আমেরিকান গডস – ২

অধ্যায় দুই 

মেয়েটিকে ওরা নিয়ে গেল গোরস্তানে 
ক্যাডিলাকে করে; 
নিয়ে গেল তারা তবে,
আনল না ফিরিয়ে। 

‘পুরাতন গান 

.

‘আমি নিজে থেকে,’ হাত ধুতে ধুতে বললেন মি. ওয়েনসডে। ‘আমার খাবারের অর্ডারটা তোমার টেবিলে দিতে বলেছি। আমাদের অনেক কিছু নিয়ে আলোচনা করতে হবে।’ 

‘আমার তা মনে হয় না।’ বলল শ্যাডো, টিস্যু পেপার দিয়ে হাত মুছে সেটাকে ডাস্টবিনে ফেলে দিল ও। 

‘তোমার একটা চাকরি দরকার,’ বললেন ওয়েনসডে। ‘মানুষ কখনওই জেলঘুঘুকে ভাড়া করে না। তোমরা ওদেরকে অস্থির করে তোল। 

‘আমার জন্য একটা চাকরি অপেক্ষা করছে।’ 

‘কোথায়? তোমার বন্ধুর ব্যায়ামাগারে?’ 

‘হয়তো,’ বলল শ্যাডো। 

‘নাহ। ওখানে চাকরি নেই। রবি বার্টন মারা গেছে। ওকে ছাড়া ব্যায়ামাগারটারও অস্তিত্ব রইবে না।’ 

‘আপনি একজন মিথ্যুক।’

‘তা তো বটেই, এ কাজে বেশ দক্ষও। আমার চাইতে ভালো আর মিথ্যুক হাজার খুঁজেও পাবে না তুমি। তবে এখন মিথ্যা বলছি না।’ পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা খবরের কাগজ বের করে শ্যাডোর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘সাত নম্বর পাতা। বারে এসে বসো, আরাম করে পড়তে পারবে।’ 

দরজা খুলে বারে ফিরে এলো শ্যাডো। ধোঁয়ায় বাতাস নীল রং ধারণ করেছে, জুক বক্সের গান শুনে আপনমনে হাসল সে। 

বারের লোকটা ওকে কোনার একটা টেবিল হাত দিয়ে দেখাল। একটা চিলি ভরতি পাত্র আর অল্প আঁচে রান্না করা মাংস রাখা আছে ওখানে, সেই সাথে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইও। 

শ্যাডো বসে পড়ল টেবিলে, খবরের কাগজটাও নামিয়ে রাখল। ‘মুক্ত মানুষ হিসাবে এটাই আমার প্রথম খাবার। আগে খেয়ে নেই, তারপর নাহয় আপনার সাত নম্বর পাতা পড়ব।’ 

চুপচাপ হ্যামবার্গার খেল শ্যাডো। জেলের চাইতে অনেক ভালো। চিলিটাও বেশ, কয়েক চামচ মুখে নিয়ে ভাবল ও, তবে এই স্টেটের সবচেয়ে সেরা কোনদিক দিয়েই না। 

লরা দারুণ চিলি বানায়। চর্বি-ছাড়ানো মাংস, কালো বিন, ছোটো ছোটো করে কাটা গাজর, আধ বোতল বিয়ার আর সদ্য কাটা মরিচ একসাথে রান্না করে কিছুক্ষণ। তারপর তাতে ঢালে রেড ওয়াইন, লেবুর রস আর এক চিমটি সুগন্ধি। একদম শেষে যোগ করে মাপা হাতের চিলি পাউডার। বেশ কয়েকবার লরার রান্না পদ্ধতি দেখেছে শ্যাডো। সবকিছু দেখে দেখে লিখেও নিয়েছিল, প্রতিটা পদক্ষেপ…আর প্রতিটা উপাদান, তাও আবার পরিমাণসহ! কিন্তু না, লরার মতো সুস্বাদু চিলি একবারও রান্না করতে পারেনি। 

সাত নম্বর পাতায় প্রথমেই পড়ে নিলো ওর স্ত্রীর মৃত্যু নিয়ে লেখা খবর। লরা মুন, প্রবন্ধ অনুসারে যার বয়স সাতাশ এবং রবি বার্টন, উনচল্লিশ বছর বয়েসে মৃত্যু বরণ করেছেন। মৃত্যুর সময় তারা ছিলেন রবি বার্টনের গাড়িতে। রাস্তায় আচমকা নড়ে ওঠে সেটা, পেছন থেকে এসে ধাক্কা দেয় বত্রিশ চাকার একটা লরি। ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রবি আর লরাকে উদ্ধার করে কর্মীরা। হাসপাতালে তাদেরকে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার দুজনকেই মৃত ঘোষণা করেন। 

শ্যাডো খবরের কাগজটা আবার ভাঁজ করে টেবিলে রেখে দিল, তবে এবার এগিয়ে দিল ওয়েনসডের দিকে। ভদ্রলোক স্টেক নিয়ে ব্যস্ত হয়েছে পড়েছেন, মাংসের ওই টুকরা থেকে এমনভাবে রক্ত ঝরছে যে কাঁচাই বলে চলে। 

‘এই যে, আপনার পত্রিকা।’ বলল শ্যাডো। 

রবি গাড়ি চালাচ্ছিল, নিশ্চয়ই মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ছিল ব্যাটা। অবশ্য কাগজে তেমন কিছু লেগেনি। রবির এই মাতাল অবস্থা বুঝতে পেরে লরার চেহারা কেমন হয়েছিল, তা যেন মানসচক্ষে দেখতে পেল ও। শুধু তাই না, পুরো ঘটনাটাই ওর চোখের সামনে ঘটছে। লরা চিৎকার করে বকছে রবিকে, বলছে রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করাতে। আচমকা কেঁপে উঠল গাড়ি, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাক খেতে লাগল… 

..রাস্তার পাশে গিয়ে কিছু একটার সাথে বাড়ি খেয়ে তবে থামল যন্ত্রটা। হেডলাইটের আলোয় উইন্ডশিল্ডের ভাঙা কাচ হীরার মতো ঝিকমিক করছে। রক্তের ফোঁটা যেন রুবির টুকরো। দুটো নিথর দেহ বের করে আনা হলো ধ্বংসাবশেষ থেকে। রাস্তার পাশে শুইয়ে রাখা হলো ওগুলো। 

‘তাহলে, কী সিদ্ধান্ত নিলে?’ জানতে চাইলেন ওয়েনসডে। খাওয়া শেষ তার, অনেকদিনের অভুক্ত মানুষের মতোই গাপুসগুপুস করে খেয়ে ফেলেছেন। এখন তার মুখে স্থান করে নিয়েছে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। 

‘ঠিক বলেছিলেন আপনি। আমি বেকার।’ 

পকেট থেকে একটা পয়সা বের করে নিলো শ্যাডো, টেলসের দিকটা ওপরে রেখে ছুড়ে দিল বাতাসে। নিচে নেমে আসার আগেই শূন্য থেকে লুফে নিলো ওটা, হাতের চেটোতে রাখল। 

‘বলুন, হেডস না টেলস?’ 

‘কী দরকার?’ 

‘আমি এমন কারও হয়ে কাজ করতে চাই না, যার কপাল আমার চাইতেও মন্দ। বলুন।’ 

‘হেডস।’ 

‘দুঃখিত।’ পয়সার দিকে না তাকিয়েই বলল শ্যাডো। ‘টেলস উঠেছে। দুঃখ পাবেন না, আমি চুরি করেছি। ফলাফল আমার আগে থেকেই জানা।’ 

‘আগে থেকে ফলাফল নির্ধারিত-এমন খেলায় জেতাই সবচেয়ে সোজা।’ আঙুল নাড়তে নাড়তে বললেন ওয়েনসডে। ‘একবার দেখোই না।’ 

কথা মতো কাজ করল শ্যাডো, দেখল-হেডস উঠেছে! 

‘ভুল করেছি!’ অবাক কণ্ঠে বলল। 

‘নিজেকে ছোটো করে দেখছ,’ হাসি দেখা গেল ভদ্রলোকের চেহারায়। ‘আসলে আমার কপালটাই এমন-খুব…খুব ভালো।’ আচমকা চোখ তুলে তাকালেন তিনি। ‘আরে, পাগলা সুইনি দেখি! এসো, পান করো আমাদের সাথে।’

‘সাউদার্ন কমফোর্ট আর কোক খাওয়ালে আছি।’ শ্যাডোর পেছন থেকে বলে উঠল কেউ। 

‘ঠিক আছে, বারম্যানকে বলছি।’ বলে উঠে দাঁড়ালেন ওয়েনসডে, রওনা দিলেন বারের দিকে। 

‘আমি কী নেব, তা জানতে চাইলেন না?’ জিজ্ঞেস করল শ্যাডো। 

‘সেটা আমি আগে থেকেই জানি।’ উত্তরে বললেন ভদ্রলোক। 

শ্যাডোর পাশে বসে পড়ল পাগলা সুইনি, লোকটার থুতনিতে হালকা বাদামি দাড়ি। পরনে ডেনিম জ্যাকেট, অনেকবার রিপু করা হয়েছে। জ্যাকেটের নিচ থেকে উঁকি দিচ্ছে একটা দাগ পড়া সাদা টি-শার্ট। তাতে লেখা— 

যদি না পারো খেতে, গিলতে বা টানতে… 
—ছুড়ে ফেলো জিনিসটা, ঝামেলা এড়াতে! 

মাথা ঢেকে রেখেছে একটা বেসবল ক্যাপ। লেখা আছে ওতে- 

মাত্র একজন পরস্ত্রীকেই ভালোবেসেছি জীবনে…আমার মাকে!

নোংরা হাতে কম দামি সিগারেটের একটা প্যাকেট খুলল সুইনি, নিজে একটা নিয়ে শ্যাডোর দিকে একটা বাড়িয়ে দিল। অবচেতনমনেই হাত বাড়াচ্ছিল ও; নিজে ধূমপান করে না বটে, তবে জেলে সিগারেটকে টাকার বিকল্প হিসেবেই দেখা হতো। ঠিক তখনই মনে পড়ল-আজ থেকে ও পাখির মতোই মুক্ত। মাথা নেড়ে না করল তাই। 

‘তুমি তাহলে কাজটা নিচ্ছ?’ জিজ্ঞেস করল দাড়িঅলা। ঠিক মাতাল মনে হলো না তাকে, আবার ঠিক সুস্থও ঠেকছে না। 

‘তাই তো মনে হচ্ছে,’ উত্তর দিল শ্যাডো। ‘তুমি কী করো?’ 

সিগারেট ধরাল লোকটা। ‘আমি লেপ্রিকন।’ হাসি মুখে বলল সে। 

তবে শ্যাডোর মুখে হাসি নেই। ‘তাই নাকি? তাহলে সাউদার্ন কমফোর্ট গলায় না ঢেলে গিনেস[২] ঢালো!’ 

[২ আইরিশ মদ।]

‘একেবারে গৎবাঁধা হয়ে গেল না কথাটা? চিন্তা-ভাবনায় পরিবর্তন আনতে হবে তোমার।’ উত্তর দিল লোকটা। ‘আয়ারল্যান্ড মানেই কিন্তু গিনেস না।’ 

‘তোমার কথায় আইরিশ টানও নেই। 

‘এই বালের জায়গায় অনেক দিন ধরে আছি যে, তাই।’ 

‘জন্ম আয়ারল্যান্ডে?’ 

‘কেবলই তো বললাম, আমি একজন লেপ্রিকন। জীবনে শুনেছ, লেপ্রিকনরা মস্কোতে জন্মায়?’ 

‘তা শুনিনি।’ 

ওয়েনসডে টেবিলে ফিরে এলেন, থাবার মতো হাতে ধরে আছেন তিনটা গ্লাস। ‘পাগলার জন্য সাউদার্ন কমফোর্ট আর কোক, আমার জন্য জ্যাক ড্যানিয়েলস আর এই গ্লাসটা তোমার জন্য, শ্যাডো।’ 

‘কী আছে এর মধ্যে?’ 

‘খেয়েই দেখো!’ 

সোনালি রং পানীয়টার। ইতস্তত ভঙ্গিতে ছোট্ট একটা চুমুক দিল শ্যাডো, টক আর মিষ্টির অদ্ভুত একটা স্বাদ জড়িয়ে গেল জিহ্বায়। মদ যে আছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু অনেকগুলো স্বাদের এক মজার মিশ্রণ যেন। 

‘খেলাম,’ বলল শ্যাডো। ‘এবার বলুন, এটা কী?’ 

‘মধু দিয়ে বানানো মদ,’ উত্তর দিলেন ওয়েনসডে। ‘মিড বলি আমরা, বীরদের পানীয়। সেই সাথে দেবতাদেরও।’ 

আরেকটা কৌতূহলী চুমুক দিল শ্যাডো…হুম, মধুর স্বাদ পাওয়া যাচ্ছে। তবে সাথে আরও অনেক কিছু আছে এতে। ‘কেমন যেন সিরকার মতো লাগছে। তবে মিষ্টি মেশানো।’ 

‘ঠিক,’ একমত হলেন ওয়েনসডে। ‘ডায়াবেটিক রোগীর প্রস্রাবের মতো স্বাদ। আমার একদম ভালো লাগে না।’ 

‘তাহলে আমার জন্য আনলেন কেন?’ যুক্তিযুক্ত প্রশ্ন শ্যাডোর। 

অদ্ভুত চোখজোড়া দিয়ে শ্যাডোকে কিছুক্ষণ দেখলেন ওয়েনসডে। ওই দুই চোখের একটা কাচের, বুঝতে পারল শ্যাডো। কিন্তু কোনটা, তা ধরতে পারল না। ‘তোমার জন্য আনলাম কারণ…আনাটাই প্রথা। আমাদের চুক্তি সম্পন্ন হবার শেষ ধাপ এই মদ্যপান। আর এখন প্রথা মানা আমাদের জন্য খুব জরুরি।’ 

‘আমরা তো কোনো চুক্তি করিনি!’ 

‘অবশ্যই করেছি। তুমি এখন থেকে আমার হয়ে কাজ করো। আমার সুরক্ষা এখন তোমার হাতে। আমাকে বিভিন্ন জায়গায় আনা-নেওয়া করবে, ছোটোখাটো কাজ করে দেবে। দরকার হলে…আবারও বলছি, দরকার হলে অবাধ্য কাউকে পোষও মানাতে হবে তোমার। আমি মারা গেলে, তুমি আমার হয়ে শোক পালন করবে। বিনিময়ে তোমার কোনো চাহিদা যেন অপূর্ণ না থাকে, সেদিকে আমি খেয়াল রাখব।’ 

‘ধোঁকা দিচ্ছে কিন্তু,’ দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বলল পাগলা সুইনি। ‘লোকটা আস্ত ধোঁকাবাজ।’ 

‘নিজেকে কবে ভালোমানুষ দাবি করলাম, শুনি?’ জানতে চাইলেন ওয়েনসডে। ‘এজন্যই তো আমার শ্যাডোর মতো একজনকে চাই, যে আমার স্বার্থ মাথায় রেখে কাজ করবে।’ 

হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল জুকবক্সের গান। নীরাবতা নেমে এলো বারে, কেউ কথা বলছে না। 

‘একজনের মুখে শুনেছিলাম, বারে সবাই একসাথে নীরব হয়ে যায় হয় ঘণ্টা শেষ হবার বিশ মিনিট আগে, নয়তো ঘণ্টা পার হয়ে বিশ মিনিটে।’ বলল শ্যাডো। ঘড়ির দিকে ইঙ্গিত করল সুইনি। কী আশ্চর্য! সময় তখন এগারোটা বেজে বিশ! 

‘একেবারে ঘড়ি ধরা। কিন্তু কেন এমন হয়, তা কখনও বুঝতে পারিনি!’ বলল শ্যাডো। 

‘আমি জানি কেন,’ বললেন ওয়েনসডে। ‘যাক গে, মিডটা শেষ করে ফেল।’ এক চুমুকে তাই করল যুবক। ‘একটু বরফ মেশালে মনে হয় মন্দ হতো না।’

‘কে জানে, হয়তো আরও বাজে হতো।’ মন্তব্য করলেন ওয়েনসডে। ‘আসলে ওই জিনিসটাই কেমন যেন!’ 

‘তা ঠিক।’ পাগলা সুইনিরও সেই মত। ‘ক্ষমা করবেন, ভদ্রমহোদয়গণ। একটু হালকা না হয়ে নিলে হচ্ছে না। প্রস্রাব করার জন্য উঠে দাঁড়াল সে। অস্বাভাবিক লম্বা একটা লোক, ভাবল শ্যাডো। প্রায় সাত ফুট হবে। 

টেবিল মুছে, খালি গ্লাসগুলো সরিয়ে নিলো এক ওয়েট্রেস। ওয়েনসডে বললেন সবাইকে আরেক প্রস্থ মদ দিতে। তবে এবার শ্যাডোর মিডের সাথে মিশিয়ে দিতে বললেন বরফ আর পানি। 

‘কাজের কথায় আসি,’ বললেন তিনি। ‘তোমার কাছে আমার কিছু চাহিদা আছে। 

‘আমার চাহিদার কথা শুনবেন না?’ 

‘অবশ্যই। বলে ফেলো, বাছা।’ 

ফিরে এসেছে ওয়েট্রেস, হাতে ধরে আছে মদের গ্লাস। মিড ভরতি পাত্রটা হাতে নিয়ে চুমুক দিল শ্যাডো। আসলেই, বরফ দিয়ে একদম লাভ হয়নি। বরং উলটো ফল হয়েছে, টক-টক ভাবটা এখন বেশি করে লাগছে জিহ্বায়। তবে ঠিক মদ বলে মনে হচ্ছে না, নিজেকে সান্ত্বনা দিল ও। এখন মাতাল হওয়া একদম চলবে না। 

লম্বা করে শ্বাস নিলো যুবক। 

‘শুনুন তাহলে,’ শুরু করল ও। ‘আমার জীবন, যার প্রায় তিনটা বছর কেটেছে জেলে, আরও খারাপের দিকে মোড় নিয়েছে। এখন আমার কয়েকটা কাজ করতে হবে। আমি লরার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যেতে চাই। শেষ একবার দেখে বিদায় জানাতে চাই মেয়েটাকে। ওর জিনিসপত্রগুলোরও একটা ব্যবস্থা করতে হবে। আর যদি আমাকে চাকরি দিতেই চান, তাহলে সেজন্য সপ্তাহে আমাকে দিতে হবে পাঁচশ ডলার।’ আন্দাজে একটা অঙ্ক বলল ও; কিন্তু সেটা শুনে ওয়েনসডের মনে কী প্রভাব পড়েছে, তা লোকটার চোখ দেখে বোঝা গেল না। ‘যদি ভবিষ্যতে একসাথে কাজ করে যাই, তাহলে ছয় মাস পর থেকে আমাকে আপনি সপ্তাহে এক হাজার ডলার করে দেবেন।’ 

এক নাগাড়ে এত কথা অনেকদিন পর বলল শ্যাডো। তবে পুরোপুরি শেষ করেনি এখনও। ‘আপনার কথা থেকে বুঝতে পারছি ‘দরকার হলে’ মানুষ পিটিয়ে হাত গন্ধ করতে হবে আমাকে। ঠিক আছে, আমার আপত্তি নেই। তবে একটা শর্তে, যারা যারা আপনার ক্ষতি করতে আসবে, কেবল তাদেরকেই বাধা দেব। শুধু শুধু মারামারিতে জড়িয়ে পড়ার মাঝে আমি নেই। দ্বিতীয়বার আর জেলে যেতে চাই না। ধরে নিন, আমি ন্যাড়া। আর জেলখানা আমার বেলতলা…একবারই যথেষ্ট। 

‘তোমাকে জেলে যেতে হবে না।’ বললেন ওয়েনসডে। 

‘হুম, আমি যাবও না।’ বলে মিডটুকু শেষ করে ফেলল ও। আচ্ছা, এই পানীয়টা ওর মুখ আলগা করার জন্য দায়ী না তো-ভাবল একবার। কিন্তু শব্দ এমনভাবে ওর মুখ থেকে বের হচ্ছে, যেমন পুরোপুরি খুলে দেওয়া কল থেকে পানি বের হয়। চাইলেও এখন আর থামতে পারবে বলে মনে হয় না। ‘আমি আপনাকে পছন্দ করি না, মি. ওয়েনসডে। এটা যে আপনার আসল নাম না, তা- ও আমি বুঝতে পেরেছি। আমরা বন্ধু নই। আপনি কীভাবে আমার অলক্ষ্যে ওই বিমান থেকে নেমেছেন, তা জানি না। আমার পিছু পিছু এখানে এসে উপস্থিত হলেন, কীভাবে তা-ও না। তবে একটা কথা বলে রাখি, আমাদের কাজ শেষ হওয়া মাত্র বিদেয় নেব। আপনি যদি আমাকে রাগান, তাহলে চলে যাবো আরও আগেই। তার আগপর্যন্ত, আপনার হয়ে কাজ করতে আমার আপত্তি নেই। 

‘মেনে নিলাম,’ বললেন ওয়েনসডে। ‘তাহলে এই সব শর্ত মেনেই চুক্তিবদ্ধ হলাম আমরা।’ 

‘ঠিক আছে,’ কিছুই যায়-আসে না-এমন ভঙ্গিতে শ্রাগ করল শ্যাডো। ওয়েনসডে হাতে থুথু দিয়ে এগিয়ে দিলেন ওর দিকে। নিজের হাতে থুথু দিল ও নিজেও। হাত মেলাল দুজন। ওয়েনসডে চাপ দিলেন প্রথমে, জবাবে চাপ দিল শ্যাডো। কিন্তু অল্পক্ষণের মাঝেই ব্যথা অনুভব করল সে হাতে। আরও কিছুক্ষণ ওভাবেই থেকে করমর্দন শেষ করলেন ওয়েনসডে। 

‘ভালো,’ বললেন তিনি। ‘খুব ভালো। আরেক গ্লাস করে ওই বাজে, বদখত আর বিচ্ছিরি মিড খেয়ে আমরা চুক্তি সম্পাদন করে ফেলি।’ 

‘আমার জন্য সাউদার্ন কমফোর্ট আর কোক।’ এতক্ষণ জুকবক্সে পয়সা ফেলছিল সুইনি, ফিরে এসে বলল। 

দ্য ভেলভেট আন্ডারগ্রাউন্ডের ‘হু লাভস দ্য সান’ গানটা বাজতে শুরু করল জুকবক্সে। অবাক হয়ে গেল শ্যাডো, এই গান জুকবক্সে! পরক্ষণেই ভাবল, আসলে পৃথিবীতে সবই সম্ভব। 

টস করার জন্য যে পয়সাটা ব্যবহার করেছিল, সেটা হাতে তুলে নিলো শ্যাডো। নতুন পয়সার স্পর্শ নেবার মজাই আলাদা, ভাবল ও। ডান হাতের তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলির মাঝখানে ধরে রাখল কিছুক্ষণ, এরপর এরপর ভান ধরল যেন ওটা বাঁ হাতে নিয়ে নিয়েছে। অথচ প্রকৃতপক্ষে ডান হাতেই আছে ওটা, লুকিয়ে ফেলেছে। এরপর বাঁ হাতে মুঠো করে ধরল কল্পিত পয়সাটা, আরেকটা নিলো ডান হাতে। ওটাকেও দুই আঙুলের ফাঁকে কিছুক্ষণ ধরে রেখে এমনভাব করল যে ফেলে দিচ্ছে বাঁ হাতে। ডান হাতে লুকিয়ে রাখা প্রথম পয়সাটাকে দিয়ে ধাক্কা দিল দ্বিতীয়টায়। উপস্থিত যে কেউ খেয়াল করলে ভাবত, দুটো পয়সাই এখন শ্যাডোর বাঁ হাতে। ধরতেই পারত না, আওয়াজ হওয়া মাত্র দ্বিতীয়টাকেও ডান হাতে লুকিয়ে ফেলেছে ও। 

‘পয়সার খেলা দেখাচ্ছ?’ জানতে চাইল সুইনি। ‘তাহলে আমার খেলা দেখো। 

খালি একটা পাত্র তুলে নিলো ও, এরপর বাতাসে হাত বাড়িয়ে কোত্থেকে যেন একটা বিশাল, উজ্জ্বল, সোনালি পয়সা নিয়ে এলো! পাত্রের ভেতর ফেলল ওটা, তারপরেই আবার হাত বাড়াল। আরেকটা সোনালি কয়েন নিয়ে ওটাও ফেলল তাতে, প্রথম সাথে লেগে ঝনঝনে আওয়াজ করল দুটো। এরপর একটা বের করল দেয়ালে ঝোলানো মোম থেকে, একটা নিজের দাড়ির ভেতর থেকে আর একটা শ্যাডোর বাঁ হাতের ভেতর থেকে। সবগুলোই জড়ো করল পাত্রের ভেতর। এরপর আঙুলগুলো দিয়ে পাত্রের মুখ ঢেকে জোরে ফুঁ দিল। 

কী আশ্চর্য! সাথে সাথে বৃষ্টির ফোঁটার মতো ঝরতে শুরু করল সোনালি পয়সা! পাত্র ভরতি হলে সবগুলো নিয়ে পকেটে পুরল সুইনি। এক সেকেন্ড পর যখন পকেট ওলটাল…তখন আর একটারও হদিস পাওয়া গেল না! 

‘একে বলে ভানুমতীর খেল।’ স্মিত হেসে বসল সে। 

খুব কাছ থেকে দেখেছে এতক্ষণ শ্যাডো। ‘আমার শেখা দরকার।’ 

‘কীভাবে করলাম শুনবে?’ যেন গোপন কথা বলছে, এমন ভঙ্গিমায় বলল সুইনি। ‘আয়াস আর জৌলুশের সাথে।’ হাসিতে ফেটে পড়ল বাচ্চা ছেলেদের মতো। 

‘তা…ভঙ্গিতে জৌলুশ ছিল বটে,’ মেনে নিলো শ্যাডো। ‘তবে আমি খেলাটার কথা বলছি। আমাকে শিখিয়ে দাও, বইতে পড়েছি এরকম একটা খেলা পয়সাগুলো পাত্র ধরা হাতে ধরে আছ তুমি, দরকারের সময় অন্য হাতে নিয়ে পাত্রে ফেলছ। কিন্তু করছটা কীভাবে, তা জানতে চাই।’ 

‘এত কষ্ট করার দরকার কী?’ পাগল সুইনি প্রশ্ন ছুড়ে দিল। ‘এরচেয়ে বাতাস থেকে পয়সা তুলে নেওয়াই তো সহজ!’ 

কথাবার্তায় বাধা পড়ল ওয়েনসডের আগমনে। ‘তোমার জন্য মিড, শ্যাডো। আমার জন্য জ্যাক ড্যানিয়েলস। আর মাগনা মদ-প্রেমী আইরিশের জন্য…?’ 

‘বিয়ার।’ বলল সুইনি। আমাকে মাগনা মদ-প্রেমী বললে?’ মদের গ্লাসটা তুলে ধরল ও, ওয়েনসডের পাত্রে ঠেকিয়ে টোস্ট করল। ‘ঝড় আমাদের উপর দিয়ে যেতে চাইলে যাক, কিন্তু আমাদের যেন ক্ষতি না করে।’ 

‘টোস্টটা তো ভালোই ছিল।’ ওয়েনসডে বললেন। কিন্তু কাজে আসবে বলে মনে হয় না।’ 

শ্যাডোর সামনে মিড এনে রাখা হলো। ‘খেতেই হবে?’ 

‘তা হবে, এছাড়া আমাদের চুক্তি সম্পূর্ণ হবে না।’ 

‘ধুরো,’ বলল বটে, কিন্তু দুই চুমুকে তরলটুকু শেষ করে ফেলল ও।

‘এবার,’ মন্তব্য করলেন ওয়েনসডে। তুমি আমার কর্মচারী হলে।’

‘খেলাটা শিখতে চাও?’ আচমকা প্রশ্ন করে বসল সুইনি। 

‘হ্যাঁ।’ শ্যাডোর উত্তর। ‘হাতায় রেখেছিলে পয়সাগুলো?’ 

‘না। আসলে এই খেলাটা দুনিয়ার সবচেয়ে সোজা খেলার একটা। তবে শিখতে হলে আমার সাথে মারামারি করতে হবে।’ 

‘থাক বাবা,’ মাথা নাড়ল শ্যাডো। ‘দরকার নেই।’ 

‘কী আজব!’ ঘরের অন্যান্যদের দিকে তাকিয়ে বলল সুইনি। ‘বুড়ো ওয়েনসডে দেহরক্ষী একটা ভাড়া করেছে বটে! মারামারি করার কথা চিন্তা করেই যার হাঁটু কাঁপে!’ 

‘যত যাই বলো, আমি মারপিটের মাঝে নেই।’ 

দুলছে আর ঘামছে সুইনি। মাথার বেসবল ক্যাপটা ঠিক করে নিলো। এরপর আচমকা বাতাস থেকে একটা পয়সা বের করে এনে রেখে দিল টেবিলের উপর। ‘খাঁটি সোনা,’ বলল সে। ‘আমার সাথে মারামারি করলেই হবে। হার হোক বা জিত, জিনিসটা তোমার। দামড়া একটা শরীর বানিয়েছে, কিন্তু স্বভাবে দেখি একদম কাপুরুষ।’ 

‘ছেলেটা তো বললই যে তোমার সাথে লড়বে না।’ বললেন ওয়েনসড়ে। ‘এখন বিয়ার খেয়ে নিয়ে ভাগো।’ 

ওয়েনসডের দিকে এক পা এগিয়ে এলো সুইনি। ‘আমাকে গালি দিয়ে আবার আদেশ চালানো হচ্ছে? শালা, বুড়ো হাবড়া, হৃদয়হীন পাষণ্ড।’ রাগে লাল হয়ে আছে আইরিশ লোকটার চেহারা। 

শান্ত করার ভঙ্গিমায় হাত তুললেন ওয়েনসডে। ‘বোকার মতো কথা বোলো না, সুইনি।’ 

চোখ লাল করে তার দিকে তাকাল পাগলা। মাতালের মতো বলল, ‘ভাড়া করেছ এক কাপুরুষকে। এখন যদি আমি তোমার কিছু করি, ওই শালা ভণ্ড রুখতে পারবে?’ 

শ্যাডোর দিকে ফিরলেন ওয়েনসডে। ‘যথেষ্ট হয়েছে, একে সামলাও।’ 

উঠে দাঁড়িয়ে পাগলা সুইনির চোখে চোখ রাখল শ্যাডো, অন্তত রাখার চেষ্টা করল। আইরিশ লোকটা আসলেই অনেক লম্বা। ‘আমাদেরকে বিরক্ত করছে কেন? মাতাল হয়ে গেছ, এবার বিদায় নাও।’ 

আস্তে আস্তে এক টুকরা হাসি সুইনির চেহারায় জায়গা করে নিলো। ‘এটাই তো চাই।’ বলেই ঘুসি ছুঁড়ল শ্যাডোকে লক্ষ্য করে। চাবুকের মতো পিছিয়ে এলো শ্যাডোর মাথা, আঘাতটা ওর ডান চোখের নিচে লেগেছে। ব্যথায় কুঁচকে উঠল যুবকের চেহারা। 

তারপরই শুরু হলো হাতাহাতি। 

মারামারির কায়দাকানুন লোকটার জানা আছে বলে মনে হলো না শ্যাডোর, অবশ্য তাতে তার কিছু যায় আসে বলেও মনে হলো না। লোকটা লড়ছে কেবল লড়ার আনন্দে। ঘুসি ছুঁড়ছে একের-পর-এক, সেগুলো লক্ষ্যে আঘাত হানছে কি না-সেদিকে একদমই ভ্রুক্ষেপ নেই। 

শ্যাডো লড়ছে সাবধানতার সাথে, সুইনির আঘাতগুলো হয় ঠেকাচ্ছে আর নয়তো এড়িয়ে যাচ্ছে। চারপাশের সবাই যে আগ্রহ নিয়ে দেখছে লড়াই, তা টের পাচ্ছে ও। টেবিল সরিয়ে ওদেরকে লড়ার মতো জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি নিজের উপর ওয়েনসডের তীক্ষ্ণ নজরও টের পাচ্ছে সে। ওর যে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই শ্যাডোর। 

কিন্তু সেই পরীক্ষা প্রশ্নগুলো কী? 

জেলে থাকতে শ্যাডো শিখেছে: লড়াই আসলে দুই ধরনের। একটা বোঝায়, আমায় ঘাঁটিয়ো না। এই ধরনের লড়াইতে দেখাতে হয় দক্ষতা আর নৃশংসতা। আরেকটা হচ্ছে প্রকৃত লড়াই, যেটা শেষ হয়ে যায় কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই। 

‘এই, সুইনি।’ শ্বাস টানতে টানতে বলল শ্যাডো। ‘আমরা লড়ছি কেন?’

‘লড়াইয়ের আনন্দ পাবার জন্য।’ মাতলামি যেন কেটে গেছে লম্বা লোকটার। ‘লড়াইয়ের অশুভ মজা লোটার জন্য। কেন, নিজের মাঝে সেই আনন্দ উপলব্ধি করতে পারছ না?’ লোকটার নিচের ঠোঁট থেকে রক্ত ঝরছে…ঝরছে শ্যাডোর মুষ্টি থেকেও! 

‘পয়সাগুলা রেখেছিলে কোথায়?’ মুখ বরাবর আসা একটা ঘুসি কাঁধে নিয়ে জানতে চাইল শ্যাডো। 

‘সে তো আগেই বলছি!’ ঘোঁত করে উঠল সুইনি। ‘কিন্তু যে কান থাকা সত্ত্বেও না শোনার সিদ্ধান্ত নেয়, তার মতো অন্ধ আর কেউ নেই। আউ!’ 

সুইনির দিকে একটা জ্যাব ছুঁড়ল শ্যাডো, পেছাতে গিয়ে লোকটা বাড়ি খেল একটা টেবিলের সাথে। খালি গ্লাস আর অ্যাশট্রে আছড়ে পড়ল মাটিতে। শ্যাডো চাইলে লড়াই তখনই শেষ করে ফেলতে পারত। 

ওয়েনসডের দিকে তাকাল ও, মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক। এবার পাগলা সুইনির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘খায়েশ মিটেছে?’ একটু ইতস্তত করে মাথা নাড়ল সুইনি। কয়েক পা পিছিয়ে এলো ও, এদিকে সুইনিও হাচরেপাচরে উঠে দাঁড়িয়েছে। 

‘লড়াইয়ের খায়েশ কি লড়াকুর মেটে!’ চিৎকার করে বলল আইরিশ লোকটা। মুচকি হেসে আবার ঘুসি হাঁকাল শ্যাডোকে উদ্দেশ্য করে। কিন্তু মন্দ ভাগ্য বেচারার, এক টুকরা বরফে পা দিয়ে বসেছে। হাসি উধাও হয়ে গেল নিমিষেই, আছড়ে পড়ল ও। মাথার পেছন দিকটা ঠক করে বাড়ি খেল মেঝের সাথে। 

সুযোগ বুঝে লোকটার বুকে হাঁটু ঠেকিয়ে বসে পড়ল শ্যাডো। ‘আবার জিজ্ঞেস করছি, খায়েশ মিটেছে?’ 

‘না মিটে উপায় কী?’ মাথা তুলে বলল সুইনি। ‘এখন আর লড়ে আনন্দ পাচ্ছি না।’ থুথু ফেলল ও, সাথে রক্তও বেরিয়ে এলো। এক মুহূর্ত পরেই দেখে গেল, মেঝেতে শুয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে লোকটা! 

শ্যাডো কতক্ষণ ওভাবে ছিল, বলতে পারবে না। আচমকা পিঠে আলতো চাপড় টের পেয়ে ঘুরে তাকাল। ওয়েনসডে ওর হাতে একটা বিয়ারের বোতল ধরিয়ে দিলেন। 

মিডের তুলনায় হাজার গুণে ভালো! 

.

ঘুম থেকে উঠে শ্যাডো দেখল, একটা সেডানের পেছনের সিটে শুয়ে আছে ও। সকালের সূর্যটা গরম হয়ে উঠতে শুরু করেছে, মাথাও ফেটে পড়বে যেন। অদ্ভুত ভঙ্গিমায় উঠে বসল সে, হাত দিয়ে চোখ ঘষছে। 

ওয়েনসডে গাড়ি চালাচ্ছেন, সেই সাথে গানও গাইছেন গুনগুন করে। গাড়ির কাপ হোল্ডারে কফির কাপ শোভা পাচ্ছে, হাইওয়ে ধরে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। মি. ওয়েনসডের পাশের সিটটা খালি। 

‘এই সুন্দর সকালে, কেমন বোধ করছ?’ মাথা না ঘুরিয়েই জানতে চাইলেন তিনি। 

‘আমার গাড়ির কী হলো?’ শ্যাডো জানতে চাইল। ‘ভাড়া নিয়েছিলাম ওটা।’

‘পাগলা সুইনি নিয়ে গেছে, ফিরিয়ে দিবে। লড়াইয়ের পর তোমরা এই চুক্তিই করেছিলে।’ 

মনে পড়ছে না শ্যাডোর, তবে খুব একটা মাথা ঘামাল না। ‘কফি আছে আর?’ হাত নামিয়ে একটা পানির বোতল বের করে আনলেন ভদ্রলোক। ‘এই নাও, পানিস্বল্পতা ঠিক হয়ে যাবে। কফির চেয়ে এখন এটাই বেশি দরকার তোমার। সামনের গ্যাস স্টেশনে থেমে নাস্তা কিনে দেব তোমাকে। একটু পরিষ্কারও হয়ে নিতে পারবে। দেখে তো মনে হচ্ছে ছাগলের খোঁয়াড়ে রাত কাটিয়েছ!’ 

‘তাই নাকি?’ 

‘হ্যাঁ। তা-ও দুর্গন্ধ ভরা খোঁয়াড়ে।’ 

বোতল খুলে গলায় পানি ঢালল শ্যাডো। আচমকা জ্যাকেটের পকেট থেকে ভেসে এলো একটা ঝনঝন আওয়াজ! অবাক হয়ে পকেটে হাত ঢোকাল ও, বের করে আনল হাফ ডলার আকারের একটা ভারী, হলদে পয়সা। একটু আঠাল মনে হলো ওটাকে। কিছুক্ষণ দেখে আবার পকেটে রেখে দিল পয়সা। 

‘কালকে কী খাচ্ছিলাম আমি?’ জানতে চাইল শ্যাডো। গতরাতের ঘটনাগুলো আস্তে আস্তে মনে পড়তে শুরু করেছে ওর। 

হাইওয়ে থেকে বেরিয়ে যাবার একটা রাস্তা দেখতে পেয়ে ওদিকেই গাড়ি চালালেন ওয়েনসডে। ‘মনে নেই?’ 

‘না।’ 

‘মিড, মিড গিলছিলে।’ মুখে ইয়া বড়ো এক হাসি এনে বললেন ভদ্রলোক। ওহ, হ্যাঁ। মিড! 

গলায় পানি ঠেলে পেছনের সিটে হেলান দিয়ে বসল শ্যাডো। স্মৃতিতে গতরাতের ঘটনাগুলো আনাগোনা শুরু করেছে। চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল সে। কিছু ঘটনা মনে পড়ল, কিছু পড়ল না। 

.

গ্যাস স্টেশনে প্রথমেই ক্লিন-ইউ-আপ কিট কিনল শ্যাডো। ওতে আছে একটা রেজর, শেভিং ক্রিম, চিরুনি, ছোটো টিউব ভরতি টুথপেস্ট আর একটা টুথব্রাশ। ছেলেদের রেস্টরুমে চলে গেল সে ওটা নিয়ে, আয়নায় নিজেকে দেখল। 

এক চোখের নিয়ে কালো হয়ে গেছে, স্পর্শ করা মাত্র চিলিক দিয়ে উঠছে। নিচের ঠোঁটটাও ফুলে গেছে অনেক। 

রেস্ট রুমের তরল সাবান ব্যবহার করে মুখ ধুলো শ্যাডো, এরপর ফোম লাগিয়ে পরিষ্কার করল গাল। চুল ভিজিয়ে চুলে চিরুনি বুলিয়ে নিলো একবার। নাহ, এখনও রুক্ষ দেখাচ্ছে ওকে। 

লরা এই অবস্থায় ওকে দেখলে কী মনে করবে? ভাবল একবার। আচমকা মনে পড়ল, লরা আর কখনওই ওকে কিছু বলবে না। আয়নায় আরেকবার নিজের চেহারা দেখল সে, কেঁপে উঠল একটু। 

পরক্ষণেই ওয়েনসডের কাছে চলে এলো ও। 

‘দেখে তো একদম বাজে লাগছে।’ বলল শ্যাডো। 

‘তা লাগছে।’ একমত হলেন ওয়েনসডে। 

ক্যাশ রেজিস্টার থেকে অনেকগুলো হালকা খাবার তুলে নিলেন তিনি, সব কিছুর দাম চুকিয়ে দিলেন গুণে গুণে। তবে টাকা দিয়ে দিবেন, নাকি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে-সেটা ঠিক করতে কষ্ট হলো তার। এদিকে টাকা বুঝে নেবার জন্য অপেক্ষমাণ কমবয়সি মেয়েটার বিরক্তি বেড়েই চলছে। ওয়েনসডের এই আচরণের সাথে পরিচিত নয় শ্যাডো, লজ্জা আর অনুতাপে যেন ভেঙে পড়বেন তিনি। বড়ো বেশি বয়স্ক মনে হচ্ছে তাকে, একবার কার্ড বাড়িয়ে দিচ্ছেন তো আরেকবার নগদ নোট। মেয়েটা তাকে টাকা ফেরত দিয়ে বিলটা কার্ডে চার্জ করল, তারপর কার্ডের রিসিট দিয়ে ওয়েনসডের হাত থেকে টাকা নিলো! এরপর আবার টাকাটা ফেরত দিয়ে তুলে নিলো আরেকটা কার্ড। 

কাজ শেষ করে গ্যাস স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে রাস্তায় নামলেন তারা, দুই পাশের ঘাসগুলো বাদামি রং ধারণ করেছে। গাছের পাতাগুলো ঝরে গেছে অনেক আগেই। কালো দুটো পাখিকে টেলিগ্রাফের তারের উপর বসে থাকতে দেখল শ্যাডো। 

‘আচ্ছা, মি. ওয়েনসডে?’ 

‘কী?’ 

‘আমি যেটা বুঝলাম, ভেতরে তো আপনাকে একটা টাকাও শেষ পর্যন্ত দিতে হলো না!’ 

‘তাই?’ 

‘হুম, আপনার কি মনে হয়, মেয়েটা এই শুভঙ্করের ফাঁকি ধরতে পেরেছে? ‘নাহ, কখনও পারবেও না।’ 

‘তাহলে আপনার পেশাটা কী, বলুন তো? ধান্ধাবাজি?’ 

মাথা দোলালেন ওয়েনসডে। ‘হ্যাঁ,’ বললেন তিনি। ‘তা বলতে পারো।’

একটা ট্রাক পেছনে ফেলার জন্য গাড়িটাকে বাঁ লেনে নিয়ে এলেন তিনি, মাথার ওপরের আকাশটা যেন আজ ধূসর রঙে সেজেছে। 

‘তুষারপাত হবে,’ মন্তব্য করল শ্যাডো। 

‘হ্যাঁ।’ 

‘সুইনি কি আমাকে সত্যি সত্যি সোনার পয়সা ব্যবহার করে খেলা দেখিয়েছে?’

‘কোনো সন্দেহ নেই।’

‘আমার মনে পড়ছে না।’ 

লম্বা একটা রাত কাটিয়েছ গতকাল। সময় দাও, মনে পড়ে যাবে।’ 

পেঁজা তুলোর মতো তুষার এসে পড়ছে গাড়ির উইন্ডশিল্ডে, গলেও যাচ্ছে দেরি না করেই। 

‘তোমার স্ত্রীর মৃতদেহের জন্য শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছে ওয়েনডেলের ফিউনারেল পার্লারে।’ বললেন ওয়েনসড়ে। ‘লাঞ্চের পর ওখান থেকে গোরস্তানে নিয়ে যাওয়া হবে।’ 

‘আপনি এসব জানেন কী করে?’ 

‘তুমি খালি হচ্ছিলে যখন, তখন ফোন করে জেনে নিয়েছি। ওয়েনডেলের পার্লারটা কোথায়, জানো তো?’ 

মাথা করল শ্যাডো, তুষারগুলো বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। ‘ওই রাস্তায় নামতে হবে।’ দেখিয়ে দিল ও। গাড়িটা হাইওয়ে থেকে নেমে, ইগল’স পয়েন্টের রাস্তায় উঠল। 

তিন বছর পার হয়ে গেছে। ভাবা যায়! অপরিচিত দোকান, আগে না দেখা ট্রাফিক লাইট-এসবই নজরে পড়ল ওর। জিমের পাশ দিয়ে যাবার সময় গাড়িটার গতি একটু কমাতে বলল সে ওয়েনসডেকে। ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ’ লেখা সাইনবোর্ড ঝুলছে সামনে। 

প্রধান রাস্তা থেকে বাঁয়ে উঠে দেখতে পেল একটা নতুন ট্যাটু পার্লার। এরপর বিমান বাহিনীর নিয়োগ কেন্দ্র পার হয়ে বার্গার কিং, ওলসেনের ওষুধের দোকানটা এখনও তেমনি আছে। ওটা পার হলেই ওয়েনডেলের পার্লারের সেই চিরচেনা হলদে ইটের দালান। অবশ্য এখন ওপরে একটা নিয়ন সাইন ঝুলছে: শেষ যাত্রার আগের বিশ্রাম কেন্দ্র। একদম ফাঁকা কয়েকটা ফলক দেখা যাচ্ছে ওই সাইনের নিচেই অবস্থিত জানালার ফাঁক দিয়ে। 

পার্কিং লটে গাড়ি ঢোকালেন ওয়েনসডে। ‘আমি আসব সাথে?’ 

‘দরকার নেই।’ 

‘ভালো,’ প্রাণহীন হাসিটা দেখা গেল আবার। ‘তুমি তোমার কাজ সারো, আমি আমার কাজ সারি। যাই হোক, মোটেল আমেরিকায় ঘর ভাড়া করে রাখব। এখান থেকে সরাসরি ওখানেই চলে এসো।’ 

গাড়ি থেকে নেমে পড়ল শ্যাডো, ওটা চোখের আড়াল হলে প্রবেশ করল পার্লারে। হালকা আলোয় অন্ধকার পুরোপুরি দূর হয়নি, ফুল আর বার্নিশের গন্ধ ভেসে আসছে। সেই সাথে সম্ভবত একটু ফরমালডিহাইডেরও। করিডরের একদম শেষ মাথায় থাকার কথা লরার কফিন। 

আচমকা শ্যাডো টের পেল, সোনার পয়সাটা মুঠ করে ধরে আছে ও। যেন ওটার ওজন স্বস্তি দিচ্ছে ওকে। পয়সার খেলা অনুশীলন করতে করতে এগোল সে। 

একদম ওপাশের দরজার পাশে সাঁটিয়ে রাখা কাগজটার একেবারে শেষে লরার নাম। দরজা দিয়ে প্রবেশ করল ও। উপস্থিত প্রায় সবাই পরিচিত-লরার সহকর্মী, তার বন্ধু-বান্ধব। 

ওদের কাছেও শ্যাডো পরিচিত একজন। থম মেরে বসে রইল সবাই। কারও মুখে হাসি নেই, এমনকি সম্ভাষণও জানাল না কেউ। 

ঘরের এক মাথায় একটা ছোট্ট মঞ্চ, ওতে শোভা পাচ্ছে সর-রঙা একটা কফিন। ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে ওটাকে। এক পা সামনে এগোল শ্যাডো। লরার দেহটা এখান থেকেই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আর এগোবার সাহস হচ্ছে না ওর, আবার পিছিয়েও যেতে পারছে না। 

কালো স্যুট পরা এক লোক এগিয়ে এলো ওর দিকে, সম্ভবত এখানকার কর্মচারী। চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা একটা বই দেখিয়ে বলল, ‘স্যার, আপনি কি বইতে সান্ত্বনা বাণী বা কোনো স্মৃতিচারণা লিখে রাখতে চান?’ 

কেবল শ্যাডো আর আজকের তারিখটা পরিষ্কার অক্ষরে লিখল ও। লিখবে না লিখবে না করেও তার পাশে লিখল-(পাপি)। কফিনের কাছে যেতে ইচ্ছে করছে না। ওখানে যে দেহটা শুয়ে আছে সেটা আর যাই হোক, এখন আর লরা নেই! 

ছোটোখাটো এক মহিলা দরজা দিয়ে প্রবেশ করল, ইতস্তত ভাবটা পরিষ্কার। মহিলার চুল লালচে, পোশাক কালো হলেও খুব দামি। বিধবার পোশাক, ভাবল শ্যাডো। মহিলাকেও ভালোভাবেই চেনে ও। অড্রি বার্টন, রবির স্ত্রী। হাতে ভায়োলেট ফুলের তোড়া ধরে আছে মেয়েটা। লরার কফিনের দিকে এগিয়ে গেল সে, পিছু পিছু শ্যাডোও। 

চোখ বন্ধ করে কফিনে শুয়ে আছে ওর স্ত্রী, বুকের উপর বেঁধে রাখা হাত। পরনের নীল স্যুটটা চিনতে পারল না শ্যাডো। বাদামি চুলগুলো লম্বা। এই ওর লরা…আবার এই লরা ওর নয়। শান্ত ভঙ্গিতে শুয়ে থাকাটা আসলে মেয়েটাকে মানাচ্ছে না, ভাবল শ্যাডো। লরা কখনওই এত আরাম করে ঘুমায় না। 

ভায়োলেটের তোড়াটা লরার বুকের ওপরে রাখল অড্রি। এরপর…একদম আচমকা…মুখ ভরতি থুথু ছিটিয়ে দিল মেয়েটার মৃত চেহারায়! 

আর দাঁড়াল না সে, রওনা দিল দরজার দিকে। তাড়াতাড়ি পিছু নিলো শ্যাডো।

‘অড্রি?’ বলল ও, কণ্ঠে প্ৰশ্ন। 

‘শ্যাডো? জেল পালিয়েছ? নাকি তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে?’ 

মেয়েটার কণ্ঠ কেমন যেন দূরের বলে মনে হলো শ্যাডোর। ঘুমের ওষুধ খেয়ে এসেছে নাকি? 

‘গতকাল ছেড়েছে, আমি এখন মুক্ত।’ উত্তর দিল শ্যাডো। ‘কিন্তু তুমি এটা কী করলে?’ 

আধো অন্ধকার করিডরে পা রাখল অড্রি। ‘কেন, ভায়োলেট যে ওর পছন্দের ফুল ছিল, জানো না?’ 

‘ফুলের কথা বলছি না।’

‘ওহ, ওটা!’ অদৃশ্য কিছু একটা মুখ থেকে মুছতে মুছতে বলল ও। ওটার ব্যাখ্যা লাগবে বলে তো মনে হয় না।’ 

‘আমার লাগবে, অড্রি।’ 

‘শোননি তাহলে?’ শান্ত, অনুভূতিহীন কণ্ঠে বলল মেয়েটা। ‘মৃত্যুর সময় আমার স্বামীকে মুখ-মেহন করে দিচ্ছিল তোমার স্ত্রী।’ 

কথা না বাড়িয়ে ঘরে ফিরে গেল শ্যাডো। 

কেউ একজন থুথুটুকু লরার চেহারা থেকে মুছে ফেলেছে। 

.

বার্গার কিং-এ দুপুরের খাবারটা খেয়ে নিলো শ্যাডো। এখন লাশ কবর দেওয়া হবে। লরার কফিনটাকে এরইমাঝে গোরস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। 

এখানে ও এসেছে ওয়েনডেলের শবযানে চড়ে, সাথে ছিল লরার মা। মিসেস ম্যাকক্যাব মোটামুটি নিশ্চিত যে তার মেয়ের মৃত্যুর জন্য শ্যাডোই দায়ী। ‘তুমি যদি এখানে থাকতে,’ বললেন তিনি। ‘তাহলে এসব ঘটত না। আসলে আমি এখনও বুঝে উঠতে পারিনি যে আমার মেয়েটা তোমাকে বিয়ে করল কেন? আমি নিষেধ করেছিলাম ওকে। একবার না, বারবার। কিন্তু আজকাল কি আর কেউ মায়ের কথা শোনে!’ একটুখানি চুপ হয়ে শ্যাডোর চেহারার দিকে তাকালেন তিনি। ‘মারামারি করেছ নাকি?’ 

‘জি।’ বলল শ্যাডো। 

‘অসভ্য কোথাকার।’ বলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন তিনি। থুতনিটা রাগে কাঁপছে। 

শ্যাডোকে অবাক করে দিয়ে শেষকৃত্যানুষ্ঠানেও উপস্থিত হলো অড্রি বার্টন, তবে দাঁড়াল সবার পেছনে। যাজকের বক্তব্য শেষ হবার পর, ঠান্ডা মাটিতে শুইয়ে রাখা হলো কফিনটাকে। কিছুক্ষণের মাঝেই বিদায় নিলো সবাই। 

শ্যাডো কিন্তু গেল না। পকেটে হাত ঢুকিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ওখানেই। 

মাথার উপর আকাশ এখন ধূসর বর্ণ ধারণ করেছে, তুষারপাত হচ্ছে এখনও। লরাকে কিছু একটা বলতে চায় ও, তাই কথাগুলো মুখে আসার আগপর্যন্ত অপেক্ষা করতে আপত্তি নেই। আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে আলো। শ্যাডোর মনে হচ্ছে, পাজোড়া যেন জমে যাচ্ছে। ঠান্ডায় ব্যথা করতে শুরু করেছে হাত আর চেহারা। পকেটে হাত ঢুকিয়ে রেখেও খুব একটা লাভ হচ্ছে না, পয়সাটার স্পর্শ পেয়ে ওটাকে আঁকড়ে ধরল ও। 

এগিয়ে গেল কবরের দিকে। 

‘এটা তোমার জন্য।’ বলল ও। 

অল্প কিছু মাটি ফেলা হয়েছে কফিনে, কিন্তু গর্তটা পুরো হতে এখনও অনেক বাকি। সোনার পয়সাটা লরার কবরে ছুড়ে দিল শ্যাডো। ওটা যেন অন্য কারও নজরে না পড়ে, তাই আরও কিছুটা মাটি ফেলল। হাত থেকে মাটি মুছে বলল, ‘শুভ রাত্রি, লরা।’ কিছুক্ষণ নীরব থেকে যোগ করল, ‘আমাকে মাফ করে দিয়ো।’ তারপর ইগল’স পয়েন্টের দিকে হাঁটতে শুরু করল ও। 

মোটেলটা কম করে হলেও দুই মাইল দূরে হবে। তবে তিন বছর জেলে থাকার পর, চাইলে বছরের পর বছর ধরে হাঁটতেও আপত্তি নেই ওর। দক্ষিণে হাঁটতে থাকলে কেমন হয়? আলাস্কায় গিয়ে নাহয় থামবে? অথবা উত্তরে, মেক্সিকোতে? চাইকি পাতাগোনিয়া বা টিয়েরা ডেল ফুয়েগোতেও চলে যাওয়া যায়! 

হঠাৎ একটা গাড়ি এসে থামল ওর পাশে, নেমে এলো জানালার কাচ।

‘লিফট লাগবে, শ্যাডো?’ জানতে চাইল অড্রি বার্টন। 

‘না,’ উত্তর দিল ও। ‘তোমার কাছ থেকে তো একদম না।’ হাঁটা শুরু করল আবার। 

ঘণ্টায় তিন মাইল বেগে গাড়ি চালিয়ে ওর পাশেই রইল অড্রি, হেডলাইটের আলোয় মনে হচ্ছে যেন তুষারগুলো নাচছে! 

‘আমি ভেবেছিলাম, লরা আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু।’ বলল অড্রি। ‘প্রত্যেকদিন আমাদের কথা হতো, জানো? রবির সাথে আমার ঝগড়া হলে, সেটাও ওকেই বলতাম সবার আগে। অথচ তখনও আমার স্বামীকে নিয়ে…আমারই পিঠে ছোরা মেরে…আমারই সবচেয়ে কাছের বন্ধু তখন তার বিছানা গরম করছিল!’ 

‘যাও তো, অড্রি।’ 

‘আমি চাই তুমি বোঝ, যা করেছি, তার কারণ ছিল বলেই করেছি।’ 

চুপ করে রইল শ্যাডো। 

‘ওই!’ চিৎকার করল মেয়েটা। ‘ওই, আমি তোমার সাথে কথা বলছি!’ 

ঘুরে তাকাল শ্যাডো। ‘কী শুনতে চাও আমার মুখ থেকে? লরার মুখে থুথু দিয়ে ভালো করেছ, তাই শুনতে চাও? নাকি শুনতে চাও, তোমার এই কথা শুনে আমি এখন লরাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছি? আমি এর কোনোটাই বলব না, অড্রি 

আরেক মিনিট পাশে পাশে চলল মেয়েটা, বলল না কিছুই। তারপর জানতে চাইল, ‘জেল কেমন, শ্যাডো?’ 

‘ভালোই,’ বলল শ্যাডো। ‘তোমার থাকতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হতো না, একদম বাড়ির মতোই বোধ করতে।’ 

অ্যাক্সিলেটরে যেন উঠে বসল মেয়েটা, গর্জে উঠল গাড়ির ইঞ্জিন। 

হেডলাইটটাও দৃষ্টির অলক্ষ্যে চলে গেলে, অন্ধকার হয়ে এলো দুনিয়া। গোধূলিকে হটিয়ে দিয়ে রাত নেমেছে। শ্যাডো ভেবেছিল, হাঁটলে শরীর গরম হবে। কিন্তু না, তা হলো না। 

জেলেও ছিল একটা গোরস্তান। লো কি লেস্মিথ ওটার নাম দিয়েছিল ‘হাড্ডির বাগান’। শব্দ দুটো এখনও খেলে যাচ্ছে শ্যাডোর মনে। যেদিন প্রথম শুনেছিল ও দুটো শব্দ, সেদিন রাতে স্বপ্ন দেখেছিল সে। দেখেছিল চাঁদের আলোয় একটা বাগানের মাঝ দিয়ে হাঁটছে; দুপাশে হাড়ের গাছ, ডালগুলোও হাড়ের। গাছটার শেকড় চলে গেছে কবরের ভেতরে। ওই গাছগুলোতে ফলও ধরেছে। অশুভ কিছু একটা যেন জড়িয়ে আছে ফলগুলোর সাথে। কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা মনে পড়ছে না। 

একের-পর-এর গাড়ি চলে যাচ্ছে ওর পাশ দিয়ে, ফুটপাত থাকলে মন্দ হতো না। অন্ধকারে দেখতে না পেয়ে হোঁচট খেল শ্যাডো। তাল সামলাতে না পেরে পড়েই গেল রাস্তার ধারে; ডান হাতটা নরম, ঠান্ডা কাদায় কয়েক ইঞ্চি ডুবে গেল যেন। উঠে দাঁড়িয়ে হাত মুছল ও প্যান্টের সাথে। আচমকা…কিছু বুঝে ওঠার আগেই, নরম কিছু একটা ঢেকে দিল নাক-মুখ। 

এবার নরম কাদাটাকে বেশ উষ্ণ মনে হলো ওর। 

.

শ্যাডোর মনে হচ্ছে: কপালটাকে কেউ মাথার সাথে পেরেক ঠুকে গেঁথে দিয়েছে! হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা। একটা গাড়িতে বসে আছে ও, সিটগুলো চামড়ায় মোড়ানো। প্রথমে মনে হলো, চোখ ভুল দেখছে। পরক্ষণেই বুঝতে পারল যে না, ওপাশের সিটটা আসলেও অতোটাই দূরে! 

ওর দুপাশে মানুষ বসে আছে, কিন্তু সেদিকে তাকাবার সাহস পেল না। 

অনেক দূরের ওপাশের সিটে বসে আছে এক মোটা তরুণ। ডায়েট কোকের একটা ক্যান হাতে নিলো তরুণটি; পরনে লম্বা, কালো কোট-রেশম দিয়ে বানানো বলে মনে হচ্ছে। বয়স বিশ-একুশের বেশি হবে না কোনোমতেই। এক পাশের গাল ভরে আছে ব্রনে। শ্যাডোকে জেগে উঠতে দেখে হাসল সে। 

‘হ্যালো, শ্যাডো।’ বলল ছেলেটা। ‘আমার সাথে গোলমাল করো না।’

‘আচ্ছা,’ উত্তরে বলল শ্যাডো। ‘করলাম না। এবার আমাকে মোটেল আমেরিকায় নামিয়ে দাও।’ 

‘ওকে একটা থাবড়া দাও তো।’ শ্যাডোর বাঁ পাশে বসা লোকটাকে নির্দেশ দিল ছেলেটা। সোলার প্লেক্সাসে ঘুসি খেয়ে দম হারিয়ে ফেলল শ্যাডো। সোজা হয়ে বসতে বেশ খানিকক্ষণ সময় লাগল ওর। 

‘বললাম গোলমাল করো না, আর শুরুতেই করে বসলে? সংক্ষেপে উত্তর দেবে, সঠিক উত্তরটাই কেবল শুনতে চাই। নইলে আমি তোমাকে খুন করব। অবশ্য না-ও করতে পারি। তোমার দেহের দুইশ ছয়টা হাড়ের প্রতিটা এক-এক করে ভাঙলেও ভাঙতে পারি। তাই আবারও বলছি, আমার সাথে গোলমাল করো না। 

‘বুঝতে পারলাম।’ বলল শ্যাডো। 

লিমোর সিলিঙে থাকা লাইটটা রং পরিবর্তন করছে-বেগুনি-নীল-সবুজ-হলুদ।

‘তুমি ওয়েনসডের হয়ে কাজ করছ?’ বলল ছেলেটা। 

‘হ্যাঁ।’ শ্যাডো। 

‘কী চায় ও? মানে এখানে কী করছে? কোনো-না-কোনো পরিকল্পনা আছে নিশ্চয়। কী সেটা?’ 

‘আমি আজ সকালেই মি. ওয়েনসডের সাথে কাজ করা শুরু করছি।’ বলল শ্যাডো। ‘ফাই-ফরমাশ খাটি।’ 

‘মানে বলতে চাচ্ছ, তুমি জানো না?’ 

‘আমি বলতে চাচ্ছি-আমি জানি না।’ 

জ্যাকেট থেকে একটা রুপালি সিগারেট কেস বের করে আনল ছেলেটা। শ্যাডোর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘নেবে? 

একবার ভাবল, এই সুযোগে হাতের বাঁধন খোলানো যাবে। কিন্তু মত পালটাল ও। ‘নাহ, ধন্যবাদ। 

ছেলেটা হাতেই বানাল সিগারেট। এরপর যখন একটা কালো জিপ্পো লাইটার দিয়ে আগুন ধরাল, তখন কেমন যেন বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ পোড়ার গন্ধ ছেয়ে গেল গাড়িতে। 

লম্বা একটা টান দিল ছেলেটা, এরপর দম বন্ধ করে রইল। মুখের দুপাশ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল একটু, আবার সাথে সাথেই সেটা টেনে নিলো নাক দিয়ে। শ্যাডোর সন্দেহ হলো, এই কাজটা জনসম্মুখে করার আগে বহুবার আয়নার সামনে অনুশীলন করেছে সে। ‘আমাকে যদি মিথ্যা বলো,’ বলল ছেলেটা। ‘তাহলে একেবারে খুন করে ফেলব। এতক্ষণে নিশ্চয়ই তা বুঝতে পেরেছ?’ 

‘হ্যাঁ। তুমি বলেছ আগে।’ 

সিগারেটে আরেকটা লম্বা টানের পর ছেলেটা বলল, ‘মোটেল আমেরিকা বললে না?’ এরপর ড্রাইভারের জানালায় টোকা দিল। ‘মোটেল আমেরিকায় চলো। আমাদের অতিথিকে নামিয়ে দিতে হবে।’ 

লিমোর ভেতরের আলো ক্ষণে ক্ষণে রং পরিবর্তন করে চলছে। শ্যাডোর মনে হলো, ছেলেটার চোখও যেন জ্বলজ্বল করছে। অতি প্রাচীন কোনো কম্পিউটারের মনিটর যেমন জ্বলজ্বল করে, তেমনি সবুজাভ। 

‘তুমি ওয়েনসডেকে বলবে-সে এখন এক সেরেফ অতীতের স্মৃতি। তাকে কেউ মনে রাখেনি। বুড়ো হাবড়ার বোঝা উচিত, আমরাই ভবিষ্যৎ। ওকে বা ওর মতো প্রাচীনদের আমরা গোণায় ধরি না। ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলা হয়েছে তাদের, ওখানেই থাকবে। আর আমার মতো যারা আছে, তারা লিমো চড়ে এগিয়ে যাব আগামীর দিকে।’ 

‘অবশ্যই বলব।’ বলল শ্যাডো। মাথা ঘুরতে শুরু করেছে ওর, অসুস্থ না হয়ে পড়ে—সেই প্রার্থনা করছে মনে মনে। 

‘ওকে বলবে, আমরা বাস্তবতাকে নতুন করে প্রোগ্রাম করেছি। বলবে, ভাষা হচ্ছে ভাইরাস আর ধর্ম একটা অপারেটিং সিস্টেম। প্রার্থনা আসলে স্প্যাম ছাড়া কিছুই না। সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বলবে, আর নয়তো তোমাকে খুন করে ফেলব।’ মৃদু স্বরে হুমকি দিল ছেলেটা। 

‘বুঝতে পেরেছি,’ বলল শ্যাডো। ‘আমাকে নাহয় এখানেই নামিয়ে দাও। বাকি পথ হেঁটে যেতে পারব।’ 

মাথা দোলাল ছোকরা। ‘তোমার সাথে কথা বলে ভালো লাগল। মন দিয়ে শোনো: আমার কথা না শুনলে তোমাকে ডিলিট করে দেওয়া হবে। আন-ডিলিট করার সুযোগ নেই।’ সিগারেটের দিকে ইঙ্গিত করল সে। ‘কৃত্রিমভাবে বানানো ব্যাঙের চামড়া এইটা। জানো, আজকাল মানুষ বুফোটেনিনও[৩] বানাতে পারে?’ 

[৩ এক ধরনের বিষ না বিষাক্ত মাশরুম, ব্যাঙ, আর কিছু উদ্ভিদে পাওয়া যায়।]

ব্রেক করল গাড়িটা, দরজা খুলে গেলে ইতস্তত ভঙ্গিতে নামল শ্যাডো, তারপর ঘুরে দাঁড়াল। গাড়ির ভেতরটা এখন ধোঁয়ার রাজ্যে পরিণত হয়েছে। শুধু দুটো লাইট, ব্যাঙের চোখের মতো জ্বলজ্বল করছে। ‘ক্ষমতার পালাবদল হচ্ছে, শ্যাডো। এরচাইতে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই নেই। ওহ ভালো কথা, তোমার স্ত্রীর ব্যাপারে শুনে খারাপ লাগছে।’ 

প্রায় সাথে সাথেই বন্ধ হয়ে গেল দরজা। চুপচাপ, কোন শব্দ না করেই এগিয়ে গেল লিমো। মোটেলটা আর মাত্র কয়েকশ গজ দূরে। হেঁটেই রওনা দিল ও, ঠান্ডা বাতাস বুক ভরে টানছে। আর কোনো ঘটনা…অথবা দুর্ঘটনা ছাড়াই পৌঁছে গেল মোটেল আমেরিকায়। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *