আল আকসা মসজিদের ইসলাম পরবর্তী ইতিহাস

আল আকসা মসজিদের পরবর্তী ইতিহাস

১. রাসূলুল্লাহর (সাঃ) যুগ আকাশে ওঠার জন্য সম্ভবতঃ মসজিদে আকসা ছাড়া আর কোন কেন্দ্র বা পথ নেই। তাই মেরাজের রাত্রে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মসজিদে আকসার পথে উর্ধজগত ভ্রমণ করেছেন। মক্কা কিংবা মদীনাহ অথবা অন্য কোন স্থান থেকে সরাসরি উর্ধ- জগত ভ্রমণ করেননি। পূর্বে বর্ণিত এক হাদীসে জানা গেছে, সেখান থেকে হাশর-নশর হবে এবং লোকেরা বেহেশত ও দোযখে যাবে। মেরাজে গিয়ে তিনি এসব জিনিস স্বচক্ষে দেখে এসেছেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ৰাইতুল মাকদিসকে শিরকমুক্ত করার জন্য রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে ইসলামের দাওয়াত পাঠান। এরপর রোমান বাহিনীর মুকাবিলা করার জন্য তিন হাজার সাহাবী মুতা নামক স্থানে জড়াে হন। সেই যুদ্ধে তিনজন প্রখ্যাত সাহাবী শহীদ হন। তারা হলেন, যায়েদ বিন হারিসা, জাফর বিন আবু তালিব ও আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা। দুইপক্ষের মধ্যে কঠিন যুদ্ধ হয়। শেষ পর্যন্ত খালিদ সাইফুল্লাহর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী নিরাপদে প্রত্যাবর্তন করে। এরপর রোম বাহিনী বাইতুল মাকদিসের উপর মুসলমানদের সাম্ভাব্য বিজয়ের আশংকায় মদীনার মুসলিম রাষ্ট্রটির উপর আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। কেননা, রোমান সম্রাট বাইতুল মাকদিস-কেন্দ্রিক খৃস্টান বিশ্বের নেতৃত্ব হাতছাড়া করতে রাজী ছিল না। ৯ম হিজরীতে মুসলমানগণ খৃস্টানদের উক্ত আক্রমণের খবর পেয়ে ৩০ হাজার সৈন্য নিয়ে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা করেন। মুসলিম বাহিনী তাবুক পর্যন্ত পৌঁছার পর খৃস্টানদের কোন যুদ্ধ তৎপরতা না দেখে পুনরায় মদীনায় ফিরে আসেন। আসলে, নোম বাহিনী মুসলমানদের খবর পেয়ে ভেঙ্গে পড়ে। বিদায় হজ্জ থেকে মদীনায় ফিরে এসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সিরিয়ায় রোমান বাহিনীর মূল দুর্গে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে মুসমানদেরকে প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিন। তিনি উসামা বিন যায়েদকে ঐ বাহিনীর সেনাপতি নিযুক্ত করেন। তখন উসামা ১৮ বছরের যুবক। উসামার নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী মদীনা থেকে বের হন এবং জোরাফে যাত্রাবিরতি করেন। সেই সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মৃত্যু পীড়ায় আক্রান্ত হন ও মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে যাওয়ার জন্য ইন্তিকাল করেন। মুসলিম বাহিনী সেখানে পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষা করতে থাকে।

২. হযরত আবু বারের যুগ রাসূলুল্লাৱ (সাঃ) ইন্তিকালের পর হযরত আবু বাকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ইসলামের ১ম খলীফা নির্বাচিত হন। তিনি উসামা বাহিনীর অগ্রযাত্রার নির্দেশ দেন। তিনি মুরতাদ বা ধর্মত্যাগীদের বিরুদ্ধেও অভিযান পরিচালনা করেন এবং তাদের উপর বিজয় লাভ করেন। উসামা বাহিনী প্রেরণের লক্ষ্য অর্জিত হয়। তারপর তিনি সিরিয়া জয় করে তাকে ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ১২ হাজার মুসলিম সেনার এক বিরাট বাহিনী গঠন করে খালিদ বিন ওয়ালিদকে এর আমীর নিযুক্ত করেন। সিরিয়ায় রোমান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ঐ বাহিনীতে বড় বড় সাহাবায়ে কেরাম শরীক ছিলেন। ঐ অভিযানের ফলে ফিলিস্তিনের কয়েকটি শহর মুসলমানদের দখলে আসে। মূলতঃ হযরত আবু বারের আমলেই জেরুসালেম জয়ের সূচনা হিসেবে ফিলিস্তিনের নিকটবর্তী শহরগুলো মুসলমানদের দখলে আসে। জেরুসালেম জয় করার আগেই হযরত আবু ৰারের রাদিয়াল্লাহু আনহু ইন্তিকাল হয়।

৩. হযরত উমার ফারুকের যুগ সিরিয়া জয়ের পর হযরত উমার ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহু বাইতুল মাকদিস জয় করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তিনি জেরুসালেম শহরে হযরত আবু ওবায়দাহ ইবন জাররাহর নেতৃত্বে ৫ হাজরে অশ্বারোহী সৈন্য পাঠান। তারপর ইয়াযিদ বিন আবী সুফিয়ানের নেতৃত্বে ৫ হাজার এবং শোরাহবিল বিন হাসানাহর নেতৃত্বে আরো ৫ হাজার সৈন্য পাঠান। সম্মিলিত বাহিনী জেরুসালেম শহর অবরোধ করে এবং তা দীর্ঘ ৪ মাস পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। শহরবাসী লোকেরা প্রথম দিকে মোকাবিলা করলেও পরে পরাজিত হয় এবং সন্ধির প্রস্তাব দেয়। তারা খলীফাতুল মুসলেমীন হযরত উমারের উপস্থিতি দাবী করে। আবু ওবায়দাহ হযরত উমারকে জেরুসালেম যাওয়ার জন্য আহ্বান জানান। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি ১৮ হিজরীর রজব মাসে জেরুসালেম পৌছেন। এটা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মেরাজেরও মাস। তিনি মোকাব্বের পাহাড়ের পথ দিয়ে জেরুসালেম পৌঁছেন। তাকবীর থেকে মোকাব্বের শব্দের উৎপত্তি। হযরত উমার তাকবীর দিতে দিতে শহরে পৌঁছার কারণে ঐ পাহাড়কে মোকাব্বের পাহাড়, বলা হয়। শহরে পৌছার পর পরই তিনি মসজিদে আকসা থেকে খৃস্টানদের সকল আবর্জনা ও অপবিত্রতা দূর করেন। তারা ইহুদীদের প্রতি বিদ্বেষের কারণে সাখরায় ময়লা-আবর্জনা নিক্ষেপ করত। তিনি সাখরার সামনে মসজিদ নির্মাণ করেন এবং সাখরাকে মসজিদের পেছনে রাখেন। মসজিদ তৈরির আগে তিনি কাব আহবারকে জিজ্ঞেস করেন, কোথায় মসজিদ তৈরি করা যায়? কাব বলেন, সাখরাকে সামনে রেখে পেছনে মসজিদ তৈরি করুন। উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তা ইহুদীদের মতই হয়ে যায়। তাই তিনি সাখরার সামনেই মসজিদে তৈরি করেন। উল্লেখ্য যে, সেখানে মসজিদে আকসা নামে কোন মসজিদ ছিল না। বরং কুরআন মসজিদে আকসা’ শব্দের উল্লেখ করায় একদিকে তা সেজদা ও ইবাদতের জায়গার প্রতি ইঙ্গিত এবং অন্যদিকে, অদূর ভবিষ্যতে নির্মিতব্য মসজিদের বিষয়ে ভষ্যিদ্বাণী করা হয়েছে। মসজিদে সাখরাকে মসজিদে উমারও বলা হয়।

৪. উমাইয়া শাসনামলে উমাইয়া খলীফাহ আবদুল মালেক বিন মারওয়ান দামেস্কের সাথে সাথে জেরুসালেমেও খেলাফতের বাইয়াত নেন এবং জেরুসালেম শহর পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেন। তিনি ৬৮৫-৮৯ খৃঃ অর্থাৎ ৭৩ থেকে ৮৬ হিজরীর মধ্যে মসজিদে সাখরাকে সুন্দর করে পুনঃনির্মাণ করেন এবং নতুন করে মসজিদে আকসা তৈরির জন্য মসজিদে আকসার দেয়ালঘেরা সকল অংশ অন্তর্ভুক্ত করেন। আবদুল মালেক বিন মারওয়ান মসজিদে আকসার পুরো সীমানার উপর এই মসজিদ দুটি তৈরির উদ্যোগ নেন। তার ছেলে ওয়ালিদের আমলে মসজিদে আকসার নির্মাণ কাজ শেষ হয়। উমাইয়া আমলেই মসজিদের মেহরাব ও মিনারা তৈরির প্রথা শুরু হয় এবং তারা মসজিদে আকসার মেহরাব ও মিনারা তৈরি করেন। শেষ পর্যন্ত ওয়ালিদ মসজিদের দেয়ালঘেরা অংশবিশেষের উপর মসজিদ দুটি তৈরি করেন। আবদুল মালেক মসজিদে আকসা ও মসজিদে সাখরার পুনঃনির্মাণের ব্যয় নির্বাহের উদ্দেশ্যে মিসরের ৭ বছরের খাজনা নির্দিষ্ট করেন। উমাইয়া খলীফা উমার বিন আবদুল আযীয সকল অঞ্চলের গভর্নরদের প্রতি মসজিদে আকসা যেয়ারত এবং আনুগত্য ও লোকদের মধ্যে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার শপথ গ্রহণের আহ্বান জানান।

৫. আব্বাসী শাসনামলে ১৩২ হিঃ থেকে ৬৫৬ পর্যন্ত আব্বাসী শাসকরা মসজিদে আকসার সংরক্ষণ ও সেবা আঞ্জাম দেন। একবার ভূমিকম্পে মসজিদের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আব্বাসীয় খলীফা আবু জাফর মনসুর তার সাম্রাজ্যের সকল গভর্নরদের প্রতি মসজিদের একটি একটি অংশ নির্মাণ করার নির্দেশ দেন। ফলে, মসজিদকে আগের চাইতেও আরো বেশী মজবুত করে নির্মাণ করা হয়। ১৫৮ হিজরীতে খলীফা মাহদী মসজিদে আকসার সংস্কার করেন এবং মসজিদ সম্প্রসারণ করেন। পরে আব্বাসী খলীফা মামুনও মসজিদের অনুরূপ সংস্কারও সম্প্রসারণ করেন।

৬. তুলুন, এখশিদিন ও ফাতেমী শাসনামলে তুলুন ও এখশিদিন শাসনামলে মসজিদে আকসার প্রয়োজনীয় সেবা অব্যাহত থাকে। তারপর জেরুসালেম ফাতেমী শাসক মোয়েজ লি-দিনিল্লার সময় ওবায়দীর শাসনে আসে। ৯৬৯ হিঃ তাঁর প্রধান সেনাপতি জাওহার আস সাকাল্লি ফিলিস্তিন দখল করেন। ফাতেমী শাসকেরা বাহ্যতঃ শিয়া মাজহাবের অনুসারী ছিল। কিন্তু তারা ফিলিস্তিনে ইহুদী ও খৃস্টানদেরকে নিকটতর করার চেষ্টা চালায়। তারা ইহুদী-খৃস্টানদের সাথে বিয়ে-শাদীর সম্পর্ক স্থাপন করে এবং বাইজানটাইনের খৃস্টান শাসকের সাথে সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষর করে। এর ফলে, জেরুসালেমে খৃস্টানদের বসবাস শুরু হয়।

৭. সেলজুকী শাসনামলে সেলজুকী শাসকরা কিছুদিন পর্যন্ত জেরুসালেম শহরের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। তারা তাদের শত্রু ফাতেমী শাসকদের কবজা থেকে ৪৬৫ হিজরী, মোতাবেক ১০৭১ খৃঃ জেরুসালেম শহর দখল করে। পরবর্তীতে ফাতেমী শাসকরা সেলজুকীদের কাছ থেকে জেরুসালেম শহর পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। কিন্তু ফাতেমীদের খৃস্টান-প্রীতির কারণে শেষ পর্যন্ত খৃস্টানরা তাদের কাছ থেকে জেরুসালেম শহর দখল করে নেয়।

৮. খৃস্টান ক্রুসেডারদের হাতে জেরুসালেমের পতন ও মুসলিম নিধন জেরুসালেম শহর ১০৯৯ খৃঃ পর্যন্ত দীর্ঘ ৫শ’ বছর মুসলমানদের শাসনাধীন ছিল। কিন্তু ফাতেমীদের বিরুদ্ধে জেরুসালেমের খৃস্টান পাদ্রী ২য় সোমন খৃস্টান বিশ্বের প্রতি সাহায্যের আহ্বান জানান। ১০৯৫ খৃঃ পোপ খৃস্টান বিশ্বের প্রতি পবিত্র জেরুসালেম শহর উদ্ধারের উদ্দেশ্যে মুসলমানেরকে সেখান থেকে বের করে দেয়ার জন্য ধর্মযুদ্ধের (ক্রুসেডের ডাক) দেন। মধ্য ও পশ্চিম ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো পোপের আহ্বানে সাড়া দেয়। কেননা, মুসলমানদের হাতে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর খৃস্টান বিশ্ব পুনরায় প্রাচ্যে তাদের নতুন সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বপ্ন দেখছিল।

১০৯৯ খৃস্টাব্দের ১৫ই জুলাই, মোতাবেক ২৩শে শাবান ৪৯২ হিঃ, খৃস্টান, সেনাপতি গডফ্রে ডিবো ইউনের নেতৃত্বে ক্রুসেড বাহিনী জেরুসালেমের বাব আস সাহেরা দিয়ে শহরে প্রবেশ করে এবং ৪০ দিন পর্যন্ত শহর অবরোধ করে রাখে। শিয়া নেতা ইফতেখারুদ্দৌলা তার বাহিনীসহ পালিয়ে যায় এবং ফাতেমীয় খলীফা মোস্তালী বিল্লাহ ও মোসতাজহের বিল্লার শাসনামলে খৃস্টানদের হাতে জেরুসালেম শহরের পতন ঘটে। খৃস্টান ক্রুসেডারগণ প্রচণ্ড উন্মত্ততা সহকারে জেরুসালেমে প্রবেশ করে এবং জনগণের মধ্যে বিরাট ত্রাসের সৃষ্টি করে। তারা পাশবিক অত্যাচার-নির্যাতনে মেতে ওঠে এবং যাকে সামনে পায় তাকেই নির্বিচারে হত্যা করে। তাদের হাত থেকে বৃদ্ধ-যুবক এবং শিশু-নারী কেউ রক্ষা পায়নি। গোটা শহরে তারা পাইকারী মুসলিম হত্যা চালায় ও রক্তের বন্যা প্রবাহিত করে। পরের দিন সকালে তারা মসজিদে আকসায় প্রবেশ করে এবং মসজিদের মুসল্পী ও নেক লোদের রক্তে মসজিদের আঙিনা রঞ্জিত করে তোলে। ক্রুসেডারদের সেনাধ্যক্ষ রেমন্ড দুপুরের সূর্য হেলার আগে এক হাঁটু রক্ত ও লাশের উপর দিয়ে মসজিদে আকসায় প্রবেশ করে। তিনদিন ব্যাপী তারা মুসলিম হত্যাকাণ্ড চালায় এবং ৯০ হাজার মুসলমান হত্যা করে। তারা মসজিদে সাখরাকে গীর্জায় রূপান্তরিত করে। মসজিদের এক অংশকে ঘোড়ার আঁস্তাবল বানায় এবং অন্য অংশে নিজেদের থাকার ব্যবস্থা করে। ১৭ই জুলাই তারা রাস্তা থেকে মুসলমানদের লাশ সরানোর কাজ শুরু করে এবং মিসরের সম্ভাব্য পাল্টা আক্রমণের প্রহর গুনতে থাকে। এইভাবে খৃস্টান শাসকরা দীর্ঘ ৯১ বছর পর্যন্ত জেরুসালেম শহর শাসন করে এবং ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইতিহাসের জঘন্যতম অপরাধ সংঘটিত করে।

৯. হিত্তিনের যুদ্ধে জেরুসালেম পুনরুদ্ধার ১১৭১ খৃঃ মোতাবেক ৫৬৭ হিজরীতে, মিসরের সুলতান সালাহউদ্দীন ইউসুফ বিন আইউব খৃস্টানদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন এবং সিরিয়ার উদ্দেশ্যে ১১৭৭ খৃঃ মিসরের আরীস ত্যাগ করে। সিরিয়ার বিভিন্ন স্থানে খৃস্টানদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করার পর তিনি ১১৮৭ খৃস্টাব্দে জেরুসালেম দখলের লক্ষ্যে হিত্তিনের ময়দানে পৌঁছেন এবং খৃস্টান বাহিনীর ১ লাখ ৬৩ হাজার অশ্বারোহীকে পরাজিত করেন। মুসলমানদের পেছনে ছিল জর্দান নদী আর সামনে ছিল শত্রুবাহিনী। মুসলিম বাহিনী জেরুসালেমের খৃস্টান রাজাকে আটক করে এবং যুদ্ধে ৩০ হাজার খৃস্টান সৈন্যকে হত্যা ও অন্য ৩০ হাজারকে আটক করে। সালাহউদ্দীনের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী ৫৮৩ হিজরীর ২৭শে রজব শুক্রবার মোতাবেক ১২ই অক্টোবর ১১৮৭ খৃঃ, জেরুসালেম শহরে বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করে। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) মেরাজের দিবসের সাথে বিজয় দিবস একাকার হয়ে গেল। তিনি প্রথম শুক্রবার মসজিদে সাখরায় জুমার নামায পড়তে পারেননি। কেননা, তাতে খৃস্টানদের টয়লেট, ঘর ও ময়লা আবর্জনা ছিল। তিনি নিজ হাতে সেগুলো ঝাড়ু দেন ও পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করে। ৫৮৩ হিঃ ৪ঠা শাবান, ২য় শুক্রবার, তিনি তাতে জুমার নামায আদায় করেন। সালাহউদ্দীন জেরুসালেমের খৃস্টান নাগরিকদের প্রতি ক্ষমা ও সহানুভূতি প্রদর্শন করেন এবং তাদের দুশমনীর কোন বিচার করেননি। খৃস্টানদের বিজয় ও মুসলমানদের বিজয়ের মধ্যে বিরাট পার্থক্য ফুটে ওঠে। সালাহউদ্দীন জেরুসালেম শহর পুনঃনির্মাণ করেন। মসজিদে আকসায় একটা মিম্বার প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি মসজিদের সম্প্রসারণ করেন এবং মসজিদের কারুকার্য আরো বৃদ্ধি করেন। এছাড়াও তিনি মসজিদে কিতাব ও কুরআনের ব্যবস্থা করেন। তিনি মসজিদে আকসার বাইরে অবস্থিত মেহরাবে দাউদের জন্য ২ জন ইমাম, ২ জন মুয়াযিন ও একজন মোতাওয়াল্লী নির্ধারণ করেন। এটি একটি উঁচু স্থানে সুরক্ষিত ছিল। মেহরাবে দাউদ শহরের প্রবেশ পথে বিদ্যমান ছিল।

১০. তাতারী আক্রমণ ও দ্বিতীয় ক্রুসেড ৬৫৮ হিজরীর ৪ঠা সফর, তাতারের নেতা হালাকু খার হাতে বাগদাদের ইসলামী খেলাফতের পতন ঘটে। তাতারীরা গোটা ইরাক ও সিরিয়া দখল করার পর মিসর অভিযানের উদ্যোগ নেয়। তাতারীরা দুর্ধর্ষ জালেম ও বর্বর। যে শহরেই তারা ঢুকেছে সে শহরের সকল কিছু ধ্বংস ও সেখানকার অধিবাসীদেরকে হত্যা করেছে। মিসরীয় বাহিনী তাতারীদের মোকাবিলার জন্য বেরিয়ে আসে এবং ফিলিস্তিনের নাবলুস ও সিরিয়ার বিমানের মাঝে অবস্থিত ‘আইনে জালুত’ নামক স্থানে ৬৫৮ হিজরীর ২৫শে রমজান, মোতাবেক ১২৬২ খৃঃ তাতারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ১৪ হাজার মিসরীয় মুসলিম সেনার হাতে ১ লাখ তাতারী সেনা পরাজিত হয়। মিসরের জাহের বাইবারসের বাহিনী সেদিন ইতিহাসের গতি পরিবর্তন করে দেয় এবং মিসরের সুলতান কোজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখে। জাহের বাইবারস জেরুসালেমের উপর তাতারী আক্রমণ প্রতিহত করে মসজিদে আকসার হেফাজত করেন এবং পরবর্তীতে মসজিদের প্রয়োজনীয় মেরামত কাজ করেন। মিসরের শাসকরা ছিলেন সুলতান সালাহউদ্দীনের বংশধর। পারিবারিক কোন্দলের কারণে তাদের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই ৭২৫ হিজরী মোতাবেক ১৩২৯ খৃঃ খৃস্টান ক্রুসেডারদের হাতে পুনরায় জেরুসালেমের পতন হয়। ১৭শ খৃস্টাব্দ মোতাবেক হিজরী ১০ম শতাব্দীর মাঝামাঝি, তুরস্কের ওসমানী সুলতান ১ম সেলিমের হাতে জেরুসালেম পুনরুদ্ধার হয় এবং ১৯২২ খৃঃ প্রথম মহাযুদ্ধের পর বৃটেনের অসিগিরীতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তা মুসলমানদের শাসনাধীন থাকে।

১১. ওসমানী শাসনামলে ১৫২০ খৃঃ থেকে ১৫৬০ খৃঃ পর্যন্ত তুর্কী সুলতান সুলাইমান কানুনী মসজিদে আকসার চার দেয়াল সংস্কার করেন। মসজিদের পার্শ্বে অবস্থিত দুর্গ, কৃপ ও হারাম শরীফের দরজা ও দেয়াল পুনঃনির্মাণ করেন এবং মাকামে দাউদ সংস্কার করেন। ওসমানী শাসন দুর্বল হয়ে পড়লে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীরা জেরুসালেমের প্রতি শ্যেন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। তুর্কী সুলতান জার্মানীর পক্ষে এবং বৃটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন। ফলে বিজয়ী বৃটেন তুর্কী শাসনের অবসান ঘটায় এবং জেরুসালেম দখল করে নেয়। পাঁচ বছর পর ১৯২২ খৃঃ জাতিসংঘ জেরুসালেমের উপর বৃটেনকে ম্যান্ডেট দেয় এবং বৃটেন জেরুসালেমের উপর অসি নিযুক্ত হয়। তখন জেরুসালেমে মুসলিম শাসনের অবসান হয়।

১২. বৃটিশ শাসনামলে ২রা নবেম্বর, ১৯১৭ খৃঃ, বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর কুখ্যাত ‘বেলফোর ঘোষণায়’ ইহুদী নেতা লর্ড রথচাইল্ডকে জানান যে, বৃটেন ফিলিস্তি নে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করবে। ১৯২২ খৃঃ জাতিসংঘ ফিলিস্তিনে পৃথক ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করে। ১৯২২ খৃঃ থেকে ১৯৬৭ খৃঃ পর্যন্ত বিশ্ব ইহুদী সংস্থা বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদীদেরকে ফিলিস্তিনে এনে পুনর্বাসন করে। জার্মানীর নাৎসী নির্যাতনের ফলে বহু ইহুদী ফিলিস্তিনে চলে আসে। ১৯৪৭ খৃঃ জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে ২ ভাগ করে একভাগে আরব রাষ্ট্র এবং অন্যভাগে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গ্রহণ করে। ১৯৪৮ সালের ১৫ই মে বৃটেন ফিলিস্তিন এবং জেরুসালেম থেকে নিজ শাসনের অবসান এবং পৃথক ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। বৃটেন, ১৯৪৮ সালের ২৬শে মে গাজ্জাকে আনুষ্ঠানিকভাবে মিসরের কাছে এবং ১৯শে মে জর্দান নদীর পশ্চিম তীর ও জেরুসালেমকে জর্দানের কাছে হস্তান্তর করে।

১৩. জর্দানের মুসলিম শাসনামলে

দীর্ঘ ৩১ বছর বৃটিশ শাসনে থাকার পর জেরুসালেম পুনরায় জর্দানের আরব মুসলমানদের শাসনে ফিরে আসে। জেরুসালেম ১৯৬৭ খৃঃ পর্যন্ত জর্দানী শাসনাধীন থাকে। ১৪. ইসরাইলী শাসনামলে ১৯৬৭ খৃঃ জুন মাসে ইসরাইল একযোগে মিসর, সিরিয়া এবং জর্দানের উপর আক্রমণ করে। ৬ দিনের যুদ্ধে ইসরাইল, জর্দানের মুসলিম শাসন থেকে জেরুসালেম দখল করে নেয়। এছাড়া ইসরাইল মিসরের সিনাই উপত্যকা এবং সিরিয়ার গোলান হাইট দখল করে। এরপর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ২৪২ নং প্রস্তাব গ্রহণ করে এতদঞ্চলের সকল রাষ্ট্রের প্রতি স্বীকৃতি এবং অধিকৃত আরব এলাকা থেকে ইসরাইলী বাহিনী প্রত্যাহারের আহ্বান জানায়। কিন্তু সেই প্রস্তাব আজও কার্যকর হয়নি। তাই জেরুসালেম এখন পর্যন্ত ইসরাইলী জবরদখলে রয়েছে। ইসরাইল জেরুসালেমকে তার স্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করে বলেছে, সে কখনও জেরুসালেম হাতছাড়া করবে না। এখন মধ্যপ্রাচ্য শান্তি সম্মেলন চলছে। বিশ্বের দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ঐ সম্মেলন আহ্বান করেছে। সম্মেলনের লক্ষ্য হল, ফিলিস্তিন সমস্যাসহ মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার সমাধান করা এবং আরব এলাকা থেকে ইসরাইলী জবরদখলের অবসান ঘটানো।

লক্ষণীয় বিষয়

জেরুসালেম বিগত ১৪শ’ বছরের মধ্যে প্রায় ১ হাজার বছর যাবত মুসলমানদের শাসনাধীন ছিল। মাত্র ২বার খৃস্টান শাসন ও সর্বশেষবার ইহুদী শাসনের যাঁতাকলে ঐ মুসলিম শহরটি নিষ্পেষিত হয়। আজ দীর্ঘ ২৫ বছর যাবত জেরুসালেম ইসরাইলের জবরদখলে রয়েছে। ইসরাইলের মাত্র ৫০ লাখ ইহুদীর কাছে আজ জেরুসালেম বন্দী। পক্ষান্তরে, ইসরাইলের পার্শ্ববর্তী আরব দেশসমূহের মুসলিম জনসংখ্যা হচ্ছে ১৭ কোটি এবং গোটা দুনিয়ায় মুসলমানদের সংখ্যা হচ্ছে ১শ’ কোটি।

আজ মুসলমানদের এই অসহায়ত্ব দূর করার জন্য জেরুসালেম বিজয়ী আবু ওবায়দাহ বিন জাররাহ ও সালাহউদ্দীন আইউবীর মত নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্ব দরকার।

.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *