ইট’স কমপ্লিকেটেড – ১

ফুলস্পিডে ফ্যান ঘুরছে। ফ্লোরে গা এলিয়ে, চোখ বুজে শুয়ে আছে নবনী। মেয়ের ঘরের পাশ দিয়েই যাচ্ছিলেন নীতু। ঘরের ভেতর বাতি জ্বলছে দেখে একবার উঁকি দিলেন ওঘরে। 

— “কখন এলি?” 

একচোখ মেলে তাকালো নবনী। মা দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। আবারও চোখ বুজে ফেললো সে। 

— “মাত্রই।” 

— “খাবার দেবো?” 

— “খুব টায়ার্ড মা। খিদের চেয়ে ঘুম পাচ্ছে বেশি।” 

— “একটু করে খেয়ে নে, তারপর ঘুমা।” 

— “উহুম।”

— “ফ্লোরে শুয়ে আছিস কেন? ফ্রেশ হ, কাপড় টাপড় ছাড়। খাটে শুয়ে আরাম করে ঘুমা।” 

— “হুম যাচ্ছি।” 

— “কাল ছয়টায় আমরা বেরোচ্ছি। জ্যাম শুরু হবার আগে ঢাকা ছাড়তে হবে। জলদি করে উঠে পড়িস। তোর লাগেজ তো গোছানো নেই। লাগেজ গোছাতে হবে সকালে উঠে। সাজগোজের একটা ব্যাপার আছে। আচ্ছা না থাক, সাজতে গেলে আবার সময় নষ্ট হবে। তারচেয়ে বরং গাড়িতেই সেজে নিস।” 

প্রচন্ড বিস্ময়ে উঠে বসলো নবনী। ভ্রু কুঁচকে মাকে জিজ্ঞেস করলো, 

— “কোথায় যাচ্ছি আমরা?” 

— “কোথায় আবার? তোর ছোট ফুফুর বাড়ি। ভুলে গেলি?” 

— “ওহ্! রওনকের বিয়ে! একদম ভুলেই গেছি আমি। কিন্তু কাল কেন মা?” 

— “তো আর কবে যাব?” 

— “বিয়ে আরো তিনদিন পর। এত আগে গিয়ে কী হবে? আর আমি ভীষণ টায়ার্ড। এটলিস্ট গোটা একদিন আমি বেড রেস্ট চাই।” 

— “ইশ্! কী পাহাড় ঠেলে এসেছেন আপনি যে গোটা একদিন বেড রেস্ট আপনার চাই?” 

— “তিনশো পিস জামার অর্ডার ছিল, দশদিন হাতে সময়। সেগুলোতে টাই ডাই করা, ব্লক করা, চুমকির কাজ করা, এমব্রয়ডারি করা। সেইম ডিজাইনের জামা দুই পিসের বেশি নিলোই না! সুতার কাজে ফাঁক ফোঁকর রইলো কি না, বডি সাইজ ঠিকঠাক বুঝে শুনে সেলাই করছে কি না আরো কত কী! তুমি তো সব জানোই আম্মু, ওয়ার্কারগুলোও এত্ত অলস! ঠেলে ঠেলে কাজ উদ্ধার করেছি। আজ সবগুলো প্যাকেট করে লন্ডন পাঠালাম। সঙ্গে অন্য শোরুমগুলোর অর্ডার তো আছেই। কেমন স্ট্রেস গেল আমার উপর, বুঝো তুমি?” 

— “তুই কী করেছিস? সব তো কর্মীরাই করলো।” 

— “আমি কী করেছি! আমি! ডিজাইন করলাম আমি। ফ্যাক্টরি মালিকদের সঙ্গে আমার মোটামুটি দাঙ্গা ফ্যাসাদ হয়ে গেছে সুতার রঙ হেরফের নিয়ে। কাজের প্রেশারে সবার মাথা গরম। এই দুই সপ্তাহে আমার কারখানা পলাশীর যুদ্ধ ময়দান হয়ে গেছে। কথায় কথায় মেয়েগুলো ঝগড়া বাঁধায়। সব তো আমাকেই সামলাতে হয়েছে। কতটা মেন্টাল স্ট্রেসে ছিলাম, তুমি জানো? এত শর্ট নোটিশে কে করবে এত কাজ? তার উপর ক্লাইন্টের ডিমান্ড! কাজ অমন, কাপড় এমন, কাটিং তেমন। উফফ! মাথা খালি হয়ে গেল আমার ডিজাইন করতে করতে।” 

— “আরেকটু সময় চেয়ে নিলে ভালো হতো।” 

— “সময় থাকলে তো চেয়ে নেবো। সামনের সপ্তাহ থেকে মেলা হবে ওখানে। পার্সেল পৌঁছানোর পর ক্লাইন্টেরও গোছগাছের একটা ব্যাপার আছে না!” 

— “তোরই দোষ। নিতে গেলি কেন ওর অর্ডার? নিজের কষ্ট, ওয়ার্কারগুলোরও কষ্ট।” 

— “আরেহ্ সারাবছর এত প্রেশার দেই নাকি ওদের? পুরোনো ক্লাইন্ট, ভালো প্রফিট হবে তাই আর বারণ করিনি। সবাইকে এ মাসে কিছু বাড়তি টাকা দিয়ে পুষিয়ে দেবো তো।” 

— “এবার কাল আমার সঙ্গে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নে।”

— “সবকিছু কনফার্ম করার আগে আমাকে কেন জিজ্ঞেস করলে না, আম্মু?”

— “করেছি তো করেছি। এখন তুই আমার সঙ্গে যাচ্ছিস ব্যস।” 

— “নানু যাবে?” 

— “আম্মার কোমরের ব্যথা খুব বেড়েছে ইদানীং। বেশিক্ষণ বসতে পারে না। এতদূরের জার্নি খুব কষ্ট হয়ে যাবে উনার জন্য। 

— “নানুকে কার কাছে রেখে যাবে?” 

— “সকালে তোর ছোটমামা আসবে আম্মাকে নিতে।” 

— “শুধু শুধু নানুকে ঐ বাসায় কেন পাঠাবে? সেই-ই তো সিঁড়ি ভেঙে মানুষটার উঠানামা করতে হবে। এত কষ্টের কী দরকার? তারচেয়ে বরং মামাকেই বলো না মামীকে নিয়ে এই বাসায় দুই চারদিন থেকে যেতে।” 

— “হ্যাঁ, এটাও মন্দ বলিসনি। যাই, তোর মামাকে বলে দেখি। তুই উঠে ফ্রেশ হ।” 

— “মুন, আমার কথা শোনো।” 

— “তোর ব্যস্ততা আছে, আমার নেই?” 

— “বলছি তো ইমার্জেন্সি না হলে আমি তোমাকে মানা করতাম না। 

— “তো কর না কাজ। আমাকে কল করে বিরক্ত কেন করছিস?” 

— “স্যরি বেবি! এক্সট্রিমলি স্যরি!” 

— “আমি বিজি। সোজা কথা বুঝিস না তুই?” 

— “আমি জানি তুমি এখন ব্যস্ত না। চলো এক্ষুনি মিট করব আমরা। আমি আসছি তোমাকে পিক করতে।”

— “তোর চেহারা আগামী একমাস আমি দেখতে চাই না। তোর ছায়াও যেন আমার সামনে না আসে। খবরদার আর একটা কল তুই আমাকে করবি না। একদম ব্লকলিস্টে ফেলে দেবো।” 

অমিতকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কল কেটে দিলো মুনিয়া। তার নাম্বারে আবার ডায়াল করতে গিয়েও অমিত নিজেকে আটকায়, মনকে বোঝায়। সে জানে, মুনিয়া মিথ্যা হুমকি দেয়নি। যা বলেছে, সত্যি বলেছে। এখন কল করলে সত্যিই ব্লক লিস্টে ফেলে দেবে। হয়তো আগামী এক সপ্তাহেও আনব্লক করবে না। এতদিন মেয়েটার সঙ্গে কথা না বলে থাকা সম্ভব নাকি? নিঃশ্বাস আটকে আসবে না! তবে নিঃশ্বাস তো এখনও আটকে আসছে। মুনিয়ার সঙ্গে দেখা হয় না গুনে গুনে দশদিন কেটে গেছে। কঠিন ব্যস্ত সময় পার করছে মেয়েটা। এতদিন বাদে আজ যখন মুনিয়া অবসর সময় পেলো তার সঙ্গে দেখা করবার, ঠিক তখনই ক্লাইন্টের সঙ্গে মিটিং করতে ছুটতে হলো সিলেট। কাজ শেষ করে বিকেলের ফ্লাইটে ফিরে এল ঢাকা শুধু মুনিয়ার সঙ্গে দেখা করবে বলে। অথচ সে কিনা এল না। সাফ কণ্ঠে জানিয়ে দিলো দুপুরে একসঙ্গে লাঞ্চ করতে চেয়েছিলাম, তোমার সময় হয়নি আমাকে দেবার মতো, তাই আমারও আপাতত সময় হচ্ছে না। মাত্র তিনঘন্টা সময়ের ব্যবধান মুনিয়া মেনে নিতে চায়নি। অমিত জানে, মুনিয়া এখন হয়তো কোনো রেস্টুরেন্টে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। প্রাণ খুলে হাসছে, সেল্ফি তুলছে, পিৎজা স্লাইসে কামড় বসাচ্ছে। খুব সুন্দর একটা সন্ধ্যা কাটছে নিশ্চয়ই! অথচ মেয়েটা জানে, এই মুহূর্তে তাকে ভেবে ঘরের বাতি নিভিয়ে একরাশ মন খারাপ নিয়ে বসে আছে একজন। সে জানে আজ রাতে মানুষটা ঠিকঠাক ঘুমুতে পারবে না, রাগ ভাঙার আগ অব্দি মানুষটার খিদে লাগবে না, একের পর এক সিগারেট ফুঁকে ফুঁকে তার সময় গড়াবে, কখনো কখনো হয়তো প্রচন্ড যন্ত্রণায় চোখের কোণ ভিজে উঠবে, বিষণ্নতায় ডুবে মদের গ্লাসে চুমুক দেবে। মুনিয়া জানে, তাকে পাশে বসিয়ে হাতে হাত রেখে কিছু মুহূর্ত কাটাবে বলে অমিত কতটা অস্থির হয়ে আছে। সে এও জানে, তাকে ২-৩ দিন চোখের সামনে না দেখলেই অমিত কষ্ট পায়। তার অবহেলা, রাগ কোনোটাই অমিত সহ্য করতে পারে না। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মানুষটা হুটহাট অসুস্থ হয়ে যায়। তবুও মুনিয়া তাকে প্রচন্ড অবহেলায় ফেলে রাখে জীবনের এককোণে, নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে, রেগে গিয়ে বারবার অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে, সম্পর্ক ভাঙতে চায়। মুনিয়া তাকে পোড়ায়, ইচ্ছে করেই পোড়ায়। তাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিতে চায়- সবটাই জানা আছে অমিতের। তবুও অমিত তার মুনিয়াকে ছেড়ে যেতে পারে না। অনেকগুলো দিন আগে মুনিয়া তাকে বেঁধে ছিল অসীম মায়ার বাঁধনে। সেই মায়া চিরতরে গেঁথে গেছে এই মনে। একদিন পুড়তে পুড়তে হয়তো সে সত্যিই ছাই হবে কিংবা ভাঙতে ভাঙতে গুড়িয়ে যাবে, তবুও এই মায়া বোধহয় কাটিয়ে উঠতে পারবে না অমিত। 

.

মসজিদের মাইকে মুয়াজ্জিন সাহেবের কন্ঠ শোনা যাচ্ছে, ‘একটি শোক সংবাদ! ১২৪, বরকত ভিলা নিবাসী আহসান বরকত ক্যান্সার আক্রান্ত হইয়া আজ সন্ধ্যায় ইন্তেকাল করিয়াছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’। 

মুখ বাকিয়ে হাসলো অমিত। মুনিয়ার দেয়া আংটিটায় চুমু খেয়ে বিড়বিড় করতে লাগলো, আমিও মায়া নামক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। মায়ার যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে আহসান সাহেবের মতো আমিও ফট করে মরে যাব যখন তখন। 

— “রওনকের দাদা এত জাদরেল স্বভাবের লোক! এই জামানায় এত বড় ছেলেকে কেউ জোর করে বিয়ে দেয়, বলো?” 

— “উহুম, ঘোর অন্যায়।”

— “ওর ভীষণ মন খারাপ, জানো?” 

— “হবেই তো। সবসময় বলতো, সামি ভাই আমার লাভ ম্যারেজ হবে। পরিণীতি চোপড়ার মতোন শ্যামবর্ণের মিষ্টি চেহারার একটা মেয়ের সঙ্গে প্রেম করবো। গ্র্যাজুয়েশন শেষ হলো আরো বছর তিনেক আগে। চাকরি বাকরি করছে অথচ এখনো একটা প্রেমিকা কেন জুটলো না, বলো তো নবনী? পরিণীতির মতোন কাউকে পায়নি?” 

— “কী সব যে বলো না! পরিণীতির মতোন কাউকে কোথায় পাবে ও?” 

— “পাবে না কেন? অবশ্যই পাবে। ক্যাটরিনা কাইফকে দেখার পর আমি শক্তপোক্ত দোয়া করেছিলাম, ইয়া খোদা আমাকে একটা ক্যাটরিনা কাইফের মতো প্রেমিকা জুটিয়ে দাও। আমার দোয়া কবুল হয়ে গেছে।”

— “আমাকে বলছো?” 

— “তো আর কাকে? আমার তো শুধু তুমিই আছো।” 

কাপড় লাগেজে গুছিয়ে রাখছিলো নবনী, সামির কথায় হঠাৎ থমকে গেল সে। মাথা নিচু করে ভীষন অভিমানে বলতে লাগলো, 

— “শুধু প্রেমিকা কেন চাইলে সামি? কেন বললে না তোমার একটা বউ চাই। বউ চাইলে হয়তো আজ আমি তোমার বউ হতাম, আমাদের বিয়েটা হয়ে যেত!” 

— “আবার কাঁদবে তুমি?” 

— “কেন কষ্ট পাও বলো তো? আছি তো আমি তোমার সঙ্গেই।” 

নবনী তাকালো না তার দিকে। হাত-পা গুটিয়ে বসে পড়লো ফ্লোরে। তার পাশে এসে বসলো সামি। 

— “ক্যাটরিনা তো হয়েছো আমি সবকিছু ছেড়ে আসার পর। যতদিন ছিলাম ততদিন হাতির বাচ্চা ছিলে। সময় নেই অসময় নেই আমার বুকে ৮৫ কেজি ওজনের শরীর নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে। আগে আমার বুকে ব্যথা ছিল না। সুস্থ সবল টগবগে যুবক ছিলাম। তোমার সঙ্গে সম্পর্ক হবার পর আমার বুকের উপর তোমার ঝাঁপাঝাপিতে ব্যথা শুরু হলো। সেই যে শুরু হলো, এখনো ব্যথা সারেনি।” 

আড়চোখে সামির দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো নবনী। তার কানের পাশে চুল গুঁজে দিতে দিতে সামি বললো, 

— “তুমি আমার রোদ্দুর। আমার মন খারাপের দিনগুলোতে তুমিই তো তুড়ি বাজিয়ে সব মন খারাপ উড়িয়ে দিতে। আমার সেই রোদ্দুরের মুখটা মেঘ কালো হবে, চোখ গাল বেয়ে কান্নাবৃষ্টি ঝরবে, সেসব আমার পছন্দ না। আমার রোদ্দুর শুধু হাসবে, চোখ জুড়ানো হাসি।” 

নবনী চেয়ে থাকে সামির দিকে নিষ্পলক। এতগুলো বছরের সম্পর্কে একবারের জন্যও এই চাহনি বদলায়নি। “তোমাকে ভালোবাসি” বলার দিন থেকে একই মায়া রয়ে গেছে আজ পর্যন্ত। ঝগড়াঝাটির সময়ও সেই মায়া সামির চোখ ছেড়ে যায়নি। এই চাহনির মায়ায় পড়েই তো প্রাণপণে ভালোবেসেছে তাকে। মনের চিলেকোঠায় পরম যত্নে ঠাঁই দিয়েছে। শতজনম আরাধনায় হয়তো অমন মানুষের ভালোবাসা মেলে। সে কোন আরাধনায় সামির ভালোবাসা পেয়েছিলো তা আজও অজানা। 

— “আমার দিকে তাকিয়ে রাত পার করে দেবে? কাপড় গোছাও জলদি। সকালে উঠতে হবে। রাত অনেক হয়েছে।” 

সামির তাড়ায় আবার কাপড় গোছানোয় মন দিলো নবনী। আলমারী থেকে জামা বের করার সময় কাপড়ের ভাঁজের ভেতর সামির দু’টো শার্টও বেরিয়ে এসেছে। কাপড় গোছাতে গোছাতে শার্টগুলোয় চোখ পড়লো নবনীর। নীল শার্টটা আলমারীতে রেখে, রক্তমাখা ছেঁড়া সাদা শার্টটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। – “এই শার্টটা তুমি ফেলে কেন দাও না নবনী? এটা দেখে দেখে মন খারাপ করার মানে আমি খুঁজে পাই না।”

— “হোক মন খারাপ। তোমার শেষ স্মৃতি ফেলে দেবো কেমন করে?” 

অমিতের ফোন বাজছে। ঝাপসা চোখে স্ক্রিনে তাকালো সে। মা কল করেছে। কল রিসিভ করলে কণ্ঠ শুনেই মা বুঝে যাবে তার ছেলে কাঁদছিল। আপাতত কল রিসিভ না করাই শ্রেয়। রিং বাজতে বাজতে কল কেটে যাওয়ার খানিক বাদেই অমিতের দরজায় ধাক্কা পড়লো। 

— “ভাইয়া? এই শুনতে পাচ্ছো, ভাইয়া?” 

মা এবার অনির নাম্বারে কল করেছে নিশ্চয়ই! বিরক্তিতে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে এল অমিতের। শত অনিচ্ছায়ও উঠে গিয়ে দরজা খুলতে হলো তাকে। 

— “কী হয়েছে?” 

অমিতের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তার দিকে চেয়ে রইলো অনি। চেহারা ঠিক 

স্বাভাবিক দেখাচ্ছে না। চোখজোড়া লাল হয়ে কিছুটা ফুলে আছে। দরজা আটকে কাঁদছিল নাকি? হ্যাঁ তাইতো মনে হচ্ছে! 

— “কথা বলছিস না কেন?” 

— “ওহ্! হ্যাঁ, হ্যাঁ। ঐ তো মা তোমাকে খুঁজছে।” 

— “লাইনে আছে?” 

— “না। তোমাকে বললো কল করতে। ইমার্জেন্সি। 

রুমের দরজায় দাঁড়িয়েই মাকে কল করলো অমিত। 

— “ঘরের দরজা আটকে বসে আছিস কেন?” 

— “এই কথা জিজ্ঞেস করতে কল করেছিলে?” 

— “কেন জিজ্ঞেস করতে পারি না?” 

— “বড় হয়েছি মা। এত বড় একটা ছেলেকে দরজা আটকে বসে আছিস কেন, এমন প্রশ্ন করা কি মানায়?” 

— “সমস্যা তো ওখানেই হলো রে বাপ। ছোটবেলায় ভালো ছিলি। মায়ের সঙ্গে সব সমস্যা শেয়ার করতি। মায়ের পরামর্শ শুনে সমস্যার সমাধান করতি। প্রয়োজনে তোকে দুই একটা চড়-থাপ্পর নির্দ্বিধায় মারতে পেরেছি। এখন তুই এডাল্ট। তোর জীবন সমস্যায় জর্জরিত, অথচ মায়ের কান পর্যন্ত সমস্যার কথা পৌঁছাতে চাস না। মা যদি কোনোক্রমে সিআইডিগিরী করে তোর সমস্যার কথা উদঘাটনও করি তবুও মায়ের কাছে স্বীকার করতে চাস না। মায়ের পরামর্শ শুনতেও চাস না। আর চড়- থাপ্পর তো থাক দূরের কথা! 

— “বলা শেষ? এবার কি ফোনটা রাখতে পারি?” 

— “বিরক্ত হচ্ছিস কেন? আচ্ছা কাজের কথায় আসি। কুমিল্লা যাচ্ছিস কবে?” 

— “যেতেই হবে?” 

— “অবশ্যই যেতে হবে।” 

— “আমার যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না মা।” 

— “কেন? সমস্যা কী?” 

— “রওনকের সঙ্গে কথা হয়েছিল আমার। কথায় কথায় বলেছিল ওর এই বিয়েতে মত নেই। ওকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে।” 

— “হ্যাঁ শুনেছি আমিও। তোর ফুফু কুমিল্লা যাবার আগে কার্ড নিয়ে এসেছিল বাসায়, তখন বললো সবকিছু। তালই সাহেব নাকি কাউকে কিছু না বলেই বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন। 

— “তুমিই বলো মা, এটা কোনো ন্যায়সঙ্গত কথা?” 

— “জানি তো বাবা। অন্যায় হচ্ছে, কিন্তু কী করবো? দাওয়াত দিয়েছে। আত্মীয় মানুষ, না গেলে খারাপ দেখায় না, বল?” 

— “তোমরা যাও। আমাকে আর অনিকে ছাড়ো। আপন চাচাতো ভাইয়ের বিয়ে তো আর না, বাবার চাচাতো বোনের ছেলের বিয়ে। আমি না গেলেও চলবে।”

— “মারবো এক চড়! ওদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কি দূরের? কত আদর করে তোদের! আর রওনক? তোকে কত পছন্দ করে ছেলেটা। আর তুই এভাবে বলছিস অমিত!” 

— “ধুর মা! বাজেভাবে কথাটা নিয়ে নিলে। রওনককে আর শান্তা ফুফুর ফ্যামিলিকে আমি কত আপন ভাবি, সে কথা তুমিও জানো। সমস্যা অন্যখানে। তোমাকে সে কথা বললে হেসে উড়িয়ে দেবে, তাই বলছি না।” 

— “কী?” 

— “ফুফুর শ্বশুর। এই বুড়োকে আমি চারআনা বিশ্বাস করি না, সহ্যও করতে পারি না। পুরো বংশের মানুষদের কী অত্যাচার করে এই লোকটা। ঐ বাড়িতে গেলে বারবার লোকটার মুখোমুখি আমাকে হতে হবে। বিশ্রী ব্যাপার! আর সবচেয়ে ভয়ে কী নিয়ে আছি, জানো? লোকটার ধরে বেঁধে মানুষকে বিয়ে দেয়ার স্বভাব। অনিকে বিয়ের উপযুক্ত পেয়ে যদি ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দেয়!” 

— “পাগল তুই! ও আমাদের মেয়ে। ওকে কিভাবে উনি ধরে বেঁধে বিয়ে দেবে?” 

— “জানি না মা। ওখানে যাওয়ার ব্যাপারে খুব একটা পজিটিভ ভাইভ আমি পাচ্ছি না।” 

— “সারাক্ষণ মেন্টাল প্রেশারে থাকলে মাথায় ভালো চিন্তা আসবে না অমিত। বাজে লোকদের পাল্লায় পড়ে মাথাভর্তি তোর বাজে চিন্তা বোঝাই হয়ে গেছে।’ 

— “তুমি আবার মুনকে খোঁচা মেরে কথা শোনাচ্ছো!” 

— “তোর মুনের নাম আমি নিয়েছি?” 

— “তাতে কী? বুঝি আমি সব।” 

— “ছাড় ওসব কথা। তোর বাবা আর আমি কাল যাচ্ছি। তুই নাহয় পরশু চলে আয়।”

— “পরশু গায়ে হলুদ না?” 

— “হ্যাঁ।” 

— “আচ্ছা আসবো। রাখি তাহলে।” 

কল কেটে অনির দিকে তাকালো অমিত। 

— “ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে রাখিস। পরশু যাচ্ছি রওনকের দাদা বাড়ি।” 

— “তুমি কাঁদছিলে?” 

অনির প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না অমিত। মাথা নিচু করে রইলো। তার পাশে এসে বসলো অনি। 

— “ঐ লোকটার সঙ্গে আজও ছবি আপলোড করেছে তোমার গার্লফ্রেন্ড। দেখেছি আমি। ছবি দেখেই কাঁদছিলে, তাই না?” 

— “মুন ঐ লোকটার সঙ্গে সরাসরি প্রেমে না জড়ালেও সম্পর্ক বেশ গভীর। এক হিসেবে প্রেম বললেও ভুল হবে না। কথাটা তুমিও জানো ভাইয়া। তবুও কেন জোর করে ওর সঙ্গে সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখছো, বলো তো? সবকিছু দেখা সত্ত্বেও অন্ধের মতো বেঁচে আছো তুমি। 

— “সবকিছু এত সহজ? মুনকে কিভাবে ভুলবো আমি?” 

— “তুমি তিল তিল করে শেষ হয়ে যাচ্ছো এটা মেনে নেয়াও আমাদের জন্য সহজ না। মা-বাবা তোমাকে নিয়ে কত দুশ্চিন্তায় ভোগে, তুমি জানো? 

— “এত যন্ত্রণা আমিও তো আর নিতে পারছি না অনি। মানুষের জীবনে নাকি মিরাকেল ঘটে। আমার জীবনে কেন ঘটে না? সমস্ত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি কেন পাই না? মুন আমাকে বিয়ে করতে রাজি কেন হয় না? ও আমাকে আগের মতো কেন ভালোবাসে না? আমি খুব করে চাই আমার জীবনে একটা মিরাকেল হোক। কোনো একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে যেন দেখতে পাই, আজ আমার বিয়ে।” 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *