আসল গোয়েন্দা
কাচের দরজা ঠেলে লোকটা মহীতোষবাবুর ঘরে ঢুকতেই তিনি টেবিল থেকে তার দিকে মুখ তুলে অভ্যস্ত স্বরে বললেন, ‘নতুন অ্যাকাউন্ট খুলবেন? সই মিলছে না? চেক ক্লিয়ারেন্স? ব্যাঙ্ক লোন? নাকি অন্য কোনো সমস্যা?’
আগন্তুকের বেশ সাদামাটা চেহারা৷ পরনে সাদা বুশ শার্ট, চোখে চশমা, গালে কয়েকদিনের না কামানো দাড়ি৷ বয়স মনে হয় বছর চল্লিশ হবে৷ লোকটা মহীতোষবাবুর প্রশ্নের জবাবে মৃদু হেসে একটা ভিজিটিং কার্ড এগিয়ে দিল৷ আইভরি রঙের ভিজিটিং কার্ডটায় উজ্জ্বল কালো কালিতে লেখা ‘ঈগলস আই’৷ কার্ডটা হাতে নিয়ে কিছুটা অবাক হয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি৷ লোকটা সম্ভবত মহীতোষবাবুর মনের ভাব পড়তে পেরে একটু চাপা স্বরে বলল, ‘অবাক হচ্ছেন তো? সাধারণ মানুষের ধারণা হল, গোয়েন্দা মানেই শীত-গ্রীষ্ম গায়ে একটা কালো ওভারকোট, মাথায় টুপি, হাতে আতস কাচ থাকবে, ছদ্মবেশ ধারণের জন্য নকল চাপদাড়ি থাকবে এসব৷ ওসব গল্প-উপন্যাসের গোয়েন্দাদের থাকে, আমাদের মতো বাস্তবের গোয়েন্দাদের থাকে না৷ আর আমরা ওয়াটসন, অজিত বা তোপসেদের মতো ল্যাংবোট নিয়েও ঘুরি না৷’
লোকটার কথা শুনে তাড়াতাড়ি তাকে বসতে বলে মহীতোষবাবু বেল টিপে বেয়ারাকে ডেকে বলে দিলেন, তাঁর চেম্বারে এখন যেন কাউকে ঢুকতে না দেওয়া হয়৷ অবশ্য এমনিতেই এখন বিকাল হয়ে গেছে, ব্যাঙ্কে কাস্টমারদের ভিড় আর নেই৷ বেয়ারা চলে যাবার পর মহীতোষবাবু ভদ্রলোককে বললেন, ‘হেড অফিস থেকে আপনাদের এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে তাই আপনাদের ফোন করেছিলাম৷ আপনাদের এজেন্সির বিজ্ঞাপন তো ইদানীং কাগজে খুব দেখি৷ তা আপনি নিশ্চয়ই ‘ঈগলস আই’-এর কর্ণধার মিস্টার মিত্র?’
ভদ্রলোক বললেন, ‘হ্যাঁ, সাধারণত আমার এজেন্সির ডিটেকটিভরাই অন্য কেসগুলো ডিল করেন৷ কিন্তু ব্যাপারটা ব্যাঙ্ক সম্বন্ধীয় বলে আমি নিজেই এলাম৷ এবার বলুন আপনাদের সমস্যাটা কী? হঠাৎ ডিটেকটিভের শরণাপন্ন কেন?’
সিনিয়র ম্যানেজার মহীতোষবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘আমাদের আশঙ্কা ব্যাঙ্কে একটা ডাকাতি হতে পারে!’
‘এরকম সন্দেহের কারণ?’
মিস্টার মিত্রের প্রশ্নের জবাবে মহীতোষবাবু তাঁর ড্রয়ার থেকে একটা কাগজের টুকরো বার করে এগিয়ে দিলেন তাঁর দিকে৷ একটা এক লাইনের চিঠি৷ তাতে লেখা— ‘আপনাদের ব্যাঙ্কে ডাকাতি হতে পারে৷ সাবধানে থাকুন৷’
কাগজটা হাতে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখার পর ‘ঈগলস আই’ বললেন, ‘এই উড়ো চিঠিটা তো কেউ মজা করেও লিখতে পারে? ডিটেকটিভ না ডেকে এ ব্যাপারে পুলিশকে তো জানাতে পারতেন? জানিয়েছেন তাদের?’
মহীতোষবাবু প্রথমে জবাব দিলেন, ‘আসলে ব্যাঙ্কের ব্যাপার তো, তাই কোনো রিস্ক নিতে চাচ্ছি না৷ ইদানীং বেশ কটা ব্যাঙ্কে পরপর ডাকাতি হয়েছে৷ হয়তো খবরটা সত্যি৷ কেউ কোনো সূত্রে ব্যাপারটা জানতে পেরে আমাদের জানিয়েছে৷’ তারপর একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘না, পুলিশকে জানাইনি, কর্তৃপক্ষ সেটা চান না৷ লোকাল পুলিশ স্টেশনে জানালে তারা এনকোয়ারিতে আসবে, অথবা ব্যাপারটা থানা থেকে যদি কোনো ভাবে ফাঁস হয়ে যায় তবে কাস্টমাররা এ ব্যাঙ্কে টাকা রাখতে ভয় পাবে৷ তাই প্রাইভেট ডিটেকটিভ সংস্থাকে দিয়েই তাঁরা প্রাথমিক তদন্ত করাতে চাচ্ছেন৷ তারপর তেমন হলে পুলিশে খবর দেওয়া হবে৷’
মিস্টার মিত্র বললেন, ‘ব্যাপারটা বুঝলাম৷ এবার একটা প্রশ্ন করি? ধরে নিই চিঠির খবরটা সত্যি৷ অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে এসব ঘটনায় ব্যাঙ্কের কোনো লোক জড়িত থাকে৷ সহকর্মীদের মধ্যে আপনার কাউকে সন্দেহ হয়?’
মহীতোষবাবু একটু আমতা আমতা করে বললেন, ‘ইয়ে মানে, আমার ভাবনাটা ঠিক কিনা জানি না৷ মাসখানেক আগে ব্যাঙ্কে একজন নতুন পিওন জয়েন করেছে৷ করালী নাম৷ ওকে যেন কেমন সন্দেহজনক মনে হচ্ছে৷ আমি ভল্ট খুললেই, ও কোনো অছিলায় এসে উঁকিঝুঁকি মারে! ক্যাশিয়ারবাবুও একই কথা বলছিলেন৷ চেহারাটাও ওর সুবিধার নয়৷ তাছাড়া, আরও একটা কথা, ঐ যে জানলার বাইরে উল্টোদিকের ফুটপাতে বন্ধ দোকানঘরটার নীচে একটা ভবঘুরে ভিখারি শুয়ে আছে দেখছেন? ও কিন্তু আগে এখানে ছিল না৷ করালী আসার কিছুদিনের মধ্যেই ওর এখানে আমদানি হয়েছে৷ আমি এর মধ্যে দু-দিন স্পষ্ট দেখেছি করালী কী যেন ইশারা করছিল ওকে!’
মহীতোষবাবুর কথা শুনে জানলার বাইরে পর্দা ফাঁক করে তাকালেন মিস্টার মিত্র৷ হ্যাঁ ভিখারি গোছের একজন লোক একমুখ দাড়ি নিয়ে নোংরা পোশাক পরে বসে আছে উল্টোদিকের একটা বন্ধ দোকানঘরের গায়ে৷ মিস্টার মিত্র এবার কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বললেন, ‘ব্যাঙ্কের ভিতর ও বাইরে কিছুদিনের জন্য আমাকে নজর রাখতে হবে৷ আপনি কি আমার জন্য এমন কোনো ব্যবস্থা করতে পারেন, যাতে আমি ক-দিনের জন্য ব্যাঙ্কের সর্বত্র, এমনকি ভল্টরুম পর্যন্ত যেতে পারি?’
মহীতোষবাবুও কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বললেন, ‘একটা ব্যবস্থা করতে পারি যদি আপনার আপত্তি না থাকে৷ আমাদের একজন সুইপারের প্রয়োজন৷ ওটা স্থানীয় ভাবেই নিয়োগ করা হয়৷ সে ভল্টরুমও পরিষ্কার করতে যায়৷ সঙ্গে অবশ্য আমি বা ক্যাশিয়ারবাবু থাকি…৷’
তাঁর কথা শেষ হতে না হতেই মিস্টার মিত্র উৎফুল্ল ভাবে বললেন, ‘আমি তো এরকমই কিছু চাচ্ছিলাম৷ আপত্তি থাকবে কেন? কাজের জন্য কতকিছু করতে হয়! একবার বর্ষাকালে একটা ডাকাত দল ধরার জন্য তারাপীঠের শ্মশানে টানা একুশদিন মড়া পোড়াবার কাজ করেছি৷ আর একবার স্মাগলারদের ধরতে দিনের পর দিন হাওড়া স্টেশনে কুলির কাজ করেছি৷ দুটো ব্যাপারেই সাকসেস পেয়েছি৷ কাল থেকে আমি আপনাদের সুইপার হিসাবে কাজ করব৷ তবে আমার পরিচয় আপনি ছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তি কেউ যেন না জানেন৷’
৷৷ ২৷৷
ব্যাঙ্ক সকাল দশটায় খোলে৷ তার কিছুটা আগেই ব্যাঙ্কে এসে যান মহীতোষবাবু ও অন্য কর্মচারীরা৷ সেদিন ব্যাঙ্কে ঢুকে নিজের চেম্বারের দিকে এগোতেই তাঁর দরজার পাশে একটা লোককে উবু হয়ে বসে থাকতে দেখলেন মহীতোষবাবু৷ মহীতোষবাবুকে দেখেই লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘হামি মথুরাপ্রসাদ আছি৷ মথুরা জমাদার৷’
তাঁকে দেখে প্রথমে চিনতেই পারেননি মহীতোষবাবু৷ কে বলবে এ লোকটা মিস্টার মিত্র? আজ তাঁর পরনে ছেঁড়া পোশাক, উস্কোখুস্কো চুল, চোখে ডাঁটা ভাঙা একটা চশমা৷ তাঁর বয়স যেন আরও কুড়ি বছর বেড়ে গেছে৷ তাঁর সঙ্গে ঝাঁটা, বালতি ইত্যাদি নানা সরঞ্জাম৷
কিছুক্ষণের মধ্যেই মহীতোষবাবু ব্যাঙ্কের অন্য কর্মচারীদের ডেকে বলে দিলেন, ‘এ হল মথুরাপ্রসাদ৷ আমার পরিচিত লোক৷ আজ থেকে সুইপারের কাজ করবে৷’
মথুরা সেলাম করল সবাইকে৷ কর্মচারীদের মধ্যে করালীও ছিল৷ মহীতোষবাবু ও মথুরা দুজনেই খেয়াল করল যে করালী যেন বেশ সন্দেহের চোখে তাকাল মথুরাপ্রসাদের দিকে৷ যাই হোক, কাজে বহাল হয়ে গেল মথুরা৷
ব্যাঙ্কের শেষ মাথায় ইউরিনালের বাইরে টুল নিয়ে বসে থাকে মথুরা৷ ইউরিনাল সাফা করে৷ দিনে তিনবার ব্যাঙ্কের টাইলস ফ্লোর মোছে, ম্যানেজারবাবু বা ক্যাশিয়ারবাবুর উপস্থিতিতে ভল্টরুমও সাফা-সুতরো করে৷ দু-দিনের মধ্যেই ব্যাঙ্কের কর্মচারী থেকে কাস্টমাররা পর্যন্ত মহীতোষবাবুকে বলতে লাগল, ‘এতদিন পর সত্যিই ব্যাঙ্কটা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন লাগছে!’ তাদের কথা শুনে মনে মনে হাসেন মহীতোষবাবু৷
তিনদিনের দিন মথুরা যখন মহীতোষবাবুর চেম্বারে ঝাঁট দিতে ঢুকল তখন তাকে আড়ালে পেয়ে তিনি জিগ্যেস করলেন, ‘কিছু জানতে পারলেন?’
টেবিলের নীচে মাথা ঢুকিয়ে মেঝে পরিষ্কার করতে করতে মথুরা ওরফে মিস্টার মিত্র বললেন, ‘এখনও আপনাকে কিছু বলার মতো সময় আসেনি৷ তাছাড়া বলা উচিতও নয়৷’
‘উচিত নয় কেন?’ জানতে চাইলেন মহীতোষবাবু৷
তিনি জবাব দিলেন, ‘আমরা তদন্ত হাতে নিলে কেউই সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকে না৷ এক্ষেত্রে আপনিও নন৷’
কথাটা মিত্র মজা করে বললেন কিনা তা বুঝতে পারলেন না মহীতোষবাবু৷ ঘর ছেড়ে যাবার আগে মিস্টার মিত্র শুধু বলে গেলেন, ‘করালী আর ঐ ভিখারিটা সত্যিই সন্দেহজনক!’
মথুরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার পর কী একটা কাজে মহীতোষবাবুর ঘরে ঢুকলেন ক্যাশিয়ার ধূর্জটিবাবু৷ কাজ শেষ করে যাবার আগে তিনি আজও বলে গেলেন, ‘বুঝলেন স্যার ঐ করালী বলে ছোকরাটার ভাবগতিক সুবিধার মনে হচ্ছে না৷ আজ যখন মথুরাকে দিয়ে ভল্টরুম মোছাচ্ছিলাম, তখন ও বাইরে থেকে কেমন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল৷ চেহারাটাও তো গুন্ডার মতো৷ একটু খেয়াল রাখবেন৷’
মহীতোষবাবু জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখলেন সেই ভিখারি গোছের লোকটা সোজা তাকিয়ে আছে ব্যাঙ্কের দিকে৷
আরও দুটো দিন কেটে গেল৷ মথুরা কাজে লেগেছে সোমবার৷ অবশেষে শুক্রবার বিকালে মহীতোষবাবুর ঘরে ঢুকল মথুরা৷ সে ইশারা করতেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পিয়নকে চা-আনাবার ছুতোয় অন্য জায়গাতে পাঠিয়ে দিলেন মহীতোষবাবু৷ ঘরটা ঝাঁট দিতে দিতে সতর্ক ভাবে মিস্টার মিত্র বললেন, ‘শুনুন, ব্যাপারটা সত্যি৷ ব্যাঙ্কে ভল্ট লুট হতে চলেছে৷ আমার অনুমান কাল তো শনিবার, কাল রাতেই সম্ভবত ঘটবে ঘটনাটা৷ ঠিক ডাকাতি বলতে যা বুঝি তা নয়, একজন লোক রাতে ঢুকে ভল্ট সাফ করবে৷’
মহীতোষবাবু চমকে উঠে বললেন, ‘কে সে লোক? করালী বা ঐ ভিখারিটা?’
মিস্টার মিত্র দুর্বোধ্য হেসে বললেন, ‘তারাও হতে পারে, আবার তৃতীয় কোনো ব্যক্তি হতে পারে৷ আচ্ছা, ভল্টের দু-সেট চাবির মধ্যে একটা আপনার কাছে আর অন্যটা ক্যাশিয়ার ধূর্জটিবাবুর কাছে থাকে তাই না?’
মহীতোষবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ৷ আচ্ছা আমি কি তাহলে পুলিশে খবর দেব?’
মিস্টার মিত্র বললেন, ‘পুলিশ এ চোরকে ধরতে পারবে না৷ বরং চোর সতর্ক হয়ে যাবে৷ আমি বরং চোরকে তুলে দেব আপনার হাতে৷ তারপর তো পুলিশ ডাকতেই হবে৷ কিন্তু তার আগে কাজটা খুব গোপনে করতে হবে৷’
‘কী ভাবে?’ জানতে চাইলেন মহীতোষবাবু৷
মিস্টার মিত্র বললেন, ‘কাল রাতে আমি ব্যাঙ্কের ভিতরেই লুকিয়ে থাকব৷ আপনি ব্যাঙ্কের ভল্টের চাবিটা শুধু আমাকে দিয়ে যাবেন৷ সে ভল্টরুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই বাইরে থেকে আমি চাবি দিয়ে দেব৷ আমার লোকেরাও ব্যাঙ্কের বাইরে থাকবে৷ চোর পালাতে পারবে না৷ আমি সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে খবর দেব৷ আপনি পুলিশ নিয়ে চলে আসবেন৷ এখন আর কোনো কথা নয়৷ করালী আর ধূর্জটিবাবু আমাকে এ ঘরে ঢুকতে দেখেছে৷ কাল চাবিটা দেবেন৷’ এই বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে৷
যতই হোক ব্যাঙ্কের ভল্টের চাবি বলে কথা৷ মহীতোষবাবু হেড অফিসে ফোন করে চাবির ব্যাপারটা জানালেন৷ তারা বলল—‘ওনাকে যখন ইনভেস্টিগেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, এবং উনি যখন ব্যাপারটা সলভ করে এনেছেন তখন উনি যা বলছেন তাই করুন৷’
৷৷ ৩৷৷
পরদিন শনিবার৷ বেলা দুটোয় ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে যায়৷ মহীতোষবাবুর অবশ্য সব কাজ গুছিয়ে বেরোতে বেলা চারটে হয়ে যায়৷ গতকাল মিস্টার মিত্রর কাছ থেকে ঘটনাটা শোনার পর থেকেই দারুণ উৎকণ্ঠার মধ্যে আছেন মহীতোষবাবু৷ মিস্টার মিত্র বলেছেন যে অপরাধী আজ রাতেই ধরা পড়বে! কিন্তু তাঁর কথার মধ্যে কোথাও যেন একটা তৃতীয় ব্যক্তিরও ইঙ্গিত ছিল৷ তবে কী?…একটা অন্য আশঙ্কা যেন ক্রমশই দানা বাঁধছে মহীতোষবাবুর মনে৷ আবার, রাস্তার সেই ভিখারিও আজ সারাদিন যেন ব্যাঙ্কের দিকেই তাকিয়ে বসে আছে৷ করালী বারকয়েক মহীতোষবাবুর চেম্বারে ঢুকেছিল তেমন কোনো কাজ না থাকাতেও৷ সে এসেছিল মহীতোষবাবু চা খাবেন কিনা ছুতো নিয়ে৷ যা সে অন্যদিন জিগ্যেস করে না৷ সব মিলিয়ে বেশ গোলমেলে ব্যাপার! যাই হোক ছুটির ঠিক আগে তাঁর ঘরে ঢুকল মথুরা৷ চাপাস্বরে সে বলল, ‘সব ঠিক আছে৷ চিন্তা করবেন না৷ রাতে আমার ফোনের অপেক্ষায় থাকবেন৷’ মহীতোষবাবু ভল্টের চাবিটা তার হাতে ধরিয়ে দিলেন৷ মথুরা ঘর ছেড়ে চলে গেল৷ মহীতোষবাবু যখন বাড়ি যাবার জন্য চেম্বারের বাইরে বেরোলেন তখন ব্যাঙ্কের সব কর্মচারী বাড়ির পথ ধরেছে৷ শুধু দারোয়ান আর করালীকে দেখতে পেলেন তিনি৷ তাঁকে দেখেই করালী হঠাৎ কেন জানি, নিজে থেকেই বলে উঠল, ‘এই তো স্যার এখনই বেরোব৷ দারোয়ানজির সঙ্গে একটু গল্প করছি৷’ কেন সে বলল কথাটা? ‘গিল্টি মাইন্ড অলওয়েজ সাসপিসাস?’ ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগোলেন মহীতোষবাবু৷ প্রচণ্ড উত্তেজনা কাজ করছে তাঁর মনের ভিতর৷
কিন্তু বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে হঠাৎ তাঁর মনে হল একটা কাজ করলে হয় না? তিনি নিজেও তো সবার অগোচরে ব্যাঙ্কে গিয়ে লুকিয়ে থাকতে পারেন৷ তাহলে তো নিজের চোখে দেখতে পারবেন কী ভাবে চোর ধরেন ডিটেকটিভ মিস্টার মিত্র? তাঁকে তো ফোন পেয়ে রাতে এখানে আবার ছোটাছুটি করে আসতে হবে৷ তার চেয়ে এখানেই যদি থেকে যান? ব্যাঙ্কের পিছনদিকে ইমারজেন্সি একটা দরজা আছে৷ তার চাবি মহীতোষবাবুর কাছেই আছে৷ সেখান দিয়ে ভিতরে ঢুকলে কেউ দেখতে পাবে না৷ কিছুক্ষণ ভাবার পর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন তিনি৷ শীতের ছোট বেলা৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার নেমে এল৷ মহীতোষবাবু শহরের মধ্যে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে একটু ঘুরপথে ব্যাঙ্কের পিছনের অন্ধকার গলিতে পৌঁছে নিঃশব্দে দরজা খুলে ব্যাঙ্কে ঢুকে গেলেন৷ ভিতরটা অন্ধকার, একটা দেওয়ালের কাছে রাখা আলমারির আড়ালে আশ্রয় নিলেন তিনি৷ ব্যাঙ্কের সামনের রাজপথের নিওনবাতির আলো ঘষা কাচের শার্সি দিয়ে ব্যাঙ্কের ভিতরে ঢুকছে৷ চোখটা অন্ধকারে একটু ধাতস্থ হবার পর মহীতোষবাবু ব্যাঙ্কের ভিতরটা মোটামুটি দেখতে পেলেন৷ ঐ তো ব্যাঙ্কের ভল্টরুমটাও দেখা যাচ্ছে৷ কিন্তু মিস্টার মিত্রকে দেখতে পেলেন না তিনি৷ গোয়েন্দাপ্রবর কোথায় লুকিয়ে আছেন তাঁর তা জানা নেই৷ মিস্টার মিত্র কথিত নাটকীয় দৃশ্য দেখার প্রতীক্ষায় মহীতোষবাবু আলমারির আড়ালে অপেক্ষা করতে লাগলেন৷ সময় এগিয়ে চলল৷ বাইরের রাস্তার কোলাহল একসময় থেমে গেল৷
রাত তখন ঠিক বারোটা৷ বাইরে কিছু দূরের জুটমিলের সাইরেন বাজল প্রতিদিনের মতো৷ একটা অস্পষ্ট শব্দ কানে এল মহীতোষবাবুর৷ কাছেই একটা জানলার পাল্লা ফাঁক হল৷ সেই ফাঁক গলে নিঃশব্দে ব্যাঙ্কে প্রবেশ করল দু-জন ছায়ামূর্তি৷ নিশ্চয়ই জানলার গরাদ কেটে ফেলেছে লোকগুলো৷ একজনকে তার অবয়ব দেখেই মহীতোষবাবু চিনতে পারলেন৷ সে করালী! আর অন্যজনের মুখে মুহূর্তের জন্য জানলার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো খেলে গেল৷ সেই ভিখারিটা! তাহলে মহীতোষবাবুদের অনুমানই ঠিক৷ এ দুজনই ভল্ট ভাঙতে এসেছে৷ ভিতরে ঢুকে তারা জানলাটা বন্ধ করে অন্ধকারের মধ্যে কোথায় যেন হারিয়ে গেল৷
কিছুটা সময় চুপচাপ কেটে গেল৷ এরপর ভল্টরুমের সামনে হঠাৎ উদয় হল একটা ছায়ামূর্তির৷ জায়গাটা করিডোরের শেষপ্রান্তে বেশ কিছুটা দূরে বলে লোকটা কে তা ঠিক বুঝতে পারলেন না মহীতোষবাবু৷ তিনি অনুমান করে নিলেন এ দুজনেরই কেউ হবে সে৷ দরজার সামনে কিছুক্ষণ কী করার পর লোকটা ভল্টরুমের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে গেল৷ সম্ভবত তার সঙ্গী বাইরে কোথাও আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে৷ মহীতোষবাবু ব্যাপারটা আন্দাজ করে নিলেন৷ উত্তেজনায় বুকের ভিতর হাতুড়ি পেটা শুরু হল মহীতোষবাবুর৷ কিন্তু মিস্টার মিত্র কোথায়? ও দুজনের একজন নিশ্চয়ই বাইরে দাঁড়িয়ে ভল্টরুমের ওপর নজর রাখছে৷ মিস্টার মিত্র ভল্টরুমের দরজা বন্ধ করতে গেলে সে নিশ্চয়ই বাধা দিতে পারে৷ আর তারপর? এ সব ভেবে মহীতোষবাবু শীতের মধ্যেও ঘেমে উঠলেন৷ ভল্টরুম থেকে লোকটাও বেরোচ্ছে না, এদিকে মিস্টার মিত্ররও দেখা নেই৷
প্রায় আধঘণ্টা পর ভল্টরুম থেকে বেরিয়ে এল লোকটা৷ পিঠে একটা বড় থলি৷ কিন্তু মিস্টার মিত্র কই? মহীতোষবাবু ভেবে নিলেন, তেমন হলে তিনি নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়বেন লোকটার ওপর৷ তাতে যদি খুন হতে হয় তিনি হবেন!
কিন্তু এরপরই ঘটল সেই অদ্ভুত ঘটনাটা৷ লোকটা থলি নিয়ে কয়েক পা এগিয়েছে, হঠাৎ অন্ধকার থেকে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল দু-দুটো ছায়ামূর্তি! অন্ধকারের মধ্যে ব্যাঙ্কের ভিতর একটা অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হল৷ ধস্তাধস্তিতে এটা ভাঙছে, ওটা ছিটকে পড়ছে! আর এরপরই ব্যাঙ্কের বাইরে পুলিশের হুইসেল শোনা গেল৷ সেই ভাঙা জানলা দিয়ে বেশ কয়েকজন লোক জোরালো টর্চ জ্বালিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল৷ আর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যাঙ্কের ভিতর বাতি জ্বলে উঠল৷ মহীতোষবাবু দেখতে পেলেন পুলিশ ঢুকেছে ব্যাঙ্কে৷
আলো জ্বলতে পুলিশ দেখে বাইরে বেরিয়ে আসতেই এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেলেন মহীতোষবাবু৷ ব্যাঙ্কের ভল্টের সামনেই মাটিতে বসে আছেন ‘ঈগলস আই’-এর কর্ণধার, গোয়েন্দা মিস্টার মিত্র৷ আর তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে করালী, সেই ভিখারি, স্থানীয় থানার বড়বাবু সহ বেশ কয়েকজন পুলিশ৷ থলের টাকা মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে আছে৷ মিস্টার মিত্রকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে মহীতোষবাবু তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে পুলিশ অফিসারকে বললেন, ‘আরে ওনাকে মাটিতে ফেলে রেখেছেন কেন? উনি গোয়েন্দা মিস্টার মিত্র৷ ডাকাত ধরতে এসেছিলেন৷ আপনি এখনই এ দুজনকে অ্যারেস্ট করুন৷’ এই বলে তিনি আঙুল তুলে দেখালেন করালী আর দাড়িঅলা লোকটার দিকে৷
পুলিশ অফিসার হেসে বললেন, ‘ম্যানেজার সাহেব, এ দুজনের সঙ্গে আপনার এবার পরিচয় করিয়ে দিই৷ আপনি এই করালী বলে যাকে চেনেন, তিনি হলেন বিখ্যাত গোয়েন্দা সমুদ্র বসু, আর এই দাড়িঅলা ভদ্রলোক ওনার সহকারী প্রতাপ রায়৷ এনারাই হলেন আসল গোয়েন্দা৷’
মহীতোষবাবু অবাক হয়ে বললেন, ‘তাহলে ইনি, এই মিস্টার মিত্র কে?’
আসল গোয়েন্দা সমুদ্র বসু এবার বললেন, ‘এ লোক হল বিখ্যাত জালিয়াত ভুবন মল্লিক৷ পেটে কিছু বিদ্যা ছিল এ লোকের৷ তা ভাঙিয়ে কখনও সরকারি অফিসার, কখনও লেখক, কখনও ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি সেজে নানা ধরনের চুরি, ডাকাতি, কেপমারি করেছে৷ সম্প্রতি ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলে গোয়েন্দা সেজে লোক ঠকাত৷ ওকে ধরার জন্যই আমরা ব্যাঙ্কের হেড অফিসের সঙ্গে কথা বলে এ নাটকটা সাজাই৷ আপনাদের হেড অফিসে একটা চেক জালিয়াতি করে এ লোক৷ আপনাকে উড়ো চিঠি দেওয়া, হেড অফিস থেকে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা, আমার এ অফিসে থেকে এখানে পাঠানো, সবই সাজানো ব্যাপার৷ আমাদের ধারণা ছিল ব্যাঙ্কে ঢোকার সুযোগ পেলে এ লোক নিজেই ভল্ট ভাঙবে৷’
মহীতোষবাবু আসল গোয়েন্দার কথা শুনে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘বুঝতে পেরেছি আপনি আসল গোয়েন্দা৷ কারণ আপনার সহকারী আছে৷ গল্পের গোয়েন্দাদের যেমন সহকারী ছিল ওয়াটসন, অজিত, তোপসে…৷’ তারপর মাটিতে পড়ে থাকা নকল গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনার তো আবার ল্যাংবোট লাগে না তাই না? জব্বর ধোঁকা দিয়েছিলেন আমাকে!’
আসল গোয়েন্দা এরপর নকল গোয়েন্দাকে বললেন, ‘নিন এবার উঠে পড়ুন৷ এলেম থাকলে এবার জেলে গিয়ে জেলার সাজার চেষ্টা করবেন৷’
—