আমেরিকান গডস – ১৬

অধ্যায় ষোলো 

‘আমি জানি পাতানো। কিন্তু এই শহরে যে আর কোনো জুয়া নেই!’

–কানাডা বিল জোনস 

.

গাছটা নেই, সাথে করে নিয়ে গেছে বিশ্বকেও, মাথার ওপরে এতক্ষণ ধরে ঝুলে থাকা ধূসর আকাশও নেই। এখন ওটার রং মাঝরাতের মতো। অনেক ওপরে একটা মাত্র শীতল তারকা আলো ছড়াচ্ছে। এক পা এগোল শ্যাডো, আরেকটু হলেই হোঁচট খাচ্ছিল। 

নিচের দিকে তাকালো শ্যাডো। পাথরে ধাপ খোদাই করা আছে, এত বড়ো বড়ো ধাপ যে দানো ছাড়া আর কারও পক্ষে কাজটা অসম্ভব। নিশ্চয়ই ওই ধাপগুলো ব্যবহার করে অনেক দিন আগে নিচে নেমেছিল তারা। 

কখনও লাফিয়ে…কখনও হাচড়ে-পাচড়ে নামতে শুরু করল ও। ব্যথায় আর্ত- চিৎকার করছে ওর দেহ, তবে এই ব্যথা অনেকদিন পর দেহকে ব্যবহার করার ব্যথা। গাছ থেকে ঝোলার ব্যথা নয়। 

অবাক না হয়েই বুঝতে পারল, এখন পুরোপুরি পোশাক পরিহিত সে! জিন্স আর সাদা টি-শার্ট আছে পরনে, অবশ্য পা খালি। দে জা ভ্যুর একটা অনুভূতি হলো ওর: যরিয়া পলুনোচনিয়ার সাথে কাটানো সেই রাতে এই পোশাকটাই পরে ছিল। মেয়েটা সে রাতে আকাশ থেকে ওর জন্য চাঁদকে তুলে এনেছিল। 

এরপর কী হবে, তা পরিষ্কার বুঝতে পারল শ্যাডো। যরিয়া পলুনোচনিয়া এসে উপস্থিত হবে। 

ধাপগুলোর নিচে ওর জন্যই অপেক্ষা করছিল মেয়েটা। আকাশে চাঁদ নেই আজ। কিন্তু তারপরও চাঁদের রুপালি আলো ঠিকরে পড়ছে ওর গায়ে। সাদা চুলগুলো চাঁদের মতোই মলিন দেখাচ্ছে। শিকাগোতে যেমন ঝালর দেওয়া সুতির নাইটগাউন পরে ছিল, আজও তাই আছে। 

শ্যাডোকে দেখে হাসল মেয়েটা। ‘হ্যালো।’ 

‘হাই,’ বলল শ্যাডো। 

‘কেমন আছ?’ 

‘বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে যেন অদ্ভুত আরেকটা স্বপ্ন দেখছি। জেল থেকে বেরোবার পর, আমার সব স্বপ্নই কেন যেন অদ্ভুত হয়।’ 

চাঁদের আলোয় রুপালি মনে হচ্ছে যরিয়ার চেহারা (যদিও আকাশে চাঁদের কোনো চিহ্নও নেই। যেখানে দাঁড়িয়ে আছে এখন, সেখান থেকে তারাও দেখা যাচ্ছে না), বড়ো দুর্বল আর ভঙ্গুর দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। বলল, ‘চাইলে তোমার যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি। কিন্তু একবার সেগুলোর ব্যাপারে জ্ঞাত হলে, আর কখনও অজ্ঞাত হতে পারবে না।’ 

যরিয়াকে পার হয়েও সামনে অনেকদূর এগিয়েছে রাস্তাটা, দু’ভাগে ভাগ হয়ে। যেকোনো একটা বেছে নিতে হবে এখন, বুঝতে পারল ও। কিন্তু তার আগে অন্তত একটা কাজ করতে হবে শ্যাডোকে। জিন্সের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল ও, লিবার্টি ডলারের পরিচিত ওজনটা টের পেতেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। আলতো করে সেটাকে বের করে আনল শ্যাডো, ‘এটা তোমার।’ বলল যুবক। 

ঠিক তখন ওর মনে পড়ল, নিজের কাপড়গুলো সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা আছে গাছের গোড়ায়। যে থলে থেকে দড়ি বের করেছিল তিন বোন, সেই থলেতেই আবার রেখে দিয়েছে ওর পোশাক। এমনকি যেন বাতাসে উড়ে না যায়, সেজন্য সবচেয়ে বড়ো বোন সেটাকে পাথরচাপাও দিয়ে রেখেছিল। তাই বুঝতে পারল, বাস্তবের পয়সাটা এখনও ওখানেই আছে…পাথরের নিচে। অথচ পয়সা আছে ওর হাতেও। পাতালপুরীর প্রবেশ পথের সামনে দাঁড়িয়ে ওটাকে আঁকড়ে ধরে আছে এখন! 

হাত বাড়িয়ে পয়সাটা নিলো যরিয়া। ‘ধন্যবাদ। দুবার তোমার জন্য লিবার্টি, মানে স্বাধীনতা বয়ে এনেছে এটা,’ বলল সে। ‘এখন অন্ধকারের আলো হবে। 

পয়সাটা আঁকড়ে ধরে রইল কিছুক্ষণ ও, তারপর যতটা সম্ভব উঁচু করে মাথার উপর তুলল হাত…খুলে ফেলল হাতের মুঠি। কী আশ্চর্য, পয়সাটা পড়ে গেল না নিচে! বরং শ্যাডোরও মাথার প্রায় এক ফুট ওপরে ভেসে রইল। অবশ্য এখন আর ওটা রুপালি পয়সা নেই, পরিণত হয়েছে গ্রীষ্মের আকাশে রাতে দেখা চাঁদে। 

সেই চাঁদের আলোয় সামনে দুই ভাগ হয়ে যাওয়া পথের দিকে তাকাল শ্যাডো। ‘কোনটা ধরে এগোব?’ প্রশ্ন করল ও। ‘কোনটা নিরাপদ?’ 

‘যেকোনোটা বেছে নিতে হবে,’ উত্তরে জানাল মেয়েটা। ‘কিন্তু সাবধান, দুই পথের কোনটাই নিরাপদ না। কোনটায় যেতে চাও-নিরেট সত্যের পথে? নাকি নরম মিথ্যার?’ 

‘সত্যের,’ উত্তর দিল শ্যাডো। ‘অনেক কষ্ট করে এসেছি, আর মিথ্যা চাই না।’

মাথা নাড়ল মেয়েটা। ‘তাহলে দাম চুকাও।’ 

‘কী দিতে হবে?’ 

‘তোমার নাম…আসল নাম।’ 

‘কীভাবে দেব?’ 

‘এই যে এভাবে,’ বলে নিখুঁত হাতটা শ্যাডোর মাথার দিকে বাড়াল যরিয়া। শ্যাডো টের পেল নরম আঙুলগুলো ওর ত্বক স্পর্শ করছে। পরক্ষণে চামড়া ভেদ করে, খুলি ভেদ করে মাথার আরও গভীরে পৌঁছে গেল। শিরশির করে উঠল ওর খুলি, শিরদাঁড়া। বেশিক্ষণ হাত ভেতরে রাখেনি মেয়েটা, বের করে এনেছে। জ্বলন্ত ম্যাগনেসিয়াম যেমন আলো দেয়, ঠিক তেমন একটা শিখা দেখা গেল ওর তর্জনীর ওপরে…নাচছে। 

‘ওটা আমার নাম?’ জানতে চাইল ও। 

হাত বন্ধ করে ফেলল যরিয়া, সাথে সাথে উধাও হয়ে গেল শিখা। ‘ছিল,’ বলল সে। এরপর হাত তুলে ডান দিকের পথটা দেখাল। ‘এবার এদিকে যাও।’

নামহীন হয়ে, শ্যাডো চাঁদের আলোয় ধরল ডান দিকের পথ। একটু এগিয়ে যখন ধন্যবাদ জানাবার জন্য পিছু ফিরে তাকাল, তখন দেখতে পেল কেবল কালো অন্ধকার। এগিয়ে গেল ও। অচিরেই বাঁক পড়ল সামনে। 

যদি এ-ই হয় মৃত্যুর পরের জীবন, বাঁক ঘুরতে ঘুরতে ভাবল শ্যাডো। তাহলে তা অনেকটাই দ্য হাউজ অন দ্য রকের মতো। 

ওয়ার্ডেনের অফিসে জেলের পোশাক পরিহিত অবস্থায় নিজেকে দেখতে পেল ও। ভদ্রলোক ওকে লরার দুর্ঘটনার ব্যাপারে জানাচ্ছেন। নিজের অনুভূতিটাও দেখতে পেল, মনে হলো সে এমন এক লোক যাকে দুনিয়া পরিত্যাগ করেছে। নিজের চেহারায় ভয়ের ছাপ দেখে কষ্ট পেল শ্যাডো, তাই তাড়াতাড়ি পা বাড়াল। এরপর নিজেকে আবিষ্কার করল ইগল’স পয়েন্টের ঠিক বাইরে অবস্থিত একটা ভিসিআর রিপেয়ার স্টোরে। আজ থেকে তিন বছর আগের এক দৃশ্যে। 

ও জানে, দোকানের ভেতরের শ্যাডো পিটিয়ে ল্যারি পাওয়ার্স আর বিজে ওয়েস্টের হাড়-মাংস এক করছে। অচিরেই দোকানটা থেকে বেরিয়ে আসবে সে, হাতে থাকবে বিশ ডলারের নোটে ভরতি একটা বাদামি ব্যাগ। এই টাকাটা ওর ভাগের অংশ, ল্যারিরা কোনোদিন কারও কাছে অভিযোগ জানাতে পারবে না। অবশ্য হ্যাঁ, ভাগের চাইতে কিছুটা বেশিই নিয়ে এসেছে শ্যাডো। ওটুকু ওকে আর লরাকে ধোঁকা দেবার চেষ্টা করার জরিমানা। পুরো পরিকল্পনায় ওর ভূমিকা ছিল চালকের, নিজের কাজ যথাযথভাবেই সম্পন্ন করেছিল সে। 

বিচারের সময় ব্যাংক ডাকাতির কথা উচ্চারণও করেনি কেউ, যদিও সবাই তা মনে মনে চাচ্ছিল। সমস্যা হলো, ওদের মাঝে কেউ মুখ না খুললে সেটা প্রমাণ করার উপায় ছিল না কর্তৃপক্ষের হাতে। আর তিনজনের কেউই মুখ খোলার কথা কল্পনাও করেনি। বাধ্য হয়ে শারীরিক আক্রমণের অভিযোগটাই কেবল আনতে পেরেছিল উকিল। হাসপাতালে ভর্তি হবার সময় ল্যারি আর ওয়েস্টের অবস্থা কী হয়েছিল, তার ছবি দেখিয়েছিল লোকটা। ঝামেলা এড়াতে আত্মপক্ষ খুব একটা সমর্থন করেনি শ্যাডো। এদিকে ল্যারি বা ওয়েস্ট, দুজনের কেউ ঝগড়ার কারণ নিয়ে মুখ খোলেনি। তবে সে-ই যে আক্রমণকারী একথা বলেছিল। 

টাকার প্রসঙ্গও ওঠেনি তাই। 

ওঠেনি লরার কথাও, শ্যাডো তাতেই খুশি ছিল। 

শ্যাডোর একবার মনে হলো, এরচাইতে মিথ্যার পথ ধরে এগোলেই বুঝি বেশি ভালো হতো। দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলল ও। এবার এসে উপস্থিত হলো শিকাগোর এক সরকারি হাসপাতালের ঘরে। মনে হলো, পেটের ভেতর থেকে সব কিছু যেন উগড়ে আসবে। থমকে দাঁড়াল সে, সামনের কিছু দেখতে চায় না। চায় না আর একটা পদক্ষেপও ফেলতে। 

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আবার মারা যাচ্ছেন ওর মা, যেমন মারা গেছিলেন শ্যাডোর ষোলো বছর বয়সের সময়। ওই যে বসে আছে শ্যাডো, মুখে ব্রণ নিয়ে মাথা নিচু করে এক মনে পেপারব্যাক বই পড়ছে। আসলে পড়ছে না বলে তাকিয়ে আছে বলাই ভালো। বইটার নাম কী, তা মনে করার প্রয়াস পেল বর্তমানের শ্যাডো। কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেল অতীতের শ্যাডোর কাছে। গ্রাভিটি’স রেইনবো পড়ছে ছেলেটা, মায়ের মৃত্যুর হাত থেকে পালিয়ে আশ্রয় খুঁজছে লন্ডনের কাল্পনিক এক জগতে। 

মরফিন দেওয়া হয়েছে বলে আরামে ঘুমাচ্ছেন ওর মা। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন, রোগটা তেমন বড়ো কিছু না। কিন্তু পরে আবিষ্কার হলো, আসলে তিনি লিম্ফোমা নামক ক্যান্সারে ভুগছেন! তা-ও একেবারে শেষ পর্যায়ে। ভদ্রমহিলার ত্বকে কেমন যেন হলদে-ধূসর একটা আভা চলে এসেছে। বয়স ত্রিশের শুরুর দিকে হলেও দেখতে আরও অনেক বেশি বয়স্ক মনে হয়। 

তরুণ শ্যাডোকে ঝাঁকাতে ইচ্ছা হলো বর্তমানের শ্যাডোর। ইচ্ছা হলো মার সাথে কথা বলা বলার আদেশ দেয়। কিন্তু না, নিজেকে স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারল না ও। চুপচাপ তাকিয়ে দেখল: কীভাবে মায়ের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চুপচাপ বসে মোটা একটা বই পড়ছিল সে। 

এরপর খুব একটা পড়া হয়নি ওর। কাল্পনিক গল্প পড়ে লাভ কী? ওগুলো জীবনের রূঢ় বাস্তবতাকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে না। 

ঘরটা থেকে বেরিয়ে এলো শ্যাডো, ভূ-গর্ভস্থ সুড়ঙ্গ ধরে এগিয়ে যেতে লাগল। আবার সে দেখতে পেল মাকে। এমন কমবয়সি অবস্থায় দেখার কথা মনে নেই ওর, টেনেটুনে পঁচিশ হবে হয়তো। ওদের প্রাক্তন অ্যাপার্টমেন্টে দাঁড়িয়ে আছে এখন শ্যাডো। চারপাশে তাকাল একবার, যদি কবেকার ঘটনা দেখছে সে ব্যাপারে ধারণা পাওয়া যায়! নিজেকে আবিষ্কার করল সে মায়ের সাথে তর্করত অবস্থায়। ছোটোখাটো, বড়ো বড়ো চোখ আর কালো চুলের একটা বাচ্চা গলা ফুলিয়ে চিৎকার করছে। শ্যাডো জানে, এই ঝগড়ার বিষয়বস্তু কী। কেননা মায়ের সাথে আর কিছু নিয়ে কখনও ঝগড়া হয়নি ওর। 

–কে আমার বাবা? 

–মারা গেছে। ওর ব্যাপারে আর কোনো প্রশ্ন করো না। 

–বুঝলাম, কিন্তু তার পরিচয়টা অন্তত বলো। 

–ভুলে যাও লোকটাকে। যে মৃত, সে মৃত। 

–আমি বাবার একটা ছবি দেখতে চাই। -আমার কাছে নেই। 

সাধারণত এই কথাটা বলার সময় মার কণ্ঠ তীক্ষ্ণ অথচ নিচু হয়ে যেত। শ্যাডো জানে এই কণ্ঠের অর্থ হলো, আরও প্রশ্ন করলে মারও খেতে হতে পারে। শ্যাডো এ-ও জানে, ওই বয়সে তা বোঝার ক্ষমতা ওর ছিল না। তাই এগিয়ে গেল সুড়ঙ্গ ধরে। 

এঁকে-বেঁকে, ঘুরে-পেঁচিয়ে এগিয়ে গেছে পথটা; সাপের খোলস আর গাছের শিকড়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে ওকে। বাঁ দিকে আচমকা একটা ডোবা দেখা গেল, সেই সাথে টপ টপ শব্দ। সম্ভবত সুড়ঙ্গের আরও সামনে কোথাও পানি ঝরছে উপর থেকে। হাঁটু ভাঁজ করে বসল ও, আঁজলায় তুলে পান করল পানি। তারপর আবার হাঁটতে শুরু করল শ্যাডো। 

থামল যখন ডিস্কো ফ্লোরের মতো রঙ-বেরঙের আলোতে চারপাশ ভরে উঠেছে, তখন। মনে হচ্ছে ওর-মহাবিশ্বের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ও, সবগুলো তারা আর গ্রহ ওকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে। কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছে না শ্যাডো। নাহ, গানের সুরের কারণে বা চেঁচামেচির কারণে না। চোখের সামনে এক মেয়েকে দেখতে পাচ্ছে সে, মনে হচ্ছে মেয়েটা ওর মা। কিন্তু এত অল্প বয়সে কখনও মাকে দেখেনি বলে বুঝতে পারছে না… 

…নাচছেন তিনি। 

কার সাথে নাচছেন, সেটা দেখার জন্য ঘুরল শ্যাডো। লোকটাকে দেখামাত্র চিনতে পারল ও, অবাক হলো না এক বিন্দুও। গত তেপান্ন বছরে তার একটুও পরিবর্তন হয়নি। 

মা যে মাতাল হয়ে আছেন, সেটা এক নজর দেখেই বুঝতে পারল শ্যাডো। বদ্ধ মাতাল নন; তবে মদ্যপানে অনভ্যস্ত কেউ একটু বেশি পান করলে তার যে অবস্থা হয়, তেমন অবস্থা তার। মার্গারিটা পান করছেন তিনি, তার ঠোঁটে লেগে আছে লবণ। লবণ লেগে আছে তার হাতের উলটো পিঠেও। 

ওয়েনসডের পরনে আজ অবশ্য স্যুট আর টাই নেই। কিন্তু গাছের আকৃতিতে বানানো পিনটা শার্টের পকেটে লাগানো। বয়সের উল্লেখযোগ্য পার্থক্য থাকলেও, পাশাপাশি দুজনকে মানিয়েছে বেশ। 

আস্তে আস্তে নাচছেন তারা, থাবার মতো একটা হাত দিয়ে মাকে আরও কাছে টেনে নিচ্ছেন ওয়েনসডে। অন্য হাতটা তার চিবুকে, ধীরে ধীরে উঁচু করে ধরছেন। পরস্পরকে চুমু খেলেন দুজন। 

কিছুক্ষণ পরেই বিদায় নিলেন তারা। ওয়েনসডের পিছু পিছু গেলেন ওর মা। হাত দিয়ে চোখ ঢাকল শ্যাডো, ওদেরকে অনুসরণ করতে চায় না। কার ঔরসে আর কার গর্ভে জন্মেছে, সেটা জানতে পেরেই খুশি ও। গর্ভধারণ প্রক্রিয়াটা দেখার ইচ্ছে নেই। 

কপাল ভালো ওর, দেখতে হলোও না। উধাও হয়ে গেল ডিস্কো ফ্লোরের আলো, এখন আলোক-উৎস বলতে কেবল মাথার উপর ঝুলে থাকা ছোটো চাঁদটা। 

হাঁটতে থাকল শ্যাডো। একটা বাঁকের কাছে এসে শ্বাস নেবার জন্য থমকে দাঁড়াল। 

আচমকা পিঠে একটা নরম স্পর্শ টের পেল ও। ‘হ্যালো,’ পেছন থেকে কমনীয় একটা কণ্ঠ ভেসে এলো। 

‘হ্যালো,’ ঘুরে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল শ্যাডো। 

মেয়েটার চুল বাদামি, ত্বক বাদামি; চোখজোড়া টানা-টানা, মধুর মতো ঘন বাদামি। ‘আমি কী তোমাকে চিনি?’ বিভ্রান্ত শ্যাডো জানতে চাইল। 

‘ভালোভাবেই চেনো,’ মৃদু হাস্যের ফাঁকে বলল মেয়েটা। ‘তোমার বিছানায় ঘুমাতাম, তোমার ওপর নজর রেখেছে আমার লোকেরা।’ সামনের পথের দিকে ইঙ্গিত করল সে। ‘সামনে পথটা তিন ভাগে ভাগ হয়েছে। একটা তোমাকে জ্ঞানী বানাবে। একটা করবে সম্পূর্ণ, আর একটায় লেখা আছে তোমার মরণ।’ 

‘আমার তো মনে হয়, আমার মৃত্যু হয়ে গেছে!’ বলল শ্যাডো। ‘গাছে ঝোলা অবস্থায়।’ 

‘মৃত্যু যেমন আছে,’ ঠোঁট গোল করে বলল মেয়েটা। ‘তেমনি আছে মরণ, আবার আছে মহাপ্রয়াণ। পুরোটাই আপেক্ষিক।’ আবার হাসি দেখা গেল তার ঠোঁটে। ‘চাও তো এ নিয়ে তোমাকে একটা কৌতুক শোনাতে পারি।’ 

‘থাক,’ বলল ও। ‘লাগবে না।’ 

‘তাহলে,’ জানতে চাইল মেয়েটা। ‘কোন পথে যাবে?’ 

‘আমি জানি না।’ মেনে নিলো শ্যাডো। 

এক দিকে মাথা কাত করল মেয়েটা, একদম বিড়ালের মতো। সাথে সাথে সেই স্বর্গীয় রাতের কথা মনে পড়ে গেল ওর, লাল হয়ে গেল লজ্জায়। ‘আমাকে বিশ্বাস করো?’ জানতে চাইল বাস্ট। ‘করলে তোমার হয়ে বেছে দেব।’ 

‘করি।’ বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে বলল শ্যাডো। 

‘বিনিময়ে কী দিতে হবে, জানতে চাইলে না?’ 

‘আমার নাম এরইমাঝে দিয়ে দিয়েছি।’ 

‘নাম আসে, নাম যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিনিময়ে যা পেয়েছ তা নিয়ে কী তুমি সন্তুষ্ট?’ 

‘হয়তো, সম্ভবত। যা আমার সামনে উন্মোচিত হয়েছে, তা অনেকটাই ব্যক্তিগত।’ 

‘সব ধরনের উন্মোচনই তাই। আর সেজন্যই উন্মোচন মানেই সন্দেহের বিষয়বস্তু।’ 

‘তোমার কথা বুঝতে পারলাম না।’ 

‘পারার কথাও না,’ বলল বাস্ট। ‘আমি তোমার হৃদয় নেব, পরে কাজে লাগবে।’ হাত বাড়িয়ে শ্যাডোর বুকের ভেতরে ঢোকাল মেয়েটা, লালচে কিছু একটা বের করে আনল ক্ষণিকের মাঝেই। কবুতরের রক্তের মতো রং ওটার, নির্মিত হয়েছে নিখাদ আলো দিয়ে। মেয়েটার হাতে ধরা অবস্থাতেও স্পন্দিত হচ্ছে। 

হাত মুষ্টি করল মেয়েটা, উধাও হয়ে গেল আলো। 

মাঝখানের রাস্তা ধরে এগোও। 

মাথা নেড়ে তাই করল শ্যাডো। 

পথটা এখন পিচ্ছিল হয়ে গেছে। পাথরের ওপরে জমেছে বরফ। মাথার ওপরের চাঁদটার আলো ঝিক ঝিক করছে থেকে থেকে। বরফের কারণে আলো প্রতিফলিত হয়ে চাঁদটাকে ঘিরে শুরু হয়েছে অপূর্ব এক গোলকের। কিন্তু এতে দেখতে কষ্ট কচ্ছে শ্যাডোর। হাঁটতেও বেগ পেতে হচ্ছে। 

তিন ভাগ যেখান থেকে শুরু হয়েছে, সেখানে এসে উপস্থিত হলো ও। প্রথম রাস্তাটা পরিচিত বলে মনে হলো, যেন এক বিশাল চেম্বারে যাওয়া যাবে ওটা ধরে। অনেকটা অন্ধকার একটা জাদুঘরের মতো। জায়গাটা কী বুঝতে অসুবিধা হলো না ওর, কানে আসছে ছোটো ছোটো অনেক আওয়াজের প্রতিধ্বনি। 

এই জায়গাটা স্বপ্নে দেখেছে শ্যাডো। মৃত্যুর পর যে রাতে লরা প্রথম ওর কাছে এসেছিল, সেই রাতে। ভুলে যাওয়া দেবতাদের আবাসস্থল এটা। এক পা পিছিয়ে এলো সে। 

এবার তৃতীয় পথের সামনে এসে দাঁড়াল ও। করিডরটাকে দেখে মনে হয় যেন ডিজনিল্যান্ড থেকে তুলে আনা। এখানেও একটা আওয়াজ কানে এলো ওর-ভারী, কম্পনের আওয়াজ। থমকে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাল একবার। দুই পথের একটাকেও সুবিধার লাগছে না। তাই মাঝখানের যে পথটার কথা ওকে বিড়াল-মানবী বলেছে, সেটা ধরেই এগোবার সিদ্ধান্ত নিলো। 

ছোট্ট চাঁদটা আস্তে আস্তে আলো হারাতে শুরু করেছে, যেন গ্রহণ লেগেছে তাতে। পথটা ধরে একটু এগোতেই নজরে এলো বিশাল একটা দরজা। 

প্রায় অন্ধকারে ওটার দিকে এগিয়ে গেল শ্যাডো, বাতাসটা উষ্ণ। ভেজা ধুলোর গন্ধ লাগছে নাকে। বসন্তের প্রথম বৃষ্টির পর, বড়ো শহরের রাস্তায় এই গন্ধ মেলে। 

ভয় পাচ্ছে না ও। 

গাছে থাকা অবস্থায় মরে গেছে ওর ভেতরে ভয়টা, যেমন মরেছে সে নিজেও। এখন নেই কোনো ভয়, কোনো ঘৃণা…কিংবা ব্যথা। আছে কেবল নির্যাসটুকু। 

দূরে কোথাও বিশালাকার কিছু একটা ঝাঁপ দিল পানিতে, তার আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে চারপাশে। চোখ কুঁচকে তাকাল শ্যাডো, কিন্তু অন্ধকারে দেখতে পেল না কিছুই। আচমকা শব্দের উৎপত্তিস্থল থেকে ওর দিকে ধেয়ে এলো ভূতুড়ে আলো, নিজেকে সে উপস্থিত করল একটা গুহায়। সামনে পানি, তলটা আয়নার মতোই নিস্তরঙ্গ। 

পানির শব্দ আস্তে আস্তে কাছিয়ে আসছে, সেই সাথে পাল্লা দিয়ে উজ্জ্বল হচ্ছে আলো। আসছে কিছু একটা, তীরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল শ্যাডো। দ্রুতই দেখতে পেল একটা নিচু আর সমতল নৌকা এগিয়ে আসছে, ওটার মাস্তুলে দপদপ করে ঝুলছে একটা সাদা লন্ঠন। আরেকটা ঝুলছে তার একটু নিচে থেকেই। লম্বা একটা অবয়ব দাঁড় বাইছে। এতক্ষণ ধরে শুনতে পাওয়া আওয়াজটা আসলে দাঁড়ের ওঠা-নামার। 

‘হ্যালো!’ ডাকল শ্যাডো। শব্দটা প্রতিধ্বনিত হতে লাগল ওর চারপাশ ঘিরে। শ্যাডোর মনে হলো যেন অসংখ্য মানুষ ওকেই আবার সম্ভাষণ জানাচ্ছে। 

কিন্তু দাঁড় বাইতে থাকা লোকটার মুখে রা নেই। 

লম্বা আর একদম কাঠির মতো শুকনো লোকটা। অবশ্য এতদূর থেকে ওটা আসলেই পুরুষ, নাকি মহিলা তা বোঝা যাচ্ছে না। সাদামাটা একটা সাদা রোব জড়িয়ে আছে দেহে, মাথাটা দেখে মনে হয় না ওটা মানুষের। বরঞ্চ মুখোশ হলেও শ্যাডো অবাক হবে না। ছোটো ঘাড় আর লম্বা ঠোঁটঅলা পাখির মতো বলে মনে হচ্ছে। আগেও এমন একটা অবয়ব দেখেছে যুবক, কোথায় তা একটু ভাবতেই মনে পড়ে গেল। হাউজ অন দ্য রকে যখন স্টলে পয়সা ঢুকিয়েছিল, তখন মাতালের পেছন দিকের একটা কবরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছিল এই অবয়ব। 

দাঁড় থেকে পানি ঝরছে, আয়নার মতো জলধারার তলে সৃষ্টি হচ্ছে ছোটো ছোটো ঢেউ। নৌকাটা নলখাগড়ার তৈরি। 

তীরের কাছে আসতে বেশিক্ষণ সময় নিলো না ওটা, আস্তে আস্তে শ্যাডোর দিকে ঘুরে তাকাল মাঝি। ‘হ্যালো,’ পুরুষালী কণ্ঠে বলল লোকটা। শ্যাডোর এই সংক্ষিপ্ত ‘মৃত্যু-পরবর্তী’ জীবনের অন্য সব অস্তিত্বের মতো একেও পরিচিত লাগল ওর। ‘উঠে পড়ো, অবশ্য পা ভিজে যাবে বলে মনে হয়। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। নৌকাটার বয়স অনেক, কাছে এলে তলায় ফাটল ধরতে পারে। 

জুতো খুলে পানিতে পা রাখল শ্যাডো, হাঁটু আর গোড়ালির মাঝামাঝি পর্যন্ত গভীর এখানকার পানি। বেশ উষ্ণই বলা চলে। নৌকাটার কাছে পৌঁছালে, মাঝি এক হাত দিয়ে ওকে উঠতে সাহায্য করল। 

তীর থেকে দূরে সরে এলো নৌকা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছে শ্যাডো। ওর প্যান্ট থেকে ঝরছে পানি। 

‘আমি চিনি তোমাকে। 

‘তা চেন,’ মাঝি বলল। আচমকা লাফিয়ে উঠল লন্ঠনের আগুন। নির্গত ধোঁয়ার দমকে কেশে ফেলল শ্যাডো। তুমি আমার হয়ে কাজ করেছ। তবে তোমাকে ছাড়াই আমাদের লিলা গুডচাইল্ডকে কবর দিতে হয়েছে।’ 

চোখ দিয়ে পানি ঝরছে শ্যাডোর, হাত দিয়ে মুছে ফেলল ফোঁটাগুলো। ধোঁয়া ভেদ করে এক পলকের জন্য দেখা গেল স্যুট পরিহিত, লম্বা এক লোককে। কিন্তু ধোঁয়া কেটে যেতেই উধাও হয়ে গেল সে। 

‘মিস্টার আইবিস?’ 

‘আবার দেখা হয়ে ভালো লাগছে,’ বলল মাঝি, অবিকল মি. আইবিসের কণ্ঠে। ‘সাইকোপম্প কাকে বলে জানো।’ 

শব্দটা শুনেছে বটে যুবক, কিন্তু অনেক আগে। তাই মাথা নেড়ে না করল। ‘সঙ্গীর আরেকটা গালভরা নাম।’ জানাল ওকে মি. আইবিস। ‘আমাদের প্রত্যেকেরই অগণিত দায়িত্ব, বেঁচে থাকার অগণিত উপায়। নিজেকে আমি লেখক ভাবি, যে কিনা নিজের ছোটো ছোটো গল্পের দ্বারা এমন এক অতীতকে তুলে ধরে যার হয়তো কোনোদিন অস্তিত্বও ছিল না। আবার দায়িত্বের কারণে আমি একজন সাইকোপম্প-জীবিতকে মৃতের দুনিয়ায় নিয়ে যাই।’ 

‘আমি তো ভেবেছিলাম, এটাই মৃতদের দুনিয়া।’ বলল শ্যাডো। 

‘ঠিক তা না। বলতে পারো, ওই দুনিয়ায় যাবার আগের ধাপ এটা।’ 

ডোবাটার উপর দিয়ে বিনা বাধায় এগিয়ে যাচ্ছে নৌকা। আচমকা মি. আইবিস তার ঠোঁট না নাড়িয়েই বললেন, ‘এমনভাবে তোমরা জীবিত আর মৃত নিয়ে কথা বলো, যেন দুটো পুরোপুরি আলাদা। যেন এমন কোনো নদী পাওয়া যাবে না, যেটা আবার রাস্তাও! এমন কোনো গান নেই যেটা রঙও!’ 

‘আছে নাকি?’ 

‘তোমার মনে রাখতে হবে,’ ধীরে ধীরে বললেন আইবিস। ‘জীবন আর মৃত্যু আসলে একই পয়সার এপিঠ-ওপিঠ।’ 

‘যদি আমার কাছে দুই নম্বর পয়সা থাকে, যার দুটো পিঠই এক?’ 

‘ওমন কিছু কারও কাছে নেই।’ 

কালো পানির দিকে তাকিয়ে গা শিউরে উঠল শ্যাডোর, মনে হচ্ছে যেন এখনই ভেসে উঠবে শত শত বাচ্চার চেহারা। যারা একদৃষ্টিতে অনুযোগের চোখে তাকিয়ে থাকবে ওরই দিকে। 

‘আমি তাহলে মৃত,’ ভাবনাটা খুব একটা পোড়াল না শ্যাডোকে। ‘নয়তো মরতে চলেছি।’ 

‘আমরা যাচ্ছি মৃতদের হলঘরে। অনুরোধ করেই তোমাকে নিতে এসেছি আমি।’ 

‘কেন?’ 

‘কঠোর পরিশ্রমী কর্মী ছিলে তুমি। কেন আসব না?’ 

‘কেননা…’ মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিলো শ্যাডো। ‘কেননা আমি কখনও তোমাদেরকে বিশ্বাস করিনি। মিশরিয় দেব-দেবীদের ব্যাপারে আমি কিছু জানিই না। কেননা, আমি এসব আশা করিনি। ভেবেছিলাম, সেইন্ট পিটারের সাথে দেখা হবে মৃত্যুর পর।’ 

দুপাশে মাথা ঝাঁকাল পাখির মতো অবয়বটা। ‘আমাদের উপর বিশ্বাস রেখেছ কি না, তাতে কিছু যায় আসে না,’ গম্ভীর কণ্ঠে জানাল সে। ‘আমরা তোমার ওপর বিশ্বাস রাখি।’ 

অন্য পাশে পৌঁছে গেছে নৌকা, পানিতে নেমে পড়ল মি. আইবিস। শ্যাডোকেও বলল নামতে। নিজে মাস্তুলের দড়ি ধরে শ্যাডোকে বলল লন্ঠনটা নিতে। হেঁটে তীরে পা রাখল ওরা, দড়িটা একটা ধাতব আঙটার সাথে বাঁধল মি. আইবিস। এরপর শ্যাডোর হাত থেকে লণ্ঠন নিয়ে মাথার ওপরে ধরে এগিয়ে গেল। 

‘ভয় পাচ্ছ?’ জানতে চাইল সে। 

‘খুব একটা না।’ 

‘নিজের আত্মার জন্য ভয় পাবার চেষ্টা করো, যে পরিস্থিতিতে আমরা আছি তা বেশ গুরুতর।’ 

একদম ভয় লাগছে না শ্যাডোর, বরঞ্চ কৌতূহল হচ্ছে। অন্ধকারের ভয় নেই এখন ওর, মারা গেছে তো হয়েছে কি? এমনকী পথের যে কুকুরটা একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, তাকেও ভয় লাগছে না। 

‘শ্যাডো,’ বলল কুকুরটা, কণ্ঠ শুনে শিহরণ জাগল ওর দেহে। ‘বিচারের সময় সমাগত। 

‘মি. জ্যাকুয়েল?’ চিনতে পারল ও। 

আইবিসের বড়ো বড়ো হাতগুলো যেন পুতুলের মতো তুলে নিলো শ্যাডোর দেহ, নামিয়ে রাখল জ্যাকুয়েলের কাছে। 

উজ্জ্বল আর ঝকঝক করতে থাকা চোখ দিয়ে শ্যাডোকে পরখ করল ওটা, ঠিক যেমন টেবিলে শুয়ে থাকা মেয়েটার দেহ পরখ করেছিল মি. জ্যাকুয়েল। শ্যাডো বুঝতে পারছিল, ওর সব ভুল, সব অপরাধ, সব ব্যর্থতা বের করে মাপা হচ্ছে। মনে হচ্ছিল, ওকেও যেন খণ্ড-বিখণ্ড করছেন জ্যাকুয়েল। 

নিজের ব্যর্থতা বা নিজের সীমাবদ্ধতা প্রকাশ পায়, এমন সব ঘটনা আর কৃত কার্য-কালাপ মনে রাখি না আমরা। হয় সেগুলোকে ঢেকে দিই মিথ্যার চাদরে, আর নয়তো মুছে ফেলি মন থেকে। শ্যাডো জীবনে এমন অনেক কিছু করেছে, যেগুলো নিয়ে ও নিজেই গর্বিত নয়। এমন অনেক ইচ্ছা ছিল ওর, যা পূরণ করতে পারেনি। সেসবই এখন দখল করে নিলো ওর মন। অপরাধবোধ, অনুতাপ আর লজ্জায় ছোটো হয়ে গেল যেন। লাশের টেবিলে শুয়ে থাকা দেহের মতোই নগ্ন মনে হচ্ছে নিজেকে। শিয়াল দেবতা আনুবিস এই মুহূর্তে ওর উকিল, ওর বিচারক…ওর জল্লাদ। 

‘থামো,’ কাতর কণ্ঠে বলে উঠল সে। ‘দয়া করে থামো।’ 

কিন্তু থামাল না পরীক্ষা। এক জীবনে যত মিথ্যা বলেছে, যত জনকে কষ্ট দিয়েছে, যা কিছু চুরি করেছে-সব ছোটো-বড়ো অপরাধকে বের করে নিয়ে এলো আনুবিস। 

কাঁদতে শুরু করল শ্যাডো। সেই ছোটোবেলায় ফিরে গেছে যেন, নিজেকে অসহায় আর শক্তিহীন বলে মনে হচ্ছে। 

তারপর আচমকা, কোন পূর্ব-নির্দেশনা ছাড়াই, শেষ হয়ে গেল আনুবিসের পরীক্ষা। একই সাথে হাঁপাচ্ছে আর ফোঁপাচ্ছে শ্যাডো। নাক দিয়ে ঝরতে শুরু করেছে পানি। এখনও অসহায় লাগছে নিজেকে। 

‘ওর হৃদয় কই?’ গর্জে উঠল যেন আনুবিস। 

‘আমার কাছে,’ গড়গড় করে উঠল একটা নারী কণ্ঠ। মুখ তুলে তাকাল শ্যাডো। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে বাস্ট, হাতে শ্যাডোর হৃদয়। 

‘আমাকে দাও,’ থোথ, আইবিস-মাথার দেবতা হাতে নিলো হৃদয়টাকে। সে এগিয়ে আসতেই একটা স্বর্ণের দাঁড়িপাল্লা এগিয়ে দিল আনুবিস। 

‘এখন আমার ভাগ্য নির্ধারিত হবে?’ বাস্টকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল শ্যাডো। ‘স্বর্গে না নরকে না প্রায়শ্চিত্তের স্থানে?’ 

‘যদি তোমার হৃদয় আর পালকের ওজন সমান হয়,’ ওকে জানাল মেয়েটা। তাহলে নিজের ইচ্ছামতো বেছে নিতে পারবে।’ 

‘আর যদি না হয়?’ 

শ্রাগ করল বাস্ট, প্রসঙ্গটা ওকে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। ‘তাহলে তোমার হৃদয় আর আত্মা খেয়ে নেবে আমেমেত…’ 

‘আশা করি একটা আনন্দময় সমাপ্তি পাব আমি।’ 

‘সমাপ্তি বলেই যেখানে কিছু নেই,’ উত্তরে জানাল মেয়েটা। ‘সেখানে আনন্দময় সমাপ্তি পাবে কোত্থেকে?’ 

এক পাল্লায় তোলা হয়েছে শ্যাডোর হৃদয়, এবার অন্য পাল্লায় আলতো করে একটা পালক রেখে দিল আনুবিস। দাঁড়িপাল্লার নিচের অন্ধকারে হুটোপুটি করে ছুটে গেল কিছু একটা। ব্যাপারটা টের পেল বটে ও, কিন্তু সেটা কী তা দেখতে ইচ্ছা করল না। 

আসলেই পালকটা খুব ভারী, কিন্তু শ্যাডোর হৃদয়ও হালকা নয়। তাই একবার এই পাল্লা নিচে নামে তো অন্যবার ওই পাল্লা। 

শেষ পর্যন্ত সমান সমান হলো ওটা, অন্ধকারে থাকা প্রাণিটা আওয়াজ করে অসন্তুষ্টি জানান দিল। 

‘তাহলে আর কি!’ বলল বাস্ট। ‘আমার আশা ছিল, জীবনে কিছু হলেও ভালো কাজ করেছ। যাক, কী আর করা।’ 

নীরবতা নেমে এলো হলঘরে, নিস্তব্ধতা যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে অন্ধকার আর পানিতে। 

সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে শ্যাডো জানতে চাইল, ‘আমি কোথায় যেতে চাই, সেটা বাছতে হবে এখন?’ 

‘হ্যাঁ,’ জানাল থোথ। ‘অথবা তোমার হয়ে আমরাও বেছে দিতে পারি।’

‘না। অসুবিধা নেই, আমিই পারব।’ 

‘বলো তাহলে।’ গর্জে উঠল আনুবিস। 

‘আমি বিশ্রাম চাই। জানাল শ্যাডো। ‘স্বর্গ চাই না, নরকও চাই না। চাই শুধু বিশ্রাম। চাই এসবের পরিসমাপ্তি ঘটুক।’ 

‘তুমি নিশ্চিত?’ থোথের প্রশ্ন। 

‘হ্যাঁ।’ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে শ্যাডো। 

শ্যাডোর জন্য একটা দরজা খুলে ধরল মি. জ্যাকুয়েল। দরজার ওপাশে শূন্যতা। অন্ধকার না, বিস্মৃতি না…কেবলই শূন্যতা। 

আনন্দের সাথে আগে বাড়ল শ্যাডো, এক মুহূর্তের জন্যও ইতস্তত করল না। দরজা দিয়ে প্রবেশ করল দৃঢ় পায়ে। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *