অধ্যায় তিন
প্রতিটা ঘণ্টাই যেন উপহার দেয় প্রাণঘাতী ক্ষত, তবে একেবারে শেষেরটাই কেড়ে নেয় জীবন।
–প্রবচন
.
মোটেল আমেরিকার পেছনে বসে আছে শুকনো এক যুবতী। শ্যাডো নিজের পরিচয় দেওয়া মাত্র জানাল: ওর জন্য আগে থেকেই ঘর ভাড়া করা আছে। হালকা সোনালি চুল আর ইঁদুরমুখো চেহারায় সন্দেহ যেন পাকাপাকি ভাবে গেঁড়ে বসেছে মেয়েটার। কিন্তু হালকা হাসিতেই সেই কুঞ্চন দূর হয়ে গেল অনেকটা। ওয়েনসডের রুম নম্বরটা কিছুতেই তার মুখ থেকে বের করতে পারল না শ্যাডো, তবে প্লাস্টিক কার্ডটা ওকে ধরিয়ে দিল যুবতী। জানাল, মোটেলের নম্বরে ফোন করলে মি. ওয়েনসডেকে জানিয়ে দেওয়া হবে যে তার কাছে অতিথি এসেছে। সরাসরি রুম নম্বর জানাবার নিয়ম নেই।
তাই করল শ্যাডো। হলের শেষ মাথার একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন প্রৌঢ়।
‘অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কী খবর?’ জানতে চাইলেন তিনি।
‘শেষ হলো।’
‘ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে চাও?’
‘না,’ সাফ মানা করে দিল শ্যাডো।
‘খুব ভালো,’ দাঁত বের করে হাসলেন ওয়েনসডে। ‘আজকাল সবাই শুধু কথাই বলে। কথা…কথা… কথা। অথচ নাগরিকরা মুখ বুজে থাকতে জানলে এই দেশটা আজ অনেক ভালো একটা অবস্থানে থাকত!’
নিজের ঘরের দিকে ওকে নিয়ে গেলেন তিনি, শ্যাডোর ঘরটা ওপাশেই। ঘরে শুধু মানচিত্র আর মানচিত্র, কিছু বিছানার উপর খোলা পড়ে আছে। আবার কিছু দেয়ালে লাগানো। উজ্জ্বল কমলা রঙের কলম দিয়ে সবগুলোকে ইচ্ছামতো দাগিয়েছেন ভদ্রলোক। সেই সাথে গোলাপি আর সবুজ রঙও আছে।
‘আমাকে একটা মোটা ছেলে অপহরণ করেছিল।’ বলল শ্যাডো। ‘বলল যে আপনারা নাকি ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে বাস করছেন এখন! ওখানেই থাকতে হবে আপনাদের। আর ওই হোঁতকার মতো যারা আছে, তারা এগিয়ে যাবে আগামীর দিকে।’
‘ইঁচড়ে-পাকা কোথাকার।’ বললেন ওয়েনসডে।
‘আপনি চেনেন ছেলেটাকে?’
শ্রাগ করলেন প্রৌঢ়। ‘চিনি বলব না, তবে জানি।’ ঘরের একমাত্র চেয়ারটায় বসে পড়লেন তিনি। ‘আমার ব্যাপারে ওদের আসলে কোনো ধারণাই নেই। যাক, আর কতোদিন শহরে থাকতে হবে তোমাকে?’
‘জানি না। হয়তো আরেক সপ্তাহ। লরার কাজ আর জিনিসপত্রের একটা গতি করতে যতদিন লাগে আরকী। অ্যাপার্টমেন্টটার একটা ব্যবস্থাও করতে হবে।’
বড়োসড়ো মাথাটা নাড়লেন ওয়েনসডে। ‘যত তাড়াতাড়ি তোমার কাজ শেষ হবে, তত তাড়াতাড়ি ইগল’স পয়েন্ট থেকে বেরোতে পারব। শুভ রাত্রি।
হলঘর পার হলো শ্যাডো। তার কামরাটা অবিকল ওয়েনসডের কামরার মতো। এমনকি বিছানার উপর অস্তগামী সূর্যের ছবিটাও এক! পিজ্জার অর্ডার দিয়ে গোসলে ঢুকল ও। দেহের আকারের জন্য বাথটাবে শোয়াটা সম্ভব হবে না। তাই কাঁচুমাচু হয়ে বসেই পড়ল। ঠিক করেছিল, জেল থেকে বেরিয়ে যথাসম্ভব সময় নিয়ে গোসল সারবে। তাই করছে এখন।
গোসল থেকে বেরোবার কিছুক্ষণের মাঝেই এসে গেল পিজ্জা, আরাম করে খেল শ্যাডো। অন্য হাতে নিলো একটা রুট বিয়ার।
বিছানায় শুয়ে পড়ল ও। মুক্ত মানুষ হিসাবে এই প্রথম কোন বিছানায় পিঠ ঠেকাচ্ছি, ভাবতেই দারুণ এক পুলক অনুভব করল মনে। পর্দা সরানোই আছে। রাস্তা দিয়ে ভেসে আসছে চলন্ত গাড়ির আলো। স্বস্তি বোধ করছে ও, চাইলে এখনই ওই রাস্তায় গিয়ে পা রাখতে পারে। বাধা দেবার জন্য না রয়েছে কোনো রক্ষী, আর না রয়েছে কোনো গরাদ।
অবশ্য ওর আর লরার অ্যাপার্টমেন্টটাতে চাইলেই রাতটা কাটিয়ে আসতে পারত শ্যাডো। কিন্তু স্ত্রীকে ছাড়া ওই ঘরে…ওই বিছানায় রাত কাটাবার কথা ভাবতেই পারছে না সে! লরার জামাকাপড়, ওর দেহের গন্ধ…এসবের কথা মনে পড়া মাত্র খচ করে উঠছে বুকের ভেতরটা।
ওভাবে ভেবো না, নিজেকেই বকল শ্যাডো। জোর করে মনটাকে পয়সার খেলার দিকে ফিরিয়ে আনল। সে জানে, জাদুকর হবার মতো ব্যক্তিত্ব নেই ওর, ওসব বাচ্চাদের খেলা দেখাবার বা মিথ্যা বলে দর্শকের মন ভরাবার ইচ্ছাও নেই। তবে এই পয়সার ব্যাপারটা আলাদা। এটা ম্যাজিক ট্রিক না, ওর কাছে এটাই শিল্প। আচমকা শ্যাডোর মনে পড়ল, লরার কবরে একটা সোনার পয়সা রেখে এসেছে সে! তারপর মনে পড়ে গেল অড্রির বলা কথাটা, তোমার স্ত্রী…অভিমানের একটা দলা যেন খোঁচাতে শুরু করল ওকে।
প্রতিটা ঘণ্টাই যেন উপহার দেয় প্রাণঘাতী ক্ষত, তবে একেবারে শেষেরটাই কেড়ে নেয় জীবন-কোথায় যেন শুনেছে প্রবচনটা।
ওয়েনসডের কথা মনে পড়তেই আপনমনে হাসল শ্যাডো। অনেকের মুখেই শুনেছে, মনের কথা চেপে না রাখাই ভালো। এতে বুক হালকা হয়। ও কিন্তু মনের কথা চেপে রাখার পক্ষে। দীর্ঘ দিন ধরে কাজটা করলে একসময় অনুভূতিগুলো সব হারিয়ে যেতে শুরু করে।
নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়ল শ্যাডো।
এবারের স্বপ্নে ও হাঁটছে…
.
এমন একটা ঘর ধরে ও হাঁটছে, যেটা আকারে শহরের চাইতে বড়ো। যেদিকেই চোখ যায়, সেদিকেই শুধু মূর্তি আর দেয়াল ভরতি খোদাই করা চিত্র। মহিলার মতো দেখতে এক মূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে আছে ও। বেলুনের মতো বড়ো বড়ো স্তনজোড়া ঝুলছে মহিলার, কোমরের কাছে অনেকগুলো কাটা হাত—একটা শিকল তৈরি করেছে যেন। দুহাতেই একটা করে তীক্ষ্ণধার ছুরি ধরে আছে মেয়েটা। ঘাড়ের দুপাশ থেকে ফণা উঁচু করে আছে দুটো সাপ, যেন ছোবল বসাবে। পুরো মূর্তিটার মাঝে কেমন যেন অশ্লীল আর অশুভ একটা ব্যাপার আছে। চমকে উঠে পিছিয়ে এলো শ্যাডো।
এরপর হল ধরে এগিয়ে যেতে শুরু করল ও। মূর্তিগুলোর চোখ যেন জীবন্ত, ওর প্রতিটা পদক্ষেপ খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করছে।
স্বপ্নের মাঝেই শ্যাডো টের পেল: প্রতিটা মূর্তির সামনের মেঝেতে তাদের নাম খোদাই করা। সাদা চুল, দাঁতের নেকলেস গলায় নিয়ে ড্রাম হাতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার নাম লিউসেটিয়াস[৪]। চওড়া কোমরের মহিলার নাম হোবোর[৫], তার দুপায়ের ফাঁক থেকে ঝরে পড়ছে দৈত্যরা!
[৪. রোমান দেবতা, পরবর্তীতে যুদ্ধ-দেব মার্স-এর সঙ্গে একীভূত হয়।
৫. সুমেরিয় দেবী, তিয়ামাতের সঙ্গে অনেকে একীভূত করেন।]
তীক্ষ্ণ, তবে নিশ্চিত একটা কণ্ঠ কথা বলে উঠল, অথচ কাউকে দেখতে পেল না শ্যাডো।
‘এই দেব-দেবীদের সবাই ভুলে গেছে, তাই এক অর্থে তাদের মৃতই বলা চলে। কেবল ইতিহাসের পাতায় রয়ে গেছেন এরা। সবাই চলে গেছেন, তবে তাদের নাম আর প্রতিকৃতি আমাদের সাথে রয়ে গেছে।’
আরেকটা মোড় ঘুরল শ্যাডো, বুঝতে পারল যে ভিন্ন একটা ঘরে এসে উপস্থিত হয়েছে। এটা আকারে প্রথমটার চাইতেও বড়ো, শেষ দেখা যাচ্ছে না। ওর একদম কাছেই একটা ম্যামথের খুলি, বাঁ দিকে আলখাল্লা পরিহিত এক মহিলা। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে তিন-রমণী, প্রত্যেককে একই গ্রানাইটের চাঁই থেকে খোদাই করা হয়েছে। কোমরের কাছে জোড়া লেগে আছে তিনজনের, চেহারা অসমাপ্ত। তবে তাদের স্তন আর স্ত্রী-জননাঙ্গ খুব যত্নের সাথে খোদাই করা হয়েছে। আরেকটা পাখিও দেখতে পেল ও, উড়ছে না। তবে চিনতে পারল না আকারে নিজের চাইতে দ্বিগুণ বড়ো পাখিটাকে। তার মুখটা শকুনের মতো, কিন্তু হাত মানুষের। এরকম আরও অগণিত মূৰ্তি পড়ল পথে।
আরেকবার কথা বলে উঠল কণ্ঠটা, যেন কোন ক্লাস রুমে পড়াচ্ছে। ‘এই দেবতারা কারো স্মৃতিতেও ঠাঁই করে নিতে পারেননি, এমনকী তাদের নামও আজ আমাদের জানা নেই। যারা এই দেবতাদের পূজা করত, তারাও বিলীন হয়ে গেছে ইতিহাসের পাতা থেকে। তাদের শেষ পূজারিরাও অন্য কাউকে গোপন কথাগুলো শিখিয়ে যেতে পারেননি।
দেবতারাও মৃত্যু বরণ করেন। তবে প্রকৃত মৃত্যু তো আসে তখন, যখন সবাই ভুলে যায়। মানুষ খুন করার চাইতে আদর্শকে খুন করা কঠিন, তবে একদিন না একদিন মারা যেতে হয় তাকেও!’
আচমকা গা-শিহরানো ফিসফিসানি আওয়াজে ভরে গেল হলঘর। ভয় এসে বাসা বাঁধল শ্যাডোর মনে। চারিদিকে কেবল বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া দেবতারা…কারও চেহারা অক্টোপাসের মতো, কারও কেবল হাতটা মমি করা…
.
ঝটকা দিয়ে ঘুম থেকে উঠল শ্যাডো, হৃৎপিণ্ড যেন পাগলা ঘোড়ার বেগে ছুটছে। কপাল ঠান্ডা হয়ে এসেছে, ঘুমের আর লেশ মাত্র নেই। বিছানার পাশের ঘড়িটা লাল রঙা সময় দেখাচ্ছে-একটা তিন বাজে এখন। মোটেল আমেরিকা লেখা সাইনটার আলো জানালা দিয়ে হালকা ঢুকছে ওর ঘরে। কিছুটা অসংলগ্নভাবেই উঠে দাঁড়িয়ে ছোট্ট বাথরুমে গেল শ্যাডো। আলো না জ্বেলেই প্রস্রাব করল বেশ কিছুক্ষণ ধরে, এরপর আবার ফিরে এলো বিছানায়। স্বপ্নটা বড়ো জীবন্ত, কিন্তু ওটাকে যে কেন দুঃস্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে, তা ধরতে পারছে না।
বাইরে থেকে আলো হালকা, তবে আঁধার সয়ে এসেছে শ্যাডোর চোখে। তাই বিছানার পাশে বসে থাকা মেয়েটাকে পরিষ্কার দেখতে পেল।
একে চেনে ও। হাজারো জনের…নাহ, লাখো মানুষের ভিড়েও পারবে। যে নীল স্যুটটা পরিয়ে কবর দেওয়া হয়েছিল মেয়েটাকে, এখনও সেটাই পরে আছে। ফিসফিস করে কথা বলল মেয়েটা, তবে পরিচিত কণ্ঠ। ‘নিশ্চয়ই ভাবছ,’ বলল লরা। ‘আমি এখানে কী করছি?’
শ্যাডো বলল না কিছুই।
চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে রইল ঘরটার একমাত্র চেয়ারে। প্রশ্ন করল, ‘আসলেই কি তুমি এসেছ?’
‘হ্যাঁ,’ উত্তর দিল মেয়েটা। ‘আমার ঠান্ডা লাগছে, পাপি।’
‘তুমি মারা গেছ, সোনামণি।’
‘হ্যাঁ।’ বলে নিজের পাশে চাপড় দিল লরা। ‘এসো, আমার পাশে বসো।’
‘নাহ।’ অস্বীকৃতি জানাল শ্যাডো। ‘আমি যেখানে আছি, সেখানেই থাকি বরং। তোমার সাথে আমার কিছু বোঝা-পড়া আছে।’
‘যেমন? মারা গেলাম কেন?’
‘তারচেয়ে বড়ো প্রশ্ন, মারা যাবার সময় কী করছিলে তুমি? তোমার আর রবির কথা বলছি।
‘ওহ, ওই ব্যাপার!’
নাকে গন্ধ আসছে শ্যাডোর, অবশ্য সেটা ওর কল্পনাও হতে পারে। শিকড়, ফুল আর রাসায়নিক তরলের গন্ধ পাচ্ছে সে নাকে। তার স্ত্রী…মানে প্রাক্তন স্ত্রী…নাহ, তা-ও হলো না। ওর মরহুমা স্ত্রী বসে আছে বিছানায়! এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওরই দিকে!
‘পাপি,’ বলল লরা। ‘আমাকে একটা…একটা সিগারেট এনে দিতে পারবে?’
‘আমি তো জানতাম তুমি ছেড়ে দিয়েছ।’
‘তা দিয়েছিলাম।’ বলল মেয়েটা। ‘তবে এখন আর স্বাস্থ্য নিয়ে খুব একটা দুশ্চিন্তা করছি না। সিগারেট পেলে স্নায়ু শান্ত হবে বলেই মনে হচ্ছে। লবিতে একটা ভেন্ডিং মেশিন দেখেছি।’
জিন্স-টি শার্ট পরে খালি পায়েই লবিতে চলে এলো শ্যাডো। রাতের বেলা রিসেপশন সামলাচ্ছে এক মাঝবয়সি লোক। জন গ্রিশামের একটা বই একমনে পড়ে চলছে সে। মেশিন থেকে এক প্যাকেট ভার্জিনিয়া স্লিমস কিনল শ্যাডো। রাতের লোকটার কাছে গিয়ে চাইল এক বাক্স ম্যাচ।
‘আপনি যে ঘরে উঠেছেন, সেটায় ধূমপান করা নিষিদ্ধ।’ বলল লোকটা। ‘তাই খেলে, জানালা খুলে খাবেন।’ বলে ম্যাচের বাক্স আর মোটেল আমেরিকার লোগো আঁকা একটা প্লাস্টিকের অ্যাশট্রে দিল সে।
‘বুঝতে পেরেছি।’ বলল শ্যাডো।
ঘরে ফিরে এসে দেখে, লরা বিছানার উপর গা এলিয়ে দিয়েছে। জানালা খুলে সিগারেটের প্যাকেটটা ওর হাতে দিল শ্যাডো, সেই সাথে ম্যাচটাও। স্ত্রীর…মৃতা স্ত্রীর আঙুলগুলোকে ঠান্ডা মনে হলো খুব। সিগারেট ধরিয়ে ম্যাচের আলোয় নিজের নখ দেখল মেয়েটা। সাধারণত নিখুঁত থাকে ওগুলো। কিন্তু এখন ভেঙে গেছে, নিচে স্থান করে নিয়েছে মাটি।
লম্বা একটা টান দিয়ে ম্যাচ নিভিয়ে ফেলল মেয়েটা। এরপর আরেকটা টান দিল। ‘বিন্দুমাত্র স্বাদ পাচ্ছি না।’ বলল সে। ‘কাজ হচ্ছে বলে মনে হয় না।’
‘আমি দুঃখিত।’ বলল শ্যাডো।
‘আমিও।’
সিগারেটে টান দেবার সাথে সাথে আরও বেশি করে জ্বলে উঠছে আগুন, তার আলোয় স্ত্রীর চেহারা দেখতে পাচ্ছে শ্যাডো।
‘তোমাকে তাহলে আগেই ছেড়ে দিয়েছে।’ বলল মেয়েটা।
‘হ্যাঁ।’
সিগারেটের আগুনটাকে কেন যেন কমলা দেখাচ্ছে। ‘আমি এখনও তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ। আসলে তোমাকে ওই ব্যাপারটার সাথে জড়ানো একদম ঠিক হয়নি।
‘দোষ আমারও আছে। চাইলে মানা করতে পারতাম।’ বলতে বলতেই শ্যাডো ভাবল, মেয়েটাকে দেখে কেন পিলে চমকে যাচ্ছে না ওর? স্বপ্নে দেখা একটা জাদুঘর ওকে ভয় পাইয়ে দিতে পারে, অথচ চলতে-ফিরতে থাকা একটা জিন্দা লাশ দেখে বিন্দুমাত্র ভয় পাচ্ছে না!
‘তা পারতে,’ ধোঁয়ায় ঢেকে আছে লরার চেহারা। আধো আলোয় খুব সুন্দর দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। ‘আমার আর রবির ব্যাপারটা জানতে চাও?’
‘মন্দ হয় না।’
লরা অ্যাশট্রেতে ঠেসে ধরল সিগারেট। ‘তুমি জেলে ছিলে,’ বলল সে। ‘আমার কথা বলার মতো একজন দরকার ছিল, বিপদে-আপদে যে সান্ত্বনা দেবে। তুমি আমার কাছে ছিলে না। আমি হতাশ হয়ে পড়েছিলাম।’
‘আমি দুঃখিত,’ শ্যাডো টের পেল, মেয়েটার কণ্ঠে একটু পরিবর্তন আছে। কিন্তু কী সেই পরিবর্তন, তা ধরতে পারল না ও।
‘জানি আমি। যাই হোক, তাই মাঝে-সাঝে রবির সাথে কফি খেতে যেতাম। তুমি জেল থেকে বের হলে কী কী করব, তা নিয়ে গল্প করতাম। রবি কিন্তু তোমাকে খুব পছন্দ করত, তোমাকে আবার কাজে নেওয়ার জন্য ওর তর সইছিল না।’
‘জানি।’
‘একদিন হঠাৎ বোনের বাড়িতে বেড়াতে গেল অড্রি। তোমার জেলে যাবার প্রায় তেরো মাস পরের কথা।’ অনুভূতি-শূন্য কণ্ঠে বলছে লরা। ‘রবি দেখা করতে এলো, মদ খেয়ে মাতাল হলাম দুজন। তারপর মেঝেতেই সঙ্গম করলাম। খুব ভালো লেগেছিল, সত্যি বলছি।’
‘এই অংশটুকু আমার না শুনলেও চলবে!’
‘তাই নাকি? মারা যাবার পর আসলে এসব অনুভূতি ঠিক কাজ করে না। মনে হয় যেন কোনো ছবি দেখছি। বাদ দাও এসব অর্থহীন ব্যাপার।
‘ব্যাপারটা কিন্তু আমার কাছে অর্থহীন না।’
আরেকটা সিগারেট ধরাল লরা। মেয়েটার চলনভঙ্গিতে কোন জড়তা নেই, ঠিক যেন আগের লরা সে। শ্যাডোর তো সন্দেহই হলো, সত্যি সত্যি মেয়েটা মারা গেছে তো? নাকি রসিকতা করা হচ্ছে ওর সাথে। ‘হুম,’ বুঝতে পারছি। ‘পরকীয়া চলতে লাগল আমাদের। অবশ্য এই ব্যাপারটাকে আমরা পরকীয়া বলতাম না, আসলে বলতাম না কিছুই। প্রায় দুই বছর ছিল সম্পর্কটার আয়ুষ্কাল।’
‘আমাকে ছেড়ে দিতে?’
‘পাগল হয়েছ? আমি তা করতে যাব কেন? তুমি আমার খেলার পুতুল, আমার পাপি। তুমি যা করেছ, তা আমার জন্যই করেছ। আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
আরেকটু হলেই কথাটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে যেত শ্যাডোরও, কোনোক্রমে নিজেকে সামলাল। নাহ, এই তিনটা শব্দ ও কিছুতেই উচ্চারণ করবে না। আর কখনই না। ‘তারপর কী হলো?
‘মারা গেলাম কীভাবে, তা জানতে চাও?’
‘হ্যাঁ।’
‘তোমার ফেরা উপলক্ষে আমি আর রবি সারপ্রাইজ পার্টি দেওয়া নিয়ে কথা বলছিলাম। দারুণ মজা হতো কিন্তু! সেই সাথে এটাও বললাম, আমাদের সম্পর্কের এখানেই শেষ। তুমি ফিরে আসছ, তাই আর এসব চলতে পারে না।’
‘উম, ধন্যবাদ, সোনা।’
‘ওয়েলকাম, প্রিয়।’ ভূতুড়ে একটা হাসি খেলে গেল মেয়েটার চেহারায়। ‘মদের বোতল খোলা হলো, আমি মাতাল হয়ে গেছিলাম। অবশ্য রবি এক ফোঁটা মদ ছোঁয়নি, গাড়ি তো ওকেই চালাতে হতো। বাড়ি ফিরছিলাম, এমন সময় পুরনো সম্পর্কের খাতিরে আমি ঠিক করলাম, শেষ একবার সুখ দেব ওকে-মুখমেহন করব। রবির প্যান্টের জিপার খুলে তাই করতে লেগে গেলাম।’
‘গাড়ি চালানো অবস্থায়! অনেক বড়ো ভুল করেছ।’
তা তো এখন বুঝতে পারছি। আমার কাঁধে ধাক্কা লেগে গিয়ারের কী যেন হলো। রবি আমাকে সরিয়ে দিতে চাইছিল, এমন সময় কান ফাটানো আওয়াজ হলো একটা। দুনিয়া যখন ঘুরতে শুরু করল, তখন নিজেকেই বললাম, ‘আমি মরতে চলেছি।’ তেমন কোনো অনুভূতি হয়নি তখন আমার, খুব একটা ভয়ও পাচ্ছিলাম না। এরপর আর কিছু মনে নেই।
আচমকা প্লাস্টিক পোড়ার গন্ধ এলো শ্যাডোর নাকে। সিগারেটটা পুড়তে পুড়তে ফিল্টার পর্যন্ত চলে এসেছে, বুঝতে পারল ও। কিন্তু লরার ভ্রুক্ষেপ নেই।
‘এখানে কেন এসেছ তুমি?’
‘স্ত্রী কি তার স্বামীকে দেখার জন্য আসতে পারে না?’
তুমি মৃত। আজ বিকালটা আমার কেটেছে তোমার লাশের সামনে দাঁড়িয়ে!’
‘জানি,’ বলেই চুপ হয়ে গেল লরা, শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। শ্যাডো উঠে, হেঁটে গেল মেয়েটার কাছে। সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরাটা হাতে নিয়ে ফেলে দিল জানালা দিয়ে।
‘কেন এসেছ?’
স্বামীর চোখে চোখ রাখার প্রয়াস পেল মেয়েটা। ‘বেঁচে থাকতে যা জানতাম, এখনও তার চাইতে বেশি কিছু জানি না। আর যা যা জানি, সেগুলোকে ভাষায় প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব না।
‘সাধারণ মানুষ মারা গেলে নিজের কবরেই থাকে, ওখান থেকে উঠে আসে না।’ বলল শ্যাডো।
‘তাই নাকি? সত্যি বলছ, পাপি? আমিও জানতাম যে তারা কবরেই থাকে। কিন্তু এখন আর নিশ্চিত হতে পারছি না।’ বিছানা ছেড়ে জানালার কাছে গেল সে। ওর চেহারায় এসে ঠিকরে পড়ছে মোটেল-সাইনের আলো। অপার্থিব এক সৌন্দর্য যেন ভর করেছে মেয়েটার চেহারায়…এর জন্যই জেলে যেতে হয়েছে শ্যাডোকে। আচমকা যুবকের মনে হলো, কেউ বুঝি ওর হৃৎপিণ্ডটাকে হাতে নিয়ে জোরে পিষছে! ‘লরা…?’
ফিরেও তাকাল না মেয়েটা। ‘তুমি বাজে কিছু ঝামেলার সাথে জড়িয়ে পড়েছ, শ্যাডো। কেউ তোমার উপর নজর না রাখলে, বিপদে পড়বে। চিন্তা করো না, আমি তোমাকে দেখে রাখব। আর হ্যাঁ, উপহারের জন্য ধন্যবাদ।’
‘উপহার মানে?’
ব্লাউজের পকেটে হাত ঢুকিয়ে সোনার পয়সাটা বের করে আনল লরা, এখনও ওটাতে মাটি লেগে আছে। ‘নেকলেস বানিয়ে গলায় ঝুলাতে পারি, অনেক অনেক ধন্যবাদ।’
‘স্বাগতম।’
এমন দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকাল লরা, যেন দেখেও আবার দেখছে না। ‘আমাদের সম্পর্ক বেশ কিছু দিক নিয়ে কাজ করতে হবে।’
‘সোনামণি,’ বলল শ্যাডো। ‘তুমি মারা গেছ।’
‘এটা সেই দিকগুলো মাঝে অন্যতম,’ বলেই একটু থামল মেয়েটা। ‘ঠিক আছে, আপাতত আমি যাচ্ছি।’ যেন কিছুই হয়নি, এমন ভঙ্গিতে শ্যাডোকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল ও। স্বামী লম্বা বলে আগেও পায়ের উপর ভর দিয়েই চুমু খেতে হতো, আজও তাই হলো।
বিব্রত ভঙ্গিতে নিচু হয়ে লরার গালে চুমু খেতে গেল যুবক। কিন্তু একেবারে শেষ ক্ষণটাতে মুখ ঘুরিয়ে চুমুটাকে ঠোঁটে নিলো লরা। জিহ্বা দিয়ে কিছুক্ষণ ঘুরে বেরাল স্বামীর মুখের ভেতরে। ঠান্ডা আর শুকনো মনে হলো জিহ্বাকে। মুখে সিগারেট আর পিত্তের স্বাদ পেল শ্যাডো। স্ত্রী মারা গেছে কি না, সে ব্যাপারে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইল না ওর।
পিছিয়ে এলো ও।
‘আমি ভালোবাসি তোমাকে,’ শান্ত ভঙ্গিতে জানাল মেয়েটা। ‘তোমার প্রতি খেয়াল রাখব।’ মোটেলের দরজা পর্যন্ত হেঁটে গেল ও। ‘ঘুমাও, পাপি। ইচ্ছা করে ঝামেলা তৈরি করো না যেন।’
দরজা খুলল সে, হলওয়ের উজ্জ্বল আলোয় দেখা গেল মেয়েটার আসল রূপ লরাকে দেখতে জীবনস্মৃত বলে মনে হচ্ছে, অবশ্য এই আলোতে সবাইকে তা-ই মনে হয়।
‘চাইলে রাতটা কাটিয়ে যেতে বলতে পারো।’ বলল মেয়েটা।
‘তা পারব বলে মনে হচ্ছে না।’ উত্তর দিল শ্যাডো।
‘পারবে, সোনামণি। এসব কিছু শেষ হবার আগেই পারতে শিখবে।’ বলে করিডরে পা রাখল লরা।
দরজা দিয়ে বাইরে তাকাল শ্যাডো, রাতের লোকটা এখনও তার জন গ্রিশামে বুঁদ হয়ে আছে। লরার দিকে ফিরেও তাকাল না। মেয়েটার পায়ের সাথে মাটি লেগে আছে, সেটার দাগ পড়ছে মাটিতে। অথচ সেদিকেও যেন লোকটার ভ্রুক্ষেপ নেই! অল্পক্ষণের মাঝেই দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল লরা।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল শ্যাডো, আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে ওর হৃৎপিণ্ডের দৌড়। হলঘরের অপর পাশে গিয়ে নক করল ওয়েনসডের দরজায়। কেন জানি ওর মনে হলো, বিশাল এক দাঁড় কাক তার রক্তলাল চোখ দিয়ে ওকে দেখছে!
দরজা খুললেন ওয়েনসডে, কোমরের কাছে একটা সাদা তোয়ালে জড়িয়ে রেখেছেন। এছাড়া দেহে আর একটা সুতাও নেই। ‘কী চাই?’
‘আপনাকে একটা ব্যাপার জানাতে এসেছি।’ বলল শ্যাডো। ‘হয়তো স্বপ্ন ছিল…নাহ, স্বপ্ন নয়। হয়তো ওই মোটা ছোকরার ছাড়া ধোঁয়ার ফল…আবার আমি পাগলও হয়ে যেতে পারি…’
‘বুঝলাম তো। এবার ঝেড়ে কাশো।’ বললেন ওয়েনসডে। ‘আমি একটা কাজের মাঝখানে আছি।’
ঘরের ভেতরে গেল শ্যাডোর নজর। বিছানায় শুয়ে আছে কেউ একজন, ওকে দেখছে। ছোটো ছোটো স্তন দুটো চাদর দিয়ে ঢেকে রেখেছে, সোনালি চুল, চেহারাটা ইঁদুরের কথা মনে করিয়ে দেয়। গলা নামিয়ে আনল যুবক। ‘আমার স্ত্রীকে দেখলাম কেবল…আমারই ঘরে!’
ভূত দেখেছ বলতে চাচ্ছ?’
‘নাহ। ভূত না। রক্ত-মাংসের মানুষ। মৃত, তবে ভূত না। ওকে স্পর্শ করেছি, চুমু খেয়েছি।’
‘বুঝলাম,’ ওয়েনসডে ঘরের ভেতরে উঁকি দিয়ে বললেন। ‘একটু আসছি।’ একটু পরেই দেখা গেল, শ্যাডোর ঘরে বসে আছেন তারা দুজন। বাতি জ্বালিয়ে দিলেন ওয়েনসডে। অ্যাশট্রেতে পড়ে থাকা সিগারেটের টুকরা দেখে বুক চুলকালেন। লোকটার স্তনবৃন্ত বুড়ো মানুষের মতো, দেহের পাশে একটা সাদা ক্ষতের দাগ। নাক টানলেন তিনি, এরপর শ্রাগ করলেন।
‘হুম,’ বললেন তিনি। ‘তো এখন? ভয় পেয়েছ?’
‘একটু।’
‘ভয় পাওয়া উচিত। মৃতদের দেখলে আমিও ভয় পাই। আর কিছু?’
‘আমি ইগল’স পয়েন্টে আর থাকতে চাই না। লরার সবকিছু ওর মা-ই দেখে- শুনে রাখতে পারবেন। আপনি যখন চান, আমি যেতে প্রস্তুত।’
হাসলেন ওয়েনসডে। ‘সুখবর, বাছা। আমরা সকালেই রওনা দেব। এখন একটু ঘুমিয়ে নাও। আমার ঘরে স্কচ আছে, লাগলে খেতে পারো।’
‘নাহ, লাগবে না।’
‘তাহলে আর বিরক্ত করো না আমাকে, লম্বা একটা রাত পড়ে আছে সামনে।’
‘শুভ রাত্রি।’
‘আমার জন্য শুভ বইকি!’ বলে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন ওয়েনসডে।
বিছানায় বসে পড়ল শ্যাডো। এখনও ঘর থেকে গন্ধ যায়নি। লরার জন্য কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছে তার। এটাই হওয়া উচিত, নিজেকে বোঝাল ও। অন্তত মরা মানুষ ফিরে এসে ভয় দেখাবার চাইতে বিলাপ করা ভালো। দুঃখ প্রকাশের সময় এখন, বিলাপের সময়। বাতি বন্ধ করে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল ও, লরার কথা ভাবছে মনে মনে। বিয়ের সময় কী সুখী, হাসোজ্জ্বল আর আনন্দিত লাগছিল মেয়েটাকে! একে-অন্যের শরীর ছাড়া একটা সেকেন্ড ও কল্পনা করতে পারত না। শেষ কবে কেঁদেছে না মনে নেই শ্যাডোর। আসলে কাঁদতে যেন ভুলেই গেছে ও। এমনকী মার মৃত্যু সংবাদ শুনেও চোখ দিয়ে পানি পরেনি।
তবে এখন কাঁদতে শুরু করল। তীব্র কষ্টে যেন ভেঙে যাচ্ছে ওর বুক। সেই ছোট্ট বেলার পর, এই প্রথম কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল বেচারা।
.
আমেরিকায় আগমন
৮১৩ খ্রিষ্টাব্দ
তীর আর আকাশের তারা দেখে সবুজ সাগর পাড়ি দিচ্ছে ওরা, এখন আছে মাঝ-সমুদ্রে। মাটি দেখতে কেমন, সেটা যখন ভুলতে শুরু করেছে, তখন সর্ব- পিতা ওদেরকে নিরাপদে আবার স্থলভূমিতে নিয়ে এলেন। ভাগ্যিস এনেছিলেন, কেননা কেবলমাত্র বিশ্বাসের উপর ভর দিয়ে আর কত ঝড়-ঝঞ্ঝা পার হওয়া যায়?
ভ্রমণটা ঠিক সুবিধের হয়নি। হাতের আঙুলগুলো যেন অসার হয়ে পড়েছে, হাজারো মদে ডুবেও হাড় থেকে তাড়ানো যাচ্ছে না শীত। সকালে ঘুম থেকে উঠে নাবিকরা দেখতে পায়, বরফ জমে গেছে দাড়িতে! সূর্য সেটাকে গলিয়ে দেবার আগ পর্যন্ত ওদেরকে দেখায় অল্প বয়সে চুল-দাড়ি পেকে যাওয়া মানুষদের মতো।
পশ্চিমের সবুজ অঞ্চলে পা রাখে যখন, তখন ওদের দাঁতগুলো নড়বড় করছে। চোখ দুটো বসে গেছে গর্তে। সবাই বলাবলি করতে লাগল, — দেশ আর ঘরের আরামদায়ক আগুন থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি আমরা। পেছনে ফেলে এসেছি পরিচিত সমুদ্র আর ভালোবাসার পরিবারকে। এখানে, পৃথিবীর এই প্রান্তে, এমনকী দেবতারাও আমাদেরকে ভুলে যাবেন!’
ওদের নেতা একটা বিশাল পাথরের ওপরে উঠে দাঁড়াল। দলের লোকদের বিশ্বাসের দুর্বলতাকে ব্যঙ্গ করে বলল, ‘এই পৃথিবীকে সর্ব-পিতা বানাননি? নিজ হাতে য়ীমিরের হাড় আর মাংস ব্যবহার করে এসব সৃজন করেছেন তিনি। য়ীমিরের মস্তিষ্ককে মেঘ রূপে স্থাপন করেছেন আসমানে। তার লবণাক্ত রক্তকে দিয়েছেন উন্মত্ত সাগরের রূপ। যদি তিনি পৃথিবী বানান, তাহলে কেন বুঝতে পারছ না যে এই ভূ-খণ্ডও তিনিই বানিয়েছেন? আমরা যদি এখানে পুরুষের মতো মারা যাই, তাহলে অবশ্যই তার ছায়ায় আশ্রয় পাব!’
আনন্দে চিৎকার করে উঠল তার লোকেরা। তাই গাছকে দেয়াল এবং ছাদ, আর মাটিকে মেঝে হিসেবে ব্যবহার করে একটা হল বানাবার কাজে মন দিল। এই নতুন এলাকায়, ওদের ধারণা, আর কোনো মানুষ নেই।
হল বানানো শেষ হলো যেদিন, সেদিন ধেয়ে আসল এক প্রলয়ঙ্করী ঝড়। মধ্য-দুপুরেই আকাশ হয়ে গেল রাতের মতো কালো; আসমানে যেন দুই দানোর লড়াই বেঁধেছে, থেকে থেকে সাদা আলো আর কান ফাটানো আওয়াজ আসছে ভেসে। শুভ লক্ষণ হিসেবে যে বিড়ালটাকে সাথে এনেছিল নাবিকরা, সেটা যেন কোথায় মুখ লুকিয়েছে! ঝড়টা এমন প্রমত্ত ছিল যে আনন্দে একে- অন্যের পিঠে চাপড় বসাল তারা। ‘বজ্র-দেব এই অদ্ভুত জায়গাতেও আমাদের সাথে আছেন।’ আকণ্ঠ মদ পান করতে শুরু করল সব ভুলে।
হলের ধোঁয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকারে ওদেরকে পুরনো সব গান গেয়ে শোনাল চারণ-কবি। সর্ব-পিতা ওডিনের গান শোনাল তাদের, যিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন নিজেরই উদ্দেশ্যে। সে গাইল সেই সময়ের গান, যখন সর্ব-পিতা ঝুলছিলেন জীবন-বৃক্ষ থেকে। নিজেকে নিজেই করেছিলেন বর্শা বিদ্ধ, সেই ক্ষত থেকে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছিল রক্ত। সর্ব-পিতার নয়টা নাম গেয়ে শোনাল সে, শোনাল নয় রুন আর ঊনত্রিশটা জাদু-বস্তুর নাম।
পরেরদিন, যেদিনটা আসলে সর্ব-পিতারই দিন, নতুন এক আগন্তুককে খুঁজে পেল তারা। একেবারে ছোটোখাটো একটা মানুষ সে, লম্বা চুলগুলো এত কালো যে দেখলে দাঁড়কাক লজ্জা পাবে। ত্বক লাল কাদার চাইতেও লালচে। এমন ভাষায় কথা বলল লোকটা, যা নাবিকরা কোনদিন শোনেনি! পরনে তার পালক আর পশুর চামড়া, লম্বা চুলগুলোতে বেণি করে বাঁধা ছোটো ছোটো হাড়।
হলে নিয়ে এলো নাবিকরা তাকে, খেতে দিল ঝলসানো মাংস। মদ খাইয়ে তৃপ্ত করল লোকটাকে। মাতাল হয়ে সে যখন গান গাইতে আরম্ভ করল, তখন হাসিতে যেন ফেটে পড়ল তারা। আরও পান করতে দিল তারা আগন্তুককে, কিছুক্ষণের মাঝেই মাতাল বেচারা অচেতন হয়ে গেল!
আগন্তুককে তুলে নিলো তারা। দুজন ধরল দুটো কাঁধ, দুজন দুটো পা। চারজন নাবিক আর লোকটা মিলে গঠিত হলো যেন আট-পাঅলা একটা ঘোড়া। মিছিলের মতো করে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো একটা অ্যাশ গাছের কাছে। গাছটা একটা পাহাড়ের চুড়ায় অবস্থিত, ওখান থেকে পরিষ্কার দেখা যায় সমুদ্র। এখানেই, গাছের ডালের সাথে, ফাঁসি দেওয়া হলো লোকটাকে। আসলে ফাঁসি না বলে সর্ব-পিতার প্রতি তাদের বলি বলাটাই বেশি যুক্তি- যুক্ত। অপরিচিতের দেহটা দুলতে থাকল বাতাসে, জিহ্বা বেরিয়ে এসেছে, চেহারা কালো হয়ে গেছে; চোখ দুটো যেন আরেকটু হলেই বেরিয়ে আসবে, উত্থিত যৌনাঙ্গে একটা চামড়ার হেলমেট ঝুলিয়ে দিলেও সেটা মাটিতে পড়বে না।
নাবিকরা আনন্দিত, হাসছে তারা-বলি দিতে পেরে খুশি।
.
পরের দিন দুটো বিশাল দাঁড়কাক এসে বসল লাশটায়, দুটো দুই কাঁধে। বসেই শুরু হলো গাল আর চোখে ঠোকরানো। নাবিকরা বুঝতে পারল, তাদের উৎসর্গ কবুল করা হয়েছে
লম্বা সময় ধরে চলছে শীতকাল, ক্ষুধায় কাতর হয়ে আছে তারা। তবে বসন্তের চিন্তায় সেই কাতরতা খুব একটা বেগ দিতে পারছে না তাদের। বসন্ত এলেই নৌকা পাঠানো হবে দেশে, সেখান থেকে নতুন নতুন মানুষ আসবে…আসবে মেয়েরাও। তবে আবহাওয়া আরও ঠান্ডা হতে শুরু করলে, অপরিচিত লোকটার গ্রামের খোঁজে নামল কেউ কেউ। খাবার দরকার, সেই সাথে মেয়েমানুষ পেলে তো সোনায় সোহাগা। তবে হায়, কিচ্ছু পেল না তারা। দুই-একটা পরিত্যক্ত অগ্নিকুণ্ড নজরে পড়ল কেবল!
শীতের এক মধ্য-দুপুরে, যখন সূর্য এতটা দূরে যে দেখে রুপালি পয়সা বলে মনে হচ্ছে, অভিযাত্রীরা দেখল-বলির দেহের অবশিষ্টাংশ অ্যাশ গাছ থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে! সেদিন বিকালে তুষারপাত হতে শুরু করল।
উত্তর দিক থেকে আসা লোকগুলো তাদের কাঠের দেয়ালে নিজেদেরকে আবদ্ধ করে ফেলল!
সেদিন রাতেই শুরু হলো আক্রমণ, ত্রিশ জন অভিযাত্রীর উপর আছড়ে পড়ল যেন পাঁচশ মানুষ। পরবর্তী সাত দিন ধরে চলল হত্যাকাণ্ড। ত্রিশ সদস্যের কেউ রেহাই পেল না। মারা গেল সবাই, ত্রিশটা আলাদা আলাদা উপায়ে। ভুলে গেল সবাই এই নাবিকদের, ইতিহাসও মনে রাখেনি।
হলঘরটা আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে জাহাজে করে এসেছিল নাবিকরা, সেটাও বাদ গেল না। আক্রমণকারীদের আশা-এই অভিযাত্রীরা একাই এসেছিল! আর কখনও কোনো সাদা-মুখো এদিকে হবে না।
সৌভাগ্যবান লিফ, এরিক দ্য রেডের পুত্র, জায়গাটা পুনঃআবিষ্কার করারও একশ বছর আগের গল্প এটা। জায়গার নাম সে দিয়েছিল ভিনল্যান্ড। লোকটার জানা ছিল না, এখানে সে পা রাখার অনেক আগে থেকে দেবতারা ওরই প্রতীক্ষায় ছিলেন। এক-হাতি টির, ধূসর ওডিন আর বজ্ৰ-দেব থর, সবাই আরও অনেক আগে চলে এসেছেন এখানে…
…দিন গুনছিলেন ওর আগমনের!