আহত ফণা – আশাপূর্ণা দেবী

আহত ফণা

দেশটা বাংলা ছাড়িয়ে অনেক দূরে।

এখানে নতুন রাস্তা বানাতে, পাহাড়ের গা কাটতে হচ্ছে। আর গরমের দুপুরে প্রায়ই দু’একটা হতভাগ্যকে ‘লু’ লেগে মরতে শোনা যাচ্ছে। খবরটা নতুন নয়। যেমন নতুন নয়, শীতকালে ওই হতভাগ্যদের ঘরেই দু দশটা বাচ্চার শীতে জমে নিথর হয়ে যাওয়ার খবর।

এককথায় এখানকার আবহাওয়াটাই বেমাত্রা, বাংলা দেশের ধারে কাছে লাগে না।

তবু ‘সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা’ নাকি যেন বাংলা দেশের লোক পেটের ভাতের ধান্ধায় এখানেও ঠেলে এসে উঠেছে। এক আধজন নয়, বেশ কয়েকজন। তবে যার যেমন সার্কেল সে তেমন দলে ঘোরে, ‘বাঙালী’ খুঁজে বেড়াতে যায় না।

শুধু যাদের পদমর্যাদার কোনো বালাই নেই, তেমনি ক’জন খুদে খুদে বাঙালী জোগাড় করে একটা ছোট-খাটো দল গড়ে নিয়েছে। জরিপ আফিসের পিছনের বারান্দায় নিত্য সন্ধ্যাবেলা তারা একসঙ্গে বসে গুলতানি করে।

অবশ্য এদের দলে দু’জন অবাঙালীও আছে, সুখলাল আর গিরিধারী। ওদের মাতৃভাষা নাকি হিন্দী, কিন্তু বাংলাভাষায় দখল ওদের খাঁটি বাঙালী যতীন রাসবেহারী নন্দ অমূল্য প্রভাপদ আর জীবনের চাইতে কিছু কম নয়।

সামান্য যে দেহাতী ‘টান’টা বাঙালী নয় বলে ধরিয়ে দিতে পারতো, সেটাও আর পারে না, কারণ তেমন একটা ‘টান’ এদের কথার মধ্যেও এসে গেছে, অনেকদিন বাংলার বাইরে থেকে থেকে।

সুখলাল আর গিরিধারী তেরো চৌদ্দ বছর বর্ধমানে কাটিয়ে প্রায় বাঙালী বনে গেছে। তাই ছিটকে এখানে এসে পড়ে বাঙালীর আড্ডাটাই বেছে নিয়েছে। ওরা মাঝে মাঝে নিজের জাতভাইয়ের সম্পর্কে সব্যঙ্গে বলে, ‘শালা ছাতুখোর ভূত!’

‘তোরা তো ভাই একদম বাঙালী বনে গেছিস।’ বলে নন্দ।

ওরা হাসে, বলে ‘যে চিংড়িমাছ খেয়েছে, সে স্রেফ বাঙালী বনেছে। নইলে আর রোজ তোদের আড্ডায় ধর্না দিতে আসি?’

ওরা, মানে যতীন রাসবেহারী অমূল্যেরা অবশ্য অন্য কথা বলে। বলে, ‘প্রাণের টানটা বাঙালীর জন্যে নয়, পাখির জন্যে।…একা পাখির টানেই এতোগুলো নানান বয়সের পুরুষ এক জায়গায় এসে হাজির হয়।’

পাখির বয়েস ঠিক ধরা যায় না।

পাখির পাথরে কোঁদা স্বাস্থ্য, বয়েসকে যেন কোথায় একখানে বেঁধে রেখেছে। সেই উগ্র শরীরটা নিয়ে পাখি হেসে গড়িয়ে পড়ে ওদের কথা শুনে। বলে ‘মরণ আর কি! তোদের এই এতবড় গাঁ-খানায় বুঝি আর মেয়েছেলে নেই?’

ওরাও হাসে।

বলে ‘নেই! সত্যিই নেই। ‘মেয়ে’ আছে, ‘ছেলে’ আছে, মেয়েছেলে নেই! …শুনিস নি সেদিন অমূল্যর দুর্দশা? ঠক্কন মালির পরিবার যখন ইঁদারা থেকে জল আনছিল অমূল্য বুঝি তাকিয়ে একটু হেসেছিল। ব্যস, জলভরা মেটে কলসীটা অমূল্যর পিঠে চৌচির হল!…গায়ের ব্যথা মরতে অমূল্যর—’

পাখি আবার গড়ায়, ‘অমূল্য ওস্তাদের সখকেও বলিহারি! ঠক্কনের বৌ আবার মেয়েমানুষ নাকি? ওতো একটা সেপাই। ওর একখানা হাতের ওজন যে তোর চাইতে বেশী রে অমূল্য!’

‘কিন্তু চোখ দুটোয় মেরেছে—’

‘তা আর একটু মরলি না কেন অমূল্য? ওই চোখের তীর খেয়ে?’ বাচাল হাসি হাসে পাখি, ‘আমরা সবাই ‘হরিবোল’ দিয়ে তোকে সগগে পাঠিয়ে দিতাম।’

এই ওদের আড্ডা। এই কথা।

তবে এটা বেশীক্ষণ চলে না। দু’চার কথার পরই আসল আড্ডা শুরু হয়। পাখি তার তেলচিটে ছিটের থলি থেকে তাস বার করে।

তাস খেলারই আড্ডা চলে অনেক রাত্তির অবধি। সুখলাল ওদের ‘তিন তাসে’র খেলা শিখিয়েছে। এ খেলার নেশা মদের নেশার চাইতে কিছু কম নয়।

রাসবেহারী জরিপ অফিসের একটু মান্য গণ্য কর্মচারী, এদের মতো রাস্তা মাপা ‘খোঁটা পোঁতা’ কুলি নয়। অফিসের ফাইল-টাইল খাতা-পত্তর সব রাসবেহারীর তত্বাবধানে থাকে।

এই অফিস বাড়িতে আড্ডা বসাবার অধিকার রাসবেহারীরই দৌলতে, কারণ সে এখানে রাত্রে থাকে, অফিস ঘরের চাবি তার হাতে। তা প্রকৃতপক্ষে এ অফিসের ‘অফিসার’ রাসবেহারীই, কারণ আসল ‘সাহেব’ দৈনিক এক আধ ঘণ্টা মূর্তিটা দেখিয়ে যান!

বাকী সারা সময় রাসবেহারী।

পাখি রাসবেহারীর রান্নাটা করে দিয়ে যায়। বলাবাহুল্য পাখির খাওয়া-দাওয়া এখান থেকেই চলে। রাতের দিকে মাঝে মাঝেই রান্নার মাপ দশগুণ হয়।…ওরা সকলে চাঁদা দিয়ে ‘ফিস্টি’ লাগাতে আসে। দু’একটা বুনো মুরগী যোগাড় হলেই ‘ভোজ’!

এখানে কারুরই স্ত্রী কন্যা মা বোন নেই, তাই একটা মেয়ের হাতের রান্না পরিবেশন, হাসি কৌতুক কৃত কৃতার্থ করে তোলে এদের।

হোক সে খারাপ মেয়েমানুষ, হোক বাচাল বেহায়া জুয়ার নেশায় এবং আরো অন্য নেশায় আসক্ত, তবু তো মেয়ে! মরুভূমির শুকনো বালুর চড়ায় এক টুকরো ওয়েশিস!

পাখি এদিকে যতই বাচাল বেহায়া হোক, হাতের রান্নাটা তার খুব ভালো, তার খাওয়া দাওয়ার যত্নটা আন্তরিক। কাউকে আর পর করে না সে। রাসবেহারীকেও যেমন যত্নে পরিবেশন করে, নন্দকে যতীনকেও তেমনি যত্নে পরিবেশন করে। নেহাতই যারা খিদমদগার!

শ্রেণীর তারতম্য আছে, কিন্তু তাস ওদের ‘এক’ করেছে। তিন তাস। আর সেই একতার বাঁধন দিয়েছে পাখি।

শুধু মানি ঠক্কন ওদের এই হাসি হুল্লোড় খাওয়া মাখা দেখে রাগে জ্বলতে থাকে। এমন কি ওপরওলার কাছে রিপোর্ট করতেও চেষ্টা করেছিল, পাখির কথা তুলে দুর্নীতির প্রশ্ন আমদানী করেছিল। ঠিকেদার দাসবাবু, আর জরিপবাবু হেসে উঠে বলেছিলেন, ‘তোকে ভাগ দেয় না বুঝি? না জুয়ায় হেরে মরিস?’

কাজেই সে আর তার বাঘিনী বৌ এখানে এক ঘরে।

আজ আবার নাকি ঠক্কন প্রভাপদকে শাসিয়েছে, সাহেবকে বলে দেবে বলে, সেই কথা নিয়ে হাসাহাসি করতে করতে পাখি হঠাৎ বলে উঠলো, ‘নতুন সাহেব তো এসে গেল।’

‘ইঞ্জিনীয়ার’ শব্দটা যে পাখি উচ্চারণ করতে পারে না তা নয়, ওসব ওর ইয়ার্কি।

রাসবেহারী বললো, ‘হ্যাঁ। দাসবাবু, জরিপবাবু, অনঙ্গবাবু সবাই মিলে হন্তদন্ত হয়ে এস্টেশনে ছুটল যে সকালে!’

‘খুব নাকি বড় সাহেব?’

‘হ্যাঁ, বিলেত-ফের্তা। দু’তিন হাজার টাকা মাইনে। আসলে ওই ধলা পাহাড়টা ফাটিয়ে সোজা নতুন রাস্তা বার করা যায় কিনা তার নক্সা করতে এসেছে।’

আবার কি ঝামেলা বাধায় দেখ! ওসব কেষ্ট-বিষ্টু যত না আসে ততই মঙ্গল, যতীন বলে।

পাখি হেসে হেসে বলে, ‘তোর মঙ্গল’ করবার তালেই তো ঘুরছে ভগবান?…নে বোস। খালি কথা!’

তাস বিলি করতে করতে কিন্তু নিজেই আবার কথা ফাঁদে পাখি। বলে, ‘সাহেবের মেমও তো এসেছে!’

‘তা’ আর আসবে না কেন?’ প্রভাপদ নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘তিন হাজার টাকার সাহেব মেম আনবে না? ওরা তাঁবুতেও মেম আনে। এ কী আমরা?’

ওর কথায় হেসে ওঠে সবাই।

সে হাসিতে কিন্তু কৌতুকের চাইতে ক্ষোভই প্রধান। ওরা তো দেখে আসছে চিরকাল, জগতের সমস্ত সুখ সৌভাগ্য আমোদ আহ্লাদ, ভগবান এক দিকেই ঢালে। যারা হতভাগা, তারা সব দিকেই হতভাগা।

‘ভগবানের পুষ্যিপুত্তুর ওরা—’ বলে নন্দ, ‘দুধের সর সব ওদের ভাগে।’

পাখি স্পষ্টবাদী। পাখি ন্যায্য অন্যায্য বোঝে। তাই পাখি তীক্ষ্ণ স্বরে বলে, ‘থাম নন্দ, মুখ্যুর মতন কথা বলিস নে। দুধের সর ওদের পাতে পড়বে না তো কি তোর পাতে পড়বে?…তুই দিয়েছিস ওদের মতন দশটা পাশ? বিলেত জার্মানী ঘুরে এসেছিস তুই? ওদের মতন মাখন মিছরীর ঘরে জন্মেছিস?…পূর্ব জন্মের সুকৃতি চাই বুঝলি? তার সঙ্গে ইহজন্মের চেষ্টা চাই। শুধু ওদের হিংসে করলেই হয় না। যে যেমন গাছ পুঁতবে সে তেমন ফল খাবে।’

‘পাখির কেবল সাহেবদের দিকে ঝোল টেনে কথা—’ অসন্তুষ্ট নন্দ বলে, ‘দে এক তাস।’

কিন্তু নন্দকে যতই হক কথা শোনাক, পাখির শরীরেই কি ঈর্ষা একেবারে নেই? না থাকলে সাহেবের মেমের প্রসঙ্গই তোলে কেন ঘুরে ফিরে?

‘সাহেবের মেম, বুঝলি অমূল্য, একেবারে পাকাটির গোছা শুধু হাড় আছে, আর কিছু নেই।’

অমূল্য একটা কুৎসিত ইঙ্গিতের মুখভঙ্গী করে বলে, ‘তবে আর কি, তোর তো পোয়া বারো।’

‘থাম অমূল্য, ছোটলোকমী করিসনা।…খেলবি তো খেল।’

‘আমার তো সবই ছোটলোকমী। বলি সরকার সাহেবের ব্যাপারটা তো এক্ষুনি তুলি নি রে?’

‘সে কথা বাদ দে! সেটাও একটা ছোটলোক! যাবার সময় আমার পাওনা টাকা বাকী রেখে চলে গেল।’

‘তুইও তাকে তেমনি কম অপমান করিস নি? এস্টেশনে গিয়ে হাটে হাঁড়ি ভেঙেছিলি। নেহাৎ ট্রেন ছেড়ে দিল, তাই বাছাধন মুখ নিয়ে পালিয়ে বাঁচল।’

‘এ সাহেব অন্য রকম।’

বললো পাখি।

‘এতো সব এক্ষুণি দেখলি কখন তুই?’ রাসবেহারী বলে, ‘সেই তো একবার মাত্তর সাহেবের কোয়ার্টার ঝাড়ামোছা করে দিয়ে আসতে গেলি।’

‘ওই একবারেই হয়—’ পাখি মুচকি হেসে বলে, ‘হাঁড়ির একটা ভাত টিপলেই বোঝা যায় সেদ্ধ হয়েছে কিনা!’

রাসবেহারী মুচকি হেসে বলে, ‘তোর আগুনে সবাই সেদ্ধ হয়ে যায় শেষ অবধি।’

পাখি একটু মদগর্বের হাসি হাসে।…

এই ভাবেই কথা কয় ওরা।

উঁচু বলে যাদের মানতেই হয়, ‘বড়’ বলে স্বীকার না করে উপায় নেই যাদের, তাদের প্রতি আক্রোশটা এরা এইভাবেই মেটায়। নিজের এলাকায় বসে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে।

শুধু এরা বলেই নয়, সব ছোটরাই এ কাজ করে আসছে আদি অন্তকাল। আড়ালে রাজার মাকে ‘ডান’ বলার প্রথা তো এ যুগে সৃষ্টি হয়নি!

পরদিন কথাটা রাসবেহারীই তুললো।

বললো, ‘মুখুজ্যে সাহেবের বাংলোয় লোক চাই। মেয়েছেলে। মেমসাহেবের শরীর ভালো নয়, সর্বদা কাছে কাছে একটা মানুষ দরকার।…তোকে কাল এক নজর দেখেই মেমসাহেবের খুব মনে ধরে গেছে রে পাখি, ডেকে পাঠিয়েছে!’

বলে ভুরু নাচায় রাসবেহারী।

প্রভাপদ কুটিল দৃষ্টি হেনে বলে, ‘মনেটা ধরেছে কার গো রাসুদা? মেমসাহেবের, না খোদ সাহেবের?’

‘তা দু’জনারই। সাহেবই তো আমায় ডেকে বললো, ‘কাল যে মেয়েটি কাজ করে গেল, তাকে পাওয়া যাবে না?’…তা আমিও তোর দর বাড়ালাম বুঝলি পাখি, বললাম, ‘ও হুজুর একটু খামখেয়ালি। বাঁধাধরা কাজ বড় করে না। করলেও মাইনের খাঁই বেশী!’

‘তা কী বললো?’

‘বললো, মাইনের জন্যে কিছু এসে যাবে না। যা চাইবে পাবে।’

‘তাহলেই বোঝা গেছে’ বলে অভব্য হাসি হাসতে থাকে সবাই মিলে।

তাহলে কালই তোর ‘জয়েনিং ডেট’—হেসে ওঠে রাসবেহারী। তারপর বলে, ‘দেখিস ভাই, আমাদের যেন একেবারে বিস্মরণ হোস নি। তোর হাতের দুটো ভালো মন্দ খেয়েই তবু দেহটাকে টিকিয়ে রেখেছি।’

পাখি মৃদু হেসে বলে, ‘রান্না হবে।’

‘হবে? কখন আর হবে? বড় মানুষের বাড়ির মোটা মাইনের ঝি হবি এখন, চব্বিশ ঘণ্টার বাঁদী—’

‘ইস রে! চব্বিশ ঘণ্টার বাঁদী! এমন কাজ পাখি করে না। বলবো সন্ধের পর ছুটি দিয়ে দিতে হবে আমায়। নইলে কাজ করা চলবে না।’

‘শুনবে? মাইনের ডাঁট দেখাবে না?’

‘দেখালে করবো না। …দেখি মেমসাহেব এই পাখির মতন আয়া আর একটা কোথায় পায়।’

এ অহঙ্কার অবিশ্যি পাখির সাজে। এখানে যখন যে হোমরা-চোমরা আসেন, তাঁর বাড়ির কাজের জন্য ঠিক পাখির কাছে অনুরোধ আসে। আসল কথা বাঙালী ঝি দেখলেই মেমসাহেবদের মুখ দিয়ে নাল ঝরে।

অবাঙালী মেমসাহেবদেরও ঝরে।

বাঙালী ঝিয়ের পরিচ্ছন্নতা বোধ, পরিপাটি কাজ, অনেকেরই আকর্ষণীয়।

‘তাহলে তাসের আড্ডাটা জলাঞ্জলি যাচ্ছে না, কি বলিস?’

সুখলাল হৃষ্টচিত্তে বিড়ির বাণ্ডিল বার করে।

‘আমার রান্নাঘরটাই জাহান্নমে যাবে’, বলে রাসবেহারী। ‘সন্ধেবেলা চলে আসবো, আবার রাঁধতে আসবো, এতো আবদার খাটে না।’

‘দেখিস?’ পাখি একটু বিজয় গৌরবের হাসি হেসে বলে, ‘খাটে কিনা? বলবো, ‘বাড়িতে বুড়ো জ্যেঠা আছে, তাকে দুটো ভাত সেদ্ধ করে না দিয়ে এলে, মরে থাকবে বুড়ো!’

‘জ্যেঠা, হি হি হি জ্যেঠা!’

একযোগে হাসতে থাকে ওরা।

তা পাখির চালাকি ব্যর্থ হয় না।

মেমসাহেব সাহেবকে বলেন, ‘দেখ, ও বলছে, বাড়িতে বুড়ো থুড়থুড়ো জ্যেঠা আছে, তাকে দুটি রেঁধে দিয়ে না এলে বেচারা খেতেই পাবে না। ‘এগারটা বারটা নাগাদ একবার এক ঘণ্টার জন্যে ছেড়ে দিতে হবে। কি করি বল তো?’

সাহেব সহাস্যে বলেন, ‘বেশ প্রশ্ন করেছ! এটা কি আমার জুরিসডিকশান?’

আহা তা তোমাকে একটু জিগ্যেস করবো তো? চল্লিশ টাকা করে মাইনে নেবে, সন্ধ্যায় আটটা বাজলেই চলে যাবে, আবার দুপুরেও; তুমি হয়তো বলবে আমি অন্যায় আশকারা দিচ্ছি!

সাহেব গলার স্বর নামিয়ে বলেন, ‘তা ও অপবাদ তো তোমার আছেই। একমাত্র আমি বাদে, সকলেই তো তোমার কাছে আশকারা পায়! আয়া, বেয়ারা, ধোবা, গোয়ালা, জমাদার, মালি—’

‘হয়েছে থামো। আর লিস্ট বাড়াতে হবে না। তবে আমি বলছি, ও সময়—আর কী বা এতো কাজ আমার? বুড়ো লোকটা খেতে পাবে না? মানবিকতায় বাধছে।’

‘বেশ তো তোমার অসুবিধে না হয়, দেবে ছুটি—’ সাহেব বলেন, তবে কাজটাজ করিয়ে নিও তার আগে। ফাঁকির তাল খোঁজে না যেন।’ টাই আঁটতে আঁটতে সাহেব আর একটা কথাও বলেন, রান্নার কথা বলছে—তা তোমার রান্না ঘরেও এক আধবার প্রবেশাধিকার দিয়ে দ্যাখো না? যতই হোক বাঙালীর মেয়ে তো? বাঙালী রান্না কিছু জানেই। সেই বস্তুটি খাবার জন্যে তোমাকে তাহলে আর ‘ওই বাবাজী’র সহকারী হতে হয় না।’

মেমসাহেবের মুখে একটি হাস্যজ্যোতি ফোটে। বলেন, ‘সে যদি বললে, হয়ে গেছে সে কথা—’

‘হয়ে গেছে? বাঃ বাঃ চমৎকার!’ সাহেবের প্রসন্নকণ্ঠের দরাজ হাসি সারা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে।

‘তোমার কেবল হাসি! আমি কি নিজের থেকে বলেছি? পাখি নিজেই বললো—’

‘কে? কি নাম বললে?’

‘পাখি। ওই ওর নাম’, মেমসাহেব বলেন, ‘আমিও নাম শুনে আশ্চর্য হয়েছিলাম। বলেছিলাম ‘পাখি পাখি’ বলে ডাকতে অসুবিধে, ভালো নাম কিছু নেই? বললো, কি জানো? হেসে ওঠেন মেমসাহেব, ‘বেশ কথা বলে। বললো, একটা নামই জোটে না মেমসাহেব, তা দুটো-পাঁচটা—। নাম আবার দিচ্ছে কে? মা বাপ মরা মেয়ে, নিত্যি ভুগতাম, রোগা টিংটিঙে পাখির মতন ছিলাম। দিদিমা ‘পাখি পাখি’ করতো, সেইটুকুই নাম!’

সাহেব হেসে বলেন, ‘পাখির মতো ছিলে? তাহলে এদেশের জলহাওয়ার গুণ আছে কি বল?’

মেমসাহেব শীর্ণ মুখে হাসেন।

অবিশ্বাসের হাসি।

জলহাওয়ার গুণে তাঁর বিশ্বাস নেই। এই তো আট নয় বছর বিয়ে হয়েছে, স্বামীর সঙ্গে ঘুরছেনও তদবধি। ভালো ভালো জায়গাতেই গিয়েছেন। ‘চেঞ্জ’ লাগাবার জন্যে পয়সা খরচ করেও গেছেন দু’চার জায়গায়, কই? হাড়ে মাংস লাগল কই?

ছোটলোকেদের হয়।

মোটা চালের ভাত খেয়ে আর খেটেখুটে হয়। কিন্তু ও দুটোর একটাও তো তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়? অথচ স্বাস্থ্য জিনিসটা কী সুন্দর!

নইলে আর পাখি যখন আজ ইঁদারা থেকে জল তুলছিল, তখন মেমসাহেব মুগ্ধনেত্রে তার গঠনভঙ্গিমার দিকে তাকিয়ে থাকেন? ভাবেন ছেলেবেলায় রুগ্ন ছিল বলে, এর নাম ‘পাখি’ ছিল?

সাহেব অনেকক্ষণ সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে সহসা বলেন, ‘তা’ কই, তোমার সেই বাঙালী-রান্নার কথাটা কি হল? মাঝপথেই থেকে গেল যে!’

‘ও হো হো হো! মেমসাহেব খিলখিলিয়ে হাসতে থাকেন, ‘আমার ঠাকুমা বলতেন চোরের মন ভাঙা বেড়ায়! এতো নতুন নতুন সব রান্না বই পড়ে শিখে খাওয়াই তোমায়, তবু সেই সুক্ত চচ্চড়ির দিকে মন!’

‘ওই তো! ঠাকুরমার হাতে খেয়ে মানুষ যে! জানো বিলেতে থাকতে মনে হতো পার্সেল করে কেউ যদি পোস্তচচ্চড়ি পাঠিয়ে দিত!’

‘তার মানে সাহেব হওয়া আর তোমার হয় নি?’

‘কই আর হলো? তোমার বাসনা অপূর্ণই রয়ে গেল!’

‘তা সত্যিই তো! ‘মেমসাহেব’ শুধু নামেই। তাই পাখি যখন বললো, আগে এখানে যে গাঙ্গুলীসাহেব না কে ছিলেন। তাঁরা ওর হাতের রান্না খেয়ে মোহিত হয়ে আয়ার কাজ ছাড়িয়ে রান্নার কাজেই লাগিয়েছিলেন, তখন পতিব্রতা সতীর হৃদয় নিয়ে বলতেই হলো, তোমার এ সাহেবও বাঙালী রান্না খুব পছন্দ করেন। তুমি যদি আর কিছু বেশী নিয়ে—তা লোকটা ভালো। জিভটিভ কেটে বললো, ‘সে কি? সাহেব যদি আমার হাতের রান্না পছন্দ করে খান, সে তো আমার ভাগ্যি!’

‘বললি এই কথা?’

অমূল্য মেয়েদের মতো গালে হাত দেয়।

পাখি কোল থেকে তাস বার করতে করতে মুখ টিপে হেসে বলে, ‘বল না কেন?’

‘তুই যা সর্বনেশে মেয়ে, ওই হাতের রান্না খাইয়ে এমন বশ করে নিবি যে—’

কথাটা আর কথায় শেষ করে না অমূল্য বিশ্রী একটা হাসি দিয়ে শেষ করে। তার পর বলে, ‘সে যাক! সাহেববাড়ির গল্পগাছা একটু কর শুনি।’

পাখি চালের ওপর বলে, ‘গল্প আবার কী? মাইনে নেব কাজ করবো, ফুরিয়ে গেল সম্পর্ক!’

‘আহা লো! অমূল্য আবার মেয়েলি ভঙ্গি করে, ‘পাখি আমাদের ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না! তবু যদি না—’

‘থাম তুই অমূল্য, পুরনো কথা রাখ’, নন্দ বলে, ‘সাহেবের চেহারাখানা কিন্তু সত্যি সাহেবের মতন!…সকালে বেড়াতে বেরিয়েছিল দু’জনে, সাহেবের পাশে মেমকে যেন ‘হসন্ত’র মতন লাগছিল। ফর্সা অবিশ্যি, কিন্তু দেহে আছে কি? আর সাহেবের যেমনি লম্বা চওড়া শরীর, তেমনি মুখ, তেমনি রং। বিধাতা পুরুষ গড়েছিল ভালো। একটা পুরুষ বেটাছেলে বটে!’

‘ওই আহ্লাদেই থাক’, পাখি হেসে ওঠে বেহায়ার মতো, ‘ওই খোলসটাই আছে। বুঝলি? হালচাল দেখলে অছেদ্দা আসবে।…’ইঞ্জিন সাহেব পানিকরে’র বাড়িতে যখন কাজ করেছি, দিনে রাতে সাহেবমেমের লীলাখেলা দেখতে দেখতে—হি হি! আর আমার এই মুখুয্যে সাহেব?…বিকেলে বাড়ি ফিরে দু’জনে মুখোমুখি বসে একটু চা খেলেন, ব্যস! তারপর সাহেব একখানা বই নিয়ে লম্বা হলেন, মেমসাহেব পশম আর বোনা কাঠি নিয়ে বসলেন, টু’ শব্দ নেই ঘরে—’

এত পশম কি হয়?

‘ওই যে যুদ্ধুর জন্যে নাকি!…বাবুলাল বলে, ওই চলে রাত নটা অবধি। তারপর সাহেব ডাক দেয় ‘বাবুলাল!’ মেমসাহেব বলে ‘টেবিল লাগাও!’…খাওয়ার পর—বললে বিশ্বাস করবি—’ হেসে খান খান হয়ে ভেঙে পড়ে পাখি, খাওয়ার পর সাহেব বলে, ‘আচ্ছা গুডনাইট!’…মেমসাহেব বলে ‘আচ্ছা!’ তারপর দু’জনে দু’ঘরে শুয়ে পড়ে!’

‘দু’ঘরে!

পাখির পরিবেশিত শব্দে যেন বজ্রপাত হয় জায়গাটায়।

‘বলিস কি পাখি?’

‘তবে আর বলি কি? মেমসাহেবের নাকি ‘হেলথো’ খারাপ, ঘুমের দরকার!…তাই তো বলছি রে ওসব মাটির সেপাই।’

প্রভাপদ কুটিল চোখে চেয়ে বলে, ‘তা সাহেবেরও তো ‘হেলথো’ ভালো রাখা দরকার—’

‘থাম! মুখ খারাপ করিস না প্রভাপদ!’

‘নাঃ! তোর আজকাল বড় মেজাজ হয়েছে পাখি!’

‘হবে না? আজ মাসভোর কাজ করছে, কেবলই মেমসাহেবের নেকনজরের গপপো করতে হচ্ছে বেচারিকে।…মেমসাহেব শাড়ি দিয়েছে, মেমসাহেব বেলাউস দিয়েছে, মেমসাহেব বখশিশ দিয়েছে।—দূর দূর!’

পাখি হঠাৎ গুম হয়ে যায়।

পাখির আত্মমর্যাদায় যেন আঘাত লাগে। পাখি যদি চেষ্টা করে এদের মুখের মতো জবাব দিতে পারে না? বাঘের বাচ্চা শুধু দুধ খেয়ে খেয়েই মানুষ হচ্ছে, মাংসের আস্বাদ জানে না। একবার জানালে—

‘পাখি রাগ করলি?’

পাখি গম্ভীর ভাবে বলে, ‘রাগ আবার কিসের? মাটির গৌরাঙ্গ, তাই তাকিয়ে দেখি না। কিন্তু পাখি যদি চেষ্টায় লাগে—’

‘তাহলে মৃত্তিকেয় প্রাণসঞ্চার হয়, কি বলিস?’

বলে নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে কুটি কুটি হয় নন্দ।

ওদের ঘরের কথা, এরা নিয়ে আসে।

এদের ঘরের আলোচনা ওদের ঘরে পৌঁছয় না।

তাই মেমসাহেব মাঝে মাঝেই সাহেবের কাছে এসে ‘পাখি’ নামক পরম সম্পদটির গুণ বর্ণনা করে যান।…’এমন আয়া নাকি তিনি জীবনে দেখেন নি। এদেশ থেকে যদি বদলী হয়ে যেতে হয়, তাহলে ‘পাখি’ হারানোর লোকসানে অশ্রুবর্ষণ করতে বাধ্য হবেন।’…এমন কি এক এক সময় এমন কুবাসনাও ব্যক্ত করেন, পাখির ওই জ্যেঠা না কে যেন একটা আছে, বুড়োটার নাকি আশী নব্বুই বছর বয়েস, অতএব সে তো একটু অবিবেচনা করে মরতেও পারে? তিনি তাহলে পাখিকে আরো বেশী মাইনে দিয়ে নিজের সঙ্গে নিয়ে যান।

সাহেব তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে হা হা করে হেসে ওঠেন, ‘বল তো বুড়োকে গুলি করে আসি! তুমি নিষ্কণ্টকে—’

‘এই চুপ! এসব ঠাট্টা শুনতে পেলে ভয় পাবে বেচারী! বাপ নেই, জ্যাঠা অন্ত প্রাণ! কিন্তু যাই বল, মোচা রাঁধতে পারে আবার কেক পুডিং বানাতে পারে, এমন আয়া তুমি পাবে কোথাও? আবার দেখ কী মায়া মমতা। এই আমার একটু সর্দি হয়েছে, কত ব্যস্ত! মেমসাহেব আদার চা খান, মেমসাহেব ‘ফুটবাথ’ নিন, মেমসাহেব নুনজলের কুল্লি করুন। জানেও ঢের!’

মুখার্জিসাহেব কিন্তু পাখির গুণকীর্তনে আর কর্ণপাত করলেন না। ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন, ‘সর্দি হয়েছে তোমার, বলছ না তো?’

‘ঘটা করে বলবার মতো কিছু হয় নি।’

‘হতে কতক্ষণ? তোমার তো সর্দি হলেই জ্বর! টেম্পারেচারটা নাও দিকি!’

‘তারপর বুঝলি?’

পাখি সেই তার বাচাল হাসি হেসে হেসে বলে, ‘তক্ষুনি জ্বর দেখা হল, তক্ষুনি ডাক্তারের কাছে খবর গেল, বুকে তেল মালিশ, পাঁজরে ফ্ল্যানেল—’

‘রুগ্ন বুঝি?’

‘ওই কবে যেন নিমোনিয়া হয়েছিল। তাই সাহেব আকাশে সিঁদুরে মেঘ দেখলেই বাড়িতে জল ঢালে।…তা রোগকে অত আদর করলে আর রোগ চেপে বসবে না? আজ তো সকালে বেশ পষ্ট জ্বর।…সাহেব কাঁদো কাঁদো, পাখি তুমি তোমার জ্যেঠামশাইয়ের জন্যে এখান থেকেই ভাত নিয়ে যাও না? দিয়েই চলে আসবে! দেখছ তো মেমসাহেবের অসুখ—’

রাসবেহারী কৌতুকের হাসি হেসে বলে, ‘তা রাজী হয়ে গেলি না কেন? দু’দিন নয় সাহেববাড়ির ভালোমন্দ দুটো খেয়ে বাঁচতাম!’

‘থাম! এক কথায় রাজী হবার মতন হ্যাংলা পাখি নয়। বললাম, ‘সেকেলে লোক তো, রাস্তা দিয়ে নিয়ে আসা ভাত খাবে না!’

‘মাইরি পাখি, বলিহারি দিই তোকে! কথা এতো জোগায় কি করে রে?’

পাখি একটা বিচিত্র মুখভঙ্গী করে বলে, ‘কথা বেচেই তো খাচ্ছি!’

‘তা’ যা বাপু তাড়াতাড়ি যা! নিরেনব্বুই জ্বরে মেমসাহেব না আবার হার্টফেল করে। …তা সাহেব কাজে বেরোবে, না বাড়ি বসে থাকবে?’

‘কাজে আর বেরিয়েছে। এখন থেকেই তো চোখ ছলছল।’

‘বয়স কত রে?’

‘কার?’

‘সাহেবর?’

‘এই আটতিরিশ ছত্তিরিশ হবে।’

‘ধন্যি বাবা!’ অমূল্য সেই তার মেয়েলি ভঙ্গিতে বলে, ‘মরে মেয়েমানুষ হবো, বড় মানুষের পরিবার হবো!’

পাখি ধমকে ওঠে।

‘থাম অমূল্য। মরে তুই কী হবি, সে যেন তোর ইচ্ছে সাপিক্ষে। মরে কেঁচো কেন্নো গুবরে-পোকা হবি কিনা তাই বা কে বলতে পারে? তবে হ্যাঁ, বলেছিস বটে ঠিক! বড় মানুষের পরিবার হল পৃথিবীর সেরা জীব। দেখি আর অবাক হই। কিছু দেয় না, শুধু নেয়, তবু আদর, তবু দাপট!’

পাখি রাসবেহারীর ভাত বেড়ে রেখে চলে যাবার জন্যে পা বাড়িয়ে বলে, ‘আজ আর বোধহয় ওবেলা আসা হবে না! সাহেবের যা ব্যস্ততা—’

‘মেমসাহেবের জ্বর, তুই রাতে ফিরবি না—’প্রভাপদ কটু গলায় বলে, ‘তবে তো আজই অর্ধেক কাজ গোছানো হয়ে যাবে—’

‘এই ছোটলোকটাকে তোরা কেউ একখানা ইট মার নারে! মা বসুন্ধরার ভার লাঘব হোক—’ বলে হাসতে হাসতে ভাঙতে চলে যায় পাখি।

কিন্তু সাহেববাড়িতে পাখির অন্য মূর্তি।

মূর্তিমতী সেবার আর নতমুখী বিষাদের প্রতিমা হয়ে মেমসাহেবের রোগশয্যা পাশে বসে আছে সে।

বার বার সাহেবের কাছে গিয়ে গিয়ে যে ওষুধের এবং পথ্যের নির্দেশ নিচ্ছে, সেও শান্ত নম্রমুখে।

সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন সাহেব মেয়েটার দিকে। ভাবছেন মেমসাহেব যে এতো গুণমুগ্ধ তার কারণ আছে।

‘সাহেব আপনি ঘুমোতে যান—’ বিছানা থেকে নেমে এসে সাহেবের সন্নিকটে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে অনুরোধ জানায় পাখি, ‘মেমসাহেব এখন একটু ঘুমিয়েছেন, আমি আছি—’

সাহেব নিদ্রাতুরা শয্যাশায়িনীর প্রতি দৃষ্টিপাত করে তেমনি আস্তে বলেন, ‘তা তোমারও তো ঘুম-টুম—’

‘আমাদের আবার ঘুম! কী যে বলেন। এখন মেমসাহেব যাতে আরাম পান—আর আপনাদের হল দামী শরীর, ঘুম না হলে—’

‘আচ্ছা—’ সাহেব আর একবার স্নেহকোমল দৃষ্টিতে নিদ্রিতাকে দেখে নিয়ে বলেন, ‘যাচ্ছি। কিন্তু জেগে উঠে উনি যদি খোঁজেন, আমাকে ডেকে দিও। বাইরে থেকে দরজায় একটু শব্দ করলেই—’

‘ওস্তাদ!’ হেসে কুটি কুটি হয় অমূল্য! ‘তারপর? দিলি তো টোকা?’

পাখি গম্ভীর মুখে বলে, ‘দিলাম বৈকি! গিন্নী যে জেগে উঠেই ‘সাহেব কই সাহেব কই’ করে আনচান করলেন!’

‘যাচ্চলে—জেগে উঠলো। তবে আর কী হলো ছাই!’

‘তুই থাম অমূল্য!’

‘তুই তো চিরকাল আমায় থামিয়েই রাখলি পাখি! কিন্তু বলি, এবারে হেরে যাচ্ছিস যে?’

‘হারি নি। চেষ্টা করছি না!’

‘কেন বল তো?’

‘কি জানি!’

‘না, বাবা তুই যেন রহস্য হয়ে উঠছিস! তা ডাকার পর কি হলো তাই বল?’

‘কি আবার হলো! জেগেই বোধহয় ছিল! তক্ষুনি ঘরে আলো জ্বলে উঠল।… সঙ্গে সঙ্গে রাতে পরবার আলখেল্লাটা জড়াতে জড়াতে বেরিয়ে এলো!…বললো, ‘কী হয়েছে? জ্বর বেড়েছে?…ছটফট করছেন?….খুঁজছেন আমায়?’ ছুটে চলে গেল।

‘জ্বর খুব বেশী বুঝি?’

‘বেশী বললে বেশী! একশো এক!’

একশো এক!

‘ফুঃ! এই নিয়েই এত মহামারী?’

‘হবে না কেন? রাজার নন্দিনী প্যারী যে—’

‘তা’ আসল কথাটা বল পাখি’, প্রভাপদ তেতো গলায় বলে, ‘যাবার সময় একটু ধাক্কা লাগিয়ে গেল বোধহয়?’

‘গেল!’ পাখি নিস্পৃহ গলায় বলে, ‘ইট পাথরকে যেমন ধাক্কা দেয় লোকে—’

‘ইস! তোর জন্যে আমার দুঃখ হচ্ছে পাখি!’

‘ওর জন্যে নয়, ওর বুদ্ধির জন্যে! তোর জয় যে, আমাদেরও জয় রে পাখি! বাইরে সাহেবরা আমাদের চাবকায়, আর ভেতরে তুই সেই সাহেবদের নাকে ঝামা ঘসিস, এটা ভাবতে কত ফূর্তি লাগে?’…

‘না না পাখি, তুই এমন গুবলেট হয়ে যাস নে।…অন্তত একবারের জন্যেও মেমসাহেবের দর্পচূর্ণ কর। ভেবেছিলাম ওই পাকাটির পুতুলকে তুই বুঝি এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিবি। তা—’

‘মেলা ফ্যাচ্ ফ্যাচ্ করিস নে যতীন, কাল রাতভোর জেগে শরীর খারাপ লাগছে, ঘুমোব।’

‘তাস খেলা হবে না?’

‘তোরা খ্যাল না!’ বলে পাখি উঠে পড়ে।

এই জরিপ অফিসের পিছনেই একখানা খড়ের চালা আছে পাখির। জমিটা বেওয়ারিশ, ঘরটা রাসবেহারীর খরচায় তোলা।

পাখি চলে গেলে, এরা বলে, ‘পাখির কি হলো বল দেখি?’

‘গঙ্গাজলী, সাহেব দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে।’

‘কিন্তু আশ্চর্য। পানিকর সাহেবের বিত্তান্ত ভাব? মেমসাহেবের সঙ্গে অত গলাগলি, অত বাড়াবাড়ি, তিনদিনের জন্যে মেমসাহেব পা মুচকে হাসপাতালে গেল সেই অবকাশেই সাহেব মচকাল।’

‘আহা যেতে দেনা আরো দু’দিন! মুখুয্যে মেমসাহেব খুব ঘুঘু বুঝছিস না? নিজেই পাখিকে তোয়াজ করছে—’

‘আরে বাবা। রেখে দাও। আমি বলছি মেমসাহেব খাল কেটে কুমীর আনছে। রাবণ রাজার মতন নিজের মিত্যুবাণ যত্ন করে তুলে রাখছে। পাখিকে চিনতে বাকী আছে তার।’

নিজের ভবিষ্যৎ বাণীতে পুলকিত গিরিধারী তাস বিলোতে শুরু করে।

কিন্তু হয়তো ওই ইতর লোকগুলোর কথাই সত্যি। হয়তো পাখিকে চেনা, মিসেস মুখার্জির মতো সভ্য ভদ্র সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ের পক্ষে অসম্ভব নয়।

কিন্তু পাখি?

নিজেকেই কি নিজে চেনে সে?

এই তো যে জীবনে সে অভ্যস্ত, সে জীবনকে হঠাৎ এমন ঘৃণ্য মনে হচ্ছে কেন তার?…এই তার বরাবরের সঙ্গীগুলোকে এমন নিকৃষ্ট মনে হচ্ছে কেন?

অথচ নিজের অক্ষমতাও যেন অপমানকর।…ওরা তাহলে ভাবছে পাখি বুড়িয়ে গেছে। পাখি গুটিয়ে যাচ্ছে। পাখির এখন থেকে পরিচয় শুধু সাহেববাড়ির চল্লিশ টাকা মাইনের আয়া? যাকে মেমসাহেবের ছাড়া শাড়ি কাচতে হয়, জুতোয় বুরুশ দিতে হয়, উঠতে বসতে ফরমাশ খাটতে হয়।…

আর কোনো মূর্তিতে ঝলসে উঠবে না পাখি? ঝলসে উঠতে পারবে না?…ওই তার আড্ডায় এসে হেসে গড়িয়ে পড়ে বলতে পারবে না, ‘সব কাঠই ঘুণে ধরা, বুঝলি? টোকা মারলেই ধরা পড়ে!’

পাখি জানে না মুখার্জি সাহেব ঘুণে ধরা কাঠ কিনা। পাখি নিজেই দেখে নি টোকা মেরে।

কিন্তু কেন?

নিজের সেই খোড়ো ঘরে শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ ভাবল পাখি। ওদের কাছে যে বলে এলো ঘুমোতে যাই, সে-কথা আর মনে থাকল না। তার বদলে অনেক ছেলেবেলার কথা মনে পড়ল ওর।…যখন দিদিমার কাছে থাকতো, তখনকার কথা। দিদিমা কিন্তু মা-মরা নাতনী বলে রেয়াৎ করত না, রোগা বলে মায়া করত না, খাটিয়ে খাটিয়ে মারতো।…একটু বয়েস হতেই বিয়ে দিয়ে দিল পাড়ার একটা বুড়োর সঙ্গে। হাড়-ঠকঠকে বুড়ো। আর সেই সময় জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হল পাখির।…

ওর এক মাসতুতো বড় বোন, অনেক বড়, ওর গালে টোকা মেরে বললো, ‘তুই যেমন হাবা, তাই ওই তিনকেলে বুড়োকে বিয়ে করলি, আমি হলে পালিয়ে যেতাম! দিদিমা বুড়ি কেন ওটার সঙ্গে তোকে জুড়ে দিল জানিস? বুড়ো নড়নড়ে, কদিনই বা বাঁচবে? দু’দিন বাদেই বিধবা হয়ে তুই আবার ঘরের মাল ঘরে ফিরে আসবি, দিদিমার রান্না করবি জীবনভোর। উপরি লাভ বুড়োর বারো বিঘে ধানজমি। ছেলেপিলে তো নেই বুড়োর!’

পৃথিবীকে সেদিন চিনল পাখি।

চেনালো সেই মাসতুতো দিদি।

তা পরে ভবিষ্যতে আরো চিনিয়েছে সে। ওই দিদিই তার গুরু! হ্যাঁ গুরু বৈ আর কি? জ্ঞানাঞ্জন শলাকা দিয়ে যে চোখ ফোটায়, সেই তো গুরু।

দিদি তা ফুটিয়েছে।

দিদিমা মারা যেতে বিধবা পাখি যখন অসহায় হয়ে চারিদিক অন্ধকার দেখছে, তখন মাসতুতো দিদি এসে তাকে কোলে তুলে নিয়ে চোখের জল ফেলে বললো, ‘এই রূপ এই বয়েস, গাঁয়ে থাকলে কি আর তোকে রাখবে পাখি? বাঘে ভালুকে ছিঁড়ে খাবে। আমার কাছে চল তুই।’

দিদির মুখে ভগবানের ছায়া দেখল পাখি।

দিদি পাখির বারো বিঘে ধানজমির ভার লাঘব করে দিয়ে, তার বদলে হালকা কখানা ছাপা কাগজ আঁচলে বেঁধে পাখির হাত ধরে বার করে নিয়ে এল তার চিরদিনের গ্রাম থেকে।

তারপর?

তারপর দিদি পৃথিবীকে ভালো করে চেনানোর ভার নিল। পাখির ধানজমির মতো, পাখির রূপ আর বয়েসের বিনিময়ে গোছা গোছা কাগজ আঁচলে বাঁধতে লাগলো দিদি!

কিন্তু জ্ঞানাঞ্জন শলাকার কাজও তো হচ্ছে ততদিনে?

চোখ-ফোটা পাখি একদিন দিদির বাসা থেকে উড়ে পালাল। তার পর কত আকাশে পাকা খেলো, কত গাছে বাসা বাঁধল, কত খাঁচায় ছোলা চিবোল, হিসেব নেই।

এখানে এসেছিল ইলেকট্রিক মিস্ত্রী শশীভূষণের সঙ্গে। বেচারী শশীভূষণ মারা গেল এখানেই। পাখি কাঁদলো। কিন্তু শশীভূষণের দলের লোকদের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেছে তখন।…এই এরা যতীন প্রভাপদ সুখলাল গিরিধারী।

আধ ডজনের ওপর লোক শোকার্ত পাখিকে স্নেহবন্ধনে ঘিরে ধরল।

অলিখিত আইনে সবাই জানে পাখি এখন রাসবেহারীর সম্পত্তি…তবে হাসিঠাট্টা হৈ-হুল্লোড়ে জীবনটা সরস করে নিতে দোষ কি? রাসবেহারী তাতে বাধাও দেয় না।

আর ওই ‘সাহেব’গুলো এলে?

এ যেন ওদের একটা খেলা।

ওদের দলের।

‘সব কাঠই যে ঘুণধরা’ এটা প্রমাণ হলেই যেন তাদের কোথায় একটা জয়।

পাখির ভার প্রমাণ করার।

কিন্তু এবার পাখি হেরে যাচ্ছে।

আশ্চর্য। প্রমাণ করবার চেষ্টা না করেই হার মানছে পাখি। তা তাই কি মানবে সত্যি সত্যি?

এরা বলে ‘কি রে পাখি, মনিবগিন্নীর জ্বর ছাড়ল?’

পাখি বলে, ‘ঘাম দিয়ে।’

‘তা গিন্নীর এতো সেবা করলি, সাহেব কিছু বখশিশ করলো না?’

পাখি এক বিচিত্র মুখভঙ্গি করে বলে, ‘করবে বলেছে!’

‘কবে?’

‘সময় আসুক।’

এরা আড়ালে বলে, ‘নবডঙ্কা! ওই তো মেমসাহেব দশটা টাকা দিয়েছে।’

‘ঘোড়েল! মেমসাহেবটা ঘোড়েল।’

পাখি এ সব শুনতে পায় না অবশ্য। তবু মেমসাহেবের হাত থেকে বখশিশ নিতে মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে ওর। মেমসাহেবের বিরক্তিই উৎপাদন করে এসেছে সে এযাবৎ, চক্ষুশূল হয়েছে তাদের আর আড়ালে সাহেবের কাছে হেসে গড়িয়ে বখশিশ আদায় করেছে।

কিন্তু এই মুখার্জি মেমসাহেব এমন অবলীলায় দেন যে ‘না’ করা যায় না। আর মুখার্জি সাহেব? তিনি যে কী তা আজ পর্যন্ত বুঝতে পারল না পাখি। এদিকে তো অন্য সাহেবদের চেয়ে শতগুণ সপ্রতিভ। তারা বরং সামনে অত ডাকাডাকি কথাবার্তা কইত না, এর সর্বদা ডাক ‘পাখি পাখি পাখি!’

‘পাখি তোমার মেমসাহেবকে বিকেলবেলা ফুড দিয়েছ?…পাখি তোমার মেমসাহেবের গা মুছিয়ে দিয়েছ।’ এসব কথাও যেমন বলেছে, তেমনি আজেবাজে কথাও তো ঢের কয়।

‘পাখি তোমায় এমন রান্না কে শেখাল বল দিকি?…পাখি আজ আমাদের কী খাওয়াচ্ছ? ….পাখি খরগোসের মাংস খেয়েছো কখনো?’…

কথা তো চলছেই।

আশ্চর্য, এই হরদম ডাকাডাকিতে মেমসাহেবের গোসা নেই।…

এইখানটায় পাখি যেন ধাঁধায় থাকে।

চিরদিনের জানা অঙ্কের পদ্ধতিতে হিসেব মেলে না।…পাখির চেনা পৃথিবী কি পাখির সঙ্গে নতুন কোনো মস্করা করছে? পাখি এখন করবেটা কি?

খবরটা সুখলাল এসে দিল।

‘পাখি জানিস না?’

‘কি?’

‘মেমসাহেব কলকাতায় যাচ্ছে—’

পাখি চমকে ওঠে।

এই তো ঘণ্টা কয়েক আগে এসেছে সে, কই শোনে নি তো? বললো, ‘যা ভাগ।’

‘তিন সত্যি কালীর দিব্যি। মেমসাহেবের ভাই এসেছে, বোনের বিয়ে। ভাইয়ের সঙ্গে আজই চলে যাবে মেমসাহেব। হঠাৎ বিয়ে বোধহয়।’

‘আর সাহেব?’

‘সাহেব?’

সুখলাল মুচকি হেসে বলে, ‘সাহেব তোর হেফাজতে রইল—’

‘যমের বাড়ি যাও তুমি লক্ষ্মীছাড়া!…সাহেব থাকবে, মেমসাহেব যাবে? মনেও করিস না। বিবি ছেড়ে এক মিনিট থাকতে পারে সাহেব? চোখের আড়াল হলেই বিবি যদি মরে যায়!’

‘দেখ, তিন সত্যি করলাম বিশ্বাস হলো না? পর্শু দিল্লী থেকে ‘চীফ’ আসছে, সাহেবের এখন সরবার সময় আছে? ওদিকে গিন্নীর বোনের বে। যাক তোর ঠাকুরই কলা খেলো!’

সুখলালের কথায় এদিক ওদিক থেকে ওরা এলো! হুমড়ে পড়ে বললো, ‘তাই নাকি? তাই নাকি? হুররে!’

‘মর তোরা!’ বলে কাজে চলে গেল পাখি।

এবং সন্ধ্যার আসরে এলো না।

‘দেখলি?’

‘দেখলি?’

‘দেখলি?’

অসভ্য হাসিতে ফেটে পড়ে বলে এরা ‘দু’ঘণ্টাও তর সইল না, চারটের গাড়িতে গেছে মেমসাহেব। আর আজই সন্ধেয়—’

ওদের জানা জগতের হিসেব মিলিয়ে নিশ্চিন্ত হলো ওরা।

বললো, মেমসাহেব ফড়িংটি হলে হবে কি, রাশভারী আছে। নইলে আর সাহেব এইভাবে সামলে চলে?’

কিন্তু গিরিধারী এক নতুন খবর আনলো।

একটা কুকুর তাড়াতে অফিস বাড়ির পিছনের দিকে গিয়েছিল বুঝি, এসে বললো, ‘পাখির ঘরে আলো জ্বলছে।’

আলো জ্বলছে।

পাখির ঘরে আলো জ্বলছে।

কে জ্বাললো আলো?

পাখি এসেছে তাহলে?…কিন্তু কখন এলো? এলো তো এদিকে এলো না কেন?…

শরীর-টরীর খারাপ হয় নি তো?

তাস ফেলে চললো ওরা।

তিন হাত ঘরের মধ্যে ছ’টা লোক ঢুকে পড়লো ঠেলে।

‘কী ব্যাপার রে পাখি?’

‘ব্যাপার আবার কী!’

‘শরীর খারাপ নয়তো?’

‘শরীর খারাপ শত্তুরের হোক!’

‘তা সাহেববাড়ি থেকে ফিরে হঠাৎ ঘরে এসে শুয়ে পড়েছিস যে? ওখানে যাস নি!’

‘মন যায় নি।’

‘তা না যেতে পারে—’ প্রভাপদ ত্যাবড়া গলায় বলে, ‘গরীবের আড্ডা বৈ তো নয়।…ওকে বোধহয় আবার এখন সাহেববাড়ি ডিউটি দিতে যেতে হবে, তাই জিরিয়ে—’

‘বেরো বেরো বেরো আমার ঘর থেকে, লক্ষ্মীছাড়া পাপেরা!’

পাখি মারমুখী হয়ে তেড়ে আসে, তার পরই হঠাৎ বসে পড়ে বলে, ‘চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসেছি—’

‘ছেড়ে দিয়ে এসেছিস? চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসেছিস? খাঁটি কথা ক’ না বাবা? মেমসাহেব ছাড়িয়ে দিয়ে গেছে তাই বল।’

‘নাঃ।’

পাখি হঠাৎ যেন শান্ত হয়ে যায়, গম্ভীর হয়ে যায়। উদাস হয়ে যায়। চৌকিতে বসে পড়ে বলে, ‘ছাড়িয়ে দিলেও তো মান মর্যাদার কিছু থাকতো!…ছাড়িয়ে দেয় নি, বরং উল্টো।…বললো কি, ‘তুমি রইলে পাখি, আমি নিশ্চিন্দি। বাবুর কোনো অযত্ন হবে না।…দেখাশোনা কোরো ভালো করে!’…শুনে কেন কে জানে, হঠাৎ ভারী রাগ হয়ে গেল। পা থেকে মাথা অবধি যেন তাদের এই ইলেকটিকের শক লাগলো। …বলে বসলাম, আপনি থাকবেন না, একা বাড়িতে, এ ক’দিন আমি আসতে পারব না।’…

শুনে মেমসাহেব যেন আকাশ থেকে পড়ল। অবাক হয়ে বললো, ‘এরকম অদ্ভুত কথা বলছ কেন পাখি? আমি থাকব না বলে সাহেবও কি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ রাখবেন? আমি থাকব না বলে তুমি কাজে আসবে না? এমন কথা তো শুনি নি কখনো—’

রক্ত মাথায় চড়ে উঠলো জানিস? বললাম, ‘এমন কথা কখনো শোনেন নি বুঝি?’

সাহেব বললো, ‘তা’ সত্যি, শুনি নি। মেমসাহেব না থাকায় বরং বেশী করে কাজ করবে, তা নয় ছুটি নিয়ে বাড়ি বসে থাকবে? অদ্ভুত তো!…দু’জনেই বললো, ‘অদ্ভুত!’

আমি বললাম, ‘ভূতদের তো সব অদ্ভুতই হবে সাহেব! যাক ক’দিনের ছুটিতে আর দরকার নেই, আমায় একেবারেই ছুটি দিয়ে দিন!…

‘আশ্চর্য!’ বলে মেমসাহেব নীরবে আমার মাইনে চুকিয়ে দিল।…চলে এলাম।’

‘তা আশ্চয্যিই বৈকি—’ রাসবেহারী বলে, ‘কী এমন হল বল দিকি যে অত ক্ষেপে গেলি?’

‘বুঝবি না। তোদের বোঝবার ক্ষমতা নেই—’ পাখি উদাস গলায় বলে, ‘মেয়েমানুষের অপমান বোঝা তোদের কর্ম নয়।…আসল কথা কী জানিস, ওরা আমাদের ‘মানুষ’ বলে গণ্য করে না। ওরা জানে, ওরা যেখানে—আমরা তার থেকে হাজার সিঁড়ি নিচুতে। তাই দু’জনায় গলা মিলিয়ে বলে, ‘অদ্ভুত!’

এর পরেও থাকবো সেখানে এই কথা বলিস তোরা? দুঃখী অভাগ্যি বলে কি চামড়ার নিচে রক্ত বয় না?’

__

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *