১০
বাজার থেকে লাল জর্জেট শাড়ী, আর খসখসে কাতান কাপড়ের পাঞ্জাবি কিনে আনা হয়েছে হবু বর-বউয়ের জন্য। সঙ্গে আনা হয়েছে বাজারের সেরা নন্দ ঘোষের দোকান থেকে রসগোল্লা, কালোজাম আর ছানা- কবুল বলার পর সবাইকে মিষ্টিমুখ করানো হবে বলে। অন্য সব সাধারণ কিংবা বিশেষ দিনগুলোতে বড় বউয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মির্জা বাড়ির রান্নাবান্না হলেও, আজ সকালের নাস্তা তৈরী হচ্ছে এই বাড়ির প্রধানের ফরমায়েশ অনুযায়ী। রমিজ মির্জা নাস্তায় ভাত-মুরগীর সালুনের পরিবর্তে পোলাউ, ডিম আর মুরগীর কোরমা তৈরীর হুকুম জারি করেছেন। বাড়ির কাজের লোক, মেয়েরা আর ছোট বউকে সঙ্গে নিয়ে রান্নাঘরে তুমুল ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে বড় বউ। শেষ মুহূর্তে এসে শ্বশুর জানালো তার ফরমায়েশ। বেলা গড়িয়ে এখন সকাল সাড়ে আটটা। এই বাড়িতে আটটা নাগাদ নাস্তা টেবিলে সাজাবার প্রচলন। সারাবছর এই বাড়িতে মেজো বউ না থাকলেও, বছরের যে ক’টাদিন বাড়িতে সে থাকে ততদিন বড় জায়ের আশপাশে ঘুরঘুর করেই তার সময় কাটিয়ে দেয়। বিয়ের পর থেকে সুরাইয়া বাড়ি এলে কখনো বড় বউ একা রান্নাঘরে কাজ করেছে বলে মনে পড়ে না। আজ এই সংকটে সুরাইয়া তার পাশে নেই। ব্যাপারটা চোখে পড়ার মতো হলেও সে কথা আপাতত মাথায় আসছে না বড় বউয়ের। রান্নাঘরের দায়িত্বে থাকা সাতজন মানুষ যেন মির্জা বাড়িতে চলমান কানাঘুষো আর থমথমে পরিস্থিতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা জগতে আছে। বড় বউ একটু পরপরই ঘড়ি দেখছে আর একমনে স্রষ্টাকে স্মরণ করে চলছে, খোদা, উদ্ধার করো! আব্বা খাওন খুঁজার আগে সব কাম সারায় দেও। আমি মসজিদে পাঁচটা টেকা দান কইরা দিমু গো খোদা! উদ্ধার করো!
.
মসজিদের মুয়াজ্জিনকে ডেকে আনা হয়েছে। রমিজ মির্জা নিজের ঘরে মুয়াজ্জিনকে বসিয়ে কথা বলছে। ভেতরে হয়তো বিয়ে নিয়েই নিচুস্বরে কথা চলছে দু’জনের। দরজায় দাঁড়িয়ে বাবার কথা শোনার চেষ্টা করছে রাশেদ। কিন্তু কিছুই শুনতে পাচ্ছে না সে। অথচ এখন শোনা যে ভীষণ জরুরি! বাড়িতে যা কিছু ঘটছে তার পেছনের গল্পটা ভীষণ নোংরা সে কথা বুঝতে বাকি নেই তার। তবে কী সেই গল্প?
— “বাবা…”
রওনক পেছন থেকে ডাকলো রাশেদ মির্জাকে। ছেলের হাত ধরে সে টেনে নিয়ে গেল বাবার ঘরের পেছনে। “তোর মা কিছু বললো?”
— “না। মুখে শাড়ী চেপে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদছে শুধু।”
— “অমিত? নবনী? ওরা কেউ কিছুই বলেনি?”
— “না। কেউ কিছুই বলছে না। নবনী অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে বাবা। চোখ-মুখ দেখে মনে হলো অজ্ঞান হয়ে যাবে। অমিত ভাইয়া পাথরের মতো বসে আছে। নাতাশা, অনি সবাই চুপ।”
— “কিচ্ছু ঠিক নেই। কেউ কিছুই বলছে না।”
— “তুমি মামীকে কেন জিজ্ঞেস করছো না বাবা?”
— “করেছি। ভাবী বললো, আপনাকে বলে লাভ কী? বাবার বিপক্ষে গিয়ে
সুরাইয়াকে বিয়ে করা ছাড়া আর কিইবা করতে পেরেছেন এই জীবনে?”
— “কষ্ট পেয়েছো?”
— “উহুম। উনার মেজাজ খুব খারাপ। নয়তো আমাকে এভাবে কথা শোনাতো না।”
— “তুমি বাইরে না দাঁড়িয়ে ভেতরে যাও। দাদা হুজুরকে কি বলছে শোনো।”
— “ঢুকতে চেয়েছিলাম। বাবা যেতে নিষেধ করলো।”
— “ওদের বিয়ে দেয়া একটা অসম্ভব ব্যাপার। অমিত ভাইয়া মুনিয়াকে ছাড়া চোখে
কিছু দেখে না আর নবনী সামি ভাইয়াকে এখনও ভুলতে পারেনি। দাদা কী এমন কান্ড করলো সেটাই বুঝে পাচ্ছি না! কেউ কিছু বলছেও না। ঘটনা না জেনে ওদের হেল্প করবো কিভাবে?”
ঘরের দুয়ার থেকে বাবার আর মুয়াজ্জিনের অস্পষ্ট কথোপকথন কানে ভেসে এল রাশেদের। আড়াল থেকে উঁকি দিতেই দেখতে পেল দু’জন এগিয়ে যাচ্ছে অমিত নবনী যে ঘরে বসে আছে সে ঘরে।
মানুষ গিজগিজ করছে মির্জা বাড়ির বসার ঘরে। সব আত্মীয়স্বজন ঘুরে ঘুরে দেখছে ওদের। কখনো নিজেদের মাঝে কানাঘুষা করছে কখনোবা নানারকম প্রশ্নে জর্জরিত করছে অমিত, নবনীর মা-বোনদের- এদের হঠাৎ বিয়ের পেছনে ঘটনা কী? সম্পর্ক ছিল আগে থেকে? নাকি রমিজ মির্জার কোনো কারসাজি?
সমস্ত প্রশ্ন, কানাঘুষা মুহূর্তেই থেমে গেল রমিজ মির্জার আগমনে। সঙ্গে এসেছে মুয়াজ্জিন আরো দু’জন গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তি। বিয়েতে তারা সাক্ষী হবেন। রিনি এতটা সময় এককোনায় বসে ছিল। চুপচাপ বসে দেখছিল অমিত-নবনীকে। পড়ার চেষ্টা করছিল ওদের চোখের ভাষা। ভোরের দিকে রিনি ছাদে যাবার বেলায় নবনী ঝড়ের গতিতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছিল। এতটাই তাড়াহুড়োয় ছিল যে একটা জলজ্যান্ত মানুষকে সে সজোরে ধাক্কা দিয়ে নেমে চলে যাচ্ছে সেদিকটায় খেয়ালই করলো না! ছাদে উঠে চিলেকোঠার জানালা দিয়ে দেখতে পেল রমিজ মির্জা আর বাড়ির বেশি কথা বলা কাজের লোকটা সে ঘরে দাঁড়িয়ে বিয়ে নিয়ে কী সব বলছে। খাটে অমিত গুটিসুটি মেরে বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। আপাতত যা কিছু চোখের সামনে ঘটছে সবটাই মাথা উপর দিয়ে গেলেও, ভোরে যা দেখলো তার সঙ্গে দুইয়ে দুইয়ে চার মেলালে বেশ মুখরোচক একটা কাহিনি আন্দাজ করা যায়। তার মায়ের মনে কৌতুহলের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। পাগলের মতো ঘরময় পায়চারি করছে আর একে ওকে জিজ্ঞেস করছে ঘটনা কী। এতবড় ঘটনা পেটের ভেতর চেপে যাচ্ছে সে কথা ভাবতেই অদ্ভুত আনন্দে মনটা ক্ষণে ক্ষণে দুলে উঠছে রিনির। মাকে পুরো ঘটনা বললে দুইয়ে দুইয়ে চারের বদলে আট মিলিয়ে পুরো বাংলাদেশ ছড়িয়ে দেবে নিশ্চিত। উচিত, অবশ্যই মেলানো উচিত। তবে এখনি না। মুয়াজ্জিন সবে বিবাহ কার্যক্রম শুরু করেছে। বিয়ে হোক, গ্রাম ছেড়ে সবাই শহরে পৌঁছাক। তারপর নাহয় আয়েশ করে ঘটনা রটনা সব হবে। ঘরভর্তি মানুষের ভীড়ে ঠিকঠাক দুজনকে ক্যামেরা বন্দী করা যাচ্ছে না। টেবিলের উপর উঠে দাঁড়ালো রিনি। ঘটনার পাশাপাশি দেখার মতোও কিছু একটা তো চাই। ভেজা চোখে, পৃথিবীর সমস্ত অসহায়ত্ব বরণ করে দুজন কবুল বলছে, একটা ঘটনাকে আরো মুখরোচক করতে এরচেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কীইবা হতে পারে?
.
ঘরের সবাই একযোগে বলে উঠলো আলহামদুলিল্লাহ। বললো না শুধু অমিত আর নবনীর মা-বোন। পাশের ঘর থেকে সুরাইয়া শুনতে পেলো কে যেন চিৎকার করে বলছে, “কবুল পড়ানো হইছে! জলদি কইরা মিষ্টি আনো”।
মুখে আঁচল চেপে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো সুরাইয়া। বহুবছর আগে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে, ছেলেমানুষী সিদ্ধান্ত! বাবা বলেছিল, ফিরে আয় নয়তো আগুনে পুড়বি। বাবার চোখে চোখ রেখে নির্লজ্জ প্রেমিকার মতন দৃঢ় কণ্ঠে সে বলেছিল, রাশেদের প্রেমে আমি জ্বলে ছাই হয়ে গেছি বাবা। ছাই কখনো পোড়ানো যায়? বাবার কথার অর্থ সেদিন ১৭ বছর বয়সী সুরাইয়ার জ্ঞানে আঁটেনি। বিয়ের পর মাস ছয়েক যেতে না যেতেই বাবার বলা প্রতিটা কথার মর্ম টের পেয়েছে হারে হারে। কালে কালে বুঝে গেছে মির্জা বাড়ি পুরোটাই আস্ত একটা অগ্নিকুন্ড, যে আগুনে সে ঝাঁপ দিয়েছিল স্বেচ্ছায়। তার একটা ভুল সিদ্ধান্তের কারণে তার সঙ্গে জ্বলছে তার ছেলে, আজ পুড়লো তার ভাতিঝি। এবার তার মুক্তি চাই! মৃত্যু অবধি এখানে জ্বলবার মতন ধৈর্য্য আর তার নাই। সংসার গোল্লায় যাক, শেষ বয়সে এসে গায়ের উপর “ডিভোর্সি” সিলমোহর লাগুক, তাতে আর কিছুই আসে যায় না! খাটের নিচ থেকে টেনেটুনে ব্যাগ বের করলো সুরাইয়া। এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা সব জিনিস গুছিয়ে নিচ্ছে সে। আজই ঐ মেরুদন্ডহীন লোকটার সংসার ত্যাগ দেবে সে।
১১
মধ্যদুপুর। বাস ছুটছে ঢাকার পথে। বোনকে বুকে জড়িয়ে বসে আছে নাতাশা। খানিক আগেই বাসে উঠার সময় মাথা ঘুরিয়ে পড়তে যাচ্ছিল নবনী। পেছন থেকে অমিত এসে আঁকড়ে ধরলো। মাথায় পানি ঢেলে, জোর করে মুখে পাউন্ড কেক আর ডাবের পানি ঢুকিয়ে দেবার পর গায়ে কিছুটা জোর পেলেও এখনো ঠিক ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি সে। কিছুক্ষণ পরপর কেঁপে কেঁপে উঠছে। থেমে থেমে বিড়বিড় করে কী যেন বলছে, সে কথা নাতাশার কান পর্যন্ত যাচ্ছে না। চোখের সামনে আটবছর আগে সেই দিনটার কথা নবনীর চোখে ভাসছে। স্তব্ধ নবনী, ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়া নবনী! তারপরের একটা বছর কী কী ঘটেছিল, সেসব ভাবতে ভাবতেই গায়ে কাঁটা দেয় নাতাশার। তেমন কিছু আবারও ঘটতে যাচ্ছে না তো? এবারের মতো ধাক্কা সামলে নিতে পারবে তো নবনী? আসন্ন বিপদের কথা ভেবে অস্থির হয়ে উঠে নাতাশা, হৃৎস্পন্দন গাঢ় হয়, দু’চোখ বেয়ে কান্না নেমে আসে। বোনকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখে সে।
ওপাশের সারিতে বসে আছে অমিত, অনি। জানালায় মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে সে। শূণ্য চোখে তাকিয়ে আছে বাইরে। বাসে উঠার পরই মোবাইল নেটওয়ার্ক ফিরে এল। একের পর এক মিসডকল এ্যালার্ট আর ম্যাসেজ নোটিফিকেশন টুংটাং শব্দে স্ক্রিনে ভাসতে থাকলো। অফিস থেকে কল এসেছিল, বাবা আর বন্ধুরা কল করেছিল, কল করেছিল মুনিয়াও। মোবাইল সুইচড অফ পেয়ে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে গালি ভরা ম্যাসেজ, ব্রেকআপের হুমকি-ধমকি দেয়া ম্যাসেজ। ম্যাসেজগুলোতে একনজর চোখ বুলিয়ে স্ক্রিন অফ করে হাতের মুঠোয় মোবাইল নিয়ে বসে রইলো সে। মুনিয়ার রাগ, গালি কিংবা হুমকি কোনোটাই এই মুহূর্তে তাকে স্পর্শ করতে পারছে না। আজ যা কিছু ঘটে গেল তারচেয়ে মন্দ আর কীইবা হতে পারে? অনাকাঙ্খিত এই সম্পর্ক কতটা ভোগাবে তাকে? এই সম্পর্কের ইতি ঘটবে কবে? মুনিয়া? সে কি জেনে যাবে এই সম্পর্কের কথা? আর তারপর? মুনিয়ার সঙ্গে সত্যিই কি চিরতরে ভালোবাসা মিটে যাবে? সম্পর্ক ভেঙে যাবে? মুনিয়াকে হারিয়ে ফেলবে সে? হাজারো প্রশ্ন টর্নেডো হয়ে ঘুরছে মাথার ভেতর। সকাল থেকে ঘাড়ে ব্যথা হচ্ছিল। ক্রমশ সেই ব্যথা যেন বাড়ছে। ঘাড় সোজা করে বসাই দায় হয়ে গেছে। বেডরুমের বিছানা-বালিশকে মনে পড়ছে খুব। মানুষের ডানা থাকলে ভীষণ ভালো হতো। এক্ষুনি ডানা মেলে উড়ে চলে যেত নিজের বাসায়, বেডরুমে। পর্দা বন্ধ করে, দরজা আটকে ফুলস্পিডে ফ্যান ছেড়ে স্লিপিং পিল খেয়ে লম্বা ঘুম দেয়া যেত। হঠাৎ ঘাড়ে স্পর্শ পড়লো। চোখ বুজেই রইলো অমিত। সে জানে হাতটা অনির। আপন মানুষরা কিছু না বলতেও মনের কথা বুঝে ফেলার চমৎকার ক্ষমতা আছে মেয়েটার। হাত ঘুরিয়ে অমিতের ঘাড় ম্যাসাজ করে দিচ্ছে অনি। নিচুস্বরে বলছে, — “তুমি অসুস্থ হলে চলবে না। বাবার বয়স হয়েছে। এসব শুনলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে না। তোমাকেই সব সামলাতে হবে- আমাদের বাসা, নবনী আপুর বাসা। মাথা ঠান্ডা রেখে সব ভাবতে হবে।”
পেছনে বসে আছেন শামীমা আর নীতু। কেউ কাউকে কিছু বলছেন না। কঠিন মানসিক ধাক্কায় মানুষ স্তব্ধ হয়, কথা হারিয়ে ফেলে। তাদের বেলায়ও তেমনটাই হয়েছে। নীতু চোখ বুজে শামীমার কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে আছেন আর শামীমা তাকিয়ে আছেন জানালার বাইরে। এতবড় ঘটনা ঘটে গেল অথচ কেউ কারো স্বামীকে এখনো এ ব্যাপারে কিছুই জানাননি। শামীমা দু’বার কল করতে গিয়েও করেননি। কথা বলায় তীব্র অনীহা জেগেছে তার। অমিতের বাবাকে কী বলবেন, কিভাবে বলবেন কিছুই মাথায় আসছে না। নীতুরও আপাতত কিছু ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে না, বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তার মোবাইল কোথায় আছে সে কথাও তার জানা নেই। এখনো গোটা ব্যাপারটা যেন স্বপ্ন মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, ঘুমটা ভেঙে গেলেই সবকিছু মিথ্যে হয়ে যাবে।
*****
নাতনীকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে আছেন জামিলা বেগম। থেমে থেমে কেঁপে উঠছে তার নাতনী। ভীষণ জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে তার গা। দোয়া কালাম পড়ে অনবরত নবনীর গায়ে ফুঁ দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। অনেকক্ষণ যাবৎ মেয়ের জামাইর চিৎকার চেঁচামেচি শুনছেন তিনি। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে আছে তার। ঘরে অসুস্থ মেয়ে,
নিজেরও তো হাই প্রেশার। এমন অবস্থায় চিৎকার করা কতটুকু সমীচীন? কঠিন পরিস্থিতি সামলাতে হয় ঠান্ডা মাথায় বিচার বিবেচনা করে। রাগারাগি করে জীবনে কে কোন রত্ন উদ্ধার করেছে? সেই কখন থেকে তার মেয়ে, ছোট ছেলে আর ছেলের বউ বুঝিয়েই যাচ্ছে উত্তেজিত না হতে, আর এই লোক গরুর মতো গলা ছেড়ে ডেকেই যাচ্ছে। কে বোঝাবে এই লোককে? কিভাবে শান্ত হবে সে?
.
— “মামলা করবো আমি, মামলা! শিপন আমার সঙ্গে যাবি? না যেতে চাইলে ঘরেই বসে থাক। মেয়ে আমার, মাথাব্যথাও আমার। আর কারো কিছুই যায় আসে না!”
শফিক সাহেবের বলা কথাগুলো ওপাশের ঘর থেকে নবনীর ঘরে বসে স্পষ্ট শুনতে পেলেন জামিলা বেগম। কথাগুলো তার কানে এসে তীরের মতো বিধলো যেন। প্রচন্ড রাগে মুহূর্তেই চেহারা কঠিন হয়ে গেল তার। নাতাশার কাছে নবনীকে রেখে তিনি উঠে এলেন ও’ঘর ছেড়ে।
— “কী কইলা শফিক তুমি? মাইয়্যা তোমার, মাথাব্যথাও তোমার? নবনী শিপনের কিছু লাগে না? নবনী, নীতুর কিছু লাগে না? নবনী আমার কিছু লাগে না? ওরে বুকে রাইখা বড় করছি আমরা। শিপনের জান হাজির নবনীর লাইগা আর তুমি কও এসব কথা?
— “আম্মা থামো তো। দুলাভাইয়ের মাথা ঠিক আছে নাকি এখন?”
— “তর মাথা ঠিকাছে? তুই নবনীরে নিয়া চিন্তা করতাছোস না?”
— “বাদ দাও না আম্মা!”
— “দিমুনা বাদ। শফিক খুব শক্ত কথা বইলা ফালাইছে।
— “কী বলতে কী বলে ফেলেছি, আপনি সেই কথা ধরে বসে গেলেন! আমার মেয়েটার কী একটা হাল করলো ঐ লোক। এত বড় অন্যায়! ঐ জানোয়ারকে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া উচিত। অথচ আমি একটা মামলা করতে চাইছি, সবাই আমাকে মানা করছে কেন?”
— “আগে কও তুমি চিল্লাইতাছো ক্যান?”
— “নিচুগলায় কথা বলার পরিস্থিতি কি আছে আম্মা?”
— “আমরা কইতাছি না? চিল্লায়া কী সমাধান করতে চাও তুমি? সমাধান তো হইবোই না, উল্টা আমার অসুস্থ নাতনীর শরীর আরো খারাপ হইব, প্রেশার বাড়াইয়া তুমি হাসপাতাল ভর্তি হইবা, আর তোমার চিল্লানিতে পুরা এলাকাবাসী জানবো নবনীর বিয়া হইছে। খুব ভালা হইব না কও?”
সোফায় ধপাস করে বসে পড়লেন শফিক সাহেব। সমস্ত আক্রোশ হঠাৎ কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। শরীরে-কণ্ঠে নেমে এল অবশ করা ক্লান্তি। গলা ধরে আসছে তার। মেয়ে জামাইর মাথায় এসে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন জামিলা বেগম। আদুরে স্বরে বললেন,
— “ঘটনা সবে আজকে ঘটলো। মামলা মোকদ্দমা কোনো সমাধান না। এইটা জমি সংক্রান্ত বিষয় না। এইটা হইলো তোমার মাইয়্যার বিয়া, তোমার মাইয়্যার জীবনের ব্যাপার। মামলা কইরা লোক জানানো কোনো বুদ্ধিমানের কাম হইব না। ভাবো, ঠান্ডা মাথায় ভাবো। যা হইয়া গেছে তা আমরা কেউ বদলাইতে পারমু না। দুই পরিবার বইসা আপোষে একটা সমাধানে আইতে হইবো।
— “আর কী সমাধান হবে আম্মা? নবনী আবার আগের মতো হয়ে গেলে? কিভাবে সমাধান হবে বলুন তো? কী করবো আমি? কী করে সবকিছু সামাল দেবো?”
— “নবনীর আব্বু, তুমি শান্ত হও। তোমার মেয়ে অসুস্থ হওয়ার আগে মনে হচ্ছে তোমাকেই হসপিটাল নিতে হবে। আর কোনো সমস্যা আমি দেখতে চাই না। শান্ত হও, প্লিজ!”
— “হইবো শান্ত। তুই যা, ভাত দে টেবিলে। শফিকে বাসায় ফিরা কিছু খায় নাই। রাত অনেক হইছে। ঐ সুমি, যাও, তোমার আপার লগে যাও। তরকারী-টরকারী বাইড়া আনো।”
— “কিসের মধ্যে কী বলছেন আম্মা? আমার গলা দিয়ে ভাত নামবে?”
— “এত ভাবো ক্যান? তুমি কি একলা? আছি না আমরা? তোমার মা মরছে পরে কানতে কানতে কইছিলা আমার এক মা মরছে, আরেকজন তো আছে। তারে বুকে নিয়াই বাকি জীবন কাটামু। সেইদিন থেইকা আমিও তোমারে নিজের পোলার মতই মানি। সন্তান পেরেশানিতে ভুগবো আর মা কোনো সমাধান দিবো না এইটা হয়? তোমার সমাধান আমি ভাইবা রাখছি। খালি একটু ভরসা রাখতে হইবো মায়ের উপর এই যা! একটু কঠিন হইবো ব্যাপারটা, কিন্তু অসম্ভব না।
— “কী সমাধান?”
— “আগে খাও। রাইতে খাওনের পরে ওষুধ আছে তোমার। ওষুধ না খাইলে প্রেশার বাড়বো।”
*****
টি টেবিলে পা তুলে, সোফায় হেলান দিয়ে আয়েশ করে বসে পান আপেল চিবুতে চিবুতে টিভি দেখছেন এরশাদ সাহেব। অনি আর শামীমা চরম বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে এরশাদ সাহেবের দিকে। কতবড় দুর্ঘটনা ঘটে গেল তাদের জীবনে, অথচ ঘরের কর্তার এই নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই? এতটাও দায়িত্বজ্ঞানহীন তো তিনি নন। তাহলে আজ কী করে মানুষটা এত আয়েশ করে বসে টিভি দেখছে? গলার ভেতরেই বা খাবার যাচ্ছে কী করে? এই বাসার বাকি কেউ তো এখনো মুখে কিছু তোলেনি! বাসায় আজ রান্না পর্যন্ত হয়নি। সকালের ভয়-আতংক এখনো তাড়া করে বেড়াচ্ছে। কতদিনে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা যাবে সে কথা ভাবতে গিয়ে বারবার হাঁপিয়ে উঠছেন শামীমা।
— “রাতে কী খাবে তোমরা? গ্রিলড চিকেন আর নান অর্ডার করি?”
রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এল শামীমার। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে রিমোটের বাটন চেপে টিভি বন্ধ করলো সে।
— “মনসা তুমি! এমন ফসফস করছো কেন?”
— “ফাইজলামি করো অমিতের আব্বু? টেনশনে মরে যাচ্ছি আমি। মাথা ঘোরাচ্ছে আমার।
— “বিপি হাই হয়েছে বোধহয়। এই অনি, যা তো মেশিনটা নিয়ে আয়। তোর মায়ের বিপি চেক করি।”
— “আব্বু!”
— “চিৎকার করছিস কেন?”
— “আমাদের পাত্তা কেন দিচ্ছো না? এমন বাজে সিচুয়েশনে তুমি এত কুল আছো কিভাবে?”
— “কিসের বাজে সিচুয়েশন? সকালে যা কিছু হলো সেটাকে বাজে বলছিস?’ “বাজে না?”
— “হ্যাঁ প্রথমে আমারও বাজে লেগেছিল। বিকট রকমে বাজে। ইচ্ছে হয়েছিল চামারটাকে মেরে লাশ বানিয়ে দেই। তারপর আমি বাসা থেকে বের হলাম। এক কাপ মসলা চা নিলাম সামনের টং দোকান থেকে। যা চা বানায় নারে লোকটা! আহ্! চুমুক দিতেই মগজের দরজা খুলে গেল। যা বলছি মন দিয়ে শোন। আগেই কিছু বলবি না। পুরোটা শুনবি, তারপর বলবি।”
— “হুম।”
— “যা কিছু হয়েছে একেবারে মন্দ হয়েছে ঠিক তাও না। বিবেচনা করতে গেলে মন্দের চেয়ে ভালোটাই বেশি। কেমন করে বল তো?”
— “কেমন?”
— “তোর মা বিয়েতে গিয়ে নবনীর কথা বললো আমাকে। মেয়েটা কিন্তু দারুণ। অমিতের সঙ্গে দারুণ মানায়। আমাদের পছন্দ করা মেয়ের সঙ্গেই বিয়ে হয়েছে। মন্দ কী? আপোষে না হয়ে, জোর করে হলো। ওদের নামে বাজে কথা রটলো আত্মীয়দের মাঝে এই তো! এটাই যা খারাপ হলো। এছাড়া তুই যদি সুদূরপ্রসারী চিন্তা করিস, ব্যাপারটা কিন্তু চমৎকার। আমার ছেলে খুবই ভালো। হ্যাঁ, একসময় বখাটেপনা করেছে খুব। এখনো মাঝেমধ্যে হুটহাট বখাটে ছেলের মতো আচরণ করে। কিন্তু মনটা তো সুন্দর। সবচেয়ে বড় কথা আমার ছেলে যাকে ভালোবাসে, নিজেকে ভেঙেচুরে ভালোবাসে। বউকে কতটা মাথায় তুলে রাখবে সেটা ওর প্রেমিকার জন্য অবসেশন দেখে আন্দাজ করেছিস নিশ্চয়ই?”
— “আব্বু…”
— “এই দাঁড়া, আমি আগে শেষ করে নেই। আমার ছেলে দেখতে ভালো, ভালো জব করছে, মাস শেষে প্রায় লাখ টাকা ইনকাম করছে। অফিস থেকে ভালো সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে, আমি ঢাকায় একটা ফ্ল্যাট ওকে দিয়েছি। শ্বশুর-শাশুড়ির ঝামেলা নেই। দুই বুড়ো-বুড়ি থাকবো চট্টগ্রাম। তোর পড়া শেষ হলে তুইও চলে যাবি ওখানে। পুরো সংসারটা তো ওর একারই। আর কী চাই মেয়েপক্ষের? আর নবনী? লক্ষী মিশুক একটা মেয়ে। দেখতে সুন্দর, শিক্ষিত, নিজের বিজনেস আছে, ইনডিপেন্ডেন্ট। আমার ভাই-ভাবী, নাতাশা ওরা খুব ভালো। একটা ভালো পরিবার পাওয়া খুব ভাগ্যের ব্যাপার। ছেলেমেয়ে বিয়ে দেয়ার জন্য যা কিছু বাবা-মা চায়, সবই আছে ওদের মাঝে। সুতরাং কোনো পক্ষ করার কোনো প্রশ্নই উঠে না। আমি আমার ছেলের বিয়েতে খুব খুশি। তোমরা কেউ স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছো না তাই আমি চুপ হয়ে আছি। নয়তো এতক্ষণে ছেলের বউ বাসায় নিয়ে আসতাম। যা কিছু হয়েছে তাতে মন খারাপের কিছু নেই। বরং ভালো হয়েছে, খুব ভালো। তুমিই ভাবো শামীমা, ছেলেকে নিয়ে আমরা কত টেনশনে আছি দুইবছর যাবৎ। অমিত প্রচন্ড মানসিক চাপে আছে মুনিয়াকে নিয়ে। ওর সম্পর্কটা একজায়গায় থেমে আছে। আগায়ও না, পেছায়ও না। তুমি আমি তো চাইছিলাম সম্পর্কটা শেষ হয়ে যাক। ও নতুন কারো সঙ্গে জীবন গড়ুক, হয় নিজে পছন্দ করে নিক নয়তো আমরা পছন্দ করে একটা লক্ষী মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেই। ও মুনিয়ার গন্ডি থেকে বেরই হতে পারছিল না। কত মেয়ে দেখাতে চাইলাম, ও দেখেনি। কত বুঝিয়েছি, ও বোঝেনি। দুইবছর ধরে ঐ মেয়ে ওকে একটু একটু করে শেষ করছে, ওকে দেখে আমরা শেষ হচ্ছি। আপোষে তোমার ছেলে কখনো অন্য কাউকে বিয়ে করতো, বলো তুমি? করতো?”
ডানে বামে মাথা নাড়লেন শামীমা। স্ত্রীর কাঁধ জড়িয়ে এরশাদ বললেন,
— “ব্যস, আর কিছু ভেবো না। যা আমরা পারতাম না তা রমিজ বুড়া করে দেখিয়েছে। এখন শুধু ভাবো ছেলে আর বউয়ের একছাদের নিচে থাকার বন্দোবস্ত কিভাবে হবে?”
— “তুমি ব্যাপারটা যত সহজ ভাবছো, বাকি সবারও এতটাই সহজ ভাবতে হবে তাই না? ভাবী আমাকে আগেই না করে দিয়েছে। কেন না করলো তা ঠিক আমার জানা নেই। এমনও হতে পারে আমার ছেলেকে উনার পছন্দ না। কিংবা আমাদের পরিবার। আর রইলো কথা অমিত নবনীর। নতুন সম্পর্কের মূলই হলো ওরা দুজন। নবনী হয়তো অন্য কাউকে ভালোবাসে। আর অমিত? ও তো ডুবেই আছে মুনিয়ার মাঝে। সারাদিন মুন মুন করে মরে যায় তোমার ছেলে। নবনীর নাম আদৌ ওর মুখ থেকে বেরোবে, না ওর মনে কখনো নবনীকে জায়গা দেবে? পুরো ব্যাপারটাই ঘোলাটে অমিতের আব্বু। কিছুই ঠিক নেই। অন্তত মেয়েপক্ষের ওরা পজিটিভ হতো তাহলে হয়তো আমি এতটা ভাবতাম না। অমিতকে ব্ল্যাকমেইল করে, ঝগড়াঝাটি করে রাজি করিয়ে নিতাম।
— “আমিও এক্সাক্টলি আম্মুর কথাগুলোই বলতে চাইছি আব্বু। তবে আম্মুর শেষ কথাগুলোয়ও আমার আপত্তি আছে। ব্ল্যাকমেইল করবে মানে? ও কি ছোট? ৩৪ হয়ে গেছে ওর। এতবড় মানুষটাকে তোমরা ব্ল্যাকমেইল করলেই তো আর চলবে না। যতদিন না ও নিজে মুনিয়াকে মন থেকে বের করছে, ততদিন পর্যন্ত কিচ্ছু হবে না। জোর করে কখনো কাউকে মনে জায়গা দেয়া যায় না। তাছাড়া নবনী আপু এখনো উনার বয়ফ্রেন্ডকে মনে ধরে বসে আছে।”
— “বয়ফ্রেন্ড? রিলেশন আছে ওর?”
— “নাহ্ যার সঙ্গে রিলেশন ছিল তার কথা বলছি।
— “ওহ্! ঐ ছেলেটা। ও তো নেই। যে নেই তাকে নিয়ে ভেবে লাভ কী? ওকে আপাতত একটু সাইডে রাখি, কেমন?”
— “না আব্বু। সাইডে রাখা চলবে না। সে এই গল্পে একজন মেইন ক্যারেক্টার।”
— “মেইন ক্যারেক্টারকে নিয়ে তখনই ভাবতাম যদি সে বর্তমানে এখানে থাকতো। ও নেই অনি। যে নেই তাকে নিয়ে এত মাথাব্যাথারও কিছু নেই। ঐ ঘটনার আরো আট বছর কেটে গেছে। আটবছর কম সময় না।”
— “কিন্তু আপু তো উনাকে এখনো সেই আগের মতই ভালোবাসে। বরং ওর কথায় যা মনে হলো, আপু ভাবে ঐ মানুষটা এখনো ওর সঙ্গেই আছে।”
— “এতবছরে হয়তো নতুন কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায়নি ও। বা জীবনে এমন কিছু ঘটেনি যাতে সে ঐ ছেলেটার গন্ডি থেকে বেরিয়ে নিজেকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে পারে। আজ ওর জীবনে যা কিছু ঘটেছে এরপর কিন্তু আগের মতো আর সবকিছু নেই। অমিতের বউ সে। ওর প্রাক্তনকে নিয়ে যদি দিনে দশবার ভাবে, আমার অমিতকে নিয়ে অন্তত একবার হলেও ভাববে। ভাবতে ভাবতেই একটা গতি হবে।”
— “ইলজিক্যাল কথাবার্তা!”
— “তোর মা বিয়েতে রাজি ছিল না। বিয়ের প্রথম একমাস মনসার মতো ফসফস করতো। ধারে কাছে ঘেঁষতে দিতো না। এখন দেখতো, বাসায় ফিরতে দেরী হলে কয়বার কল করে আমাকে।
— “তোমাদের সিচুয়েশন আর ভাইয়ার সিচুয়েশন সেইম না। ওরা কেউ কাউকে ঠিকমতো চেনেই না, আর সবচেয়ে বড় কথা ওরা দু’জনই অন্য কাউকে নিয়ে অবসেসড।
— “আপাতত আমার কথা তোর পাগলামি মনে হবে। কিন্তু বিশ্বাস কর, একছাদের নিচে বাস করতে করতে দুজন দুজনে অভ্যস্থ হয়ে যাবে। মুনিয়ার কাছে তোর ভাই পাচ্ছে টা কী? দিনরাত নিয়ম করে লাখি গুতাই তো খাচ্ছে। চোখের সামনে সারাক্ষন একটা মেয়েকে যখন ঘুরঘুর করতে দেখবে তখন আপনাআপনিই একটু হলেও ওর সম্পর্কে তোর ভাইয়ের জানতে ইচ্ছে হবে, ওকে বুঝতে ইচ্ছে হবে। নবনী কি ফেলনা মেয়ে নাকি যে অমিতের ওকে চোখে পড়বে না? আর ঐ ছেলেটা তো নবনীর জীবনে এখন আর নেই। আমার ছেলে আছে। ওদের শক্তপোক্ত একটা সম্পর্কও হয়েছে। সম্পর্কের একটা জোর আছে না বল? ও যখন দেখবে ওর হাজবেন্ড অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্কে আছে তখন হিংসায় পাগল হয়ে দেখবি আমার ছেলের দিকে মন দিয়েছে। আরে হিংসা তো মেয়েদের কমন প্রবলেম। নবনীর হিংসা হবেই হবে, দেখে নিস তোরা।”
অনি, শামীমা দাঁতে দাঁত চেপে তাকালো এরশাদের দিকে।
জিভ কাটলেন এরশাদ সাহেব। মিনমিন করে বললেন,
— “আশ্চর্য! সব কথা ধরতে হবে কেন? মুখ ফসকে বলে ফেলেছি।”
— “আচ্ছা দিলাম বাদ। কথা শোনো, একছাদের নিচে বাস করার জন্য ওদের রাজি ও তো হতে হবে, তাই না?”
— “হবে, আমরা রাজি করাবো। কিন্তু আগে কথা বলবো মেয়েপক্ষের সঙ্গে। দেখি উনাদের মতামত কী।
— “যদি দিতে না চায়?”
— “না করবে বলে মনে হয় না। ফেরার পথে ভাই বলছিল, তোর অমিতকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমার নবনীর জন্য একদম পারফেক্ট। কিন্তু আমার মেয়েটা… ব্যস এতটুকুই বললো। উনি আর কথা বাড়াননি, আমিও আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি।”
— “অদ্ভুত কান্ড অমিতের আব্বু! তুমি জিজ্ঞেস কেন করলে না?”
— “কেন যে জিজ্ঞেস করলাম না নিজেও জানি না। সে যাই হোক, ওসব বাদ। বিয়ে হয়েই গেছে, চাইলেই বিয়ে ভাঙা যায় না। কাল সকালে আমরা যাবো, কথাবার্তা বলবো। তারপর একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে, বউ কবে নাগাদ আমরা বাসায় আনছি।”
— “আব্বু তুমি সিওর সব ঠিক হবে? সবটা তুমি সামলে নিতে পারবে?”
— “ধুর, মুখটা আর প্যাঁচার মতো করে রাখিস না তো। তোর ভাইয়ের বিয়ে, একটু হাসিখুশি থাক। এখন বল কী খাবি?”
শামীমা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন। এখন মনে হচ্ছে সব ঠিক হবে, চমৎকারভাবেই ঠিক হবে। যা কিছু হয়েছে তার পুরোটাই মন্দ হয়নি। মন্দের আড়ালে খুব ভালো কিছুও হয়েছে।
১২
নবনীদের ফ্ল্যাটে হঠাৎ করেই নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। এতটা সময় ধরে শফিক- নিতুর বেডরুম থেকে গুনগুন শব্দ ভেসে এলেও এখন আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। শফিক আর জামিলা বেগমকে মধ্যখানে রেখে চারদিকে চারজন দাঁড়িয়ে আছে। চারজনেরই দৃষ্টি আটকে আছে শফিকের দিকে। কী বলবে সে এখন? কী সিদ্ধান্ত নেবে?
— “একটা সিদ্ধান্ত নেও শফিক। এইভাবে তো আর হয় না।”
— “আমি নিজেও বুঝি তা হয় না। নবনীর বয়স আর দুইমাস বাদে ত্রিশ হবে। আমার ছোট মেয়েটাও ছাব্বিশে পা দিলো। দু’জনের বিয়ে নিয়েই আমি ভাবি। কিন্তু পরিস্থিতি কি আমার পক্ষে আছে? নবনীর সামনে বিয়ের কথা উচ্চারণ করার সাহসও আমার হয় না। চাইলে নাতাশাকে বিয়ে দিতে পারি। কিন্তু সমাজ আছে, আত্মীয়স্বজন আছে। দশটা মানুষ নিয়েই তো আমার চলতে হয়। নবনীকে রেখে নাতাশাকে তো আমি বিয়ে দিতে পারি না। কত কথা উঠবে তা তো আর আপনার অজানা না।
— “দেখো, এতদিন যা পরিস্থিতি ছিল তা কিন্তু পুরাটাই উল্টায়া গেছে। নতুন কইরা নবনীরে বিয়ার লাইগা রাজি করানোর কিছু নাই। এখন ওরে রাজি করাইতে হইব সংসারের লাইগা। যা হইছে তা মাইনা লওনের লাইগা।”
— “আমিও চাই আমার মেয়ের ঘর সংসার হোক। কিন্তু কিভাবে?”
বাবার সঙ্গে সঙ্গে নাতাশাও বলে উঠলো,
— “ঠিকই তো নানী। এই কথা আপুকে বলবো কিভাবে। চোখের সামনে দেখতেই পাচ্ছো আপু কেমন অসুস্থ হয়ে গেছে। সামি ভাইয়ার বাইরে আপু আর কিছুই ভাবতে পারে না। উনার মাঝেই ওর জীবন আটকে আছে। সামি ভাইয়াকে বাদ দিয়ে অন্য কারো সঙ্গে সংসারের কথা… কিভাবে সম্ভব?”
— “সামিরে কি আমি ভুলতে পারছি? তোরা কেউ পারছোস? মরার আগ পর্যন্ত ওরে ভুলা সম্ভব না। তাই বইলা তো জীবন থামায়া রাখা যাইবো না। নবনী যেহেতু বাঁইচা আছে, জীবন তো তারে চালাইতে হইব। আট বছর সময় তো কম না রে নাতাশা। নবনী সামিরে মনে ধইরা সারাজীবন কাটাইতে চাইলো, আমরাও ওরে তাই করতে দিতাছি। কেউ কি কখনো সময় নিয়া ওরে বুঝাইছি, এইবার তোর আগানো উচিত। একে তো মনে সবার ভয় ছিল নবনীরে এসব কইলে না আবার কোন কেলেংকারী ঘটে। আর সবচেয়ে বড় কথা হইলো সামিরে আমরাই এখনো এক সুতাও ভুলতে পারি নাই, সেইখানে নবনীরে সব ভুইলা আগাইতে আর কী কমু? এখন যেহেতু ঘটনা ঘইটাই গেছে সেইটা মাইনা নেয়াই মঙ্গল। মনডারে এইবার আমগো শক্ত করতে হইবো, নবনীর ভালোর লাইগাই করতে হইবো। এছাড়া আর পথ খোলাও তো নাই।”
নীতু বলল,
— “চোখে মুখে এখনও আমি অন্ধকারই দেখছি আম্মা। রিনি একদম ওর মায়ের মতই হয়েছে। অসভ্য ইতর স্বভাবের। একে তো সোশ্যাল মিডিয়ায় অমিত-নবনীর বিয়ের ভিডিও আপলোড করেছে, তার উপর জনে জনে কল করে বলছে, কুকর্ম করতে গিয়ে ধরা খেয়েছে ওরা। তাই ধরে-বেঁধে বিয়ে দিয়েছে। আত্মীয়রা ছিঃ ছিঃ করছে আম্মা। শফিককে আর আমাকে ফোন করে যা তা বলছে। শামীমা ভাবী কল করেছিল। বললো, উনাদেরও নাকি বাজে সব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এমন বিপদের সময় আত্মীয়রা কোথায় পাশে দাঁড়াবে, তা না! উল্টো আমাদের পেরেশানি আরো বাড়াচ্ছে। তোমাকে আমি না করে দিলাম নবনীর আব্বু, তোমার ভাই বউ আর ভাতিজি যেন আর কখনও আমার বাসায় পা না রাখে। আমার সামনেও যেন না। রিনিকে সামনে পেলে কষে চড় লাগাবো আমি।
— “ইশ! থাপ্রাথাপ্রি পরে করিস। আগে ঘর কেমনে সামলাবি সেইটা ভাব।”
— “নানী, আপু রাজি হবে না। উল্টো সবকিছু আরো নাগালের বাইরে চলে যাবে।
— “তোর মতে আর কোনো পথ আছে? দেখা আমারে?”
- ……………….
— “এই যে চুপ কইরা আছোস। পথও দেখাবি না, আবার আমার দেখানো পথে চলবিও না। তা তো হয় না রে ময়না। নবনীরে আমরা সবাই মিলামিশা বুঝামু দরকার পরলে ওরে আমরা সময় দিমু। জামাইরও তো ওরে বুঝার দরকার আছে।”
— “নবনীর যে সমস্যা, তার কী হবে?”
— “সেইটা নিয়া আমিও একটু ভাবতাছি। তার উপর জামাইরও নাকি কার সঙ্গে প্রেম-ভালোবাসা আছে। এক্কেরে গোঁজামিল কান্ড! কেমনে যে কী হইব নিজেও হিসাব মিলাইতে পারতাছি না। তবে আশাও ছাড়তাছি না। দুইটারে এক বাসায় রাখা হোক। একলগে থাকতে থাকতে মায়া মহব্বত হইবোই। আরে চোখের সামনে বহুদিন একটা গাছ পইড়া থাকলেও তো মায়া লাইগা যায়। আর ওরা তো জ্বলজ্যান্ত মানুষ।”
— “আম্মা, যদি কখনো কোনো টানই ওদের মাঝে তৈরী না হয়, তখন?”
— “দ্যাখ শিপন, বিয়া হইছে সেইটা সারা দুনিয়া এখন জানে। ওরা কুকাম করতে গিয়া ধরা খাইছে সেইটাও সারা দুনিয়া জানে। এখন যদি আমরা তালাক্ব নিয়া ফিরায়াও নিয়া আসি তাতে কিন্তু ওগো গায়ের উপর থেইকা “বিয়াত্তা” সিল উইঠা যাইবো না। ওরা কুকাম করছে সেইটাও মানুষ ভুলবো না। বরং আরো একটা খারাপ শব্দ ওগো লগে জুড়বো ওরা তালাকপ্রাপ্ত। কতাডা শুনতে খুব ভাল্লাগবো? একটুও না। তার চেয়ে বরং থাকুক একলগে, মায়া মহব্বত হইলেও হইতে পারে। হইয়া গেলে ভালো, আমগো চিন্তা শেষ হইব। ‘ওগো সুন্দর একটা গতি হইব। সুযোগ যেহেতু আছে সেইটা আমরা কামে কেন লাগামু না? আর না হইলে কী হইব সেইটা আমি আপাতত ভাবতে চাইতাছি না। আমি এহন খারাপ কুনু কতাই মাথায় আনমু না।”
— “তাহলে আম্মা আমি কি এরশাদকে কল করবো? দেখি ওরা কী বলে?”
— “হ দেও। ফোনে কতা না কইয়া জামাইসহ বাসায় আইতে কও। সামনাসামনি কতা হউক।”
— “কিন্তু নানী…”
— “ঐ ছেড়ি এত বাগড়া দিবি না তো। নানী কী কইতাছি ঐডা শোন। তোরে নবনী অত্যাধিক আদর করে, তুই কিছু কইলে ঠান্ডা মাথায় শুনবো। আমি ওর লগে যখন কতা কইতে বসমু, তুইও আমার লগে থাকবি। ওরে বুঝাইবি।”
নানীর প্রস্তাবে প্রবলভাবে সায় দিতে ইচ্ছে হলেও কী যেন বাঁধ সাধছে নাতাশাকে। কী সেই বাঁধ? সামির প্রতি অগাধ মায়া নাকি অপ্রত্যাশিত সম্পর্কের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ?
১৩
ড্রইংরুমে বসে আছে দুই পরিবার। কাজের মেয়ে শান্তা অনেক আগেই চা-নাস্তা রেখে গেলেও কেউই মুখে কিছু তোলেনি। পুরো ঘরের সবাইকে দুশ্চিন্তায় দেখা গেলেও, একমাত্র ফুরফুরে মেজাজে আছেন এরশাদ সাহেব। হাসি যেন তার মুখ থেকে সরছেই না। তার প্রিয় মোগলাই পরোটা সুন্দর পিস করে টেবিলে সাজানো আছে, সঙ্গে আছে শসা-টমেটোর মাখানো সালাদও। একটা বিকেল অতি মধুর হবার জন্য এরচেয়ে বেশি আর কী চাই? তার উপর কাজের মেয়েটা নাস্তা সাজানোর সময় বলে গেল সমস্ত খাবার হোমমেড। এই বাসার সবাই টেনশন করতে করতে তাকে খাবারের জন্য সাধাসাধি করার কথা একদম ভুলে গেছে। এতটা সময় তাদের আপ্যায়নের আশায় বসে থাকতে থাকতে চোখের সামনে গরম মোগলাইগুলো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। চোখে এই দৃশ্য সয়ে নেয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। লাজ লজ্জার বালাই ঝেড়ে প্লেট হাতে নিয়ে জামিলা বেগমের দিকে এগিয়ে বললেন,
— “খালাম্মা আপনি আগে নিন।”
জিভ কাটলেন জামিলা। কপাল চাপড়ে বললেন,
— “আয়হায়! খাওনের কতা ভুইলাই গেছি। আমার বাড়ি আইছো তোমরা, আমরা তোমগো বাটিতে খাওন তুইলা দিমু। তুমি উল্টা আমারে দিতাছো। কী বিতিকিচ্ছিরি কান্ড!”
— “আপনার আর আমার ঘর কি এখন আলাদা? আমরা তো একই পরিবারের
সদস্য। উচ্ছ্বাস ভরা হাসিতে মোগলাই পরোটায় কামড় বসালেন এরশাদ সাহেব। অবাক হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন শফিক। এমন মুহূর্তেও একটা লোক এত আনন্দে কী করে থাকতে পারে? মানুষের মনে এত আনন্দ আসে কোত্থেকে? চারদিকের এত বাজে কথা শোনা সত্ত্বেও কী করে সম্ভব? সে কেন পারে না এরশাদের মতো এত আনন্দে বাঁচতে? কেন দুশ্চিন্তায় তার বিছানায় পড়ার যোগাড় হয়? — “ভাই জরুরি কথা ছিল। আমার নবনীর জটিল সমস্যা আছে।”
— “জটিলকে আমি সহজ বানিয়ে ফেলব ভাবী। এত ভাবাভাবির কিছু নেই।”
— “সমস্যা একটু বেশিই। আপনাদের জানা দরকার।”
— “এত কথা আর জেনে লাভ কী? বিয়ে হয়ে গেছে, এখন আর ওসব জেনে কাজ নেই।”
— “আপনি শুনুন আগে। নবনীর মে… মেয়ের নির্বুদ্ধিতায় ভীষণ রাগ হলো জামিলা বেগমের। নীতু পুরো কথা বলার আগেই ওপাশ থেকে ধমকে উঠলেন তিনি,
— “কথা কইতেই আছোস! কথা কওনের সময় কি গেছেগা? মেহমানগো আগে ভালোমতো আপ্যায়ন কর। রাইতে ওগো খাওনোর বন্দোবস্ত কর। যা, রান্নাঘরে যা। কী কী কুটাবাছা করতে হইব শান্তারে গিয়া বুঝাইয়া দিয়া আয়।
এরশাদ সাহেব বাঁধ সাধলেন।
— “আজ নাস্তা পর্যন্তই থাকুক। আমরা অন্যদিন এসে ডিনার করব।”
— “না ভাই, তা কী করে হয়? কতবছর পর এসেছেন মেয়ে বউ নিয়ে। না খাইয়ে বিদায় করব নাকি?”
আজ আর ঝামেলা বাড়াতে চাইলো না শামীমা। স্বামীর মতন সেও জোর গলায় নীতুকে বললো,
— “ভাবি আজ বাদ দিন। খুব টেনশনে আছি, এখন খাওয়া-দাওয়া চলবে না। সব মিটে যাক, নবনীকে আমরা যেদিন নিতে আসব সেদিন নাহয় খাওয়া-দাওয়া হবে।”
— “শামীমা, থাকো রাত পর্যন্ত। খাওয়া-দাওয়া করে তারপর যাও।”
— “অবশ্যই খাবো। কিন্তু আজ না, আরেকদিন। আপনারা নবনীকে বুঝিয়ে দেখুন। রাজি হয়ে গেলে ভালো। আমরাও অমিতকে দেখছি। জলদি জলদি নবনীকে বাসায় নিয়ে যেতে পারলেই হলো। আচ্ছা আমি কি একবার নবনীর সঙ্গে দেখা করতে পারব?”
— “নবনী অসুস্থ, ঘুমাচ্ছে ওর ঘরে।
— “অমিতও অসুস্থ। গতরাতে মাথা ঘুরে, বমি করে বাজে অবস্থা। প্রেশার লো হয়ে গেছে তার, আজ অফিসেও যায়নি। মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারছে না। ওকে খালি বাসায় রেখেই চলে এসেছি। এবার আমরা উঠি। আপনার ফোনের অপেক্ষায় থাকবো।”
*****
গায়ে ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়েছে বেশ সময় পেরোলো। দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে এলোমেলো চুল আর ক্লান্ত চেহারার বিধ্বস্ত নবনী। গতকাল থেকে পেটে ঠিকমতো কিছু পড়েনি। জ্বরের ধকল আরো দুর্বল করে দিয়েছে তাকে। প্ৰায় বুজে আসা চোখে তাকিয়ে আছে সে সামির দিকে। জানালার গ্রিলে এসে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে সেই কখন! জ্বর ছাড়ার আরো আগে। এতটা সময় ধরে কিছুই বললো না সে। চুপচাপ নিষ্পলক তাকিয়ে আছে তার দিকে। সদা সর্বদা জাগতিক সব ধরনের সমস্যা সমাধানের ঝুলি নিয়ে যে মানুষটা ঘুরে ফিরে বেড়ায়, যে মানুষটা শত শত সমস্যার সমাধান তুড়ি বাজিয়ে করে দিলো সে আজ চুপ। প্রিয়তমার ঘোর বিপদের দিনে সে চুপ। কেন? জানতে ইচ্ছে হয় নবনীর। তবে মুখ ফুটে বলতে ইচ্ছে হয় না। গলায় তার ভীষণ ব্যথা। গতকাল চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে গলা ভেঙেছে। গতকালের গলা ব্যথা এখনও ছেড়ে যায়নি, মনের ব্যাথাও না। কবে নাগাদ এই বিচ্ছিরি ব্যথা তাকে ছেড়ে যাবে, কে জানে!
১৪
সকাল থেকেই একটু আধটু শরীর খারাপ লাগছিল শফিক সাহেবের। মেয়ের দুশ্চিন্তায় সেদিকে পাত্তা দেয়া হয়নি তার। রাত গড়াতে গড়াতে শারীরিক অবস্থায় আরো অবনতি হলো। রাত এগারোটা বাজবার একটু আগেও শালার সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি, শরীর খারাপ লাগছে বলে উঠে আসছিলেন নিজের ঘরের দিকে; চলতে চলতে হঠাৎ পড়ে গেলেন ফ্লোরে। দেরী না করে শিপন, নিতু আর সুমি তাকে নিয়ে ছুটলো হসপিটালে। বাসায় নবনীকে রেখে গেল নাতাশা আর জামিলা বেগমের কাছে। হেঁচকি তুলে কাঁদছে নবনী। কয়েকবার শিপন মামাকে কল করেও কোনো খোঁজ পায়নি নাতাশা। বাবাকে নিয়েই হয়তো ছুটোছুটি চলছে। পৃথিবীর সমস্ত অসহায়ত্ব বুঝি এই ঘরটায় বিধাতা ঢেলে দিয়েছেন। চোখের সামনে অসুস্থ বোন বাচ্চাদের মতো বসে বসে কাঁদছে, তাকে স্বান্তনা দেবার মতো কিংবা সাহস যোগাবার মতন মানসিক অবস্থা নিজেরও যে নেই! এই তো গেল মাসেই বান্ধবীর বাবা মারা গেল। ভদ্রলোকও ওর বাবার মতই কথা বলছিলেন স্ত্রীর সঙ্গে। শরীর খারাপ লাগছে বলে একগ্লাস পানি চাইলেন। স্ত্রী পানি নিয়ে ফিরতে ফিরতে লোকটা ফ্লোরে পড়ে রইলো, আর উঠলো না। তরতাজা মানুষটা পাড়ি জমালো পরপারে। নাতাশার হাত-পা ভয়ে কাঁপছে। গলা শুকিয়ে আসছে বারবার। বাবা আবার বাড়ি ফিরবে তো?
একমনে দরূদ শরীফ পড়ে যাচ্ছেন জামিলা বেগম। ভীষণ নরম স্বভাবের মানুষ হলেও, বিপদের দিনগুলোতে সবচেয়ে বেশি শক্ত থাকতে তাকেই দেখা যায়। আজ পর্যন্ত কেউ কখনো তাকে দেখেনি বিপদে ভেঙে পড়তে, কিংবা কেঁদে কেটে চোখের জলে ভাসতে। উপরওয়ালার প্রতি অগাধ বিশ্বাস তার। তিনি জানেন, উপরওয়ালা তার বিশ্বাস ভাঙবে না। বিপদের এই সময়টা কেটে যাবে, খুব শিগগিরই কেটে যাবে। ভালো কিছু হবে, অবশ্যই হবে।
দীর্ঘ অপেক্ষা বাদে কল এলো নাতাশার মোবাইলে। শিপন মামা কল করেছে। তড়িঘড়ি করে রিসিভ করলো নাতাশা,
— “কখন থেকে কল করছি তোমাকে!”
— “কল রিসিভ করার অবস্থায় আছি নাকি!”
— “আব্বু কেমন আছে?”
— “দুলাভাইর মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছে। থাকতে হবে হসপিটালে। আমরা আজ এখানেই থাকবো। নবনীকে তোরা দেখে রাখিস।” —
— “আব্বু ঠিক আছে তো, না? চিনতে পারছে সবাইকে? হাত-পা নাড়াতে পারছে?”
— “সব ঠিক আছে। টেনশন করিস না।”
— “মামা তুমি কথা লুকাচ্ছো না তো?”
— “কথা কেন লুকাতে যাব? হাবিজাবি কথা ভেবে নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়িস না।
এত বিপদ আপদ আর ভালো লাগছে না। ঐ কুত্তা রমিজের জন্যই আজ এতকিছু হয়ে যাচ্ছে। রাত অনেক হয়েছে, এখন একটু ঘুমা। আর কোনো সমস্যা হলে কল করিস।”
নাতাশার দিকে ব্যাকুল হয়ে তাকিয়ে আছে জামিলা বেগম আর নবনী। কল কেটে মিনমিন করে সে বললো,
— “মাইল্ড স্ট্রোক!”
*****
— “বাসার সামনে এসে এভাবে চিৎকার করার মানে কী, অমিত?”
রাত দেড়টা। মুনিয়ার বাসার ড্রইংরুমে বসে আছে অমিত। মুনিয়া আর তার মা, বোন, তিনজনই অমিতের দিকে পাহাড়সম রাগ আর বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে। এই তিনজনের কাছে আজকাল সে বড্ড অপ্রয়োজনীয়, বিরক্তিকর এবং ছ্যাঁচড়া প্রজাতির একজন মানুষ। তার কাছ থেকে পিছু ছাড়ানো গেলেই যেন এরা হাফ ছেড়ে বাঁচে, সেসব অমিতের অজানা নয়। এই তো রাত দেড়টায় মুনিয়ার বাসায় এসে উঠেছে, তাতেও কেউ খুশি নয় সে কথাও অমিত জানে। এতে অমিতের কিছুই যায় আসে না। মুনিয়াকে না দেখে থাকা যে ভীষণ কষ্টের হয়ে যাচ্ছিল! ঐ ঘটনার পর থেকে মুনিয়াকে হারাবার ভয় তাকে প্রতিমুহূর্তে মেরে ফেলছে, সে কথা কে বোঝাবে মুনিয়াকে? কঠিন সময়গুলোতে ভালোবাসার মানুষের একটুখানি স্পর্শ টনিকের মতো কাজ করে, মুনিয়াই তো বলেছিল সে কথা। অনেকগুলো দিন আগে যখন সম্পর্কের বসন্তকাল ছিল, তখন মুনিয়ার মন খারাপ হলেই জরুরি তলব করে নিয়ে আসতো পুরোনো সেই এক কামড়ার ফ্ল্যাটটাতে। মন ভালো করার বাহানায় লেপ্টে থাকতো অমিতের বুকে। সেকেন্ড গড়িয়ে মিনিট হতো, মিনিট পেরিয়ে ঘন্টা, ঘন্টা পেরিয়ে গোটা একবেলা। স্নিগ্ধ আলিঙ্গন থেকে গভীর স্পর্শ, গভীর স্পর্শ থেকে গাঢ় চুমু, গাঢ় চুমু থেকে আদিম খেলায় মেতে উঠা। সম্পর্কের বসন্তকাল ফুরিয়ে গেছে কবেই, অতখানি আশা মুনিয়াকে ঘিরে অমিতের জাগে না। শুধু একটুখানি আদুরে গলার ডাক, আর তুলতুলে হাতজোড়ার আলতো স্পর্শ। ব্যস! তার সমস্ত বিষণ্নতা ধুয়ে মুছে বিদায় হবার জন্য এতটুকুই কি যথেষ্ট না?
.
— “এখন কেন মুখ থেকে কথা বেরোচ্ছে না? খুব তো নিচে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছিলে, তোমার সঙ্গে দেখা না করলে কেলেংকারী ঘটে যাবে!”
— “তো আর কিইবা করার ছিল আমার? কবে থেকে দেখা করতে চাইছি অথচ তুমি দেখাই করতে চাও না। কলও রিসিভ করো না। কোনো একভাবে তোমার সঙ্গে আমার দেখা তো করতে হবে!”
— “তাই বলে আমার বাসার সামনে এসে চিৎকার করবি? বাস্টার্ড একটা! তোর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছি, তুই করিসনি। কাজের ব্যস্ততা দেখিয়েছিস। তোকে কল করেছি, সুইচ অফ করে রেখেছিস; ম্যাসেজ সিন করেও কোনো রিপ্লাই দিসনি। এবার তুই বল তোর কল আমি কেন রিসিভ করব?”
— “মুনিয়া আমি ঢাকায় ছিলাম না। আউট অফ নেটওয়ার্ক ছিলাম। ম্যাসেজ সিন করে রিপ্লাই দেইনি কারণ রিপ্লাই দেয়ার মতো সিচুয়েশনে তখন আমি ছিলাম না।”
— “আহারে! সিচুয়েশন ছিল না কেন রে? তোর বাপ-মা মরে গেছে? লাশ কবরে নামাচ্ছিলি?”
— “মা-বাবাকে কেন টানছো?”
— “যেই মহিলা ছেলে জন্ম দিয়ে রাস্তায় ছেড়ে দেয় রাত দেড়টায় চিৎকার চেঁচামেচি করে একটা মেয়েকে ব্ল্যাকমেইল করার জন্য, তার জন্য এরচেয়ে ভালো কিছু আমি বলতে পারছি না।”
— “আমি তোমাকে একটুখানি দেখতে চেয়েছি মুন! বেশিকিছু তো চাইনি। এত
ভালোবাসি তোমাকে, এতটুকু দাবি কি আমি করতে পারি না? তাই বলে এতকিছু শোনাবে তুমি আমাকে?”
মুনিয়ার পক্ষ টেনে তার বোন বললো,
— “আপনি আমার বোনকে কেন দোষ দিচ্ছেন?”
— “তোমার কি মনে হয় জিনিয়া, ও যা কিছু বলছে তাতে ওর কোনো অন্যায় নেই?”
— “না নেই। কারণ শুরুটা আপনি করেছেন। আপনি কেন বাসার নিচে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলেন? এত সাহস কী করে হয় আপনার? আপনার কাছে কি মনে হয় না আপনি ওর রেপুটেশন নষ্ট করার মতো একটা কাজ করেছেন?”
.
এতটা সময় ধরে দাঁতে দাঁত চেপে অমিতকে শুনছিলেন মুনিয়ার মা। ছেলেটাকে ভীষণ অসহ্য লাগে তার। শিল্পপতি, মন্ত্রীর ছেলেরা তার মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে যেতে ইচ্ছুক। অথচ এই ছেলেটার জন্য একটা ভালো ঘরের ছেলের সঙ্গে সম্পর্কে এগোতে পারছে না তার মেয়ে। তার উপর যখন-তখন কিসব কান্ড করে বসে, কখন আবার মেয়েটার এতদিনের শ্রমে গড়া ক্যারিয়ারটাই ডুবে যায়, কে জানে! কম বয়সে ছেলেমেয়েরা ভুল করবে, এই তো স্বাভাবিক। তবে তার মেয়ে তখন এতটাও ছোট তো ছিল না। ২০-২২ বছর বয়সে এই ছেলেটার সঙ্গে প্রেম করার মতো ভুল করলো কেমন করে সে হিসেবটাই মিলিয়ে পান না মুনিয়ার মা। চোখ রাঙিয়ে, শীতল কন্ঠে তিনি অমিতকে বললেন,
— “আমার মেয়ে একজন সেলিব্রিটি। এলাকার প্রত্যেকে জানে এই এ্যাপার্টমেন্টে মডেল মুনিয়া থাকে। তাছাড়া এটা ভদ্রলোকেদের পাড়া। এখানে কোনো বস্তির লোক থাকে না যে রাত দেড়টায় কেউ এসে চিৎকার চেঁচামেচি করলেই সবাই ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে নেবে।”
— “আমি যত চাই সম্পর্কটা সবার চোখের আড়ালে রাখতে, তুই ততই চাস সবার সামনে প্রেম জাহির করতে। তোর নিয়ত আমি জানি না ভেবেছিস? আমার ক্যারিয়ার নষ্ট করে ঘরে বসাতে চাস। সেই সুযোগে আমাকে বিয়ে করে পেটে বাচ্চা দিয়ে চিরতরে দাসী বানিয়ে রাখতে চাস। একবার তো পেটে দিয়েছিস ও একটা। প্রোটেকশন নেয়া সত্ত্বেও আমি কনসিভ করলাম কেমন করে? তোর কারসাজি ছিল সব। তুই আমার সঙ্গে যা খুশি করে পার পেয়ে যাবি ভেবেছিস? তোর খুশিমতো সব হবে? এত সহজে তোর কাছে আমি ধরা দেবো না। কালই তোর নামে আমি থানায় জিডি করবো। আমার তিল তিল করে গড়া ক্যারিয়ার। তোর মতো দুই পয়সার লোকের হাতে নষ্ট হতে দেবো না। তোর সঙ্গে আমার ব্রেকআপ মানে ব্রেকআপ।”
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে চলে গেল মুনিয়া। রাগে কটমট করতে করতে বোনের পেছন পেছন ছুটলো জিনিয়া। পায়ের উপর পা তুলে বেশ জমিদারী কায়দায় সোফায় বসলো মুনিয়ার মা।
— “তুমি আসলে একটা গন্ডার। এভাবে বলতে চাইনি, তবে বাধ্য হয়ে বলছি। মুনিয়ার সঙ্গে তোমার যা কিছু চলছে এরমাঝে আমি কখনোই তোমাকে মুখোমুখি কিছু বলিনি। কিন্তু আজ বলতেই হবে। এই সম্পর্ক মুনিয়া আর বয়ে বেড়াতে চাইছে না। অনাকাঙ্খিত সম্পর্ক আর মানুষ দুটোই বোঝা। তোমাকে গন্ডার কেন বললাম জানো? মুনিয়া এত কিছু বলে তোমাকে, তবুও ওর সঙ্গে তোমার সম্পর্ক রাখা চাই। আজও কত কী বলে ফেললো, তবুও তুমি এখনো এখানেই বসে আছো। লজ্জা নেই তোমার? কখনো ভেবে দেখেছো, মুনিয়ার পাশে তোমাকে মানায় কি না? তোমার মাস শেষে ইনকাম কত হয়? লাখখানেক? ওর পেছনে দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ীরা ঘোরে। তাদের ইনকাম সম্পর্কে আইডিয়া আছে তোমার? নিজেকে দেখো একবার আয়নায়। দিনদিন কী হাল হচ্ছে তোমার? বয়স হওয়ার আগেই বুড়ো হয়ে যাচ্ছো। মানানসইয়ের একটা ব্যাপার থাকে অমিত। এটা তোমাকে বুঝতে হবে। এসব পাগলামি ছাড়ো। আমার মেয়েকে ওর মতো থাকতে দাও। তুমি আমাদের কঠিন মাথাব্যথায় পরিণত হয়েছো। এবার আমাদের মুক্তি দাও।”
.
অমিতের চোখে পানি ছলছল করছে। মাথা নিচু করে সে বেরিয়ে এল মুনিয়ার ফ্ল্যাট থেকে। অপমান, অবহেলার পাহাড় জমতে জমতে যেন আকাশ ছোঁয়া হচ্ছে। খুব করে ইচ্ছে হয় মুনিয়াকে ঘৃণা করতে, তাকে ছাড়া বাঁচতে, তাকে ছাড়া হাসতে। মায়াজাল থেকে অমিত বেরোতে পারে না কিছুতেই। দেয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে তার মরে যেতে ইচ্ছে হয়, যন্ত্রণা থেকে চিরতরে মুক্তি নিতে ইচ্ছে হয়। এই মায়ার ইতি কোথায়? মুনিয়া নামক বদঅভ্যেসের অন্ত কোথায়?
*****
গুটিসুটি মেরে নবনী বিছানায়া শুয়ে আছে। পাশেই বসে তসবিহ জপছেন জামিলা বেগম। তার একহাত টেনে নিজের গালের সঙ্গে মেশালো নবনী। তসবীহ বালিশের কোনায় রেখে নাতনীর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জামিলা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,
— “কিছু কইবা টিয়াপাখি?”
— “আমার কারণে বাবার এই অবস্থা। আমার একটা ভুলের জন্য কতগুলো মানুষ ভুগছে।”
— “নিজেরে আর দোষ দিও না। যা হওয়ার হইছে, সেইটা আর বদলানো যাইব না। কিন্তু তুমি চাইলে যা কিছু ঘটছে সেইটারে সুন্দর করতে পারো।” —
— “মানে?”
— “শফিক তোমারে খুব ভালোবাসে। প্রথম যখন তোমারে কোলে নিলো খুশিতে কাইন্দা দিছিল। তারপর কইলো কি, আজ থেইকা আমার সারা দুনিয়া একদিকে, আমার এই ছোট পুতুল আরেকদিকে। দিনরাইত খালি তোমার মুখের দিকে তাকায়া থাকতো। কতক্ষণ পরপর আমারে, নীতুরে তোমার হাত-পা, চোখ, মুখের গড়ন দেখায়া জিগাইতো, দেখেন তো আমার সঙ্গে মিলে কি না? যদি কইতাম তুমি দেখতে নীতুর মতো বা হাত-পা হইছে তোমার দাদীর মতন তাইলেই মুখটা কালা কইরা ফালাইতো। তোমারে নিয়া তার কত চিন্তা! শফিক যে তোমারে নিয়া পাগলামি করতো আমার দেইখা খুব মায়া লাগতো। প্রথমবার বাপ হইলে পরে কাউরে এমন পাগলামি করতে ঐ প্রথম আমি শফিকরেই দেখছিলাম। আহা! ঐ দিনগুলা মনে হইলে আমার কেমন হাহাকার লাগে। মনে হয় ক্যান গেলোগা দিন?”
নবনীর চোখের কোন বেয়ে পানি ঝরছে। শাড়ীর আঁচলে নাতনীর চোখ মুছে দিলেন জামিলা বেগম।
— “বছর ঘুরছে, তোমার বয়স বাড়ছে। শফিকের ছোট পুতুল বড় হইছে। কিন্তু শফিকের ভালোবাসা আজ অব্দি তিল পরিমাণও কমে নাই। এখনো এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালো সে তোমারেই বাসে।”
— “অথচ সেই মানুষটা আজ হসপিটালে পড়ে আছে আমার কারণে।
— “বাপের এই অবস্থা থেকে মুক্তিও তুমিই দিতে পারবা।”
— “কিভাবে নানী?”
— “যা কমু মন দিয়া শুনবা? আগেই পাগলামি করবা না তো?”
— “বলো তুমি।”
— “তোমার বিয়া হইছে এইটা নিয়া শফিক যতটুক না চিন্তা করতাছে, তার চেয়ে বেশি ধাক্কা খাইছে আত্মীয়গো মইধ্যে তোমারে নিয়া কুকতা শোনার কারণে। তুমি ফিরলা যেদিন, সেদিন সন্ধ্যার পর থেইকা শফিকরে এইজন সেইজন ফোন দিয়া বাজে কতা জিগাইতাছে। বয়স হইছে জামাইর, মাইয়্যার নামে কুকতা শুইনা সহ্য করার মতো ক্ষমতা তার নাই। এই ধকল আরো বাড়বো। মানুষের মুখ বন্ধ হইব না, শফিক সুস্থও হইবো না।”
— “তাহলে উপায়?”
— “উপায় একটা আছে। আমি অনেক হিসাব-নিকাশ কইরা একটা পথ পাইছি। কতটুক কাজ হইব জানি না, তুমি রাজি হইবা কি না তাও জানি না। কিন্তু একটা সুযোগ নেয়াই যায়।”
— “আমি রাজি। আব্বুকে সুস্থ করার জন্য যা দরকার আমি করবো।”
— “তোমারে এই অবস্থা কইরা বিয়া দিছে শুইনাই শফিক লাফ দিছিলো রমিজের নামে মামলা দিবো, তোমাগো দুইজনরে তালাক্ব করাইবো। মামলা করলে আরো মানুষের কানে এইসব যাইব, আর তালাক্ব নিলে মানুষ আরো ছিঃ ছিঃ করবো। তোমগো মইধ্যে কিছু হয় নাই এই কতা কেউ বিশ্বাস করবো না। কারণ মানুষ খারাপ কতা বিশ্বাস করতে পছন্দ করে, শুইন্যা মজা পায়। এহন যদি তালাক্ব দেও তাইলে মানুষ আরো বেশি কইরা ঘাটাইবো। আরো বেশি কইরা ছিঃ ছিঃ করবো। তোমার ছোট বইনও বিয়ার উপযুক্ত। ঘরে বড় ভাই-বইন কারো তালাক্ব হইলে ছোটগুলারে বিয়া দেওন যায় না। মানুষ আত্মীয়তা করতে চায় না। তার উপর তোমার হইছে কলংকের বিয়া, আবার যদি পরদিনই গিয়া তালাক্ব দেও তাইলে বুঝতাছো কী হইবো? নাতাশারে বিয়া দিতে বেগ পাইতে হইব, শফিকও এইসব মানসিক চাপে আরো অসুস্থ হইব। বড় ইস্টোকও হইতে পারে।”
— “তুমি কি বলতে চাইছো আমি ঐ লোকের সঙ্গে সংসার করি?”
— “না, তা কমু ক্যান? আমি কি জানি না তুমি সামিরে কেমন ভালোবাসো? অন্য কাউরে তুমি কেমনে স্বামী বইলা মাইনা নিবা?”
— “তাহলে করবোটা কী?”
— “সংসারের নাটক। ছয়মাস তুমি ঐ বাসায় থাকবা। মানুষরে আমরা কমু তোমগো প্রেম ছিল, গোপনে বিয়া তোমরা আগেই সারছো। অমিত প্রমোশনের অপেক্ষায় ছিল, তুমিও তোমার বুটিক আরো বড় করার পরিকল্পনায় ছিলা। দুইজনের দুইদিক গোছানো হইলেই তোমরা নিজেগো কতা সবাইরে জানাইতা।”
— “তুমি কি পাগল?”
— “পাগলামির কী দেখলা?”
— “মিথ্যা কেন বলবো আমরা? আমি তো উনাকে ঠিকমতো চিনিই না। আর একবাসায় থেকে সংসারের নাটক করব মানে? এমন হয় নাকি কখনো? উনার সঙ্গে একরুমে থাকা অসম্ভব!”
— “একরুমে কে থাকতে কইছে? থাকবা তো আলাদা। বাসায় অমিতের বইন আছে, দরকার লাগলে নাতাশাও তোমার লগে থাকবো। ভয়ের কিছু নাই। তুমি খালি ঐ বাসায় থাকবা। মেহমান গেলে অমিতের পাশে একটু বসবা, মাঝেমধ্যে আত্মীয়স্বজনের অনুষ্ঠানে যাইবা। ব্যস, এইটুকুনই। ততদিনে নাতাশারও একটা বিয়ার ব্যবস্থা আমরা কইরা ফালামু। তাইলেই আর এত ঝামেলা পোহাইতে হইবো না। তোমার বাপেরও এত পেরেশান হইতে হইব না।”
— “খুবই বাজে সলিউশন।”
— “যেই যেই সমস্যাগুলা হওনের ভয় আমি পাইতাছি সেইগুলা কি মিছা? তুমিই কও।”
— “তা মিথ্যা না। এমন হবে তা তো বোঝাই যাচ্ছে।”
— “তাইলে নিস্তার পাওনের পথ দেখাও।”
— “তাই বলে এসব করতে হবে?”
— “দ্যাখো নবনী, সেই ছোট থেইকা আমরা তোমারে আগলায় রাখছি। তুমি সুখে থাকবা যেমনে, অমনেই সব করছি। তুমি কষ্ট পাইবা এমন কিছু কোনোদিন করি নাই। সামি চইলা যাওনের পর তোমারে সুস্থ করতে যে যা করতে কইছে তাই করছি। যে যেখানে যাইতে কইছে ঐখানেই আমরা পাগলের মতো ছুটছি। পাগলামি তখন আমরাও অনেক করছি। কারণ আমরা তোমারে ভালোবাসি। তামার মা-বাপ-বইন কোনোদিন কয় নাই নবনীরে সুস্থ করতে এইসব পাগলামি কেন করমু? তখন মনে হইতো পাগলামি কইরা যদি নবনী সুস্থ হয় তো পাগলামিই করুম। তোমার বাপটা অসুস্থ। আমার মাইয়্যার মুখের দিক আমি তাকাইতে পারতাছি না। তোমার বাপ এখনও দুশ্চিন্তা করতেই আছে। এমন চলতে থাকলে মরণের আর খুব দূর বাকি নাই। আমি জিন্দা থাকতে শফিকরে কাফনের কাপড়ে পেঁচাইবো, আমার মাইয়্যা সাদা কাপড় পিনবো, তোমরা এতিম হইবা এই জিনিস আমার সইহ্য হইবো না গো নাতনী। শফিকের লগে আমিও বিদায় নিমু। তুমি সামিরে ভালোবাইসা সারাজীবন একলা থাকার সিদ্ধান্ত নিছো, নিজের চিকিৎসা আর করাইতে চাও নাই; আমরা সব মাইনা নিছি। যদি তুমি এমনে সুখে থাকো তাইলে তাই হইবো। তুমি কি এহন তোমার বাপ-মায়ের সুখের কথা চিন্তা করবা না? আমগোরে কি তুমি একটুও ভালোবাসো না? তোমার বাপ, তোমার মা, আর বইনের জন্য একটুও কি মায়া নাই? এইযে এত বড় প্যাঁচের মইধ্যে সবাই পইড়া আছে, নাতাশার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, তুমি কি একটু ভাববা না সবাইরে নিয়া? তোমার হাতে এহন সবকিছু। তুমি চাইলেই সবাইরে পেরেশানিমুক্ত করতে পারো। তোমার বাপরেও সুস্থ করতে পারো।
— “ছয়মাস বাদে ডিভোর্স হওয়ার পর কি আমাদের নিয়ে কথা উঠবে না?”
— “তখন দেখা যাইবোনে। ছয়মাস লম্বা সময়। ততদিনে তোমার বিয়ার ঘটনা আড়াল হইয়া যাইব, নাতাশারও একটা গতি হইব।”
অসীম দ্বিধায় জামিলা বেগমের দিকে তাকিয়ে আছে নবনী। চরম অযৌক্তিক কথাগুলো, যৌক্তিক মেনে নেয়া ছাড়া আপাতত আর কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না সে।
*****
— “মানুষের এত সমালোচনা আমরা আর নিতে পারছি না। তোর বোনের কথা একবার ভাব অমিত, আমাদের কথা ভাব।”
— “মুনিয়া? ও যদি বাসায় আসে ওকে কী বলবো?”
— “তোর জীবনে মুনিয়াই সব? আমরা কেউ না? আমাদের নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা তোর হচ্ছে না?”
- ………………..
— “ওদিকে শফিক ভাই হসপিটালাইজড। কখন কী হয়ে যায়, কে জানে? দুই বাসায় বিয়ের উপযুক্ত দুইটা মেয়ে। যদি শফিক ভাইয়ের কিছু একটা হয়ে যায়? যদি মেয়ে দুটোকো আমরা ভালো কোথাও বিয়ে না দিতে পারি, এর দায় কে নেবে? তোর একটা সিদ্ধান্তের উপর সবার ভালো থাকা ডিপেন্ড করছে। ছয়টা মাসেরই তো ব্যাপার অমিত! এতটুকু স্যাক্রিফাইস তুই আমাদের জন্য করতে পারবি না?”
মায়ের দিকে হতাশ চোখে তাকালো অমিত। গোটা পৃথিবীটাই যেন তার বিপক্ষে ছুটছে। এত স্ট্রেস নিয়ে কি আদৌ মানুষ বাঁচে? ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে অমিত বললো,
— “নিয়ে আসো যাকে খুশি। কিন্তু মুনিয়ার সামনে কেউ যেন মুখ না খোলে।”
*****
খুশিতে আত্মহারা হয়ে খাটে বসে পা দুলাচ্ছেন শামীমা। গেট লক করে জামিলা বেগমকে কল করলেন এরশাদ।
— “খালাম্মা, আপনার বুদ্ধি সুপারহিট। কাজ হয়ে গেছে। শফিক ভাই আগামীকাল ফিরলেই আমরা নবনীকে নিয়ে আসবো। আচ্ছা নবনী রাজি হয়েছে তো?”
— “একটু গাইগুই করছিল। কিন্তু সেও রাজি হইছে।”
— “বাহ্! বাহ্! আপনি যা খেল দেখালেন না! আমরা টেনশনে আধমরা হয়ে যাচ্ছিলাম সবাই।”
— “এহন সব ভালোয় ভালোয় মিটলে হয়!”
— “মিটবে মিটবে। আপনি আমার কাছে বিশাল উপহার পাওনা রইলেন। চট্টগ্রাম গিয়েই আপনার জন্য সারপ্রাইজ প্ল্যান করব।”
— “আমার কিছু লাগবো না গো বাবা। আমার নাতিনের জীবনডা গুছায়া গেলেই হয়!”
এরশাদের কান থেকে মোবাইল ছিনিয়ে নিলো শামীমা।
— “খালাম্মা, ছয় মাসের ভেতর সব ঠিক হবে তো, তাই না?”
— “হইব হইব। স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন হইলো বড় কঠিন বন্ধন। বন্ধনের টানে হইলেও দুইজন দুইজনের কাছে আইবো। একছাদের নিচে থাইকাও ওগো একটা গতি হইবো না, এইডা আবার কী কও?”