অধ্যায় বিশ
ভাড়া করা গাড়িটা নিয়ে যখন বন থেকে বের হলো শ্যাডো, তখনও ঘড়িতে সকাল সাড়ে আটটা বাজে। ঘণ্টায় পঁয়তাল্লিশ মাইল গতিতে চলছে গাড়ি, তিন সপ্তাহ আগে চিরতরে ছেড়ে আসছে বলে ধরে নেওয়া শহরটায় আবার প্রবেশ করল ও। শহরের ভেতর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে এগোল সে, বিগত কয়েক সপ্তাহে জায়গাটায় কোনো পরিবর্তন আসেনি বললেই চলে। হ্রদের দিকে চলে গেছে যে রাস্তাটা, সেটার মাঝামাঝি এসে গাড়ি পার্ক করল শ্যাডো, নেমে পড়ল বাহনটা থেকে।
জমাট বদ্ধ লেকের ওপরে এখন আর মাছ-শিকারিদের ভিড় নেই। আশপাশে নেই এসইউভি। হ্রদটা যেন রূপ পরিবর্তন করেছে, এতদিন সাদা সাজে সেজেছিল। এখন বরফের ওপরে পানির স্তর জমেছে, নিচেও আছে পানি। কালচে রঙটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে পাতলা বরফের আস্তরণের নিচে। ধূসর আকাশের নিচে প্রায় বিরান হ্রদটা।
প্রায় বিরান…
একটা মাত্র গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে বরফের ওপরে, ব্রিজের প্রায় সরাসরি নিচে পার্ক করা আছে ওটা। শহরে যেই প্রবেশ করুক না কেন, ওটা দেখতে পাবেই। রঙটা সবুজ, ময়লাটে। এই ধরনের গাড়ি সাধারণত পার্কিং লটে ফেলে যায় মানুষ, আর কখনও নিতে আসে না। ভেতরে ইঞ্জিন নেই ওটার, চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে বরফের ওপরে। ওটা কখন ডুবে যাবে, তারই অপেক্ষা করছে সারা শহর।
রাস্তাটার মাঝখানে একটা চেইন দিয়ে দর্শনার্থীদের সাবধান করে দেওয়া হয়েছে। বরফ পাতলা-লেখা সাইনবোর্ড ঝুলছে একটা ওটার সাথে। তার নিচে হাতে আঁকা ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটা গাড়ি, একজন মানুষ আর একটা স্নো- মোবিলের ছবি।। বোঝানো হচ্ছে, এদের কেউ যেন ভুলেও নিকটবর্তী না হয়।
সাবধানবাণী উপেক্ষা করে এগিয়ে গেল শ্যাডো। পিচ্ছিল হয়ে আছে পথটা। বরফ এরইমধ্যে গলতে শুরু করেছে। কাদা-কাদা হয়ে আছে মাটি। বাদামি ঘাস বলতে গেলে একদম সাহায্যই করছে না। সাবধানে এগিয়ে গেল ও, পথ থেকে নেমে পা রাখল বরফে।
বরফের ওপরে পানির একটা হালকা আস্তরণ, সেটাও বরফগলা পানিই। ওপর থেকে দেখে গলিত বরফকে যতটা গভীর মনে হয়েছিল, পা রেখে বোঝা গেল যে গভীরতা তার চাইতেও বেশি। পানির স্তর জমেছে বলে স্বাভাবিকের চাইতে অনেক বেশি পিচ্ছিল হয়ে আছে বরফ স্তর। হাঁটতে বেশ কষ্টই হচ্ছে শ্যাডোর। ঠান্ডা পানিতে বারবার ভিজে যাচ্ছে ওর বুট আর বুটের ফিতা। যেখানে যেখানে পানির সাথে স্পর্শ লাগছে চামড়ার, জমে যাচ্ছে যেন। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে ওর। মনে হচ্ছে নিজেকেই বুঝি দেখছে দূর থেকে…যেন ছবির নায়ক ও, দুদে কোনো গোয়েন্দা!
ক্ল্যাংকারের দিকে এগিয়ে গেল শ্যাডো। বুঝতে পারছে, যেকোনো সময় বরফ ভেঙে যেতে পারে। এই পানিতে একবার পড়লে আর দেখতে হবে না, জমে যাবে একেবারে সাথে সাথেই। তবুও এগোতে থাকল ও। বরফ আগের চাইতেও অনেক বেশি পিচ্ছিল হয়ে আছে, কয়েকবার তো আছাড়ই খেল বেচারা।
রাস্তা থেকে যতটা মনে হচ্ছিল, ক্ল্যাংকারটা এখন তার চাইতেও বেশি দূরে বলে মনে হচ্ছে। হ্রদের দক্ষিণ দিক থেকে বরফ ভাঙার আওয়াজ ভেসে এলো। সেই সাথে তাল মিলিয়ে যেন গুঙিয়ে উঠল এদিককার বরফও। তারপরও এগিয়ে চলল শ্যাডো।
আত্মহত্যা করবে নাকি? ওর সুস্থ মস্তিষ্ক প্রশ্ন করে উঠল। বাদ দাও না।
‘না,’ নিজেকেই শোনাল সে। ‘আমার জানতেই হবে।’
বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর ক্ল্যাংকারের কাছে এসে পৌঁছল শ্যাডো। অবশ্য আগেই বুঝে গেছে, ভুল হয়নি ওর। গাড়িটাকে ঘিরে ধরে আছে কেমন একটা অশুভ বাতাস, সেই সাথে বাজে একটা হালকা গন্ধ। গাড়িটার পেছনে চলে গেল ও। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখে, সিটগুলোও খুলে ফেলা হয়েছে। দরজা খোলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হতে হলো। এবার নজর দিল ট্রাঙ্কের দিকে। ওটাও বন্ধ।
একটা ক্রো-বার আনলে মন্দ হতো না, ভাবল ও।
গাভসের ভেতরেই হাত মুঠো করল শ্যাডো, এক-দুই-তিন গুণে ড্রাইভারের দিকের জানালার কাছে ঘুসি বসিয়ে দিল।
হাতে ব্যথা পেল বেশ, কিন্তু জানালার কিছু হলো না।
একবার ভাবল, দৌড়ে এসে লাথি হাঁকায়। তবে কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। দৌড়াতে গিয়ে আছাড় খাবার সম্ভাবনাই বেশি। আর তাছাড়া বেশি নড়াচড়া করতে গেলে ক্ল্যাংকার বরফ ভেঙে ডুবেও যেতে পারে।
গাড়িটার দিকে ভালোমতো তাকাল শ্যাডো, তারপর হাত বাড়িয়ে খুলে নিলো রেডিয়ো অ্যান্টেনাটা। পুরনো দিনের গাড়ি, অ্যান্টেনাটা সামনেই। ওপরে ওঠানো আর নিচে নামানো যায়। তবে এই ক্ষেত্রে ওটা অনেকদিন হলো আটকে আছে এক জায়গায়। চাপ দিয়ে গোড়া থেকে ভেঙে নিলো ওটাকে শ্যাডো। পাতলা মাথাটা ব্যবহার করে কাজ চালাবার মতো হুক বানাল একটা। সামনের জানালার ফাঁক ফলিয়ে ওটা ব্যবহার করে খুলে ফেলল দরজা। তবে একেবারে সহজ হলো না কাজটা, বার কয়েক চেষ্টার পর সফল হলো সে। দরজার লক খুলে হাত দিল হ্যান্ডেলে। কিন্তু না, খুলল না তা-ও।
নিশ্চয়ই বরফে জমে গেছে দরজা।
শক্ত করে টান দিল এবার, কয়েকবার টানাটানি করতেই আচমকা খুলে এলো ওটা। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল বরফ।
অশুভ বাতাসটা গাড়ির ভেতরে আরও বেশি। রোগ আর পচনের গন্ধ বাতাসে, অসুস্থ বোধ করল শ্যাডো।
ড্যাশবোর্ডের নিচে হাত গলিয়ে কালো প্লাস্টিকের হ্যান্ডেলটা খুঁজে পেল ও, ওটা ব্যবহার করেই খুলতে হয় ট্রাঙ্ক। শক্ত করে টান দিল সে।
শব্দ করে খুলে গেল ট্রাঙ্ক।
গাড়ি থেকে বেরিয়ে পেছন দিকে গেল শ্যাডো, পিছলা খেল এবারও। তবে গাড়ির দেহ ধরে সামলে নিলো নিজেকে।
ট্রাঙ্কে আছে ওটা। ভাবল শ্যাডো।
এক ইঞ্চি ফাঁক হয়ে আছে ট্রাঙ্ক। পুরোটা খুলল সে।
বাজে গন্ধ বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। তবে গন্ধটা আরও বাজে হতে পারত। ট্রাঙ্কের নিচটা এক ইঞ্চি মতো অর্ধ-গলিত বরফে ভরা বলেই হয়তো হলো না। একটা মেয়ে শুয়ে আছে ট্রাঙ্কে। তার পরনে লাল জামা। চুলগুলো বড়ো বড়ো, মুখ বন্ধ। তাই নীল রিবনগুলো দেখতে পাচ্ছে না শ্যাডো। তবে ওগুলো যে আছে জায়গা মতো, তা জানে। শীতে সংরক্ষিত হয়েছে মেয়েটার লাশ!
বড়ো বড়ো চোখগুলো যেন দেখছে শ্যাডোকে। মৃত্যুর সময় কাঁদছিল মেয়েটা। অশ্রু জমাট বেঁধে আছে গালে। এখনও গলতে শুরু করেনি।
‘এখানেই ছিলে তুমি!’ অ্যালিসন ম্যাকগভার্নের লাশকে উদ্দেশ করে বলল শ্যাডো। ‘ব্রিজের উপর দিয়ে যাওয়া প্রত্যেক মানুষ দেখেছে তোমাকে। মাছ শিকারিরা হেঁটে গেছে তোমার পাশ দিয়ে, অথচ কেউ জানত না!’
কথাটা উচ্চারণ করার সাথে সাথে ভুলটা ধরতে পারল ও।
একজন জানত। একদম শুরু থেকেই জানত।
সে-ই এখানে রেখে গেছে লাশটা।
ট্রাঙ্কের ভেতর হাত গলিয়ে দিল শ্যাডো, অ্যালিসনকে বের করে আনতে চায়। ভেতরে একটু উবু হতে হলো ওকে, তাই শরীরের ভার গিয়ে পড়ল গাড়িতে। সেটাই হলো কাল।
সামনের চাকার নিচের বরফে ধরল ভাঙন, মুহূর্তের মাঝে কয়েক ফুট নিচে তলিয়ে গেল চাকাটা। খোলা দরজা দিয়ে হু হু করে ভেতরে ঢুকতে শুরু করল পানি। শক্ত বরফে দাঁড়িয়ে আছে ও, তবুও গোড়ালি পর্যন্ত পানি উঠে এলো নিমিষে। ভয়ার্ত চোখে চারপাশে তাকাল শ্যাডো, সরে যেতে হবে। কিন্তু পারল না, ভেঙে গেল বরফ। ট্রাঙ্কে থাকা অ্যালিসনের লাশ, গাড়ি আর শ্যাডো-সবাই পড়ে গেল পানিতে। দিনটা মার্চ মাসের তেইশ তারিখ, সময় নয়টা বেজে দশ।
পানিতে ডুবে যাবার আগে বুক ভরে শ্বাস নিতে পেরেছে শ্যাডো। চোখ বন্ধ করে ফেলল ও, কিন্তু হ্রদের পানির শীতলতা যেন এক ধাক্কায় ওর দেহ থেকে সব অক্সিজেন বের করে আনল!
ট্রাঙ্কের সাথে আটকে গেছে ও, গাড়ির ওজনে ভারী পাথরের মতো টুপ করে তলিয়ে যেতে লাগল বেচারা।
হ্রদের বরফের নিচে আছে সে এখন, অন্ধকার আর শীত ঘিরে ধরেছে চারদিক থেকে। জামা-কাপড়, গাভ, বুট-এসব ওজন বাড়ানো ছাড়া আর কিছুই করছে না। প্রতি মুহূর্তে বেড়েই চলছে ওগুলো ওজন।
তলাচ্ছে তো তলাচ্ছেই শ্যাডো, গাড়িটা থেকে দূরে সরে যেতে চাইল সে। কিন্তু যন্ত্রটা যেন আলিঙ্গন করে রেখেছে ওকে, সরতে দেবে না। আচমকা উপলব্ধি করতে পারল, হ্রদের একদম তলদেশে এসে পৌঁছেছে ও। বাঁ পায়ের গোড়ালি আটকা পড়েছে গাড়ির তলে।
ভয় পুরোপুরি গ্রাস করে নিলো শ্যাডোকে।
চোখ খুলল যুবক, যদিও জানে যে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নজরে আসবে না।
তারপরও কেন যেন পরিষ্কার দেখতে পেল সব কিছু। দেখতে পেল ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে তাকিয়ে থাকা অ্যালিসন ম্যাকগভার্নের সাদা চেহারা। দেখতে পেল বিগত বছরের ক্ল্যাংকারগুলোও। হ্রদের মাটিতে কবর হয়ে আছে ওগুলোর।
প্রতিটার ট্রাঙ্কে যে একটা করে বাচ্চার লাশ আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই শ্যাডোর। সংখ্যায় ওগুলো অনেক। সারা দুনিয়ার সামনে চুপচাপ শুয়ে রয়েছে হ্রদের পানিতে!
এখানে খুঁজলেই পাওয়া যাবে লেমি হাউটালাকে। পাওয়া যাবে জেসি লোভাট, স্যান্ডি ওলসেন আর জো মিংকে। সারা লিন্ডকুইষ্টও আছে এখানেই কোথাও। ঠান্ডা আর নিশ্চুপ পরিবেশে বিশ্রাম নিচ্ছে তারা…
বাঁ-পাটা টানল শ্যাডো, কিন্তু না। এখনও আটকা পড়ে আছে। ফুসফুসের চাপটা আর সহ্য হচ্ছে না। অক্সিজেনের অভাবে কানে ব্যথা করতে শুরু করেছে। অল্প শ্বাস ছাড়ল ও, চেহারাটা ঢেকে গেল বুদবুদে।
দ্রুতই, ভাবল ও। আমাকে শ্বাস নিতে হবে।
নিচু হয়ে দুই হাত ক্ল্যাংকারটার বাম্পারে রাখল শ্যাডো, এরপর ঠেলতে শুরু করল সর্বশক্তিতে।
কিছুই হলো না।
গাড়ির খোলস বই কিছু নয় এটা, নিজেকে শোনাল ও। ইঞ্জিন নেই, ওটাই তো গাড়ির সবচেয়ে ভারী অংশ। আরেকবার চেষ্টা করো, পারবে।
আবার ঠেলা দিল শ্যাডো।
আস্তে আস্তে, একেকবারে এক ইঞ্চির ভগ্নাংশ পরিমাণ সরতে শুরু করল গাড়িটা। বাঁ-পাটা বের করে আনতে সক্ষম হলো শ্যাডো। লাথি মেরে ভেসে ওঠার প্রয়াস পেল ও, কিন্তু নড়ল না এক বিন্দু। কোটটা, ভাবল সে। কোথাও আটকে গেছে মনে হয়। অবশ হতে শুরু করা আঙুলগুলো জিপারে ছোঁয়াল যুবক, আপ্রাণ চেষ্টায় গা থেকে খুলে ফেলল কোটটা। মুক্ত হওয়া মাত্র গাড়ির কাছ থেকে সরে এলো সে।
ওপরে উঠছে, না নিচে যাচ্ছে-তা টের পাচ্ছে না বেচারা। শুধু বুকে বোধ করছে তীব্র ব্যথা। মস্তিষ্ক সেই ব্যথা সহ্য করতে জানাচ্ছে অস্বীকৃতি। বুঝতে পারছে, আর কিছুক্ষণের মাঝেই শ্বাস নেবে ও। বুক ভরে যাবে ঠান্ডা পানিতে। মারা যাবে সাথে সাথে। যখন আর পারছে না, ঠিক তখন শক্ত কিছু একটার সাথে বাড়ি গেল মাথা।
বরফ…পানির ওপরের স্তরে অবস্থিত বরফের সাথে ঠোকর খেয়েছে ওর মাথা। হাত মুঠো করে বরফে ঘুসি বসাল শ্যাডো, ভাঙার চেষ্টা করছে। কিন্তু হাতগুলোতে যে শক্তি নেই, পায়ের নিচে নেই শক্ত অবলম্বন যে ঠেলে দেবে।
হাস্যকর মৃত্যু হতে যাচ্ছে আমার ভাবল শ্যাডো।
আস্তে আস্তে সয়ে আসতে শুরু করছে শীতলতা। মারা যে যাচ্ছে তা বুঝতে পারল সে। এবারের উপলব্ধির সাথে মিশ্র রয়েছে রাগ। তীব্র ব্যথা আর রাগকে শক্তি বানিয়ে শেষ বারের মতো চেষ্টা করল ও। ভেবেছিল, হাত দুটো বুঝি আর নাড়াতে পারবে না। কিন্তু না, পারল সে।
হাত দিয়ে ধাক্কা দিল শ্যাডো; টের পেল, বরফের একটা প্রান্ত ওপরে উঠতে শুরু করছে। পরক্ষণেই বাতাসের স্পর্শ অনুভব করল হাতে। খাবলে ধরার চেষ্টা করল কিছু একটা, ঠিক সেই মুহূর্তে কেউ একজন আঁকড়ে ধরল ওর হাত। টেনে তুলল ওকে। উঠতে গিয়ে মাথা বাড়ি খেল বরফের সাথে, চেহারা হয়ে গেল ক্ষত- বিক্ষত। পানির ওপরে উঠে দেখতে পেল, বরফের ভেতরে একটা গর্ত করে উঠে আসতে পেরেছে। প্রথম কয়েকটা মুহূর্ত শ্বাস নেওয়া ছাড়া অবশ্য আর চিন্তা রইল না ওর মাথায়। চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না বলে মনে হচ্ছে, কেবল দিনের উজ্জ্বল আলো বাদে। কেউ একজন টানছে ওকে, পানির উপর তুলে আনছে। জমে মারা যাবে বা এই জাতীয় কিছু একটা বলল সেই কেউ একজন। হাচড়ে-পাচড়ে উঠে এলো শ্যাডো, কাশছে প্রচণ্ডভাবে। সেই সাথে কাঁপছেও।
নাক-মুখ…সব দিয়েই একসাথে শ্বাস নেবার প্রয়াস পাচ্ছে ও। শুয়ে আছে বরফের ওপর। বুঝতে পারছে, ভাববার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। কিছুক্ষণ পর আর শ্বাসও টানতে পারবে না।
‘আমাকে এখানেই রেখে যাও,’ বলার চেষ্টা করল সে। ‘আমি ঠিক আছি।’
আসলেই তো তাই, একটু বিশ্রাম নিতে হবে। তারপর আবার উঠে দাঁড়িয়ে কাজে যাবে ও। বরফের উপর তো আর চিরটাকাল শুয়ে থাকতে পারবে না।
কেউ একজন ঝাঁকাচ্ছে শ্যাডোকে, বুকে দিচ্ছে পানির ঝাপটা। মাথাটা একটু উঁচু করে ধরে আছে সেই কেউ একজন। শ্যাডো টের পেল, বরফের উপর দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওকে। বাধা দেবার প্রয়াস পেল সে, বলতে চাইল—একটু বিশ্রাম নিতে দেওয়া হচ্ছে না কেন? তাহলেই তো ঠিক হয়ে যাবে সব কিছু!
ঘুমিয়ে পড়েছে বলে মনে হলো না ওর। কিন্তু একটা বিশাল সমভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল নিজেকে। মহিষের মাথা আর কাঁধ বিশিষ্ট এক লোক দাঁড়িয়ে আছে ওখানে, শকুন-মাথার এক মহিলাও আছে। দুই জনের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে হুইস্কি জ্যাক। ওর দিকে তাকিয়ে আফসোসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ছে।
ঘুরে দাঁড়িয়ে উলটো দিকে হাঁটা ধরল হুইস্কি জ্যাক। মহিষ-মানব সঙ্গী হলো তার। কিছুক্ষণ হাঁটল মেয়ে থান্ডারবার্ডটাও। তারপর উড়াল দিল আকাশে।
বুকটা যেন খালি হয়ে গেছে শ্যাডোর। ওই তিনজনকে ডাকার প্রয়াস পেল ও, হতাশ না হবার অনুরোধ জানাল মনে মনে। কিন্তু পরক্ষণেই তরল হয়ে গেল দৃশ্যটা। চলে গেল সমভূমি, উধাও হলো হারিয়ে ফেলার বেদনা।
শূন্যতা গ্রাস করে নিলো সবকিছুকে।
.
এমন তীব্র ব্যথা এর আগে কখনওই অনুভব করেনি শ্যাডো। ওর দেহের প্রতিটা কোষ, প্রতিটা স্নায়ু যেন গলে যাচ্ছে। নিজেদের উপস্থিতির প্রমাণ দিতে চাইছে তারা প্রচণ্ড ব্যথার জন্ম দিয়ে।
ওর চুল ধরে আছে একটা হাত, আরেকটা হাত ওর থুতনির নিচে। চোখ খুলে চাইল যুবক, হাসপাতালে আছে বলে মনে হচ্ছে।
পা খালি শ্যাডোর, তবে পরনে এখনও জিন্সের প্যান্টটা আছে। ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। বাতাস ঘোলা, বাষ্প ভাসছে। সামনের দেয়ালে একটা আয়না ঝুলছে, তার নিচেই একটা ছোটো বেসিন। তাতে একটা নীল টুথব্রাশ বসে আছে।
আস্তে আস্তে দৃশ্যটার অর্থ ঢুকতে শুরু করছে ওর মাথায়।
জ্বলছে ওর আঙুল…জ্বলছে ওর পা।
ব্যথার চোটে কোঁকাতে শুরু করল বেচারা।
‘আস্তে মাইক, আস্তে।’ পরিচিত একটা কণ্ঠ নির্দেশ দিল।
‘কী?’ বলল শ্যাডো, অন্তত বলার চেষ্টা করল। ‘হচ্ছে কী এখানে?’ নিজের কানেই অপরিচিত শোনাল নিজের কণ্ঠ ও।
একটা বাথটাবে শুয়ে আছে এখন। পানিটা গরম, একদম গলা পর্যন্ত ডুবে আছে।
‘জমতে বসা কোনো লোককে আগুনের সামনে বসাবার মতো বোকামি আর হয় না। আরেকটা বোকার মতো কাজ হলো কম্বল দিয়ে তাকে আবৃত করে রাখা। কম্বল তাপ কু-পরিবাহী, না তাপ আসতে দেয়। আর না যেতে। আর আমার মতে তৃতীয় প্রকার বোকামি হলো তার দেহের সব রক্ত বের করে নিয়ে আবার গরম করে তারই শরীরে প্রবেশ করানো। আজকালকার ডাক্তাররা অবশ্য তা-ই করে। অর্থ, শ্রম আর সময়ের কি নিদারুণ অপচয়!’ শ্যাডোর মাথার ওপরে আর পেছন থেকে ভেসে এলো কণ্ঠটা।
‘সবচেয়ে বুদ্ধিমানের মতো কাজ হলো, এরকম মানুষকে গরম পানির ভেতর চুবিয়ে রাখা। খুব গরম না, কুসুম গরম। ভালো কথা, তুমি কিন্তু মারাই গেছিলে হ্রদে। এখন কেমন বোধ করছেন, হুডিনি সাহেব?’
‘ব্যথা,’ জানাল শ্যাডো। ‘সারা দেহ ব্যথায় যেন চিৎকার করছে। আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন।’
‘হয়তো বাঁচিয়েছি। যাই হোক, এখন নিজে নিজে মাথা পানির ওপরে তুলে রাখতে পারবে?’
‘আশা করি।’
‘আমি ছেড়ে দিচ্ছি, ভয় নেই। ডুবে যেতে শুরু করল আবার ধরব।
হাতের চাপ কমে গেল ওর মাথা থেকে।
শ্যাডো টের পেল, ওর দেহটা টাবের সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দুই হাত বাড়িয়ে টাবটাকে আঁকড়ে ধরল সে। বাথরুমটা ছোটো, বাথটাবটা ধাতব। এনামেলের অবস্থা ভালো না, আঁচড়ের দাগ অনেক।
এক বৃদ্ধ লোক ওর দৃষ্টির সীমার মাঝে চলে এলো আচমকা। দুশ্চিন্তা খেলা করছে বয়স্ক চেহারাটায়।
‘এখন ভালো লাগছে?’ জানতে চাইলেন হিনজেলমান। ‘বিশ্রাম নাও। যখন কিছুটা সুস্থ বোধ করবে, তখন জানিয়ো। একটা রোব ব্যবস্থা করে রেখেছি। ঠিক আছে তো মাইক?
‘ওটা আমার নাম না।’
‘তুমি যা বলো,’ অস্বস্তি খেলে গেল বৃদ্ধের চেহারায়।
কতটা সময় বসে ছিল বাথটাবে, সে ব্যাপারে কোনো ধারণাই নেই শ্যাডোর। ব্যথা বন্ধ হওয়া আর হাতে-পায়ে পুরোপুরি সার না ফেরা পর্যন্ত সেভাবেই বসে রইল ও। এরপর হিনজেলমানের সাহায্যে উঠে দাঁড়াল, বাথটাবের পাশে বসে দুজনের মিলিত প্রচেষ্টায় খুলে আনল জিন্সটা।
হিনজেলমানের দেওয়া রোবটা ছোটোই হলো দেহে, তবে ওর আপত্তি করার প্রশ্নই ওঠে না। বৃদ্ধ লোকটার উপর ভর দিয়ে চলে এলো বসার ঘরে, গা এলিয়ে দিল একটা প্রাচীন সোফায়। ক্লান্ত, দুর্বল আর নিঃশেষিত মনে হচ্ছে নিজেকে। দেয়াল থেকে অনেকগুলো হরিণের মাথা আশ্চর্য চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে 1
শ্যাডোর জিন্স নিয়ে উধাও হয়ে গেলেন হিনজেলমান। এর কিছুক্ষণের মাঝেই পাশের ঘর থেকে ড্রায়ারের ঘটাঘট শুনতে পেল শ্যাডো। ধূমায়িত একটা মগ নিয়ে তারও কিছুক্ষণ পর ভেতরে প্রবেশ করলেন বৃদ্ধ।
‘কফি এনেছে।’ বললেন তিনি। ‘ভেতরে একটু মদও দিয়েছি, আগে যেমন দিতাম আমরা। এখনকার ডাক্তাররা অবশ্য মানা করে কাজটা করতে।’
দুই হাতে মগটাকে আঁকড়ে ধরল শ্যাডো। ‘ধন্যবাদ।’
‘বন্ধুদের আবার ধন্যবাদ দেবার দরকার কী?’ বললেন হিনজেলমান। ‘একদিন তুমি আমার জীবন বাঁচাবে, দেখো!’
কফিতে চুমুক দিল শ্যাডো। ‘আমি তো ভেবেছিলাম যে মারা গেছি।’
‘তোমার কপাল ভালো, আমি ব্রিজের ওপরেই ছিলাম। কেন যেন মনে হচ্ছিল যে আজকেই ডুববে ক্ল্যাংকারটা। আমার মতো বয়স হলে বুঝতে পারবে, কী বোঝাতে চাইছি। যাই হোক, একটা পকেট ঘড়ি নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম ব্রিজের উপর। দেখি, তুমি ক্ল্যাংকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছ! গলা ফাটিয়ে ডাকলাম তোমাকে, শোননি মনে হয়। গাড়িটাকে পানিতে তলিয়ে যেতে দেখে চলে গেলাম অকুস্থলে। ভয়ই পেয়ে গেছিলাম, জানো? প্রায় দুই মিনিট পানির নিচে ছিলে তুমি…’ অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন তিনি। ‘তোমার কপাল ভালো যে আমাদের দুজনের ওজনে বরফ আবার নতুন করে ভেঙে যায়নি।’
মাথা নেড়ে সায় জানাল শ্যাডো।
‘অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।’ হিনজেলমানকে বলল সে। বৃদ্ধ লোকটার চেহারা যেন একশ ওয়াটের বাতির মতো জ্বলে উঠল!
কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবতে শুরু করল শ্যাডো, আস্তে আস্তে চিন্তা করার ক্ষমতাটা ফিরে আসছে বলে মনে হচ্ছে। আচমকা অনেকগুলো প্রশ্ন জেগে উঠল ওর মনে।
এক বৃদ্ধ লোক, যিনি কিনা লম্বায় ওর অর্ধেক আর ওজনে ওর এক-তৃতীয়াংশের সমানও হবেন না, ওকে টেনে আনলেন কী করে? অজ্ঞান শ্যাডোকে বরফের ওপর দিয়ে টেনে ওকে শুধু বাড়িতেই আনেননি, বাথটাবেও শুইয়ে দিয়েছেন।
আগুনের কাছে গিয়ে একটা পাতলা কাঠ গুঁজে দিলেন হিনজেলমান।
‘কী করছিলাম জানতে চাইলেন না?’
উত্তরে শ্রাগ করলেন হিনজেলমান। ‘আমার জেনে কাজ নেই।’
‘একটা জিনিস আমি বুঝতে পারছি না…’ বলল শ্যাডো। একটু ইতস্তত করে ভাবনাটুকু গুছিয়ে নিলো। ‘আমার জীবন বাঁচাতে গেলেন কেন আপনি?’
‘আমাকে এভাবেই বড়ো করা হয়েছে।’ বললেন হিনজেলমান। ‘কাউকে বিপদগ্রস্ত দেখলে আমি—’
‘না,’ ওকে থামিয়ে দিল শ্যাডো। ‘আমি সেটা জানতে চাইনি। প্রতি শীতে আপনি একজন করে বাচ্চাকে খুন করেন। একমাত্র আমিই সেটা ধরতে পেরেছি। আপনি নিশ্চয়ই আমাকে ট্রাঙ্ক খুলতে দেখেছিলেন। তাহলে ডুবে মরতে দিলেন না কেন?’
মাথা কাত করলেন হিজেলমান। ভাবুক ভঙ্গিতে নাক চুলকালেন কিছুক্ষণ। ‘হুম,’ অবশেষে বললেন তিনি। ‘ভালো একটা প্রশ্ন করেছ। বলতে পারো, আমি একজনের কাছে ঋণী ছিলাম। সেই ঋণ শোধ করলাম।’
‘ওয়েনসডের কাছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘বিশেষ একটা কারণে আমাকে লেকসাইডে নিয়ে এসেছিলেন তিনি, তাই না? এখানে কেউ আমাকে খুঁজে পেত না। যদি না…’
হিনজেলমান চুপ করে রইলেন। দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা একটা পোকার- দণ্ড তুলে নিয়ে খোঁচাতে শুরু করলেন ফায়ারপ্লেসের আগুন। ‘এই শহর আমার বাড়ি,’ দুষ্টুমি ভরা কণ্ঠে বললেন তিনি। ‘জায়গাটা ভালো।’
কফি শেষ করল শ্যাডো। কাপটা মেঝেতে নামিয়ে রাখল সে। এইটুকু কাজ করতেই যেন সব শক্তি ফুরিয়ে গেল বেচারার। ‘কতদিন হলো এখানে আছেন?
‘অনেকদিন হলো।’
‘হ্রদটা আপনিই বানিয়েছেন?’
অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালেন হিনজেলমান। ‘হ্যাঁ, আমিই বানিয়েছি। যেটাকে আজকে সবাই হ্রদ বলছে, সেটা তখন ছোটো একটা ঝরনা আর একটা ডোবা পুকুর ছিল কেবল। একটু বিরতি নিলেন তিনি। ‘আমি বুঝতে পেরেছিলাম, এই দেশটা আমাদের জন্য উর্বর নয়। গিলে খেয়ে নেবে। আমি কারও খাবার হতে চাইনি। তাই একটা চুক্তি করলাম। আমি ওদেরকে দিলাম একটা হ্রদ…দিলাম সমৃদ্ধি…’
‘বিনিময়ে নিলেন প্রতি শীতে একটা করে বাচ্চা?’
‘সবগুলোই ভালো বাচ্চা,’ জানালেন হিজেলমান। ‘যাকে পছন্দ হয়, কেবল তাকেই নেই আমি। শুধু সেই ১৯২৪…নয়তো ১৯২৫ সালে চার্লি নেলিগানকে গেছিলাম। ছেলেটা বড়ো বদ ছিল। যাই হোক, তোমার প্রশ্নের উত্তর দেই। হ্যাঁ, সেরকমই চুক্তি হয়েছিল।’
‘এই শহরের বর্তমান অধিবাসী,’ জানতে চাইল শ্যাডো। ‘ম্যাবেল, মার্গারিতা, চ্যাড-এরা জানে?’
হিনজেলমান কিছুই বললেন না। আগুনের ভেতর থেকে পোকারটা বের করে আনলেন তিনি। দণ্ডটার প্রথম ছয় ইঞ্চি কমলা বর্ণ ধারণ করেছে। শ্যাডো জানে, প্রচণ্ড গরম হয়ে আছে ওটা। কিন্তু হিনজেলমানের অসুবিধা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। আরও কিছুক্ষণ আগুন খুঁচিয়ে দণ্ডটাকে ওখানেই রেখে দিলেন তিনি। ‘ওরা জানে যে ভালো একটা জায়গায় বাস করছে। জানে যে এই কাউন্টির অন্য সব শহর…এমনকি এই স্টেটের অন্য সব শহর ধুঁকছে এখন। এসব ওরা জানে…বোঝে ‘
‘তার কৃতিত্ব যে পুরোটাই আপনার, সেটা জানে?
‘এই শহর,’ বললেন হিনজেলমান। ‘আমার খুব কাছের। আমি না চাইলে এখানে কিছুই হয় না। বুঝতে পেরেছ? আমি না চাইলে কেউ পা রাখতেও পারবে না শহরে। এজন্যই তোমার পিতা তোমাকে এখানে পাঠিয়েছিলেন।’
‘আপনি তো তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন!’
‘আমি করিনি! তোমার পিতা প্রতারক ছিলেন, কিন্তু আমি আমার ঋণ পইপই করে শোধ করি।
‘আমি আপনার কথা বিশ্বাস করি না।’ জানাল শ্যাডো।
হিনজেলমানকে আহত দেখাল। কপাল ঘষতে শুরু করলেন তিনি। ‘আমি কথা দিলে কথা রাখি।’
‘আমার ক্ষেত্রে রাখেননি। লরা এসেছিল এখানে। বলছিল, কেউ বা কিছু একটা যেন ওকে ডেকে এনেছে। আর স্যাম ব্ল্যাক ক্রো ও অড্রি বার্টনের একই রাতে শহরে উপস্থিত থাকাকে আপনি কাকতালীয় বলবেন?
‘স্যাম ব্ল্যাক ক্রো আর অড্রি বার্টন। আমার আসল পরিচয় জানত এই দুইজন। এ-ও জানত, আমার পেছনে লোক লেগেছে। একজন ব্যর্থ হলেও, আরেকজন তো কাজে আসবে-এটাই ভেবেছিলেন নিশ্চয়ই? নইলে আর কাকে কাকে লেকসাইডে আনতেন, হিনজেলমান? আমার জেলের ওয়ার্ডেনকে? নাকি লরার মাকে?’ শ্যাডো টের পেল, রেগে উঠতে শুরু করেছে ও। ‘আপনি আমাকে শহর থেকে তাড়াতে চাইছিলেন। কিন্তু ওয়েনসডেকে রাগাতে চাননি।’
আগুনের আলোয় গার্গয়েলের মতো দেখাচ্ছে হিনজেলমানকে। ‘শহরটা ভালো,’ বললেন তিনি, চেহারায় হাসির আভাস মাত্র নেই। ‘তুমি অনেক বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শুরু করছিলে। লেকসাইডের জন্য সেটা ভালো হতো না।’
‘আপনার আসলে আমাকে বরফে রেখে আসা উচিত ছিল।’ বলল শ্যাডো। ‘ক্যাংকারের ট্রাঙ্কটা আমি খুলেছি। এই মুহূর্তে ওখানে জমে শুয়ে আছে অ্যালিসন কিন্তু বরফ গলতে শুরু করবে। অচিরেই ভেসে উঠবে লাশটা। তখন অনুসন্ধান শুরু হবে। বাকিদের লাশ খুঁজে পাওয়া তো এরপর কেবল সময়ের ব্যাপার।’
পোকারটা তুলে নিলেন হিজেলমান, আগুন খোঁচাবার ভান ধরলেন না আর। এখন দণ্ডটাকে তলোয়ারের মতো করে ধরে আছেন। ওটার কমলা আগা বাতাসে শিস কাটছে, ধোঁয়াও বেরচ্ছে। প্রায় নগ্ন, ক্লান্ত দেহটাকে যে সময়মতো নাড়াতে পারবে না, সেটা জানে শ্যাডো। তারপরও চেষ্টা করল। ‘আমাকে খুন করতে চান?’ প্রশ্ন করল ও। ‘করে ফেলুন, এমনিতেও আমি মৃত একজন মানুষ। আপনি যে এই শহরের হর্তা-কর্তা-বিধাতা, তা আমি জানি। তবে ঘুণাক্ষরেও ভাববেন না যে আমাকে কেউ খুঁজতে আসবে না। আপনার স্বপ্নের পৃথিবী ভেঙে পড়তে শুরু করেছে, হিনজেলমান।’
উঠে দাঁড়ালেন বৃদ্ধ, পোকারের দণ্ডটা ছড়ির মতো করে ব্যবহার করছেন। কার্পেট থেকে ধোঁয়া বেরতে শুরু করল। শ্যাডোর দিকে অশ্রু-সজল চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি ভালোবাসি লেকসাইডকে। ভালোবাসি টেসিকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে, বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলতে।’ দণ্ডটার উত্তপ্ত আগা দিয়ে শ্যাডোর দিকে ইঙ্গিত করলেন তিনি। এক ফুট দূর থেকেও সেই উত্তাপ টের পাচ্ছে ও।
‘চাইলেই আমি তোমাকে খুন করতে পারি,’ বললেন হিনজেলমান। ‘ঠিক করে ফেলতে পারি সব। আগেও করেছি। তোমার আগেও অনেকে আমার রহস্য ধরতে পেরেছিল। চ্যাড মুলিগান বাবাও তাদের একজন। তাকে সামলেছি, তোমাকেও সামলাতে পারব।’
‘তা হয়তো পারবেন,’ বলল শ্যাডো। ‘কিন্তু আর কতদিন চলবে এভাবে, হিনজেলমান? এক বছর? দশ বছর? এখন কম্পিউটারের যুগ। মানুষ আর বোকা নেই। প্রতি বছর একজন করে বাচ্চা উধাও হয়ে যাচ্ছে, সেটা কর্তৃপক্ষ ঠিক ধরে ফেলবে। আগে হোক বা পরে, গন্ধ শুঁকে শুঁকে তারা চলে আসবেই। আচ্ছা, বয়স কতো আপনার? বলুন তো।’ সোফার কুশনটা দুহাতে আঁকড়ে ধরে আছে শ্যাডো, দরকার হলেই মাথার উপর ধরবে। অন্তত প্ৰথম আঘাতটা তো এড়ান যাবে এতে। হিনজেলমানের চেহারা নিস্পৃহ। ‘রোমানরা ব্ল্যাক ফরেস্টে আসার আগে থেকেই বাচ্চাদের ভেট হিসেবে পেয়ে আসছি আমি। কোবোল্ড হবার আগে দেবতা ছিলাম।’
‘যথেষ্ট হয়নি?’ কোবোল্ড কী, জানে না শ্যাডো।
সরাসরি ওর চোখের দিকে তাকাল হিনজেলমান। পোকারটা হাতে নিয়ে আবার ঠেলে দিল আগুনে। ‘ব্যাপারটা এত সহজ নয়। তোমাকে কে বলল যে চাইলেই আমি এই শহর ছেড়ে চলে যেতে পারি? আমি এই শহরেরই একটা অংশ। আমাকে সরিয়ে দিতে চাও, শ্যাডো? খুন করবে? আমাকে মুক্তি দিবে এই শহর থেকে?’
মেঝের দিকে তাকাল শ্যাডো। কার্পেট থেকে এখনও ধোঁয়া উঠছে। হিনজেলমান ওর দৃষ্টি অনুসরণ করলেন, পা দিয়ে নিভিয়ে দিলেন ওখানকার অঙ্গার। শ্যাডোর মনে হলো, একশোরও বেশি বাচ্চা যেন ওর দিকে ঘৃণা আর; হতাশা নিয়ে তাকিয়ে আছে।
ওদেরকে যে হতাশ করছে, তা বুঝতে পারছে শ্যাডো। কিন্তু কী করবে তা বুঝতে পারছে না। ‘নাহ, আমি আপনাকে খুন করতে পারব না। আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন।’
এখন আর নিজেকে সিনেমার নায়ক বা ছুঁদে গোয়েন্দা বলে মনে হচ্ছে না তার। মনে হচ্ছে ব্যর্থ একজন মানুষ।
‘একটা গোপন কথা শুনতে চাও?’ আচমকা প্রশ্ন করলেন হিনজেলমান।
‘অবশ্যই,’ বলল শ্যাডো, গোপন কিছুই এখন আর ভালো লাগে না ওর।
‘এই দেখ।’
হিনজেলমান যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেখানে পর মুহূর্তেই দেখা গেল একটা বাচ্চাকে। ছেলে বাচ্চাটার বয়স টেনে-টুনে পাঁচ বছর হবে। তার চেহারা বাদামি, লম্বা। একেবারে নগ্ন সে, কেবল গলায় একটা চামড়ার ব্যান্ড পরে আছে। দুটো তলোয়ার বিঁধে আছে তার দেহে, একটা বুক ভেদ করে চলে গেছে। অন্যটা কাঁধ দিয়ে ঢুকেছে, বের হয়েছে অন্য পাশের পাঁজরের নিচ থেকে। এখনও রক্ত ঝরছে দুই ক্ষত থেকে, যদিও তলোয়ার দুটো জং ধরা। অনেক পুরনো যে তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
শ্যাডোর দিকে তাকাল বাচ্চা, দুচোখে শুধু ব্যথা।
এভাবে খুব সহজেই জংলী গোত্ররা দেবতা বানাতে পারে, বুঝতে পারল শ্যাডো। কাউকে বলে দিতে হলো না।
একটা বাচ্চাকে আলাদা করে রাখতে হবে দীর্ঘদিনের জন্য। কাউকে দেখা করতে দেওয়া যাবে না, কারও স্পর্শ যেন না পায় বাচ্চাটা-সেদিকে নজর রাখতে হবে। গ্রামের অন্য যেকারও চাইতে যেন খাবার বেশি পায় ও, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। যখন পাঁচটা শীত এসে বিদায় নেবে, যখন রাত দীর্ঘতম…তখন কোনো এক রাতে বাচ্চাটাকে টেনে নিয়ে আসতে হবে বাইরে। অগ্নিকুণ্ডের পাশে এনে লোহা আর তামার দুটো তলোয়ার ব্যবহার করে হত্যা করতে হবে তাকে। মৃতদেহটাকে কয়লার তাপ ব্যবহার করে একেবারে শুকিয়ে ফেলে জড়িয়ে ফেলতে হবে লোমাবৃত চামড়ায়। এক বসতি থেকে অন্য বসতিতে নিয়ে যাওয়া হবে লাশটা, তার উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হবে অগণিত প্রাণী আর ছোটো বাচ্চা। তাহলে অচিরেই সে পরিণত হবে গ্রাম আর গোত্রের সৌভাগ্যে। কিছুদিনের মাঝেই যখন খসে পড়তে শুরু করে মাংস, তখন হাড়গুলোকে রেখে দিতে হবে একটা বাক্সে। এরপর বাক্সটাই পরিণত হবে উপাসনার বস্তুতে। ওই ধরনের গোত্রগুলো অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে, ভুলে যাওয়া হয়েছে বাচ্চা-দেবতাকে। এর ফলে সে পরিণত হয় এক কোবোল্ডে!
শ্যাডো ভাবল, আটলান্টিক পার হয়ে হিনজেলমানকে নিয়ে কে এসেছিল এই উইসকনসিনে? পরক্ষণেই উধাও হয়ে গেল রক্তাক্ত বাচ্চা, সেই জায়গায় উপস্থিত হলো বৃদ্ধ লোকটা।
‘হিনজেলমান?’ দরজার কাছ থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এলো।
ঘুরে দাঁড়ালেন হিনজেলমান, সেই সাথে শ্যাডোও।
‘তোমাকে বলতে এসেছিলাম যে,’ চ্যাড মুলিগান বলল, কণ্ঠে ক্লান্তি। ‘ক্ল্যাংকারটা বরফে ডুবে গেছে।’ হাতে একটা অস্ত্র ধরে আছে সে, তবে ওটার নল মেঝের দিকে।
‘হাই, চ্যাড।’ বলল শ্যাডো।
‘হাই, মাইক।’ উত্তরে বলল চ্যাড। ‘আমাকে একটা নোট পাঠিয়ে জানানো হয়েছে, তুমি নাকি হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছ।’
‘তাই নাকি? আমি তো দেখি নানা জায়গায়…নানা ভাবে মারা যাচ্ছি।’
‘এদিকে এসো, চ্যাড।’ আচমকা বলে উঠলেন হিনজেলমান। ‘আমাকে মাইক হুমকি দিচ্ছে!’
‘না,’ জানাল চ্যাড। ‘দিচ্ছে না। দশ মিনিট ধরে এখানেই দাঁড়িয়ে আছি আমি, হিনজেলমান। তোমার সব কথাই শুনেছি। আমার বাবার ব্যাপারে বলা কথা, হ্রদটার কথা।’ ভেতরে চলে এলো পুলিস অফিসার, তবে বন্দুক এখনও উঁচিয়ে ধরেনি। ‘হায়, ঈশ্বর হিনজেলমান! হ্রদটা পুরো শহরের কেন্দ্রবিন্দু বলা চলে। এখন কী করব আমি?’
‘মাইককে গ্রেফতার করো। আমাকে খুন করতে চাইছে ছেলেটা।’ বললেন হিনজেলমান। ‘তোমাকে এখানে দেখে ভয় কমে গেছে।’
‘নাহ,’ আবারও বলল চ্যাড মুলিগান।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন হিনজেলমান। নিচু হয়ে পোকারটা বের করে আনলেন তিনি।
‘ওটা নামিয়ে রাখো, হিনজেলমান। আস্তে আস্তে, আর হাত দুটো ওপরে তোলো। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়াও!’
বৃদ্ধ লোকটার চেহারায় নিখাদ ভয় ফুটে উঠল। শ্যাডোর আরেকটু হলে মায়াই হতো হিনজেলমানের জন্য, কিন্তু অ্যালিসন ম্যাকগভার্নের লাশের চেহারা মনে পড়ায় শক্ত হয়ে গেল সে। হিনজেলমান স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, পোকারটা এখনও ধরে আছেন তিনি। চ্যাডের কথা যেন শুনতেই পাননি। শ্যাডো আরেকটু হলেই হাত বাড়িয়ে পোকারটা নিয়ে নিত বৃদ্ধের হাত থেকে। কিন্তু সেই মুহূর্তেই লোকটা পোকার-দণ্ডটা ছুঁড়ে দিলেন মুলিগানের দিকে।
কিন্তু ছোঁড়াছুড়িতে সম্ভবত খুব একটা দক্ষ নন হিনজেলমান, আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দণ্ডটা ছুঁড়ে দিয়েই ছুটতে শুরু করলেন দরজার দিকে।
মুলিগানের বাঁ হাত স্পর্শ করে বেড়িয়ে গেল ওটা।
বৃদ্ধের ছোটো ঘরটায় কান ফাটানো শোনাল বন্দুকের গর্জন।
একটা মাত্র গুলি ছোঁড়া হলো…
… আর দরকার হলো না।
মুলিগান বলল, ‘তোমার পোশাক পরে নাও।’ একঘেয়ে আর নিষ্প্রাণ শোনাল ওর কণ্ঠ।
মাথা নেড়ে সায় জানাল শ্যাডো, পাশের ঘরে গিয়ে ড্রায়ার থেকে বের করে আনল পোশাক। জিন্সগুলো এখনও ভেজা। কোটটা হ্রদের মেঝেতে পড়ে আছে, আর বুটগুলো খুঁজে পেল না। ওগুলো বাদে বাকি সব কিছু পরে নিলো শ্যাডো। ততক্ষণে মুলিগান বেশ কয়েকটা জ্বলন্ত কাঠ ফায়ারপ্লেস থেকে বের করে এনেছে।
মুখ খুলল মুলিগান। ‘পুলিস হয়ে বেআইনিভাবে আগুন ধরানোটা গর্বের কাজ না,’ শ্যাডোর দিকে তাকাল সে। ‘তোমার বুট দরকার।’
‘কোথায় রেখেছে, জানি না।’ জানাল শ্যাডো।
‘ধুরো,’ বলল মুলিগান। তারপর যোগ করল। ‘আমি দুঃখিত, হিনজেলমান।’ বৃদ্ধের লাশটার কলার আর বেল্ট ধরে ফায়ারপ্লেসে ছুঁড়ে দিল লাশটা। ধূসর চোখগুলো জ্বলতে শুরু করল পট পট করে, জ্বলন্ত মাংসের গন্ধে ভরে উঠল ঘর।
‘খুন বলা যাবে না তোমার কাজটাকে, আত্মরক্ষাই বলতে হবে।’
‘তা আমি জানি,’ নিস্পৃহ কণ্ঠে জবাব দিল মুলিগান। ওর নজর এখন ঘরের চারিদিকে ছড়িয়ে দেওয়া কাঠের দিকে। সোফার দিকে একটাকে ঠেলে দিল সে, এরপর দ্য লেকসাইড নিউজের একটা পুরাতন কপি নিয়ে কাঠের ওপরে ফেলে দিল। কাগজে আগুন ধরতে বেশিক্ষণ লাগল না।
‘বাইরে চলো।’ কাজ শেষে বলল অফিসার।
বেরোবার পথে জানালাগুলো খুলে দিল সে, খালি পেয়ে হেঁটে বাইরে গিয়ে পুলিসের গাড়িতে উঠে বসল শ্যাডো। চ্যাড খুলে দেওয়ায় সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে বসতে হলো ওকে। পা মুছে নিয়ে শুকিয়ে আসা মোজা পরে নিলো সে।
‘হেনিং’সের দোকান থেকে তোমার জন্য বুট কিনে নেওয়া যাবে।’
‘কতটুকু শুনেছ?’ জানতে চাইল শ্যাডো।
‘যা শুনেছি, তা যথেষ্ট।’
হেনিং-এর দোকানে যাওয়ার আগে আর কোনো বাক্য-বিনিময় হলো না ওদের মাঝে। ওখানে পৌঁছাবার পর চ্যাড জানতে চাইল, ‘তোমার পায়ের সাইজ কতো?’
শ্যাডো জানাল।
দোকানে ঢুকল মুলিগান। একজোড়া মোটা উলের মোজা আর একজোড়া বুট কিনে নিয়ে বেরিয়ে এলো সে। ‘তোমার সাইজের আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না। তাই এগুলোই আনতে বাধ্য হলাম।’
বুট আর মোজা পরে নিলো শ্যাডো, মাপ ঠিকই আছে। ‘ধন্যবাদ।’
‘গাড়ি আছে সাথে?’ জানতে চাইল মুলিগান।
‘ব্রিজের কাছেই, রাস্তায় পার্ক করে রেখেছি।’
ইঞ্জিন চালু করল মুলিগান।
‘অড্রির কী হলো?’
‘তোমাকে নিয়ে যাবার একদিন পরের কথা। মেয়েটা বলল, বন্ধু হিসেবেই কল্পনা করে আমাকে। প্রেমিক হিসেবে নয়। ইগল’স পয়েন্টে চলে গেল তারপরেই, বলতে পারো-আমার হৃদয় ভেঙে!’
‘হুম, বুঝতে পেরেছি।’ জানাল শ্যাডো। ‘তবে ব্যাপারটা আসলে তা না। হিনজেলমান তাকে চাননি।’
পথে পড়ল বৃদ্ধের বাড়ি, চিমনি দিয়ে পুরু সাদা ধোঁয়া বেরোচ্ছে।
‘অড্রি লেকসাইডে এসেছিল, কারণ হিনজেলমান ওকে চেয়েছিলেন। আমাকে শহর থেকে বের করে দেবার জন্য তার মেয়েটাকে দরকার ছিল।’
‘আমার ধারণা ছিল: আমাকে পছন্দই করে অড্রি।’
শ্যাডোর ভাড়া করা গাড়ির কাছে চলে এসেছে ওরা। ‘এখন কী করবে তুমি?’ জানতে চাইল শ্যাডো।
‘জানি না। মুলিগানের উত্তর। তবে লোকটার চেহারা প্রাণ ফিরে পাচ্ছে একটু একটু করে। সেই সাথে দুশ্চিন্তার ছায়াও ফুটে উঠেছে সেখানে। ‘আমার সামনে মাত্র দুটো পথ খোলা আছে। হয়—’ হাতের দুই আঙুল ব্যবহার করে পিস্তলের নল বানাল ও, মুখের ভেতর পুরে দিল ওগুলো। পরক্ষণেই সরিয়ে যোগ করল, ‘মাথায় একটা বুলেট ঢুকিয়ে দেব। আর নয়তো আরও কয়েকদিন অপেক্ষা করব। বরফ গলে গেলে পায়ের সাথে কংক্রিটের একটা ব্লক বেঁধে লাফ দেব ব্রিজের উপর থেকে। আরেক পথ হিসেবে ঘুমের ওষুধও আছে।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।
তুমি হিনজেলমানকে খুন করোনি, চ্যাড। অনেকদিন আগেই মারা গেছিলেন তিনি। তা-ও এখান থেকে অনেক দূরের কোনো এক জায়গায়।’
‘কথাটা বলার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ, মাইক। কিন্তু আমি ওকে খুন করেছি। ঠান্ডা মাথায় গুলি করেছি একজন মানুষকে, তারপর সেটা ধামা-চাপা দিয়েছি। যদি জানতে চাও কেন করলাম কাজটা, তাহলে বলতে পারব না।’
এক হাত বাড়িয়ে মুলিগানের হাতে আলতো করে চাপড় বসাল শ্যাডো। ‘হিনজেলমান ছিলেন এই শহরের হর্তা-কর্তা-বিধাতা। আমার মনে হয় না যে তুমি যা করেছ তা বুঝে-শুনেই করেছ। আমার ধারণা, তার ইচ্ছাতেই তুমি উপস্থিত ছিলে ওখানে। তার ইচ্ছাতেই শুনতে পেয়েছ সবকিছু। এসব তারই ইচ্ছা ছিল। এছাড়া এখান থেকে বেরোবার আর কোনো উপায় ছিল না তার সামনে।’
মুলিগানের চেহারার পরিবর্তন হলো না এক বিন্দুও। শ্যাডো বুঝতে পারল, ওর কথা পুলিস চিফের কানে ঢুকলেও মাথায় ঢোকেনি। লোকটা হিনজেলমানকে খুন করেছে, তারপর তার জন্য একটা চিতা সাজিয়েছে। এই বৃদ্ধের শেষ ইচ্ছা পূরণ করছে সে-আত্মহত্যার কথা ভাবছে!
চোখ বন্ধ করে ফেলল শ্যাডো। মনের ভেতর ফুটিয়ে তুলতে চাইল সেই অনুভূতিটা, যেটা বরফ নামাবার সময় ভর করে ছিল ওর ভেতরে, চ্যাডের মনে পাঠিয়ে দিতে চাইল অনুভূতিটুকু। ‘চ্যাড, ভুলে যাও ব্যাপারটাকে। লোকটার মনে মেঘ ভিড় করেছে, শ্যাডো যেন দেখতে পাচ্ছে ওটাকে। এবার কল্পনা করল, মেঘটা সরে যাচ্ছে। ‘চ্যাড,’ প্রবল কণ্ঠে বলল সে। ‘এই শহরটা এখন পরিবর্তিত হতে যাচ্ছে। মন খারাপ করা এলাকার মাঝে আশার আলো হয়ে ছিল এতদিন। এখন হতে চলেছে অন্য সবগুলোর মতো। ঝামেলা শুরু হবে অচিরেই। মানুষজন চাকরি হারাবে, শুরু হবে হাতাহাতি। গোলমাল-গন্ডগোল আসন্ন। দক্ষ কোন পুলিস চিফ হাল না ধরলে, অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে অনেক।’ কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে যোগ করল সে। ‘মার্গারিতার দরকার হবে তোমাকে।’
আস্তে আস্তে হালকা হতে শুরু করেছে লোকটার মনের মেঘ, টের পাচ্ছে শ্যাডো। মার্গারিতা ওলসেনের ঘন কালো চোখ আর লম্বা চুল কল্পনা করল সে। তারপর সেই দৃশ্যটাকে ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস পেল চ্যাডের মনে। ‘মার্গারিতা অপেক্ষা করছে তোমার জন্য,’ কথাটা যে সত্যি সেটা নিজেও টের পাচ্ছে।
‘মার্জি?’ উচ্চারণ করল চ্যাড মুলিগান।
ঠিক সেই মুহূর্তে চ্যাডের মনের ভেতর প্রবেশ করল শ্যাডো। কীভাবে, তা বলতে পারবে না। মনে হয় না সেই কাজটা ভবিষ্যতে আর কোনদিন করতেও পারবে! বিকালের ঘটনাগুলো এক এক করে তুলে নিলো ও, যেমন করে শকুন তুলে নেয় মৃত প্রাণির চোখ।
চ্যাডের কপাল থেকে মুছে গেল ভাঁজ, চোখের পাতা ফেলল সে।
‘মার্জির সাথে দেখা করতে যাও,’ আদেশ দিল যেন শ্যাডো। ‘তোমাকে দেখে খুশি হলাম, চ্যাড। নিজের খেয়াল রেখো।’
‘অবশ্যই,’ হাই তুলল চ্যাড় মুলিগান।
গাড়ির রেডিয়ো কেশে উঠল খুক খুক করে, হ্যান্ডসেটের দিকে হাত বাড়াল চ্যাড। গাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল শ্যাডো।
ভাড়া করা গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল সে, শহরের মাঝখানে অবস্থিত সমতল হ্রদের দিকে তাকিয়ে রইল। ওটার নিচে শুয়ে থাকা মৃত বাচ্চাদের কথা মনে পড়ে গেল তার।
দ্রুতই, অ্যালিসনের লাশ ভেসে উঠবে ওপরে…
হিনজেলমানের বাড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় সে খেয়াল করল, আগুন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। দূর থেকে ভেসে আসছে সাইরেনের আওয়াজ।
দক্ষিণে হাইওয়ে ৫১-এর দিকে রওনা দিল সে। আরেকজনের সাথে দেখা করা বাকি আছে। তবে তার আগে, ম্যাডিসনে থামতে হবে ওকে। বিদায় জানাতে হবে মেয়েটাকে।
.
সামান্থা ব্ল্যাক ক্রোর সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে রাতের বেলা কফি হাউজের দরজা বন্ধ করার কাজটা। মন একেবারে শান্ত হয়ে ওঠে তার। মনে হয় যেন দুনিয়াকে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখতে সাহায্য করছে এভাবে। প্রায়শই ইন্ডিগো গার্লসদের একটা সিডি বাজিয়ে নিজের মতো করে কাজ শুরু করে ও। প্রথমেই পরিষ্কার করে এসপ্রেসো মেশিন। তারপর শেষ একবার সবকিছু দেখে নেয়, রান্নাঘরে কোন কাপ বা থালা পড়ে আছে কি না-সেটাও বাদ পড়ে না। সারাদিন ধরে কফি হাউজে মানুষের ফেলে যাওয়া খবরের কাগজগুলো এক করে তুলে রাখে সদর দরজার সামনে।
জায়গাটাকে এক কথায় ভালোবাসে সামান্থা। পুরনো বইয়ের দোকানের সারির মাঝে একটা আলাদা পরিচিতি নিয়ে অবস্থিত ওটা।
চিযকেকের অবশিষ্ট স্লাইসগুলো ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখল ও, তারপর একটা কাপড় বের করে মুছে ফেলল ওগুলো রাখার ডিসপ্লে। একা একা থাকাটা উপভোগ করছে।
জানালায় টোকার আওয়াজটা বাস্তবে ফিরিয়ে আনল ওকে। দরজা খুলে ওরই বয়সি আরেক মেয়েকে ঢুকতে দিল ভেতর। মেয়েটার নাম ন্যাটালি।
‘হ্যালো,’ বলে স্যামকে গাল আর ঠোঁটের কোনায় চুমু খেল ন্যাটালি। এমন চুমু অনেক কিছু বুঝিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। ‘কাজ শেষ?’
‘প্ৰায়।’
‘সিনেমা দেখতে যাবে?’
‘অবশ্যই। মিনিট পাঁচেক সময় দাও। দ্য অনিয়ন ম্যাগাজিন পোড়ো নাহয়।’
‘এই সপ্তাহেরটা আগেই পড়েছি। দরজার কাছে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল ন্যাটালি। জমিয়ে রাখা খবরের কাগজগুলো থেকে একটা নিয়ে পড়তে শুরু করল। এদিকে স্যাম ব্যস্ত টাকা-পয়সা গুছিয়ে রাখার কাজে।
এক সপ্তাহ হলো প্রেম করছে দুজন। এই সম্পর্কটার জন্যই বুঝি সারাজীবন অপেক্ষা করছিল স্যাম। নিজেকে বোঝায়-ন্যাটালিকে দেখে খুশি হবার কারণ শুরু কিছু রাসায়নিক আর ফেরোমোন। হয়তো আসলেই ব্যাপারটা সত্যিই তাই। কিন্তু মেয়েটাকে দেখলেই যে ওর মুখে হাসি ফুটে ওঠে, তাতে সন্দেহ নেই।
‘এই কাগজে আরেকটা প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে,’ বলল ন্যাটালি। ‘আমেরিকা কি পরিবর্তনশীল?’
‘কী লিখল।’
‘তেমন কিছু লেখেনি। শুধু বলেছে, সম্ভবত হ্যাঁ। কিন্তু কীভাবে আর কোথায় হচ্ছে সেই পরিবর্তন, সেটা ধরতে পারছে না। হয়তো সত্যিকারে হচ্ছেই না।
হাসল স্যাম। ‘হুম, সব নৌকাতেই পা রাখছে আরকি!
‘তাই তো মনে হচ্ছে।’ ভ্রু কুঁচকে আবার খবরের কাগজে মন দিল ন্যাটালি।
‘আমার মনে হয়, হচ্ছে।’ মোছার কাপড়টা ভাঁজ করতে করতে বলল স্যাম। ‘সরকারই কাজটা করুক বা অন্য কেউ, এখন সবকিছু আগের চাইতে ভালো বলে মনে হয়। কে জানে, হয়ত লম্বা একটা শীতের পর বসন্ত আসতে শুরু করেছে বলে!’
‘প্রবন্ধে লেখা,’ একটু বিরতি দিয়ে বলল ন্যাটালি। ‘অনেকেই নাকি রাতে অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখছে আজকাল। আমি অবশ্য অদ্ভুত স্বপ্ন দেখি না।’
চারদিকে একবার নজর বুলিয়ে নিলো স্যাম, কোন কিছু বাদ পড়ল কি না! নাহ, ঠিকই আছে সব। অ্যাপ্রোন খুলে রান্নাঘরে ঝুলিয়ে রাখল ও, তারপর ফিরে এসে বাতি নেভাতে শুরু করল। ‘আমি অবশ্য মাঝে মাঝে অদ্ভুত কিছু স্বপ্ন দেখি আজকাল। এতটাই অদ্ভুত যে একটা ডায়েরিতে লিখে রাখছি সব। ঘুম থেকে উঠেই লিখি, কিন্তু পরে যখন পড়ি তখন আর কিছু বুঝতে পারি না।’
রাস্তায় পরার কোট আর গ্লাভস দেহে-হাতে গলিয়ে নিলো স্যাম
‘স্বপ্ন নিয়ে কিছু কাজ করেছিলাম একদা।’ ন্যাটালি সবকিছু নিয়েই কাজ করেছে। অতিপ্রাকৃত থেকে শুরু করে ফেং-সুই আর জ্যাজ-কিছুই বাদ দেয়নি। ‘বলো তো শুনি, হয়তো কিছু একটা ধরতে পারব।’
‘বলছি,’ দরজা খুলে অবশিষ্ট বাতিগুলোও নিভিয়ে দিল স্যাম। ন্যাটালিকে বের হতে দিয়ে তালা লাগাল কফি হাউজের দরজায়। ‘মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখি, আকাশ থেকে মানুষ খসে পড়ছে, ঠিক তারার মতো। মাঝে মাঝে দেখি আমি পাতালপুরীতে, মহিষ-মানবের সাথে কথা বলছি। মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখি গত মাসে চুমু খাওয়া এক ছেলেকে।’
ঘোঁত করে উঠল ন্যাটালি। ‘আমাকে ওই ছেলের ব্যাপারে আর কিছু জানাতে চাও?’
‘উহু। চুমুটা রোমান্টিক ধরনের কিছু ছিল না। ওখানে উপস্থিত না থাকলে বুঝতে পারবে না।’
ফুটপাতে শোনা যাচ্ছে ন্যাটালির পায়ের শব্দ। স্যাম হাঁটছে ওর পাশেই। ‘ছেলেটার গাড়ি আমার কাছে আছে।’
‘ওই বেগুনিটা?’
‘হ্যাঁ।’
‘কেন? এখন কই সে?’
‘জানি না। হয়তো জেলে আছে, হয়তো মারা গেছে।’
‘মারা গেছে?’
‘আমার ধারণা,’ একটু ইতস্তত করল স্যাম। ‘কয়েক সপ্তাহ আগে পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম ছেলেটা মৃত। ইএসপির কারণে হয়তো। যাই হোক, আমি নিশ্চিত ছিলাম। এখন আর নিশ্চিত নই।’
‘রেখে দেবে গাড়িটা?’
‘অন্য কেউ এসে চাওয়ার আগ পর্যন্ত থাক। আমার মনে হয়, শ্যাডো তাই চাইত।’
স্যামের দিকে তাকাল ন্যাটালি। ‘ওগুলো কোত্থেকে পেলে?’
‘কোনগুলো?’
‘ওই ফুলের তোড়া…যেগুলো তুমি ধরে আছ? তোমার হাতে এলো কোত্থেকে? কফি হাউজ থেকে নিয়ে বেরিয়েছ? তাহলে তো আমি দেখতে পেতাম!’
হাতের দিকে তাকাল স্যাম। হাসল তারপর, ‘খুব দুষ্ট হয়েছ তুমি! আমার আসলে ধন্যবাদ জানানো উচিত তোমাকে। দারুণ তোড়াটা, অনেক অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু লাল গোলাপ আনলেই আরও বেশি যুক্তিযুক্ত হতো না?’
ছয়টা সাদা গোলাপ দিয়ে বানানো একটা ফুলের তোড়া হাতে ধরে আছে সে। ‘আমি দেইনি তোমাকে,’ বলল ন্যাটালি। তারপর সিনেমা হলে পৌঁছাবার আগে দুজনের মাঝে আর কোনো বাক্য-বিনিময় হলো না।
সে রাতে ঘরে ফিরে গোলাপগুলোকে একটা অস্থায়ী ফুলদানি রেখে দিল স্যাম। অন্য কাউকে ওগুলোর আসল গল্প শোনায়নি সে। তবে ক্যারোলাইন, যে ন্যাটালির পর এসেছিল ওর জীবনে, তাকে ভূতুড়ে তোড়ার গল্পটা বলেছিল। দুজনেই মাতাল হয়েছিল সে রাতে। ক্যারোলাইন একমত হয়েছিল যে গল্পটা আসলেই খুব রহস্যময়। কিন্তু সত্যিকার অর্থে তার একটা শব্দও মেয়েটা বিশ্বাস করেনি।
.
একটা পে-ফোনের পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়েছিল শ্যাডো। এরপর অপারেটরকে ফোন করে নিয়েছিল ওর নম্বর।
তবে ওকে জানানো হলো, এই মুহূর্তে সম্ভবত মেয়েটা বাড়িতে নেই। আছে কফি হাউজে।
যাবার পথে একটা ফুলের তোড়া নিয়েছিল শ্যাডো। কফি হাউজটাকে খুঁজে বের করতে কষ্ট হয়নি একদম। রাস্তার অপর পাশে একটা পুরাতন বইয়ের দোকানের সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল কিছুক্ষণ। দেখছিল তাকিয়ে তাকিয়ে।
দরজা বন্ধ হলো আটটায়। মিনিট দশেক পর আরেক মেয়ের হাত ধরে রাস্তায় নেমে এলো স্যাম ব্ল্যাক ক্রো। কথা বলছিল দুজন। আসলে যা বলার তা বলছিল স্যামই। হাসছিল মেয়েটা।
রাস্তা পার হলো দুই মেয়ে। শ্যাডো যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, তার সামনে দিয়েই হেঁটে গেল ওরা। স্যামের বান্ধবী হাঁটছিল সামনে সামনে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল শ্যাডো, ওর বুকের ভেতরে যেন কোনো বীণা বিষণ্ন সুরে বাজতে শুরু করেছে।
চুমুটা দারুণ ছিল, ভাবল সে। কিন্তু স্যাম এখন যে নজরে তার বান্ধবীর দিকে তাকাচ্ছে, সেই নজরে যে কোনোদিন ওর দিকে তাকাবে না, তা-ও পরিষ্কার।
‘চুলোয় যাক দুনিয়া।’ অস্ফুট কণ্ঠে বলল ও। ‘আমাদের এল পাসো আর পেরুর স্মৃতি তো আর কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।’
দৌড়ে মেয়েটার পিছু নিলো ও, কাছে গিয়ে ফুলের তোড়া গুঁজে দিল স্যামের হাতে। তারপর তাড়াতাড়ি সরে এলো, পাছে মেয়েটা নিতে অস্বীকার করে।
এরপর গাড়ির চড়ে রওনা দিল শিকাগোর দিকে। পুরো রাস্তা স্পিড লিমিটের একটু নিচে রাখল গতি।
আর একটা মাত্র কাজ করা বাকি আছে জীবনে।
তাড়াহুড়োর কিছু নেই।
.
রাতটা এক মোটেল সিক্সে কাটাল শ্যাডো। পরের দিন সকালে উঠে টের পেল, পরনের পোশাক থেকে দুর্গন্ধ আসছে। তবে গা না করে পরে নিলো ওগুলোই। আর বেশিক্ষণ এসবের দরকার হবে না তার।
বিল চুকিয়ে চলে গেল বাদামি দালানটার দিকে। খুঁজে পেতে কষ্ট হলো না।
চুপচাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল ও। দ্রুতও না, আবার আস্তেও না। মৃত্যুর দিকে দৌড়ে যাবার ইচ্ছা নেই ওর, আবার নিজের কাছে কাপুরুষ প্রতিপন্ন হতে চায় না। সিঁড়িটা পরিষ্কার করেছে কে যেন। ক্লোরিনের ঝাঁঝালো গন্ধ আসছে জায়গাটা থেকে।
সিঁড়ির একেবারে ওপরে অবস্থিত লাল রং করা দরজা হাট করে খোলা। বাতাসে ভাসছে পুরাতন খাবারের গন্ধ। কিছুক্ষণ ইতস্তত করল শ্যাডো, তারপর ঘণ্টা বাজালো।
‘আসছি!’ চিৎকার করে জানালো এক নারী কণ্ঠ। বামনাকৃতির আর স্বর্ণকেশী যরিয়া উত্রেনেয়া রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো ওর দিকে, অ্যাপ্রোনে হাত মুছছে। মহিলাকে দেখে অন্যরকম লাগছে আজ, আনন্দিত বলে মনে হচ্ছে। গালগুলোতে রুজ লাগিয়েছে সে, চোখে কীসের যেন দীপ্তি। শ্যাডোকে দেখে হাঁ হয়ে গেল তার মুখ। ‘শ্যাডো! তুমি আমাদের কাছে ফিরে এসেছ?’ হাত বাড়িয়ে ওর দিকে এগিয়ে এলো সে। নিচু হয়ে মহিলাকে আলিঙ্গন করল করল। ‘তোমাকে দেখে প্রীত হলাম!’ জানাল যরিয়া উত্রেনেয়া। ‘এবার পালাও!’
অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে পা রাখল শ্যাডো। সবগুলো দরজাই খোলা, কেবল যরিয়া পলুনোচনেয়ার ঘরেরটা বাদে। জানালাগুলোও খোলা, মৃদু বাতাস আসছে ভেতরে।
‘পরিষ্কার করছেন নাকি?’ জানতে চাইল ও।
‘হ্যাঁ, অতিথি আসছে। এবার যাও। তবে যাবার আগে কফি খেয়ে যাও।’
‘আমি চেরনোবোগের সাথে দেখা করতে এসেছি।’ জানাল শ্যাডো। ‘সময় হয়েছে।’
যরিয়া উত্রেনেয়া প্রবল বেগে মাথা নাড়ল। ‘না, না। দেখা কোরো না ওর সাথে। বোকার মতো হবে কাজটা।’
‘আমি জানি।’ বলল শ্যাডো। ‘তবে দেবতাদের সাথে ওঠা-বসা করে একটা ব্যাপার বুঝতে পেরেছি, চুক্তি চুক্তিই। ওরা নিজেদের ইচ্ছা-মতো চুক্তি ভাঙতে পারে। আমরা পারি না। আমি হাজার চেষ্টা করলেও পালাতে পারব না, আমার পাজোড়া ঘুরে-ফিরে এখানেই নিয়ে আসবে শেষ পর্যন্ত।’
নিচের ঠোঁট ফুলিয়ে বলল যরিয়া উত্রেনেয়া। ‘তা সত্যি। কিন্তু আজকে যাও। কালকে এসো। তখন হয়তো চেরনোবোগ থাকবে না।’
‘কে এসেছে?’ করিডরের ওপাশ থেকে আরেকটা মহিলা কণ্ঠ ভেসে এলো। ‘যরিয়া উত্রেনেয়া, কার সাথে কথা বলছ তুমি? আমি একা একা এই ম্যাট্রেস ওলটাতে পারব না তো!’
করিডর ধরে এগিয়ে গেল শ্যাডো। ‘শুভ সকাল, যরিয়া ভেচেরনেয়া। আমি সাহায্য করি?’ ওকে দেখে অবাক যরিয়া ভেচেরনেয়া হাত থেকে ফেলে দিল ম্যাট্রেস।
শোবার ঘরটা ধুলোয় ভরতি। সবকিছু ঢেকে আছে ওতে। কাঠের আসবাব, গাস-কিছুই বাকি নেই।
এই ঘরটার কথা মনে আছে ওর। যেবার এই অ্যাপার্টমেন্টে রাত কাটিয়েছিল, সেবার ওয়েনসডে ব্যবহার করেছিলেন ঘরটা। বিয়েলবোগের বেডরুম এটা!
অনিশ্চিত চোখে ওর দিকে তাকাল যরিয়া ভেচেরনেয়া। ‘এই ম্যাট্রেসটা ওলটানো দরকার।’
‘কোনো অসুবিধা নেই,’ বলে হাত বাড়াল শ্যাডো। বিনা আয়াসে উলটে
ফেলল।
‘কেন এসেছ তুমি?’ যরিয়া উত্রেনেয়ার কণ্ঠে বন্ধুত্বের ছাপ নেই কোন
‘আমি এসেছি,’ শুরু করল শ্যাডো। ‘কেননা গত ডিসেম্বরে এক যুবক চেকার্স খেলেছিল এক বৃদ্ধ দেবতার সাথে। সেই খেলায় পরাজয় হয়েছিল যুবকের।’
বৃদ্ধা মাথার ওপরে খোঁপা করেছে। ঠোঁটে ঠোঁট চাপল মহিলা। ‘আগামীকাল এসো, আজ যাও।
‘তা যে হবার নয়।’
‘তাহলে মরো। যাও, ওই কোনায় চুপ করে বসে থাকো। যরিয়া উত্রেনেয়া কফি বানিয়ে দেবে তোমাকে। চেরনোবোগের আসতে বেশি বাকি নেই।’
বসার ঘরে ফিরে এলো শ্যাডো। যেমনটা আগেরবার দেখেছিল, তেমনটাই আছে ঘরটা। জানালা খোলা আছে কেবল। ধূসর বিড়াল ঘুমিয়ে আছে সোফার হাতলে। শ্যাডোর আগমন টের পেয়ে এক নজর কেবল তাকাল ও, তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
এখানেই চেরনোবোগের সাথে চেকার্স খেলেছিল ও। এখানেই ধরেছিল নিজের জীবনের বাজি।
কিছুক্ষণ পর যরিয়া উত্রেনেয়া এসে ওকে এক কাপ কালো কফি দিয়ে গেল। সেই সাথে ছোটো ছোটো কয়েকটা চকলেট-চিপ কুকি।
‘যরিয়া পলুনোচনেয়ার সাথে আরেকবার দেখা হয়েছিল আমার।’ বলল সে। ‘পাতালপুরীতে আমার সাথে দেখা করার জন্য এসেছিল ও। ওর জন্যই চাঁদের আলোতে পথটা দেখতে পেয়েছি। বিনিময়ে কিছু একটা নিয়েছে আমার কাছে, কিন্তু কী নিয়েছে তা মনে করতে পারছি না।’
‘তোমাকে বেশ পছন্দই করে ও,’ বলল যরিয়া উত্রেনেয়া। ‘আমাদের সবাইকে রক্ষা করে। খুব সাহসী মেয়ে।’
‘চেরনোবোগ কোথায়?’
‘এই সব ধোওয়া-মোছা নাকি ওর সহ্য হয় না। তাই বাইরে গেছে। খবরের কাগজ আর সিগারেট কিনে নিশ্চয়ই কোনো পার্কে গিয়ে বসবে। আজ আর ফিরবে বলে মনে হয় না। তোমার অপেক্ষা করার দরকার নেই। কাল এসো নাহয়।’
‘আমি অপেক্ষা করব,’ জানাল শ্যাডো। ওকে অপেক্ষা করার জন্য কোনো জাদু বাধ্য করছে না। স্বেচ্ছায় কাজটা করছে সে। এটাই শেষ, এভাবেই সব কিছু শেষ হওয়া উচিত। এরপর আর কোনো দায়বদ্ধতা রইবে না। রইবে না কোনো রহস্য।
করিডর থেকে একটা গভীর পুরুষ-কণ্ঠ ভেসে এলো। সোজা হয়ে বসল শ্যাডো। হাত কাঁপছে না দেখে নিজের ওপরেই সন্তুষ্ট হলো। খুলে গেল দরজা।
‘শ্যাডো?’
‘হাই।’ বসে বসেই বলল শ্যাডো।
ঘরে প্রবেশ করল চেরনোবোগ। দ্য শিকাগো সান-টাইমসের একটা ভাঁজ করা কপি ধরে আছে হাতে। ওটা কফি টেবিলের উপর রেখে শ্যাডোর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সে। করমর্দন করল দুজন।
‘আমি এসেছি,’ জানাল শ্যাডো। ‘আমাদের চুক্তি ছিল একটা। তুমি তোমার অংশ পালন করেছ, এবার আমি আমারটা করব।’
মাথা দোলাল চেরনোবোগ। ভ্রু কুঁচকে এসেছে। সূর্যের আলো ওর ধূসর চুল আর গোঁফে এসে পড়ছে, সোনালি দেখাচ্ছে ওগুলো।
‘আজ…’ বলল সে। ‘আজ…’ থেমে গেল আচমকা। ‘আজ চলে যাও। এখন সময় হয়নি।’
‘যত সময় লাগে তৈরি হবার জন্য, নিন নাহয়। আমি তৈরি।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল চেরনোবোগ। ‘তুমি বোকার হদ্দ, জানো?’
‘হ্যাঁ।’
‘বোকার হদ্দ তুমি পাহাড়ের চুড়ায় ভালো একটা কাজ করেছ।’
‘আমি কেবল আমার কর্তব্য পালন করেছি।’
‘হয়তো,’ কাঠের সাইডবোর্ডের দিকে এগিয়ে গিয়ে ওটার নিচ থেকে একটা অ্যাটাশে কেস বের করে আনল চেরনোবোগ। ডালা খুলে ভেতর থেকে বের করে আনল একটা হাতুড়ি। স্লেজ হ্যামারের মতোই দেখতে, তবে আকারে ছোটো। হাতলে রক্ত লেগে আছে।
ঘুরে দাঁড়িয়ে চেরনোবোগ বলল। ‘তোমার কাছে আমি ঋণী। কতটা তা নিজেও জানো না। তোমার জন্য আস্তে আস্তে পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। আমাদের মাঝে এসেছে সত্যিকারের বসন্ত।’
‘আমার সামনে অনেকগুলো পথ খোলা ছিল না। তাই যা করার ছিল, তাই করেছি।’ বলল শ্যাডো।
মাথা দোলাল চেরনোবোগ। ‘তোমাকে আমার ভাইয়ের ব্যাপারে আগে কখনও বলেছি?’
‘বিয়েলবোগের ব্যাপারে?’ কার্পেটের মাঝখান পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসল শ্যাডো। ‘কেবল বলেছেন, তাকে অনেকদিন হলো দেখেন না।’
‘হ্যাঁ,’ হাতুড়ি তুলল বৃদ্ধ। ‘অনেক লম্বা একটা শীত কাটালাম আমরা, বাছা। কিন্তু এখন তা শেষ হতে চলেছে।’ মাথা নাড়ল সে, যেন আচমকা কিছু মনে পড়েছে। বলল, ‘চোখ বন্ধ করো।’
তাই করল শ্যাডো, মাথা তুলে অপেক্ষা করে রইল আঘাতের।
স্লেজ হ্যামারটার মাথাটা ঠান্ডা, বরফের মতো। আলতো করে ওর কপাল স্পর্শ করল ওটা, যেন চুমু খাচ্ছে।
‘কাজ শেষ,’ বলল চেরনোবোগ। লোকটার মুখে আনন্দ আর স্বস্তির হাসি দেখতে পেল শ্যাডো, এর আগে তাকে ওভাবে হাসতে দেখেনি কখনও। অ্যাটাশে কেসে আবার বন্দী হলো হাতুড়ি।
‘আপনিই চেরনোবোগ তো?’ জানতে চাইল শ্যাডো।
‘হ্যাঁ, আজ আমিই চেরনোবোগ। আগামীকাল থেকে শুরু হবে বিয়েলবোগের রাজত্ব।’
‘তাহলে আমাকে হত্যা করলেন না কেন?’
পকেট থেকে ফিল্টার ছাড়া একটা সিগারেট বের করে আনল বৃদ্ধ। ম্যান্টেলপিস থেকে একটা ম্যাচের বাক্স এনে ধরাল ওটা। ‘কারণ,’ অনেকক্ষণ পর বলল সে। ‘রক্তের দরকার আছে। তেমনি দরকার আছে কৃতজ্ঞতার। লম্বা এই শীতকে আমি পেছনে ফেলতে চাই।’
উঠে দাঁড়াল শ্যাডো। জিন্সের হাঁটুতে ধুলো লেগে আছে, হাত দিয়ে ওগুলো পরিষ্কার করার প্রয়াস পেল সে। ‘ধন্যবাদ।’
‘তোমাকে স্বাগতম।’ জানাল বৃদ্ধ। ‘আবার যদি চেকার্স খেলতে ইচ্ছা হয়, তাহলে চলে এসো। তবে এবার কিন্তু আমি সাদা ঘুঁটি নেব!
‘ধন্যবাদ। হয়তো আসব। তবে অতি সত্ত্বর নয়।’
বৃদ্ধ লোকটার উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকিয়ে হাত মেলাল শ্যাডো, বিদায় শব্দটা উচ্চারণ করল না দুজনের কেউ।
বেরোবার পথে যরিয়া উত্রেনেয়ার গালে চুমু খেল শ্যাডো, চুমু খেল যরিয়া ভেচেরনেয়ার হাতের উলটো পিঠে। একেকবারে দুটো করে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে গেল সে।