আলোকিত – মহাশ্বেতা দেবী

আলোকিত – মহাশ্বেতা দেবী

সকাল থেকেই দৌড়োদৌড়ি শুরু। আজ না দীপাবলি! তুলি, দীপ, শ্রীজ, আবির, তিন্নি, তপু, ওরা সবাই খুব ব্যস্ত। এবার দীপাবলি পড়েছে পয়লা নভেম্বরে। হাল্কা শীত শীত ভাব হাওয়ায়। সকালে উঠেই সবার প্রথম কাজ হল ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে অক্টোবর থেকে নভেম্বরে নিয়ে আসা। পাড়ার প্রত্যেকটা বাড়িতেই এই একই দৃশ্য।

দশটা বাজতে বাজতেই ছয় বন্ধু জড়ো হল রাস্তায়। বাজি কিনতে যাওয়া হবে এবার। বাজির বাজার ওদের পাড়া থেকে বেশি দূর নয়। মিনিট পনেরোর রাস্তা। এইটুকু রাস্তা, তার ওপর যাচ্ছে ছ’জন, কিন্তু তবুও বড়রা কিছুতেই কিছু শুনবে না। বড় একজন কাউকে ওদের সঙ্গে পাঠাবেই। তবে এবারে মন্দের ভালো, ওদের সঙ্গে যাচ্ছে তিন্নির দিদি তিতলি ।

আগের দিন রাতে পাড়ার সব বড়রা গটমট করে তুলিদের বাড়িতে মিটিং করতে গেল দীপাবলির ব্যাপারে। ওরা সবাই বেশ ভয়ে ভয়েই ছিল। বড়রা মিটিংএ ঠিক করবে পরদিন কে ওদের সঙ্গে যাবে বাজির বাজারে। ভয় এই কারণে যে যদি সকলে মিলে আবিরের বদরাগী কাকা কিম্বা দীপের সেই ডাক্তার মাসি বা ওই ধরণের কাউকে দায়িত্বটা দেয়।

আবিরের বদরাগী কাকার অল্পতেই রাগ উঠে যায়। আর রেগে গেলে সে হাতের কাছে যা পায় তা ভাঙতে শুরু করে। এহেন লোককে নিয়ে বেরোনো মানে বিশাল এক ঝুঁকি নেওয়া। বাজির বাজারে গিয়ে যদি রেগে যায়, তাহলে তো বুঝতেই পারছ ! দীপের ডাক্তার মাসির কথাই ধর। তিনি সব জায়গায় জীবাণু দেখেন। পরিষ্কার ঝকঝকে তকতকে জিনিসপত্রতেও তিনি দেখেন ব্যাক্টেরিয়া। আর অসুখ ? তাঁর মতে আমাদের সকলের সব শক্ত শক্ত রোগ, যাদের নামও আমরা কোনদিন শুনিনি। এই রকম মানুষ যদি বাজির বাজারে যায় তাহলে নিৰ্ঘাৎ পরের দিন দোকানদার সন্ন্যাসী হয়ে হিমালয়ে তপস্যা করতে বসবে। এইসব লোকজনদের নিয়েই ভয় করছিল সবাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন ঠিক হল যে এবার তিতলিদি যাবে তখন সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। তিতলিদির নামে এই ধরনের কোন অপবাদ নেই। অতএব বাজি কেনবার যাত্রাটা জমবে ভাল।

রাতটা কাটাল সবাই কোন রকমে বিছানায় ছটফট করে। সকাল দশটা বাজতে না বাজতেই সাতজনের মধ্যে ছজন হাজির হয়েছে রাস্তায়। এখন শুধু তপুর অপেক্ষা। সবসময়ের মত আজকেও ওর জন্য অপেক্ষা করতে হবে সবাই জানতো সেটা। কিন্তু দীপাবলি বলে কথা। সবাই বেশ অধৈর্য হয়ে উঠছিল।

শ্ৰীজা রাস্তা ধরে হাঁটছিল। সঙ্গে আবির আর তুলি। ওরা সব চাইতে আগে এখানে এসেছে। যথারীতি ওদেরই সবচেয়ে বেশি অধৈর্য হওয়ার কথা। কিন্তু শ্ৰীজা ঠিক অধৈর্য হয়ে হাঁটছিল না। রাস্তার সবচেয়ে অন্ধকার কোনায় যে বাড়িটা সেটার কাছে যেতে চাইছিল আসলে। এই দিকটাতে গাছপালা একটু বেশি আর ঘন। সূর্যের আলো না পড়াতে বেশ ঠান্ডা লাগছিল। তুলি বলল, ‘চল শ্ৰীজা ফিরে যাই, ওদিকে তপু এসে গেছে বোধহয়।’ উত্তরে শ্ৰীজা বলল, ‘এই বাড়িটাতে একটা ছোট্ট ছেলে আছে, জানিস ? আমি ওকে দুয়েকবার দেখেছি। রাস্তায় বেরোয় না মোটে। একটা লম্বা লোকের সঙ্গে থাকে।ততক্ষণে ওরা বাড়িটার অনেক কাছে চলে এসেছিল। দিনের আলোতেও ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থাকে বাড়িটা। সামনের বাগানটায় আগাছা উঠছে। খুব এলোমেলো অবস্থা। এক এক জায়গায় বাড়িটার রঙ উঠে গেছে, কোন কোন জায়গায় ফাটল। আবির বলল, “ওই লম্বা লোকটা না, ভীষণ রাগী। একবার আমার দিকে এমন কটমট করে চেয়েছিল যে মনে হচ্ছিল যে ও আমায় এক্ষুণি ধরে খেয়ে ফেলবে। বাচ্চাটা থাকে কি করে ওর সঙ্গে ? আচ্ছা ওকে একদিন ডাকলে হয় না ? না হয় খেলবে আমাদের সঙ্গে। শ্রীজা তুই ঠিক দেখেছিস তো?’ এক নিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে আবির হাঁপাতে লাগল। ওদিক থেকে তিতলিদির ডাক শোনা যাচ্ছিল। তিনজন মিলে উল্টোমুখে হাঁটা লাগাল।

বাজার সারতে সারতে সবার বেশ অনেকক্ষণ লাগল। এসেছিল খালি হাতে, ফিরল হাত ভর্তি ফুলঝুরি – রংমশাল – তুবড়ি-চরকি-রকেট বাজি নিয়ে। বাড়িতে সবাই তেতে পুড়ে পৌঁছলো যখন, তখন দেড়টা বাজে। মায়েরা সবাই বকাঝকা করল অল্প অল্প, কিন্তু তা গায়ে তো কিছুই নয়। শ্রীজা কিন্তু কিছুতেই মাথা থেকে ওই অন্ধকার বাড়িটা আর ওর বাসিন্দা সেই ছোট্ট ছেলেটাকে বার করতে পারল না। সারা দুপুর ওদের কথা ভাবল শ্ৰীজা। বাচ্চাটা কে? ওর নাম কী? ওই লম্বা লোকটা ওর কে হয়? ও বাড়ি থেকে বেরোয় না কেন? – এইরকম শত শত প্রশ্ন ঘুরতে লাগল ওর মাথার মধ্যে। শেষপর্যন্ত একটা প্ল্যানই সে ছকে ফেলল মনে মনে। এখন শুধু সন্ধের অপেক্ষা।

দুপুরটা কোনরকমে ছটফট করে কাটিয়ে দিল ওরা ছজন। অন্ধকার হতে না হতেই সাজানো শুরু হল প্রত্যেক বাড়িতে। তিন্নিদের ছাদে তিন্নি আর তিতলি মিলে মোমবাতি লাগাল, দীপের বাড়িতে রঙিন টুনিলাইট জ্বলে উঠল, তপুর বাড়িতে ওরা জ্বালাল মাটির প্রদীপ, শ্ৰীজাদের বাড়িতেও জ্বলল প্রদীপ, আবিরদের বারান্দায় জ্বলল মোমবাতি। দেখতে দেখতে আলোয় সেজে উঠল গোটা পাড়া। সব কী ঝকমকে ঝলমলে! আলো জ্বলল না শুধু পাড়ার সবচেয়ে অন্ধকার কোণে ভূতের মত দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটায়।

সেই অন্ধকার বাড়িটা থেকে বড়ো বড়ো চোখে ছেলেটা তাকিয়ে ছিল আলোকিত পাড়াটার দিকে। কি সুন্দরই না লাগছে আলোগুলো! কি সুন্দর বাজি ফাটছে দূরে! হালকা হালকা শব্দ ভেসে আসছিল বাজি ফাটার। সকলের বাড়ি সাজানো হয়েছে। মোমবাতি, প্রদীপ কিম্বা টুনি লাইট – কোন না কোন একটা রয়েছে প্রত্যেক বাড়িতে। খালি ওদের বাড়ি ছাড়া। কে সাজাবে? কাকাকে খুব ভয় পায় যে ও। মুখ ফুটে কিছু বলতেও সাহস পায় না। তাই আজ পাড়ায় সব কটা বাড়ি যখন সেজে উঠেছে আলোয়, তখন শুধু ওদের বাড়িটাই অন্ধকারে ডুবে রয়েছে। কাকা অফিস থেকে এখনও ফেরেনি। বাড়িতে ও একা। ভয় লাগছিল ওর। বাইরেটা কি অন্ধকার !

ও ছোট্ট দুটো হাতে আঁকড়ে ধরেছিল একটা ছোট মোমবাতি। রান্নাঘরের এককোনে খুঁজে পেয়েছিল সেটা। আগুনও জ্বালিয়েছে মোমবাতিতে। আগুনের হলদেটে শিখাটা দপ দপ করে জ্বলছে। আগুনটা হাত দিয়ে ঘিরে শিখাটাকে বাঁচিয়ে রাখল ও। আস্তে আস্তে হেঁটে গেল ওদের বারান্দায়। সত্যি কি অন্ধকার এখানে! এখান থেকে ওই পাড়াটাকে একট স্বপ্নের রাজ্য মনে হচ্ছে। আস্তে আস্তে অন্ধকার বারান্দার সবচেয়ে অন্ধকার কোনাটাতে লাগিয়ে ফেলল মোমবাতিটা। একটা হলদেটে আলো ছড়িয়ে গেল খানিকটা জায়গা জুড়ে। ওর মুখে ফুটে উঠল একটা অপূর্ব হাসি।

.

কিন্তু একি ! বারান্দাটা একটু বেশি আলোকিত মনে হচ্ছে যেন ? একটু না, বেশ আলোকিত। চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়াল ও। কে ওরা ? ফুলঝুরি হাতে একদল ছেলেমেয়ে। ওর সমবয়সীই হবে। ফুলঝুরির আলোতেই আলোকিত হয়ে উঠেছে অন্ধকার জায়গাটা। অবাক চোখে তাকিয়ে রইল ও সেই আলোকিত ছেলেমেয়েদের দিকে। সবার সামনে দাঁড়ানো মেয়েটা হাসছিল। কি সুন্দর হাসিটা! ওরা সকলেই কি সুন্দর! ঝলমল করছে যেন। এটা কি স্বপ্ন? স্বল্পই মনে হচ্ছে যেন। ঠিক সেই মুহূর্তেই স্বপ্নটা সত্যি হয়ে গেল যখন সেই মেয়েটা ওর হাতে নিজের ফুলঝুরিটা ধরিয়ে দিল। বিস্ময়ের সঙ্গে ও দেখল বস্তটাকে। সেই সুন্দর ছেলেমেয়েদের সকলের মুখে হাসি। ও-ও হেসে উঠল।

সেদিন রাতে তুলি, দীপ, শ্ৰীজা, আবির, তিন্নি, তপুর সঙ্গে আরেকজন বাজি ফাটিয়েছিল। ওদের সাতজনের হাসিতে ভরে উঠেছিল গোটা পাড়া আর আলোকিত জায়গাটা আরও আলোকিত লাগছিল যেন সেদিন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *