্ট ধরে টানাটানি শুরু করে দাও!” 

— “সামি! এখন কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে।” 

— “ধুর রেগে যাচ্ছো কেন? মজা করছিলাম। তবে ছেলেটা খুব লয়্যাল। খালি ফ্ল্যাটে তোমার সঙ্গে থাকতে হবে ভেবে চলে গেল। গার্লফ্রেন্ডকে বোধহয় খুব ভালোবাসে। নয়তো এমন সুন্দর হাতির বাচ্চা বউ পেয়ে কেউ আবার গার্লফ্রেন্ডকে মনে ধরে বসে থাকবে নাকি?” 

১৭

রাত অনেক গড়ালো। কী এক স্বপ্ন দেখতে গিয়ে ঘুমের ঘোরে সারা শরীরের ঘাম ছেড়ে, গলা শুকিয়ে, হাঁপাতে হাঁপাতে ঘুম ভাঙলো নবনীর। খানিকটা স্বাভাবিক হবার পর অনেক চেষ্টায়ও মনে পড়লো না স্বপ্নে সে কী দেখছিল? বিরক্ত ধরে এল তার। আজব কান্ড! মাত্রই দেখা স্বপ্ন কেউ কী করে এক মুহূর্তে ভুলে যেতে পারে! তার উপর তাকে এমন নাস্তানাবুদ বানিয়ে ফেলা স্বপ্ন! গলা-টলা শুকিয়ে একাকার। এলোমেলো বিড়বিড় করতে করতে ডাইনিংরুমে এসে ঢকঢক করে দুই গ্লাস পানি খেয়ে ফেললো নবনী। ড্রইংরুম থেকে আলো আসছে। ওদিকটায় উঁকি দিয়ে দেখলো অমিত রুমের লাইট অফ করে টিভি দেখছে। সামি বলেছিল অমিতের সঙ্গে কথা বলে পুরো ব্যাপারটা ক্লিয়ার করতে। কিন্তু এখন কিভাবে সম্ভব? অনি ঘুমুচ্ছে, রাত বাজে আড়াইটা। এত রাতে আলাদা ঘরে বসে কথা বলা কি বাজে দেখাবে না? আবারও লোকটা তীব্র বিতৃষ্ণায় ভ্রু কুঁচকাবে নিশ্চয়ই! নাহ্, তার চেয়ে বরং দিনের আলোয়, অনিকে সামনে রেখে কথা বলা যাবে। এসব ভাবতে ভাবতেই ঘরে ফিরে যাচ্ছিল নবনী। হঠাৎ ঘাড়ের পেছনের রগটা বুঝি ভূত এসে টেনে বাঁকিয়ে দিলো। চট করেই রেগে গেল নবনী। প্রায় দৌড়ে গিয়ে ড্রইংরুমের লাইট জ্বালিয়ে অমিতের মুখোমুখি গিয়ে বসলো। বরাবরের মতন অমিত ভ্রু কুঁচকালো, চোখে মুখে তার ভীষণ বিরক্তি। নিচু স্বরে ধমকে উঠলো নবনী, 

— “খবরদার পেঁচার মতন মুখ করবেন না। চেহারা ঠিক করুন। ঠিক করুন বলছি!” 

নবনীর ধমকে খেই হারালো অমিত। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। 

— “হ্যাঁ, এবার ঠিক আছে। আসল কথায় আসি কেমন?” 

— “আমার উপর আপনি এত বিরক্ত কেন?” 

— “কই বিরক্ত?” 

— “দেখি তো আমি। আমাকে দেখলেই রাজ্যের সব বিতৃষ্ণা আমি আপনার 

চেহারায় দেখতে পাই। আর কথা বলা থাক দূরের ব্যাপার। কাজিন না আমরা? আমরা কি শত্রু? আপনাকে দেখলে আমার মুখ লুকিয়ে রাখতে হয় লজ্জায়। এভাবে কিভাবে এতগুলো মাস থাকব আমি? আমি আপনার বাসার গেস্ট। মিনিমাম ভদ্রতা বজায় রাখা উচিত, তাই না?” 

— “আনএক্সপেক্টেড গেস্ট।” 

— “ইশ্! আমি তো খুব শখ করে এই বাসায় এসেছি, তাই না? ফ্যামিলির কথা ভেবেই এসেছি। হয়ে গেছে একটা ভুল, ইচ্ছে করে তো আর করিনি। নয়তো কে আসে আপনার বাসায় থাকতে? এই এলাকায় আছেন ৭-৮ বছর হলো। কতবার চাচা চাচী দাওয়াত করলো। এত কাছে থেকেও এসেছি কখনো? আসিনি। ঠ্যাকায় পড়ে এসেছি।” 

— “খুব সহজে বলে দিলেন, হয়ে গেছে একটা ভুল। আসলেই কি ব্যাপারটা এত সহজ? কতখানি ভুগতে হচ্ছে আমাকে! আমার একটা রিলেশন আছে সে কথা জানেন নিশ্চয়ই? ও জানতে পারলে কী বলবো ওকে? এই বিয়ে আমি মানি না। কিন্তু আপনি আমার ওয়াইফ সে কথাও কি অস্বীকার করা যাবে? চোখের সামনে সেই আপনি ঘোরাফেরা করছেন এটা আমি হাসিমুখে মেনে নেবো? এতটাও কি একটা মানুষের কাছে এক্সপেক্ট করা উচিত? মুন জানলে কী হবে বলুন তো? ওর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারব কখনো?” 

মাথা নিচু করে ফেললো নবনী। মিনমিন করে বলতে লাগলো, 

— “আমিও অন্য কাউকে ভালোবাসি। নিজের চেয়েও বেশি। ওকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবো এমনটা আমি কখনো দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। ইচ্ছে করে কিছু করিনি আমি। সেদিন যদি আমি একা থাকতাম, আমাকে মেরে ফেললেও কেউ বিয়ে দিতে পারতো না। রাজি হয়েছি শুধু নাতাশা আর অনির কথা ভেবে। বিশ্বাস করুন প্লিজ! এখানেও আমি আসতাম না। আপনার সামনে দাঁড়াবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা কিংবা সাহস কোনোটাই আমার ছিল না। কোনোমতে ডিভোর্স হয়ে গেলে আমি বেঁচে যাই। কিন্তু বাবা অসুস্থ হলো, অনি-নাতাশার কথা বললো নানী। আপনার আমার সঙ্গে যা কিছু ঘটে গেছে তা তো বদলাতে পারব না। মেয়ে দুটোর ভবিষ্যৎ যেন নষ্ট না হয় সে কথা ভেবেই রাজি হয়েছি। আপনি যতটা কষ্ট পাচ্ছেন, ঠিক ততটা আমিও পাচ্ছি। আমি ভুল স্বীকার করেছি, আপনাকে স্যরিও বলেছি। স্যরি বলা ছাড়া আর কী করতে পারি আমি? এক বাসায় কয়েকমাস থাকতে হবে আমাদের, তারপর আগের মতো সব হয়ে যাবে। আমাকে দেখে এভাবে মুখ কালো করে ফেলবেন না প্লিজ। আমার খুব গিল্ট ফিল হয়। আপনার বাসায় এসে থাকার সিদ্ধান্ত আমার জন্য সহজ ছিল না। ব্যাপারটা আমার জন্য আরো জটিল করবেন না প্লিজ। আমি আপনার ওয়াইফ সে কথা স্বীকার করার কোনো প্রয়োজন নেই। কেউ আপনাকে ফোর্স করছে না আমাকে মেনে নেয়ার জন্য। ভুলে যান সেসব। আমিও ভুলার চেষ্টা করছি। আপনি আমার সঙ্গে যতটা সহজ আচরণ করবেন আমি ততটাই ঐ বিদঘুটে ঘটনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো। এই সম্পর্ক বাদেও আমাদের আলাদা সম্পর্ক আছে। আমরা কাজিন, খুব দূরের আত্মীয় কিন্তু না। আমার বাবার আপন চাচাতো ভাইয়ের ছেলে আপনি। কাছের আত্মীয়ই তো, তাই না? হয়তো যোগাযোগের অভাবে সম্পর্ক খুব একটা নেই আমাদের মাঝে। তবে একই বাসায় যেহেতু থাকবো, সম্পর্ক ভালো করে নেয়াই বেটার।” 

— “কী সহজ সবকিছু, তাই না? আপনি নিজে একটা রিলেশনে আছেন। আপনিই বলুন না, আপনার বয়ফ্রেন্ড যদি জানে আপনার অন্য কারো সঙ্গে বিয়ে হয়েছে সে কি আপনার সঙ্গে রিলেশন রাখবে?” 

— “কেন রাখবে না? আমি কি ইচ্ছে করে করেছি নাকি এসব?” 

— “যান গিয়ে বলুন। দেখি আপনার রিলেশন টিকে কি না?” 

— “ও সবকিছু জানে। সেদিন সামিই তো বললো, বিয়েতে রাজি হয়ে যাও। নাতাশা আর তোমার সেইফ হওয়া আগে জরুরি। বিয়েশাদী কি হবে না হবে সেসব পরেও ভাবা যাবে। ওর কথা শুনেই তো আমি রাজি হলাম।” 

— “কিহ্! আপনার বয়ফ্রেন্ড বলেছে বিয়ে করতে! সে জানে আপনি এখন আমার বাসায়?” 

— “হ্যাঁ জানে।” 

— “ঝামেলা করেনি?” 

— “কেন করবে? ও তো জানেই সবটা। আমাকে বিশ্বাসও করে। দুনিয়া উল্টেপাল্টে গেলেও ওকে ছেড়ে আমি কোথাও যাচ্ছি না সে কথা ও জানে। তাই এসব নিয়ে ওর মাথাব্যথা নেই।”

— “মাই গড!” 

অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো অমিত। বোকা বোকা চেহারায় অমিতের দিকে তাকিয়ে রইলো নবনী। 

— “আপনি হাসছেন কেন?” 

— “আপনার সামনে কাঁদবোনা নিশ্চয়ই!” 

— “কাঁদবেন কেন?” 

— “সবার জীবন আপনার মতো সহজ না। এমন আন্ডারস্ট্যান্ডিং লাইফ পার্টনার পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এতটা ভাগ্য আমার নেই। মুন কখনোই এই ব্যাপারটা মেনে নেবে না। তার উপর আপনাকে আমার বাসায় দেখলে কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে। আমাদের সম্পর্কটা আর টিকবে না। সম্পর্কটা না টিকলে হয়তো আমারও এই পৃথিবীতে টিকে থাকা দায় হয়ে যাবে।” 

— “আপনি তো দেখছি ইনিয়ে বিনিয়ে সুইসাইড থ্রেট দিচ্ছেন! এতদূর ভাবছেন কেন আপনি? আপনার গার্লফ্রেন্ড এসব জানবেই না। কে জানাবে তাকে?”

— “সত্যি কথা কখনো চাপা থাকে না।”

— “আমরা চেপে রাখবো। আপনার কতবড় ক্ষতি আমি করে ফেললাম, আমার একটা দায়িত্ব আছে না? আমাকে আপনি বিশ্বাস করতে পারেন। আমি কাউকে কিছু জানতে দেবো না। আর এখানে এসে যদি আমাকে দেখেও ফেলে তাতে কী, বলুন? আমরা তো আর একঘরে থাকছি না। বলে দেবো আমি আপনার কাজিন। এখানে এসেছি আমার জরুরি কাজে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো অমিত। হতাশ চোখে তাকিয়ে রইলো টিভির স্ক্রিনে। লম্বা 

আলোচনায়ও কোনো ফায়দা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। তার জন্য মায়া হচ্ছে নবনীর, আহারে বেচারা! কী দুশ্চিন্তায়ই না ডুবে মরছে সে। 

১৮

খাবার টেবিলে বসে সকালের নাস্তা করছে ওরা তিনজন। অনি নাস্তা করতে করতে দেখছে অমিত, নবনীকে। গুনে গুনে দশদিন পেরোলেও দুজনের মাঝে এখনও স্বাভাবিকতা আসেনি। দু’জনের মাঝে দেয়াল দাঁড় করিয়ে রেখেছে অমিতই। বাবা গতকাল জানতে চেয়েছিল ওদের কথা। মা তো প্রতিদিন নিয়ম করে জিজ্ঞেস করছেই। আপাতত অনির কাছেও অমিত-নবনীর বিয়েটা স্বাভাবিক লাগছে। এতদিন মনে হচ্ছিল, অনাকাঙ্খিত একটা সম্পর্ক টেনে নেয়া নিরর্থক। নবনীর সঙ্গে এই ক’টাদিন কাটানোর পর মনে হচ্ছে, এই মেয়েটা কিংবা এই সম্পর্কট মন্দ কী! ভালোই তো, বরং অনেক বেশি ভালো। থাকুক না নবনী চিরকাল অমিতের হয়ে। টিকে থাকুক ওদের সম্পর্কটা আজীবন। জটিল এই সম্পর্কের পথটা সবাই মিলে বুঝিয়ে শুনিয়ে একটুখানি সহজ করে দিলেই তো হয়! দু’জনকে আরো একটুখানি কাছাকাছি থাকার, বোঝাপড়ার সুযোগ করে দিলেই তো হয়! 

মিথ্যেমিথ্যি গলা ঝাড়লো অনি। অমিতের দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে বললো, 

— “ভাইয়া, তুমি আজ অফিসে যাবার সময় নবনী আপুকে কারখানায় নামিয়ে দিয়ে যেও।” 

— “আমি কেন?” 

— “আপু গতকাল সিঁড়ি থেকে স্লিপ কেটে পড়ে গেছে। কারখানায় ওর জরুরি কাজ আছে। যেতেই হবে, নয়তো বাসায়ই থাকতে বলতাম।” 

— “আমার জরুরি কাজ আছে, জলদি অফিসে যেতে হবে।”

— “৫-৭ মিনিটেরই তো ব্যাপার।”

— “না, না। আমি যেতে পারব। একটা রিকশা নিয়ে নেবো।” 

— “হলোই তো, উনি চলে যাবে রিকশা নিয়ে।” 

— “রিকশার জন্য নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। বেচারীর পায়ে ব্যথা ভাইয়া। ও আমাদের কাজিন, কাছের মানুষ। কবে কী ঘটেছে সেসব মাথায় রাখবে আর কতদিন? এবার একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করো। একই বাসায় আছি আমরা। সবাই সবার সঙ্গে নরমাল বিহেভ করা কি উচিত না?” 

— “আমি নিচে ওয়েট করছি। আপনি আসুন।” 

অমিতের পাশে বসে আছে নবনী। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে তার। মেয়েদের সঙ্গে তার উঠাবসা নেই এমনটা তো না। বান্ধবী, কলিগ, অফিসে প্রায় প্রতিদিন আসা বিভিন্ন মডেল এমন কত মেয়ের সঙ্গেই কথা হচ্ছে, একসঙ্গে বসে কাজ হচ্ছে। কই, কখনো তো এতটা অস্বস্তি হয়নি। নবনীর বেলায় এমন কেন তবে? বহুবার মাথায় এসেছে, এই মেয়েটার সঙ্গে স্বাভাবিক হওয়ার কথা। শত চেষ্টায়ও তার সঙ্গে স্বাভাবিক হতে পারছে না, অন্য দশটা মানুষের মতো হাসিমুখে কথা বলতে পারছে না। কোন এক অজানা জড়তা তাকে আঁকড়ে ধরে বারবার। বাবা জানলে রাগ করবে নিশ্চয়ই! কিন্তু এই সমস্যার সমাধান কোথায়? 

১৯

আজ অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে অমিত। সকালে ঘুম থেকে উঠেই চলে এল সাভারে। আজকের দিনের জন্য এখানকার একটা রিসোর্টে রুম বুক করে রেখেছে গত সপ্তাহেই। আজ মুনিয়ার জন্মদিন। এরচেয়ে বিশেষ দিন তার কাছে আর কী হতে পারে? মুনিয়ার জন্মদিনের মাস দুয়েক আগে থেকেই চলতে থাকে অমিতের নানারকম প্ল্যান। সম্পর্কের প্রথম দুইবছর মুনিয়ার বার্থডে সেলিব্রেট করতে চলে গিয়েছিল অন্য শহরে। একবার সেইন্ট মার্টিন, অন্যবার সিলেটে। একান্তে তিন চারদিন সময় কাটিয়েছিল তারা। গেল বছর মুনিয়ার ব্যস্ততার কারণে যাওয়া হয়নি দূরে কোথাও, ঢাকাতেই একটা রেস্টুরেন্টে ছোট আয়োজন করেছিল। এবার দুই সপ্তাহ আগে থেকেই খুব রিকোয়েস্ট করে মুনিয়ার বিজি শিডিউল থেকে দূরে কোথাও একান্তে সময় কাটাবে বলে একটা দিন চেয়ে নিয়েছে অমিত। কথা ছিল দু’জনে একসঙ্গে সকালেই চলে আসবে এখানে। অমিত গাড়ি নিয়ে বেরোতেই মুনিয়া কল করে বললো, “তুমি যাও, আমি ঘন্টা তিনেক পর আসছি। জরুরি কাজ পড়ে গেছে।” 

তিনঘণ্টা পেরিয়ে সাতঘন্টা হয়ে গেল, সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো, মুনিয়া এখনো আসেনি। চোখের কোণে পানি জমেছে অমিতের। মুনিয়ার নাম্বারে অসংখ্য কল আর টেক্সট করা সত্ত্বেও এখনও কোনো রিপ্লাই আসেনি। ভেজা চোখে তাকিয়ে আছে সে মোবাইল স্ক্রিনে। ছবির প্রাণবন্ত হাসির মুনিয়া তাকিয়ে আছে তার দিকেই। অমিত ভেবে পায় না এত মায়া যার হাসিতে, সে কেমন করে অন্যকে পোড়াতে পারে? 

.

কারখানায় কাজের ভীষণ চাপ যাচ্ছে। বড় দু’টো অর্ডার এসেছে লন্ডন আর কানাডা থেকে। বিশ দিনের ভেতর কাজ শেষ করে প্রোডাক্ট ডেলিভারি করতে হবে। ওদিকে শীত শুরু হতে না হতেই অনলাইন পেইজে শাল, আর ফুল হাতা ব্লাউজ বেশিরভাগই স্টক আউট। সেগুলো আবার রিস্টক করতে হচ্ছে। তিনদিন যাবৎ বাসায়ও ফেরা হচ্ছে না সময়মতো। ভোর সকালে কারখানায় এসে রাত দশটা এগারোটায় ফিরতে হচ্ছে। প্রোডাক্ট ডেলিভারী হওয়ার আগ অব্দি এমনই চলবে। এত এত কাজের চাপেও গুনে গুনে দেড়ঘন্টা কেড়ে নিলো শামীমা চাচী। আকারে ইঙ্গিতে ব্যস্ততার কথা জানালেও, চাচী সে কথা শুনলোই না। বরং কাঁদতে কাঁদতে ছেলে আর ছেলের প্রেমিকার বিরুদ্ধে একগাদা অভিযোগ শোনালো। ভদ্রতার খাতিরে কিংবা মায়ের বয়সী চাচীর কান্নাকাটির মায়ায় পড়ে এত ব্যস্ততায়ও কল কাটতে পারেনি নবনী। চাচীর সমস্ত অভিযোগ মন দিয়ে শুনেছে। কল কেটে দেবার আগে বেচারী খুব অনুরোধ করে বললো তার ছেলেকে মুনিয়ার ব্যাপারে বোঝাতে, জীবন নিয়ে নতুন করে ভাবতে। চাচীকে মিথ্যা স্বান্তনা দিলেও সত্যিকারে অমিতকে এই ব্যাপারে কিছু বলা অসম্ভব। আগের মতো দুজনের মাঝে গুমোট ভাবটা আর নেই। তবে স্বাভাবিক কথাবার্তা হলেও, ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলার মতো খুব একটা সখ্যতাও নেই। মাথার দুপাশে চেপে ধরে রেখেছে নবনী। বহুবছর এতটা সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা হয়নি। তার উপর কাজের চিন্তায় ঘুমও হচ্ছে না রাতে ঠিকঠাক। সকালের নাস্তাই এখনো করা হয়নি। সব মিলিয়ে মাথা ধরেছে খুব। আজ বাসায় জলদি ফিরে, স্লিপিং পিল খেয়ে লম্বা ঘুম দিতে হবে। 

.

রাতের খাবার শেষে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করছে নবনী। আয়নায় দেখছে চিন্তিত অনিকে। অনবরত কল করে যাচ্ছে অমিতের নাম্বারে। ভাইয়ের চিন্তায় বেচারী ঠিকমতো খেতেও পারেনি। সকালবেলা বাসা থেকে বেরোবার আগে শেষ কথা হয়েছিল দুই ভাইবোনের। এরপর অমিতের সঙ্গে আর কারো কোনো যোগাযোগ হয়নি। মা-বাবা, বোন কারো কল রিসিভ করছে না সে। নবনীও কল করেছিলো দু’বার। অমিত রিসিভ করেনি। অনির মুখটা দেখে মেজাজ খারাপ হচ্ছে নবনীর। এই লোকটাকে নিয়ে কেউ শান্তিতে নেই। এতগুলো দিনে তার চালচলন আর অনির বিভিন্ন কথায় কিছুটা আন্দাজ করলেও, আজ চাচীর সাথে দীর্ঘ আলাপে সে কথা পুরোপুরি বোঝা হয়ে গেছে নবনীর। একজন চৌত্রিশ বছর বয়সী মানুষ এতটা বোধ-বুদ্ধিহীন কী করে হতে পারে, তাই-ই ভেবে পাচ্ছে না সে। তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে অনির পাশে এসে বসলো নবনী। 

— “উনার ফ্রেন্ডদের কাছে খোঁজ নাও।” 

— “নিয়েছি। কেউ জানে না ও কোথায় আছে।” 

— “অফিস? ওখানে খোঁজ নিয়েছো?” 

— “হ্যাঁ। বাসা থেকে বলে গেল অফিসের কাজে বাইরে যাচ্ছে, অথচ অফিসে খোঁজ নিয়ে জানলাম ভাইয়া আজ ছুটি নিয়েছে।” 

— “ওহ! অফিসেই যায়নি?” 

— “উহুম। এখন তো ফোনের সুইচও অফ। 

— “কী মুশকিল! 

— “থানায় যাবো একবার?” 

— “থানা? তুমি কি বাজে কিছু ধারণা করছো?” 

— “ভাইয়া একটু পাগলাটে স্বভাবের। কিন্তু সারাদিনে একবারও কল রিসিভ করবে না এমন কখনো হয়নি।” 

— “রাতও তো অনেক হলো।” 

— “আমার সত্যিই ভয় লাগছে আপু। চলো একবার থানা হয়ে আসি। কোথায় কোন বিপদ হলো কে জানে?” 

— “চাচা-চাচীকে একবার জা…” 

নবনীর কথা শেষ হবার আগেই বাসার কলিংবেল বেজে উঠলো। অনি দৌড়ে গেল দরজা খুলতে, পেছন পেছন গেল নবনীও। অমিত এসেছে। ছোটবেলার বন্ধু সৌমিকের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জড়িয়ে আসা কন্ঠে চিৎকার করে বারবার বলছে, “মুন এমন কেন করলো? আমি সহ্য করতে পারব না, ও কি জানতো না?” 

অমিতকে এক প্রকার ঠেলতে ঠেলতে ঘরে নিয়ে এল সৌমিক। তাকে সোফায় বসিয়ে অনিকে বললো,

— “অনি আমাকে এক্ষুনি একটু হসপিটাল যেতে হবে। আমার শ্বশুরের অবস্থা ভালো না, অমিতকে সামলাও।”

— “ওর হয়েছেটা কী, একটু বলে যান?” 

— “মুনিয়ার বার্থডে ছিল। রিসোর্ট বুক করলো, দু’জনে একসঙ্গে সারাদিন কাটাবে বলে প্ল্যান করলো। কিন্তু মুনিয়া যায়নি। কাজের বাহানায় রয়ে গেল এখানেই। আসলে কাজ-টাজ কিছু না, ও আজ শাহরিয়ারের সঙ্গে ছিল। চেনো তো শাহরিয়ার চৌধুরীকে?” 

— “হ্যাঁ।” 

— “রেস্টুরেন্টে বেশ অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখেছি ওদের। চট করে তোমার ভাইকে ছবি তুলে দিলাম। সেটা দেখেই বিস্তারিত জানতে ছুটে এল আমার অফিসে। তারপর অফিস থেকে চলে গেল বারে। পেছন পেছন আমিও গেলাম। ওকে একা ছাড়ার সাহস হয়নি।

— “বিকেলে কল করলাম তখন বলেননি কেন ও কোথায় আছে?” 

— “ইচ্ছে করে জানাইনি। ও বাসায় কী বলে বেরিয়েছে তা তো জানি না।”

— “দুশ্চিন্তায় আমি শেষ!”

— “পাগলকে এতক্ষণ সামলেছি। তোমার ভাইকে রেখে গেলাম, ওকে এখন তুমিই সামলাও। চোখে চোখে রেখো আর নিজেও সাবধানে থেকো। দুইদিন অফিসে যেতে দিও না। এবারের ধাক্কাটা একটু জোরদারই ছিল। সামলাতে সময় লাগবে। কোনো সমস্যা হলে জানিও। আমি গেলাম।” 

অনি দরজা আটকে এসে দেখলো নবনী চোখ বড় করে অমিতকে দেখছে। তার দুইহাতে দু’টো ফুলদানী। 

— “আপু, তুমি ঘরে যাও। মাথাব্যথা করছে বলছিলে না! ঘুমাও গিয়ে।

— “রাখো তোমার ঘুম। ঘুম, মাথাব্যথা সব উড়ে গেছে আমার। উনাকে কী করবে, সেটা বলো।” 

— “নতুন কিছু না। মুনিয়ার সঙ্গে বড়সড় ঝামেলা হলেই মদ খেয়ে বাসায় ফিরে পাগলামি করে।” 

— “জানো, তুমি ঐ ভাইয়াটার সঙ্গে কথা বলছিলে তখন উনি ফুলদানিগুলো আছাড় দিতে চেয়েছিল। আমি জোর করে হাত থেকে কেড়ে নিয়েছি। সেজন্য আমাকে দুটো পঁচা গালিও দিলো!” 

ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো অনি। নবনীর হাত চেপে বললো, 

— “আপু তুমি রাগ করেছো? কী লজ্জার ব্যাপার বলো তো! এসব ঝামেলা এখন তোমাকেও পোহাতে হচ্ছে।” 

অনিকে ভীষণ অসহায় দেখাচ্ছে। ওকে দেখে খুব মায়া লাগছে নবনীর। লোকটা এই পরিবারের সবার হাড়-মাংস জ্বালিয়ে ফেলেছে নিশ্চিত! নয়তো এত অসহায় হয়ে কেউ কাঁদে নাকি? 

টি টেবিলের উপরে থাকা নবনীর মোবাইল নিয়ে টিভি বরাবর ছুঁড়ে মারলো অমিত। মোবাইলের স্ক্রিন ভেঙে চুরমার হয়ে পড়ে রইলো ফ্লোরে। টিভির স্ক্রিনে বিশাল ফাঁটা দাগ পড়েছে। নবনী দু’হাতে মুখ চেপে একবার ভাঙা ফোনের দিকে তাকাচ্ছে তো অন্যবার টিভির স্ক্রিনে। অনির কান্নার গতি দ্বিগুন হলো। হাউমাউ করে কাঁদছে অমিতও। দেয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে অনবরত মুন, মুন বলে চিৎকার করছে। কপাল ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে তার। অনি ভাইয়ের হাত টেনে যতই সরাতে চাইছে ততই অমিত শরীরের সমস্ত শক্তি ঢেলে দেয়ালে মাথা ঠুকছে।

ঘরের মধ্যখানে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো নবনী। এর আগে কখনো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে বলে মনে পড়ে না। এইতো গেল মাসেই লোকটা ইনডিরেক্টলি সুইসাইড করবে বলে থ্রেট দিচ্ছিল। আজ সত্যি সত্যি তেমন কিছু ঘটে যাবে না তো? ভয়ে নবনীর গলা শুকিয়ে এল। একগ্লাস পানি খাওয়া জরুরি ফ্রিজের ঠান্ডা পানি ঢকঢক করে গিলতে গিলতে অমিতকে দেখছে নবনী। সকালেই চাচী বলছিল তার পাগলামির কথা। পাগলামি যে এমন সীমা ছাড়ানো পর্যায়ে চলে যায়, সে কথা কে জানতো? দেয়ালে রক্তের দাগ বসে যাচ্ছে, কপাল থেকে নাক 

বেয়ে রক্তের ফোঁটা পড়ছে ফ্লোরে। ভয়, রাগ মিলে মাথার রগ ফেঁটে যাবার উপক্রম হলো নবনীর। লোকটাকে এবার থামাতে হবে, প্রয়োজনে চড় থাপ্পর দিয়ে হলেও থামাতে হবে। 

হেঁচকা টানে অমিতকে সোফায় ফেলে দিলো নবনী। নেশায় বুদ অমিত কোনোভাবে শরীরের টাল সামলে সোফা থেকে উঠতে যাচ্ছিল, নবনী আবারও তাকে ধাক্কা দিয়ে সোফায় শুইয়ে দিলো। 

— “খবরদার! চুপ করে শুয়ে থাকুন বলছি। একদম বাড়াবাড়ি করবেন না। এ্যাই অনি, যাও তো ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এসো।” 

তড়িঘড়ি করে অনি রুম থেকে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এল। অমিতের হাত ধরে বসালো নবনী। ডেটলে ভেজানো তুলো কাছে নিতেই নবনীর হাত ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো অমিত। — “লাগবে না কিছু।” 

— “কেন লাগবে না?” 

— “মুনকে এনে দেবেন?” 

— “দেবো।” 

— “আসবে না ও। আমি জানি আসবে না। ও শাহরিয়ারের সঙ্গে আছে। রাত গভীরে লম্বা চুমু হয় জানেন তো? আমার মুনও চুমুতে ব্যস্ত, লম্বাআআআ চুমু!”

আবারও হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো অমিত। বুকের বাঁ পাশে কেমন মোচড় কেটে ব্যথা হচ্ছে নবনীর। প্রেমিকার চরম প্রতারণা নিজ চোখে দেখেছে বোধহয়! প্রতারণার যন্ত্রণা কেমন হয় সে অনুভূতি জানা নেই তার। তবে ভালোবাসা হারাবার যন্ত্রণা মৃত্যু সমতূল্য সে কথা ভীষণভাবে জানে সে। অমিতেরও হয়তো মৃত্যুযন্ত্রণা হচ্ছে! 

চোখের পলকে অমিত ডেটলের বোতল মুখে নিয়ে নিলো। ধাক্কা দিয়ে বোতল ফেলে দিলো নবনী। চেঁচিয়ে উঠলো অমিতের সঙ্গে 

— “মারবো ধরে এক চড়! কী সাংঘাতিক! আমরা দুই দুইজন জলজ্যান্ত মানুষ আপনার সামনে দাঁড়ানো, অথচ আপনি আমাদের সামনেই সুইসাইড এটেম্পট নিতে চাইছেন? আপনার বোন কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়ে যাচ্ছে আপনি চোখে দেখতে পান না? দেয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে রক্তারক্তি কান্ড করে ফেললেন। একটুও কি ব্যথা লাগছে না? এতটুকুতে কি পোষায়নি যে এখন ডেটল গিলতে চাইছেন? মাতাল হলে কি মানুষ গন্ডারও হয়ে যায়?”

— “আমার সব অনুভূতি মুনের কাছে জমা আছে। ও চলে গেছে আমার অনুভূতি 

মরে গেছে। এবার আমিও মরতে চাই, এত যন্ত্রণা আর নিতে পারছি না। এবার আমাকে মুক্তি দিন প্লিজ! — “এইতো ব্যান্ডেজটা করি, তারপর মুনকে এনে দেবো। আমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসবো ওকে। আর কোনো পাগলামি, চেঁচামেচি না।” 

অমিতের কাছে বসে ড্রেসিং করে দিচ্ছে নবনী। আগের চেয়ে অনেকটাই নিস্তেজ হয়ে গেছে সে। একটু আগেও খুব চিৎকার করছিল, এখন পাশে বসেও নবনী তার কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে না। তার একহাত শক্ত করে ধরে রেখেছে অনি। শীতের মাঝে মাথার উপর ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরছে। তবুও ঘামছে অমিত। তার কপালে নবনীর হাত। সেই হাত চেপে ধরলো অমিত। পৃথিবীর সমস্ত অসহায়ত্ব তার চোখে, কন্ঠে। বিড়বিড় করে বললো, “আমার মুন অমানুষ হলো কবে?” 

.

নবনীর গায়ে ঢলে পড়লো অমিত। জ্ঞান হারিয়ে অসহ্য যন্ত্রণা থেকে সাময়িক বিদায় নিয়েছে সে। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *