অধ্যায় ছয়
সোপানের দরজা খোলা,
যা দিয়ে করছে প্রবেশ রঙ-বেরঙা মানুষের মেলা!
ভোলগা থেকে এসেছে কেউ, কেউ এসেছে তাতারের শুষ্ক ভূমি থেকে,
সঙ্গী হয়েছে হোয়াং-হোর মানুষ, প্রাণে বাঁচার আকুতিতে।
দারিদ্র আর দুঃখ রেখে এসেছে পেছনে,
তবে এসেছে সাথে দেবতাদের নিয়ে; যারা চায় এখানেও রাজ্যবিস্তার করতে।
–থমাস বেইলি অ্যালড্রিক, ‘দ্য আনগার্ডেড গেটস’, ১৯৮২
.
এই তো কেবল পৃথিবীর বৃহত্তম ক্যারোসেলে ছিল শ্যাডো, দুই পা দিয়ে আঁকড়ে ধরেছিল ইগল মাথার এক বাঘকে। মাথার উপর উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছিল হাজার হাজার বাতি, কানে ভেসে আসছিল যান্ত্রিক বাজনা।
আচমকা বদলে গেল সুরটা, মনে হচ্ছে যেন কেউ করতাল বাজাচ্ছে মন্দিরে। বাতির জায়গায় এখন কেবল তারার আলো, অথচ দেখতে কষ্ট হচ্ছে না এক বিন্দু। এমনকী পরিবর্তন এসেছে পশু-মূর্তিগুলোর মাঝেও। পায়ের ফাঁকে উষ্ণ দেহের আভাস পেল ও, নরম পালকের স্পর্শ অনুভব করল।
‘কেমন লাগল, ভালো না?’ পেছন থেকে ভেসে এলো একটা কণ্ঠ। শ্যাডো কানে যেমন শুনতে পেল, তেমনি শুনতে পেল মন দিয়েও।
আস্তে আস্তে ঘুরল ও, প্রতিটা মুহূর্ত…প্রতিটা ক্ষণ যেন আলাদা আলাদা করে দেখতে পেল সে। যেন ছোটো ছোটো সেকেন্ডগুলো অনন্ত কাল ধরে স্থির হয়ে আছে। কী দেখছে, তা বুঝতে পারল না ওর মন। ভাবল, মাছিরা বোধহয় তাদের অসংখ্য চোখ দিয়ে এভাবেই দেখতে পায় সবকিছু।
মি. ন্যান্সির দিকে তাকিয়ে আছে ও, লোকটা সরু গোঁফঅলা এক বৃদ্ধ নিগ্ৰো। পরনে সেই জ্যাকেট আর সেই হলদে গ্লাভস, একটা সিংহের উপর বসে আছে সে। আবার একই সময়ে…একই জায়গায় একটা মাকড়সাকে দেখতে পাচ্ছে শ্যাডো। ঘোড়ার সমান বড়ো সেই মাকড়সার চোখ যেন নেবুলা, অনেক উপর থেকে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। আবার একই সময়…একই জায়গায় সে দেখতে পাচ্ছে এক অস্বাভাবিক লম্বা লোককে, বাদামি-কালো ত্বক আর তিনজোড়া হাত তার, মুখটা লালে রাঙানো। দেখতে পাচ্ছে এক নিগ্রো বাচ্চাকে, ছেড়া-ফাঁটা পোশাক যার পরনে; বাঁ-পাটা ফুলে আছে, মাছি ভন ভন করছে। এই সবার পেছনে একটা ছোট্ট বাদামি মাকড়সাও দেখতে পাচ্ছে ও, পাতার আড়ালে লুকিয়ে আছে।
এ সবই দেখছে শ্যাডো, বুঝতে পারছে-সবগুলো আসলে একটাই অস্তিত্ব।
‘মুখ বন্ধ না করলে,’ সবগুলো মি. ন্যান্সি এক সাথে বলে উঠল। ‘কিছু একটা ঢুকে যেতে পারে কিন্তু!’
মুখ বন্ধ করে ঢোক গিলল শ্যাডো।
ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার এক মাইল মতো দূরত্বে একটা পাহাড় পাহাড়ের উপর কাঠ নির্মিত একটা হল। ওটার দিকেই এগোচ্ছে ওরা। ওদের পশুগুলো নিঃশ্বব্দে পা ফেলছে।
চেরনোবোগ ওর সেন্টরটাকে সাথে নিয়ে এগিয়ে এলো। শ্যাডোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এসব কিছুই সত্যি না। তাই বেশি ভেবে মাথা নষ্ট করো না।’ শ্যাডো লোকটার জায়গায় দেখতে পেল ধূসর চুলের এক বৃদ্ধ পূর্ব- ইউরোপবাসীকে, জীর্ণ রেইনকোট পরে আমেরিকার মাটিতে পা রাখছে। তবে সেই সাথে আরেকটা কালো অবয়বও দেখতে পেল, ওদেরকে ঘিরে রাখা অন্ধকারের চাইতেও কালো; চোখ দুটো যেন জ্বলন্ত অঙ্গার। দেখতে পেল এক রাজকুমারকে, কালো চুল বাতাসে উড়ছে, ঠোঁটের উপর ঘন কালো গোঁফ। দুই হাত আর চেহারায় রক্তের ছাপ, নগ্নাবস্থায় একটা সেন্টরের উপর বসে আছে।
‘আপনারা কে?’ জানতে চাইল শ্যাডো। ‘উহু, আপনারা কী?’
এগিয়ে চলছে ওদের পশুগুলো, পাশেই সমুদ্র। রাতের সৈকতে আছড়ে পড়ছে ঢেউ।
ওয়েনসডে তার নেকড়েটাকে ওর দিকে নিয়ে এলেন, প্রাণিটা এখন বিশালাকার ধারণ করেছে, সবুজ চোখ দিয়ে তাকিয়ে আছে ওকে লক্ষ করে। শ্যাডোর পশুটা ভয় পেয়ে সরে যেতে চাইল, বেচারার গলায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার প্রয়াস পেল সে। কেন যেন ওর মনে হচ্ছে, এই নেকড়ের আরেকটা যমজ আছে। হয়তো চোখের আড়ালে থেকে নজর রাখছে ওটা।
‘তুমি জানো, আমি কে?’ মাথা উঁচু করে জানতে চাইলেন ওয়েনসডে। চোখজোড়া যেন ক্ষণিকের জন্য জ্বলে উঠল। নাহ, চোখজোড়া নয়, শুধু ডান চোখটা। বাঁ দিকেরটা একদম নিষ্প্রভ। ‘তোমাকে আমার নামগুলো বলি শোনো। আমাকে ডাকা হয় যুদ্ধের দেবতা বলে; ডাকা হয় গ্রিম, রেইডার আর থার্ড বলেও। আমি এক-চক্ষু। আমি সর্বোচ্চ, সত্য-অন্বেষণকারী। আমি গ্রিমির, আমি আলখাল্লা-আবৃত। আমি সর্ব-পিতা। যত ধরনের বাতাস আছে, তারচেয়েও বেশি আছে আমার নাম। মৃত্যুর যত পন্থা আছে, তারচেয়েও সংখ্যায় অধিক আমার উপাধি। আমার দুই দাঁড়কাকের নাম হুগিন আর মুনিন, চিন্তা আর স্মৃতি। আমার দুই নেকড়ে ফ্রেকি আর গেরি। আমার অশ্ব, গ্যালোস।’ দুইটি ভূতুড়ে দাঁড়কাক এসে বসল ওয়েনসডের দুই কাঁধে। এমনভাবে তার কানে নিজেদের চঞ্চু ঠেকাল যেন গ্রহণ করছে প্রৌঢ়ের মননের স্বাদ। আবার ডানা ঝাপটে উড়াল দিল তারা। ‘বিশ্বাস রাখব কীসে?’ ভাবল শ্যাডো। দুনিয়ার ভেতর থেকে একটা কণ্ঠ স্বর যেন সাথে সাথে জানিয়ে দিল ওকে—সবকিছুতে।
‘ওডিন?’ শব্দগুলো যেন বাতাসের রূপ নিয়ে আস্তে আস্তে বের হলো ওর গলা দিয়ে।
‘ওডিন,’ ফিসফিসিয়েই বললেন ওয়েনসডে। ‘ওডিন,’ এবার একটু জোরালো কণ্ঠে, যেন শব্দটার স্বাদ অনুভব করছেন মুখে। ‘ওডিন। এবার এত জোরে যে দুনিয়াই ভরে উঠল তার গলার স্বরে।
তারপর আচমকা…যেন এতক্ষণ সবকিছু স্বপ্নে দেখছিল…কাঠের দালানটায় আবিষ্কার করল শ্যাডো নিজেকে। বিশাল একটা দালান, তবে প্রাচীন দেয়ালগুলো…কাঠের অবশ্যই, তবে ছাদটা খড় ছাওয়া। ঠিক মাঝখানে একটা অগ্নিকুণ্ড, ওটার ধোঁয়ায় শ্যাডোর চোখ জ্বলছে!
‘আমার মনের ভেতর এসব করা উচিত ছিল,’ বিড়বিড় করে শ্যাডোকে বললেন মি. ন্যান্সি। ‘ওয়েনসডের মনে না। তাহলে অন্তত ঠান্ডায় জমতে হতো না।’
‘আমরা ওনার মনের ভেতর আছি?’
‘অনেকটা সেরক…এটা ভালাস্কজালফ, ওডিনের প্রাচীন হলঘর।
স্বস্তির সাথে শ্যাডো টের পেল, ন্যান্সি এখন কেবল এক বৃদ্ধ মানুষ, সাথে অন্য কিছু নয়। দেয়ালের সাথে লাগানো আছে কাঠের বেঞ্চ। ওতে বসে আছে দশজনের মতো মানুষ। একে অন্যের থেকে বেশ কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে বসেছে তারা। নানা ধরনের মানুষ-লাল শাড়ি পরিহিতা কালো ত্বকের এক মহিলা আছে, আছে কয়েকজন ব্যবসায়ীর মতো দেখতে পুরুষ। বাকিরা আগুনের এতটা কাছে গিয়ে বসেছে যে তাদেরকে ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছে না শ্যাডো।
‘অন্যরা কোথায়?’ ন্যান্সির দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে জানতে চাইলেন ওয়েনসডে, রাগ ঝরছে গলা দিয়ে। ‘আমাদের সংখ্যা তো অনেক, অথচ মাত্র দশ জন এসেছে!’
‘আমন্ত্রণ তো তুমি জানিয়েছ!’ বলল ন্যান্সি। ‘তবে দশজন যে এসেছে, তাই তো বেশি! এক কাজ করি, আমি নাহয় একটা গল্প বলে মিটিংটা শুরু করি।’
‘অসম্ভব।’ নাকচ করে দিলেন ওয়েনসডে।
‘দেখে তো মনে হচ্ছে না যে এরা তোমার উপর খুব একটা সন্তুষ্ট,’ বললেন ন্যান্সি। ‘তাই বলি কী, একটা গল্প শোনাই। মাথাটা একটু ঠান্ডা হবে। তোমার সাথে চারণ-কবিও যেহেতু নেই, তাই আমি আর আমার গল্পই ভরসা।’
‘গল্প-টল্প বাদ।’ বললেন ওয়েনসডে। ‘পরে ওসব করার অনেক সময় পাওয়া যাবে। এখন দরকার নেই।’
‘ঠিক আছে, গল্প বাদ।’ বলে হাসিমুখে অগ্নিকুণ্ডের দিকে এগোতে লাগল বৃদ্ধ লোকটা। ‘অন্তত দু-চারটা কথা বলে মিটিং তো শুরু করতে দাও।’
‘আমি জানি, তোমরা সবাই কী ভাবছ!’ অগ্নিকুণ্ডের আলোতে ঠিকঠাক দেখা যায়, এমনভাবে দাঁড়িয়ে বলল ন্যান্সি। ‘ভাবছ, বুড়ো আনানসি এখানে কী করছে? কেন সে-ই কথা শুরু করল? অথচ সর্ব-পিতা সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন! দিচ্ছি এসব প্রশ্নের উত্তর। এখানে পা রেখেই তোমাদেরকে দেখে আমার মনে একটা প্রশ্ন জন্ম নিয়েছে-বাকিরা কই? তবে মুখে ওটা উচ্চারণ করার আগেই মনে উত্তর পেয়ে গেলাম। আমরা সংখ্যায় অনেক অল্প আর দুর্বল, অথচ ওরা শক্তিশালী। কিন্তু তার অর্থ এই না যে আমরা হেরে গেছি।
‘একবার এক বাঘকে দেখেছিলাম, একটা ওয়াটার হোলের পাশ বসে ছিল সে। বিশ্বাস করো, আমার জীবনে এরচেয়ে বড়ো বিচিঅলা কোন প্রাণী দেখিনি। বাঘটার শরীরও ছিল রাজসিক। সামনের দাঁত দুটো যেন ছুরির সমান, ক্ষুরের চাইতেও ধারাল। সাহস জুগিয়ে ওর কাছে গিয়ে বললাম, বাঘ ভাই আমার, বিনা চিন্তায় গোসলে যেতে পারো। আমি আছি তো, তোমার বিচি দেখে রাখব। বিশ্বাস করল সে আমার কথা, পানি নেমে পড়ল। আমি ওই বিচিজোড়া নিয়ে নিজের ছোটো ছোটো মাকড়সার বিচি সেখানে রেখে দিলাম। তারপর কী করলাম শুনবে? দিলাম ভোঁ-দৌড়।
‘পরের শহরে পৌঁছাবার আগে আর থামিনি। সেখানে দেখা হলো বানরের সাথে। তোমাকে দেখতে দারুণ লাগছে আনানসি, বলল বানর। সুযোগ বুঝে জানতে চাইলাম, আসার পথে অসাধারণ এক গান শুনেছি। অন্যান্য শহরে সবাই খুব গাইছে, তুমি শুনেছ? বানর মাথা নেড়ে না করতেই নাচতে নাচতে শুনিয়ে দিলাম-
মজা করে চিবিয়ে, ক্যোঁৎ করে গিলে,
খেয়েছি আমি বাঘের বিচি; নয় কো মনের ভুলে।
কে আমাকে রুখবে এখন, কে ঠেকাবে দেয়ালে,
খেয়েছি আমি বাঘের বিচি, ক্যোঁৎ করে গিলে।
‘গান শুনে পেট ধরে হাসিতে ফেটে পড়ল বানর। একটু শান্ত হয়ে নিজেই গাইতে শুরু করল। দারুণ গান, বলল সে। আমার সব বন্ধুকে শোনাব।
‘অবশ্যই, তাই করো। এই বলে আবার ওয়াটার হোলের কাছে চলে এলাম আমি।
‘বাঘটা তখন ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে হাঁটাহাঁটি করছিল, আশপাশে যাকেই পাচ্ছিল, তাকেই দেখাচ্ছিল ধারাল শ্বদন্ত। চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে, এমনভাবে আমার দিকে তাকাল ও। ভয়ই পেয়ে গেছিলাম, কিন্তু বেচারার দুই পায়ের ফাঁকে নজর পড়তেই উবে গেল ভয়। ওখানে যে আমার দেখা সবচেয়ে ছোটো ছোটো একজোড়া বিচি ঝুলছে!
‘এই আনানসি, আমাকে দেখে বলল সে। তোমার না আমার বিচিজোড়া পাহারা দেবার কথা? কিন্তু গোসল সেরে এসে দেখি, তুমিও নেই…আমার বিচিও নেই। আছে কেবল এই ছোটো ছোটো দুটো। ব্যাপার কী?
‘আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করেছি, জানালাম ওকে। কিন্তু একদল বানর এসে তোমার বিচিজোড়া খেয়ে ফেলে! যখন ওদেরকে তাড়া দিতে চায়, তখন টেনে খুলে ফেলে আমার বিচি। লজ্জায় তাই পালিয়ে গেছিলাম।
‘মিথ্যা কথা বলছ, আনানসি-বাঘ বলল। তোমার কলিজা আমি চিবিয়ে খাবো। এই বলে যখন আমার দিকে এক পা এগিয়েছে, ঠিক তখন একদল বানরকে আসতে দেখল ও। লাফাতে লাফাতে তারা গাইছে-
মজা করে চিবিয়ে, ক্যোঁৎ করে গিলে,
খেয়েছি আমি বাঘের বিচি; নয় কো মনের ভুলে।
কে আমাকে রুখবে এখন, কে ঠেকাবে দেয়ালে,
খেয়েছি আমি বাঘের বিচি, ক্যোঁৎ করে গিলে।
‘গান শোনা মাত্র হুঙ্কার ছাড়ল বাঘ, ঝাঁপিয়ে পড়ল বানরদের উপর। এদিকে বাঘের হুঙ্কার শুনে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার অবস্থা বানরদের। চিৎকার করতে করতে এক লাফে উঠে পড়ল উঁচু উঁচু সব গাছের মগডালে। আর আমি? নতুন বড়ো বড়ো বিচি চুলকাতে চুলকাতে চলে এলাম ঘরে। আজও বানর দেখতে পেলেই পিছু নেয় বাঘ। তাই মনে রেখ সবাই, ছোটো বা দুর্বল হওয়া মানেই কিন্তু শক্তিহীন হয়ে পড়া না।’
হাসি মুখে বাউ করল মি. ন্যান্সি, পেশাদারের মতো চারপাশ থেকে ভেসে আসা শুভেচ্ছা গ্রহণ করছে। এরপর ফিরে এলো চেরনোবোগ আর শ্যাডোর কাছে।
‘গল্প বলতে না নিষেধ করেছিলাম।’ বললেন ওয়েনসডে।
‘এটাকে গল্প বলে?’ বলল ন্যান্সি। ‘আমি তো গলাই পরিষ্কার করতে পারলাম না। যাক গে, এবার যাও। নিজের ঝলকটা দেখাও।’
এবার ওয়েনসডের পাদ-প্রদীপ…নাহ, অগ্নি-প্রদীপের আলোয় আসার পালা। এগিয়ে গেলেন তিনি, আরমানি কোট পরনে বয়স্ক লোকটাকে দেখতে একটু অদ্ভুতই লাগছে। চুপচাপ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি, একটা শব্দও উচ্চারণ করলেন না। কেউ যে এতক্ষণ এইরকম পরিস্থিতিতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, তা বিশ্বাস হতে চাইছিল না শ্যাডোর। অবশেষে নীরবতা ভেঙে কথা বলে উঠলেন তিনি, ‘তোমার আমাকে চেনো…তোমরা সবাই আমাকে চেনো। কেউ কেউ আমাকে পছন্দ করো, কেউ কেউ অপছন্দ। তবে আমি আসলে কে, সেটা তোমাদের সবার জানা আছে।’
বেঞ্চে বসে থাকা লোকজন নড়ে-চড়ে উঠল।
‘আমি তোমাদের প্রায় সবার চাইতেই আগে থেকে এখানে আছি। তোমাদের মতো আমিও ভাবতাম, যেভাবে চলছে, চলুক না। হয়ে যাচ্ছে তো। হ্যাঁ, আরামে- আয়েসে হয়তো থাকতে পারছি না। কিন্তু টিকে তো আছি। তবে এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। ঝড় আসছে একটা…সেই ঝড় কিন্তু আমরা তৈরি করিনি।
একটু থামলেন তিনি, এরপর এক পা এগিয়ে বুকের উপর হাত বাঁধলেন।
‘লোকেরা যখন আমেরিকায় এলো, তখন সাথে করে নিয়ে এলো আমাদের। আমি, লোকি আর থর, আনানসি, লেপ্রিকন, ব্যানশি, কোবোল্ড, কুবের, অ্যাসটারথ-আমাদের সবাইকে ওরাই এনেছে। এনেছে তোমাদেরকেও। অভিবাসীদের মনকে নিবাস বানিয়ে আমরা সমুদ্র পাড়ি দিয়েছি। এই দেশটা অনেক বড়ো। দেখা গেল, এখানে আসার কিছুদিনের মাঝেই আমাদেরকে নিয়ে আসা লোকরাই আমাদেরকে পরিত্যাগ করছে। পুরনো দেশের পুরনো স্মৃতি বলে ধরে নিয়েছে আমাদের। যারা উপাসক ছিল, একে একে মৃত্যু বরণ করেছে সবাই। অনেকে আবার উপাসনা করাও ছেড়ে দিয়েছে। এদিক-ওদিক থেকে পাওয়া টুকরা-টাকরা উপাসনার উপর ভর করে এতদিন টিকে ছিলাম ভীত, সন্ত্রস্ত আর পরিত্যক্ত আমরা। লোকচক্ষুর আড়ালে, সবার অলক্ষ্যে টিকে থেকেছি।
‘স্বীকার করতেই হয়, আমাদের প্রভাব একেবারেই কমে এসেছে। এখান থেকে চেয়ে, ওখান থেকে চিন্তে বেঁচে থাকতে হয় আমাদের। ন্যাংটা হয়ে নাচ দেখিয়ে আর বড়োলোকদের গাড়িতে তেল ভরে পয়সা কামাই, আর সেটা উড়িয়ে দিই মদ খেয়ে। আমরা…দেবতারা, এই দেবতাবিহীন দেশে এভাবেই টিকে আছি কোনোক্রমে।’
আবার বিরতি নিলেন ওয়েনসডে। একে একে সবার দিকে তাকালেন তিনি, দক্ষ প্রশাসকের মতো এক অর্থবহুল হাসি ফুটিয়ে তুললেন চেহারায়। অথচ শ্রোতামণ্ডলীর মুখে হাসি নেই, নিস্পৃহতার মুখোশ পরে বসে আছে যেন। গলা পরিষ্কার করলেন ওয়েনসডে, থুথু ফেললেন আগুনের মাঝে। সাথে সাথে যেন লাফিয়ে উঠল শিখা, এক পলকের জন্য উজ্জ্বল হয়ে উঠল চারপাশ।
‘তোমরা সবাই নিশ্চয়ই যার যার মতো করে আবিষ্কার করেছ—এই দেশে নতুন কিছু দেবতা শক্তিশালী হতে শুরু করেছে। ক্রেডিট কার্ড আর ফ্রি-ওয়ের দেবতা, ইন্টারনেট আর টেলিফোনের প্রভু; রেডিয়ো, হাসপাতাল আর টেলিভিশনের ভগবান, বিপার আর নিয়ন লাইনের হর্তা-কর্তা। এরা সবাই অহংকারী, মোট- সোটা আর বোকা। নিজেদের গুরুত্ব আর নতুনত্বের মোহে অন্ধ।
‘আমাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে অজানা নেই তাদের। ওরা আমাদেরকে ভয় পায়, ঘৃণা করে।’ বললেন ওডিন। ‘যদি অন্য কিছু ভেবে থাকো তো চোখে ঢুলি পরে আছ! আমাদেরকে ধ্বংস করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। পারলে যেকোনো দিন করেই বসবে। তাই এখনই সময়, এক হবার। এখনই সময়, পদক্ষেপ নেবার
লাল শাড়ি পরা বৃদ্ধা মহিলা এগিয়ে এলেন। তার মাথায় একটা ছোট্ট, নীল মণি। বললেন, ‘এইসব ছাইপাঁশ শোনাবার জন্য ডেকে এনেছ আমাদের?’ ঘোঁত করে উঠলেন তিনি। কিছুটা বিরক্তিতে, আর অনেকটা মজা পেয়ে।
কোঁচকানো ভ্রু মসৃণ হয়ে এলো ওয়েনসডের। ‘মানছি, আপনাদেরকে আমিই ডেকেছি, মামা-জী। কিন্তু এসব কথা ছাইপাঁশ নয়, গুরুত্বপূর্ণ। হাঁটুর বয়সি বাচ্চাও তা বুঝতে পারবে।’
‘কী বলতে চাচ্ছ, আমার বুদ্ধি হাঁটুর বয়সি একটা বাচ্চার চাইতেও কম?’ একটা আঙুল তুলে নাচালেন তিনি। ‘কালীঘাটে বসে বসে যখন বুড়ো হয়েছি, তখনও তোমার কথা কেউ কল্পনা করতেই শুরু করেনি, বুঝেছ? আর আমি কিনা বাচ্চার চাইতেও অবোধ! ঠিক আছে, তাহলে তাই সই।’
আরেক বার দ্বৈত দৃশ্য ধরা দিল শ্যাডোর চোখে-বৃদ্ধাকে দেখতে পেল সে, বিরক্ত চেহারায় তাকিয়ে আছে। কিন্তু তার পেছনে বৃহদাকার কিছু একটা লুকিয়ে আছে যেন। সদ্য কেনা চামড়ার জ্যাকেটের চাইতেও কালো ত্বকের এক নগ্ন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে ওখানে…মুখ আর ঠোঁট যেন ধমনীতে বয়ে চলা রক্তের চাইতেও বেশি লাল! তার গলায় খুলি দিয়ে বানানো মালা ঝুলছে। অগণিত হাতে ধরে আছে ছুরি, তলোয়ার আর কর্তিত মস্তক!
‘আমি আপনাকে তা বলিনি, মামা-জী।’ ক্ষমা প্রার্থনার সুরে বললেন ওয়েনসডে। ‘কিন্তু যে কেউ বুঝতে পারবে—’
‘একমাত্র যে জিনিসটা যে কেউ বুঝতে পারবে, তা হলো…’ বললেন বৃদ্ধা, আঙুল দিয়ে ওডিনের দিকে ইঙ্গিত করছেন (তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা কালো মহিলাও তাই করল)। ‘…যশের নেশায় তুমি অন্ধ হয়ে গেছ। অনেকদিন হলো এই দেশে আমরা শান্তির সাথে বাস করছি। মানছি, আমাদের মাঝে কেউ কেউ অন্যদের তুলনায় একটা ভালো অবস্থানে আছে। ভারতে আমার আরেক অবতার কিন্তু আমার চাইতেও ভালো আছে। তাই বলে আমার ঈর্ষান্বিত হবার তো কোনো মানে হয় না! অনেক নতুন দেবতাকে ওপরে উঠতে দেখেছি, কেউ টেকেনি। কালের সাথে সাথে ধসে পড়েছে তারা সবাই।’ হাত নামিয়ে রাখলেন তিনি। অন্যরা তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কারও চোখে সম্মান, কারও কৌতুক আর কারও কারও লজ্জা। ‘এই তো, কয়েক বছর আগেই আমেরিকা উপাসনা করল রেল লাইনের। আর এখন? ইস্পাতের দেবতাকে ভুলে…’
‘আপনি যা বলতে চাইছেন তা সরাসরি বলুন, মামা-জী।’ বললেন ওয়েনসডে।
‘আমি কী বলতে চাইছি?’ নাকের পাটা ফুলে উঠল মহিলার। ‘আমি…যে শিশুরও অধম…বলতে চাই-আমাদের অপেক্ষা করা উচিত। কিচ্ছু করার দরকার নেই। ওরা যে আমাদের ক্ষতি করতে চায়—তা কিন্তু নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না!’
‘যখন রাতের আঁধারে ওরা আমাদেরকে খুন করতে আসবে, তখন আমরা কী করব?’
মহিলার চেহারায় ফুটে ওঠা বিরক্ত আর কৌতুক ধরতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হলো না শ্যাডোর। ‘আমাকে ধরতে পারবে না, খুন করা তো দূরে থাক।’
পেছনে বসে থাকা এক যুবক ওয়েসডের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কেশে উঠল 1 তারপর ভরাট কণ্ঠে বলল, ‘সর্ব-পিতা, আমার লোকেরা ভালোই আছে। যা পেয়েছি, তা নিয়ে বিনা অসুবিধাতেই দিন কাটাচ্ছি। আপনার এই যুদ্ধের ফল যদি আমাদের বিপক্ষে যায়, তবে সব হারাতে হবে।’
‘চোখ খুলে দেখো, বাছা।’ বললেন ওয়েনসডে। ‘তোমার সব হারিয়ে বসেছ। আমি চাইছি তোমাদেরকে কিছু ফেরত পাবার সুযোগ করে দিতে।’
আমি আসলে এগুলো বিশ্বাস করি না, ভাবল শ্যাডো। এসবের কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। আসলে আমার বয়স এখনো পনেরো। মা এখনও বেঁচে আছেন, লরার সাথে এখনও দেখাই হয়নি। এ সবকিছু আসলে স্বপ্ন…হ্যাঁ, হ্যাঁ। স্বপ্ন ছাড়া কিছুই না।
অথচ এই ভাবনাটাও বিশ্বাস হচ্ছে না ওর, দুনিয়াতে টিকে থাকতে হলে মানুষকে তার ইন্দ্রিয় আর তার স্মৃতির উপর বিশ্বাস করে থাকতে হয়। যদি ওগুলোও মিথ্যা বলে, তাহলে আর কোন কিছুতেই বিশ্বাস রাখা চলে না।
আচমকা বন্ধ হয়ে গেল আগুন, অন্ধকার নেমে এলো ওডিনের হলে। ‘এবার?’ ফিসফিস করে জানতে চাইল শ্যাডো।
‘এখন আমরা ক্যারোসেলের ঘরটায় ফিরে যাব,’ জানাল ন্যান্সি। ‘বুড়ো একচোখা আমাদেরকে রাতের খাবার খাওয়াবে। চেষ্টা করবে কয়েকজনকে তেল মারার। আর কেউ ‘দ’ শব্দটা উচ্চারণও করবে না।’
‘দ-শব্দ?’
‘দেবতা। সত্যি বলছি, ঘটে কি তোমার একটুও ঘিলু নেই? যেদিন মানুষকে মগজ দেওয়া হচ্ছিল, সেদিন কোথায় ছিলে?’
‘একজন বাঘের বিচি চুরি করার গল্প বলছিল, সেটা শুনতে গিয়ে আর মগজ আনতে পারিনি।
হাসল মি. ন্যান্সি।
‘কিন্তু কোন সিদ্ধান্তেই তো আসা গেল না!’
‘আস্তে আস্তে সবাইকে রাজি করাচ্ছে ওয়েনসডে, এক এক করে। শেষ পর্যন্ত জয় হবে ওরই।’
আচমকা শ্যাডো টের পেল, কোত্থেকে যেন ঠান্ডা বাতাস বইছে। চোখ খুলে দেখতে পেল, সেই ক্যারোসেলের ঘরটায় দাঁড়িয়ে আছে ওরা! চারপাশে পর্যটক, সবাই ঘিরে আছে ওয়েনসডেকে।
‘এদিক দিয়ে এসো সবাই,’ গমগমে কণ্ঠে বললেন তিনি। ঘরটা থেকে বেরোবার একমাত্র দরজার দিকে এগোল সবাই। পর্যটকদের মাঝে দক্ষ রাজনীতিবিদের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন ওয়েনসডে। এর প্রশংসা করছেন, ওকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।
‘স্বপ্ন ছিল না তো সব?’ জিজ্ঞেস করল শ্যাডো
‘কী সব?’
‘ওই হলঘর, আগুন, বাঘের বিচি, ক্যারোসেলে চড়া।’
‘ক্যারোসেলে চড়া! ওই কাজটা তো নিষিদ্ধ! কেন, নোটিশ পড়নি? এখন চুপ করো।’
চুপচাপ ওয়েনসডের দেখানো পথ ধরে বাইরে চলে এলো ওরা।
শ্যাডো আর ন্যান্সি এলো সবার পেছনে। হাউজ অন দ্য রক থেকে বের হবার পর, সরাসরি রওনা হলো পার্কিং লটের দিকে।
‘শেষ হবার আগেই বিদায় নিতে হচ্ছে,’ বলল ন্যান্সি। ‘দুনিয়ার সবচেয়ে বড়ো কৃত্রিম অর্কেস্টা দেখতে পেতাম।’
‘আমি দেখেছি,’ বলল চেরনোবোগ। ‘তেমন ভালো কিছু না।’
.
রেস্তোরাঁটা দশ মিনিট দূরত্বে। ওয়েনসডে তার দশ অতিথির সবাইকে রাতের খাবারের দাওয়াত দিয়েছেন। এমনকী যাদের গাড়ি নেই, তাদের রেস্তোরাঁয় যাবার ব্যবস্থাও করেছেন। কিন্তু গাড়ি নেই যাদের, তারা কীভাবে হাউজ অন দ্য রকে এসে পৌঁছাল তা বুঝে পেল না শ্যাডো। কীভাবে ফিরে যাবে, তাও ধরতে পারল না সে। তবে বলল না কিছুই…এসব পরিস্থিতিতে কিছু না বলাটাই উত্তম।
ওয়েনসডের কয়েকজন অতিথিকে গাড়িতে তুলল শ্যাডো। লাল শাড়ি পরা বৃদ্ধা ওর সাথে সামনে বসল, অদ্ভুত দর্শন যুবক পেছনে-তার নাম এলভিসের মতো শোনায়। আরেকজন এলভিসের সাথে পেছনে বসল, কিন্তু শ্যাডোর তাকে মনে নেই।
লোকটা যখন গাড়িতে ঢোকে, তখন পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল ও। এমনকী তার জন্য দরজা খুলেছিল আর বন্ধও করেছিল। অথচ তার ব্যাপারে কিছুই মনে নেই শ্যাডোর। ড্রাইভার সিট থেকে পিছু ফিরে একবার তাকাল ও। সাবধানতার সাথে মুখস্থ করল তার চেহারা, পোশাক, চুল। ভবিষ্যতে যদি কখনও দেখা হয়, তাহলে যেন চিনতে পারে। কিন্তু যখন রাস্তার দিকে তাকাল তখন টের পেল, লোকটার ব্যাপারে কিছুই মনে নেই ওর!
আসলে আমি ক্লান্ত, ভাবল শ্যাডো। আড়চোখে ডান দিকে তাকাল ও। প্রথমেই নজরে পড়ল ওর গলার নেকলেসটা। মহিলা নড়ার সাথে সাথে ছোটো ছোটো ঘণ্টার মতো আওয়াজ করে উঠল হাতের বালাগুলো। কপালের নীল মণিটার রঙও আরও ঘন দেখাচ্ছে। শরীর থেকে মসলা আর নাটমেগের গন্ধ ভেসে আসছে ওর নাকে। ওকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসল মামা-জী।
‘আমাকে মামা-জী বলে ডাকতে পারো,’ বললেন মহিলা।
‘আমি শ্যাডো, মামা-জী,’ বলল শ্যাডো।
‘তোমার মনিবের পরিকল্পনা কেমন ঠেকছে, মিস্টার শ্যাডো?’
গতি একটু কমাল ও। ‘আমি প্রশ্ন করি না, তিনি-ও উত্তর দেন না।’
‘আমার কী মনে হয় জানো? ওডিন আসলে চায় শেষ একটা যুদ্ধ। আমাদের বয়স যথেষ্ট হয়েছে, তাই হয়তো অনেকে রাজিও হয়ে যাবে।’
‘প্রশ্ন করাটা আমার দায়িত্বের মাঝে পড়ে না, মামা-জী।’ বলল শ্যাডো। গাড়ির ভেতরটা ভরে উঠল বৃদ্ধা মহিলার হাসির খনখনে আওয়াজে।
পেছনে বসে থাকা লোকটা…না, না; অদ্ভুত-দর্শন যুবক নয়, অন্যজন … কিছু একটা জানতে চাইল। উত্তরও দিল শ্যাডো। কিন্তু এক মুহূর্ত পরেই আর প্রশ্নটা মনে করতে পারল না সে।
অদ্ভুত দর্শন যুবক চুপচাপ বসে ছিল এতক্ষণ, এবার গুনগুন করে গাইতে শুরু করল। গভীর, মেটালিক একটা সুর…যার তালে তালে কাঁপতে শুরু করল যেন গাড়ির ভেতরটা। যুবক লম্বায় আর দশজনের মতোই। কিন্তু তার বুকটা অদ্ভুত। এতদিন কেবল শুনেই এসেছে শ্যাডো-কারও কারও বুক পিপের মতো হয় দেখতে। এই প্রথম দেখতে পেল। তার পাগুলো গাছের গুঁড়ির, হাতগুলো শুয়োরের হাঁটু। পরনে হুডঅলা একটা কালো পার্কা, তার ওপরে বেশ কয়েকটা সোয়েটার; সবার ওপরে চড়িয়েছে পুরু ডাঙ্গারিজ। শীত সামলাবার জন্য পরা পোশাকগুলোর সাথে সাদা টেনিস শ্যু মিলে কিম্ভুতকিমাকার লাগছে তাকে।
‘সুরটা একটু কড়া।’ ড্রাইভারের সিট থেকে বলল শ্যাডো।
‘দুঃখিত,’ লজ্জিত কণ্ঠে বলল যুবক, বন্ধ করে দিল গুনগুন করা।
‘আমার ভালোই লাগছে,’ বলল শ্যাডো। ‘থেমো না।’
একটু ইতস্তত করল যুবক, তারপর আবার শুরু করে দিল। আগের মতোই ভরাট কণ্ঠে ভরে উঠল গাড়ির ভেতরটা। তবে এবার ফাঁকে ফাঁকে শব্দ উচ্চারণ করল কিছু। ‘ডাউন, ডাউন, ডাউন।’
রাস্তার সবগুলো দালান আর অফিস বিল্ডিঙে শোভা যাচ্ছে ক্রিসমাসের আলোকসজ্জা। ওগুলো দেখতে দেখতে কখন যে রেস্তোরাঁটা এসে পড়ল, টেরই পেল না শ্যাডো। বার্ণের মতো দেখতে দালানটার সদর দরজায় গাড়ির আরোহীদের নামিয়ে দিয়ে নিজে চলে গেল পার্কিং লটে। ঠান্ডা হাওয়ায় একা একা কিছুক্ষণ হাঁটতে চায় ও।
একটা কালো ট্রাকের পাশে পার্ক করল নিজের গাড়ি, দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। ঠান্ডা বাতাসে বাষ্পে পরিণত হচ্ছে ওর নিশ্বাস। রেস্তোরাঁর ভেতরে কী হচ্ছে তা আঁচ করতে পারছে শ্যাডো। ওয়েনসডে অতিথিদেরকে একটা বড়ো টেবিলে বসাচ্ছেন। সত্যি সত্যি গাড়িতে কালী ছিল নাকি? ভাবল ও। তারচেয়ে বড়ো চিন্তার কথা, পেছনে বসা সেই বারবার ভুলে যাওয়া লোকটা কে?
‘ওই, ম্যাচ আছে?’ কিছুটা পরিচিত, কিছুটা অপরিচিত একটা কণ্ঠের প্রশ্নে সম্বিত ফিরল শ্যাডোর। ঘুরে দাঁড়িয়ে না বলতে যাবে, এমন সময় চুপ হয়ে গেল। কেননা বাঁ চোখের ঠিক সামনেই ধরা আছে একটা পিস্তল। আচমকা ওর পাজোড়া যেন হাল ছেড়ে দিল, পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলাবার জন্য একটা হাত বাড়িয়ে দিল সে। এদিকে কে যেন নরম কিছু একটা ওর মুখে গুঁজে দিয়েছে।
চিৎকার করতে চাইল শ্যাডো, চাইল ওয়েনসডেকে…ওদের সবাইকে সাবধান করে দিতে। কিন্তু অর্থহীন কয়েকটা আওয়াজ ব্যতীত আর কিছু ওর মুখ দিয়ে বের হলো না।
‘টার্গেটরা ভেতরে,’ অর্ধ-পরিচিত কণ্ঠটা বলল। ‘সবাই তৈরি?’ রেডিয়োর অপর প্রান্ত থেকে উত্তর দিলে কেউ প্রশ্নটার। ‘তাহলে কাজে নামা যাক।’
‘এই বিশালদেহীকে নিয়ে কী করব?’ আরেকটা কণ্ঠ জানতে চাইল।
‘নিয়ে চলো।’ প্রথম কণ্ঠটা উত্তর দিল।
ব্যাগের মতো কিছু একটা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো শ্যাডোর মাথা, এরপর হাত আর পা বাঁধা হলো টেপ দিয়ে। ট্রাকের পেছনে ওকে তুলে, রওনা দিল দ্বিতীয় লোকটা।
.
শ্যাডোকে আটকে রাখা ছোট্ট ঘরটায় জানালা নেই। আছে একটা প্লাস্টিকের চেয়ার, ভাঁজ করা যায় এমন একটা টেবিল, আর ঢাকনাসহ একটা বালতি। বালতিটাকে আপাতত টয়লেট হিসেবে ব্যবহার করছে শ্যাডো। মেঝেতে ছয়-ফুট লম্বা একটা ফোম আছে, সঙ্গে পাতলা একটা কম্বল। কম্বলটার মাঝখানে একটা একটা বাদামি দাগ, রক্ত পারে…আবার হতে পারে পায়খানাও! অনুসন্ধানের ইচ্ছে নেই শ্যাডোর। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা নগ্ন বাতি জ্বলছে, কিন্তু সুইচ নেই দেয়ালে। সবসময় জ্বলছে তো জ্বলছেই। একটা দরজাও আছে বটে, কিন্তু সেটায় হ্যান্ডেল নেই।
ক্ষুধা পেয়েছে শ্যাডোর।
কিম্ভূত লোকগুলো ওর হাত-পায়ের বাঁধন আর মুখের গোঁজ খোলার পর, ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে এই ঘরটার। প্রথম যে কাজটা শ্যাডো করেছে, তা হলো ঘরের ভেতরটা সাবধানতার সাথে ঘুরে দেখা। দেয়ালে আঘাত করে দেখেছে, কেমন যেন ধাতব আওয়াজ শুনতে পেয়েছে ফলশ্রুতিতে। দেয়ালের একদম ওপরের দিকে রয়েছে একটা ছোটো গ্রিড, বাতাস চলাচলের জন্য। দরজা ভালোভাবে বন্ধ করা।
এরপর নিজের দিকে নজর দিয়েছে ও, বুঝতে পারছিল যে বাঁ ভ্রুর উপর থেকে আস্তে আস্তে রক্ত ঝরছে। মাথাটাও যন্ত্রণা করছিল খুব।
মেঝেতে কার্পেট-টার্পেটের বালাই নেই। পা ঠুকে দেখেছে, মেঝে থেকেও ধাতব আওয়াজ আসছে!
বালতির ঢাকনা সরিয়ে ওতে প্রস্রাব করে হালকা হয়ে নিয়েছে ও, নিজস্ব হিসাব অনুযায়ী আক্রান্ত হবার পর মাত্র ঘণ্টা চারেক পার হয়েছে।
ওয়ালেট নেই পকেটে, কিন্তু পয়সাগুলো নেয়নি কিম্ভূতেরা।
চেয়ারে বসে পড়ল যুবক। পয়সার খেলা খেলতে শুরু করল ও। প্রথমে নিচ থেকে পয়সা টেবিলের ভেতর দিয়েই কীভাবে ওপরে আনা যায়, সেই অনুশীলন করল। এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়ল অন্যান্য খেলায়।
দরকারও ছিল। অনুশীলনের সময় শ্যাডো তার পূর্ণ মনোযোগ ব্যয় করে। অন্যভাবে বলতে গেলে, মনের ভেতর ক্রোধ বা বিভ্রান্তি থাকলে, পয়সার খেলা সম্ভব হয় না ওর পক্ষে। তাই কেন জানি পয়সা হাতে নিলেই শান্ত হতে শুরু করে ওর মন, ভয় আর বিভ্রান্তি দূর হয়ে যায়।
অনুশীলন করছে আর ভাবছে, ওকে কি এই কিম্ভূত লোকগুলো খুন করে ফেলবে? ভাবনাটা মনে আসা মাত্র হাতটা যেন একটু কেঁপে উঠল। টেবিলের উপর পড়ে গেল পয়সা।
এখন আর হবে না বুঝতে পেরে, পয়সাগুলো সরিয়ে নিলো শ্যাডো। হাতে রইল কেবল যরিয়া পলুনোচনেয়ার দেওয়া লিবার্টির ছবিঅলাটা। শক্ত করে চেপে ধরল ওটাকে মুঠোয় নিয়ে।
শুরু হলো অপেক্ষা।
.
ভোর প্রায় তিনটার সময়, কিম্ভূতেরা ফিরে এলো ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে। দুজন মানুষ, কালো স্যুট পরে আছে। চুলগুলোও কালো, কালো পায়ের জুতোজোড়াও। একজনের চিবুক চারকোনা, কাঁধ প্রশস্ত, দেখে মনে হয় কলেজে থাকার সময় ফুটবল খেলত। কেবলমাত্র নখের অবস্থা বাজে, প্রায় সবগুলো দাঁতে-কাটা! অন্যজনের বয়স একটু বেশি; মাথার চুল কমে এসেছে, চোখে রুপালি রিমের চশমা। এ আবার তার নখগুলোর বেশ ভালোই যত্ন নেয়। দুজনের মাঝে মিল নেই। তবে শ্যাডোর মনে হলো, অন্তরের অন্তস্তলে দুজন আসলে একই অস্তিত্ব। টেবিলের দুই পাশে দাঁড়াল দুই কিম্ভূত, ওর দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে।
‘কার্গোর হয়ে কতদিন হলো কাজ করছেন, স্যার?’ একজন প্রশ্ন করল। ‘কার্গো? মানে?’
‘নিজেকে ওয়েনসডে নামে পরিচয় দেয় সে…আবার কখনও সর্ব-পিতা বলে।’
‘কয়েকদিন হবে।’
‘আমাদের সাথে মিথ্যা বলবেন না, স্যার।’ চশমাঅলা কিম্ভূতের মন্তব্য।
‘ঠিক আছে, বললাম না। আসলেই কয়েকদিন হয়েছে।’
চৌকা-চোয়াল কিম্ভূত ঝুঁকে এসে শ্যাডোর কানটা দুই আঙুলের ফাঁকে ধরল। একই সাথে মোচড়াতে আর চাপ দিতে শুরু করল সে। প্রচণ্ড ব্যথা পেল ও। ‘মিথ্যা বলতে মানা করেছিলাম, স্যার।’ বলেই ছেড়ে দিল কান।
দুই কিম্ভূতেরই জ্যাকেটের নিচে বন্দুক আছে, ফোলা দেখেই টের পাচ্ছে শ্যাডো। তাই প্রতি-আক্রমণ করতে গেল না। এমনভান করল যেন ফিরে গেছে জেলে। মাথা নিচু করে থাকো, ভাবল শ্যাডো। এমন কিছু ওদেরকে বোলো না, যা তারা ইতিমধ্যেই জানে। আর প্রশ্নটা তো ভুলেও করো না।
‘এই লোকগুলো খুব বিপজ্জনক, স্যার,’ চশমাঅলা কিম্ভূত বলল। ‘ওদের বিরুদ্ধে তথ্য দিয়ে নিজের আর দেশের উপকারই করবেন, স্যার।’ সহানুভূতির হাসি হাসল সে।
‘ওহ।’ কেবল এতটুকুই বলল শ্যাডো।
‘আর যদি সাহায্য না করেন, স্যার।’ চৌকা-চোয়াল বলল। ‘অখুশি হলে আমরা যে পশু হয়ে যাই, তা নিজের চোখেই দেখতে পাবেন।’ হাত মুঠি না করেই শ্যাডোর পাকস্থলীতে মাপা হাতের আঘাত হানল সে। নাহ, অত্যাচার শুরু হয়নি। কেবল নিজের অত্যাচার করার ইচ্ছার প্রমাণ দিল লোকটা।
‘আমি আপনাদের দুজনকেই খুশি করতে চাই।’ দম ফিরে পেলে বলল শ্যাডো।
‘আপনার সহযোগিতা চাই কেবল, স্যার।’
‘আমি কি জানতে পারি…’ বলতে বলতেই আঁতকে উঠল ও (ইস, প্রশ্ন করা উচিত হয়নি)। …কাদেরকে সহযোগিতা করছি?’
‘আমাদের নাম জানতে চাচ্ছেন?’ চৌকা কিম্ভূত জিজ্ঞেস করল। ‘ফাজলামি নাকি?’
‘নাহ, লোকটার কথায় যুক্তি আছে,’ চশমা কিম্ভূত বলল। ‘এতে আমদেরকে তথ্য দেওয়াটা ওর জন্য সহজ হবে।’ এমনভাবে হাসল লোকটা যেন টুথপেস্টের বিজ্ঞাপন করছে। ‘আমি মিস্টার স্টোন। আর আমার সহকর্মী, মিস্টার উড।’
‘আসলে,’ বলল শ্যাডো। ‘আমি জানতে চাচ্ছিলাম, আপনারা কোন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করছেন?’
মাথা নাড়ল স্টোন। ‘আহ, প্রশ্নটার উত্তর খুব একটা সহজে দেওয়া সম্ভব না।’
‘সরকারি প্রতিষ্ঠান,’ বলল উড। ‘বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এরকম শত শত প্রতিষ্ঠান এখন মাঠে নেমেছে, জানেনই তো!’
‘তবে এতটুকু নিশ্চয়তার সাথে বলতে পারি,’ আবারও সুন্দর করে হেসে বলল স্টোন। ‘আমরা ভালোর পক্ষে। আপনার ক্ষুধা লেগেছে, স্যার?’ বলে পকেট থেকে একটা স্নিকারস বার বের করল সে। ‘এই নিন, উপহার।’
‘ধন্যবাদ,’ শ্যাডো বললেন। বারটা খুলে মুখে দিল ও।
‘সাথে পান করার জন্য কিছু নেবেন? কফি? বিয়ার?’
‘পানি হলে ভালো হয়।’
দরজার কাছে চলে গেল স্টোন, নক করে ওপাশে দাঁড়ানো গার্ডকে বলল কিছু একটা। একটু পরেই ফিরে এলো পলিস্টাইরিন কাপ ভরতি পানি নিয়ে।
‘সিআইএ,’ বলল উড। মাথা নাড়তে নাড়তে যোগ করল। ‘ওই বলদগুলোকে নিয়ে নতুন একটা কৌতুক শুনলাম, বুঝেছ স্টোন? শোনো, কেনেডি হত্যার পেছনে যে সিআইএর হাত নেই, সেটা নিশ্চিত হবে কী করে?’
‘আমি জানি না,’ বলল স্টোন। ‘কীভাবে?’
‘হত্যাকাণ্ডটা সফল হয়েছে যে, তাই!’ হাসিতে ফেটে পড়ল দুজন।
‘পানি খেতে ভালো লাগছে, স্যার?’ জানতে চাইল স্টোন।
‘কিছুটা।’
‘তাহলে আজ সন্ধ্যায় কী কী করলেন, সেগুলো বলুন, স্যার।’
‘পর্যটকরা যা করে, তাই। আমরা হাউজ অন দ্য রকে গেলাম, সেখান থেকে একটা রেস্তোরাঁয়। বাকিটা তো আপনাদের জানা।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল স্টোন, হতাশা ভরে মাথা নাড়ল উড নিজেও। নাড়তে নাড়তেই লাথি হাঁকাল শ্যাডোর মালাইচাকি লক্ষ করে। তীব্র ব্যথায় আরেকটু হলেই চিৎকার করে উঠছিল ও। কিন্তু এক মুহূর্ত সামলাতে না দিয়ে শ্যাডোর পিঠে মুঠো বসিয়ে দিল কিম্ভূত। হাত না সরিয়ে গিঁট দিয়ে চাপ দিতে শুরু করল কিডনির ঠিক ওপরে। এই ব্যথাটা যেন হাঁটুর ব্যথার চাইতেও বেশি।
আমি এই দুজনের চাইতেও দশাসই, ভাবল ও। ওদেরকে চাইলেই শায়েস্তা করতে পারি। কিন্তু না, অস্ত্র আছে দুজনের কাছেই। এদেরকে সামলাতে পারলেও, সেল থেকে বেরোনো হবে না (তবে হ্যাঁ, একটা না…দুটো বন্দুক থাকবে তখন ওর হাতে…নাহ, থাক)।
শ্যাডোর চেহারা থেকে হাত সরিয়ে রাখছিল উড, যেন কোন দাগ না পড়ে যায়। মারগুলো মাপা, ব্যথা দেবার উদ্দেশ্যেই মারা। শ্যাডো লিবার্টির মুখ ছাপা পয়সাটা আরও জোরে আঁকড়ে ধরল, কখন এই মার-পিট শেষ হবে—সেই অপেক্ষায়।
বেশ অনেক… অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো ওকে।
‘কয়েক ঘণ্টা পরেই আবার আপনার সাথে দেখা হচ্ছে, স্যার।’ বলল স্টোন। ‘উডি কিন্তু ওসব অত্যাচার-টত্যাচার করা পছন্দ করে না। আমরা দুজন যুক্তি মেনে চলি। বললাম না, আমরা ভালোর পক্ষে? আপনি ভুল দলে নাম লিখিয়েছেন। খানিকক্ষণ নাহয় ঘুমিয়ে নিন।’
‘আমাদেরকে আরেকটু সিরিয়াসলি নিবেন আশা করি।’ যোগ করল উড। ‘আমারও তাই আশা,’ বলল স্টোন। ‘ভেবে দেখবেন কিন্তু।’
ধাম করে দরজা লাগিয়ে বিদায় নিলো দুজন। শ্যাডো আশা করল, বাতিটা নিভিয়ে যাবে হয়তো। কিন্তু সেই আশার গুড়ে বালি। মাথার ওপরে এখনও জ্বলজ্বল করছে বাতিটা। কোনোরকমে নিজেকে টেনে নিয়ে গেল ও ফোমের ওপরে। এরপর কম্বলটা জড়িয়ে নিয়ে চোখ বন্ধ করল।
হারিয়ে গেল স্বপ্ন রাজ্যে।
.
এখন ওর বয়স পনেরো। মারা যাচ্ছেন ওর মা, খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা বলছেন তিনি। কিন্তু বুঝতে পারছে না সে।
.
ঘুমের মাঝেই নড়ল শ্যাডো, তীব্র ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল যেন।
পাতলা কম্বলের নিচে কাঁপছে ও, হাত দিয়ে বাতির আলো ঢাকার প্রয়াস পাচ্ছে। ওয়েনসডে আর অন্যরা কি এখনও মুক্ত আছে? বেঁচে আছে তো?
রুপালি ডলারটা শীতল লাগছে ওর, ওটা কেন তার শরীরের উষ্ণতায় গরম হচ্ছে না, তাই ভাবল মনে মনে। আধা-ঘুম…আধা-জাগরণে কেন যেন স্বাধীনতা, চাঁদ, যরিয়া পলুনোচনেয়া এক হয়ে মিলে-মিশে গেল! রূপ নিলো স্বর্গ থেকে নামা রুপালি আলোর স্তম্ভে। আস্তে আস্তে ওটা ধরে ওপরে উঠতে শুরু করল শ্যাডো। ওর ব্যথা, ওর ভয় সব যেন আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে।
আচমকা অনেকদূর থেকে যেন ভেসে এলো একটা আওয়াজ। কিন্তু ততক্ষণে ঘুমের হাতে নিজেকে সমর্পণ করে দিয়েছে শ্যাডো।
.
কোথাও…কোনো একজন সাহায্যের জন্য চিৎকার করছে। হয়তো ওর স্বপ্নে…অথবা সত্যি সত্যি।
ফোমের উপর থেকে গড়িয়ে নামল শ্যাডো, এমন এমন জায়গায় ব্যথা পেল যার অস্তিত্বের কথা আগে জানাতই না। মনে হলো, কেউ যেন ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকাচ্ছে! ধমক দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইল ও, ঘুমাতে চায়। কিন্তু মুখ দিয়ে বেরোল শুধু একটা ঘোঁত শব্দ
‘পাপি?’ বলল লরা। ‘উঠে পড়। উঠে পড়ো, সোনামণি।’
স্বস্তির একটা পরশ বয়ে গেল ওর দেহজুড়ে। কেমন এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছিল এতক্ষণ, জেলের স্বপ্ন…দেবতা আর ঈশ্বরের স্বপ্ন। এখন লরা এসেছে ওকে ডেকে তুলতে। কাজে যেতে হবে তো। সুযোগ পেলে হয়তো কফির একটা কাপ শেষ করা যাবে…স্ত্রীর নরম ঠোঁটে চুমু বসাবার সম্ভাবনাও রয়েছে। হাত বাড়িয়ে লরাকে স্পর্শ করল ও।
বরফ শীতল…আঠালো একটা মাংসে হাত পড়ল শ্যাডোর।
চোখ খুলল ও।
‘এত রক্ত কেন?’ জানতে চাইল সে।
‘আমার না,’ বলল মেয়েটা। ‘অন্য মানুষের রক্ত। আমার দেহে এখন রক্ত নেই। আছে তো শুধু ফরমালডিহাইড, গ্লিসারিন আর লিনোলিন।’
‘অন্য মানুষ বলতে?’ আঁতকে উঠল যেন শ্যাডো।
‘গার্ডদের।’ উত্তর পেল। ‘ভয় পেয়ো না। আমি ওদেরকে খুন করেছি। যাই হোক, উঠে পড়ো। অনেকদূর যেতে হবে তোমাকে। কেউ অ্যালার্ম বাজাবার সময় পেয়েছে বলে মনে হয় না। তবে যাবার আগে একটা কোট নিয়ে যেয়ো, বাইরে তীব্র ঠান্ডা।’
‘খুন করেছ মানে?’
শ্রাগ করে বিব্রত ভঙ্গিতে হাসল মেয়েটা। হাত দেখে মনে হচ্ছিল যেন মেয়েটা এতক্ষণ তুলির বদলে আঙুল দিয়ে আঁকা-আঁকি করেছে। যে ছবিতে রং হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে শুধু লাল রঙ। চেহারা আর কাপড়ে এখনও রক্তের ছোপ লেগে আছে। লরার পরনে সেই নীল স্যুট।
‘নিজে মৃত হলে, মানুষকে খুন করা সহজ হয়ে যায়।’ ওকে জানাল লরা। ‘মানে, বলতে চাইছি—ব্যাপারটা তখনও আর এত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় না। বিবেকও বাধা দেয় না।’
‘আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ!’ জানাল শ্যাডো।
‘সকালের ক্রুরা আসার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাও নাকি?’ প্রশ্ন করল লরা। ‘চাইলে থাকতে পারো। তবে আমার ধারণা পালালেই ভালো করবে।’
‘সবাই সন্দেহ করবে, কাজটা আমিই করেছি।’ বোকার মতো বলল শ্যাডো।
‘হয়তো,’ বলল লরা। ‘সোনামণি, কোট পরে নাও। বাইরে ঠান্ডা।’
করিডরে চলে এলো শ্যাডো, ওটার শেষ মাথায় একটা গার্ড রুম। ঘরের ভেতরে পড়ে আছে চারটা লাশ, এদের তিনজন অচেনা গার্ড। অন্যজন স্টোন নামে নিজেকে পরিচয় দেওয়া লোকটা। তার বন্ধু, উডকে কোথাও দেখা গেল না। মেঝেতে রক্তের দাগ দেখে বুঝতে পারল ও, ওদের দুজনকে টেনে আনা হয়েছে ঘরের ভেতরে।
ওর নিজের কোটটাও দেখতে পেল, দেয়ালে ঝোলানো। কেউ স্পর্শ করেছে বলেও মনে হলো না। ক্যান্ডিবার ভরতি একটা কার্ডবোর্ডের বাক্স টেনে আনল লরা। গার্ডদের পরনে ছিল কালো…ক্যামোফ্লাজ ইউনিফর্ম। কিন্তু তাতে কোনো রকমের ট্যাগ দেখতে পেল না শ্যাডো। তাই কাদের হয়ে তারা কাজ করছে, সেটাও বুঝতে পারল না।
নিজের ঠান্ডাটা হাতটা দিয়ে শ্যাডোর হাতে চাপ দিল লরা। সোনালি পয়সাটা দিয়ে নেকলেস বানিয়ে গলায় ঝুলিয়েছে সে।
‘ভালো মানিয়েছে।’ প্রশংসা করল শ্যাডো।
‘ধন্যবাদ।’ সুন্দর করে হাসল লরা।
‘মি. ওয়েনসডে আর অন্যদের খবর জানো? কোথায় তারা?’ শ্যাডোর প্রশ্নের উত্তরে একগাদা ক্যান্ডিবার এগিয়ে দিল লরা, সেগুলোকে পকেটে পুরল ও।
‘এখানে তুমি ছাড়া আর কাউকে পাইনি। আমি ভয় পাচ্ছিলাম, তোমার ক্ষতি করে বসতে পারে এরা। বলেছিই তো, তোমার উপর নজর রাখব আমি। যাই হোক, এগুলো নাও।’ বলে কয়েকটা কেমিক্যাল প্যাড এগিয়ে দিল ও। পাতলা প্যাডগুলো হাত আর পা গরম রাখে, একেকটা দিয়ে কাজ চলে যায় বেশ কয়েক ঘণ্টা। কৃতজ্ঞতার সাথেই ওগুলো নিলো শ্যাডো।
‘তা বলেছিলে।’
একটা আঙুল বাড়িয়ে ওর বাঁ ভ্রুর ওপরে বুলিয়ে দিল লরা। ‘আঘাত পেয়েছ!’
‘আমি ঠিক আছি।’
ধাতব দরজার মাঝখানে অবস্থিত একটা দরজা খুলল শ্যাডো, আস্তে আস্তে খুলে গেল ওটা। মাটি চার-ফুট নিচে। লাফিয়ে নামল সে, মনে হলো যেন নুড়ির ওপর নামছে। লরার কোমর ধরে নামিয়ে আনল মেয়েটাকেও। আগেও অনেকবার কোলে নিয়েছে ও মেয়েটাকে…দ্বিতীয়বার ভাবেওনি…
এতক্ষণ অন্ধকার মেঘের আড়ালে লুকিয়ে ছিল চাঁদ, এখন বাইরে বেরিয়ে এলো। অস্ত যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে যে আলো আছে তাতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে চারপাশ।
পিছু ফিরে তাকাল শ্যাডো। বুঝতে পারল, এতক্ষণ ওকে একটা ফ্রেইট ট্রেনের কালো, ধাতব বগিতে রাখা হয়েছিল! পরিত্যক্ত ট্রেনটা, যতদূর দেখা যায় কেবল বগি আর বগি। আগেও এরকম ট্রেনে উঠেছে ও, ধরতে পারা উচিত ছিল।
‘আমাকে খুঁজে পেলে কী করে?’ মৃতা স্ত্রীর কাছে জানতে চাইল ও।
আস্তে আস্তে মাথা তুলল লরা। ‘অন্ধকার দুনিয়াতে আলো যেমন পরিষ্কার দেখা যায়, আমার চোখেও তুমি তেমন। খুব একটা কষ্ট হয়নি। যাই হোক, রওনা দাও। যত তাড়াতাড়ি পার, যতদূর সম্ভব চলে যাও। আর ভালো কথা, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করো না। তাহলে আর সমস্যা হবে না।’
‘কোথায় যাবো?’
মাথার চুলে হাত বুলাল লরা। ‘রাস্তাটা ওদিকে, যেভাবেই হোক দক্ষিণে চলে যাও। দরকার হলে গাড়ি চুরি করো।’
‘লরা,’ বলে ইতস্তত করতে লাগল শ্যাডো। ‘এসব কী হচ্ছে, জানো? এরা কারা? কাদেরকে খুন করলে তুমি?’
‘হুম,’ উত্তর দিল মেয়েটা। ‘সম্ভবত জানি।’
‘অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমাকে,’ বলল শ্যাডো। ‘তুমি না এলে এখনও আটকা থাকতে হতো আমাকে, মনে হয় না ছেড়ে দিত।’
‘নাহ,’ বলল লরা। ‘আমারও তা মনে হয় না।’
খালি বগিগুলোপার হয়ে এলো ওরা। শ্যাডো আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরল রুপালি পয়সা। যরিয়া পলুনোচনেয়া আর তার স্মৃতির কথা মনে পড়ে গেল: কেন এসেছিল, জানতে চেয়েছ? মৃত মানুষের কাছে প্রাপ্ত জ্ঞানে কোনো খাদ থাকে না।
‘লরা…তুমি কী চাও?’ প্রশ্ন করল শ্যাডো।
‘তুমি সত্যি সত্যি জানতে চাও?’
‘হ্যাঁ, অবশ্যই।’
মৃত একজোড়া নীল চোখ দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল মেয়েটা। ‘আবার বাঁচতে চাই। এরকম জিন্দালাশ হয়ে থাকতে চাই না। হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি অনুভব করতে চাই, পেতে চাই শিরা-উপশিরায় বয়ে চলা রক্তের স্পন্দন টের পেতে। যতক্ষণ রক্ত বইতে থাকে, ততক্ষণ কেউ টের পায় না। কিন্তু যখন বন্ধ হয়, তখন বোঝা যায় অনুভূতিটা কেমন দারুণ ছিল।’ হাত দিয়ে চোখ ঘষল মেয়েটা, রক্ত লেগে গেল ওর চেহারায়। ‘এই জীবনটা খুব কঠিন, পাপি! জানো, আমার মতো জিন্দালাশ কেন রাতেই বের হয় কেবল? কারণ রাতের আঁধারে নিজেকে জ্যান্ত মানুষ বলে চালিয়ে দিতে কষ্ট হয় না আমাদের। কিন্তু আমি চাই বাঁচতে, বেঁচে থাকা কারও অনুকরণ করতে নয়!’
‘আমি বুঝতে পারছি না, আমার কাছে কী চাও তুমি।’
‘আমি চাই, তুমি আমার এই আশাটাকে পূর্ণ করো। আমি জানি সোনামণি, চাইলে তুমি পারবে।’
‘ঠিক আছে,’ বলল ও। ‘আমি চেষ্টা করব। আর যদি কীভাবে কাজটা করতে হবে তা বুঝতে পারি, তাহলে তোমাকে খুঁজে পাব কীভাবে?’
উত্তর পেল না, মেয়েটা নেই! চলে গেছে! চারপাশের এই বনের ভেতর একা একা দাঁড়িয়ে আছে এখন ও। আকাশের এক ফালি আলো দেখে বুঝতে পারছে, পূর্ব কোনদিকে। কানে ভেসে এলো রাতের পাখির শেষ চিৎকার, চেহারায় পেল ডিসেম্বর মাসের ঠান্ডা বাতাসের স্পর্শ
এসব কিছুকে সঙ্গী বানিয়ে দক্ষিণ দিকে হাঁটা ধরল শ্যাডো।