আমেরিকান গডস – ১৫

অধ্যায় পনেরো 

ঝুলাও আমায়, ফাঁসির কাষ্ঠে; মরে গিয়ে চলে যাব,
ঝুলাও আমায়, ফাঁসির কাষ্ঠে; মরে গিয়ে চলে যাব।
করব না রাগ, পার করেছি অনেক লম্বা সময়,
কবরে শুয়ে রয়েছি অনেক কাল। 

–পুরনো গান 

.

গাছের সাথে ঝোলার প্রথম দিনটায় কিছুটা অস্বস্তি বোধ করেছিল কেবল শ্যাডো। আস্তে আস্তে সেটা রূপ নিলো ব্যথার, ভয়ের আর মাঝে মাঝে একঘেয়েমি আর নির্লিপ্ততার মাঝামাঝি এক অনুভূতিতে…যেন কিছু একটার অপেক্ষা ঝুলে রইল ও। 

বাতাসও স্থির হয়ে আছে। 

কয়েক ঘণ্টা পর, চোখে লাল আর সোনালি রঙের ঝলকানি দেখতে পেল সে। প্রতিটাই এমনভাবে নড়ছে যেন জীবন্ত! 

আস্তে আস্তে হাত আর পায়ের ব্যথা হয়ে উঠল অসহ্য। নরম করলে, লগব্যাগ করে দুলতে শুরু করে ওর দেহ। শক্ত করলে চাপ পড়ে গলায়, কাঁপতে শুরু করে দুনিয়া। তাই গাছটার কাণ্ডের সাথে নিজেকে আটকে রাখল ও। বুকের ভেতর চাপ অনুভব করছে, হৃৎপিণ্ড সম্ভবত ভুলে গেছে তার কাজ। মাঝে মাঝেই মিস করছে হৃৎস্পন্দন… 

চোখের সামনে এখন নেচে বেড়াচ্ছে নীলকান্তমণি, রুবি আর পান্না। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে বলে লম্বা বিরতি নিচ্ছি দুই শ্বাসের মাঝখানে। পিঠে ঘষা লাগছে গাছের রুক্ষ বাকল। বিকালের শীতলতা কাঁপিয়ে দিচ্ছে শ্যাডোকে। 

ব্যাপারটা একেবারেই সাধারণ, কেউ যেন ওর মনের ভেতরে বলে উঠল। হয় সহ্য করো, আর নয়তো মরো। 

ভাবনাটা কিছুটা হলেও স্বস্তি দিল ওকে, বারবার কথাটা আওড়াতে শুরু করল ও। মন্ত্র বানিয়ে নিলো যেন। 

ব্যাপারটা একেবারেই সাধারণ। হয় সহ্য করো, আর নয়তো মরো।
ব্যাপারটা একেবারেই সাধারণ। হয় সহ্য করো, আর নয়তো মরো।
ব্যাপারটা একেবারেই সাধারণ। হয় সহ্য করো, আর নয়তো মরো।
ব্যাপারটা একেবারেই সাধারণ। হয় সহ্য করো, আর নয়তো মরো। 

সময় বয়ে চলল, সেই সাথে চলল মন্ত্র জপা। আচমকা শ্যাডোর মনে হলো, কেউ যেন শব্দগুলো পুনরুচ্চারণ করছে! যখন ওর মুখের ভেতরটা শুকিয়ে এলো, যখন জিহ্বা হয়ে গেল সাপের ছেড়ে যাওয়া খোলসের মতো ককর্শ, তখনই কেবল বন্ধ হলে সেই অন্য কারও মন্ত্র জপা। পা দিয়ে ধাক্কা মেরে নিজেকে গাছ থেকে সরিয়ে নেওয়ার প্রয়াস পেল ও, প্রয়াস পেল বুক ভরে শ্বাস নেবার মতো সোজা হবার। 

বেশ কিছুক্ষণ পর, আবার হাল ছেড়ে দিতে হলো ওকে। আর পারছে না। আবারও ঝুলতে শুরু করল ও গাছ থেকে। 

খিটখিট শব্দ শুরু হলো আচমকা, মনে হলো যেন কেউ একসাথে তীব্র রাগ আর তীব্র আমোদে শব্দটার জন্ম দিচ্ছে। সাথে সাথে মুখ বন্ধ করে ফেলল শ্যাডো, বুঝতে পারছে যে শব্দটার উৎস ও নিজেই। কিন্তু না, তারপরেও বন্ধ হলো না ওটা। তাহলে এই বিশ্বই আমাকে নিয়ে হাসছে, ভাবল শ্যাডো। ওর মাথাটা কাত হয়ে গেছে একপাশে। ‘রাটাটস্ক,’ হঠাৎ কেউ বলে উঠল ওর কানে। নামটা নিজে উচ্চারণ করতে চাইল শ্যাডো, কিন্তু জিহ্বা পারল না ওর আদেশ পালন করতে। আস্তে আস্তে মাথা ঘোরাল যুবক, চোখ পড়ল এক কাঠবিড়ালির ধূসর-বাদামি চোখে। নজরে এলো প্রাণিটার চোখা দুই কান। 

কাছ থেকে দেখলে যে কাঠবিড়ালির চেহারা খুব একটা দৃষ্টি-নন্দন নয়, সেটা সেদিন বুঝতে পারল সে। ইঁদুরের মতো দেখতে প্রাণিটার আচরণে কেমন একটা প্রচ্ছন্ন হুমকির আভা, দাঁত দুটোও বেশ তীক্ষ্ণ মনে হয়। শ্যাডো ভাবল, এখন আমাকে খাবার বা হুমকি মনে না করলেই হয়। কাঠবিড়ালি মাংসাশী প্রাণী হবার কথা না…কিন্তু বিগত কিছু দিনের অভিজ্ঞতায় নিজের জ্ঞানের উপর ভরসা হারিয়ে ফেলেছে বেচারা… 

ঘুমিয়ে পড়ল শ্যাডো। 

.

পরবর্তী কয়েক ঘণ্টায় বেশ কবার ঘুম ভাঙ্গল ওর, প্রতিবার ব্যথার দমকে। অশুভ একটা স্বপ্নের মাঝখান থেকে যেন ওকে টেনে তুলল ব্যথা। সেই স্বপ্নে পুনর্জীবিত হয়েছিল মৃত বাচ্চারা, ওদের চোখগুলো ফোলা ফোলা… ঠিক ফুলে ওঠা 

মুক্তার মতো। শ্যাডোর কাছে এসে অনুযোগ করে বলছিল, ওদের প্রতি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে যুবক। একটা মাকড়সা ওর মুখের উপর হাঁটতে শুরু করায় আরেকবার ঘুম ভেঙে গেল ওরা। ওটাকে ঝটকা মেরে ফেলে দিয়ে, আবার ফিরে গেল স্বপ্নে। এবার দেখতে পেল হাতির মাথার এক স্ফীত উদরের লোক। সে বসে আছে একটা বিশালাকায় ইঁদুরের পিঠে, তার একটা গজদন্ত ভাঙা। হাতি- মাথার লোকটা শুঁড় বাঁকিয়ে শ্যাডোকে বলল, ‘তোমার এই যাত্রা শুরু করার আগে আমার সাহায্য চাইলে সম্ভবত কষ্ট কমাতে পারতাম।’ বলেই হাতে তুলে নিলো সে ইঁদুরটাকে। অবাক হয়ে শ্যাডো খেয়াল করল, আকার পরিবর্তন না করেই প্রাণিটা একেবারে ক্ষুদ্র হয়ে গেছে। চারহাতি হাতি-মাথার দেবতা এক হাত থেকে অন্য হাতে নিয়ে লোফালুফি করতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর যখন সবগুলো হাত খুলে দেখাল, তখন একদম অবাক হলো না শ্যাডো…যদিও চারটি হাতই খালি! নিস্পৃহ চেহারায় শ্যাডোর দিকে তাকাল দেবতা। 

‘শুঁড়ের ভেতর আছে,’ বলল শ্যাডো, মনোযোগ দিয়ে দেখছিল সবকিছু।

বিশাল মাথাটা নাড়াল হাতি-মাথা দেবতা। ‘ঠিক ধরেছ, ট্রাঙ্কেই আছে। মন দিয়ে শোনো, অনেক কিছু ভুলে যাবে তুমি। অনেক কিছু ফেলে যেতে হবে। তবে এই জিনিসটা কথাটা হারিয়ো না। ঠিক তখনই শুরু হলো বৃষ্টি। ঠান্ডা পানিতে ভেজা শ্যাডোর দেহ কেঁপে কেঁপে উঠল। গভীর ঘুম থেকে এক ঝটকায় পূৰ্ণ সজাগ হয়ে উঠল ও। আস্তে আস্তে কাঁপুনিটা এতটাই তীব্র আকার ধারণ করল যে ভয় পেয়ে গেল শ্যাডো। এমনভাবে যে কারও দেহ কাঁপতে পারে, তা ওর ধারণাতেই ছিল না। প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি খাঁটিয়ে কাঁপুনি বন্ধ করার চেষ্টা করল সে, কিন্তু ব্যর্থ হলো। দেহটা যেন অবাধ্য হয়ে গেছে, কোনো কথাই মানছে না। কাঁপুনির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে শুরু করল ব্যথা। যেন ছোটো ছোটো অগণিত ক্ষতের জন্ম দিচ্ছে একটা ছুরি। অসহ্য ব্যথা দখল করে নিলো শ্যাডোর সত্তাকে। 

.

হাঁ করে পড়ন্ত বৃষ্টির ফোঁটা মুখের ভেতরে নেবার চেষ্টা করছে শ্যাডো। ফেটে যাওয়া ঠোঁট আর শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া জিহ্বা কিছুটা হলেও শান্তি পেল তাতে। সেই সাথে ভিজে গেছে ওকে বেঁধে রাখা দড়িও। আচমকা গর্জে উঠল আকাশ, বজ্রের আলোতে ঝলসে গেল শ্যাডোর চোখ, যেন কোনো অদৃশ্য ইঙ্গিতে আগের চাইতে দ্বিগুণ বেগে পড়তে শুরু করল বৃষ্টি। বৃষ্টির আর রাতের আগমন টের পেয়েই হয়তো বিদায় নিলো ছুরিটা, কমে এলো কাঁপুনি। এখন আর ঠান্ডা লাগছে না শ্যাডোর। উহু, ভুল হলো। ঠান্ডা এখন ওর অংশে পরিণত হয়েছে। 

শ্যাডোকে ঝুলন্ত অবস্থায় রেখে আকাশে নেচে বেড়াচ্ছে বজ্ৰ। গুড়গুড় শব্দ এখন চিরস্থায়ী, বজ্রপাত উধাও হয়েছে। তবে একেবারে বিদায় নেয়নি, এখনও অনেকক্ষণ পরপর চিৎকার করে নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছে সে। যুবকের দেহকে নিয়ে খেলছে এখন বাতাস, চাইছে ওকে গাছ থেকে টেনে নিচে নামাতে, চাইছে ওর চামড়া তুলে নিতে, হাড়গুলোকে করতে টুকরা টুকরা। শ্যাডোর অন্তরাত্মা বুঝতে পারল, এতক্ষণে শুরু হয়েছে প্রকৃত ঝড়। 

অদ্ভুত এক আনন্দ দখল করে নিলো ওর মন, হাসতে শুরু করল প্রাণখুলে। এদিকে বৃষ্টি যেন প্রতি মুহূর্তে শ্যাডোর দেহকে স্পর্শ করবে বলে পণ করেছে। বজ্রের ইচ্ছা, শ্যাডোর হাসির আওয়াজকে ছাপিয়ে দেবে। 

কিন্তু না, পারল না বজ্ৰ। 

আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠল শ্যাডো। বাঁচছে ও, এর আগে কখনও এভাবে বাঁচেনি। 

যদি মারাও যায়, ভাবল সে। যদি এভাবেই…এখানেই…এখনই মারা যায়, তাহলেও আর আফসোস থাকবে না কোন। 

‘ওই!’ ঝড়কে চিৎকার করে জানাল সে। ‘ওই! এই যে আমি! এখানে!’ 

ফাঁকা কাঁধ আর গাছের কাণ্ডের মাঝে কিছুটা পানি আটকে ফেলল শ্যাডো। এরপর মাথা বাঁকিয়ে পান করে নিলো সেটুকু। প্রতিটা ঢোকের সাথে সাথে ওর হাসি আরও বিস্তৃত হচ্ছে। নাহ, পাগলামির হাসি নয় সেটা। আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের হাসি। একেবারে শক্তিহীন হবার আগ পর্যন্ত হেসেই চলল সে। 

গাছের গোড়ায়, মাটিতে শুইয়ে রাখা চাদরটা ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে আছে ওয়েনসডের মৃত, মলিন হয়ে আসা হাত। সেই সাথে ফুটে আছে তার মাথার অবয়ব। জ্যাকুয়েলের টেবিলে শুয়ে থাকা মেয়েটার কথা মনে পড়ে গেল শ্যাডোর। আচমকা উপলব্ধি করল, ঠান্ডা পরিবেশে থাকা সত্ত্বেও নিজেকে উষ্ণ মনে হচ্ছে ওর, গাছের বাকলকে মনে হচ্ছে তুলোর মতো নরম। আবার ঘুমাল শ্যাডো। এই ঘুমের মাঝে যদি স্বপ্ন দেখেও থাকে, সেটা আর মনে রইল না ওর। 

.

পরের দিন সকালের কথা, ব্যথাটা আর নির্দিষ্ট জায়গায় আটকে নেই। এখন সেটা ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেহ জুড়ে। 

ক্ষুধা লেগেছে শ্যাডোর, থেকে থেকে পাকস্থলী খামচে ধরছে ব্যথা। মাথাটা ও দপদপ করছে। মাঝে মাঝে যুবকের মনে হতে লাগল: বুঝি শ্বাস নিতে ভুলে গেছে ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড ভুলে গেছে স্পন্দিত হতে। তখন দম বন্ধ করে ফেলত ও, হৃৎস্পন্দনের আওয়াজ সমুদ্রের ঠেউয়ের মতো কানে আঘাত না করা পর্যন্ত ছাড়ত না। 

শ্যাডোর মনে হতে লাগল, গাছটা বুঝি নরক থেকে স্বর্গ পর্যন্ত বিস্তৃত। মনে হলো যেন চিরকাল ধরে গাছটা থেকে ঝুলছে ও। মাথার ওপরে গাছটাকে কেন্দ্ৰ করে উড়ে বেড়াচ্ছে বাদামি একটা বাজপাখি। ওর কাছেই, একটা ভাঙা ডালে এসে বসল কিছুক্ষণের জন্য। তারপর আবার উড়াল দিল পশ্চিম দিকে। 

ভোরে বন্ধ হয়ে যাওয়া ঝড়টা আবার ফিরে এলো দিন গড়াবার সাথে সাথে। এদিক-ওদিক…দুই দিগন্তই দখল করে নিলো ধূসর কালো মেঘ। শুরু হলো টিপটিপ বৃষ্টি দিয়ে। শ্যাডোর মনে হলো, গাছের নিয়ে শুইয়ে রাখা দেহটা যেন আস্তে আস্তে নিজে থেকেই কুঁচকে উঠছে। 

কখনও জ্বলছে শ্যাডোর দেহ, কখনও ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে। 

বজ্রপাতের শব্দকে ড্রামের আওয়াজ বলে মনে হলো শ্যাডোর। হৃৎপিণ্ডে চলছে ছোটো ড্রামের বাজনা আর মাথার ওপরে বড়ো ড্রামের! 

ব্যথাগুলোকে রং বলে কল্পনা করল ও, লাল-নীল-আর সবুজ। কাঠবিড়ালিটা গাছের কাণ্ড থেকে লাফিয়ে শ্যাডোর কাঁধে এসে নামল। ‘রাটাটস্ক!’ খিটখিটিয়ে বলল প্রাণিটা। ওর জিহ্বাকে স্পর্শ করল কাঠবিড়ালির নাক। ‘রাটাটস্ক।’ আবার লাফিয়ে কাণ্ডে উঠল ওটা। শ্যাডোর মনে হচ্ছে যেন ওর ত্বকে কেউ ছোটো ছোটো পিন দিয়ে খোঁচা দিচ্ছে। অনুভূতিটা অসহ্য। 

পুরো জীবন চোখের সামনে দেখতে পেল সে। আক্ষরিক অর্থেই যেন মাটিতে বিছিয়ে দিয়েছে কেউ। এই তো ওর মা নরওয়ের আমেরিকান অ্যাম্বাসিতে অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে; ওই যে লরা…বিয়ের পোশাকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে… 

শুষ্ক ঠোঁটে ফাটল ধরল, হাসছে শ্যাডো। 

‘হাসছ কেন, পাপি?’ জানতে চাইল লরা। 

‘আমাদের বিয়ের দিনে,’ উত্তর দিল যুবক। ‘অর্গান-বাদককে ঘুস দিয়েছিলে তুমি। লোকটা কনে হেঁটে আশার সময় সচরাচর যে সুর বাজানো হয়, সেটা না বাজিয়ে স্কুবি ডুর সুর বাজিয়েছিল! মনে আছে?’ 

‘অবশ্যই মনে আছে, প্ৰিয়।’ 

‘তখন তোমাকে খুব ভালোবাসতাম।’ 

শ্যাডো টের পেল, লরার নরম আর ভেজা ঠোঁট চেপে বসেছে ওর ঠোঁটে সাথে সাথে বুঝতে পারল, আরেকটা হ্যালুসিনেশন হচ্ছে ওর। ‘তুমি আসলে এখানে নেই, তাই না?’ প্রশ্ন করল সে। 

‘না,’ উত্তর দিল মেয়েটা। ‘কিন্তু শেষ বারের জন্য আমাকে ডাকছ তুমি। চিন্তা করো না, আসছি আমি।’ 

শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে এখন শ্যাডোর। 

‘ঘুমাও, পাপি।’ বলল লরা। তবে কণ্ঠটা নিজের বলে মনে হলো ওর।

স্ত্রীর কথা শুনল সে, ঘুমিয়ে পড়ল। 

.

ভারী আকাশে তারচেয়েও ভারী পয়সার মতো ঝুলে আছে সূর্য। শ্যাডো বুঝতে পারল: জেগে আছে ও। ঠান্ডা বাসা বেঁধেছে ওর শরীরে। মস্তিষ্কের যে অংশটা এখনও শক্ত আছে, সেটা যেন অনেকদূর থেকে ফিসফিস করে বলছে ওকে কিছু। সেই অংশটা বুঝতে পারছে, ওর মুখ আর গলা জ্বলছে…ব্যথায় হাল ছেড়ে দিতে চাইছে সবকিছু। দিনের আলোতেই আকাশ থেকে তারা খসে পড়তে দেখছে শ্যাডো। আবার মাঝে মাঝে দেখছে বিশালাকার কিছু পাখি, উড়ে আসছে ওর দিকে। কিন্তু কিচ্ছু ওকে স্পর্শ করতে পারছে না, পারছে না প্রভাব ফেলতে। 

‘রাটাটস্ক, রাটাটস্ক।’ খিটখিটে কণ্ঠে এখন রাগের ছাপ। 

ধপ করে শ্যাডোর কাঁধে নামল কাঠবিড়ালিটা, তীক্ষ্ণ নখর গেঁথে বসল ওর মাংসে। এক দৃষ্টিতে ওর দিকেই তাকিয়ে রইল প্রাণিটা। শ্যাডোর সন্দেহ হলো, সম্ভবত ভ্রম হচ্ছে। কেননা কাঠবিড়ালি সামনের দুই থাবায় ধরে আছে একটা খেলনা কাপ। ওটাকে শ্যাডোর ঠোঁটের সাথে লাগিয়ে দিল সে। শ্যাডো টের পেল, কাপের ভেতরে পানি রয়েছে! অবচেতন মনেই চুমুক দিল কাপে, পানিটুকু ফাটল ধরা ঠোঁট আর শুষ্ক জিহ্বা ভিজিয়ে দিলো। অল্প যেটুকু বাকি রইল, সেটা গিলে ফেলল ঢক করে। 

গাছে ফিরে গেল কাঠবিড়ালি। এরপর হয়তো সেকেন্ড…মিনিট…বা ঘণ্টা বাদে ফিরে এলো আবার। সময়টা ঠিক ধরতে পারল না শ্যাডো, ওর মনের ভেতরে থাকা ঘড়িটার কল-কব্জা নষ্ট হয়ে গেছে। কাঠবিড়ালিটা আবার ফিরে এসেছে তার কাপটা নিয়ে, এবারের পুরোটা গিলে ফেলল ও। 

কেমন যেন কাদাময়-ধাতব স্বাদ পেল মুখে, অথচ শান্ত হয়ে গেল তৃষ্ণার্ত গলাটা। উন্মাদনা আর ক্লান্তিও যেন দূর হয়ে গেল অনেকটাই। 

তৃতীয় কাপটা পান করার পর, তৃষ্ণা একেবারেই উধাও হয়ে গেল শ্যাডোর।

আচমকা নড়ে উঠল সে, চেষ্টা করল দড়ির বাঁধনট ছেঁড়ার। ছিলে গেল শ্যাডোর দেহ; নিচে নামার…পালিয়ে যাবার চেষ্টা করল। কিন্তু না, পারল না। 

বেশ দক্ষ হাতে বাঁধা হয়েছে, দড়ি দেখে বোঝাই যায় না ওটা কতটা শক্তিশালী। খুব দ্রুতই আবারও ক্লান্ত হয়ে পড়ল সে। 

.

আছন্ন অবস্থায় নিজেকে গাছ বলে ভ্রম হলো শ্যাডোর। মাটির অনেক গভীরে চলে গেছে তার শেকড়, গভীরে গেছে সময়েরও…লুক্কায়িত কয়েকটা ঝরনায় গিয়ে শেষ হয়েছে। উর্ডের ঝরনার পানির স্বাদ অনুভব করতে পারছে সে, সেটাকে অতীতের ঝরনাও বলে হয়। মহিলা বিশালাকৃতি, মেয়ে-দানো। সে যে ঝরনাটাকে পাহারা দিয়ে রেখেছে, তাকে ‘কালের জলধারাও বলা হয়’। আরও শিকড় আছে ওর, সেগুলো শেষ হয়েছে অন্যান্য ঝরনায়। এদের মাঝে অনেকগুলোই গোপন। তৃষ্ণা পেলেই শিকড় ব্যবহার করে পানি তুলে নেয়। 

একশটা হাত আছে ওর, প্রতিটা আবার ভাগ হয়েছে শত-সহস্র আঙুলে। সবগুলোই আকাশের দিকে ইঙ্গিত করছে। সারা আকাশের ভার তার কাঁধে। 

ব্যথা একেবারে মিলিয়ে গেছে বলা যাবে না, কিন্তু ব্যথাটা ওকে ভোগাচ্ছে না। ভোগাচ্ছে ওর সাথে ঝুলতে থাকা দেহটাকে। এই মুহূর্তে উন্মাদ শ্যাডো, গাছে ঝুলতে থাকা মানুষটার চাইতে অনেক বড়ো কিছু। যুবক এখন নিজেই ওই গাছ, সেই সাথে ওটার ডালের ফাঁকে ফাঁকে বয়ে চলা বাতাসও। কালো মেঘের ভারে ক্লান্ত আকাশ? সেটাও শ্যাডো। রাটাটস্ক নামের কাঠবিড়ালি, যেটা বারবার আসা- যাওয়া করছে, সেটাও শ্যাডো। একেবারে ওপরের ভাঙা ডালে বসে থাকা পাগলাটে বাজপাখিটাও সে নিজে। গাছের একেবারে হৃদয়ে আবাস গেড়ে বসা পোকাটাও শ্যাডো ছাড়া আর কিছু নয়। 

আকাশের তারাগুলো নড়তে শুরু করেছে। শত হাতের সবগুলো উজ্জ্বল তারার দিকে বাড়িয়ে দিলে ও। হারিয়ে গেল সেগুলো ঔজ্জ্বল্য… 

.

উন্মাদনা আর ব্যথার মাঝে এলো সুস্থতার একটা মুহূর্ত। শ্যাডো জানে, এই মুহূর্তটা দ্রুতই শেষ হয়ে যাবে। সূর্যের আলো ওর চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। চোখ মুদল সে, যদি লাভ হয়… 

.

বেশিক্ষণ বাকি নেই তার জীবনের, শ্যাডো নিজেও জানে ব্যাপারটা। 

চোখ খুলে দেখতে পেল, এক যুবক ওর ডালে বসে আছে। 

ছেলেটার ত্বক গাঢ় বাদামি। কপাল উঁচু, কালো চুলগুলো কোঁকড়ানো। মাথা কাত করে যুবকের দিকে তাকিয়ে রইল শ্যাডো। বুঝতে পারল, ছেলেটা বদ্ধ উন্মাদ। 

‘তুমি নগ্ন,’ ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলল পাগল। ‘আমি নগ্ন।’ 

‘তা তো দেখতেই পাচ্ছি।’ কোনোক্রমে বলল শ্যাডো। 

পাগলটা কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওর দিকে, তারপর মাথাটা বার বার ঘোরাতে লাগল। অনেকক্ষণ এই কাজ করার পর আচমকা জানতে চাইল, ‘আমাকে চেনো?’ 

‘না।’ উত্তর দিল শ্যাডো। 

‘আমি তোমাকে চিনি, কায়রোতে দেখেছি। আমার বোন তোমাকে পছন্দ করে।’ 

‘তুমি…’ নামটা ভুলে গেল শ্যাডো। যে গাড়ি চাপা পড়া জন্তু খায়… মনে পড়েছে। ‘হোরাস।’ 

মাথা নাড়ল পাগল। ‘হোরাস। আমি সকালে শ্যেন, বিকালে বাজপাখি। আমি তোমার মতোই…সূর্য। আমি জানি রা-এর প্রকৃত নাম। আমার মা বলেছিলেন।’ 

‘ভালো তো,’ নম্র কণ্ঠে বলল শ্যাডো। 

পাগল যুবক তীব্র মনোযোগের সাথে মাটির দিকে তাকিয়ে রইল, বলল না কিছুই। তারপর আচমকা গাছ থেকে নেমে পড়ল। 

পাথরের মতো টুপ করে ডাল থেকে পড়ল বাজপাখিটা, একেবারে শেষ মুহূর্তে ছড়িয়ে দিল ডানা। উড়ে এসে বসল শ্যাডোর কাছের একটা ডালে, তীক্ষ্ণ নখর থেকে একটা খরগোশের বাচ্চা ঝুলছে। 

‘তুমি ক্ষুধার্ত?’ জানতে চাইল পাগল। 

‘না,’ বলল শ্যাডো। ‘হওয়া উচিত, তবে আমি ক্ষুধার্ত নই।’ 

‘আমার ক্ষুধা লেগেছে।’ বলে দ্রুত খরগোশটাকে খেয়ে ফেলল সে। কিছুক্ষণের মাঝেই প্রাণিটার হাড় আর চামড়া ছাড়া কিছু বাকি রইল না। খাওয়া শেষে শ্যাডোর দিকে এগিয়ে এলো পাগল, বসল মাত্র এক হাত দূরত্বে। ওর চোখে শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল প্রথমে, এরপর সেখানে স্থান করে নিলো সাবধানতা আর যত্ন। পাগলটার থুতনিতে রক্ত লেগে আছে, সেই সাথে বুকেও। হাতের চেটো ব্যবহার করে ওগুলো মুছল হোরাস। 

শ্যাডোর মনে হলো, কিছু একটা বলা দরকার ওর। ‘হেই।’ 

‘হেই,’ বলল পাগলটাও। ডালের ওপর উঠে দাঁড়াল সে, এরপর অন্য দিকে ঘুরে প্রস্রাব করল। তলপেট খালি করল ছেলেটা অনেক সময় ধরে। কাজ শেষ করে আবার শ্যাডোর দিকে ঘুরে বসল। 

‘তোমার নাম কী?’ জানতে চাইল সে। 

‘শ্যাডো।’ 

মাথা নাড়ল পাগল। ‘তুমি শ্যাডো। আমি আলো। সবকিছুরই শ্যাডো, মানে ছায়া আছে। ভালো কথা, দ্রুতই লড়তে শুরু করবে ওরা। ওদেরকে আসতে দেখেছি।’ 

কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর ছেলেটা বলল। ‘তুমি মারা যাচ্ছ, তাই না?’

শ্যাডোর আর জবাব দেবার উপায় নেই। বাতাসে ভাসল বাজপাখি, আস্তে আস্তে ওপরে উঠে হারিয়ে গেল মেঘের আড়ালে। 

.

চাঁদের আলো। 

কাশির দমকে কেঁপে উঠল শ্যাডোর অবয়ব, বুকে আর গলায় তীব্র ব্যথা অনুভব করছে সে। শ্বাস টানতে পারছে না। 

‘হাই, পাপি।’ পরিচিত একটা কণ্ঠ বলল। 

নিচের দিকে তাকাল শ্যাডো। 

চাঁদের আলোয় রুপালি লাগছে চারপাশ। তবে পূর্ণিমা বলে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে চারপাশটা। মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে পরিষ্কার দেখতে পেল শ্যাডো, দেখতে পেল মেয়েটার মলিন চেহারা। 

‘হাই, পাপি।’ আবারও বলল সে। 

কথা বলতে চাইল শ্যাডো, কিন্তু শব্দের পরিবর্তে বেরিয়ে এলো কফ। বেশ অনেকক্ষণ ধরে কাশল বেচারা। 

‘শুনে তো খুব একটা ভালো লাগছে না।’ বলল মেয়েটা। 

‘হ্যালো, লরা। কোনোক্রমে মুখ থেকে বের করল বেচারা। 

মৃত চোখজোড়া তাকাল ওর চোখের দিকে, হাসি ফুটে উঠলে মেয়েটার মুখে।

‘আমাকে খুঁজে পেলে কী করে?’ জানতে চাইল ও। 

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে রইল লরা। তারপর মুখ খুলল, ‘জীবনের কাছাকাছি বলতে একমাত্র তুমিই আছ আমার। তুমিই আমার শেষ আস্থার স্থান, তুমিই একমাত্র রঙিন অংশ। আমাকে চোখ বেঁধে সাগরের গভীরে ফেলে দিলেও, ঠিকই তোমাকে খুঁজে বের করতে পারব। শত শত মাইল মাটির নিচে কবর দিলেও জানব তুমি কোথায় আছ।’ 

মেয়েটার দিকে তাকাল শ্যাডো, অশ্রু বেরিয়ে এলো চোখে। 

‘তোমাকে কেটে নামাব?’ কিছুক্ষণ পর জানতে চাইল লরা। ‘তোমাকে উদ্ধার করতেই আমার অনেক সময় বয়ে যায়, তাই না?’ 

আবারও কাশল যুবক। ‘নাহ, এভাবেই রেখে যাও। কাজটা শেষ করতেই হবে।’ 

ওর দিকে মুখ তুলে চাইল লরা। মাথা নেড়ে বলল, ‘তুমি আসলে পাগল। মরার জন্য এখানে ঝুলে আছ! বেঁচে থাকলেও, পঙ্গু হবে নিশ্চিত।’ 

‘হয়তো। কিন্তু বাঁচছি বটে।’ 

‘হুম,’ এক মুহূর্ত পর বলল লরা। ‘তা বাঁচছ।’ 

‘আমাকে একটা কথা বলে ছিলে, মনে আছে? গোরস্তানে? 

‘কয়েক দিন আগের কথাও এখন অনেক বছর আগের কথা বলে মনে হয়, পাপি।’ বলল লরা। ‘এখানে আমার ভালো লাগছে, ব্যথা করছে না আগের মতো। আমার কথা বুঝতে পারছ?’ 

আচমকা বেড়ে গেল বাতাসের গতি, লরার গন্ধ নাকে এলো শ্যাডোর: পচে যাওয়া মাংস, অসুস্থতা আর ক্ষয়ের গন্ধ। বাজে, বিকৃত একটা ঘ্রাণ। 

‘আমার চাকরি চলে গেছে,’ বলল মেয়েটা। ‘রাতের শিফটের কাজ ছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ জানালো, মানুষ নাকি অভিযোগ দিচ্ছে। ওদের বললাম, আমি অসুস্থ। কিন্তু পাত্তা দিল না তারা। তৃষ্ণা পেয়েছে খুব ‘ 

‘ওই তিন বোনের কাছে,’ মেয়েটাকে বলল শ্যাডো। ‘পানি আছে। খামার বাড়িতে।’ 

‘পাপি…’ লরার কণ্ঠ ভয়ার্ত শোনাল। 

‘ওদেরকে বলো…আমি তোমাকে পানি দিতে বলেছি…’ 

মলিন চেহারাটা ওর দিকে তাকাল। ‘আমি যাই।’ বলেই মুখ কোঁচকাল লরা। ঘাসের উপর থুথুর সাথে কী যেন ফেলল। মাটিতে পড়ার সাথে সাথে জিনিসটা নড়তে শুরু করল। 

শ্বাস নেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে প্রায়। শ্যাডোর মনে হচ্ছে, ওর বুকের ওপর যেন ভারী কিছু একটা বসে আছে। 

‘থাকো,’ কোনোক্রমে বলল ও। কে জানে, মেয়েটা শুনতে পেয়েছে কি না। ‘দয়া করে যেয়ো না,’ আবারও কাশতে শুরু করল ও। ‘রাতটা থেকে যাও।’ 

‘কিছুক্ষণ থাকি নাহয়।’ বলল লরা। তারপর এমন কিছু কথা যোগ করল, যেগুলো বাচ্চাকে শান্ত করতে মায়েরা বলে থাকে। ‘আমি যতক্ষণ এখানে আছি, ততক্ষণ তুমি নিরাপদ, জানো তো?’ 

উত্তর দিতে গিয়ে কেশে ফেলল শ্যাডো। মাত্র এক মুহূর্তের জন্য চোখ মুদল ও, অন্তত নিজে সেটাই ভেবেছিল। কিন্তু যখন চোখ খুলল আবার, তখন চাঁদ বিদায় নিয়েছে। 

একাকী হয়ে গেছে সে… 

.

দপদপানিটা এখন সহ্যের বাইরে চলে গেছে। এই ব্যথার কাছে মাইগ্রেন কেন, অন্য কিছুই দাঁড়াতে পারবে না। চারপাশের সবকিছু যেন পরিণত হয়েছে ছোটো ছোটো প্ৰজাপতিতে। 

লাশের সাথে জড়িয়ে থাকা চাদরটা পতপত করে উঠছে সকালের বাতাসে। সময় যেন প্রবাহিত হতে ভুলে গেছে, শ্বাস নেওয়ার দরকারবোধ করছে না শ্যাডো। অনুভব করতে পারছে না বুকের ভেতরে হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি। 

এবার যে অন্ধকারের মাঝে প্রবেশ করল ও, সেটা গভীর। আলো বলতে একটা মাত্র তারার ঔজ্জ্বল্য। 

এই অন্ধকার…সম্ভবত শেষ অন্ধকার। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *