আসল জাদুকর
চমনলাল বললেন, ‘আমরা তো ম্যাজিশিয়ান, অনেক কিছু আমরা ভ্যানিশ করে দিতে পারলেও একটা জিনিস ভ্যানিশ করতে পারি না, তা হল মানুষের দুঃখকষ্ট৷ হুডিনি পারেননি, গণপতি পারেননি, ভানুমতিও পারেননি৷ আমি যদি আমার ক্ষুদ্র সামর্থ্যে এ দুটো বাচচার ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে পারি সেটা আমার কাছে অনেক বড়ো ব্যাপার৷ জীবনে অনেক আয় করেছি, তার কিছুটা এবার সৎকাজে হয়তো ব্যয় হবে৷’ চমনলালের ফরসা সুন্দর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল শেষ কথাগুলো বলার সময়৷ সমর বলল, ‘আজও আপনাদের মতো মহানুভব মানুষরা আছেন বলে এইসব দুঃস্থ শিশুরা হয়তো ভবিষ্যৎ জীবনে খুশির আলো দেখতে পায়৷ আমার অনাথ আশ্রমটা খুব ছোটো৷ আপনাদের মতো দয়ালু ব্যক্তিরা কিছু সাহায্য করেন বলে কোনো রকমে চলে যায়৷ বর্ষা আসছে, আপনার ডোনেশনের পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে ছাদটা সারিয়ে নিতে পারব৷ আর এই যমজ ছেলে দুটোরও একটা গতি হল৷ আপনার ছত্রছায়ায় থেকে নিশ্চয়ই ওরা মানুষ হয়ে উঠবে৷’
চমনলাল বললেন, ‘আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব৷ একজনকে আমি নিজের কাছে রেখে পড়াশেঅনা করাব, আর অন্য জনকে ভরতি করাব স্থানীয় নামি একটি বোর্ডিস্কুলে৷ তবে চিন্তা নেই, সপ্তাহে একবার ওদের দুজনের দেখা সাক্ষাৎ হবে৷ তাছাড়া গরম আর শীতের ছুটিতে দু ভাই একসঙ্গেই থাকবে৷’
যাদের সম্বন্ধে কথাগুলো বলা হল, বছর আটেকের যমজ দুই ভাই কানন আর সুজন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সমরের পিছনে৷ তাদের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ আন্দাজ করতে পারছে সমর৷ তারা ঘাবড়ে গেছে চমনলালের সঙ্গি আর সহকারিকে দেখে৷ দানবের মতো চেহারা লোকটার৷ ঘোর কৃষ্ণবর্ণ৷ ম্যাজিক দেখাতে গিয়েই নাকি কী একটা অ্যাক্সিডেন্টে প্রৌঢ় যাদুকরের সহযোগী এই তরুণের মুখের একপাশ পুড়ে গেছিল৷ তার দাঁতগুলোও বাইরে বার করা৷ সব মিলিয়ে ছোটোদের কাছে ভয় পাওয়ার মতো অবয়ব তার৷ সমরেরও তার দিকে তাকাতে কেমন যেন অস্বস্তিবোধ হচ্ছে৷ লোকটার নাম রতন সিং৷ সে দেখতে চমনলালের ঠিক বিপরীত৷ কিছুক্ষণ আগেই স্থানীয় আদালত থেকে হোটেলে ফিরেছে সবাই৷ অনাথ ছেলে দুটোকে যাদুকর চমনলালের হাতে তুলে দেবার জন্য প্রয়োজনীয় সই সাবুদের কাজ সেখানেই মিটে গেছে৷ ছেলে দুটোকে এবার তার সঙ্গে নিয়ে যাবেন মিস্টার চমনলাল৷ সে কথাই এরপর সমরকে বললেন তিনি— ‘এবার কিন্তু আমাদের বিদায় নেবার সময় হয়েছে৷ আসলে কাল আমার একটা গ্র্যান্ড শো আছে৷ তার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে৷ নইলে আপনার সঙ্গে আরও কিছুটা সময় কাটাতে পারতাম৷ আপনার ট্রেন তো কাল রাতে? এই ইলাহাবাদে অনেক কিছু দেখার আছে৷ বিখ্যাত ত্রিবেণী সঙ্গম, ইলাহাবাদ ফোর্ট, স্বরাজ ভবন এসব৷ জানেন তো, অনেকে বলেন যে এই ইলাহাবাদ ছিল ভারতের দ্বিতীয় প্রচীনতম নগরী৷ অনেক প্রাচীন মন্দিরও আছে এখানে৷ একটা টাঙা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ুন কাল৷ এসব দেখে নিতে পারবেন৷’
এ কথা বলার পর বাচচা দুটোর উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘তোমরা এবার এসো আমার সঙ্গে৷’
সেই দানবাকৃতি লোকটাও হাত বাড়িয়ে বলল, ‘তোমরা আসো আমার কাছে৷’
কিন্তু সে ডাকাতেই ছেলেদুটো না এগিয়ে ভয় পেয়ে খামচে ধরল সমরের কোমর৷ তা দেখে চমনলাল হেসে বললেন, ‘তোমরা ওকে ভয় পেও না, এই রতন আঙ্কলও খুব সুন্দর ম্যাজিক জানে৷ তোমরা ম্যাজিক শিখবে? ও তোমাদের অনেক ম্যাজিক শিখিয়ে দেবে৷’ — এ কথা বলে তিনি কি একটা ইশারা করলেন তার সহকারীকে৷ রতন সিং প্যান্টের পকেট থেকে একটা ডিম বার করে হাতের তালুর মধ্যে রেখে হাত মুঠো করল৷ পরমুহূর্তেই হাত খুলতে সে ডিম ভ্যানিশ! রতন এরপর ছেলে দুটোকে বলল, ‘এবার দেখো, একটা ডিম ভ্যানিশ হয়ে গেলেও কতগুলো ডিম পাওয়া যায়? এই বলে সে নিজের মুখ, কান, নাক থেকে প্রায় এক ডজন ডিম বার করে সেগুলোকে আবার একটা ডিমে পরিণত করে তার বুকের মধ্যে রাখল৷ আর এরপরই সে বলে উঠল, ‘এ যাঃ ডিম টা মনে হয় ফুটে গেল৷ আর তার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই তার বুকের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল জ্যান্ত এক মোরগ! রতনের হাতে বসে সে ডেকে উঠল— ‘কোঁকোঁর কোঁ, কোঁ…৷’ তাই দেখে ভয় ভুলে তালি দিয়ে উঠল দুই ভাই৷ কী মজার কাণ্ড!
মুহূর্তের জন্য সব ভুলে সমরও তালি দিয়ে উঠল৷ কিন্তু তার পরই জলে ভরে উঠল চোখ৷ সে জড়িয়ে ধরল বাচচা দুটোকে৷ কত দিনের সম্পর্ক এই ছোট্ট ছেলেদুটোর সঙ্গে৷ এদের দু ভাইয়ের যখন মাত্র বছর দুই বয়স, তখন এই অনাথ শিশুদুটেকে একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তার হোমে দিয়ে গিয়েছিল৷ তারপর থেকে সমরের কাছেই মানুষ তারা৷ মাত্র দিন পনেরো আগে সমর কলকাতার এক খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখেছিল যে যমজ বাচচার দায়িত্ব নিতে চান ইলাহাবাদের বিখ্যাত ম্যাজিশিয়ান চমনলাল৷ বাচচা দুটোর ছবি সমেত চমলালের কাছে তাদের দায়িত্ব নেবার আবেদন জানায় সমর৷ জবাবও মেলে সঙ্গে সঙ্গেই৷ তার সঙ্গে ট্রেনের টিকিটও পাঠান তিনি৷ অবিলম্বে ইলাহাবাদে আসতে হবে৷ কারণ, কদিনের মধ্যেই তিনি শো করতে বিদেশ যাচ্ছেন, তার আগেই বাচচা দুটোকে তাঁর হাতে তুলে দিতে হবে৷ সেই মতো গতকাল রাতে তাদের নিয়ে সমর ইলাহাবাদে পৌঁছেছে৷ বাচচা দুটোর সঙ্গে এত তাড়াতাড়ি যে বিচ্ছেদ হবে তা সে বুঝতে পারেনি৷ বাচচা দুটোকে চমনলালের হাতে তুলে দেওয়া ছাড়া উপায়ও ছিল না সমরের৷ তার অনাথ আশ্রমটা ধুঁকতে ধুঁকতে চলছে৷ কোনোদিন আশ্রম বন্ধ হয়ে গেলে কী হবে এই ছেলেদুটোর৷ তার চেয় চমনলালের কাছে নিশ্চিন্তে বড়ো হবে তারা৷ চমনলালের কেমন সুন্দর শান্ত-সৌম্য মুখশ্রী৷ তাকে দেখেই মনে হয় লোকটা খুব মানবিক, হূদয়বান৷ শুধু ওই কুৎসিত লোকটা যদি চমনলালের সঙ্গী না হত, তবে যেন আরও ভালো হত৷ ওই লোকটা আবার বাচচা দুটোকে কিছু করবে নাতো? এ প্রশ্নটাই মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে সমরের মনে৷ বিদায় পর্ব মিটল এক সময়৷ চমনলাল তার সঙ্গী আর বাচচা দুটোকে নিয়ে হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন৷
২
জাদুকর চমনলাল তাদের নিয়ে চলে যাবার পর হোটেলের ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘণ্টাখানেক চুপচাপ শুয়ে রইল সমর৷ বাচচা দুটোর বিচ্ছেদ বেদনা কাটিয়ে ধাতস্থ হতে বেশ কিছুটা সময় লাগল তার৷ সমরের এরপর মনে হল যে ঘরে শুয়ে না থেকে বাইরে থেকে বেড়িয়ে এলে বরং মনটা একটু ভালো হতে পারে৷ তা ছাড়া এ হোটেলে খাবার পাওয়া যায় না৷ রাতের খাবার খাওয়ার জন্য তাকে বাইরে বেরোতে হবে৷ এই ভেবে এরপর হোটেল ছেড়ে বাইরে পা রাখল সমর৷
চমনলাল যে হেটেলে সমরের থাকার ব্যবস্থা করেছেন এ জায়গা শহরের বাইরের দিকে৷ রাত নেমেছে, জায়গাটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা৷ বেশ অনেকটা দূরে বিন্দু বিন্দু আলো জ্বলছে৷ সমরের মনে হল সেই আলোগুলো যেন মৃদু কাঁপছে৷ হোটেলের বাইরে রাস্তায় একটা টাঙা দাঁড়িয়েছিল৷ সমর তাকে জিজ্ঞেস করল, ওই আলোগুলো কিসের? ওঠা কোন জায়গা?’
টাঙ্গাওয়ালা বলল, ‘ওটা নদী, ওগুলো বজরার আলো৷’
সমর জানতে চাইল, ‘ওটা কী প্রয়াগ? যেখানে কুম্ভ মেলা হয়?’
সে বলল, ‘না বাবুজি, প্রয়াগ অনেক দূরে আছে৷ ওটা গঙ্গা৷ আপনি যাবেন ওখানে?’
সমর চড়ে বসল টাঙাতে৷ খটাখট শব্দে দুলকি চালে চলতে শুরু করল টাঙা৷ নদীর দিকে চলতে চলতে সমর টুকটাক নানা কথা বলতে লাল টাঙাওয়ালার সঙ্গে৷ কথা বলতে বলতে টাঙাওয়ালা এক সময় বলল, নদীর পাড়ে কাল সকালে বহুত ভিড় হবে৷ টিভি, পত্রকার সব আসবে শুনছি!’
সমর জানতে চাইল, ‘কেন? কাল কোনো পরব আছে নাকি?’
সে জবাব দিল, ‘না বাবুসাব৷ পরব না৷ বাজিকর চমনলাল কী একটা খেলা দেখাবে ওখানে৷ ও খেলা শুধু চমনলালই নাকি দেখাতে পারে৷ তা দেখতেই লোক আসবে৷ চমনলাল সবচেয়ে বড়ো বাজিকর৷’
টাঙাওয়ালার কাছে চমনলালের কথা শুনে বেশ আশ্চর্য হয়ে গেল সমর৷ চমনলাল তাহলে বেশ খ্যাতিমান ব্যক্তি!
হ্যাঁ, তিনি একবার বলেছিলেন বটে আগামীকাল তার শোয়ের জন্য ব্যস্ত তিনি৷
টাঙাওয়ালার সঙ্গে কথা বলতে বলতে গঙ্গার পাড়ে গিয়ে নামল সমর৷
বেশ রাত হয়েছে৷ ঘাট মোটামুটি ফাঁকা হয়ে গেছে৷ নদীর জলে ভেসে আছে বেশ কিছু বজরা, নৌকো৷ তাদের আলোগুলো দুলছে৷ নদীর পাড়ে কয়েকটা জায়গাতে আগুন জ্বেলে বসে আছে সাধুসন্তের দল৷ ঠান্ডা বাতাস ভেসে আসছে নদীর বুক থেকে৷ সমর পাড় ধরে হাঁটতে শুরু করল৷ কিছুটা এগিয়েই নদীর ধারে পার্কের মতো একটা জায়গা৷ সেখান থেকে প্রশস্ত সিঁড়ি নেমে গেছে ঘাটের দিকে৷ তার মুখটাতে বাতিস্তম্ভে বাতি জ্বলছে৷ সমরের জায়গাটা বেশ ভালো লাগল৷ সিঁড়ি বেয়ে নেমে সে একদম নীচের ধাপে গিয়ে বসল৷ তার পয়ের কাছে পাথুরে সিঁড়িতে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ধাক্কা খাচ্ছে নদীর জল৷ ঘাটের কিছুটা তফাতে নদীর জলে বেশ বড়ো মকরমুখী একটা বজরা ভাসছে৷ আলো জ্বলছে তাতে৷ নদীর দিকে তাকিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল সমর৷ হঠাৎ তার কিছুটা তফাতেই তাকে চমকে দিয়ে জলের মধ্যে থেকে ধুম করে উঠে এল ছায়ামূর্তি৷ সে এগিয়ে আসতে লাগল ঘাটের দিকে৷ এত রাতে এই ভরা গঙ্গায় স্নান করতে নেমেছিল লোকটা! হঠাৎ ঘাটের বাতিস্তম্ভের আলোটা পড়ল লোকটার মুখের একপাশে৷ সঙ্গে সঙ্গে সমরের শিরদাঁড়া দিয়ে যেন একটা হিমেল স্রোত নেমে গেল৷ এ কী মানুষ না অন্য কেউ?
লোকটাও এরপর ফিরে তাকাল সমরের দিকে এবং পর মুহূর্তেই তাকে চিনতে পেরে বলে উঠল, ‘বাঙালিবাবু! আপনি এখানে? আমি রতন সিং৷ ম্যাজিশিয়ান চমনলালের অ্যাসিসটেন্ট৷ চিনতে পারছেন?’
একে তার ওরকম দানবীয় বীভৎস চেহারা৷ তার ওপর অন্ধকার নদী থেকে হঠাৎ এমনভাবে উঠে আসা! এই দুই মিলে বেশ ঘাবড়েই গিয়েছিল সমর৷ এ লোকটার জন্যই চমনলালের মতো অত সুন্দর মানুষের হাতে বাচচা দুটোকে তুলে দিয়েও সমর একটু অস্বস্তিতে আছে৷ সে বলল, ‘হ্যাঁ চিনেছি, রাতে আপনি নদীতে সাঁতার দিচ্ছিলেন!’
ঘাটে উঠে এল রতন সিং৷ সমরও উঠে দাঁড়াল৷ রতন সিং-এর সারাদেহ থেকে জল ঝরছে৷ সে সমরের দিকে তাকিয়ে নদীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা মকরমুখী বজরার দিকে আঙুল তুলে বলল; ‘ওটা হল চমনলালের বজরা৷ ওখান থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ডুব সাঁতারে ঘাটে এসে উঠলাম৷’
‘বজরা থেকে নদীতে ঝাঁপ দিলেন কেন?’ একটু বিস্মিতভাবে জানতে চাইল সমর৷
রতন সিং মাথার চুল থেকে জল ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, ‘কী কারণে ঝাঁপ দিলাম সেটা খুলে বলা যাবে না৷ তবে এটুকু বলি যে কাল এখানে একটা বড়ো শো আছে চমনলালের৷ তারই প্রস্তুতি চলছে এখন৷ পঁচিশ বছর পর আবার তার বিখ্যাত খেলাটা দেখাতে চলেছেন চমনলাল৷ ওই দেখুন—’
তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সমর দেখতে পেল ঘাটের ওপর পার্কের গায়ে এক জায়গাতে বিশাল একটা হোর্ডিং টাঙানো৷ তাতে জাদুকরের বেশে চমনলালের ছবি৷ তার গায়ে বড়ো বড়ো করে লেখা আছে— ‘গ্রেট শো অফ চমনলাল৷’ সমর জানতে চাইল, ‘কী খেলা দেখাবেন চমনলাল?’
লোকটা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে কিছুটা আপন মনেই যেন প্রথমে বলল, ‘তার সবচেয়ে বিখ্যাত খেলাটা৷ এ খেলাটা আমি ছেলেবেলায় একবার দেখেছিলাম৷ খুব আবছা মনে আছ৷ গঙ্গার পাড়ে অনেক লোক, বজরা থেকে শিকলবাঁধা বাক্সটা ধীরে ধীরে জলে নামানো হচেচ্ছ…৷
সমরও তার সঙ্গে সঙ্গেই ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছিল৷ এরপর সে সমরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘না, খেলাটার কথা এখন আপনাকে বলা যাবে না৷ কাল সকাল দশটায় এখানে চলে আসুন, নিজের চোখেই দেখবেন খেলাটা৷’
ওপরে উঠে এল তারা দুজন৷ সমর এরপর তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, বাচচা দুটো এখন কোথায়? কেমন আছে ওরা?’
রতন সিং জবাব দিল, ‘এখন ওরা চমনলালের হাবেলিতে আছে৷ ওখানে গিয়ে ওরা আপনার জন্য একটু কান্নাকাটি করছিল৷ আমি ওদের খেলা দেকিয়ে, কিছু পশুপাখি আছে সেগুলো দেখিয়ে ওদের শান্ত করলাম৷ এখন পর্যন্ত ওরা ভালোই আছে৷ এখানকার কাজ মিটলে আমি আবার তার হাবেলিতে ফিরব৷ তখন দেখা হবে ওদের সঙ্গে৷’
অন্ধকার নদীর দিকে তাকিয়ে বাচচা দুটো কথা ভেবে কেমন হুহু করে উঠল সমরের বুক৷ সারা জীবন বাচচাদুটোর ভরনপোষণের নিশ্চয়তা থাকলে বাচচা দুটোকে সে এমনভাবে অপরিচিত লোকের হাতে তুলে দিয়ে যেত না৷ সমরের চোখ জলে ভরে এল৷ তাদের কথা ভাবতে ভাবতে কিছুক্ষণ নদীর কালো জলের দিকে তাকিয়ে থাকার পর অবেগ মথিত কণ্ঠে রতন সিং-এর হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ছেলে দুটোকে আপনাদের হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছি৷ ওদের দেখবেন৷ আমার অনাথ আশ্রমে অনেক অভাব থাকলেও কোনোদিন ওদের দুঃখ পেতে দিইনি৷ কোনোদিন হাত তুলিনি ওদের গায়ে৷ নিকট আত্মীয়র মতোই ওদের বড়ো করার চেষ্টা করেছি৷ আপনিতো নিশ্চয়ই ওদের সঙ্গেই থাকবেন৷ আমাকে কথা দিন, ওদের কোনো কষ্ট হবে না…৷’
সমর আর কিছু বলতে পারল না৷ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এল তার স্বর৷ তার কথা শুনে রতন সিং তাকিয়ে রইল তার দিকে৷ মুহূর্তের জন্য সমরের মনে হল এই দানবাকৃতি লোকটার চোখেও কোনেও কী যেন চিকচিক করছে! নাকি সেটা নদীর জল? রতন সিং-এরপর কিছুটা অস্পষ্টভাবে বলল, ‘ডুব সাঁতারটা আমি একটু ভালোই জানি এই যা ভরসা৷ আমি চেষ্টা করব৷’
সমর জিজ্ঞেস করল, ‘তার মানে?’
রতন সিং তার কথার কোনো জবাব না দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নিচে নেমে আবার ঝাঁপ দিল জলে৷ যেমন অদ্ভুতভাবে সে উঠে এসেছিল, তেমন অদ্ভুতভাবেই সে আবার হারিয়ে গেল৷
৩
নদীর পাড় থেকে খাওয়া দাওয়া সেরে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেছিল সমরের৷ হোটেলের ঘরে রাতে ভালো ঘুম হয়নি সমরের৷ বার বারই ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল৷ কখনও তার চোখে ভেসে উঠছিল বাচচা দুটোর মুখ, কখনও বা চমনলালের সহকারী সেই অদ্ভুত লোকের ভয়ংকর মুখটা৷ শেষ রাতের দিকে ঘুম এসেছিল তার, তাই ঘুম ভঙতে বেশ দেরি হল তার৷ সমর আজই কলকাতার ট্রেন ধরবে৷ চমনলাল বলেছিল শহরটা আজ ঘুরে নিতে৷ কিন্তু সমর ঠিক করল সে যাবে গঙ্গার ঘাটে, যেখানে চমনলাল খেলা দেখাবেন৷ ছেলে দুটোও থাকতে পারে সেখানে, অথবা খেলা শেষে চমনলালের সঙ্গে কথা বলে তার হাবেলিতে গিয়ে শেষ বারের জন্য একবার সে দেখে আসবে বাচচা দুটোকে৷
সমর যখন নদীর পাড়ে যাবার জন্য জন্য তৈরি হয়ে হোটেল থেকে বেরুল তখন প্রায় নটা বাজে৷ একটা টাঙা নিল সমর৷ গন্তব্যে এগোতে এগোতেই সে বুঝতে পারল চমনলালের গ্রেট-শো বেশ আলোড়ন তুলেছে শহরে৷ বহু মানুষ যাচ্ছে সেখানে৷ এমনকি টাঙাওয়ালাও বলল, সমরকে ও জায়গাতে নামিয়ে সে নিজেও নাকি ওখানেই থাকবে ভোজবাজি দেখার জন্য৷
নির্দিষ্ট জায়গাতে পৌঁছে সমর টাঙা থেকে নামল৷ যে জায়গাটা গতকাল রাতে জনশূন্য ছিল, সে জায়গাটা আজ লোকারণ্য৷ যেন কোনো মেলা বসে গেছে সেখানে, ঘাটের ওপরে-নিচে নদীর পাড় ধরে খালি মানুষের মাথা আর মাথা৷ ভিড় ঠেলে সমর কোনো রকমে ঘাটের কিনারে নদীর পাড়ে গিয়ে দাঁড়াল৷ সেখানে মানুষের এত ঠেসাঠেসি, ঠেলাঠেলি যে যে-কোনো সময় কেউ ছিটকে পড়তে পারে জলে৷ খাঁকি পোশাকের একজন পুলিশ কনস্টেবল একটা হ্যান্ডমাইক নিয়ে জনতাকে সংযত করার চেষ্টা করছে৷ নদীর ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে জাদুকরের মকরমুখী বজরা৷ রঙিন পতাকা দিয়ে সাজানো হয়েছে সেটা৷ বজরা থেকে হাত কুড়ি লম্বা একটা কাঠের পাটাতন বেরিয়ে এসে ঝুলছে জলের ওপর৷ সেই পাটাতনের সঙ্গে একটা কপিকল লাগানো৷ নদীর পাড়ে দাঁড়ানো সবাই তাকিয়ে আছে সেই বজরার দিকে৷ আশেপাশের লোকজনের আলোচনা শুনে সমর বুঝতে পারল চমনলাল নাকি ওই বজরাতেই আছেন, নির্দিষ্ট সময় দেখা দেবেন তিনি৷ আর কিছুক্ষণের মধ্যেই চমনলালের খেলাটা সম্বন্ধেও জানতে পারল সমর৷ পাশে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধ বললেন যে বছর পঁচিশ আগে নাকি তিনি এ খেলাটা একবার দেখেছিলেন৷ বজরা থেকে জলের ওপর ঝুলতে থাকা পাটাতনের ওপর থেকে শিকলবন্দি একটা সিন্দুক জলে ফেলা হবে৷ তার ভিতরে থাকবে একজন ছেলে৷ শিকলবন্দি সিন্দুক থেকে সেই ছেলে আবার বেরিয়ে এসে দেখা যাবে বজরার ছদে! সবার চোখের সামনেই ঘটবে এই বিস্ময়কর খেলা!
সময় যত এগোতে লাগল তত বাড়তে লাগল লোক সমাগম৷ বেশ কয়েকটা টিভি ক্যামেরাও বসানো হয়েছে ঘাটের ওপর উঁচু জায়গাতে৷ ক্যামেরার লেন্স তাগ করা আছে বজরার দিকে৷ দশটা যখন বাজল তখন নদীর পাড়ে তিলধারনের জায়গা নেই৷
ঠিক কাঁটায় কাঁটায় দশটায় বজরার ছাদে এসে দাঁড়ালেন বিখ্যাত যাদুকর চমনলাল৷ তার পরনে এখন ঝলমলে জরিদার পোশাক, মাথায় পাগড়ি৷ সূর্যের আলোতে ঝলমল করছেন তিনি৷ তার হাতে একটা যাদু দণ্ড আর হ্যান্ডমাইক৷ তাকে দেখে তুমুল হর্ষধ্বনি উঠল নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা জনতার মধ্যে৷ সমবেত জনতাকে অভিবাদন জানিয়ে হ্যান্ডমাইকে চমনলাল বললেন, ‘আমি আজ যে খেলাটা দেখাতে যাচ্ছি সে খেলাটা এক সময় দেখাতেন বিখ্যাত যাদুকর হুডিনি৷ জলের তলায় শিকলবন্দি সিন্দুক থেকে বেরিয়ে আসবে মানুষ৷ শুধু এ দেশেই নয়, সারা পৃথিবীতে এ খেলা দেখার সৌভাগ্য খুব কম লোকেরই হয়৷ এ দুঃসাহসী খেলা দেখাবার সাহস কোনো জাদুকরের হয় না৷ পঁচিশবছর আগে আমি এখানে এই খেলা প্রথম দেখিয়েছিলাম৷ আজ আবার দেখাব৷ আমার অনুরোধ নদীর পাড়ে যাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন তাদের মধ্যে থেকে কয়েকজ নিরপেক্ষ লোক, সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধি বজরাতে চলে আসুন, যারা পরীক্ষা করে দেকবেন যে সত্যিই সিন্দুকের মধ্যে মানুষ থাকছে কিনা? সিন্দুকটা সত্যি শিকল দিয়ে বেঁধে তালা চাবি দেওযা হচ্ছে কি না? অর্থাৎ আমি কোনো কারসাজি করছি কিনা সেসব ব্যাপার৷ তারা কোনো ফাঁকি ধরতে পারলে নগদ পাঁচলক্ষ টাকা পুরস্কার৷’
ঘাটের একপাশে এখটা ছোটো নৌকো দাঁড়িয়েছিল৷ হয়তো বা সেটা চমনলালেরই নৌকো হবে৷ ঘোষণা শেষ হতেই কয়েকজন উৎসাহী লোক আর সাংবাদিক চড়ে বসল সেই নৌকোতে৷ তারা এগিয়ে চলল বজরার দিকে৷ ওদিকে বজরার ভিতর থেকে বেশ কয়েকজন লোক বেরিয়ে একটা লোহার সিন্দুক এনে রাখল সেই ঝুলন্ত পাটাতনের ওপর৷ বজরায় পৌঁছে পাড়ের লোকগুলোও উঠে দাঁড়াল সেই পাটাতনে৷ তারপর পরীক্ষা করতে লাগল সেই সিন্দুকটা৷ কিছু সময় পেরিয়ে গেল৷ চমনলাল এরপর ঘোষণা করলেন, ‘যাকে ওই সিন্দুকের ভিতর ঢোকানো হবে, জীবনের বাজি রেখে যে খেলাটা খেলবে, এবার অমি আমার সেই সহকারীকে আপনাদের সামনে হাজির করছি৷ আপনারা তাকে করতালি দিয়ে অভিনন্দিত করুন৷
বজরার ছাদে হাজির হল একটা ছোট্ট ছেলে৷ তার পরনেও রঙচঙে পোশাক৷ কিন্তু তাকে দেখেই চমকে উঠল সমর৷ আরে এ যে কানন অথবা সুজন! ওকে সিন্দুকে তালা বন্ধ করে জলে ফেলতে যাচ্ছেন চমনলাল! আতঙ্কে সমর চিৎকার করে উঠল, ‘চমনলাল আপনি এ কী করছেন! বাচচাটা মরে যাবে যে, মরে যাবে যে!’
কিন্তু সমরের আর্তনাদ করতালি আর চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে ঢাকা পড়ে গেল৷ তার পাশে দাঁড়ানো সেই ভদ্রলোক সমরকে বললেন, ‘আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন? চমনলালের এ খেলা আমি দেখেছি৷ বাচচাটা ঠিক উঠে আসবে জলের ভিতর থেকে৷’
হতবাক সমর তাকিয়ে রইল বজরার দিকে৷ উত্তেজনায় তার হাত পা কাঁপছে৷ চমনলালের সঙ্গে ছাদ থেকে নেমে তার পায়ে পায়ে বাচচাটা এসে দাঁড়াল পাটাতনের বাক্সটার সামনে৷ সমরের চারপাশে আবার হাততালির ঝড় উঠল৷ সিন্দুকে ঢোকার অগে বাচচাটা যেন একবার অসহায় ভাবে তাকাল পাড়ে দাঁড়ানো জনতার দিকে৷ সে কী সমরকে খুঁজছে? সমর চিৎকার করার চেষ্টা করল, ‘এই যে আমি এখানে…৷’ কিন্তু সে শব্দ চাপা পড়ে গেল চিৎকার চেঁচামেচিতে৷
ছেলেটা বাক্সর ভিতর ঢুকল৷ তার ডালা বন্ধ করল চমনলাল৷ শিকল বেঁধে সিন্দুকে তালা দেওয়া হল৷ পাড় থেকে যারা বজরায় গেছিল তারা পরীক্ষা করল সব কিছু৷ এরপর বাক্সটা কপিকলে বেঁধে ধীরে ধীরে জলে নামানো শুরু হল৷ সিন্দুকের কিনারা যখন জলে স্পর্শ করল তখন ভয়ে, চোখ বন্ধ করে ফেলল সমর৷ উত্তেজনায় সমবেত জনতাও একবার নিশ্চুপ হয়ে গেছে৷ মাইক্রোফোনো শুধু চমনলালের গলা শোনা গেল, ‘কিছুক্ষণের মধ্যেই সিন্দুকটা আবার ওপরে তোলা হবে৷ আপনারা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন৷’
প্রতিটা মুহূর্ত যেন এক একটা মিনিট, একটা মিনিট যেন একটা ঘণ্টা৷ সমর নিজের হৃৎস্পন্দন স্পষ্ট শুতে পাচ্ছে৷ জনতাও নিশ্চুপভাবে দাঁড়িয়ে আছে সিন্দুক উঠে আসার প্রতীক্ষায়৷ টিভি ক্যামেরার লেন্সগুলোও তাকিয়ে জলের দিকে৷
মাইক্রোফোন হাতে যাদুকর চমনলাল বলে যাচ্ছেন নানা কথা৷ তিনি যে পৃথিবীর সেরা জাদুকর সেটাই তিনি তার বক্তব্যে বোঝাবার চেষ্টা করছেন৷ সেসব কথা অবশ্য সমরের কিছুই কানে ঢুকছে না৷ এমন করে প্রায় আধঘণ্টা সময় কেটে গেল৷ তারপর চমনলাল ঘোষণা করলেন, ‘এবার আমরা সিন্দুকটা তুলব৷ কেউ চোখের পাতা ফেলবেন না৷ ভালো করে সিন্দুকটা লক্ষ করবেন৷’
অন্য সবার সঙ্গে সমরও নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইল বজরার দিকে৷ ঘড়ঘড় শব্দে কপিকল তুলল জলের ভিতর থেকে৷ একই রকম শিকল বাঁধা আছে তার গায়ে৷ পাটাতনের ওপর সেটা উঠিয়ে শিকল, তালা খোলা শুরু হল তার৷ সমরের হৃৎপিণ্ড যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে৷ সিন্দুকের ডালা খোলা হল৷ তারপর সেটা কাত করা হল সবাইকে দেখাবার জন্য৷ সিন্দুকের ভেতর ছেলেটা নেই! মুহর্তের নিস্তব্ধতা, তারপর প্রবল হাততালির ঝড় উঠল জনতার মধ্যে৷ সেই শব্দ যেন ঢেউ তুলল নদীর জলে৷ সমরের বুকের ভারটাও যেন কিছুটা হালকা হয়ে গেল ফাঁকা সিন্দুকটা দেখে৷ চমনলাল এরপর বললেন ‘যে বাচচাটা সিন্দুকের মধ্যে ছিল সে কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির হবে আপনাদের সামনে৷ আপনার অপেক্ষা করুন, ঠিক সেই মুহূর্তে সমরের মোবাইলটা বেজে উঠল৷ অচেনা নাম্বার৷ কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সুজনের গলার স্বর ভেসে এল, ‘আমি আর কানন তোমার হোটেলের ঘরে ফিরে এসেছি৷ তুমি এখনই ফিরে আসো৷’ আর তারপর শোনা গেল, ‘আমি রতন সিং বলছি৷ আমি বাচচা দুটোকে নিয়ে এসেছি৷ আপনি এখনই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হোটেলে চলে আসুন৷ যে-কোনো মুহূর্তে বিপদ ঘটতে পারে ওদের৷ তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি…৷’ লাইনটা কেটে গেল এরপর৷ ওই ভয়ংকর দেখতে লোকটা বাচচা দুটোকে হোটেলে নিয়ে গেল কেন? সমরের বুক কেঁপে উঠল৷ চমনলালের কথা অনুযায়ী তো কানন বা সুজন কিছুক্ষণের মধ্যে এখানেই দেখা দেবে! তাহলে ওরা হোটেলে কী ভাবে তা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না সমর৷ কিন্ত ফোনটা পাওয়ার পর সমর আর দেরি না করে ভিড় ঠেলে ছুটতে শুরু করল হোটেলে ফেরার জন্য৷ ভাগ্যক্রমে একটা টাঙ্গাও পেয়ে গেল সে৷
৪
হোটেলে নিজের ঘরে ঢুকেই সে দেখতে পেল তিনজনকে৷ চমনলালের সহকারী আর কাননের সারা দেহ থেকে জল ঝরছে৷ রতন সিং জড়িয়ে ধরে আছে কাননকে৷ তার চোখমুখ ভয়ে রক্ত শূন্য৷ সমরকে দেখে সে কেঁদে ফেলল৷ সমর রতন সিং-এর কাছ থেকে তাকে কোলে তুলে নিয়ে জানতে চাইল, ‘কী হয়েছে? আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না?’
রতন সিং বেশ উত্তেজিতভাবে বলল, ‘সব কিছু বুঝিয়ে বলার মতো সময় এখন নেই৷ চমনলালকে আমি ফোন করেছি এই মাত্র৷ সে এসে পড়ল বলে৷ তার সঙ্গে আজ বোঝাপড়া হবে আমার৷ শুধু এইটুকু মনে রাখুন যে চমনলাল নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল এই বাচচাটাকে৷ কিছুটা আমার জন্য, আর কিছুটা কপালের জোরে বাচচাটা এখনও বেঁচে আছে৷ আপনি একটা কাজ করুন এই বাচচাটাকে নিয়ে বাথরুমের আড়ালে চলে যান৷ চমনলাল যেন আপনাদের উপস্থিতি টের না পায়৷ আর অন্য ছেলেটাকে নিয়ে আমি থাকব ঘরের ভিতর৷ তারপর দেখুন কী হয়!’ আশ্বাস দেবার ভঙ্গিতে লোকটা তার দানবের মতো থাবাটা সমরের ঘাড়ের ওপর রাখল৷
লোকটা কী বলছে তা কিছুই বুঝতে পারছে না সমর৷ রতনসিং এরপর বলল, ‘আপনার অনাথ আশ্রমের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বরটা চটপট একটা কাগজে লিখে দিন তো৷ ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে চমনলালের কাছ থেকে৷’ কিসের ক্ষতিপূরণ তা বুঝতে না পারলেও সমর একটা চিরকুটে নম্বরটা লিখে দিল৷ আর এরপরই হোটেলের বাইরে একটা গাড়ির শব্দ শোনা গেল৷ সম্ভবত চমনলাল এসেছেন! রতন সিং-এর কথামতো কাননকে নিয়ে বাথরুমের মধ্যে লুকিয়ে পড়ল সমর৷ দরজার ফাঁক দিয়ে সে দেখতে লাগল ঘরের ভিতরটা৷ আর সুজনকে নিয়ে ঘরের ভিতর দাঁড়িয়ে রইল রতন সিং৷
দরজা ঠেলে ঝড়ের বেগে ঢুকলেন জাদুকর চমনলাল৷ তারপর তাদের দুজনকে দেখে রতন সিং ধমকে উঠলেন, ‘বাচচাটাকে তুমি এখানে নিয়ে এসেছ কেন? তোমার মাথা খারাপ হয়েছে? এই মুহূর্তে আমার সঙ্গে চলো তোমরা৷ পাবলিক বাচচটাকে দেখার জন্য নদীর পাড়ে অপেক্ষা করছে৷’ তার ধমক শুনে রতন সিং শান্ত স্বরে বলল, ‘না, আমরা যাব না৷ আপনার সঙ্গে আমার আজ বোঝাপড়া আছে৷’
চমনলাল খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘কিসের বোঝাপাড়া? তোমার মাইনে বাড়াবার ব্যাপার? ও সব পরে হবে৷ এখন বোঝাপাড়ার সময় নেই৷ বাচচাটাকে না দেখতে পেলে পাবলিক ক্ষেপে গিয়ে পিঠের চামড়া তুলে দেবে৷’
‘তুলুক৷’ আবার শান্ত স্বরে জবাব দিলেন রতন সিং৷
‘তোমার এতবড়ো সাহস! শো শেষ হলে আমি তোমার মজা দেখাচ্ছি৷ তুমি না যাও আমি বাচচটাকে নিয়ে যচ্ছি৷’ এই বলে চিৎকার করে উঠে চমনলাল এরপর ধরতে গেলেন সুজনকে৷ কিন্তু সুজনকে তিনি ধরার আগেই রতনসিং-এর বাঘের মতো হাতের থাবা মুচড়ে ধরল চমনলালের হাত৷ সেই থাবার ঝাঁকুনিতে চমনলাল ছিটকে পড়লেন মেঝেতে৷ হতভম্ব চমনলাল৷ রতন সিং-এর চোখ যেন জ্বলছে! সে এবার বলল, ‘তোমার খেলাটা আমাকে না জানালেও এ খেলাটা আমি জেনে গেছি চমনলাল৷ পঁচিশ বছর আগে আজকেরই মতো যে ঘটনাটা ঘটেছিল, যে ঘটনা আজ আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে৷ সে দিন যে ছেলেটাকে তুমি জলে নামিয়েছিলে সিন্দুকের ভিতরে করে সে ছেলেটা আজ কোথায়? বলো কোথায়?’
চমনলাল উঠে বসার চেষ্টা করে বললেন, ‘তোমাকে তো বলেছি তোমার সে ভাই পালিয়ে গেছিল৷ আমি অনেক চেষ্টা করেও তার সন্ধান পাইনি৷’
রতন সিং চিৎকার করে উঠল, ‘তুমি মিথ্যা কথা বলছ৷ তার কী হয়েছিল আমি জানি৷’
‘কী জানো?’ সমরের মনে হল চমনলালের গলাটা এবার যেন একটু কাঁপা কাঁপা শোনাল৷
রতন সিং বলল, ‘কী হয়েছিল সেটা তুমি আমার থেকে ভালো জানো৷ সিন্দুকের মধ্যে পুরে জলে ডুবিয়ে মারা হয়েছিল তাকে৷ সে আর ওপরে উঠে আসেনি৷ লোকে যাকে দেখেছিল সে তার যমজ ভাই এই আমি৷’
চমনলাল একবার কম্পিত স্বরে বলার চেষ্টা করল, ‘এ সব ভুল বলছ তুমি…৷’
রতন সিং তার কাছে গিয়ে হ্যাচকা টানে তাকে দাঁড় করিয়ে বলল, ‘আমি ভুল বকছি না ঠিক বলছি তা কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রমাণ হবে৷ চলো, এবার আমরা নদীর ঘাটে যাব৷ সঙ্গে পুলিশও যাবে৷ আসল সিন্দুকটা এবার তোলা হবে নদী থেকে৷ তার মধ্যে থেকে মড়া বাচচাটা যখন বেরোবে তখন বোঝা যাবে কে ঠিক বলছে, কে ভুল? তুমি খুনি, তুমি খুনি! পঁচিশ বছর পর আবার আজ একটা বাচচাকে খুন করলে তুমি! তোমার এবার বিচার হবে৷’ রতন সিং-এর কথা শুনে এবার ফ্যাকাশে হয়ে গেল যাদুকর চমনলালের মুখ৷ তার চোয়াল ঝুলে পড়ল৷ আতঙ্কিত ভাবে তিনি তাকিয়ে রইলেন রতন সিং-এর দিকে৷
কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা৷ রতন সিং তারপর চমনলালকে বলল, ‘আমার এই হাতের থাবাগুলো দেখেছ তো? ইচ্ছে করলে আমি এখনই তোমার গলা চেপে ধরে খুনের বদলা নিতে পারি৷ কিন্তু আমি তোমার মতো খুনি নই৷ চলো এবার, জল থেকে আসল সিন্দুকটা তোলা হবে৷ ফাঁসির দড়ি অপেক্ষা করে আছে খুনির জন্য৷’
আতঙ্কিত চমনলাল এবার বলে উঠল, ‘না না, আমাকে তুমি ছেড়ে যাও৷ তোমার কত টাকা লাগবে বলো?’
কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা৷ রতন সিং বলল, ‘হ্যাঁ, টাকাতো তুমি দেবেই ক্ষতিপূরণ হিসেবে৷ তাছাড়া অন্য শর্তও আছে৷ আর কোনো দিন কোথাও ম্যাজিক দেখাতে পারবে না তুমি৷ তোমার খেলা শেষ চমনলাল৷ চমনলাল বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তোমার সব শর্ত মানব আমি, শুধু তুমি আমাকে পুলিশে দিও না৷’
রতন সিং এরপর চিরকুটটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই অ্যাকাউন্টে পাঁচ লাখ টাকা জমা দিতে হবে ছেলেটার মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ হিসেবে৷ ও টাকা তোমার কাছে আছি আমি জানি৷ মাত্র এক ঘণ্টা সময়৷ আমি খোঁজ নেব৷ পাঁচ মিনিটও যদি বেশি দেরি হয় তবে পুলিশ গিয়ে জল থেকে সিন্দুক বন্দি লাশটা তুলবে৷ কোনো চালাকির চেষ্টা করবে না৷ আর আজ রাতের মধ্যেই তুমি এ শহর ছাড়বে৷ কোনোদিন যেন আর তোমাকে না দেখি৷’ ‘আচ্ছা’ বলে চমনলাল ভীরু শেয়ালের মতা কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে৷
সে চলে যাবার পর কাননকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল বিস্মিত সমর৷ সে রতন সিংকে বলল, ‘ব্যাপারটা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না৷ কাননতো আমার সঙ্গেই, তবে সিন্দুকে মৃত ছেলেটা কেন?’ রতন সিং বলল, ‘ও জানে আপনার এই ছেলেটা এখনও সিন্দুকে আছে৷ ম্যাজিকের ব্যাপারটা আপনাকে আমি বুঝিয়ে বলি৷ যে ফাঁকা সিন্দুকটা জল থেকে তোলা হয়েছিল সেটা আগে থেকেই জলে নামানো ছিল৷ দুটো সিন্দুক হুবহু একই রকম ছিল৷ বাচচাসহ সিন্দুকটা জলের ভিতরেই রয়ে যেত৷ যমজ অন্য বাচচাটাকে দেখিয়ে সিন্দুকের বাচচা বলে ধোঁকা দিত শয়তান চমনলাল৷ হুডিনির খেলা ও দেখাতে পারে না৷ বারত জোরে আজ এই বাচচাটা বেঁচে গেল৷ বজরার নিচে আমি লুকিয়ে ছিলাম৷ সিন্দুকটা জলে পড়তেই আমি সেটাকে বজরার খোলে টেনে নিই! আমার আসুরিক শক্তি দিয়ে সিন্দুক ভেঙে বাচচাটাকে মুক্ত করি৷ তারপর বজরার পিছন দিয়ে বাচচটাকে নিয়ে সাঁতার কেটে অন্য দিক দিয়ে পাড়ে উঠি৷ ব্যাপারটা কেউ খেয়াল করেনি৷’
এরপর একটু থেমে সে বলল, ‘কিন্তু পঁচিশ বছর আগে সেই বাচচাকে কেউ উদ্ধার করতে পারেনি৷ সে সত্যিই জলের নিচে হারিয়ে গেছিল৷ কুম্ভমেলায় এসে আমরা দুই যমজভাই হারিয়ে গিয়েছিলাম৷ তারপর আমরা এহাত সে হাত ঘুরে চমনলালের খপ্পরে পড়ি৷ মাত্র সাত বছর তখন বয়স আমাদের…৷’
সমর এবার স্পষ্ট দেখতে পেল দানবের মতো লোকটার চোখের কোনে জল চিকচিক করছে৷ সমর বলল, ‘তাহলে ওই শয়তান লোকটাকে আপনি ছেড়ে দিলেন কেন?’
রতন সিং বলল, ‘ঘটনা সত্যি হলেও ওর বিরুদ্ধে তো কোনো প্রমাণ নেই৷ ওকে কিছু করা যাবে না৷ ওর মনের ভয়টাকে কাজে লাগিয়ে যেটুকু কাজ করা গেল৷ টাকাটা সম্ভবত পাবেন আপনারা৷ আর শহরটা ওকে এমনিতেই ছাড়তে হত৷ ওদিকে নদীর তীরে লোকজন এতক্ষণে নিশ্চয়ই হুজ্জুতি শুরু করে দিয়েছে৷’ রতন সিং এরপর বাচচা দুটোর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘আমাকে দেখে প্রথমে তোমরা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলে তাই না? আসলে আমার মুখটা দেখে সবাই আমাকে ভয় পায় মানুষটা কিন্তু আমি খারাপ নই৷ তোমরা এখন আমাকে দেখে আর ভয় পাচ্ছ নাতো? আর কোনো দিন দেখা হবে না হয়তো তোমাদের সঙ্গে৷ তবে এই কুৎসিত কদাকার দেখতে লোকটাকে পারলে মনে রেখ৷’
সমর স্পষ্ট দেখতে পেল দানবের মতো লোকটার চোখের কোল বেয়ে এবার সত্যিই জল নামতে শুরু করেছে! তবে তার দিকে তাকিয়ে এখন আর কোনো অস্বস্তি হচ্ছে না সমরের৷ বরং তার দিকে তাকিয়ে সমরের মনে হতে লাগল জীবনে এত সুন্দর মুখ সে খুব কম দেখেছে৷ জাদুকর চমনলালের মুখটাই বরং হিংস্র, বাইরের মুখটা তার মুখোশ৷ তার চেয়ে অনেক অনেক সুন্দর রতন সিং-এর এই মানবিক মুখ৷ এ মুখ কুৎসিত হতে পারে না কখনও৷ এ হল আসল জাদুকরের মুখ৷ যে অন্যের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলে৷ রতন সিং এরপর সমরের উদ্দেশে হাত জোড় করে নমস্কার জানিয়ে বলল, ‘এবার তাহলে আমি চলি৷ বাচচা দুটোকে নিয়ে সাবধানে ফিরবেন৷ আশা করছি চমনলাল আপনাদের পিছু নেবে না৷ সে নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত৷’
সমর জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি এখন কোথায় যাবেন? এরপর কী করবেন?’
রতন সিং হেসে জবাব দিল, ‘জানি না৷ এতদিন তো চমনলালের আশ্রয়ই ছিলাম৷ এবার দেখি পথ আমাকে কোথায় নিয়ে যায়?’
সমরও এবার হাত জোড় করে প্রণাম জানাল, তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মানবিক মুখকে, এক আসল জাদুকরকে৷ ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে অজানার উদ্দেশে বেরিয়ে গেল যাদুকর রতন সিং৷