অধ্যায় বারো
আমেরিকা তার ধর্ম আর তার নৈতিকতা বিনিয়োগ করেছে নিশ্চিত লাভজনক খাতে। আশীর্বাদপ্রাপ্ত একটা দেশের রূপ ধরেছে সে, কেননা তার আশীর্বাদ পাওয়াই উচিত। তার অধিবাসীরা যে ঈশ্বরের ওপরেই বিশ্বাস রাখুক না কেন, দিন শেষে রাষ্ট্রীয় এই ধারণাকেই বুকে নিয়ে রাখে।
–অ্যাগনেস রিপ্লিয়ার, টাইমস অ্যান্ড টেন্ডেনসিস।
.
পশ্চিম দিকে রওনা দিল শ্যাডো; উইসকনসিন আর মিনেসোটা পার হয়ে উত্তর ডাকোটায় প্রবেশ করল। ওখানকার পাহাড়গুলো বরফে ঢাকা, দেখে মনে হয় যেন বিশাল এক ঘুমন্ত মহিষ! শত শত মাইল পার হয়ে গেল, কিন্তু শ্যাডো আর ওয়েনসডের মাঝে একটা বাক্যও বিনিময় হলো না। উত্তর ডাকোটা, রিজার্ভেশন এলাকার দিকে এগোচ্ছে গাড়ি।
লিংকন টাউন গাড়িটা বদলে একটা পুরাতন উইনিব্যাগো নিয়েছে ওয়েনসডে। লিংকনটা চালাতে ভালোই লাগত শ্যাডোর, নতুন এটার ভেতর থেকে কেন যেন পুরুষ বিড়ালের গন্ধ আসছে! চালাতেও ভালো লাগছে না।
মাউন্ট রাশমোরের প্রথম সাইনপোস্টটা নজরে পড়ল ওদের, এখনও একশ মাইল দূরে জায়গাটা। ওয়েনসডে ঘোঁত করে উঠলেন। ‘এই জায়গাটা,’ আঙুল দিয়ে দেখালেন তিনি। ‘দারুণ পবিত্র।’
শ্যাডো ভেবেছিল, প্রৌঢ় ঘুমিয়ে পড়েছেন। যুবক বলল, ‘আমি যতদূর জানি, ওটা ইন্ডিয়ানদের জন্য পবিত্র একটা এলাকা ছিল।’
‘পবিত্র তো জায়গাটা এখনও,’ বললেন ওয়েনসডে। ‘আমেরিকার কাজ করার পদ্ধতিটাই এমন—মানুষ চায় উপাসনা করার অজুহাত। আজকাল শুধু পাহাড় দেখতে যাবার মাঝে সার্থকতা খুঁজে পায় না মানুষ। তাই মিস্টার গুটজেন বর্গলামের অসাধারণ সেই শিল্পকর্মের জন্ম। পাহাড়ের দেয়ালে প্রেসিডেন্টদের চেহারা খোদাই করার পর, মানুষ এখন শত শত মাইল গাড়ি চালিয়ে দেখতে আসে আগে বহুবার পোস্টকার্ডে দেখা চেহারা।’
‘একজনকে চিনতাম, অনেকদিন আগে ব্যায়ামাগারে আসত। সে বলেছিল, ডাকোটা ইন্ডিয়ান যুবকরা পাহাড়টা বেয়ে উঠত। এরপর অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়ে দল বেঁধে ঝুলে পড়ত চূড়া থেকে। কেন জানেন? যেন তারা প্রেসিডেন্টের নাকে মূত্র-ত্যাগ করতে পারে!’
ঘোঁত করে উঠলেন ওয়েনসডে। দারুণ! দারুণ! কোন প্রেসিডেন্টকে বেশি পছন্দ ছিল তাদের?’
শ্রাগ করল শ্যাডো। ‘বলেনি কখনও।
চাকার নিচে অনেকগুলো মাইল পেছনে ফেলে এলো উইনিব্যাগোটা। শ্যাডোর মনে হচ্ছিল, ও বুঝি স্থির হয়ে আছে। আর চারপাশে আমেরিকার ভূমি ছুটছে ষাট মাইল প্রতি ঘণ্টা বেগে। কুয়াশা ঢেকে রেখেছে দূরের দিগন্ত।
গাড়ি চালাবার দ্বিতীয় দিনের কথা, মাঝ দুপুরে প্রায় পৌঁছে গেল ওরা। কী সব চিন্তা করে শ্যাডো বলল, ‘গত সপ্তাহে লেকসাইড থেকে একটা মেয়ে উধাও হয়ে গেছে। আমরা তখন স্যান ফ্রান্সিসকোতে ছিলাম।’
‘উম?’ আগ্রহী মনে হলো না ওয়েনসডেকে।
‘মেয়েটার নাম অ্যালিসন ম্যাকগভার্ন। এর আগেও কয়েকজন বাচ্চা উধাও হয়ে গেছিল। প্রতি শীতেই যায়।’
ভ্রু কুঁচকে তাকালেন ওয়েনসডে। ‘মর্মান্তিক ঘটনা, তাই না? দুধের কার্টনের পেছনে ছাপা বাচ্চাদের চেহারা দেখতে মায়াই লাগে। এখন অবশ্য ফ্রি-ওয়ের রেস্ট এরিয়ায় লাগানো থাকে পোস্টারগুলো: ‘আমাকে দেখেছেন কোথাও?’ সামনের এক্সিট দিয়ে বেরিয়ে যাও।’
শ্যাডোর মনে হলো, মাথার উপর দিয়ে বুঝি একটা হেলিকপ্টার যাচ্ছে। কিন্তু মেঘাচ্ছন্ন আকাশে মেঘ ভেদ করে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
‘লেকসাইডকেই কেন বেছে নিলেন আপনি?’ জানতে চাইল ও।
‘আগেই তো বলেছি। জায়গাটা তোমাকে লুকিয়ে রাখার জন্য ভালো। ওখানে তুমি আত্মগোপন করে রইবে।’
‘কিন্তু কেন?’
‘কেননা, এখন সেটা করাই গুরুত্বপূর্ণ। রাস্তার বাঁয়ে থেকো।’ বললেন ওয়েনসডে।
শ্যাডো বাঁয়ে ঘোরাল গাড়ির নাক।
‘ঝামেলা হবে মনে হচ্ছে।’ বললেন ওয়েনসডে। ‘ধ্যাত্তেরিকা, গতি কমাও। কিন্তু একেবারে থেমো না।’
‘আরেকটু ব্যাখ্যা করবেন?
‘ঝামেলা। অন্য কোনো রাস্তা চেন?’
‘নাহ। উত্তর ডাকোটায় এই প্রথম এলাম।’ বলল শ্যাডো। ‘কোথায় যাচ্ছি, তা-ও তো জানি না।’
পাহাড়ের অন্য পাশ থেকে লাল একটা আলো ভেসে এলো, কুয়াশায় হালকা দেখাচ্ছে।
‘রোডব্লক,’ বললেন ওয়েনসডে। কোটের পকেটে এক হাত ঢোকালেন তিনি, তারপর আরেক পকেটে। কিছু একটা খুঁজছেন বলে মনে হচ্ছে।
‘উলটো দিকে যাবো?’
‘যাওয়া যাবে না, শত্রুরা আমাদের পেছনেই আছে।’ বললেন ওয়েনসডে। ‘গতি কমিয়ে দশ-পনেরো মাইলে নামাও।’
আয়নার দিকে তাকাল শ্যাডো, পেছনেও হেডলাইটের আলো দেখা যাচ্ছে। বেশ কাছেই, খুব বেশি হলে এক মাইল হবে। ‘আপনি নিশ্চিত?’ জানতে চাইল সে।
নাক টানলেন ওয়েনসডে। ‘যতটুকু নিশ্চিত হওয়া সম্ভব।’ বললেন তিনি। ‘আহ, পেয়েছি!’ একটা সাদা চক বের করে দেখালেন শ্যাডোকে।
পরক্ষণেই প্রৌঢ় দেবতা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ড্যাশবোর্ডে চক দিয়ে আঁকিবুকি করার কাজে। দেখে মনে হচ্ছিল যে তিনি কোন অ্যালজেবরার ধাঁধাঁ মেলাবার চেষ্টা করছেন।
‘এবার,’ কিছুক্ষণ পর বললেন তিনি। ‘এবার গতি বাড়িয়ে ত্রিশ করো, এরপর আর গতি কমিয়ো না।’
পেছনের একটা গাড়ি সাইরেন বাজিয়ে গতি বাড়াল। ‘থেমো না, গতিও কমিয়ো না।’ ওয়েনসডে আবারও বললেন। ‘ওরা চায়, রোডব্লকের সামনে আমরা গতি কমাই।’ আবার আঁকিবুকি শুরু করলেন তিনি।
পাহাড় ধরে নামতে শুরু করল ওরা, রোডব্লকটা আর মাত্র পৌনে এক মাইল দূরে।
বারোটা গাড়ি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রাস্তা বন্ধ করে আছে। এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা পুলিসের গাড়ি-কালো অনেকগুলো এসইউভি।
‘কাজ শেষ,’ বললেন ওয়েনসডে, চকটাকে সরিয়ে রাখলেন। উইনিব্যাগোর ড্যাশবোর্ড এখন অগণিত রুন-অক্ষরে ভরতি। সাইরেন বাজানো গাড়িটা প্রায় কাছে চলে এসেছে। গতি কমিয়ে শ্যাডোদের গাড়ির সাথে তাল মিলিয়ে চলছে এখন। পেছন থেকে ভেসে আশা একটা উচ্চ আওয়াজ শুনতে পেল শ্যাডো-থামো! ওয়েনসডের দিকে তাকাল ও।
‘ডানে যাও,’ বললেন তিনি। ‘রাস্তার ঠিক পাশেই।’
‘এই গাড়ি রাস্তা ছাড়া চলবে না, উলটে যাবে।’
‘অসুবিধা হবে না। ডানে যাও, এখুনি!’
প্রাণপণে ডান দিকে স্টিয়ারিং হুইল ঘোরাল শ্যাডো। লাফিয়ে লাফিয়ে এগোল উইনিব্যাগো। এক মুহূর্তের জন্য ওর মনে হলো, সত্যি সত্যি গাড়িটা উলটে যাবে! কিন্তু ঠিক তখনই উইন্ডশিল্ডের সামনের দৃশ্যটা উধাও হয়ে গেল, মনে হলো যেন পরিষ্কার জলাধারে বাতাস দোলা দিয়েছে!
মেঘ উধাও হয়ে গেল, সাথে করে নিয়ে গেল তুষার, কুয়াশা আর দিনের আলো।
এখন মাথার ওপরে রয়েছে তারা, যেন রাতের আকাশকে খোঁচা দিচ্ছে আলোর বর্শা।
‘এখানেই থামো,’ বললেন ওয়েনসডে। ‘বাকি রাস্তাটা হেঁটে যেতে হবে।’ ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল শ্যাডো। উইনিব্যাগোর পেছন থেকে ওর কোট, বুট আর গ্লাভস বের করে নিলো। এরপর বলল, ‘চলুন, যাওয়া যাক।’
ওর দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালেন ওয়েনসডে, সেই দৃষ্টিতে সম্ভবত কিছুটা বিরক্তি…অথবা গর্বও ছিল। ‘কখনও তর্ক করো না কেন তুমি?’ জানতে চাইলেন তিনি। ‘কেন বলো না যে এসব অস্বাভাবিক? শান্তভাবে নাও কেন সবকিছু?’
‘কারণ আপনি আমাকে প্রশ্ন করার জন্য টাকা দেন না।’ বলল শ্যাডো। পরক্ষণেই টের পেল, মুখ থেকে সত্যটা বেরিয়ে এসেছে। ‘যাই হোক, লরার ব্যাপারটার পর আর কোনো কিছুই আমাকে অবাক করে না।’
‘ওর পুনরায় জীবিত হবার পর?’
‘ও যে রবির সাথে শুয়েছে, সেটা জানার পর। সেই ব্যাপারটায় কষ্ট পেয়েছি। বাকিগুলো খুব একটা গায়ে লাগেনি।’
কোন দিকে যেতে হবে, তা ইঙ্গিতে দেখালেন ওয়েনসডে। হাঁটতে শুরু করল ওরা, পায়ের নিচের মাটিটাকে মনে হলো পাথরের তৈরি। আগ্নেয়, মাঝে মাঝে কাচের মতো। বাতাসটা ঠান্ডা, তবে খুব বেশি না। কাত হয়ে একটা পাহাড় বেয়ে নামতে হলো ওদের। নামার রাস্তাটা রুক্ষ হলেও, সেটা ধরেই এগোল ওরা। পাহাড়ের নিচে নজর গেল শ্যাডোর।
‘ওটা কী?’ জানতে চাইল শ্যাডো। কিন্তু ওয়েনসডে ওর ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করিয়ে দিলেন।
জিনিসটা দেখতে যান্ত্রিক একটা মাকড়সার মতো। নীল ধাতব, ঝকঝক করতে থাকা এলইডি লাইট। আকারে একটা ট্রাক্টরের সমান। পাহাড়ের নিচে চুপচাপ বসে আছে। ওটার দুই পাশে হাড়ের স্তূপ। প্রতিটার ভেতরে একটা করে অগ্নিকুণ্ড, আকারে মোমের আগুনের চেয়ে খুব একটা বেশি বড়ো হবে না। দপদপ করছে ওটা।
শ্যাডোর দিকে ইঙ্গিত করে ওয়েনসডে বোঝালেন, ওগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে। সাবধান হবার জন্য এক পা পাশে যাবার প্রয়াস পেল ও। আর ভুলটা করল সেখানেই, কাচের রাস্তায় মচকে গেল তার পা। তাল হারিয়ে গড়াতে শুরু করল ও, হাত বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরতে চাইল একটা পাথর। অবসিডিয়ানের ধারালো কোনা ওর হাতের চামড়ার গ্লাভসটা এমনভাবে ছিঁড়ে ফেলল, যেন ওটা কাগজের তৈরি!
শ্যাডোর গড়ান থামল পাহাড়ের নিচে এসে, যান্ত্রিক মাকড়সা আর হাড়ের স্তূপের মাঝে।
অনেক কষ্টে নিজেকে টেনে তুলল ও। খেয়াল করে দেখল, একটা উরুর হাড়ের উপর পড়েছে তার হাত। আর ও…
…আর ও দাঁড়িয়ে আছে দিনের আলোতে। ধূমপান করছে আর হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। চারপাশে অনেকগুলো গাড়ি, কিছু খালি। কিছু ভরতি। কফির শেষ কাপটা খাবার জন্য এখন আফসোস হচ্ছে ওর। তলপেট প্রতিবাদ জানাচ্ছে, এই মুহূর্তে খালি না করলেই নয়।
স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একজন এগিয়ে এলো ওর দিকে, বিশালদেহী লোকটার গোঁফও বলার মতো। লোকটার নাম মনে করতে চাইল সে, কিন্তু পারল না।
‘কীভাবে পালাল, বুঝতে পারছি না,’ বলল বিশালদেহী, ক্ষমা প্রার্থনার সুর কণ্ঠে।
দেখার ভুল,’ মন্তব্য করল ও। ‘এরকম অদ্ভুত আবহাওয়া ওরকম ভুল হতেই পারে। কুয়াশার কারণে মরীচিকা দেখেছ আরকি। নিশ্চয়ই অন্য কোনো রাস্তা ধরে যাচ্ছিল ওই গাড়িটা। আমরা ভেবেছিলাম, তারা এদিকেই আছে।’
বিশালদেহীকে হতাশ বলে মনে হলো। ‘ওহ, আমি তো ভাবলাম আবার এক্স- ফাইলসের মতো কিছু হলো নাকি!’
‘তেমন উত্তেজনাকর কিছু হলে তো ভালোই হতো।’ বর্তমানের ওর পাইলসের সমস্যা আছে। চুলকাচ্ছে এখন জায়গাটা, মনে হচ্ছে সামনেই ঝামেলা শুরু হবে। গাড়িতে ফিরে যেতে মন চাচ্ছে ওর…মন চাচ্ছে একটা গাছের পেছনে গিয়ে খালি হয়ে আসতে। সিগারেট রাস্তায় ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেলল আগুন।
স্থানীয় বিশালদেহী পুলিস গাড়িগুলোর একটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল, ওটার ড্রাইভারের সাথে কী যেন বলাবলি করল সে।
লোকটা ফোন বের স্পর্শ করল মেন্যু লেখা জায়গাটা, নিচে নেমে খুঁজে বের করল ‘লন্ড্রি’ লেখা নামটা। ফোন করল সে।
একটা মেয়ে ধরল। ‘বলছি।
‘মিস্টার টাউন বলছি, মিস্টার ওয়ার্ল্ডকে চাই।’
‘দাঁড়ান, দেখি তিনি ফ্রি আছেন কি না।’
বেশ কিচ্ছুক্ষণ বজায় রইল নীরবতা। আড়াআড়ি হয়ে দাঁড়াল সে, বেল্টটা টেনে তুলল কোমরের ওপরে-কমপক্ষে দশ পাউন্ড ওজন কমাতে হবে। সেই সাথে মুত্রথলির উপর চাপও কমবে কিছুটা। আচমকা ফোনে ভেসে এলো একটা কণ্ঠ, ‘হ্যালো, মিস্টার টাউন।’
আমরা ওদেরকে হারিয়ে ফেলেছি,’ বলল টাউন। ঘৃণার একটা দলা পাকিয়ে উঠল ওর পাকস্থলীতে। এই হারামজাদারা উডি আর স্টোনকে খুন করেছে। লোক দুজন খুব ভালো ছিল। অবশ্য মিসেস স্টোনকে বিছানায় নিতে উদগ্র হয়ে আছে সে। বুঝতে পারছে না, আরও অপেক্ষা করবে…নাকি এখনই নেবে প্রথম পদক্ষেপ। এখন প্রতি সপ্তাহে-দুই সপ্তাহে মহিলাকে বাইরে খাওয়াতে নিয়ে যায় ও। ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ হিসেবেই দেখে ব্যাপারটাকে। একদিন-না- একদিন মহিলা অবশ্যই বুঝতে পারবে…
‘কীভাবে?’
‘আমি জানি না। আমরা রোডব্লকের ব্যবস্থা করেছিলাম। পালাবার উপায় ছিল না ওদের, কিন্তু তারপরেও কীভাবে যেন পালিয়ে গেল।’
‘জীবনের ছুড়ে দেওয়া অনেক রহস্যের একটা হবে। দুশ্চিন্তা করো না, স্থানীয়দের শান্ত করেছ তো?’
‘হ্যাঁ। মরীচিকা বলে বুঝিয়েছি।’
‘ওরা মেনে নিয়েছে?
‘সম্ভবত।
মি. ওয়ার্ল্ডের গলাটা কেমন যেন পরিচিত বলে মনে হচ্ছে-ভাবনাটা নিজের কাছেই অদ্ভুত বলে মনে হলো টাউনের। সরাসরি দুই বছর হলো লোকটার অধীনে কাজ করে সে, প্রায় প্রতিদিন কথা হয়। পরিচিত তো মনে হবেই।
‘এতক্ষণে অনেক দূরে চলে গেছে ওরা।’
‘রিজার্ভেশনে লোক পাঠাব?’
‘খাজনার চাইতে বাজনা বেশি হয়ে যাবে। কর্তৃপক্ষের সাথে গোলমাল করে লাভ নেই, এক দিনের জন্য যথেষ্ট হয়েছে। আমাদের হাতে সময়ের অভাব নেই। ফিরে এসো। পলিসি মিটিং ঠিকঠাকভাবে শেষ করা নিয়ে ব্যস্ত আমি।
কোনো সমস্যা?’
‘হচ্ছে কিছু।’
‘আমি কোনো সাহায্য করতে পারি?’
এখনও দরকার নেই। আশা করি সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারব। ‘ঠিক আছে, স্যার।’
‘বিদায়, টাউন।’
ফোন কেটে গেল।
টাউনের মনে হলো, একটা সোয়াট টিম নিয়ে ওই উইনিব্যাগোকে আটকাতে পারলেই ভালো হতো। আর তা হলে রাস্তায় ল্যান্ড মাইন বিছিয়ে দিলেও মন্দ হতো না। ওই হারামজাদাদের বুঝিয়ে দেওয়া যেত, কতটা সিরিয়াস টাউনরা। মি. ওয়ার্ল্ড একদা ওকে বলেছিল: আগুনের অক্ষর ব্যবহার করে আমরা ভবিষ্যতের গল্প লিখছি। মি. টাউনের মনে হলো, এখনই প্রস্রাব না করলে সম্ভবত ওর একটা কিডনি নষ্ট হয়ে যাবে…
.
…শ্যাডোর হাতের মুঠোর আঙুলগুলো একটা একটা করে খুলল কেউ একজন, উরুর হাড়টা সরিয়ে নিলো।
প্রস্রাবের চাপটা আর নেই; এতক্ষণে উপলব্ধি করতে পারল ও-লোকটা অন্য কেউ ছিল। এই মুহূর্তে শ্যাডো দাঁড়িয়ে আছে খোলা আকাশের নিচে, পাথুরে একটা জমিতে।
শ্যাডোকে আবার চুপ করার ইঙ্গিত দিলেন ওয়েনসডে, তারপর হাঁটতে শুরু করলেন। পিছু নিলো ও।
যান্ত্রিক মাকড়শাটা গুঙিয়ে উঠল হঠাৎ, চমকে উঠলেন ওয়েনসডে। থমকে দাঁড়াল শ্যাডো। যন্ত্রটার গায়ে জ্বলে উঠল লাল আলো। শ্বাস নিতেও যেন ভুলে গেল বেচারা।
একটু আগে ঘটা ঘটনাটা মনে করল শ্যাডো, মনে হচ্ছিল যেন অন্য কারও মনের ভেতরটায় বাসা গেঁড়ে বসেছে সে। তারপর ভাবল, মি. ওয়ার্ল্ড। আমার কাছে তার গলা পরিচিত বলে মনে হচ্ছিল। চিন্তাটা এসেছিল আমার চিন্তায়, টাউনের না। এজন্যই ব্যাপারটা অদ্ভুত বলে মনে হচ্ছিল। অনেক ভেবেও, কণ্ঠটা কার তা মনে করতে পারছিল না।
মনে পড়বে, ভাবল শ্যাডো। আজ হোক আর কাল, মনে পড়বেই।
লাল আলো পরিণত হলো নীলে, তারপর আবার লালে। শেষ পর্যন্ত হালকা লাল হয়ে শান্ত হলো যান্ত্রিক মাকড়শা। সামনে এগোতে শুরু করলেন ওয়েনসডে, তারার নিচে একাকী একটা অবয়ব। মাথায় হ্যাট, বাতাসে পতপত করে উড়ছে আলখাল্লা। হাতের ছড়িটা পাথুরে মাটিতে ঠক ঠক করছে।
যান্ত্রিক মাকড়শাটাকে অনেক পেছনে ফেলে আসার পর, ওয়েনসডে মুখ খুললেন। ‘এখন কথা বললে অসুবিধে হবে বলে মনে হয় না।’
‘আমরা কোথায়?’
‘দৃশ্যপটের পেছনে।’ বললেন ওয়েনসডে।
‘মানে?’
‘ধরে নাও এই জায়গাটা দৃশ্যপটের পেছনে থাকে, নাট্যমঞ্চের পেছনের দরজা দিয়েই কেবল যেখানে প্রবেশ করা যায়। আমরা এতক্ষণ ছিলাম দর্শকদের সারিতে, এবার চলে এসেছি পেছনে।’
‘যখন ওই হাড়টা স্পর্শ করলাম, তখন টাউন নামের এক লোকের মনের ভেতর চলে গেছিলাম আমি। লোকটা কিম্ভূতদের একজন, আমাদেরকে প্রচণ্ড ঘৃণা করে।’
‘হুম।’
‘ওর বসের নাম মিস্টার ওয়ার্ল্ড। আমাকে যেন কার কথা মনে করিয়ে দেয় সে, কিন্তু ধরতে পারছি না। আমি সম্ভবত টাউনের মন দখল করে নিয়েছিলাম। নিশ্চিত নই যদিও।’
‘আমরা কোথায় যাচ্ছি, তা কি সে জানে?’
‘আপাতত আমাদের পিছু ধাওয়া করা বন্ধ করছে। রিজার্ভেশনে যেতে চায় না বলে। আমরা রিজার্ভেশনে যাচ্ছি?’
‘হয়তো,’ ছড়ির উপর ভর দিয়ে একটু বিশ্রাম নিলেন ওয়েনসডে। তারপর আর হাঁটতে শুরু করলেন।
‘ওই মাকড়শার মতো জিনিসটা কী ছিল?’
‘সার্চ ইঞ্জিন, প্যাটার্ন ম্যানিফেসটেশন।’
‘বিপজ্জনক?’
‘আমার সমান বয়সি হতে হলে, সবসময় বাজে ধারণাটাই আগে করতে হয়।’
হাসল শ্যাডো। ‘কত বয়স?’
‘আমার জিহ্বার যত বয়স, তত।’ বললেন ওয়েনসডে। ‘তবে আমার দাঁতের চাইতে কয়েকমাস বেশি।’
‘আপনার মুখ খোলানো খুব কঠিন।’ বলল শ্যাডো।
ওয়েনসডে ঘোঁত করলেন কেবল।
.
এরপর পথে পড়া প্রতিটা পাহাড় চড়া কঠিন থেকে কঠিনতর হতে শুরু করল।
মাথাব্যথা শুরু হলো শ্যাডোর। পরবর্তী পাহাড়টার নিচে হোঁচট খেল সে, কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলল বটে। কিন্তু শব্দ বের না হয়ে বেরিয়ে এলো বমি!
ওয়েনসডে কোটের ভেতরের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা ছোটো ফ্লাস্ক বের করে আনলেন। ‘একটা চুমুক দাও। সাবধান, মাত্র এক চুমুক।’
ঝাঁঝালো স্বাদ তরলটা। মুখে দেওয়ামাত্র এমনভাবে উধাও হয়ে গেল, যেমনটা যায় ভালো মানের ব্র্যান্ডি। তবে মদ বলে মনে হলো না জিনিসটাকে। ফ্লাস্কটা সরিয়ে নিয়ে আবার পকেটে ভরলেন ওয়েনসডে। দর্শকদের আসলে নাট্যমঞ্চের পেছনে যাওয়া ঠিক না। সেজন্যই তোমার অসুস্থবোধ হচ্ছে। তাড়াতাড়ি এখান থেকে বেরোতে হবে আমাদেরকে।’
হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল ওরা। ওয়েনসডের অসুবিধা হচ্ছে না, তবে শ্যাডো মাঝে মাঝে হোঁচট খাচ্ছে; অবশ্য পান করার পর থেকে কিছুটা ভালো লাগছে।
ওয়েনসডে ওর হাত ধরলেন। ‘ওই যে,’ বাঁ দিকের দুটো একই রকম দেখতে পাথর-কাচের স্তূপের দিকে ইঙ্গিত করলেন তিনি। ‘ওই দুই স্তূপের ভেতর দিয়ে যেতে হবে আমাদের। পাশেই থেকো।’
হাঁটল ওরা, ঠান্ডা বাতাস আর দিনের উজ্জ্বল আলো মাঝে মাঝেই এসে পড়ল শ্যাডোর চেহারায়।
একটা পাহাড়ের মাঝমাঝিতে আছে ওরা এখন, কুয়াশার হদিস নেই। রৌদ্রজ্জ্বল একটা দিন, আকাশ নীল। পাহাড়ের পাদদেশে একটা খোয়া বিছানো রাস্তা। লাল একটা স্টেশন ওয়্যাগন ঝাঁকি খেতে খেতে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। কাছের একটা দালান থেকে বেরোচ্ছে জ্বলন্ত কাঠের ধোঁয়া। মনে হচ্ছে, কেউ যেন একটা মোবাইল হোম নিয়ে এসে বছর ত্রিশেক আগে ওই পাহাড়ের ধারে ফেলে রেখেছে। পরবর্তী সময়ে অনেকবার মেরামত করা হয়েছে ওটাকে।
মোবাইল হোমটার কাছে ওরা পৌঁছানো মাত্র, খুলে গেল দরজাটা। মাঝবয়সি তীক্ষ্ণ চোখ আর মুখ বিশিষ্ট এক লোক ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হুম, শুনলাম যে দুজন সাদা মানুষ আমার সাথে দেখা করতে আসছে। তা-ও একটা উইনিব্যাগোতে চড়ে। আরও শুনলাম, রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে তারা! আসলে রাস্তার পাশে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে না রাখলে সাদা মানুষ কিছু খুঁজেই পায় না। যাক, অন্তত আসতে তো পেরেছ! এই মুহূর্তে লাকোটা জমিতে দাঁড়িয়ে আছ তোমরা, জানো?’ লোকটা চুল অনেক লম্বা…আর ধূসর।
‘তুমি আবার লাকোটা হলে কবে? প্রতারক কোথাকার।’ বললেন ওয়েনসড়ে। এখন তার দেহে একটা কোট আর মাথায় ক্যাপ! অথচ এই একটু আগেই আলখাল্লা আর মাথায় হ্যাট ছিল। ‘শোনো, হুইস্কি জ্যাক। আমার ক্ষুধা লেগেছে। আর আমার এই বন্ধু একটু আগে বমি করে উগড়ে দিয়েছে সকালের নাস্তা। ভেতরে আমন্ত্রণ জানাবে কিনা বলো।’
বগল চুলকালো হুইস্কি জ্যাক। পরনে তার নীল জিন্স আর ধূসর একটা আন্ডারশার্ট। পায়ে রয়েছে মোকাসিন, ঠান্ডা কাবু করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। আচমকা লোকটা বলল, ‘আমার জায়গাটা পছন্দ। যাই হোক, ভেতরে এসো।
ট্রেইলারের ভেতরে সম্ভবত বাতাস কম আর ধোঁয়া বেশি। আরেকজন মানুষ বসে আছে টেবিলে। এই লোকটার পরনে বাকস্কিন, পা খালি। দেহের রং বাদামি।
ওয়েনসডে খুব খুশি বলে মনে হলো। ‘হুম,’ বললেন তিনি। ‘দেরি করে লাভই হয়েছে দেখছি। হুইস্কি জ্যাক আর আপেল জনি। এক ঢিলে দুই পাখি!’
টেবিলে বসে থাকা লোকটা, আপেল জনি, ওয়েনসডের দিকে তাকাল। তারপর যৌনাঙ্গ আঁকড়ে ধরে বলল, ‘আবারও ভুল করেছ। এইমাত্র পরখ করে দেখলাম, আমার আপেল জায়গামতোই আছে।’ শ্যাডোর দিকে তাকিয়ে হাত তুলল সে, তালু বাইরের দিকে। ‘আমি জন চ্যাপম্যান। তোমার বস আমার সম্পর্কে কী বলে, সে কথায় কান দিয়ো না। লোকটা একটা হাড়-হারামি। আজীবন তাই ছিল, সবসময় তাই থাকবে। কেউ কেউ তেমনই হয়।’
‘আমি মাইক আইনসেল।’ বলল শ্যাডো।
খোঁচা খোঁচা দাড়ি ওঠা থুতনি চুলকাল চ্যাপম্যান। ‘আইনসেল,’ বলল সে। ‘নামটা খুব একটা ভালো না, তবে কাজ চলবে। তোমার আসল নাম কি?’
‘শ্যাডো।’
‘আমিও তোমাকে শ্যাডো বলেই ডাকব। ওই, হুইস্কি জ্যাক—’ কানে শব্দটা ওরকম শোনালেও, আসলে লোকটা ‘হুইস্কি জ্যাক’ বলছে না, বুঝতে পারল শ্যাডো। ‘খাবারের অবস্থা কী?’
হুইস্কি জ্যাক এগিয়ে একটা লোহার পটের ঢাকনা তুলল। ‘খাওয়া যাবে।’
চারটা প্লাস্টিকের পেয়ালা নিয়ে পটের ভেতরের খাবারগুলো তাতে ঢালল সে। ওগুলো টেবিলের উপর রেখে দিয়ে পা রাখল বাইরের তুষারে। বরফের ভেতরে পুতে রাখা একটা প্লাস্টিকে জগ বের করে আনল, ওটাকে ভেতরে নিয়ে এসে চারটা গ্লাসে ঢালল হলদে-বাদামি তরল। টেবিলে রাখা পেয়ালাগুলোর পাশে রাখল গ্লাসগুলো। একদম শেষে রাখল চারটা চামচ। তারপর অন্যদের সাথে টেবিলে বসল ও।
চোখে সন্দেহ নিয়ে গ্লাসটার দিকে তাকালেন ওয়েনসডে। ‘দেখে তো পেশাব মনে হচ্ছে।’
‘এখনও ওগুলো পান করো নাকি?’ জানতে চাইল হুইস্কি জ্যাক। ‘তোমরা…সাদা মানুষেরা আসলে পাগল। এইটা অনেক ভালো এক পানীয়।’ তারপর শ্যাডোর দিকে ফিরে বলল, ‘বুনো টার্কির স্ট্যু ওটা, অ্যাপলজ্যাক এনেছে জন।
‘অ্যাপেলজ্যাক আসলে হালকা অ্যাপল সাইডার।’ বলল জন চ্যাপম্যান। ‘মদের প্রতি আমার কখনওই খুব একটা বিশ্বাস ছিল না। ওটা মানুষকে পাগল করে তোলে।’
দারুণ সুস্বাদু ছিল স্ট্যুটা, পানীয়ও কম যায় না। নিজেকে জোর করে নিয়ন্ত্রণ করল শ্যাডো, নইলে হয়তো ঢক ঢক করে গিলে ফেলত। এক পেয়ালা শেষ করে আরেক পেয়ালা নিলো ও, সেই সাথে আরেক গ্লাস অ্যাপল সাইডার।
‘গুজব শুনতে পাচ্ছি যে তুমি নাকি সবার সাথে কথা বলছ। যে যা চাইছে, তাকে তা-ই দেবার প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছ? যুদ্ধের দামামা বাজাবে নাকি?’ জানতে চাইল জন চ্যাপম্যান। শ্যাডো আর হুইস্কি জ্যাক পেয়ালা-গ্লাস ধোওয়া আর বেঁচে যাওয়া স্ট্যু তুলে রাখার কাজে ব্যস্ত।
‘গ্রীষ্মে ঘটা ঘটনাগুলো সংক্ষেপে বললে অমনটাই হবে,’ বললেন ওয়েনসডে।
‘ওরাই জিতবে,’ সরাসরি বলল হুইস্কি জ্যাক। ‘আসলে এরইমধ্যে জিতে গেছে। আর তুমি হেরেছ। যেমনটা হয়েছিল আমার লোক আর সাদাদের ভেতরে। অধিকাংশ সময় জিতেছে তারাই, আর যখন হেরেছে তখন চুক্তি করেছে। তারপর সময় সুযোগ বুঝে ভেঙে ফেলেছে সেই চুক্তি। আরেকটা অহেতুক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ইচ্ছা নেই আমার।’
‘আর আমার সাহায্য চেয়ে লাভ নেই,’ বলল জন চ্যাপম্যান। ‘আমি তোমাদের হয়ে লড়তে চাইলেও, কাজে আসব না। আর লড়তে আমি চাই-ও না। আমাকে ভুলে গেছে সবাই,’ একটু থমকে যোগ করল। ‘পল বানিয়ান।’ মাথাটা হালকা করে নাড়িয়ে আবার বলল, ‘পল বানিয়ান।’ দুই শব্দে এতকিছু প্রকাশ করতে আগে কখনও শোনেনি শ্যাডো।
‘পল বানিয়ান,’ বলল সে। ‘এই লোক আবার কী করল?
‘মাথার ভেতরের জায়গা দখল করেছে,’ ওয়েনসডের কাছ থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ধরাল হুইস্কি জ্যাক।
‘উদাহরণ দিই। হামিংবার্ডদের ওজন নিয়ে বা দাঁত ক্ষয় নিয়ে চিন্তিত বলে, তাদের খাবারে চিনি দেওয়া বন্ধ করে দিল কিছু মানুষ,’ ব্যাখ্যা করলেন ওয়েনসডে। ‘বদলে দিল নিউট্রাসুইট। পাখিগুলো তা খেয়ে মরতে শুরু করে একে একে। কেননা ওদের পেট ভরতি খাবার থাকলেও, সেই খাবারে ক্যালরি নেই! পল বানিয়ানও তাই। কেউ পল বানিয়ানের ব্যাপারে প্রচলিত গল্পগুলো কাউকে বলিনি। নেই তার অস্তিত্বও! সেই ১৯১০ সাথে আচমকা পাদ-প্রদীপের আলোতে তার আগমন। এরপর আর কী, জাতির পেট এখন ক্যালোরিহীন খাবারে ভরতি!’
‘আমার কিন্তু পল বানিয়ানকে বেশ পছন্দ,’ বলল হুইস্কি জ্যাক। ‘মল অভ আমেরিকায় কয়েক বছর আগে গেছিলাম। ওকে নিয়ে আমার আপত্তি নেই। সে কল্পিত হলেও না। অন্তত কল্পিত হলে আমরা ধরে নিতে পারি, কখনও গাছ কাটতে হয়নি ওকে! মন্দের ভালো বলা যায়।’
‘এক নাগাড়ে অনেক কথা বলে ফেললে দেখি।’ বলল জনি চ্যাপম্যান।
ওয়েনসডেও সিগারেট ধরিয়েছেন, ধোঁয়া ছাড়লেন তিনি। আস্তে আস্তে বাতাসে মিলিয়ে গেল ধোঁয়া। ‘হুইস্কি জ্যাক, তোমার কী মত?’
‘আমি তোমাকে সাহায্য করব না,’ বলল হুইস্কি জ্যাক। ‘গোহারা হারার পর, যদি কখনও চাও তো ফিরে এসো। আমি এখানেই থাকলে তোমাকে খাবার রেঁধে খাওয়াব।’
‘ভেবে-চিন্তে বলছ তো?’ বললেন ওয়েনসডে। ‘বিকল্পটা কিন্তু খুব ভয়ঙ্কর।’
‘বিকল্পটা যে কী, তা তুমি নিজেও জানো না,’ বলল হুইস্কি জ্যাক। শ্যাডোর দিকে তাকিয়ে যোগ করলো। ‘তুমি কিছু একটা খুঁজছ।’
‘নাহ, কাজ করছি।’ বলল শ্যাডো।
মাথা নাড়ল হুইস্কি জ্যাক। ‘সেই সাথে কিছু একটা খুঁজছ। কারও ঋণ শোধ করতে চাও—’
লরার নীল ঠোঁট আর হাতে লেগে থাকা রক্তের কথা মনে পড়ে গেল শ্যাডো মাথা দোলাল ও।
‘একটা গল্প শোনো। প্রথমে দুনিয়াতে এসেছিল একটা শেয়াল, তার ভাই ছিল নেকড়ে। শেয়াল বলল, মানুষ চিরদিন বেঁচে থাকবে। যদি মারাও যায়, তবুও ফিরে আসবে খুব দ্রুতই। নেকড়ে বলল, নাহ। মানুষকে মারা যেতে হবে, জীবিত সবকিছুকেই মরতে হবে। নইলে সারা দুনিয়া দখল করে বসবে তারা। সব স্যামন, ক্যারিবু আর মহিষ খেয়ে ফেলবে। ভুট্টা আর যবও বাদ যাবে না। একদিন মারা গেল নেকড়ে, শেয়ালকে অনুরোধ করল তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য। কিন্তু শেয়াল জবাব দিল না। মৃতকে মৃতই থাকতে হবে। তোমার কথা আমাকে প্রভাবিত করেছে। কথাগুলো বলার সময় চোখ দিয়ে পানি বইছিল বেচারার। তাই এখন নেকড়ে চালায় মৃতদের দুনিয়া। আর শেয়াল বাস করে সূর্য আর চাঁদের আলোতে, এখনও আফসোস করে ভাইয়ের মৃত্যুর।’
ওয়েনসডে বললেন, ‘রাজি না হলে, রাজি হবে না। আমরা সামনে এগোব।’
হুইস্কি জ্যাকের চেহারা ভাবলেশহীন। ‘আমি এই যুবকের সাথে কথা বলছি।’ বলল সে। ‘তুমি আমাদের সাহায্যের বাইরে চলে গেছ। কিন্তু এই ছেলেটা যায়নি।’ শ্যাডোর দিকে ফিরল সে। ‘তোমার স্বপ্নের কথাটা বলো।’
শ্যাডো বলল, ‘দেখলাম, আমি খুলির একটা পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠছি। অনেকগুলো বিশাল বিশাল পাখি উড়ছিল ওটাকে কেন্দ্রে রেখে। ওদের পাখায় ভর করেছিল বিদ্যুৎ। আমাকে আক্রমণ করল তারা, ধসে পড়ল পাহাড়।’
‘সবাই স্বপ্ন দেখে,’ বললেন ওয়েনসডে। ‘এবার আমরা রওনা দিতে পারি?’
‘সবাই ওয়াকিনাইয়ু, থান্ডারবার্ডের স্বপ্ন দেখা না।’ বলল হুইস্কি জ্যাক। ‘আমরা এখান থেকেও তা টের পেয়েছি।’
‘আমিই তো তোমাকে বললাম!’ বললেন ওয়েনসড়ে।
‘পশ্চিম ভার্জিনিয়ায় কিছু থান্ডারবার্ড আছে।’ জানাল চ্যাপম্যান। ‘সংখ্যায় বেশি না হলেও কিছু মেয়ে আর একটা বুড়ো পুরুষ তো আছেই। একজোড়া সন্তান-ধারণক্ষম দম্পতিও আছে। অবশ্য কখনওই সংখ্যায় ওরা খুব বেশি ছিল না।’
লাল কাদার মতো দেখতে একটা হাত বাড়িয়ে শ্যাডোর চেহারা স্পর্শ করল হুইস্কি জ্যাক। ‘থান্ডারবার্ড শিকার করলে তোমার স্ত্রীকে ফেরত আনতে পারবে। তবে এখন ওর মালিক নেকড়ে, তার স্থান মৃতদের মাঝে; জীবিতদের মাঝে নয়।’
‘তুমি তা কীভাবে জানো?’ জানতে চাইল শ্যাডো।
ঠোঁট না নাড়িয়েই জানতে চাইল হুইস্কি জ্যাক। ‘মহিষ-মানব কী বলেছে?’
‘বিশ্বাস রাখতে।’
‘শুনবে তার কথা?’
‘উম…হ্যা,’ শব্দ উচ্চারণ না করেই কথা বলছে তারা। শ্যাডো একবার ভাবল, অন্য দুজন কি ওদেরকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছে? আর দেখলেও, কতক্ষণের জন্য? এক হৃৎস্পন্দন? নাকি আরও বেশি?
‘তোমার গোত্রকে খুঁজে বের করে,’ বলল হুইস্কি জ্যাক। ‘আমার কাছে ফিরে এসো। আমি সাহায্য করতে পারব।’
‘আসব।’
হুইস্কি জ্যাক হাত সরিয়ে নিলো। তারপর ওয়েনসডেকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার হো চাঙ্কের কী হবে?’
‘আমার কী?’
‘হো চাঙ্ক। উইনিব্যাগোরা নিজেকে সে নামেই ডাকে।’
মাথা নাড়লেন ওয়েনসডে। ‘নিয়ে আসাটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়, সমস্যায় পড়ার সম্ভাবনা আছে। ওটাকে খুঁজছে সবাই।’
‘চুরি করা নাকি?’
আহত মনে হলো ওয়েনসডেকে। ‘একদম না। কাগজ সামনের গ্লাভ কম্পার্টমেন্টেই আছে।’
‘চাবি?’
‘আমার কাছে।’ বলল শ্যাডো।
‘আমার ভাতিজা, হ্যারি ক্লজের একটা বুইক আছে। ১৯৮১ সালের, অদল- বদল করবে?’
শিস দিলেন ওয়েনসডে। ‘এটা কেমন ব্যাবসা হলো?’
শ্রাগ করল হুইস্কি জ্যাক। ‘যেখানে তোমাদের গাড়ি ফেলে এসেছ…ওখান থেকে ওটা ফিরিয়ে নিয়ে আসা কতটা কষ্ট হবে, ভেবেছ? আমি বরঞ্চ তোমার উপকারই করছি। প্রস্তাবটা মানলে মানো, না মানলে ভাগো। আমার কি?’
ওয়েনসডেকে দেখে রাগান্বিত মনে হলো, তারপর সেই রাগ পরিণত হলো আমোদে। ‘শ্যাডো, লোকটাকে উইনিব্যাগোর চাবি দিয়ে দাও।’ তাই করল ও। ‘জনি,’ বলল হুইস্কি জ্যাক। ‘এই লোকগুলোকে হ্যারি ব্লুজের কাছে নিয়ে যাবে। ওকে বলো, আমি এদেরকে ওর গাড়িটা দিয়ে দিতে বলেছি।’
‘অবশ্যই।’ বলল জন চ্যাপম্যান। উঠে দাঁড়িয়ে চলে গেল দরজার কাছে। পাশেই থাকা একটা ছোটো বারলাপ স্যাক তুলে নিয়ে দরজা খুলে বাইরে পা রাখল। শ্যাডো আর ওয়েনসডে তার পিছু নিলো। দোড়গোরায় দাঁড়িয়ে বিদায় দিল হুইস্কি জ্যাক। ‘ওই,’ ওয়েনসডেকে বলল সে। ‘আর ফিরে এসো না। এখানে তোমাকে কেউ চায় না।’
আসমানের দিকে আঙুল তুলে ইঙ্গিত করলেন ওয়েনসডে। ‘উচ্ছন্নে যাও।’ তুষার ঠেলে নিচের দিকে যেতে শুরু করল ওরা। চ্যাপম্যান সামনে দাঁড়িয়ে। তার নগ্ন পা বরফে ছাপ রেখে এগোচ্ছে। ‘ঠান্ডা লাগে না?’ জানতে চাইল শ্যাডো।
‘আমার স্ত্রী চকতো ইন্ডিয়ান ছিল।’ জানাল চ্যাপম্যান।
‘তোমাকে ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচার জাদু শিখিয়ে গেছে?’
‘না। ওর ধারণা ছিল, আমি পাগল,’ বলল চ্যাপম্যান। ‘সব সময় বলত, ‘জনি, বুট পরে নিলেই তো হয়।’ পাহাড়ের ঢাল আচমকা খাড়া হয়ে গেলে, কথা বলা বন্ধ করল ওরা। হোঁচট খেতে খেতে এগোল তিনজন। নিজেদেরকে সামলাবার জন্য পাশে থাকা বার্চ গাছগুলো ধরতে হলো তাদের, নইলে আছাড় খেত হয়তো। পথ একটু সমতল হলে চ্যাপম্যান বলল, ‘এখন আর বেঁচে নেই মহিলা। তার মৃত্যুর সাথে সাথে আমি কিছুটা উন্মাদ হয়ে গেছিলাম বলতে পারো। ব্যাপারটা যে কারও সাথে ঘটতে পারে, এমনকি তোমার সাথেও।’ শ্যাডোর হাতে চাপড় দিল সে। ‘হে যিশু, তুমি তো দেখি বিশালদেহী এক মানুষ!’
‘লোকে তাই বলে।’ বলল শ্যাডো।
প্রায় আধ-ঘণ্টা পাহাড় বেয়ে নিচে নামল ওরা। এরপর এগোতে শুরু করল খোয়া বিছানো একটা পথ ধরে। যে দালানগুলোর দিকে এগোচ্ছে, সেগুলো পাহাড় থেকেই দেখা যাচ্ছিল। আচমকা একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল ওদের পাশে। চালক মহিলা। জানালার কাচ নামিয়ে জানতে চাইল, ‘তোমাদের সাহায্য দরকার?’
‘আপনাকে অনেক দয়া, ম্যাডাম।’ বললেন ওয়েনসডে। ‘আমরা মিস্টার হ্যারি ব্লুজে-কে খুঁজছি।’
‘ওকে রেক হলে পাবে।’ বলল মহিলা, বয়স চল্লিশের ঘরে হবে। উঠে পড়ো।’
প্যাসেঞ্জার সিটে বসলেন ওয়েনসডে। জন চ্যাপম্যান আর শ্যাডো উঠল পেছনে। শ্যাডো এত লম্বা যে পা ভাঁজ করেও বসতে বেগ পেতে হলো ওকে। যাই হোক, ঝাঁকি খেতে খেত এগোল গাড়িটা।
‘তোমরা তিনজন কোত্থেকে এলে?’ জানতে চাইল মহিলা।
‘এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে গেছিলাম।’ উত্তরে বললেন ওয়েনসডে।
‘পেছনের ওই পাহাড়ে বাস করে। যোগ করল শ্যাডো।
‘পাহাড়? কোন পাহাড়?’ জানতে চাইল মহিলা।
গাড়ির রিয়ার উইন্ডো দিয়ে পেছনে তাকাল শ্যাডো। কিন্তু না, পাহাড় নেই ওখানে! কেবল মেঘ আর মেঘ।
‘হুইস্কি জ্যাক।’ নামটা উচ্চারণ করল ও।
‘আহ,’ বলল ড্রাইভার। ‘আমরা ওকে ইনকটমি বলে ডাকি। আমার ধারণা, দুজন একই। দাদার কাছে তার ব্যাপারে অনেক গল্প শুনেছি।’ রাস্তায় ঝাঁকি খেয়ে লাফিয়ে উঠল গাড়ি, গাল বকল মহিলা। ‘তুমি ঠিক আছ?’
‘জি, ম্যাম।’ বলল জনি চ্যাপম্যান। দুই হাতে সিট ধরে আছে সে।
‘রেজের রাস্তা,’ বলল মহিলা। ‘আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে যাবে।’
‘সবগুলোই এমন?’ জানতে চাইল শ্যাডো।
‘মোটামুটি। এখানকারগুলো এমনই। ক্যাসিনোর টাকা কোথায় যায়, সেই প্ৰশ্ন করো না। এমন একটা জায়গায় আসবেটা কে?’
‘আমি দুঃখিত।’
‘তার দরকার নেই,’ গিয়ার পরিবর্তন করল মহিলা। ‘এখানকার সাদা মানুষদের সংখ্যা ক্রমেই কমছে। শহরের পর শহর জনশূন্য হচ্ছে দিন দিন। টেলিভিশনের পর্দায় একবার নজর রাখার পর, খামারে তাদেরকে আটকে রাখবে কীভাবে? আমাদের কাছ থেকে সাদারা আমাদেরই জমি কেড়ে নিয়েছিল, আবাস গেড়েছিল। আর এখন আবার চলেও যাচ্ছে। ওদের অধিকাংশই যায় দক্ষিণে। কিছু যায় পশ্চিমে। আমার তো মনে হয়, আর কিছুদিন অপেক্ষা করলে যুদ্ধ ছাড়াই ফিরিয়ে নিতে পারব আমাদের জমি।’
‘আমার শুভকামনা রইল।’ বলল শ্যাডো।
রেক হলে, পুল টেবিলে খুঁজে পাওয়া গেল হ্যারি ব্লুজে-কে। মেয়েদেরকে পটাবার জন্য পুল খেলায় দক্ষতা দেখাচ্ছে। ডান হাতের পেছনে একটা ক্লজে ট্যাটু করে রেখেছে সে। ডান কানে দুল পরেছে অনেকগুলো।
‘হো হোকা, হ্যারি ব্লুজে।’ বলল জন চ্যাপম্যান।
‘চুলায় যাও,’ এমনভাবে বলল হ্যারি যেন কথাটা কোনো গুরুত্বই রাখে না। ‘তোমাকে দেখলেই বিতৃষ্ণা জন্মে মনে।’
ঘরের অন্য পাশে বয়স্ক কিছু লোক বসে আছে। কয়েকজন তাস খেলছে, কয়েকজন কথা-বার্তা বলতে ব্যস্ত। হ্যারির বয়সিও আছে বেশ কজন, নিজেদের পালার জন্য অপেক্ষা করছে। পুল টেবিলটা সচরাচর আকৃতির, একপাশে চটে গেছে। রুপালি ডাক্ট টেপ ব্যবহার করে ঢেকে রাখা হয়েছে ওটা।
‘তোমার চাচার কাছ থেকে একটা মেসেজ এনেছি।’ পাত্তা না দিয়ে বলল চ্যাপম্যান। ‘তোমার গাড়িটা এই দুজনকে দিয়ে দিতে বলেছে।’
হলে কম করে হলেও ত্রিশ বা চল্লিশজন মানুষ আছে, সবাই এখন হয় তাদের তাসের দিকে…আর নয়তো পায়ের দিকে…অথবা আঙুলের দিকে তাকিয়ে আছে তীব্র মনোযোগে। এমন ভান করছে যেন কিছু শোনেনি।
‘লোকটা আমার চাচা নয়।’
দাঁত বের করে হাসল চ্যাপম্যান, এমন বাজে দাঁত আগে কোন মানুষের মুখে দেখেনি শ্যাডো। ‘তোমার চাচাকে বলব কথাটা? সে তো বলে, একমাত্র তোমার জন্যই সে লাকোটায় আছে।’
‘হুইস্কি জ্যাক অনেক কিছুই বলে। ঠাট্টার সুরে বলল হ্যারি ব্লুজে। অবশ্য এই ছেলেটাও ‘হুইস্কি জ্যাক’ উচ্চারণ করেনি। খুব সম্ভব ‘উইসকাডজাক’ বলেছে।
শ্যাডো বলল, ‘আরেকটা কথাও বলেছে, বিনিময়ে তুমি আমাদের উইনিব্যাগো পাবে।’
‘কই সেটা?’
‘এখানে নেই, হুইস্কি জ্যাক আনবে পরে,’ বলল জন চ্যাপম্যান। ‘ওর কথায় বিশ্বাস রাখা যায়।’
একটা ট্রিক শট খেলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো হ্যারি ব্লুজে, ওর হাত কাঁপছে। ‘আমি ওই বুড়ো শেয়ালের ভাতিজা নই। লোকটা আর কাউকে এই কথা না বললেই খুশি হতাম।’
‘মৃত নেকড়ের চাইতে জীবিত শেয়াল ভালো।’ গভীর কণ্ঠে বললেন ওয়েনসডে। ‘তোমার গাড়ি দেবে কি না বলো।’
কেঁপে উঠল হ্যারি ব্লুজে। ‘অবশ্যই,’ বলল সে। ‘আমি তো শুধু দুষ্টামি করছিলাম। সারাক্ষণই করি।’ খেলার ছড়িটা টেবিলে নামিয়ে একটা পুরু জ্যাকেট হাতে নিলো ও। ‘আগে আমার জিনিসগুলো বের করে নেই।’
বার বার আড়চোখে ওয়েনসডের দিকে তাকাচ্ছিল সে, যেন ভয় পাচ্ছে প্রৌঢ়কে!
হ্যারি ক্লজের গাড়িটা মাত্র একশ মিটার দূরে। ওদিকে যেতে যেতে পথে একটা সাদা চুনকাম করা গির্জা পড়ল। যাজকের পোশাক পরা একজন দরজার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে সিগারেট তার, তবে চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না যে ওটা টেনে মজা পাচ্ছে সে।
‘আপনার দিনটা সুখে কাটুক, ফাদার!’ চিৎকার করে উঠল জনি চ্যাপম্যান। কিন্তু যাজক ভদ্রলোক জবাব দিল না কোন। বরঞ্চ পায়ের নিচে সিগারেটটা পিষে, অবশিষ্টাংশ তুলে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
হ্যারি ক্লজের গাড়ির দুইপাশের আয়না নেই, চাকাগুলোর বয়সও হয়েছে অনেক। হ্যারি ব্লুজের মুখে শুনতে পেল, গাড়িটা প্রচণ্ড তেল খায়। তবে এছাড়া আর কোনো সমস্যা নেই। নিজের জিনিসগুলো একটা কালো ময়লার ব্যাগে ভরে নিলো সে (এদের মাঝে ছিল আধা-ভরতি কমদামি বিয়ারের বোতল, গাঁজার কয়েকটা পুটলি, দুই ডজন কান্ট্রি আর ওয়েস্টার্ন গানের ক্যাসেট আর একটা হলদে হতে শুরু করা স্ট্রেঞ্জার ইন আ স্ট্রেঞ্জ ল্যান্ড বইয়ের কপি)।
‘একটু আগের ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইছি,’ হ্যারি ব্লুজে বলল ওয়েনসডেকে। ‘উইনিব্যাগোটা পাবো কবে?’
‘তোমার চাচাকে জিজ্ঞেস করো, এই দালালি তো সে-ই করেছে।’
‘উইসাকেডজাক আমার চাচা না।’ বলে ব্যাগটাকে কাঁধে ঝুলিয়ে একেবারে কাছের বাড়িটায় ঢুকে পড়ল হ্যারি ক্লজে, লাগিয়ে দিল দরজা।
.
জনি চ্যাপম্যানকে সু ফলসে, একটা খাবারের দোকানের সামনে নামিয়ে দিল ওরা।
যাত্রাপথে চুপ করে রইলেন ওয়েনসডে। হুইস্কি জ্যাকের ওখান থেকে বেরোবার পর হতেই মুখ গোমড়া করে আছেন তিনি। সেন্ট পলের বাইরে, একটা পারিবারিক রেস্তোরাঁয় খেতে বসলেন ওরা দুজন। কারও ফেলে যাওয়া খবরের কাগজ পড়তে শুরু করল শ্যাডো। কাগজের একটা পাতা পড়েই সেটা দেখাল ওয়েনসডেকে। ‘এই দেখুন।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেখলেন ওয়েনসডে। ‘আমি আনন্দিত যে এয়ার-ট্রাফিক- কন্ট্রোলারদের ঝামেলা বিনা সমস্যায় শেষ হয়েছে।’
‘ওটা না, আজকের তারিখটা দেখুন।’ বলল শ্যাডো। ‘চোদ্দো ফেব্রুয়ারি!’
‘ভ্যালেন্টাইন’স ডে শুভ হোক।’
‘আমরা জানুয়ারি বিশ বা একুশ তারিখে রওনা দিয়েছিলাম। তারিখ খুব একটা বেশি লক্ষ করি না কখনওই, কিন্তু জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ ছিল ওটা-এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তাহলে আজ চোদ্দোই ফেব্রুয়ারি হয় কী করে?’
‘কারণ আমরা নাট্যমঞ্চের পেছনে প্রায় এক মাস হেঁটেছি।’
‘আমি তো ভেবেছিলাম, শর্টকাট নিচ্ছি!’
কাগজটা সরিয়ে রাখলেন ওয়েনসডে। ‘জনি অ্যাপলসিড উচ্ছন্নে যাক। যখনই দেখা হয়, তখনই কেবল পল বানিয়ানের ব্যাপারে কথা বলে। জীবিতাবস্থায় চ্যাপম্যানের চোদ্দোটা আপেল বাগান ছিল। হাজার হাজার একর জমি চাষ করত সে। কিন্তু ওর ব্যাপারে যে সব গল্প প্রচলিত আছে, তাতে এক বিন্দুও সত্যি নেই। যাই হোক, পত্রিকাঅলারা যেমন বলে-সত্যটা ছাপার মতো বড়ো না হলে, পৌরাণিক কাহিনিই ছাপো। এই দেশের কিংবদন্তি দরকার। কিন্তু কিংবদন্তিরা ও তাদের পরিস্থিতি বুঝতে অক্ষম।’
‘সেটা একমাত্র আপনিই ধরতে পেরেছেন?’
‘আমি অতীতের পাতায় হারিয়ে যাওয়া একজন। আমাকে কে পাত্তা দেয়?’
নম্র স্বরে বলল শ্যাডো। ‘আপনি দেবতা।’
তীক্ষ্ণ চোখে ওর দিকে তাকালেন ওয়েনসডে। কিছু একটা বলবেন বলে মনে হলো, কিন্তু পরক্ষণেই আবার চেয়ারে গা ছেড়ে দিলেন। মেন্যুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তো?’
‘দেবতা হওয়া তো ভালো।’ বলল শ্যাডো।
‘তাই?’ জানতে চাইলেন ওয়েনসডে।
এবার শ্যাডোর নজর ফিরিয়ে নেবার পালা।
.
লেকসাইড থেকে পঁচিশ মাইল দূরের একটা গ্যাস স্টেশনে, রেস্ট রুমের দেয়ালে অ্যালিসন ম্যাকগভার্নের সাদা-কালো একটা ছবি দেখতে পেল শ্যাডো। ওটার ওপরে একটা প্রশ্ন লেখা: আমাকে দেখেছ? ছবির মেয়েটা আত্মবিশ্বাসের সাথে হাসছে, ওপরের দাঁতের সারিতে নীল রঙের রাবার ব্যান্ড। বড়ো হয়ে যে মেয়েটা পশুদের নিয়ে কাজ করতে চায়, সেই মেয়েটাকে যেন দেখতে পাচ্ছে ও।
আমাকে দেখেছ?
একটা স্নিকারস বার, এক বোতল পানি আর এক কপি দ্য লেকসাইড নিউজ কিনল শ্যাডো। প্রধান গল্পটা মার্গারিতা ওলসেনের লেখা, একটা যুবক আর একটা বয়স্ক লোকের ছবির নিচে লিখেছে। বরফে মাছ ধরতে গেছিল এই দুজন, শিকারকে মাঝখানে ধরে দাঁত বের করে আসছে। হেডলাইনে লেখা: পিতা-পুত্র মিলে ধরল স্থানীয় ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো নর্দান পাইক। বিস্তারিত ভেতরে।
গাড়ি চালাচ্ছিলেন ওয়েনসডে। বললেন, ‘পত্রিকায় বলার মতো কিছু পেলে জানিয়ো।’
সাবধানতার সাথে পুরো পত্রিকায় নজর বোলাল শ্যাডো, কিন্তু জানাবার মতো কিছু পেল না।
অ্যাপার্টমেন্টের বাইরের ড্রাইভওয়েতে ওকে নামিয়ে দিলেন ওয়েনসডে। ঘরে প্রবেশ করার আগে হ্রদের দিকে তাকাল শ্যাডো। এখানে সেখানে সবুজ আর বাদামি বিন্দু দেখা যাচ্ছে, ওগুলো মাছ-শিকারিদের কুঁড়ে। অনেকেই পাশে গাড়ি পার্ক করে রেখেছে। ব্রিজের কাছেই গর্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে পুরনো, সবুজ ক্ল্যাংকারটা। ‘মার্চ মাসের তেইশ তারিখে,’ ওটাকে উৎসাহ দিল শ্যাডো। ‘সকাল সোয়া নয়টার দিকে ডুবলেই হবে। তার আগে গাঁট মেরে বসে থাকো।’
‘অসম্ভব,’ পাশ থেকে একজন মহিলা বলে উঠল। ‘এপ্রিলের তিন তারিখ, সন্ধ্যা ছয়টায়। সেই দিন পানিতে ডুববে সে। হাসল শ্যাডো। স্কি স্যুট পরে সামনেই দাঁড়িয়ে আছে মার্গারিতা ওলসেন। অ্যাপার্টমেন্ট ডেকের অন্যপাশে দাঁড়িয়ে আছে সে, পাখির জন্য খাবার ঢালছে ফিডারে।
‘নর্দান পাইক নিয়ে লেখা তোমার খবরটা পড়লাম।’
‘উত্তেজনাকর, কী বলো?’
‘হুম, শিক্ষামূলক বলা চলে।
‘আমি তো ভেবেছিলাম, তুমি আর ফিরছ না।’ বলল মেয়েটা। ‘অনেকদিন ছিলে না।’
‘চাচার সাথে কাজে ছিলাম,’ বলল শ্যাডো। ‘সময় কোনদিক দিয়ে চলে গেল, বুঝতেই পারিনি।’
খাবার ভরা শেষ করল মার্গারিতা। এতক্ষণ ধৈর্য ধরে বসে ছিল কয়েকটা গোল্ডফিঞ্চ, কিচির-মিচির করতে শুরু করল তারা।
‘কাগজে অ্যালিসন ম্যাকগভার্নের ব্যাপারে কিছু দেখলাম না।’
‘লেখার মতো কিছু নেই। এখনও পাওয়া যায়নি মেয়েটাকে। কেউ কেউ বলছিল: মেয়েটাকে ডেট্রয়টে দেখা গেছে, তবে তার সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি।’
‘বেচারি।’
‘মেয়েটা মারা যাক—আমি সেই প্রার্থনাই করি।’ নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল মার্গারিতা। ‘কেন?’ চমকে গেছে শ্যাডো।
‘তা না হলে বেচারিকে যে দুর্ভাগ্য সইতে হচ্ছে, তা আরও ভয়াবহ।’
তুমি অ্যালিসনের কথা ভাবছ না, মনে মনে বলল শ্যাডো। নিজের সন্তানের কথা, স্যান্ডির কথা ভাবছ
‘তোমার সাথে কথা বলে ভালো লাগল।’ কেবল এতটুকুই বলল সে।
‘হুম। আমারও।’
.
ফেব্রুয়ারি মাসটা কেটে গেল চুপচাপ। দিনগুলো ছিল ধূসর; কোনো কোনো দিনে তুষারপাত হলেও, অধিকাংশ দিনেই হলো না। আবহাওয়া একটু উষ্ণ হলো, শূন্যের ওপরেও উঠল তাপমাত্রার কাঁটা। তবে নিজের অ্যাপার্টমেন্টেই বেশিরভাগ সময় কাটাল শ্যাডো, একসময় তো মনে হলো যেন জেলে বন্দি হয়ে আছে! একঘেয়েমি ভাবটা কাটাবার জন্যই হাঁটাহাঁটি করতে শুরু করল ও।
দিনের বেশিরভাগ সময় হেঁটেই কাটিয়ে দিল ও, এমনকি শহরের বাইরেও যেতে শুরু করল। একা একা হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল উত্তরে বা পশ্চিমে বন পর্যন্ত, আবার কোনো কোনো দিন গিয়ে উপস্থিত হলো দক্ষিণের ভুট্টা খেতগুলোতে। লাম্বার কাউন্টির বুনো পথ ধরে বেরাল, বাদ গেল না পুরনো রেলরোডের রাস্তাগুলোও। দুই একবার জমে থাকা হ্রদটার পাশ দিয়ে উত্তর- দক্ষিণেও হেঁটেছে। স্থানীয় লোক অথবা পর্যটকদের সাথে দেখাও হয়েছে ওর। কাউকে চিনতে না পারলেও, হাত নাড়তে ভুল করেনি। অধিকাংশ সময় দেখা হলো না কারও সাথেই, কেবল কাক আর ফিঞ্চপাখি হলো ওর সঙ্গী। অবশ্য কয়েকবার গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া র্যাকুন বা পোসামের দেহ ভক্ষণরত একটা বাজপাখিও দেখতে পেয়েছে।
শ্যাডো আবিষ্কার করল, হাঁটার সময় কিছু ভাবতে হয় না ওকে। ব্যাপারটা ভালো লাগলো তার। চিন্তাগুলো কেন যেন নিয়ন্ত্রণে থাকতে চায় না, অস্বস্তিকর সব জায়গা আর পরিস্থিতির মাঝে ফেলে দেয় সবসময়। তাই ক্লান্তিকে দুই হাত বাড়িয়ে সম্ভাষণ জানায় সে। ক্লান্তি যখন চরমে পৌঁছে, তখন আর লরার চিন্তা ভিড় করে না ওর মাথায়; দেখতে হয় না দুঃস্বপ্ন। হাঁটার পর ঘরে ফিরে সুন্দর ঘুম হয়, স্বপ্নরা এসে বাগড়া দেয় না!
নাপিত জর্জের দোকানে পুলিস চিফ চ্যাড মুলিগানের সাথে দেখা হয়ে গেল একদিন। চুল কাটানো নিয়ে শ্যাডো বাড়তি আগ্রহবোধ করলেও, প্রতিবার দেখা যায়—আগের পরের চেহারায় খুব একটা পার্থক্য নেই! কেবল চুলটা একটু ছোটো, এই যা। শ্যাডোর পাশের সিটেই বসেছিল চ্যাড। চেহারার ব্যাপারে খুব সাবধান মনে হলো লোকটাকে। চুল কাটা শেষ হলে, আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকাল সে, এমনভাবে মুখ বাঁকাল যেন জরিমানা করবে কি না ভাবছে।
‘খারাপ লাগছে না,’ শ্যাডো বলল চ্যাডকে।
‘তুমি যদি মেয়েমানুষ হতে, তাহলে ভালো লাগত?’
‘সম্ভবত।
চুল কাটানো শেষে একসাথে ম্যাবেলের দোকানে গেল ওরা। হট চকলেটের অর্ডার দিয়ে চ্যাড বলল, ‘আচ্ছা মাইক, পেশা হিসেবে আইনকে বেছে নেবার কথা কখনও চিন্তা করেছ?’
‘নাহ,’ শ্রাগ করল শ্যাডো। ‘অনেক কিছু জানতে হয়, নইলে…’
মাথা নাড়ল চ্যাড। ‘লেকসাইডের মতো জায়গায় পুলিসের কাজ বলতে কী বোঝায় শুনবে? মাথা ঠান্ডা রাখতে শেখা। মাঝে মাঝে অযাচিত ঘটনা ঘটে, কেউ কেউ খুনের হুমকি দেয়। মাথা ঠান্ডা রেখে বোঝাতে পারলেই… কেল্লা ফতে। বলবে, ঝামেলা মেটাবার জন্য বাইরে নিয়ে যেতে চাও। ব্যস।’
‘তারপর, বাইরে বেরোলে ঝামেলা মিটে যাবে?’
‘হাতকড়া পরাবার সাথে সাথেই সাধারণ সব মিটে যায়। যাই হোক, চাকরি চাইলে বোলো আমাকে। নতুন নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তোমার মতো মানুষই আমাদের দরকার।
‘মনে থাকবে। চাচার সাথে যদি টিকতে না পারি, তাহলে অবশ্যই তোমাকে জানাব।’
হট চকলেটের কাপে চুমুক দিল ওরা। আচমকা মুলিগান বলে উঠল, ‘আচ্ছা মাইক, তোমার যদি কোনো বিধবা আত্মীয়া থাকে, যে হঠাৎ করে তোমাকে ফোন দিতে শুরু করে, তাহলে কী করবে?’
‘ফোন করতে শুর করে মানে?’
‘মেয়েটা অনেক দূরে থাকে, তাই লং-ডিসট্যান্স কল করে,’ লাল হয়ে গেল মুলিগানের গাল। ‘গত বছর একটা বিয়েতে দেখা হয়েছিল ওর সাথে। তখন বিবাহিতা ছিল মেয়েটা, স্বামী বেঁচেও ছিল। খুব একটা কাছের আত্মীয় নয়, দূর সম্পর্কের।’
‘তোমার পছন্দ?’
আরেকটু লাল বর্ণ ধারণ করল গাল। ‘ঠিক জানি না।’
‘তাহলে অন্যভাবে বলি, তোমাকে মেয়েটার পছন্দ?’
‘ফোনে দুয়েকটা কথা এমন বলেছে যে…দারুণ সুন্দর মেয়েটা।’
‘এখন কী করতে চাও?’
‘ওকে এখানে আসতে বলতে পারি। আসলে কথাটা সে-ও বলেছে, আসতে চায়।’
‘তোমরা দুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক। আমি বলব, আমন্ত্রণ জানাও।’
মাথা দোলাল করল চ্যাড, গালের লালচে অংশটা একবার ওকে দেখিয়ে দোলাল আবারও!
শ্যাডোর অ্যাপার্টমেন্টের ফোনটা সংযোগহীন অবস্থায় পড়ে আছে। কয়েকবার ওটাকে চালু করার কথা ভেবেছে সে। কিন্তু করেই বা লাভ কী? ফোন করবেটা কাকে? কোনো এক গভীর রাতে রিসিভার তুলে কানে ঠেকিয়েছিল ও। মনে হচ্ছিল যেন একদল মানুষের আলোচনা শুনতে পাচ্ছে। নাহ, ঠিক শুনতে নয়। কেননা মানুষগুলো এত আস্তে কথা বলছে যে ফিসফিসানি ছাড়া আর কিছুই কানে আসছে না। ‘হ্যালো,’ বলেছিল সে। ‘কে কথা বলে?’ কিন্তু জবাব পায়নি। কেবল আচমকা একটা হাসির শব্দ শুনতে পেয়েছিল, যেন অনেক দূর থেকে আসছে। এতটাই হালকা যে সত্যি সত্যি শুনেছে না পুরোটাই একটা কল্পনা, সে ব্যাপারে সন্দিহান শ্যাডো।
.
পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ ওয়েনসডের সাথেই কাটাতে হলো ওকে
রোড আইল্যান্ডের একটা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে একবার। শুনতে হয়েছে ওয়েনসডে সাথে এক মহিলার ঝগড়া। মহিলা বিছানা থেকে উঠবেই না, আবার ওদেরকে চেহারাও দেখাবে না! ফ্রিজে প্লাস্টিকের ব্যাগ ভরতি ঝিঁঝিঁ পোকা পেয়েছিল শ্যাডো, আরেকটা ভরতি ছিল বাচ্চা ইঁদুরের লাশে।
সিয়াটলের একটা রক ক্লাবে শ্যাডো দেখেছে ওয়েনসডেকে এক যুবতী মেয়ের সাথে কথা বলতে। মেয়েটার মাথা ভরতি ছোটো ছোটো লাল চুল আর সারা দেখে নীল রঙের ট্যাটু। আলোচনা নিশ্চয়ই সফল হয়েছিল, কেননা হাসিমুখে ক্লাব থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন ওয়েনসডে।
এই ঘটনার পাঁচ দিন পর, ভাড়া করা একটা গাড়িতে বসে ওয়েনসডের জন্য অপেক্ষা করছে শ্যাডো। ভ্রু কুঁচকে ডালাসের একটা দালান থেকে বেরিয়ে এলেন প্রৌঢ়। শব্দ করে দরজা বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইলেন তিনি, চেহারা রাগে লাল হয়ে গেছে। ‘চালাও,’ আদেশ দিলেন তিনি। ‘বালের আলবেনিয়ান, মরুক গে ওরা।’
এর তিনদিন পর বোল্ডারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে ওরা, পাঁচজন কমবয়সি জাপানিজ মহিলার সাথে দুপুরের খাবার খেল। শান্ত, সমাহিত পরিবেশে শেষ হয় খাওয়া-দাওয়া। ওয়েনসডের কাজ হয়েছে কি না, তা বুঝতে পারেনি শ্যাডো। তবে মানুষটাকে খুশি বলেই মনে হচ্ছিল।
লেকসাইডে ফেরার জন্য উতলা হয়ে উঠেছে শ্যাডো। ওখানে শান্তি আছে, আছে ফিরে আসার অভ্যর্থনা-ওগুলো তার ভালো লাগে।
কাজ না থাকার দিনগুলোতে ব্রিজ পার হয়ে টাউন স্কয়ারে যায় সে, ম্যাবেলের দোকান থেকে দুটো প্যাস্টি কিনে নেয়। একটা খেয়ে ফেলে ওখানে, সাথে কফি। কেউ খবরের কাগজ ফেলে গেলে একটু দেখে নেয়। তবে নিজে থেকে কখনও কাগজ কেনার ইচ্ছা হয়নি।
অন্য প্যাস্টিটা পার্সেল করে নেয়, লাঞ্চ হিসেবে খাবার জন্য।
একদিন সকালে বসে বসে ইউএসএ টুডে পড়ছিল, এমন সময় ম্যাবেল জানতে চাইল। ‘আচ্ছা, মাইক। আজ তুমি কোথায় যাচ্ছ?’
হালকা নীল সাজে আজ সেজেছে আকাশ। সকালের কুয়াশা অবশ্য গাছের মাথায় তাদের অস্তিত্বের প্রমাণ রেখে গেছে। ‘জানি না,’ উত্তর দিল শ্যাডো। ‘বুনো পথ ধরতে পারি।’
কফির কাঁপে তরল ঢালল ম্যাবেল। ‘তুমি কাউন্টি কিউ-এর পুবে গেছ কখনও? বেশ দূরে অবশ্য। ওখানে যাবার একটা ছোটো রাস্তা আছে, টুয়েন্টিয়েথ অ্যাভিনিউয়ের পাশে।’
‘নাহ, যাইনি কখনও।’
‘যেতে পারো,’ বলল ও। ‘জায়গাটা সুন্দর।’
আসলেই দারুণ সুন্দর! শ্যাডো শহরের বাইরে গাড়ি পার্ক করে, পায়ে হেঁটে এগিয়ে চলল। গ্রাম্য রাস্তাটা প্যাঁচালো, শহরের পূব দিকে অবস্থিত পাহাড়গুলোর ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেছে। প্রায় প্রতিটা পাহাড়েই পাতাবিহীন ম্যাপেল গাছের সারি। সেই সাথে রয়েছে সাদা বার্চ, কালো ফির আর পাইন।
হাঁটার মাঝেই, একটা ছোটো বিড়াল ওর পাশে চলতে শুরু করল। কাদার মতো ওটার গায়ের রঙ, সামনের থাবাগুলো সাদা। ওটার কাছে গেল শ্যাডো, কিন্তু প্রাণিটা ভয় পেল না। গেল না পালিয়েও।
‘হাই, বিড়াল,’ আনমনে বলল শ্যাডো।
একদিকে মাথা কাত করল বিড়ালটা, সবুজাভ চোখ দিয়ে তাকাল ওরই দিকে। তারপরই হিসিয়ে উঠল ওটা। নাহ-শ্যাডোকে উদ্দেশ করে নয়, রাস্তার পাশে থাকা কিছু একটা লক্ষ করে। তবে সেটা কী, তা দেখতে পেল না শ্যাডো।
‘শান্ত হ,’ বলল শ্যাডো। রাস্তা পার হয়ে ওপাশে ভুট্টা খেতের মাঝে হারিয়ে গেল বিড়ালটা।
পরবর্তী বাঁকটা ঘোরার সাথে সাথে একটা ছোটো কবরস্থানে এসে পৌঁছাল শ্যাডো। মাথার কাছের ফলকগুলো ক্ষয়ে গেছে, তবে কয়েকটার পাশে এখনও তাজা ফুল রাখা দেখতে পেল। কবরস্থানটা ঘিরে অবশ্য দেয়াল নেই, আছে কেবল ছোটো ছোটো কিছু মালবেরি গাছ। নেই কোনো দরজাও, কেবল দুটো পাথুরে গেটপোস্ট দিয়ে ঢোকার পথটা চিহ্নিত করা আছে। ভেতরে পা রাখল ও।
ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে লাগল ভেতরে, ফলকগুলো দেখছে। ১৯৬৯ সালের পর আর কোনো তারিখ ফলকগুলোই নজরে পড়ল না। আস্ত আছে, এমন একটা গ্রানাইটের দেবমূর্তির গা থেকে তুষার সরাল ও, তারপর হেলান দিল।
পকেট থেকে পার্সেল বের করে খুলল শ্যাডো। প্যাস্টিটা বের করে আনতেই শীতল বাতাস ভরে উঠল যেন সুবাসে। কামড় বসাল ওতে।
পেছনে নড়ে উঠল কেউ। শ্যাডো ভেবেছিল, বিড়ালটা বোধহয় ফিরে এসেছে। কিন্তু পরক্ষণেই পারফিউমের গন্ধ ভেসে এলো নাকে, সেই সাথে কিছু একটা পচারও।
‘আমার দিকে তাকিয়ো না,’ পেছন থেকে বলে উঠল একটা নারী কণ্ঠ।
‘হ্যালো লরা।’
ইতস্তত শোনাল মেয়েটার গলা, কিছুটা ভয়ার্তও। ‘হ্যালো, পাপি ‘
এক টুকরা প্যাস্টি ভাঙ্গল শ্যাডো। ‘খাবে?’
ওর ঠিক পেছনে এসে দাঁড়াল লরা। ‘নাহ। তুমিই খাও। আমার এখন খাওয়ার দরকার হয় না।’
সুস্বাদু প্যাস্টিটা শেষ করল শ্যাডো। ‘আমি তোমাকে দেখতে চাই।’
‘ভালো লাগবে না।’
‘প্লিজ?’
সামনে এসে দাঁড়াল মেয়েটা। দিনের আলোয় লরাকে দেখতে পেল শ্যাডো। কিছু কিছু জিনিস সেই একই আছে, এই যেমন ওর চোখ, মুখের বাঁকানো হাসিটা। আবার পরিবর্তনও এসেছে অনেক। তবে মেয়েটা যে মৃত, সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। উঠে দাঁড়াল শ্যাডো, পার্সেলের প্যাকেট থেকে প্যাস্টির লেগে থাকা টুকরাগুলো ফেলে পকেটে ভরল ওটাকে।
কায়রোর ফিউনারেল হোমে কাটানো সময়টা কাজে আসছে এখন, মৃত লরার উপস্থিতিতে খুব একটা কষ্ট হচ্ছে না ওর। কিন্তু কী বলবে, তা বুঝতে পারছে না।
লরার ঠান্ডা হাত খুঁজে নিলো ওর হাত, প্রত্যুত্তরে হালকা করে চাপ দিল শ্যাডো। বুকের ভেতর দৌড়াতে থাকা হৃৎপিণ্ডটার উপস্থিতি টের পাচ্ছে পরিষ্কার ভয় পাচ্ছে ও, ভয় পাচ্ছে এই মুহূর্তটার স্বাভাবিকত্বকে। মনে হচ্ছে এভাবেই অনন্তকাল কাটিয়ে দিতে পারবে!
লরাকে পাশে নিয়ে!
‘তোমার অভাব খুব বোধ করি।’ মেনে নিলো শ্যাডো।
‘আমি এখানেই আছি।’
‘এই মুহূর্তগুলোতেই তোমার অভাব বেশি করে বোধ হয়। যখন পাশে থাকো না, তখন তোমাকে অতীতের এক স্বপ্ন ভাবতে কষ্ট হয় না। কিন্তু যখন থাকো…’
আলতো করে ওর আঙুলে চাপ দিল লরা।
‘তো,’ জানতে চাইল শ্যাডো। ‘মৃত্যু আসলে কেমন?’
‘কঠিন।’ যুবকের কাঁধে মাথা রাখল লরা, আরেকটু হলেই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসত শ্যাডো। ‘একটু হাঁটবে নাকি?’
‘অবশ্যই,’ মৃত চেহারাটায় বাঁকা হাসি খেলে গেল।
ছোট্ট কবরস্থান থেকে বেরিয়ে এলো ওরা, পথে উঠল। হাতে হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে শহরের দিকে। ‘কোথায় ছিলে?’ জানতে চাইল লরা।
‘এখানেই।’ জবাব দিল শ্যাডো।
‘ক্রিসমাসের পর থেকে,’ বলল লরা। ‘তোমাকে খুঁজে বের করতে কষ্ট হচ্ছিল। কখনও কখনও, অল্প সময়ের জন্য খুঁজে পেতাম তোমাকে। তারপরই আবার উধাও হয়ে যেতে।’
‘লেকসাইড নামে একটা ছোটো শহরে ছিলাম আমি।’ বলল শ্যাডো। ‘ছোটো হলেও ভালো।’
‘ওহ।’
মেয়েটার পরনে কবর দেওয়ার সময়কার সেই নীল স্যুটটা নেই আর। এখন কয়েকটা সোয়েটার পরে আছে, সেই সাথে একটা লম্বা স্কার্ট। পায়ে শোভা পাচ্ছে বার্গান্ডি বুট। ওটার দিকে শ্যাডোর নজর দেখে হাসল লরা। বলল, ‘দারুণ না? শিকাগোর একটা দোকান থেকে কিনেছি।’
‘শিকাগো থেকে এতদূরে এলে যে?’
‘শিকাগোতে বেশিদিন কাটাইনি, পাপি। আমি দক্ষিণে যাচ্ছিলাম। ঠান্ডাটা খুব ভোগাচ্ছিল। মৃতদের অবশ্য ঠান্ডা পছন্দই হবার কথা। কিন্তু কেন জানি আমার কাছে একে ঠিক ঠান্ডা বলে মনে হচ্ছিল না, মনে হচ্ছিল শূন্যতা। একজন মৃত মানুষ আসলে কোন জিনিসটাকে ভয় পায় জানো? এই শূন্যতাকে। টেক্সাসের পথ ধরেছিলাম আমি। ভেবেছিলাম শীতকালটা গ্যালভেস্টনেই কাটিয়ে দেব। ছোটো বেলায় তাই করতাম।’
‘তাই নাকি?’ বলল শ্যাডো। ‘কখনও বলোনি যে?’
‘বলিনি? তাহলে হয়তো অন্য কেউ কাটাত। এখন আর নিশ্চিত করে কিছুই জানি না আমি। সিগালের কথা মনে আছে আমার, রুটি ছুড়ে দিতাম। মাঝে মাঝে ওপরে ছুড়ে দিলে ওরা উড়ে এসে লুফে নিত।’ একটু বিরতি নিলো সে। ‘হয়তো অন্য কারও স্মৃতি আমার মাথায় ভর করেছে।’
একটা গাড়ি এলো ওদের কাছে, ড্রাইভার হাত নাড়ল। হাত নাড়ল শ্যাডোও, ক্ষণিকের জন্য ওর মনে হলো, স্ত্রীকে সাথে নিয়ে হাঁটছে। এর চাইতে স্বাভাবিক আর কী হতে পারে?
‘ভালো লাগছে।’ যেন ওর মন পড়তে পেরেই বলল লরা।
‘হ্যাঁ।’
‘যখন ডাক এলো, তখন তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম। টেক্সাসে কেবলমাত্র পা রেখেছি তখন।’
‘ডাক?’
ওর দিকে তাকাল লরা। গলায় পরে থাকা সোনালি পয়সা ঝিকিয়ে উঠল। ‘সেরকমই মনে হয়েছিল। তোমার কথা মনে পড়তে শুরু করল আচমকা। উদগ্র হয়ে উঠল তোমাকে দেখার বাসনা।’
‘তুমি জানতে যে আমি এখানে আছি?’
‘হ্যাঁ,’ বলেই থমকে দাঁড়াল লরা। ভ্রু কুঁচকে চেপে ধরল নিচের ঠোঁট। মাথা একদিকে কাত করে বলল, ‘আচমকা কীভাবে যেন জেনে গেলাম। মনে হচ্ছিল, তুমি আমাকে ডাকছ! ভুল মনে হয়েছিল, তাই না?’
‘হ্যাঁ।’
‘তুমি আমাকে দেখতে চাওনি?’
‘ব্যাপারটা তা নয়,’ একটু ইতস্তত করল শ্যাডো। ‘নাহ, আমি তোমাকে দেখতে চাইনি। তোমাকে দেখা মাত্র কষ্ট পাই খুব।’
পায়ের নিচে বরফ কুঁচি শব্দ করে ভাঙতে শুরু করল, তাতে সূর্যের আলো পড়ে সৃষ্টি হলো হীরের ঝলক।
‘বাঁচতে না পারাটা,’ বলল লরা। ‘খুব কষ্টের নিশ্চয়।’
‘দেখ, তোমাকে কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায়, সেই চেষ্টায় ব্যস্ত আমি। সম্ভবত একটা উপায় পেয়েছি—’
‘না,’ ওকে থামিয়ে দিল মেয়েটা। ‘আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। চাই তুমি জীবনে সফল হও। অনেক খারাপ কাজ করেছি…’ মাথা নাড়ল সে। তবে আমি তোমার কথা বলছিলাম।’
‘আমি তো বেঁচেই আছি!’ বলল শ্যাডো।
‘তুমি মৃত নও,’ বলল লরা। ‘তাই বলে বাঁচছ, সেটাও নিশ্চিত করে বলতে পারি না।’
আলাপচারিতা এই দিকে মোড় নিলো কীভাবে? ভাবল শ্যাডো।
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি,’ নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল মেয়েটা। ‘তুমি আমার পাপি। কিন্তু মানুষ যখন মৃত চোখ দিয়ে দেখে, তখন অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে যায়। মনে হয় যেন চোখের সামনে থেকে কোন পর্দা উঠে গেছে। তুমি এই বিশ্বের বুকে পুরুষাকৃতির একটা গর্ত,’ ভ্রু কুঁচকাল মেয়েটা। ‘আমরা যখন একসাথে ছিলাম, তখনও তাই ছিলে। তোমার সাথে থাকতে আমার ভালো লাগত। তুমি বলতে গেলে আমার পূজা করতে; যা চাইতাম, তাই এনে দিতে। কিন্তু মাঝে মাঝে যখন রুমে ঢুকতাম, তখন মনে হতো যেন ওখানে কেউ নেই। তারপর বাতি জ্বালানো মাত্র দেখতে পেতাম তোমাকে। চুপচাপ বসে আছ, না টিভি দেখছ…আর না কিছু পড়ছ। কিছুই না করে যে এভাবে বসে থাকা যায়, তা আগে জানতাম না।
আচমকা আলিঙ্গন করল ও শ্যাডোকে, যেন এতে করে তার কথার বিষটা শুয়ে নিচ্ছে। ‘রবির সবচেয়ে ভালো দিকটা ছিল, ওর অস্তিত্ব আমি অনুভব করতে পারতাম। মাঝে মাঝে খুব খারাপ ব্যবহার করত, বোকা-সোকাও ছিল। কিন্তু ও জীবন্ত ছিল, পাপি। চাহিদা ছিল ওর। বিশ্বের বুকে থাকা গর্ত পূরণ করত।’ হঠাৎ থমকে দাঁড়াল সে। ‘আমি দুঃখিত, আমার কথায় কষ্ট পেলে?’
কথা বলল না শ্যাডো। জানে, মুখ খুললে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। তাই মাথা নেড়ে না করল কেবল।
‘ভালো,’ বলল লরা। ‘খুব ভালো।’
গাড়িটা যেখানে পার্ক করেছিল শ্যাডো, সেটার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ওরা। যুবকের মনে হলো, এখন কিছু একটা বলা দরকার-যেয়ো না, আমি তোমাকে ভালোবাসি। অথবা, আমি দুঃখিত। অথচ যখন মুখ খুলল তখন বেরিয়ে এলো, ‘আমি মৃত নই।’
‘হয়তো না।’ বলল মেয়েটা। ‘কিন্তু বাঁচছ কী?’
‘আমার দিকে তাকাও।
‘এটা কোনো উত্তর হলো না,’ ওর মৃতা স্ত্রী জবাব দিল। ‘যাক গে, উত্তরটা আশা করি তুমি নিজেই আবিষ্কার করতে পারবে।’
‘এখন কী করবে?’ জানতে চাইল শ্যাডো।
‘তোমার সাথে দেখা হলো,’ বলল মেয়েটা। ‘এখন আবার দক্ষিণে যাব।’
‘কোথায়? টেক্সাসে?’
‘গরম কোথাও। কোথায়…তাতে কিছু যায় আসে না।’
‘আমার এখানেই অপেক্ষা করতে হবে,’ জানাল শ্যাডো। ‘বসের দরকার হতে পারে।’
‘একে বাঁচা বলে না।’ বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল লরা। পরক্ষণে হাসি দেখা গেল মুখে। যে হাসিটা শ্যাডোর মনে দোলা দিয়ে যায় সবসময়, সেই হাসিটাই!
হাত বাড়িয়ে মৃতা স্ত্রীকে আলিঙ্গন করতে চাইল শ্যাডো। কিন্তু মাথা নেড়ে দূরে সরে গেল লরা। চুপচাপ বসে রইল তুষারে ঢাকা একটা পিকনিক টেবিলের ওপরে।
শ্যাডোর চলে যাবার পরেও বসে রইল সে।
মধ্যরঙ্গ
যুদ্ধ যে অনেক আগেই শুরু হয়েছে, তা কেউ টেরই পায়নি। যেমন টের পায়নি অবশ্যম্ভাবী ঝড়ের আগমন।
ম্যানহাটনের রাস্তায় গার্ডার পড়ে মারা গেল দুজন পথচারী, এক আরব ট্যাক্সি ড্রাইভার আর তার প্যাসেঞ্জার। সেই সাথে দুই দিন বন্ধ রইল রাস্তায় যান চলাচল। ডেনভারের এক ট্রাক ড্রাইভারকে নিজ গৃহে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল । খুনের অস্ত্র হলো মাথার এক দিক বাঁকানো একটা হাতুড়ি। লাশের পাশে মেঝেতেই ফেলে রাখা হয়েছিল অস্ত্রটা। ড্রাইভারের চেহারা স্পর্শও করা হয়নি, তবে মাথার পেছনটা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বাথরুমের আয়নায় বাদামি লিপস্টিক দিয়ে লেখা হয়েছে অদ্ভুত কিছু অক্ষর
ফিনিক্স, অ্যারিজোনার পোস্টাল সর্টিং স্টেশনে পাগল হয়ে গেল একজন পুরুষ কর্মচারী। টেরি ‘দ্য ট্রল’ ইভেনসন, এক মোটাসোটা, হোঁতকা লোককে খুন করল সে। বেচারা টেরি একাই থাকত, একটা ট্রেলারে। অনেককে উদ্দেশ্য করেই ছোঁড়া হয়েছিল গুলি, তবে মারা গেছে কেবল একজনই। খুনিকে ধরা যায়নি; এমনকী সে কে, তা-ও বের করতে পারেনি পুলিস।
‘সত্যি বলতে কী,’ টেরি ‘দ্য ট্রল’ ইভেনসনের সুপারভাইজার নিউজ অ্যাট ফাইভকে বলল। ‘আমাদের ধারণা ছিল এখানকার কেউ পাগল হলে হবে টেরি। কাজ ভালো করে, কিন্তু একটু অদ্ভুত লোকটা। যাক, মানুষের রূপ দেখে তার ভেতরটা আসলে আন্দাজ করা যায় না।’
মন্টানায় কর্তৃপক্ষ খুঁজে পেল নয়জন সন্ন্যাসীর লাশ। রিপোর্টারদের ধারণা, একসাথে আত্মহত্যা করেছে এই নয়জন। কিন্তু অচিরেই জানা গেল, পুরনো ফার্নেস থেকে নির্গত হওয়া কার্বন মনো-অক্সাইড তাদের মৃত্যুর জন্য দায়ী।
কী ওয়েস্ট করবস্থানে কেউ একজন অপবিত্র করল একটা ক্রিপ্ট।
আইডাহোতে একটা ইউপিএস ট্রাকের সাথে যাত্রীবাহী ট্রেনের আঘাতে মারা গেল ট্রাকের ড্রাইভার। আরোহীদের অবশ্য তেমন বড়ো কোনো ক্ষতি হয়নি।
স্নায়ু যুদ্ধ…নকল যুদ্ধ চলছে এখনও। এসব লড়াইতে না কিছু জেতা যায়, আর না কিছু হারা।
ঝড় আসছে।
.
শেবার রানিকে সবাই অর্ধ-পিশাচ বলেই জানে। ডাইনি, জ্ঞানী আর রানি এই মহিলা শেবায় সেই সময় রাজত্ব করেছিল, যখন দেশটা ছিল স্মরণকালের সবচাইতে ধনী সাম্রাজ্য! ওখান থেকে মসলা, মণি-মুক্তা আর সুগন্ধি কাঠ নৌকায় আর উটের পিঠে করে নিয়ে যাওয়া হতো সারা বিশ্বে। জীবিত থাকা অবস্থাতেই সবার পূজা পেত সে, এমনকী সবচেয়ে জ্ঞানী সম্রাটরাও তার উপাসনা করত জীবিত দেবী হিসেবে। আজ…ভোর দুইটার সময়…সেই শেবার রানি হাঁটছে সানসেট বুলেভার্ডের ফুটপাত ধরে। এমনভাবে, যেন ফুটপাত ওর সাম্রাজ্য। আর রাত?
প্রজা…
সরাসরি কেউ ওর দিকে তাকালে ঠোঁট নাড়ায় মেয়েটা, যেন কিছু একটা বলছে। আর যখন গাড়ি ভরতি মানুষ পাশ দিয়ে চলে যায়, তখন তাদের চোখে
চোখ রেখে হাসে।
লম্বা একটা রাত পার হচ্ছে।
লম্বা একটা সপ্তাহ ছিল।
লম্বা ছিল বিগত চার হাজার বছরও!
কারও কাছে তার ঋণ নেই-এ ব্যাপারটা নিয়ে গর্বিত সে। রাস্তার অন্যান্য বেশ্যাদের দালাল আছে, আছে অভ্যাস, বাচ্চা-কাচ্চা; আছে এমন অনেকে যারা তাদের ইনকামে ভাগ বসায়। কিন্তু এসব থেকে মুক্ত মেয়েটা।
আসলে ওর পেশায় এখন আর পবিত্র কিছুই অবশিষ্ট নেই।
এক সপ্তাহ আগে, আচমকা বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে লস অ্যাঞ্জেলসে। ভেজা রাস্তায় বেড়ে গেছে দুর্ঘটনার সংখ্যা। বৃষ্টির পানি পাহাড় বেয়ে নিচে নামার সময় সাথে করে নিয়েছে এসেছে কাদা স্রোত। সেই স্রোতের মুখে পড়ে বাড়ি-ঘর সব গিয়ে পড়েছে ক্যানিয়নে। নদীর কংক্রিট চ্যানেলে আস্তানা গেঁড়ে বসা ভবঘুরে আর গৃহহীনদের চুবিয়ে মেরেছে পানি। লস অ্যাঞ্জেলসে যখন বৃষ্টি আসে, তখন অধিবাসীদেরকে চমকে দিয়ে আসে।
গত সপ্তাহটা গৃহে অন্তরীণ হয়ে কাটাতে হয়েছে বিলকিসকে। ফুটপাতে দাঁড়াতে পারেনি বলে নিজের বিছানায় শুয়েই কাটিয়েছে দিনগুলো। তবে একেবারে অর্থহীনভাবে কাটায়নি সপ্তাহটা। অ্যাডাল্টফ্রেন্ডফাইন্ডার.কম, এলএ-এস্কর্টস.কম, ক্ল্যাসিহলিউডবেবস.কম-এসব সাইটে নিজের প্রোফাইল খুলেছে। ওর সাথে সংযুক্ত করা যাবে না, এমন একটা ই-মেইল অ্যাড্রেসও খুলে নিয়েছে। নতুন সাগরে জাহাজ ভাসাতে পেরে গর্বিত বিলকিস, তবে সেই সাথে ভয়ও পাচ্ছে। কাগুজে ঝামেলা এড়াচ্ছে ও বহুদিন ধরে। এমনকি এলএ উইকলির পাতায় বিজ্ঞাপনও দেয়নি কোনদিন। নিজের খদ্দেরদের নিজেই বেছে নিতে পছন্দ করে; চোখে দেখে, গন্ধ শুঁকে আর হাত দিয়ে স্পর্শ করে উপাসকদের বেছে নেয় সে।
ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে আচমকা উপলব্ধি করল, যেসব বেশ্যাদেরকে ও ঘৃণা করে, তাদের মতো ওরও একটা বাজে অভ্যাস আছে। দুশ্চিন্তা করতে শুরু করল বিলকিস, ঠোঁট নাড়িয়ে কী সব বলতে শুরু করেছে। যদি কেউ ওই লালচে ঠোঁটের কাছে কান পাতে তো শুনতে পাবে।
‘আমি এখন উঠব আর হাঁটব শহরের রাস্তা জুড়ে। খুঁজে বের করব আমার প্রেমাস্পদকে। রাতের বেলা বিছানায় খুঁজব তাকে, যে আমার অন্তরে বাস করে। তাকে চুমু খেত দেব, চুমু খাব আমিও। আমার ভালোবাসা কেবলই আমার, যেমন আমি কেবলই আমার ভালোবাসার।’
মেয়েটার আশা, বৃষ্টি বন্ধ হলে ফিরে আসবে খদ্দেররা। অধিকাংশ সময় সানসেট বুলেভার্ডের নির্দিষ্ট একটা বা দুইটা রাস্তায় দোকান বসায় সে। মাসে একবার এলএপিডি-এর এক অফিসারকে হপ্তা দিয়ে আসে। এই অফিসারের আগেরজন, জেরি লেবেক আচমকা উধাও হয়ে গেছিল। ডিপার্টমেন্টে এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনার অবসান হয়নি আজও। লোকটা বিলকিসের ব্যাপারে পাগল হয়ে গেছিল, এমনকী মেয়েটার পিছু নেওয়াও শুরু করেছিল সে। একদিন বিকাল আচমকা ঘুম ভেঙে যায় মেয়েটার। দরজা খুলে দেখে, সিভিলিয়ান পোশাক পরে দরকার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে জেরি লেবেক। মাথা নিচু করে অপেক্ষা করছে ওরই আসার। যে আওয়াজটা বিলকিস শুনেছিল, তা হলে কাঠের সাথে লোকটার মাথা ঠোকার আওয়াজ।
জেরির চুলে হাত বুলিয়ে ওকে ভেতরে নিয়ে এসেছিল বিলকিস। পরে তার কাপড়-চোপড় একটা কালো ময়লার ব্যাগে ভরে কয়েক ব্লক দূরের একটা আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। অফিসারের বন্দুক আর ওয়ালেট আরেকটা ব্যাগে ভরে তার উপর ঢেলে দিয়েছিল নষ্ট হওয়া খাবার। এই ব্যাগটাকে ফেলেছিল একটা বাস স্টপে।
স্যুভনির রাখার পক্ষপাতী নয় বিলকিস।
দুর-পশ্চিমের রাতের কমলা আকাশ দেখে বোঝা যাচ্ছে, ওদিকের কোথাও বজ্রপাত হচ্ছে; সম্ভবত সমুদ্রের ওপরে। বিলকিস জানে, অচিরেই শুরু হতে যাচ্ছে বৃষ্টি। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছাই ওর নেই, এরচেয়ে অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে যাওয়াই ভালো। গোসল করে, পায়ের লোম কামিয়ে নেবে। তারপর-ঘুম! পার্শ্ব একটা রাস্তা ধরে চলতে শুরু করল ও, পাহাড়ের পাশে গাড়ি রেখে এসেছে।
হঠাৎ পেছন থেকে ভেসে এলো একজোড়া হেডলাইট। গতি একটু কমিয়ে পেছন ফিরে হাসল বিলকিস। সাদা লিমোটা দেখা মাত্র যেন মুখেই জমে গেল হাসিটুকু। লিমোর খদ্দেররা লিমোতেই সব করে ফেলতে চায়। এতে লাভ নেই ওর। তারপরও, ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ হিসেবে চেষ্টা করে দেখা যায়।
.
গুঞ্জন করে নেমে এলো জানালা। বিলকিস মুখে হাসি ধরে রেখেই এগিয়ে গেল লিমোর দিকে। ‘হাই, হানি। কিছু চাই?’
‘ভালোবাসা চাই, ভালোবাসা।’ লিমোর পেছন থেকে ভেসে এলো কণ্ঠটা। খোলা দরজা দিয়ে যতটা ভেতরে তাকানো যায়, তাকাল বিলকিস। সাবধানের মার নেই, পাঁচজন মাতাল ফুটবল খেলোয়াড়ের সাথে একবার লিমোতে চড়েছিল এক মেয়ে, সেবার অবস্থা খারাপ হয়ে গেছিল তার। কিন্তু এই লিমোতে মাত্র একজন বসে আছে, বয়সও কম। একে উপাসক বানানো যাবে বলে মনে হয় না। তবে এই বয়সে যার লিমো আছে, তার টাকা-পয়সার অভাব হবার কথা না। বারাকা, একদা এই নামেই ডাকা হতো এই হস্তান্তর হওয়া অর্থকে। আর সত্যি বলতে কী, এখন যা পায়, তা-ই দরকার বিলকিসের।
‘কত?’ জানতে চাইল ছেলেটা।
‘নির্ভর করে কী চাই, আর কতক্ষণের জন্য—তার ওপরে,’ উত্তর দিল বিলকিস। ‘পোষাতে পারবে কি না, সেই প্রশ্নও আছে।’ ভেতর থেকে অদ্ভুত একটা গন্ধ ভেসে আসছে, যেন তার পুড়ছে কোথাও। লিমোর দরজা খুলে দিল কেউ
‘যা চাই, তা কেনার ক্ষমতা আমার আছে,’ বলল খদ্দের। গাড়িতে বসে চারপাশ দেখে নিলো বিলকিস, আর কেউ নেই ভেতরে। কেবল খদ্দের, ফোলা- ফোলা মুখের ছেলেটার বয়স এতই কম যে মদ পানের বয়স হয়েছে বলেও মনে হয় না। ‘মালদার নাকি?’ জানতে চাইল ও।
‘মালদারদের মাঝেও মালদার।’ জানাল খদ্দের, ওর দিকে এগিয়ে এলো ছেলেটা। ভঙ্গিমায় কেমন ইতস্তত একটা ভাব। মুচকি হাসল বিলকিস।
‘উম, পয়সা আমাকে উত্তেজিত করে, প্রিয়।’ বলল সে। ‘ডট কম বিলিওনিয়ার নাকি?’
‘হ্যাঁ। আমি টেকনিক্যাল বয়।’ বলল খদ্দের, এদিকে গাড়ি চলতে শুরু করেছে।
‘তাহলে বিলকিস,’ কিছুক্ষণ পর বলল সে। ‘চুষতে কত নেবে?’
‘কী নামে ডাকলে আমাকে?’
‘বিলকিস,’ আবারও বলল খদ্দের।
হাসি উধাও হয়ে গেল বিলকিসের চেহারা থেকে। ‘কী চাই তোমার?’
‘আগেই বলেছি, ভালোবাসা চাই।’
‘যা চাও, পাবে।’ বলল মেয়েটা, যে করেই হোক ওকে এই লিমো থেকে বের হতেই হবে। গাড়িটা খুব দ্রুত চলছে, নইলে ঝাঁপ দেওয়ার একটা চেষ্টা করত। ঘটনা যেভাবে এগোচ্ছে, তা পছন্দ হচ্ছে না ওর।
‘আমি কী চাই, হুম।’একটু বিরতি নিলো ছেলেটা, জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল। ‘আমি চাই পরিষ্কার একটা দুনিয়া। আমি চাই আগামীর উপর রাজত্ব করতে, চাই বিবর্তন…চাই বিপ্লব। আমি চাই আমাদেরকে সবার অলক্ষ থেকে সরিয়ে এনে সবার সামনে রাখতে। তোমরা অতীত দিনের ভুলে যাওয়া গল্প, তোমাদের সাথে পাদপ্রদীপের আলো কেন ভাগাভাগি করতে হবে আমাদেরকে?’
‘আমার নাম আয়েশা,’ বলল বিলকিস। ‘তুমি কী বলছ, তার একবিন্দুও বুঝতে পারছি না আমি। আরেকটা মেয়ে আছে অবশ্য, ওর নাম বিলকিস। সানসেটে ফিরে চলো, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি…’
‘ওহ, বিলকিস,’ নাটকীয় ভঙ্গিমায় দীর্ঘশ্বাস ফেলল ছেলেটা। ‘চারপাশে বিশ্বাসের পরিমাণ সীমিত। তার সবটাই আমাদের দরকার।’ গতি না কমিয়েই বাঁক ঘুরল গাড়িটা, বিলকিসকে সিটের সাথে ঠেসে ধরল খদ্দের। ড্রাইভার আর ওদের মাঝে একটা কালো কাচ, দেখা যায় না। আচমকা মেয়েটার মনে হলো, গাড়িটা আপনা-আপনিই চলছে। কেউ চালাচ্ছে না ওটাকে!
ঠিক তখনই হাত বের করে ড্রাইভারের কাচে নক করল খদ্দের।
গতি কমে গেল গাড়ির। পুরোপুরি বন্ধ হবার আগেই দরজায় ধাক্কা দিল বিলকিস। কিছুটা লাফিয়ে আর কিছু আছাড় খেয়ে বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে। পাহাড়ি একটা রাস্তায় চলছিল গাড়ি, ওটার ডান দিকে খাদ আর বা দিকে খাড়া পাহাড়। তাই পথ বেয়ে নিচে নামতে শুরু করল ও।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল লিমোটা, নড়ল না এক বিন্দুও।
বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। পায়ের হাই হিলগুলো পিছলা খাচ্ছে বার বার। লাথি মেরে ওগুলো পা থেকে খুলল সে, ভেজা শরীর নিয়েই দৌড়াচ্ছে। ভয় পেয়েছে বিলকিস, ক্ষমতা ওর আছে বটে। কিন্তু তা যৌনতার ক্ষমতা। এই দেশে সেই ক্ষমতা ওকে এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছে, তবে অন্য সব কিছুর জন্য নিজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, মন, উচ্চতা আর ব্যক্তিত্বকে ব্যবহার করতে হয় ওর।
ডান দিকে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা একটা গার্ড-রেইল আছে। গাড়ি যেন খাদ বেয়ে নিচে না পড়ে, তার জন্য সুরক্ষা হিসেবে বসান হয়েছে ওটাকে। বৃষ্টি এখন ভারী বর্ষণের রূপ নিয়েছে, বিলকিসের পায়ের পাতা ছিলে বের হতে শুরু করেছে রক্ত।
অদূরেই লস অ্যাঞ্জেলসের আলো দেখতে পাচ্ছে ও। ওখানে পৌঁছালেই মিলবে আশ্রয়, নিরাপদ আশ্রয়। আচমকা রাতের অন্ধকার ছিঁড়ে ছুটল বজ্রের ত্রিশূল, চমকে উঠে আছাড় খেল বিলকিস। দৌড়াবার তাল সামলাতে না পেরে কয়েক ফুট হেঁচড়ে এগোল ওর দেহ, সাথে সাথে রক্ত বেরোতে শুরু করল পা আর কনুই থেকে। কোনোরকমে উঠে দাঁড়াচ্ছে, এমন সময় দেখতে পেল একটা গাড়ির হেডলাইট। ওর দিকেই ভেসে আসছে।
প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসছে ওটা, কোনদিকে যাবে বুঝে উঠতে পারল না মেয়েটা। মূল্যবান কয়েকটা মুহূর্ত খরচ করার পর ছুটল রাস্তার ওপাশে পাহাড় বেয়ে ওঠার চেষ্টা করবে। সাদা লিমোটাকে যখন দেখতে পেল ও, তখন কম করেও হলেও আশি মাইল বেগে চলছে ওটা…বেশিও হতে পারে। তাড়াহুড়ো বেড়ে গেল বিলকিসের, গাছ-গাছড়া বেয়ে ওঠার প্রয়াস পেল।
কিন্তু হায়, বৃষ্টিতে নরম হয়ে গেছে মাটি। কাদার ধস ওকে ঠেলে যেন নামিয়ে দিল রাস্তায়। এত জোরে আঘাত হানল গাড়িটা যে পুতুলের মতো উড়ে গেল বিলকিসের দেহ। লিমোর পেছনের রাস্তায় গিয়ে পড়ল দেহটা। প্রথম আঘাতেই কোমর আর খুলির হাড় ভেঙে গেল ওর।
খুনিকে অভিশাপ দেবার প্রয়াস পেল সে, তবে চুপিচুপি। কেননা ঠোঁট নাড়াবার সাধ্য নেই এখন তার। অভিশাপে জর্জরিত করল সে খদ্দেরকে, এমনসব অভিশাপ যা কেবল কোনো অর্ধ-পিশাচই দিতে পারে।
থেমে গেছে গাড়ি, কেউ একজন এগিয়ে আসছে ওর দিকে। ‘তোমরা সব বেশ্যা। সব্বাই।’
শব্দ করে গাড়ির দরজা বন্ধ করার আওয়াজ শুনতে পেল বিলকিস।
পেছন দিকে রওনা হলো লিমো, প্রথমবার আস্তে আস্তে গেল ওর দেহের ওপর দিয়ে। চাকার নিচে মটমট করে ভাঙল হাড়গুলো। তারপর…দ্বিতীয়বার…গতি জমা করে ছুটে এলো গাড়িটা।
অকুস্থল থেকে বিদায় নিলো ওটা, পেছনে ফেলে গেল লালচে একতাল মাংসপিণ্ড। ওটাকে মানুষ বলে চেনার কোন উপায় নেই।
কে জানে, হয়তো অল্প কিছুক্ষণের মাঝেই লস অ্যাঞ্জেলসের বৃষ্টি যতটুকু অবশিষ্ট আছে সেটাকেও ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
মধ্যরঙ্গ-দুই
‘হাই, সামান্থা।
‘ম্যাগস নাকি?’
‘আর কে হবে?’
‘লিয়োন বলল, গোসল করার সময় নাকি ওর স্যামি খালা ফোন করেছিল।’
‘হুম, অনেকক্ষণ কথা হলো ওর সাথে। খুব মিষ্টি একটা ছেলে।’
‘ঠিক, ভাবছি ওকে রেখেই দিই।’
কিছুক্ষণ চুপ করে রইল দুইজন। অস্বস্তিকর নীরবতাটুকু বেশি হবার আগেই, ‘স্যামি, স্কুলের কী খবর?’
এক সপ্তাহের ছুটি পাচ্ছি, ফার্নেসের ঝামেলা। তোমার অবস্থা বলো।’
‘হুম, নতুন এক প্রতিবেশী পেয়েছি। পয়সার খেলা জানে। লেকসাইড নিউজের চিঠি-পত্র কলামটা আপাতত খুব ভালো চলছে। আমার উপর দায়িত্ব পড়েছে একটা সম্পাদকীয় লেখার। পুরনো গোরস্থানের জায়গাটা নতুন কোনো কাজে লাগানো উচিত হবে কি না, সে নিয়ে লিখতে হবে। এমনভাবে যেন কেউ আহত না হয়, আবার আমাদের অবস্থানও কারও কাছে পরিষ্কার না হয়।
‘দারুণ মজা মনে হচ্ছে।
‘একদম না। গত সপ্তাহে জিলি আর স্ট্যান ম্যাকগভার্নদের বড়ো মেয়ে, অ্যালিসন ম্যাকগভার্ন উধাও হয়ে গেছে। মেয়েটা ভালো ছিল, লিয়োনের জন্য কয়েকবার বেবি-সিটিং-ও করিয়েছিলাম।
কিছু একটা বলার জন্য মুখ খোলা হলো, কিন্তু তা না বলে আবার বন্ধ হয়ে গেল ওটা। বরঞ্চ বলল, ‘খুব খারাপ।’
‘হ্যাঁ।’
‘তো…’ এখন যাই বলা হোক না কেন, কষ্ট কাউকে-না-কাউকে পেতেই হবে। তাই প্রসঙ্গ পালটাবার প্রয়াসে, ‘লোকটা দেখতে কেমন?
‘কে?’
‘প্রতিবেশী।’
‘লোকটার নাম আইনসেল, মাইক আইনসেল। ভালোই, তবে আমার পছন্দের তুলনায় বয়স কম। বিশালদেহী…দেখে মনে হয় …’
‘কী?’
‘বিবাহিত। সেই সাথে একটু উদ্ভ্রান্তও।’
‘রহস্যময় নিশ্চয়ই?’
‘খুব একটা না। অসহায়ের মতো চলাফেরা করে। কীভাবে জানালায় সিল লাগাবে, সেটাও জানে না। এখন দেখে মনে হয়, পথ ভুলে লেকসাইডে চলে এসেছে। মাঝে মাঝে লম্বা সময়ের জন্য উধাও হয়ে যায়!’
‘ব্যাংক ডাকাত হবে হয়তো।’
‘হুম। আমিও তাই ভাবছিলাম।
‘না, ম্যাগস। এই ভাবনাটা আমার ছিল। শোনো, কেমন আছ তুমি? সব ঠিক?’
‘হ্যাঁ।’
‘সত্যি?’
‘না।’
বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পর, ‘আমি আসছি।’
‘স্যামি, তার কোনো দরকার নেই।’
‘স্কুল খোলার আগেই আসব, খুব মজা হবে। কাউচে একটা বিছানা করে দিলেই হবে। আর সেই সাথে তোমার রহস্যময় প্রতিবেশীকে একদিন রাতে খাবারের দাওয়াত দাও।’
‘স্যামি, ঘটকালি করতে চাইছ?’
‘ঘটকালি কে করে? ক্লডিন হারামজাদীর পর, ভাবছি কয়দিন প্রেমিকা না খুঁজে প্রেমিক খুঁজলে মন্দ হয় না। এই ক্রিসমাসেই তো হিচ-হাইকিং করার সময় একটা ভালো ছেলের সাথে পরিচয় হলো।
‘ওহ, স্যাম। এই হিচ-হাইকিং করাটা বন্ধ করতে হবে।’
‘তাহলে লেকসাইডে আসব কীভাবে?’
‘অ্যালিসন ম্যাকগভার্ন উধাও হবার সময় হিচ-হাইকিং করছিল। এরকম একটা শহরেও কাজটা নিরাপদ না। আমি টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
‘লাগবে না, আমার কিছু হবে না।’
‘স্যামি।’
‘টাকা পাঠালে শান্তি পাবে? ভালো ঘুম হবে রাতে?’
‘তা তো হবেই।’
‘ঠিক আছে, ম্যাগস। টাকা পাঠিয়ে দাও। লিয়োনকে চুমু খেয়ে বলো, ওর স্যামি খালা আসছে। এবার যেন আমার বিছানায় খেলনা না লুকায়।’
‘বলব, তবে কাজ হবে বলে মনে হয় না। যাই হোক, আসছ কবে?’
‘কালকে রাতেই। বাস স্টেশনে আসতে হবে না তোমাকে। হিন জলমানকে বলব, তিনি যেন টেসিতে করে আমাকে পৌঁছে দেন।’
‘দেরি করে ফেলেছ, টেসি শীতনিদ্রায় গেছে। তবে হিনজেলমান তোমাকে পছন্দ করে…ওর গল্পগুলো শোনো বলো। যেভাবেই হোক পৌঁছে দেবে সে।’
‘আমার তো মনে হয়, লোকটাকে দিয়ে তোমাদের সম্পাদকীয় লেখানো উচিত। ‘পুরনো গোরস্তানের জমির প্রসঙ্গে বলছি। সেই অমুক সালের এক শীতে আমার দাদা একটা হরিণকে গুলি করেছিল, জায়গাটা ছিল পুরনো গোরস্তানের পাশেই। গুলি ছিল না তার সাথে। তাই ব্যবহার করেছিল আমার দাদির দেওয়া চেরি-স্টোন। গুলিটা লেগেছিল বটে, কিন্তু হরিণটা মরেনি। এই ঘটনার দুই বছর পর যখন দাদা ওদিক দিয়ে যাচ্ছিল, তখন দেখতে পেল এক অদ্ভুত দৃশ্য। বিশালাকার একটা হরিণ মাথার উপর একটা চেরি গাছ নিয়ে দৌড়াচ্ছে। এবার আর ভুল হয়নি তার, গুলি করে মেরেছিল সে ওটাকে। আর দাদি এত চেরি পাই বানিয়েছিল যে পরবর্তী স্বাধীনতা দিবসেও তা শেষ হয়নি… ‘
হাসিতে ফেটে পড়ল দুই বোন।
মধ্যরঙ্গ-তিন
জ্যাকসনভিল, ফ্লোরিডা, রাত দুইটা
‘বাইরে দেখলাম, সাহায্য চাই লেখা?’
‘আমরা সবসময় কর্মচারী নেই।’
‘আমি শুধু রাতের শিফটে কাজ করতে পারব। কোনো সমস্যা?’
‘হবার কথা না। যাই হোক, একটা অ্যাপ্লিকেশন পূরণ করে জমা দিতে হবে। আগে কখনও গ্যাস স্টেশনে কাজ করেছ?’
‘নাহ, তবে কত আর কঠিন হবে?’
‘হুম, ব্যাপারটা খুব কঠিন কিছু না। ম্যাম, কিছু মনে করো না। তোমাকে দেখে ঠিক সুস্থ মনে হচ্ছে না।’
‘আমি জানি। আমার একটা রোগ আছে। দেখে যেমন মনে হয়, আসলে তত গুরুতর নয়।’
‘ঠিক আছে। অ্যাপ্লিকেশনটা আমাকে দিয়ে যাও। আমাদের রাতের শিফটে আসলে লোকবল অনেক কম। এখানে সবাই ওটাকে জম্বি-শিফট বলে। যাক গে, নামটা কী? লোরনা?’
‘লরা।’
‘হুম, লরা। আশা করি পাগল-ছাগলদের সামলাতে পারবে। রাতে ওদের প্রকোপ বেড়ে যায়।’
‘পারব।’