আমেরিকান গডস – ১৭

অধ্যায় সতেরো 

এই মহাদেশের সবই সুবিশাল। এর নদীগুলো দিগন্ত বিস্তৃত, আবহাওয়া হয় খুব বেশি গরম আর নয়ত তীব্র ঠান্ডা। এখানকার বজ্রপাত কানে তালা লাগিয়ে দেয়, এখানে যে কেউ গড়ে তুলতে পারে এক সুন্দর ভবিষ্যৎ। তাই এসবের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের ভুল, অন্যায় আচরণ, ক্ষতি, অপমান আর ধ্বংসও চরম পর্যায়ের। 

–জর্জ সেলউইনকে লর্ড কার্লাইল, ১৭৭ 

.

আমেরিকার দক্ষিণ-পূর্বের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটার কথা লেখা আছে জর্জিয়া আর টেনেসির সব প্রাচীন খামারের বার্নে। বিজ্ঞাপন সেই কেন্টাকিতে পৌঁছাবার আগে গিয়ে শেষ হয়নি। প্যাঁচালো রাস্তা দিয়ে যে কেউ এগোলেই দেখতে পাবে সেগুলো। জীর্ণ হয়ে আসা যেকোনো বার্নের ছাদের বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা: 

পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য
রক সিটি দেখুন 

সেই সাথে কাছের কোন ধসে পড়তে বসা, দুধ দোয়াবার ঘরে সাদা বড়ো হাতের অক্ষরে লেখা থাকবে: 

রক সিটিতে দাঁড়িয়ে দেখুন সাতটা রাজ্য 
পৃথিবীর আর কোথাও এমনটা নেই 

এসবের ফলে ড্রাইভারের ধারণা হয়, রক সিটি নিশ্চয়ই খুব কাছেই। অথচ প্রকৃতপক্ষে সম্ভবত সেটায় যেতে হলে গাড়ি চালাতে হবে আরও একদিন। জর্জিয়া রাজ্যে একদম সীমানাতেই, টেনেসির চাট্টানুগার কিছুটা দক্ষিণ-পশ্চিমে, লুকআউট পাহাড়ে অবস্থিত ওটা। 

লুকআউট পাহাড় কেবল নামেই পাহাড়, উচ্চতায় ওটা বড়োসড়ো টিলার সমান হবে হয়তো। সাদারা যখন এখানে পা রাখে, তখন চেরোকি ইন্ডিয়ানদের একটা গোত্র, চিকামাউগা বাস করত পাহাড়ে। ওরা অবশ্য একে ডাকত চোয়াট্টোটনোগি বলে। আক্ষরিক অর্থ করলে যার অর্থ দাঁড়ায়-একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত বড়ো হওয়া পাহাড়। 

১৮৩০ সাল, অ্যান্ড্রু জ্যাকসনের ইন্ডিয়ান পুনর্বাসন আইনের আওতায় পড়ে যায় বলে আদি নিবাস ছাড়তে হয় তাদের। চকতো, চিকামাউগা, চেরোকি আর চিকাস-ইউএস সেনাদের পাল্লায় পড়ে সবাইকে প্রায় এক হাজার মাইল হেঁটে নতুন আবাস গাড়তে হয় বর্তমান ওকলাহোমায়। পুরো ব্যাপারটাকে ঠান্ডা মাথায় খুন বললেও অত্যুক্তি হবে না। হাজার হাজার নারী-পুরুষ-বাচ্চা প্রাণ হারায় পথে। যুদ্ধে জয় মানে যুদ্ধে জয়, তারপর যা-ই করা হোক না কেন-তাতে কিছু যায়- আসে না। 

জায়গাটা দখলের কারণও ছিল। যার অধীনে থাকবে লুকআউট পাহাড়, সেই নিয়ন্ত্রণ করবে পুরো এলাকাটা-অন্তত কিংবদন্তি তা-ই বলে। জায়গাটা ইন্ডিয়ানদের কাছে পবিত্র, আবার একই সাথে আশপাশের মাঝে সবচেয়ে উঁচুও। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় এখানে রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধ হয়েছিল। প্রথম দিনের যুদ্ধটা হয়েছিল মেঘের ওপরে, তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে যুদ্ধে জিতে গেছিল ইউনিয়ন আর্মি। এরপর কোনো ধরনের অর্ডার ছাড়াই মিসৌরি রিজটাও নিয়ে এসেছিল নিজেদের দখলে। উত্তর দখল করেছিল লুকআউট পাহাড়, আর উত্তরই জিতেছিল যুদ্ধে। 

পাহাড়ের গভীরে রয়েছে অগণিত সুড়ঙ্গ আর গুহা, এদের মাঝে অনেকগুলোকে প্রাচীন বলা চলে। এখন অবশ্য প্রায় সবগুলোই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অবশ্য স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর পৃষ্ঠপোষকতায় কিছুদিন আগেই আবিষ্কার হয়েছে ভূ-গর্ভস্থ একটা ঝরনা। লোকটা সেই ঝরনার নাম দিয়েছে রুবি ফলস। এলিভেটর ব্যবহার করে যাওয়া-আসা করতে হয়। পর্যটকরা আসে ঝরনাটা দেখতে, তবে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আসে পাহাড়ের শীর্ষে অবস্থিত রক সিটি দেখতে! 

রক সিটির শুরু হয়েছিল পাহাড়ের পাদদেশে একটা শখের বাগান হিসেবে। নানা ধরনের পাথরের ভেতর আর ওপর দিয়ে তখন পর্যটকরা ঘুরে বেড়াত। কখনও পাশের এনক্লোজারে থাকা হরিণের দিকে ছুড়ে দিত ভুট্টা, পথের মাঝে ঝুলন্ত সেতু দেখতে পেয়ে হতো আনন্দে আত্মহারা। তবে এখানকার সবচেয়ে বড়ো আকর্ষণ নিঃসন্দেহে কোয়ার্টার ডলার খরচ করে বিনকিউলারে চোখ রাখা, আশপাশের সাতটা রাজ্য দেখা যায় এই একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে। তবে অবশ্যই, রৌদ্রজ্জ্বল দিন হলে কেবল তবেই। এখানেই অবশ্য পথের শেষ না, সামনে অপেক্ষা করে আছে গুহা। প্রতি বছর লাখ-লাখ পর্যটককে নিয়ে সেগুলো চলে যায় পাহাড়ের গভীরে। সেখানে তারা দেখে পুতুল আর নানা রূপকথার আদলে তৈরি চিত্রকর্ম। ফেরার পথে আচ্ছন্ন থাকে সবাই। কেন এসেছে, কী দেখেছে বা দেখে সন্তুষ্ট হয়েছে কি না—কোনো বিষয়েই নিশ্চিত থাকে না। 

.

যুক্তরাষ্ট্রের আনাচ-কানাচ থেকে দলে দলে এসে তারা জড়ো হয়েছে লুকআউট পাহাড়ে। তবে এই তারা কিন্তু সাধারণ পর্যটক নয়। গাড়িতে, বাসে, বিমানে, ট্রেনে…এমনকী পায়ে হেঁটেও এলো তারা। কেউ কেউ এলো উড়ে, তবে অবশ্যই রাতের আঁধারে। কয়েকজন আবার পাতালে চলাচল করতে জানে, তারা এলো সেভাবেই। ট্রাক ড্রাইভার বা মোটরিস্টদের কাছে লিফট নিয়েও এলো অনেকে। 

তবে প্রায় সবার মাঝেই একটা মিল আছে-ক্লান্তিতে ভেঙে পড়া ধুলা-ভরা দেহে সবাই উপস্থিত হয়েছে লুকআউট পাহাড়ের পাদদেশে। আসা শুরু হয়েছে সেই ভোরে, মাঝখানে কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আরেকটা বড়ো দল এসেছে সকাল বেলা। তবে সবাই আসতে আসতে কয়েকদিন সময় লেগে গেল। 

জীর্ণ আর বহু ব্যাবহারে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত একটা ইউ-হল ট্রাকে করে এলো বেশ কজন ভিলা[১১] আর রুসালকা[১২]। এই মেয়েদের চেহারা অবস্থা তথৈবচ, মেক-আপ শোচনীয়। 

[১১. স্লাভিক পরী, আমাদের দেশের নিশির মতো 
১২. শভিক জলপরী]

পাদদেশের কয়েক গাছের কাছে দাঁড়িয়ে বয়স্ক এক ওয়াম্পির একটা মার্লবোরো সিগারেট ধরিয়ে এগিয়ে দিল বানরের মতো আরেক প্রাণির দিকে। প্রাণিটার সাদা দেহ ঢেকে আছে কমলা পশমে। কৃতজ্ঞতার সাথে সিগারেটটা নিলো সে। 

পাহাড়ে ওঠার রাস্তার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছে একটা টয়োটা প্ৰিভিয়া। সাতজন চাইনিজ নারী-পুরুষ নামছে ওটা থেকে। ওদেরকে দেখে কিন্তু বেশ পরিচ্ছন্নই মনে হচ্ছে, পরনে তাদের কালো স্যুট। একজনের হাতে ক্লিপবোর্ড। গাড়ি থেকে নামানো জিনিসগুলো দেখে দেখে বোর্ডে টিক দিচ্ছে। অনেককিছুই নামল: তলোয়ার ভরতি একটা ব্যাগ, বাঁকানো লাঠি আর অনেকগুলো আয়না। অস্ত্রগুলো বণ্টন করা শেষ হলে, ক্লিপবোর্ডে সই করে দিল লোকটা। 

এক বিখ্যাত কৌতুকাভিনেতা, যাকে বিশ্ব সেই ১৯২০ সাল থেকেই মৃত বলে জানে, জং ধরা একটা গাড়ি থেকে নেমেই দেহের কাপড় খুলতে শুরু করল। লোকটার পা অবিকল ছাগলের মতো। লেজটা ছোটো, দেখতে সেটাও ছাগলের লেজের মতো। 

হাসিমুখে এসে উপস্থিত হয়েছে চারজন মেক্সিকান। তার প্রত্যেকের চুল কালো আর উজ্জ্বল। নিজেদের মাঝে একটা বোতল চালাচালি করছে তারা। ওতে আছে চকলেট গুঁড়া, মদ আর রক্তের মিশ্রণে তৈরি পানীয়। অন্যদের নজর এড়াবার জন্য একটা বাদামি কাগজের থলের ভেতরেই রেখে হাত-বদল করছে। 

তারা আসছে তো আসছেই। ক্যাব ভাড়া করে এসে উপস্থিত হলো ভারতীয় উপমহাদেশের নামকরা দানব-রাক্ষসের দল। মামা-জীকে খুঁজে পাবার আগ পর্যন্ত নীরবে চক্কর খেল সবাইকে ঘিরে। মামা-জী তখন চোখ বন্ধ করে প্রার্থনায় মগ্ন, ঠোঁটগুলো নড়ছে শুরু নীরবে। এই রাক্ষসগুলো তাকে ছাড়া আর কাউকে চেনে না। অথচ তা-ও, পুরাতন যুদ্ধগুলোর কথা মনে করে বৃদ্ধার কাছে যেতে ভয় পাচ্ছে। আচমকা গলায় ঝুলতে থাকা খুলির মালায় হাত বুলালেন তিনি। আস্তে আস্তে তার বাদামি চামড়া ধারণ করল কালো বর্ণ; ঠোঁট দুটো বেঁকে গেল, লম্বা দাঁতগুলো হয়ে উঠল তীক্ষ্ণ। চোখ খুলে তিনি আদেশ করলেন রাক্ষসদের কাছে আসার। আদেশ পালিত হলে এমনভাবে তাদের আলিঙ্গন করলেন যেন ওরা তারই সন্তান। 

গত কয়েকদিন উত্তর আর পুবে বৃষ্টি হয়েছে বটে, কিন্তু পরিবেশে বিদ্যমান চাপ এক বিন্দু কমেনি তাতে। স্থানীয় আবহাওয়াবিদরা বারবার সাবধান করে দিয়েছেন, সামনে টর্নেডো আসতে পারে। দিনের বেলা তাপমাত্রা বেশ বেশি থাকে, তবে রাতে পড়ে ঠান্ডা। 

অনানুষ্ঠানিক ভাবে দল গঠন করে সময় কাটাতে লাগল তারা। জাতীয়তা, গোত্র, মানসিকতা আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রজাতির ভিত্তিতে ভাগ করা হলো দলগুলোকে। ক্লান্ত দেখাচ্ছে সবাইকে, সেই সাথে চিন্তিতও। 

এদের মাঝে কেউ কেউ আলাপচারিতায় ব্যস্ত, একদম অল্প হলেও হাসি-ঠাট্টার আওয়াজ ভেসে আসছে। বিয়ারের ফোয়ারা বইছে যেন। 

স্থানীয় অনেককেই দেখা যাচ্ছে ওখানে। ওদের নড়া-চড়া, কথা-বার্তা বলা- সবই কেমন যেন আড়ষ্ট…অস্বাভাবিক। যখন তারা কথা বলছে, তখন মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে ওদের দেহকে দখল করে রাখা লোয়ার কণ্ঠ। 

বয়স বোঝা মুশকিল, এমন দুজন চিকামাউগা মহিলা, তেলের দাগঅলা নীল জিন্স আর জীর্ণ চামড়ার জ্যাকেট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে সবার মাঝে। যুদ্ধের জন্য নেওয়া প্রস্তুতি দেখছে তারা, মাঝে মাঝে কিছু একটা দেখিয়ে মাথা নাড়ছে। আসন্ন লড়াইতে তাদের অংশ নেবার ইচ্ছা আছে বলে মনে হচ্ছে না। 

পূর্ব আকাশে উঁকি দিল চাঁদ, পূর্ণিমার এখনও এক দিন বাকি। আকাশ যত বড়ো, চাঁদটাকেও ততটাই বড়ো বলে মনে হচ্ছে। পাহাড়ের উপর থেকে লালচে- কমলা পোশাক পরে ওটা তাকিয়ে আছে যেন ওদেরই দিকে। তবে আকাশে নিজের জায়গায় স্থির হবার পর, ওটাকে বেশ ক্ষুদ্র আর মলিন বলেই মনে হলো। চাঁদের আলোয় বসে, লুকআউট পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল তারা। 

.

তেষ্টা পেয়েছে লরার। 

মাঝে মাঝে জীবিত মানুষদের উপস্থিতি মোমের আগুনের মতোই কোমলভাবে টের পায় ওর মন। আবার অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায়, উপস্থিতিটা মশালের আগুনের মতো তীব্র। অবশ্য পরেরটা হলে সুবিধা ওরই। এড়ানো সহজ হয়ে যায়, সহজ হয় প্রয়োজনে খুঁজে পাওয়াটাও। তবে শ্যাডোর আলোটা অদ্ভুত, গাছে ঝুলতে থাকা ওর দেহটাকে থেকে আসছে। 

হাত ধরে হাঁটার সময় লরা কিন্তু একবার বকুনি দেয়েছিল শ্যাডোকে। আশা ছিল, ওর ভেতরে অন্তত একটু হলেও জান্তব অনুভূতির আগুন দেখবে। স্মৃতিটা এখন মনে পড়ে যাচ্ছে তার। ইস, শ্যাডো যদি ওর কথার আসল অর্থটা বুঝতে পারত! 

অথচ গাছে ঝুলতে থাকা অবস্থায় যখন মারা যাচ্ছে, তখন যেন আরও বেশি করে বাঁচছে শ্যাডো। জীবন যখন আস্তে আস্তে ছেড়ে যাচ্ছে লোকটাকে, তখন আরও বেশি আসল…আরো বেশি পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠছে সে। সারা রাত লরাকে থাকার জন্যও বলেছে। নিশ্চয়ই ক্ষমা করে দিয়েছে ওকে…অন্তত লরার সেটাই আশা। অবশ্য তাতে কিছু যায় আসে না। শ্যাডো আগের চাইতে বেশি করে বাঁচছে, এটা জানাই যথেষ্ট। 

খামার বাড়িতে ওকে আসতে বলেছিল শ্যাডো। পান করার মতো পানি নাকি পাওয়া যাবে এখানে। বাড়িটা একেবারে অন্ধকার, আলো জ্বলছে না কোথাও। কারও উপস্থিতি টেরও পাচ্ছে না লরা। কিন্তু শ্যাডো বলেছে, তিন বোন আছে এখানে। লরার চাহিদা মেটাবে। ঠেলা দিয়ে খামারের দরজা খুলল মেয়েটা, তীব্র ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে আপত্তি জানাল জং-ধরা দরজাটা। লরার বাঁ ফুসফুসের ভেতর নড়ে উঠল কিছু একটা, কেশে ফেলল ও। 

একটা সরু হলওয়েতে নিজেকে আবিষ্কার করল লরা, ধুলো পড়া একটা পিয়ানো ওর রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে আছে। খামার বাড়ির ভেতর থেকে স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ আসছে একটা। পিয়ানোর ফাঁক দিয়ে কোনো রকমে পার হলো লরা, ওপাশের দরজা খুলে পা রাখল একটা প্রায় ধ্বংস-প্রাপ্ত বসার ঘরে, জীর্ণ আসবাব দিয়ে ভরতি ঘরটা। ম্যান্টেলপিসে একটা তেলের বাতি জ্বলছে, ফায়ারপ্লেসে জ্বলছে কয়লার আগুন। বাইরে থেকে অবশ্য ধোঁয়ার গন্ধ পায়নি লরা, চিমনি দিয়ে ধোঁয়া উঠতেও দেখেনি। আগুনে অবশ্য লাভ হচ্ছে না কিছু, ঘরের ভেতরে ঠান্ডাটা দূর হয়নি একদম। অবশ্য সেটার দোষ হয়তো ঘরটাকে পুরোপুরি দেওয়া যায় না। 

মৃত্যু ওকে কষ্ট দিয়েছে। সেই কষ্টগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কিছু একটা না থাকার কষ্ট। এই যেমন সর্বদা উপস্থিত এক তেষ্টা যা ওর শরীরের প্রতিটা কোষকে যেন শুকিয়ে ফেলে; হাড়ের ভেতর এমন শীতলতা যা এক মুহূর্তের জন্য রেহাই দেয় না ওকে। মাঝে মাঝে নিজেকে লরা আবিষ্কার করে আগুনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে। অবাক হয়ে টের পায় ওর ভাবনা-আচ্ছা, চিতার আগুনে আমার শরীর গরম হবে তো? মাঝে মাঝে ভাবে সমুদ্রের পানি গিলে ফেললেও কী আমার তেষ্টা যাবে না? 

ঘরটায় সে একা নেই, আচমকা উপলব্ধি করতে পারল মেয়েটা। 

একটা কাউচে বসে আছে তিনজন মহিলা, দেখে মনে হচ্ছে কোন অদ্ভুত শিল্প- কলার অংশ হিসেবে ওদেরকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। ওর দিকেই তাকিয়ে আছে মহিলা তিনজন, কিন্তু কারও মুখে রা নেই। 

এমনটা আশা করেনি লরা। 

আচমকা ওর নাকের ছিদ্র থেকে ঝরে পড়ল কিছু একটা। একটা টিস্যু বের করে এনে নাক ঝাড়ল মেয়েটা। এরপর সেটাকে দলা পাকিয়ে ছুড়ে দিল আগুনের ভেতর। আগুনে শূককীটটাকে জ্বলতে দেখল একমনে। 

কাজ শেষে ফিরল কাউচে বসে থাকা মহিলাদের দিকে। ও ভেতরে পা রাখার পর এক বিন্দুও নড়েনি তারা। শুধু চুপচাপ এক দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে ওর দিকে। 

‘হ্যালো। খামার আপনাদের?’ জানতে চাইল লরা। 

সবচেয়ে বড়ো মহিলা মাথা দোলাল। মহিলার হাতগুলো লাল, চেহারায় নিস্পৃহ একটা ভাব। 

‘শ্যাডো, মানে গাছে লটকে আছে যে লোকটা, আমার স্বামী। আমাকে বলল, আপনাদের কাছে পানি চাইতে। জানাতে বলল যে ও দিতে বলেছে।’ ওর পেটের ভেতর এক মুহূর্তের জন্য নড়ে উঠল কিছু একটা, তারপরই আবার শান্ত হয়ে গেল। 

একেবারে ছোটোখাটো মহিলাটা এবার কাউচ ছেড়ে উঠল, এতটাই ছোটো যে তার পা এতক্ষণ ঝুলছিল বাতাসে। তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে। 

দরজা খোলা-বন্ধ হবার আওয়াজ পেল লরা। তারপর বাইরে হওয়া কিছু শব্দ, প্রতিটা শব্দের সঙ্গী হয়ে ভেসে এলো পানির আওয়াজ। 

ছোটোখাটো মহিলাটা ফিরে এলো অচিরেই; হাতে একটা বাদামি, মাটির তৈরি জগ। সাবধানে সেটাকে টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে ফিরে গেল কাউচে। 

‘ধন্যবাদ,’ বলে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল লরা। চারপাশে খুঁজেও কোনো কাপ বা গ্লাস পেল না। তাই জগটাকেই তুলে নিলো ও, দেখে মন হয়নি এতটা ভারী হবে। ভেতরের পানিটুকু একেবারে পরিষ্কার। 

ঠোঁটের কাছে তুলে পান করতে শুরু করল ও। 

এত ঠান্ডাও যে পানি হতে পারে, তার কল্পনা করতে পারেনি লরা। মেয়েটা জিহ্বা, দাঁত আর তালু, সব যেন জমে যাচ্ছে। তারপরেও পান করতে থাকল সে, আসলে থামতে পারছে না। অনুভব করতে পারছে যে পানিটা ওর পাকস্থলী, অস্ত্র, হৃদয়, শিরা-সব জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছে। যেন তরল বরফ ছুটতে শুরু করেছে ওর দেহ জুড়ে। 

আচমকা অবাক হয়ে লক্ষ করল, জগের সব পানি শেষ করে ফেলেছে! 

মহিলা তিনজন নিস্পৃহ চোখেই এতক্ষণ ধরে দেখছিল তাকে। মৃত্যুর পর লরার দুনিয়া হয়ে গেছিল সাদা-কালো। উপমার স্থান ছিল না এখানে। কিন্তু এখন, ওই তিন মহিলাকে দেখার পর ওর মনে হলো-একদল জুরির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে মনে হলো ল্যাবে আটকা পড়া প্ৰাণী… 

…আর ওই তিনজন যেন বৈজ্ঞানিক। 

আচমকা প্রচণ্ড কাঁপতে শুরু করল লরা। টেবিল ধরে নিজেকে একটু সুস্থির করার প্রয়াস পেল সে, কিন্তু টেবিলটা যেন জীবন্ত। কিছুতেই ধরা দিতে চাইছে না ওর হাতে। কোনোরমে ওটাকে ধরে বমি করতে শুরু করল লরা। মুখ থেকে বেরোতে শুরু করল পিত্ত, ফরমালিন, শূককীট আর পোকা। তারপর টের পেল: একই সাথে মল ত্যাগ আর প্রস্রাব করতে শুরু করে দিয়েছে সে। দেহের ভেতর থেকে যেন বেরিয়ে আসছে সবকিছু। সম্ভব হলে হয়তো চিৎকার করত। কিন্তু এতটাই আচমকা আর এতটাই দ্রুত মেঝেটা ওপরে উঠে আসতে শুরু করল যে তা আর পারল না। 

সময় যেন ধেয়ে এলো ওকে লক্ষ্য করে, গিলে নিলো পুরোপুরি। হাজারো স্মৃতি একই সাথে এসে কড়া নাড়ল লরার মনে। এক ক্রিসমাসের এক সপ্তাহ আগে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে হারিয়ে গেছিল লরা। আশপাশে কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না ওর বাবাকে। পরক্ষণেই আবার চিচি’র বারে বসে আইসক্রিম খেতে খেতে সেদিনে ডেট, এক বিশালদেহী ‘খোকাবাবু’ আড়চোখে পরখ করে দেখার স্মৃতি মনে পড়ে গেল। পরক্ষণেই লরা নিজেকে আবিষ্কার করল একটা গাড়িতে। প্রচণ্ড দুলছে ওটা, এদিকে রবি চিৎকার করছে গলা ফাটিয়ে। একটা ধাতব পোষ্টে বাড়ি খেয়ে থেমে গেল গাড়িটার নড়া-চড়া। কিন্তু তার আরোহীদের সেই সৌভাগ্য হয়নি… 

সময়ের-বারি, যেটা ভাগ্যের কুপ বা উর্ডের কুপ থেকে এসেছে, জীয়ন-বারি নয়। তবে হ্যাঁ, জীবন-বৃক্ষের পুষ্টি আসে এই পানি থাকে। তাই তা অনন্য। 

জ্ঞান ফিরে এলো লরার, তখনও কাঁপছে ওর দেহ। তবে এখন ঠান্ডায়! এমনকী ওর নিশ্বাস পর্যন্ত বাষ্প হয়ে উড়ে যাচ্ছে বাতাসে। হাত ছুলে গেছে, ক্ষতে লেগে আছে রক্ত… 

…তাজা রক্ত। 

এবার যেতে হবে লরাকে। কোথায়, তা-ও সে জানে! সময়ের-বারি পান করেছে ও, যেটা এসেছে ভাগ্যের ঝরনা থেকে। মানস চোখে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে পাহাড়টাকে। 

হাতের ক্ষতটা চাটল লরা, ওটার স্বাদ অনুভব করতে পেরে শিহরিত হয়ে উঠল। হাঁটতে শুরু করল পাহাড়ের দিকে। 

মার্চের ভেজা একটা দিন, ঠান্ডাও পড়েছে বেশ। বিগত কয়েকদিনের ঝড় দক্ষিণের স্টেটগুলোতে ইচ্ছামতো চালিয়েছে ধ্বংসযজ্ঞ। রক সিটিতে তাই আছে হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র পর্যটক। ক্রিসমাসের সাজ-সজ্জা নামিয়ে নেওয়া হয়েছে আগেই। বসন্তকালীন পর্যটকরা এখন আসা শুরু করেনি। 

তাই বলে একেবারে পরিত্যক্ত নয় জায়গাটা। আজ সকালে একটা ট্যুর বাস এসে এক ডজন নারী-পুরুষকে নামিয়ে দিয়ে গেছে। তাদের পরনে স্যুট, মুখে আশ্বস্ত করার হাসি। তাদেরকে দেখে মনে হয়, খবর পাঠক-পাঠিকা হিসেবেই বেশি মানায় তাদের। রক সিটির সামনের পার্কিং লটে পার্ক করে রাখা হয়েছে একটা কালো হামভি। 

নারী-পুরুষগুলো কোনো একটা উদ্দেশ্য নিয়ে রক সিটিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বসার মতো ভালো একটা জায়গা খুঁজে পেতেই বন্ধ হলো ঘোরাঘুরি। নিজেদের মধ্যে গল্প করতে শুরু করল তারা। 

এবার আসা পর্যটকদের মাঝে কিন্তু শুধু এরাই নেই। সেদিন রক সিটির রাস্তায় হাঁটলে দেখা পাওয়া যেত আরও কিছু লোককে। এদের অনেককেই দেখে সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রী বলে মনে হয়। আবার বেশ কয়েকজন যেন ভিনগ্রহের আগন্তুক। লম্বা লম্বা লিমোজিন, ছোটো ছোটো স্পোর্টস কার আর বিশালাকার এসইউভিতে চড়ে এসেছে তারা। কয়েকজনকে দেখে মনে হয়, চোখে সানগ্লাস গলানোটা যেন তাদের অভ্যাস, ঘরের ভেতরেও পরে থাকে। এরা নানা বয়সের, নানা আকারের, নানা মানসিকতার। 

তবে সবার মাঝেই অন্তত দর্শনে হলেও মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে একটা। তাদের ভাবখানা এমন, আমাকে তুমি চেন। অন্তত চেনা উচিত। চলা- ফেরার…নড়া-চড়ার মাঝেই লুকিয়ে আছে তাদের বিশ্বাস—পৃথিবী আমাদেরকে ঘিরেই আবর্তিত হয়! 

মোটকু ছেলেটা ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের মাঝে। এমন এক নেতা বলে মনে হচ্ছে ছেলেটাকে, যার সাথে কর্মীদের সাথে একদম যোগাযোগ নেই। অথচ সফলতা লাভ করেছে যেন কীভাবে! ছেলেটা চেষ্টা করছে মানুষকে পটাবার! তার কালো কোটটা পতপত করে উড়ছে বাতাসে। 

মাদার গুজ কোর্টের পানীয় স্ট্যান্ডের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কেউ বা কিছু একটা কেশে ওর দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়াস পেল। বিশালদেহী সে, পা আগ আঙুল থেকে স্কালপেলে ব্যবহৃত ব্লেড বেরিয়ে আছে। চেহারাটা ক্ষতে ক্ষতে বিকৃত। ‘কুরুক্ষেত্রে বাঁধবে। লোভী কণ্ঠে বলল। 

‘কুরুক্ষেত্র টাইপ শব্দ,’ বলল মোটকু। ‘অতি প্রাচীন, কানে লাগে। বলো পালার পরিবর্তন হতে চলেছে।’ 

ক্ষতে ভরা চেহারাটা একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল মোটকুর দিকে। ‘অপেক্ষা করছি।’ বলল কেবল। 

‘যা মন চায় করো, আমি মি. ওয়ার্ল্ডকে খুঁজছি। দেখেছ ওকে?’ 

মাথা চুলকালো ব্লেড বেরিয়ে থাকা আঙুলগুলো। কিছুক্ষণ ভেবে একটা দিক দেখিয়ে বলল, ‘ওই দিকে আছে।’ 

মোটকু ছেলেটা হাঁটা শুরু করল সেদিকে, ধন্যবাদ পর্যন্ত জানাল না। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর সে এক মহিলাকে বলল, ‘কুরুক্ষেত্র বাঁধবে।’ 

মাথা দোলাল মহিলা, তারপর কাছে এসে জানতে শুরু করল, ‘এ ব্যাপারে তোমার অনুভূতি কী?’ 

ফাঁক হয়ে গেল ক্ষতঅলা একজোড়া ঠোঁট, তারপর বলতে শুরু করল। 

.

টাউনের ফোর্ড এক্সপ্লোরার গাড়িতে জিপিএস লাগানো। ছোটো একটা পর্দা, স্যাটেলাইট থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য এনে ওর গাড়ির অবস্থান মানচিত্রে দেখাচ্ছে। কিন্তু তারপরও ব্ল্যাকসবার্গের দক্ষিণে এসে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে সে। পর্দার মানচিত্রের সাথে এখনকার গ্রাম্য রাস্তার মিল আছে বলে মনে হচ্ছে না। অনেকক্ষণ পর গাড়ি থামাতে বাধ্য হলো লোকটা, জানালা নামিয়ে এক মোটা, সাদা মহিলার কাছে জানতে চাইল-অ্যাশট্রি খামারটা কোনদিকে? 

মাথা নেড়ে কিছু একটা বলল মহিলা। কিন্তু কী বলল, তা বুঝতে পারল না টাউন। ঝামেলা না করে ধন্যবাদ জানাল ও, তারপর জানালা তুলে মহিলার দেখানো দিকে রওনা দিল। 

আরও প্রায় চল্লিশ মিনিট গাড়ি চালাবার পর, আর সেই সাথে অগণিত গ্রাম্য রাস্তা পার হবার পর, আক্রোশে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল সে। 

‘এইসব কাজ আর বুড়ো হাড়ে সহ্য হয় না।’ শব্দ করেই বলল। 

টাউনকে খুব একটা বয়স্ক বলা যাবে না, পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই করছে বয়স। কর্মজীবনের অধিকাংশ সময়ই কেটেছে কেবল আদ্যক্ষর দিয়ে পরিচিত সরকারি প্রতিষ্ঠানে। প্রায় বারো বছর আগে চাকরি বদলায় সে। কিন্তু সরকারি চাকরি ছেড়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নাম লিখিয়েছে কি না—সেটা নিজেও জানে না। কখনও মনে হয় হ্যাঁ, আবার কখনও না। অবশ্য একেবারে আম-জনতা ছাড়া আর কারও কাছে এই দুইটার মাঝে কোনো পার্থক্য আছে বলে মনে হয় না ওর। 

হাল ছেড়ে দিচ্ছে, এমন সময় সাইনবোর্ড আর সদর দরজাটা নজরে পরল টাউনের। হাতে আঁকা সাইনবোর্ডটা শুধু এক শব্দের: অ্যাশ। গাড়ি থেকে নেমে সদর দরজা খুলে ফেলল ও, তারপর আবার ফিরে এসে গাড়ি চালিয়ে ঢুকল ভেতরে। 

আমার অবস্থার সাথে ব্যাং সিদ্ধ করার মিল আছে, ভাবল সে। একটা ব্যাং পানিতে ফেলে তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিলেই হলো। যতক্ষণে প্রাণিটা টের পাবে কোন সমস্যা আছে, ততক্ষণে সে সিদ্ধ হয়ে গেছে। যে দুনিয়ায় টাউন কাজ করে, সেটা বড়োই অদ্ভুত। পায়ের নিচে মাটি থাকে না কখনওই, উলটো মনে হয় যেন ফুটন্ত পানির পাত্রে ডুবে আছে! 

অথচ প্রথম যখন ওকে এজেন্সিতে ট্রান্সফার করা হয়, তখন সবকিছু সোজা- সাপ্টা বলে মনে হয়েছিল। এখন সবকিছু…ঠিক জটিল না, তবে অনেক বেশি অদ্ভুত বলতে হবে। মি. ওয়ার্ল্ডের অফিসে একদিন রাত দুইটার সময় বসেছিল ও। কী করতে হবে, সেটা বুঝিয়ে বলছিল মি. ওয়ার্ল্ড। ‘বুঝতে পেরেছ?’ মি. ওয়ার্ল্ড একটা ছুরি ধরিয়ে দিয়ে জানতে চাইছিল। ‘আমার জন্য একটা ডাল কেটে আনবে। বেশি বড়ো লাগবে না, কয়েক ফুট হলেই চলবে।’ 

‘বুঝেছি,’ বলেছিল টাউন। ‘কিন্তু কাজটা করতে হবে কেন, স্যার?’ 

‘কেননা, আমি তোমাকে বলেছি।’ কেবল এতটুকুই বলেছিল মি. ওয়ার্ল্ড। ‘গাছটা খুঁজে বের করে একটা ডাল কাটবে। তারপর চাট্টানুগাতে আমার সাথে দেখা করবে। একটুও সময় নষ্ট করবে না।’ 

ব্যাপারটার সাথে কি ওই হারামজাদা জড়িত?’ 

‘শ্যাডো? ওকে দেখলে অগ্রাহ্য করবে। স্পর্শ করারও দরকার নেই। আমি চাই না, তুমি ওকে শহীদ বানিয়ে দাও। এখনকার পরিকল্পনায় শহীদের দরকার নেই।’ তারপর হাসি দেখা গেল মি. ওয়ার্ল্ডের চেহারায়। লোকটা খুব অল্পেই মজা পায়, ব্যাপারটা আগেও টের পেয়েছে টাউন। এমনকি ক্যানসাসে মজা করেই শোফার হিসেবে গেছিল সে। 

‘দেখুন—’ 

‘কোন শহীদ চাই না আমি, টাউন।’ 

আর কিছু বলেনি টাউন, মাথা নেড়ে ছুরি নিয়ে নিয়েছিল। 

শ্যাডো নামের লোকটা ওর জীবনের একটা অংশ হয়ে গেছে বুঝতে পেরে তার উপর ঘৃণাটা আরও পোক্ত হয়েছে টাউনের। ঘুমাবার সময় লোকটার চেহারা ভেসে ওঠে ওর সামনে। তখনও শ্যাডোর চেহারায় থাকে তাচ্ছিল্যের হাসি। টাউনের ইচ্ছা হয়, হাতের মুঠোটা লোকটার পেটে সেঁধিয়ে দেয়! 

তৃণভূমির উপর দিয়ে ফোর্ড এক্সপ্লোরার চালিয়ে নিয়ে গেল সে, একটা পরিত্যক্ত খামার বাড়ি পড়ল কেবল পথে। অল্প একটা চড়াই পার হয়ে দেখতে পেল গাছটাকে। ওটা পার হয়েই নিজের গাড়িটা পার্ক করল টাউন। বন্ধ করে নজর দিল ড্যাশবোর্ডের ঘড়িটার দিকে। সকাল ছয়টা আটত্রিশ বাজে। চাবি-টাবি সব গাড়িতেই রেখে নামল সে, এগোল গাছের দিকে। 

বিশাল একটা গাছ, যার উচ্চতা অন্য কিছুর সাথেই তুলনা করা সম্ভব না। বাকলগুলো দেখে মনে হয় যেন সিল্কের স্কার্ফ। 

মাটির একটু ওপরেই, গাছের ডাল থেকে দড়ি বাঁধা অবস্থায় ঝুলছে একজন মানুষ। আর মাটিতে দেখা যাচ্ছে চাদর দিয়ে ঢাকা কিছু একটা। ওটা যে কী, তা বুঝতে পারছে টাউন। পা দিয়ে চাদর সরাতেই নজরে পড়ল ওয়েনসডের ক্ষত- বিক্ষত চেহারা। 

গাছের দিকে এগোল টাউন, প্রথমে কাণ্ডটাকে ঘিরে চক্কর গেল একটু। খামার বাড়ি থেকে দেখা যাবে না, এমন জায়গায় এসে প্যান্ট খুলে পেশাব করল কাণ্ডে। এরপর বাড়িটার কাছে গিয়ে খুঁজে বের করল একটা কাঠের মই। ওটাকে গাছের কাছে নিয়ে এসে ঠেস দিল কাণ্ডের গায়ে। এরপর ওপরে উঠতে শুরু করল। 

দড়ি বাঁধা শ্যাডো গাছ থেকে ঝুলছে। লোকটা বেঁচে আছে বলে মনে হচ্ছে না ওর। উঠছে-নামছে না বুক। অবশ্য তাতে কিছু যায় আসে না। 

‘হাই, হারামজাদা।’ বলল টাউন, কিন্তু নড়ল না শ্যাডো। 

মইয়ের একদম ওপরের ধাপে পৌঁছাল টাউন, পকেট থেকে ছুরি বের করে ছোটোখাটো একটা ডাল কেটে নিলো। আসলে অর্ধেক কেটে, ভেঙে ফেলল বাকিটুকু। প্রায় ত্রিশ ইঞ্চির মতো লম্বা হবে ওটা। 

ছুরিটা খাপে ভরে নিয়ে নিচে নামতে শুরু করল সে। শ্যাডোর মুখোমুখি এসে থমকে দাঁড়াল। ‘ঈশ্বর…তোকে আমি ঘৃণা করি।’ ইচ্ছা হচ্ছিল বন্দুক বের করে গুলি করে মারে লোকটাকে। কিন্তু জানে, তা পারবে না। তাই ডালটা দিয়েই শ্যাডোর পেটে খোঁচা মারল, নিজেকে প্রবোধ দিল ওটাকে বর্শা ভেবে। 

‘অনেক হয়েছে,’ নিজেকেই বকলো সে। ‘এবার কাজে নামো।’ একদম নিচের কয়েকটা ধাপ লাফিয়ে নেমে হাতের দিকে তাকাল ও। হাতে ধরা ডালটা দেখে নিজেকে ছোটো বাচ্চা বলে মনে হচ্ছে ওর। বাচ্চারা যেমন ডালকে বর্শা বা তলোয়ার ভেবে ধরে থাকে, টাউন নিজেও তাই করছে। অন্য কোনো গাছ থেকে কাটলেও খুব একটা ক্ষতি হতো না। ভাবল ও। এই গাছের ডাল না হলেই বা কী? কে টের পেত? 

পরক্ষণেই ভাবল, মি. ওয়ার্ল্ড পেতেন। 

খামার বাড়িতে গিয়ে আবার রেখে এলো মইটা। মনে হলো যেন কিছু একটা নড়ছে ভেতরে। মইটা বাইরেই পেয়েছিল, তাই ভেতরে ঢুকতে হয়নি ওকে। এখন কৌতূহলী হয়ে তাকাল জানালা দিয়ে। প্রায় ভেঙে পড়া একগাদা আসবাব দিয়ে সাজানো একটা অন্ধকার ঘর পড়ল নজরে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো যেন ভেতরে তিনজন মহিলা বসে আছে। 

একজন উল বুনছে, একজন চেয়ে আছে সরাসরি ওরই দিকে। বাকি জন ঘুমাচ্ছে। ওর দিকে তাকিয়ে থাকা মহিলার চেহারা বিকৃত হয়ে গেল আস্তে আস্তে। ওটা যে হাসি, তা টের পেয়ে কিছুক্ষণ সময় লাগল টাউনের। একটা আঙুল তুলে নিজের গলায় ঠেকাল মহিলা, তারপর গলা কাটার ভঙ্গি করে টান দিল। 

ওই এক মুহূর্তে এসবই দেখেছে বলে মনে হলো ওর। পরের মুহূর্তেই দেখতে পেল, ঘরটা খালি… 

…..কেউ নেই ভেতরে। 

চোখ কচকালো টাউন। 

গাড়ির কাছে ফিরে এলো সে। ভেতরে বসে ডালটাকে সাদা চামড়ায় মুড়িয়ে প্যাসেঞ্জার সিটের উপর রাখল। চাবি একবার ঘোরাতেই চালু হলো এঞ্জিন ড্যাশবোর্ডের ঘড়িতে বাজে ছয়টা আটত্রিশ! ভ্রু কুঁচকে হাতঘড়ির দিকে তাকাল সে, ওটার মতে এখন সময় দুপুর একটা আটান্ন। 

দারুণ, ভাবল টাউন। হয় গাছে আমি আট ঘণ্টা কাটিয়েছে। নয়তো গাছে উঠে ফিরে গেছি এক মিনিট অতীতে। ভাবতে ভাবতেই উপলব্ধি করল, সম্ভবত দুটি ঘড়িই কাকতালীয় ভাবে একই সাথে নষ্ট হয়ে গেছে। 

এদিকে গাছে ঝুলতে থাকা শ্যাডোর দেহ থেকে টপটপ করে ঝরতে শুরু করেছে রক্ত। ক্ষতটা ওর পাশে। আস্তে আস্তে ঝরতে থাকা রক্তটা ঘন, গুড়ের মতো কালো। 

.

লুকআউট পাহাড়ের শীর্ষ দখল করে নিয়েছে মেঘ। 

পাহাড়ের পাদদেশে, অন্যদের থেকে অনেকটা দূরে বসে আছেন ইস্টার। পাহাড়ের ওপাশ থেকে উদীয়মান সূর্য দেখছেন একমনে। 

আরেকটা রাত এলো আবার চলেও গেল। এখন স্থবির হয়ে আছে সবাই। দলের সবার আসা এখনও শেষ হয়নি। তবে এখন একজন-দুজন করে আসছে। গত রাতে দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে এসেছে কিছু প্রাণী। তাদের মাঝে আপেল গাছ আকৃতির দুজন বাচ্চা ছেলেও আছে। 

কেউ বিরক্ত করছে তাদেরকে। বাইরের দুনিয়ার কেউ ওদের উপস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল বলেও মনে হচ্ছে না। রক সিটির পর্যটকদের যেন মানসচোখে দেখতে পেলেন ইস্টার-কোয়ার্টার ঢুকিয়ে এদিকেই তাকাচ্ছে তারা বিনকিউলার দিয়ে। অথচ গাছ, ঝোপ আর পাথর ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছে না। 

রান্না করার জন্য জ্বালানো আগুনের গন্ধ পাচ্ছেন তিনি। ক্যাম্পের ওপাশে কেউ একজন বাজাচ্ছে হারমোনিকা। সুরটা শুনে অবচেতন মনেই একসাথে হাসলেন আর কেঁপে উঠলেন তিনি। ব্যাকপ্যাকে একটা পেপারব্যাক বই নিয়ে এসেছেন তিনি, আলো ফোঁটার অপেক্ষা করছেন এখন। 

আকাশে দুটো বিন্দু দেখা যাচ্ছে, একটা ছোটো আর অন্যটা বড়ো। সকালের বাতাসে ভেসে আসা এক বিন্দু জল তার চেহারায় এসে পড়ল। নগ্ন পদে এক মেয়ে এগিয়ে এলো মহিলার দিকে। একটা গাছের পাশে থেমে পেট খালি করে নিলো। ইস্টার হাত নেড়ে ডাকলেন মেয়েটাকে। 

‘শুভ সকাল, মহামান্যা,’ বলল মেয়েটা। ‘অচিরেই যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে।’ ওর গোলাপি জিহ্বা স্পর্শ করল লালচে ঠোঁট। কাঁধে একটা কালো কাকের পাখা বেঁধে রেখেছে। গলায় ঝুলিয়েছে আরেকটা কাকের পা। 

‘তুমি জান কীভাবে?’ 

হাসল মেয়েটা। ‘আমি মরিগানদের একজন, মাচা নাম আমার। যুদ্ধের আগেই তার গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়ায়, আমি সেই গন্ধ পাই। আমাকে যুদ্ধের দেবী বলে ডাকা হয়, আমি ঘোষণা করছি-আজ রক্ত ঝরবে।’ 

‘তাই নাকি?’ অন্যমনস্ক ইস্টার বললেন। আকাশের দিকেই মন তার। কিছুক্ষণ আগে মেঘের নিচে দেখতে পাওয়া ছোটো বিন্দুটা নিক্ষিপ্ত পাথরের মতো নিচে নামতে শুরু করেছে! 

‘আমরা লড়ব, একজন একজন করে খুন করব শত্রুপক্ষকে।’ বলল মেয়েটা। ‘তাদের কাটা মুণ্ডু নিয়ে করব উল্লাস, তাদের চোখ আর লাশ খুবলে খাবে কাক।’ অনেক কাছে চলে এসেছে ফোঁটাটা, ওটা যে পাখি তা বুঝতে পারলেন ইস্টার। 

এক পাশে মাথা কাত করে বললেন, ‘যুদ্ধ দেবীরা গোপন জ্ঞান পায় নাকি? কারা জিতবে, কারা হারবে…এসব?’ 

‘না,’ জানাল মেয়েটা। ‘আমি কেবল যুদ্ধের গন্ধ পাই। কিন্তু আমরা জিতবই, জিততে আমাদেরকে হবেই। সর্ব-পিতাকে ওরা যেভাবে খুন করেছে, তা আমি দেখেছি। হয় আমরা থাকব, নয়তো ওরা।’ 

‘হুম,’ বললেন ইস্টার। ‘তা বটে।’ 

আবারও হাসল মেয়েটা, আধা-আলোতে ফিরে গেল ক্যাম্পে। বসেই রইলেন ইস্টার, হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করলেন মাটি থেকে বেরিয়ে থাকা একটা সবুজ পাতা। তার স্পর্শ পাওয়া মাত্র বড়ো হতে শুরু করল ওটা, কিছুক্ষণের মাঝেই পরিণত হলো একটা সবুজ, টিউলিপের মাথায়। সূর্য গরম হলে আত্মপ্রকাশ করবে ওটা। বাজপাখির দিকে তাকালেন ইস্টার। ‘তোমাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?’ জানতে চাইলেন তিনি। 

ইস্টারের মাথার প্রায় পনেরো ফিট ওপরে ডানা ঝাপটাতে লাগল বাজপাখি। তারপর আস্তে করে নেমে পড়ল মাটিতে। উন্মাদ চোখে তাকাল তার দিকে! 

‘হ্যালো, সুদর্শন।’ বললেন ইস্টার। ‘তোমার আসল রূপ দেখাবে না? 

ওর দিকে এগিয়ে এলো বাজপাখি, বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে। পরক্ষণেই দেখা গেল, ওখানে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবক। একবার ইস্টারের দিকে তাকিয়েই আবার নজর ফেরাল মাটিতে। ‘তুমি?’ প্রশ্ন করল সে। ও তাকাচ্ছে ঘাসের দিকে, তাকাচ্ছে আকাশ আর ঝোপের দিকে। কিন্তু ভুলেও ইস্টারের দিকে নজর ফেলছে না। 

‘আমি,’ বললেন মহিলা। ‘আমি কী?’ 

‘তুমি।’ আবার থেমে গেল যুবক। মনে হচ্ছে যেন কী বলবে তা খুঁজে পাচ্ছে না। নানা ধরনের অনুভূতি খেলা করে গেল যুবকের চেহারায়। 

পাখি হিসেবে একটু বেশিই সময় কাটিয়ে ফেলেছে ছেলেটা, ভাবলেন তিনি। কীভাবে মানুষের মতো কথা বলতে হয় তা আর মনে নেই। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলেন তিনি। অনেকক্ষণ পর যুবক বলল, ‘আমার সাথে আসবে?’ 

‘হয়তো। কোথায় নিতে চাও?’ 

‘গাছে ঝোলা মানুষটার তোমার সাহায্য দরকার। ব্যথা পেয়েছে, রক্ত ঝরছিল। এখন বন্ধ। মনে হয় মৃত।’ 

‘যুদ্ধ চলছে একটা, আমি চাইলেই পালিয়ে যেতে পারি না।’ 

নগ্ন যুবক বলল না কিছুই, কেবল দেহের ওজন এক পা থেকে অন্য পায়ের ওপর চাপাল। ইস্টারের মনে হলো, লোকটা বাতাসে উড়তে যতটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত, মাটিতে ততটাই অস্বস্তি বোধ করছে। তারপর আচমকা বলল, ‘যদি লোকটা চিরদিনের জন্য চলে যায়, তাহলে সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে।’ 

 ‘কিন্তু যুদ্ধ—’ 

‘লোকটা মারা গেলে, যুদ্ধে কে জিতল আর কে হারল তাতে কিছু যায় আসে না।

‘কোথায় যেতে হবে? জায়গাটা কি ধারে-কাছে কোথাও?’ 

টিউলিপের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যুবক। মাথা নেড়ে বলল, ‘অনেক দূরে।’

‘হুম,’ বললেন ইস্টার। ‘আমাকে এখানে দরকার হবে। চাইলেই উধাও হয়ে যেতে পারি না। তাছাড়া, দূরে হলো আমি যাবই বা কীভাবে? তোমার মতো আমি উড়তে পারি না, বুঝেছ?’ 

‘জানি,’ বলল হোরাস। ‘তুমি উড়তে পারো না।’ তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকাল। বড়ো বিন্দুটা নামতে শুরু করেছে। ওদিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘কিন্তু ও পারে।’ 

.

আরও কয়েক ঘণ্টা বেহুদা গাড়ি চালাবার পর টাউনের মনে হলো, জিপিএস সিস্টেমটাকে সে শ্যাডোর চাইতেও বেশি ঘৃণা করে। খামার বাড়ি থেকে, ওই গাছটা থেকে ফেরার রাস্তা খুঁজে বের করা, ওগুলো খুঁজে পাওয়ার থেকেও বেশি কঠিন বলে মনে হচ্ছে এখন। যেদিকেই যাক না কেন ও, যে রাস্তাই নিক না কেন, ঘুরে ফিরে উপস্থিত হচ্ছে হাতে আঁকা অ্যাশ সাইনবোর্ডের সামনেই। 

কী আশ্চর্য! যে পথে এসেছে, তার উলটো পথে ফিরে গেলেই তো হয়, তাই না? 

সমস্যা হলো, গতবার সে তাই করেছে। আসার পথে যেখানে বাঁ দিকে গাড়ির নাক ঘুরিয়েছে, এবার সেখানে ঘুরিয়েছে ডান দিকে। কিন্তু তারপরও, ঘুরে ফিরে উপস্থিত হয়েছে ঠিক সেই খামার বাড়ির সামনেই! ঘন কালো মেঘ ভিড় জমিয়েছে আকাশে, খুব দ্রুতই অন্ধকার হয়ে আসছে চারপাশ। সকাল বলে মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে রাত নেমেছে। লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে। এভাবে চললে বিকালের আগে চাট্টানুগায় পৌঁছানো অসম্ভব হয়ে যাবে। 

সেল ফোন থেকে বার বার নো সার্ভিস লেখা ভেসে আসছে। গাড়িটার গ্লাভ কম্পার্টমেন্টে রাখা মানচিত্রটায় প্রধান রাস্তা আর হাইওয়ে পরিষ্কারভাবে আঁকা হয়েছে। কিন্তু আর কিছু নিয়ে সেই মানচিত্রের মাথাব্যথা নেই! 

রাস্তায় থেমে যে কাউকে জিজ্ঞেস করবে, সেই উপায়ও নেই। কাউকে দেখা যাচ্ছে না চারপাশে। বাড়ি আছে অনেকগুলোই, কিন্তু কোনোটাতেই বাতি জ্বলছে না। এদিকে ফুয়েল ট্যাঙ্কের অবস্থাও খারাপ, প্রায় শেষের দিকে। দূরে কোথাও হওয়া বজ্রপাতের আওয়াজ ভেসে এলো ওর কানে। সেই সাথে উইন্ডশিল্ডে এসে আঘাত হানল এক ফোঁটা বৃষ্টি। 

রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলা মেয়েটাকে দেখা মাত্র স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে টাউন বলল, ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ,’ মেয়েটার একদম পাশে এসে থামাল গাড়ি। ‘ম্যাম, আমি দুঃখিত। রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি। এখান থেকে হাইওয়ে এইট্টি-ওয়ানে যাব কীভাবে, বলতে পারেন?’ 

প্যাসেঞ্জারের দিকের জানাল দিয়ে ওর দিকে তাকাল মেয়েটা। ‘আসলে আপনাকে বলে বোঝানো সম্ভব না। তবে চাইলে দেখিয়ে দিতে পারি।’ মলিন চেহারা তার, চুলগুলো লম্বা আর কালো। 

‘উঠে পড়ুন,’ বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে বলল টাউন। ‘তবে আগে গ্যাস ভরতে হবে।’ 

‘ধন্যবাদ,’ কৃতজ্ঞতা জানাল মেয়েটা। ‘আমার গাড়ির দরকার ছিল,’ উঠে বসল সে। ‘সিটে একটা ডাল দেখতে পাচ্ছি।’ অবাক হয়ে বলল সে। 

‘পেছনের সিটে রেখে দিন। যাচ্ছেন কোথায়?’ জানতে চাইল টাউন। ‘যদি কোন গ্যাস স্টেশন আর ফ্রি-ওয়েটা দেখিয়ে দিতে পারেন, তাহলে আপনার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতেও আপত্তি থাকবে না!’ 

মেয়েটা আবার ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, ‘আমি সম্ভবত আপনার গন্তব্যের চাইতেও দূরে যাচ্ছি। আমাকে ফ্রি-ওয়ে পর্যন্ত এগিয়ে দিলেই হবে। তারপর কোনো ট্রাকে লিফট নিব নাহয়।’ হাসল মেয়েটা। এই হাসিতেই পটে গেল টাউন। 

‘ম্যাম,’ বলল লোকটা। ট্রাকের চাইতে আমার গাড়িতেই বেশি আরামে থাকবেন।’ নাকে মেয়েটার গন্ধ এসে লাগছে ওর। গন্ধটা ভারী, ম্যাগনোলিয়া বা লাইলাকের মতোই কড়া। তবে সমস্যা হচ্ছে না টাউনের। 

‘আমি জর্জিয়ায় যাচ্ছি,’ জানাল মেয়েটা। ‘অনেক দূরের রাস্তা।’ 

‘আমি চাট্টানুগায় যাচ্ছি। তত দূর পর্যন্ত আপনাকে নিয়ে যেতে পারব।’

‘উম,’ বলল মেয়েটা। ‘আপনার নাম কী? 

‘বন্ধুরা আমাকে ম্যাক বলে ডাকে।’ জানাল মি. টাউন। বারে যখন মেয়েদের সাথে কথা বলে, তখন যোগ করে-আর যারা ভালোভাবে চেনে, তারা ডাকে বিগ ম্যাক বলে। কিন্তু আপাতত তার দরকার আছে বলে মনে হলো না। রাস্তাটা অনেক লম্বা, পরস্পরের সাথে পরিচিত হবার অনেক সময় পাওয়া যাবে। ‘আপনার নাম?’ 

‘লরা।’ 

‘হুম, লরা।’ বলল টাউন। ‘আশা করি আমরা ভালো বন্ধু হবো।’ 

.

মি. ওয়ার্ল্ডকে রেইনবো রুমে খুঁজে পেল মোটকু। রেইনবো রুমটা রক সিটির রাস্তায় একটা ঘের দেওয়া ঘর ওটা। লাল, সবুজ আর হলদে রঙের পাতলা চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে ওটার কাচের জানালাগুলো। ভেতরে অস্থির ভঙ্গিতে হাঁটছে মি. ওয়ার্ল্ড। লোকটার পরনে একটা বারবেরি বর্ষাতি। 

কাশল মোটকু, চোখ তুলে তাকাল মি. ওয়ার্ল্ড। 

‘উম, মিস্টার ওয়ার্ল্ড?’ 

‘বলো? কোনো সমস্যা? সবকিছু সময় মেনে হচ্ছে তো?’ 

মোটকুর গলা শুকিয়ে এসেছে। ঠোঁট ভেজাল সে। ‘সবকিছু ঠিক আছে। তবে হেলিকপ্টার আসবে কি না, তার নিশ্চয়তা নেই।’ 

‘দরকারের সময় ঠিকই পাওয়া যাবে ওগুলো, দুশ্চিন্তা করো না।’ 

‘তাহলে তো ভালোই,’ বলে চুপচাপ জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল মোটকু। না আর কিছু বলল, আর না বিদায় নিলো! ছেলেটার মাথায় একটা ক্ষতের দাগ। 

কিছুক্ষণ পর মি. ওয়ার্ল্ড জানতে চাইল, ‘আর কিছু?’ 

ক্ষণিকের নীরবতার পর হোঁতকা ঢোক গেলে বলল, ‘হ্যাঁ।’ 

‘একা একা বলতে চাও?’ 

মাথা নেড়ে সায় জানাল ছেলেটা। 

মোটকুকে সাথে নিয়ে অপারেশন্স সেন্টারে চলে এলো মি. ওয়ার্ল্ড। জায়গাটা আসলে স্যাঁতস্যাঁতে একটা গুহা। বাইরে একটা সাইনবোর্ড টাঙিয়ে পর্যটকদের জানানো হয়েছে: মেরামতের জন্য আপাতত বন্ধ আছে জায়গাটা। ওটার সামনে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছে দুইজন মানুষ। 

‘বলো, কী বলবে?’ জানতে চাইল মি. ওয়ার্ল্ড। 

‘হুম, বলছি। দুটি জিনিস। প্রথম প্রশ্ন, কীসের জন্য অপেক্ষা করছি আমরা? আর দ্বিতীয় প্রশ্ন, এইটা একটু কঠিন। আমাদের বন্দুক আছে। তাই না? আছে আরও অস্ত্র-শস্ত্র। ওদের কী আছে? তলোয়ার, ছুরি, হাতুড়ি আর পাথরের কুঠার। আমাদের আছে স্মার্ট বোমা!’ 

‘ওটা কিন্তু ব্যবহার করা যাবে না।’ মি. ওয়ার্ল্ড মনে করিয়ে দিল। 

‘জানি, আগেও বলেছেন। আমি জানি, অসুবিধা নেই। কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে, এলএ-তে ওই মাগীকে সরিয়ে দেবার পর…আমি কেন জানি…’ থেমে গেল সে। চেহারা বিকৃত হয়ে গেল তার, আর বলতে চাচ্ছে না কিছু। 

‘উৎকণ্ঠায় ভুগছ?’ 

‘হ্যাঁ। শব্দটা আমার পছন্দ হয়েছে, উৎকণ্ঠায় ভুগছি।’

‘কী নিয়ে?’ 

‘আমরা লড়ব, আর লড়লে অবশ্যই জিতব।’ 

‘তোমার উৎকণ্ঠার কারণ কী এই চিন্তাটাই? আমার তো মনে হয় ব্যাপারটা গৌরবের।’ 

‘হ্যাঁ, কিন্তু ওরা তো এমনিতেও মরা যাবে। যেমনটা গেছে ডাকবাহী পায়রা আর থায়লাসিনরা। তাই না? কিন্তু যুদ্ধ শুরু হলে তো রক্তক্ষয় হবে।’ 

‘আহ,’ মি. ওয়ার্ল্ড নড করলেন। 

লোকটা বুঝতে পারছে, ভাবল মোটকা। তারপর যোগ করল, ‘দেখুন, শুধু আমি একাই এসব ভাবছি না। রেডিয়ো মর্ডানের ক্রুদের সাথে আলোচনা করেছি এটা নিয়ে। ওরাও শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। অন্য অনেকেও তেমনটাই বলছে। বুঝতেই পারছেন।’ 

‘তা পারছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে জানাতে চাই, এমন অনেক তথ্য আমার কাছে আছে যা তুমি জানো না।’ এরপর যে হাসিটা দেখা গেল মি. ওয়ার্ল্ডের চেহারায়, তাকে হাসি না বলে ক্ষতঅলা একটাকে বিকৃত চেহারা বলাই ভালো। 

পিট পিট করে তাকাল ছেলেটা। ‘মি. ওয়ার্ল্ড, আপনার ঠোঁটের কী হয়েছে?’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল ওয়ার্ল্ড। ‘সত্যিটাই বলি,’ বলল সে। ‘অনেকদিন আগে একজন এই দুটোকে সেলাই করে লাগিয়ে দিয়েছিল।’ 

‘আয়-হায়,’ বলে উঠল হোঁতকা। ‘পুরো ওমের্তার কাহিনি দেখি।’ 

‘হ্যাঁ, আমাদের অপেক্ষার কারণ জানত চাইছ? জানতে চাইছ, কেন কাল রাতে আক্রমণ করলাম না?’ 

মাথা নাড়ল হোঁতকা, ঘামছে কুল কুল করে। 

‘আমরা এখনও আক্রমণ করিনি, কারণ একটা ডালের অপেক্ষা করছি।’

‘ডাল?’ 

‘ঠিক শুনেছ, একটা ডাল। ওটা দিয়ে কী করব, শুনবে?’ 

মাথা নাড়ল ছেলেটা। ‘হ্যাঁ, কী করবেন?’ 

‘তোমাকে বলতে পারি,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল মি. ওয়ার্ল্ড। ‘কিন্তু তাহলে তোমাকে হত্যা করতে হবে।’ বলে চোখ টিপল সে। সাথে সাথে হালকা হয়ে গেল ঘরের আবহাওয়া। 

খিল খিল করে হাসতে শুরু করল মোটকু। ঠিক আছে।’ বলল সে। ‘হি হি। ঠিক আছে, আমি বুঝতে পেরেছি।’ 

মাথা নাড়ল মি. ওয়ার্ল্ড। মোটকুর কাঁধে হাত রাখল সে। ‘সত্যি জানতে চাও?’

‘হ্যাঁ।’ 

‘যেহেতু আমরা বন্ধু, তাই বলছি। আমি ডালটা নেব। এরপর সেটা ছুড়ে দেব আমাদের দিকে আক্রমণ করতে আসা সেনাদলের দিকে। আমি ছুড়ে দেওয়া মাত্র ডালটা পরিণত হবে একটা বর্শায়। যখন ওটা সেনাদলের ওপরে পৌঁছাবে, তখনও চিৎকার করে বলল ‘এই যুদ্ধটাকে আমি ওডিনের নামে উৎসর্গ করলাম 

‘হাহ! কেন?’ 

‘ক্ষমতা…,’ চিবুক চুলকাতে চুলকাতে বলল মি. ওয়ার্ল্ড। ‘আর টিকে থাকার জন্য। আসলে এই যুদ্ধের ফলাফলে কিছুই যায় আসে না। আমাদের দরকার বিশৃঙ্খলা আর খুনোখুনি।’

‘আমি বুঝতে পারছি না।’ 

‘দেখাচ্ছি তোমাকে,’ বলল মি. ওয়ার্ল্ড। ‘মন দিয়ে খেয়াল করো!’ এই বলে তার বারবেরির বর্ষাতির পকেট থেকে একটা শিকারির ছুরি বের করে আনল সে। তারপর দক্ষ হাতে সেটা ঢুকিয়ে দিল মোটকুর থুতনির নিচে, চাপ দিয়ে মগজে সেঁধিয়ে দিল ফলা। ‘এই মৃত্যুকে ওডিনের জন্য উৎসর্গ করলাম।’ বলল সে। 

লোকটার হাতের ওপরে এসে পড়ল কিছুটা তরল, তবে রক্ত না ওটা। মোটকু ছেলেটার চোখের পেছন থেকে ভেসে এলো স্পার্কের শব্দ। বাতাস ভারী হয়ে উঠল পোড়া তারের গন্ধে। কয়েকবার কেঁপে উঠল মোটকু ছেলেটার দেহ, তারপর আছড়ে পড়ল মেঝেতে। হোঁতকার চেহারার ভাবটাকে বিভ্রান্তি আর দুঃখ বলা চলে। ‘ওই দেখ,’ বাতাসকে উদ্দেশ্য করে বলল যেন মি. ওয়ার্ল্ড। ‘মনে হচ্ছে, চোখের সামনে শূন্য আর এককে পায়রা হয়ে উড়ে যেতে দেখেছে!’ 

খালি করিডর থেকে উত্তর এলো না কোনো। 

কাঁধের উপর তুলে নিলো সে দেহটাকে, এমন ভঙ্গিতে যেন ওটার কোন ওজনই নেই। এরপর একটু গোপন একটা জায়গায় নিয়ে গিয়ে ঢেকে রাখল কাপড় দিয়ে। সন্ধ্যায় লাশটার একটা গতি করা যাবে। যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝে একটা লাশ ফেলে দেওয়া আর এমনকী ব্যাপার! কে দেখবে? আর দেখলেই বা কী? 

কিছুক্ষণ নীরবতা বজায় রইল জায়গায়। তারপর ভরাট আর কর্কট একটা কণ্ঠ, যেটা মি. ওয়ার্ল্ডের না, বলে উঠল, ‘দারুণ শুরু।’ 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *