আমেরিকান গডস – ১৩

অধ্যায় তেরো 

হে মোর বন্ধু, 
বলবে কী কিছু? 
করবে কি ঠিক সবকিছু?
দেবে কি নতুন মাত্রা বন্ধুত্বে? 

কেন এমন গম্ভীর? 
একসাথে আছি, থাকব সর্বদা। 
তুমি, আমি আর সে- 
জীবন লাগিয়েছি যে বাজিতে। 

–স্টিফেন সোনহেইম, ‘ওল্ড ফ্রেন্ডস’ 

.

শনিবার সকালে, নক শুনে দরজা খুলল শ্যাডো। 

মার্গারিতা ওলসেন বাইরে দাঁড়িয়ে আছে! ভেতরে প্রবেশ করল না মেয়েটা, গম্ভীর চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল বাইরে। ‘মিস্টার আইনসেল…?’ 

‘মাইক বলে ডেকো, প্লিজ।’ 

‘আচ্ছা, মাইক। আজ রাতে, এই ধরো ছয়টার দিকে, আমার বাড়িতে তোমার দাওয়াত। বেশি কিছু খাওয়াতে পারব না অবশ্য, কেবল স্প্যাগেটি আর মিটবল।’ 

‘স্প্যাগেটি আর মিটবল আমার পছন্দ।’

‘তবে যদি অন্য কাজ থাকে তো…’ 

‘নেই।’ 

‘তাহলে ছয়টার সময়?’ 

‘ফুল আনব?’ 

‘চাইলে আনতে পারো। তবে এই আমন্ত্রণটা কিন্তু সামাজিক, রোমান্টিক নয়।’

গোসল সেরে হাঁটতে বেরল শ্যাডো। ব্রিজে পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এলো আবার। সূর্য উঠেছে। আকাশের অনেকটা উজ্জ্বল করে রেখেছে সে। বাসায় ফিরে যুবক লক্ষ করল, ঘামে ভেজা ওর কোটটা! ফোররানারটা বের করে চলে গেল ডেভের দোকানে, ওখান থেকে এক বোতল ওয়াইন কিনে নিলো। দাম বাইশ ডলার, শ্যাডোর মনে হলো-এই দামের ওয়াইন ভালো না হয়ে যায় না। 

উপহার হিসেবে কিনল একটা চারাগাছ। ওটার পাতাগুলো সব সবুজ, ফুল ধরেনি। এই উপহারের মাঝে চাইলেও রোমান্টিক কিছু খুঁজে বের করা সম্ভব না। সেই সাথে কিনল এক কার্টন দুধ, যদিও জানে যে ওটায় কখনও চুমুক দেওয়া হবে না। সেই সাথে কিনল কিছু ফল, ওগুলোও কখনও খাওয়া হবে না। 

ম্যাবেলের দোকানে গিয়ে লাঞ্চে খাবার জন্য প্যাস্টি কিনল একটা, ওকে দেখা মাত্র উজ্জ্বল হয়ে উঠল ম্যাবেলের চেহারা। হিনজেলমান বলেছে তোমাকে?’ 

‘আমি তো জানতামই না যে তিনি আমাকে খুঁজছেন।’ 

‘গোরু খোঁজা খুঁজছে, তোমাকে নিয়ে নাকি বরফে মাছ ধরতে যাবে। চ্যাড মুলিগানও খুঁজছিল। জানো, ওর এক আত্মীয়া এসেছে বাইরে থেকে। খুব ভালো মেয়ে, তোমার পছন্দ হবে।’ বলতে বলতে একটা বাদামি প্যাকেটে প্যাস্টিটা ভরল ম্যাবেল, গরম রাখার জন্য মুড়ে দিল প্যাকেটের ওপরের দিকটা। 

অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে অ্যাপার্টমেন্টে ফিরল শ্যাডো, গাড়ি চালাতে চালাতেই এক হাতে শেষ করল প্যাস্টিটা। ফোররানারের মেঝে আর ওর জিনিসের সামনের দিকটা ভরে গেল প্যাস্টির ছোটো ছোটো টুকরায়। ফেরার পথে লাইব্রেরির সামনের রাস্তাটা ধরল। বরফে আচ্ছাদিত শহরটাকে সাদা-কালোতে আঁকা ছবি বলে মনে হচ্ছে। বসন্ত এখনও অনেক দূরের বিষয়। শ্যাডোর মনে হলো, ওই ক্যাংকারটা আজীবন জমাট বাঁধা হ্রদের ওপরেই বসে থাকবে, চারপাশে থাকবে মাছ-শিকারিদের তাঁবু আর ট্রাক। 

অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে গাড়ি পার্ক করল সে, এরপর কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল। গোল্ডফিঞ্চ আর নাটহ্যাচ পাখি ভিড় করেছে খাবার জন্য। ওদের চোখের সামনে দিয়েই ঘরে ঢুকল শ্যাডো, চারাগাছটায় পানি ঢেলে ভাবল-ওয়াইনটা ফ্রিজে রাখবে কি না। 

ছয়টা বাজতে এখনও অনেক দেরি। 

টেলিভিশন দেখতে পারলে ভালো হতো, আফসোসের সাথে ভাবল শ্যাডো। চুপচাপ বসে থাকা মানেই নানা চিন্তাকে মাথায় ঢোকার আমন্ত্রণ জানানো। সেটা চায় না ও। চায় বিনোদিত হতে, চুপচাপ বসে টিভির ছবি আর শব্দের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে দিতে। লুসির দুধ দেখতে চাও? স্মৃতির গহীন থেকে লুসির কণ্ঠে বলে উঠল কেউ। মাথা ঝাঁকাল শ্যাডো, যদিও আর কেউ নেই ঘরে। 

নার্ভাসবোধ করছে, বুঝতে পারল আচমকা। অন্যদের সাথে, স্বাভাবিক মানুষদের সাথে এই হতে চলছে ওর প্রথম সামাজিক যোগাযোগ। যারা জেলের কয়েদি না, নয় দেবতা বা কিংবদন্তির নায়ক। শেষ এমন কিছু হয়েছিল তিন বছর আগে। তখন ওর নাম ছিল শ্যাডো, কিন্তু আজ মাইক আইনসেল হয়ে ওকে কথোপকথন চালাতে হবে। 

ঘড়ির দিকে তাকাল একবার, আড়াইটা বাজে। মার্গারিতা ওলসেন বলেছিল, ছয়টার দিকে যেতে। ছয়টা মানে কি কাঁটায় কাঁটায় ছয়টা? একটু আগে গেলে কি খুব অসুবিধা হবে? নাকি একটু দেরি করে যাবে? অনেক চিন্তা-ভাবনার পর ঠিক করল, ছয়টা পাঁচে যাবে ও। 

আচমকা বেজে উঠল শ্যাডোর টেলিফোন। 

‘হুম?’ রিসিভার তুলে বলল ও। 

‘এভাবে কেউ ফোনে কথা বলে?’ গর্জে উঠলেন যেন ওয়েনসডে। 

‘যখন সংযোগ নেব, তখন ভদ্রভাবে কথা বলব নাহয়,’ উত্তর দিল শ্যাডো। ‘আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারি?’ 

‘আমি জানি না,’ বললেন ওয়েনসডে। একটু বিরতি নিয়ে যোগ করলেন। ‘দেবতাদের এক করা আর একগাদা বিড়ালকে সোজা লাইনে হাঁটানো একই কথা। এই জিনিসটা তাদের স্বভাবে নেই।’ ওয়েনসডের কণ্ঠে ক্লান্তির আভা শুনতে পেল শ্যাডো, এই প্ৰথম 

‘কী হয়েছে?’ 

‘কঠিন। কাজটা একটু বেশিই কঠিন। তারচেয়ে বড়ো কথা, এতে কাজ হবে কি না, সেটাও জানা নেই। এরচেয়ে নিজের গলা নিজেই কেটে ফেলা ভালো।’ 

‘এভাবে বলতে নেই।’

‘হুম।’ 

‘তবে হ্যাঁ,’ দুষ্টামি করে ওয়েনসডেকে একটু চাঙ্গা করার প্রয়াস পেল শ্যাডো। ‘নিজের গলা নিজে কাটলে, ব্যথা লাগার সম্ভাবনা কম।’ 

‘লাগবে। আর আমার মতো অস্তিত্বদের জন্যও, ব্যথা ব্যথাই। যদি কেউ বস্তুগত এই দুনিয়াতে কিছু করে, তাহলে বস্তুগত দুনিয়াও তার উপর প্রভাব ফেলে। ব্যথা কষ্ট দেয়, ঠিক যেমনটা মাতাল করে তোলে লোভ আর পোড়ায় আসক্তি। হয়তো আমরা সহজে মরি না, কিন্তু মরি বটে। যদি আমাদেরকে কেউ ভালোবেসে স্মরণ করে, তাহলে আমাদের মতোই কিছু একটা এসে আমাদেরই ফাঁকা জায়গা দখল করে নেয়। আবার প্রথম থেকে শুরু হয় সবকিছু। আর যদি ভুলে যাওয়া হয়…তাহলে সব শেষ।’

কী বলবে, বুঝে পেল না শ্যাডো। ‘তা কোত্থেকে ফোন করেছেন?’

‘তোমার জেনে কাজ কী?’ 

‘মাতাল হয়েছেন নাকি?’ 

‘এখনও হইনি। থরের কথা মনে পড়ছে। তোমার সাথে দেখা হয়নি কখনও। বিশালদেহী ছিল, ঠিক তোমারই মতো। সাদা মনের মানুষ, খুব একটা চালাক না। কিন্তু চাইলে নিজের পরনের পোশাকও খুলে দেবে। আত্মহত্যা করেছিল থর। সেই ১৯৩২ সালে ফিলাডেলফিয়ায়, বন্দুকের নল মুখে পুরে টিপে দিয়েছিল ট্রিগার। এইভাবে কি কোনো দেবতার মারা যাওয়া উচিত?’ 

‘আমি দুঃখিত।’ 

‘তোমার আসলে কিছু যায় আসে না, বাছা। অনেক দিক দিয়েই তোমার মতো ছিল ও। বড়োসড়ো, বোকা।’ চুপ হয়ে গেলেন ওয়েনসডে, কাশলেন খক খক করে। 

‘কোনো সমস্যা?’ দ্বিতীয়বারের মতো জানতে চাইল শ্যাডো। ‘ওরা যোগাযোগ করেছে।’ 

‘কারা?’ 

‘প্ৰতিপক্ষ।’ 

‘কী চায়?’ 

‘শান্তি চুক্তি। নিজে বাঁচো আর অন্যকে বাঁচতে দাও টাইপ।’ 

‘এখন কী হবে?’ 

‘অত্যাধুনিক কিছু হারামজাদার সাথে ক্যানসাস সিটির এক মেসনিক হলে বাজে স্বাদের কফি পান করতে হবে।’ 

‘ঠিক আছে। আপনি আমাকে তুলে নেবেন? নাকি কোথাও আসব?’ 

‘যেখানে আছ, সেখানেই থাকো। মাথা নিচু করে রাখবে, কারও যেন নজরে না পড়ো। ঠিক আছে?’ 

‘কিন্তু—’ 

ক্লিক করে একটা শব্দ হলো কেবল, ওপাশ থেকে আর কোনো কথা শুনতে পেল না শ্যাডো। ডায়াল টোনও নেই, অবশ্য কখনও ছিলও না। 

সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কোন কাজ নেই এখন। ওয়েনসডের সাথে হওয়া কথোপকথন শ্যাডোকে নাড়া দিয়ে গেছে। হাঁটার জন্য উঠে দাঁড়াল সে, কিন্তু রাত নামতে শুরু করেছে দেখে বসে পড়ল আবার। 

মিনিটস অভ দ্য লেকসাইড সিটি কাউন্সিল ১৮৭২-১৮৮৪ বইটার পাতা ওলটাতে শুরু করল ও, চোখ বোলাচ্ছে কেবল। পড়ছে না কিছুই, মাঝে মাঝে চোখে উল্লেখযোগ্য কিছু আটকে গেলে থামছে কেবল। 

১৮৭৪ সালের জুলাই মাসে, শ্যাডো জানতে পারল, কিছু বহিরাগত কাঠুরে পা রেখেছিল শহরে। থার্ড স্ট্রিট অ্যান্ড ব্রডওয়ের এক কোনায় বানানো হয়েছিল একটা অপেরা হাউজ। স্থানীয় মিলের পুকুরটাকে হ্রদে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল সেই বছরেই। আর ক্ষতি পূরণ হিসেবে কোনো এক মি. স্যামুয়েল স্যামুয়েলসকে দেওয়া হয়েছিল সত্তর ডলার। সেই সাথে আশপাশের জমি অধিগ্রহণের জন্য মি. হেইকি সালমিনেনকে দেওয়া হয়েছিল পঁচাশি ডলার। 

শ্যাডো ধারণাও করতে পারেনি যে হ্রদটা মনুষ্য-নির্মিত। যদি শহরে হ্রদ না- ই থাকে, তাহলে সেটার নাম লেকসাইড দেবার কী মানে? 

পড়ে চলল ও। ব্যাভারিয়া থেকে আগত, হুডেনমুহলেন, যে এখানে এসে মি. হিনজেলমান নাম নিয়েছে, হ্রদ-প্রকল্পের দায়িত্বে ছিল। সিটি কাউন্সিলের পক্ষ থেকে এজন্য তাকে দেওয়া হয়েছিল মোট তিনশ সত্তর ডলার, আরও কিছু লাগলে সেটা অধিবাসীদের দান থেকে নিতে হবে। একটা টিস্যু পেপার ছিঁড়ে সেটাকে বুকমার্ক হিসেবে বইয়ের ভেতরে রাখল ও। এই জায়গাটা বর্তমানের হিনজেলমানকে দেখালে সে খুশিই হবে। লোকটা এ ব্যাপারে জানে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে ওর। পাতা উলটে চলল শ্যাডো, হ্রদের ব্যাপারে আর কিছু পায় কি না খুঁজছে। ১৮৭৬ সালের বসন্ত মাসে প্লাবিত করা হয়েছিল হ্রদটা। 

ঘড়ির দিকে তাকাল শ্যাডো, সাড়ে পাঁচটা বাজে। বাথরুমে গিয়ে দাড়ি কামিয়ে নিলো ও, চুল আঁচড়ে পালটে নিলো পোশাকও। বাকি সময়টা কেটে গেল যেন চোখের পলকে। ওয়াইন ও চারাগাছ নিয়ে পাশের দরজার সামনে দাঁড়াল সে। 

নক করতেই মার্গারিতা ওলসেন এসে খুলে দিল দরজা। মেয়েটাকে দেখে ওর মতোই নার্ভাস বলে মনে হচ্ছে। উপহার দুটো নিয়ে ধন্যবাদ জানাল শ্যাডোকে। টেলিভিশনে ‘ওজের জাদুকর’ দেখাচ্ছে। ডরোথি এখনও ক্যানসাসে, বসে আছে প্রফেসর মার্ভেলের ওয়্যাগনে। বুড়ো প্রতারক মেয়েটার মন পড়ার ভান ধরছে। শান্ত হয়ে বসে আছে ডরোথি, অতি সত্বর যে একটা ঝড় আসছে সে ব্যাপারে অজ্ঞ। লিয়োন বসে আছে পর্দার সামনে, একটা খেলনা ফায়ার-ট্রাক নিয়ে খেলছে। শ্যাডোকে দেখে হাসিতে ভরে উঠল ওর চেহারা, দৌড়ে শোবার ঘরে চলে গেল ও। এক মুহূর্ত পর একটা কোয়ার্টার হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো। 

‘দেখো, মাইক আইনসেল!’ চিৎকার করে দুই হাত বন্ধ করল সে, এমন ভান করল যেন পয়সাটাকে ডান হাতে নিয়েছে। এরপর খুলে বলল, ‘দেখো, পয়সা নেই! মাইক আইনসেল, দেখো!’ 

‘খুব ভালো,’ বলল শ্যাডো। ‘খাওয়া শেষ হলে যদি আম্মু অনুমতি দেয়, তাহলে আরও সহজে কীভাবে কাজটা করা যায় তা দেখাব।’ 

‘চাইলে এখনও দেখাতে পারো।’ বলল মার্গারিতা। ‘আমরা সামান্থার জন্য অপেক্ষা করছি। টক-দই আনতে পাঠিয়েছি ওকে। কখন আসবে, কে জানে?’ 

যেন ওর কথা শুনতে পেয়েই, কাঠের ডেকে পায়ের শব্দ শোনা গেল। কাঁধের ধাক্কায় দরজা খুলল কেউ একজন। প্রথম দেখায় চিনতে মেয়েটাকে পারল না শ্যাড়ো। কিন্তু মেয়েটা যখন বলল, ‘কোন ধরনের আর কোন স্বাদের দই চেয়েছিলে সেটা বুঝতে পারিনি, তাই নিজের মতো করে একটা এনেছি। ঠিক সেই মুহূর্তে মেয়েটাকে চিনতে পারল ও, কায়রো যাবার পথে একেই লিফট দিয়েছিল গাড়িতে। 

‘অসুবিধা নেই,’ বলল মার্গারিতা। ‘স্যাম, আমার প্রতিবেশীর সাথে পরিচিত হও, ইনি মাইক আইনসেল। আর মাইক, এ সামান্থা ব্ল্যাক ক্রো, আমার বোন।’ 

আমি তোমাকে চিনি না, মরিয়া হয়ে ভাবল শ্যাডো। তোমার সাথে আমার আগে কখনও দেখা হয়নি। আমরা একে-অন্যের অপরিচিত। একবার কেবল ভেবে ভেবেই তুষারপাত ঘটিয়েছিল ও, তাই চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি? হাত বাড়িয়ে বলল, ‘পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।’ 

চোখ পিটপিট করে ওর দিকে তাকাল মেয়েটা। এক মুহূর্ত বিভ্রান্তির পর, পরিচিতির আবহ খেলে গেল ওর চোখে, মুখে হালকা হাসি নিয়ে বলল, ‘হ্যালো।’ 

‘খাবার তৈরি কি না দেখে আসি,’ বলল মার্গারিতা। 

কোট-হ্যাট খুলে ফেলল স্যাম। ‘তুমিই তাহলে সেই রহস্যময় প্রতিবেশী? কে ভেবেছিল!’ নিচু গলায় বলল ও। 

‘আর তুমি হচ্ছে,’ উত্তরে বলল শ্যাডো। ‘মেয়ে-স্যাম। আমরা কি এসব নিয়ে পরে কথা বলতে পারি?’ 

‘কী হচ্ছে এখানে, তা যদি জানাও তো আমার আপত্তি নেই।’ 

‘জানবে।’ 

শ্যাডোর প্যান্ট ধরে টান দিল লিয়োন। ‘এখন দেখাবে?’ কোয়ার্টারটা তুলে ধরে জানতে চাইল বাচ্চাটা। 

‘ঠিক আছে,’ বলল শ্যাডো। ‘তবে মনে রাখবে, জাদুকর কিন্তু জাদুর রহস্য আর কাউকে বলে না। তুমিও বলতে পারবে না।’ 

‘করলাম প্রতিজ্ঞা।’ আর তর সইছে না লিয়োনের। 

পয়সাটা বাঁ হাতে নিলো শ্যাডো, এরপর বাচ্চাটার ডান হাত নাড়াল। কীভাবে পয়সাটাকে জায়গামতো রেখে হাত পরিবর্তন করার ভান করা যায়, শেখাল তাই। এরপর কয়েকবার লিয়োনকে দিয়ে পুনরাবৃত্তি করালো। 

বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর, সফল হলো ছেলেটা। ‘অর্ধেক শিখলে,’ বলল শ্যাডো। ‘বাকি অর্ধেক বলি এখন। পয়সাটা কোথায় থাকা উচিত, সেদিকে মনোযোগ দেবে এরপর। যেখানে থাকা উচিত, সেখানে আছে বলে মনে করবে। যদি এমন ভান করো যে পয়সাটা তোমার ডান হাতে, তাহলে কেউ তোমার বাঁ হাতের দিকে ভুলেও তাকাবে না।’ 

এক দিকে মাথা কাত করে সব দেখল স্যাম, বলল না কিছু। 

‘খাবার তৈরি!’ রান্নাঘর থেকে ধোঁয়া-ওঠা স্প্যাগেটির বাটি নিয়ে বেরোতে বেরোতে বলল মার্গারিতা। ‘লিয়োন, হাত ধুয়ে এসো।’ 

গার্লিক ব্রেড, ঘন সস আর রসালো মিটবলও ছিল টেবিলে। খেতে খেতে প্রশংসা করল শ্যাডো। 

‘পারিবারিক রেসিপি। পরিবারের কর্সিকান দিকটা থেকে পেয়েছি।’ 

‘আমি তো জানতাম, তোমরা নেটিভ আমেরিকান!’ 

‘বাবা চেরোকি,’ বলল স্যাম। ‘ম্যাগসের নানা কর্সিকা থেকে এসেছে। ম্যাগসের বয়স যখন দশ, তখন ওর মাকে পরিত্যাগ করে বাবা। এর ছয় মাস পর আমি জন্মাই। ডিভোর্সটা আনুষ্ঠানিক মর্যাদা পেলে বিয়ে করে আমার বাবা- মা। আমার বয়স যখন দশ, তখন সে আমাদেরকেও ছেড়ে চলে যায়। এখন তো মনে হচ্ছে, বাবার দশ বছরের বেশি মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতা নেই।’ 

‘ওকলাহোমায় আছে এখন, তা-ও দশ বছর হয়ে গেছে মনে হয়।’ বলল মার্গারিতা। 

‘আমার নানার পরিবার ইহুদি, ইউরোপ থেকে আগত।’ বলে চলছে স্যাম। ‘দেশটা সম্ভবত আগে কমিউনিস্ট ছিল, এখন সেখানে অরাজকতা। আমার ধারণা, চেরোকির বউ হবার খুব ইচ্ছা ছিল আমার মার।’ ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিল সে। ‘স্যামের মা অন্যরকম মহিলা। কিছুটা অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয়।’ মার্গারিতার কণ্ঠে বিরাগ। 

‘এখন কোথায় আছে, জানো?’ জিজ্ঞেস করল স্যাম। মাথা নাড়ল শ্যাডো। ‘অস্ট্রেলিয়ায়। ইন্টারনেটে এক পুরুষের সাথে পরিচয় হয়েছে, হোবার্টে থাকে। সামনা সামনি যখন প্রথম দেখা হলো, তখন লোকটাকে কেমন কেমন মনে হয়েছিল মার। কিন্তু তাসমানিয়াতে থাকার আগ্রহ পেয়ে বসেছিল ওকে। তাই এখন ওখানেই বাস করছে। বাটিকের জামা না কী সব শেখাচ্ছে ওখানকার মেয়েদের। তা-ও আবার এই বয়সে! দারুণ না?’ 

আসলেই দারুণ, একমত হলো শ্যাডো। প্লেটে তুলে নিলো আরও কিছু মিটবল। তাসমানিয়ার আদি নিবাসীদেরকে যে ব্রিটিশরা বিলুপ্ত করে দিয়েছে, সেটা ওদেরকে জানাল স্যাম। শেষের দিকে এসে সবাই মিলে ঘিরে ধরেছিল জায়গাটা, কিন্তু পেয়েছিল কেবল এক বৃদ্ধ আর এক অসুস্থ ছেলেকে। তাসমানিয়ার ব্যাপারে আরও অনেক কিছু বলল ও-কীভাবে ওখানকার কৃষকেরা থাইলাসিনস, মানে তাসমানিয়ান বাঘকে দেখা মাত্র খুন করত! ১৯৩০ সালের দিকে যখন রাজনীতিবিদরা থালাসিনসদের বাঁচাবার জন্য পদক্ষেপ নিলেন, ততদিনে ওগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বলতে বলতে দুই গ্লাস ওয়াইন শেষ করে ফেলেছে স্যাম, এবার তিন নম্বর গ্লাসে চুমুক দিল। 

‘তা, মাইক,’ আচমকা বলল স্যাম, লজ্জায় গাল লাল হয়ে গেছে। ‘তোমার পরিবারের সম্পর্কে কিছু বলো। আইনসেলরা কেমন?’ মুখে দুষ্টামির হাসি দেখে গেল তার। 

‘আমরা পরিবার হিসেবে বিরক্তিকর।’ বলল শ্যাডো। ‘আমাদের কেউ এখন পর্যন্ত তাসমানিয়ায় যায়নি। তুমি ম্যাডিসনের স্কুলে পড়ো? জায়গাটা কেমন?’ 

‘আলাদা কিছু না। ইতিহাস পড়ছি আর তামা দিয়ে টুকি-টাকি জিনিস বানানো শিখছি।’ 

‘আমি বড়ো হলে,’ বলল লিয়োন। ‘জাদু নিয়ে পড়ব। পুফ। আমাকে শেখাবে, মাইক আইনসেল?’ 

‘অবশ্যই, তবে তোমার আম্মুর অনুমতি লাগবে।’ 

‘ম্যাগস,’ আচমকা মুখ খুলল স্যাম। ‘খাওয়া শেষে মাইককে নিয়ে একটু বারে যাবো। এই ঘণ্টা দুয়েক থাকব বড়োজোর।’

কেবল শ্রাগ করল মার্গারিতা, সেই সাথে একটা ভ্রু ওপরে উঠল একটু।

‘আমার কাছে ওকে রহস্যময় মনে হচ্ছে,’ বলল স্যাম। ‘কিছু কথা বলতে চাই।’ 

শ্যাডোর দিকে তাকাল মার্গারিতা, ও তখন চিবুক থেকে কাল্পনিক সস মোছার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। ‘তোমরা দুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক,’ এমন ভঙ্গিতে বলল মেয়েটা যেন তা না হলেই সে খুশি হতো। 

ডিনার শেষে থালা-বাসন ধোয়ার কাজে স্যামকে সাহায্য করল শ্যাডো। এরপর লিয়োনকে শেখাল পয়সার একটা খেলা। অবাক হয়ে খেলা দেখল বাচ্চাটা। তারপর মাকে জিজ্ঞেস করতে থাকল, ‘কাজটা করল কীভাবে, আম্মু? কীভাবে করল?’ 

শ্যাডোর দিকে ওর কোট বাড়িয়ে ধরল স্যাম। ‘চলো, যাই।’ তিন গ্লাস ওয়াইনের প্রভাবে মেয়েটার গাল লাল হয়ে গেছে। 

বেশ ঠান্ডা বাইরে। 

বেরোবার আগে ঘরের ভেতর থেকে দ্য মিনিটস অভ দ্য লেকসাইড সিটি কাউন্সিলের বইটা নিয়ে এলো শ্যাডো। হিনজেলমান বারে থাকলেও থাকতে পারেন, বৃদ্ধকে তার দাদার ব্যাপারে লেখাটা দেখাতে চায় ও। 

পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করল দুজন। 

গ্যারেজের দরজা খুলল যুবক, সাথে সাথে হাসিতে ফেটে পড়ল স্যাম। ‘হায়, ঈশ্বর!’ ফোররানারটাকে দেখা মাত্র বলল সে। ‘পল গুন্থারের গাড়ি। তুমি পলের গাড়ি কিনেছ! 

গাড়ির দরজা খুলে ধরল শ্যাডো, এরপর ড্রাইভারের সিটে বসে বলল, ‘গাড়িটা পরিচিত নাকি?’ 

‘বছর দুয়েক আগে ম্যাগসের সাথে থাকতে এসেছিলাম, তখন আমার জোরাজুরিতেই গাড়িটাকে বেগুনি রং করা হয়।’ 

‘ভালো,’ বলল শ্যাডো। ‘দোষ দেবার জন্য একজনকে পাওয়া গেল।’ 

রাস্তায় গাড়িটা নামাল শ্যাডো, এরপর উঠে দাঁড়িয়ে বন্ধ করল গ্যারেজের দরজা। যখন আবার ফিরে এলো, তখন স্যামের চোখে অদ্ভুত একটা দৃষ্টি দেখতে পেল ও। মেয়েটার আত্মবিশ্বাসের ফানুসে যেন ছিদ্র হয়েছে, আস্তে আস্তে চুপসে যাচ্ছে সে। কিছুক্ষণের চেষ্টায় নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে জানতে চাইল। ‘কাজটা একেবারে বোকার মতো হয়ে যাচ্ছে, তাই না? এক বদ্ধ উন্মাদ, খুনির সাথে গাড়িতে উঠে বসেছি!’ 

‘গতবার কিন্তু নিরাপদেই বাড়িতে ফিরেছিলে।’ 

‘দুইজন মানুষকে খুন করেছ তুমি,’ বলল স্যাম। ‘এফবিআই তোমাকে খুঁজছে। ছদ্মনাম নিয়ে আমারই বোনের পাশের অ্যাপার্টমেন্টে আস্তানা গেঁড়েছ! নাকি মাইক আইনসেল তোমার আসল নাম?’ 

‘না,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল শ্যাডো। ‘আমার আসল নাম না।’ অস্বস্তিবোধ হলো কথা বলতে, মনে হলো মাইক আইনসেলকে অস্বীকার করা মানে নিজেকেই অস্বীকার করা। 

‘তুমি ওই দুজনকে খুন করেছ?’ 

‘না।’ 

‘আমার বাড়িতে এসেছিল লোকগুলো, বলল যে আমাদেরকে একসাথে দেখে গেছে। তোমার একটা ছবিও দেখিয়েছিল আমাকে। কী যেন নাম ছিল লোকটার…মি. হ্যাট? নাহ, মিস্টার টাউন। ঠিক যেন দ্য ফিউজিটিভ ছবির স্ক্রিপ্ট। কিন্তু আমি বলেছি, তোমাকে চিনি না।’ 

‘ধন্যবাদ।’ 

‘তাহলে সবকিছু খুলে বলো। তুমি আমার কথা গোপন রাখলে, আমিও তোমার কথা গোপন রাখব।’ 

‘আমি তো তোমার একটা গোপন কথাও জানি না,’ বলল শ্যাডো। 

‘তুমি তো জানো যে আমার কথা শুনেই গাড়িটার এই হাল হয়েছে। ফলশ্রুতিতে পল গুন্থারকে আশপাশের কয়েক কাউন্টির হাস্যাস্পদে পরিণত হতে হয়েছে। বাধ্য হয়ে শহর ছেড়েই চলে গেছে বেচারা। আসলে আমরা মাতাল ছিলাম তখন।’ 

‘আমার মনে হয় না ব্যাপারটা খুব একটা গোপন আছে,’ বলল শ্যাডো। ‘মাতাল না হলে কেউ নিজের গাড়ির গায়ে এই রকম বেগুনি রং চড়ায় না।’ 

নিচু কিন্তু দ্রুত কণ্ঠে বলে উঠল স্যাম। ‘যদি আমাকে খুন করতেই চাও, তাহলে দয়া করে ব্যথা দিয়ো না। আমার আসলে তোমার সাথে আসা উচিত হয়নি। বোকা, একেবারে হদ্দ বোকা আমি। চাইলেই তোমাকে ধরিয়ে দিতে পারি! হায় যিশু!’ 

দীর্ঘশ্বাস ফেলল শ্যাডো। ‘আমি এই জীবনে কখনও কাউকে খুন করিনি। তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি বারে,’ বলল ও। ‘সেখানে কয়েকটা বিয়ার খাবো। যদি কথা দাও পুলিসকে বলবে না, তাহলে খুশি মনে ফিরিয়ে নিয়ে যাব বাড়িতে। আর নইলে অখুশি মনে। তবে বাড়ি তুমি ফিরবে।’ 

ব্রিজ পার হবার সময় নীরব রইল দুজনেই। 

‘তাহলে কে খুন করেছে লোকগুলোকে?’ জানতে চাইল স্যাম। 

‘বলতে পারি, কিন্তু বিশ্বাস করবে না।’ 

‘করবো,’ রাগান্বিত মনে হলো মেয়েটাকে। ওয়াইন আনাটা ঠিক হয়নি বলেই এখন মনে হচ্ছে শ্যাডোর। 

‘বিশ্বাস না করলেও দোষ দেব না।’ 

‘আমি,’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল স্যাম। ‘যেকোনো কিছু বিশ্বাস করতে পারি। তোমার কোনো ধারণাই নেই।’ 

‘তাই?’ 

‘আমি বিশ্বাস করতে পারি সত্যকে; আবার যেগুলো বানানো, সেগুলো বিশ্বাস করতেও আমার আপত্তি নেই। যেসব সত্য না মিথ্যা তা কেউ জানে না, ওগুলোকেও বিশ্বাস করি। সান্তা ক্লজ, ইস্টার বানি, মেরিলিন মনরো, দ্য বিটলস, এলভিস-সবার ওপরেই বিশ্বাস আছে আমার। আমার বিশ্বাস, মানুষকে নিখুঁত করা সম্ভব, জ্ঞানের কোনো সীমা নেই, দুনিয়া পরিচালনা করে গোপন কিছু সংঘ, মাঝে মাঝে ভিনগ্রহের অধিবাসীরা আসে আমাদের এখানে। ওদের মাঝে যারা ভালো, তারা লেমুরের মতো দেখতে। আর যারা খারাপ, তারা আমাদের পশুপালকে হত্যা করে, আমাদের পানি আর মেয়েমানুষকে ধরে নিয়ে যেতে চায়। আমার বিশ্বাস: ভবিষ্যৎ অন্ধকার, আমার বিশ্বাস: ভবিষ্যৎ চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল। আমি বিশ্বাস করি, একদিন সাদা মহিষ-মানবী ফিরে এসে সবাইকে শায়েস্তা করবে। ছেলেদেরকে যদি কেবল আকারে বড়ো হওয়া বাচ্চা বলো—তাও আমি বিশ্বাস করব। বিশ্বাস করব যদি বলো রাজনীতিবিদরা নীতিবিহীন চোর ছাড়া আর কিছুই না। আবার এ-ও বিশ্বাস করব যে ওদেরকে সরালে যারা আসবে, তারা আরও খারাপ। আমি বিশ্বাস করি, শেষ বন্যাটা যখন শুরু হবে, তখন ক্যালিফোর্নিয়া ডুবে যাবে পানির তলে। তখন ফ্লোরিডার উপর ভর করবে পাগলামি আর ওটার রাস্তায় রাস্তায় দেখা যাবে অ্যালিগেটর আর বিষাক্ত আবর্জনা 1 আমার বিশ্বাস, অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল সাবান আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে, তাই একদিন সাধারণ ঠান্ডা লেগেই সবাই মারা যাবো-যেমনটা মারা গেছিল ওয়ার অভ দ্য ওয়ার্ল্ডসের ভিনগ্রহের প্রাণিরা। আমি বিশ্বাস করি, গত শতাব্দীর সেরা কবি হলেন এডিথ সিটওয়েল আর ডন মার্কুই। জেড পাথর যে আসলে ড্রাগনের জমাট বাঁধা বীর্য, সেটা বিশ্বাস করতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কেউ যদি বলে, হাজার বছর আগের কোনো এক পূর্ব জীবনে আমি ছিলাম একহাতি একজন সাইবেরিয়ান শামান, তাহলে সেটা মেনে নিতে আমার আপত্তি নেই। মানবজাতির ভবিষ্যৎ তারকালোকে-এ কথা আমি বিশ্বাস করি। বিশ্বাস করি, ছোটোবেলায় ক্যান্ডির স্বাদ অনেক বেশি ভালো লাগত। আলো একই সাথে তরঙ্গ আর কণা…বিশ্বাস করি। কোথাও কোনো একটা বাক্সে একটা বিড়াল একই সাথে জীবিত আর মৃত…বিশ্বাস করি (তবে যদি অতিসত্বর কেউ বেচারাকে খেতে না দেয়, তাহলে দুইভাবেই বেচারা মৃত হবে)। আমার বিশ্বাস: নিজস্ব এক ঈশ্বর আছে আমার, যে শুধু আমাকে নিয়েই ভাবে আর আমার ভালাই দেখে। আবার এমন এক বৈশ্বিক ঈশ্বরের অস্তিত্বে আমি বিশ্বাস করি, যে মহাবিশ্ব বানিয়ে উধাও হয়ে গেছে। আমি যে আছি, সেটাই হয়তো খেয়াল নেই তার। আমি বিশ্বাস করি ঈশ্বর-বিহীন এক বিশ্বে, যেখানে রাজত্ব কেবল বিশৃঙ্খলার। বাকি সব কিছু যেখানে মৌমাছির গুঞ্জনের মতো তুচ্ছ। আমি বিশ্বাস করি পরম সততায় আর ক্ষতিহীন মিথ্যায়। আমি বিশ্বাস করি, মেয়েদের নিজের মতো করে বেছে নেবার অধিকার আছে, বাচ্চার আছে বাঁচার অধিকার। মানব জীবনের চাইতে দামি কিছু হয় না, তবে কর্তৃপক্ষের উপর ভরসা রাখতে পারলে দরকার আছে মৃত্যুদণ্ডেরও। তবে আমার বিশ্বাস, বোকার হদ্দও সেই ভরসা করতে পারে না। বিশ্বাস করি, জীবন আসলে এক খেলা; বিশ্বাস করি, জীবন একটা জঘন্য ঠাট্টা; বিশ্বাস করি, জীবনকে উপভোগ করাই জীবনের মূলমন্ত্র।’ অবশেষে থামল মেয়েটা, দম ফুরিয়ে গেছে। 

আরেকটু হলেই হাততালি দেবার জন্য স্টিয়ারিং হুইল থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছিল শ্যাডো। বদলে বলল, ‘ঠিক আছে। তাহলে আশা করি পুরোটা শুনেও আমাকে উন্মাদ ভাববে না।’ 

‘আগে বলো তো।’

‘যদি বলি, দুনিয়াতে আমরা যত দেবতাকে কল্পনা করেছি তাদের সবার অস্তিত্ব আছে, তাহলে বিশ্বাস করবে?’ 

‘…হয়তো।’ 

‘সেই সাথে যোগ দিয়েছে নতুন কিছু দেবতা-কম্পিউটার আর টেলিফোনের দেবতা টাইপ। এদের ধারণা, এক বনে দুই বাঘ থাকা মানায় না। তাই সামনে যুদ্ধ আসছে।’ 

‘এই দেবতারা ওই দুজনকে খুন করেছে?’ 

‘নাহ, আমার স্ত্রী করেছে।’ 

‘তুমি না বললে যে তোমার স্ত্রী মৃত!’ 

‘হ্যাঁ।’ 

‘তাহলে কি মারা যাবার আগে খুন করেছে?’ 

‘নাহ, পরে। বিস্তারিত জানতে চেয়ো না।’ 

হাত তুলে কপালের উপর থেকে চুল সরাল স্যাম। 

মেইন স্ট্রিটে উঠে এলো ওরা, কিছুক্ষণের মাঝে পৌঁছে গেল বারে। গাড়ি থেকে নামল দুজনেই। 

‘যুদ্ধ হবে কেন?’ জানতে চাইল স্যাম। ‘অহেতুক মনে হচ্ছে না ব্যাপারটা? যুদ্ধে জিতে কার কী লাভ হবে?’ 

‘আমি জানি না।’ বলল শ্যাডো। 

‘দেবতাদের উপর বিশ্বাস রাখার চাইতে ভিনগ্রহ বাসীদের উপর বিশ্বাস রাখা সহজ। হয়তো মিস্টার টাউন আর মিস্টার ছাতা-মাতা-কিছু একটা আসলে ভিনগ্রহবাসী! 

বারের ঠিক সামনের ফুটপাতে এসে থমকে দাঁড়াল স্যাম। শ্যাডোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কেবল এতটুকু বলো যে তুমি ভালোদের পক্ষে।’ 

‘পারলে বলতাম,’ বলল শ্যাডো। ‘কিন্তু তা সম্ভব না। তবে আমি চেষ্টা করছি।’ 

ওর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে ধরল স্যাম। ‘চলবে, তোমাকে ধরিয়ে দেব না আমি। তবে বিনিময়ে আমাকে বিয়ার কিনে দিতে হবে।’ 

বারের দরজা খুলে ধরল শ্যাডো, সাথে সাথে গরম আর সুরের একটা দমকা হাওয়া যেন ধাক্কা দিল ওকে। ভেতরে পা রাখল দুজন। 

পরিচিত মুখ দেখে মাথা দোলাল শ্যাডো, স্যাম নাড়ল কয়েকজন বন্ধুকে উদ্দেশ করে। বারকিপের কাছে দাঁড়িয়ে আছে চ্যাড মুলিগান, হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরেছে লাল-চুলো এক মেয়ের কাঁধ। এই মহিলার কথাই বলেছিল, বুঝতে পারল ও। মেয়েটার চেহারা এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না, ওর দিকে পিঠ দিয়ে আছে। তবে চ্যাড দেখতে পেল শ্যাডোকে, স্যালুট ঠুকল একটা। মুচকি হাসল সে, হাত নাড়ল চিফের দিকে। হিনজেলমানের খোঁজে চারপাশে তাকাল শ্যাডো, কিন্তু পেল না লোকটাকে। পেছন দিয়ে একটা ফাঁকা টেবিল দেখে সেদিকে রওনা দিল। 

ঠিক মুহূর্তেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল কেউ একজন। 

চিৎকার গা শিহরানো, নিজের চোখে ভূত দেখলেই কেবল এমন চিৎকার করতে পারে কেউ। চুপ হয়ে গেল সবাই। ঘুরে দাঁড়াল শ্যাডো, কেউ খুন হয়েছে নিশ্চয়ই! কিন্তু উপলব্ধি করতে পারল, সবাই এক দৃষ্টিতে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। এমনকি জানালার পাশে দিনের বেলায় যে বিড়ালটা ঘুমিয়ে থাকে, সেটাও দাঁড়িয়ে পড়েছে…তাকিয়ে আছে ওরই দিকে। 

সময় যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। 

‘ওকে ধরো!’ হিস্টিরিয়াগ্রস্ত এক মহিলা কণ্ঠ বলে উঠল। ‘ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে বলছি, কেউ ওকে ধরো! পালাতে দিয়ো না! প্লিজ!’ কণ্ঠটা পরিচিত মনে হলো তার। 

এক বিন্দু নড়ল না কেউ, কেবল তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টিতে। নড়ল না শ্যাডোও। 

লোকজন সরিয়ে সামনে এগিয়ে এলো চ্যাড মুলিগান, মেয়েটা তার পেছনেই। চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে আছে, যেকোনো মুহূর্তে আবার চিৎকার করতে শুরু করবে। একে চেনে শ্যাডো। খুব ভালো করেই চেনে। 

হাতে বিয়ারের বোতল ধরে আছে চ্যাড, সেটা একটা টেবিলের উপর রেখে দিল। ‘মাইক।’ 

‘চ্যাড।’ 

অড্রি বার্টন আঁকড়ে ধরল চ্যাডের শার্টের হাতা। মেয়েটার চেহারা সাদা হয়ে গেছে, চোখে দেখা যাচ্ছে অশ্রু। ‘শ্যাডো,’ বলল সে। ‘হারামজাদা, খুনি!’ 

‘একে চেনো তুমি?’ জানতে চাইল চ্যাড, অস্বস্তি খেলা করছে চোখে-মুখে। মুখ খুলল অড্রি বার্টন। ‘চিনি মানে! রবির হয়ে অনেকদিন কাজ করেছে এ। ওর ছিনাল স্ত্রী আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল। শ্যাডো জেল খাটা কয়েদি, খুনের অভিযোগ কর্তৃপক্ষ ওকে খুঁজছে।’ কেঁপে কেঁপে উঠছে মেয়েটার গলা, জোর করে যেন হিস্টিরিয়াকে আটকে রাখছে সে। কিন্তু কান্নার ফাঁকে ফাঁকে ঠিক বলছে কথা। 

বারের কেউ একটা শব্দও উচ্চারণ করছে না। চ্যাড মুলিগান চোখ তুলে শ্যাডোর দিকে তাকাল। ‘তোমার ভুল হচ্ছে সম্ভবত। সমস্যা নেই, ঝামেলা মিটে যাবে আশা করি,’ বারের দিকে তাকাল ও। ‘সব ঠিক আছে, চিন্তা করার মতো কিছু নেই।’ এরপর শ্যাডোর দিকে ফিরল সে। ‘বাইরে চলো, মাইক।’ লোকটার পেশাদারিত্বে মুগ্ধ না হয়ে পারল না ও। 

‘অবশ্যই।’ 

ঘুরে দাঁড়াতে যাবে, এমন সময় হাতে নরম একটা স্পর্শ পেল শ্যাডো। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখে, স্যাম ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নির্ভরতার হাসি হেসে মেয়েটাকে শান্ত করার প্রয়াস পেল সে। 

শ্যাডোর দিকে একবার তাকাল মেয়েটা, তারপর তাকাল উপস্থিত সবার দিকে। সবার মনোযোগ ওদের দিকেই। অড্রি বার্টনকে উদ্দেশ করে বলল সে। ‘তুমি কে, তা আমি জানি না। তবে বলি, তুমি একটা হারামজাদী।’ আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে, শ্যাডোকে নিজের দিকে টেনে আনল সে। এরপর চুমু খেলে প্রচণ্ড তীব্রতায়। শ্যাডোর মনে হলো, কয়েক মিনিট ধরে চুমু খাচ্ছে যেন। তবে প্রকৃতপক্ষে সময়টা পাঁচ সেকেন্ড হলেও অবাক হবার কিছু নেই। 

বেশ অদ্ভুত ছিল চুমুটা। ঠোঁটে ঠোঁট লাগানো চুমু কেবল, তবে ওটার উদ্দেশ্য শ্যাডোর প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন নয়। বারের অন্যান্যদের বোঝাবার জন্য ছিল চুমুটা-স্যাম তার পক্ষ বেছে নিয়েছে। মেয়েটা যে ওকে ভালোবাসে না, সেটা পরিষ্কার। 

তবে অনেক অনেক আগে, একটা গল্প পড়েছিল শ্যাডো। তখন একদম বাচ্চা ছিল ও: গল্পটা এক অভিযাত্রীর। বেচারা পাহাড়ের চূড়া থেকে পড়ে গেছে। ওপরে ওর জন্য অপেক্ষা করছে নরখেকো বাঘ, নিচে অতল খাদ। পড়তে পড়তে কোনোক্রমে পাহাড়ের খাঁজ আঁকড়ে ধরে নিজেকে সামলাল লোকটা। পাশেই ঝুলছে স্ট্রবেরি, ওপরে মৃত্যু। মৃত্যু নিচেও। কী করা উচিত এখন লোকটার? এখন প্রশ্ন সেটাই। 

উত্তরটা হলো: স্ট্রবেরি খাওয়া। 

ছোটোবেলায় গল্পটার অর্থ বুঝতে কষ্ট হয়েছিল শ্যাডোর, কিন্তু এখন পরিষ্কার বুঝতে পারছে। তাই চোখ বন্ধ করে চুমুর মাঝে ডুবিয়ে দিল নিজেকে। বুনো স্ট্রবেরির স্বাদ নিচ্ছে যেন। 

‘চলো, মাইক। জোরাল কণ্ঠে বলল চ্যাড মুলিগান। ‘চলো, বাইরে যাই।’

পিছিয়ে এলো স্যাম, জিহ্বা দিয়ে চাটল ঠোঁট। হাসল একটু, হাসিটা আরেকটু হলেই যেন চোখে পৌঁছাত। ‘খারাপ না,’ বলল সে। ‘ছেলে হিসেবে একদম মন্দ নয়। যাও, বাইরে খেলতে যাও,’ বলে অড্রি বার্টনের দিকে তাকাল সে। ‘তবে তুমি হারামজাদী, হারামজাদীই আছ।’ 

স্যামের দিকে চাবি ছুড়ে দিল শ্যাডো, একহাতে লুফে নিলো মেয়েটা। বারের দরজা দিয়ে বাইরে বেরোল সে, পিছু পিছু বেরোল চ্যাড মুলিগান। হালকা তুষারপাত শুরু হয়েছে। ‘কিছু বলবে?’ জানতে চাইল চ্যাড। 

অড্রিও ওদের পেছন পেছন বাইরে এসেছে। ওকে দেখা মনে হচ্ছে যেন আবার চিৎকার করতে শুরু করবে। বলল, ‘ওই লোকটা দুজন মানুষকে খুন করেছে, চ্যাড। এফবিআই ওর খোঁজে আমার বাড়িতে এসেছিল। লোকটা উন্মাদ। চাইলে তোমার সাথে স্টেশনে আসতে পারি।’ 

‘তুমি যথেষ্ট ঝামেলা করেছ, ম্যাম,’ বলল শ্যাডো, নিজের কাছেই কণ্ঠটা ক্লান্ত বলে মনে হলো। ‘দয়া করে এবার বিদায় হও।’ 

‘চ্যাড, শুনেছ? আমাকে হুমকি দিয়েছে!’ বলল অড্রি। 

‘ভেতরে যাও, অড্রি,’ বলল চ্যাড। মনে হচ্ছিল, মেয়েটা বোধহয় তর্ক করবে। কিন্তু না, নিজেকে সামলে নিয়ে বারের ভেতরে ছিলে গেল সে। 

‘এবার কিছু বলবে?’ জানতে চাইল চ্যাড। 

‘আমি কাউকে খুন করিনি।’ 

মাথা দোলাল চ্যাড। ‘আমি তোমাকে বিশ্বাস করি।’ বলল সে। ‘আশা করি এইসব অভিযোগ ধোপে টিকবে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তুমি কি ঝামেলা করবে, মাইক?’ 

‘একদম না।’ বলল শ্যাডো। ‘ভুল হচ্ছে কোথাও।’ 

‘ঠিক,’ বলল চ্যাড। ‘তাহলে চলো, অফিসে গিয়ে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলি।’

‘আমাকে কি গ্রেফতার করা হয়েছে?’ জানতে চাইল সে। 

‘না,’ উত্তর দিল চিফ। ‘তুমি ঝামেলা না করলে গ্রেফতার করার কারণও নেই।’ 

শ্যাডোর দেহে হাত বুলালো চ্যাড, কোনো অস্ত্র পেল না। এগিয়ে গিয়ে মুলিগানের গাড়ি বসল ওর দুজন। পেছনের সিটে বসে গরাদের ভেতর দিয়ে বাইরে তাকাল শ্যাডো। সাহায্য, এসওএস, মুলিগানকে প্রভাবিত করতে চাইল ও; যেমনটা করেছিল শিকাগোর এক পুলিসকে। তোমার বন্ধু মাইক আইনসেল বসে আছে পেছনে। এই লোকের জান বাঁচিয়েছ তুমি। কেমন বোকার মতো কাজ হয়ে যাচ্ছে না? পুরোটা ভুলে গেলেই ভালো হয়। 

‘তোমাকে ওখান থেকে বের করে আনা দরকার ছিল।’ বলল চ্যাড। ‘কোনো বলদ যদি একবার খালি মুখ ফসকে বলে ফেলত যে তুমি অ্যালিসন ম্যাকগভার্নের খুনি, তাহলে আর দেখতে হতো না। লোকজন উত্তেজিত হয়ে হয়তো তোমাকেই ঝুলিয়ে বসত!’ 

যুক্তি আছে তোমার কথায়।’ 

লেকসাইড পুলিস অফিসে পৌঁছাবার আগে আর কোনো বাক্য বিনিময় হলো না ওদের মাঝে। গাড়ি থেকে নামার সময় চ্যাড জানাল, জায়গাটা আসলে কাউন্টি শেরিফের ডিপার্টমেন্টের সম্পত্তি। স্থানীয় পুলিস কোনোরকমে কাজ চালিয়ে নেয়। অতিসত্বর নতুন একটা দালান দেওয়া হবে ওদেরকে। 

ভেতরে পার রাখল ওরা। 

‘উকিল ডাকব?’ জানতে চাইল শ্যাডো। 

‘তোমাকে কোনো কিছুর জন্য অভিযুক্ত করা হয়নি,’ বলল মুলিগান। ‘তাই তোমার ইচ্ছা,’ একটা চেয়ার দেখাল সে। ‘ওখানে বসো।’ 

দেখানো কাঠের চেয়ারে বসল শ্যাডো। নিজেকে বোকা আর অবশ বলে মনে হচ্ছে। নোটিশ বোর্ডে কয়েকটা ছোটো ছোটো পোস্টার ঝোলানো আছে। ‘নিরুদ্দেশ’ লেখা আছে ওপরে, পোস্টারের ছবিটা অ্যালিস ম্যাকগভার্নের। 

কাঠের একটা টেবিলের উপর স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড আর নিউজউইকের পুরনো কপি পড়ে আছে। আলোও নেই বেশি। দেয়ালটা হলদে রং করা, তবে এককালে সেটা সাদা হলেও হতে পারত। 

মিনিট দশেক পর, ভেন্ডিং মেশিন থেকে এক কাপ গরম চকলেট এনে দিল চ্যাড। শ্যাডোর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘ব্যাগে কী?’ প্রথমে বুঝতে পারল না যুবক প্রশ্নটা। পরে উপলব্ধি করল, এখন হাতে দ্য মিনিটস অভ লেকসাইড সিটি কাউন্সিল বইটা ধরে আছে। 

‘পুরাতন একটা বই,’ উত্তর দিল ও। ‘তোমার দাদার ছবিও আছে। পরদাদাও হতে পারে অবশ্য। 

‘তাই নাকি?’ 

টাউন কাউন্সিলের ছবিটা বের করে দেখাল শ্যাডো। মুচকি হাসল চ্যাড। 

আস্তে আস্তে পার হতে লাগল সময়, সেকেন্ড পরিণত হলো মিনিটে। মিনিট ঘণ্টায়। দুটো স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড পড়া শেষ করে নিউজউইক হাতে নিলো। মাঝে মাঝে এসে চ্যাড দেখে যাচ্ছে, জানতে চাইছে—বাথরুমে যাবার প্রয়োজন আছে কি না। একবার তো হ্যাম রোল আর পটেটো চিপসও এগিয়ে দিল। 

‘ধন্যবাদ,’ জিনিস দুটো হাতে নিয়ে বলল শ্যাডো। ‘গ্রেফতার হয়েছি না হইনি?’ 

মুখ দিয়ে শ্বাস টানল চ্যাড। ‘এখনও না,’ বলল সে। ‘তবে সম্ভবত তোমার নাম আইনানুগ ভাবে মাইক আইনসেলে পরিবর্তন করা হয়নি। প্রতারণা না করা হলে, ভিন্ন নাম ব্যবহার করা আমাদের এই স্টেটে শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়। একটু ধৈর্য ধরো। 

‘আমি কি একটা ফোন করতে পারি?’ 

‘লোকাল কল?’ 

‘নাহ, লং-ডিসট্যান্স।’ 

‘তাহলে আমার কলিং কার্ড ব্যবহার কর। নইলে কোয়ার্টার দিতে দিতে ফতুর হয়ে যাবে।’ 

হুম, তাই করি-ভাবল শ্যাডো। আর তুমি নম্বরটা জেনে যাও? আমার তো মনে হয়, এক্সটেনশন ব্যবহার করে শুনবে ও 

‘ভালোই হয় তাহলে,’ বলল ও। একটা ফাঁকা অফিস ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো শ্যাডোকে। কায়রো, ইলিনয়ের ফিউনারেল হোমের নম্বর দিল সে চ্যাডকে। ফোন ডায়াল করে ওর দিকে রিসিভার বাড়িয়ে চিফ বলল, ‘আমি বাইরে আছি।’ 

কয়েকবার রিং বাজার পর ওপাশ থেকে ফোন তোলা হলো। ‘জ্যাকুয়েল অ্যান্ড আইবিস থেকে বলছি। কী ভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’ 

‘হাই, মিস্টার আইবিস। আমি মাইক আইনসেল। কয়েকদিন তোমাদের ওখানে ছিলাম।’ 

একটু ইতস্তত করার পর জবাব এলো, ‘মনে পড়েছে। তা কেমন আছ, মাইক?’ 

‘খুব একটা ভালো না, মিস্টার আইবিস। একটু সমস্যায় আছি। গ্রেফতার হতে যাচ্ছি। আমার চাচাকে দেখলে একটা বার্তা পৌঁছে দিতে পারবে?’ 

‘অবশ্যই পারব, দাঁড়াও। মাইক, একজন তোমার সাথে কথা বলতে চায়।’ অন্য কেউ ধরল ফোন। এক আকর্ষণীয় মহিলা কণ্ঠ বলল, ‘হাই, সোনামণি। তোমাকে মিস করছি।’ 

কণ্ঠটা আগে কখনও শুনেছে বলে মনে হয় না। কিন্তু একে চেনে ও…অবশ্যই চেনে। 

ছেড়ে দাও, এবার শ্যাডোর মনের মাঝে যেন কথা বলে উঠল মেয়েটা। সবকিছু ছেড়ে দাও। 

‘কাকে চুমু খাচ্ছিলে, প্রিয়? আমাকে ঈর্ষাকাতর বানাতে চাচ্ছ নাকি?’ 

‘মেয়েটা আমার ভালো বন্ধু,’ উত্তর দিল শ্যাডো। ‘আমার ধারণা, কিছু একটা প্রমাণ করার জন্য আমাকে চুমু খেয়েছিল ও। ভালো কথা, ব্যাপারটা তুমি জানলে কী করে?’ 

‘আমার লোকেরা যেখানে তাকে, সেখানেই আমি থাকি,’ বলল ‘ মেয়েটা। ‘ভালো থেকে, সোনামণি…’ এক মুহূর্তের নীরবতার পর আবার মি. আইবিসের কণ্ঠ শোনা গেল। ‘মাইক?’ 

‘জি।’ 

‘তোমার চাচাকে খুঁজে পাচ্ছি না, ব্যস্ত মনে হয়। তবে তোমার আঙ্কেল, ন্যান্সির কাছে খবর পাঠিয়ে দিয়েছি। শুভকামনা রইল।’ বলে ফোন রেখে দিল লোকটা। 

চুপচাপ বসে রইল শ্যাডো, চ্যাডের আগমনের অপেক্ষায়। ফাঁকা অফিসটায় সময় কাটানো মুশকিল, মন অন্যদিকে নেবার মতো কিছু পেলে মন্দ হতো না। কিছুটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও দ্য মিনিটসটা আবার হাতে তুলে নিলো ও। আন্দাজে মাঝখানটা খুলে পড়তে শুরু করল। 

ফুটপাত আর সরকারি দালানে থুথু অথবা তামাক ফেলা বন্ধ করার জন্য ১৮৭৬ সালের ডিসেম্বরে একটা প্রজ্ঞাপন জারি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। লেমি হাউটালা বয়স সে বছর মাত্র বারো হয়েছিল। ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে উন্মাদনার বশবর্তী হয়ে’ বেচারি ১৩ ডিসেম্বর, ১৮৭৬ সালে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। ‘সাথে সাথে একটা সার্চ পার্টির আয়োজন করা হলেও, প্রচণ্ড তুষারপাতের জন্য সেই পার্টি খোঁজ চালাতে পারেনি।’ তাই সবার সম্মতিক্রমে, কাউন্সিলের পক্ষ থেকে হাউটালা পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। 

পরবর্তী সপ্তাহে ওলসেনদের স্টেবলে ধরা আগুন কোনো ধরনের সমস্যা ও হতাহতের ঘটনা ছাড়াই নিভিয়ে ফেলা সম্ভব হয়। 

মন দিয়ে পরবর্তী কয়েক পাতা পড়ল শ্যাডো, কিন্তু তাতে লেমি হাউটালার উল্লেখ খুঁজে পেল না। 

অনেকটা অবচেতন মনেই, ১৮৭৭ সালের শীত কালে চলে গেল শ্যাডো। জানুয়ারি মাসে পেয়ে গেল যেটা খুঁজছিল-জেসি লোভাট, বয়স অনুল্লিখিত, ‘এক নিগ্রো বাচ্চা’, ডিসেম্বর মাসের ২৮ তারিখে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ‘ভ্রাম্যমাণ অভিযাত্রীদের কেউ মেয়েটিকে কিডন্যাপ করেছে’। তবে লোভাট পরিবারের প্রতি সমবেদনা পাঠাবার কোনো উল্লেখ দেখা গেল না। 

১৮৭৮ সালের মিনিটগুলো দেখছে, এমন সময় চ্যাড মুলিগান নক করে ঘরে প্রবেশ করল। লোকটার চেহারায় কেমন একটা লজ্জা-লজ্জা ভাব, যেন একটা ছোটো বাচ্চা বাজে রিপোর্ট কার্ড দেখাতে এসেছে তার অভিভাবককে। 

‘মিস্টার আইনসেল,’ বলল সে। ‘মাইক, আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমি তোমাকে পছন্দই করি। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না, বুঝতে পেরেছ?’ 

মাথা নাড়ল শ্যাডো, বুঝতে পেরেছে। 

‘আমার করার কিছু নেই,’ বলল চ্যাড। ‘পেরোল অমান্য করার জন্য তোমাকে গ্রেফতার করতেই হবে।’ বলে শ্যাডোকে ওর অধিকারগুলো জানাল চিফ। এরপর কিছু কাগজপত্র তৈরি করে তাতে শ্যাডোর হাতের ছাপ নিলো। এরপর দালানের অন্য পাশে, কাউন্টি জেলের দিকে নিয়ে গেল ওকে। 

ঘরটায় এক পাশে একটা লম্বা কাউন্টার আর অনেকগুলো দরজা, অন্য পাশে দুটো হোল্ডিং সেল। একটা সেল কয়েদি আছে, লোকটা সিমেন্টের বিছানায় পাতলা কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমাচ্ছে। অন্যটা খালি। 

কাউন্টারের পেছনে ঘুম-ঘুম চোখে বসে আছে বাদামি উর্দি পরিহিত এক মহিলা। এক চোখ দিয়ে ছোটো একটা পোর্টেবল টিভিতে জে লেনো দেখছে। চ্যাডের কাছ থেকে কাগজগুলো নিয়ে, তাতে সই করল মহিলা। আরও কিছু কাগজপত্র পূরণ করল চ্যাড, এরপর শ্যাডোর দেহ হাতরিয়ে সব কিছু নিয়ে নিলো। ওয়ালেট, পয়সা, অ্যাপার্টমেন্টের দরজা, বই, হাতঘড়ি—কিছুই বাদ গেল না। এরপর ওগুলোকে কাউন্টারে রেখে শ্যাডোর হাতে ধরিয়ে দিল কমলা রঙের পোশাক ভরা একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ। খালি সেলে গিয়ে ওগুলো পরে নিয়ে বলা হলো ওকে, তবে চাইলে মোজা আর আন্ডারওয়্যার রাখতে পারবে বলেও জানানো হলো। কথা মতো কাজ করল শ্যাডো, সেলের ভেতরটা বাজে রকমের দুর্গন্ধে ভরা। কমলা পোশাকটার পেছন দিকে বড়ো হাতের অক্ষরে লাম্বার কাউন্টি জেল লেখা। 

সেলের ধাতব টয়লেটটা কাজ করছে না। একেবারে কোনা পর্যন্ত ওটা তরল মল আর হলদে প্রস্রাবে ভরতি! 

কাপড় পরিবর্তন শেষ হলে, বাইরে বেরিয়ে এলো ও। মহিলার হাতে ওর পরনের স্বাভাবিক পোশাক তুলে দিলে, সে ওগুলোকে আরেকটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে শ্যাডোর অন্যান্য জিনিসপত্রের সাথে তুলে রাখল। ওয়ালেট দেবার আগে অবশ্য একটু দোনোমনো করেছিল যুবক। ‘সাবধানে রেখ,’ মহিলাকে ওটা দিয়ে বলল সে। ‘আমার সারাটা জীবন ওটার ভেতরে।’ পাথুরে চেহারায় ওয়ালেটটা নিলো মহিলা, জানাল-নিরাপদেই থাকবে সবকিছু। চ্যাডের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ঠিক বলেছে কিনা। কাগজে মুখ গুঁজে ছিল লোকটা, এবার শ্যাডোর দিকে তাকিয়ে জানাল, ঠিক বলেছে লিয। এখন পর্যন্ত কোনো কয়েদির জিনিস-পত্র হারাবার ঘটনা ঘটেনি। 

চারটা একশ ডলারের বিল আগেই ওয়ালেট থেকে বের করে হাতের ভাঁজে লুকিয়ে রেখেছিল। পোশাক পরিবর্তন করার সময় সেটাকে মোজার ভেতর ঢুকিয়ে রেখেছে, সেই সাথে রেখেছে রুপালি লিবার্টি ডলারটাও। 

‘আচ্ছা,’ জানতে চাইল শ্যাডো। ‘বইটা শেষ করতে সমস্যা আছে?’ 

দুঃখিত, মাইক। নিয়ম তো নিয়মই।’ 

শ্যাডোর জিনিসপত্রগুলো একটা ব্যাগে ভরে পেছনের ঘরে নিয়ে গেল লিয। চ্যাড জানাল, অফিসার বাউটের দক্ষ হাতে ওকে ছেড়ে দিচ্ছে সে। লিযকে দেখে মনে হলো না যে এই প্রশংসা খুব একটা প্রভাব ফেলেছে ওর ওপরে। বিদায় নিলো চ্যাড, এর কিছুক্ষণের মাঝেই বেজে উঠল টেলিফোন। লিয, মানে অফিসার বাউট, ফোন ধরল। ‘ঠিক আছে,’ বলল সে। ‘ঠিক আছে। সমস্যা নেই। ঠিক আছে, সমস্যা নেই। ঠিক আছে।’ ফোন রেখে দিয়ে মুখ বিকৃত করল সে। 

‘কোনো সমস্যা?’ 

‘হ্যাঁ, না। মানে একটু। মিলওয়াকি থেকে তোমাকে নেবার জন্য লোক আসছে।’ 

‘তাতে আবার কী সমস্যা?’ 

‘তিন ঘণ্টা তোমাকে পাহারা দিয়ে রাখতে হবে এখন।’ বলল লিয। ‘আর ওই সেলটা,’ কয়েদি রাখাটার দিকে ইঙ্গিত করল সে। ‘ভরতি। আত্মহত্যা করতে চায় লোকটা। ওর সাথে তোমাকে এক সেলে রাখতে চাই না। কাগজপত্রের ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই।’ মাথা নাড়ল সে। ‘আর ওটা,’ অন্যটা দেখাল ইঙ্গিতে। ‘নষ্ট, ভয়াবহ দুর্গন্ধ। তাই না?’ 

‘হ্যাঁ। ঘেন্না লাগে।’ 

‘মানবিকতার খাতিরেই তোমাকে ওখানে রাখা যাবে না। যত তাড়াতাড়ি নতুন ফ্যাসালিটিতে যাওয়া যায়, তত ভালো। তাই ভাবছি, তোমাকে হাতকড়া পরিয়ে এখানেই রেখে দেই। নাকি সেলে যাবে? তোমার ইচ্ছা।’ 

‘হাতকড়া ভালো লাগে না খুব একটা।’ বলল শ্যাডো। ‘তবে আপাতত মেনে নিয়েই হচ্ছে।’ 

কোমরের বেল্ট থেকে একজোড়া হাতকড়া বের করে আনল মহিলা, এরপর সেমি-অটোমেটিকটায় আলতো চাপড় বসাল। শ্যাডোর মনে হলো, ওকে দেখানোর জন্যই করল কাজটা। ‘হাত পেছনে নাও।’ 

কাফগুলো একটু বেশিই শক্ত বলে মনে হলো, শ্যাডোর কব্জিগুলো বেশ মোটা। এরপর পায়ে শিকল বেঁধে কাউন্টারের অন্য পাশের বেঞ্চে বসিয়ে দিল। ‘কান খুলে শোনো,’ বলল মহিলা। ‘তুমি আমাকে জ্বালিও না, আমিও তোমাকে জ্বালাব না।’ টিভিটা একটু বাঁকাল সে, যেন শ্যাডো দেখতে পায়। 

‘ধন্যবাদ। 

‘আমরা নতুন অফিস পেলে,’ বলল লিয। ‘এসব ঝামেলা আর থাকবে না।’ 

দ্য টু নাইট শো শেষ হবার পর, চিয়ার্স শুরু হলো। শ্যাডো আগে চিয়ার্সের মাত্র একটা এপিসোড দেখেছে-সেখানে কোচের মেয়ে বেড়াতে এসেছিল বারে। ওই একই এপিসোডটা বেশ কয়েকবার দেখেছে সে। ব্যাপারটা আসলেই অদ্ভুত, ভাবল ও। মানুষ যখন কোনো সিরিজের একটা মাত্র এপিসোড দেখে, তখন কেন যেন বারবার ওটার মাত্র একটাই এপিসোড দেখা হয়! 

অফিসার লিয বাউট চেয়ারে হেলান দিল। দেখে মনে হয় না যে ঘুমাচ্ছে, তবে জেগে যে নেই তা-ও নিশ্চিত। তাই চিয়ার্সের অভিনেতারা যখন কৌতুক করা বাদ দিয়ে শ্যাডোর দিকে তাকাল, ব্যাপারটা ধরতেই পারল না সে! 

ডায়ান, স্বর্ণকেশী যে বারমেইড নিজেকে আঁতেল ভাবে, প্রথম মুখ খুলল। ‘শ্যাডো,’ বলল সে। ‘তোমাকে নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছিলাম। আচমকা কোথায় ডুব দিয়েছিলে, বলো তো! যাই হোক, আবার দেখতে পেয়ে প্রীত হলাম। যদিও কমলা রং আর হাতকড়া তোমাকে ঠিক মানায় না।’ 

কিছুই বলল না শ্যাডো। 

‘চুপ কেন?’ বলল ডায়ান। ‘তোমাকে খুঁজে পেতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে, জানো?’ 

মুখ ঘুরিয়ে নিলো শ্যাডো। অফিসার লিয আস্তে আস্তে নাক ডাকতে শুরু করেছে। কার্লা, ছোটোখাটো ওয়েট্রেস মহিলা, খেপে গেল। ‘ওই, বেয়াদ্দপ! তোমার প্যান্ট খারাপ করিয়ে দেওয়ার জন্য এসেছি আমরা, বুঝেছ? এখন তৈরি হও।’ 

আচমকা কালো হয়ে গেল পর্দা। বাঁ দিকের নিচের কোনায় ‘সরাসরি সম্প্রচার লেখাটা ফুটে উঠল। সেই সাথে ভেসে এলো অদৃশ্য এক মেয়ের কণ্ঠ। ‘এখন দল পরিবর্তনের সময় শেষ হয়ে যায়নি। অবশ্য চাইলে যে দলে আছ, সে দলেও থাকতে পারো। আমেরিকান হবার অর্থই তো তাই! বিশ্বাসের স্বাধীনতার মাঝে ভুল আদর্শে বিশ্বাসও পড়ে কিন্তু। ঠিক যেমন বাক-স্বাধীনতার মধ্যে পড়ে চুপ করে থাকার স্বাধীনতা।’ 

পর্দায় এখন একটা রাস্তা দেখা যাচ্ছে। নড়তে নড়তে এগোচ্ছে ক্যামেরা, একমাত্র ডকুমেন্টারি ভিডিয়ো করার সময়ই ক্যামেরার এমন কাজ দেখা যায়। 

টাক পড়তে শুরু করা মাথা, বাদামি চামড়া আর কিছুটা গর্বিত চেহারা নিয়ে একজন এসে উপস্থিত হলো পর্দায়। একটা দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে, হাতে ধরা আছে প্লাস্টিকের কাপ ভরতি কফি। সরাসরি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে লোকটা বলল, ‘সন্ত্রাসীরা মুক্তিযোদ্ধা টাইপের গাল-ভরা বুলির পেছনে লুকিয়ে থাকে। তুমি জানো, আমিও জানি-ওরা আসলে খুনি-বেজন্মা ছাড়া আর কিছু না। নিজেদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে আমরা ভবিষ্যতের জন্য লড়ছি।’ 

কণ্ঠটা চিনতে পারল শ্যাডো, কেননা একদা ও মি. টাউনের মাথার ভেতরে প্রবেশ করেছিল। কণ্ঠটা বাইরে থেকে আরও ভরাট বলে মনে হলো ওর। 

ক্যামেরা পেছনে এলে সে দেখতে পেল, মি. টাউন একটা ইট নির্মিত দালানের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। দরজার ওপরে চৌকানা করে ‘জি’ অক্ষরটা লেখা। 

‘তৈরি।’ অদৃশ্য কারও কণ্ঠ ভেসে এলো। 

‘দেখা যাক, ভেতরের ক্যামেরা কাজ করছে কি না।’ মহিলা কণ্ঠটা বলে উঠল।

পর্দার বাঁ কোনায় এখনও সরাসরি সম্প্রচার লেখা ভাসছে। তবে এখন ওতে দেখা যাচ্ছে একটা ছোট্ট হলের ভেতরের দৃশ্য। ঘরটায় আলো কম। এক পাশে দুজন মানুষ বসে আছে, মুখোমুখি…মাঝখানে একটা টেবিল। ওদের একজনের পিঠ ক্যামেরার দিকে। জুম করল ক্যামেরা, এক মিনিটের জন্য ফোকাসের বাইরে চলে গেল লোক দুটো। তবে ফিরে এলো পরক্ষণেই। ক্যামেরার দিকে মুখ করে থাকা লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল, যেমনটা কোন শিকল পরানো ভালুক হাঁটে। ওয়েনসডেকে চিনতে পারল শ্যাডো। দেখে মনে হচ্ছে যেন ব্যাপারটা তিনি উপভোগই করছেন। 

ক্যামেরার দিকে পিঠ দিয়ে থাকা লোকটা বলল, ‘–আমরা এই অর্থহীন কর্মকাণ্ড বন্ধের একটা সুযোগ দিতে চাচ্ছি। আর রক্তপাত চাই না, চাই না হতাহতের ঘটনা ঘটুক। পারস্পারিক শত্রুতা বন্ধ করে দিতে চাই। এজন্য কিছুটা হলেও ছাড় তো তোমাকেও দিতে হবে।’ 

ওয়েনসডে হাঁটা বন্ধ করে ঘুরলেন। রাখে তার নাক ফুলে আছে। ‘প্ৰথমত,’ বললেন তিনি। ‘তোমাকে বুঝতে হবে যে তুমি চাইছ আমি আমাদের সবার হয়ে কথা বলি। এটা অসম্ভব। আর দ্বিতীয়ত, তোমরা তোমাদের প্রতিজ্ঞা রাখবে—সেই নিশ্চয়তা কোথায়?’ 

অন্য লোকটা মাথা নাড়ল। নিজেকে ছোটো করে দেখছ তুমি। তোমাদের নেতা নেই, এ কথা মানলাম। কিন্তু তোমার কথাই সবাই শোনে…মানে। আর আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষার কথা বলছ? এসব কিছু রেকর্ড করা হচ্ছে, সেই সাথে সরাসরি সম্প্রচারও,’ ক্যামেরার দিকে ইঙ্গিত করল সে। ‘তোমার অনুসারীদের কেউ কেউ সেটা দেখছে-শুনছে। অন্যরাও দেখবে। ক্যামেরা মিথ্যে বলে না।’ 

‘মিথ্যে? সেটা সবাই বলে।’ বললেন ওয়েনসডে। 

অন্য লোকটার কণ্ঠ চিনতে পারল শ্যাডো-মিস্টার ওয়ার্ল্ড 

‘তোমার বিশ্বাস হয় না,’ বললেন মি. ওয়ার্ল্ড। ‘যে আমরা আমাদের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করব?’ 

‘আমার ধারণা, তোমরা ভাঙার জন্যই প্রতিজ্ঞা করো। তবে আমি কথা দিলে কথা রাখি।’ 

‘এটা যে শান্তিচুক্তির জন্য মিটিং,’ বলল মি. ওয়ার্ল্ড। ‘সেটা ঠিক করেই আমরা এক হয়েছি। তবে বলে রাখি, তোমার শিষ্য কিন্তু আবার আমাদের হাতে এসেছে পড়েছে।’ 

ঘোঁত করলেন ওয়েনসডে। ‘নাহ, পড়েনি।’ 

‘আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা করছি। পারস্পারিক শত্রুতাটা কি খুব জরুরি?’ 

ওয়েনসডেকে অবাক দেখাল। ‘আমার ক্ষমতায় যতটুকু কুলায়, ততটুকু দিয়ে…’ 

টেলিভিশনের পর্দায় দেখা ওয়েনসডের ছবিতে অদ্ভুত কিছু একটা আছে, বুঝতে পারল শ্যাডো। লাল একটা ডট ফুটে উঠেছে তার বাঁ চোখে, নকল ওটা। তিনি নড়া মাত্র লাল ডটটা তার উপস্থিতি পর্দায় জানান দিচ্ছে। তবে ওয়েনসডে নিজে বুঝতে পারছেন বলে মনে হলো না। ‘বিশাল একটা দেশ এটা,’ বললেন তিনি। মাথা ওপরে তুললেন বলে লাল ডটটা তার গালে দেখা গেল, তারপর আবার নকল চোখের উপর স্থির হলো ওটা। ‘যথেষ্ট জায়গা আছে—’ 

ব্যাং শব্দ হলো একটা, সাথে সাথে বিস্ফোরিত হলো ওয়েনসডের মাথা। পেছন দেখে আছড়ে পড়ল তার দেহ। 

উঠে দাঁড়াল মি. ওয়ার্ল্ড, এখনও টেলিভিশনের দিকে পিঠ দিয়ে আছে। হেঁটে পর্দার বাইরে চলে গেল সে। ‘আবার দেখব আমরা, এবার আস্তে আস্তে। ওকে জানাল যেন মহিলা কণ্ঠ। 

সরাসরি সম্প্রচার এখন পুনঃপ্রচার হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে লাল ডটটা ওয়েনসডের কাচের চোখের উপর স্থির হলো। আরও একবার তার চেহারার বাঁ দিকটা পরিণত হলো রক্তের মেঘে। পর্দায় স্থির হয়ে রইল সেই দৃশ্যটাই। 

‘এখন এই দেশ দেবতার নিজের দেশ,’ বলল মহিলা কণ্ঠ। ‘কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোন দেবতার?’ 

আরেকটা কণ্ঠ, শ্যাডোর মনে হলো যেটা মি. ওয়ার্ল্ডের, বলল, ‘এখন আমরা আবার আমাদের নিয়মিত প্রোগ্রামে ফিরে যাচ্ছি।’ 

পর্দা দখল করে নিলো চিয়ার্সের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। 

আচমকা বেজে উঠল টেলিফোন, অফিসার লিয চমকে উঠে পড়ল। রিসিভার তুলে নিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। হ্যাঁ।’ এরপর ফোন রেখে দিয়ে শ্যাডোর কাছে এসে বলল, ‘তোমাকে সেলে আটকে রাখতে হবে। টয়লেট ব্যবহার করো না। ল্যাফিতি শেরিফের ডিপার্টমেন্ট শীঘ্রই এসে তোমাকে নিয়ে যাবে। কাফ আর পায়ের শিকল খুলে সেলের ভেতরে ঢোকাল সে শ্যাডোকে। গন্ধটা আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে এতক্ষণে। 

কংক্রিটের বিছানার উপর বসে পড়ল যুবক, মোজা থেকে বের করে আনল লিবার্টি ডলারটা। নিজেকে শান্ত রাখার জন্য শুরু করল অনুশীলন। কিচ্ছু ভাবতে চাইছে না এখন, মাথাকে ব্যস্ত রাখতে চাইছে অন্য চিন্তায়। 

আচমকা তীব্রভাবে ওয়েনসডেকে মিস করতে শুরু করেছে ও। লোকটার আত্মবিশ্বাস, দৃঢ়তা, ব্যক্তিত্ব-সব। 

হাতের পয়সাটার দিকে তাকাল শ্যাডো। কিছুক্ষণ রুপালি আভা দেখে শক্ত করে চেপে ধরল। ভাবল, যারা যারা বিনা অপরাধে যাবজ্জীবন পায়, তাদের একজন হতে চলেছে ও। অবশ্য ততক্ষণ পর্যন্ত টিকলে তবেই; মি. ওয়ার্ল্ড আর মি. টাউনের ক্ষমতা যা দেখল, তাতে জেল থেকে ওকে বের করে নিয়ে যেতে খুব একটা কষ্ট হবে না। কে জানে, হয়তো পরবর্তী ফ্যাসিলিটিতে যাবার আগেই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি বরণ করতে হবে ওকে। ক্রসফায়ারও হতে পারে, অসম্ভব কিছুই না। 

কিছুক্ষণ পর শ্যাডো উপলব্ধি করতে পারল, অফিস ঘরে মানুষজন নড়াচড়া করতে শুরু করেছে! আসলেই তাই, অফিসার লিয খুলে দিল সদর দরজা। মহিলার অলক্ষ্যে পয়সাটা আবার ঢুকিয়ে রাখল অর মোজার ভেতরে। এদিকে বাদামি উর্দি পরা এক ডেপুটি শেরিফ সদ্য খোলা দরজা দিয়ে প্রবেশ করে অফিসার লিযের দিকে কিছু কাগজ বাড়িয়ে ধরেছে। ওগুলো পড়ে নিয়ে সই করে দিল সে, এলো চ্যাড মুলিগানও। সদ্য আগত লোকটার সাথে কিছু কথা বলে শ্যাডোর সেলের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। 

‘তোমাকে নিতে কয়েকজন লোক এসেছে। তোমার সাথে নাকি জাতীয় নিরাপত্তা জড়িত। তাই নাকি?’ 

‘দ্য লেকসাইড নিউজের প্রথম পাতায় খবর হবার যোগ্য ব্যাপারটা।’

ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল চ্যাড। ‘ভবঘুরে এক পেরোল অমান্যকারীকে পুলিস ধরেছে। এতে খবরের কী আছে?’ 

‘তাই নাকি?’ 

‘এদের মতে তো আমাকে তাই বলতে হবে। এবার সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল শ্যাডো, সেভাবেই হাতকড়া বাঁধল চ্যাড। বাদ গেল না পায়ের শিকলও। 

শ্যাডো ভাবল, আমাকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হবে। পাতলা কমলা পোশাক আর হাতকড়া-শিকল সত্ত্বেও পালাবার ঝুঁকি নেব নাকি? নিজের চিন্তার অসারতা নিজেই বুঝতে পেরে ক্ষান্ত দিল। 

ওকে অফিসে নিয়ে এলো চ্যাড, লিয এতক্ষণে টিভিটা বন্ধ করে দিয়েছ। কালো চামড়ার ডেপুটি বুঝে নিলো শ্যাডোকে। ‘বিশালদেহী দেখি!’ চ্যাডকে বলল সে, বলতে বলতেই সই করে দিল লিযের দেওয়া কাগজে। 

একবার শ্যাডোর দিকে, আর আরেকবার ডেপুটির দিকে তাকাল চ্যাড। তারপর নিচু, তবে শ্যাডো শুনতে পাই এমন কণ্ঠে বলল, ‘সরাসরি বলি, আমার ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছে না।’ 

মাথা দোলাল ডেপুটি। ‘আপনাকে ব্যাপারটা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে, স্যার। আমাদের কাজ শুধু কয়েদি আনা-নেওয়া করা।’ 

মুখ বাঁকাল চ্যাড। শ্যাডোকে বলল, ‘যাও বাইরে যাও, গাড়ি বাইরেই আছে।’

দরজা খুলে দিল লিয। ‘কয়েদির পোশাক ফিরিয়ে দিতে ভুলো না।’ ডেপুটিকে বলল মহিলা। ‘আগের যে কয়েদিকে তোমরা নিয়ে গেছিলে, তার পোশাক আর ফেরত পাইনি। আমাদের খরচ হয় তো, নাকি?’ গাড়ির কাছে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো শ্যাডোকে। ওটাকে শেরিফ ডিপার্টমেন্টের গাড়ি বলে মনে হলো না ওর। গাড়িটা কালো, টাউন গাড়ি। আরেক ডেপুটি, বয়সের ভারে গোঁফ যার ধূসর বরফ, বাহনটার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। আরাম করে সিগারেট ফুঁকছিল এতক্ষণ, ওদেরকে আসতে দেখে পায়ের নিচে ফেলে নিভিয়ে ফেলল। শ্যাডোর জন্য খুলে দিল পেছনের দরজা। 

অদ্ভুত ভঙ্গিমায় নড়ে-চড়ে ভেতরে ঢুকল শ্যাডো, হাতকড়া আর শিকল ঝামেলা করছে। সামনের আর পেছনের সিটের মাঝে গরাদ নেই। ভেতরে ঢুকে বসল দুই ডেপুটিও। কালো ডেপুটি চালু করল ইঞ্জিন। 

চ্যাড মুলিগান জানালায় নক করলে, ড্রাইভারের দিকে একবার তাকিয়ে জানালা নামাল বয়স্ক ডেপুটি। ‘ব্যাপারটা কেমন যেন ঠিক মনে হচ্ছে না,’ বলল চ্যাড। ‘এতটুকুই বলতে চাচ্ছিলাম।’ 

‘আপনার মন্তব্য আমরা আমলে নিলাম, কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।’ জবাব দিল ড্রাইভার। 

এখন তুষারপাত হচ্ছে, হেডলাইটের আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তুষারের ভেসে বেরানো। অপেক্ষা না করে অ্যাক্সিলেটরে পা বসাল ড্রাইভার, কিছুক্ষণের মাঝেই ওরা উঠে এলো প্রধান সড়কে। 

‘ওয়েনসডে খবর শুনেছ?’ বলল ড্রাইভার। পরিচিত শোনাল লোকটার কণ্ঠ ‘মারা গেছে।’ 

‘হুম, জানি।’ বলল শ্যাডো। ‘টিভিতে দেখেছি। 

‘সবগুলো হারামজাদা,’ বয়স্ক ডেপুটি এই প্রথম কথা বলল, এর কণ্ঠটাও পরিচিত। 

‘আমাকে নিতে আসার জন্য ধন্যবাদ,’ বলল শ্যাডো। 

‘ব্যাপার না।’ অন্য পাশ থেকে আগত একটা গাড়ির আলোতে ড্রাইভারের চেহারা কিছুক্ষণ আগের চাইতে বয়স্ক বলে মনে হলো। এর আগের বার যখন শ্যাডোর সাথে এর দেখা হয়েছিল, তখন তার পরনে ছিল হলদে গ্লাভস আর একটা চেক জ্যাকেট। ‘আমরা মিলওয়াকিতে ছিলাম। আইবিসের ফোন পেয়ে পাগলের মতো গাড়ি চালিয়ে এসেছি।’ 

‘তোমাকে ওরা মৃত্যুদণ্ড দেবে, আর আমি বসে বসে আঙুল চুষব? তোমার মাথার মালিকানা আমার।’ সাদা ডেপুটি সিগারেটের খোঁজে পকেট হাতড়াল। লোকটার কণ্ঠে পূর্ব-ইউরোপিয়ান টান। 

‘ঘণ্টা দুয়েকের বেশি সময় পাবো না,’ বলল মি. ন্যান্সি। ‘আসল ডেপুটিরা তখন তোমাকে নিতে আসবে। আমরা অবশ্য ততক্ষণে হাইওয়েতে ৫৩-তে উঠে যাব। তবে আগে কোথাও থেমে ওই শিকল খুলতে হবে। পোশাকও পালটাতে হবে তোমাকে।’ হাতকড়ার চাবি দেখিয়ে হাসল চেরনোবোগ। 

‘গোঁফটা বেশ মানিয়েছে। বলল শ্যাডো। 

‘ধন্যবাদ।’ তা দিতে দিতে বলল লোকটা। 

‘ওয়েনসডে কি আসলেই মারা গেছেন?’ জানতে চাইল শ্যাডো। ‘নিশ্চয়ই কোনো খেলা খেলছেন তিনি! এসবই ধোঁকা।’ 

শ্যাডো বুঝতে পারল, মনের ভেতর একটা আশা লালন করছিল ও। কিন্তু ন্যান্সির চেহারা দেখে উপলব্ধি করল, সে আশা মিথ্যা। 

আমেরিকায় আগমন 
১৪০০ খ্রিস্টপূর্ব 

যখন স্বপ্নাবিভাব হলো যাজিকার, তখন অন্ধকার তার রাজত্ব বিস্তার করেছে চারদিকে। সেই সাথে ঠান্ডাও প্রচণ্ড। অবশ্য সুদূর উত্তরে মধ্য-দুপুরের আগে সূর্যের দেখা পাবার আশা করাও বৃথা। সদা উপস্থিত অন্ধকারের মাঝে এক চিলতে আলো হওয়া ছাড়া যেন ওটার কোনো ভূমিকা নেই। 

গোত্র হিসেবে ওদেরটাকে, মানে উত্তরাঞ্চলের এই যাযাবরদের কোনোভাবেই বড়ো বলা যাবে না। ওদের দেবতা হচ্ছে একটা ম্যামথের খুলি এবং ম্যামথের চামড়া দিয়ে বানানো একটা আলখাল্লা। নুনইয়ুননিনি নামে ডাকে ওরা তাকে। যখন চলার ওপরে থাকে না, তখন একটা কাঠের ফ্রেমের উপর রাখা হয় খুলিটাকে…এক মানুষ উচ্চতায় 

মহিলা গোত্রের ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, খুলির সব রহস্যের রক্ষক। নাম তার আতসুলা, গোত্রের ভাষায়-শিয়াল। চলার সময় ভালুকের চামড়া পরে নুনইয়ুননিনির দুই বাহকের সামনে হাঁটে ও। 

তুন্দ্রা অঞ্চলে গোত্রটার আবাস, বাস করে তাঁবুতে। সেরা মানের তাঁবু বানানো হয় ক্যারিবুর চামড়া দিয়ে। এই মুহূর্তে পবিত্র তাঁবুর ভেতরে বসে আছে চারজন— যাজিকা আতসুলা, গোত্র-প্রধান গুগউই; প্রধান যোদ্ধা ইয়ানু আর সন্ধানী কালানু। স্বপ্নাবিভাব হবার পরেরদিন সবাইকে ডেকেছে আতসুলা। 

চুল থেকে কয়েকটা উকুন বের করে আগুনে ছুড়ে দিল আতসুলা, শুকিয়ে আসতে থাকা বাঁ হাত দিয়ে ঢেলে দিল কিছু শুকনো পাতা। ধোঁয়ার দমকে চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো, সেই সাথে অদ্ভুত একটা গন্ধও আসছে। কাঠের বেদি থেকে একটা কাঠের কাপ নিলো মেয়েটা, এগিয়ে দিল গুগউইয়ের দিকে। কাপটার ভেতরে ঘন হলদে তরল। 

কয়েকটা পাঙ্ঘ মাশরুম খুঁজে পেয়েছে ও-প্রতিটা সাতটা করে দাগ। যাজিকা ছাড়া আর কারও পক্ষে সাত দাগঅলা মাশরুম খুঁজে বের করা সম্ভব না। অমাবস্যার সময় তুলতে হয়েছে ওগুলো, তারপর শুকোতে হয়েছে হরিণের তরুণাস্থির উপর রেখে। 

আগেরদিন ঘুমাবার আগে, তিনটা মাশরুম খেয়েছিল ও। ঘুমিয়ে দেখা স্বপ্নটা ওকে বিভ্রান্ত করেছে, করে তুলেছে ভীত। উজ্জ্বল আলোকে দ্রুত এগিয়ে আসতে দেখেছে সে, দেখেছে পাথুরে পর্বতকে বরফে আচ্ছাদিত হতে। কাঁপতে কাঁপতে ঘুম ভেঙে গেছে ওর, তলপেটে অনুভব করেছে প্রচণ্ড চাপ। কাঠের কাপটা নিয়ে ভেতরে প্রস্রাব করেছে আতসুলা, এরপর সেটাকে তাঁবুর বাইরে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে আবার। 

ঘুম থেকে উঠে, কাঠের কাপটা থেকে বরফে টুকরা সরিয়ে ফেলেছে ও। ফলে রয়ে গেছে কেবল ঘন তরল। 

সেটাই এখন একে একে সবার হাতে ঘুরছে। প্রথমে গুগউই, এরপর ইয়ানু আর শেষে কালানু। সবাই লম্বা করে চুমুক দিল কাপে, একদম শেষে এলো আতসুলার পালা। পান করা শেষে যতটুকু বাকি আছে, সেটা মাটিতে ফেলে দিল ও; দেবতা নুনইয়ুননিনি সামনে। 

তাঁবুতে চুপচাপ বসে রইল চারজন, দেবতার কথা বলার অপেক্ষা করছে।

কালানু, যে পুরুষের মতো পোশাক পরলেও আদপে নারী, পিট পিট করে তাকাল কিছুক্ষণ। তারপর এগিয়ে গেল খুলির দিকে। ম্যামথের চামড়া দিয়ে বানানো আলখাল্লাটা নিজের গায়ে জড়িয়ে এমনভাবে দাঁড়াল যেন ওর মাথাটা খুলির ভেতরে থাকে। 

‘এই ভূমিতে পা রেখেছে অশুভ, ‘ কালানুর কণ্ঠে বলে উঠল নুনইয়ুননিনি। ‘এমন অশুভ যে এখানে থাকলে তোমরা, তোমাদের মায়েরা আর তোমাদের মায়েদের মায়েরা-কেউ রেহাই পাবে না।’ 

ঘোঁত করে উঠল তিন শ্রোতা। 

‘দাস ব্যবসায়ী…নাকি নেকড়ের পাল?’ জানতে চাইল গুগউই, লম্বা আর সাদা তার চুল; চেহারা কুঞ্চিত। 

‘দাস ব্যবসায়ী না,’ জানাল নুনইয়ুননিনি। ‘নয় নেকড়ের পালও।’

‘তাহলে কি দুর্ভিক্ষ?’ 

চুপ করে রইল নুনইয়ুননিনি, কালানু বেরিয়ে এসে ওদের সাথে যোগ দিল। 

এবার গুগউই প্রবেশ করল আলখাল্লার ভেতরে। 

‘এমন এক দুর্ভিক্ষ,’ বলল নুনইয়ুননিনি। ‘যেটাকে ঠিক তোমাদের পরিচিত দুর্ভিক্ষের সাথে মেলানো যাবে না। তবে হ্যাঁ, তেমন দুর্ভিক্ষও আসছে। 

‘তাহলে কী?’ জানতে চাইল ইয়ানু। ‘আমি ভীত নই, দরকার হলে সেই অশুভের বিরুদ্ধে লড়াই করব। আমাদের বর্শা আছে, আছে ছুড়ে মারার মতো পাথর। আমাদের বিরুদ্ধে এক শত বীর যোদ্ধা লড়াই করলেও, জয়ী হবো আমরাই। জলাভূমিতে নিয়ে গিয়ে একে একে খুন করব সবাইকে।’ 

‘মানুষরূপী কিছু না,’ গুগউইয়ের কণ্ঠে বলল নুনইয়ুননিনি। ‘এই অশুভ আসবে আকাশ থেকে। তোমাদের পাথর বা বর্শা, কোনটাই কাজে আসবে না।’ 

‘তাহলে আমরা নিজেদেরকে রক্ষা করব কী করে?’ জানতে চাইল আতসুলা। ‘আমি আকাশে আগুন দেখেছি। শুনেছি দশটা বজ্রের চাইতেও উঁচু একটা আওয়াজ। দেখেছি বনকে শুয়ে পড়তে, দেখেছি নদীর পানিকে ফুটতে।’

‘আই…’ আর কিছু বলল না নুনইয়ুননিনি। গুগউই বেরিয়ে এলো আলখাল্লার ভেতর থেকে। 

কিছুক্ষণ বজায় রইল নীরবতা। আতসুলা আরও কিছু পাতা ঠেলে দিল আগুনে। ধোঁয়ায় চোখ থেকে বেরিয়ে এলো পানি। 

এবার ইয়ানু মাথা ঢোকাল আলখাল্লায়। গম গম করে উঠল ওর কণ্ঠ ‘তোমাদেরকে পথে নামতে হবে,’ বলল নুনইয়ুননিনি। ‘সূর্যের দিকে এগোবে তোমরা। যেখান সূর্য উদয় হয়, সেখানেই পাবে নিরাপদ একটা আবাসস্থল। অনেক লম্বা সময় যাত্রা করতে হবে। দুইবার পূর্ণিমা হবে, দুইবার দেখতে নামবে আমাবস্যা। আর পথে সামনে পড়বে দাস ব্যবসায়ী আর হিংস্র পশু। তবে সূর্যের দিকে এগোলে, আমি তোমাদেরকে পথ দেখাব। 

মেঝেতে থুথু ফেলল আতসুলা। ‘না,’ বলল ও। অনুভব করতে পারল, দেবতার ওর দিকেই তাকিয়ে আছেন। ‘না, তুমি খারাপ দেবতা। আমরা সূর্যোদয়ের দিকে রওনা হলে দলে দলে মারা পড়ব। তোমাকে বহন করার, তোমার তাঁবু গাড়ার, তোমার দাঁতে চর্বি মাখার কে থাকবে তখন? 

কিছুই বলল না দেবতা। আতসুলা আর ইয়ানু জায়গা পরিবর্তন করল। এখন যাজিকার মাথা খুলির ভেতরে। 

‘আতসুলা অবিশ্বাসী,’ নুনইয়ুননিনি আতসুলার কণ্ঠে বলল। ‘নতুন এই আবাসস্থলে পা রাখার আগেই সে মারা যাবে। তবে তোমরা, বাকিরা বেঁচে থাকবে। আমার প্রতি বিশ্বাস রাখো। পুবে এমন একটা জায়গা আছে, যেখানে মানুষ নেই। এই এলাকায় হবে তোমাদের নতুন বাসস্থান। তোমাদের বাচ্চারা, তাদের বাচ্চারা…এভাবে সাতে সাত প্রজন্ম থাকবে ওখানে। আতসুলা অবিশ্বাস না করলে, চিরদিনই থাকতে পারতে। সকালে তোমাদের তাঁবু আর তোমাদের সম্পত্তি গুছিয়ে নেবে। রওনা করবে পূর্ব দিকে।’ 

গুগউই, ইয়ানু আর কালানু বাউ করল নুনইয়ুননিনি উদ্দেশ্যে, প্ৰশংসা করল তার ক্ষমতা আর জ্ঞানের। 

পূর্ণিমা এলো, এলো অমাবস্যা। একবার না…দুবার। গোত্রের সবাই পূর্বদিকে, সূর্যোদয়ের দিকে দিকে হেঁটে চলল। ঠান্ডা বাতাস, যেটা তাদের চামড়াকে পর্যন্ত জমিয়ে দিচ্ছে, ওদেরকে থামাতে পারল না। সত্য হলো নুনইয়ুননিনি প্রতিজ্ঞা, গোত্রের কেউ মারা গেল না পথে। কেবল এক মা বাচ্চা প্রসব করতে গিয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করল। আর সবাই জানে, প্রসব-সংক্রান্ত সব ক্ষমতা চন্দ্রের, নুনইয়ুননিনির এই বিষয়ে বিন্দুমাত্র ক্ষমতা নেই। 

সকাল হতেই সামনে এগিয়ে গেছে কালানু। আকাশ এখন কালো, অথচ সে ফিরে আসেনি! তবে রাতের আকাশে খেলা করছে নানা রঙের আলো, জ্বলছে…নিভছে…এঁকে-বেঁকে এদিক-ওদিক যাচ্ছে। সাদা, সবুজ, বেগুনি আর লাল আলো। আতসুলা আর ওর গোত্রের লোকে উত্তরা আলো আগে দেখেছে বটে, কিন্তু এমন কিছু কখনও দেখেনি। 

অনেকক্ষণ পর ফিরে এলো কালানু। ‘মাঝে মাঝে মনে হয়,’ আতসুলাকে বলল সে। ‘দুহাত দুপাশে ছড়িয়ে নিজেকে ছেড়ে দিলেই আকাশে শুয়ে পড়ব।’ 

‘তুমি যে আমাদের সন্ধানী, তাই,’ বলল যাজিকা। ‘যখন মারা যাবে, তখন তোমার স্থান হবে আকাশে। তারা হয়ে আমাদেরকে পথ দেখাবে। 

‘পূর্বে উঁচু উঁচু বরফাবৃত পাহাড়।’ দাঁড়কাককে হার মানানো কালো চুলগুলো লম্বা কালানুর, যেরকম পুরুষরা রাখে। ‘আমরা চড়তে পারি, কিন্তু সময় লাগবে অনেক।’ 

‘তুমি আমাদেরকে পথ দেখিয়ে নিরাপদে নিয়ে যাবে,’ বলল আতসুলা। ‘তবে আমি পাহাড়ের পাদদেশেই মারা যাব। হবো তোমাদের নিরাপদ যাত্রার প্রার্থনায় উৎসর্গ।’

ওদের পশ্চিম দিক থেকে, যেখান থেকে ওরা এসেছে, যেখানে সূর্য ডুবেছে অনেক আগেই, আচমকা অসুস্থ এক হলদে আলো দেখা গেল। প্রতি মুহূর্তে উজ্জ্বল হচ্ছে ওটা, যেন দিনের আলোকেও হার মানাবে। গোত্রের সবাই হাত দিয়ে চোখ ঢাকল, চিৎকার করে উঠল ভয়ে। বাচ্চাদের কান্নার আওয়াজে ভরে উঠল চারপাশ। 

‘নুনইয়ুননিনি এই পরিণতির ব্যাপারেই আমাদেরকে সারধান করেছিলেন।’ বৃদ্ধ গুগউই বলল। ‘তিনি নিঃসন্দেহে এক ক্ষমতাশালী আর জ্ঞানী দেবতা। 

‘তিনি সব দেবতার মাঝে সেরা।’ বলল কালানু। ‘আমাদের নতুন আবাসে আমরা তাকে রাখব সবার ওপরে। মাছের তেল আর পশুর চর্বি ঘষব দাঁতে। আমাদের বাচ্চাদের, তাদের বাচ্চাদের আর তাদেরও বাচ্চাদের শোনাব নুনইয়ুননিনির ক্ষমতার গল্প। তাকে কেউ কোনোদিন ভুলে যাবে না। 

‘দেবতারা অসাধারণ,’ বলল আতসুলা। এমন ভঙ্গিমায় যেন গোপন কথা বলছে। ‘তবে আমাদের হৃদয় আরও বড়ো। কেননা সেখান থেকেই তারা আসেন, আর সেখানেই তারা ফিরে যাবেন…’ 

আতসুলার এই ঈশ্বর-দ্রোহিতা আরও কতক্ষণ চলত, কে জানে? কিন্তু এমন একভাবে তা বন্ধ হয়ে গেল, যা নিয়ে কোনো তর্ক চলে না। 

পশ্চিম দিক থেকে যে গর্জনটা ভেসে এলো, সেটা এতই প্রবল যে রক্ত বইতে শুরু করল কান থেকে। পরবর্তী অনেকক্ষণ কিছু না শুনতে পেল মানুষ, না দেখতে পেল। তবে বেঁচে রইল তারা, পশ্চিমের অন্যান্য গোত্রদের যে সেই সৌভাগ্য হয়নি তা জানে। 

‘বেশ বেশ,’ বলল আতসুলা, কিন্তু নিজের উচ্চারিত শব্দ সে নিজেই শুনতে ব্যর্থ হলো। 

বসন্তের সূর্য তখন তার শীর্ষে উঠল, সেদিন মারা গেল আতসুলা। নতুন আবাস দেখার সৌভাগ্য হলো না ওর। গোত্রও এগিয়ে চলল যাজিকা ছাড়া। 

পাহাড় পার হয়ে দক্ষিণ আর পশ্চিম দিকে এগোল গোত্র, থামল মিঠা পানি প্রবাহিত হচ্ছে এমন একটা উপত্যকা খুঁজে পাবার পর। সেই সাথে খুঁজে পেল মাছ ভরতি নদী। খুঁজে পেল এমন সব হরিণ, যেগুলো আগে কখনও মানুষ দেখনি। ওগুলো এত শান্ত যে খুন করার আগে তাদের আত্মার কাছে ক্ষমা চাইতে হলো শিকারিদের। 

এলো শীতল সময়, আবার চলেও গেল। গোত্রটা বড়ো হতে শুরু করল, আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল চারিদিকে। নতুন নতুন গোত্র তৈরি হলো, তাদের জন্য বেছে নেওয়া হলো নতুন নতুন টোটেম-শকুন, শেয়াল, স্লথ, বিড়াল আর মহিষ। একেকটা টোটেম একে গোত্রের প্রতিনিধি, একেক গোত্রের দেবতা। 

নতুন এই এলাকার ম্যামথগুলো আগের চাইতে বড়ো। সেই সাথে শ্লথ আর সাইবেরিয়ার ম্যামথদের চাইতে বোকা। নতুন এলাকায় খুঁজে পাওয়া গেল না সাত দাগ বিশিষ্ট কোন পাঙ্ঘ মাশরুম। নুনইয়ুননিনিও আর কোনোদিন কথা বলল না গোত্রের সাথে। 

কালানুর নাতী-নাতনীদের যুগে, একদল যোদ্ধা ফিরে এলো। আরেকটা বড়ো আর ক্রমবর্ধনশীল গোত্রের সদস্য ছিল ওরা, উত্তরে গেছিল দাস ধরে আনতে। কালানুদের গোত্রের উপত্যকাটা খুঁজে পেল তারা। অধিকাংশ পুরুষদের হত্যা করে, মহিলা আর বাচ্চাদের বন্দী করল। 

এই বাচ্চাদের একজন, ক্ষমা লাভের আশায় যোদ্ধাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল একটা গুহায়। ওখানে তারা আবিষ্কার করল ম্যামথের খুলি, ছেঁড়া-ফাটা ম্যামথ চামড়ার আলখাল্লা, কাঠের একটা কাপ আর আতসুলার মমিকৃত মস্তক 

নতুন এই গোত্রের কয়েকজন যোদ্ধা এসব পবিত্র জিনিস সাথে নিয়ে যেতে চাইছিল। ওদের ধারণা, এতে আরেকটা গোত্রের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে পারবে। অন্যরা আবার তার বিপক্ষে। কেননা নতুন দেবতাকে বয়ে নিয়ে গেলে ওদের আদি দেবতা রুষ্ট হতে পারেন (এই গোত্রের দেবতা ছিল শকুন, আর কে না জানে যে শকুন দেবতারা সহজেই ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়েন? 

তাই পবিত্র দ্রব্যাদি ছুড়ে ফেলা হলো পাহাড়ের পাশে, গভীর একটা খাদের ভেতর। প্রথম গোত্রের বন্দীদের সাথে নিয়ে যোদ্ধারা রওনা দিল দক্ষিণে। আস্তে আস্তে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠল এই শকুন গোত্র আর শেয়াল গোত্ররা। 

নুনইয়ুননিনি পুরোপুরি হারিয়ে গেল স্মৃতির অতলে। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *