আমেরিকান গডস – ১৮

অধ্যায় আঠারো 

সৈন্যদের পথ আটকাতে চেয়েছিল ওই দুজন। কিন্তু গুলি ছুঁড়ে উভয়কেই হত্যা করা হয়। গানে ওদের কারাবাসের কথা বলা হয়েছে কেবল কাব্যের খাতিরে। সত্যি ঘটনাগুলোকে সবসময় অবিকৃত রেখে কাব্যে তুলে ধরা যায় না। ওই পঙতিগুলোতে যথেষ্ট জায়গা নেই। 

–দ্য ব্যালাড অভ স্যাম ব্যাসের প্রসঙ্গে, আ ট্রেজারি অভ আমেরিকান ফোকলোর। 

.

হয়তো এসব বাস্তব হতেই পারে না। প্রিয় পাঠক, যদি এই আখ্যান পড়ে আপনার মাঝে অস্বস্তির জন্ম নেয়, তাহলে পুরোটাকেই রূপকার্থে লেখা বলে ধরে নিন। হাজার হলেও, ধর্মের সবকিছুই তো রূপক। ঈশ্বর নানা রূপে আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হন—কখনও স্বপ্নে, কখনও আশায়, কখনও কোনো নারী রূপে, কখনও যাজকের বেশ ধরে। তাকে কখনও পাওয়া যায় কোনো শহরে, কখনও কোনো অমূল্য বস্তুতে। তিনি এমন একজন, যিনি আপনাকে ভালোবাসেন। যিনি কেবল আপনারই খাতিরে, আপনার পছন্দের ফুটবল দলের প্রতি সুনজর দেন। আপনার জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে রয়েছে যার আশীর্বাদ। 

ধর্ম তাই এমন এক বেদি, যেখানে দাঁড়িয়ে দেখতে পাওয়া যায় জীবনটাকে।

তাই এই গল্প অবাস্তব ধরে নিন। এসব প্রকৃতপক্ষে ঘটতেই পারে না। এই আখ্যানের আক্ষরিক অর্থে বিশ্বাস করা যাবে না এক বিন্দুও। তারপরও, যেহেতু একসাথে এতদূর চলেই এসেছি। তাই বাকিটুকুও শোনাই আপনাকে : 

লুকআউট পাহাড়ের পাদদেশে, একটা ছোটো অগ্নিকুণ্ডকে ঘিরে বসে আছে একদল নারী-পুরুষ। বৃষ্টি পড়ছে অঝোর ধারায়। কপাল ভালো, গাছ ছিল এক গাদা। নইলে আর আগুন জ্বালাতে হতো না! তর্কে লিপ্ত সবাই। 

কালি মা, এখন যার ত্বক কয়লার চাইতেও কালো আর দাঁত দুধের চাইতেও সাদা, বললেন, ‘সময় হয়েছে।’ 

আনানসি, রুপালি চুল ভরতি মাথা দুলিয়ে জানাল আপত্তি। ‘এখনও অপেক্ষা করা সম্ভব,’ বলল সে। ‘যেহেতু অপেক্ষা করা সম্ভব, তাই অপেক্ষা করাই শ্রেয়।’ 

অসন্তোষের রোল উঠল উপস্থিতদের মাঝে। 

‘ঠিক বলেছে আনানসি,’ আরেক বৃদ্ধ বলে উঠল আচমকা। তার নাম চেরনোবোগ, হাতে একটা ছোটো স্লেজহ্যামার শোভা পাচ্ছে। শত্রুপক্ষ আমাদের চাইতে উঁচু অবস্থানে আছে। পানির প্রবাহও আমাদের বিপরীতে। এখন যুদ্ধ করা চরম পাগলামি ছাড়া আর কিছু হবে না।’ 

কিছুটা মানুষ আর কিছুটা নেকড়ের মতো দেখতে একটা কিছু মাটিতে থুথু ফেলল। ‘তাহলে আক্রমণটা করব কবে শুনি? যখন আবহাওয়া পরিষ্কার হবে আর ওরা অস্ত্র হাতে তৈরি থাকবে, তখন? আমি তো বলি, আক্রমণটা এখুনি হোক।’ 

‘আমাদের আর ওদের মাঝখানে মেঘ আছে এখনও,’ হাঙ্গেরিয়ান ইস্টেন মনে করিয়ে দিল। লোকটার গোঁফ জাঁকালো, মাথায় একটা ধুলো-ধূসরিত কালো টুপি। 

দামি স্যুট পরিহিত এক লোক চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ। এবার আলোতে এসে কীসব যেন বলল। উপস্থিত সবার ঘনঘন মাথা দোলানো দেখে মনে হলো, লোকটার কথা পছন্দ করেছে তারা। 

মরিগান নামধারী তিন রমণীর একজন মুখ খুলল এবার, ‘সময় সঠিক বা বেঠিক, তাতে কী যায় আসে? এখন সময় হয়েছে, সেটাই বড়ো কথা। ওরা আমাদেরকে এক এক করে খুন করছে। তাই আমি বলি কী, একসাথে মরাই ভালো। মৃত্যু বরণ করতে হলে আক্রমণ করে, দেবতার মতো বরণ করাই কী শ্রেয় নয়? নাকি গর্তে আটকা পড়া ইঁদুরের মতো মৃত্যু চাও তোমরা?’ 

এবার প্রায় সবাই মাথা দোলাল। সবার মনের কথা যেন মেয়েটা একাই বলে দিয়েছে। এখনই সময়। 

‘প্রথম মুণ্ডুটা আমার।’ অস্বাভাবিক লম্বা এক চাইনিজ ভদ্রলোক ঘোষণা করল। তার গলায় ছোটো ছোটো করোটির একটা মালা। আস্তে আস্তে, কিন্তু উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে পাহাড় ধরে উঠতে শুরু করল সে। তার এক হাতে অর্ধ-চন্দ্র আকৃতির একটা বাঁকানো অস্ত্ৰ। 

.

কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়, এমনকী শূন্যতাও নয়। 

সেখানে হয়তো দশ মিনিট ছিল মাত্র শ্যাডো, হয়তো ছিল দশ হাজার বছর। অবশ্য তাতে কী যায় আসে? সময় এমন একটা ধারণা, যার কোনো প্রয়োজন আর নেই ওর। 

নিজের নামটাও ভুলে গেছে যুবক। নিজেকে একই সাথে শূন্য আর পবিত্র বলে মনে হচ্ছে। 

কোনো আকার নেই তার, এখন ও অন্তঃসার শূন্য। 

এখন সে…নিজেই শূন্যতা 

সেই শূন্যতার মাঝেই কথা বলে উঠল কেউ, ‘হো-হোকা, ভাই আমার। এসো, কথা বলি। 

একদা যে শ্যাডো নামে পরিচিত ছিল, সে জানতে চাইল, ‘হুইস্কি জ্যাক?’ 

‘হ্যাঁ,’ অন্ধকারেই উত্তর দিল হুইস্কি জ্যাক। ‘তোমাকে খুঁজে পাওয়া বড়ো কষ্ট। মারা যাবার পর যেখানে যেখানে যাবে বলে ভেবেছিলাম, সেসব জায়গার কোথাও পাইনি তোমায়। যাই হোক, নিজ গোত্রকে খুঁজে পেয়েছিলে?’ 

ডিস্কোতে নৃত্যরত নারী আর পুরুষের কথা মনে পড়ে গেল ওর। নিজের পরিবারকে পেয়েছি, কিন্তু গোত্রকে পাইনি।’ 

‘বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।’ 

‘আমাকে একা থাকতে দাও, যা চেয়েছিলে তা তো পেয়েছই।’ 

‘প্রাণ ফিরিয়ে দিতে তোমার কাছে আসছে দেবতারা।’ জানাল হুইস্কি জ্যাক।

‘কিন্তু আমি তো তা চাই না।’ বলল শ্যাডো। ‘সব শেষ হয়ে গেছে।’ 

‘সব শেষ হয়ে গেছে? ওমনটা কখনওই হয় না।’ যুবককে দৃঢ় কণ্ঠে জানিয়ে দিল হুইস্কি জ্যাক। ‘চলো, আমার বাড়িতে চলো। বিয়ার দেব?’ 

বিয়ার হলে মন্দ হয় না, ভাবল শ্যাডো। ‘অবশ্যই।’ 

‘আমার জন্যেও একটা আনো তাহলে। দরজার বাইরের রাখা আছে।’ ইঙ্গিত করে দেখাল হুইস্কি জ্যাক। এখন তার কুঁড়েতেই আছে দুজন। 

একটুও আগে হাত বলতে কিছু ছিল না শ্যাডোর, এখন একজোড়া হাত দিয়ে দরজা খুলে ফেলল। বাইরেই একটা প্লাস্টিকের কুলার দেখা যাচ্ছে। ওটার ভেতরে নদীর পানি ব্যবহার করে বানানো বরফ, সেই বরফের মাঝে নাক উঁচু করে ভাসছে এক ডজন বাডওয়াইজার। একজোড়া ক্যান নিয়ে বের করে দোরগোড়ায় বসল ও, তাকাল উপত্যকার দিকে। 

পাহাড়ের একদম শীর্ষে বসে আছে ওরা, কাছেই একটা ঝরনা থেকে পানি ঝরার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। 

‘আমরা কোথায়?’ জানতে চাইল শ্যাডো। 

‘গতবার যেখানে এসেছিলে,’ জানাল হুইস্কি জ্যাক। ‘আমার বাড়িতে। গরম হবার পর বিয়ার দেবে নাকি?’ 

উঠে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধের দিকে একটা ক্যান বাড়িয়ে ধরল শ্যাডো। ‘গতবার তো এই ঝরনাটা ছিল না।’ 

কিছুই বলল না হুইস্কি জ্যাক। ক্যানটা খুলে এক ঢোকে খালি করে ফেলল অর্ধেকটা। ‘আমার ভাতিজা, হেনরি হ্যারি ব্লুজের কথা মনে আছে? কবি ছেলেটা? ওই যে, তোমাদের উইনিব্যাগোটা যার বুইকের সাথে বদলা-বদলি করলে?’ 

‘হ্যাঁ। তবে জানতাম না যে সে কবিতাও লেখে।’ 

থুতনি তুলে চাইল হুইস্কি জ্যাক, গর্ব ঝরে পড়ছে কণ্ঠে। ‘আমেরিকার সেরা কবি ও।’ বিয়ারের বাকিটুকু শেষ করে ঢেকুর তুলল লোকটা। তারপর আরেকটা ক্যান তুলে নিয়ে বসল বাইরে। শ্যাডোও যোগ দিল তার সাথে। সকালের মিষ্টি রোদ পোহাতে পোহাতে আর ঝরনার দৃশ্য দেখতে দেখতে ক্যানে চুমুক দিল দুজন। 

‘হেনরি ডায়াবেটিক ছিল,’ বলেই চলছে হুইস্কি জ্যাক। ‘তোমরা আমেরিকায় এলে। আমাদের আখ, আলু আর ভুট্টা কেড়ে নিয়ে আমার আমাদের কাছেই বিক্রি করলে পটেটো চিপস, পপকর্ন! এসবের ফলে অসুস্থ হলাম কারা? এই আমরাই।’ গলা শুকিয়ে আসায় আবার চুমুক দিল সে ক্যানে। ‘কবিতার জন্য কয়েকটা পুরষ্কারও পেয়েছে হেনরি। মিনেসোটার কয়েকজন তো ওর কবিতার বইও প্রকাশ করতে চেয়েছিল। যেদিন মারা যায়, সেদিন একটা স্পোর্টস কারে করে যাচ্ছিল ওই ব্যাপারে কথা বলতে। তোমাদের ব্যাগোটা বদলে একটা হলদে মিয়াটা নিয়েছিল। ডাক্তারদের মতে, গাড়ি চালাতে চালাতেই ও কোমায় চলে যায়। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়ি ধাক্কা খেয়ে বসে তোমাদের লাগানো সাইনবোর্ডে। একদম অলস তোমরা। আকাশ দেখে, মেঘ আর পাহাড় দিয়ে রাস্তা চেনার ক্ষমতা তোমাদের নেই। প্রতিটা রাস্তার মোড়ে সাইনবোর্ড ঝোলাতেই হবে? যাই হোক, মারা গেল হেনরি ব্লুজে। নেকড়ের সাথে বাস করার জন্য চলে গেল চিরতরে। তাই ভাবলাম, আমাকে আটকে রাখার মতো আর কেউ নেই লাকোটা এলাকায়…চলে এলাম উত্তরে। এখানে মাছ ধরা পড়ে খুব।’ 

‘আমার সমবেদনা গ্রহণ করুন।’ 

‘যাই হোক, সাদা মানুষের রোগ এখানে আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। কেউ সাদা মানুষের সাইনবোর্ড দেখে সাদা মানুষের রাস্তায় চলে আসতে পারবে না এখানে।’ 

‘শুধু সাদা মানুষের বিয়ার আসলেই চলবে?’ 

ক্যানের দিকে তাকাল হুইস্কি জ্যাক। ‘যখন তোমরা আমাদের দেশ ছেড়ে পাততাড়ি গোটাবে, তখন বাডওয়াইজারের কারখানাগুলো রেখে যেতে পারো।’ 

‘আমরা কোথায় আসলে?’ জানতে চাইল শ্যাডো। ‘আমি কি এখনও গাছ থেকে ঝুলছি? আমি কি মৃত? আমি কি সত্যি সত্যি এখানে? এসব বাস্তব?’ 

‘হ্যাঁ।’ জানাল হুইস্কি জ্যাক। 

‘হ্যাঁ!’ এটা আবার কেমন উত্তর? 

‘সত্যি জবাব, যথার্থও।’ 

‘আপনি নিজেও কি দেবতা?’ এবার শ্যাডোর প্রশ্ন। 

মাথা নাড়ল হুইস্কি জ্যাক। ‘আমাকে দেবতা না বলে, কিংবদন্তি বলতে পারো। আমাদের আর দেবতাদের অবস্থা একই। পার্থক্য হলো, আমাদের কেউ উপাসনা করে না। সবাই আমাদের নামে ফোলানো-ফাঁপানো গল্প বলে কেবল। তা-ও শুধু সেগুলোই, যেগুলোতে আমরা বোকা প্রতিপন্ন হই!’ 

‘বুঝলাম।’ কিছুটা হলেও, আসলেই বুঝতে পেরেছে ও। 

‘দেখো, দেবতাদের জন্য এই দেশটা একদম উর্বর নয়। আমরা, ইন্ডিয়ানরা তা আরও আগেই টের পেয়েছিলাম। এমন অনেক আত্মা আছেন, যারা স্রষ্টা… যারা এই দুনিয়াকে বানিয়েছেন। কিন্তু ভেবে দেখ, সুস্থ মস্তিষ্কের কে কয়োটের উপাসনা করবে? বেচারা যখন কোনো পাথরের সাথে ঝগড়া করে, তখন তাতে জয় হয় সেই পাথরের! 

‘তাই আমরা সেই স্রষ্টাকে বা স্রষ্টাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়েই সন্তুষ্ট। আমরা এখানে কখনও মন্দির বানাইনি, দরকারই পড়েনি। এই দেশের পুরোটাই তো আমাদের মন্দির…এই দেশটা আমাদের ধর্ম। এখানে যে মানবজাতি পা রেখেছে, তার চাইতেও বয়স্ক আর জ্ঞানী সে। সে-ই আমাদেরকে দিয়েছে স্যামন মাছ, ভুট্টা আর মহিষ। দিয়েছে ভাত আর সবজি। তরমুজ আর টার্কি কি এই মাটিরই দান না? আমরা ছিলাম এই দেশের…এই মাটির সন্তান।’ 

দ্বিতীয় ক্যানটাও শেষ করে ফেলল বৃদ্ধ। এরপর ইঙ্গিতে দেখাল নিচের দিকে। ঝরনাটা ওখানে এক নদীর সাথে গিয়ে মিশেছে। ‘যদি ওই নদী ধরে কিছুদূর এগোও, তাহলে একটা হ্রদ পাবে। ওটার ধারে দেখতে পাবে বুনো ধান। যখন ওই বুনো ধান যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যেত, তখন মানুষ বের হতো ক্যানুতে চড়ে। ইচ্ছামত ধান তুলে সেটাকে রেঁধে খেত। অথবা সিদ্ধ করে জমিয়ে রাখত পরবর্তী কোন সময়ের জন্য। এই মাটির একেক এলাকায় জন্মাত একেক ধরনের খাবার। উত্তরে যাও তো পাবে লেবুর বাগান, কমলার বাগান, পাবে সবুজ সবুজ…কী যেন—’ 

‘অ্যাভোকাডো?’ 

‘হ্যাঁ, অ্যাভোকাডো।’ সন্তুষ্ট হলো হুইস্কি জ্যাক। ‘ওসব কিন্তু এদিকে ফলে না। এই এলাকা, বুনো ধানের এলাকা। মুজের এলাকা। যাই হোক, যেটা বলতে চাচ্ছি তা হলো-আমেরিকা এমনই। দেবতাদের জন্য উর্বর ভূমি না একেবারেই। উদাহরণ চাইলে বলব, তার হচ্ছে এমন অ্যাভোকাডো, যারা বুনো ধানের এলাকায় শিকড় বসাতে চাইছে।’ 

‘হতে পারে,’ আচমকা মনে পড়ে গেলে শ্যাডোর। ‘কিন্তু তারা তো যুদ্ধে জড়াতে চলেছে।’ 

এই প্রথম আর শেষবারের জন্য হুইস্কি জ্যাককে হাসতে দেখল শ্যাডো। হাসি না বলে গর্জন বলাই মনে হয় ভালো হবে। ‘আচ্ছা শ্যাডো,’ আচমকা হাসি থামিয়ে জানতে চাইল সে। ‘তোমার বন্ধুরা যদি পাহাড় থেকে ঝাঁপ দেয়, তাহলে তুমিও দেবে?’ 

‘দিতেও পারি।’ ভালো বোধ করতে শুরু করেছে শ্যাডো। এর আগে কবে নিজেকে এতটা জীবন্ত মনে হচ্ছিল, তা খেয়াল করতে পারছে না। 

‘যুদ্ধ হবে না।’ 

‘তাহলে কী হবে?’ 

হাতের চাপে ক্যানটাকে একদম সমান করে ফেলল হুইস্কি জ্যাক। ‘দেখো,’ এবার ঝরনার দিকে ইঙ্গিত করল বৃদ্ধ। সূর্য আকাশে অনেকটাই ওপরে উঠে এসেছে। ঝরনার পানির সাথে মিলে রঙধনুর জন্ম দিয়েছে সে। 

‘রক্তের বন্যা বইবে।’ সরাসরি বলে ফেলল হুইস্কি জ্যাক। 

ঠিক তখনই পুরো ব্যাপারটা খোলাসা হয়ে গেল শ্যাডোর কাছে, সবকিছু বুঝতে পারল সেই এক মুহূর্তে। প্রথমে মাথা নাড়ল একবার, তারপর ফিক করে হেসে ফেলল। কিছুক্ষণের মাঝেই সেটা পরিণত হলো অট্টহাসিতে। 

‘তুমি ঠিক আছ?’ 

‘একদম,’ বলল শ্যাডো। ‘লুকিয়ে থাকা ইন্ডিয়ানটাকে ধরে ফেলেছি মনে হচ্ছে।’ 

‘ওই ব্যাটা মনে হয় হো চাঙ্ক। কখনওই ঠিকমতো লুকাতে পারত না।’ সূর্যের দিকে তাকাল হুইস্কি জ্যাক। ‘ফেরার সময় হয়েছে।’ বলে উঠে দাঁড়াল সে।

‘দুই মানুষের প্রতারণা,’ বলল শ্যাডো। ‘যুদ্ধ কেবল নামেই, তাই না?’

ওর হাতে আলতো করে চাপড় দিল হুইস্কি জ্যাক। ‘দেখে যতটা মনে হয়, ততটা বোকা নও তুমি।’ 

কুটিরে ফিরে এলো দুজন। দরজা খুলল হুইস্কি জ্যাক। ইতস্তত করতে লাগল শ্যাডো। ‘আপনার সাথে থাকতে পারলেই খুশি হতাম। জায়গাটাকে ভালো মনে হচ্ছে।’ 

‘ভালো জায়গার অভাব নেই,’ বলল লোকটা। ‘শোনো, যখন দেবতাদের সবাই তাদেরকে ভুলে যায়, তখন মৃত্যু হয় তাদের। মানুষের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা খাটে। কিন্তু দেশ, ভূমি, মাটির কোন মৃত্যু নেই। জায়গা ভালো হোক বা মন্দ, মাটি থাকবে এখানেই। থাকব আমিও।’ 

ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল শ্যাডো। কিছু একটা যেন টানছে ওকে। অন্ধকারে আবার নিজেকে একা আবিষ্কার করল ও। কিন্তু এখন সেই অন্ধকার আস্তে আস্তে উজ্জ্বল হতে শুরু করেছে… 

… অচিরেই যা রূপ নিলো জ্বলন্ত সূর্যে। 
সেই সাথে শুরু হলো তীব্র ব্যথা। 

.

তৃণভূমি ধরে হেঁটে যাচ্ছেন ইস্টার, তার পায়ের স্পর্শ পাওয়া মাত্র মাটিতে ফুটছে বসন্তের ফুল। 

অনেক অনেক দিন আগে এই ভূমিতে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল একটা খামার বাড়ি। এখন তার খুব অল্পই অবশিষ্ট আছে, আগাছা দখল করে নিয়েছে বাকিটুকু। বৃষ্টি পড়ছে ফোঁটায় ফোঁটায়। মাথার ওপরে নিচু হয়ে ভাসছে মেঘের দল। 

খামার বাড়ির ধ্বংসাবশেষ যেখানে, সেখান থেকে একটু সামনে এগোলেই একটা বিশাল, ধূসর-রুপালি গাছ। দেখে মনে হয় মৃত, পাতা নেই ডালে। ওটার সামনের ঘাসে যেন মড়ক লেগেছে, কাপড় দিয়ে স্তূপ করে রাখা আছে কিছু একটা। 

মুখ তুলে ওপরের দিকে চাইলেন ইস্টার। মৃত দেহটাকে ঝুলতে দেখে হাসলেন একটু। ‘আস্তে আস্তে খোলার মাঝেই তো আসল মজা।’ বললেন তিনি। ‘তা পুরুষের কাপড়ই হোক, অথবা উপহারের বাক্সই হোক।’ 

মহিলার পাশেই হাঁটতে থাকা যুবক যেন এতক্ষণে নিজের নগ্নতা টের পেল। সে বলল, ‘পলক না ফেলে আমি সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারি!’ 

‘খুব ভালো!’ উৎসাহ দিলেন ইস্টার। ‘এখন দেহটাকে গাছ থেকে নামাও।’

শ্যাডোকে বেঁধে রাখা ভেজা রশিগুলো আরও আগেই পচে গেছে। দুই জনের টান সহ্য করতে না পেরে এবার ছিঁড়ে গেল। পড়ন্ত দেহটাকে লুফে নিলেন ইস্টার আর হোরাস। এমন আয়াসে যে শ্যাডোকে বিশালদেহী বলে মনেই হলো না। ধূসর তৃণভূমিতে শুইয়ে দিল দেহটাকে। 

শ্বাস পড়ছে না দেহটার, একপাশে জমাট বাঁধা রক্ত কালো বর্ণ ধারণ করেছে।

‘এখন?’ 

‘এখন,’ জানালেন মহিলা, ‘আমরা দেহটাকে আস্তে আস্তে উষ্ণ করে তুলব। তোমার কী করতে হবে, তা তুমি জানো।’ 

‘জানি। কিন্তু করতে পারব না।’ 

‘সাহায্য করতে না চাইলে, আমাকে ডেকে আনলে কেন?’ 

সাদা একটা হাত বাড়িয়ে হোরাসের কালো চুল স্পর্শ করলেন ইস্টার। মহিলার দিকে তাকিয়ে পলক ফেলল হোরাস। তারপর চেয়ে রইল অখণ্ড মনোযোগে। 

উড়তে শুরু করল হোরাস, কিছুক্ষণের মাঝেই উঠে গেল আকাশে। সূর্যকে ঘিরে রেখেছে মেঘ, সেটাকে কেন্দ্র করে উড়ছে সে। প্রথমে বাজপাখিটাকে দেখে মনে হলো যেন একটা বিন্দু। তারপর ধুলা, কিছুক্ষণের মাঝেই নগ্ন চোখে আর দেখা গেল না তাকে। আস্তে আস্তে উধাও হয়ে যেতে শুরু করল মেঘ, সূর্য উঁকি দিচ্ছে আড়াল থেকে। অতি দ্রুতই দেখা গেল, আকাশে আর মেঘ নেই! গ্রীষ্মের সূর্যকে যেন হার মানাবে বলে পণ করেছে। 

সূর্যের উজ্জ্বলতা ভাসিয়ে দিচ্ছে মৃত দেহটাকে। এবার কাজে নামলেন ইস্টার। ডান হাতের আঙুল দিয়ে আলতো করে শ্যাডোর বুকে আঁচড় দিলেন তিনি। মনে হলো, মরদেহটার বুকে কীসের যেন স্পন্দন টের পাচ্ছেন। নাহ, হৃৎস্পন্দন না। তবে হাতটা সরালেন না তিনি, রেখে দিলেন হৃৎপিণ্ডের ঠিক ওপরেই। 

শ্যাডোর ঠোঁটে ঠোঁট নামিয়ে আনলেন তিনি, ফুঁ দিয়ে ফুলিয়ে তুললেন ওর ফুসফুস। আচমকা দেখা গেল, শ্যাডোকে চুম্বন করতে শুরু করেছেন তিনি। নম্র চুম্বন তার, স্বাদে বসন্তের বৃষ্টি আর তৃণভূমির ফুলের মতো। 

রক্ত বইতে শুরু করল লাশটার পাশ দিয়ে, তাজা রক্ত বেরোতে শুরু করল ক্ষত থেকে। সূর্যের আলোতে সেটাকে রুবি বলে মনে হচ্ছে। হঠাৎ করে যেমন রক্তপাত শুরু হয়েছিল, তেমনি হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেল। 

শ্যাডোর গাল আর কপালে চুমু খেলেন ইস্টার। ‘সময় হয়েছে,’ বললেন তিনি। ‘উঠে দাঁড়াও। ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে, এখন শুয়ে থাকলে চলবে?’ 

পিট পিট করে উঠল শ্যাডোর চোখ, তারপর একদম আচমকা খুলে গেল। ধূসর চোখজোড়া একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল ইস্টারের দিকে। 

মুচকি হাসলেন তিনি, হাত সরিয়ে নিলেন বুকের উপর থেকে। 

‘আমাকে ফিরিয়ে এনেছেন,’ আস্তে আস্তে বলল শ্যাডো, নতুন করে কথা বলা শিখতে হচ্ছে যেন ওকে। কিছুটা ব্যথা আর কিছুটা বিভ্রান্তির সুর কণ্ঠে। 

‘হ্যাঁ।’ 

‘আমি মুখোমুখি হয়েছি শেষ বিচারের। সবকিছু শেষ হয়ে গেছিল। কিন্তু আপনি ফিরিয়ে আনলেন। কেন আনলেন?’ 

‘আমি দুঃখিত।’ 

‘আপনার তা হওয়াই উচিত।’ 

আস্তে আস্তে উঠে বসল শ্যাডো। মুখ কুঁচকে স্পর্শ করল দেহের যেখানে ক্ষত ছিল, সেখানে। কী আশ্চর্য, রক্ত লেগে আছে চামড়ায়! অথচ তার নিচে ক্ষত নেই! 

এক হাত বাড়িয়ে দিল সে, সেই হাত ধরে ইস্টার টেনে তুললেন তাকে। এমন দৃষ্টিতে চারদিকে তাকাল শ্যাডো, যেন সবকিছু নতুন করে দেখছে! মনে হলো নাম ভুলে গেছে সবকিছুর-ঘাসের ভেতর থেকে মাথা তুলে তাকানো ফুল, ধ্বংস-প্ৰায় খামার বাড়ি, জীবন-বৃক্ষ…সব। 

‘মনে আছে?’ প্রশ্ন করলেন ইস্টার। ‘কী কী দেখেছ সে সব?’ 

‘যা মনে পড়ে: আমি আমার নাম খুইয়ে ফেলেছিলাম, হারিয়ে ফেলেছিলাম আমার হৃৎপিণ্ড। আপনি আমাকে ফিরিয়ে এনেছেন।’ 

‘আমি দুঃখিত,’ বললেন মহিলা। ‘অতিসত্বর লড়তে শুরু করবে সবাই। নতুন আর পুরাতন দেবতাদের মাঝে যুদ্ধ শুরু হতে চলেছে।’ 

‘আপনি চান, আমি আপনাদের হয়ে লড়াই করি? তাহলে বলব, সময় নষ্ট করছেন।’ 

‘তোমাকে ফিরিয়ে এনেছি তার কারণ, তোমাকে ফিরিয়ে আনাটাই ছিল আমার দায়িত্ব,’ বললেন ইস্টার। ‘এখন তোমার দায়িত্ব কী, সেটা নিজেই ঠিক করে নাও।’ 

.

মেঘ আর বৃষ্টির মাঝে নড়াচড়া করছে অগণিত ছায়া। 

সবুজ জ্যাকেট পরিহিত লালচুলো একদল লোকের পাশে হাঁটছে সাদা শিয়াল। এক মিনেটরের পাশে উড়ছে এক ড্যাকটিল। পাহাড়ের ধার ধরে হেঁটে হেঁটে উঠছে একটা শুয়োর, এক বানর আর এক তীক্ষ্ণ দাঁতধারী ঘুল। ওপরে উঠছে নীল ত্বকের এক লোকও, হাতে তার একটা জ্বলন্ত ধনুক। 

হেন্ড্রিয়ানের প্রেমিক, সুদর্শন অ্যানটিনোস হাঁটছে একদল রানির সামনে। প্রত্যেকেই সশস্ত্র, বর্ম পরিহিত। 

ধূসর ত্বকের এক লোক, তার এক চোখ দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে একদল পুরুষের মিছিল। এই লোকগুলোর প্রত্যেকের চেহারাতেই রুক্ষ একটা ভাব, নিস্পৃহ চেহারা গুলো অ্যাজটেকদের আঁকা মানুষের চেহারার সাথে একদম মিলে যায়! 

পাহাড়ের একদম ওপর থেকে এক স্নাইপার খুব সাবধানতার সাথে নিশানা করল, তার লক্ষ্য সাদা শেয়ালটা। বড়ো করে একটা দম নিয়ে গুলি ছুঁড়ল সে। বিস্ফোরণের আওয়াজের সাথে বাতাসে ছড়িয়ে গেল কর্ডাইট আর গান পাউডারের গন্ধ। যেখানে একটু আগে একটা সাদা শেয়াল হাঁটছিল, সেখানে দেখা গেল একজন যুবতী জাপানিজ মেয়ের দেহ। আস্তে আস্তে উধাও হয়ে যেতে শুরু করল লাশটা। 

আস্তে আস্তে পাহাড় বেয়ে উঠতে শুরু করল সবাই। কেউ চারপায়ে হেঁটে, কেউ দুই পায়ে…আবার কেউ পা ছাড়াই! 

.

ঝড় না থাকলে টেনেসির পাহাড়ি পথ ধরে গাড়ি চালানোটা অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা। আবার যখন বৃষ্টি শুরু হয়, তখন এর চাইতে বাজে অভিজ্ঞতা আর হয় না! 

পুরো রাস্তাটা গল্প করেই কাটিয়েছে লরা আর টাউন। মেয়েটার সঙ্গের জন্য কৃতজ্ঞ সে। ওর মনে হচ্ছে অনেকদিন পর এক পুরনো বন্ধুর সাথে সময় কাটাচ্ছে সে। ইতিহাস, গান আর সিনেমা নিয়ে আলোচনা করেছে ওরা। দ্য ম্যানুস্ক্রিপ্ট ফাউন্ড ইন সারাগোসা নামের একটা বিদেশি সিনেমা দেখেছিল টাউন, তা-ও অনেক আগে। এতদিনে এই প্রথম একজনকে পেল, যে ছবিটা দেখেছে (অবশ্য টাউনের ধারণা ছিল, ছবিটা স্প্যানিশ। লরার মতে ওটা পোলিশ)! বেচারার তো সন্দেহই হতে শুরু করেছিল, ছবিটা বোধ হয় সত্যি সত্যি দেখেনি ও। কল্পনা ছিল হয়তো। 

রক সিটিতে আসুন লেখা সাইনবোর্ডটা দেখাল লরা। টাউন মুচকি হেসে জবাব দিল, ওখানেই যাচ্ছে সে। অবাক হলো মেয়েটা। জানাল, সে নিজেও যেতে চায় রক সিটির মতো জায়গাগুলোতে। কিন্তু সময় করে উঠতে পারে না। এই জন্যই রাস্তায় নেমেছে ও, অভিযানের উদ্দেশ্যে। 

নিজের পেশার কথাও জানাল মেয়েটা, বলল-ও একজন ট্রাভেল এজেন্ট। আপাতত স্বামীর কাছ থেকে একটু বিরতি নিয়েছে। তবে ভবিষ্যতেও কখনও একত্রিত হতে পারবে বলে মনে হয় না। দোষটা যে ওর নিজেরই, সেটাও জানাল। 

‘আমার তা বিশ্বাস হয় না।’ 

দীর্ঘশ্বাস ফেলল মেয়েটা। ‘কথাটা সত্যি, ম্যাক। যে মেয়েটাকে আমার স্বামী বিশ্বাস করেছিল, আমি আর সেই মেয়েটি নেই!’ 

সময়ের সাথে পরিবর্তন আসে সব মানুষের মাঝেই, জানাল ম্যাক। এরপর নিজের অজান্তেই যেন মুখ খুলে গেল ওর। উডি আর স্টোনারের ব্যাপারে, ওদের একসাথে সময় কাটানোর ব্যাপারে সব খুলে বলল লোকটা। বলল ওই দুজনের খুন হবার কথাও। 

সান্ত্বনার ভঙ্গিতে লোকটার হাতে হাত রাখল মেয়েটা। হাতটা এতটাই ঠান্ডা যে গাড়ির তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিল টাউন। 

লাঞ্চের সময় নক্সভিলে থামল ওরা। জাপানিজ খাবার দিয়ে পেট ভরালো দুজন। খাবারটা খুব একটা ভালো না। মিসো স্যুপটা ঠান্ডা, সুশি আবার গরম। তবে এসবের কোন কিছুই টাউনকে বিরক্ত করতে পারল না। মেয়েটা যে ওর সাথে আছে, একসাথে অভিযানে বের হয়েছে, এতেই টাউন খুশি। 

‘আসলে,’ এবার নিজের গোপন কথা বলতে শুরু করল লরা। ‘এক জায়গায় আটকা পড়াটা আমার সহ্য হচ্ছিল না। যেখানে ছিলাম, সেখানে থাকতে থাকতে যেন পচন ধরেছিল আমার মধ্যে। তাই গাড়ি আর ক্রেডিট কার্ড ছাড়াই বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়। অপরিচিত মানুষের দয়ার উপর নির্ভর করছি পুরোপুরি।’ 

‘তুমি ভয় পাও না?’ জানতে চাইল টাউন। ‘অনেক কিছুই তো হতে পারে। ছিনতাইকারী সামনে পড়তে পারো! আবার হয়তো কোনোদিন কোনোদিন খাওয়াই মিলবে না!’ 

মাথা নাড়ল মেয়েটা। তারপর হাসল ইতস্তত করে। ‘তোমার সাথে দেখা হলো তো, তাই না?’ বলার মতো কিছু পেল না টাউন। 

খাওয়া শেষ হলে, মাথার উপর জাপানিজ খবরের কাগজ ধরে দৌড়ে গাড়ির দিকে এগোল ওরা। নিজেদেরকে মনে হলো কমবয়সি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী, হাসি ফুটে উঠল দুজনের মুখেই। 

‘তোমাকে কতদূর নিয়ে যাবো?’ গাড়িতে ফিরে এলে জানতে চাইল লোকটা।

‘তুমি যতদূর যাচ্ছ, ম্যাক।’ লাজুক হাসি হাসল লরা। 

নিজেকে বিগ ম্যাক বলে পরিচয় দেয়নি বলে ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানাল সে। এই মেয়েটা এক রাতের সঙ্গী হবার মতো নয়। পঞ্চাশ বছর লেগেছে একে খুঁজে বের করতে। কিন্তু এই জাদুময়ী মেয়েটা অবশেষে এসেছে ওর জীবনে। 

এ প্রেম নয়তো কী? 

‘দেখো,’ চাট্টানুগার কাছাকাছি পৌঁছে বলল টাউন। উইন্ডশিল্ডের উপর আছড়ে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা। ‘রাতের জন্য তোমাকে একটা মোটেল খুঁজে দেব? চিন্তা করো না, আমি টাকা দেব। আর আমার কাজ শেষ হলে…যদি তুমি চাও…তাহলে নাহয় একসাথে গরম পানিতে গোসল করব আমরা!’ 

‘দারুণ পরিকল্পনা।’ জানাল লরা। ‘কাজ কী তোমার?’ 

‘ওই যে,’ মুচকি হেসে জানাল লোকটা। ‘পেছনের সিটে যে ডালটা আছে, সেটা বিশেষ একজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া!’ 

‘ঠিক আছে,’ গাল ফোলাল মেয়েটা। ‘বোলো না।’ 

লরাকে রক সিটির পার্কিং লটে অপেক্ষা করতে বলল টাউন। জানাল, ডালটা পৌঁছে দিয়েই ফিরে আসবে। গাড়ি চালিয়ে লুকআউট পাহাড়ের পাশে চলে এলো ওরা, গতি ঘণ্টায় ত্রিশ মাইলে ধরে রেখেছে। 

পার্কিং লটে গাড়ি থামাল টাউন, ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল ও। 

‘ওই, ম্যাক। গাড়ি থেকে নামার আগে আমাকে একবার আলিঙ্গন করবে না?’ জানতে চাইল লরা, মুখে হাসি। 

‘অবশ্যই,’ বলে দুই হাত দিয়ে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরল টাউন। মেয়েটার চুলের গন্ধ নাকে আসছে ওর। সুগন্ধির গন্ধ ছাপিয়ে আসছে পচা একটা গন্ধ। অবশ্য যেকোনো ভ্রমণেই এই সমস্যা হয়। ওই গরম পানির গোসলটা দুজনের জন্যই জরুরি-ভাবল সে। মুখ তুলে চাইল লরা, মেয়েটার হাত আলতো করে স্পর্শ করে আছে ওর ঘাড়। 

‘ম্যাক…একটা কথা জানতে চাই। তোমার দুই বন্ধুর সাথে আসলে কী হয়েছিল, তুমি কি তা সত্যি সত্যি জানতে চাও?’ প্রশ্ন করল লরা। ‘উডি আর স্টোনের কথা বলছি।’ 

‘হ্যাঁ,’ মেয়েটার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবাতে ডুবাতে বলল টাউন। ‘অবশ্যই চাই।’

টাউনের মনের আশা পূরণ করল লরা। 

.

আস্তে আস্তে হাঁটছে শ্যাডো, গাছটাকে কেন্দ্র করে। একেকবারে বড়ো করে আনছে বৃত্তটাকে। মাঝে মাঝে থেমে একটা ফুল, একটা পাতা অথবা একটা নুড়ি পাথর তুলে আনছে ও। মনযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে ওগুলোর দিকে, যেন জীবনে এই প্রথমবারের মতো দেখছে! 

ইস্টার মন দিয়ে দেখছেন শ্যাডোকে, কথা বলার সাহস হচ্ছে না। এই মুহূর্তে সেটা উচিতও হবে না। তাই চুপচাপ তাকিয়ে আছেন কেবল। 

গাছের শিকড় থেকে প্রায় বিশ ফুট দূরে, ঘাসের মাঝখান থেকে শ্যাডো তুলে নিলো একটা ক্যানভাসের ব্যাগ। ওটা খুলে ভেতর থেকে কাপড় বের করে আনল সে। পুরনো হলেও, কাজ চলবে। একটা একটা করে পরে নিলো সবগুলো। 

সব পরা শেষে, পকেটে হাত ঢোকালো ও। হাত বের করে আনল যখন, তখন ওর চেহারায় বিভ্রান্ত একটা ভাব। ইস্টারের দিকে তাকিয়ে অবাক স্বরে বলল, ‘পয়সা নেই!’ অনেকক্ষণ পর এই প্রথম কথা বলল শ্যাডো। 

‘পয়সা নেই?’ শ্যাডোর শব্দগুলোই আবার উচ্চারণ করলেন ইস্টার। 

মাথা নাড়ল যুবক। ‘পয়সা থাকলে হাতগুলোকে ব্যস্ত রাখা যায়।’ জুতা পরতে পরতে বলল সে। 

পোশাক পরিহিত শ্যাডোকে স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। গম্ভীর হলেও, বেশ স্বাভাবিক। কে জানে, কতদূর গেছিল বেচারা ভাবলেন ইস্টার। ফিরে আসতে কী কী হারাতে হয়েছে, তা-ই বা জানে কে! তবে আগেও অনেককে মৃত্যুর ওপার থেকে ফিরিয়ে এনেছেন তিনি। তাই জানেন, অতি সত্বর আবার আগের মতো হয়ে যাবে যুবক। ফিরে পাবে আগের জীবনের স্মৃতি। তবে গাছে ঝুলন্ত অবস্থায় যা যা দেখেছে, তা হারিয়ে ফেলবে পুরোপুরি। 

ওকে পথ দেখিয়ে এগিয়ে চললেন ইস্টার। যেটার পিঠে করে এসেছেন, সেটা এখনও ওখানেই আছে। 

‘আমাদের দুজনকে বহন করতে পারবে না ও,’ জানালেন তিনি। ‘তুমি যাও, আমি কোনো একটা উপায় বের করে নেব।’ 

মাথা দোলাল শ্যাডো। ভাবখানা এমন যেন সে কিছু একটা মনে করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আচমকা মুখ খুলল ও, ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো আনন্দের একটা চিৎকার। 

থান্ডারবার্ডটা তার ক্রূর ঠোঁট খুলে পালটা চিৎকার দিয়ে বরণ করে নিলো শ্যাডোকে। 

শকুনের সাথে অনেকটাই মিল আছে পাখিটার। ওটার পালক কালো, সেই সাথে একটা বেগুনি আভাও আছে। গলার কাছে সাদা একটা দাঁত। ঠোঁটগুলো কালো আর ক্রূর-মাংস ছিঁড়ে খাওয়াই যার একমাত্র উদ্দেশ্য। মাটিতে বসে থাকা অবস্থায় ওটা আকারে একটা কালো ভালুকের সমান, লম্বায় শ্যাডোর কাছাকাছি। গর্বের সাথে জানাল হোরাস, ‘আমি ওকে নিয়ে এসেছি। এরা পাহাড়ে বাস করে।’ 

আবারও মাথা নাড়ল শ্যাডো। ‘একবার স্বপ্নে দেখেছিলাম এদের। ওটার চাইতে বাজে স্বপ্ন জীবনে দেখেনি!’ 

থান্ডারবার্ডটা ঠোঁট খুলে হালকা আওয়াজ করল, ক্ররু? তুমিও আমার স্বপ্নের কথা শুনেছ?’ প্রশ্ন করল শ্যাডো। 

এক হাত বাড়িয়ে পাখির মাথায় বুলিয়ে দিল শ্যাডো। পাখিটাও আদরের উত্তরে মাথা দিয়ে চাপ দিল ওর হাতে। ইস্টারের দিকে ফিরল শ্যাডো। ‘আপনি এর পিঠে চড়ে এসেছিলেন? 

‘হ্যাঁ,’ বললেন তিনি। ‘এবার তোমার ওর পিঠে চড়ে ফিরে যাবার পালা। অবশ্য তোমাকে অনুমতি দেবে কি না, সেই প্রশ্ন ভিন্ন।’ 

‘আপনি কীভাবে চড়লেন?’ 

‘একদম সোজা,’ জানালেন ইস্টার। ‘বজ্রের পিঠে চড়ার মতো। পড়ে না গেলেই হলো।’ 

‘আপনি ফিরে যাবেন ওখানে?’ 

মাথা নাড়লেন ইস্টার। ‘আর না, সোনামণি। যথেষ্ট হয়েছে। তুমি যাও, যা করার তা করো। আমি ক্লান্ত। তোমার সৌভাগ্য কামনা করছি।’ 

মাথা ঝাঁকাল শ্যাডো। ‘হুইস্কি জ্যাকের সাথে দেখা হয়েছে। আমি মারা যাবার পর, আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন তিনি। একসাথে বিয়ার পান করেছি দুজন।’ 

‘হুম,’ বললেন ইস্টার। ‘খুব ভালো।’ 

‘আপনার সাথে আর কখনও দেখা হবে?’ প্রশ্ন করল শ্যাডো। 

সবুজাভ চোখ দিয়ে ওর চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন মহিলা। তারপর আচমকা মাথা নেড়ে বললেন, ‘আমার সন্দেহ আছে।’ 

আড়ষ্ট ভঙ্গিতে পাখিটার পিঠে বসল শ্যাডো। নিজেকে একটা ইঁদুর বলে মনে হচ্ছে ওর। মুখে পাচ্ছে ওজোন গ্যাসের স্বাদ। আচমকা বজ্রপাতের আওয়াজ ভেসে এলো ওর কানে। থান্ডারবার্ডটা ছড়িয়ে দিল পাখনা, ঝাপটাতে শুরু করল।

বাতাসে ভাসতে শুরু করল ওরা। আপ্রাণ চেষ্টায় পাখিটার পিঠে বসে রইল শ্যাডো। 

মনে হচ্ছে যেন, বজ্রের পিঠে চড়াও হয়েছে সে। 

.

গাড়ির পেছন সিট থেকে ডালটা বের করে আনল লরা। মি. টাউনের লাশটাকে রেখে দিল গাড়ির সামনের সিটেই। গাড়ি থেকে বেরিয়ে বৃষ্টি অগ্রাহ্য করে হাঁটতে শুরু করল রক সিটির উদ্দেশ্যে। টিকিট বিক্রির বুথ বন্ধ হয়ে গেছে আগেই। তবে গিফট শপের দরজা খোলা, ওটা দিয়েই দুনিয়ার অষ্টমাশ্চার্যে পা রাখল মেয়েটা। 

কী আশ্চর্য, কেউ থামাল না ওকে! যদিও পথে বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ পড়ল বটে। ওদের অনেককেই দেখতে কৃত্রিম বলে মনে হয়। আবার কয়েকজনকে প্রায় অদৃশ্য। ঝুলন্ত একটা সেতু পার হলো লরা, তারপর পার হলো সাদা হরিণের বাগান, হাঁটল দুই পাথুরে দেয়ালের মাঝখানের পথ দিয়ে। 

সামনে পড়ল চেইন লাগানো একটা প্রবেশ পথ। ওটার সাথে ঝুলানো সাইনবোর্ড জানাচ্ছে, আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে জায়গাটাকে। তবে পাত্তা দিল না লরা। ওটা টপকে প্রবেশ করল একটা গুহায়। গুহামুখের ঠিক সামনেই একটা প্লাস্টিকের চেয়ার। এক লোক বসে আছে চেয়ারটাতে, ছোটো একটা বৈদ্যুতিক লণ্ঠনের আলোয় মন দিয়ে পড়ছে ওয়াশিংটন পোস্ট। লরাকে দেখে কাগজটা ভাঁজ করে রাখল সে, এরপর উঠে দাঁড়িয়ে বাউ করল। লোকটা লম্বা, উপলব্ধি করতে পারল মেয়েটা, মাথায় কমলা রঙের ছোটো ছোটো করে কাটা চুল। 

‘মি. টাউনের নাম নিশ্চয়ই আর জীবিতদের খাতায় নেই?’ বলল লোকটা। ‘স্বাগতম, বর্শা-বাহক। 

‘ধন্যবাদ। ম্যাকের দুর্গতির জন্য আমি দুঃখিত,’ উত্তরে জানাল লরা। ‘তোমরা বন্ধু ছিলে?’ 

‘নাহ, একদম না। তবে ওর আসলে বেঁচে থাকা উচিত ছিল। একদম সহজ একটা কাজ দিয়েছিলাম। যাই হোক, বর্শাটা এখন তোমার হাতে।’ চোখ তুলে মেয়েটার দিকে চাইল সে, অদ্ভুত এক আভা খেলা করছে সে চোখের তারায়। ‘অন্য ভাবে বলতে গেলে, তুরুপের তাস এখন তোমার মালিকানায়…আমাকে এখানকার সবাই মিস্টার ওয়ার্ল্ড নামে ডাকে।’ 

‘আমি শ্যাডোর স্ত্রী।’ 

‘ওহ, সুন্দরী লরা তুমি?’ বলল মি. ওয়ার্ল্ড। ‘আমার তোমাকে চেনা উচিত ছিল। জেলে থাকার সময় বিছানার ওপর তোমার অনেকগুলো ছবি লাগিয়ে রাখত শ্যাডো। আমরা সেলমেট ছিলাম। আরেকটা কথা বলি, কিছু মনে করো না। যে রকম উচিত ছিল, তার চাইতে অনেক বেশি সুন্দরী লাগছে তোমাকে। এতক্ষণে তো পচন ছড়িয়ে যাওয়ার কোথা, তাই নয় কি?’ 

‘হ্যাঁ,’ নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল লরা। ‘কিন্তু খামারের ওই তিন বোন আমাকে তাদের কূপ থেকে পানি এনে দিল। তারপর থেকেই…’ 

‘উর্ডের কূপ থেকে?’ ভ্রু কুঁচকে ফেলল লোকটা। ‘অসম্ভব!’ 

নিজের দিকে ইঙ্গিত করল লরা। ওর ত্বক মলিন, চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। কিন্তু কোথাও পচনের চিহ্ন নেই। জিন্দা-লাশ হতে পারে ও, তবে মৃত্যুটা বেশিক্ষণ আগে হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। 

‘বেশিক্ষণ এই অবস্থা থাকবে না,’ জানালেন মি. ওয়ার্ল্ড। ‘নর্নদের কাছ থেকে অতীতের একটু স্বাদ পেয়েছ কেবল তুমি। দ্রুতই তা বর্তমানে সাথে মিলে-মিশে যাবে। তখন ওই সুন্দর নীল চোখ দুটো গলে বেয়ে পড়তে থাকবে গালের ওপর দিয়ে। সৌন্দর্যের লেশমাত্রও অবশিষ্ট থাকবে না ওই কোমল চেহারায়। যাই হোক, আমাকে আমার ডাল দিয়ে দাও। 

পকেট থেকে এক প্যাকেট লাকি স্ট্রাইকস সিগারেট বের করে, একটা ধরাল সে। 

‘একটা দেবে?’ অনুরোধ করল লরা। 

‘অবশ্যই। একটা ডাল দাও, একটা সিগারেট নাও।’ 

‘এই ডালের দাম যে ওই সিগারেটের চাইতে অনেক বেশি, তা তুমিও জানো।’

কিছুই বলল না লোকটা। 

‘আমি অনেকগুলো প্রশ্নের জবাব চাই।’ দাবি জানাল লরা। 

একটা সিগারেট ধরিয়ে মেয়েটার দিকে এগিয়ে দিল মি. ওয়ার্ল্ড। জ্বলন্ত শলাকাটা নিয়ে বুক ভরে টান দিল লরা। ‘এবার,’ হাসল ও। ‘নিকোটিনের স্বাদটা যেন পেয়েই গেছিলাম প্রায়!’ 

‘আচ্ছা,’ আচমকা জানতে চাইল মি. ওয়ার্ল্ড। ‘খামার বাড়ির ভেতরে….ওই তিন বোনের কাছে গেছিলে কেন?’ 

‘শ্যাডোর কথা শুনে,’ জানাল লরা। ‘ও-ই বলেছিল যেতে।’ 

‘জেনে-শুনে কাজটা করেছে বলে মনে হয় না।’ বলল মি. ওয়ার্ল্ড। ‘তবে যাই হোক, মরে গেছে, ভালোই হয়েছে। ও যে আর দৃশ্যপটে নেই, সেটা ধরে নিয়েই এগোতে পারছি।’ 

‘তুমি আমার স্বামীর সাথে প্রতারণা করেছে। অথচ শ্যাডো ভালো মানুষ, সেটা জানো?’ 

‘হ্যাঁ, জানি।’ বলল মি. ওয়ার্ল্ড। ‘এসব যখন শেষ হবে, তখন একটা মিসেলটোর লাঠি নিয়ে নাহয় ওর চোখটার ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে দেব। খুশি হবে তো তাতে? এবার আমার ডাল দাও। 

‘ওটা দরকার কেন?’ 

‘স্যুভনির বলতে পারো, এই বাজে ব্যাপারটার একটা স্মৃতি,’ জানাল মি. ওয়ার্ল্ড। ‘ভয় পেয়ো না, জিনিসটা মিসেলটো নয়। ওটা আসলে একটা বর্শার প্রতীক। আর এই জঘন্য দুনিয়ায়…প্রতীকই সবকিছু।’ 

বাইরে থেকে আস্তে আস্তে জোরাল আওয়াজ ভেসে আসছে। 

‘তুমি কার পক্ষে?’ জানতে চাইল লরা। 

‘এসব কোনো একটা পক্ষের বিজয়ের জন্য হচ্ছে না। তবে জানতে যখন চাইলে তখন বলি: আমি জয়ী পক্ষে। সবসময় তা-ই ছিলাম।’ 

লরা মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিল যে ধরতে পেরেছে। তবে হাত থেকে ডালটা ছাড়ল না। লোকটার দিকে পিঠ দিয়ে ফিরল ও। অনেক নিচে, কিছু একটা স্পন্দিত হচ্ছে…জ্বলছে…নিভছে। চিৎকারও যেন ভেসে এলো একটা, তবে মিলিয়ে গেল ক্ষণিকের মাঝেই। 

‘ঠিক আছে, ডালটা আমি তোমাকে দেব।’ বলল লরা। 

‘ভালো মেয়ে,’ ঠিক ওর পেছন থেকেই ভেসে এলো মিস্টার ওয়ার্ল্ডের কণ্ঠ। ওটা কানে ঢোকা মাত্র যেন কেঁপে উঠল বেচারি। 

কিন্তু নড়ল না, স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কাছে আসতে দিতে হবে লোকটাকে, এতটাই কাছে যেন লোকটার নিশ্বাস ওর কানে অনুভূত হয়। 

তারপর নাহয়… 

.

সফরটাকে উত্তেজনাকর বললে কম বলা হয়ে যায়, অনুভূতিটাকে পুরোপুরিভাবে প্রকাশ করার মতো ভাষা শ্যাডোর জানা নেই। 

বিজলির মতো এঁকে-বেঁকে ঝড়ের ভেতর দিকে এগোল ওরা। যেন সওয়ার হয়েছে হারিকেনের মাথায়। এমন ভ্রমণের কথা কল্পনাও করা যায় না। নাহ, এক মুহূর্তের জন্যও ভয় পায়নি শ্যাডো। পেয়েছে শুধু ওড়ার আনন্দ, পেয়েছে ঝড়কে কাঁচকলা দেখিয়ে এগিয়ে যাবার উল্লাস। 

থান্ডারবার্ডটার পালক আঁকড়ে ধরে আছে শ্যাডো। স্থির বিদ্যুতের প্রভাবে খাড়া হয়ে আছে ওর হাতের লোমগুলো। বৃষ্টির ফোঁটা এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে ওর মুখমণ্ডল। 

‘অসাধারণ,’ ঝড়ের চিৎকার ছাপিয়ে উঠল ওর কণ্ঠের হুঙ্কার। 

পাখিটা যেন বুঝতে পারছে ওর উল্লাস। তাই আরও ওপরে উঠতে শুরু করল সে। ওটার ডানার প্রতি ঝাপটানির সাথে যেন বজ্র ঝলকাচ্ছে। পরক্ষণেই আবার ডাইভ দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে কালো মেঘের ভেতরে। 

‘স্বপ্নে তোমার পিছু নিয়েছিলাম আমি।’ বলল শ্যাডো। ‘একটা পালক হলেও পাবার আশায়।’ 

জানি। স্থির বিদ্যুতের ঝির ঝির শব্দ যেন পাখিটার বলা বাক্য পরিবহন করছে। অনেকেই আমাদের কাছে পালকের জন্য আসে। নিজেদের পৌরুষ প্রমাণ করতে চায়। আমাদের মাথা কাটতে চায় তারা, আমাদের জীবন উপহার দিতে চায় তাদের মৃত ভালোবাসাকে। 

মনের ভেতর একটা ছবি খেলে গেল শ্যাডোর। এক মেয়ে থান্ডারবার্ড, অন্তত পাখিটার বাদামি পালক দেখে তাই মনে হলো ওর, একটা পাহাড়ের পাশে মরে পড়ে আছে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে এক মহিলা। চকমকি পাথরের কুঠার ব্যবহার করে ওটার খুলি টুকরা টুকরা করছে। মগজ আর হাড়ের রাজ্য ভেদ করে অবশেষে একটা মসৃণ পাথর খুঁজে পেল মেয়েটা। রং ওটার গাঢ় লাল, ভেতর থেকে যেন ফুলকি বেরোচ্ছে। এটাই তাহলে ইগল স্টোন, ভাবল শ্যাডো। কী করে যেন বুঝতে পারল, তিনদিন আগে মারা যাওয়া মৃত ছেলের জন্য ওই পাথরটা নিচ্ছে মহিলা। ঠান্ডা হয়ে আসা বুকটার উপর রাখবে ওটাকে, সকাল হতেই আবার বেঁচে উঠবে ওর ছেলে। হাসবে…খেলবে। আর পাথরটা তার সব রং হারিয়ে হয়ে যাবে বিবর্ণ…মৃত! 

‘আমি বুঝতে পেরেছি,’ পাখিটাকে জানাল শ্যাডো। 

মাথা হেলিয়ে চিৎকার করে উঠল পাখিটা। কী আশ্চর্য, ওর সেই চিৎকারই আসল বজ্রপাত! 

অদ্ভুত কোনো স্বপ্নের মতো বয়ে যেতে লাগল নিচের দুনিয়া। 

.

ডালটাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল লরা, অপেক্ষা করতে লাগল মি. ওয়ার্ল্ড নামধারী লোকটা কাছে আসার। এখনও গুহার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে ও। দেখছে ঝড়…দেখছে নিচের সমবেত জনতাকে। 

এই জঘন্য দুনিয়ায়, ভাবল ও। প্রতীকই সবকিছু। একদম ঠিক 1 

ডান কাঁধের উপর একটা স্পর্শ অনুভব করল লরা। 

খুব ভালো। মিস্টার ওয়ার্ল্ড আমাকে চমকে দিতে চায় না। সে নিশ্চয়ই ভয় পাচ্ছে যে ডালটাকে ঝড়ের মাঝে ছুঁড়ে দেব; হারিয়ে ফেলবে সে ওটাকে। 

পেছন দিকে একটু হেলান দিল লরা, পিঠে লোকটার বুকের স্পর্শ পেতে থেমে গেল। এদিকে মি. ওয়ার্ল্ড থেমে নেই। তার ডান হাত জড়িয়ে ধরেছে লরাকে। বাঁ হাতটা লরার সামনে। দুই হাত দিয়ে শক্ত করে ডালটা ধরল ও, দম ছেড়ে মনঃস্থির করে নিলো। 

‘আমার ডালটা দাও, পিজ।’ ওর কানে ফিসফিস করে অনুরোধ করল লোকটা। ‘এই নাও,’ বলল লরা। তারপর অর্থ না বুঝেই, যেন অবচেতন মনে যোগ করল, ‘এই মৃত্যু আমি শ্যাডোর নামে উৎসর্গ করলাম।’ প্রাণপণ শক্তিতে ডালটাকে নিজের বুকের ভেতর ঢুকিয়ে দিল ও। অনুভব করতে পারল, ওটা তার হাতেই রূপান্তরিত হয়ে একটা বর্শা হয়ে গেছে! 

মৃত্যুর পর থেকে ব্যথা নামের অনুভূতিটা যেন হারিয়ে ফেলেছে লরা। তাই কেবল বুঝতে পারল, বর্শার ফলাটা ওর বুক-পিঠ ভেদ করে আরেকটা দেহে বাঁধা পেয়েছে। চাপ বাড়াল ও, এবার বুঝতে পারল-মি. ওয়ার্ল্ডের দেহেও গেঁথে গেছে ফলাটা। ঘাড়ের উপর সে টের পেল লোকটার বিস্মিত চিৎকার। ব্যথায় আর চমকে কুঁকড়ে গেছে যেন লোকটা। 

লোকটার উচ্চারিত শব্দগুলো বুঝতে পারল না লরা। কোন দেশি ভাষা, তা-ও না। তবে থামল না ও। বর্শার ফলাটা মি. ওয়ার্ল্ডের পিঠ দিয়ে বের না হওয়া পর্যন্ত ঠেলতে লাগল। 

‘হারামজাদী,’ ইংরেজিতে বলল মি. ওয়ার্ল্ড। ‘হারামজাদী, মাগি।’ লোকটার কণ্ঠে তারল্য চলে এসেছে। ফলাটা ওর একটা ফুসফুস ফুটো করে দিতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে হলো লরার। 

নড়ে উঠল মি. ওয়ার্ল্ড, মানে নড়ার প্রয়াস পেল আরকী। আর তার সাথে সাথে নড়তে শুরু করল লরার দেহও। দুইজনের দেহ এখন বর্শার হাতলে একসাথে বিঁধে আছে। লোকটার হাতে উঠে এসেছে একটা ছোরা। এলোপাথাড়ি ওটা দিয়ে লরার বুকে আর স্তনে আঘাত করতে শুরু করল মি. ওয়ার্ল্ড। 

তাতে অবশ্য লরার কিছু যায় আসে না। এক জিন্দা-লাশের কাছে আরও কয়েকটা ক্ষত এমনকি দাম রাখে? 

শক্ত হাতে লোকটার ছোরা ধরা হাতের কব্জিতে আঘাত হানল ও, সাথে সাথে নিচে পড়ে গেল ওটা। লাথি দিয়ে সরিয়ে দিল লরা। 

এখন একই সাথে কাঁদছে আর চিৎকার করছে মি. ওয়ার্ল্ড। লোকটার চোখ থেকে টপটপ করে গরম অশ্রু এসে পড়ছে লরার ঘাড়ে…উষ্ণ রক্ত ভিজিয়ে দিচ্ছে ওর পিঠ। 

আচমকা হুমড়ি খেল মি. ওয়ার্ল্ড, সেই সাথে লরা নিজেও। পিচ্ছিল রক্তে পা পড়ে আছাড় খেল ওরা দুজনই। 

.

রক সিটির পার্কিং লটে এসে নামল থান্ডারবার্ড। বৃষ্টি এখন অঝোর ধারায় পতিত হচ্ছে। অনেক কষ্টে সামনের কয়েক ফুট কেবল দেখতে পাচ্ছে শ্যাডো। পাখিটার পিঠ থেকে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে নামল সে। 

আচমকা বজ্রপাতের সাথে ঝলসে উঠল সারা দুনিয়া। আলো যখন কমে গেল, তখন শ্যাডো তাকিয়ে দেখে—আশপাশে পাখি নেই! 

পার্কিং লটটাকে প্রায় খালিই বলা চলে। প্রবেশপথের দিকে এগিয়ে গেল শ্যাডো। পথে একটা ফোর্ড এক্সপ্লোরার পড়ল, দেয়ালের পাশে পার্ক করে রাখা। ওটাকে কেন যেন পরিচিত বলে মনে হলো তার! ভেতরে বসে থাকা লোকটার উপর চোখ পড়ল পর মুহূর্তে। এমনভাবে লোকটা স্টিয়ারিং হুইলের ওপর ঝুঁকে আছে যেন ঘুমাচ্ছে! 

দরজাটা খুলল শ্যাডো। 

মি. টাউনকে ও শেষ দেখেছিল আমেরিকার কেন্দ্রের ওই মোটেলে। লোকটার চেহারায় বিস্ময় দেখা যাচ্ছে। দক্ষতার সাথে কেউ ঘাড় মটকে দিয়েছে বেচারার। লোকটার চেহারা স্পর্শ করল শ্যাডো। এখনও গরম আছে। 

গাড়ির ভেতর থেকে সুগন্ধির গন্ধ ভেসে আসছে। একদম হালকা গন্ধ, কিন্তু সাথে সাথেই চিনতে পারল ও। দড়াম শব্দে দরজা বন্ধ করে এগিয়ে গেল সে। 

হাঁটছে, এমন সময় দেহের পাশে এক মুহূর্তের জন্য একটা তীক্ষ্ণ ব্যথার অনুভূতি হলো ওর। 

টিকিট বুথটা ফাঁকা, কর্মচারীর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। এক মুহূর্তের জন্যও না থেমে রক সিটির বাগানের দিকে অগ্রসর হলো সে। 

গর্জে উঠল মেঘ, সেই আওয়াজে কেঁপে উঠল গাছের ডাল। বৃষ্টি যেন পণ করেছে, সবকিছু ভাসিয়ে নেবার আগে থামবে না। এখনও সন্ধ্যা হয়নি, তবে চারপাশের ঘন অন্ধকার দেখলে কে বলবে সে কথা? 

দূর থেকে ভেসে এলো একটা পুরুষ কণ্ঠ। আবছাভাবে শুনতে পেল শ্যাডো। পুরোটা বুঝতে না পারলেও, কয়েকটা শব্দ ঠিক আলাদা করতে পারল, ‘…ওডিনের উদ্দেশ্যে! 

তাড়াতাড়ি এগোতে শুরু করল শ্যাডো, একবার পিছলা খেয়ে পড়েও গেল। পাহাড়টাকে ঘিরে ভেসে আছে ঘন মেঘের একটা স্তর। 

যেখান থেকে আওয়াজ এসেছিল বলে মনে হলো, ঠিক সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলো শ্যাডো। কিন্তু, কী আশ্চর্য! কেউ নেই ওখানে! নেই আওয়াজও! 

চিৎকার করে ডাকল যুবক, মনে হলো যেন কেউ উত্তর দিচ্ছে। আবার হাঁটতে শুরু করল সে। 

নেই…কেউ নেই…কিচ্ছু নেই…কেবল একটা গুহা দেখতে পেল। ওটার সামনে একটা চেইন, দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধ বোঝাচ্ছে। 

চেইনটা টপকালো শ্যাডো, উঁকি দিল ঘন-কালো অন্ধকারের ভেতরে।

হাতের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেছে উত্তেজনায়। 

আচমকা ওর পেছন থেকে ভেসে এলো একটা কণ্ঠ। প্রায় শোনা যায় না, এমন কণ্ঠে বলল, ‘আমাকে কখনও হতাশ করো না তুমি।’ 

ঘুরল না শ্যাডো। ‘ব্যাপারটা অদ্ভুত। নিজেকে নিয়ে আমি হতাশ। সব সময়ই ছিলাম।’ 

‘আরে না,’ বলল কণ্ঠটা। ‘তোমার যা যা করণীয় ছিল, তা তা করেছ। শুধু তাই নয়, আরও বেশি করেছ। সবার নজর নিজের দিকে কেড়ে নিয়েছিলে। তাই আসলে পয়সাটা কোথায় আছে, তা কেউ ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করতে পারেনি। একেই বলা বিভ্রান্ত করা। আর তাছাড়া, নিজের সন্তানের উৎসর্গ পিতার জন্য অন্য রকম এক ক্ষমতা বয়ে আনে। খেলার শেষ পর্যায় শুরু করার জন্য সেটুকু যথেষ্ট। সত্যি বলতে কি, তোমাকে নিয়ে আমি গর্বিত।’ 

‘খেলাটা,’ বলল শ্যাডো। ‘প্রথম থেকেই পাতানো ছিল, তাই না? এখানে যুদ্ধ হতে যাচ্ছে না। হতে যাচ্ছে যজ্ঞ…হত্যাযজ্ঞ!’ 

‘বিলকুল ঠিক,’ ছায়ার ভেতর থেকে ওয়েনসডের কণ্ঠ ভেসে এলো। ‘পাতানো ছিল খেলাটা। কিন্তু শহরে যে জুয়া এই একটাই!’ 

‘আমি চাই লরাকে,’ জানাল শ্যাডো। ‘সেই সাথে লোকিকেও। ওরা কোথায়?’

উত্তরে পেল কেবল নীরবতা। বৃষ্টির ঝাপটা এসে ভিজিয়ে দিল শ্যাডোকে। ধারে কাছেই কোথাও গর্জে উঠল বজ্ৰ। 

এগিয়ে গেল শ্যাডো। 

লোকি লাই-স্মিথ মেঝেতে বসে আছে, পিঠ ঠেকিয়ে রেখেছে একটা খাঁচায়। কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে ওকে, শুধু হাত আর চেহারা বাইরে বেরিয়ে আছে। পাশেই একটা চেয়ারে রাখা হয়েছে বৈদ্যুতিক লণ্ঠন। ওটার ব্যাটারিও প্রায় শেষের দিকে, তাই হলদে একটা আবছা আলো বেরচ্ছে কেবল। 

মলিন দেখাচ্ছে বেচারাকে, ভঙ্গুর। 

কেবল চোখ দুটো বাদে। এখনও আগুন জ্বলছে ওই চোখজোড়ায়। চেয়ে চেয়ে শ্যাডোকে দেখছে। 

লোকির কয়েক পা দূরে এসে থমকে দাঁড়াল শ্যাডো। 

‘দেরি করে ফেলেছ।’ বলল লোকি, ফিসফিস করে। ‘আমি বর্শাটা ছুঁড়ে দিয়েছি, উৎসর্গ করেছি যুদ্ধটাকে। শুরু হয়েছে…হত্যাযজ্ঞ।’ 

‘ঠাট্টা করছ না তো?’ বলল শ্যাডো। 

‘নাহ, করছি না। তাই এখন তুমি যা ইচ্ছা, তাই করতে পারো। কিছু যায় আসে না।’ 

থমকে দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবল শ্যাডো। তারপর বলল, ‘যুদ্ধটা শুরু করার জন্য তোমার এই বর্শা ছুঁড়ে দেওয়াটা জরুরি ছিল। ঠিক ওই উপশালার ব্যাপারটার মতো। এই যুদ্ধ থেকেই শক্তি পাচ্ছ, ঠিক বলেছি না?’ 

চুপ করে রইল লোকি। 

‘মোটামুটি ধরতে পেরেছি সব,’ বলল শ্যাডো। ‘ঠিক কখন পারলাম, তা বলতে পারি না। সম্ভবত যখন গাছে ঝুলছিলাম, তখন। ওয়েনসডে ক্রিসমাসের সময় আমাকে একটা কথা বলেছিলেন।’ 

চুপচাপ ওর দিকে তাকিয়ে রইল লোকি, বলল না কিছুই। 

‘প্রতারণাটা করতে দুইজন দরকার,’ বলল শ্যাডো। ‘যেমন ওই ফিডল গেম। যেমনটা ছিল ওই বিশপ আর পুলিসের প্রতারণা। দুই পক্ষে দুই জন, অথচ তাদের উদ্দেশ্য এক!’ 

ফিসফিস করে উঠল লোকি, ‘বোকার মতো কথা বলছ।’ 

‘তা হবে কেন? তুমি মোটেলে যে অভিনয় করেছিলে, সেটার প্রশংসা করতেই হয়। ওখানে তোমার থাকাটা ছিল জরুরি, সবকিছু পরিকল্পনা মোতাবেক চলছে তা নিশ্চিত করার জন্য। আমি তোমাকে দেখেছিলাম, কেন তুমি ওখানে তা সম্ভবত বুঝতেও পেরেছিলাম। কিন্তু তুমিই যে মিস্টার ওয়ার্ল্ড, সেটা একদম বুঝতে পারিনি।’ 

একটু উঁচু কণ্ঠে বলল এবার শ্যাডো। ‘বেরিয়ে আসুন। যেখানেই থাকুন না কেন, আমার সামনে এসে দাঁড়ান।’ 

গুহামুখ দিয়ে ভেতরে ভেসে এলো বাতাস, সাথে করে নিয়ে এলো বৃষ্টির পানি। কেঁপে উঠল শ্যাডো। 

‘আর ঘুঁটি হতে চাই না আমি,’ বলল শ্যাডো। ‘নিজের চেহারা দেখান। আমি দেখতে চাই আপনাকে।’ 

গুহার ভেতরের ছায়ায় কাঁপন উঠল। ‘তুমি একটু বেশিই জেনে ফেলেছ, বাছা।’ ওয়েনসডের পরিচিত কণ্ঠটা শুনতে পেল শ্যাডো। 

‘তাহলে আপনি মারা যাননি!’ 

‘গেছি,’ ছায়ার ভেতর থেকে বললেন ওয়েনসডে। ‘নইলে এসব কিছুতেই সম্ভব হতো না।’ প্রায় মিলিয়ে গেল তার কণ্ঠ। কালি, মরিগান আর ওই বালের আলবেনিয়ানরা কোনোদিন এক হতো না। আমি ছিলাম বলির পাঁঠা, আমার মৃত্যুই সবাইকে যুদ্ধে নাম লেখাতে বাধ্য করেছে।’ 

‘নাহ,’ বলল শ্যাডো। ‘আপনি বলির পাঁঠা নন, আপনি বিশ্বাসঘাতক পাঁঠা।’

কালো ছায়ায় আবার কাঁপন উঠল যেন। ‘একদম না। তোমার কথার অর্থ দাঁড়ায়, আমি নতুন দেবতাদের জন্য পুরনো দেবতাদের সাথে দুই নম্বুরি করছি। তেমন কিছুই হচ্ছে না এখানে। 

‘একদম না।’ ফিসফিস করে সম্মতি জানাল লোকি। 

‘তা তো আমিও বুঝতে পারছি না,’ বলল শ্যাডো। ‘তোমরা একপক্ষকে ধোঁকা দিচ্ছ না, উভয় পক্ষকে দিচ্ছ! 

‘হুম, সেরকমই কিছু একটা।’ গর্বিত কণ্ঠে বললেন ওয়েনসডে। 

‘আপনাদের আসলে দরকার রক্তক্ষয়…চাই উৎসর্গ। আর সেজন্য বেছে নিয়েছেন দেবতাদের 

তীব্র বেগে বইছে বাতাস, গুহার সামনে যেন চিৎকার করে নাচন-কুদনে লিপ্ত তারা। 

‘ক্ষতি কী? এই জঘন্য দেশে আমি প্রায় বারোশ বছর ধরে বন্দী। আমি ক্ষুধার্ত, আমি তৃষ্ণায় কাতর…রক্ত ছাড়া এই ক্ষুৎপিপাসা মেটার নয়।’ 

‘মৃতদের রক্ত-মাংস ভোগ করে নিজেকে ক্ষমতাশালী করে তোলেন আপনি।’

ওয়েনসডেকে যেন এখন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে শ্যাডো। প্রতিটা মুহূর্তে নিরাকার থেকে সাকার হচ্ছে তার অবয়ব। তবে কেবলমাত্র আড়চোখে তাকালেই তা বুঝতে পারছে ও। ‘আমার উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত মৃত্যুই কেবল আমাকে শক্তিশালী করে তোলে।’ 

‘যেমন গাছে ঝুলন্ত অবস্থায় আমার মৃত্যু।’ বলল শ্যাডো। 

‘ওটা আলাদা,’ জানালেন ওয়েনসডে। ‘বিশেষ কিছু।’ 

‘তুমিও মৃত্যু চাও?’ লোকির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল শ্যাডো।

ক্লান্ত ভঙ্গিতে এপাশ-ওপাশ মাথা দোলাল লোকি। 

‘তুমি ক্ষমতা পাও বিশৃঙ্খলা থেকে।’ উপলব্ধি করতে পারল শ্যাডো। 

কথা শুনে হাসল লোকি, ক্লিষ্ট হাসি। কমলা রঙের ফুলকি খেলে গেল ওর চোখে। 

‘তোমাকে ছাড়া এসব কিছুই সম্ভব হতো না।’ বললেন ওয়েনসডে। ‘অনেক নারীর সাথে শুয়েছি আমি…’ 

‘আপনার একজন সন্তান দরকার ছিল।’ ধরতে পারল শ্যাডো। 

‘আমার তোমাকে দরকার ছিল বাছা। হ্যাঁ, আমার ঔরসজাত সন্তান। আমি জানতাম, তোমার মার গর্ভে তুমি এসেছ। কিন্তু দেশ ছেড়ে চলে যায় তোমার মা। আমাদের অনেক সময় লেগেছে তোমাকে খুঁজে বের করতে। যখন সফল হলাম, তখন তুমি জেলে! তোমার ব্যাপারে জানতে হতো আমাদের। কী তোমাকে আনন্দ দেয়? কোন জিনিসটা স্থবির করে তোলে? তুমি আসলে কে?’ নিজের কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট মনে হলো লোকিকে। ‘জানতে পারলাম, ঘরে তোমার ফেরার অপেক্ষায় আছে একজন স্ত্রী। তাই পুরো কাজটা কঠিন হয়ে গেল। কঠিন হলেও, অসম্ভব নয়! 

‘মেয়েটা তোমার যোগ্য ছিল না,’ যোগ করল লোকি। ‘ওকে ছাড়াই তুমি ভালো আছ।’ 

‘অন্য কোনোভাবে যদি কাজটা করা সম্ভব হতো…’ বললেন ওয়েনসডে, এবার শ্যাডো বুঝতে পারল তার বাক্যের উদ্দেশ্য। 

 শালার বেটি মরেও মরল না।’ হাঁপাতে শুরু করেছে লোকি। ‘উড আর স্টোনের মতো কর্মচারী সহজে মেলে না। ট্রেন ডাকোটা পার হলেই, তোমাকে পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দেওয়া হতো।’ 

‘লরা কোথায়?’ জানতে চাইল শ্যাডো। 

মলিন একটা হাত তুলে গুহার পেছন দিকে ইঙ্গিত করল লোকি।

‘ওদিকে গেছে,’ বলেই সামনের দিকে ঝুঁকে গেল ওর দেহ। 

কম্বলটা এতক্ষণ রক্তের একটা ছোটোখাটো ডোবাকে ঢেকে রেখেছিল। সেই সাথে লোকির বুকের-পিঠের ক্ষতও। ‘কী ব্যাপার?’ জানতে চাইল ও। 

উত্তর দিল না লোকি। 

লোকটা আর কোনোদিন কথা বলবে না। 

‘ব্যাপার হচ্ছে-তোমার স্ত্রী,’ ওয়েনসডের কণ্ঠ বলল। কেন যেন আস্তে আস্তে আবার উধাও হয়ে যেতে শুরু করেছেন তিনি। ‘তবে এই যুদ্ধের কারণে আবার ফিরে আসবে ও। সেই সাথে চিরতরে ফিরব আমিও। আমি একটা ভূত, আর লোকি লাশ। কিন্তু সেই পর্যন্ত জিত আমাদেরই। পাতানো খেলা, বুঝলে?’ 

‘পাতানো খেলাগুলোই,’ শ্যাডো ওয়েনসডের কথা ওয়েনসডেকেই শুনিয়ে দিল। ‘জেতা সবচাইতে সহজ।’ 

কিন্তু উত্তর পেল না। বন্ধ হয়ে গেছে ছায়ার কাঁপুনি। 

‘বিদায় পিতা।’ বলল শ্যাডো। 

বাইরে বেরিয়ে এলো ও, পুরো এলাকা নিশ্চুপ। নেই চিৎকার-চেঁচামেচি, নেই তলোয়ারের আওয়াজ। একেবারেই একা এখানে সে। 

নাহ, ভুল হলো। 

এই জায়গার নাম রক সিটি। এই সেই জায়গা যেখানে প্রতি বছর লাখো লাখো লোক বিস্মিত হতে আসে। এখানে বাস্তবতার পর্দা পাতলা। শ্যাডো বুঝতে পারল, আসল যুদ্ধটা কোথায় হচ্ছে। 

ক্যারোসেলে চড়ার সময় যে অনুভূতি হয়েছিল, সেটাকে আবার নিজের মাঝে তুলে আনার প্রয়াস পেল শ্যাডো। মনে করার চেষ্টা করল উইনিব্যাগোর আচমকা উধাও হয়ে যাবার মুহূর্তটাকে— 

আর তারপর, একেবারে মাখনের মতো মসৃণ আয়াসে, নিখুঁতভাবে ঘটল ঘটনাটা… 

…মঞ্চের পেছনে এসে উপস্থিত হলো ও। 

এখনও একটা পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে সে, এই ব্যাপারটার পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু বাকি সবকিছুই পরিবর্তিত। এই পাহাড়টা সবকিছুর কেন্দ্রে। এর সামনে লুকআউট পাহাড় আসলে কিছুই না। 

এটাই ঘটনাস্থল। 

চারপাশের পাথুরে দেয়ালগুলো একটা প্রাকৃতিক অ্যাম্ফিথিয়েটারের কাজ করছে। ওগুলোর ভেতর দিয়ে এঁকে-বেঁকে এগিয়ে যাওয়া পথগুলো জন্ম দিয়েছে কিছু সেতুর। 

আর আকাশ… 

আকাশের রং ঘন কালো। তবে আলো জ্বলছে ওখানে, সেই আলোতে নিচের দুনিয়াকে দেখাচ্ছে সবুজাভ-সাদা। কালো আকাশ, তবে আলোটা যেন সূর্যের চাইতে উজ্জ্বল। 

ওটা আসলে বজ্রপাতের আলো, বুঝতে পারল শ্যাডো। বিজলি চমকাবার মুহূর্তটাকে জমিয়ে রাখা হয়েছে অনন্তকালের জন্য। 

মানুষ বিশ্বাস করে, ভাবল শ্যাডো। এটাই মানুষের কাজ। তারা বিশ্বাস করে। কিন্তু সেই বিশ্বাসের দায়-দায়িত্ব নিতে চায় না। কল্পনা করে, কিন্তু সেই কল্পনা বাস্তব হয়ে সামনে এসে দাঁড়ালে আর তাতে ভরসা রাখতে পারে না। মানুষ শূন্যতাকে ভরিয়ে তোলে ভূত, দেবতা আর ইলেকট্রনের গল্পে। মানুষ ভাবে, মানুষ বিশ্বাস করে। আর সম্ভবত…খুব সম্ভবত…সেই বিশ্বাসের কারণেই মেলে বস্তু। 

পাহাড়ের শীর্ষ এখন যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, সেটা সাথে সাথেই বুঝতে পারল শ্যাডো। দুই পাশে জড়ো হয়েছে দুই সেনাদল। 

আকারে সেনাদের প্রত্যেকেই বিশাল, আসলে আমেরিকা জায়গাটাই এমন…যেখানে সবকিছুই বেশি বেশি। 

পুরাতন দেবতারা ভিড় করেছে এক পাশে। পুরাতন মাশরুমের মতো বাদামি চামড়ার দেবতা, আবার সদ্য ছাল ছাড়ানো মুরগির মতো গোলাপি ত্বকের দেবতাও আছে। কেউ কেউ পাগল, আবার কেউ কেউ সুস্থ। পুরাতন দেবতাদের চিনতে পারল শ্যাডো। ওদের অনেকের সাথেই পরিচয় হয়েছে ওর। তাদের মাঝে আছে ইফ্রিত আর পিস্কিরা, আছে বামন আর দৈত্যরা। রোড আইল্যান্ডের অন্ধকার ঘরে দেখা হওয়া সেই মহিলাও আছে, তার চুলের জায়গায় কিলবিল করছে সাপ। মামা-জীকেও দেখতে পেল ও। সবাইকে চিনতে পারছে শ্যাডো। 

এমনকী চিনতে পারছে নতুন দেবতাদেরও। 

একজনকে দেখতে পাচ্ছে পরিষ্কার, সে রেলরোড ব্যারন না হয়ে যায়ই না। আছে বিমানের দেবতা, গাড়ির দেবতারাও বাদ যায়নি। ওদের কালো গ্লাভসে লেগে আছে রক্ত, ক্রোমের দাঁতগুলো খিচিয়ে আছে। অ্যাজটেকদের পর আর কেউ এত বেশি মনুষ্য বলি পায়নি। 

সবার জন্য করুণা বোধ করল শ্যাডো। 

নতুন দেবতাদের মাঝে অহংকার দেখতে পেল ও, সেই সাথে অজানা এক ভয়ও। তাদের ভয়-সদা পরিবর্তনশীল দুনিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে, দুনিয়াকে নিজের মতো বা নিজেকে দুনিয়ার মতো সাজাতে না পারলে, স্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে হবে! 

বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুই সেনাদল। উভয়ের কাছেই বিপক্ষ দল 

অশুভ…ওরা রাক্ষস…দানব। 

প্রাথমিক লড়াই এরইমাঝে হয়ে গেছে, পাথরের ওপরে পড়ে থাকা রক্ত দেখে তা বুঝতে পারল শ্যাডো। 

সত্যিকারের যুদ্ধের জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করছে তারা। এখনই যা করার করতে হবে ওকে। নয়তো অনেক বেশি দেরি হয়ে যাবে। 

আমেরিকায় সবকিছু যেন চিরকাল ধরে চলতে থাকে। ওর মনের ভেতর কে জানি বলে উঠল। ১৯৫০ সাল টিকে ছিল হাজারও বছর। কে বলেছে তোমার সময় নেই? তাড়াহুড়ো করছ কেন? 

কিছুটা হেঁটে, কিছুটা হোঁচট খেতে খেতে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগোল শ্যাডো। সবার দৃষ্টি নিজের উপর অনুভব করতে সক্ষম হলো ও। কিছু নজর চোখের, আবার কিছু নজর চোখ বাদে অন্য কিছুর। কেঁপে উঠল যুবক। 

মহিষ-মানব কথা বলে উঠল ওর মনে। যা করছ, ঠিকভাবেই করছ। শ্যাডো ভাবল। অবশ্যই ঠিকভাবে করছি। আজ সকালে মৃত্যুর ওপার থেকে ফিরে এসেছি আমি। তার তুলনায় সবকিছুই একদম…জলবৎ তরলং। 

‘বুঝলে তোমরা,’ এমনভাবে শুরু করল শ্যাডো যেন গল্প করছে। ‘একে যুদ্ধ বলা চলে না। শুরু থেকে কখনওই যুদ্ধ হবার পরিকল্পনা ছিল না। কেউ যদি ভাব যে লড়তে এসেছ, তাহলে বোকার স্বর্গে বাস করছ রে ভাই।’ উভয় পক্ষ থেকেই হই-হল্লার আওয়াজ আসতে শুনল শ্যাডো। বুঝতে পারল, ওর কথা শুনে কেউ খুশি হচ্ছে না। 

‘আমরা আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য লড়ছি,’ এক মিনেটর বলে উঠল।

‘আর আমরা আমাদের!’ অন্য পাশ থেকে বলে উঠল আরেকজন। 

‘এই দেশ…এই জমি, দেবতাদের জন্য অনুর্বর।’ বলল শ্যাডো। শুরু হিসেবে কালজয়ী না হলেও, আপাতত এতেই কাজ চালিয়ে নিতে হবে। ‘তোমরা সবাই সম্ভবত সেটা নিজেদের মতো করে বুঝতে পেরেছ। পুরাতন দেবতাদের সবাই অগ্রাহ্য করে। নতুনদেরকে ভুলে যায় তারা পুরনো হবার আগেই। এখানে উপস্থিত সবাই হয় ভুলে যাওয়া হয়েছে, নয়তো ভুলে যাওয়া হবে—এই ভয়ের ভেতর বাস করছে।’ 

কমে এসেছে হল্লা। এমন কিছু কথা শ্যাডো বলেছে, যেগুলোর সাথে সবাই একমত। এখন ওর কথা মন দিয়ে শুনবে তারা। 

‘অনেকদূরের এক দেশ থেকে এদেশে এসেছিল এক দেবতা। এখানকার মানুষজন আস্তে আস্তে তার উপর থেকে বিশ্বাস হারাতে শুরু করল। সেই সাথে কমতে শুরু করল সেই দেবতার ক্ষমতাও। উৎসর্গ আর বলির মাধ্যমে ক্ষমতা লাভ করত সেই দেবতা। বিশেষ করে যুদ্ধ আর মৃত্যু থেকে। যুদ্ধে যারা মারা যেত, তাদের মৃত্যুকে তার উদ্দেশ্যে ভেট হিসেবে পাঠানো হতো। 

‘অনেক পুরাতন এক দেবতা তিনি। ধারণা করা হয়, সবচেয়ে ধূর্তও সেই তিনিই। আরেক দেবতার সাথে মিলে কাজ করতেন, দ্বিতীয় সেই দেবতা হলো বিশৃঙ্খলা আর প্রতারণার দেবতা। একসাথে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে সর্বস্বান্ত করে ফেলতেন তারা। 

‘পঞ্চাশ কী একশ বছর আগে, বিশেষ এক পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ করতে শুরু করেন তারা। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতার অভূতপূর্ব এক উৎস নির্মাণ করা, এমন এক উৎস যেখান থেকে দরকার মতো শক্তি নিতে পারবেন। এমন কিছু, যেটা তাদের কল্পনার চাইতেও শক্তিশালী করে তুলবে। হাজার হলেও, বলি হিসেবে দেবতাদের লাশের চাইতে শক্তিশালী আর কী হতে পারে? 

‘বুঝতে পারছ আমার কথা? 

‘এই যে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছ তোমরা, তার ফলাফলে তাদের কিছুই যায় আসে না। তাদের দরকার যথেষ্ট সংখ্যক দেবতার মৃত্যু। তোমাদের মৃত্যু শক্তি যোগায় সেই বিশেষ দেবতাকে।’ 

আচমকা চিৎকারের আওয়াজ ভেসে এলো যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। আওয়াজের উৎসের দিকে তাকাল শ্যাডো। বিশালদেহী এক লোককে দেখতে পেল সে। লোকটার ত্বক মেহগনি রঙা; নগ্ন বুক আর মাথায় একটা হ্যাট পরে আছে। মুখে ঝুলছে সিগার। কবরের মতো গভীর কণ্ঠে ব্যারন সামেডি বলল। ‘বুঝলাম, কিন্তু ওডিন…ওডিন তো মারা গেছেন। শান্তি আলোচনার সময় এই হারামজাদারা ওকে খুন করেছে। আমি মৃত্যুকে চিনি, এই ব্যাপারে আমাকে ধোঁকা দেওয়া সম্ভব না।’ শ্যাডো বলল, ‘সত্যি সত্যি না মরলে কি এই যুদ্ধ হতো? যখন এটা শেষ হবে, তখন আগের চাইতে শক্তিশালী হয়ে ফিরবেন তিনি।’ 

‘তুমি কে?’ জানতে চাইল কেউ একজন। 

‘আমি তার…তার পুত্র। 

নতুন দেবতাদের একজন বলল, ‘কিন্তু মিস্টার ওয়ার্ল্ড বলেছিল…’ 

‘মিস্টার ওয়ার্ল্ড বলে কেউ নেই…কেউ ছিলও না কখনও। ওই হারামজাদা তোমাদেরকে ধোঁকা দিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চেয়েছিল।’ 

শ্যাডোর কথা বিশ্বাস করল সবাই। ‘আমার কি মনে হয় জানো?’ মাথা নেড়ে বসল ও। ‘দেবতা হবার চাইতে, মানুষ হওয়া ভালো। আমাদের কারও বিশ্বাসের দরকার হয় না। আমরা ওসব ছাড়াও জীবন এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।’ 

নীরবতা নেমে এলো পাহাড়ের শীর্ষে 

তারপর আচমকা, বিকট আওয়াজ করে, পাহাড়ের উপর আছড়ে পড়ল বিজলী। অন্ধকার হয়ে গেল চারপাশ। 

তবে জ্বলতে শুরু করল উপস্থিত অনেকে। 

শ্যাডোর মনে হলো, এরা বুঝি ওর সাথে ঝগড়া শুরু করবে। অথবা মেরে ফেললেও ফেলতে পারে। যাই হোক না কেন, অপেক্ষা করতে লাগল ও। 

আচমকা টের পেল, জ্বলতে থাকা অস্তিত্বগুলো আস্তে আস্তে উধাও হয়ে যেতে শুরু করেছে। দেবতা বিদায় নিচ্ছে জায়গাটা থেকে, প্রথমে কয়েকজন কয়েকজন করে…তারপর একসাথে অনেকে। 

রটওয়াইলার আকারের একটা মাকড়শা এগিয়ে এলো ওর দিকে। অসুস্থ বোধ হলেও, দাঁড়িয়ে রইল শ্যাডো। 

কাছাকাছি এসে মি. ন্যান্সির কণ্ঠে প্রাণিটা বলল। ‘ভালো কাজ দেখিয়েছ বাছা, আমি গর্বিত।’ 

‘ধন্যবাদ।’ 

‘তোমাকে এখান থেকে বের করে নেওয়া দরকার। বেশি সময় থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বে।’ বলতে বলতেই নিজের একটা বাদামি পা দিয়ে ওর কাঁধ স্পর্শ করল প্রাণিটা… 

পরক্ষণেই নিজেকে ও আবিষ্কার করল লুকআউট পাহাড়ে। মি. ন্যান্সি শ্যাডোর কাঁধে হাত রেখে কাশছে। বন্ধ হয়ে গেছে বৃষ্টিপাত। পেটের এক পাশ হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে মি. ন্যান্সি। কোনো সমস্যা হয়েছে কি না, জানতে চাইল শ্যাডো। 

‘আরে না,’ জানাল মি. ন্যান্সি। ‘আমি শক্ত-পোক্ত মানুষ।’ তবে কণ্ঠ শুনে তা মনে হলো না, মনে হলো যেন সে প্রচণ্ড ব্যথায় সংকুচিত হয়ে আছে। 

অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে আশপাশে, বসেও আছে কেউ কেউ। কম-বেশি আহত সবাই। 

আকাশে একটা গুঞ্জনের মতো শব্দ শুনতে পেল শ্যাডো, দক্ষিণ দিক থেকে আসছে। ‘হেলিকপ্টার?’ মি. ন্যান্সির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল ও। 

মাথা দোলাল মি. ন্যান্সি। তবে ভয়ের কিছু নেই। ওরা সবকিছু আগের মতো করে গুছিয়ে দিয়ে বিদায় নেবে।’ 

‘ঠিক আছে।’ 

শ্যাডো জানে, সবকিছু আগের মতো করার আগে একটা জিনিস দেখতে চায় ও। ধূসর চুলো এক লোকের কাছ থেকে ফ্ল্যাশ লাইট ধার নিয়ে খুঁজতে শুরু করল তাই। 

লরাকে খুঁজে পেল একটা পার্শ্ব-গুহার মেঝেতে। রক্তে আঠা-আঠা হয়ে আছে মেঝেটা। কাত হয়ে শুয়ে আছে মেয়েটার দেহ। একটা হাত মুঠো করে ধরে আছে বুকে, খুব নাজুক দেখাচ্ছে লরাকে। সেই সাথে মৃতও। তবে এতদিনে শ্যাডোর তা সয়ে গেছে। 

চারজানু হয়ে মেয়েটার পাশে বসল শ্যাডো, হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল গাল। আলতো করে ডাকল নাম ধরে। চোখ খুলে গেল লরার, মাথাটা একটু বাঁকিয়ে সরাসরি শ্যাডোর চোখের দিকে তাকাল সে। 

‘হ্যালো, পাপি।’ ক্ষীণ কণ্ঠে বলল লরা।

‘হাই, লরা। এখানে কী হয়েছে?’

‘তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। ওরা জিতেছে?’ 

‘যুদ্ধ শুরু হবার আগেই আমি থামিয়ে দিয়েছি।’

‘আমার চালাক পাপি,’ বলল লরা। ‘ওই মিস্টার ওয়ার্ল্ড লোকটা বলল, তোমার চোখে গেঁথে দেবে একটা ডাল ব্যবহার। আমার লোকটাকে একদম পছন্দ হয়নি।’ 

‘মারা গেছে, সোনামণি। তুমি ওকে খুন করেছ।’ 

‘ভালো।’ বলে চোখ মুদল লরা। 

মেয়েটার ঠান্ডা হাত নিজের হাতে নিলো শ্যাডো, বসে রইল চুপচাপ। অনেকক্ষণ পর আবার চোখ খুলল লরা। 

‘আমাকে আবার জীবিত করার উপায় খুঁজে পেয়েছ?’ জানতে চাইল ও। ‘বলতে পারো। অন্তত একটা উপায় আমি জানি।’ 

‘খুব ভালো,’ আলতো করে চাপ দিল লরা শ্যাডোর হাতে। ‘আর উলটোটা চাই যদি?’ 

‘উলটোটা?’ 

‘হ্যাঁ,’ ফিসফিস করে বলল লরা। ‘আমার মনে হয়, ওটা এখন আমার প্রাপ্য।’

‘আমি যে চাই না।’ 

কিছুই বলল না লরা, অপেক্ষা করল চুপ করে। 

অনেকক্ষণ পর শ্যাডো বলল, ‘ঠিক আছে।’ মেয়েটার হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রাখল তার ঘাড়ে। 

‘এই না হলে আমার স্বামী।’ গর্ব খেলে গেল লরার কণ্ঠে। 

‘ভালোবাসি, সোনামণি।’ বলল শ্যাডো। 

‘আমিও, পাপি।’ লরার উত্তর। 

মেয়েটার ঘাড়ের সাথে ঝুলতে থাকা সোনালি পয়সা আঁকড়ে ধরল শ্যাডো। শক্ত করে টান দিতেই ছিঁড়ে গেল মালা। সোনালি কয়েনটা তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলির মাঝে নিয়ে ফুঁ দিতেই, উধাও হয়ে গেল ওটা 

এখনও খোলা আছে লরার চোখ দুটো, কিন্তু নড়ছে না। 

নিচু হয়ে ঠান্ডা গালে চুমু গেল শ্যাডো, কিন্তু লরার তরফ থেকে প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। দেখা যাবে, তেমনটা আশাও করেনি শ্যাডো। উঠে দাঁড়িয়ে গুহামুখের দিকে এগিয়ে গেল ও। 

ঝড় বন্ধ হয়ে গেছে। বাতাস তাজা আর পরিষ্কার। আগামীকাল, কোনো সন্দেহ নেই—ভাবল শ্যাডো। দারুণ এক দিন হতে চলেছে। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *