প্রথমে ভেবেছিল পরদিন সকালে যাবে৷ কিন্তু অফিসের কাজ-কর্ম বিকেলের মধ্যে মিটে
যাবে বুঝে, তপন ঠিক করে ফেলল শুধু শুধু রাতটা আর মেসের ঘুপচি ঘরে কাটিয়ে লাভ নেই৷ তার থেকে বিকেলের বাস ধরে যদি হলদিয়া চলে যেতে পারে, তাহলে বড়দিনের দু-দিন ছুটির সঙ্গে শনি-রবি মিলে দিব্যি একটা চারদিনের ছুটি কাটানো যাবে৷ ধর্মতলা থেকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় হলদিয়ার বাস ছাড়ে, অসুবিধা নেই কিছু৷
কিন্তু মুশকিল হল, তার নিজের কাজ শেষ হয়ে গেলেও সেগুলো চেকিং করতে অনেকটা সময় লাগিয়ে দিলেন বিমলবাবু৷ তাই শেষ পর্যন্ত তপন যখন ছুটতে ছুটতে ধর্মতলা পৌঁছল, তখন হলদিয়ার লাস্ট বাস ছাড়ব ছাড়ব করছে৷ তাতে অবশ্য অসুবিধা নেই কিছু৷ বাসস্ট্যান্ডের কাছেই তপনের বাড়ি৷ টোটো, রিকশা সব অনেক রাত পর্যন্ত থাকে৷ তপন তাই চটপট টিকিট কেটে বাসে উঠে বসতে না বসতেই বাস ছেড়ে দিল৷ শীতকাল৷ তায় আবার বিকেল থেকে টিপির টিপির বৃষ্টি হচ্ছে৷ বাসে তাই প্যাসেঞ্জার নেই তেমন৷ ছোট ব্যাগটা গুছিয়ে রেখে আরাম করে বসল তপন৷ কলকাতায় চাকরিটা পাওয়ার পর থেকে গত একবছর প্রায় প্রতি শনি-রবিবারেই হলদিয়া যায় সে৷ কিন্তু সে হল কোনওরকমে ঠেলে-গুঁজে বাসে ওঠা৷ এরকম হাত-পা ছড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ তো আর মেলে না৷ সারাদিন পরিশ্রমও গেছে খুব৷ তাই জ্যাকেটের চেনটা ভালো করে টেনে দিয়ে, মাফলারটা গলায় জড়িয়ে নিয়ে চোখ বুজল৷
কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল খেয়াল নেই৷ হঠাৎ লোকজনের কথাবার্তায় ঘুমটা ভেঙে গেল৷ বাসটা দাঁড়িয়ে আছে৷ আর চারপাশের লোকজন বেশ উত্তেজিতভাবে জোরে জোরে কথা বলছে৷ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হল তপন৷ এত তাড়াতাড়ি তো হলদিয়া পৌঁছানোর কথা নয়৷ তারপরেই পাশের প্যাসেঞ্জারের চেঁচামেচিতে ব্যাপারটা বোঝা গেল৷ হলদিয়া নয় তারা এসে পৌঁছেছে মহিষাদলে৷ কিন্তু ড্রাইভার বলছে, ইঞ্জিন স্টার্ট নিচ্ছে না৷ বাস আর যাবে না৷
বেশ খানিকটা তর্কাতর্কির পর সবাইকেই নেমে যেতে হল বাস থেকে৷ তপন পড়ল বিপদে৷ কারণ মহিষাদল থেকে তখন আর হলদিয়া যাওয়ার বাস নেই৷ এদিকে মহিষাদল এমন কিছু বড় জায়গা নয় যে চাইলেই থাকার হোটেল পাওয়া যাবে৷ তা ছাড়া হোটেলে থাকা মানে খামোখা কতগুলো টাকা খরচা৷ খানিকটা যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা, তখন হঠাৎ তপনের মনে পড়ল তার এক দূরসম্পর্কের পিসির বাড়ি আছে মহিষাদলের কাছেই গেঁওখালিতে৷ তপন অবশ্য বহু বছর সেখানে যায়নি৷ কিন্তু যোগাযোগ আছে৷ একরাতের জন্য সেখানে আশ্রয় নিলে অখুশি হবে না৷
ফোন খুলে পিসতুতো দাদা বাপনের নম্বর ডায়াল করল তপন৷ অমন হঠাৎ করে তপন আসছে শুনে প্রথমটায় অবাক হলেও বাপনদা কিন্তু খুশিই হল৷ তবে বাপনদার কাছে জানা গেল তাদের বাড়িটা ঠিক গেঁওখালিতে নয়৷ গেঁওখালি বাজার থেকে দেড় কিলোমিটার মতো ভিতরে ঢুকে এলে মীরপুর গ্রাম৷ সেখানেই পিসির বাড়ি৷ বাপনদা বলল, তপু তুই একটা টোটো ধরে মহিষাদল থেকে গেঁওখালি চলে আয়৷ টোটোটা বাজারের সামনে দাঁড়াবে৷ টোটোওলাকে বলবি মীরপুর যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দিতে৷ একটাই রাস্তা৷ সোজা এসেছে৷ ভয়ের কিছু নেই৷ সোজা চলে আসবি৷ আমি যেতাম তোকে আনতে৷ কিন্তু ক’দিন আগে পা মচকে গিয়ে হাঁটতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে৷ তাও চেষ্টা করব যতটা সম্ভব এগিয়ে যেতে৷ তুই রওনা দে৷
বাপনদার কথামতো একটা টোটো ধরে গেঁওখালি পৌঁছে গেল তপন৷ গঞ্জ জায়গা৷ বাজারের দোকান-পাট ইতিমধ্যেই বেশির ভাগ বন্ধ হয়ে গেছে৷ টোটোওলাকে বলাতে সে মীরপুরের রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে বলল, সোজা চলে যান দাদা৷ জোরে হাঁটলে আধঘণ্টাটাক লাগবে৷ ফাঁকা রাস্তা৷ তবে ভয়ের কিছু নেই৷ আমি আপনাকে পৌঁছে দিতে পারতাম৷ তবে ছেলেটার জ্বর৷ ওষুধ কিনে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে৷
গেঁওখালি বাজারের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে রাস্তাটা৷ ছোট ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে রওনা দিল তপন৷ কিছুদূর পর্যন্ত দু-চারটে দোকান-পাট বাড়িঘর আছে৷ তারপর দু-পাশে চাষের জমি৷ কীসের চাষ হয়েছে, কতদূর বিস্তৃত জমি বোঝার কোনও উপায় নেই৷ কারণ কৃষ্ণপক্ষের রাত৷ আকাশে চাঁদের চিহ্ন নেই৷ তারার আলোয় চারিদিকেই শুধু অন্ধকারের সমুদ্র৷ ঝোপে-ঝাপে অবশ্য অসংখ্য জোনাকি জ্বলছে৷ মাঝে-মধ্যে দু-একটা সাইকেল পাশ কাটিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে৷ এ ছাড়া চারিদিক শুনশান৷ টিপটিপে বৃষ্টিটা নেই৷ কিন্তু কনকনে ঠান্ডা হাওয়া একেবারে হাড়ের ভিতর পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে৷
সাবধানে হাঁটছিল তপন৷ অচেনা রাস্তা৷ তায় আবার এরকম অন্ধকারে৷ গর্তে পা পড়ে গিয়ে বিপদ হতে কতক্ষণ৷ কিছুক্ষণ হাঁটার পর বাতাসে কেমন একটা আঁশটে, জলীয় গন্ধ ভেসে এসে নাকে লাগল৷ জলাভূমির পাশ দিয়ে গেলে যেমনটা পাওয়া যায়৷ মীরপুর গ্রামের পাশে রূপনারায়ণ নদী৷ কিন্তু রাস্তাটাও কি নদীর পাশ দিয়ে গেছে, ভাবছিল তপন৷ কেমন যেন একটু অস্বস্তিও হচ্ছিল৷ চার-পাশের পরিবেশটা কেন যেন মনে হচ্ছে হঠাৎ একটু বদলে গেছে৷ আশপাশে দু-একটা মাটির বাড়ি দেখা যাচ্ছে৷ কিন্তু তার কোনওটাতেই আলো জ্বলছে না৷ কোনও মানুষের অস্তিত্বও টের পাওয়া যাচ্ছে না৷ বাড়িগুলোর গড়নও কেমন যেন অচেনামতো৷ একটা বাড়ির দরজায় মনে হল ক্রশের মতো কী একটা ঝুলছে৷ বাপানদা আর টোটোওয়ালা দুজনেই বলেছিল, রাস্তা একটাই৷ সেটাই সোজা মীরপুর গেছে৷ কিন্তু সন্দেহ হতে শুরু করল তপনের৷ যেরকম অন্ধকার তাতে ভুল রাস্তায় চলে যাওয়া বিচিত্র কিছু নয়৷ কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পারলে ভালো হত, কিন্তু চারপাশে কোনও মানুষজনই দেখা যাচ্ছে না৷ ভাবতে ভাবতেই দেখা গেল রাস্তার ধারে একটা বাড়িতে আলো জ্বলছে৷ এই বাড়িটাও বেশ অন্যরকম দেখতে৷ মাটির বাড়ি ঠিকই, কিন্তু সামনে একটুখানি আর্চ দেওয়া পোর্টিকোর মতো জায়গা৷ সেখান থেকে দু-ধাপ সিঁড়ি উঠে একটা ছোট বারান্দা, তারপর দরজা৷ দরজাটা অবশ্য ভিতর থেকে বন্ধ৷ কিন্তু ভিতর থেকে কথাবার্তার আওয়াজ আসছে৷ পাশে একটা জানলা, সেটা ভেজানো আছে৷
অচেনা জায়গা৷ তাই প্রথমেই দরজায় টোকা দিতে সাহস হল না তপনের৷ সে বারন্দায় উঠে এসে সাবধানে জানলাটা একটু ফাঁক করে ভিতরে উঁকি দিল৷ ভিতরে বেশ কয়েকজন লোক রয়েছে৷ তবে তাদের দেখে তপনের মনে হল সম্ভবত কোনও নাটকের মহড়া চলছে৷ কারণ লোকগুলো সবই চাপা পায়জামা আর ওপরে ফোলা ফোলা একধরনের জামা পরেছে৷ পিরিয়ড ফিল্মে ইউরোপের মানুষজনকে যেরকম পোশাক পরতে দেখা যায় সেরকম৷ লোকগুলোর মাথায় পরচুলা আছে৷ মুখও পেইন্ট করে ধপধপে ফর্সা৷ নিশ্চিত কোনও ঐতিহাসিক নাটকই হচ্ছে৷ ঘরটা এমনভাবে সাজানো যেন একটা ছোট বিচারশালা৷ একজন লোক, সম্ভবত অপরাধী, কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন৷ বিচারকের আসনে যিনি বসে আছেন, তাঁর মুখ দেখা যাচ্ছে না৷ তবে তাঁর পাশে আরও কয়েকজন রয়েছেন যাঁরা বিচারকের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলছেন৷ ঘরটা খুব বড় নয়৷ কিন্তু নাটকে সংলাপ স্পষ্টভাবে শুনতে পাচ্ছিল না তপন৷ তবে কোনও একটা বিষয়ে যে উত্তেজিতভাবে আলোচনা হচ্ছে সেটা বোঝা যাচ্ছে৷ অপরাধী লোকটি প্রাণপণে হাত-মুখ নেড়ে তিনি যে নির্দোষ সেকথা বলতে চাইছেন৷ কিন্তু বিচারক তাতে কানও দিচ্ছেন না৷ তিনি অন্য দুজনের সঙ্গে কথা বলছেন৷ দেখে মনে হচ্ছে বিচারকের সঙ্গে এই লোকগুলোর কোনও ষড় আছে৷ সেটা বুঝতে পেরেই অন্য মানুষটি সমানে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করছেন৷ কিন্তু লাভ হল না কিছুই৷ বিচারক হাত তুলে সাজা ঘোষণা করে দিলেন৷ তারপরই ঘটল একটা সাংঘাতিক কাণ্ড৷ একটা লোক এসে ঘ্যাচাং করে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো লোকটার ডান হাত কব্জি থেকে কেটে দিল৷ লোকটি ভয়াবহ চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেলেন৷ যদিও নাটকের মহড়া, কিন্তু তপনের মনে হচ্ছিল ঘটনাটা যেন সত্যিই ঘটেছে৷ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিল সে৷ আর ঠিক এই সময় তার মোবাইলটা বিকট আওয়াজ করে বেজে উঠল৷ সেই আওয়াজ শুনে চেয়ারে বসে থাকা বিচারক মুখ ঘুরিয়ে জানলার দিকে তাকালেন আর অবাক হয়ে তপন দেখল মুখটা তার ভীষণ চেনা৷ যদিও কোথায় দেখেছে মনে করতে পারছে না৷
মোবাইলের স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে লেখা আছে বা পনদা কলিং৷ তপন তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নেমে রাস্তায় এসে ফোনটা ধরল৷
কী রে কদ্দূর এলি?
এসে গেছি তো বেশ খানিকটাই৷ কোথায় এসেছি কী করে বলব বলো তো! চারিদিকই তো ঘুরঘুট্টি অন্ধকার৷ আচ্ছা দাঁড়াও বলছি, আমি এসেছি…..
বাড়িটার একটা বর্ণনা দেবে বলে পিছন ফিরে অবাক হয়ে তপন দেখল রাস্তার ধারটা পুরোপুরি অন্ধকার৷ বাড়ি, আলো, মহড়া সবই কেমন ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেছে৷ সবটাই কি তাহলে চোখের ভুল? নাকি রাস্তাটা হঠাৎ একটা বাঁক নিয়েছে বলে বাড়িটা দেখা যাচ্ছে না! অন্ধকার ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে গা-টা কেমন যেন শিরশির করে উঠল তপনের৷ এদিকে ফোনের ওদিকে বাপনদা অস্থির হয়ে উঠেছে৷ তাই বাধ্য হয়েই বলল, রাস্তাটা যেখানে বাঁদিকে বেঁকেছে, সেখানে আছি….
বুঝেছি৷ আর মিনিট দশেক লাগবে৷ এগিয়ে আয়৷ আমি গ্রামের মুখে দাঁড়িয়ে আছি৷
রাস্তার ধারেই একটা দোকান৷ তাতে তখনও উনুনে চায়ের কেটলি বসানো৷ সামনের বেঞ্চে বসে ছিল বাপনদা৷ তপনকে দেখেই একেবারে হৈহৈ করে উঠল, যাক ভাগ্যিস বাস খারাপ হয়েছিল, তাই এতদিন বাদে পিসির বাড়ি আসা হল৷ শেষবার এসেছিলি তখন তোর ক্লাস ফোর৷ মা শুনেই দারুণ খুশি৷ বারবার বলছে কতকাল বাদে আবার তপুটাকে দেখব৷
বড় রাস্তা থেকে পিসির বাড়ি কাছেই৷ তবে পায়ে ব্যথার জন্য খুঁড়িয়ে হাঁটছে বাপনদা৷ তাই একটু সময় লাগল৷ পিসেমশাই বর্ধিষ্ণু চাষি৷ ছড়ানো বাড়ির একপাশে ধানের গোলা৷ পিছনে পুকুর, ফলের বাগান সব মিলিয়ে জমজমাট অবস্থা৷ তপন আসছে শুনে ওইটুকু সময়ের মধ্যেই নানারকম রান্নার আয়োজন শুরু হয়ে গিয়েছে৷ নিজের একসেট ফর্সা পাজামা-পাঞ্জাবি বার করে দিয়ে বাপনদা বলল, তুই জামা বদলে টিউবওয়েলে হাত-মুখ ধুয়ে নে তপু৷ মা চা দিচ্ছে৷ হারুদা তোকে টিউবওয়েল পাম্প করে দেবে৷
আলোয়ান গায়ে দিয়ে একটা মাঝবয়সি লোক বারান্দার একপাশে বসেছিল৷ দেখেই বোঝা যাচ্ছে বাড়ির কাজকর্ম করে৷ বাপনের কথা শুনে উঠে বাইরের দিকে গেল৷ তপনও গেল পিছন পিছন৷ বারান্দা থেকে নেমে ডান পাশে একটু গেলেই টিউবওয়েল৷ ঠান্ডা জল৷ এতক্ষণ ক্লান্তির পর হাত-মুখ ধুয়ে ভারী আরাম হল তপনের৷ কিন্তু গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে হঠাৎ চোখ পড়ল হারুর ওপর৷ সে তখনও দাঁড়িয়ে আছে টিউবওয়েলের পাশে৷ বারান্দার আলো তেরছা হয়ে এসে পড়েছে তার মুখে৷ তপন চমকে উঠে দেখল, হারু কীরকম যেন স্থির, ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে৷ আর হারুকে অবিকল সেই নাটকের মহড়ার সময় যে লোকটাকে শাস্তি দেওয়া হল তার মতো দেখতে৷
এই হারুদা লোকটা কে গো?
ভাত খেতে বসে বাপনদাকে জিজ্ঞাসা করল তপন৷
আরে আমাদের গ্রামের ছেলে৷ বাবা-মা মরে গেছে৷ ওর বুদ্ধিশুদ্ধি খুব পরিষ্কার নয়৷ ডান হাতটা কমজোরি৷ আবার বুকেরও দোষ আছে৷ কাজকম্ম কিছুই করতে পারে না৷ আমাদের বাড়িতে থাকে৷ টুকটাক ফাইফরমাশ খাটে আর দু-বেলা খায়…….
দাদার কথার উত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তপন, কিন্তু তার আগেই বাপন বলল, শোন তপু কালকের দিনটা এখানে থেকে যা৷ একটা অদ্ভুত জিনিস দেখতে পাবি৷ এই মীরপুর গ্রাম কিন্তু এককালে পর্তুগিজদের বিজনেস সেন্টার ছিল৷ রূপনারায়ণ নদী দিয়ে ব্যবসা চলত৷ তখন অবশ্য নদীটা গ্রামের অনেক কাছে ছিল৷ তো সেই পর্তুগিজদের বংশধর বেশ কয়েকটা পরিবার এখনও এখানে রয়ে গেছে৷ অন্ধকারে দেখতে পাসনি, গ্রামে ঢোকার মুখে একটা বেশ বড় চার্চও আছে৷ বড়দিনে সেখানে পর্তুগিজ রীতি মেনে প্রার্থনা হয়৷ আর তার আগের দিন ওরা মোমবাতি আর ফুল নিয়ে গান গাইতে গাইতে কবরখানায় যায়৷ যারা মারা গেছে তাদের জন্য প্রার্থনা করে৷ সে ভারী সুন্দর দৃশ্য৷ কালকের দিনটা থেকে গেলে দেখতে পাবি৷
নরম বিছানায়, কম্বলের ভিতর ঢুকে ঘুমিয়ে পড়েছিল তপন৷ হঠাৎ একটা গানের সুরে ঘুমটা ভেঙে গেল তার৷ কিন্তু উঠে বসে কেমন যেন একটা ধাঁধা লাগল৷ এমনিতেই অচেনা জায়গা৷ তারওপর চারপাশটা মনে হচ্ছে যেন ভীষণরকম বদলে গেছে৷ পাশের একটা চৌকিতে শুয়ে বাপনদা ঘুমোচ্ছিল৷ সেই চৌকিটাই এখন নেই৷ সামনের দরজাটা খোলা৷ বাইরে থেকে ভেসে আসছে গানের সুর৷ মন্ত্রমুগ্ধের মতো খাট থেকে নেমে দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল তপন৷ রাস্তা দিয়ে একটা মিছিল যাচ্ছে৷ সবার হাতে মোমবাতি আর সাজিতে ফুল৷ তাদের জামা-কাপড় একেবারে অন্যরকম৷ গানের সুর আর কথাও অচেনা৷ মিছিলের পিছন পিছন হাঁটতে লাগল তপনও৷ গ্রামের একদম শেষে কবরখানা৷ মিছিলটা সেখানে গিয়ে ঢুকল৷ তাদের সঙ্গে তপনও৷ কিন্তু কবরখানায় ঢোকার পর মিছিলের লোকগুলো হঠাৎ কোথায় জানি হারিয়ে গেল৷ তপন চমকে উঠে দেখল ঘুটঘুটে অন্ধকার কবরখানায় সে একলা দাঁড়িয়ে আছে৷ ভীষণ ভয় পেয়ে ছুটে পালানোর জন্য পিছন ফিরতেই একেবারে মুখোমুখি হারুদা৷ কিন্তু সে পিসির বাড়ির ন্যালাখ্যাপা হারুদা মোটেই নয়৷ তার দু-চোখ জ্বলজ্বল করছে৷ মুখে একটা নিষ্ঠুর হিংস্র হাসি, এতদিন বাদে হাতে পেয়েছি তোকে৷ ষড়যন্ত্র করে শাস্তি দিয়েছিলি আমায়, আমার ডান হাত কেটে দিয়েছিলি, আমার বউ-মেয়ে আমাকে ছেড়ে চলে গেছিল….আজ সবকিছুর শোধ নেব আমি…….
ফ্যাঁসফেঁসে গলায় কথাগুলো বলতে বলতে তপনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার গলা টিপে ধরল হারুদা৷ প্রাণপণে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করছিল তপন৷ কিন্তু হারুদার শরীরে যেন হাতির বল৷ সাঁড়াশির মতো তার দশটা আঙুল চেপে বসেছে তপনের গলায়৷ দমবন্ধ হয়ে আসছে তপনের৷ তবে তারমধ্যেও সে বুঝতে পারল নাটকের মহড়ায় বিচারকের মুখটা তার চেনা লেগেছিল কারণ সেটা ছিল সে নিজে৷ প্রাণ বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টায় হারুদার বুকে শেষ পর্যন্ত বোধহয় একটা ঘুসি মেরেছিল তপন৷ তাতেই হাতটা আলগা হয়ে যায়৷ তবে ততক্ষণে সে নিজেও জ্ঞান হারিয়েছে৷
পরদিন সকালে কবরখানায় অজ্ঞান তপনকে খুঁজে পায় গ্রামের লোকেরা৷ পাশে পড়েছিল হারুদার মৃতদেহ৷ আকস্মিক উত্তেজনায় হার্টফেল, বলেছিল ডাক্তার৷ মাঝরাতে উঠে সে কেন কবরখানায় এসেছিল, সেকথা কাউকে বলতে পারেনি তপন৷ তবে বাপনের কাছে খোঁজ নিয়ে জেনেছিল, যে কবরটার পাশে সে পড়েছিল, সেটা ছিল আলফ্রেড ডি সুজা নামে এক ব্যক্তির৷ চার্চের নথি থেকে জানা যায়, বিচারকের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে আলফ্রেডকে মিথ্যে চুরির মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছিল৷ বিচারক আলফ্রেডের ডানহাত কেটে ফেলার হুকুম দেন৷ বিনা দোষে এরকম শাস্তি পেয়ে পাগল হয়ে যায় আলফ্রেড৷ সে নাকি সারাদিন শুধু ওই বিচারককে শাপ-শাপান্ত করতে করতে গ্রামের রাস্তায় ঘুরে বেড়াত৷ তারপর একদিন রূপনারায়ণ নদীর ধারে তার মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়৷
—