অধ্যায় সাত
হিন্দু দেবতারা অমর বটে! কিন্তু আমরা যেভাবে ভাবি সেভাবে নয়। তাদের মৃত্যু হয়, আবার তাদের জন্মও আছে। মানুষ যেসব দ্বিধা-দ্বন্দ্বের দোলাচালে দোলে, তাদেরকেও সেসব দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে হয়। সত্যি বলতে কী, মানুষের সাথে তাদের পার্থক্য দেখা যায় খুব কম ক্ষেত্রেই…অসুরদের সাথে তো সেই পার্থক্য থাকেই না প্রায়। অথচ হিন্দুদের কাছে তারা সবার চাইতে উঁচু আর আলাদা একটা জাত। তারা যেন এমন এক প্রতীক, যা কোন মানুষ কোনভাবেই কখনও হতে পারবে না। বলা যায়, হিন্দু দেবতারা এমন এক নাটকের কুশীলব, যা আমরা নিজেদের জীবনে চেয়েছি সবসময়; তারা এমন এক মুখোশ, যার দিকে চেয়ে নিজেদেরকেই দেখতে চেয়েছি।
‘ওয়েন্ডি ডনিজার ও ফ্ল্যাহার্টি, প্রারম্ভ, হিন্দু মিথস
শ্যাডো কয়েক ঘণ্টা ধরে কেবল হাঁটছে তো হাঁটছে। দক্ষিণ দিকে এগোচ্ছে সে, অন্তত ওর সেটাই ধারণা। গাছের ভেতর দিয়ে পরিত্যক্ত রাস্তা ধরে আবার কখনও বহুল ব্যবহৃত রাস্তা ধরে এগোচ্ছে ও। সোজা হাঁটতে থাকলে একসময়-না- একসময় দক্ষিণ উইসকনসিনে পৌঁছানো যাবে। রাস্তায় অবশ্য কয়েকবার জিপ গাড়িকে আলো জ্বালিয়ে ওর দিকে আসতে দেখেছিল শ্যাডো, তবে সাহায্য না চেয়ে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থেকেছে। সকালের কুয়াশা এখনও কোমরের মাঝ- পর্যন্ত, তাই অসুবিধা হয়নি। গাড়িগুলোর রং ছিল কালো।
রওনা দেবার মিনিট তিরিশেক পর, দূর থেকে হেলিকপ্টারের আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল শ্যাডো, তখনই বড়ো রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়েছে। যান্ত্রিক ফরিঙের আওয়াজ মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত মাটিতে পড়ে থাকা একটা গাছের আড়ালে আত্মগোপন করেছিল ও।
একেবারে শেষ মুহূর্তে অবশ্য আকাশের দিকে একপলক চেয়েছিল ও, ধূসর আকাশের পটভূমিতে কালো হেলিকপ্টার একেবারে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। তারপরই আবার মাথা গুঁজে দিয়েছে, আওয়াজ না মেলানো পর্যন্ত বেরোয়নি।
গাছের নিচটা অবশ্য স্বাভাবিকের চাইতে অনেক বেশি ঠান্ডা। কেমিক্যাল প্যাডগুলোর জন্য মনে মনে লরাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিল শ্যাডো। ওগুলো না থাকলে হয়তো জমেই যেতে হতো। তবে হাত-পা ছাড়া বাকি দেহটা যেন জমে গেছে—হৃৎপিণ্ড, মন, আত্মা-সব।
আমি কী চাই? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করল শ্যাডো। উত্তর দিতে না পেরে হেঁটে চলল সামনে। একপা-একপা করে এগোচ্ছে, এতক্ষণে পরিচিত লাগতে শুরু করেছে গাছগুলো। যেন আগেও গেছে এ পথ ধরে। বৃত্তাকারে ঘুরছে না তো? হয়তো কপালে এই ক্যান্ডি বারগুলো শেষ হওয়া পর্যন্ত এভাবে ঘোরাই লেখা যাচ্ছে। একসময় ফুরিয়ে যাবে প্যাডগুলোও। তখন কোনো গাছের গুঁড়ির উপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়বে ও, আর কখনও যে ঘুম ভাঙবে না।
প্রশস্ত একটা ঝরনার ধারে এসে উপস্থিত হলো শ্যাডো, স্থানীয়রা একে ক্রিক বলে ডাকে। ঠিক করল, এর ধার ধরেই এগোতে থাকবে। ক্রিক গিয়ে নামে নদীতে, আর সব নদী শেষ হয় মিসিসিপিতে। হাঁটতে থাকলে…অথবা কোনো নৌকা চুরি বা ভেলা বানিয়ে এক সময় না এক সময় ঠিক নিউ অর্লিয়ন্সে পৌঁছে যেতে পারবে। জায়গাটার উষ্ণতার কথা মনে পড়তেই, ওর নিজের ভেতরেও কেমন এক উষ্ণ অনুভূতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল।
অনেকক্ষণ হলো বন্ধ হয়ে গেছে হেলিকপ্টারের আনাগোনা। কেন জানি ওর মনে হচ্ছিল, বগিতে ঘটে যাওয়া তাণ্ডব সামাল দেবার জন্যই এসেছিল ওই হেলিকপ্টারগুলো; ওর পিছু ধাওয়া করার উদ্দেশ্যে নয়। নইলে ফিরে আসত তারা, কুকুর লেলিয়ে দিত, সাইরেন বাজত-এক কথায় নরক নামিয়ে আনত।
আসলেই, কী চায় শ্যাডো? আপাতত একটা উত্তর আসছে মনে, ধরা পড়তে চায় না। চায় না ওই বগিতে যেসব মানুষ খুন হয়েছে তাদের হত্যার দায় নিতে ‘আমি কিছু করিনি,’ নিজের কণ্ঠ শুনতে পেল ও। ‘সব করেছে আমার মৃতা স্ত্রী।’ এই কথা আইনের লোকের সামনে বললে তার চেহারা কেমন হবে, তা আন্দাজ করতে পারছে ও। এরপর শুরু হবে মানুষের তর্ক-ওকে কী পাগলা গারদে পোরা হবে, নাকি দেওয়া হবে মৃত্যুদণ্ড…?
উইসকনসিনে কি এখনও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়?-ভাবল সে। তবে তাতে কিছু যায় আসে না। শ্যাডো আসলে চায়, ওর জীবনে এখন কী ঘটছে, তা জানতে…বুঝতে। জানতে চায়, কখন শেষ হবে অদ্ভুত এসব ঘটনার ঘনঘটা। মুচকি হাসি হেসে ভাবল, আসলে ও চায় সবকিছু যেন আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। কখনও যেন জেলে যেতে না হয় ওকে, লরা যেন এখনও জীবিত থাকে, চায় এ সবকিছু যেন আসলে না ঘটে!
সেই ট্রেন অনেক আগেই প্ল্যাটফর্ম ত্যাগ করেছে বাছা, নিজেকে শোনাল শ্যাডো। তোমার আর ফেরার কোনো পথ নেই, এখন শুধু সামনে এগিয়ে যাওয়া
দূর থেকে কাঠঠোকরার…কাঠ ঠোকরাবার আওয়াজ ভেসে এলো।
শ্যাডো টের পেল, কেউ একজন ওকে দেখছে। কয়েকটা লাল কার্ডিনাল পাখির অস্তিত্ব টের পেল ও ঝোপের আড়ালে। পথের উপর পড়ে আছে একটা হরিণের বাচ্চার লাশও। ওটার পাশটা ছিঁড়ে খাচ্ছে ছোটোখাটো কুকুর আকৃতির একটা পাখি। লাল মাংস টেনে আনছে বাঁকানো, তীক্ষ্ণ ঠোঁট দিয়ে। হরিণটার চোখ অনেক আগেই খুবলে খাওয়া শেষ, তবে মাথাটা আস্ত আছে এখনও। কীভাবে যে মারা গেল ওটা, ভাবল শ্যাডো।
কালো পাখিটা একদিকে কাত করল মাথা। এরপর কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠল, ‘তুমি ছায়া-মানব।’
‘আমি শ্যাডো,’ বলল ও। পাখিটা ডানা ঝাপটে উঠে বসল মৃত পশুটার দেহে। পাখিটার চোখগুলো বিশাল, আর ঘন কালো কালো। কেমন যেন একটা ভয় ভিড় করে ওটাকে কাছ থেকে দেখলে।
‘তোমাকে কাই-রো যেতে বলেছে,’ দাঁড়কাকটা সেই কর্কশ কণ্ঠেই আবার কথা বলে উঠল। এটা কি হুগিন, না মুনিন? ভাবল শ্যাডো।
‘কাই-রো?’ প্রশ্ন করল ও।
‘মিশরে।’
‘এখন আমাকে মিশরে যেতে হবে?’
‘মিসিসিপি ধরে এগোও। দক্ষিণে যাও। শিয়ালকে খুঁজে বের করো।’
‘দেখ,’ বলল শ্যাডো। ‘আমার মনে হচ্ছে…হে যিশু, ওটা…’ বলতে বলতেই থেমে গেল ও। কী করছে? জঙ্গলের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে একটা দাঁড়কাকের সাথে? ‘ঠিক আছে। কেবল বলতে চাচ্ছি, আর কোনো রহস্য চাই না আমার।’
‘রহস্য,’ ওর সাথে একমত হলো যেন পাখিটা।
‘আমি ব্যাখ্যা চাই। কাই-রোতে শিয়ালকে খুঁজব-মানে কী এর? এতে তো আমার উপকার হচ্ছে না। মনে হচ্ছে কোনো স্পাই-থ্রিলারের লাইন শুনছি!’
‘শিয়াল। বন্ধু। টোক। কাই-রো।’
‘আগের বারই শুনেছি, কিন্তু আমার আরও তথ্য চাই।’
উত্তর না দিয়ে আরেক টুকরা কাঁচা মাংস ছিঁড়ল পাখিটা। এরপর উড়ে গিয়ে বসল গাছের মাথায়, ঠোঁট থেকে মাংসের টুকরাটা ঝুলছে।
‘হেই! অন্তত সত্যিকারের একটা রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছে দাও!’
উড়াল দিল দাঁড়কাক। হরিণের বাচ্চাটার দিকে তাকাল শ্যাডো। সত্যিকারের শিকারি হলে এতক্ষণে ওটার রসালো একটা টুকরা কেটে নিয়ে ঝলসাতে শুরু করত। কিন্তু উপলব্ধি করতে পারল, সত্যিকারের শিকারি সে নয়। এখন একটা গাছের গুঁড়িতে বসে চকলেটের বার খেতে মন চাইছে ওর।
কিছুদূর গিয়েই থেমে গেছে দাঁড়কাকটা, শব্দ করে ডেকে উঠল।
‘আমাকে অনুসরণ করতে বলছ?’ জানতে চাইল শ্যাডো। উত্তরে আরেকবার কর্কশ কণ্ঠে ডেকে উঠল দাঁড়কাকটা। উঠে দাঁড়াল ও, পাখিটার কাছে পৌঁছাতেই আবার উড়াল দিল ওটা। শ্যাডো যেদিকে এগোচ্ছিল, ওটার কিছুটা বাঁয়ে গিয়ে একটা ডালের উপর বসে পড়ল।
‘ওই,’ বলল শ্যাডো। ‘হুগিন না মুনিন, তুমি যেটাই হও না কেন…’
ঘুরে তাকাল পাখিটা, মাথা আবার একদিকে কাত করে আছে।
‘বলো-নেভারমোর।’ বলল শ্যাডো।
‘চুলোয় যাও।’ উত্তর পেল কেবল। বাকি সময়টা চুপচাপ এগোল ওর দুজন।
.
আধ ঘণ্টার মাঝে একটা শহরের প্রান্তে এসে উপস্থিত হলো ওরা। শ্যাডোকে একা রেখে আবার জঙ্গলে চলে গেল দাঁড়কাক। শহরে কালভারের ফ্রোজেন কাস্টার্ড- বাটার-বার্গারের সাইন দেখতে পেল শ্যাডো, তার পাশেই একটা গ্যাস স্টেশন। প্রথমে কালভারের দোকানে গেল, খালি ওটা। কেবল মাথা কামানো এক যুবক বসে আছে রেজিস্টারে। দুটো বার্গার আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের অর্ডার দিল ও। এরপর রেস্টরুমে গেল একটু পরিষ্কার হয়ে নিতে। একেবারে বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে ওকে। পকেটে কী কী আছে, দেখে নিলো এই সুযোগে-কয়েকটা পয়সা যার মধ্যের রয়েছে রুপালি ডলারটাও, টুথপেস্ট আর টুথব্রাশ, তিনটা ক্যান্ডিবার, পাঁচটা কেমিক্যাল প্যাড, একটা ওয়ালেট (ভেতরে ওর ড্রাইভিং লাইসেন্স আর একটা ক্রেডিট কার্ড আছে কেবল), আর কোটের ভেতরের পকেটে পঞ্চাশ আর বিশ ডলারের নোট মিলিয়ে এক হাজার ডলার। হাত-মুখ গরম পানিতে ধুয়ে নিলো ও, চুল হাত দিয়ে আঁচড়ে ফিরে গেল রেস্তোরাঁয়। বার্গার, ফ্রাই আর কফি ওর জন্য প্রস্তুত!
খাওয়া শেষ করে রেজিস্টারের কাছে গেল ও। ‘ফ্রোজেন কাস্টার্ড খাবেন?’ জানতে চাইল পেছনে বসা যুবকটা।
‘না, ধন্যবাদ। আমি আসলে জানতে চাচ্ছিলাম যে, এখানে গাড়ি ভাড়া নেবার ব্যবস্থা আছে? আমার গাড়িটা পথেই নষ্ট হয়ে গেছে।’
মাথার খোঁচা খোঁচা চুল চুলকালো যুবক। ‘শহরে নেই, মিস্টার। চাইলে আপনি নষ্ট গাড়িটার জন্য ট্রিপল এ-কে ফোন করতে পারেন। গ্যাস স্টেশনে গিয়েও দেখতে পারেন।’
‘খারাপ না বুদ্ধিটা, ধন্যবাদ।’
গলতে থাকা তুষারের উপর দিকে রাস্তা পার হলো শ্যাডো। গ্যাস স্টেশন থেকে আরও কয়েকটা ক্যান্ডি বার আর কেমিক্যাল প্যাড কিনে জানতে চাইল, ‘গাড়ি ভাড়া নিতে চাই। কার সাথে কথা বলা যায়?’
এখানকার ক্যাশ রেজিস্টারের পেছনে বসে আছে মোটা-সোটা, চশমা পরা এক মহিলা। কথা বলার সুযোগ পেয়ে খুব খুশি মনে হলো তাকে। ‘একটু ভাবতে দাও,’ বলল সে। ‘আমরা তো একটু প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকি। ম্যাডিসনের আগে গাড়ি ভাড়া দেয়, এমন কাউকে পাবে না। কোথায় যাচ্ছ?’
‘কাই-রো। অবশ্য জায়গাটা যে কোথায়, তাই জানি না!’
‘আমি জানি,’ বলল মহিলা। ‘এক কাজ করো, ওই ওখান থেকে একটা ইলিনয়ের ম্যাপ এনে দাও তো।’ নিৰ্দেশ পালিত হলে ম্যাপটা খুলে একটা জায়গা দেখাল মহিলা, বিজয়ীর সুরে বলল, ‘এই তো।’
‘কায়রো?’
‘মিশরের ওই শহরটার নাম ওভাবেই উচ্চারণ করা হয়। তবে এর নাম স্থানীয়রা বলে-কাইরো। ওখানে একটা থেবসও আছে। আমার ভাবির জন্ম থেবসে। আমি জানতে চেয়েছিলাম, মিশরের থেবসে নাকি? আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়েছিল যেন পাগল হয়ে গেছি!’ মৃদু হাসল মহিলা।
‘পিরামিড-টিরামিড নেই?’ শহরটা এখান থেকে প্রায় পাঁচশ মাইল দক্ষিণে। ‘আমার জানামতে নেই। লোকে জায়গাটাকে লিটল ইজিপ্ট নামেও ডাকে। কারণ প্রায় দেড়শ বছর আগে, এই এলাকায় আচমকা দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ফসল সব খেতেই নষ্ট হয়ে গেছিল। কিন্তু ওখানকার ফসলের কিচ্ছু হয়নি। তাই সবাই খাবারের জন্য যেত লিটল ইজিপ্টে, ঠিক বাইবেলে বর্ণিত প্রাচীন মিশরের মতো।’
‘ওখানে যাব কীভাবে?’ জানতে চাইল শ্যাডো।
‘গাড়ি চালিয়ে।’
‘আমার গাড়ি এখানে আসার পথে নষ্ট হয়ে গেছে, কয়েক মাইল আগেই। মাফ করবেন, কিন্তু জিনিসটা একেবারে রদ্দিমাল ছিল।’
‘রদ্দিমাল,’ হেসে ফেলল মহিলা। ‘আমার দেবরও এ নামেই ডাকে ওর গাড়িগুলোকে। পুরনো গাড়ি কেনা-বেচা করে সে। মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে বলে, আরেকটা রদ্দিমাল গছিয়ে দিয়েছি, ম্যাটি। সে হয়তো তোমার গাড়ির প্রতি আগ্রহী হবে।’
‘গাড়িটা আসলে আমার বসের,’ এত সহজে মিথ্যা বলছে দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেল শ্যাডো। ‘আমি তাকে ফোন করে জানিয়ে দেব, তিনি এসে নিয়ে যাবেন।’ আচমকা একটা চিন্তা এলো মাথায়। ‘আপনার দেবর আশপাশেই থাকে নাকি?’
‘নাহ, মাসকোডা। দক্ষিণে, দশ মিনিটের পথ। নদীর ওধারেই। কেন?’
‘পাঁচ-ছয়শ ডলারের মাঝে তার একটা রদ্দিমাল কেনা যাবে না?’
মিষ্টি করে হাসল মহিলা। ‘জনাব, পাঁচশ ডলার দিলে ট্যাঙ্কি ভরতি তেলসহ গাড়ি বিক্রি করে দেবে ও। তবে বোলো না যে আমি এটা বলে দিয়েছি।’
‘একটু কষ্ট করে ফোন করবেন?’ জানতে চাইল শ্যাডো।
হাতের ফোনটা দেখাল মহিলা। ‘এরইমাঝে করে ফেলেছি। হ্যালো? আমি ম্যাটি। এখুনি এখানে চলে এসো। তোমার জন্য খদ্দের ধরেছি।’
.
শ্যাডোর কেনা রদ্দি মালটা ১৯৮৩ মডেলে শেভি নোভা, তেলসহ মাত্র সাড়ে চারশ ডলার লাগল। এই পর্যন্ত ওটা চলেছে প্রায় পৌনে এক মিলিয়ন মাইল। ভেতর থেকে বুর্বো, তামাক আর কলার গন্ধ ভেসে আসছে। ওটার আদি রং যে কী ছিল, তা আঁচ পর্যন্ত করতে পারছে না শ্যাডো, তুষার আর কাদার নিচে চাপা পড়ে গেছে। তবে এটা ছাড়া ম্যাটির দেবরের আর কোনো গাড়ি পাঁচশ মাইল চলতে পারবে বলে ওর মনে হয়নি। নগদ টাকায় দাম চুকিয়ে দিয়েছে ও,
ম্যাটির দেবরও তার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি। টাকা পেয়েই সে খুশি।
প্রথমে পশ্চিম দিকে এগোল শ্যাডো গাড়ি নিয়ে, এরপর উত্তরের পথ ধরল। পকেটে এখনও সাড়ে পাঁচশ ডলার আছে। সাবধানতার সাথে হাইওয়ে এড়িয়ে চলছে ও। রদ্দিমালটায় রেডিয়ো আছে বটে, কিন্তু চালু হচ্ছে না। কিছুক্ষণের মাঝেই একটা সাইন দেখতে পেল সে, বুঝতে পারল যে উইসকনসিন পার হয়ে ইলিনয়ে প্রবেশ করেছে।
মম’স নামের একটা দোকানের সামনে থামল ও, বন্ধ হয়ে যাব-যাব করছিল দোকানটা।
পথে যতগুলো শহর পড়ল, সবগুলোর নামের সাইনবোর্ডের পাশে আরেকটা সাইনবোর্ড দেখতে পেল ও। গর্বের সাথে ওগুলো জানাচ্ছে, শ্যাডো প্রবেশ করছে ‘অমুক’ শহরে (জনসংখ্যা-’তমুক’)। আর অতিরিক্ত বোর্ডটা জানাচ্ছে, এই শহরের অনূর্ধ্ব-১৮ দলটা ইন্টারস্টেট বাস্কেটবল চ্যাম্পিয়ানশিপে রানার-আপ হয়েছিল। কোনো কোনোটা জানাচ্ছে, শহরটায় বাস করে ইলিনয় অনূর্ধ্ব-১৬ মহিলা রেসলিং সেমিফাইনালিস্টরা।
এগিয়ে চলল শ্যাডো, ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে, প্রতিটা মুহূর্ত যেন প্ৰাণশক্তি শুষে নিচ্ছে। লালবাতি উপেক্ষা করল একবার, আরেকবার তো আরেকটু হলেই একটা ডজের সাথে লাগিয়ে দিচ্ছিল! গ্রাম্য রাস্তায় ওঠা মাত্র একটা ফাঁকা পার্শ্ব রাস্তায় ঢুকল শ্যাডো। গাড়িটা পার্ক করে বন্ধ করে দিল ইঞ্জিন। এরপর পেছনের সিটে গা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
.
অন্ধকার গ্রাস করে নিলো ওকে; মনে হলো যেন পড়ে যাচ্ছে ও-ঠিক অ্যালিসের[৯] মতোই। শত শত বছর ধরে পড়ছে তো পড়ছেই, দুপাশে একের পর এক দেখা দিচ্ছে অগণিত চেহারা, কিছু চেনা আবার কিছু অচেনা…
[৯. অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে এখানে। ]
আচমকা, ঝটকা দিয়ে বন্ধ হয়ে গেল ওর পতন। এখন একটা গুহায় আছে সে, তবে একাকী নেই। পরিচিত একজোড়া চোখের দিকে তাকিয়ে আছে শ্যাডো-বড়ো বড়ো, তরল একজোড়া চোখ।
জায়গাটাকেও চেনা চেনা লাগছে ওর, পরিচিত মনে হচ্ছে ভেজা গোরুর গন্ধ। গুহার দেয়ালে জ্বলছে মশাল, মহিষের মাথা আর মানুষের দেহটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে।
আমাকে মুক্তি দেওয়া যায় না?’ জানতে চাইল শ্যাডো। ‘শান্তি মতো ঘুমাতে দাও একটু।
মাথা দোলাল মহিষ-মানব। ঠোঁট নড়ছে না, তখনও শ্যাডো মাথার ভেতরে তার কণ্ঠ শুনতে পেল। ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ, শ্যাডো?’
‘কায়রো।
‘কেন?’
‘যাওয়ার মতো আর কোন জায়গাটা আছে আমার? ওয়েনসডে আমাকে ওখানে যেতে বলেছেন, ওনার মিড পান করেছি।’ স্বপ্নের মাঝে যুক্তিটা অকাট্য বলে মনে হলো শ্যাডোর। তিন বার ওয়েনসডের মিড পান করেছে ও, আর তাই চুক্তি ভঙ্গের প্রশ্নই ওঠে না।
আগুনের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিল মহিষ-মানব, নাড়া খেয়ে আরও জোরে জ্বলে উঠল আগুন। ‘ঝড় আসছে।’ বলল সে, হাত বের করে এনে ছাইটা মুছল লোমহীন বুকে।
‘তোমরা সেই কবে থেকেই তো কথাটা আমাকে বলে আসছ। আমি কি একটা প্রশ্ন করতে পারি?’
কিছুক্ষণ চুপ করে রইল মহিষ-মানব, একটা মাছি এসে বসল তার কপালে। ‘করো।’
‘এসব কি সত্যি সত্যি ঘটছে? তোমরা কি আসলেই দেবতা? সব কিছু…’ এক মুহূর্ত চুপ করে আবার যোগ করল শ্যাডো, …অসম্ভব ঠেকছে।’
দেবতা আসলে কী?’ প্রশ্ন করল মহিষ-মানব
‘আমি জানি না।’
টোকা দেবার শব্দ শুনতে পাচ্ছে শ্যাডো। একটানা…একঘেয়ে। ওদিকে পাত্তা না দিয়ে পূর্ণ মনোযোগ মহিষ-মানবের দিকে ঢেলে দিল শ্যাডো। দেবতারা কী, জানতে চায়। জানতে চায় এই অদ্ভুত কয়েকটা দিনের ব্যাপারে।
ট্যাপ, ট্যাপ, ট্যাপ।
.
চোখ খুলে তাকাল শ্যাডো, চোখ ঘষতে ঘষতে উঠে বসল। ঠান্ডায় হাড় পর্যন্ত জমে যেতে চাইছে। গাড়ির বাইরের দুনিয়া ধারণ করেছে অদ্ভুত এক বেগুনি বৰ্ণ। গোধূলি বেলার এই আলো সন্ধ্যা আর রাতের মাঝে পার্থক্য করে দেয়।
ট্যাপ, ট্যাপ। ‘হেই, মিস্টার।’ কেউ একজন ডাকল ওকে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল শ্যাডো। গাড়ির পাশে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে, অন্ধকারে ঠিক দেখা যাচ্ছে না চেহারাটা। শ্যাডো হাত বাড়িয়ে কয়েক ইঞ্চি নামিয়ে দিল জানালার কাচ। আড়মোড়া ভেঙে বলল, ‘হাই।’
‘ঠিক আছ তুমি? অসুস্থ না তো? নাকি মাতাল?’ তীক্ষ্ণ কণ্ঠ শুনতে পেল ও – হয় কোনো মহিলার, আর নয়তো বাচ্চা ছেলের।
‘আমি ঠিক আছি,’ বলল শ্যাডো। ‘দাঁড়াও,’ বলে গাড়ির দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো। হাত-পা-ঘাড় ব্যথায় আড়ষ্ট হয়ে আছে।
‘উরে বাপস, তুমি দেখি বিশালাকার!
‘সবাই তাই বলে,’ বলল শ্যাডো। ‘তুমি কে?’
‘আমি স্যাম।’ কণ্ঠটা উত্তর দিল।
‘ছেলে-স্যাম? নাকি মেয়ে-স্যাম?’
‘মেয়ে-স্যাম। আগে স্যামি ছিল নাম, এখন শুধু স্যাম।’
‘শোনো তাহলে, মেয়ে-স্যাম। ওদিকে গিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকো।’
‘কেন? তুমি পাগল খুনি নাকি?’
‘না,’ বলল শ্যাডো। ‘প্রস্রাব করতে হবে, একটু প্রাইভেসি তো চাই নাকি?’
‘ওহ, ঠিক আছে। সমস্যা নেই। তুমি যা বলো। আমি তো পাশের স্টলে কেউ থাকলেও শুরু করতে পারি না!’
‘ঠিক আছে রে বাবা, এখন একটু ওদিকে যাও।’
গাড়ির ওপাশে চলে গেল মেয়েটা, রাস্তার পাশের খেতে নেমে গেল শ্যাডো। জিপার খুলে অনেকক্ষণ ধরে প্রস্রাব করল। এরপর আবার ফিরে এলো গাড়ির কাছে, রাত নেমে এসেছে ততক্ষণে।
‘আছ এখনও?’ জানতে চাইল সে।
‘হ্যাঁ,’ বলল মেয়েটা। ‘তোমারটা ব্লাডার না নদী? তুমি যতক্ষণ পেশাব করেছ, ততক্ষণে মনে হয় একটা সাম্রাজ্য শুরু হয়ে আবার ধ্বংসও হয়ে গেছে।’
‘ধন্যবাদ। কিছু চাই তোমার?’
‘হুম, দেখতে চেয়েছিলাম তুমি ঠিক আছ কি না। মানে মারা-টারা গেলে তো আবার পুলিস ডাকতে হতো।’
‘এখানেই থাকো?’
‘নাহ। ম্যাডিসন থেকে হাঁটা ধরেছি।’
কাজটা কিন্তু নিরাপদ না।’
‘প্রতিবছর পাঁচবার করে এই কাজ করি, এবার তৃতীয় বছর হবে। এখনও বেঁচে আছি তো! তুমি কোথায় যাচ্ছ?’
‘কায়রো।’
‘ওহ, আমি এল পাসোতে যাবো। আমার খালার সাথে ছুটির দিনগুলোতে থাকব।’
‘আমি তো তোমাকে অত দূর নিতে পারব না।’
‘আরে, টেক্সাসের এল পাসোতে নিয়ে যেতে হবে না। ইলিনয়েও আছে একটা। কয়েক ঘণ্টার পথ, দক্ষিণ দিকে। এখন কোথায় আছো, জানো?’
‘না,’ বলল শ্যাডো। ‘কোনো ধারণাই নেই। হাইওয়ে ৫২-এর কোথাও?’
‘এর পরের শহর হচ্ছে পেরু।’ বলল স্যাম। ‘ইলিনয়েও আছে একটা। এক কাজ করো, হাঁটু গেঁড়ে বসো, আমি শুঁকব।
অবাক হলেও, কথা মতো কাজ করল শ্যাডো। ওর মুখের কাছে নাক এনে শুঁকল স্যাম। ‘হুম, মদের গন্ধ নেই। তুমি গাড়ি চালাতে পারো। চলো, যাই।’
‘তোমাকে সাথে নিবো…সেটা কে বলল?’
কারণ আমি বিপদে পড়া এক রাজকুমারী, আর তুমি আমার নাইট। পার্থক্য খালি এই যে ঘোড়ার বদলে তুমি এসেছে নোংরা গাড়িতে করে। জানো, পেছনের জানালায় কে যেন ‘আমাকে পরিষ্কার করো’ লিখে গেছে!’
গাড়িতে বসে দরজা খুলে দিল শ্যাডো। সাধারণত সামনের দরজা খুললে ভেতরের বাতি জ্বলে ওঠে সব গাড়িতে, এটায় জ্বলল না।
‘না,’ বলল ও। ‘জানতাম না।’
উঠে বসল মেয়েটা। আমিই লিখেছি! হালকা আলো থাকতে থাকতেই।’ ইঞ্জিন চালু করল শ্যাডো, হেডলাইট জ্বালিয়ে উঠে পড়ল গাড়িতে। ‘বাঁয়ে যাও,’ সাহায্য করল স্যাম। মেয়েটার কথা মতো তাই করল ও, কয়েক মিনিটের মাঝে চালু হয়ে গেল গাড়ির হিটার; উষ্ণতায় ভরে উঠল ভেতরটা।
‘চুপ করে আছ কেন?’ বলল স্যাম। ‘কিছু একটা বলো!’
‘তুমি কি মানুষ?’ জানতে চাইল শ্যাডো। ‘নারী-পুরুষের মিলনের ফলে জন্ম নেওয়া মানুষ?
‘অবশ্যই।’
‘খুব ভালো। নিশ্চিত হয়ে নিলাম। আমার কাছ থেকে কী শুনতে চাও?’
‘আমাকে আশ্বস্ত করার মতো কিছু। কেন জানি মনে হচ্ছে, পাগল এক ড্রাইভারের গাড়িতে উঠে বসেছি।’
‘হুম,’ বলল শ্যাডো। ‘কী বললে স্বস্তি পাবে?
‘বলো যে তুমি জেল পালানো কয়েদি না, অথবা খুনি-ও নও।’
একটু ভাবল শ্যাডো। ‘আমি ও দুটোর কোনটাই নই।’
‘ভেবে বলতে হলো?’
‘কয়েদি ছিলাম, কিন্তু কাউকে খুন করিনি।’
‘ওহ।’
ছোটো একটা শহরে প্রবেশ করল ওদের গাড়ি, রাস্তার বাতি জ্বলছে। আবার ক্রিসমাসের আলোকসজ্জাও দেখা যাচ্ছে বাড়িতে বাড়িতে। ডান দিকে তাকাল শ্যাডো, মেয়েটার চুল ছোটো ছোটো করে কাটা। চেহারাটা আকর্ষণীয় …আবার কিছুটা পুরুষালীও। দেখতে পেল, মেয়েটাও ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
‘জেলে কেন গেছিলে?’
‘রাগের মাথায় কয়েকজনকে খুব খারাপভাবে আহত করেছিলাম।’
‘প্ৰাপ্য ছিল?’
একটু ভাবল শ্যাডো। তখন তো তাই মনে হয়েছিল।’
‘আরেকবার সেই একই পরিস্থিতিতে পড়লে মারবে?’
‘আরে না, জীবনের তিনটা বছর নষ্ট হয়েছে এ জন্য।’
‘হুম। তোমার দেহে ইন্ডিয়ান রক্ত আছে?’
‘জানামতে নেই।’
‘দেখে মনে হয় কিন্তু ‘
‘তোমাকে নিরাশ করার জন্য মাফ চাইছি।’
‘অসুবিধা নেই। ক্ষুধা পেয়েছে?’
মাথা দোলাল শ্যাডো। ‘খাওয়া যায়।’
‘সামনেই কয়েকটা দোকান আছে; খেতেও ভালো, দামেও সস্তা।’
পার্কিং লটে গাড়ি ঢোকাল শ্যাডো, একসাথে বেরিয়ে এলো দুজন গাড়ি থেকে। তালা দেবার প্রয়োজনবোধ করল না ও, তবে চাবিগুলো পকেটে ভরে নিলো খবরের কাগজ কেনার জন্য কিছু পয়সা বের করে জানতে চাইল, ‘এখানে খাওয়ার মতো টাকা আছে তোমার কাছে?’
‘আছে।’ থুতনি ওপরে তুলে বলল মেয়েটা।
আবার মাথা দোলাল শ্যাডো। ‘এক কাজ করা যাক-লটারি করি। হেডস উঠলে তুমি আমার খাবার খরচ দেবে, আর টেলস উঠলে আমি তোমার।’
‘আগে পয়সাটা দেখতে দাও,’ সন্দেহ নিয়ে বলল স্যাম। ‘আমার এক চাচা আছে। ওর কাছে থাকা পয়সাটার দুই দিকই হেডস!’
হাতে নিয়ে পয়সাটা পরখ করে দেখল মেয়েটা, যখন সন্তুষ্ট হলো যে দুই নম্বুরি নেই তখন ফিরিয়ে দিল শ্যাডোর হাতে। বৃদ্ধাঙ্গুলিতে পয়সাটা এমনভাবে স্থাপন করল যেন হেডস ওপরে থাকে। এরপর চুরি করল লটারিতে।
‘টেলস উঠেছে,’ আনন্দের সাথে বলল স্যাম। ‘আমার খাবার খরচ তুমি দেবে!’
‘হুম, কী আর করা! সবসময় তো আর জেতা যায় না।’
নিজের জন্য মিট লোফ নিলো শ্যাডো, স্যাম নিলো লাজানিয়া। খবরের কাগজে মনে দিল শ্যাডো, দেখল ট্রেনের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে কিছু লেখা আছে কি না…নেই। প্রথম পাতার আকর্ষণীয় খবর বলতে—শহরে কাকের উপদ্রব বেড়ে গেছে। স্থানীয় কৃষকরা শহরের দেয়ালে কাকের লাশ ঝোলাতে চায়। পাখি- বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে লাভ হবে না। জীবিত কাক খেয়ে ফেলবে লাশগুলোকে। কিন্তু স্থানীয়রা মানতেই চাচ্ছে না। ‘যখন স্বজাতির লাশ দেখবে কাকরা,’ স্থানীয় একজন বলল। ‘তখন বুঝতে পারবে যে ওদেরকে আমরা চাই না।
ধোঁয়া ওঠা খাবার চলে এলো সামনে, একজনের পক্ষে এত খাবার শেষ করা অসম্ভব।
‘কায়রোতে যাচ্ছ কেন?’ মুখ ভরতি খাবার নিয়ে জানতে চাইল স্যাম। ‘কোনো ধারণা নেই। বসের আদেশ, তাই যেতে হচ্ছে।’
‘কী করো তুমি?’
‘ফাই-ফরমাশ খাটি।’
হাসল স্যাম। ‘তুমি যে মাফিয়ার লোক না, তা ওই রদ্দিমাল দেখলেই বোঝা যায়। আচ্ছা, তোমার গাড়ির ভেতর থেকে কলার গন্ধ আসছে কেন?’
শ্রাগ করে খেতে শুরু করল শ্যাডো।
চোখ ছোটো ছোটো করে তাকাল স্যাম। ‘তুমি কলার চোরাচালানকারী হতে পারো! যাই হোক, আমি কি করি তা জানতে চাইলে না যে?’
‘স্কুলে পড় নিশ্চয়?’
‘হ্যাঁ। ইউডব্লিউ ম্যাডিসনে।’
‘নিশ্চয়ই আর্ট হিস্টরি, উম্যান’স স্টাডি আর তামার কাজ নিয়ে লেখাপড়া করো? ফাঁকা সময়ে কাজ করো কোন কফি হাউজে?’
চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল মেয়েটার, চামচ নামিয়ে রেখে বলল, ‘তুমি জানো কী করে?’
‘কী? আরে তোমার এখন বলা উচিত: আমি রোমান ভাষা আর পাখি-বিদ্যা নিয়ে পড়াসোনা করি!’
‘মানে কী? আন্দাজে বলেছ?’
‘আমি আবার কী বললাম!’
শ্যাডোর চোখে চোখ রাখল মেয়েটা। ‘তুমি একটা অদ্ভুত লোক, মিস্টার…এই, আমি তোমার নাম জানি না এখনও!’
‘শ্যাডো।
চেহারা বাঁকাল মেয়েটা, যেন মুখে এমনকিছু ঢুকিয়েছে যেটার স্বাদ ভালো লাগছে না। কিন্তু কিছু না বলে মাথা নিচু করে শেষ করল খাবার।
‘জায়গাটার নাম মিশর কেন, জানো?’ স্যামকে জিজ্ঞেস করল শ্যাডো।
‘জানি। শহরটা ওহাইয়ো আর মিসিসিপির মোহনায় বলে। প্রাচীন মিশরও তাই ছিল, নীলের মোহনায়।’
‘বুঝলাম।’
খাবার শেষ, তাই চেয়ারে হেলান দিয়ে কফি আর চকলেট ক্রিম পাইয়ের অর্ডার দিল স্যাম। ‘বিয়ে করেছ, মিস্টার শ্যাডো?’ ওকে ইতস্তত করতে দেখে বলল, ‘বাজে একটা প্রশ্ন করে বসেছি, তাই না?’
‘বৃহস্পতিবার ওকে কবর দিয়েছি,’ শব্দ বেছে বেছে উচ্চারণ করল শ্যাডো। ‘গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেছে।’
‘হায় ঈশ্বর। আমি দুঃখিত।’
‘আমিও।’
অদ্ভুত একটা বিরতির পর মেয়েটা বলল, ‘আমার সৎ বোনের ছেলে খোয়া গেছে গত বছর।’
‘তাই? কীভাবে?’
কফির কাপে চুমুক দিল মেয়েটা। ‘আমরা জানি না। আসলে আমরা জানি-ও না, ও আসলেই মারা গেছে কি না! বলতে পারো, হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে সে। বয়স ছিল মাত্র তেরো। গত বছর শীতের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আমার বোন ভেঙে পড়েছিল।’
‘সূত্র-টুত্র পাওয়া যায়নি?’ নাটকের পুলিস বলে মনে হলো ওর নিজেকে। ‘কোন অপরাধের শিকার হয়নি তো?’
‘পুলিসের সন্দেহ পড়েছিল আমার দুলাভাইয়ের উপর। ওর বাপ লোকটা ভালো না, তালাকের সময় বাচ্চার দেখভাল করার দায়িত্ব পেয়েছিল আমার বোন। ওই হারামজাদা আমার ভাগনেকে অপহরণ করতে পারে, হয়তো করেওছে! ঝামেলা হলো, আমাদের এই শহরটা একদম ছোটো, এখানে কেউ দরজা পর্যন্ত লাগায় না!’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে কফির কাপটাকে হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরল ও। ‘তুমি নিশ্চিত, ওই দেহে ইন্ডিয়ান রক্ত নেই?’
‘থাকতেও পারে, তবে আমার জানা মতে নেই। বাবার ব্যাপারে আমি বেশি কিছু জানি না। মা বলেননি। তবে সে নেটিভ আমেরিকান হলে অবশ্যই বলতেন।’
আবার চেহারা বাঁকাল মেয়েটা। চকলেট ক্রিম পাই পুরোপুরি শেষ হবার আগেই থামল স্যাম, থালাটাকে এগিয়ে দিল শ্যাডোর দিকে। ‘খাবে?’ উত্তরে হাসল শ্যাডো। ‘অবশ্যই,’ খানিকক্ষণের ভেতরেই শেষ করে ফেলল থালাটা।
বিল নিয়ে এলো ওয়েট্রেস, টাকা দিয়ে দিল শ্যাডো।
‘ধন্যবাদ।’ কৃতজ্ঞতা জানাল স্যাম।
ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। চালু হবার আগে কয়েকবার খুক খুক করে কেশে উঠল গাড়িটা। দক্ষিণ দিয়ে চলতে শুরু করল ওরা। ‘হেরোডোটাস নামের কোনো লোকের বই পড়েছ?’
‘হায় যিশু, কী বললে নামটা?’
‘হেরোডোটাস। কোন বই পড়েছ?’
‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তোমাকে,’ স্বপ্নালু কণ্ঠে বলল মেয়েটা। ‘এই তোমাকে মনে হয় নির্বোধ, আবার পরমুহূর্তেই আমার মন পড়তে শুরু করে দাও! আবার ইচ্ছা হলেই শুরু করে দাও হেরোডোটাসকে নিয়ে গল্প। যাই হোক, আমি লোকটার বই পড়িনি। তবে শুনেছি। রেডিয়োতেই তো মনে হয়। ভালো কথা, লোকটাকে মিথ্যার জনক বলে না?’
‘আমি তো জানতাম, সেই উপাধি শয়তানের!
‘ওকেও বলে। তবে রেডিয়োতে শুনেছিলাম, হেরোডোটাস সব উলটাপালটা ইতিহাস বর্ণনা করে গেছে।’
‘আমার তা মনে হয় না। লোকটা তা-ই লিখেছে, যা সে শুনেছে। অদ্ভুত অনেক কথা লিখেছে সে। যেমন মিশরে যখন কোনো সম্ভ্রান্ত লোকের স্ত্রী মারা যায়, তখন মমিকারকদের দেবার আগে তিনদিন অপেক্ষা করা হয়। আগে দেহটা পচে যায়, তারপর…’
‘কেন? ওহ, দাঁড়াও…দাঁড়াও। বুঝতে পেরেছি। ছিহ… ঘেন্না!’
‘তার লেখা ইতিহাসে অনেক যুদ্ধের কথাও আছে। আছে দেবতাদের কথাও। মাঝে মাঝেই দেখা যায়, কোনো সৈনিক যুদ্ধের ফলাফল জানাবার জন্য দৌড়ে রাজসভার দিকে আসছে। পথে আচমকা প্যানের সাথে দেখা হয়ে গেল। প্যান বলল, এখানে আমার জন্য মন্দির বানাতে বলবে। সৈন্যটা রাজাকে যুদ্ধের খবর জানিয়ে যোগ করে, ‘ওহ, ভালো কথা। প্যান চায়, তার জন্য একটা মন্দির বানানো হোক।’ পুরো ব্যাপারটা যেন একদম ডাল-ভাত!’
‘তারমানে দেবতাদের নিয়ে অনেক গল্পও লিখেছে লোকটা? মানে কী? সবটাই তার ভ্রম?
‘নাহ,’ বলল শ্যাডো। ‘তা না।’
‘মগজের ওপর লেখা কয়েকটা বই পড়েছিলাম,’ বলল মেয়েটা। ‘আমার রুমমেটের ছিল। ওতে লেখা: পাঁচ হাজার বছর আগে মানুষের মস্তিষ্কের দুই খণ্ড জোড়া লাগে। তার আগে সবার ধারণা ছিল, ডান দিকের মস্তিষ্ক থেকে যে আওয়াজ আসে তা আসলে ঈশ্বরের আদেশ। সবটাই আসলে মগজের খেল।’
‘আমার তত্ত্বটা বেশি ভালো।’ বলল শ্যাডো
‘কোন তত্ত্ব?’
‘মানুষ আসলে অতীতে মাঝে মাঝেই দেবতাদের সামনে পড়ত।’
‘ওহ।’ আবার নেমে এলো নীরবতা। আওয়াজ বলতে কেবল মাফলারের গর্জন, খুব একটা সুস্থ মনে হচ্ছে না যন্ত্রাংশটাকে। ‘কী মনে হয়, দেবতারা কি এখনও আছে ওখানে?’
‘কোথায়?’
‘গ্রিসে, মিশরে, যেসব জায়গায় দেবতাদের বাস…সেখানে? যদি এখন ওখানে যাই, তাহলে দেবতাদের দেখা পাবো?’
‘হয়তো। কিন্তু মনে হয় না দেবতাকে দেখলেও চিনতে পারবে।’
‘আমার ধারণা,’ বলল মেয়েটা। ‘এখন যেমন মানুষ এলিয়েনদের দেখে, তখন দেখত দেবতাদের। হয়তো এলিয়েনদের জন্ম মানুষের মস্তিষ্কের ডান দিকে।’
‘দেবতারা কখনও কারও পশ্চাদদেশে কিছু ঢুকিয়েছে বলে তো জানা নেই, ‘ বলল শ্যাডো। ‘আর নিজের হাতে গোরু-বাছুরও খুন করেনি। উপাসক ছিল কাজটা করার জন্য।
হেসে ফেলল স্যাম। চুপচাপ কেটে গেল আরও কিছুক্ষণ। তারপর আচমকা সে বলল, ‘তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের একটা গল্প মনে পড়ে গেল। শুনবে?’
‘অবশ্যই।’ বলল শ্যাডো।
‘গল্পটা ওডিন, নর্স দেবতাকে নিয়ে। অনেকদিন আগের কথা। তখন ভাইকিং জাহাজে চড়ে সফর করছিল ভাইকিং এক রাজা। বাতাস বওয়া বন্ধ হয়ে গেছিল। তাই রাজা প্রার্থনা জানালেন, ওডিন যদি বাতাস পাঠান তো নাবিকদের একজনকে উৎসর্গ করবেন। বুঝেছ? যাই হোক, তাদের প্রার্থনা শুনলেন সর্ব-পিতা। বাতাসের উপর ভর করে তীরে পৌঁছাল জাহাজ। মাটিতে পা রেখে লটারি হলো, কী কপাল-রাজা সাহেব হারলেন লটারিতে! ওডিনের উদ্দেশ্যে তাই বলি হতে হবে তাকে। বুঝতেই পারছ, লোকটা এতে খুব একটা খুশি হলো না। নাবিকরা আলোচনা করে ঠিক করল, বলি দেওয়া হবে তাকে। তবে রাজার যেন কোনো ক্ষতি না হয়, সেদিকেও লক্ষ রাখবে। একটা বাছুর মেরে ওটার নাড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে দিল রাজার গলা, অন্য প্রান্তটা বাঁধল পাতলা একটা ডালের সঙ্গে। বর্শার জায়গায় অস্ত্র হিসেবে নিলো একটা নলখাগড়ার ডাল। এরপর মানুষটিকে ঝুলিয়ে দিয়ে পাশে খোঁচা মেরে বলল-আপনাকে সর্ব-পিতার উদ্দেশ্যে বলি দিলাম।’
কথা বলছে স্যাম, আর মন দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে শ্যাডো। সামনেই পড়ল একটা নতুন সাইনবোর্ড-তমুক শহর (জনসংখ্যা-৩০০)। স্টেট অনূর্ধ্ব-১২ স্পীড- স্কেটিং চ্যাম্পিয়নশিপের রানার-আপদের আবাস। রাস্তার দুপাশে দুটো ফিউনারেল পার্লার দেখতে পেল ও। তিনশ মানুষ থাকে, এমন শহরে দুই-দুইটা ফিউনারেল পার্লার কেন…?
‘যাই হোক, ওডিনের নাম নেওয়ার সাথে সাথে নলখাগড়া পরিণত হলো বর্শায়, বেচারা রাজার বাঁ দিকটা ফুটো করে দিল। আর বাছুরের নাড়ি পরিণত হলো পুরু দড়িতে, গাছের পাতলা ডালটা হয়ে গেল এই মোটা গুঁড়ির সমান। ক্ষত দিয়ে রক্ত ঝরতে ঝরতে, চেহারা কালো হয়ে মারা গেলেন রাজা। গল্প শেষ। সাদা লোকদের দেবতারা খুব অদ্ভুত হয়, মিস্টার শ্যাডো।’
‘হ্যাঁ,’ বলল শ্যাডো। ‘তুমি শ্বেতাঙ্গ নও?’
‘চেরোকি।
‘পুরোপুরি?’
‘নাহ। চার ভাগের এক ভাগ। আমার মা সাদা ছিলেন, বাপ ছিলেন রিজার্ভেশনবাসী ইন্ডিয়ান। রিজার্ভেশন ছেড়ে এদিকে এসেছিলেন, আমার মাকে বিয়ে করলেন। আমি জন্মালাম। তারপর আলাদা হয়ে গেলেন দুজনে, চলে গেলেন ওকলাহামায়।’
‘আর তোমার বাবা? রিজার্ভেশনে ফিরে গেলেন?’
‘নাহ। টাকা-পয়সা ধার করে টাকো বিল’স নামে একটা টাকো বেলের নকল দোকান চালু করলেন। ভালোই কামান, অবশ্য আমাকে পছন্দ করেন না। বলেন, আমি নাকি দোআঁশলা!’
‘কষ্ট পেলাম।’
‘ভালো মানুষ না খুব একটা। তবে আমি আমার ইন্ডিয়ান পরিচয় নিয়ে গর্বিত। আমার কলেজের খরচ অনেকটাই বেঁচে যায়। কে জানে, সামনে হয়তো চাকরিও মিলবে একটা, যদি তামার জিনিস-পত্র বেচতে না পারি আরকি।
‘তা তো পারাই উচিত,’ বলল শ্যাডো।
এল পাসো, ইলিনয় (জনসংখ্যা- ২৫০০)-সাইনবোর্ড দেখল শ্যাডো। শহরের প্রান্তের একটা বাড়ির সামনে নামিয়ে দিল স্যামকে। ‘ভেতরে আসবে?’ জানতে চাইল মেয়েটা। ‘কফি খাওয়াবে খালা।’
‘না,’ বলল যুবক। ‘চলার ওপর থাকা দরকার।’
হাসল মেয়েটা, এই প্রথমবারের মতো ভঙ্গুর মেয়েটা বেরিয়ে এলো স্যামের ভেতর থেকে। শ্যাডোর হাতে আলতো করে চাপড় দিয়ে বলল, ‘তোমার মাথা খারাপ, মিস্টার। তবে তুমি লোক ভালো।
‘মানুষ মাত্রই তাই,’ বলল শ্যাডো। ‘আমাকে সঙ্গ দেবার জন্য ধন্যবাদ।’
‘অসুবিধা নেই।’ বলল স্যাম। ‘ভালো কথা, কায়রোর রাস্তায় কোনো দেবতার দেখা পেলে আমার তরফ থেকে হাই বলে দিয়ো। গাড়ি থেকে নেমে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল ও। ঘণ্টা বাজিয়ে অপেক্ষা করল কিছুক্ষণ, একবারের জন্যও পিছু ফিরে তাকাল না। মেয়েটা ঘরের ভেতরে না প্রবেশ করা পর্যন্ত গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষা করল শ্যাডো। তারপর রওনা দিল হাইওয়ের দিকে। পথে পড়ল নরম্যাল, রুমিংটন আর লনডেল শহরগুলো।
.
সেদিন রাত এগারোটার দিকে, অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাঁপতে শুরু করল শ্যাডো মিডলটাউনে ঢুকেছে কেবল তখনও। সিদ্ধান্ত নিলো ও, এখন ঘুমানো দরকার; আর গাড়ি চালানো সম্ভব না। তাই একটা মোটেলের সামনে গাড়ি থামাল ও, পঁয়ত্রিশ ডলার দিয়ে নিচতলার একটা ঘর ভাড়া নিলো। ঘরে ঢুকে প্রথমেই চলে গেল বাথরুমে। টাইল করা মেঝেতে একটা তেলাপোকা মরে পড়ে আছে। বাথটাব পরিষ্কার করার জন্য একটা তোয়ালে হাতে তুলে নিলো শ্যাডো, কাজ শেষে পানি দিয়ে ভরতি করল টাবটা। গোসলে যাবার আগে শোবার ঘরে গিয়ে খুলে ফেলল পরনের জামা। দেহের এখানে সেখানে ক্ষতের দাগ কালো হতে শুরু করেছে। পানি ভরা শেষ হলে, বাথটাবে বসল শ্যাডো। কিছুক্ষণ আরাম করে নিয়ে বেসিনেই ধুয়ে ফেলল মোজা, টি-শার্ট আর জাঙ্গিয়া। ভালো মতো পানি ঝরিয়ে নিয়ে ওগুলো ঝুলিয়ে দিল একটা দড়িতে। তেলাপোকাটা সরালো না, মৃত্যুর প্রতি সম্মান দেখিয়ে রেখে দিল জায়গামতোই।
অবশেষে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল শ্যাডো। টিভি চালু করে দিয়ে তিন বার ‘স্লিপ’ বোতামটা চাপল, পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর আপনা-আপনিই বন্ধ হয়ে যাবে যন্ত্রটা। এখন রাত বারোটা বাজতে মিনিট পনেরো বাকি।
ছবি খুব একটা ভালো আসছে না, পর্দায় লাফালাফি করছে রঙ। টেলিভিশন প্রোগ্রামের জঙ্গলে যেন হারিয়ে গেল শ্যাডো। এক চ্যানেলে শেখাচ্ছে রান্নার পদ্ধতি তো আরেক চ্যানেল জানাচ্ছে-কেয়ামত সন্নিকটে। এখন যদি যিশুর আশীর্বাদ আর ব্যাবসায় সফলতা পেতে হয়, তাহলে অমুক যাজককে টাকা পাঠাতে হবে। চ্যানেল পরিবর্তন করল ও। ম্যা*শ-এর একটা পর্ব শেষ হয়ে ডিক ভ্যান ডাইক শো শুরু হলো!
অনেকদিন হলো সিরিজটার কোনো পর্ব দেখে না শ্যাডো। ১৯৬৫ সালের সাদা-কালো ছবিটা দেখে স্বস্তিতে ভরে গেল ওর মন। রিমোট নামিয়ে রেখে বিছানার পাশের বাতি নিভিয়ে দিল সে, দেখতে দেখতে হারিয়ে যেতে লাগল ঘুমের অতলে। তবে অবচেতন মন জানাচ্ছে, অদ্ভুত কিছু একটা হচ্ছে এখানে। ডিক ভ্যান ডাইক শো খুব একটা দেখেনি ও, কিন্তু এই পর্বটা একেবারেই অন্যরকম মনে হচ্ছে।
অভিনেতা-অভিনেত্রীরা রবের মাতলামি নিয়ে চিন্তিত। লোকটা ঠিকমতো কাজেই যাচ্ছে না! সবাই মিলে তাই ওর বাড়িতে গেল, এদিকে রব বেডরুমে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে রেখেছে! অনুরোধ-ওপরোধ করে বাইরে বের করে আনতে হলো তাকে। মাতালের মতো হেলছিল সে, কিন্তু কৌতুকটা ভোলেনি। কিছু ঠাট্টা করার পর বিদায় নিলো ওর বন্ধুরা। রবির বউ যখন ওকে বোঝাতে গেল, তখন মেয়েটাকে মেরে বসল সে! তাও আবার গায়ের জোর খাটিয়ে! মেঝেতে বসে কাঁদতে শুরু করল মেয়েটা। নাহ, মেরি টাইলার মুরের সেই বিখ্যাত চিলের মতো চিৎকার করা কান্না নয়। নিজেকে আঁকড়ে ধরে ফোঁপাতে শুরু করল সে। ‘আমাকে মেরো না, প্লিজ। তুমি যা চাও, তাই করব। কিন্তু আমাকে আর মেরো না!’
‘এসব কী?’ উচ্চ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল শ্যাডো, কার উদ্দেশ্যে…কে জানে? ঝিরঝির করতে শুরু করল টিভির পর্দা। যখন আবার ছবি ফিরে এলো, তখন কীভাবে যেন ভ্যান ডাইক শোর জায়গা করে নিয়েছে আই লাভ লুসি! শ্যাডো দেখল, রিকিকে ওদের আইসবক্স বদলে ফ্রিজ কেনার জন্য বাধ্য করতে চাইছে লুসি। রিকি বিদায় নিলে, কাউচে গিয়ে বসে পড়ল মেয়েটা। একহাত কোমরে রেখে চাইল সরাসরি শ্যাডোর চোখে।
‘শ্যাডো?’ বলল মেয়েটা। ‘আমাদের কথা বলা দরকার।’
হতবাক হয়ে গেল শ্যাডো। এদিকে মেয়েটা কিন্তু বসে নেই। পার্স খুলে সিগারেট বের করেছে একটা, তারপর দামি একটা রুপালি লাইটার দিয়ে ওটা ধরিয়ে আবার লাইটারটা রেখে দিয়েছে। ‘ভুল শোননি,’ বলল সে। ‘আমি তোমার সাথেই কথা বলছি।’
‘অদ্ভুত!’
‘তোমার বাকি জীবনটা বুঝি অদ্ভুত না?’
‘ওগুলো বাদ দাও। টিভির ভেতর থেকে খোদ লুসিল বল আমার সাথে কথা বলছে-এর সামনে ওসব কিছুই না।’
‘লুসিল বল না, লুসিল রিকার্ডো। আর শোনো, আমি লুসিল নই। দেখা দিতে সুবিধা হয়, তাই আমার এই রূপ।’ অস্বস্তিভরে সোফায় নড়ে উঠল মেয়েটা।
‘তাহলে তুমি কে?’ জানতে চাইল শ্যাডো।
‘ভালো প্রশ্ন। আমাকে এই নির্বোধ বাক্স বলতে পারো। আমি টিভি, আমি সেই চোখ যা সব দেখে। আমি টিউব…আমি সেই উপাসনালয়, যার সামনে এক হয় পুরো পরিবার।’
‘তুমি টেলিভিশন? নাকি টেলিভিশনের ভেতরের অস্তিত্ব?’
‘টিভি আসলে প্রার্থনার বেদি। আমিই সে, যাকে উদ্দেশ্য করে বলি দেয় মানুষ।’
‘কী বলি দেয়?’
‘অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের সময়,’ বলল লুসি। ‘কখনও কখনও সম্পর্কের বন্ধন।’ দুই আঙুল এক করে পিস্তলের মতো করে ধরল মেয়েটা, তারপর যেন ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিল ধোঁয়া। এরপর শ্যাডোকে অবাক করে দিয়ে চোখ টিপল, আই লাভ লুসি-এর নায়িকা এই ভঙ্গিতে চোখ টেপাকে বিখ্যাত করেছেন।
‘তুমি দেবতা?’ জানতে চাইল শ্যাডো।
তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল লুসির ঠোঁটে, আয়াসের সাথে রাজসিক ভঙ্গিতে টান দিল সিগারে। ‘তা বলতে পারো।’
‘স্যাম তোমাকে হাই বলেছে।’
‘কী? স্যাম কে? কী সব বলছ?’
ঘড়ির দিকে তাকাল শ্যাডো, বারোটা বেজে পঁচিশ। ‘গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলছি না। যাই হোক, টিভির-লুসি, কী নিয়ে কথা বলতে চাও? আজকাল দেখি অনেকেই আমার সাথে কথা বলতে আগ্রহী! অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার সমাপ্তি হয় আমাকে আঘাত করার মাধ্যমে।’
ক্যামেরা জুম করে লুসির চেহারা ফুটিয়ে তুলল পর্দায়, চিন্তিত বলে মনে হলো মেয়েটাকে। ‘আমার ব্যাপারটা পছন্দ হলো না। শ্যাডো, সোনামণি, আমার দ্বারা তোমার কখনও কোনো ক্ষতি হবে না। আমি তোমাকে একটা চাকরির প্রস্তাব দিতে চাই।’
‘কী করতে হবে আমাকে?’
‘আমার হয়ে কাজ করবে। কিম্ভূতদের সাথে তোমার যে ঝামেলা হয়েছে, তা আমি শুনেছি। তুমি যেভাবে ব্যাপারটা সামলেছ, সেটাও শুনেছি। দক্ষ হাতে সামলেছ সব। কে ভেবেছিল, বেচারা শ্যাডো এমন নৃশংস হতে পারে? ওরা তো দারুণ খেপে আছে!’
‘তাই?’
‘তোমাকে আসলে গোণায় ধরেনি ওরা। তবে আমি সেই ভুল করছি না। নিজের দলে তোমাকে আমার চাই,’ উঠে ক্যামেরার কাছে চলে এলো মেয়েটা। ‘শোন শ্যাডো, আমরাই ভবিষ্যত। আমরা যদি শপিং মল হই, তবে তোমার বন্ধুরা রাস্তার পাশের দর্শনীয় স্থান বই কিছু না। আমরা অন-লাইন দোকান, তোমার বন্ধুরা হাইওয়ে বসে জিনিসপত্র বিক্রি করা ছোটোলোক। আমরা ভবিষ্যৎ, তোমার বন্ধুরা অতীতের বিস্মৃতে হারিয়ে গেছে…’
খুব পরিচিত শোনাল কথাগুলো। শ্যাডো জিজ্ঞেস করল, ‘লিমোতে বসে থাকা কোনো মোটা বাচ্চাকে চেনো?’
দুই হাত দুই দিকে দিয়ে চোখ ওলটালো মেয়েটা, ঠিক যেমন করে লুসি ওলটায়। ‘টেকনিক্যাল বয়? তোমাদের দেখা হয়েছে? ছেলেটা কিন্তু আসলে ভালো, আমাদেরই একজন। আমার প্রস্তাব মেনে নাও, দেখবে কী দারুণ সে!’
‘আর যদি তোমার, আই-লাভ-লুসির সাথে কাজ না করি তো?’
লুসির অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় নক হলো একটা, রিকির আওয়াজ শুনতে পেল শ্যাডো। ছেলেটা জানতে চাইছে, লুসির এত দেরি হচ্ছে কেন? পরের সিনের শ্যুটিং এই শুরু হলো বলে! বিরক্তি খেলে গেল মেয়েটার সুন্দর চেহারায়। ‘ধুরো,’ বলল সে। ‘দেখো, ওই বুড়ো-হাবড়া তোমাকে যা দিচ্ছে, আমি তার দ্বিগুণ দেব। লাগলে তিনগুণ। কে জানে, সব শেষে শতগুণও দিতে পারি। তারচেয়ে বড়ো কথা, বুড়ো যাই দিক না কেন…’ দুষ্টামি, আবেদন, আমন্ত্রণ-সব একসাথে ঝরে পড়ল যেন মেয়েটার হাসিতে। ‘…আমি তারচেয়েও বেশি কিছু দেব।’ বলতে বলতেই ব্লাউজের বোতাম খুলতে শুরু করল মেয়েটা। ‘লুসির দুধ দেখতে চাও?’ কালো হয়ে গেল পর্দা, পঁয়তাল্লিশ মিনিট হয়ে গেছে! ঘড়ির দিকে তাকাল শ্যাডো। মাঝরাত হয়েছে তা-ও আধ-ঘণ্টা হলো। ‘খুব একটা আগ্রহ নেই।’
কাত হয়ে চোখ মুদল ও। ওয়েনসডে আর মি. ন্যান্সির মতো লোকদের কেন পছন্দ হয়, সেটা এখন পরিষ্কার বুঝতে পারছে। ওদের মাঝে লুকোছাপা কম। হ্যাঁ, টাকা-পয়সা খুব একটা নেই। খাবারের স্বাদও ভালো না, কিন্তু এত নাটক করে কথা বলে না।
বুঝতে পারলো, রাস্তার পাশের দোকান যতই কম দামি আর সস্তা হোক না কেন, ওর কাছে দামি শপিং মলের চাইতে বেশি আকর্ষণ রাখে।
.
পরদিন সকালে যখন রাস্তার উপর সুর্যের আলো পড়ল, তখন শ্যাডো অনেকদূর এগিয়ে গেছে। তুষারের নাম-গন্ধ নেই, দুপাশে শীতের ঘাস আর ন্যাড়া গাছ দেখা যাচ্ছে। রদ্দিমালটায় গ্যাস ভরার জন্য একটা ছোটো স্টেশনে থামল ও। ভয়ে ভয়ে গাড়িটাকে ধুয়েও নিলো। যন্ত্রটা ওপাশ থেকে যখন বের হলো, তখন অবাক হয়ে শ্যাডো দেখল—গাড়িটার রং আসলে সাদা! মরচেও পড়েনি খুব একটা। কিছুক্ষণের মাঝেই আবার পথে নামল ও।
আকাশটাকে এমন নীল দেখেনি অনেকদিন, তবে ফ্যাক্টরির চিমনি থেকে বেরিয়ে আসা সাদা ধোঁয়া কিছুটা হলেও কৃত্রিমতা এনে দিয়েছে দৃশ্যে। মৃত এক গাছের ডালে বসেছিল একটা বাজপাখি, ওর গাড়িটাকে দেখে উড়ে এসেছে। পুরো দৃশ্যটা যেন ফ্রেমে বেঁধে রাখার মতো।
অনেকক্ষণ আপনমনে গাড়ি চালাবার পর আচমকা আবিষ্কার করল, ও পূর্ব সেন্ট লুইসের দিকে যাচ্ছে। ইচ্ছে করেই অন্য দিকে গাড়ির নাক ঘোরাল, এবার নিজেকে আবিষ্কার করল একটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের রেড-লাইট এলাকায়। আঠারো হুইলের বিশাল বিশাল ট্রাক আর তারচেয়েও বড়ো বড়ো বাহন পার্ক করা আছে গুদামঘরের সামনে। না থেমে এগিয়ে চলল শ্যাডো। দুপুরের খাবারটা সেরে নিলো রেড বাড নামের একটা শহরে, স্যান্ডউইচ আর কোক দিয়ে।
পথে পড়ল শত শত হলুদ বুলডোজার, ট্রাক্টর আর ক্যাটারপিলারের ধ্বংসাবশেষ সম্বলিত উপত্যকা। মনে মনে জায়গাটার নাম দিল ও বুলডোজারের কারবালা, যেখানে যন্ত্রগুলো শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার জন্য আসে।
পথে পড়ল পপ-আ-টপ লাউঞ্জ, পড়ল চেস্টার (পপাইয়ের উৎপত্তি এখানে)। শ্যাডো লক্ষ করল, এখনকার বাড়িগুলোর সামনে থাম দেখা যাচ্ছে। এমনকি একেবারে জীর্ণ আর একেবারে ছোটো বাড়িটাও গর্ব ভরে নিজেকে প্রাসাদ বলে ঘোষণা করছে! শুকিয়ে যাওয়া একটা বড়ো, কাদাময় নদী পার হতে হলো ওকে। একটু এগিয়ে যখন নদীটার নাম লেখা সাইনবোর্ড দেখতে পেল, তখন না হেসে পারল না। ওটার নাম-বড়ো কাদাময় নদী!
মিসিসিপির ধার ধরে এগিয়ে চলল শ্যাডো, নীল নদ দেখেনি কখনও ও। কিন্তু বিকালের পড়ন্ত আলোয় কেন যেন নদীটার হলদে পানি দেখে ওর বারবার নীলের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। নাহ, এখনকার নীল নদ নয়। অনেকদিন আগের সেই নদটা, যখন ওটার অববাহিকা ভরা থাকত কোবরা, শিয়াল আর বুনো গোরুতে…
থেবসে যাবার দিক-নির্দেশনাঅল একটা সাইন নজরে পড়ল ওর।
রাস্তাটা মাটি থেকে প্রায় বারো ফুট ওপরে, তাই উপর থেকে জলাভূমি দেখার সৌভাগ্য হলো শ্যাডোর। সেই সাথে আকাশে উড়তে থাকা ঝাঁক ঝাঁক পাখিও, এবার ঝাঁক এগোচ্ছে তো আরেকবার পিছাচ্ছে। ব্রাউনিয় গতির প্রকৃষ্ট এক উদাহরণ যেন ওগুলো।
গোধূলি বেলায় আরও মরে এলো সূর্যের আলো, সারা দুনিয়াকে ভরে দিল যেন নরম-স্বাদু রঙে। আচমকা চারপাশের পৃথিবী শ্যাডোর চোখে ধরা দিল অলীক এক বস্তু রূপে। কখন যে ও কায়রোর অভ্যন্তরে চলে এসেছে, টেরই পায়নি। একটা ব্রিজ অতিক্রম করা মাত্র সে নিজেকে আবিষ্কার করল একটা ছোট্ট শহরে। প্রথমেই নজরে পড়ে কায়রো কোর্টহাউজ আর কায়রো কাস্টমস হাউজ। মরা আলোতে ওর মনে হলো, সোনালি রস দিয়ে মাখানো দুটো কুকি বিস্কুট যেন দালান দুটো।
একটা পার্শ্ব-রাস্তায় গাড়ি পার্ক করে শ্যাডো হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো বেড়িবাঁধে। ওহাইয়ো নদী দেখছে এখন, নাকি মিসিসিপি তা জানে না ও। ছোট্ট একটা বাদামি বিড়াল দৌড়াদৌড়ি করছে একটা দালানের পেছনে রাখা দুই ট্রাশ- ক্যানের মাঝে। বিকালের এই আলোয় আবর্জনাকেও কেমন যেন জাদুময় মনে হচ্ছে।
নদীর ধার ধরে উড়ে যাচ্ছে একাকী এক সিগাল, মাঝে-সাঝে ডানা ঝাপটে ভারসাম্য সামলে নিচ্ছে।
আচমকা শ্যাডো বুঝতে পারল, ও একা নেই। একটা ছোট্ট মেয়ে, পায়ে পুরাতন টেনিস শ্যু আর পরনে বুড়ো মানুষের পশমি সোয়েটার পরে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে। ওর থেকে মাত্র দশ মিটার দূর থেকে দেখছে ছয়-বছর-বয়সি চোখের গাম্ভীর্য দিয়ে। চুলগুলো কালো মেয়েটার, লম্বা আর সোজা; ত্বকের রং নদীটার মতোই বাদামি।
মেয়েটার দিকে তাকিয়ে হাসল শ্যাডো, কিন্তু মেয়েটা হাসল না। কেবল চোখে বিদ্রোহ নিয়ে তাকিয়ে রইল। এদিকে বাদামি বিড়ালটার অবস্থান থেকে ভেসে এলো দুটো প্রাণির চিৎকারের আওয়াজ। বেচারিকে ধাওয়া করছে একটা লম্বা নাক বিশিষ্ট কালো কুকুর।
‘হাই,’ মেয়েটাকে বলল শ্যাডো। ‘আগে কখনও অদৃশ্য হবার গুঁড়ো দেখেছ?’
একটু ইতস্তত করে মাথা নাড়ল মেয়েটা, দেখেনি।
‘হুম,’ বলল শ্যাডো। তাহলে এটা দেখো।’ পকেট থেকে একটা কোয়ার্টার বের করে বাঁ হাতের উপর নিলো ও। এরপর সেটা উঁচু করে এপিঠ-ওপিঠ দেখাল। এরপর সেটা ডান হাতের দিকে ছুড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করল কেবল, বাতাস খামচে ধরে ডান হাতটা মেয়েটার সামনে এনে বলল, ‘মন দিয়ে দেখো। এবার আমার পকেট থেকে কিছু অদৃশ্য হবার গুঁড়ো নিচ্ছি…’ বাঁ হাতটা বুক-পকেটের কাছে নিয়ে এলো শ্যাডো, এই সুযোগে পয়সাটাও পকেটে ফেলে দিল। ‘…এবার ওগুলোকে ছড়িয়ে দিচ্ছি হাতে…’ লবণ ছড়াবার মতো ভঙ্গি করল ও। ‘… দেখো, পয়সাটা নেই!’ খালি ডানহাতটা দেখাল শ্যাডো, মেয়েটাকে আরও অবাক করে দেবার জন্য বাঁ হাতটাও দেখাতে ভুলল না!
মেয়েটা তাকিয়ে রইল কেবল।
শ্রাগ করল শ্যাডো। হাত দুটো পকেটে ভরল, সুযোগ বুঝে একহাতে তুলে নিলে কোয়ার্টার আর অন্য হাত দিয়ে পাঁচ ডলারের একটা নোট। বাতাস থেকে ওগুলো নিয়ে আসার ভান করবে সে, তারপর তুলে দেবে মেয়েটার হাতে। ‘আরে, বলল ও। ‘আমাদের সাথে দেখি আরেক সঙ্গী যোগ হয়েছে।
কালো কুকুর আর বাদামি বিড়ালটাও ঝগড়া ভুলে ওর খেলা দেখায় মনে দিয়েছে, মেয়েটার দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে দুজন। কুকুরটার বড়ো বড়ো কান দুটো খাড়া খাড়া হয়ে আছে, হাস্যকর দেখাচ্ছে ওটাকে।
ফুটপাত ধরে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে সারসের মতো লম্বা ঘাড়অলা এক লোক, চোখে সোনা দিয়ে বানানো ফ্রেমের চশমা। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে সে, মনে হচ্ছে খুঁজছে কিছু একটা। শ্যাডোর মনে হলো, লোকটা সম্ভবত কুকুরটার মনিব।
‘কী মনে হয়,’ কুকুরটাকে জিজ্ঞেস করল শ্যাডো, মেয়েটাকে শান্ত করার প্রয়াস আরকী। ‘দারুণ না?’
লম্বা নাক চাটল কালো কুকুরটা। এরপর মানুষের গলায় বলল, ‘আমি একবার হুডিনির জাদু দেখেছিলাম। তুমি হ্যারি হুডিনির নখেরও যোগ্য নও।
বাচ্চা মেয়েটা একবার দুই প্রাণির দিকে তাকাল, এরপর আবার শ্যাডোর দিকে। আচমকা পালাতে শুরু করল সে, নরক থেকে দানব উঠে এসে ওর পিছু ধাওয়া করছে! প্রাণী দুটো পিছু নিলো না। সারসের কথা মনে করিয়ে দেওয়া লোকটা কুকুরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল, আলতো করে চুলকে দিল ওটার কান। ‘একটু নরম হও!’ কুকুরটাকে বলল সে। ‘পয়সার একটা খেলা দেখিয়েছে কেবল। পানির নিচ থেকে পালানোর চেষ্টা তো আর করেনি।
‘এখনও করেনি,’ বলল কুকুর। ‘কিন্তু সামনে যে করবে, সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ নেই।’ সোনালি আলো বিদায় নিয়েছে, সন্ধ্যা যেন ঘনিয়ে এসেছে।
পকেটে পয়সা আর নোটটা পুরে নিলো শ্যাডো। ‘তোমাদের মাঝে শিয়াল কে?’
‘চোখ নেই নাকি?’ কালো কুকুরটা ঘোঁত করে উঠল। সারসের মতো লোকটার পাশে গিয়ে দাঁড়াল সে। এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে সাথে যোগ দিল শ্যাডো। বিড়ালটার হদিস নেই কোনো
হাঁটতে হাঁটতে একসারি বিশাল, পুরাতন দালানের সামনে এসে উপস্থিত হলো তারা। বিশেষ একটা বাড়ির সামনে এসে থামল। দরজার পাশে লেখা সাইনে লেখা: আইবিস আর জ্যাকেল। পারিবারিক ফার্ম। ফিউনারেল পার্লার। ১৮৬৩ সাল থেকে।
‘আমি মি. আইবিস,’ চশমা পরা লোকটা বলল। ‘চলো, তোমাকে রাতের খাবার খাওয়াবো। আমার বন্ধুর আবার কাজ আছে।’
আমেরিকার কোথাও
নিউ ইয়র্ককে ভয় পায় সালিম। বুকের কাছে তাই ওর স্যাম্পল ভরতি কেসটা আঁকড়ে ধরাটা খুব একটা অস্বাভাবিক না। কালো মানুষদের অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকাটাকেও ভয় পায় সে। ভয় পায় ইহুদিদের, যারা সম্পূর্ণ কালো পোশাকে আবৃত রাখে নিজেদেরকে…অনেককে তো ইহুদি বলে চিনতেও পারে না। এত মানুষ দেখে অভ্যস্ত নয় সে। লম্বা-লম্বা, নোংরা দালানগুলো থেকে পিঁপড়ার মতো পিলপিল করে বের হয় তারা। গাড়ির অদ্ভুত হর্নের আওয়াজ ভয় পায়…ভয় পায় একইসাথে নোংরা আর মিষ্টি গন্ধের বাতাসও; ওমানের সাথে যার বিন্দুমাত্র মিল নেই!
এক সপ্তাহ হলো নিউ ইয়র্ক, আমেরিকায় এসেছে সালিম। প্রতিদিন দুই, কখনও কখনও তিনটা আলাদা আলাদা অফিসে যায় ও। স্যাম্পল ভরতি কেসটা থেকে বের করে দেখায় তামার মনোহারী সামগ্রী-চাবির রিং, বোতল, ছোটো ছোটো ফ্ল্যাশলাইট, দ্য এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিঙের মডেল, স্ট্যাচু অভ লিবার্টি, আইফেল টাওয়ার ইত্যাদি। প্রতি রাতে ওর দুলাভাই ফুয়াদকে মাস্কাটে ফ্যাক্সও পাঠায় সে। যদি কোনো দিনে কয়েকটা অর্ডার পায় তাহলে সেটাও জানায় (তবে এসব করে যা কামায় তা যে সালিমের আমেরিকায় আসা বা হোটেল থাকা-খাবার খরচ যোগাবার জন্য যথেষ্ট না, সেটা জানে ভালোভাবেই)।
দুলাভাইয়ের ব্যাবসায়িক পার্টনাররা প্যারামাউন্ট হোটেলে রেখেছে ওকে; কেন—তা জানে না! বদ্ধ, খরুচে আর বিভ্রান্তিকর মনে হয় জায়গাটাকে।
ফুয়াদ, ওর দুলাভাই, খুব একটা ধনী নয়। তবে ছোটোখাটো তামার জিনিসপত্র বানাবার একটা ফ্যাক্টরির সহ-মালিক সে। ওখানে সবকিছুই বানানো হয় আরব দেশ, ইউরোপ আর আমেরিকায় পাঠাবার জন্য। ছয় মাস হলো ফুয়াদের হয়ে কাজ করছে সালিম। দুলাভাইকে কেন যেন ভয় পায়, তার ওপর লোকটার ফ্যাক্সের ভাষাও দিন দিন কড়া হচ্ছে। সন্ধ্যাবেলা হোটেল রুমে বসে সময়টা কাটায় সালিম, নিজেকেই বোঝায় সব ঠিক হয়ে যাবে। বোঝায়, এই অদ্ভুত দুনিয়ায় ওর বাস করার সময় খুব অল্প…নির্দিষ্ট।
হাত-খরচ হিসেবে এক হাজার ডলার দিয়েছে ওকে ফুয়াদ, ওমানে থাকার সময় অনেক মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন বানের জলের মতো খরচ হয়ে যাচ্ছে।
প্রথম প্রথম ইচ্ছামতো সবাইকে বখশিশ দিত, পাছে লোকে ওকে কঞ্জুস আরব বলে ধরে নেয়। যখন বুঝতে পারল যে ওর পকেট কাটা হচ্ছে, আর সম্ভবত ওকে নিয়ে হাসাহাসিও করা হচ্ছে-বখশিশ দেওয়াই বন্ধ করে দিল।
মাত্র একবার সাবওয়েতে চড়েছিল বেচারা, বিভ্রান্ত হয়ে মিস করে বসেছিল অ্যাপয়েন্টমেন্ট। এখন মিটিঙে যাওয়ার সময় ট্যাক্সি নেয় সালিম, অন্য কোথাও যেতে হলে হেঁটে যায়। কখনও কখনও যেতে হয় স্বাভাবিকের চাইতেও গরম অফিসে, কখনও কখনও ঠান্ডায় জমে যাওয়া ঘরে। রাস্তায় হাঁটার সময় প্রায়শই পানিতে ভিজে যায় ওর জুতা, বৃষ্টির সময় অবস্থা আরও বেশি খারাপ হয়।
হোটেলে খায় না সালিম (থাকার খরচ ফুয়াদের পার্টনাররা দিলেও, খাবার খরচটা ওর নিজেকেই দিতে হয়)। তাই ফালাফেল হাউজ আর ছোটো ছোটো দোকানগুলো থেকে খাবার কিনে কোটের আড়ালে লুকিয়ে নিয়ে আসে হোটেলে। আসলে আসে না, আসত। যখন বুঝতে পারল যে ও কী খায়, তাতে কারও কিছু যায় আসে না-তখন সবার চোখের সামনেই খাবার নিয়ে উঠতে শুরু করল।
আজ সালিমের মনটা বিক্ষিপ্ত। আজ সকালে পাওয়া ফ্যাক্সটা ছোটো, কিন্তু কড়া। ওটা অনুসারে, সালিমের অগ্রগতি হতাশাজনক। ওর বোন, ফুয়াদ, ফুয়াদের পার্টনার, ওমানের সুলতান আর সারা আরব বিশ্বকেই হতাশ করছে সে। দ্রুত কিছু অর্ডার না পেলে, ফুয়াদ আর ওকে টানতে পারবে না। হোটেল খরচ অনেক বেশি। আমেরিকায় আসলে করছেটা কী সালিম? ওদের টাকায় আয়েশে দিন কাটাচ্ছে? ঘরে বসে বসে ফ্যাক্সটা পড়েছিল সালিম (গত রাতে একটু বেশি গরম লেগেছিল বলে জানালা খুলে রেখেছিল, সকালে উঠে দেখে ঘরটা ফ্রিজের চাইতেও ঠান্ডা), জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিল বাইরে।
স্যাম্পল কেসটাকে এমনভাবে বুকের সাথে আঁকড়ে ধরল সালিম, যেন ভেতরে হীরা-পান্না নিয়ে ঘুরছে! ব্লকের পর ব্লক পার হয়ে রওনা দিল ব্রডওয়ের দিকে। যে দালানটা খুঁজছিল, সেটা বের করে উঠে গেল পঞ্চম তলায়; প্যানগ্লোবাল ইম্পোর্টসের অফিসে।
ঘরটা একদম ছোটো, তবে কোম্পানিটার কর্মক্ষেত্র অনেক বিশাল। প্ৰাচ্য থেকে যত স্যুভনির যুক্তরাষ্ট্রে আসে, তার অর্ধেকটাই এদের হাত ধরে। প্যানগ্লোবালের কাছ থেকে বড়ো ধরনের অর্ডার পাওয়া সালিমের ব্যর্থতা আর সফলতার মাঝে পার্থক্যকারী হয়ে দাঁড়াবে। তাই শক্ত হয়ে কাঠের চেয়ারে বসে রইল ও, স্যাম্পলের কেসটা কোলের উপর রেখে দিয়েছে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনেই, ডেস্কের ওপাশে বসে থাকা মহিলার দিকে। চুলে একটু বেশিই লাল রং ব্যবহার করে ফেলেছে বেচারি, একের পর এক ক্লিনেক্স ব্যবহার করে নাক মুছছে। এগারোটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট হলেও, আধা-ঘণ্টা আগে এসে উপস্থিত হয়েছে সালিম। এখন বসে বসে কাঁপছে সে, জ্বর আসবে মনে হচ্ছে। একঘেয়ে সময় কেটে যাচ্ছে এক সেকেন্ড-এক সেকেন্ড করে।
হাতঘড়ির দিকে তাকাল ও, খুক খুক করে কেশে গলা পরিষ্কার করল।
ডেস্কের পেছনে বসা মহিলা চেহারায় বিরক্ত নিয়ে তাকাল ওর দিকে। ‘কী চাই?’ এমনভাবে বলল যেন শোনা গেল-খী সাই?
‘এখন এগারোটা বেজে পঁয়ত্রিশ।’ বলল সালিম।
দেয়াল ঘড়িটা এক নজর দেখে নিয়ে বলল, ‘হুম
‘আমাকে এগারোটায় আসার কথা বলা হয়েছিল।’ সেলিম মুখে হাসি এনে বলল।
‘মিস্টার ব্ল্যান্ডিং আপনার আসার কথা জানেন।’ বলল মহিলা।
কথা না বাড়িয়ে টেবিলের উপর থেকে এক কপি দ্য নিউ ইয়র্ক পোস্ট তুলে নিলো সালিম। ইংরেজি যতটা ভালো বলতে পারে, পড়তে ততটা পারে না। গোলকধাঁধায় আটকা পড়া লোকের মতো কাগজের সব গল্প পড়ল ও। অপেক্ষা করল সে, একবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার কাগজের দিকে।
সাড়ে বারোটার দিকে ভেতরের অফিস থেকে বেশ কয়েকজন বেরিয়ে এলো। ইংরেজি হাসি-ঠাট্টা করছিল তারা। এদের মাঝে একজনের দিকে নজর গেল ওর-বড়ো, ভুঁড়িঅলা এক লোক, দুই ঠোঁটের মাঝে সিগার ঝুলিয়ে আছে। একবার সেলিমের দিকে তাকাল সে, তারপর মহিলাকে জানাল-জিঙ্ক আর ভিটামিন সি ঠান্ডায় দারুণ কাজে আসে। পরামর্শ মোতাবেক কাজ করবে জানিয়ে কয়েকটা খাম এগিয়ে দিল মহিলা। পকেটে ওগুলো পুরে, বাকিদের সাথে হলে চলে গেল লোকটা। অল্প কিছুক্ষণের মাঝেই হাসির আওয়াজ মিলিয়ে গেল!
ঘড়িতে একটা বাজে যখন, তখন মহিলা দুপুরের খাবার হিসেবে ব্যাগ থেকে বের করল কয়েকটা স্যান্ডউইচ, একটা আপেল আর একটা পানীয়
‘ক্ষমা করবেন,’ বলল সালিম। ‘মিস্টার ব্ল্যান্ডিংকে কি জানানো যাবে যে আমি এখনও অপেক্ষা করছি?’
অবাক চোখে সালিমের দিকে তাকাল মহিলা, ও যে এখনও অপেক্ষা করছে সেটা যেন বিশ্বাসই হতে চাইছে না। মাত্র পাঁচ ফুট দুরে যে আড়াই ঘণ্টা ধরে সালিম বসে আছে, সেটা যেন ভুলেই গেছে। ‘তিনি লাঞ্চে গেছেন।’
তা সালিম আগেই বুঝতে পেরেছে, সিগার ঝোলানো লোকটাই যে ব্ল্যান্ডিং-সে ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত ও। ‘ফিরবেন কখন?’
শ্রাগ করে স্যান্ডউইচ মুখে দিল মহিলা। ‘বাকি দিনটা তিনি ব্যস্ত।’
‘তাহলে ফিরে এলে কি দেখা হবে?’
আবারও শ্রাগ করে নাক ঝাড়ল মহিলা।
ক্ষুধা পেয়েছে সালিমের, কিন্তু ক্ষমতাহীনতা আর ব্যর্থতার জ্বালা ওকে ভোগাচ্ছে আরও বেশি। তিনটার দিকে মহিলা ওর দিকে ফিরে বলল, ‘আজ আর তিনি ফিরবেন না।’
‘বুঝিনি?’
‘মিস্টার ব্ল্যান্ডিং আজ আর ফিরবেন না।’
কালকের জন্য একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা যাবে?’
নাক মুছল মহিলা। ‘টেলিফোন করে আসতে হবে, অ্যাপয়েন্টমেন্ট শুধু টেলিফোনেই দেওয়া হয়
‘বুঝেছি,’ সালিম বলল। এরপর হাসল ও-সেলসম্যানের হাসি। মাস্কাট থেকে বেরোবার আগে বারবার বলে দিয়েছে ফুয়াদ-আমেরিকায় এই হাসি ছাড়া সবকিছু অচল। ‘ফোন করে আসব তাহলে,’ বলে তুলে নিলো স্যাম্পল কেসটা। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমেই মুখোমুখি হলো ঝিরঝিরে বৃষ্টির। হোটেলে ফিরতে হলে হাঁটতে হবে অনেকক্ষণ, তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে হাত তুলে ডাকল রাস্তা দিয়ে যেতে থাকা সবগুলো হলদে ক্যাব। একটাও দাঁড়াল না।
একটা তো পার হয়ে গেল তীব্র গতিতে, যাবার সময় কাদা ছিটিয়ে গেল সালিমের কোট-প্যান্টে। আচ্ছা, ক্যাবের সামনে ঝাঁপ দিলে কেমন হয়? ভাবল সালিম। উপলব্ধি করতে পারল, দুলাভাই ওকে হারাবার চাইতে বেশি শোক করবে স্যাম্পল কেসটাকে নিয়ে। একমাত্র ওর বোন বাদে আর কেউ আফসোস করবে বলে মনে হয় না (বাবা সারাজীবনই ওর কর্মকাণ্ডে হতাশ ছিলেন; এদিকে একটা প্রেমের সম্পর্কও বেশিদিন টেকেনি)। তবে কাজটা শেষ পর্যন্ত করল না সে, কেননা কোন গাড়িই অতটা দ্রুত চলছে বলে মনে হয় না।
বেশ কিছুক্ষণ পর একটা জীর্ণ হলদে ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল ওর পাশে, চিন্তা- ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেলে বলে কৃতজ্ঞতাবোধ করল সে।
গাড়ির পেছনের সিটটায় ধূসর ডাক্ট টেপ লাগানো, চালক আর আরোহীর মাঝে যে প্লেক্সিগ্লাসটা থাকে, সেটা আধ-খোলা। ‘প্যারামাউন্ট হোটেল, প্লিজ। বলল সালিম।
ঘোঁত করে গাড়ি হাঁকাল ক্যাব-ড্রাইভার। লোকটার গালে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। পরনে ধুলো-রঙা সোয়েটার আর প্লাস্টিকের কালো সানগ্লাস। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, রাত নেমে এসেছে। এমন সময় সানগ্লাস! চোখে সমস্যা নেই তো আবার, ভাবল সালিম।
আচমকা একটা ট্রাক এসে দাঁড়াল ওদের সামনে, গাল বকে উঠল ড্রাইভার। ড্যাশবোর্ডে লাগানো নামটার দিকে তাকিয়ে রইল সালিম, কিন্তু পড়তে পারল না। ‘কতদিন ধরে ক্যাব চালাচ্ছ, বন্ধু?’ আরবিতে জানতে চাইল ও।
‘দশ বছর,’ একই ভাষায় জবাব দিল ড্রাইভার। ‘তোমার দেশ কোনটা?’
‘মাস্কাট,’ বলল সালিম। ‘ওমান।’
‘আহ, আমিও একদা ওমানে ছিলাম। অনেক দিন আগের কথা। উবার শহরের নাম শুনেছ?’ জানতে চাইল লোকটা।
‘হ্যাঁ। টাওয়ারের হারানো সেই শহর। পাঁচ…নাকি দশ বছর আগে মরুভূমির বালি খুঁড়ে পুনরায় আবিষ্কার করা হয়েছে শহরটাকে। তুমি কি সেই খনন-কার্যে ছিলে নাকি?’
‘ওরকমই কিছু একটা। শহরটা ভালো ছিল।’ ট্যাক্সি ড্রাইভার বলল। ‘অধিকাংশ রাতে তিন বা চার হাজার মানুষ থাকত শহরটাতে। সব পথিক বিশ্রাম নেবার জন্য আসত উবারে। গান বাজত, মদ বইত পানির মতো!
‘আমিও তাই শুনেছি।’ বলল সালিম। ‘তারপর একদিন আচমকা ডুবে গেল শহরটা, তাই না? কত বছর আগে? এক? নাকি দুই?’
কিছু বলল না ট্যাক্সি ড্রাইভার। পথে একটা লাল ট্রাফিক বাতি পড়ায়, থামল ওখানে। লাল বাতির জায়গায় জ্বলল সবুজ বাতি, কিন্তু গাড়ি এগোল না। একটু ইতস্তত করে সালিম হাত দিল ড্রাইভারের কাঁধে। ঝটকা মেরে সোজা হলো লোকটা, অ্যাক্সিলেটরে চেপে বসল ওর পা।
‘বাল – বাল-বালস্য বাল,’ ইংরেজিতে বলল সে।
‘খুব ক্লান্ত বলে মনে হচ্ছে?’ জানতে চাইল সালিম।
‘এই যন্ত্র চালাচ্ছি একটানা ত্রিশ ঘণ্টা হলো।’ বলল চালক। ‘এভাবে আর কতক্ষণ? এর আগে মাত্র পাঁচ ঘণ্টা ঘুমাতে পেরেছিলাম, তা-ও একটানা চোদ্দো ঘণ্টা চালাবার পর! ক্রিসমাসের আগে আমাদের লোকবল কমে গেছে।’
‘আশা করি, যথেষ্ট পরিমাণে টাকা অন্তত পেয়েছ!’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল চালক। ‘খুব একটা না। আজ সকালে এক লোককে ফিফটি-ফার্স্ট স্ট্রিটে তুলে বিমান বন্দরে গিয়ে নামিয়েছি। ওখানে পৌঁছানো মাত্ৰ লোকটা বিমান বন্দরের ভেতরে পালিয়ে গেল! নেই…পঞ্চান্ন ডলার…একেবারে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ফেরার টোলটাও নিজের পকেট থেকে দিতে হয়েছে।
মাথা নাড়ল সালিম। ‘আজকের দিনটা এক লোকের দেখা পাওয়ার পেছনে ব্যয় করেছি, দেখা হয়নি। দুলাভাই আমাকে ঘৃণা করে। আমেরিকায় এসেছি এক সপ্তাহ হলো, টাকা খরচ ছাড়া আর কোনো লাভ হয়নি। কিচ্ছু বিক্রি করতে পারিনি।’
‘কী বিক্রি করো?’
‘বাল-ছাল। সস্তা জিনিস-পাতি। কমদামি, বিচ্ছিরি সব স্যুভনির।’
ডানে কেটে এগিয়ে নিলো ড্রাইভার ক্যাবটাকে। লোকটা দেখছে কীভাবে, ভাবল সালিম। এই রাতে…এই বৃষ্টির মাঝে ওই সানগ্লাস পরে?
‘তুমি তাহলে বাল-ছাল বিক্রি করো?’
‘হ্যাঁ।’ বলল সালিম, দুলাভাইয়ের বানানো জিনিসগুলোকে এই নামে ডাকতে পেরে একই সাথে ভয় আর শিহরণ জাগল ওর দেহে।
‘মানুষ কেনে না?’
‘না।’
‘কী অদ্ভুত! নিউ ইয়র্কের দোকানগুলোতে শুধু ওগুলোই বিক্রি হতে দেখি। ‘ নার্ভাস ভঙ্গিতে হাসল সালিম।
ওদের সামনের রাস্তায় একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে, লালচে-মুখো এক পুলিস অফিসার ওটার সামনে দাঁড়িয়ে সবাইকে অন্য পথে যাবার নির্দেশ দিচ্ছে।
‘আমরা ইংলিশ অ্যাভিনিউ ধরে এগোবো,’ ট্যাক্সি ড্রাইভার বলল। কিন্তু মোড় ঘুরেই দেখতে পেল, রাস্তাটা পুরোপুরি বন্ধ!
চুপচাপ বসে রইল ড্রাইভার। ওর থুতনিটা নামতে শুরু করল বুকের কাছে…একবার…দুইবার…তিনবার। এরপর আস্তে আস্তে নাক ডাকাতে শুরু করল বেচারা। হাত তুলে ওকে জাগাতে চাইল সালিম, আচমকা স্পর্শে কেঁপে উঠল ড্রাইভার। লোকটার চশমায় হাত লেগে খসে পড়ল ওটা।
চোখ খুলে তাকাল ট্যাক্সি ড্রাইভার, কোলের উপর পড়ে থাকা সানগ্লাসটা তুলে নিয়ে আবার চোখে দিল। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে অনেক, সালিম ওর চোখ দেখে ফেলেছে। বৃষ্টির মাঝে কচ্ছপের গতিতে এগোচ্ছে গাড়িগুলো।
‘আমাকে খুন করবে?’ জানতে চাইল সালিম।
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে উত্তর দিল ড্রাইভার, ‘না।’
থমকে গেল গাড়ির অগ্রগতি, ছাদে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে টপটপ করে।
সালিম মুখ খুলল, ‘আমার দাদির মুখে শুনেছিলাম, তিনি প্রতিজ্ঞা করে বলেছিলেন-ইফ্রিত দেখেছেন একটা। তবে মারিতও হতে পারে। মরুভূমির ধারে ঘুরঘুর করছিল ওটা। আমরা বিশ্বাস করিনি, তাকে বলেছিলাম যে সম্ভবত বালুঝড় দেখেছে…অথবা দমকা হাওয়ার নাচন। কিন্তু না, তিনি হার মানবেন না। বললেন, ওটার চোখ দেখেছেন। তোমার চোখের মতোই জ্বলছিল তার মণিও!’ হাসল ড্রাইভার, চোখগুলো এখন কালো সানগ্লাসের আড়ালে ঢাকা । সালিম বুঝল না, হাসিতে ঠাট্টা মিশে আছে কি না। ‘দাদিরা এখানেও এসেছে কিন্তু।
‘নিউ ইয়র্কে জিনের সংখ্যা অনেক?’ জানতে চাইল সালিম!
‘নাহ, খুব বেশি নেই।’
‘আল্লাহ ফেরেশতা বানিয়েছেন নূর দিয়ে, মানুষকে মাটি থেকে। আর কাউকে কাউকে বানিয়েছেন আগুন দিয়ে।’ বলল সালিম
‘এখানকার মানুষজন আমাদের ব্যাপারে কিচ্ছু জানে না,’ বলল ড্রাইভার। ‘তাদের ধারণা, আমরা কেবল মানুষের ইচ্ছা পূরণ করি। আচ্ছা, যদি তাই পারতাম তো ক্যাব চালাচ্ছি কেন?’
‘বুঝলাম না।’
চালক লোকটাকে বিষ্ণু মনে হলো। ‘এরা বিশ্বাস করে, আমরা আছি কেবল মানুষের ইচ্ছা পূরণের জন্য। অথচ আমি ঘুমাই ব্রুকলিনের একটা ঘরে। সারাদিন ধরে চালাই ট্যাক্সি। কখনও কখনও বখশিশ পাই, আবার কখনও ভাড়াও পাই না।’ লোকটার নিচের ঠোঁট কাঁপতে শুরু করল। ‘একবার একজন পেছনের সিটে বসে পায়খানা পর্যন্ত করেছে, জানো? নিজ হাতে ওটা পরিষ্কার করতে হয়েছে আমাকে! কেন করল কাজটা? কেন?’
এক হাত বাড়িয়ে ইফ্রিতের কাঁধ স্পর্শ করল সালিম, সোয়েটারের কাপড়ের ফাঁক দিয়ে মাংস অনুভব করছে! সালিমের হাতে হাত রাখল ইফ্রিত…
…কিছুক্ষণ রইল ওভাবেই।
মরুভূমির কথা মনে পড়ে গেল সালিমের, লালচে বালির ঝড় দখল করে নিলো ওর ভাবনার জগত। কখন যে এইটথ অ্যাভিনিউতে এসে পৌঁছেছে, বলতেই পারবে না।
‘বয়ষ্করা অবশ্য বিশ্বাস করে। কপাল ভালো এখনও গর্তে পেশাব করে না তারা। ওরা জানে, ফেরেশতাদের কথা শুনতে গেলে আমাদের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয় জ্বলন্ত তারা। কিন্তু যখন এই বয়স্করা এখানে আসে, আমাদেরকে রেখে আসে অনেক…অনেক দুরে। ওখানে অন্তত আমার ক্যাব চালাতে হতো না!’
‘আমি দুঃখিত।’
‘আসলে সময়টাই খারাপ,’ বলল ইফ্রিত। ‘ঝড় আসছে, ভয় করছে আমার। পালাতে পারলে আর কিছু চাইতাম না।
আর কোনো কথা হলো না দুজনের মাঝে।
হোটেলের সামনে ক্যাব থেকে নেমে ইফ্রিতকে বিশ ডলারের একটা নোট ধরিয়ে দিল সালিম, বলল খুচরা টাকা রেখে দিতে। এরপর ভেতরের সবটুকু সাহসকে জড়ো করে ড্রাইভারকে ওর রুম নম্বর জানিয়ে দিল। উত্তরে কিছুই বলল না ড্রাইভার। এদিকে পেছনে সিটে ততক্ষণে উঠে বসেছে এক যুবতী, তাকে নিয়ে রওনা দিল ট্যাক্সি ক্যাব।
.
সন্ধ্যা ছয়টা বাজে ঘড়িতে। সালিম এখনও বাড়িতে পাঠাবার জন্য ফ্যাক্সটা লেখেনি। বৃষ্টির মাঝেই বেরিয়ে পড়ল ও, কাবাব আর ফ্রেঞ্চ-ফ্রাই কিনল। মাত্ৰ এক সপ্তাহ হলে এসেছে এ দেশে, কিন্তু এরইমধ্যে নিজেকে আগের চাইতে মোটা আর গোল বলে মনে হচ্ছে।
নিউ ইয়র্ক ওকে নরম করে তুলছে!
হোটেলে ফিরে এসে অবাক হয়ে লক্ষ করল, ট্যাক্সি ড্রাইভার লবিতে দাঁড়িয়ে আছে! হাত দুটো পকেটে ভরে দেখছে সাদা-কালো পোস্ট কার্ড। সালিমকে দেখে হাসল সে। ‘তোমার ঘরে ফোন করেছিলাম,’ বলল ইফ্রিত। ‘কিন্তু উত্তর পাইনি। তাই ভাবলাম অপেক্ষা করি।
হেসে তার হাত স্পর্শ করল সালিম। ‘এখন এসেছি।’
হাত ধরাধরি করে লিফটে উঠল ওরা দুজন। ঘরে ঢুকে বাথরুমের দিক নির্দেশনা চাইল ইফ্রিত। ‘নিজেকে খুব নোংরা মনে লাগছে।’ ইঙ্গিতে পথ দেখাল সালিম। ইফ্রিত বাথরুমে ঢুকলে জুতা-মোজা খুলল সে, এরপর বাকি পোশাক।
ট্যাক্সি ড্রাইভার কোমরের সাথে তোয়ালে জড়িয়ে বেরিয়ে এলো। চোখে এখন আর সানগ্লাস নেই, আধো-অন্ধকার ঘরটা তার চোখের আলোতে লালচে দেখাচ্ছে। চোখ টিপে টিপে চোখের পানি আটকাল সালিম। ‘ইস! আমি যা দেখছি, তা যদি তুমি দেখতে পেতে!’ বলল সে।
‘আমি কখনও কারও ইচ্ছা পূরণ করি না।’ ফিসফিস করে বলল ইফ্রিত। কোমরের তোয়ালে খুলে ফেলে আলতো করে সালিমকে শুইয়ে দিল বিছানায়।
.
সেদিন রাতে, দৈহিক-ক্ষুধা মেটাবার এক পর্যায়ে সালিম জানতে চাইল, ‘নাম কী তোমার?’
‘ড্রাইভিং পারমিটে কিছু একটা লেখা আছে বটে, কিন্তু ওটা আমার নাম না।’ বলল ইফ্রিত।
.
ঘুম থেকে যখন উঠল সালিম, তখন ঠান্ডা সূর্য চুপি চুপি উঁকি দিচ্ছে ঘরটার ভেতরে। নিজেকে একাকী আবিষ্কার করল ও।
সেই সাথে এ-ও টের পেল, তার স্যাম্পল কেসটা নেই। নেই ওর স্যুটকেসও, ওর ওয়ালেট, পাসপোর্ট আর ওমানে ফেরার টিকিটও!
একটা জিন্সের প্যান্ট, টি-শার্ট আর পশমি একটা সোয়েটার পড়ে আছে মেঝেতে। ওগুলোর নিচে একটা ড্রাইভিং লাইসেন্সও আছে, ইব্রাহিম বিন ইরামের নামে। ট্যাক্সিটার পারমিটও সেই নামেই। ইংরেজিতে লেখা একটা কাগজ জড়ানো অবস্থায় সালিম পেল ট্যাক্সির চাবি। লাইসেন্স আর পারমিটের ছবিটার সাথে ওর খুব একটা মিল নেই। অবশ্য ইফ্রিতের সাথেও ছিল না।
ঝন ঝন করে বেজে উঠল টেলিফোনটা। রিসেপশন থেকে ওকে জানানো হলো-যেহেতু মিস্টার সালিম ঘর ছেড়ে দিয়েছেন, তাই মিস্টার সালিমের বন্ধুরও তাড়াতাড়ি ঘরটা ছেড়ে দিতে হবে।
‘আমি কখনও কারও ইচ্ছা পূরণ করি না।’ জিনের বলা কথাগুলো ফিসফিস করে বলল সে।
পোশাকগুলো পরে নিজেকে হালকা মনে হলো খুব
নিউ ইয়র্কের রাস্তাগুলো একেবারে সরল-অ্যাভিনিউগুলো উত্তর-দক্ষিণ বরাবর, রাস্তাগুলো পূর্ব-পশ্চিম। খুব একটা কঠিন হবে না, ভাবল সে
চাবিগুলো নিয়ে কিছুক্ষণ লোফালুফি করল সালিম। এরপর পকেটে পাওয়া কালো প্লাস্টিকের সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে বিদায় নিলো হোটেল ঘরটা থেকে।
ক্যাবটাকে খুঁজে বের করতে হবে।