ইউনিকর্নের সোনার শিং

ইউনিকর্নের সোনার শিং

কিংবদন্তীর রানি ‘কুইন অব শেবা’ আর ‘কিং সলোমনের’ গল্প নিশ্চয় তোমার জানা? বাইবেলের সেই গল্প! রানি শেবা জ্ঞানী সলোমনের জ্ঞানের পরীক্ষা নিতে গেছিলেন৷ তবে আধুনিক ইতিহাস গবেষকদের মতে রানি শেবা এক সময় সত্যিই ছিলেন এ পৃথিবীতে৷ এ বক্তব্যর সপক্ষে বহু প্রমাণও মিলেছে৷ মিশরীয়রা শেবাকে তাদের দেশের রানি বলে দাবি করলেও গবেষকরা বলেছেন আসলে তার সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল এই ‘ইয়েমেন’৷ বর্তমান ইয়েমেনের রাজধানী সানা’র পূর্বে এই মারি শহরের কাছে প্রত্নবিদরা যে প্রাচীন নগরীর অংশবিশেষ খুঁজে পেয়েছেন সেটাই ছিল মরুভূমি ঘেরা রানি শেবার রাজধানী৷ শেবাকে অবশ্য ইয়েমেন বা আরবের লোকেরা ‘বিলকিস’ বলে ডাকে৷ আরব মরুভূমির বহু জায়গাতে এখনও নাকি তাঁর সাম্রাজ্যের বহু চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়৷’

দুপুরবেলায় হোটেলের লনে একটা তাঁবুর নিচে নরম পানীয়তে চুমুক দিতে দিতে হেরম্যান কথাগুলো বললেন তাঁর সামনে বসা সুদীপ্তকে৷ আজই তারা দুজন ইয়েমেনর রাজধানী সানা থেকে উড়ে এসেছে মারিবে৷ মধ্যাহ্ন ভোজের পর সুদীপ্তকে নিয়ে হেরম্যান এসে বসেছেন লনে৷ মরুভূমি অঞ্চল বলে বাইরে বেশ গরম, কিন্তু লনের চারপাশ খেজুর গাছ দিয়ে ঘেরা বলে জায়গাটা আরামপ্রদ৷ হেরম্যানের সঙ্গে একজনের দেখা করতে আসার কথা৷ সুদীপ্তকে নিয়ে তারই প্রতীক্ষা করছেন তিনি৷

ছেলেবেলায় ‘মরাল বুক’-এ ‘কুইন অব শেবা’ আর ‘কিং সলোমন’-এর গল্প সুদীপ্ত পড়েছে৷ কিন্তু হেরম্যান হঠাৎ এ প্রসঙ্গের অবতারণা করায় সুদীপ্ত একটু চুপ করে থেকে কৌতূহলীভাবে বলল, ‘হ্যাঁ, গল্পটা আমি জানি৷ এটা তো ইতিহাসের গল্প! আপনি তো ক্রিপটোজ্যুলজিস্ট৷ এ গল্পের সাথে কোন ক্রিপটিডের সম্পর্ক আছে নাকি?’ ঠান্ডা পানীয়র গ্লাসে শেষ চুমুক দিয়ে একটা পরিতৃপ্তির শব্দ করে মৃদু হেসে হেরম্যান একটু রহস্যময়ভাবে জবাব দিলেন, ‘তা একটা আছে৷’

‘কী সেটা?’ ব্যগ্র ভাবে সুদীপ্ত জানতে চাইল৷ কারণ এবারের এই ইয়েমেন সফর কী কারণে, সে ব্যাপারে এখনও মুখ খোলেননি হেরম্যান৷ সুদীপ্তকে শুধু কিছুদিন আগে টেলিফোনে বলেছিলেন, ‘চলো দুজন সপ্তাহ খানেকের জন্য ইয়েমেন থেকে ঘুরে আসি৷’

সুদীপ্ত অবশ্য তখনই জানতে চেয়েছিল, ‘কোন ক্রিপটিডের খোঁজে?’

হেরম্যান বলেছিলেন, ‘আগে চলোই না ওখানে৷ তারপর সব বলব৷ অক্টোবরের পাঁচ তারিখ সানা পৌঁছাব৷’ সেই কথা মতো গতকাল রাতে কলকাতা থেকে সুদীপ্ত আর জার্মানি থেকে হেরম্যান পৌঁছেছেন সানায়৷ তারপর সেখান থেকে আজ এখানে৷

সুদীপ্তর প্রশ্ন শুনে হেরম্যান দূরে দিগন্ত বিস্তৃত বালিয়াড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আজ থেকে প্রায় তিন হাজার বছর আগে এই মরুসমুদ্র অতিক্রম করে সুদূর ইজারইলে জেরুজালেমে জ্ঞানী সলোমনের আমন্ত্রণে সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন রানি শেবা৷ সঙ্গে নিয়ে গেছিলেন রাজার জন্য বেশ কিছু উপহার৷ তার মধ্যে যেমন ছিল চার টন সোনা, মশলা, সুগন্ধী, তেমনই ছিল বেশকিছু পশু-পাখি৷ তার মধ্যে উপহার হিসাবে বেশ কয়েকটা সিংহ যেমন ছিল, তেমনই ছিল একটা অদ্ভুত প্রাণী৷’ এই বলে আবার থেমে গেলেন হেরম্যান৷

সুদীপ্ত উত্তেজনা আর চাপতে না পেরে বলে উঠল, ‘আর রহস্য না করে ব্যাপারটা বলে ফেলুন৷’

হেরম্যান মৃদু হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, ব্যাপারটা বলেই ফেলি৷ শুনে তুমি হয়তো আবার টিটকারি দেবে৷ রানি সেবার উপহারের মধ্যে সেই অদ্ভুত প্রাণীটাকে দেখতে ছিল সাদা ঘোড়ার মতো৷ কিন্তু তার শিং ছিল! একটাই শিং! কপাল ফুঁড়ে ওঠা সঙিনের মতো সোজা একটাই শিং…’

তার কথা শেষ হতে না হতেই বিস্মিত সুদীপ্ত বলে উঠল, ‘তার মানে ইউনিকর্ন!’

হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, ইউনিকর্ন৷’

সুদীপ্ত বলল, ‘লোককথা, উপকথার প্রাণী ছেড়ে আপনি এবার একেবারে রূপকথার প্রাণীর সন্ধান শুরু করেছে নাকি! নিশ্চয় সে কারণেই আপনার এখানে আসা? সত্যিই আপনাকে নিয়ে আর পারা গেল না!’

হেরম্যান শুনে বললেন, ‘আমার কথায় তুমি যে হাসবে তা আমার জানা৷ সারা পৃথিবীর জীব বিজ্ঞানিরাই যখন আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করে তখন তোমার আর হাসতে দোষ কী? অথচ আমরা যারা ক্রিপ্টোজুলজিস্ট, অর্থাৎ যারা রূপকথা বা লোককথার প্রাণী ‘ক্রিপটিডদের’ খুঁজে বেড়াই, আমাদের জন্যই কিন্তু খোঁজ মিলেছে ইন্দোনেশিয়ার জীবন্ত ড্রাগন কমোডো, ডিমপাড়া অদ্ভুত স্তন্যপায়ী প্লাটিপাস, রূপকথার সমুদ্র অভিযান কাহিনির জায়েন্ট স্কুইড বা মেগামাউথ শার্কের৷ ১৭৭০ ক্রিস্টাব্দের আগে অস্ট্রেলিয়ার বাইরে পৃথিবী জানতই না পেটের থলিতে বাচচা নিয়ে ঘোরা ক্যাঙারুর কথা৷ স্যার হেনরি মর্টন ১৮৮৭ সালে সেন্ট্রাল আফ্রিকাতে খুঁজে পেলেন রূপকথার প্রাণী ‘ওকাপি’৷ এই তো যেদিন ১৯৮০ সালে টিম ফ্ল্যানিরি খুঁজে বার করলেন ইন্দোনেশিয়ার উপকথার সাদাকালো লোমঅলা মানুষ, এক ধরনের বানর ‘ডিংগিমো’- কে৷ আর ২০০১ সালে উত্তর আমেরিকার উপকূলে খোঁজ মিলল ৫৬ ফিট লম্বা সি সারপেন্টের৷’

হেরম্যান তার তালিকাটি আরও দীর্ঘ করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সুদীপ্ত তাকে সাময়িকভাবে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘কিন্তু তা বলে ইউনিকর্ন! এই একবিংশ শতাব্দীতে ইউনিকর্নের খোঁজ করা খুব বেশি বাড়াবাড়ি নয় কি?’

হেরমান তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে কাঁধটা একটু ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘না, বাড়াবাড়ি নয়৷ শুধু ইওরোপিয়ান ফোক টেলসেই নয়, হেরেডোটাস, অ্যারিস্টটল, স্ট্যাবো, প্লিনির রচনাতেও এই একশৃঙ্গী প্রাণীর উল্লেখ আছে৷ এই সব প্রাচীন ঐতিহাসিক চিন্তাবিদরা কি শুধু কল্পনার ওপর ভিত্তি করে ওর কথা লিখলেন? ইথিওপিয়ার ন্যাশনাল মিউজিয়ামে একটা অতি প্রাচীন পাথর খোদাই আছে৷ তাতে লেখা আছে জ্ঞানী রাজা সলোমনের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় রানি শেবা যে উপহারগুলো তার জন্য নিয়ে গেছিলেন তার মধ্যে ছিল ঘোড়ার মতো দেখতে একশৃঙ্গ একটা প্রাণী, অর্থাৎ ইউনিকর্ন৷ ইয়েমেনের মরু উপজাতীদের মধ্যে অনেকেই দাবি করেন যে তাঁরা প্রাণীটাকে দেখেছেন৷ তবে সম্প্রতি এ ব্যাপারে একটা খবর আমাকে এখানে ছুটিয়ে এনেছে৷’

‘কী খবর?’ প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল সুদীপ্ত, কিন্তু তার আগেই কম্পাউন্ডে প্রবেশ করল হুড খোলা একটা জিপ৷ গাড়িটা লনের পাশে এসে থামতেই, যেদিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন হেরম্যান৷ চাপাস্বরে তিনি বললেন, ‘যার সাথে আমি অভিযানে যাব, তিনি সম্ভবত নামছেন৷’

জিপ থেকে নেমে লম্বা পা ফেলে সুদীপ্তদের সামনে এসে দাঁড়াল আলখাল্লা পরা মাঝবয়সি একজন লোক৷ হেরম্যান তার দিকে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘আসুন মিস্টার শিমন, আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম৷’

শিমন বলে লোকটার সাথে করমর্দনের পর হেরম্যান সুদীপ্তর সাথেও তাঁর পরিচয় করিয়ে দিলেন৷ শিমন সুদীপ্তকে নিজের সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত পরিচয় জানিয়ে যা বললেন তা হল, তিনি আসলে ইহুদি৷ পেশায় ব্যবসায়ী৷ তাঁর গ্রেট গ্র্যান্ডফাদার ইজরাইল থেকে কর্মসূত্রে এই আরব ভূখণ্ডে এসেছিলেন৷ তিনি রুব-অল-খালি মরুভূমিতে ব্রিটিশ প্রত্নবিদ স্মিথের সঙ্গী ছিলেন৷

‘স্মিথ কে?’ সুদীপ্ত অবশ্য তার পরিচয় পেয়ে গেল এরপরই৷

শিমন এরপর বসলেন সুদীপ্তর সাথে৷ তিনি বসার পর হেরম্যান তাকে বললেন, ‘আমাদের যাত্রার আয়োজন সম্পন্ন তো?’

শিমন জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ৷ কাল ভোরেই যাত্রা শুরু করব৷ পাঁচশো মাইল প্রথমে যেতে হবে৷ তারপর পঞ্চাশ মাইল বৃত্তাকার এলাকা নিয়ে অনুসন্ধান চালাতে হবে৷ রানি শেবার সেই ভাঙা মন্দির খুঁজে পাওযা যাবে কি না জানি না৷ যদি না মরুঝড় আবার তার ওপর থেকে বালির আবরণ সরিয়ে দেয়৷ শেষবারে আমি কপ্টারে আকাশপথ থেকেও জায়গাটা খুঁজেছিলাম৷ হদিস মেলেনি৷’

হেরম্যান এরপর বললেন, ‘যদিও সে ঘটনার যে বিবরণ, এখানকার যে সংবাদপত্রে বেরিয়েছিল তা আমি নেটের মাধ্যমে পড়েছি, আরও স্মিথের তোলা ছবিটাও সেখানে ছিল না, তবুও ও ব্যাপারটা আমি আপনার মুখ থেকে আর একবার শুনতে চাই৷’

শিমন কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, ‘কাগজে যা বেরিয়েছে, তার থেকে বেশি বলার কিছু নেই, তবু বলছি৷ আমি একজন ব্যবসায়ী৷ তেলের ব্যবসা সহ আমার বেশ কিছু ব্যবসা আছে৷ দু-মাস আগে আমি যখন ‘রুব-অল-খালি’ মরুভূমিতে তৈলকূপের অনুসন্ধান চালাচ্ছিলাম, তখন এক বিকালে স্মিথের সঙ্গে আমার পরিচয়৷ তিনি আমাকে জানান যে তিনি নাকি কাছেই এক জায়গাতেই রানি শেবার প্রাচীন এক মন্দিরের সন্ধান পেয়েছেন৷ তাঁর ধারণা সেখানে গুপ্তধন আছে৷ আমি যদি তাঁকে সাহায্য করি তবে তিনি তার অর্ধেক বখরা দিতে রাজি৷ তাঁর নাকি একজন সঙ্গী ছিল৷ দু-দিন আগে সে নাকি পালিয়ে গেছে৷ একটা মাত্র জিপ তার সম্বল৷ তিনি ফেরার পথ ধরছিলেন, তখনই তাঁর সঙ্গে আমাদের দেখা৷ তাঁর সাথে আলোচনার পর তার প্রস্তাবে আমি রাজি হয়ে গেলাম৷ জনাসাতেক লোক আর আমার দুটো জিপ নিয়ে পরদিন ভোরে যাত্রা শুরু করে দুপুর নাগাদ পৌঁছে গেলাম সেখানে৷ আমরা দেখতে পেলাম মরু সমুদ্রে দাঁড়িয়ে আছে বিরাট বড়ো এক প্রাচীরের ধ্বংসস্তূপ৷ তার ওপাশে কী আছে তা অবশ্য ঠিক বোঝা যাচ্ছে না৷ স্মিথ বললেন, প্রাচীরের ওপাশে আছে এক প্রাচীন নগরী৷ আমরা ঠিক করলাম পরদিন আমরা ওই প্রাচীরের ভিতরে ঢুকব৷ আমরা যে জায়গাটাতে রাত্রিবাসের জন্য তাঁবু ফেললাম সেটা ওই প্রাচীর থেকে আনুমানিক আধমাইল৷ প্রাচীরের আরও কাছে এগোনো যায়নি, কারণ, সামনে বেশ কয়েকটা বালির পাহাড় ছিল৷ জিপ যেত না৷ মরুঝড় মাঝেমাঝেই মরুভূমির বুকে ওইরকম বালুপাহাড়ের সৃষ্টি করে৷ স্মিথ আমাকে জানালেন, ও জায়গাতে তিনি দু-দিন আগেই রত্রাত কাটিয়েছেন৷ তবে জায়গাটা খুব শুষ্ক৷ তিন মাইল পশ্চিমে শুধু একটা প্রাকৃতিক কূপ আছে৷ সেখানে সামান্য কিছু জল মেলে৷ তাঁবু খাটানো হয়ে গেলে সেই কূপের সন্ধানে দু-জন লোককে নিয়ে রওনা হলাম স্মিথের বর্ণিত কূপের খোঁজে৷ কিন্তু সে জায়গাতে পৌঁছেও কূপের সন্ধান মিলল না৷ হয়তো বালিঝড় সেটা ঢেকে দিয়েছিল৷ সেখান থেকে ফিরতে যাচ্ছি, ঠিক সে-সময় মরুঝড় শুরু হল৷ রুব-অল-খালিতে মাঝে মাঝেই এ ঝড় হয়৷ মরুঝড় কিন্তু সমুদ্রতুফানের থেকেও ভয়ংকর৷ থেমে যেতে হল আমাদের৷ টানা পাঁচ ঘণ্টা ঝড় চলল৷ চাঁদ উঠলে আমরা যে জায়গায় তাঁবু ফেলেছিলাম, সেখানে পৌঁছে অবাক হয়ে গেলাম৷ তাঁবু জিপ আর কোনো লোকজনের চিহ্ন নেই সেখানে৷ দূরের সেই প্রাচীরটা অদৃশ্য৷ অনেক খোঁজাখুজির পর পরদিন দুপুর নাগাদ আমরা একটা বালিয়াড়িতে খুঁজে পাই শুধু স্মিথের ক্যামেরাটা৷ আর তাতেই ছিল সেই ছবি৷

শিমনের কথাগুলো একটানা শুনে যাবার পর হেরম্যান এবার তাঁকে প্রশ্ন করলেন, ‘সেই ছবি কোথায়?’

তাঁর কথার জবাবে তিনি পকেট থেকে একটি ছবি বার করে এগিয়ে দিলেন হেয়ারম্যানের হাতে৷ সুদীপ্তও ঝুঁকে পড়ল ছবিটা দেখার জন্য৷ চন্দ্রালোকে বালিয়াড়ির ছবি৷ সে ছবিতে একটা অনুচচ বালিপাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে এক অদ্ভুত প্রাণী৷ তার মাথায় একটা মাত্র শিং! জ্যোৎস্না যেন চুঁইয়ে পড়ছে প্রাণীটার গা বেয়ে৷ ইউনিকর্ন? তার পিছনে দেখা যাচ্ছে একটা আবছা কালো রেখা৷ সম্ভবত সেই প্রাচীরটা হবে৷ শিমন মন্তব্য করলেন, সম্ভবত তিনি যেদিন ওখানে রাত কাটিয়েছিলেন সেদিনই তোলা হয়েছিল ও ছবি৷ প্রাচীরের প্রায় কাছাকাছি চলে গেছিলেন স্মিথ৷ আমার ধারণা ওই প্রাণীর ছবি তোলা হয়েছে পাঁচশো ফুট দূর থেকে৷

হেরম্যান জানতে চাইলেন, ‘আচ্ছা ওই ধ্বংসস্তূপের সন্ধান কীভাবে পান প্রত্নবিদ স্মিথ?’

শিমন জবাব দিলেন, ‘তিনি আমাকে যা বলেছিলেন তা হল, মারিব শহরের ধ্বংসস্তূপে একটা পাথরের ফলকে ও জায়গার উল্লেখ পান তিনি৷ ঘটনাচক্রে ঝড় বালি সরিয়ে দেওয়ায় জায়গাটা খুঁজে পান৷ বিলকিস বা রানি শেবার সাম্রাজ্যের ওইরকম নিদর্শন কিন্তু রুব-অল-খলির নানা জায়গাতে বালি চাপা অবসস্থায় পড়ে আছে৷ একমাত্র মারিবকেই প্রত্নবিদরা বালির নিচ থেকে বার করেছেন৷

দুদিন পর এক দুপুরে ‘রুব-অল-খালি’ মরুভূমিতে তাঁবুর ভিতর বসেছিল হেরম্যান আর সুদীপ্ত৷ বাইরে প্রচণ্ড গরম৷ উত্তাপ প্রায় পঞ্চাশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড৷ সূর্য না ডুবলে বাইরে বেরোনোর কোন উপায় নেই৷ ইতিপূর্বে সুদীপ্ত বেশ কয়েকবার হেরম্যানের সঙ্গী হয়েছেন তাঁর অভিযানে৷ কখনও সুন্দাদ্বীপের সোনার কমোডো ড্রাগনের খোঁজে ইন্দনেশিয়ার গহীন জঙ্গলে, কখনও তুষার মানবের খোঁজে নেপাল হিমালয়ে৷ আবার কখনও সবুজ মানুষের খোঁজে আফ্রিকার ‘রিফট’ উপত্যকায়৷ কিন্তু ‘রুব-অল-খালি’ মরুভূমির মতো অদ্ভুত জায়গাতে সে কোনোদিন আসেনি৷ তাঁবুর বাইরে যতদূর চোখ যায়, শুধু বালির সমুদ্র, আর তার মধ্যে মাঝে মাঝে শুধু জেগে আছে ছোটো ছোটো বালির পাহাড়৷ একটা কাঁটা ঝোপ পর্যন্ত কোথাও নেই! অত্যধিক শুষ্কতার জন্য এখানে কাঁকড়াবিছে আর স্যান্ড স্নেক ছাড়া কোনো প্রাণী বাস করে না৷ তারাও যতক্ষণ না সূর্যাস্ত হয় ততক্ষণ পর্যন্ত বালির বাইরে বেরোতে সাহস করে না৷

তিনটে তাঁবু পড়েছে৷ একটাতে হেরম্যান আর সুদীপ্ত, অন্যটাতে শিমন, আর বড়ো তাবুটাতে শিমনের সঙ্গীদের থাকার ব্যবস্থা৷ শিমন পাঁচ জন লোক আর দুটো গাড়ি এনেছেন তাঁর সঙ্গে৷ যে জায়গাতে তাঁবু ফেলা হয়েছে, শিমনের অনুমান এরই কাছাকাছি কোন জায়গাতেই দলবল সমেত নিখোঁজ হয়েছিলেন প্রত্নবিদ স্মিথ৷ যদিও সে প্রাচীরের কোন চিহ্ন চোখে পড়েনি সুদীপ্তদের৷ তাঁবুর মধ্যে বসে শিমনের দেওয়া ছবিটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন হেরম্যান৷ সুদীপ্ত এক সময় তাঁকে প্রশ্ন করল, ‘এ ছবিটা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?’

হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘যদিও আমি ছবির ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ নই তবুও প্রাথমিকভাবে আমার মনে হচ্ছে, ছবিটা আসল৷ স্মিথের সম্বন্ধে আমি যতটুকু খবর সংগ্রহ করতে পেরেছি তাতে তিনি একজন নামকরা প্রত্নবিদ৷ ইয়েমেনের প্রাচীন ইতিহাসের ওপর তিনি একটা উল্লেখযোগ্য বইও লিখেছিলেন৷ তিনি হঠাৎ এই নকল ছবি তৈরি করতে যাবেন কেন? অবশ্য যদি না…৷’ তাঁর কথা শেষ হবার আগেই তাঁবুতে ঢুকলেন শিমন৷ তাঁর পরনে সাদা আলখাল্লা, পায়ে হাইহিল বুট৷ কোমরে জড়ানো কার্তুজের বেল্ট, কাঁধে রাইফেল৷ তাঁর সাথে রাইফেল বন্দুক এর আগে দেখেনি সুদীপ্তরা৷ শিমন একটু হেসে নিজেই বললেন, ‘আসলে সবরকম প্রস্ততিই নিয়ে আসা প্রয়োজন, তাই এসব৷ এ তল্লাট জনমানবহীন হলেও মরুদস্যুরা কিন্তু মাঝে মাঝে হানা দেয় এখানে৷ ওদের প্রধান লক্ষ্য যদিও যারা তৈলকূপ অনুসন্ধান করতে আছে তারা, তবুও যা সামনে পায় তাই কেড়ে নেয়৷’

এরপর একটু থেমে তিনি হেরম্যানকে বললেন, ‘তবে আপনার জন্যও আমি একটা জিনিস এনেছি৷ ইস্পাতের তৈরি একটা ফোল্ড করা খাঁচা৷ যদি প্রাণীটার সন্ধান মেলে, ওটাকে খাঁচায় বন্দী করে সভ্য জগতে নিয়ে যেতে পারবেন৷’

হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘ধন্যবাদ, কিন্তু আপনার কী মনে হয় প্রাণীটার সত্যিই অস্তিত্ব আছে?’

শিমন বললেন, ‘স্মিথের ছবিটার ব্যাপারে আমার তেমন আগ্রহ নেই৷ আমার আগ্রহ আসলে স্মিথের সেই গুপ্তধনের ব্যাপারে৷ স্মিথের তোলা এই ছবিটা যেমন সত্যি হতে পারে, তেমন গুপ্তধনের ব্যাপারটাও সত্যি হতে পারে৷ বালির নিচে কয়েক হাজার বছর ধরে চাপা-পড়া নগীরতে সোনা থাক অসম্ভব নয়৷ মারিবের খননকার্যর সময়ও মাটির নীচে থেকে বেশ কিছু স্বর্ণপাত্র মিলেছিল৷’

সুদীপ্ত এবার বলল, ‘কিন্তু, সে জায়গা আমরা খুঁজে বার করব কীভাবে! বালিঝড়ে যদি সে জায়গা সত্যিই চাপা পড়ে থাকে? তবে আমরা আবার গুপ্তধনের ব্যাপারে তেমন আগ্রহী নই৷ আমরা এসেছি ওই প্রাণীটার জন্যই৷ গুপ্তধন পেলে আপনিই নেবেন৷’

শিমন হেসে বললেন, ‘আমাদের আগ্রহ যে ভিন্ন ভিন্ন তা জানি৷ তবে আপনারা যে সামান্য একটা প্রাণীর খোঁজে এতদূর ছুটে এসেছেন, এ ব্যাপারটা আমাকে বেশ অবাক করেছে৷ আচ্ছা, আপনারা দু-জন তো পৃথিবীর দুই প্রান্তের বাসিন্দা, জার্মানি আর ইন্ডিয়া! আপনাদের দু-জনের মধ্যে বন্ধুত্ব হল কীভাবে?’

হেরম্যান এর জবাব দিলেন, ‘আমি একবার নেপাল হিমালয়ে গেছিলাম তুষার মানবের সন্ধানে৷ ও গেছিল যেখানে ট্রেকিং-এ৷ তখনই পরিচয়, তারপর বন্ধুত্ব৷ ও কিন্তু আমাদের বেশ কয়েকটা অভিযানে সঙ্গী ছিল৷

শিমন কথাটা শুনে কী যেন একটা জবাব দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই তাঁবুর বাইরে বেশ উত্তেজিত ভাবে শিমনের লোকদের চেঁচামেচির শব্দ কানে এল৷

বাইরে বেরিয়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল সুদীপ্তরা৷ তাঁবুর বাইরে প্রায় অর্ধনগ্ন একটা বাচচা ছেলেকে ধরে রেখেছে শিমনের অনুচররা৷ ছেলেটি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের হাত থেকে মুক্তি পাবার৷ সে মনে হয় একজনের হাতে কামড়েও দিয়েছে৷ তার হাত থেকে রক্ত ধরছে৷ ছেলেটার দিকে তাকিয়ে দুর্বোধ্য ভাষায় চিৎকার করছে সে৷ কিন্তু এই দুর্গম জায়গাতে ও এল কোথা থেকে?

ব্যাপারটা কিছুক্ষণের মধ্যেই শোনা গেল৷ ছেলেটা নাকি একটু দূরের বালিয়াড়ির আড়াল থেকে লক্ষ করছিল তাঁবুগুলো৷ সে যার হাতে কামড় দিযেছে, সে-ই তাকে দেখতে পেয়ে ধর আনে৷ তবে ওর সাথে আরও একজন লোক ছিল৷ পূর্ণবয়স্ক মানুষ৷ তার পায়ের ছাপ মিলেছে সেখানে! ব্যাপারটা শুনে শিমন বললেন, ‘এ ছেলেটাকে দেখে মনে হচ্ছে যাযাবর উপজাতির৷ কানে মাকড়ি আছে৷ সম্ভবত মরুদস্যুরা কাছেই কোথাও আছে৷ হয়তো তাঁবু আক্রমণ করার আগে আমাদের ওপর নজরদারি পাঠানো হয়েছে৷’ হেরম্যান, সুদীপ্ত আর শিমন এগিয়ে গেল ছেলেটার সামনে৷ তাদের দেখেই ছটফটানি থেমে গেল ছেলেটার৷ হেরম্যানের উদ্দেশ্যে দুর্বোধ্য ভাষায় সে কী যেন বলল৷ তার বিন্দু বিসর্গ বুঝতে পারল না কেউ৷ মরু রাজ্যে নানা অজানা-অচেনা ভাষা আছে, তেমনই কিছু হবে হয়তো৷

হেরম্যান শিমনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাচচাটাকে নিয়ে কী করবেন এখন?’

শিমন জবাব দিলেন, ‘ওকে এখন ছাড়া চলবে না৷ ভাবতে হবে ওকে নিয়ে কী করব? আপাতত বাঁধা থাক৷’

সুদীপ্তর ব্যাপারটাতে বেশ খারাপ লাগল৷ সে বলল, ‘এতটুকু ছেলেকে বাঁধবেন?’

শিমন বেশ কঠিনভাবে জাবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, বাঁধতে হবে৷ উপায় নেই৷ নইলে নির্ঘাত পালাবে!’

শিমনের নির্দেশে তার লোকজন মিলে তাঁবুর মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা শরু হল ছেলেটাকে৷ সঙ্গে সঙ্গে হেরম্যানের দিকে তাকিয়ে আবার কী যেন চিৎকার করে বলতে লাগল ছেলেটা৷ বাঁধা শেষ হলে ছেলেটাকে ওরা ছুঁড়ে ফেলল সুদীপ্তদের তাঁবুর গায়ে, বালির ওপর৷ চেঁচাতেই থাকল ছেলেটা৷

শিমন এরপর হেরম্যানের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আপনারা তাঁবুতে গিয়ে বিশ্রাম করুন৷ আমি জিপ নিয়ে একটু দেখে আসি কাছাকাছি কোন প্রাকৃতিক জলের কূপ আছে কি না? এখানে বেশ কদিন থাকতে হতে পারে অনুসন্ধানের জন্য৷ জল মিললে থাকতে সুবিধা হবে৷ আমি ফিরে আসি৷’ রোদের তাপ কমলে বিকালে, আমরা সবাই সেই প্রাচীরের খোঁজে বেরোব৷’

‘ঠিক আছে তা হলে তাই হবে৷’ জবাব দিলেন হেরম্যান৷ শিমন আর তার দু-জন সঙ্গী নিয়ে তার জিপটা এঁকেবেঁকে কিছুক্ষণের মধ্যেই হারিয়ে গেল বালিয়াড়ির আড়ালে৷ শিমনের অন্য তিনজন সঙ্গীও নিজেদের তাঁবুতে চলে যাবার পর সুদীপ্ত আর হেরম্যান ফিরে এল তাঁদের তাঁবুতে৷ বাচচাটা পড়ে রইল বাইরেই৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই তার চিৎকার ধীরে ধীরে থেমে গেল৷ আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেল তাঁবুর বাইরেটা৷ তাঁবুর ভিতরে বসে হেরম্যান বললেন, ‘আমরা এখানে একসাথে এসেছি ঠিকই, কিন্তু আমাদের দেখতে হবে যে শিমনের সোনা খোঁজার জন্য আমাদের আসল লক্ষ্য যেন ব্যাহত না হয়৷ আমাদের আসল লক্ষ্য প্রাণীটাকে খুঁজে বের করা৷ চলো, এখন তো কোন কাজ নেই৷ বরং ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে নেওয়া যাক৷ শরীর চাঙ্গা হবে৷ রোদের তাপ কমলে তো আবার বেরোতে হবে৷’ এই বলে তাঁবুতে শুয়ে পড়লেন হেরম্যান৷ সুদীপ্ত শুল, কিন্তু তার ঘুম এল না৷ শুয়ে শুয়ে সে ভাবতে লাগল নানা কথা৷ সত্যিই পৃথিবী কী বিরাট, বিচিত্র! হিমালয়ের তুষারধবল পর্বতমালা, ইন্দোনেশিয়ার অন্ধকারাচ্ছন্ন সেই আদিম মহাবৃক্ষে আচ্ছাদিত বনভূমি, আর এই সূর্যের আলোতে ঝলসে থাকা দিকচিহ্নহীন মরু সমুদ্র, এরা সবাই একই পৃথিবীর অংশ, অথচ কোন মিলই নেই এই তিন জায়গার মধ্যে৷ মানুষ এক জন্মে এর কতটুকুই-বা চর্মচক্ষে দেখতে পারে? নেহাত ঘটনাচক্রে হেরম্যানের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল তাই এ পৃথিবীর কিছুটা অন্তত দেখা হল তার৷ কোন ক্রিপটিডের দেখা মিলুক না মিলুক এই অদ্ভুত পৃথিবীকে দেখার সৌভাগ্য তো হয়৷ এও তো এক বিরাট পাওনা!

হেরম্যান নাক ডাকছেন৷ সময় এগিয়ে চলেছে৷ মাঝে একবার বাইরে জিপের শব্দ শোনা গেল৷ সম্ভবত শিমন ফিরে এলেন৷ ঘণ্টাখানেক এভাবে নানা কথা ভাবতে ভাবতে সময় কাটাবার পর সুদীপ্তর হঠাৎ মনে পড়ে গেল সেই বাচচা ছেলেটার কথা৷ হতে পারে সে উপজাতির মরুদস্যুদের গুপ্তচর৷ কিন্তু বাচচা ছেলে তো বটেই৷ এমনভাবে ছেলেটাকে বাইরের রোদে ফেলে রাখা হয়েছে এটাও নিষ্ঠুর কাজ৷ কথাটা মাথায় আসতেই উঠে পড়ল সুদীপ্ত৷ তাঁবু থেকে জলের বোতল নিয়ে বইরে বেরিয়ে এল৷ চারটে বাজলেও বাইরে প্রচণ্ড রোদ৷ তা নরম হতে আরও ঘণ্টাখানেক সময় লাগবে৷ বাইরে বেরিয়ে দুটো জিনিস দেখতে পেল সুদীপ্ত৷ শিমনের গাড়িটা ফিরে এসেছে৷ আর একটা জিপে তোলা হয়েছে স্টিলের তৈরি বিরাট একটা খাঁচা৷ সেটা সেই গোটানো খাঁচাই হবে, যার কথা শিমন বলেছিলেন৷ সুদীপ্ত এরপর জল নিয়ে এগোল ছেলেটার দিকে৷ ইতিমধ্যে ছেলেটা সম্ভবত গড়িয়ে গড়িয়ে সুদীপ্তদের তাঁবুর একেবারে গায়ে এসে খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসেছে৷ ছেলেটা কিন্তু সুদীপ্ত তার কাছে যেতে কোন চিৎকার করল না৷ বরং একটা আবছা হাসির রেখা যেন ফুটে উঠল তার ঠোঁটের কোণে৷ একমাথা ঘন চুল তার৷ দেহের চামড়া শুষ্ক হলেও মুখমণ্ডলে কেমন যেন একটা লাবণ্য আছে৷ হয়তো তা দেশকাল নির্বিশেষে সব শিশুরই থাকে৷ সরলতার লাবণ্য৷ বাচচাটা বড়ো বড়ো চোখে সুদীপ্তকে দেখছে৷ ওর হাত পিছমোড়া করে বাঁধা, পাও বাঁধা৷ সুদীপ্ত বোতল থেকে ধীরে ধীরে জল ঢেলে দিল ছেলেটার মুখে৷ বেশ তৃপ্তি করেই জল খেল ছেলেটা৷ তারপর শিমনদের তাঁবুর দিকে তাকিয়ে নিয়ে চাপাস্বরে কী যেন বলতে লাগল বারবার, সারা মাথা ঝুঁকিয়ে নিজের পেটটা যেন দেখাতে লাগল৷ তার ভাষা বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু সুদীপ্তর হঠাৎ মনে হল সে যেন তার পরনে পশুলোমের যে ছোট্ট পোশাকটা আছে সেটা দেখতে বলছে৷ বাচচাটার উর্ধ্বাঙ্গ সম্পূর্ণ উন্মুক্ত৷ তার পোশাকে কী কিছু আছে? একটু ইতস্তত করে সুদীপ্ত নিচু হয়ে বসে হাত বোলাতে লাগল পোশাকে৷ হঠাৎ তার কোমরে একটা শক্তমতো ছোট্ট একটা ধাতব জিনিসের উপস্থিতি যেন টের পেল সে৷ এবার হাসি ফুটে উঠল ছেলেটার মুখে৷ যেন ওটার কথাই বলার চেষ্টা করছিল সে৷ সুদীপ্ত বার করে আনল জিনিসটা৷ তিন ইঞ্চির মতো লম্বা একটা কার্তুজের খোল৷ জিনিসটা ভালো করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতেই তার ভিতর একটা ছোট্ট কাগজ রাখা আছে দেখল সে৷ কাগজটা বার করে তার ভাঁজ খুলতেই অবাক হয়ে গেল৷ একটা ছোট্ট চিঠি, সেটা সম্ভবত লেখা হয়েছে সুদীপ্তদের উদ্দেশ্যেই৷ লেখা আছে— ‘আপনারা দুই বিদেশি এখন খুব বিপদগ্রস্ত৷ স্থানীয় এক অসভ্য মরু জনগোষ্ঠীর হাতে তুলে দেবার জন্য আপনাদের ভুলিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷ গতকাল রাতে আমি আড়ি পেতে আপনাদের কথা তাবুর বাইরে থেকে শুনেছি৷ তাতে মনে হয়েছে আপনারা ঠিক শিমনের লোক নন৷ তবুও তাঁবুর ভিতর ঢুকতে সাহস পাইনি, পাছে আপনারা আমাকে বিশ্বাস না করে শিমনকে ডেকে পাঠান৷ আপনারা যে প্রাণীর খোঁজে এসেছেন ধূর্ত শিমনও এসেছে সে প্রাণীকেই নিয়ে যেতে৷ সে প্রাণীর রুপোর খুর, সোনার শিং৷ গতকাল রাতে তাঁবুতে আপনারা আলোচনা করছিলেন যে প্রাচীন নগরীর ব্যাপারে সেখানে সোনা নেই, তবে তার চেয়ে মূল্যবান কিছু আছে৷ শিমন যখন আপনাদের নিয়ে এগোবে তখন মাইল পাঁচেক যাত্রার পর আপনাদের হঠাৎ চোখে পড়বে এক প্রাচীন পাথুরে স্তম্ভ৷ যদি বাঁচতে চান তবে ওই স্তম্ভর দক্ষিণে পালাবেন৷ কিছুটা এগোলেই পেয়ে যাবেন এক প্রাচীরঘেরা নগরীর ধ্বংসস্তূপ৷ শিমন সে নগরীর উপস্থিতি জানে, কিন্তু তার ভিতরে ঢুকসে সাহস পাবে না৷ বাঁচতে হলে কাজটা করবেন৷ আমি আপনাদের জন্য সেখানে অপেক্ষা করব…৷’

চিঠির নিচে স্পষ্টভাবে নাম স্বাক্ষর করা আছে— স্মিথ৷

প্রত্নবিদ স্মিথ?

চিঠিটা পড়ে সুদীপ্ত চমকে উঠল৷ তারপর এক ছুটে তাঁবুতে ঢুকে হেরম্যানকে ডেকে তুলে চিঠিটা তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়ে সেটা কীভাবে পাওয়া গেল, তা জানাল তাঁকে৷

হেরম্যান চিঠিটা পড়ে অবাক হয়ে গেলেন৷ তারপর বললেন, এর অর্থ চিঠিটা যদি সত্যি হয় তবে কোন একটা প্রাণীর অস্তিত্ব এ তল্লাটে আছে৷’ এরপর তিনি পকেট থেকে সেই ছবিটা বার করে খুঁটিয়ে দেখে বললেন, আরে দেখো, আমরা ভালো করে খেয়াল করিনি৷ ছবির শিংটা যেন সত্যিই এখন সোনালি মনে হচ্ছে! একে ইউনিকর্ন, তায় আবার সোনার শিং, রুপোর খুর!’

সুদীপ্ত বলল, ‘কিন্তু চিঠিটার সত্যতা সম্বন্ধে আপনার ধারণা কী? বক্তব্য যদি সত্য হয় তবে আমাদের তো চূড়ান্ত বিপদ৷ হেরম্যান চিঠিটা তাঁবুর ফাঁক গলে আসা আলোতে মেলে ধরে বেশ কিছুক্ষণ দেখার পর বললেন, ‘আমি কিছুদিন ফরেন্সিক রাইটিং অ্যানলিসিস র্চ্চা করেছিলাম৷ ওই যাকে তোমরা বলো, হস্তাক্ষর বিশ্লেষণ৷ এই হাতের লেখা কোনো পুরুষের, এবং সে যে ইওরোপী সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত৷ কিন্তু শিমনকেই বা আমরা অবিশ্বাস করি কীভাবে? এ চিঠির ওপর ভিত্তি করে তো কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না৷’

সুদীপ্ত বলল, ‘তেমনই কিন্তু চিঠিটাকে অবহেলাও করা যাবে না, কী করবেন এখন?’

হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, কথাটা ঠিক৷ একটা কাজ করা যাক৷ চলো, আমরা একবার ওর তাঁবুতে গিয়ে কৌশলে ওকে বাজিয়ে দেখার চেষ্টা করি৷ ওর সম্বন্ধে তো আমি গভীরভাবে কিছু জানি না, নেট-টেলিফোন আর এ তিনদিনে যতটুকু পরিচয়৷’

তাঁবু থেকে বেরিয়ে পড়লেন দু-জন৷ হেরম্যান একবার তাকালেন সেই ছেলেটার দিকে৷ ছেলেটার চোখে মুখেও যেন প্রবল আগ্রহ হেরম্যানদের নিয়ে৷ কিন্তু তাঁরা শিমনের তাঁবুর দিকে এগোতেই যেন ভয় পেয়ে গেল ছেলেটা৷ হয়তো সে ভাবছে শিমনকে তাঁরা ব্যাপারটা জানাতে যাচ্ছেন৷ মাথা নেড়ে প্রবল আপত্তি জানাতে লাগল সে৷ সুদীপ্ত একটু হেসে হাতের ইশারায় তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল৷

দুজনে এগোল শিমনের তাঁবুর দিকে৷ কিন্তু তাঁবুর ভিতরে আর তাদের ঢোকা হল না, ভিতর থেকে ভেসে আসা শিমনের একটা কথা কানে যেতেই বালিতে পা আকে গেল তাদের৷ শিমন বলছেন, ‘লোকদুটোকে ওদের হাতে দিলেই প্রাণীটাকে ওরা আমাদের হাতে তুলে দেবে৷ কাজটা আজ রাতেই শেষ হয়ে যাবে৷ দুদিন পর এ সময় আমরা প্রাণীটাকে নিয়ে সানায় বসে আছি৷ একজন তো সাদা চামড়ার৷ বেদুইন সর্দারটা সাদা চামড়ার লোক পেলে খুব খুশি হয়৷’

অনুচরদের একজন জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, তুমি ওই জন্তুটাকে সত্যিই দেখেছে? ওর রুপোর খুর, সোনার শিং?’

শিমন জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, সত্যিই দেখেছি৷ প্রাণীটা ওই প্রাচীরের বাইরে কীভাবে যেন চলে এসছিল৷ বেদুইনরা আটক করে ফেলে তাকে৷ বেদুইন সর্দারটার ওই সোনার শিং-এর প্রতি তেমন লোভ নেই৷ অশিক্ষিত লোক৷ ওর খালি ভয় বলি না পেলে যদি দেবতা কুপিত হন, তবে কী হবে৷ ওরা কিন্তু কোন বহুল প্রচলিত ধর্মগোষ্ঠীর লোক নয়৷ ওই দেবতা ওদের নিজস্ব৷ বেদুইনদের উটের চামড়া দিয়ে তৈরি তাঁবুর গ্রামের ঠিক মাঝখানে ওই দেবতার মূর্তি আছে৷ কাঠের তৈরি ভয়াল মূর্তি, সেটাও আমি দেখেছি৷

অন্য একজন জানতে চাইল, ‘ছেলেটাকে নিয়ে কী করবে? সম্ভবত ও ওই প্রাচীর ঘেরা জায়গাটার ওপাশের বাসিন্দা৷ মেরে ফেলব ওকে?’

শিমন জবাব দিলেন, ‘এখন এসব কিছু নয়, লোক দুটোর সন্দেহ হতে পারে৷ ছেলেটার ভাষা তো ওরা বুঝবে না, কজেই ভয়ের কিছু নেই৷ আগে লোক দুটোকে বেদুইনদের হাতে তুলে দিই, তারপর বেদুইনরা ছেলেটাকে না নিলে সে ব্যাপারটা করা যাবে৷ তবে আমার ধারণা যাযাবর সর্দারটা আগ্রহর সাথেই ওকে নেবে৷ কারণ, বহু যুগ ধরে শত্রুতা চলে আসছে প্রাচীরের দুপাশের বর্বর জনগোষ্ঠীর মধ্যে৷ এক পক্ষ, অন পক্ষর কাউকে পেলে জ্যান্ত রাখে না….৷’

সুদীপ্ত উত্তেজিতভাবে কান খাড়া করে শুনছিল তাঁবুর ভিতর থেকে ভেসে আসা কথোপকথন৷ হেরম্যানের মৃদু খোঁচায় সম্বিৎ ফিরল তার৷ হেরম্যান ইশারায় তাকে বুঝিয়ে দিলেন, তাঁবুর কাছে দাঁড়িয়ে থাকা আর নিরাপদ নয়, যে কোন সময় কেউ তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এলেই বিপদ হতে পারে৷ তাঁবুর পাশ থেকে সন্তর্পণে সরে আসার সময় শিমনের আরও দু-একটা কথা কানে এল তাদের৷ শিমন বলছে, ‘তবে একটাই খটকা৷ জুতো পরা পায়ের ছাপটা কার? প্রাচীরের ওপাশের কোনো লোক কী জুতো পরে? ছাপটা ওই বুড়ো স্মিথের নয়তো? কিন্তু আমি তো তকে নিজের চোখে চোরাবালিতে ডুবে যেতে দেখেছি৷ ওর পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে আমারও একটা লোক মরল…৷’

সুদীপ্তরা তাঁবু থেকে নিজেদের তাঁবুর কাছে ফেরার পর হেরম্যান বললেন, ‘তাহলে চিঠির ব্যাপারটা আগাগোড়া সত্যি৷ আমাদের পালাতে হবে৷ কিন্তু এখন পালালে ওরা জিপ নিয়ে পিছু ধাওয়া করে৷ ধরে ফেলবে৷ অন্ধকারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে৷ আর আমাদের বাইরে যাওয়াটা যে কোনো অজুহাতে একটু পিছতে হবে৷ যাতে বেরোবার পরই সন্ধ্যা নেমে যায়৷ তবে ওরা যেন আমাদের ব্যবহারে কোন কিছু আঁচ না করতে পারে৷ চিঠির বক্তব্য মতো আমরা ওই প্রাচীরের দিকে পালাব৷ তারপর যা হয় হবে৷’

এরপর একটু থেমে তিনি বললেন, ‘তবে চিঠি আর তাঁবুর ভেতর শিমনের কথাবার্তায় একটা ব্যাপার কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, এ তল্লাটে একটা অদ্ভুত প্রাণী সত্যিই আছে!’

সুদীপ্ত তাঁর কথা শুনে বুঝতে পারল, এত বিপদের মধ্যেও ইউনিকর্নের ব্যাপারটা হেরম্যান মাথা থেকে কিছুতেই সরাতে পারছেন না! এই না হলে ক্রিপ্টোজ্যুলজিস্ট!

সুদীপ্ত একটু চুপ করে তেকে বলল, ‘কিন্তু এই বাচচাটার কী হবে? ও তো পালাতে না পারলে মারা পড়বে!’

হেরম্যান বললেন, ‘ওর হাত-পার বাঁধন খুলে দিয়ে আমরা তাঁবুর ভিতরে গিয়ে ঢুকি৷ কেউ জিজ্ঞেস করলে বলব, আমরা ও সম্বন্ধে কিছু জানি না৷ আমরা তাঁবুর বাইরে বেরোইনি৷ তবে তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি৷’ এই বলে তিনি তাকালেন শিমনের তাঁবুর দিকে৷ সুদীপ্ত আর দেরি করল না, সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে ছেলেটার হাত-পার বাঁধন ঢিলে করে তাকে ইশারা করল পালাবার জন্য৷ তারপর হেরম্যানের সঙ্গে তাঁবুর ভিতর ঢুকে ছাউনির ফাঁক দিয়ে লক্ষ করতে লাগল শিমনের তাঁবুটা৷

হেরম্যান বললেন, ‘শিমন লোকটা যে এত ধূর্ত তা কিন্তু ওর কথাবার্তা শুনে বোঝ যায় না!’ সুদীপ্ত বলল, ‘আসলে ওটা ওর মুখোশ’৷

এগিয়ে চলল সময়৷ এক সময় রোদের তাপ কমে আসার পর সুদীপ্ত দেখতে পেল, শিমন তার সঙ্গীদের নিয়ে তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এল৷ তারপর সে আসতে শুরু করল সুদীপ্তদের তাঁবুর দিকে৷ সঙ্গে সঙ্গে সুদীপ্তরা ঘুমের ভান করে শুয়ে পড়ল৷

শিমন তাদের তাঁবুতে ঢুকে বেশ কয়েকবার হাঁকডাকের পর তারা দুজন উঠে বসল৷ শিমন তাদের উদ্দেশ্যে বলল, ‘আপনারা ঘুমোচ্ছেন, ওদিকে বেরোবার সময় হয়ে গেছে তো? উঠুন এবার৷’

হেরম্যান কৃত্রিম হাই তুলে বললেন, ‘শরীরটা খুব খারাপ লাগছে৷ আজ কী না বোরোলেই নয়? কাল নয় ভোরে বেরোতাম?’

শিমন বলল, ‘না না আজই বেরোতে হবে৷ কাল ভোরে বেরোলে হবে না৷ আমার লোকজন সব তৈরি হয়েই আছে৷ আপনারা তৈরি হয়ে নিন৷’

হেরম্যান বললেন, ‘ঠিক আছে৷’ শিমন বেরিয়ে গেল তাঁবু ছেড়ে৷

হেরম্যান ঠিক আছে বললেও, তিনি ও সুদীপ্ত তৈরি হতে বেশ অনেকটা সময় নিয়ে নিলেন৷ তাঁবুর ভিতর থেকে তারা দেখতে পেল শিমন অধৈর্য হয়ে পায়চারি করছে তাদের প্রতীক্ষায়৷ আর মাঝে মাঝে তাঁবুর দিকে তাকাচ্ছে৷

সুদীপ্তরা শেষ পর্যন্ত যখন তাঁবুর বাইরে বেরোল তখন সূর্য ডুবে গেছে৷ শুধু তার লাল আভা ছড়িয়ে আছে মরুভূমির বুকে৷ এ এক অপূর্ব দৃশ্য; সুদীপ্তরা হঠাৎ খেয়াল করল, আরে, বাচচা ছেলেটা কিন্তু পালায়নি৷ হাত-পায়ে দড়ি জড়িয়ে সে একই জায়গাতে বসে আছে৷ ওর মতলব কী?

শিমন সুদীপ্তদের উদ্দেশ্যে বেশ অসন্তাোষের ভঙ্গিতে বলল, ‘অনেক দেরি করিয়ে দিলেন আপনারা৷ নিন, এবার গাড়িতে উঠুন৷’ শিমনের একজন অনুচর বাজপাখির শিকার ধরার মতো করে বাচচাটাকে একটা গাড়িতে তুলল৷ জিপদুটোর হুড খুলে ফেলা হয়েছে৷ বাচচাটার গাড়িতেই সেই খাঁচাটা আছে৷ সেই জিপটাতে চড়ে বসল শিমন আর তার দুজন সঙ্গী৷ অন্যটাতে হেরম্যান, সুদীপ্ত আর দুজন৷ একজনকে রেখে যাওয়া হল তাঁবু পাহারার জন্য৷ চালকের আসনে শিমনের অনুচররাই৷ গোধূলি বেলায় রুব-অল-খলির আর্যে গভীরে যাত্রা শুরু করল গাড়ি দুটো৷ চারদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু ছোটো বড়ো বালির পাহাড়৷ বাতাস তার ঢালের গায়ে নানা বিচিত্র আলপনা এঁকে দিয়েছে৷ তার ওপর এসে পড়েছে দিনশেষের লাল আলো৷ আশ্চর্য সুন্দর এক কল্পলোকের পৃথিবী যেন সুদীপ্তদের চারপাশে৷ সে দৃশ্য কিছুক্ষণের জন্য যেন সুদীপ্তদের সব চিন্তা ভুলিয়ে দিল৷ তারপর এক সময় ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসতে লাগল মরুভূমির বুকে৷ জ্বলে উঠল জিপের হেডলাইট৷

অন্ধকার মুছে চাঁদ উঠল একসময়৷ সোনার থালার মতো গোল চাঁদ৷ আবার স্পষ্ট হয়ে উঠল চারপাশের বালিয়াড়িগুলো৷ অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে সেই আলোতে৷ সুদীপ্তর মনে হল চাঁদের আলোতে কেমন যেন রহস্যময় লাগছে রাতের মরুভূমি৷ যেন সামনের ওই ছোটো বড়ো বালির পাহাড়ের আড়ালেই কোন কিছু অপেক্ষা করে আছে তাদের জন্য! আসলে এই মরুরাজ্যের এক এক সময় এক এক রূপ৷ কখন প্রখর দুঃসহ রৌদ্রস্নাত, কখনও নয়নাভিরাম, কখনও-বা রহস্যময়! হেরম্যান একবার চাপা স্বরে বললেন, ‘এরকমই এক জ্যোৎস্নায় প্রাণীটার ছবিটা তোলা হয়েছিল৷’ তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে লাগলেন বালির স্তূপগুলো৷ সুদীপ্তর মনে হল, এ অবস্থাতেও তিনি ইউনিকর্নের খোঁজ চালাচ্ছেন! যদি চন্দ্রালোকে প্রাণীটা একবার এসে দাঁড়ায় কোন বালিয়াড়ির মাথায়! বালি পাহাড়ের ঢালে ধীর গতিতে ওঠানামা করতে করতে এগিয়ে চলল গাড়ি দুটো৷ ধীরে ধীরে উত্তেজনা চেপে বসতে লাগল সুদীপ্তদের মনে৷ নিজেদের যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করতে লাগল হেরম্যান আর সুদীপ্ত৷ পাছে জিপের সঙ্গীরা তাদের মতলব আঁচ করতে পারে সেজন্য৷ রানি শেবা আর রাজা সলোমনের গল্প শোনাতে শুরু করলেন হেরম্যান৷ মরুভূমির রাত ক্রমশ বেড়ে চলল৷ এক সময় হঠাৎ তার চোখে পড়ল কিছু দূরে চাঁদের আলোতে মরুভূমির বুকে দাঁড়িয়ে আছে এক পাথুরে স্তম্ভ৷ হাতুড়ি পিটতে শুরু করল সুদীপ্তর বুকে৷ এবার পালাতে হবে৷ হেরম্যানের সঙ্গে একবার তার চোখাচোখি হল৷ তিনি ইসারায় শান্ত থাকতে বললেন তাকে৷ সেই স্তম্ভের দিকে এগিয়ে চলল গাড়ি দুটো৷

দুটো জিপের মধ্যে বেশ কিছুটা দূরত্ব আছে৷ দু-শো ফুটের মতো ব্যবধান৷ আগে চলেছে শিমনের জিপটা৷ সুদীপ্তরা মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছে ওই স্তম্ভটার পাশ দিয়ে তাদের জিপটা যাবার সময়ই গাড়ি থেকে ঝাঁপ দিয়ে ছুটতে শুরু করবে তারা৷ প্রথম জিপটা পৌঁছে গেল স্তম্ভটার কাছে৷ আর ঠিক সেই সময় সুদীপ্তদেরও চমকে দিয়ে প্রথম জিপটা থেকে লাফ দিয়ে ছুটতে শুরু করল ছেলেটা৷ তার মানে সেও এই জায়গাতে আসার প্রতীক্ষায় ছিল৷ তাই সে তার হাত-পায়ের বন্ধন যে খুলে গেছে তা বুঝতে দেয়নি কাউকে৷ ছেলেটা জিপ থেকে নেমে ছুটতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই থেমে গেল শিমনের জিপ৷ সুদীপ্তদের গাড়িটাও দাঁড়িয়ে পড়ল৷ শিমন চিৎকার করে বলে উঠল, ‘ধরো ওকে৷’ ছেলেটা যেন জ্যা মুক্ত তিরের মতো ছুটে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল কিছুদূরের বালিয়াড়ির আড়ালে৷ আর এর পরেই হেরম্যান আর সুদীপ্তও গাড়ি থেকে লফ দিয়ে ছুটতে লাগল৷ কিন্তু তারা ছেলেটার মতো দ্রুত গতিতে ছুটতে পারল না৷ বালিতে পা বসে যেতে লাগল৷ কোনোরকমে ছুটে গিয়ে তারা আর একটা বালির স্তূপের আড়ালে আশ্রয় নিল৷ ঘটনার আকস্মিকতার মুহূর্তের জন্য সে হতভম্ব হয়ে গেছিল লোকগুলো৷ তারপরই আবার শোনা গেল শিমনের চিৎকার! ধরো ধরো, কেউ যেন পালাতে না পারে…৷

জিপদুটোর আলো ঘুরে গেল৷ সুদীপ্তরা যে বালিয়াড়ির আড়ালে আশ্রয় নিয়েছে সেদিকেই আসতে লাগল জিপদুটো৷ তারা কোথায় লুকিয়েছ অনুমান করতে পেরেছে শিমন৷ জিপদুটো পৌঁছে গেল সুদীপ্তদের বালিয়াড়িটার কাছে৷ শিমন জিপ থেকে লাফ দিয়ে নেমে চিৎকার করে সুদীপ্তদের উদ্দেশ্যে বলল, ‘বাইরে বেরিয়ে আসুন, নইলে কিন্তু গুলি করে মারব৷’

অন্যরাও সুদীপ্তদের ধরার জন্য জিপ থেকে নীচে নামল৷ দু-জনের হাতে মোটা দড়ি৷ আর বোধহয় পালানো গেল না! ঠিক এই সময় আর একটা চিৎকার শোনা গেল৷ সুদীপ্তরা বালিয়াড়ির আড়াল থেকে দেখতে পেল বেশ কিছুটা দূরে একটা সমতল জায়গাতে পৌঁছে গেছে ছেলেটা৷ চাঁদের আলোতে ফাঁকা জায়গাতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে ছেলেটা৷ তাকে দেখা মাত্রই শিমনের নির্দেশে সে ছাড়া অন্য সবাই গাড়িতে উঠে বসে ছেলেটার দিকে তীর বেগে গাড়ি ছুটিয়ে দিল৷ ছেলেটা এবার অদ্ভুত ভঙ্গিতে একবার এদিকের ফাঁকা জমিটার এদিক ওদিক ছুটতে শুরু করল৷ বাচচা ছেলেরা যেমন এরোপ্লেন সেজে দু-হাজ ডানার মতো দু-পাশে ছড়িয়ে এঁকে বেঁকে ছোটে ঠিক সেইরকম তার ছোটার ভঙ্গি৷ তারপর এক সময় বিস্তৃত ফাঁকা জায়গার মাঝখানে হঠাৎই দাঁড়িয়ে পড়ল৷ ছেলেটা শেষ পর্যন্ত তাহলে ধরা দেবে নাকি? গাড়ি দুটো তার একদম কাছাকাছি পৌঁছে গেছে৷ তবু সে নড়ছে না৷ কিন্তু এরপরই এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল৷ জিপ দুটোর পিছনের চাকা দুটো হঠাৎই শূন্যে উঠে গেল৷ আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই গাড়ি দুটো যেন লোকজন সমেত মাটির গভীরে ঢুকে গেল৷ শুধু কার যেন একটা আর্ত চিৎকার ভেসে এল জায়গাটা থেকে৷ ভোজবাজির মতো হারিয়ে গেল সবাই৷ হেরম্যান চাপা স্বরে বললেন, ‘চোরাবালি! বাচচাটা ফাঁদ ফেলে ওদের সবাইকে চোরাবালিতে ডুবিয়ে দিল! সেই জন্যই সে ওভাবে ছুটছিল!’

ছেলেটা তখনও দাঁড়িয়ে আছে একই জায়গাতে৷ কিন্তু শিমন কোথায় গেল? সে তো জিপে ছিল না? সে কোথায় গেল৷ হঠাৎই সে যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে৷ হেরম্যান বলল, ‘চলো, এবার আমাদের পালাতে হবে৷’

কিছুটা তফাতে তফাতে দাঁড়িয়ে আছে ছোটো ছোটো বালির ঢিবি৷ হেরম্যান আর সুদীপ্ত, এক ছুটে ফাঁকা জায়গাগুলো পার হয়ে এক-একটা ঢিবির আড়ালে আশ্রয় নিতে নিতে এগোতে লাগল৷ আর সেই বাচচা ছেলেটাও তাদের দেখতে পেয়ে সে জায়গা ছেড়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল৷ শেষ পর্যন্ত একটা বালির ঢিপির আড়ালে মিলিত হল তিনজন৷ সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর ছেলেটা তাকে ইশারায় অনুসরণ করল সুদীপ্তরা৷

ছেলেটা কিছুটা এগোবার পর মাটি থেকে একটা পাথর কুড়িয়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলল একপাশে৷ সঙ্গে সঙ্গে পাথরটা অদৃশ্য হয়ে গেল বালির মদ্যে৷ চোরাবালি! এরপর সে হাত-পা নেড়ে সে বুঝিয়ে দিল, ‘আমি যেভাবে চলছি সেভাবে চলো৷’ ঠিক যেভাবে সে পা ফেলে চলেছে, ঠিক সেভাবেই সুদীপ্তরা পা ফেলে এগোতে লাগল৷ তার সাথে সাথে এগিয়ে চলল সময়ও৷ বেশ অনেকক্ষণ চলার পর ছেলেটা হঠাৎ এক জায়গাতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে মাটির দিকে তাকাল৷ চাঁদের আলোতে সেখানে বালির ওপর জেগে আছে কিছু চিহ্ন৷ ঘোড়ার খুরের মতো দাগ! বাচচাটার ঠোঁটের কোণে এবার ফুটে উঠল স্পষ্ট হাসির চিহ্ন৷ ছেলেটা সেই ছাপগুলো সুদীপ্তদের দেখিয়ে মাথার ওপর নিজের হাতটা শিং-এর মতো তুলে ধরল৷ ইউনিকর্ন! হেরম্যান উত্তেজিতভাবে বলে উঠলেন, ‘তার মানে প্রাণীটা সত্যিই আছে! পায়ের ছাপ আর মাথার শিং দেখিয়ে ছেলেটা আমাদের সেটাই বোঝাতে চাইছে!’

সুদীপ্ত বলল, ‘হতে পারে!’

ছেলেটা আর দাঁড়াল না৷ পায়ের ছাপটা যেদিকে গেছে সেদিকেই এগোতে লাগল সে৷ হেরম্যান আর সুদীপ্ত উত্তেজিতভাবে অনুসরণ করল তাকে৷ বেশ কিছুক্ষণ চলার পর তারা এমন এক জায়গাতে পৌঁছল, যেখানে চারপাশে ছোটো ছোটো টিলার মতো বালিয়াড়ি ছড়িয়ে আছে৷ সেখানে এসে হঠাৎই কোথায় যেন হারিয়ে গেল প্রাণীটার পায়ের ছাপ৷ বাচচাটা সুদীপ্তদের নিয়ে একটা ছোটো টিলার ওপর উঠে বসল৷ অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে সেখান থেকে৷ যতদূর চোখ যায় চাঁদের আলোতে জেগে আছে সার সার বালির পাহাড়৷ টিলার ওপর বসে ছেলেটা কী যেন খুঁজতে লাগল৷ বেশ কিছুক্ষণ পর তারা দেখতে পেল একজনকে৷ একটা লোক কিছুদূরের এক টিলার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে খোলা জায়গাতে৷ তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে যেন খুশিতে ভরে উঠল ছেলেটার মুখ৷ সুদীপ্তদের তার পিছনে আসতে ইশারা করে ঢাল বেয়ে সে নীচে নামতে লাগল লোকটার কাছে যাবার জন্য৷ নীচে নেমে এল তিনজন৷ লোকটা তাদের দেখতে পেয়ে হাত নাড়ল৷ হেরম্যান বললেন, ‘ইওরোপীয় পোশাক, সম্ভবত ইনিই প্রত্নবিদ স্মিথ!’

সুদীপ্তরা এগোতে যাচ্ছিল তার দিকে৷ কিন্তু হঠাৎ আরও একটা জিনিস চোখে পড়তে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল তারা৷ অন্য একটা টিলার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে একজন৷ বন্দুক তাগ করে সে সন্তর্পনে সুদীপ্তদের অনুসরণ করে এ জায়গাতে পৌঁছে গেছে৷ সে কাঁধে বন্দুক তুলে হিংস্র বাঘের মতো এগোচ্ছে লোকটার দিকে৷ তাদের কী করা উচিত বুঝতে পারছে না সুদীপ্তরা৷ হঠাৎ তাদের পাশ থেকে ছেলেটা একটা তীব্র শিস দিয়ে উঠল৷ আর তারপরই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল৷ সুদীপ্তরা যে টিলার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল তার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল এক বিরাট প্রাণী৷ তারপর সে সুদীপ্তদের গা ঘেঁসে তির গতিতে ছুটে গেল ফাঁকা জমিতে৷ যেখানে শিমন দাঁড়িয়ে আছে সেইদিকে৷ শিমন হয়তো দেখতে পেয়েছিল প্রাণীটাকে, কিন্তু সে প্রাণীটাকে গুলি করার সুযোগ পেল না৷ তার আগেই প্রাণীটা ক্ষিপ্র গতিতে তার সঙিনের শিং দিয়ে শিমনকে গেঁথে মাটি থেকে শূনে তুলে ফেলল৷ তারপর মাথার ওপর তার দেহটাকে কয়েকবার ঘুরিয়ে তার দেহটাকে ছিটকে ফেলল দূরে৷ শিমনের শেষ আর্তনাদ হারিয়ে গেল রুব-অলখলি মরুভূমিতে৷ কয়েক মুহূর্ত মনে হয় লাগল পুরো ব্যাপারটা ঘটতে৷ আর এরপরই একটা টিলার ঢাল বেয়ে দ্রুত গতিতে উপর দিকে উঠতে শুরু করল প্রাণীটা৷ টিলার মাথার ওপর উঠে দাঁড়াল দৃপ্ত ভঙ্গিতে৷ চাঁদের আলোতে তার মাথায় জেগে আছে খাড়া সঙিনের মতো সোনার শিং৷ ইউনিকর্নের সোনার শিং? কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র৷ প্রাণীটা অনেকটা হ্রেষাধ্বনির মতো একটা ডাক ছাড়ল৷ সে ডাক যেন বিজয়ীর উল্লাসধ্বনি৷ আর তারপরই উলটো দিকের ঢাল বেয়ে হারিয়ে গেল সুদীপ্তদের চোখের আড়ালে৷ বিস্মিত সুদীপ্তরা দাঁড়িয়ে রইল চাঁদের আলোতে৷

রাত শেষ হয়ে আসছে৷ স্মিথের সেই প্রাচীন নগরীর দিকে হাঁটছিল হেরম্যান আর সুদীপ্ত৷ ছেলেটা নেই৷ সুদীপ্তদের স্মিথের জিম্মায় দিয়ে সে যেন কোথায় চলে গেছে৷ সুদীপ্তদের বিস্ময়ের ঘোরে তখনও কাটেনি৷ যেতে যেতে স্মিথ বলছিলেন, ‘আমার সম্বন্ধে শিমনের পুরো গল্পটাই বানানো৷ নগরীটা দেখে আমি ফেরার পথে ধরা পড়লাম শিমনের হাতে৷ ওরা আমাকে বর্বর উপজাতিদের হাতে বলির জন্য তুলে দিতে চেয়েছিল৷ বিনিময়ে তারা পেত ওই সোনার শিংওলা দুষ্প্রাপ্য প্রাণীটা৷ ইওরোপের বাজারে কয়েক লক্ষ পাউন্ড দাম হবে ওর৷ প্রাণীটা কোন ভাবে প্রাচীরের বাইরে এসে পথ ভুলে চলে গেছিল বেদুইনদের তাঁবুতে৷ যদিও প্রাণীটাকে ওরা শেষ পর্যন্ত আটকে রাখতে পারেনি৷ অসাধারণ ক্ষিপ্র আর শক্তিধর প্রাণী ও৷ তার ওপর মাথায় ওরকম ভয়ংকর অস্ত্র৷ পালিয়ে আসে প্রাণীটা৷ ছেলেটার পোষা জন্তুটা৷ ওর খোঁজেই নগরী থেকে বেরোয় ছেলেটা৷ শিমনের হাত থেকে পালিয়ে দৌড়াতে গিয়ে আমি ওই চোরাবালির অঞ্চলে একটা প্রাচীন কূপের মধ্যে পড়ে গেলাম৷ ওরা ভাবল আমি চোরাবালিতে ডুবে গেছি৷ আর তারপরই ছেলেটার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়, সে আমায় নিয়ে যায় তাদের নগরীতে৷ ওখানেই মাসখানেক কাটিয়ে ফেরার পথ ধরছিলাম৷ ছেলেটা আমাকে এগিয়ে দিতে যাচ্ছিল৷ ফেরার পথে আমি শিমনের সাথে দেখতে পাই আপনাদের৷ তাঁবুর কাছে গোপনে গিয়ে আড়াল থেকে আপনাদের কথাবার্তাও শুনি, আর তারপর….’

হেরম্যান বললেন, ‘আচ্ছা ওই প্রাণীটা কি সত্যিই ইউনিকর্ন?’

সুদীপ্ত জানতে চাইল, ‘প্রাচীরের ভিতর সোনার চেয়ে মূল্যবান কী আছে? ওই ইউনিকর্ন?’

স্মিথ বললেন, ‘প্রচীরের ভিতর ঢুকলে আপনারা আপনাদের প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবেন৷’

সূর্যের প্রথম আলো যখন মাটি ছুঁল তখন সুদীপ্তরা পৌঁছে গেল মরুভূমির বুকে জেগে থাকা এই বিরাট প্রাচীরের সামনে৷ স্মিথ বললেন, ‘এক সময় রানি শেবার রাজধানীর অংশ ছিল এই নগরী৷ প্রত্নতত্ত্বের অনেক অমূল্য নিদর্শন আজও ছড়িয়ে আছে এখানে৷ সামান্য কিছু মানুষ, প্রাচীন জনগোষ্ঠী আজও বাস করে এখানে৷ তবে তারা হিংস্র নয়, শান্তিপ্রিয়৷ নগরের বাইরে তারা যায় না৷’ প্রাচীরের ফোঁকর গলে সবাই ভিতরে প্রবেশ করার পর স্মিথ বললেন, ‘আগে আপনাদের কৌতূহল নিরসন করি, তারপর যেখানে মানুষ আছে সেদিকে নিয়ে যাব৷’ চারপাশে ছড়িয়ে আছে প্রাচীন সভ্যতার বহু নিদর্শন৷ ভাঙা মিনার, স্তম্ভ, ঘর-বাড়ির অংশ৷ স্মিথের সঙ্গে চলতে চলতে হঠাৎই একটা স্তম্ভর গায়ে চোখ অটকে গেল সুদীপ্তদের৷ সেখানে খোদিত আছে ইউনিকর্নের একটা মূর্তি! বেশ কিছুক্ষণ ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দিয়ে চলার পর স্মিথ এক জায়গাতে দাঁড়িয়ে পড়ে কিছু দূরে একটা দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, ‘ওই যে আপনাদের ইউনিকর্ন৷’

সুদীপ্তরা দেখতে পেল কিছু দূরে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে বিরাটাকৃতি কিছু প্রাণী৷ মাথায় সঙিনের মতো খাড়া শিং তাদের৷ গায়ের রং ধবধবে সাদা৷ স্মিথ বললেন, ‘মরুভূমির দুষ্প্রাপ্য অ্যান্টিলোপ৷ পৃথিবীর কয়েকটা মরুভূমিতে খুব অল্পসংখ্যায় এরা টিকে আছে৷ এই প্রাণীরা সোনার হরিণের চেয়েও মূল্যবান৷’

হেরম্যান বললেন, ‘হ্যাঁ, চিনেছি৷ এ প্রাণীর নাম হল— ‘ওরিক্স’৷ ওদের না দেখলেও বইতে আমি পড়েছি এ প্রাণীর কথা!’

স্মিথ বললেন, ‘প্রাণীগুলোর শিংগুলো বিশেষভাবে লক্ষ করুন৷ তিনফুট লম্বা শিং-দুটো সমান্তরলাভাবে ওপর দিকে উঠেছে৷ পাশ থেকে দেখলে মনে হয় ওদের একটাই শিং৷ ওরাই ইউনিকর্ন৷ প্রাচীন প্রস্তরগাত্রে যে ছবি দেখা যায় তা এই ওরিক্স অ্যান্টিলোপ৷ রানি শেবা এই ওরিক্সই উপহার দিয়েছিলেন রাজা সলোমনকে৷ হাজার হাজার বছর ধরে ওরা এই মরুভূমির বাসিন্দা৷

স্মিথের কথা শেষ হতে না হতেই কাছেই একটা ভাঙা প্রাচীরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল সেই বাচচা ছেলেটা৷ আর তার সঙ্গে বিরাট বড়ো একটা ওরিক্স৷ তার মাথার সোনালি শিং আর পায়ের রুপোর খুর ঝিলিক দিচ্ছে সকালের আলোতে৷ অবাক হয়ে গেল সুদীপ্তরা৷ স্মিথ হেসে বললেন, ‘কাল রাতের প্রাণীটা৷ ওর ছবিই আমি তুলেছিলাম৷ প্রথমে আমিও ব্যাপারটাতে অবাক হয়ে গেছিলাম৷ এখানে আসার পর ব্যাপারটা জানতে পারি৷ এখানকার অধিবাসীরা ওকে রানি শেবার প্রতীক বলে মানে৷ তাই ওর শিঙে আর খুরে সোনা-রুপোর খাপ পরিয়ে দিয়েছে তারা৷ রাজা সলোমনকে যে প্রাণীটি উপহার দেওয়া হয়েছিল, তাকেও নাকি এভাবে সাজিয়ে দিয়েছিলেন রানি শেবা৷ তা থেকেই এ সাজের উৎপত্তি৷’

প্রাণীটাকে নিয়ে ছেলেটা একেবারে সুদীপ্তদের গা ঘেঁসে দাঁড়াল৷ রাতের সেই রুদ্রমূর্তি নয়, বরং বেশ শান্তই লাগল প্রাণীটাকে৷ এত ঘটনার মধ্যে হেরমন্যান কিন্তু হাতছাড়া করেননি তাঁর ক্যামেরাটা৷ তিনি সেটা বার করে বললেন, ‘ওর ছবি তুলব৷ ও ক্রিপটিড না হতে পারে, কিন্তু এত কাছ থেকে এ প্রাণী দেখার সৌভাগ্য কজনের হয়? তুমি ওর গায়ে হাত দিয়ে দাঁড়াও৷ তবে পাশ থেকে নয়, ওর ছবি তুলব সামনে থেকে, যাতে দুটো শিং-ই দেখা যায় ওর৷’

তাঁর কথা শুনে হেসে ফেলল সুদীপ্ত আর স্মিথ৷ হেরম্যান নিজেও হাসলেন এক চোট৷ বাচচা ছেলেটা প্রাণীটার শিংটা ছুঁতে বলল৷

সুদীপ্ত তার শিং-টা ছুঁয়ে বলে উঠল, ‘ইউনিকর্নের সোনার শিং!’

ক্রিপ্টোজ্যুালজিস্ট হেরম্যানের হাতের ক্যামেরা ঝিলিক দিয়ে উঠে ফ্রেমবন্দি করল ইউনিকর্নকে৷

__

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *