অধ্যায় চৌদ্দ
অন্ধকারে ডুবছে মানুষ,
জানা নাই করার কী আছে;
আমার কাছে আছে লণ্ঠন,
তাও যে নিভে গেছে।
হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি আমি,
তুমিও দিবে আশা করি,
অন্ধকারে চাই যে তোমায়,
হতে আমার সঙ্গী।
–গ্রেগ ব্রাউন, ‘ইন দ্য ডার্ক উইথ ইউ’
.
ভোর পাঁচটায় মিনিয়াপোলিসের বিমান বন্দরের পার্কিং লটে গাড়ি পরিবর্তন করে নিলো ওরা। একেবারে ওপরের তলা পর্যন্ত উঠে গেল, এখানকার কোনো লটের ওপরের তলায় ছাদ নেই।
কমলা পোশাক, হাতকড়া আর পায়ের শেকল নিয়ে একটা বাদামি কাগজের ব্যাগে ভরল শ্যাডো। এরপর ওটাকে ফেলে দিল আস্তাকুঁড়ে। প্রায় মিনিট দশেক অপেক্ষা করার পর, বন্দরের দরজা খুলে ওদের দিকে এগিয়ে এলো এক যুবক। ছেলেটা বার্গার কিং-এর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাচ্ছে, বুকটা অনেকটাই ব্যারেলের মতো। দেখামাত্র তাকে চিনতে পারল শ্যাডো-হাউজ অন দ্য রক থেকে ফেরার পথে ওর গাড়িরই পেছনের সিটে বসেছিল ছেলেটা, গুনগুন করে গান গাইছিল। এখন অবশ্য চোয়ালে হালকা দাড়ি দেখা যাচ্ছে, চেহারায় একটা ভারিক্কী ভাব এসেছে তাতে।
হাতের তেলটুকু জিন্সের সাথে মুছল যুবক, শ্যাডোর দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিল। ‘সর্ব-পিতার মৃত্যু খবর শুনেছি,’ বলল সে। ‘এর মূল্য ওদেরকে চুকাতে হবে…কড়া মূল্য।’
‘ওয়েনসডে তোমার বাবা ছিলেন নাকি?’ জানতে চাইল শ্যাডো।
‘তিনি সর্ব-পিতা।’ বয়সের তুলনায় গম্ভীর শোনাল যুবকের কণ্ঠ। ‘সবাইকে জানিয়ে দিয়ো, দরকারের সময় আমার লোকদের সবাইকেই পাওয়া যাবে।’
দাঁতের ফাঁক থেকে এক টুকরা তামাক বের করে আনল চেরনোবোগ, থুথুর সাথে ফেলে দিয়ে বলল। ‘তোমার লোক কজন বাকি আছে এখন? দশ? বিশ?’
যুবকের চেহারা লাল হয়ে গেল। ‘আমাদের দশজন কি বিপক্ষের একশ জনের সমতুল্য নয়? যুদ্ধক্ষেত্রে কে আমার লোকদের সামনে দাঁড়াবার সাহস রাখে? যাই হোক, বেশ অনেকেই আছে। কয়েকজন আছে অন্য শহরে, কিছু আছে পাহাড়ে। ফ্লোরিডাতেও আছে কিছু। সবাই যার যার কুঠার ধারাল করে রেখেছে। আমি ডাকলেই চলে আসবে।’
‘তাই করো, এলভিস,’ বলল মি. ন্যান্সি। ঠিক এলভিস বলল কিনা লোকটা, তা নিশ্চিত নয় শ্যাডো। তবে ওর কাছে তেমনটাই মনে হলো। ডেপুটির উর্দি ছেড়ে পুরু বাদামি কার্ডিগান গায়ে দিয়েছে এখন বৃদ্ধ। সেই সাথে কর্ডরয়ের ট্রাউজার্স আর বাদামি চপ্পল। ‘ডাকো সবাইকে। বুড়োর সেটাই ইচ্ছা ছিল।’
‘এভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করল! এভাবে কেড়ে নিলো তার প্রাণ? আমি ওয়েনসডের কথা শুনে হেসেছিলাম, এখন বুঝতে পারছি যে ভুল হয়েছিল। আমাদের কেউই আসলে নিরাপদ নয়,’ এলভিসের মতো শোনায়, এমন নামের অধিকারী যুবক বলল। ‘তবে তোমরা আমাদের উপর নির্ভর করতে পারো।’ শ্যাডোর পিঠে হালকা চাপড় দিল ও। শ্যাডোর মনে হলো, যেন উলটে পড়বে! ভারী
মুগুর দিয়ে আঘাত হানলেও এতটা জোরাল হতো না।
চেরনোবোগ পার্কিং লটটার উপর নজর বুলাচ্ছিল। ‘আচ্ছা, আমাদের জন্য কোন গাড়িটা ঠিক করেছ?’
এলভিস নামের যুবক দেখাল। ‘ওই যে।’
ঘোঁত করে উঠল চেরনোবোগ। ‘ওটা?’
১৯৭০ ভিডব্লিউ মডেলের একটা বাস দাঁড়িয়ে আছে সামনে, পেছনের কাচে রঙধনুর স্টিকার।
‘গাড়িটা ভালো। আর তাছাড়া তোমরা যে এমন একটা জিনিস চালাচ্ছ, সেটা কারও মাথাতেই আসবে না।’
বাহনটার কাছে গেল চেরনোবোগ। আচমকা বুড়ো ধূমপায়ীর মতো খক খক করে কাশতে শুরু করল। থুথু ফেলে, শ্লেষ্মা টেনে, এমনকি বুক হাতিয়েও কমানো গেল না কাশির দমক। ‘হুম, তা করবে না। কিন্তু যদি পুলিস আমাদেরকে আটকায় তো? আমরা কারও নজরে পড়তে চাই না, চাই লুকিয়ে থাকতে।’
যুবক বাসের পেছনের দরজা খুলে ধরল। ‘আটকালে আটকাক না। তোমরা তো আর হিপ্পি নও, বেআইনি কিছু বহনও করছ না। এক নজর দেখেই তোমাদেরকে ছেড়ে দেবে। যাই বলো না কেন, এর চাইতে ভালো ছদ্মবেশ আর হয় না। তারচেয়ে বড়ো কথা, বিনা নোটিশে আর কিছু জোগাড় করাও আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।’
চেরনোবোগকে দেখে মনে হচ্ছে, আরও ঝগড়া করার ইচ্ছা আছে তার। কিন্তু মি. ন্যান্সি দক্ষতার সাথে পরিস্থিতি সামাল দিল। ‘এলভিস, তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমরা দারুণ কৃতজ্ঞ। আমরা যেটায় এসেছি, সেটা শিকাগোতে ফিরিয়ে দিতে হবে।’
‘আমরা ওটাকে রুমিঙ্গটনে ছেড়ে আসব।’ জবাব দিল এলভিস। ‘বাকি কাজ নেকড়েরাই সারবে। ওসব নিয়ে ভাববেন না,’ শ্যাডোর দিকে ফিরল সে। ‘আমার সমবেদনা নাও, তোমার ব্যথা আমি বুঝতে পারছি। শুভ কামনা রইল। আর শোক পালনের দায়িত্ব যদি তোমার ঘাড়ে এসে পড়ে, তাহলে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা আর সহানুভূতি জেনো,’ শ্যাডোর হাতে চাপ দিল সে, শ্যাডোর মনে হলো যেন হাতের হাড়গুলো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাবে। ‘সর্ব-পিতার লাশ দেখলে তাকে জানিয়ো-ভিনডালফের পুত্র আলভিসস তার ভরসার সম্মান জানাবে।’
বাসটার ভেতর থেকে পাতচৌলি, পুরনো সুগন্ধি আর তামাক পাতার গন্ধ ভেসে আসছে। মেঝে আর দেয়ালের সাথে লাগিয়ে রাখা হয়েছে রং জ্বলা একটা গোলাপি কার্পেট।
‘লোকটার পরিচয় কী?’ ইঞ্জিন চালু করতে করতে জানতে চাইল শ্যাডো।
‘বললই তো—ভিনডালফের পুত্র আলভিসস। বামনদের রাজা; দুনিয়ার সব বামনের মাঝে সবচেয়ে লম্বা, সবচেয়ে শক্তিশালী, আর সর্বশ্রেষ্ঠ।
‘কিন্তু লোকটা তো পাঁচ-আট বা পাঁচ-নয় হবেই। যুক্তি দেখাল ও। ‘বামন হয়ে কীভাবে?
‘এজন্যই তো বামনদের মাঝে সবচেয়ে লম্বা।’ পেছন থেকে চেরনোবোগ জবাব দিল। ‘সারা আমেরিকায় ওর সমান বামন নেই।’
‘আর শোক পালনের কথা কী যেন বলল?’
দুই বয়স্ক মানুষ কিছুই বলল না। ন্যান্সির দিকে তাকাল শ্যাডো, কিন্তু সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।
‘শোক পালনের কথা যে বলেছে, তা তো আপনারাও শুনতে পেয়েছেন।’
চেরনোবোগ মুখ খুলল। ‘তোমাকে কাজটা করতে হবে না।’
‘কোন কাজটা?’
‘শোক পালন। বামনটা একটু বেশিই বলে ফেলেছে। অবশ্য ওর দোষ দিয়েই বা লাভ কী? ওর জাতিটাই এমন—কথা বলছে তো বলছেই। যাক গে, ওসব নিয়ে ভাববার দরকার নেই। শোক পালনের কথা ভুলে যাও।’
.
উত্তর দিকে যাওয়া মানে যেন ভবিষ্যৎ সময়ের দিকে অগ্রসর হওয়া। চলতে চলতে উধাও হয়ে যেতে শুরু করল তুষার, কেন্টাকিতে পরেরদিন পৌঁছাবার পরে তার আর হদিসও পাওয়া গেল না। কেন্টাকিতে শীত প্রায় শেষ, বসন্ত আসি আসি করছে। শ্যাডোর মনে হলো, কোনো সমীকরণ দিয়ে উত্তর দিকে অগ্রসর হওয়া দূরত্ব আর সময়ের মাঝে সম্পর্ক স্থাপন করা যায় কি না। এই যেমন প্রতি পঞ্চাশ মাইল সামনে এগোনো মানে এক দিন ভবিষ্যতে চলে যাওয়া।
তত্ত্বটা নিয়ে আলোচনা করতে চাইল ওর মন, কিন্তু মি. ন্যান্সি সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে ঘুমাচ্ছে। আর এদিকে চেরনোবোগ নাক ডাকাচ্ছে পেছনে সিটে শুয়ে।
সময়কে এই মুহূর্তে বড়ো নমনীয় বলে মনে হচ্ছে, থমকে যাচ্ছে যেন থেকে থেকে। চারপাশের সব পাখি আর পশুকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে ওঃ রাস্তার দুইপাশের আর বাসের সামনের রাস্তায় বসে থাকা কাক দেখতে পাচ্ছে, দুর্ঘটনায় মৃত পশুর মাংস ছিঁড়ে খাচ্ছে ওরা; আকাশে প্রায় পরিচিত আকৃতি নিয়ে উড়ে যাচ্ছে একদল পাখি; একদৃষ্টিতে ওরই দিকে তাকিয়ে আছে একটা বিড়াল।
ঘোঁত করে ঘুম ভাঙ্গল চেরনোবোগের। আস্তে আস্তে উঠে বসে বলল, ‘অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখলাম।’ বলল সে। ‘দেখলাম, আমি আসলে বিয়েলবোগ। পৃথিবীর সবাই সর্বদা কল্পনা করে এসেছে, আমরা আসলে দুই জন। একজন শুভর দেবতা আর আরেকজন অশুভের। কিন্তু এখন যখন আমরা দুজনেই বুড়ো, তখন যেন আমি একমাত্র অস্তিত্ব! আমিই মানুষকে নানা কিছু উপহার দেই, আবার আমিই নেই ছিনিয়ে।’ কথা বন্ধ করে একটা সিগারেট ঠোঁটের ফাঁকে গুঁজে দিল সে।
নিজের দিকে জানালার কাচ নামিয়ে দিল শ্যাডো।
‘ফুসফুস-ক্যান্সারের ভয় পান না?’ জানতে চাইল ও।
‘আমিই তো ক্যান্সার,’ বলল চেরনোবোগ। ‘নিজেকে আর ভয় কী?’
ন্যান্সি মুখ খুলল এবার। ‘আমাদের মতো অস্তিত্বদের ক্যান্সার হয় না। আমাদের হৃদরোগ হয় না, সিফিলিস বা পার্কিনসন্স রোগে আমরা ভুগি না। আমাদের হত্যা করা কঠিন।’
‘ওয়েনসডেকে কিন্তু হত্যা করা হয়েছে।’
আর কথা হলো না, তেল নেবার জন্য গাড়ি থামাল শ্যাডো। এরপর একটা রেস্তোরাঁর পাশে থামল নাস্তা খাবার জন্য। ওরা দোকানে ঢোকার আগেই, সদর দরজার কাছে অবস্থিত পে-ফোনটা বেজে উঠল ঝন ঝন শব্দে।
বয়স্কা এক মহিলাকে খাবারের অর্ডার দিল ওরা। মহিলা বসে বসে হোয়াট মাই হার্ট মেন্ট পড়ছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল সে, ফোন কাছের গিয়ে তুলল ওটা। ‘হুম,’ একবার বলেই ঘরের ভেতরে নজর বুলালো। ‘আছে বলেই তো মনে হচ্ছে, একটু দাঁড়ান।’ এই বলে সে চলে এলো মি. ন্যান্সির কাছে। ‘আপনার জন্য।’
‘আচ্ছা,’ বলল মি. ন্যান্সি। ‘ম্যাম, দয়া করে ফ্রাইটা ভালো করে ভাঁজবেন। বলে পে-ফোনের কাছে চলে গেল সে। ‘বলছি।’
‘…’
‘আমাকে এতটাই বোকা মনে হয় যে তোমার কথা বিশ্বাস করব?’
‘…’
‘আমি জানি ওটা কোথায়।’
‘…’
‘অবশ্যই চাই,’ কিছুটা রাগান্বিত শোনাল তার গলা। ‘তুমিও জানো যে আমরা ওটা চাই। আর আমি জানি যে তুমি ওটা থেকে মুক্তি চাও। তাই এসব ছাতার কথা বলে লাভ নেই।’ ফোন রেখে দিয়ে সে ফিরে এলো টেবিলে।
‘কে?’ জানতে চাইল শ্যাডো।
‘নাম বলেনি।’
‘কী চায়?’
‘শান্তিচুক্তি, ওয়েনসডের লাশটা ফিরিয়ে দিতে চায়।’
‘মিথ্যে কথা,’ বলল চেরনোবোগ। ‘টোপ ফেলে আমাদেরকে ফাঁদে পা দিতে বাধ্য করবে। তারপর খুন করে ফেলবে। ঠিক যেমনটা ওয়েনসডের সাথে করেছে…যেমনটা আগে আমি করতাম।’ শেষের বাক্যটা উচ্চারণ করার সময় গর্ব খেলে গেল তার কণ্ঠে।
‘সত্যি সত্যি নিরপেক্ষ একটা জায়গায় যেতে বলেছে।’ বলল ন্যান্সি।
মুচকি হাসল চেরনোবোগ, আওয়াজ শুনে মনে হলো যেন একটা ধাতব অস্ত্র কোনো অভাগার খুলির বারোটা বাজাচ্ছে। ‘আমিও এই একটা বলতাম। কোন নিরপেক্ষ জায়গায় এসো। তারপর সবাইকে খুন করতাম। দিন ছিল বটে তখন।’ শ্রাগ করল মি. ন্যান্সি। বাদামি ফ্রাইয়ে কামড় দেওয়া মাত্র হাসি ফুটে উঠল তার চেহারায়। ‘দারুণ।’ বলল সে।
‘আমরা ওদেরকে বিশ্বাস করতে পারি না।’ বলল শ্যাডো।
‘দেখ বাছা, আমি তোমার চাইতে বয়স্ক, তোমার চাইতে চালু আর অবশ্যই তোমার চাইতে অনেক বেশি সুদর্শন।’ কেচাপের বোতল ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল ন্যান্সি। ‘এক বিকালে যত মেয়ে পটাতে পারব, সারা বছরে তুমি তত জনকে পটাতে পারবে না। আমি দেবদূতের মতো নৃত্যে পারঙ্গম, কোণঠাসা ভালুকের মতো নৃশংস যোদ্ধা, শেয়ালের চাইতে ধূর্ত…’
‘বুঝলাম। তো?’
শ্যাডোর চোখে চোখ রাখল ন্যান্সির বাদামি চোখ। ‘আমাদের যেমন লাশটা দরকার, ওদেরও তেমন লাশটাকে হস্তান্তর করা দরকার।’
‘কিন্তু সত্যিকারের নিরপেক্ষ জায়গা বলে তো কিছু নেই।’ বলল চেরনোবোগ।
‘আছে, একটা।’ বলল মি. ন্যান্সি। ‘কেন্দ্ৰ।’
.
কোনো কিছুর প্রকৃত কেন্দ্র নির্ধারণ করাটা খুব কঠিন। আর মানুষের মতো জীবিত…অথবা মহাদেশের মতো বিশাল কিছুর কেন্দ্র বের করাটা তো একেবারেই অসম্ভব। কেননা মানুষের কেন্দ্র আবার কী? স্বপ্নের কি কোনো কেন্দ্র থাকা সম্ভব? আর যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটা দেশের কেন্দ্র বের করার সময় কি আলাস্কাকে আমলে নিতে হবে? অথবা হাওয়াইকে?
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইউএসএর একটা বিশাল প্রতিকৃতি বানানো হলো। কার্ডবোর্ড দিয়ে বানানো প্রতিকৃতিটায় ছিল নিচের আটচল্লিশটা স্টেট। উদ্দেশ্য ছিল দেশের কেন্দ্র আবিষ্কারের। একটা পিনের উপর বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল প্রতিকৃতিটাকে।
যা বোঝা গেল তা হলো: যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্র জায়গাটা অবস্থিত লেবানন, ক্যানসাস থেকে কয়েক মাইল দূরে; জনি গ্রিবের শুয়োর খামারে। ১৯৩০ সালের দিকে লেবাননের অধিবাসীরা ওই খামারের ঠিক মাঝখানে একটা বিশাল বড়ো স্মৃতিস্তম্ভ খাড়া করার সব প্রস্তুতি পর্যন্ত সেরে ফেলল! কিন্তু বাদ সাধল জনি। হাজার হাজার পর্যটক এসে ওর শুয়োরদের বিরক্ত করুক, তা সে চায় না। তাই স্মৃতিস্তম্ভটার স্থান হলো দুই মাইল পাশের শহরে। এজন্য আলাদা একটা পার্কই বানিয়ে ফেলল তারা। এরপর লোহা আর পিতল দিয়ে বানানো স্মৃতিস্তম্ভটা সেখানে স্থাপন করল। এরপর মোটেল আর ভালো রাস্তা বানিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল পর্যটকের।
কিন্তু এলো না কেউ!
এখন পার্কটা দাঁড়িয়ে আছে মন খারাপ করা একাকীত্বকে সঙ্গী করে। ওখানে আছে একটা চ্যাপেল, এতটাই ছোটো যে অল্প কজনও আঁটবে না। আর আছে একটা মোটেল, যেটার জানালাগুলোকে মৃত মানুষের চোখ বলে ভ্রম হয়।
‘এ জন্যই,’ ঘোষণা করল যেন মি. ন্যান্সি, মিসৌরির হিউম্যানসভিলে ওদের গাড়ি প্রবেশ করছিল তখন। ‘আমেরিকার কেন্দ্র হচ্ছে একটা ছোটো, প্রায়- ধ্বংসপ্রাপ্ত পার্ক, একটা শূন্য চার্চ, কয়েকটা পাথরের স্তূপ আর একটা পরিত্যক্ত মোটেল।’
‘আর শুয়োরের খামার?’ বলল চেরনোবোগ। ‘এই মাত্র না একটা শুয়োরের খামারের কথা বললে! ওটার কী হলো?’
‘সবই তো কাল্পনিক,’ উত্তর দিল মি. ন্যান্সি। ‘এমনকী এই কেন্দ্রটাও। খামার খামারের মতোই আছে। দুনিয়াতে কাল্পনিক জিনিস নিয়েই মাতামাতি বেশি। সবাই কেবল ওসব নিয়েই কামড়া-কামড়ি করে।’
‘সবাই বলতে কি আমরা, মানুষেরা?’ জানতে চাইল শ্যাডো। ‘নাকি আপনারা, দেবতারা?’
ন্যান্সি উত্তর দিল না। অদ্ভুত একটা শব্দ করে উঠল চেরনোবোগ, সেটা মুচকি হাসিও হতে পারে, আবার ঘোঁত করাও হতে পারে।
বাসের পেছনে আরাম করে শোয়ার প্রয়াস পেল শ্যাডো, পুরোটা রাস্তায় খুব অল্পই ঘুমাতে পেরেছে ও। অশুভ কিছু একটা আশঙ্কা করছে সে, মনে হচ্ছে যেন কেউ একজন ওর তলপেট খামচে ধরে আছে। জেলে থাকতেও এমন তীব্র হয়নি অনুভূতিটা, লরা যখন ওকে ব্যাংক ডাকাতির ব্যাপারে রাজি করাতে এলো—তখনও না। খুব বাজে ধরনের কিছু একটা অপেক্ষা করছে সামনে। এমনকী ওর ঘাড়ের লোমগুলোও উঠে দাঁড়িয়েছে, অসুস্থ বোধ করছে সে। ঢেউয়ের মতো করে বারে বারে আসছে ভয়।
হিউম্যানসভিলে গাড়ি থামাল ন্যান্সি, একটা সুপারমার্কেটের সামনে দাঁড়াল। একসাথে ভেতরে ঢুকল সে আর শ্যাডো। চেরনোবোগ ব্যস্ত পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফোঁকার কাজে।
নাস্তার সিরিয়াল যে তাকে রাখা হয়, সেটার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক ছেলে, চেহারা দেখে বাচ্চাই মনে হয়।
‘হাই,’ বলল মি. ন্যান্সি।
‘হাই,’ উত্তর দিল ছেলেটা। ‘কথাটা কি সত্যি? তিনি কি খুন হয়েছেন?’
‘হ্যাঁ,’ জানাল মি. ন্যান্সি। ‘তাকে খুন করা হয়েছে।’
ঝটকা দিয়ে সিরিয়ালের কয়েকটা বাক্স শেলফে রেখে দিল ছেলেটা। ‘ওদের ধারণা, আমাদেরকে তেলাপোকার মতোই পিষে মারতে পারবে।’ বলল সে, হাতে একটা রূপালি ব্রেসলেট। ‘এত সহজে মরছি না আমরা, তাই না?’
‘নাহ।’ বলল মি. ন্যান্সি। ‘এত সহজে না।’
‘আমি আপনাদের সাথে আছি।’ বলল ছেলেটা, চোখ জ্বলজ্বল করছে।
‘আমি জানি তুমি সাথে আছ, গিডিয়োন।’ বলল মি. ন্যান্সি।
কয়েক বোতল আর.সি. কোলা কিনলেন মি. ন্যান্সি। সেই সাথে কিছু টয়লেট পেপার, এক প্যাকেট কালো সিগারেল্লো, এক কাঁদি কলা আর সেই সাথে একটা ডাবলমিন্ট চুয়িং গাম। ‘ছেলেটা ভালো, সপ্তম শতাব্দীতে ওয়েলশ থেকে এসেছে।’
প্রথমে কিছুক্ষণ পশ্চিম দিকে এগিয়ে, এরপর উত্তরে গেল। বসন্তকে হটিয়ে আবার চারপাশ দখল করে নিলো শীত। রেডিয়ো স্টেশন ঘোরাবার ব্যাপারে দক্ষ হতে শুরু করেছে শ্যাডো। মি. ন্যান্সি চায় ড্যান্স মিউজিক আর টক রেডিয়ো শুনতে। এদিকে চেরনোবোগ আবার পছন্দ করে ক্ল্যাসিকাল মিউজিক, যত গম্ভীর হয় তত ভালো। শ্যাডো নিজে পছন্দ করে পুরনো দিনের গান।
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে শুরু করেছে, চেরনোবোগের অনুরোধে চেরিভিল, ক্যানসাসের (জনসংখ্যা-২৪৬৪) ঠিক বাইরেই দাঁড়াল ওরা। তুষারে এখনও গাছের ছায়া পড়ছে, ঘাসগুলো কাদা-রঙের।
‘এখানে অপেক্ষা করো,’ গাড়ি থেকে নেমে কিছুদূর হাঁটার পর বলল চেরনোবোগ। একা একা এগিয়ে গেল সে, দাঁড়াল তৃণভূমির মাঝখানে। ফেব্রুয়ারির বাতাসে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর কার সাথে যেন কথা বলতে শুরু করল!
‘মনে হচ্ছে যেন কারও সাথে কথা বলছে!’ বলল শ্যাডো।
‘আত্মারা,’ জানাল মি. ন্যান্সি। ‘ওর সাথে ফিসফিসিয়ে কথা বলে। এখানে প্রায় একশ বছর আগেও ওর উপাসনা করত তারা। রক্ত-বলি দিত, হাতুড়ির আঘাতে গুঁড়িয়ে দিত খুলি। কিছুদিন পর শহরবাসীরা বুঝতে পারল, কেন এখানে যারা আসে তারা আর ফিরে যায় না!’
চেরনোবোগ ফিরে এলো, এখন ওর গোঁফ আগের চাইতেও কালো বলে মনে হচ্ছে। সাদা চুলের ফাঁকে দেখা যাচ্ছে কালো রঙ। দাঁত বের করে হাসল লোকটা। ‘ভালো লাগছে। আহ, কিছু কিছু জিনিস তাদের অস্তিত্বের ছাপ রেখে যায়। রক্ত তাদের মাঝে একটা।’
গাড়ির দিকে ফিরে চলল ওরা। সিগারেট ধরাল চেরনোবোগ, তবে কাশল না আর আগের মতো। ‘আমার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার সময় হাতুড়ি ব্যবহার করত সবাই। ভোটান বলত ফাঁসি-কাঠ আর বর্শার কথা। কিন্তু আমার জন্য অস্ত্র বলতে কেবল একটাই…’ নিকোটিনের পরত পড়া একটা আঙুল দিয়ে শ্যাডোর কপালের ঠিক মাঝখানে টোকা দিল সে।
‘দয়া করে এসব করবেন না।’ ভদ্রভাবে বলল শ্যাডো।
‘দয়া করে এসব করবেন না…’ ভেঙচি কাটল চেরনোবোগ। ‘একদিন আমার হাতুড়ি দিয়ে তোমার ওই মাথা গুঁড়িয়ে দেব, নাকি ভুলে গেছ ব্যাপারটা?’
‘মনে আছে,’ বলল শ্যাডো। ‘কিন্তু আমার কপালে টোকা দিলে, হাত ভেঙে দেব।’
ঘোঁত করে উঠল চেরনোবোগ, তারপর বলল। ‘এখানকার লোকজনের আমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। এখান থেকেই জন্ম নিয়েছে চরম এক শক্তি। আমার লোকদের আত্মগোপনে বাধ্য করার ত্রিশ বছর পরও, এই জায়গাটা থেকে এসেছে ইতিহাসের সেরা চলচ্চিত্র অভিনেত্রী।
‘জুডি গারল্যান্ড?’ জানতে চাইল শ্যাডো।
ঝট করে মাথা নাড়ল চেরনোবোগ।
‘ও লুইসি ব্রুকসের কথা বলছে,’ বলল মি. ন্যান্সি।
লুইসি ব্রুকস কে, সেটা আর জানতে চাইবার ইচ্ছা হলো না শ্যাডোর। বরঞ্চ বলল, ‘দেখুন, ওয়েনসডে যখন কথা বলতে গেলেন, তখনও কিন্তু শান্তিচুক্তির অধীনেই গেছিলেন।’
‘হ্যাঁ।’
‘আমরা এখন যাচ্ছি ওদের কাছ থেকে ওয়েনসডের লাশ ফিরিয়ে আনার জন্য। সেটাও শান্তিচুক্তির অধীনে।’
‘হ্যাঁ।’
‘আমরা এটাও জানি, ওরা আমাকে খুন করে পথের কাঁটা দূর করতে চায়।’
‘শুধু তোমাকে না, আমাদের সবাইকেই খুন করতে চায়।’ বলল ন্যান্সি। ‘তাহলে এবার যে ওরা কথা রাখবে, সেটার নিশ্চয়তা কী?’
‘যেন রাখে,’ জানাল চেরনোবোগ। ‘সেজন্যই আমরা কেন্দ্রে ওদের সাথে দেখা করছি। জায়গাটা…’ ভ্রু কুঁচকাল সে। ‘শব্দটা বলতে পারছি না। পবিত্রের বিপরীত।’
‘অপবিত্র।’ কিছু না ভেবেই বলল শ্যাডো।
‘না,’ বলল চেরনোবোগ। ‘আমি বোঝাতে চাইছি, ওটা এমন জায়গা যেখানে মন্দির বানানো যায় না। যেখানে মানুষ আসতেই চায় না, আর এলেও চলে যেতে চায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। এমন এক জায়গা যেখানে একান্ত বাধ্য না হলে কোনো দেবতাও পা রাখবে না।’
‘জানি না,’ বলল শ্যাডো। ‘এমন অর্থের কোনো শব্দ আছে বলে মনে হয় না।’
‘পুরো আমেরিকা জায়গাটাই কিছুটা এমন।’ বলল চেরনোবোগ। ‘এই জন্য আমাদেরকে এখানে কেউ থাকতে দিতে চায় না। কিন্তু কেন্দ্র…ওই জায়গাটা আরও বাজে। মাইন বিছানো মাঠ বলতে পারো। শান্তিচুক্তি যেন কোনোক্রমেই না ভাঙে, সেদিকে কড়া নজর রাখতে হবে আমাদের।’
গাড়ির কাছে পৌঁছে গেছে ওরা। শ্যাডোর হাতে চাপড় দিল চেরনোবোগ। ‘চিন্তা করো না, আমি ছাড়া আর কেউ তোমাকে খুন করার সুযোগ পাবে না। কেউ না।
.
সেদিন সন্ধ্যাতেই আমেরিকার কেন্দ্রে উপস্থিত হলো শ্যাডো, রাত তখনও নামেনি পুরোপুরি। লেবাননের উত্তর-পশ্চিমে, একটা ছোটো টিলা বলা যায় জায়গাটাকে। পার্কের চারপাশে একবার ঘুরে এলো ও, ছোটো একটা চ্যাপেল আর পাথরের স্মৃতিস্তম্ভ নজরে এলো প্রথমেই। যখন ১৯৫০ সালে নির্মিত এক তলা মোটেলটা দেখতে পেল, তখন মন খারাপ হয়ে গেল ওর। দালানটার সামনে একটা কালো হামভি পার্ক করা। দেখে মনে হয় যেন প্রচণ্ড কুৎসিত আর প্রায় অহেতুক কোনো আর্মার্ড গাড়ি। মোটেলে জ্বলছে না আলো।
দালানটার পাশেই পার্ক করল ওরা। ঠিক সেই মুহূর্তেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো শোফারের উর্দি পরিহিত এক লোক। শ্যাডোদের গাড়ির হেডলাইটের আলোয় পরিষ্কার দেখা গেল লোকটাকে। মাথায় পরা শোফারের ক্যাপ একবার স্পর্শ করে অভিবাদন জানালো লোকটা, তারপর হামভি নিয়ে চলে গেল।
‘বড়ো গাড়ি মানে…ছোটো পুরুষাঙ্গ।’ বলল মি. ন্যান্সি।
‘এই আস্তাকুঁড়ে বিছানা আছে বলে মনে হয়?’ প্রশ্ন করল শ্যাডো। ‘অনেকদিন হলো বিছানায় শুয়ে ঘুমাই না। মোটেলটাকে দেখে তো মনে হচ্ছে যেকোনো সময় ধসে পড়বে!’
‘টেক্সাসের কিছু শিকারি এটার মালিক,’ বললেন মি. ন্যান্সি। ‘বছরে একবার আসে। কী যে শিকার করে, তা কে জানে! তবে ওদের আসার জন্যই জায়গাটা এখনও ভেঙে ফেলা হয়নি।’
গাড়ি থেকে নেমে এলো ওরা। ওদের জন্য মোটেলের সামনে এক মহিলা দাঁড়িয়ে ছিল, চিনতে পারল না শ্যাডো। নিখুঁত মেকআপ নিয়েছে মেয়েটা, দেখে খবর-পাঠিকা বলে মনে হলো ওর।
‘এসেছ বলে খুব খুশি হয়েছি,’ বলল মেয়েটা। ‘তুমি নিশ্চয়ই চেরনোবোগ, অনেক শুনেছি তোমার কথা। আর তুমি আনানসি, সারাক্ষণ দুষ্টামিতে মেতে থাকো, তাই না? ভালো, ভালো। আর তুমি হচ্ছ শ্যাডো। অনেক ঘুরিয়েছ আমাদেরকে,’ শ্যাডোর হাত আঁকড়ে ধরল সে, শক্ত করে চাপ দিয়ে চোখে চোখ রেখে বলল, ‘আমি মিডিয়া। অবশেষে দেখা হলো আমাদের। আশা করি আমাদের বিনিময় কোনো ঝামেলা ছাড়াই শেষ হবে।’
মোটেলের সদর দরজা খুলে গেল। ‘কেন জানি, টোটো,’ লিমোতে দেখা সেই মোটা ছেলেটা বেরিয়ে এলো। ‘মনে হচ্ছে আমরা আর ক্যানসাসে নেই। ওযের জাদুকর বইটার বিখ্যাত সেই লাইনটা উচ্চারণ করল সে।
‘ক্যানসাসেই আছি।’ বলল মি. ন্যান্সি। ‘সারাদিন সম্ভবত তার বুকের ওপর দিয়েই গাড়ি চালিয়ে এসেছি।’
‘এই মোটেলে নেই বাতি, নেই বিদ্যুৎ বা গরম পানির ব্যবস্থা, মোটা ছেলেটা বলল। কিছু মনে করো না, তোমাদের গরম পানি খুব দরকার। গায়ের গন্ধে মনে হচ্ছে বছরখানেক ধরে ওই গাড়িতেই বাস করছ!’
‘ওসব বলার দরকার আছে বলে মনে হয় না,’ নম্র কণ্ঠে বলল মেয়েটা। ‘আমরা সবাই এখানে বন্ধু। ভেতরে এসো, তোমাদেরকে ঘর দেখিয়ে দেই। আমরা প্রথম চারটা ঘর নিয়েছি। তোমাদের মরহুম বন্ধু পঞ্চমটায় আছে। বাকিগুলো খালি, নিজের ইচ্ছামতো বেছে নিতে পারো। ঠিক ফোর সিজনস না জায়গাটা, তবে করার আর কিছু নেই!’
দরজা খুলে শ্যাডোদেরকে মোটেলের লবিতে নিয়ে এলো সে। ছত্রাক, ধুলো আর পচনের গন্ধ ভেসে আসছে ভেতর থেকে।
লবিতে, প্রায় অন্ধকারে বসেছিল একজন পুরুষ। ‘ক্ষুধার্ত?’ জানতে চাইল সে।
‘খাওয়ার জন্য আবার ক্ষুধার্ত হওয়া লাগে নাকি?’ উত্তরে বললেন মি. ন্যান্সি। ‘ড্রাইভারকে হ্যামবার্গার আনতে পাঠিয়েছি,’ বলল লোকটা। ‘জলদিই ফিরে আসবে।’ মুখ তুলে তাকাল সে, অন্ধকারে কারও চেহারা পরিষ্কার বোঝা যাবার কথা না। তবুও বলল, ‘বিশালদেহী তুমিই তো শ্যাডো, নাকি? যে হারামজাদা উডি আর স্টোনকে খুন করেছে?’
‘না,’ বলল শ্যাডো। ‘ওই কাজটা করেছে অন্য একজন। তোমাকে চিনি আমি।’ আসলেই তাই, এই লোকের মাথার ভেতরেই কিছুক্ষণ সময় কাটিয়েছিল ও। ‘তুমি টাউন। তা উড়ের বিধবাকে বিছানায় নিতে পেরেছ এখনও?’
চেয়ার থেকে পরে গেল মি. টাউন। সিনেমার দৃশ্য হলে হাসিতে ফেটে পড়ত সবাই। কিন্তু এখন চুপ করে রইল। তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে শ্যাডোর কাছে চলে এলো সে। মাথা নিচু করে লোকটার চোখে চোখ রাখল শ্যাডো। বলল, ‘যা শেষ করতে পারবে না, তা শুরু করতে যেয়ো না।’
শ্যাডোর হাতে হাত রাখল মি. ন্যান্সি। ‘শান্তিচুক্তি… ভুলে গেলে? আমরা এখন কেন্দ্ৰে আছি।’
মুখ ঘুরিয়ে নিলো মি. টাউন। কাউন্টারের ওপর ঝুঁকে তিনটা চাবি বের করে আনল সে। ‘হলের শেষ মাথায় তোমাদের ঘর,’ বলল লোকটা। ‘এই যে চাবি।’
ন্যান্সিকে ওগুলো ধরিয়ে দিয়ে বিদায় নিলো লোকটা, হারিয়ে গেল করিডরের ছায়াতে। মোটেলের একটা দরজা খোলার আওয়াজ শুনতে পেল ওরা, তারপর আবার সেটা বন্ধ হবার আওয়াজ হলো।
একটা চাবি শ্যাডোকে আর আরেকটা চেরনোবোগকে দিল মি. ন্যান্সি। ‘গাড়িতে ফ্ল্যাশলাইট আছে?’ জানতে চাইল শ্যাডো।
‘না,’ জানাল মি. ন্যান্সি। ‘অন্ধকারকে ভয় পাও নাকি?’
‘না, অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা মানুষকে পাই।’
‘আঁধার আমার প্রিয়,’ বলল চেরনোবোগ, মনে হচ্ছে না যে অন্ধকারে তার খুব একটা সমস্যা হচ্ছে। অন্ধকার করিডর ধরে আরামসে এগিয়ে যাচ্ছে সে, তালা খুলতেও অসুবিধা হলো না। ‘আমি দশ নম্বর ঘরে আছি,’ ওদেরকে জানাল সে। ‘মিডিয়া, ওর কথা আগেও শুনেছি মনে হয়। এই মহিলাই তার বাচ্চাদেরকে খুন করেছিল না?’
‘নাহ, অন্য একজন।’ বলল মি. ন্যান্সি। তবে একই রকম খারাপ।’
আট নম্বর ঘরটা মি. ন্যান্সি নিলো, বাকিটা জুটল শ্যাডোর ঘাড়ে। ঘরটা স্যাঁতস্যাঁতে, যেন বহুদিনের পরিত্যক্ত। তবে ভেতরে একটা বিছানার ফ্রেম আছে, তার ওপরে আছে জাজিমও। তবে চাদর নেই। জাজিমের ওপরে বসল শ্যাডো, জানালা দিয়ে হালকা আলো ঢুকছে ঘরে। পা থেকে জুতা খুলে জাজিমে শুয়ে পড়ল ও। কয়েকদিন ধরে টানা গাড়ি চালাতে হচ্ছে তাকে।
হয়তো ঘুমালোও কিছুক্ষণ…
.
হাঁটছে ও।
ঠান্ডা বাতাসে উড়ছে ওর জামা-কাপড়। ছোটো ছোটো তুষারকণা ধুলোর মতো উড়ে বেড়াচ্ছে বাতাসে।
বেশ কয়েকটা গাছ নজরে পড়ল ওর, তবে শীতের কারণে পাতা নেই একটাও। দুপাশেই উঁচু উঁচু পাহাড়। শীতের বিকাল এখন: আকাশ আর বরফ ঘন বেগুনি রং ধারণ করেছে। সামনে কোথাও-এই হালকা আলোতে কিছু বোঝা যাচ্ছে না পরিষ্কার করে—অগ্নিকুণ্ডের আলো জ্বলছে…হলুদ, কমলা আলো।
ওর সামনে…বরফে হাঁটছে একটা ধূসর নেকড়ে।
দাঁড়িয়ে পড়ল শ্যাডো, দাঁড়াল নেকড়েও। ঘুরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল নেকড়েটা। ওটার একটা চোখে দেখা গেল হলদে-সবুজ আভা। শ্রাগ করে সামনে এগোল সে।
অগ্নিকুণ্ডটা একটা বাগানের ঠিক মাঝখানে জ্বলছে। আশে পাশে প্রায় একশ গাছ, দুই সারিতে দাঁড়িয়ে আছে। ওগুলো থেকে ঝুলছে কিছু অবয়ব। গাছের সারির একদম শেষ মাথায় একটা দালান, দেখে মনে হয় যেন ওলটানো কোনো নৌকা। কাঠের তৈরি দালানটায় খোদাই করা হয়েছে অগণিত পশুর চেহারা-ড্রাগন, গ্রিফিন, ট্রল, ভালুক। আলোতে যেন নাচছে ওগুলো। এদিকে অগ্নিকুণ্ডটা এত তীব্র হয়ে জ্বলছে যে ওটার কাছেও যেতে পারছে না শ্যাডো। তবে নেকড়েটার অসুবিধা হচ্ছে না। আগুনকে ঘিরে পাক খাচ্ছে ওটা।
আগুনের ওপাশ থেকে নেকড়ের জায়গায় বেরিয়ে এলেন একজন মানুষ, হাতে ছড়ি ধরা।
‘তুমি সুইডেনের উপশালায় আছ,’ পরিচিত, রুক্ষ কণ্ঠে বললেন লোকটা। ‘প্রায় এক হাজার বছর আগের সময়ে।’
‘ওয়েনসডে?’ জিজ্ঞেস করল শ্যাডো।
কথা বলতে থাকলেন লোকটা, যেন শ্যাডো নেই-ই ওখানে। ‘প্ৰথম প্ৰথম প্ৰতি বছর পেতাম বলি। তারপর আস্তে আস্তে বেড়ে গেল মাঝখানের সময়টা…নয়ের বিশেষ এক উৎসর্গ, আমার উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হতো এখানে। টানা নয়দিন…প্রতিদিন নয়টি করে পশু…ওই গাছগুলোর ডাল থেকে ঝুলত তাদের দেহ, নয়টির মাঝে একটি অবশ্যই মানুষ হতো।’
আগুনের আলোয় গাছের দিকে হেঁটে গেল লোকটা, পিছু নিলো শ্যাডো। গাছগুলোর কাছাকাছি হওয়া মাত্র আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয়ে ধরা দিল দেহগুলো। মাথা নাড়ল শ্যাডো, গাছের ডাল থেকে একটা মহিষের দেহ ঝুলতে থাকাটা অদ্ভুত এক কষ্টের জন্ম দিচ্ছে ওর মনে। আবার দৃশ্যটা এমন অবাস্তব যে হাসিও পাচ্ছে। ঝুলতে থাকা একটা করে হরিণ, হাউন্ড, বাদামি ভালুক আর চেস্টনাট ঘোড়া পার হয়ে এলো সে। কুকুরটা এখনও বেঁচে আছে। কয়েক সেকেন্ড পরপর পা ছুঁড়ছে ওটা, কেঁউ কেঁউ করে উঠছে থেকে থেকে।
যে লোকটার পিছু অনুসরণ করছে শ্যাডো, সে তার হাতের ছড়িটা তুলে ধরল। প্রকৃতপক্ষে যে ওটা একটা বর্শা, তা এতক্ষণে টের পেল ও। বর্শাটা দিয়ে মৃতপ্রায় কুকুরটার পেট কেটে ফেললেন লোকটি। রক্তাক্ত নাড়ি-ভুঁড়ি আছড়ে পড়ল তুষারের ওপর। ‘এই মৃত্যু…ওডিনের জন্য।’ ঘোষণা করলেন যেন তিনি।
‘ব্যাপারটাকে প্রতীকী বলতে পারো,’ শ্যাডোর দিকে ফিরে বললেন লোকটি ‘কিন্তু প্রতীকী এই আচরণই আসলে সবকিছু। সব কুকুরের মৃত্যুর প্রতীক এই একটি কুকুরের মৃত্যু। নয়জন মানুষকে উৎসর্গ করা হতো আমার উদ্দেশ্যে, কিন্তু লক্ষ্য ছিল সারা মানবজাতি। মাত্র নয়জনের রক্ত…তবে তার অর্থ সমগ্র দুনিয়ার সব ক্ষমতা। একদিন…আচমকা বন্ধ হয়ে গেল রক্তের প্রবাহ। রক্ত ছাড়া বিশ্বাসের ক্ষমতা আর কতটুকু, বলো?’
‘আপনাকে মরতে দেখেছি নিজচোখে,’ জানাল শ্যাডো।
‘দেবতাদের ব্যাপারটাই আলাদা,’ বললেন লোকটি, শ্যাডো এখন নিশ্চিত যে ওয়েনসডের সাথেই কথা বলছে। ‘মৃত্যু তাদের সামনে অর্থহীন, পুনরুত্থানের আরেকটা সুযোগ ছাড়া আর কিছু নয়। আর যখন রক্ত প্রবাহিত হয়…’ ঝুলতে থাকা পশু আর মানুষের দিকে ইঙ্গিত করলেন তিনি।
ঝুলন্ত পশুর লাশ বেশি ভীতিপ্রদ, নাকি মানুষের-তা ঠিক বুঝতে পারল না শ্যাডো। মানুষগুলো অন্তত আগে থেকে নিজেদের ভবিষ্যৎ জানত! লাশগুলো থেকে মদের গন্ধ আসছিল, সম্ভবত ওদেরকে ফাঁসিতে ঝোলাবার আগে ইচ্ছামতো মদ গেলানো হয়েছে। অথচ ওই পশুগুলোর সেই সৌভাগ্য হয়নি, জীবিত অবস্থায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে ওদের। লোকগুলোর চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, এদের কারও বয়সই বিশের বেশি হবে না।
‘আমি কে?’ জানতে চাইল শ্যাডো।
‘তুমি কে?’ উত্তরে পালটা প্রশ্ন করলেন লোকটি। ‘তুমি একটা সুযোগ… একটা সম্ভাবনা। তুমি বিশাল এক প্রাচীন প্রথার অংশ। তবে হ্যাঁ, প্রথা হলেও ওটার জন্য মরতে আমাদের কারওই আপত্তি নেই। তাই না?’
‘আপনি কে?’ আবার জানতে চাইল শ্যাডো।
‘জীবনের সবচাইতে কঠিন অংশ কোনটা জানো? বেঁচে থাকাটা।।’ বললেন লোকটি। আগুনের দিকে তাকিয়ে শ্যাডো উপলব্ধি করতে পারল, ওটার জ্বালানি হচ্ছে হাড়! পাঁজরের হাড়…মাথার খুলি আর পায়ের হাড় বেরিয়ে আছে আগুনের ভেতর থেকে। ‘গাছে তিনদিন, অন্তপুরীতে তিনদিন আর ফিরে আসার জন্য তিনদিন।’
আচমকা এমন তীব্রভাবে জ্বলে উঠল আলো, যে মুখ ঘুরিয়ে নিতে হলো শ্যাডোকে। গাছের দিকে…অন্ধকারের দিকে তাকাল ও।
.
দরজায় টোকার শব্দে চোখ খুলল শ্যাডো, এখন জানালা দিয়ে চাঁদের আলো ভেতরে ঢুকছে। আচমকা শব্দ হওয়ায় চমকে গেছে ও, ঝটকা দিয়ে বসেছে। ‘ডিনার দেওয়া হয়েছে,’ মিডিয়ার কণ্ঠ কানে এলো।
জুতা আবার পরে নিয়ে করিডরে পা রাখল সে, কে যেন কিছু মোম খুঁজে পেয়ে ওগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। মোমের হালকা হলদে আলোয় অন্ধকার কতটুকু দূর হয়েছে তা বলা মুশকিল। হামভির ড্রাইভার দাঁড়িয়ে আছে রিসিপশন হলে, কার্ডবোর্ডের একটা ট্রে আর একটা কাগজের থলে ধরে আছে। লোকটার পরনে লম্বা, কালো কোট। মাথায় শোফারের ক্যাপ।
‘দেরির জন্য দুঃখিত।’ কর্কশ কণ্ঠে বলল সে। ‘সবার জন্য একই খাবার-বার্গার, ফ্রাই, কোক আর পাই। আমারটা আমি গাড়িতে বসেই খেয়ে নেব।’ খাবারগুলো নামিয়ে রেখে আবার বাইরে বেরোল লোকটা। লবি এখন ফাস্ট ফুডের গন্ধে ম ম করছে। কাগজের থলেটা তুলে নিয়ে সবার মাঝে খাবার, ন্যাপকিন আর কেচাপের প্যাকেট বণ্টন করে দিল শ্যাডো।
নীরবে খেয়ে চলল সবাই, শব্দ বলতে কেবল মোম গলার হিস হিস আওয়াজ। টাউন যে ওকে চোখ ফুলিয়ে দেখছে, তা নজর এড়ালো না শ্যাডোর। চেয়ারটা একটু সরাল ও, যেন দেয়ালের দিকে পিঠ থাকে। মুখের কাছে ন্যাপকিন ধরে বার্গার খাচ্ছে মিডিয়া।
‘হায়রে, বার্গার সব ঠান্ডা,’ মোটা ছেলেটা বলে উঠল। এখনও চোখে রোদ- চশমা পরে আছে। রাতের বেলা রোদ এলো কোত্থেকে, তা বুঝতে পারল না শ্যাডো। তার উপর ঘরটাও অন্ধকার।
‘সে জন্য দুঃখিত,’ বলল টাউন। ‘একদম কাছের ম্যাকডোনাল্ড’সটাও নেব্রাস্কায়!’
প্রায় ঠান্ডা হয়ে আসা হ্যামবার্গার আর ঠান্ডা ফ্রাই দিয়ে রাতের খাবার সারল সবাই। এরপর পাইয়ে কামড় বসাল মোটাকু। সবকিছু ঠান্ডা হয়ে গেলেও, পাইয়ের ভেতরের অংশটুকু ঠিকই গরম আছে। ‘আও,’ পাইয়ের ভেতরের অংশ চিবুকে এসে পড়ায় আঁতকে উঠল সে। ‘জ্বলছে! যে কোনোদিন মামলা খেয়ে বসবে এর নির্মাতা।’
ছেলেটাকে আঘাত করার অদম্য এক ইচ্ছা পেয়ে বসল শ্যাডোকে। আসলে এখন না, সেই অনেক আগে লিমোতে যখন লোক দিয়ে ওকে পিটিয়েছিল মোটকু, তখন থেকেই হাত নিসপিস করছে ওর। তবে নিজেকে সামলে নিলো। ‘ওয়েনসডের দেহটা নিয়ে এখনই এখান থেকে চলে যাওয়া যায় না?’ জানতে চাইল ও।
‘ঠিক মাঝরাতে নেওয়া যাবে।’ একইসাথে বলে উঠল মি. ন্যান্সি আর মোটকু। ‘এসব নিয়ম মেনে করতে হয়।’ চেরনোবোগ জানাল।
‘বুঝলাম,’ শ্যাডোর বিরক্তি চাপা রইল না। ‘কিন্তু এই নিয়মগুলো যে কী, তা- ই তো কেউ জানাচ্ছে না। নিয়ম…নিয়ম করে মুখে ফেনা তুলছে সবাই। অথচ কোন খেলা যে খেলছি, আমি তাই জানি না।’
‘আমার মনে হয়, নিয়মের পুরো ব্যাপারটাই বেহুদা,’ বলল টাউন। তবে যদি এসব মানলে গ্রাহক খুশি হয়, তাহলে আমার এজেন্সিও খুশি। আমারও মানতে আপত্তি নেই।’ কোকে চুমুক দিল সে। ‘ঠিক মাঝরাতে লাশ নিয়ে তোমরা বিদায় হবে। আমরা বিদায় জানাব হাত নেড়ে। তারপর ইঁদুরের বাচ্চার মতো খুঁজে বের করে তোমাদের প্রত্যেককে চুবিয়ে মারব।’
‘ভালো কথা,’মোটকু শ্যাডোকে বলল। ‘তোমার মনিবকে বলতে বলেছিলাম—সে এখন প্রাচীন এক ইতিহাস। বলেছিলে?’
‘হ্যাঁ।’ জানাল শ্যাডো। ‘উত্তরে তিনি কী বলেছিলেন শুনবে? বলেছিলেন, ওই মোটা-হোঁতকাকে বোলো: আজকের ভবিষ্যৎ, আগামীর অতীত ছাড়া কিছু না। ওয়েনসডে সত্যি সত্যি অমন কিছু বলেননি। তবে এই ‘নতুন-দেবতারা’ এসব বাক্য ভালো খায়।
মোটকু বলল, ‘একেবারেই বাজে জায়গা এটা। বিদ্যুৎ নেই, ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক নেই। যেন সেই প্রস্তর-যুগে ফিরে এসেছি।’ স্ট্র দিয়ে কোক টানল ছেলেটা, এরপর খালি কাপটা টেবিলে রেখে করিডর ধরে উধাও হয়ে গেল।
ময়লাগুলো এক করে থলের ভেতর রাখল শ্যাডো। ‘আমেরিকার কেন্দ্র দেখতে যাচ্ছি,’ ঘোষণা করল ও। উঠে দাঁড়িয়ে পা রাখল বাইরে, অন্ধকারের মাঝে। মি. ন্যান্সি সাথে এলো। একসাথে পার্কে ঘুরে বেড়াল ওরা, পাথরের স্মৃতিস্তম্ভের কাছে পৌঁছাবার আগে কেউ কিছু বলল না। বাতাস বইছে, কিন্তু ইতস্ততভাবে। একবার এদিক দিয়ে তো আরেকবার ওদিক। ‘এখন কী?’ জানতে চাইল শ্যাডো।
অন্ধকার আকাশে ভেসে আছে অর্ধ-চন্দ্ৰ।
‘এখন,’ জানাল ন্যান্সি। ‘তুমি তোমার ঘরে ফিরে যাবে। দরজা বন্ধ করে চেষ্টা করবে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিতে। ঠিক মাঝরাতে আমরা লাশটা হাতে পাব। তারপর এখান থেকে সোজা বেরিয়ে যাব। কেন্দ্রে কারওই বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না।
‘আপনি যা বলেন।’
সিগারেল্লো ধরিয়েছে মি. ন্যান্সি। ‘এমনটা হওয়াই উচিত হয়নি,’ বলল সে। ‘আমাদের মতো…আমরা আসলে অমিশুক। দলগতভাবে থাকতে পারি না, এমনকি আমিও না। বাক্কাসই বেশিদিন পারেনি। একা একা…অথবা নিজেদের ছোট্ট দলে সময় কাটাই আমরা। বড়ো একটা দলে টিকতে পারি না বেশিদিন। আমরা চাই: সবাই আমাদের প্রশংসা করুক, উপাসনা করুক। আমি চাই: মানুষ আমাকে নিয়ে গল্প বলুক, আমার বুদ্ধিমত্তার কথা ছড়িয়ে দিক চারিদিকে। চারিত্রিক দুর্বলতা এটা, জানি আমি। আমরা চাই বড়ো কিছু হয়ে থাকতে, কিন্তু আজকের দিনে আমরা একেবারেই ক্ষুদ্রকায় অস্তিত্ব। নতুন দেবতারা জন্ম নেয়, আবার হারিয়ে যায় স্মৃতির অতলে। এই দেশটা আসলে বেশিক্ষণ কোনো দেবতাকেই সহ্য করতে পারে না। ব্রহ্মা সৃষ্টি করে, বিষ্ণু করে প্রতিপালন আর শিব করে ধ্বংস। ব্রহ্মার জন্য নতুন করে সব সৃষ্টি করার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে সে।’
‘কী বলতে চাইছেন আপনি?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল শ্যাডো। ‘যুদ্ধ শেষ? লড়াইয়ের এখানেই পরিসমাপ্তি?’
ঘোঁত করল মি. ন্যান্সি। ‘পাগল হয়েছ? ওরা ওয়েনসডেকে হত্যা করেছে। শুধু তাই না, গর্ব করে প্রচারও করেছে সেটা। প্রতিটা চ্যানেলে…সবার চোখের সামনে দেখিয়েছে। না, শ্যাডো…যুদ্ধের তো সবে কেবল শুরু!
স্মৃতিস্তম্ভের পাদদেশের কাছে ঝুঁকল লোকটা, সিগারেল্লো নিভাল মাটিতে। রেখে দিল ওখানেই…ওভাবেই…
‘আগে আপনি অনেক ঠাট্টা করতেন,’ বলল শ্যাডো। ‘এখন আর করেন না।’
‘আজকাল কেন জানি ঠাট্টাটা আসে না। ওয়েনসডে মৃত। ভেতরে আসবে না?’
‘আসব। আপনি যান, আমি আসছি।’
মোটেলের দিকে রওনা দিল ন্যান্সি। শ্যাডো হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল স্মৃতিস্তম্ভটাকে। এরপর ঘুরে দাঁড়িয়ে রওনা দিল ছোটো চ্যাপেলটাকে লক্ষ্য করে। খোলা দরজা দিয়ে ওটার ভেতরে প্রবেশ করল ও। একদম কাছের বেঞ্চটাকে খুঁজে নিয়ে বসল ওতে, চোখ বন্ধ আর মাথা নিচু করে ভাবতে শুরু করল-লরার কথা, ওয়েনসডের কথা…বেঁচে থাকার কথা।
আচমকা পেছন থেকে একটা ‘ক্লিক’ শব্দ ভেসে এলো, সেই সাথে মাটিতে পা ফেলার আওয়াজ। উঠে বসে পেছনে ফিরল শ্যাডো, খোলা দরজার ওপাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের আলো পড়ে ঝিকিয়ে উঠছে ধাতব কিছু।
‘গুলি করবে?’ জানতে চাইল শ্যাডো।
‘হা যিশু, করতে পারলে খুশি হতাম,’ বলল মি. টাউন। ‘আত্মরক্ষার্থে খুন করা যায়। যাই হোক, প্রার্থনা করছ? নিশ্চয়ই ভাবছ, এরা সবাই দেবতা। ভুল করছ, এরা দেবতা নয়।’
‘প্রার্থনা করছিলাম না,’ বলল শ্যাডো। ‘ভাবছিলাম।’
‘আমার মনে হয়,’ বলল টাউন। ‘এরা আসলে মিউটেশন, বিবর্তনের পরীক্ষা কারও হালকা-পাতলা সম্মোহিত করার ক্ষমতা আছে, সেই সাথে একটু জাদু- মন্ত্রের ভেক ধরে মানুষকে ধোঁকা দিতে চায়…এছাড়া আর কিছু না। হাজার হলেও, ওরা সাধারণ মানুষের মতোই মৃত্যুবরণ করে!
‘সব সময়ই করত,’ বলে উঠে দাঁড়াল শ্যাডো। এক পা পিছিয়ে এলো টাউন। ছোটো চ্যাপেলটা থেকে বেরিয়ে এলো ও, মি. টাউন রইল কিছু দূরেই। ‘এই, তুমি কি লুইসি ব্রুকসকে চেন?’
‘তোমার বন্ধু নাকি?’
‘নাহ, অভিনেত্রী ছিল।’
একটু বিরতি নিলো টাউন। ‘মনে হয় নাম পরিবর্তন করেছে। এখন হয়তো লিজ টেইলর বা শ্যারন স্টোন নামে পরিচিত।’
‘হতে পারে,’ মোটেলে ফিরে চলল শ্যাডো, তাল মিলিয়ে এগোল টাউনও। ‘এই মুহূর্তে জেলে থাকা উচিত তোমার,’ বলল লোকটা। ‘উচিত ফাঁসিতে ঝোলা।
‘আমি তোমার সহকর্মীদেরকে খুন করিনি,’ জানাল শ্যাডো। তবে তোমাকে একটা কথা বলি, জেলে থাকার সময় শুনেছিলাম। আর কখনও ভুলিনি।’
‘বলো।’
‘সারা বাইবেল ঘেঁটে এমন মাত্র একজনের নাম পাবে, যাকে যিশু স্বর্গে নেবার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। সেই লোক পিটার না, পল না। সে এক ছিঁচকে চোর, যাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছিল। তাই মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্তদের ছোটো করে দেখো না।’
হামভির কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল চালক। ‘শুভ রাত্রি, জেন্টেলমেন।’ ওদেরকে দেখে বলল সে।
‘শুভ রাত্রি,’ উত্তরে বলল টাউন। এরপর শ্যাডোকে উদ্দেশ করে যোগ করল। ‘ব্যক্তিগতভাবে এসবে আমার কিছু যায় আসে না। আমি তাই করি, যা আমাকে মিস্টার ওয়ার্ল্ড করতে বলেন। ব্যস, সবকিছু বড়ো সহজ হয়ে যায়।’
করিডর ধরে ওর ঘর, নয় নম্বর রুমের সামনে এসে দাঁড়াল শ্যাডো।
তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করেই বলল, ‘দুঃখিত। আমি মনে করেছিলাম এটা আমার ঘর।
‘ভুল করোনি,’ বলল মিডিয়া। ‘আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।’ চাঁদের আলোয় মেয়েটার চেহারা, তার চুল-সব পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে শ্যাডো।
‘আমি অন্য কোনো খালি ঘর খুঁজে নিচ্ছি।
‘আমি বেশিক্ষণ থাকব না।’ জানাল মেয়েটা। ‘ভাবলাম, তোমাকে একটা প্রস্তাব দেবার এটাই উপযুক্ত সময়।’
‘কী প্রস্তাব?’
‘আরে…শান্ত হও।’ মুচকি হেসে মিডিয়া বলল। ‘দেখো, ওয়েনসডে আর নেই। তুমি কারও প্রতি আর দায়বদ্ধ নও। আমাদের দলে যোগ দাও।’
কিছুই বলল না শ্যাডো।
‘আমরা চাইলেই তোমাকে বিখ্যাত বানাতে পারি, শ্যাডো। তোমাকে ক্ষমতাশালী করে তুলতে পারি। তুমি হতে পারো পরবর্তী ক্যারি গ্রান্ট। হতে পারো পরবর্তী বিটলস।’
‘এর চাইতে লুসির দুধ দেখার প্রস্তাবটা ভালো ছিল।’
‘আহ।’
‘আমার ঘরটা ফেরত চাই। শুভ রাত্রি।’
‘অবশ্য,’ এমনভাবে বলল মিডিয়া যেন শ্যাডোর কথা শুনতেই পারেনি। ‘চাইলে তোমাকে ধ্বংসও করে দিতে পারি। তোমাকে দেখলেই যেন সবাই হাসাহাসি করে, সে ব্যবস্থা করতে পারি। নাকি তোমাকে পিশাচ বানিয়ে রেখে দেব সবার স্মৃতিতে? ম্যানসনের মতো, হিটলারের মতো পিশাচ?’
‘আমি দুঃখিত, ম্যাম। তবে খুব ক্লান্ত,’ বলল শ্যাডো। ‘তুমি বিদায় নিলে প্রীত হই।’
‘তোমাকে দিতে চেয়েছিলাম সারা বিশ্ব,’ বলল মেয়েটা। ‘যখন নর্দমায় মুখ থুবড়ে পড়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করবে, তখন কথাটা ভেবে দেখ।’
‘দেখব।’
মিডিয়া বিদায় নিলেও, তার সুগন্ধ ছেড়ে গেল ঘরটায়। নগ্ন জাজিমে শুয়ে লরার কথা ভাবল ও। মনে পড়ল লরার ফ্রিসবি খেলার দৃশ্য; রুট বিয়ার খেতে ভালোবাসত মেয়েটা, ভালোবাসত নিত্য-নতুন কেনা আন্ডারওয়্যার পরে ওকে দেখাতে। কিন্তু যে দৃশ্যটাই মনে ফুটে উঠুক না কেন, সবগুলো শেষ হয় একইভাবে: লরার মৃত্যুর মুহূর্তটায়…যে মুহূর্তে রবির পুরুষাঙ্গ মুখে নিয়েছিল মেয়েটা। প্রতিবার কষ্ট দিয়ে ভেঙে যায় ছবিটা।
তুমি মৃত নও, বলেছিল লরা। তাই বলে বাঁচছ, সেটাও আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি না।
দরজায় নক হলো একটা। মোটকু ছেলেটা এসেছে। ‘ওই হ্যামবার্গারগুলো, ‘ বলল সে। ‘খুব একটা ভালো না! বিশ্বাস হয়, প্রায় পঞ্চাশ মাইলের মাঝে একটাও ম্যাকডোনাল্ড’স নেই? আমার ধারণাই ছিল না যে দুনিয়াতে এমনও জায়গা আছে!’
‘এই কামরাটা আস্তে আস্তে গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশনে পরিণত হচ্ছে।’ বলল শ্যাডো। ‘যাক গে, কেন এসেছ? ইন্টারনেটের স্বাধীনতার লোভ দেখাতে?’
কাঁপছে মোটকু। ‘নাহ, তোমার মৃত্যু লেখা হয়ে গেছে। তুমি তো আসলে অতি-প্রাচীন হাতে লেখা একটা পাণ্ডুলিপি, চাইলেও তোমাকে ডিজিটালাইজড করা যাবে না। আমি আধুনিক…তুমি প্রাচীন…’ শ্যাডোর মনে হলো, অদ্ভুত একটা গন্ধ আসছে ছেলেটার দেহ থেকে। জেলখানায় শ্যাডোর অপর পাশে আরেকজন কয়েদি ছিল। শ্যাডো তার নাম কখনও জানতে পারেনি। আচমকা একদিন, ঠিক মধ্য দুপুরে, কাপড়-চোপড় খুলে সবাইকে বলতে শুরু করল: ওর মতো যারা সত্যি সত্যি ভালো মানুষ, তাদেরকে স্পেস শিপে করে নিয়ে যাবার জন্য পাঠানো হয়েছে ওকে। এরপর আর কখনও লোকটাকে দেখেনি শ্যাডো। মোটকুর দেহ থেকে এই মুহূর্তে যে গন্ধটা আসছে, সেটা ওই একবারই, ওই পাগলের দেহে পেয়েছিল।
‘কোনো কাজ আছে তোমার?’
‘কথা বলতে চেয়েছিলাম,’ বলল হোঁতকা, তার কণ্ঠে করুণার আহ্বান। ‘আমার ঘরটা কেমন যেন। এই আরকি। আমাকে তোমার সাথে এখানে কিছুক্ষণ থাকতে দেবে?’
‘তোমার লিমোর বন্ধুদের কী হলো? যাদেরকে দিয়ে আমাকে পিটিয়েছিলে? তাদের কাউকে নিয়ে এসো।’
‘আমরা এখন ডেড জোনে আছি, ওরা আসতে পারবে না।’
শ্যাডো বলল, ‘মাঝরাতের দেরি আছে, ভোরের তো আরও অনেক। তোমার বিশ্রাম দরকার, আমারও তাই।’
মোটকু কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর মাথা দুলিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি টেনে দিল শ্যাডো, শুয়ে পড়ল জাজিমে।
কয়েক মুহূর্ত পর আবার শুরু হলো আওয়াজ। কীসের আওয়াজ, সেটা বুঝতে কিছুক্ষণ সময় লাগল ওর। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে এলো হলওয়েতে। মোটকু ছেলেটা নিজের ঘরে ফিরে গেছে। মনে হচ্ছে যেন সে বড়োসড়ো কিছু একটা বারবার দেয়ালে ছুড়ে মারছে। আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে, ছেলেটা নিজেকেই ছুঁড়ছে।
‘আমি…’ সম্ভবত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ছেলেটা। নিশ্চিত হতে পারল না শ্যাডো।
‘চুপ করো!’ চেরনোবোগের ঘর থেকে একটা চিৎকার ভেসে এলো।
মোটেলের বাইরে চলে এলো শ্যাডো, ক্লান্ত লাগছে খুব।
চালক এখনও হামভির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ‘ঘুম ধরছে না, স্যার?’ জানতে চাইল সে।
‘না।’ উত্তর দিল শ্যাডো।
‘সিগারেট, স্যার?’
‘নাহ, লাগবে না।’
‘আমি ধরালে কিছু মনে করবেন?’
‘একদম না।’
একটা ডিসপোজেবল লাইটার ব্যবহার করে আগুন ধরাল ড্রাইভার, সেই হালকা হলদে আলোতে লোকটার চেহারা দেখতে পেল শ্যাডো। চিনতে কষ্ট হলো না একদম…
… আস্তে আস্তে সব কিছু পরিষ্কার হতে শুরু করল ওর সামনে।
চিকন-চাকন চেহারাটা পরিচিত ওর। জানে, ক্যাপটা সরালেই ছোটো করে কাটা কমলা চুল দেখতে পাবে। এ-ও জানে, হাসতে গেলেই লোকটার চেহারায় দেখা যাবে লক্ষ লক্ষ ক্ষত।
‘দেখে তো মনে হচ্ছে ভালোই আছ!’ বলল ড্রাইভার।
‘লো কি?’ প্রাক্তন সেলমেটের দিকে ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শ্যাডো।
জেলের বন্ধুত্ব বিশেষ কিছু; খারাপ সময় আর খারাপ স্থান থেকে রক্ষা করে তা। কিন্তু এমন বন্ধুত্বের শুরু যেখানে, শেষটাও সেখানেই—জেলের চার দেয়ালের ভেতর। বাইরের মুক্ত জীবনে এমন বন্ধুর সাথে দেখা হোক, তা চায় না কেউ।
‘হায় যিশু, লো কি লেস্মিথ।’ বলল শ্যাডো, নিজের কানেই ধরা পড়ল ব্যাপারটা। ‘লোকি। লোকি লাই-স্মিথ! মিথ্যার জনক লোকি!
‘মাথাটা একটু কম চলে তোমার,’ বলল লোকি। ‘তবে শেষ পর্যন্ত ধরতে পেরেছ।’ হালকা হাসি খেলে গেল ওর মুখে।
.
শ্যাডোর ঘরে বসে আছে দুই প্রাক্তন সেলমেট। বিছানায়…জাজিমের দুই পাশে বসে আছে দুজন। মোটকুর ঘর থেকে আসা আওয়াজ এতক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে।
‘তোমার কপাল ভালো, আমার সাথে এক সেলে ছিলে।’ বলল লোকি। ‘নইলে এক বছরও টিকতে না।’
‘চাইলেই যে কোনো মুহূর্তে জেল থেকে বেরোতে পারতে না?’
‘তার চাইতে সময়টা জেলে কাটিয়ে দেওয়াই ভালো ছিল, একটু বিরতি দিয়ে যোগ করল লোকি। ‘দেবতার ব্যাপার-স্যাপার বুঝতে হবে তোমাকে। ব্যাপারটা ঠিক জাদু নয়। ব্যাপারটা মানুষের বিশ্বাসের। চারপাশে যত বিশ্বাস আছে, সবগুলোকে এক করে ঘনত্ব বাড়াবার। যেন আমরা হতে পারি মানুষের চাইতেও বেশি কিছু,’ আবার বিরতি দিল সে। ‘তারপর একদিন…একেবারে আচমকা মানুষ তোমাকে ভুলে যাবে। কেউ আর বিশ্বাস রাখবে না তোমার উপর। উপাসনা, উৎসগ—এগুলো তো বাদই দিলাম। তারপর আর কি, আমাদেরকে ব্যস্ত হতে হয় ব্রডওয়ের কর্নারে বসে তাস পেটাবার কাজে।’
‘তুমি আমার সেলে গেলে কেন?’
‘কাকতালীয় ব্যাপার, আর কিছু না।’
‘এখন বিপক্ষের হয়ে কাজ করছ।’
‘চাইলে সে কথা বলতে পারো। লাইনের কোন পাশে দাঁড়িয়ে আছ, সেটার উপর নির্ভর করছে সবকিছু। আমার যা মনে হয় তা বলি-বিজয়ী দলে আছি।’
‘কিন্তু তুমি আর ওয়েনসডে, তোমরা দুজন তো একই…কী বলে ওটাকে—’
‘নর্স দেবতা আমরা দুজনেই। এটাই তো বলতে চাচ্ছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘তো?’
ইতস্তত করল শ্যাডো। ‘এককালে নিশ্চয়ই বন্ধু ছিল তোমরা।’
‘না। আমরা কখনওই বন্ধু ছিলাম না। লোকটা মারা গেছে, তাতে আমার আফসোস নেই। আমাদেরকে আটকে ধরে রেখেছিল সে। এখন যেহেতু ও নেই, তাই সামনের দিকে তাকাতে পারব। হয় আমাদেরকে পরিবর্তন মেনে নিতে হবে, আর নয়তো ধ্বংস হতে হবে। ওয়েনসডে নেই, যুদ্ধও নেই।’
বিভ্রান্ত চোখে লোকির দিকে তাকাল শ্যাডো। ‘তুমি যে এতটা বোকা নও, তা আমি জানি,’ বলল সে। ‘ওয়েনসড়ের মৃত্যুতে কিছুই থামবে না। বরঞ্চ এখন সবাই এক হয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবে। গত কয়েকমাস খেটে-খুটে তিনি যা করতে পারেননি, তাকে মেরে ফেলে এক মুহূর্তেই তোমরা তা করে দেখিয়েছ!’
‘হয়তো!’ শ্রাগ করল লোকি। ‘আমার তো মনে হয়, ঝামেলা সৃষ্টিকারী সরে গেলে সরে যাবে ঝামেলাও। আর তাছাড়া, এসব আমার মাথাব্যথা না। আমি এক নগণ্য ড্রাইভার।’
‘একটা প্রশ্নের উত্তর দাও,’ প্রশ্ন করল শ্যাডো। ‘আমাকে নিয়ে সবাই এত ব্যস্ত কেন? এমনভাব করছে সবাই যেন আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমার এত দাম কেন?’
‘আমি কী জানি! তুমি গুরুত্বপূর্ণ, কেননা ওয়েনসডের কাছে তোমার গুরুত্ব ছিল। আর তার কাছে কেন তোমার গুরুত্ব…তা এখন আর কোনো দিনই জানা যাবে না। জীবনের এক অমীমাংসিত রহস্য ধরে নাও।’
‘রহস্যে রহস্যে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।’
‘তাই নাকি? আমার মনে হয়, রহস্য আসলে নুনের মতে…স্বাদ বাড়ায়।’
নগণ্য এক ড্রাইভার বললে নিজেকে। সবার হয়েই গাড়ি চালাও?’
‘যার আমাকে দরকার হয়, তার জন্যই চালাই। জীবিকা বলতে পারো।’ চেহারার কাছে হাতঘড়ি তুলে একটা বোতাম চাপল লোকি। ডায়ালগুলোতে নরম নীল আলো জ্বলতে শুরু করল। ‘মাঝ রাতের আর পাঁচ মিনিট বাকি আছে। আসবে?’
বড়ো করে একটা শ্বাস নিলো শ্যাডো। ‘আসছি।’
অন্ধকার মোটেলের পাঁচ নম্বর ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল দুজন।
পকেট থেকে একটা ম্যাচের বাক্স বের করে আগুন ধরাল লোকি, আচমকা জ্বলে ওঠা আলোয় চোখে ধাঁধা লেগে গেল শ্যাডোর। একটা একটা করে মোমবাতি ধরাতে শুরু করল লোকি। বিছানার মাথায়, সিঙ্কে আর জানালার ধারে রাখা হয়েছে ওগুলো।
ঘরের বিছানাটা দেয়াল থেকে সরিয়ে ঠিক মাঝখানে নিয়ে আসা হয়েছে। ফলে চারদিকের দেয়াল থেকে ওটার দূরত্ব কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র কয়েক ফুটে। বিছানার উপর চাদর বেছানো, মোটেলের পুরনো আর পোকায় কাটা চাদর। সেটার ওপর শুয়ে আছেন ওয়েনসডে।
মৃত্যুর সময় যে হালকা রঙের স্যুটটা পরে ছিলেন, সেটাই পরে আছেন এখনও। তার চেহারার ডান দিকটা কেউ স্পর্শ পর্যন্ত করেনি, আগের মতোই আছে। কিন্তু বাঁ দিকটার অবস্থা খারাপ। বাঁ কাঁধ আর স্যুটের সামনের দিকটা কালো দাগে ভরতি। হাত দুটো দুপাশে ছড়ানো, চেহারার ভাবটাকে কোনোভাবেই শান্ত বলা যায় না। যেন ব্যথা পেয়েছেন তিনি খুব; রাগ আর নিখাদ উন্মাদনায় ভরে আছে চেহারা। সেই সাথে কিছুটা সন্তুষ্টিও আছে ওখানে কোথাও।
মি. জ্যাকুয়েলের হাতে পড়লে, ওই ব্যথা আর রাগ মুছে যাবে নিমিষেই—ভাবল শ্যাডো। মৃত্যু তাকে যে সম্মানটা দেয়নি, সেটা দক্ষ হাতে দিতে পারত সে।
তবে হ্যাঁ, মৃত্যুও পারেনি দেহটাকে সংকুচিত করে তুলতে। তাছাড়া এখনও জ্যাক ড্যানিয়েল’সের হালকা গন্ধ ভেসে আসছে ওয়েনসডের কাছ থেকে।
বাতাস বাড়ছে, আমেরিকার কাল্পনিক কেন্দ্রকে ঘিরে উড়ে বেড়াচ্ছে তারা। জানালার সাথে থাকা মোমের আলো জানান দিচ্ছে বাতাসের উপস্থিতি।
হলওয়ে থেকে ভেসে আসা পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল শ্যাডো। কেউ একজন দরজায় নক করে বলল, ‘তাড়াতাড়ি করো। সময় হয়েছে।’ একে একে ঢুকতে শুরু করল সবাই।
প্রথমে এলো টাউন, তার পিছু পিছু মিডিয়া ও মি. ন্যান্সি আর চেরনোবোগ। একেবারে শেষে এলো মোটা-হোঁতকা। বিড়বিড় করে কী যেন বলছে সে, অথচ শব্দ বেরোচ্ছে না। ছেলেটাকে দেখে করুণা বোধ করল শ্যাডো।
বিনাবাক্য ব্যয়ে, এবং আনুষ্ঠানিকতার ধার না ধেরে লাশটাকে ঘিরে ধরল তারা। ছোটো জায়গাটায় হাত বাড়ালেই পাশের জনকে ছোঁয়া যাবে, এমন অবস্থা। ঘরের আবহাওয়া ধার্মিকতায় পূর্ণ। এমনটা আগে কখনও দেখেনি শ্যাডো।
‘আমরা এই দেবতাহীন জায়গায় একত্র হয়েছি,’ মুখ খুলল লোকি। ‘এই ব্যক্তির লাশ হস্তান্তরের জন্য, যেন তার শেষকৃত্য নিয়ম মেনে পালন করা সম্ভব হয়। কেউ যদি কিছু বলতে চান তো বলতে পারেন।’
‘আমার কিছু বলার নেই,’ বলল টাউন। ‘জীবনে এর সাথে একটা বাক্যও বিনিময় করেছি বলে মনে হয় না।’
চেরনোবোগ বলল, ‘এসবের মূল্য চুকাতে হবে তোমাদের, জানো তো? যা করেছ, তাতে কিচ্ছু শেষ হয়ে যায়নি। বরং শুরু হয়েছে।’
মোটকু খিল খিল করে মেয়েদের মতো উচ্চ কণ্ঠে হাসতে শুরু করল আচমকা। সে বলল, ‘বুঝতে পেরেছি।’ তারপর একদম আচমকা শুরু করে দিল আবৃত্তি:
‘ঘুরছে তো ঘুরছেই সবকিছু,
ইগল অমান্য করছে পাখি-পালককে;
ধসে পড়ছে সব; কেন্দ্র ধরে রাখতে পারছে না কিছুতেই…’
আচমকা আবার থমকে গেল ছেলেটা, ভ্রু কুঁচকে গেছে। বলল, ‘ধুরো, আগে পুরোটাই মুখস্থ ছিল।’ মুখ বিকৃত হয়ে গেল তার।
হঠাৎ সবাই তাকাল শ্যাডোর দিকে। বাতাস এখন চিৎকার করতে শুরু করেছে। যুবক বলল, ‘পুরো ব্যাপারটাই ঘৃণিত। এখানে উপস্থিত তোমাদের অর্ধেক হয়তো তাকে খুন করেছ, আর নয়তো সেই ঘটনার সাথে সরাসরি সংযুক্ত ছিলে। এখন ওয়েনসডের দেহ ফিরিয়ে দিচ্ছ আমাদের? খুব ভালো। মানছি, লোক হিসেবে তিনি খুব একগুঁয়ে ছিলেন। তবে আমি ওর মিড পান করেছি, এখনও ওর হয়ে কাজ করি। আমার কথা শেষ।’
মিডিয়া মুখ খুলল এবার, ‘এমন এক দুনিয়াতে আছি আমরা, যেখানে প্রতিদিন অনেক মানুষ মারা যায়। তাই একটা ব্যাপার মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ, আমাদের কাছ থেকে চলে যাওয়া মানুষের জন্য আমরা যতগুলো মুহূর্ত দুঃখ পাই, ততগুলো আনন্দের মুহূর্তই আমাদেরকে উপহার দেয় সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চা। সেই প্ৰথম কান্না, জাদুময় একটা ব্যাপার নয় কি? হয়তো কথাটা খারাপ শোনায়, কিন্তু আনন্দ আর দুঃখ যেন দুধ আর কুকি। এরচেয়ে ভালো সম্পর্ক আর কিছু হয় না। ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের সবার ভাবা দরকার।’
গলা পরিষ্কার করল মি. ন্যান্সি। ‘আর কেউ যেহেতু কথাটা বলছে না, তাই আমিই বলি। আমরা কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছি: এমন এক দেশের কেন্দ্রে, যেখানে কারও দেবতাদের নিয়ে মাথাব্যথা নেই। আর এইখানে…এই জায়গায় তো আরও না। শান্তিচুক্তিকে সম্মান দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই আমাদের। তোমরা আমাদেরকে আমাদের বন্ধুর লাশ দিয়েছ, সেটা আমরা নিচ্ছি। তবে শুনে রাখো, এর দাম চুকাতে হবে তোমাদের। রক্তের বিনিময়ে রক্ত, হত্যার বিনিময়ে হত্যা।’
‘যত্তসব,’ বলল টাউন। ‘বাসায় গিয়ে মাথায় গুলি ঢুকিয়ে দাও, তাতে আমাদের অনেক সময় আর কষ্ট-দুটাই বাঁচবে।’
‘চুলোয় যাও,’ রাগে গর্জে উঠল চেরনোবোগ। ‘তুমি, তোমার পরিবার সবাই চুলোয় যাও। যুদ্ধক্ষেত্রে তোমার মৃত্যু হবে না, তোমার রক্ত ঝরাবে না কোনো যোদ্ধা। নগণ্য এক মৃত্যু লেখা আছে তোমার কপালে। ঠোঁটে চুমু আর বুকে মিথ্যা নিয়ে মারা যাবে তুমি।’
‘চুপ করো, বুড়ো।’ বলল টাউন।
বাতাসের চিৎকার যেন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
‘ঠিক আছে, লাশটা এখন তোমাদের,’ বলল লোকি। ‘আমাদের কাজ শেষ। বুড়োকে নিয়ে যেতে পারো।’
আঙুল দিয়ে ইঙ্গিত করল সে, সাথে সাথে টাউন, মিডিয়া আর মোটকু বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। শ্যাডোর দিকে তাকিয়ে হাসল ও। ‘এ ভুবনে আসলে কেউ সুখী নয়, তাই না?’ বলে সে নিজেও বিদায় নিলো।
‘এখন কী?’ জানতে চাইল শ্যাডো।
‘এখন ওকে জড়িয়ে নিয়ে,’ বলল আনানসি। ‘আমরা বিদায় নেব।’
মোটেলের চাদরেই দেহটাকে জড়িয়ে নিলো ওরা। বয়স্ক দুজন লাশটাকে নিয়ে গেল করিডর পর্যন্ত। তারপর শ্যাডো বলল, ‘একটু দাঁড়ান। হাঁটু ভাঁজ করে লাশটাকে কাঁধে তুলে নিলো সে, এরপর একদম অল্প আয়াসে উঠে দাঁড়াল। ‘আমি নিচ্ছি,’ বলল ও। ‘চলুন, গাড়িতে নিয়ে যাওয়া যাক।’
চেরনোবোগকে দেখে মনে মনে হলো যেন তর্ক করবে, কিন্তু মুখ খুলল না। ওয়েনসডের দেহ বেশ ভারী হলেও, খুব একটা কষ্ট হলো না শ্যাডোর। অবশ্য এছাড়া আর উপায়ও নেই। করিডর ধরে ফেলা প্রতিটা পদক্ষেপের সাথে ওয়েনসডের বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেল ওর, গলায় পেল মিডের স্বাদ।
আমার সুরক্ষা এখন তোমার হাতে। আমাকে বিভিন্ন জায়গায় আনা-নেওয়া করবে, ছোটোখাটো কাজ করে দেবে। দরকার হলে…আবারও বলছি, দরকার হলে অবাধ্য কাউকে পোষও মানাতে হবে তোমার। আমি মারা গেলে, তুমি আমার হয়ে শোক পালন করবে…
মি. ন্যান্সি ওর জন্য মোটেল লবির দরজা খুলে ধরল, তারপর দ্রুত এগিয়ে খুলল গাড়ির পেছনের দরজা। বিপক্ষের চারজন হামভির পাশে দাঁড়িয়ে আছে, যেন দাঁড়িয়ে আছে ওদের চলে যাবার অপেক্ষায়। লোকি এতক্ষণে মাথায় চড়িয়েছে ক্যাপটা।
আস্তে করে ওয়েনসডের দেহটা গাড়িতে নামিয়ে রাখল শ্যাডো। কাঁধে কারও টোকা টের পেয়ে ঘুরে দাঁড়াল ও। টাউন দাঁড়িয়ে আছে, ওর দিকেই হাত বাড়ানো। কিছু একটা ধরে আছে সে।
‘এটা,’ বলল লোকটা। ‘মিস্টার ওয়ার্ল্ড তোমাকে দিয়েছে।’
জিনিসটা ওয়েনসডের কাচের চোখ, মাঝখানে চির ধরেছে ওটার। সামনের কিছুটা অংশ ভেঙে গেছে।
‘মেসনিক হল পরিষ্কার করার সময় জিনিসটা পেয়েছি। সৌভাগ্যের জন্য দিচ্ছি তোমাকে। দরকার হবে সামনে।
চোখটাকে আঁকড়ে ধরল শ্যাডো। কড়া কথা শোনাতে ইচ্ছা করছে ওর, কিন্তু টাউন আর দাঁড়িয়ে নেই। এরইমাঝে হামভিতে উঠে বসেছে সে।
.
পূর্ব দিকে এগোচ্ছে ওরা। সকালের আলো যখন নজরে পড়ল, তখন ওরা মিসৌরির প্রিন্সটনে। এরমাঝে এক মুহূর্তের জন্যও চোখ দুটো বন্ধ করেনি শ্যাডো।
ন্যান্সি বলল, ‘তোমাকে কোথায় নামিয়ে দেব? তোমার জায়গায় আমি হলে নকল পরিচয়পত্র বানিয়ে কানাডা, নাহয় মেক্সিকো পালিয়ে যেতাম।’
‘আমি আপনাদের সাথেই থাকব।’ বলল শ্যাডো। ‘ওয়েনসডে বেঁচে থাকলে সেটাই চাইতেন।’
‘তুমি আর ওর হয়ে কাজ করো না। ওয়েনসডে মারা গেছে। লাশটা জায়গামতো পৌঁছে দেওয়ার পর তুমি স্বাধীন ‘
‘কী করব?’
‘যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত মাথা নিচু করে থাকো।’ বলল ন্যান্সি।
‘সব ঝামেলা শেষ হলে,’ যোগ করল চেরনোবোগ। ‘আমার কাছে ফিরে এসো। আমি সব কিছুর ইতি টানব।’
‘লাশটা কোথায় নিচ্ছি আমরা?’ প্রশ্ন করল শ্যাডো।
‘ভার্জিনিয়ায়, ওখানে একটা গাছ আছে।’ জানাল ন্যান্সি।
‘জীবন-বৃক্ষ নাম, নয় দুনিয়ার মাঝে সংযোগ করেছে ওটা। চেরনোবোগ বলল। ‘আমার দেশেও ছিল, তবে ওখানে সেটা জন্মেছিল মাটির নিচে।’
‘গাছের নিচে শুইয়ে দেব ওকে,’ বলল ন্যান্সি। ‘এরপর আমাদের কাজ শেষ, তোমারও। আমরা যাব দক্ষিণে, যুদ্ধ হবে। রক্ত বইবে, অনেকে মারা যাব। দুনিয়ায় আসবে পরিবর্তন, অল্প কিছুটা হলেও!
‘আমাকে আপনাদের পক্ষে যুদ্ধে চান না? আমি আকারে কিন্তু বেশ বড়ো! যোদ্ধা হিসেবেও মন্দ নই।’
শ্যাডোর দিকে তাকিয়ে হাসল ন্যান্সি। লাম্বার কাউন্টি জেল থেকে বেরোবার পর আর এমন হাসি হাসতে দেখা যায়নি লোকটাকে। ‘যুদ্ধটা এমন এক জায়গায় হবে, যেখানে তুমি যেতেও পারবে না।’
‘মানুষের মন আর হৃদয়ে।’ বলল চেরনোবোগ। ‘ওই গোলকের মতো।’
‘মানে?’
ক্যারোসেলের কথা বোঝাচ্ছে।’
‘ওহ,’ বলল শ্যাডো। দৃশ্যপটের পেছনে, তাই তো? বুঝতে পেরেছি।’
মাথা তুলে তাকাল মি. ন্যান্সি। ‘হুম, আসল যুদ্ধটা সেখানেই হবে।’
‘শোক পালনের ব্যাপারটা বলুন।’
‘প্রথা একটা, কাউকে-না-কাউকে লাশের সাথে থাকতে হবে। আমরা খুঁজে নেব সেই কাউকে।’
‘ওয়েনসডে চাইতেন, আমি সেই ‘কেউ’ হই।’
‘না। বলল চেরনোবোগ। ‘খুব খারাপ বুদ্ধি, তুমি মারা পড়বে।’
‘তাই? মারা পড়ব? একটা লাশের সাথে থাকতে গিয়ে?’
‘আমার মৃত্যুর পর এ ধরনের শোক-পালন চাই না আমি,’ বলল মি. ন্যান্সি। ‘আমি চাই, আমাকে উষ্ণ একটা জায়গায় শুইয়ে দেওয়া হবে। আর যখন কোনো সুন্দরী আমার কবরের উপর দিয়ে হেঁটে যাবে, হাত বাড়িয়ে তার গোড়ালি আঁকড়ে ধরব। ঠিক যেমনটা চলচ্চিত্রে দেখা যায়।’
‘আমি অমন দৃশ্য কোন সিনেমায় দেখিনি,’ বলল চেরনোবোগ।
‘দেখেছেন, ওটার নাম ক্যারি। যাই হোক, কেউ একজন আমাকে এই শোক পালনের ব্যাপারটা খোলাসা করে বলুন।
‘তুমি বলো,’ বললেন ন্যান্সি। ‘আমি গাড়ি চালাচ্ছি।’
‘আমি ক্যারি নামে কোনো চলচ্চিত্রের কথা শুনিইনি। তাই তুমি বলো।’ মুখ খুলল ন্যান্সি, ‘যে লোকটা শোক পালন করবে, তাকে গাছের সাথে বেঁধে রাখা হবে। যেভাবে ওয়েনসডে ঝুলে ছিল, সেভাবে তাকে ঝুলতে হবে নয় রাত আর নয় দিন। খাবার পাবে না, পানি পাবে না…একদম একা। যদি নয়দিন পরও লোকটা বেঁচে থাকে, তাহলে তাকে নামিয়ে নেওয়া হবে। এই তো শোক পালন।’ চেরনোবোগ বলল, ‘আলভিসস হয়তো ওর কাউকে পাঠাবে। বামনরা শক্তপোক্ত আছে, বাঁচলেও বাঁচতে পারে।’
‘আমিই পালন করব।’ বলল শ্যাডো।
‘না।’
‘হ্যাঁ।’
কিছুক্ষণ চুপ করে রইল দুই বৃদ্ধ। তারপর ন্যান্সি জানতে চাইল, ‘কেন?’
‘কেননা যেকোনো জীবিত মানুষই কাজটা করতে চাইবে।’ বলল শ্যাডো।
‘তুমি উন্মাদ।’
‘হয়তো। কিন্তু আমি ওয়েনসডের জন্য শোক পালন করব।’
তেল ভরার সময় ওরা থামলে চেরনোবোগ জানাল, অসুস্থ বোধ করছে সে। সামনে বসতে চায়। পেছনে বসতে আপত্তি নেই শ্যাডোর। হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল ও।
চুপচাপ চলল গাড়ি। শ্যাডোর মনে হলো যেন গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।
‘ওই…চেরনোবোগ,’ বেশ কিছুক্ষণ পর মুখ খুলল ন্যান্সি। ‘মোটেলে টেকনিক্যাল বয়ের অবস্থা দেখেছ? ছেলেটাকে অসুস্থ বলে মনে হলো। সহ্য করতে পারবে না, এমন জিনিসে জড়িয়ে পড়েছে মনে হয়। আজকালকার বাচ্চা- কাচ্চাদের নিয়ে এটাই সমস্যা। তারা ভাবে, অনেক অভিজ্ঞতা জড়ো করে ফেলেছে, জানে সবকিছু। ওদেরকে শেখাতে হলে কড়া পন্থা অবলম্বন করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।’
‘সে-ই তো ভালো।’ বলল চেরনোবোগ।
হাত-পা ছড়িয়ে পেছনের সিটে শুয়ে ছিল শ্যাডো, নিজেকে ওর দ্বৈত-সত্তার কেউ বলে মনে হচ্ছে। ওর একটা অংশ আনন্দে উদ্বেল হয়ে আছে-কাজের মতো কাজ করছে একটা বলে ভাবছে। যদি লরার কথা সত্য হয় এবং ও আসলেই ‘বাঁচছে না’, তাহলে কিছুই করত না সে। কিন্তু না, কিছু একটা করেছে ও। শ্যাডোর আশা, এসব শেষ হবার পরেও বেঁচে থাকবে। তবে দরকার পড়লে মরতেও আপত্তি নেই।
ওর মনের আরেকটা অংশ, এখনও সব কিছুর অর্থ খুঁজে বের করতে চাইছে। ‘লুকানো ইন্ডিয়ান।’ উঁচু কণ্ঠে বলল সে।
‘কী’ চেরনোবোগ সামনের সিট থেকে বলল।
‘বাচ্চা বয়সে আমরা ওসব ছবি নিয়ে খেলতাম। ‘ছবির মাঝে লুকানো ইন্ডিয়ানকে দেখতে পাচ্ছ? ছবিতে দশজন ইন্ডিয়ান আছে, সবাইকে খুঁজে বের করতে পারবে?’ এক নজরে সবাইকে খুঁজে পাওয়া যায় না। সাবধানতার সাথে লুকিয়ে থাকে ছায়ায়…’ হাই তুলল ও।
‘ঘুমাও,’ পরামর্শ দিল চেরনোবোগ।
‘কিন্তু…’ বলতে বলতেই ঘুমিয়ে পড়ল শ্যাডো। স্বপ্নে খুঁজতে শুরু করল লুকানো ইন্ডিয়ানদের।
.
ভার্জিনিয়ায় অবস্থিত গাছটা, লোকালয় থেকে অনেক দূরে; একটা পুরনো খামারের পেছন দিকে। ব্ল্যাক্সবার্গ থেকে এক ঘণ্টা দক্ষিণে গাড়ি চালাবার পর পৌঁছানো যায় সেই খামারটায়। পেনিউইঙ্কল ব্রাঞ্চ আর রুস্টার স্পার নামক রাস্তা ধরে এগোতে হয়। বার দুয়েক পথ হারিয়ে ফেলল ওরা। মি. ন্যান্সি আর চেরনোবোগ রাগারাগি করল একে-অন্যের সাথে, একবার করে শ্যাডোর সাথেও।
পথ-নির্দেশনার জন্য ছোটো একটা জেনারেল স্টোরের সামনে দাঁড়াল ওরা। ওটার সামনেই দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে রাস্তাটা। দোকানের পেছন থেকে এক বৃদ্ধ বেরিয়ে এসে চেয়ে রইল ওদের দিকে। মি. ন্যান্সিকে একটা ন্যাপকিনের পেছনে মানচিত্র এঁকে দেখাল সে, এদিকে সেই সুযোগে এক পাত্র আচার দেওয়া শুয়োরের পা কিনল চেরনোবোগ।
আবার পথে নামল ওরা। দশ মিনিট পর পৌঁছাল লক্ষ্যে। খামারটার দরজায় বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা-অ্যাশ।
গাড়ি থেকে নেমে সদর দরজা খুলল শ্যাডো। গাড়িটা ভেতরে প্রবেশ করলে পর আবার বন্ধ করে দিল। হাঁটতে শুরু করল ও, দেহটাকে নড়াবার সুযোগ পেয়েছে বলে ভালো লাগছে। গাড়িটা একটু বেশি সামনে এগিয়ে গেলে দৌড়ালও বার দুয়েক।
ক্যানসাস থেকে ফেরার পথে সময়ের হিসাব গুলিয়ে ফেলেছে শ্যাডো। দুই দিন পার হয়েছে? নাকি তিন? জানে না ও।
লাশটায় পচন ধরেনি একদম! এখনও কেবলমাত্র জ্যাক ড্যানিয়েল’সের হালকা একটা গন্ধ নাকে পাচ্ছে ও। সেই সাথে টক হয়ে যাওয়া মধুরও, তবে গন্ধটা খুব একটা মন্দ লাগছে না ওর। মাঝে-সাঝেই পকেট থেকে কাচের চোখটা বের করে দেখছে সে। ভেতরের কিছু একটা ভেঙে গেছে, সম্ভবত বুলেটের আঘাতের জন্যই। তবে বাইরে থেকে দেখে কিছু বোঝা যায় না। স্যুভনির হিসেবে জিনিসটা খুব একটা ভালো না হলেও, শান্তি পাচ্ছে ও।
খামারের দালানটা অন্ধকার, বন্ধ। চারপাশের খেতটা আগাছা ভরতি, দেখে পরিত্যক্ত বলে মনে হয়। দালানটার ছাঁদেও ভাঙন ধরেছে। প্লাস্টিকের শিট দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে জায়গাটা। আচমকা গাছটা দেখলে পেল শ্যাডো।
গাছটা খামার বাড়ির চাইতেও লম্বা, এত সুন্দর বৃক্ষ এর আগে দেখেনি শ্যাডো। একই সাথে পার্থিব আর অপার্থিব। দুপাশের ভারসাম্য একেবারে নিখুঁত। বড়ো পরিচিত মনে হলো ওটাকে, যেন আগে কোথাও দেখেছে। আচমকা মনে পড়ল ওর, ওয়েনসডে পিন হিসেবে এই গাছেরই একটা প্রতিকৃতি পরতেন সবসময়।
শ্যাডোদের গাড়িটা লাফাতে লাফাতে তৃণভূমি ধরে এগোচ্ছে, গাছটার প্রায় বিশ ফুট দূরে থামল বাহনটা।
গাছের পাশে তিনজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। প্রথম দেখায় শ্যাডোর মনে হলো, ওরা যরিয়া বোনেরা। কিন্তু না, এই তিনজনকে চেনে না ও। ক্লান্ত আর বিরক্ত দেখাচ্ছে মহিলাদেরকে, যেন অনেকদিন ধরে দাঁড়িয়ে আছে তারা। প্রত্যেকেই ধরে আছে একটা করে কাঠের সিঁড়ি। সবচেয়ে বড়ো বোনটার হাতে আরও আছে একটা বাদামি থলে। দেখে মনে হচ্ছে যেন রাশিয়ান একদল পুতুল-একজন লম্বা, শ্যাডোর সমানই হবে; এক জন মাঝারী আকৃতির, আরেকজন এতটাই খাটো আর পিঠে কুঁজ যে দেখে ছোটো বাচ্চা বলে মনে হয়েছিল শ্যাডোর। তিনজনের চেহারা এতটাই কাছাকাছি যে দেখেই বোঝা যায় তারা বোন।
গাড়িটাকে দেখে একদম খাটো মহিলা বাউ করল, অন্য দুজন চেয়ে রইল কেবল। একটাই সিগারেট টানছে তিনজন মিলে। ফিল্টার পর্যন্ত শেষ করে সেটা গাছের শিকড়ে পিষে নেভাল।
চেরনোবোগ গাড়ির পেছনটা খোলা মাত্র সবচেয়ে লম্বা মহিলা বোন ওদেরকে সরিয়ে এগিয়ে এলো। ওয়েনসডের লাশটা এমন স্বাভাবিকভাবে তুলে নিলো সে যেন ময়দার বস্তা তুলছে! গাছের প্রায় দশ ফুট সামনে দেহটাকে শুইয়ে দিল সে। এরপর বোনদের সাথে নিয়ে খুলে ফেলল ওয়েনসডেকে পেঁচিয়ে রাখা চাদর।
.
দিনের আলোতে আরও বীভৎস দেখাচ্ছে লাশটাকে, মাত্র একবার তাকিয়েই নজর সরিয়ে নিলো শ্যাডো। এদিকে মহিলারা ব্যস্ত দেহটাকে নিয়ে, স্যুটের ভাঁজ সোজা করল তারা। তারপর চাদরটার এক কোনায় শুইয়ে আবার মুড়িয়ে নিলো।
এরপর তিনজনই এগিয়ে এলো শ্যাডোর দিকে
–তুমিই সে? সবচেয়ে লম্বা মহিলা জানতে চাইল।
–যে শোক পালন করবে? মাঝের জনের প্রশ্ন।
-সর্ব-পিতার জন্য? ছোটো জনের জিজ্ঞেস।
মাথা দোলাল শ্যাডো। সত্যি সত্যি মহিলাদের কণ্ঠ শুনেছে কি না, সে ব্যাপারে পরেও কখনও নিশ্চিত হতে পারেনি সে। হয়তো শোনেনি, তাদের চোখের দৃষ্টি আর আচরণ দেখে ধরে নিয়েছে।
মি. ন্যান্সি বাথরুম ব্যবহার করার জন্য দালানে গেছিল, ফিরে এলো গাছের কাছে। সিগারেল্লো ঝুলছে তার মুখে, দেখে গম্ভীর মনে হচ্ছে।
‘শ্যাডো,’ বলল সে। ‘আসলেই শোক পালন করার দরকার নেই তোমার। যোগ্য কাউকে খুঁজে নিতে পারব।’
‘আমিই করছি শোক পালন।’ গম্ভীর কণ্ঠ শ্যাডোরও।
যদি তুমি মারা পড় তো?’
‘তাহলে মরব।’
রাগের সাথে সিগারেল্লোটা ফেলে দিল মি. ন্যান্সি। ‘আগেই বলেছিলাম, তোমার মাথায় গোবর পোড়া, আবারও বলছি। মুক্তির পথ দেখাচ্ছি, বুঝতে পারছ না কেন?’
‘আমি দুঃখিত।’ শক্ত মুখে বলল শ্যাডো, আর কী বলবে বুঝে পেল না। ন্যান্সি ফিরে গেল গাড়ির কাছে
শ্যাডোর পাশে এসে দাঁড়াল চেরনোবোগ, ওকেও খুব একটা সন্তুষ্ট বলে মনে হচ্ছে না। ‘মরা যাবে না তোমার।’ বলল সে। ‘আমার জন্য হলেও নিরাপদে ফিরতে হবে।’ শ্যাডোর কপালে আলতো করে টোকা দিল ও। ‘ব্যাম!’ যুবকের কাঁধে হালকা চাপড় দিয়ে ন্যান্সির সাথে গিয়ে বসল গাড়িতে।
সবচেয়ে বড়ো মহিলা, যার নাম হয়তো উর্থা আর নয়তো উডার, ইঙ্গিতে শ্যাডোকে নগ্ন হতে বলল।
‘সব খুলে ফেলব?’
শ্রাগ করল মহিলা। টি-শার্ট আর নিচের আন্ডারওয়্যার বাদে সব খুলে ফেলল শ্যাডো। মেয়েরা সিঁড়িটাকে গাছের সাথে লাগিয়ে আবারও ইঙ্গিতে ওকে চড়ার নির্দেশ দিল।
নয় ধাপ উঠল ও। তারপর মেয়েটার নির্দেশে একটা নিচু ডালে পা রাখল।
মাঝারী আকৃতির মহিলা বাদামি থলেটা ধরল উপুড় করে, ভেতর থেকে কতগুলো দড়ি পড়ল মাটিতে। বয়সের ভারে বাদামি হয়ে গেছে, মাটি আর কাদা লেগে আছে ওতে। ওয়েনসডের দেহের পাশে সাবধানে গিঁট খুলে দড়িটা শুইয়ে রাখতে শুরু করল।
কাজ শেষ হলে নিজেদের সিঁড়ি ব্যবহার করে গাছে উঠতে শুরু করল তিন বোন। প্যাঁচানো আর কঠিন সব গিঁট দিতে শুরু করল দড়িতে, তারপর শ্যাডোকে জড়িয়ে। এমনকি লজ্জাহীনভাবে যুবকের টি-শার্ট আর আন্ডারওয়্যারও খুলে ফেলল তারা, যেমন করে খোলে লাশ নিয়ে কাজ করা মানুষেরা। বাঁধন খুব বেশি আঁটোসাঁটো হলো না, তবে শক্ত হলো নিঃসন্দেহে। শ্যাডোর বগলের নিচে, ওর দুই পায়ের ফাঁকে, কব্জি, গোড়ালি আর বুকের উপর দিয়ে গেল দড়ি। ক্ষণিকের মাঝেই গাছের সাথে বাঁধা পড়ল শ্যাডো।
একেবারে শেষে হালকা করে ওর গলায় পেঁচিয়ে দেওয়া হলো দড়ি। প্ৰথম প্রথম কিছুটা অস্বস্তি হলো শ্যাডোর, কিন্তু এত দক্ষভাবে পেঁচানো হয়েছে যে দড়িটা কোথাও কেটে বসল না ওর মাংসে।
শ্যাডোর পা মাটি থেকে পাঁচ ফুট ওপরে ঝুলছে। গাছটা বিশাল হলেও, পাতা নেই। আকাশের পটভূমিতে ডালগুলোকে কালো বলে মনে হচ্ছে। বাকলগুলো মসৃণ রুপালি।
সিঁড়িগুলো সরিয়ে নিলো তিন বোন। ঝট করে কয়েক ইঞ্চি নিচে নেমে গেল শ্যাডোর দেহ, ভয় পেয়ে গেল ও। কিন্তু শব্দ করল না।
ওয়েনসডের দেহটাকে গাছের গোড়ায় শুইয়ে দিল বোনেরা, বিদায় নিলো এরপর…
…শ্যাডোকে একাকী রেখে।