অধ্যায় চার
লেট দ্য মিডনাইট স্পেশাল শাইন ইটস লাইট অন মি,
লেট দ্য মিডনাইট স্পেশাল সাহিন ইটস এভার লাভিং লাইট অন মি।
–‘দ্য মিডনাইট স্পেশাল’ গানটি থেকে নেওয়া
.
মোটেল আমেরিকা রাস্তার যে পাশে অবস্থিত, তার উলটো পাশের কাউন্টি কিচেনে সকালের নাস্তা সেরে নিলো শ্যাডো আর ওয়েনসডে। আটটা বাজে ঘড়িতে, দুনিয়া এখনও কুয়াশার চাদরে মোড়া।
‘আসলেই ইগল’স পয়েন্ট ছাড়তে চাও?’ জানতে চাইলেন ওয়েনসডে। তাহলে কয়েকটা ফোন সারতে হবে। আজ শুক্রবার, মেয়েদের দিন, আরামের দিন। আগামীকাল শনিবার, শনিবারে অনেক কাজ করতে হবে।’
‘চাই,’ উত্তর দিল শ্যাডো। ‘এখানে থাকার কোনো কারণ দেখছি না।’
বেশ কয়েক পদের মাংসের তরকারি সামনে নিয়ে বসে আছেন ওয়েনসডে। শ্যাডো অবশ্য তরমুজ, একটা বেগল আর পনির ছাড়া কিছু নেয়নি।
‘তোমার গত রাতের স্বপ্নটা খুব অদ্ভুত ছিল!’ বললেন প্রৌঢ়।
‘তা ছিল,’ মেনে নিলো শ্যাডো। সকালে উঠে কার্পেটে পরিষ্কার দেখতে পেয়েছে সে লরার কর্দমাক্ত পায়ের ছাপ। সেই ছাপ ঘর ছাড়াও লবি, এমনকি করিডরেও ছিল!
‘আচ্ছা,’ প্রশ্ন করলেন ওয়েনসডে। ‘তোমার নাম শ্যাডো কেন?’
শ্রাগ করল শ্যাডো। ‘নাম তো নামই, আর আমার এই নামের পেছনে অন্য কোনো কারণ নেই। বাইরের দুনিয়াটাকে দেখে যেন পেন্সিলে আঁকা ছবি বলে মনে হচ্ছে। এখানে-সেখানে মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে নানা গাঢ়ত্বের ধূসর রঙ। কখনও কখনও হয়তো একটু লাল রং মাখানো, তবে অধিকাংশই এখনও সাদা ‘আপনার চোখ নষ্ট হয়েছে কীভাবে?’
বেকনের আধা-ডজন টুকরা একসাথে গালে পুরলেন ওয়েনসডে। খানিকক্ষণ চেবানোর পর মুখে লেগে থাকা চর্বিটুকু মুছে ফেললেন হাত দিয়ে। ‘নষ্ট হয়নি।’ বললেন তিনি। ‘এমনকী ওটা কোথায় আছে তা-ও জানি।
‘এবার কী করব আমরা?’
চিন্তিত দেখাল ওয়েনসডেকে। ‘বলছি শোনো, আগামীকাল আমরা কয়েকজনের সাথে দেখা করতে যাবো। এরা সবাই যার যার ক্ষেত্রে সেরা-তাদের আচরণে প্রভাবিত হয়ো না বা ভয় পেয়ো না। এরপর আমরা সবাইকে এক করব এই দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোর একটাতে। ওদেরকে আমরা আপ্যায়ন করব সেখানে। আসলে একটা বিশেষ কাজে ওদের সহায়তা চাই আমার।’
‘তা এই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটা কোথায়?’
‘সময় হলেই দেখতে পাবে, বাছা। আর জায়গাটা না, জায়গাগুলোর একটা। যাই হোক, আমি খবর পাঠিয়ে দিয়েছি। পথে আমরা শিকাগোতে থামব, আমার কিছু টাকা দরকার। যেভাবে আমি তাদের আপ্যায়ন করতে চাই, তাতে অনেক টাকা লাগবে। আমার কাছে এত নেই। এরপর রওনা দেব ম্যাডিসনের দিকে।’ বিল চুকিয়ে দিয়ে মোটেলের পার্কিং লটের দিকে রওনা দিলেন তারা। গাড়ির কাছে এসে শ্যাডোর দিকে চাবি ছুড়ে দিলেন তিনি।
গাড়ি চালিয়ে শহরের বাইরে নিয়ে এলো তাকে শ্যাডো।
‘জায়গাটার কথা মনে পড়বে খুব?’ একগাদা মানচিত্র ঘাটতে ঘাটতে জানতে চাইলেন ওয়েনসডে।
শহরটার কথা? নাহ, আসলে ওখানে আমার কোনো জীবন ছিল না! কমবয়সে আমি কখনও এক শহরে বেশি দিন থাকতাম না। এখানে এসেছি যখন, তখন বিশ শেষ হয়ে ত্রিশের দিকে এগোচ্ছে বয়স। তাই শহরটাকে লরার শহর বলা চলে, আমার না।
‘প্রার্থনা করো যেন মেয়েটা ওই শহরেই থাকে।’ বললেন ওয়েনসডে।
‘আহ, ভুলে গেলেন? গত রাতের ব্যাপারটা তো স্বপ্ন ছিল!’
‘ঠিক বলেছ। ঘটনাটাকে স্বপ্ন বলে ধরে নেওয়াই ভালো। যাক গে, তা কাল রাতে কিছু করেছ-টরেছ নাকি?’
লম্বা করে শ্বাস নিলো শ্যাডো। ‘তা জেনে আপনার কী?’ একটু থেমে যোগ করল, ‘না।’
‘ইচ্ছা হয়েছিল?’
উত্তর দিল না শ্যাডো, চুপচাপ উত্তরে, শিকাগোর দিকে চালাল গাড়ি। মুচকি হাসলেন ওয়েনসডে, মানচিত্রের দিকে মন দিলেন। মাঝে মাঝে হলদে একটা প্যাডে কী সব যেন টুকেও নিলেন তিনি।
একসময় শেষ হলো তার কাজ। কলম সরিয়ে রেখে মানচিত্রগুলো ভরে নিলেন একটা ফাইলে। তারপর সেটা রেখে দিলেন পেছনের সিটে। ‘আমরা যেসব রাজ্যে যাচ্ছি, মিনেসোটা, উইসকনসিন ইত্যাদি, সেগুলোর সবচেয়ে বড়ো সুবিধা হলো—ওসব জায়গায় হাত বাড়ালেই মেলে আমার পছন্দ মতো মেয়ে মানুষ। সাদাটে ত্বক, নীল চোখ, চুলের রং হালকা যে প্রায় সাদা বর্ণ; লালচে ঠোঁট, বড়ো বড়ো বুক…আহ! কমবয়সে এরকম মেয়ে পেলে আর ছাড়তাম না!’
‘বেশি বয়সে বুঝি খুব ছাড়েন?’ জানতে চাইল শ্যাডো। ‘গতরাতে আপনার ঘরে যে দৃশ্য দেখলাম, তাতে কথাটা মানা কঠিন হয়ে গেল।’
‘ওহ, গতরাত,’ মুচকি হাসি দেখা গেল ওয়েনসডের চেহারায়। ‘আমার সফলতার রহস্য বলব?’
‘কী? পয়সা খরচ?’
‘ওসব না। রহস্যটা হলো আবেদন। নিখাঁদ আবেদন।’
‘তাই নাকি? তবে এই আবেদন হলো এমন এক জিনিস, যা থাকলে আছে…আর না থাকলে নেই।’
‘ভুল, অন্য সব কিছুর মতো সেটাও শেখা যায়।’ বললেন ওয়েনসডে।
পুরাতন একটা রেডিয়ো চ্যানেল ধরল শ্যাডো। এমন সব গান শোনায় সেগুলো, যা ও জন্মাবার আগেই প্রাচীন তকমা ধারণ করেছে। বব ডিলান শোনালেন নিরেট বৃষ্টির কথা। শ্যাডো ভাবতে শুরু করল, অমন বৃষ্টি কী আসলেই ঝরেছে? নাকি সামনে ঝরবে? রাস্তাটা খালি, অ্যাস্ফল্টের উপর পড়ে থাকা বরফের টুকরাগুলো হীরক খণ্ডের মতো ঝিক-ঝিক করছে।
.
মাইগ্রেন যেমন ধীরে ধীরে…জানান দিয়ে আসে, তেমনি ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো শিকাগো। হাইওয়েতে ওদের গাড়ির আশপাশে ছিল গ্রাম্য পরিবেশ। এরপর টুকরা টুকরা মফস্বল শহর আর ইতস্তত বাড়ি-ঘর। আচমকা দেখা গেল, শিকাগো চোখের সামনেই!
কালো একটা বাদামি পাথরের দালানের সামনে পার্ক করা হলো গাড়ি। ফুটপাতে তুষারের নাম-গন্ধ নেই, সম্প্রতি পরিষ্কার করা হয়েছে বোধ হয়। লবিতে এসে প্রবেশ করলেন তারা। ধাতব ইন্টারকম বক্সের একদম ওপরের বোতামটা টিপলেন ওয়েনসডে। হলো না কিছুই। তাই আবার চাপলেন, এরপর কী ভেবে সবগুলোই চাপতে শুরু করলেন। তবুও কিস্যু হলো না!
‘নষ্ট,’ সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকা এক বুড়ি মহিলা জবাব দিল। ‘কাজ করে না। বাড়ির সুপারকে অনেকবার বলেছি ঠিক করতে। কিন্তু লাভ নেই, গা করে না ব্যাটা। হিটারে কথা বলতে বলতেও মুখে ফেনা তুলে ফেললাম! কিন্তু নিজে শীতে অ্যারিজোনায় চলে যায় বলে সেটা নিয়েও তার মাথাব্যথা নেই।’ মহিলার কথায় আঞ্চলিক টান। পূর্ব ইউরোপে জন্ম সম্ভবত, ভাবল শ্যাডো।
বাউ করলেন ওয়েনসডে। ‘যরিয়া, আমার প্রিয়, দারুণ লাগছে তোমাকে দেখতে। বয়স এক বিন্দু বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে না!’
বুড়ি মহিলা চোখ ছোটো ছোটো করে তাকাল তার দিকে। ‘তোমার সাথে সে দেখা করতে চায় না। আমিও চাই না। তোমার আগমের মাঝে আনন্দের কিছুই নেই।’
‘তার কারণ তো জানো—গুরুত্বপূর্ণ কিছু না ঘটলে আমি আসি না।’
ঘোঁত করে উঠল মহিলা। হাতে অনেকগুলো খালি ব্যাগ ধরে আছে, পরনে লাল একটা কোট। একেবারে গলা পর্যন্ত বোতাম বন্ধ করা পুরনো কোটটার। সন্দেহের চোখে শ্যাডোর দিকে তাকাল সে।
‘এই বিশালদেহী আবার কে?’ প্রশ্ন করল ওয়েনসডের উদ্দেশ্যে। ‘তোমার অনেক খুনির একজন না তো?’
‘আমাকে ভুল বুঝছ। এই ভদ্রলোকের নাম শ্যাডো। সে আমার হয়ে কাজ করছে, মানলাম। কিন্তু তাতে লাভ হচ্ছে তোমাদের। শ্যাডো, পরিচিত হও। ইনি মিস যরিয়া ভেচেরনেয়া।’
‘পরিচিত হয়ে প্রীত হলাম।’ বলল শ্যাডো।
পাখির মতো ঘাড় বাঁকিয়ে ওর দিকে তাকাল বৃদ্ধা। ‘শ্যাডো…ভালো নাম। যখন ছায়া লম্বা হয়ে মাটিতে পড়ে, তখন শুরু হয় আমার সময়। আর তোমার প্রতিচ্ছায়া আসলেই অনেক লম্বা।’ মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার ওকে দেখে নিলো সে, তারপর হাসল; ঠান্ডা একটা হাত বাড়িয়ে দিল তার দিকে। ‘চুমু খাবার অনুমতি দেওয়া যাচ্ছে।’
হাঁটু গেড়ে তাই করল শ্যাডো, মহিলার হাতে অ্যাম্বারের বড়ো একটা আংটি শোভা পাচ্ছে।
‘কী ভদ্র একটা ছেলে!’ বলল মহিলা। ‘আমি এখন মাল-সামান কিনতে দোকানে যাচ্ছি। ভাগ্য গণনা করে আমিই একমাত্র যা একটু কামাই করতে পারি। বাকি দুজন তো একেবারে কিছুই কামাতে পারে না! সব সময় সত্যি কথা বলে যে, তাই। মানুষ আসলে সত্যি কথা শুনতে চায় না। তাই আর ফিরেও আসে না। কিন্তু আমি মিথ্যা বলি; ওদেরকে সে সব কথাই শোনাই, যেগুলো ওরা শুনতে চায়। রাতের খাবার খেয়ে যাবে তো?’
‘আমার তো তাই আশা,’ মন্তব্য করলেন ওয়েনসডে।
‘তাহলে খাবার বেশি করে কিনতে হবে, পয়সা ছাড়ো।’ বলল মহিলা। ‘আমি আত্মাভিমানী হতে পারি, তবে নির্বোধ নই। অন্যরা কিন্তু আমার চাইতেও গর্বিত, আর তার গর্ব তো আকাশ-ছোঁয়া। তাই টাকা দাও, তবে অন্যদেরকে বোলো না।’
ওয়ালেট খুলে একটা বিশ ডলারের নোট বের করে আনলেন ওয়েনসডে। ওটা যেন লুফে নিলো বৃদ্ধা, কিন্তু তবুও জায়গা ছেড়ে নড়ল না। আরেকটা বিশ ডলারের নোট বের করে সেটা যরিয়া ভেচেরনেয়াকে দিলেন ওয়েনসডে।
‘চলবে,’ বললেন মহিলা। ‘আজ রাতে তোমরা খাবে রাজকুমারদের মতো। যাও, ওপরে চলে যাও। যরিয়া উত্রেনেয়া জেগেও আছে, তবে অন্যজন এখনও ঘুমে। তাই সাবধান, আওয়াজ করো না যেন।’
ওয়েনসডেকে সাথে নিয়ে শ্যাডো সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল। দুইটি তালার ঠিক মাঝখানে সিঁড়ির ওপরে কালো প্লাস্টিকের ব্যাগ ভরতি আবর্জনা রাখা। ওখান থেকে পচে যাওয়া সবজির গন্ধ আসছে।
‘এরা কি জিপসি?’ জানতে চাইল শ্যাডো।
‘কারা? যরিয়া আর তার পরিবার? একদম না। ওরা রাশিয়ান, আরও ঠিক করে বলতে গেলে স্লাভ।
‘কিন্তু মহিলা নাকি ভাগ্য গণনা করে?’
‘সে তো অনেকেই করে, আমিও করি মাঝে-সাঝে। হাঁপাতে হাঁপাতে জবাব দিলেন ওয়েনসডে। ‘ইস, মোটা হয়ে গেছি!’
সিঁড়ি গিয়ে শেষ হয়েছে লাল রঙা একটা দরজা পর্যন্ত গিয়ে। ওটার ঠিক মধ্যখানে একটা ছোটো ফুটো। দরজায় নক করলেন ওয়েনসডে। উত্তর এলো না। আবার নক করলেন তিনি, এবার আরেকটু জোরে।
‘শুনেছি তো! শুনেছি!’ তালা খোলার আওয়াজ ছাপিয়ে কণ্ঠটা ভেসে এলো। এরপর চেইন ধরে টানা-হ্যাঁচড়ার শব্দ। অবশেষে একটু ফাঁক হলো লাল দরজাটা। ‘কে?’ কর্কশ কণ্ঠে জানতে চাইল কেউ একজন। কিছুটা বুড়োটে আর অপরিমিত ধূমপানের কারণে বসে যাওয়া গলা।
‘একজন পুরনো বন্ধু, চেরনোবোগ। সাথে লোক আছে।’
দরজাটা খুলল আরেকটু, চেন লাগানো অবস্থায় এর চাইতে বেশি খোলে না। একটা মলিন চেহারা দেখতে পেল শ্যাডো, ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। ‘কী চাই তোমার, ভোটান?’
‘আপাতত তোমার সঙ্গ। দেবার মতো কিছু খবরও এনেছি, তোমার কাজে আসবে।’
এবার পুরোপুরি খুলে গেল দরজা। কর্কশ কণ্ঠটার মালিক এক বয়স্ক লোক। পরনের বাথরোবটা ছোটো, চুল ইস্পাত-ধূসর; রুক্ষ চেহারাটায় কেমন একটা আকর্ষণ রয়েছে, প্যান্টটাও বেশ বয়সি, পায়ে শোভা পাচ্ছে স্লিপার। হাতে একটা ফিল্টার ছাড়া সিগারেট ধরে আছে। টানছে মাঝে মাঝে, তবে হাত উলটো করে তালুর ফাঁকে ধরে আছে জ্বলন্ত দেহটা। জেলের কয়েদিরা যেভাবে ধরে, ভাবল শ্যাডো। অথবা কোন যোদ্ধার মতো। বাঁ-হাতটা ওয়েনসড়ের দিকে বাড়িয়ে দিল লোকটা। ‘তাহলে স্বাগতম, ভোটান। তোমার সাথে এ কে?’
‘আমার পরিচিত একজন। শ্যাডো, মি. চেরনোবোগের সাথে পরিচিত হও।’
‘প্রীত হলাম।’ শ্যাডোর বাঁ হাতটাকে নিজের বাঁ হাতে নিয়ে বলল সে। কড়ে পড়া হাত, টের পেল শ্যাডো। এমন হলদে যে মনে হয় আয়োডিনের বোতলে এইমাত্র হাত চুবিয়ে এসেছে।
‘কেমন আছেন, মি. চেরনোবোগ?
‘বুড়োরা যেমন থাকে। আমার পেট ব্যথা, কোমর সোজা করা কষ্ট। প্রতিদিন সকালে কাশির চোটে ফুসফুস নাক দিয়ে পালাতে চায়!’
‘দরজা আটকে আছ কেন?’ এক মহিলা আচমকা চেরনোবোগের পেছন থেকে জানতে চাইল। লোকটার কাঁধের উপর দিয়ে তাকাল শ্যাডো। এক বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে আছে। বোনের চাইতে আকারে ছোটোখাটো আর রুগ্ন। কিন্তু চুল এখনও সোনালি রঙা। ‘আমি যরিয়া উত্ৰেনেয়া।’ বলল বৃদ্ধা। ‘হলে দাঁড়িয়ে আছ কেন? ভেতরে এসে বসো। আমি কফি দিচ্ছি।’
বিড়ালের বিষ্ঠা, পুড়ে যাওয়া ফুলকপি আর বিদেশি সিগারেটের গন্ধের মাঝে পা দিল যেন শ্যাডো। ওদেরকে পথ দেখিয়ে একটা বসার ঘরে নিয়ে আসা হয়েছে। বিশাল একটা সোফায় বসে আছে ওরা, গদি সম্ভবত ঘোড়ার পশম দিয়ে বানানো হয়েছে। ওদেরকে দেখে বিরক্ত হয়ে আড়মোড়া ভাঙ্গল একটা বয়স্ক বিড়াল। উঠে দাঁড়িয়ে কী যেন শুঁকল, তারপর আবার গিয়ে শুয়ে পড়ল সোফার অন্য পাশে; একে একে সবাইকে একনজর দেখে নিয়ে চোখ মুদল। চেরনোবোগ অবশ্য সোফায় না বসে ওদের উলটো পাশের একটা আর্মচেয়ারে বসল।
যরিয়া উত্রেনেয়া একটা খালি অ্যাশট্রে খুঁজে বের করে লোকটার পাশে এনে রাখল। ‘কফি কি দুধ-চিনিসহ দেব? নাকি ছাড়া?’ জানতে চাইল সে। ‘আমরা পান করি রাতের মতো কালো কফি। তবে পাপের মতো মিষ্টি দিতে ভুল হয় না।’
‘আমার আপত্তি নেই, ম্যাম।’ বলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল শ্যাডো।
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল যরিয়া উত্রেনেয়া।
‘মেয়েটা ভালো,’ বলল চেরনোযোগ, মহিলার গমনপথের দিকে তাকিয়ে আছে। ‘ওর অন্য দুই বোনের মতো নয়। ওদের একজন খুনখুনে, আরেকজন তো সারাটা দিন ঘুমিয়েই কাটায়।’ লম্বা, কিন্তু নিচু একটা কফি টেবিলের উপর পা তুলে দিল লোকটা। টেবিলের ওপরের তলে দাবার বোর্ডের মতো দাগ কাটা।
‘আপনার স্ত্রী?’ জানতে চাইল শ্যাডো।
‘ওই মেয়ে কারও স্ত্রী নয়।’ বলে চুপচাপ কিছুক্ষণ রুক্ষ হাতের দিকে তাকিয়ে রইল বয়স্ক লোকটা। ‘নাহ, আমরা একে-অন্যের আত্মীয়। অনেক অনেক বছর আগে একসাথে এখানে এসেছিলাম, তারপর থেকে একত্রেই আছি।’
বাথরোবের পকেট থেকে এক প্যাকেট সিগারেট বের করল সে। ওয়েনসডে একটা পাতলা, সোনার লাইটার বের করে এনে জ্বালিয়ে দিলেন ওটা। ‘প্ৰথমে পা রেখেছিলাম নিউ ইয়র্কে,’ বলল লোকটা। ‘আমাদের মতো সবাই প্রথমে নিউ ইয়র্কেই যায়। এরপর এখানে এলাম। পরিস্থিতি খুব দ্রুত খারাপের দিকে মোড় নিলো। এমনকি আগে যে দেশে ছিলাম, সেখানেও আমাকে সবাই ভুলতে বসেছে। কিন্তু এখানে এসে দেখলাম, আমি যেন অতীত স্মৃতি। শিকাগোতে পা রেখে কী করেছি জানো?’
‘না।’ উত্তর দিল শ্যাডো।
‘মাংস সরবরাহের ব্যাবসায় একটা চাকরি জুটিয়ে নিলাম। আমার পদটার নাম ছিল নকার, নামটার পেছনের কারণও বলে দেই। কারণ আমার হাতে থাকত একটা স্লেজ হ্যামার, হাতুড়িটার ঘায়ে যে কতো শত গোরু-গাভির ভবলীলা সাঙ্গ করেছি, তার ইয়ত্তা নেই। একটা মাত্র আঘাত, ব্যাম! ব্যস। আসলে কাজটার জন্য দরকার শক্তির। এরপর আরেকজন এসে প্রাণিটার গায়ে শিকল পরিয়ে উঁচু করে ঝোলাত। তারপর গলা কেটে ফেলে রক্ত ঝরিয়ে নিত। আমরা, মানে নকাররা, ছিলাম সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী।’ বাথরোব গুটিয়ে হাতের শক্তিশালী মাংসপেশি দেখাল ও। ‘অবশ্য শুধু শক্তি থাকলেই হয় না, মারতেও জানতে হয়। ঠিকমতো না লাগলে গোরুটা তো মরে না-ই, উলটো খেপে যেতে পারে। এরপর পঞ্চাশের দশকে আবিষ্কৃত হলো বোল্ট-সিস্টেম বন্দুক। কাজটা আরও সহজ হয়ে গেল। মাথা তাক করে…ব্যাম! ব্যাম! হয়তো ভাবছ, যে কেউ এখন খুন করতে পারে। কিন্তু না।’ হাত দিয়ে বন্দুক তাক করার ভঙ্গি করল সে। ‘এখনও এজন্য দক্ষতার বিকল্প নেই।’ স্মৃতিচারণটুকু হাসি ফুটিয়ে তুলল ওর ঠোঁটে, দাগ পড়া দাঁত দেখতে পেল শ্যাডো।
‘গোরু মারার গল্প আর কতো শোনাবে!’ যরিয়া উত্রেনেয়া একটা লালচে কাঠের ট্রেতে করে ওদের কফি নিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বলল। ছোটো ছোটো এনামেলের কাপে ঢেলেছে কফি। সবাইকে একটা করে কাপ দিয়ে বসে পড়ল চেরনোবোগের পাশে।
‘যরিয়া ভেচেরনেয়া বাজারে গেছে,’ বলল সে। ‘চলে আসবে।
‘দেখা হয়েছে সিঁড়িতে।’ জানাল শ্যাডো। ‘শুনলাম, তিনি নাকি ভাগ্য গণনা করেন?’
‘হ্যাঁ, গোধূলি বেলায় করে। মিথ্যা বলার সেটাই উপযুক্ত সময়। আমি মন ভোলানো মিথ্যা বলতে পারি না, তাই গণক হিসেবে ব্যর্থ। আমাদের বোন, যরিয়া পলুনোচনেয়া তো একদমই মিথ্যা বলতে পারে না।’
কড়া, কিন্তু মিষ্টি কফিটা শ্যাডোকে একটা ধাক্কা দিয়ে গেল; এমনটা সে একদম আশা করেনি। সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে বাথরুমের দিকে গেল ও, ঘরটা ক্লজিটের চাইতে বড়ো হবে না। অনেকগুলো পুরনো ফটোগ্রাফ ঝুলছে দেয়ালে, নানা পোজে তাতে দেখা যাচ্ছে একগাদা নারী-পুরুষকে। বিকাল হয়েছে মাত্র, তবে এরইমাঝে মরে যেতে শুরু করেছে আলো। হলঘর থেকে উচ্চ কণ্ঠের শব্দ ভেসে এলো কানে। বরফ-ঠান্ডা পানিতে হাত ধুয়ে নিলো সে।
শ্যাডো যখন বাইরে বেরিয়েছে, তখন চেরনোবোগ হলে দাঁড়িয়ে।
‘তুমি কেবল বিপদ টেনে আনো!’ চিৎকার করে বলছে সে। ‘ঝামেলা আর বিপদ তোমার সব সময়ের সঙ্গী! নাহ, একটা শব্দও শুনতে চাই না! এখুনি বেরিয়ে যাও আমার ঘর থেকে।
ওয়েনসডে তখন সোফায় চুপচাপ বসে, থেকে থেকে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছেন। যরিয়া উত্রেনেয়া দাঁড়িয়ে আছে, চুল নিয়ে নার্ভাস ভঙ্গিতে খেলছে।
‘কোনো সমস্যা?’ জানতে চাইল শ্যাডো।
‘ওই লোকটা নিজেই এক মূর্তিমান সমস্যা!’ চিৎকার করল চেরনোবোগ। ‘বলে দাও, আমি কোনো ভাবেই ওকে সাহায্য করব না! আমি চাই, ভোটান আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাক! তোমরা…তোমরা দুজনেই চলে যাও!’
‘প্লিজ,’ অনুরোধ করল যরিয়া উত্রেনেয়া। ‘একটু আস্তে কথা বলো, যরিয়া পলুনোচনেয়া জেগে যাবে!’
‘এই পাগলামিতে আমাকে যদি অংশ নিতে বলো, তাহলে তোমার আর ভোটানের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই!’ চিৎকার করে বলল চেরনোবোগ, দেখে মনে হচ্ছিল যেন কেঁদে ফেলবে! সিগারেট থেকে ছাই ঝরতে ঝরতে যে পায়ের কাছে স্তূপ বানিয়ে ফেলেছে, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই!
উঠে বসলেন ওয়েনসডে। চেরনোবোগের কাছে গিয়ে হাত রাখলেন কাঁধে।
‘শোনো,’ নম্র সুরে বললেন তিনি। ‘প্রথমত, আমি পাগলামি করছি না, এছাড়া আসলেই আর কোন উপায় নেই। আর দ্বিতীয়ত, সবাই থাকবে সেখানে। তুমি কি সবার থেকে আলাদা হয়ে থাকতে চাও?’
‘তুমি জানো, আমি কে!’ বলল চেরনোবোগ। ‘তুমি জানো এই হাতজোড়া কী করেছে! আসলে তোমার দরকার আমার ভাইকে। কিন্তু সে তো আর নেই!’
হলওয়ের একটা দরজা খুলে ফেল। ভেতর থেকে ঘুম কাতুরে কণ্ঠে এক মেয়ে বলে উঠল। ‘ঝামেলা হয়েছে নাকি?’
‘না, না, বোন।’ বলল যরিয়া উত্রেনেয়া। ‘ঘুমিয়ে পড়ো আবার।’ এরপর চেরনোবোগের দিকে ফিরে বলল, ‘দেখলে তো, তোমার চেঁচামেচির ফল কী হলো? এখন যাও, গিয়ে সোফায় চুপচাপ বসে পড়ো!’
শ্যাডোর মনে হলো, চেরনোবোগ বুঝি প্রতিবাদ জানাবে। কিন্তু না, সব প্রতিবাদ বিদায় নিয়েছে ওর ভেতর থেকে। আচমকা লোকটাকে বেশ বয়স্ক মনে হলো যুবকের-বয়স্ক, দুর্বল আর একাকী।
জীর্ণ বসার ঘরে ফিরে গেল তিন পুরুষ।
‘তোমার ভাইয়ের ক্ষেত্রে যেটা খাটে, তোমার ক্ষেত্রেও সেটা খাটে।’ বললেন ওয়েনসডে। ‘তোমরা, দ্বৈত-সত্তার অধিকারীরা, এদিক দিয়ে আমাদের চাইতে বেশি সুবিধা পাও।’
কিছু বলল না চেরনোবোগ।
‘ভালো কথা, বিয়েলবোগের কাছ থেকে কোন খবর পেয়েছ?’
মাথা নেড়ে না করল চেরনোবোগ। আচমকা শ্যাডোকে জিজ্ঞেস করে বসল, ‘তোমার কোনো ভাই আছে?’
‘আমার জানামতে নেই।’
‘আমার একটা আছে। লোকে বলে, আমরা দুইয়ে মিলে একটি অস্তিত্ব, বুঝতে পেরেছ? কমবয়সে ওর চুল ছিল একদম সোনালি, চোখ ছিল নীল। লোকে বলত, দুজনের মাঝে ও ভালো। আমার চুল ছিল ঘন কালো, তোমার চুলও তার সামনে কিছু না। লোকে বলত, আমি অশুভ। সময় বয়ে চলল, আমার চুল এখন ধূসর। যত দূর মনে হয়, ওর চুলও এখন তাই। আমাদের দুজনকে পাশাপাশি দাঁড় করাও, কে ভালো আর কে মন্দ তা বুঝতেই পারবে না!’
‘খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন বুঝি আপনারা?’ জানতে চাইল শ্যাডো।
‘ঘনিষ্ঠ হবো কী করে! আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় বিন্দুমাত্র মিলও ছিল না।’ হলের শেষ মাথা থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এলো, ভেতরে প্রবেশ করল যরিয়া ভেচেরনেয়া। ‘এক ঘণ্টার মাঝে রাতের খাবার দিচ্ছি।’ বলেই বিদায় নিলো সে।
দীর্ঘঃশ্বাস ফেলল চেরনোবোগ। ‘মেয়েটার ধারণা, সে খুব ভালো রাঁধুনি। আসলে ও যখন বড়ো হয়েছে, তখন সব কাজ করত চাকররা। এখন আর চাকর- বাকর নেই। আসলে এখন আর…কিছুই অবশিষ্ট নেই।’
‘কিছু না কিছু সব সময় থেকেই যায়।’ বললেন ওয়েনসডে।
‘তোমার কোনো কথাই আমি শুনতে চাই না।’ শ্যাডোর দিকে ফিরল লোকটা। ‘চেকার্স খেল নাকি?’ জানতে চাইল। যুবকের মাথা দোলানো দেখে ‘খুব ভালো। আমার সাথে খেলবে, এসো।’ বলেই ম্যান্টেলপিস থেকে একটা কাঠের বাক্স নামাল লোকটা। ভেতরের ঘুঁটিগুলো বের করে রাখল টেবিলের উপর।
‘না চাইলে খেলার দরকার নেই,’ শ্যাডোর হাত আলতো করে স্পর্শ করে বললেন ওয়েনসডে।
‘আমার অসুবিধা নেই।’ বলল শ্যাডো। ‘আমি খেলতেই চাই।’
শ্রাগ করে এক কপি রিডার্স ডাইজেস্ট হাতে তুলে নিলেন তিনি। এদিকে চেরনোবোগ তার হলদে হয়ে আসা হাতে ঘুঁটি সাজাতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মাঝেই শুরু হলো খেলা।
পরবর্তী দিনগুলোতে বহুবার এই দানটার কথা মনে করেছে শ্যাডো। কয়েক রাতে তো স্বপ্নেও দেখেছে খেলার দৃশ্য! ও খেলছিল সাদা ঘুঁটি নিয়ে, কালের করাল গ্রাসে যেটা জীর্ণ হয়ে গেছে। চেরনোবোগেরগুলো কালো ছিল কোনো এক কালে। এখন মলিন হয়ে গেছে। কথা হলো না কোনো, শব্দ বলতে শুধু ঘুঁটি চালার আওয়াজ।
প্রথম আধ-ডজন চালে দুজনেই আস্তে আস্তে কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে গেল। পেছনের সারিগুলো স্পর্শও করল না কেউ। দুই চালের মাঝে বেশ কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হলো, যেমনটা দাবার ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। আগ্রহ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীর চাল দেখছে তারা। আর ভাবছে, এরপর কীভাবে এগোবে?
জেলে থাকতে চেকার্স খেলেছে শ্যাডো। সময়টা বেশ কেটে যায়। খেলেছে দাবাও, তবে অনেক দূর পর্যন্ত ভেবে ভেবে এগোবার অভ্যাস নেই ওর। ক্ষণেরটা ক্ষণেই ভাবে সে। ওভাবে খেলে চেকার্সে জেতা যায় বটে…কখনও কখনও।
একটা কালো ঘুঁটি তুলে নিয়ে, শ্যাডোর সাদা ঘুঁটি খেল চেরনোবোগ। ওটার স্থান হলো টেবিলের পাশে।
‘প্রথম ঘুঁটি আমার,’ বলল চেরনোবোগ। ‘তুমি শেষ, হেরে গেছ।’
‘আরে না,’ বলল শ্যাডো। ‘এখনও খেলার অনেক বাকি।’
‘তাহলে বাজি ধরবে নাকি? খেলাটা আরেকটু উত্তেজনাকর হোক। ‘নাহ,’ পত্রিকা থেকে নজর না তুলেই বললেন ওয়েনসডে। ‘ও বাজি ধরবে না।’
‘আমি তোমার সাথে খেলছি না, বুড়ো। ওর সাথে খেলছি। তা মিস্টার শ্যাডো, বাজি ধরবে?’
‘আপনারা কী নিয়ে ঝগড়া করছিলেন?’ জানতে চাইল ও।
ভ্রু কুঁচকে তাকাল চেরনোবোগ। ‘তোমার প্রভু চায়, আমি ওর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধি। তারচেয়ে বরং মরে যাওয়াই ভালো।’
বাজি ধরতে চান? ঠিক আছে, ধরলাম। আমি জিতলে আপনাকে আমার সাথে আসতে হবে।’
ঠোঁট টিপল চেরনোবোগ। ‘তাহলে আমারও একটা শর্ত আছে।
‘কী?’
নিস্পৃহ ভঙ্গিতে শর্তটা শোনাল চেরনোবোগ। ‘আমি জিতলে, তোমার মাথায় আঘাত করার সুযোগ দেবে। হাঁটু গেড়ে বসতে হবে তোমাকে। এরপর আমি স্লেজ হ্যামার দিয়ে তোমার মাথায় বাড়ি মারব।’
বয়স্ক চেহারাটার দিকে তাকাল শ্যাডো, লোকটার মনের কথা পড়ার চেষ্টা করছে। ঠাট্টা করছে বলে মনে হলো না। কালো চোখজোড়ায় কীসের এক আকুতি ভিড় করেছে…হয়তো মৃত্যুর…হয়তো প্রতিশোধের।
পত্রিকা বন্ধ করলেন ওয়েনসডে। ‘হাস্যকর কথা বোলো না তো। এখানে আসাই আমার উচিত হয়নি। চলো, শ্যাডো। আমরা চলে যাচ্ছি।’
‘না,’ অস্বীকার করল ও। মরতে সে ভয় পায় না। বেঁচে থাকবেই বা কার জন্য? ‘ঠিক আছে, আমি রাজি। যদি আপনি জিতে যান, তাহলে আপনার স্লেজ হ্যামার দিয়ে আমার মাথায় একটা আঘাত হানার সুযোগ পাবেন।’ বলতে বলতে চাল চালল ও।
আর কথা হলো না, তবে ওয়েনসডে আর পত্রিকা তুলে নিলেন না হাতে। একটা আসল, কাচের চোখ দিয়ে খেলা দেখতে শুরু করলেন তিনি। মনের ভেতর কী চলছে, তা চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই।
শ্যাডোর আরেকটা ঘুঁটি খেল চেরনোবোগ, শ্যাডো খেল প্রতিপক্ষের দুটি। করিডর ধরে অপরিচিত রান্নার গন্ধ ভেসে আসছে। খুব একটা উপাদেয় না মনে হলেও, খিদে চাগিয়ে উঠল শ্যাডোর।
চুপচাপ চাল দিয়ে চলছে দুজন…সাদা আর কালো…উত্তর আর প্রত্যুত্তর। এ ওর ঘুঁটি তুলে নিচ্ছে তো ও তার। রাজায় পরিণত হলো দুটো ঘুঁটি। এমনিতে ঘুঁটি কেবল সামনে যেতে পারে। কিন্তু রাজার জন্য ডানে-বাঁয়ে-সামনে-পেছনে সব দিকই খোলা। তাই খেলার সবচেয়ে বিপজ্জনক ঘুঁটি এটি। খেলতে খেলতে দেখা গেল, চেরনোবোগের রাজা তিনটি, আর শ্যাডোর দুটো।
একটা রাজাকে ব্যবহার করে বোর্ড থেকে শ্যাডোর অন্য সব ঘুঁটি তুলে নিলো চেরনোবোগ। বাকি দুই রাজা দিয়ে শ্যাডোর রাজাদেরকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে। তারপর আরেকটা খুঁটিকে রাজায় পরিণত করল সে। শ্যাডোর দুই রাজাকে নিস্পৃহ ভঙ্গিতেই তুলে নিলো।
খেলা শেষ।
‘আমি জিতেছি,’ বলল বৃদ্ধ। ‘এবার তোমার মাথা গুঁড়িয়ে দেবার পালা। ইচ্ছাকৃতভাবে হাঁটু গেড়ে বসতে হবে কিন্তু তোমাকে।’ শ্যাডোর হাতে আলতো চাপড় দিল সে।
‘রান্না শেষ হতে এখনও বাকি আছে।’ বলল শ্যাডো। ‘আরেক দান হবে নাকি? শর্ত সেই একই থাকুক।’
আরেকটা সিগারেট ধরাল চেরনোবোগ। ‘শর্ত একই থাকুক মানে? তোমাকে দুই বার খুন করতে বলছ!’
‘আপনি আমার মাথায় একবার আঘাত হানার সুযোগ জিতেছেন মাত্র। নিজেই বলেছেন, শক্তির সাথে দক্ষতা না হলে এক আঘাতে কাজ হয় না সবসময়। যদি এই দান জেতেন, তাহলে দুটো আঘাত করার সুযোগ থাকবে।’
‘একটা আঘাত,’ কিছুটা ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল চেরনোবোগ। ‘একটা আঘাতই যথেষ্ট আমার জন্য।’ ডান হাতটা দেখাল সে।
‘আচ্ছা, ওই স্লেজ হ্যামারটা শেষ ব্যবহার করেছেন কবে? ত্রিশ বছর আগে? নাকি চল্লিশ? হয়তো আঘাতে আমার কিছুই হবে না। দক্ষতাতেও কিন্তু মরচে ধরে!’
কিছু বলল না চেরনোবোগ। টেবিলের ওপরে টোকা দিতে দিতে কী যেন ভাবল। আচমকা চব্বিশটা ঘুঁটির সবগুলো বসিয়ে দিল যার যার স্থানে।
‘শুরু করা যাক,’ বলল সে। ‘এবারও তুমি সাদা, আমি কালো।
প্রথম চালটা দিল শ্যাডো, চেরনোবোগও চালল প্রায় সাথে সাথে। শ্যাডোর কেন যেন মনে হলো, এবারেও প্রথমবারের খেলাটা অনুকরণ করার চেষ্টা করবে লোকটা। আর এই সীমাবদ্ধতাকেই কাজে লাগাতে হবে ওকে।
অগোছালোভাবে খেলল এবার ও। একটু সুযোগ পেতেই লুফে নিলো, চিন্তা- ভাবনা ছাড়াই চাল দিতে শুরু করল। তবে এবার, প্রতি চালের সাথে হাসি ফুটল তার চেহারায়। চেরনোবোগ প্রতিটা চাল দেবার পর আরও বড়ো হলো সেই হাসি।
অতিসত্বর দেখা গেল, চেরনোযোগ যেন ওর প্রতিটা ঘুঁটি প্রবল আক্রোশে বোর্ডের উপর আছড়ে ফেলছে। ওর প্রতিটা চালের সাথে সাথে কেঁপে উঠছে চারপাশের সব ঘুঁটি। ‘এই নাও,’ শ্যাডোর একটা ঘুঁটি তুলি নিয়ে বিজয়ীর ভঙ্গিতে বলল সে। ‘এর কী উত্তর দেবে, দাও।’
কিছু বলল না শ্যাডো। মুচকি হাসল কেবল। নিজের ঘুঁটি ব্যবহার করে এক চালে তুলে নিলো চেরনোবোগের চার-চারটি! বোর্ডের মাঝখানে এখন আর একটাও কালো ঘুঁটি নেই। বোর্ডের পাশে জড়ো করে রাখা একটা সাদা ঘুঁটি ব্যবহার করে একটু আগেরটাকে রাজায় রূপ দিল।
খেলা শেষ হতে আর বেশি সময় লাগল না, কয়েকটা চাল মাত্ৰ।
শ্যাডো বলল, ‘আরেক দান হবে? তিনে-দুই?’
একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইল চেরনোবোগ। ‘সাহস আছে তোমার, ছোকরা।’ হাসতে হাসতে বলল সে। ‘তোমাকে পছন্দ হয়েছে আমার।’
হঠাৎ যরিয়া উত্রেনেয়া দরজা দিয়ে মাথা গলিয়ে জানাল-খাবার তৈরি! শ্যাডোরা যেন ঘুঁটি সরিয়ে টেবিল ক্লথ বিছিয়ে ফেলে।
‘আমাদের ডাইনিং রুম নেই,’ ক্ষমা প্রার্থনার সুরে জানাল সে। ‘এখানেই খাই সবাই।’
কিছুক্ষণের মাঝেই তরকারির পাত্র চলে এলো টেবিলে। খেতে বসা সবাইকে দেওয়া হলো একটা ছোটো, রং করা ট্রে। তার ওপরে কয়েকটা চামচ, হাতে ধরে বা কোলে রেখে খেতে হবে।
পাঁচটা কাঠের পাত্র নিয়ে তাতে সেদ্ধ করা আলু রাখল যরিয়া ভেচেরনেয়া, কোনটাই চামড়া ছাড়ানো নয়। এর উপর দরাজ হাতে ঢালল খয়েরি রঙা বর্শ[৬]। সাথে যোগ করল এক চামচ সাদা ক্রীম। এরপর সবার হাতে ধরিয়ে দিল একটা করে।
[৬. বিট দিয়ে বানানো এক ধরনের স্যুপ যাতে সবজি আর মাংস থাকে।]
‘আমি তো ভেবেছিলাম, মোট ছয়জন আছি বাড়িতে।’
‘যরিয়া পলুনোচনেয়া এখনও ঘুমাচ্ছে।’ বলল যরিয়া ভেচেরনেয়া। ‘আমরা ওর খাবার ফ্রিজে রেখে দেই, ঘুম থেকে উঠলে খেয়ে নেয়।’
বর্শটা কেমন যেন ভিনেগারের মতো দেখতে, স্বাদে আচার দেওয়া বিটসের মতো। তবে সেদ্ধ আলুটা খেতে বেশ মজার।
এরপর এলো গোরুর মাংস দিয়ে বানানো পট রোস্ট, সাথে সবুজ কিছু একটা। তবে এত লম্বা সময় ধরে ওগুলো সিদ্ধ করা হয়েছে যে এখন আর সবুজের চিহ্নও নেই! কল্পনাতেও বোধ হয় দেখা সম্ভব না। বাদামি হয়ে আছে প্রত্যেকটাই।
সব শেষে এলো বাঁধাকপির পাতা দিয়ে রান্না করা মাংস আর ভাত। পাতাগুলো এত শক্ত যে ছুরি দিয়েও কাটা যাচ্ছে না। আর কাটতে গেলেই, ভাতসহ মাংস ছিটিয়ে পড়ছে কার্পেটে। শ্যাডো চামচ দিয়ে খাবার এদিক-ওদিক নাড়ল কেবল।
‘আমরা চেকার্স খেললাম এতক্ষণ,’ পট রোস্টের আরেক টুকরার উপর আক্রমণ চালাতে চালাতে বলল চেরনোবগ। ‘ছেলেটা এক দান জিতেছে, আমি এক দান। ও জেতায় এখন আমাকে ভোটানের সাথে যেতে হবে, ওদের এই পাগলামির অংশ হতে হবে। আর আমি জিতেছি বলে, এসব ঝামেলা শেষ হলে শ্যাডোকে খুন করতে পারব।’
মাথা নাড়ল দুই যরিয়া। ‘কী দুঃখের কথা।’ শ্যাডোকে বলল যরিয়া ভেচেরনেয়া। ‘তোমার ভাগ্য গণনার সময় আমার বলা উচিত ছিল: লম্বা একটা জীবন হবে তোমার। বউ থাকবে, হালি-হালি বাচ্চা হবে!’
‘এজন্যই তুমি এত ভালো একজন গণক।’ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বলল যরিয়া উত্রেনেয়া, এতক্ষণ জেগে থাকার অভ্যাস নেই ওর। ‘তুমি মিথ্যাটা দারুণ বলতে পারো।
খাবার পর্ব শেষ হলো বটে, কিন্তু শ্যাডোর ক্ষুধা এখনও মেটেনি। জেলের খাবার মুখে তোলা যেত না, তবে তা-ও এরচেয়ে ভালো ছিল।
‘দারুণ খাবার খেলাম।’ বললেন ওয়েনসডে, প্লেট চেটে-পুটে খেয়েছেন বলে সন্দেহ করতে পারল না শ্যাডো। ‘তোমাদের দুই বোনকে ধন্যবাদ। এবার আমাদের বিদায় দাও, আর যদি আশপাশের ভালো হোটেলের খোঁজ দিতে পারো তো সোনায় সোহাগা।’
যরিয়া ভেচেরনেয়াকে আহত মনে হলো। ‘হোটেলে যাবার দরকার কী? তোমরা আমাদেরকে বন্ধু বলে মনে করো না?’
‘এমনিই তোমাদের যথেষ্ট ঝামেলায় ফেলেছি, তার ওপর…’ বললেন ওয়েনসডে।
‘ঝামেলা কীসের?’ হাই তুলতে তুলতে বলল যরিয়া উত্রেনেয়া।
তুমি বিয়েলবোগের ঘরে যাও,’ ওয়েনসডেকে বলল যরিয়া ভেচেরনেয়া। ‘খালিই আছে। আর শ্যাডো, তোমার জন্য সোফা গুছিয়ে দিচ্ছি। যথেষ্ট আরামে ঘুমাতে পারবে।’
‘তোমাদেরকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।’ বললেন ওয়েনসডে।
‘আর তাছাড়া, হোটেলে যা দিতে হতো, আমাকে তার চাইতে একটা পয়সাও বেশি দিতে হবে না।’ বিজয়ীর সুরে বলল যরিয়া ভেচেরনেয়া। ‘মাত্র একশ ডলার।’
‘ত্রিশ।’ দর কষাকষি শুরু করলেন ওয়েনসডে।
‘পঞ্চাশ।’
‘পঁয়ত্রিশ।’
‘পঁয়তাল্লিশ।’
‘চল্লিশ।’
‘পঁয়তাল্লিশের চেয়ে এক সেন্টও কম না।’ বলে হাত বাড়িয়ে ওয়েনসডের সাথে করমর্দন করল যরিয়া ভেচেরনেয়া। টেবিল পরিষ্কার করার কাজে লেগে গেল সাথে সাথে। এদিকে যরিয়া উত্রেনেয়া এত বড়ো বড়ো করে হাই তুলছে যে শ্যাডোর ভয় হলো, মহিলার চোয়াল না খুলে আসে! শুভরাত্রি বলে বিদায় নিলো সে, নিজেও অবস্থাটা টের পেয়েছে।
যরিয়া ভেচেরনেয়াকে সাহায্য করল শ্যাডো। অবাক হয়ে লক্ষ করল, সিঙ্কের পাশে একটা ডিশ ওয়াশিং মেশিন দেখা যাচ্ছে! ওখানে সে সব তৈজসপত্র রাখতেই বাধা দিল যরিয়া ভেচেরনেয়া। কাঠের বর্শ ভরতি পাত্রগুলোকে দেখিয়ে বলল, ‘ওগুলো সিঙ্কে রাখো।’
‘দুঃখিত।’
‘ব্যাপার না। যাক গে, এদিকে এসো। পাই আছে।’
পাইটা, মানে আপেলের পাইটা কেনা হয়েছে দোকান থেকে। আর গরম করা হয়েছে ওভেনে, তারপরেও বেশ লাগল খেতে। আইসক্রিম আর পাই খেল চারজনে মিলে। এরপর যরিয়া ভেচেরনেয়ার পীড়াপীড়িতে বসার ঘরে যেতে হলো সবাইকে। শ্যাডোর জন্য সোফাটাকে বিছানার রূপ দিল মহিলা।
করিডরে দাঁড়িয়ে শ্যাডোকে বললেন ওয়েনসডে। ‘চেকার্স খেললে…’
‘হুম। তো?’
‘ধন্যবাদ। একদম বোকার মতো কাজ করেছ একটা। তবে ধন্যবাদ। যাই হোক, শুভ রাত্রি।’
দাঁত মেজে ঠান্ডা পানি দিয়ে মুখ ধুল শ্যাডো। এরপর বসার ঘরের বাতি বন্ধ করে শুয়ে পড়ল সোফা-কাম-বিছানায়, মাথা বালিশে রাখার আগেই ঘুমিয়ে পড়ল।
.
অদ্ভুত স্বপ্নটা ঘুমাবার কতক্ষণ পর শুরু হলো, জানা নেই শ্যাডোর। স্বপ্নে বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেল ও।
একটা মাইনফিল্ডের ভিতর দিয়ে ট্রাক চালিয়ে যাচ্ছে সে, দুই দিকেই একের-পর-এক ফুটছে বোমা। উইন্ডশিল্ডটা ভেঙে চৌচির হয়ে গেছে অনেক আগেই। উষ্ণ রক্ত বেয়ে পড়ছে ওর চেহারা দিয়ে।
কেউ একজন গুলি ছুঁড়ছে!
একটা বুলেট এসে ওর ফুসফুস ছিদ্র করে দিল, আরেকটা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেলল ওর শিরদাঁড়া। শুধু তাই না, তৃতীয় বুলেট আঘাত হানল কাঁধে প্রতিটা আঘাত আলাদা আলাদা করে টের পেল শ্যাডো, আছড়ে পড়ল স্টিয়ারিং হুইলের ওপরে।
একেবারে শেষ বিস্ফোরণের পর অন্ধকার হয়ে গেল সবকিছু।
.
আমি নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছি, একাকী অন্ধকারে বসে বসে ভাবছে শ্যাডো। একেই বোধ হয় মৃত্যু বলে। ছোটো বেলায় গল্প শুনত…বিশ্বাসও করত যে স্বপ্নে মারা যাবার অর্থ, আসলেও মারা যাওয়া। কিন্তু এখন নিজেকে মৃত বলে মনে হচ্ছে না। পরীক্ষা করে দেখার জন্যই যেন চোখ খুলল সে।
ছোট্ট বসার ঘরটায় একজন মহিলা এসে উপস্থিত, জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। পিঠ শ্যাডোর দিকে দেওয়া। যুবকের মনে হলো, হৃৎপিণ্ড যেন এক সেকেন্ডের জন্য হলেও স্পন্দিত হতে ভুলে গেছে। ‘লরা?’
ঘুরে দাঁড়াল মেয়েটা, চাঁদের আলোয় অবয়ব দেখা যাচ্ছে। ‘আমি দুঃখিত, ‘ বলল সে। ‘তোমাকে জাগাতে চাইনি।’ নরম একটা ইউরোপিয় টান কথায়। ‘আমি চলে যাচ্ছি।’
‘না, না। অসুবিধা নেই।’ তাড়াতাড়ি বলে উঠল শ্যাডো। ‘আমি তোমার জন্য জাগিনি। দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম।’
‘বুঝতে পেরেছি,’ বলল মেয়েটা। ‘তুমি কাঁদছিলে আর গুঙিয়ে উঠছিলে। একবার ভাবলাম, ডেকে তুলি। পরে সিদ্ধান্ত নিলাম, থাক।’
মেয়েটার চুলের আসল রং জানা নেই শ্যাডোর, তবে চাঁদের আলোয় বর্ণহীন বলে মনে হচ্ছে। পরনে তার একটা সাদা সুতির নাইটগাউন, এতবড়ো যে মেঝেতে এসে পড়েছে ঝুল। উঠে বসল শ্যাডো, ঘুম ছুটে গেছে। ‘তুমি যরিয়া পলু…’ উচ্চারণ করতে পারল না ও, তাই ভিন্ন পথ ধরল। …তুমি তৃতীয় বোন। ঘুমিয়ে ছিলে।’
‘আমি যরিয়া পলুনোচনেয়া। আর তুমি নিশ্চয়ই শ্যাডো? ঘুম থেকে যখন উঠি, তখনও যরিয়া ভেচেরনেয়া তাই বলল।’
‘হ্যাঁ। কী দেখছিল জানালা দিয়ে?’
একনজর ওকে দেখে নিলো মেয়েটা, তারপর ইশারায় নিজের পাশে এসে দাঁড়াতে বলল। ছোটো একটা ঘর, কিন্তু হেঁটে যেতে যেতে শ্যাডোর মনে হলো বুঝি লম্বা পথ পাড়ি দিয়েছে।
মেয়েটার বয়স বোঝা যাচ্ছে না, নিভাঁজ ত্বক। চোখগুলো কালো, পাপড়ি লম্বা। চুল কোমর ছুয়েছে, সাদাটে রঙের। তবে চাঁদের আলোয় পরিষ্কার ধরা পড়ছিল না। দুই বোনের চাইতেই লম্বা ও।
রাতের আকাশের দিকে ইঙ্গিত করল মেয়েটা। ‘ওটা দেখছিলাম।’
‘উরসা মেজর? বিশালাকার ভালুক দেখছিলে?’
‘ওভাবেও বলা যায়,’ বলল মেয়েটা। ‘তবে আমার যেখানে জন্ম, সেখানে কিন্তু ওটাকে ওই নামে ডাকে না। যাক, আমি ছাদে যাচ্ছি। আসবে?’
বলেই জানালা খুলে ফায়ার-এস্কেপে পা রাখল মেয়েটা। জানালা দিয়ে সাথে সাথে ভেতরে প্রবেশ করল গা শিহরানো ঠান্ডা বাতাস। শ্যাডোর অস্বস্তি হচ্ছে, কিন্তু কেন তা বুঝতে পারছে না। সোয়েটার, মোজা আর জুতা পরে নিয়ে মেয়েটার পিছু পিছু সে-ও উঠে পড়ল ফায়ার-এস্কেপে। ওর জন্য অপেক্ষা করছিল মেয়েটা! শ্যাডোর নিশ্বাস বাতাসে বাষ্পের সৃষ্টি করছে। অথচ যরিয়া খালি পায়েই উঠে যাচ্ছে ধাতব সিঁড়ি বেয়ে! ঠান্ডা বাতাস বইল এক দমকা, মেয়েটার দেহের সাথে যেন আরও এঁটে বসল নাইটগাউন। সাথে সাথে শ্যাডো টের পেল, মেয়েটা গাউনের নিচে কিছুই পরেনি।
‘ঠান্ডা লাগছে না?’ সিঁড়ির মাথায় পৌঁছে জানতে চাইল শ্যাডো, কিন্তু ওর শেষ শব্দগুলো যেন লুফে নিলো বাতাস।
‘বুঝতে পারিনি।’ ওর মুখের কাছে মুখ এনে বলল মেয়েটা, শ্বাসে মিষ্টি একটা গন্ধ।
‘বললাম, ঠান্ডা লাগছে না?’
উত্তর না দিয়ে, আঙুল তুলে ওকে অপেক্ষা করার ইঙ্গিত দিলে যরিয়া। আলতো পায়ে সমতল ছাদে পা রাখল সে। শ্যাডো অবশ্য অতোটা সহজে ছাদে উঠতে পারল না। তবে উঠেই মেয়েটার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। পানির একটা ট্যাঙ্কির পাশে দাঁড়িয়ে আছে যরিয়া, কাঠের একটা বেঞ্চও আছে সেখানে। নিজে বসে শ্যাডোকে পাশে বসার ইঙ্গিত দিল সে। আড়ালে বসেছে বলে ঠান্ডা বাতাসের হাত থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পেল দুজন।
‘নাহ,’ এতক্ষণে উত্তর দিল সে। ঠান্ডায় আমার অসুবিধা হয় না। এখন আমার সময়। পানিতে যেমন মাছের অসুবিধা হয় না, তেমনি এই সময়ে কোনো কিছুই আমাকে সমস্যায় ফেলাতে পারে না।’
‘রাত তোমার খুব পছন্দ বলে মনে হচ্ছে।’ বলেই আফসোস হলো শ্যাডোর। আরও ভারী…আরও জ্ঞানী কোনো কথা বলতে পারলে খুশি হতো ও।
‘আমার বোনেরা তাদের সময়ের। যরিয়া উত্রেনেয়ার সময় হচ্ছে ভোর। আগের দেশটায় ও দরজা খুলে দিলে আমাদের পিতা…কী যেন শব্দটা? ঘোড়ায় টানা গাড়ি?’
‘রথ?’
‘হ্যাঁ, রথ। আমাদের পিতা তার রথ নিয়ে বেরোতেন। আর যরিয়া ভেচেরনেয়া গোধূলি বেলায় দরজা খুলে দিত, তখন তিনি ফিরে আসতেন।’
‘আর তুমি?’
চুপ করে রইল মেয়েটা। ভরাট ঠোঁট দুটো কেমন যেন পাণ্ডুর মনে হচ্ছে। ‘আমি কখনও আমার পিতাকে দেখিনি। ঘুমিয়ে থাকতাম।’
‘রোগ-টোগ হয়েছিল নাকি?’
উত্তর দিল না সে। শ্রাগ করল বলে মনে হলো শ্যাডোর, তবে নিশ্চিত হতে পারল না।
‘যাই হোক, আমি কী দেখছি তা জানতে চেয়েছিলে?’
‘উরসা মেজর দেখছিলে।’
কথা না বলে আঙুল দিয়ে ওটা দেখাল মেয়েটা। বাতাস আবার নাইটগাউনটাকে তার দেহের সাথে সেঁটে রেখেছে। স্তনবৃত্তগুলো পরিষ্কার দেখা গেল এক মুহূর্তের জন্য। শীতে কেঁপে উঠল শ্যাডো।
‘ওডিনের ওয়িন, আমাদের ওখানে এই নামে ডাকা হয় ওটাকে। আমাদের বিশ্বাস অনুযায়ী ওটা দেবতা নয়, বরঞ্চ খারাপ কিছু। শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে যাকে। যদি একবার পালাতে পারে, তাহলে সবকিছু খেয়ে ফেলবে। আর তিন বোন আছে, যারা লক্ষ রাখে তার উপর। সারাদিন…সারারাত…ক্ষণিকের জন্যও নজর রাখা বন্ধ করে না। যদি পালায়, তাহলে…পুফ, বিনাশ হবে সব কিছুর!’
‘মানুষ এসব বিশ্বাস করত?’
‘করত, অনেকদিন আগের কথা বলছি।’
‘তুমি কি তারার ফাঁকে সেই ভয়ানক ‘জিনিস’টাকে খুঁজছ?’
‘ওরকমই কিছু একটা ‘
হাসল শ্যাডো। ঠান্ডায় হাড় জমে যাচ্ছে, নইলে এই কথোপকথনকে ও স্বপ্ন বলেই ধরে নিত। সবকিছু যে বড়ো স্বপ্ন-স্বপ্ন লাগছে। ‘তোমার বয়স জানতে চাইলে রাগ করবে? অন্য দুই বোনকে খুব বয়স্ক মনে হয়।’
মাথা দোলাল মেয়েটা। ‘আমিই সবার ছোটো। যরিয়া উত্রেনেয়ার জন্ম হয়েছিল সকালে, যরিয়া ভেচেরনেয়ার গোধূলি বেলায়। আমার জন্ম মাঝরাতে। আচ্ছা, তুমি বিবাহিত?’
‘আমার স্ত্রী মারা গেছে। গত সপ্তাহে, এক গাড়ি দুর্ঘটনায়। গতকাল ওকে কবর দিয়েছি।’
‘শুনে দুঃখ পেলাম।’
‘গতরাতে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল,’ এই অন্ধকারে, রাতের চাঁদের আলোয় বসে কথাটা বলতে একটুও বাঁধল না শ্যাডোর। যদিও দিনের আলোতে এই বাক্যটা নিজের কাছেই বলতে অস্বস্তি হচ্ছিল ওর!
‘কেন এসেছিল, জানতে চেয়েছ?’
‘নাহ, চাইনি।’
‘উচিত ছিল হয়তো। মৃত মানুষের কাছে প্রাপ্ত জ্ঞানে খাদ থাকে না। যরিয়া ভেচেরনেয়ার মুখে শুনলাম, তুমি নাকি চেরনোবোগের সাথে চেকার্স খেলেছ?’
‘হ্যাঁ। আমার মাথায় একবার আঘাত করার সুযোগ জিতে নিয়েছে ও।’
‘আগেরকার দিনে মানুষ কী করত জানো? বলির জন্য নির্বাচিত ব্যক্তিকে নিয়ে যেত অনেক উঁচু কোনো স্থানে। তারপর তার মাথার পেছন দিকটা পাথর দিয়ে গুঁড়িয়ে দিত। সব করত চেরনোবোগের জন্য।
চকিতে পেছনে তাকাল শ্যাডো! নাহ, ছাদে ওরা ছাড়া আর কেউ নেই!
হাসল যরিয়া পলুনোচনেয়া। ‘আরে বোকা, ও এখানে নেই। তুমিও তো এক দান জিতেছ। সবকিছু শেষ না হওয়া পর্যন্ত চেরনোবোগ কিছু করবে বলে মনে হয় না। আর তাছাড়া, ও যা করার তা জানিয়ে-শুনিয়েই করবে; ঠিক ওই গোরুগুলোর মতো। নইলে আর খুন করে লাভ কী?’
‘আমার মনে হচ্ছে,’ শ্যাডো বলল ওকে। ‘আমি এখন এক দুনিয়ায় এসে উপস্থিত হয়েছি, যেখানে সবকিছু চলে তার নিজের নিয়মে, নিজের যুক্তিতে। স্বপ্নের মতো বলা যায়, ওখানকার নিয়ম আমাদের দৈনন্দিন দুনিয়ার সাথে মেলে না। কিন্তু সেই নিয়ম নিয়ে প্রশ্নও তোলা যায় না। বুঝতে পেরেছ?’
‘হ্যাঁ,’ বলে ওর হাত ধরল মেয়েটা। একেবারে বরফের মতো ঠান্ডা। ‘তোমাকে বিশেষ প্রতিরক্ষা দেওয়া হয়েছিল। অথচ সেটা বিলিয়ে দিয়েছ! আমি তোমাকে এখন যে প্রতিরক্ষা দেব, তা ওটার তুলনায় দুর্বল। হাজার হলেও পিতার দেওয়া প্রতিরক্ষা তো আর কন্যা দিতে পারবে না। তবে একেবারে ফেলনাও হবে না তা।’
‘এজন্য তোমার সাথে লড়তে হবে? নাকি চেকার্স খেলতে হবে?’ জানতে চাইল শ্যাডো।
‘কিছুই করতে হবে না, এমনকি একটা চুমু পর্যন্ত দিতে হবে না। শুধু আমার কাছ থেকে চাঁদটাকে নিয়ে নিলেই চলবে।’
‘মানে?’
‘চাঁদটাকে নিয়ে নাও।’
‘আমি বুঝতে পারছি না।’
‘দেখাচ্ছি, দাঁড়াও। বলল যরিয়া পলুনোচনেয়া, বাঁ হাতটাকে তুলে এমনভাবে ধরল যেন বৃদ্ধাগুলি আর তর্জনীর ফাঁকে চাঁদটাকে দেখা যায়। তারপর…আলতো আয়াসে তুলে নিলো চন্দ্রকে! মনে হলো যেন আকাশ থেকে তুলে এনেছে! তবে শ্যাডো পরক্ষণেই দেখতে পেল, নাহ। জায়গা মতোই আছে ওটা। যরিয়া হাত খুলতে দেখা গেল, একটা রূপালি ডলার ওর দুই আঙুলের ফাঁকে শোভা পাচ্ছে!
‘দারুণ একটা ভেলকি দেখালে।’ বলল শ্যাডো। ‘কীভাবে করেছ, তা বুঝতেই পারিনি।’
‘ভেলকি দেখাইনি।’ বলল মেয়েটা। ‘তুলে এনেছি, তোমার জন্য, তোমাকে নিরাপদ রাখার জন্য…এই নাও। এটা কাউকে দিয়ো না।’
পয়সাটা শ্যাডোর হাতে দিয়ে, হাত মুড়ে দিল যরিয়া। ঠান্ডা একটা স্পর্শ পেল ও। পরক্ষণেই সামনে ঝুঁকে এলো যরিয়া পলুনোচনেয়া, আঙুল দিয়ে শ্যাডোর চোখ বন্ধ করে একবার চোখের পাতার উপর চুমু খেল।
.
ঘুম থেকে উঠে শ্যাডো দেখে, সব জামা-কাপড় পরে বিছানায় শুয়ে আছে! সূর্যালোকের সরু একটা রশ্মি আসছে জানালা দিয়ে। সেই আলোতে নাচছে ধুলো। বিছানা ছেড়ে জানালার কাছে চলে গেল সে, দিনের আলোতে ঘরটাকে আরও ক্ষুদ্র দেখাচ্ছে।
যে জিনিসটা গতরাত থেকে ওকে অস্বস্তিতে ভোগাচ্ছিল, এবার দেখতে পেল সেটা। জানালার বাইরে ফায়ার-এস্কেপ নেই! নেই ব্যালকনি বা ধাতব সিঁড়িও!
তবে হাতে এখনও ধরে আছে একটা উজ্জ্বল, ১৯২২ সালের রুপালি লিবার্টির চেহারা ছাপা ডলারের কয়েন! যেন এই মাত্র ওটাকে বের করা হয়েছে টাকশাল থেকে!
‘ঘুম ভেঙেছে দেখছি,’ দরজা দিয়ে মাথা গলিয়ে বললেন ওয়েনসডে। ‘ভালো, ভালো। কফি লাগবে? লাগলে খেয়ে নাও। এরপর আমরা ব্যাংক ডাকাতি করতে বেরোব।
.
আমেরিকায় আগমন, ১৭২১
আমেরিকার ইতিহাস পড়ার সময় যে জিনিসটা মাথায় রাখতে হবে তা হলো, মি. আইবিস তার চামড়ায় বাঁধানো ডায়রিতে লিখল। এই ইতিহাসের পুরোটাই কল্পিত। বাচ্চাদের জন্য আর যারা খুব অল্পেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, তাদের জন্য খুব সাধারণভাবে বর্ণনা করা হয়েছে সবটা। লেখা হয়েছে দারুণ দক্ষতার সাথে, কলমটা দোয়াতে চুবিয়ে নেওয়ার ফাঁকে মনের ভাষা গুছিয়ে নিলেন তিনি। তবে আমেরিকার জন্ম হয়েছে অভিবাসীদের জন্য। স্বাধীনতার খোঁজে তারা এসেছিল এখানে। আস্তে আস্তে ভরিয়ে তুলেছে ফাঁকা এই দেশটাকে।
সত্যিকার অর্থে আমেরিকান কলোনিগুলো ছিল বাকিদের জন্য একটা আস্তাকুঁড়। সেখানে সবাই ফেলে দিতে সমাজের যেসব সদস্যকে ভুলে যাওয়া উচিত, তাদের। এমনও একদিন ছিল, যখন বারো পেনি চুরির অপরাধে লন্ডনের গাছে ফাঁসিতে ঝুলতে হতো চোরকে। সেসময় আমেরিকা হয়ে গেছিল ক্ষমা পাবার, আরেকবার নতুন করে সব কিছু শুরু করতে পারার সমার্থক। তবে তার জন্য একটা ভয়ানক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যেতে হতো সবাইকে-দ্বীপান্তর। এই পদ্ধতি এতই ভয়াবহ ছিল যে অনেকে তার চাইতে গাছের ডাল থেকে ঝুলে পড়াটাকেই উত্তম বলে মনে করত। কাউকে সাজা হিসেবে দেওয়া হতো পাঁচ বছরের দ্বীপান্তর, কাউকে দশ বছরের… আবার কাউকে সারা জীবনের জন্য।
অপরাধীকে বিক্রি করে দেওয়া হতো কোনো ক্যাপ্টেনের কাছে। জাহাজে করে সে ক্রীতদাস বা দাসীকে নিয়ে যেত কলোনিতে অথবা ওয়েস্ট ইন্ডিজে। দাসবাহী জাহাজগুলো সাধারণত হতো চরম অস্বাস্থ্যকর। যাই হোক, কলোনিতে পৌঁছে ক্যাপ্টেন তাদেরকে বেঁচে দিত। নতুন মালিক রক্ত পানি করা পরিশ্রম করিয়ে তুলে নিত তার বিনিয়োগ। যতদিনের সাজা, ততদিন কাজ করতে হতো সেই ক্রীতদাসকে। তবে অন্তত তাকে ইংল্যান্ডের জেলে পচে মরতে হতো না (তখন জেলে কয়েদ অপরাধীদের তিনটি ভাগ্যের একটি বরণ করে নিতে হতো-হয় মুক্তি পেত, নয়তো দ্বীপান্তর আর নয়তো মৃত্যুদণ্ড। নির্দিষ্ট একটা সময় জেল খেটে মুক্তি পাবে, সে উপায় ছিল না)। শাস্তির সময় শেষ হবার পর, সেই অপরাধীরা হয়ে যেত পাখির মতোই মুক্ত। অবশ্য চাইলে কোন ক্যাপ্টেনকে ঘুস-টুস দিয়ে ফিরেও আসা যেত ইংল্যান্ডে। অনেকে আসতও। কিন্তু যদি কর্তৃপক্ষের হাতে ধরা পড়ত, তাহলে আর দ্বিতীয়বার কিছু না ভেবে তাকে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো ফাঁসিতে।
এসি ট্রেগোয়ানের গল্পটাই ধরা যাক, ক্লজিট থেকে কালির একটা বোতল এনে দোয়াতে ভরল মি. আইবিস। তারপর আবার শুরু করল লেখা: কর্নওয়ালের একটা ছোট্ট গ্রামে জন্মেছিল মেয়েটা। ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত গ্রামটায় অনেক পুরুষ ধরে বাস করে ওদের পরিবার। মেয়েটার বাবা ছিল জেলে, গুজব ছিল-লোকটা খুব একটা ভালো মানুষ ছিল না। ঝড়ের রাতে সে পাহাড়ের চুড়ায় ঝুলিয়ে দিত একটা ল্যাম্প। উদ্দেশ্য ছিল-ওটা দেখে যেসব জাহাজ কাছাকাছি এসে ভেঙে পড়বে, সেগুলো লুটপাট করা। এসির মা ছিল রাঁধুনি। বারো বছর বয়সে মায়ের সাথেই গ্রামের জমিদারের বাড়িতে কাজ করতে শুরু করে সে। ওর কাজ ছিল বাসন-কোসন ধোওয়া। চিকন-চাকন মেয়ে ছিল এসি, আয়ত বাদামি চোখ আর গাঢ় বাদামি চুল ছিল মাথা ভরা। আলসেই বলা যেত ওকে, প্রায়শই কাজ ফেলে রূপকথার গল্প শুনতে দেখ যেত-পিস্কি[৭] আর স্প্রিগানদের গল্প, কালো কুকুর আর পানির সিল-মহিলার গল্প। কে বলছে, তাতে কিছু যেত-আসত না ওর, শুনতে পারলেই হলো। জমিদার অবশ্য এসব গল্প শুনে হাসতেন, তবে রাঁধুনিরা ঠিক দুধের সর ভরতি একটা পিরিচ রাতের বেলা রান্নাঘরের দরজার বাইরে রেখে দিত…পিস্কিদের জন্য।
[৭. অথবা পিক্সি, কর্নিশ পুরাণের দুষ্টু চরিত্র।]
আস্তে আস্তে পার হয়ে গেল অনেকগুলো বছর, এখন আর এসি সেই ছোট্ট মেয়েটি নেই। সবুজ সমুদ্রের মতোই আকর্ষণীয়ভাবে বেড়ে উঠেছে ওর দেহ। চোখের চাহনি আর চুলের দুলুনি কীসের যেন ইঙ্গিত দেয়। বার্থোলোমিউ, জমিদারের আঠারো বছর বয়সি ছেলেটা সেই ইঙ্গিতে মজে গেল। তবুও ঝুঁকি নিলো না এসি। জঙ্গলের পাশে একটা পাথর খুঁজে বের করল ও। একটা কাপড়ে মুড়িয়ে সেখানে রাখল ছেলেটার আধ-খাওয়া এক টুকরো রুটি আর নিজের এক গোছা চুল। পরেরদিনই বার্থেলোমিউ নিজে থেকে এসে কথা বলল ওর সাথে, নীল চোখের চাহনিতে অমোঘ আকর্ষণ।
ওই নীল চোখে ডুব দিল এসি।
কিছুদিনের মাঝেই অক্সফোর্ডে পড়তে গেল বার্থোলোমিউ। এসির গর্ভাবস্থা যখন সবার সামনে পরিষ্কার হয়ে গেল, তখন কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া হলো ওকে। তবে বাচ্চাটা জন্মাল মৃত হয়ে। এদিকে ওর মায়ের অনেক অনুরোধে মন গলল জমিদারের স্ত্রীর। তার চাপাচাপিতেই এসিকে আবার ধোলাই ঘরে কাজ করার অনুমতি দিলেন জমিদার।
তবে বার্থেলোমিউ-এর প্রতি মেয়েটার যে ভালোবাসা ছিল, সেটা ততদিনে পরিণত হয়েছে জমিদার পরিবারের প্রতি ঘৃণায়! এক বছরের মাঝে পাশের গ্রামের এক মন্দ লোককে সঙ্গী হিসেবে বেছে নিলো সে, লোকটার নাম ছিল জোসাইয়াহ হর্নার। এক রাতে, যখন জমিদার পরিবারের সবাই ঘুমাচ্ছে, উঠে গিয়ে সদর দরজা খুলে দিল এসি। প্রেমিক বাইরেই অপেক্ষা করছিল, ইচ্ছামতো চুরি করে পালিয়ে গেল লোকটা
সন্দেহ এসির উপর পড়তে দেরি হলো না। কেননা ভেতর থেকে কেউ দরজা না খুললে, বাইরে থেকে চোর ঢুকতে পারার প্রশ্নই ওঠে না। এদিকে জমিদার-পত্নী নিশ্চিত, শোবার সময় তিনি দরজা আটকিয়ে ছিলেন। আর তাছাড়া, জমিদারের রূপার থালা-বাসন কোথায় থাকে, তা জানতে হলে চোরের দলে ভেতরের কাউকে না কাউকে থাকতেই হবে। এমনকি পয়সা- কড়ি আর সই করা ধারের কাগজগুলোও বাদ দেয়নি চোর। তবে এসির মুখ থেকে স্বীকারোক্তি বের করা গেল না। সমস্যা হলো জোসাইয়াহ হর্নার ধরা পড়ার পর। আদালতে দাঁড়াতে হলো মেয়েটাকে।
হর্নারের কপাল খারাপ। ফাঁসিতে ঝোলানো ছিল যখনকার নিত্ত-নৈমিত্তিক ব্যাপার, তখন জন্মেছিল বেচারা। তবে বিচারক এসির প্রতি নরম হলেন। বয়স আর বাদামি চুলের কথা বিবেচনা করে সাত বছরের দ্বীপান্তরের সাজা দেওয়া হলো ওকে। ক্যাপ্টেন ক্লার্ক নামের একজনের জাহাজ, নেপচুনে করে নিয়ে যাওয়া হবে মেয়েটাকে। পথে সুদর্শন ক্যাপ্টেনের সাথে এক চুক্তি হলো এসির। ঠিক হলো, দাসদের বিক্রি করে ক্যাপ্টেন স্ত্রী হিসেবে এসিকে এনে তুলবে তার মায়ের বাড়িতে। ওখানে কেউ মেয়েটাকে চেনে না, তাই কোনো সমস্যাও হবে না। ফিরতি পথটা দুই কপোত-কপোতী কাটাল প্রেম করে।
লন্ডনে পৌঁছাবার পর, এসিকে নিয়ে মায়ের ওখানে উঠল ক্যাপ্টেন ক্লার্ক। ভদ্রমহিলাও ওকে বরণ করে নিলেন নিজের পুত্রবধূ হিসেবে। আট সপ্তাহ পর, আবার পানিতে ভাসার সময় এলো নেপচুনের। পোতাশ্রয়ে দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন- স্বামীকে হাত নেড়ে বিদায় জানাল যুবতী…সুন্দরী স্ত্রী। শাশুড়ির বাড়িতে ফিরে এসে দেখল, মহিলা ঘরে নেই। তাই সিঙ্কের এক গাদা কাপড়, কিছু সোনার পয়সা আর একটা রূপার পট নিয়ে ‘বিদায়’ নিলো এসি।
পরবর্তী দুই বছরে দক্ষ এক চোরে পরিণত হলো এসি। সবসময় চওড়া একটা স্কার্ট পরত ও। সেটার আড়ালে সিল্ক, লেস এসব লুকাতে কোনো কষ্টই হতো না। জীবনকে উপভোগ করল সে প্রাণ-ভরে। আর এভাবে অপরাধ করেও ধরা না পড়ার জন্য প্রতি রাতে কৃতজ্ঞতা জানাত ছোটো বেলায় গল্প শোনা সেই সব পরীদের। এসি ধরেই নিয়েছিল, পিস্কিদের হাত এই লন্ডনেও ওকে রক্ষা করছে। রাতে এক পাত্র দুধ সে রেখে দিত জানালার কার্নিশে, কোনোদিন ভুল হতো না। বন্ধুরা এসব দেখে হাসাহাসি করত। তবে শেষ হাসি হাসত এসিই। ওরা বসন্তে আক্রান্ত হতো, অথবা ধরা পড়ে ঝুলত ফাঁসিতে। কিন্তু এসি না কখনও ধরা পড়েছে, আর না অসুস্থ হতে হয়েছে ওকে।
বিশতম জন্মদিনের এক বছর আগের কথা। ভাগ্য মুখ ফিরিয়ে নিলো ওর থেকে। ফ্লিট স্ট্রিটের একটা হোটেল বসে ছিল এসি, এমন সময় এক যুবক প্রবেশ করল ঘরে। তারচেয়ে বড়ো দুর্ভাগ্যের কথা, ফায়ারপ্লেসের ঠিক পাশে গিয়ে বসল সে। ওহ! একদম আনকোরা মাল মনে হচ্ছে, আপন মনে ভাবল এসি। নতুন শিকার পেয়েছে ধরে নিয়ে বসল ছেলেটার পাশে। এক হাত ছেলেটার হাঁটুতে বোলাতে বোলাতে, অন্য হাত ঢুকিয়ে দিল কোটের পকেটে। ঠিক সেই সময় ফিরে তাকাল ছেলেটি, নীল একজোড়া চোখের মাঝে যেন ডুবে গেল এসি।
যেমন ডুবেছিল সেই বেশ কটা বছর আগে!
বার্থোলোমিউ-এর মুখে শুনতে পেল ও নিজের নাম।
পরদিনই নিউগেট জেলে নিয়ে যাওয়া হলো ওকে, অভিযোগ আনা হলো দ্বীপান্তর থেকে ফিরে আসার। অপরাধ প্রমাণিত হলো তার। কিন্তু এসি দাবি জানাল, সে গর্ভবতী। এসব দাবি প্রমাণ বা খারিজ করার জন্য নিয়োজিত মহিলারাও মানতে বাধ্য হলো যে আসলেই তাই-এসি সন্তান-সম্ভবা। তবে এই বাচ্চার বাবা কে, তা বলতে অস্বীকৃতি জানাল মেয়েটা।
মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে রেহাই পেল মেয়েটা, তবে আজীবনের জন্য দ্বীপান্তরের সাজা শোনাল হলো ওকে
এবার যে জাহাজটায় ওকে তোলা হলো, তার নাম সি-মেইডেন। দ্বীপান্তরের সাজা পাওয়া দুইশ কয়েদি ছিল সেই জাহাজে। এমনভাবে তাদেরকে ভরা হয়েছিল হোল্ডে যেন ওরা আসলে শুয়োর, বিক্রি করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জ্বর আর ডায়রিয়ায় প্রায় প্রতিদিন মারা যেত কেউ-না- কেউ। বসার জায়গা মেলাও মুশকিল, তাই শোবার তো প্রশ্নই ওঠে না। হোল্ডের পেছন দিকে এক মহিলা বাচ্চা প্রসব করতে গিয়ে মারা গেল। কয়েদিরা সেই লাশ আর নবজাতককে ঠেলে ফেলে দিল পোর্টহোল দিয়ে! এসির তখন আট মাস চলে। ওর যে গর্ভপাত হয়নি, সেটাই এক আশ্চর্যের ব্যাপার।
পরবর্তী জীবনটায় বহুবার দুঃস্বপ্নে এই হোল্ডে অবস্থানের দিনগুলো হানা দিয়েছে ওকে। রাতে চিৎকার করতে করতে ঘুম থেকে জেগেছে সে, মুখে পেয়েছে ওই জায়গার স্বাদ।
সি-মেইডেন নোঙর ফেলল ভার্জিনিয়ার নরফোকে। এসিকে কিনে নিলো একজন আপাত গরীব কৃষক। জন রিচার্ডসন নামের লোকটা তামাক চাষ করত। বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে এই এক সপ্তাহ আগে মারা গেছে তার স্ত্রী। তাই একজন দাই-মার খুব দরকার, সেই সাথে যদি ঘরের কাজ করার মতো কাউকে পাওয়া যায় তো আরও ভালো।
ছেলে অ্যান্থনিকে নিয়ে তাই রিচার্ডসনের ঘরে উঠে এলো এসি। সবাইকে বলল, ছেলের নাম রেখেছে তার বাবার নামে। কে জানে, হয়তো আসলেই কোন এক অ্যান্থনিকে শয্যা-সঙ্গী বানিয়েছিল ও। অচিরেই দেখা গেল, এসির এক স্তন থেকে দুধ খাচ্ছে অ্যান্থনি…আর অন্য স্তন থেকে তামাক চাষির কন্যা ফাইলিডা রিচার্ডসন। প্রথমে মেয়েটা খেত বলে হৃষ্ট-পুষ্ট হয়ে বেড়ে উঠল সে, আর অ্যান্থনি দুর্বল হয়ে; অপুষ্টিতে বেঁকে গেল ওর বাঁ পা।
এসির দুধের পাশাপাশি, ওর বলা গল্প শুনেও বেড়ে উঠল বাচ্চারা। মাইনে বাস করা নকারদের গল্প শোনাল ও, বাদ দিল না দুষ্ট বুকাদের গল্পও। পিস্কিদের কাহিনি তো পারলে প্রতিদিন শোনায়, যাদের জন্য সব সময় প্রথম মাছটা, প্রথম রুটিটা তোলা থাকত। আপেল গাছ-মানবদের গল্পও বাদ দিল না, মন চাইলে মানুষের সাথে কথা বলত তারা। আর খেতে সাইডার ফলাতে চাইলে তাদেরকে তুষ্ট করতেই হতো চাষিদের। কর্নিশ টানে ওদেরকে গান গেয়ে শোনা বিপজ্জনক গাছদের গল্প-
এলম হলো গম্ভীর,
ঘৃণা ভরা ওক গাছ;
ধরে নেবে উইলো,
যদি বাইরে করো রাত।
এই সব গল্প দারুণ আগ্রহের সাথে শোনাত এসি, বাচ্চারও শুনত সমান আগ্রহ নিয়ে।
ছোটো থেকে আস্তে আস্তে বড়ো হতে শুরু করল ওদের খামার। প্রতি রাতে এসি ট্রেগোয়ান পিস্কিদের জন্য পাত্র-ভরতি দুধ রেখে দিত পেছনের দরজায়। প্রায় আট মাস পর, এক রাতে এসির শোবার ঘরের সামনে এসে উপস্থিত হলো জন রিচার্ডসন। যা চাইল, তা কেবল কোনো রমণীর পক্ষেই এক পুরুষকে দেওয়া সম্ভব। মেয়েটা তাকে জানাল, সম্মানিত একজন পুরুষের কাছ থেকে এমন প্রস্তাব একদম আশা করেনি ও। হাজার হলেও সে একজন বিধবা…সাজাপ্রাপ্ত মহিলা। তাকে এমন প্রস্তাব দেওয়া অত্যাচার করারই নামান্তর। মেয়েটার সজল চোখ দেখে মাফ চাইল রিচার্ডসন। সে রাতেই, সেই করিডরে হাঁটু গেঁড়ে বসল এসির সামনে…প্রস্তাব দিল বিয়ের। সানন্দে রাজি হলো এসি, তবে বিয়ের আগে একরাতের জন্যও শয্যা সঙ্গিনী হলো না রিচার্ডসনের। বিয়ের পর চিলেকোঠার ছোটো ঘরটি ছেড়ে এসে উঠল বড়ো মাস্টাররুমে। যে-ই দেখত ওকে, সে-ই বলত-রিচার্ডসন দারুণ সৌভাগ্যবান!
এক বছরের মাথায় আরেক ছেলে সন্তান জন্ম নিলো ওদের ঘরে। পিতার নামানুসারে নবজাতকের নাম রাখা হলো জন।
প্রতি রবিবার চার্চে যেত তিন বাচ্চা, শুনত ভ্রাম্যমাণ যাজকের বাণী। এরপর যেত লেখাপড়া শিখতে। এসবে আপত্তি নেই এসির; তবে পিস্কিদের রহস্য যেন ভুলে না যায় ওরা, সে ব্যাপারে কড়া নজর রাখত। বাচ্চারা যখন স্কুলে যাবার জন্য বের হতো, সবার এক পকেটে কিছুটা লবণ আর অন্য পকেটে রুটি দিয়ে দেত ও। জীবন আর পৃথিবীর প্রাচীন এই দুই নিদর্শন নিশ্চিত করবে বাচ্চাদের নিরাপদে ঘরে ফেরা।
ভার্জিনিয়ার মনোরম পাহাড়ি এলাকায় আস্তে আস্তে বেড়ে উঠল বাচ্চারা, শক্তিশালী আর লম্বা হয়ে (কেবল অ্যান্থনি বাদে। বড়ো হয়েও কাটেনি ওর দুর্বলতা, প্রায়শই অসুস্থ থাকত বেচারা)। আনন্দে সময় কাটতে লাগল রিচার্ডসন পরিবারের। স্বামীকে সত্যি সত্যি দারুণ ভালোবাসত এসি। বিয়ের প্রায় এক দশক পর আচমকা জন রিচার্ডসনের এমন তীব্র দাঁতে ব্যথা শুরু হলো যে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেল চাষি। কাছের শহরে গিয়ে তুলে ফেলা হলো দাঁতটাকে, কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। রক্ত দুষিত হয়ে মারা গেল বেচারা। তাকে কবর দেওয়া হলো একটা উইলো গাছের নিচে।
রিচার্ডসনের দুই সন্তান বড়ো হবার আগ পর্যন্ত তাই খামার দেখা-শোনার ভার এসে চাপল সদ্য বিধবা এসির উপর। দক্ষতার সাথে সবকিছু সামলে নিলো সে, দাস আর কেনা অপরাধীদের পরিচালনা করতে কষ্ট পোহাতে হলো না। প্রতি বছর বেড়েই চলল তামাকের ফলন। আর প্রতি বছর নিউ ইয়ার’স ইভের সময় আপেল গাছের নিচে সাইডার ঢেলে গেল ও, ফলনের সময় সদ্য বানানো রুটি রাখল খেতে। প্রতিরাতে পাত্র ভরতি দুধ দরজার বাইরে রেখে দিতেও ভুল করল না। নাম ছড়িয়ে পড়ল খামারের। সবাই জানত: রিচার্ডসনের বিধবা দাম রাখে বটে, কিন্তু মাল দেয় সেরা।
আরও দশ বছর পার হলো এভাবেই। কিন্তু তারপর এলো বাজে একটা বছর। ওর ছেলে অ্যান্থনি, খুন করে বসল জনিকে। ঝগড়ার সূত্রপাত হয়েছিল খামারের মালিকানা আর ফাইলিডার বিয়ে নিয়ে। অনেকে বলে, ইচ্ছা করে কাজটা করেনি অ্যান্থনি। আবার অনেকের মতই ভিন্ন। যাই হোক, পালিয়ে গেল ছেলেটা। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে সন্তানকে তার পিতার পাশে কবর দিল এসি।
অনেকেই বলল, অ্যান্থনি বোস্টনে পাড়ি জমিয়েছে। আবার কেউ কেউ জানাল, ওকে দক্ষিণে যেতে দেখেছে। তবে ছেলেটার মায়ের ধারণা, ইংল্যান্ডের জাহাজে উঠেছে সে। হয়তো রাজা জর্জের হয়ে বিদ্রোহী স্কটদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য নাম লিখিয়েছে।
যাই হোক, দুই ছেলের কেউ নেই বলে ফাঁকা হয়ে গেল খামারটা। এদিকে ফাইলিডার মুখে হাসি নেই। সারাক্ষণ বিলাপ করে সে। সৎ মা যা-ই বলুক বা করুক না কেন, ক্ষণিকের জন্যও তা থামে না।
তবে দুঃখ যতোই গভীর হোক না কেন, খামার চালাতে একজন পুরুষ মানুষ বড়ো দরকার! তাই হ্যারি সোমসের সাথে বিয়ে হলো ফাইলিডার। ছেলেটা ছিল জাহাজের ছুতার। কিন্তু সাগরে কয়েকদিন ভেসেই তার সমুদ্র- ভ্রমণের সব শখ মিটে গেছে। লিংকনশায়ারের যে খামারে ও বড়ো হয়েছে, সে রকম একটা খামারে জীবনের বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দিতে চায় এখন। রিচার্ডসনদের খামারের সাথে ওটার খুব বেশি মিল না থাকলেও, যা পেয়েছে তাতেই খুশি ছেলেটা। এই দম্পতির পাঁচজন সন্তান হলো, তবে বেঁচে রইল তাদের মাঝে মোট তিনজন।
বিধবা রিচার্ডসনের খুব মনে পড়ত দুই পুত্রের কথা, স্বামীর অভাবটাও খুব করে বোধ করত সে। এখন অবশ্য অনেক ভেবেও তার সম্পর্কে খুব বেশি কিছু মনে করতে পারে না ও, শুধু এটুকুই যে লোকটা ওর খুব দেখভাল করত। ফাইলিডার সন্তানেরা গল্প শুনতে আসত এসির কাছে। মুরের কালো কুকুর, আপেল বৃক্ষ-মানব আর হাড়-ঝকমকির গল্প শোনাত ও। তবে বাচ্চারা ওসব শুনতে চাইত না। তারা চাইত শুধু জ্যাকের গল্প শুনতে। কীভাবে জ্যাক সিমের বিচি পেল, কীভাবে হত্যা করল দৈত্যকে-এসব। বাচ্চাদেরকে খুব ভালোবাসত এসি, যেন এরা ওর নিজেরই বংশধর।
কোন এক বছরের মে মাসের কথা। রান্নাঘরের পেছনে অবস্থিত বাগানে চেয়ার নিয়ে বসল ও। ভার্জিনিয়ার এই গরমের মাঝেও কেমন করে যেন ঠান্ডা চুপিচুপি প্রবেশ করেছে ওর দেহে। হাড়-মাংস জমিয়ে দিয়েছে। একটু গরম হতে পারলে মন্দ হয় না, সেই সাথে নিয়ে এসেছে পাত্র ভরতি মটরশুঁটি।
রোদ পোহাতে পোহাতে আর মটরশুঁটি চাবাতে চাবাতে বৃদ্ধা মিসেস রিচার্ডসন ভাবল, একবার কর্নওয়ালে ফিরে যেতে পারলে মন্দ হয় না। ছোটো বেলায় কীভাবে পিতার জাহাজ ফেরার অপেক্ষায় বসে রইল পাহাড়ের চূড়ায়, সেই স্মৃতি ভিড় করল ওর মনে। সেই সাথে মনে পড়ল যেন আরেক জীবনের কথা। যে জীবনে চুরি করত ও, সবার অলক্ষ্যে তুলে নিত দোকান থেকে সিল্কের কাপড় আর মানুষের পকেট থেকে ওয়ালেট। নিউগেটের ওয়ার্ডেনের কথাও মনে পড়ল ওর। লোকটা জানিয়েছিল, ওর মামলা আদালতে দাঁড়াতে এখনও বারো সপ্তাহ বাকি আছে। ফাঁসি থেকে বাঁচার উপায় একটাই, এই সময়ের মাঝে গর্ভ-ধারণ করা। লোকটার কর্কশ কণ্ঠে করা ওর রূপের…ওর দেহের প্রশংসা এখনও কানে বাজে এসির। ওয়ার্ডেনের প্রতি তীব্র ঘৃণা নিয়ে দিনের পর দিন স্কার্ট উঠিয়েছে ও। মৃত্যুকে ফাঁকি দেবার জন্য নিজের ভেতরে ধারণ করেছে আরেকটা জীবন।
‘এসি ট্রেগোয়ান?’ অপরিচিত এক লোকের কথায় স্মৃতির জাল যেন ভেঙে গেল।
মুখ তুলে চাইল ও, হাত দিয়ে সূর্যের আলো বাধা দেবার প্রয়াস পেল ‘আমি কি আপনাকে চিনি?’ জানতে চাইল এসি। লোকটার আসা একদম টের পায়নি। সবুজ পোশাকে আপাদ-মস্তক ঘেরা যেন লোকটা-সবুজ প্যান্ট, সবুজ জ্যাকেট আর সবার ওপরে সবুজ কোট। চুলগুলো গাজরের মতো লাল, হাসিটা একটু বাঁকানো। লোকটার মাঝে এমন কিছু আছে, যা যে কারও মন ভালো করে দেয়। আবার এমন কিছুও আছে যা চিৎকার করে জানাচ্ছে-এই লোকের সাথে ঝামেলায় যেয়ো না। ‘তা বলতে পারো।’ উত্তর দিল সে।
চোখ কুঁচকে লোকটার দিকে তাকাল এসি, মনে মনে তার পরিচয় খুঁজে বেড়াচ্ছে। বয়সে ওর নাতী-নাতনীদের সমান হবে। কিন্তু ডেকেছে আবার প্রায় ভুলে যাওয়া নামটা ধরে। কণ্ঠে কেমন যেন একটা টান, যে টানটা শুনেছে সেই ছোটো বেলায়। কর্নওয়ালের সৈকত আর পাথারের ফাঁকে ফাঁকে।
‘তুমি কর্নিশ নাকি?’ জানতে চাইল সে।
‘হ্যাঁ,’ বলল লাল চুলো লোকটা। ‘মানে ছিলাম। এখন আমি নতুন দুনিয়ার অধিবাসী। যেখানে কেউ একজন সৎ লোকের জন্য এক পাত্র এল বা এক গ্লাস দুধ পরিবেশন করে না। যেখানে ফসল তোলার সময় কেউ খেতে রেখে আসে না এক টুকরা রুটি।
‘আমি মনে হয় তোমাকে চিনতে পেরেছি,’ জানাল এসি। ‘যদি ভুল না হয়ে থাকে, তাহলে আমার ঝগড়া নেই তোমার সাথে।
‘আমারও তোমার সাথে বিবাদ নেই।’ একটু মন খারাপ করা কণ্ঠে বলল লোকটা। ‘যদিও তুমি আর তোমার মতো কয়েকজন আমাকে নিয়ে এসেছ এখানে। এই জায়গায় জাদু নেই; পিস্কি বা তাদের মতোদের আশ্রয়ও নেই।’
‘আমার দিকে সব সময় নজর ছিল তোমার।’ বলল এসি।
‘কখনও ভালো করেছি, কখনও মন্দ। আমরা আসলে বাতাসের মতো, দুই দিকেই যার গমন।’
মাথা দোলাল এসি।
‘আমার হাত ধরবে, এসি ট্রেগোয়ান?’ বলে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দল লাল-চুলো। বয়স হয়েছে বৃদ্ধার, চোখেও কম দেখে। কিন্তু হাতের কমলা পশম দেখতে ভুল হলো না এসির। বিকালের আলোতে সোনালি দেখাচ্ছে। ঠোঁট কামড়ে ধরল ও, তারপর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের হাত রাখল হাতটায়।
এসি ট্রেগোয়ানের লাশ যখন আবিষ্কৃত হলো, তখনও গরম রয়েছে দেহটা। তবে প্রাণবায়ু উড়ে গেছে অনেক আগেই।
অথচ অর্ধেক মরটশুঁটি রয়ে গেছে পাত্রে।