আমেরিকান গডস – ১১

অধ্যায় এগারো 

তিনজনের মাঝে কোনো কথা কেবল তখনই গোপন থাকে, যখন তাদের মাঝে দুইজন মৃত হয়। 

–বেন ফ্র্যাঙ্কলিন, পুওর রিচার্ড’স অ্যালামানক। 

.

ঠান্ডা আরও তিনটা দিন পার হলো। থার্মোমিটারের পারদ মাঝ-দুপুরেও শূন্যের উপর উঠতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। বিদ্যুত, তাপ কু-পরিবাহী মুখোশ আর হালকা, কিন্তু উষ্ণ জামা-কাপড় আবিষ্কার হবার আগে মানুষ কীভাবে শীতে বাঁচত-ভেবে কুল পেল না শ্যাডো। 

ভিডিয়ো-কাম-ট্যানিং সেলুনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ও এখন। হিন জলমান ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওকে তার বড়শির সংগ্রহ দেখাচ্ছেন। এরকম একটা কিছু যে এতটা আকর্ষণীয় হবে, তা বুঝতে পারেনি শ্যাডো। যাই হোক, বৃদ্ধ লোকটাকে শীত- সংক্রান্ত প্রশ্নটা করল ও। 

‘সত্যি সত্যি জানতে চাও?’ 

‘জি।’ 

‘আসলে আগেরকার দিনে মানুষ সবসময় পার পেত না, মাঝে মাঝে শীতে মারাও যেত। বিশেষ করে যদি বাড়ির চিমনীতে সমস্যা থাকত, অথবা স্টোভে গোলমাল থাকত তবে তো কোন কথাই নেই। বড়ো কঠিন সময় পার করতে হতো তখন মানুষকে। সারা গ্রীষ্ম আর শরত কেটে যেত শীতের জন্য খাবার আর আগুন ধরাবার কাঠ সংগ্রহ করতে করতেই। সবচেয়ে বাজে ব্যাপারটা ছিল-পাগলামি। রেডিয়োতে অবশ্য শুনেছি, সেসবের জন্য দায়ী আসলে সূর্যের আলো। শীতের সময়ে যথেষ্ট আলো মেলে না বলেই এরকম হয়। আবার বাবার কাছে শুনেছি, রোগটার একটা নামই দিয়ে দিয়েছিলেন তারা-শ্বৈত-পাগলামি। লেকসাইডের কখনও বড়ো ধরনের সমস্যা হয়নি, তবে আশপাশের সব শহর ততটা সৌভাগ্যবান ছিল না। আমার ছোটো বেলার একটা প্রবাদ শোনো-চাকরানী যদি ফেব্রুয়ারিতে তোমাকে খুন করার চেষ্টা না করে, তাহলে তার সাহস বলতে কিছু নেই। পাগলামির ধরনটা বুঝতেই পারছ! 

‘গল্পের বইকে তখন সোনার গুঁড়ার চাইতেও দামি বলে ধরা হতো। আসলে শুধু গল্পের বই না, পড়ার মতো যেকোনো কিছুর চাহিদাই ছিল আকাশছোঁয়া। তখন তো শহরে শহরে আজকের মতো লাইব্রেরি ছিল না। ব্যাভারিয়া থেকে একবার আমার দাদার ভাই বই পাঠিয়েছিলেন। শহরের সব জার্মান এসে তখন ভিড় জমিয়েছিল টাউন হলে-শুনবে বলে। ফিন, আইরিশ আর অন্যান্য দেশের মানুষরাও আসত। তাদের গল্প শোনাত অন্য জার্মানরা। 

‘এখান থেকে বিশ মাইল দূরে, জিবওয়েতে, নগ্ন এক মাকে রাস্তায় হন্টনরত অবস্থায় পেয়েছিল কর্তৃপক্ষ। দুগ্ধপোষ্য শিশুটাকে বুকের কাছে লাগিয়ে রেখেছিল সেই মা। পাগলামি তাকে এমনভাবে পেয়ে বসেছিল যে বাচ্চাটাকে নিজের কাছ থেকে সরাতেই দেয়নি মহিলা! আফসোসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন হিনজেলমান। ‘পরিস্থিতি খুব খারাপ হতো তখন। যাই হোক, কোন ভিডিয়ো ভাড়া নিতে চাও? একদিন না একদিন এই শহরেও আধুনিক সিনেমা হল স্থাপন করা হবে, আমাদের দোকানও বন্ধ করে দিতে হবে তখন। তবে এখন আমাদের সংগ্রহ বেশ ভালো। 

হিনজেলমানকে মনে করিয়ে দিল শ্যাডো—ওর বাড়িতে না আছে টেলিভিশন, আর না আছে ভিসিআর। হিনজেলমানের সঙ্গ, তার বলা অবিশ্বাস্য সব গল্প আর ঠোঁটের দুষ্টামি-মার্কা হাসি খুব পছন্দ হয়েছে তার। শ্যাডো যদি জানায় যে মাঝে- সাঝে টেলিভিশনের ভেতর থেকে তারকা ওর সাথে কথা বলে, তাহলে দুজনের মধ্যকার সম্পর্কটা দুর্বল হয়ে যেতে পারে! 

ড্রয়ার হাতড়ে একটা পাতলা বাক্স বের করে আনল হিনজেলমান, সম্ভবত ক্রিসমাস-বাক্স ওটা। চকোলেট বা কুকি বিস্কুট উপহার দেওয়ার জন্য ওরকম বাক্স ব্যবহার করা হয়। ওটার ঢাকনি খুলে ভেতর থেকে একটা নোটবুক আর কয়েকটা টিকিটের তোড়া। শ্যাডোর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘কয়টা কিনবে?’ 

‘কী কিনব?’ 

‘ক্ল্যাংকার কখন ডুববে সেটার টিকিট। আজকে আমরা কোন নষ্ট গাড়িকে হ্রদের উপর রেখে আসব। তাই আজ থেকেই টিকিট বিক্রি চলছে। তোমাকে আন্দাজ করতে হবে ওটার পানিতে ডোবার সময়। একেকটা টিকিট পাঁচ ডলার, দশটার দাম চল্লিশ। আর বিশটা নিলে গুনতে হবে পঁচাত্তর ডলার। একেক টিকিটের বিনিময়ে পাবে পাঁচ মিনিট করে সময়। যে ওই গাড়ি, মানে ক্ল্যাংকার ডোবার সবচেয়ে কাছাকাছি সময়ের টিকিট কিনবে, সে পাঁচশ ডলার পাবে। আর যদি সময় খাপে-খাপ মিলে যায়, তাহলে পাবে এক হাজার ডলার! যত তাড়াতাড়ি কিনবে, তত নিজের ইচ্ছামতো সময় বেছে নিতে পারবে। তুমি কি ওটার অতীত ইতিহাস দেখতে চাও?’ 

‘অবশ্যই।’ 

শ্যাডোর দিকে একটা ফটোকপি করা কাগজ এগিয়ে দিলেন হিনজেলমান। বরাবরের মতো এবারও পুরনো একটা গাড়ির ইঞ্জিন আর ফুয়েল ট্যাঙ্ক সরিয়ে রেখে আসা হয়েছে হ্রদের ওপরে। বরফ গলে যখন যন্ত্রটা পানিতে ডুবে যাবে, তখন শেষ হবে এই লটারি। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে আগে আগে ক্ল্যাংকার ডুবে ছিল সাতাশে ফেব্রুয়ারি (সেই ১৯৯৮ সালের শীতে। তবে ওটাকে শীত বলা যায় কি না, তা নিয়ে হিনজেলমানের সন্দেহ আছে)। আর সবচেয়ে দেরি হয়েছিল ১৯৫০ সালের মে মাসে, ঠিক এক তারিখে। সাধারণত এপ্রিল মাসের মাঝামাঝিতেই বেশি ডোবে ওটা, তাও মধ্য বিকালের দিকে। 

এপ্রিল মাসের মধ্য-বিকাল এরইমাঝে শেষ হয়ে গেছে, তাই তেইশ মার্চের সকালের নয়টা থেকে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত সময় কিনল শ্যাডো। হিনজেলমানের দিকে এগিয়ে দিল ত্রিশ ডলার। 

‘ইস, শহরের সবাই যদি তোমার মতো বিনা যুদ্ধে টিকিট কিনত!’ বললেন বৃদ্ধ। 

‘এখানে পা রাখার প্রথম রাতে আপনি যে সাহায্য করেছিলেন, তার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি বলতে পারেন। 

‘না, মাইক,’ বললেন বৃদ্ধ। ‘বরঞ্চ মনে করো, বাচ্চাদের জন্য কিনছ।’ একমুহূর্তের জন্য গম্ভীর দেখাল তাকে, চেহারার সচরাচর আমুদে ভাবটা আর নেই। বিকালে চলে এসো, ক্ল্যাংকারটাকে হ্রদের উপর রেখে আসব।’ 

ছয়টা নীল রঙের কাগজ তিনি এগিয়ে দিলেন শ্যাডোর দিকে। পুরনো দিনের হাতের লেখা অনুসারে তারিখ আর সময় লেখা আছে ওতে। এরপর সেগুলো আবার নিজের নোটবুকে টুকে নিলেন হিন জলমান। 

‘আচ্ছা,’ আচমকা প্রশ্ন করল শ্যাডো। ‘আপনি কখনও ইগল স্টোনের নাম শুনেছেন?’ 

‘রাইনডারল্যান্ডের উত্তরের এলাকাটা তো? না, না। ওটা তো ইগল রিভার। উম…মনে হয় না।’ 

‘থান্ডারবার্ড?’ 

‘ফিফথ স্ট্রিটে থান্ডারবার্ড ফ্রেমিং গ্যালারি নামে একটা জায়গা ছিল বটে, কিন্তু এখন বন্ধ হয়ে গেছে। ওরকম কিছু?’ 

‘নাহ।’ 

‘তাহলে এক কাজ করো, লাইব্রেরিতে চলে যাও। অবশ্য সামনে ওখানে ছাড়ে বই বিক্রি বলে সবাই এখন একটু ব্যস্ত। দালানটা চিনিয়ে দিয়েছিলাম না?’ 

মাথা দোলাল শ্যাডো, বিদায় নিলো সাথে সাথেই। লাইব্রেরির কথা নিজে মনে করল না কেন, তাই ভাবল একবার। বেগুনি ফোররানারটায় চড়ে দুর্গের মতো দালানটার সামনে আসতে বেশি সময় লাগল না। ভেতরে প্রবেশ করা মাত্র দেখতে পেল, বেজমেন্টের দিকে ইঙ্গিত করা একটা সাইনে লেখা: ছাড়ের বই। আসল লাইব্রেরিটা নিচতলায়। 

গম্ভীর-মুখো এক মহিলা, ঠোঁটে ঠোঁট চেপে জানতে চাইল কোনো সাহায্য করতে পারবে কি না। 

‘একটা লাইব্রেরি কার্ড দরকার,’ জানাল শ্যাডো। ‘থান্ডারবার্ডদের সম্পর্কে জানতে চাই।’ 

একটা তাক ভরতি নেটিভ আমেরিকানদের ধর্ম-বিশ্বাস আর প্রথা সংক্রান্ত বই দেখিয়ে দেওয়া হলো শ্যাডোকে। কয়েকটা বই নামিয়ে নিয়ে জানালার পাশে গিয়ে বসল শ্যাডো। কয়েক মিনিটের মাঝেই জানতে পারল, থান্ডারবার্ড আসলে পাহাড়ের শীর্ষে বাস করা পৌরাণিক এক বিশালদেহী পাখি। ওরা পাখা ঝাপটালেই সৃষ্টি হয় বজ্র। কিছু কিছু গোত্রের বিশ্বাস মতো, থান্ডারবার্ডরাই সৃষ্টি করেছে এই বিশ্বকে। আরও আধা-ঘণ্টা পড়েও নতুন কিছু আবিষ্কার করতে পারল না ও। ইগল স্টোনের কথা খুঁজে পেল না কোথাও। 

শ্যাডো যখন তাকে বইগুলো পুনরায় গুছিয়ে রাখছে, তখন নিজের উপর অন্য কারও নজর টের পেল ও। ছোটো ছোটো চোখের দৃষ্টি তাকের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে তারই দিকে। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানো মাত্র উধাও হয়ে গেল সেই চোখের মালিক। শ্যাডো আবার তাকের দিকে ফিরতেই উঁকি দিল ছেলেটা। 

পকেটে এখন রুপালি লিবার্টি ডলার আছে শ্যাডোর। ওটা পকেট থেকে বের করে ডান হাত দিয়ে ওপরে তুলে ধরল। ছেলেটা যে পয়সা দেখতে পাচ্ছে, সেটা নিশ্চিত হবার পর লুকিয়ে ফেলল বাঁ হাতে। এরপর দুই হাত মেলে ধরে দেখাল শ্যাডো, দুটোই খালি। এরপর কাশি দেবার ভান করে মুখ থেকে বের করে আনল পয়সাটা। 

চোখ বড়ো বড়ো করে এতক্ষণ বাচ্চাটা তাকিয়ে ছিল ওর দিকে, এবার কোথায় যেন চলে গেল। কয়েক মুহূর্ত পরেই ফিরে এলো শক্ত মুখ করা মার্গারিতা ওলসেনকে সাথে নিয়ে। চোখে সন্ধেহ নিয়ে শ্যাডোর দিকে তাকিয়ে মহিলা বলল, ‘কেমন আছ, মিস্টার আইনসেল? লিয়োন জানাল, তুমি নাকি ওকে জাদু দেখাচ্ছ? 

‘এই একটু পয়সার খেলা দেখিয়েছি। তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। অ্যাপার্টমেন্টটা এখন বেশ আরামদায়ক গরম হয়ে উঠেছে।’ 

‘খুব ভালো,’ চেহারা এখনও শক্ত করে আছে মার্গারিতা। 

‘লাইব্রেরিটা দারুণ।’ 

‘দালানটা সুন্দর। তবে এই শহরের দরকার দেখতে কম সুন্দর, কিন্তু কাজে বেশি উপযোগী দালান। বেজমেন্টে যাচ্ছ?’ 

‘যাওয়ার ইচ্ছা আছে।’ 

‘যাও, মহৎ এক উদ্দেশ্যে ছাড়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’ 

‘তাহলে অবশ্যই যাবো।’ 

‘হল ধরে নিচে গেলেই পাবে। তোমাকে দেখে খুশি হলাম, মিস্টার আইনসেল।’ 

‘মাইক বলে ডেকো আমাকে, ম্যাম।’ 

চুপ করে রইল মার্গারিতা। এরপর লিয়োনের হাত ধরে ওকে টেনে নিয়ে গেল বাচ্চাদের সেকশনের দিকে।

‘কিন্তু, আম্মু,’ ছেলেটাকে বলতে শুনল শ্যাডো। ‘সত্যি সত্যি জাদু দেখিয়েছে লোকটা। আমি নিজ চোখে দেখেছি। পয়সাটা উধাও হয়ে গেছিল, এরপর নাক দিয়ে বেরিয়েছে!’ 

দেয়াল থেকে ঝুলতে ঝুলতে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন আব্রাহাম লিংকন। মার্বেল আর ওক কাঠ দিয়ে বানানো সিঁড়ি বেয়ে নামল শ্যাডো। বেজমেন্টে পা রাখা মাত্র দেখতে পেল, অনেকগুলো টেবিল ভরতি শুধু বই আর বই। নানা ধরনের বই অগোছালোভাবে রাখা-হার্ডকাভার, পেপারব্যাক, ফিকশন, নন-ফিকশন, সব একসাথে। এমনকি এনসাইক্লোপেডিয়া আর কিছু সময়পঞ্জিও আছে। 

ঘরটার পেছন দিকে চলে এলো শ্যাডো। এখানে টেবিল ভরতি চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা বই। প্রতিটার স্পাইনে সাদা রং দিয়ে একটা করে ক্যাটালগ নম্বর লেখা। ‘আজ এদিকে আপনি ছাড়া আর কেউ আসেনি,’ ছোট্ট, ধাতব ক্যাশ বাক্সের পাশে বসে থাকা লোকটা ওকে দেখে বলল, ‘আজকাল মানুষ শুধু থ্রিলার, বাচ্চাদের বই আর সস্তা প্রেমের উপন্যাসের প্রতিই আগ্রহ দেখায়। জেনি কারটন, ড্যানিয়েল স্টিল, এদের বইই বিক্রি করেছি বেশি।’ লোকটা নিজে পড়ছিল আগাথা ক্রিস্টির দ্য মার্ডার অভ রজার অ্যাকরয়েড। ‘ওই টেবিলে থাকা যেকোনো বইয়ের দাম মাত্র পঞ্চাশ সেন্ট। এক ডলার দিয়ে তিনটা পাবেন।’ 

লোকটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে শ্যাডো আবার বই বাছাইয়ে মন দিল। হেরোডোটাসের একটা ইতিহাসের বই খুঁজে পেল ও, জেলে ফেলে আসা পেপারব্যাক বইটার কথা মনে পড়ে গেল। পারপ্লেক্সিং পার্লার ইলিউশ্যনস নামের আরেকটা বই পছন্দ হলো ওর। ভাবল, ওখান থেকে ভালো দুয়েকটা পয়সার খেলা শেখা যেতে পারে। বই দুটো নিয়ে ক্যাশ বাক্সের দিকে এগিয়ে গেল ও। 

‘আরেকটা নিন, দাম সেই এক ডলারই আসবে।’ বলল লোকটা। ‘আর তাছাড়া, আরেকটা বই নিলে আমাদের উপকারই হবে। এমনিতেই জায়গার সংকট।’ 

আবার টেবিলের কাছে ফিরে গেল শ্যাডো। কোনো বইটা কেউ কিনবে না, সেটা আন্দাজ করার চেষ্টা চালাল ও। দুটো বই পড়ল নজরে- মূত্রনালির রোগসমূহ (ছবি এবং একজন ডাক্তারের মন্তব্যসহ) আর মিনিটস অভ দ্য লেকসাইড সিটি কাউন্সিল ১৮৭২-১৮৮৪। প্রথম বইটার ছবি দেখে মনে হলো, সম্ভবত এই শহরে এমন কোনো তরুণ আছে, যে এগুলো দেখিয়ে তার বন্ধুদেরকে হতবাক করে দেবে। তাই মিনিটস বইটা বেছে নিলো ও। 

ফেরার পথে পুরোটা সময় ওকে সঙ্গ দিয়ে গেল হ্রদের দৃশ্য। এমনকি ওর নিজের অ্যাপার্টমেন্টটাও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে যেন। ব্রিজের কাছে এসে দেখল, চার কি পাঁচজন মানুষ ঠেলে ঠেলে একটা গাড়ি বরফের উপর নিয়ে যাচ্ছে। 

‘মার্চ মাসের তেইশ তারিখ,’ হ্রদটাকে বলল শ্যাডো। ‘সকাল নয়টা থেকে সাড়ে নয়টার মাঝে ‘ 

অ্যাপার্টমেন্টের সামনে এসে দেখে, অফিসার চ্যাড মুলিগান ওর অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে আছে। পুলিসের গাড়িটা দেখা মাত্র বুক ধরফর করতে শুরু করল শ্যাডোর। তবে লোকটাকে সামনের সিটে বসে কাগজপত্র ঘাঁটতে দেখে শান্ত হলো একটু। 

গাড়িটার কাছে এগিয়ে গেল ও, বইয়ের প্যাকেটটা হাতেই ধরা। 

শ্যাডোকে দেখতে পেয়ে জানালা নামাল মুলিগান। ‘লাইব্রেরিতে গেছিল?’

‘হ্যাঁ।’ 

‘দুই কি তিন বছর আগে লুডলামের কয়েকটা কিনেছিলাম। পড়ার ইচ্ছা আছে, আমার এক আত্মীয়া আবার লেখকের বড়ো ভক্ত। এখন তো মনে হয়, দ্বীপান্তরে না গেলে সম্ভবত আমার আর বইগুলো পড়া হবে না।’ 

‘তোমাকে কোনো ভাবে সাহায্য করতে পারি, চিফ?’ 

‘নাহ। ভাবলাম, একবার দেখে যাই তোমাকে। অসুবিধা হচ্ছে কি না। চাইনিজ একটা প্রবাদ আছে-যদি কারও জীবন বাঁচাও, তাহলে সেই জীবনের দায়িত্ব সবসময়ের জন্য তোমার উপর এসে পড়ে। বলছি না যে গত সপ্তাহে তোমার জীবন বাঁচিয়েছি, তবে একবার খোঁজ নিতে মন চাইল। ভালো কথা, বেগুনি গাড়ি কেমন চলছে।’ 

‘ভালো, বেশ ভালো।’

‘শুনে খুশি হলাম।’ 

‘লাইব্রেরিতে আমার প্রতিবেশীনী, মিস ওলসেনকে দেখলাম।’ আচমকা বলল শ্যাডো। ‘ভাবছিলাম…’ 

‘সারাক্ষণ কোষ্ঠকাঠিন্যের রোগীর মতো মুখ গোমড়া করে থাকে কেন?’

‘অনেকটা সেরকমই।’ 

‘অনেক লম্বা কাহিনি। পুরোটা শুনতে হলে আমার সাথে একটু ঘোরাঘুরি করতে হবে।’ 

এক মুহূর্ত ভেবে নিলো শ্যাডো। ‘ঠিক আছে,’ বলে উঠে পড়ল গাড়িতে। উত্তর দিকে রওনা দিল মুলিগান। এরপর ফাঁকা রাস্তা পেয়ে গাড়ি দাঁড় করাল। 

‘মার্জের সাথে ড্যারেন ওলসেনের দেখা হয়েছিল ইউডব্লিউ স্টিভেন্স পয়েন্টে। সাথে করে মেয়েটাকে এই লেকসাইডে নিয়ে এসেছিল ড্যারেন। মহিলা সাংবাদিকতা নিয়ে লেখা-পড়া করা। আর ড্যারেন হোটেল ম্যানেজমেন্ট বা এই জাতীয় কিছু একটা নিয়ে পড়ছিল। এই ধরো তেরো, কী চোদ্দো বছর আগের কথা বলছি। মেয়েটা তখন ছিল অনিন্দ্য সুন্দর। কালো চুল…’ একটু বিরতি নিলো চিফ। ….অবাক হয়েছিল সবাই। ক্যামডেনের মোটেল আমেরিকা চালাত ড্যারেন, জায়গাটা এখান থেকে বিশ মাইল দূরে হবে। কিন্তু ক্যামডেনে আর কে যায়? তাই অতি সত্বর বন্ধ হয়ে গেল মোটেলটা। দুটো ছেলে ছিল ওদের। যখনকার কথা বলছি, তখন স্যান্ডির বয়স এগারো। ছোটোটা, মানে লিয়োন কোলে। 

‘ড্যারেন ওলসেনকে আর যা-ই হোক, সাহসী বলা চলে না। হাই স্কুলে থাকতে বেশ ভালো ফুটবল খেলত। কিন্তু এছাড়া ওর বলার মতো আর অর্জন নেই। যাই হোক, চাকরি খোয়ানোর কথাটা স্ত্রীকে বলার সাহস জুটাতে পারল না ও। তাই পরের দুই মাস, প্রতিদিন সকালে বেরিয়ে যেত ঘর থেকে। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে শোনাত মোটেল চালানো কত কঠিন-সেই গল্প।’ 

‘সময় কাটাত কীভাবে?’ জানতে চাইল শ্যাডো। 

‘নিশ্চিত জানা নেই। আমার ধারণা, আয়রনউড বা গ্রিন বে-তে চলে যেত। প্রথম প্রথম চাকরির খোঁজ করত হয়তো। এরপর মদ খেয়েই পয়সা উড়াতে শুরু করল। কে জানে, পতিতাগমনও শুরু করেছিল কি না। জুয়া খেললেও খেলতে পারে। এটুকু নিশ্চিত করে বলতে পারি, চাকরি হারাবার দশ সপ্তাহের মধ্যে জমানো সব টাকা ফুরিয়ে আসে ওদের। মার্জের জানাটা তাই ছিল শুধু সময়ের ব্যাপার-দাঁড়াও!’ আচমকা গাড়ি চালিয়ে দিল চিফ, সেই সাথে চালু করল সাইরেনও। আইওয়া স্টেটের প্লেট লাগানো একটা গাড়ির চালকের পিলে চমকে দিল সে, সত্তর মাইল বেগে লোকটা গাড়ি চালাচ্ছিল। 

আইওয়ার চালককে জরিমানা করার পর, মুলিগান আবার বলতে শুরু করল। 

‘কী যেন বলছিলাম? ওহ হ্যাঁ। মার্জ জেনে ফেলল, তালাক দেবার জন্য আদালতে আবেদন জানাল সে। বাচ্চাদের অধিকার কে পাবে, তা নিয়ে বেশ বাজে একটা ব্যাপার হলো আদালতে। তবে শেষ পর্যন্ত সেই অধিকার পেল মার্জই। ড্যারেন পেল মাঝে মাঝে এসে বাচ্চাদেরকে দেখার অনুমতি। তখনও লিয়োন ছোটো, তবে স্যান্ডি একটু বড়ো হয়েছে। যে বয়সের বাচ্চারা বাপদেরকে নায়ক জ্ঞান করে, সেই বয়স হয়েছে ওর। মার মুখে বাপ সম্পর্কে একটাও মন্দ কথা সহ্য করতে পারত না সে। যাই হোক, বাড়িটাও বিক্রি করতে হলো মার্জকে, দুই ছেলে নিয়ে সে উঠে এলো ওই অ্যাপার্টমেন্টটায়। ড্যারেন শহর ছাড়ল, মাস ছয়েক পরপর এসে সবাইকে জ্বালিয়ে মারতে শুরু করল। 

‘প্রথম কয়েক বছর গেল এভাবেই। কয়েকদিন পরপর এসে বাচ্চাদের সাথে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আর মার্জকে কান্না উপহার দিয়ে বিদায় নিত ড্যারেন। আমরা অনেকেই প্রার্থনা করতে শুরু করেছিলাম যেন লোকটা আর না আসে। অবসর নেবার পর লোকটার বাবা-মা ফ্লোরিডাতে চলে গেছিলেন। গত বছর যখন এসেছিল, তখন বাচ্চাদেরকে ক্রিসমাসের জন্য ফ্লোরিডায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু মার্জ তা হতে দিলে তো! আরেকবার সৃষ্টি হলো অপ্রীতিকর একটা পরিস্থিতির। এমনকী আমাকেও একবার যেতে হয়েছিল ঝামেলা থামাতে। গিয়ে দেখি, রাস্তায় দাঁড়িয়ে যা-ইচ্ছা-তাই বলে যাচ্ছে ড্যারেন। বাচ্চারা ভয়ে থর থর করে কাঁপছে, মার্জ কাঁদতে কাঁদতে লাল করে ফেলেছে চোখ। 

‘ড্যারেনকে সাবধান করে দিয়ে বললাম, আর কিছু বললে ওকে রাতটা জেলে কাটাতে হবে। লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছিল, আমাকে মেরে বসবে যেন। কিন্তু জাতে মাতাল হলেও, ব্যাটা তালে ঠিক। শহরের দক্ষিণে, ট্রেইলার পার্কে ওকে নামিয়ে দিয়ে জানালাম—নিজেকে এবার একটু গুছিয়ে নেওয়া উচিত ওর। যথেষ্ট জ্বালিয়েছে মেয়েটাকে…পরেরদিন বিদায় নিলো ড্যারেন। 

‘এর দুই সপ্তাহ পরের কথা, আচমকা উধাও হয়ে গেল স্যান্ডি। স্কুলেও যায়নি সেদিন। সবচেয়ে কাছের বন্ধুটাকে বলেছিল, বাবার কাছে যাচ্ছে। ড্যারেন নাকি ওর জন্য বিশেষ একটা উপহার কিনে রেখেছে। এরপর আর কেউ ওকে দেখেনি। বাবা বা মা যখন বাচ্চাকে অপহরণ করে, তখন সেই বাচ্চার হদিস লাগানো খুব কঠিন। বাচ্চাটা নিজেই চায় না যে তাকে খুঁজে বের করা হোক, বুঝতে পেরেছ?’ 

শ্যাডো জানাল, বুঝতে পেরেছে। আরও একটা জিনিস বুঝতে পারল সে, তবে মুখ ফুটে বলল না-চ্যাড মুলিগান আসলে মার্গারিতা ওলসেনকে ভালোবাসে।

আরেকটা গাড়ি বের করল মুলিগান, এবারের অপরাধী ষাট মাইল বেগে গাড়ি চালানো কয়েকজন তরুণ। এদের জরিমানা করল না সে, কেবল ‘ঈশ্বরের ভয়’ ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। 

.

সেদিন সন্ধ্যায় শ্যাডো সময় কাটালো রান্নাঘরের টেবিলে বসে। রুপালি একটা ডলারকে পেনিতে পরিণত করার চেষ্টাতেই কাটল তার সময়। পারপ্লেক্সিং পার্লার ইলিউশ্যন্স বইটায় পেয়েছে এই খেলাটা। কিন্তু কীভাবে কী করতে হবে, সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র নির্দেশনাও দেওয়া নেই বইটায়। কেবল লেখা, ‘এরপর স্বাভাবিক পদ্ধতিতে হাপিস করে দিন পয়সাটাকে।’ এক্ষেত্রে ‘স্বাভাবিক পদ্ধতিটা কী?’ ভাবল শ্যাডো। হাতায় ফেলে দেব? নাকি চিৎকার করে বলল, ‘আয়, হায়! একটা সিংহ!’ যাতে সবাই ওদিকে তাকায় আর এই সুযোগে পয়সা ‘হাপিস’ হয়ে যায়? 

ওপরে ছুড়ে মারল শ্যাডো কয়েনটাকে, নিচে পড়তে শুরু করলে লুফে নিলো। আয়নার সামনে গিয়ে অনুশীলন করার চেষ্টা করে দেখল ও, কিন্তু না কাজ হলো না। বুঝতে পারল, আসলে বইটাতেই ঠিকভাবে লেখা নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পকেটে ভরল সে পয়সাটার এরপর বসে পড়ল কাউচে। এবার অন্য বই, মানে দ্য মিনিটস অভ দ্য লেকসাইড সিটি কাউন্সিল ১৮৭২-১৮৮৪ খুলে বসল। খুদে খুদে অক্ষরে, দুই সারিতে ছাপা বইটা। পড়া দুষ্কর। পাতা উলটে ওই সময়ের ছবি বের করল ও, লেকসাইড সিটি কাউন্সিলের সদস্যদের দেখতে পেল। লম্বা জুলফি আর মাটির পাইপ ঝুলছে কারও কারও ঠোঁটে। কারও মাথায় পুরনো হ্যাট তো কারও মাথায় নতুন। অনেকের চেহারাই পরিচিত বলে মনে হলো। 

তাই ১৮৮২ সালের কাউন্সিলের মোটাসোটা সেক্রেটারিকে দেখে মনে হলো, একে তো এই একটু আগে দেখেছি! বিশ পাউন্ড মেদ আর গালের দাড়িটুকু ঝরিয়ে ফেললেই, চ্যাড মুলিগানের সাথে সেক্রেটারি প্যাট্রিক মুলিগানের কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। সম্ভবত পুলিস চিফের পর-পরদাদা লোকটা। হিনজেলমানের দাদাও কি আছে ছবিতে? একবার ভাবল শ্যাডো। কিন্তু সম্ভবত গল্পের সেই দাদা সিটি কাউন্সিল চালাবার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। ছবি দেখার সময় একবার ‘হিনজেলমান’ দেখতে পেল বলে মনে হলো ওর। তবে খুঁজে পেল না আর, এদিকে ছোটো ছোটো অক্ষরগুলো পড়তেও কষ্ট হচ্ছে। 

বইটা বুকের উপর রেখে চোখ বন্ধ করে ফেলল শ্যাডো। অবশ্য জানে, কাউচে ঘুমিয়ে পড়াটা অনুচিত হচ্ছে। শোবার ঘর মাত্র কয়েক পা দূরে। আমি তো আর ঘুমাব না, নিজেকেই বোঝাল ও। কেবল চোখ বন্ধ করব কিছুক্ষণের জন্য… 

অন্ধকারের রাজত্বে এসে উপস্থিত হয়েছে শ্যাডো। 

.

চারপাশে খোলা সমভূমি। মাটির ভেতর থেকে যেখানে বের হয়ে পা রেখেছিল, সেই জায়গাটার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে এখন। এখনও তারা খসে পড়ছে আসমান থেকে, প্রতিটা তারা লাল মাটি স্পর্শ করার সাথে সাথে হয় পুরুষ আর নয়তো নারীতে পরিণত হচ্ছে। পুরুষদের লম্বা কালো চুল আর উচু হনু, মেয়েরা সবাই দেখতে মার্গারিতা ওলসেনের মতো। এরা হচ্ছে তারকালোকের মানুষ! 

কালো, গর্বিত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল তারা 

‘আমাকে থান্ডারবার্ডসদের ব্যাপারে জানান,’ অনুরোধ করল শ্যাডো। ‘আমার নিজের জন্য জানতে চাইছি না, আমার স্ত্রীর জন্য দরকার।’

একে একে সবাই ওর দিকে পিঠ দিয়ে ঘুরল। তবে একেবারে শেষ জন, একেবারে শেষ মুহূর্তে পিছু ফিরে ইঙ্গিত করল লালচে আকাশের দিকে। মেয়েটার গলায় সাদা দাগ দেখতে পেল সে। 

‘নিজেই জিজ্ঞেস করছ না কেন?’ প্রশ্ন করল মেয়েটা। ক্ষণিকের জন্য বজ্রের আলোয় ঝলসে উঠল চারপাশ। 

শ্যাডোর চারপাশে উঁচু উঁচু পাথর আর পাহাড় শীর্ষ। সবচেয়ে কাছেরটায় চড়তে শুরু করল ও। ক্ষয় হতে শুরু করা হাতির দাঁতের মতো রং পাথরটার। ওপরে ওঠার জন্য ওতে হাত রাখতেই কেটে গেল! এটা পাথর না, ভাবল শ্যাডো। আসলে হাড়। পুরনো, শুষ্ক হাড়! 

স্বপ্ন দেখছে ও, আর স্বপ্নে মানুষের যা ইচ্ছা তাই করার সুযোগ থাকে না খুব একটা। হয়তো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ হয় না, আর নয়তো স্বপ্ন শুরু হবার আগেই সেই সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়ে থাকে। ওপরে উঠতে শুরু করল শ্যাডো। হাতে ব্যথা পাচ্ছে, পায়ের নিচে পড়ে মুচমুচ করে ভেঙে যাচ্ছে হাড়। বাতাস ওকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। কেবলমাত্র প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তির জোরেই উঠতে পারছে ও। 

পুরো পাহাড়টা একই হাড় বারবার ব্যবহার করে বানানো হয়েছে, প্রতিটাই শুষ্ক আর বলের মতো-যেন কোনো বিশাল পাখির ডিমের খোলস! কিন্তু আরেকবার বজ্রপাতের আলো ওর ভুল ধরিয়ে দিল। হাড়গুলোর মাঝে রয়েছে চোখের ফোকর। আছে দাঁত, হাসছে ওকে দেখে। তবে সেই হাসিতে আনন্দ নেই। 

দুরে কোথাও ডাকাডাকি করছে পাখি, আস্তে আস্তে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করল ওর চেহারায়। 

মাটি থেকে শত শত ফুট ওপরে চলে এসেছে। ওপরে, প্রায় শীর্ষের কাছাকাছি উড়ছে অনেকগুলো পাখি-বিশাল, কালো, শকুনের মতো। প্রতিটার গলায় সাদা সাদা ছোপ। একইসাথে রাজসিক আর ভীতিপ্রদ মনে হচ্ছে পাখিগুলোকে। পাখা ঝাপটানির শব্দ ডুবিয়ে দিচ্ছে বজ্রপাতের আওয়াজ। 

পাথরটাকে কেন্দ্র করে উড়ছে ওগুলো। 

এক পাখা থেকে আরেক পাখার দূরত্ব পনেরো…নাহ, বিশ ফুট হবে। ভাবল শ্যাডো। 

আচমকা একটা পাখি উড়ে এলো ওকে লক্ষ্য করে, নীলচে বজ্র ওটার পাখাকে ঘিরে ধরেছে। পাথরের…নাকি হাড়ের বলব…একটা ফাটলে নিজেকে তুলল শ্যাডো। ওটা আসলে মাথার খুলি, সাদা দাঁতগুলো ওর দিকেই তাকিয়ে হাসছে। কিন্তু থামল না যুবক, টেনে-হিঁচড়ে নিজেকে নিয়ে চলল ওপরে। ভয়, আতঙ্ক আর ঘোর সামনে মাথা নত করল না সে। 

আরেকটা পাখি উড়ে এলো ওর দিকে, হাতের সমান বড়ো একটা নখর এসে বসল ওর হাতে। 

হাত বাড়িয়ে পাখিটার একটা পালক তোলার প্রয়াস পেল শ্যাডো। কেননা ওটা ছাড়া ফিরলে গোত্রের কাছে ও হাস্যম্পদে পরিণত হবে। কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে ওপরে উঠে গেল পাখিটা, হারিয়ে গেল অন্ধকারে। আবার ওঠা শুরু করল যুবক। 

এখানে কমপক্ষে হাজারখানেক খুলি আছে। ভাবল শ্যাডো। লাখখানেকও হতে পারে। তবে সবগুলো মানুষের না। অনেক…অনেকক্ষণ পর পাহাড়ের মাথায় উপস্থিত হতে পারল ও। থান্ডারবার্ড নামের বিশাল পাখিগুলো ওকে কেন্দ্র করে উড়ছে এখন। 

একটা কণ্ঠ শুনতে পেল শ্যাডো, মহিষ-মানবের কণ্ঠ। ডাকছে ওকে। বলছে এই খুলিগুলো কাদের, সে কথা … 

আচমকা ধসে পড়তে শুরু করল পাথর, সবচেয়ে বড়ো পাখিটা বজ্রের গতিতে ছুটে এলো ওর দিকে। নিচের দিকে পড়তে শুরু করল শ্যাডো, খুলির পাহাড় থেকে নিচে… 

.

চিৎকার করে উঠেছে টেলিফোন। ওটার যে সংযোগ আছে, তা-ও জানা ছিল না শ্যাডোর! ঘুমে আচ্ছন্ন অবস্থাতেই তুলে ধরল রিসিভার। 

‘এসব কী?’ ওয়েনসডের চিৎকার শুনতে পেল শ্যাডো। এর আগে লোকটাকে কখনও এতটা খেপে উঠতে শোনেনি। ‘কী বাল-ছাল করছ শুনি?’ 

‘ঘুমাচ্ছিলাম।’ বোকার মতো জবাব দিল ও। 

‘লেকসাইডের মতো বালের একটা জায়গায় পাঠালাম কেন, একবার ভেবে দেখেছ? ওখানে গিয়েও যদি মরা মানুষকে জাগিয়ে তোলার মতো চিল্লাপাল্লা করো, তাহলে হবে কী করে!’ 

‘আমি স্বপ্নে থান্ডারবার্ড দেখছিলাম…’ বলল শ্যাডো। ‘আর খুলি…’ কেন যেন স্বপ্নের বিবরণ পুনরায় দেওয়াটা ওর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হলো। 

‘তুমি কী স্বপ্ন দেখেছ, তা আমি জানি। শুধু আমি না, পৃথিবীর সবাই মনে হয় জানে। নিজের অবস্থান যদি এমন বিজ্ঞাপন দিয়ে জানাও, তাহলে লুকিয়ে রেখে লাভটা কী হলো?’ 

চুপ করে রইল শ্যাডো। 

ওপাশেও নীরবতা বজায় রইল কিছুক্ষণ। এরপর ওয়েনসডে বললেন, ‘সকালে আসছি,’ মনে হলো যেন রাগ কমে গেছে। ‘আমরা স্যান ফ্রান্সিসকোতে যাব।’ রেখে দিলেন রিসিভার। 

কার্পেটের উপর ফোনটাকে নামিয়ে রেখে উঠে বসল শ্যাডো। সকাল ছয়টা বাজে ঘড়িতে, তবে বাইরে এখনও ঠান্ডা। কাঁপতে কাঁপতে সোফা থেকে নামল সে, জমে যাওয়া হ্রদের উপর দিয়ে চিৎকার করতে করতে প্রবাহিত হচ্ছে ঠান্ডা বাতাস। দেয়ালের ওপাশেই কেউ একজন কাঁদছে বলে মনে হলো। মার্গারিতা ওলসেন বলেই মনে হচ্ছে শ্যাডোর, মহিলার মাঝে মাঝে ফুঁপিয়ে ওঠাটা ওর মনে জন্ম দিল হাহাকার। 

বাথরুমে গিয়ে তলপেট খালি করে নিলো শ্যাডো। এরপর শোবার ঘরে গিয়ে বন্ধ করে দিল দরজা, সেই সাথে বন্ধ হয়ে গেল মহিলার কান্নার আওয়াজ। বাইরে এখনও শোঁ শোঁ শব্দে কেঁদে জ্বলছে বাতাস… 

…যেন কোনো বাচ্চা হারিয়ে ফেলা মা তীব্র শোকে কান্না করছে! 

.

জানুয়ারির স্যান ফ্রান্সিসকো স্বাভাবিকের চাইতেও বেশি গরম, এতটাই যে শ্যাডোর ঘাড় বেয়ে গড়াতে শুরু করল ঘাম! ওয়েনসডের পরনে একটা ঘন নীল স্যুট, চোখের সোনালি রঙা চশমাটা চেহারায় আইনজীবীর একটা ছাপ ফেলেছে। 

হাইড স্ট্রিট ধরে হাঁটছে দুজন। রাস্তার লোক আর প্রতারকের দল তাকিয়ে তাকিয়ে তাদের চলে যাওয়া দেখছে। তবে কেউ পথ আটকে দাঁড়াল না, কেউ ভিক্ষা পর্যন্ত চাইল না! 

শক্ত হয়ে আছে ওয়েনসডের চোয়াল। তিনি যে এখনও রেগে আছেন, তা পরিষ্কার বুঝতে পারছে শ্যাডো। সকালে অ্যাপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়ানো কালো লিংকন গাড়িটায় ওঠার পর থেকে বিমান বন্দরে যাওয়া পর্যন্ত কোন কথা হয়নি তাদের মাঝে। ওয়েনসডে প্রথম শ্রেণিতে আর ও সাধারণে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে। 

শেষ বিকেল এখন। শ্যাডো সেই ছোটোবেলার পর আর স্যান ফ্রান্সিসকোতে পা রাখেনি। তবে শহরটা পরিচিত মনে হলো দেখে অবাক হলো সে। কাঠের ঘরগুলো যেন আলাদা কোনো শিল্প। অচেনা জায়গা বলে মনেই হচ্ছে না। 

‘লেকসাইড যে এই কাউন্টিতেই, সেটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে!’ বলল ও। ওয়েনসডে চোখ পাকিয়ে তাকাল ওর দিকে। তারপর বলল, ‘কে বলেছে একই কাউন্টিতে? নিউ অর্লিন্স আর নিউ ইয়র্ককে একই কাউন্টিতে বলবে? মিয়ামি আর মিনিয়াপোলিসকে?’ 

‘বলব না?’ 

‘না। সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে মিল আছে হয়তো-মুদ্রা বা সরকারও এক। আর তাছাড়া, জমি তো একই। কিন্তু এই সবগুলোকে এক দেশের আবহ দিচ্ছে কে জানো? গ্রিনব্যাক, দ্য টু নাইট শো আর ম্যাকডোনাল্ডস।’ রাস্তার শেষ মাথার কাছে এগিয়ে আসছে ওরা, সামনেই একটা পার্ক। ‘এখন যে মহিলার কাছে যাচ্ছি, তার সাথে ভালো ব্যবহার কোরো। তবে খুব ভালো ব্যবহার করার দরকার নেই।’ 

‘ঠিক আছে।’ বলল শ্যাডো। 

ঘাসের উপর পা রাখল দুজন। 

একটা ছোট্ট মেয়ে, চোদ্দোর চাইতে একদিন বেশি হবে না বয়েস, চুলগুলো সবুজ-কমলা-গোলাপি রঙে রাঙানো, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে ওদের দিকে। একটা কুকুর, জাতে মনগ্রেল, বসে রয়েছে ওর পাশে। মেয়েটাকে দেখে কুকুরটার চাইতে বেশি ক্ষুধার্ত বলে মনে হচ্ছে। ওদেরকে দেখে খ্যাঁক করে উঠল প্রাণিটা, পরক্ষণেই লেজ নাড়াতে শুরু করল। 

এক ডলারের একটা নোট মেয়েটার দিকে এগিয়ে দিল শ্যাডো। এমনভাবে কাগজটার দিকে চেয়ে রইল মেয়েটা যেন কী করবে তা বুঝে উঠতে পারছে না। ‘কুকুরটার জন্য খাবার কিনো।’ বলল ও। হেসে মাথা দোলাল মেয়েটা। 

‘সরাসরি বলি,’ বললেন ওয়েনসডে। ‘মহিলার সাথে কথা বলার সময় সাবধানে থাকবে। তোমাকে তার পছন্দ হয়ে গেলে, বিপদ হবে!’ 

‘আপনার প্রেমিকা-ট্রেমিকা নাকি?’ 

‘পুরো চীনের মালিক বানিয়ে দিলেও আমি ওর সাথে প্রেম করব না।’ শ্যাডোর মনে হলো, ওয়েনসডের রাগ হালকা হয়েছে। কে জানে, হয়তো ভবিষ্যতের জন্য তুলে রেখেছেন। ওয়েনসডের মতো মানুষের জন্য রাগ-ই হলো চালিকাশক্তি। 

ঘাসের উপর এক মহিলাকে বসা দেখল ও, সামনে একটা কাগজের টেবিলক্লথ বিছান। নানা ধরনের তৈজসপত্র রাখা আছে ওতে। 

মহিলা মোটা নন-বাড়তি মেদ বলতে কিচ্ছু নেই তার শরীরে। মাত্র একটা শব্দই মহিলার দেহের ব্যাপারে ব্যবহার করতে পারে শ্যাডো-নিখুঁত। চুল এতটা বর্ণহীন যে প্রায় সাদা হয়ে গেছে। নায়িকারাও দেখে ঈর্ষান্বিত হবে, এমন লালচে কোমল ঠোঁট। বয়স পঁচিশ হতে পারে, আবার হতে পারে পঞ্চাশও! 

সামনে রাখা অনেকগুলো রান্না করা ডিম মন দিয়ে দেখছেন মহিলা। ওয়েনসডের আগমন টের পেয়ে মুখ তুলে তাকালেন। ‘হ্যালো, প্রতারক কোথাকার।’ বললেন তিনি। তবে বললেন হাসিমুখে। ওয়েনসডে বাউ করে মহিলার হাত নিলেন নিজের হাতে। আলতো করে ঠোঁট ছুইয়ে বললেন, ‘তোমাকে স্বৰ্গীয় লাগছে দেখতে।’ 

‘আর কেমন লাগবে?’ মুচকি হেসে জানতে চাইলেন মহিলা। ‘যাই হোক, তুমি যে মিথ্যাবাদী, তা তো জানাই আছে। নিউ অর্লিয়ন্সে যাওয়াটা উচিত হয়নি আমার, প্রায় ত্রিশ পাউন্ড চর্বি জমেছিল কোমরে। হাঁটতে গেলে দুই উরু এখন ঘষা খায়, জানো?’ শ্যাডোর দিকে চেয়ে করা হলো প্রশ্নটা। উত্তরে কী বলবে, ভেবে পেল না ও। চেহারা লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। 

আনন্দে হেসে উঠলেন মহিলা। ‘লজ্জা পাচ্ছে দেখি! আরে, ওয়েনসডে, তুমি দেখি এক লজ্জাবতীকে সাথে করে নিয়ে এসেছ! নাম কী তোমার?’ 

‘শ্যাডো,’ বললেন ওয়েনসডে। যুবকের অস্বস্তি তিনি খুব উপভোগ করছেন। শ্যাডো, ইস্টারের সাথে পরিচিত হও।’ 

কিছু একটা বলল শ্যাডো, সেটা হ্যালো হতেও পারে আবার না-ও হতে পারে। ওর দিকে তাকিয়ে আবার হাসলেন ইস্টার। যুবকের মনে হলো, পাদ-প্রদীপের উজ্জ্বল আলো যেন ওর ওপরে এসে পড়েছে। ত্রস্ত হরিণের মতো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে; না পারছে দাঁড়িয়ে থাকতে, আর না পারছে ছুটে পালাতে। জেসমিনের সুগন্ধ আসছে মহিলার দেহ থেকে; সেই সুগন্ধে নেশা ধরছে শ্যাডোর। 

‘সবকিছু ঠিক আছে?’ জানতে চাইলেন ওয়েনসডে। 

মহিলা, মানে ইস্টার, গলার ভেতর থেকে হেসে উঠলেন। হাসি যেন উপচে পড়ছে মহিলার দেহের প্রতিটা অংশ থেকেও। ‘সব ঠিক,’ বললেন তিনি। ‘তোমার কী খবর, বুড়ো নেকড়ে?’ 

‘তোমার সাহায্যের আশায় এসেছি।’

‘সময় নষ্ট করেছ কেবল।’ 

‘আমার কথা তো অন্তত শোনো।’

‘লাভ কী!’ 

শ্যাডোর দিকে তাকালেন মহিলা। ‘বসো, খাবার খাও। সবকিছুই দারুণ স্বাদু। ডিম, রোস্ট আর রান্না করা মুরগি, চিকেন সালাদ, সবই আছে। এক কাজ করো, থালাটা দাও, আমি তুলে দিচ্ছি।’ তাই করলেন মহিলা। এরপর ওয়েনসডের দিকে তাকালেন। ‘খাচ্ছ না যে?’ 

‘তোমার আমন্ত্রণ না পেয়েই?’ বললেন ওয়েনসডে। 

‘বাজে কথা দিয়ে ভরতি তোমার পেট, বদহজম হয় না কেন তা কেবল ঈশ্বরই জানেন,’ একটা খালি প্লেট এগিয়ে দিলেন মহিলা। ‘নিয়ে খাও।’ 

পেছন থেকে পড়ন্ত সূর্যের আলোতে দারুণ দেখাচ্ছে ইস্টারের চুল। ‘শ্যাডো,’ তৃপ্তির সাথে মুরগির রান চিবুতে চিবুতে বললেন। ‘মিষ্টি নাম। এই নাম কেন? 

ঠোঁট ভিজিয়ে শুরু করল শ্যাডো। ‘আমি যখন ছোটো ছিলাম,’ বলল সে। ‘তখন পরিবারে ছিল কেবল আমি আর আমার মা। তিনি আসলে…অনেকটা সেক্রেটারির কাজ করতেন। নানা ইউএস অ্যাম্বাসিতে কাজ করতে হতো তাকে, বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলোতে। তারপর একদিন আচমকা অসুস্থ হয়ে সময়ের আগেই অবসর নিতে হলো মাকে, আবার চলে এলাম আমেরিকায়। অন্য বাচ্চাদের সাথে ঘনিষ্ঠতা হয়নি কখনওই। শুধু ছায়ার মতো বড়োদের পেছনে ঘুরেছি। হয়তো সেজন্যই…আকারের ছিলাম ছোটোখাটো।’ 

‘তাহলে তো বেশ বড়ো হয়েছ দেখছি!’ 

‘হ্যাঁ।’ 

ওয়েনসডের দিকে ফিরলেন ইস্টার। ‘এই ছেলেটাকে নিয়েই সবার মাথাব্যথা?’ 

‘তুমিও শুনেছ?’ 

‘কান তো খাড়াই থাকে।’ বলে শ্যাডোর দিকে ফিরলেন। ‘ঝামেলা এড়িয়ে চলবে। এখন দুনিয়াতে অগণিত গুপ্ত-সংঘ, এদের না আছে বিশ্বস্ততা, আর না আছে পারস্পারিক ভ্রাতৃত্ববোধ। সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যেমনই হোক না কেন, আদপে সব একই ঝাঁকের কই। এদের কোনো কোনোটা একেবারে অদক্ষ। আবার কোনো কোনোটা মাত্রাতিরিক্ত বিপজ্জনক। একটা কৌতুক শুনলাম সেদিন, সিআইএ আর কেনেডিকে নিয়ে।’ 

‘শুনেছি,’ জানালেন ওয়েনসডে। 

‘আফসোসের কথা,’ শ্যাডোর দিকে ফিরল ওর মনোযোগ। ‘কিন্তু যে কিম্ভূতদের সাথে তোমার দেখা হয়েছিল, তাদের কথা আলাদা। ওরা আছে, কারণ সবাই জানে যে ওদের থাকার দরকার আছে!’ কাপে চুমুক দিলেন মহিলা, এরপর উঠে দাঁড়ালেন। ‘শ্যাডো নামটা ভালো। যাক গে, আমার মোকাচিনো দরকার। চলো, যাই।’ 

হাঁটতে শুরু করলেন তিনি। ‘খাবারের কী হবে?’ জানতে চাইলেন ওয়েনসডে। ‘এভাবে রেখে যাবে?’ 

ওয়েনসডের দিকে তাকিয়ে হাসলেন ইস্টার। ক্ষুধার্ত মেয়ে আর কুকুরের দিকে ইঙ্গিত করলেন। এরপর হাত দুপাশে ছড়িয়ে যেন বোঝালেন সারা পৃথিবীকে। ‘ওরা খাক।’ আর দাঁড়ালেন না তিনি, ওয়েনসডেকে সাথে নিয়ে পিছু নিলো শ্যাডো। 

‘মনে আছে,’ হাঁটতে হাঁটতে ওয়েনসডেকে বললেন তিনি। ‘আমি ধনী? আরামেই তো আছি। তোমাদেরকে সাহায্য করতে যাব কেন?’ 

‘তুমি আমাদেরই একজন।’ বললেন ওয়েনসডে। ‘আমাদের সবার মতো তোমাকেও ভুলে গেছে মানুষ। আগের মতো করে তাদের ভালোবাসা পাও না তুমি। তাই প্রশ্নটা হলো, আমাদের সাহায্য করবে না কেন?’ 

রাস্তার পাশের একটা কফিহাউজে এসে বসল ওরা। ওয়েট্রেস মাত্র একজন, নিজের পৌত্তলিক পরিচয় বোঝাবার জন্য একটা হলদে রিং পরে আছে ভ্রুতে। আরেকজন কাউন্টারের পেছনে দাঁড়িয়ে কফি বানাবার কাজে ব্যস্ত। ওদের দিকে এগিয়ে এলো ওয়েট্রেস, মুখে বহুল প্রশিক্ষিত হাসি। 

ওয়েনসডের চৌকোনা ধূসর হাতে হাত রাখলেন ইস্টার। ‘কেবলই তো বললাম,’ বললেন তিনি। ‘আমি আরামেই আছি। আমার দিনটাকে এখনও ডিম আর খরগোশ ব্যবহার করে উদযাপন করা হয়। মানুষ মাথায় ফুলের মুকুট পরে, একে অন্যকে উপহার দেয় পুষ্পাহার। আর সবই করে আমার নামে। প্রতি বছর সংখ্যাটা আরও বাড়ছে।’ 

‘তাদের ভালোবাসা আর পূজায় তুমি প্রতি বছর আরও মোটা হচ্ছ?’ শুষ্ক কণ্ঠে বললেন ওয়েনসডে। 

‘বাজে ব্যবহার করো না।’ আচমকা খুব ক্লান্ত মনে হলো ইস্টারকে, মোকাচিনোর কাপে চুমুক দিলেন তিনি।

‘প্রশ্নটা গুরুতর। আমিও তোমার সাথে একমত, প্রতি বছর শত শত মানুষ তোমার নামে একে-অন্যকে উপহার দেয়। তোমার উৎসব উদযাপনের প্রায় সব প্রথাই অনুসরণ করে। কিন্তু কখনও সত্যিকার তোমাকে চিনে করে কাজটা? হুহ? এক্সকিউজ মি, মিস?’ ওয়েট্রেসকে ডাকলেন তিনি। 

মেয়েটা জানতে চাইল, ‘আরেকটা এসপ্রেসো লাগবে?’ 

‘না, সোনামণি। আমাদের তর্ক হচ্ছে, তোমাদের মতামত দরকার। ‘ইস্টার’ শব্দটা আসলে কী বোঝায়, বলো তো?’ 

এমনভাবে ওয়েনসডের দিকে তাকিয়ে রইল মেয়েটা, যেন চোখের সামনে দুনিয়ার অস্টমাশ্চার্য দেখছে! তারপর বলল, ‘আমি পৌত্তলিক, খ্রিস্টানদের ব্যাপারে ধারণা নেই।’

কাউন্টারের পেছনে থাকা মহিলা বলল, ‘আমার ধারণা শব্দটা ল্যাটিন। এর অর্থ-যিশুর পুনরুত্থান। 

‘তাই?’ 

‘হ্যাঁ, আমি মোটামুটি নিশ্চিত।’ বলল মহিলা। ‘সূর্য যেমন ইস্ট, মানে পূর্ব দিকে ওঠে।’ 

‘পুনরুত্থিত যুবক, হুম…যুক্তিযুক্ত কথা।’ ওয়েনসডের মন্তব্য শুনে হাসল মহিলা, এরপর মন দিল কফি মেশিনে। ওয়েট্রেসের দিকে তাকালেন প্রৌঢ়। ‘আরেকটা এসপ্রেসো দিতে পারো। আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি। তুমি পৌত্তলিক, তাই না? কার উপাসনা করো?’ 

‘উপাসনা?’ 

‘হ্যাঁ, উপাসনা। অনেক দেবতাই তো আছেন। তা বিশেষ কার উদ্দেশ্যে ঘরে প্রার্থনার বেদী বানিয়েছ? কার সামনে মাথা নত করো? সকাল-বিকাল কাকে পূজা দাও?’ 

শব্দ বেরোবার আগে কয়েকবার ঠোঁট নাড়ল মেয়েটা। ‘মেয়েদের শক্তিকে, নারী ক্ষমতায়নের পূজা করি বলতে পারেন।’ 

‘খুব ভালো। তা এই নারী-শক্তির কোন বিশেষ নাম আছে?’ 

‘আমার পূজ্য আসলে আছেন সবার অন্তরে।’ ভ্রু কুঁচকে তাকাল মেয়েটা। ‘তার নামের দরকার নেই।’ 

‘আহ,’ মুচকি হেসে বললেন ওয়েনসডে। ‘নিশ্চয়ই তার উদ্দেশ্যে নানা আচার পালন করো? পূর্ণিমার রাতে লাল ওয়াইন পান করো? নগ্ন হয়ে ডুব দাও ফেনার মাঝে? নাকি রুপালি মোমদানিতে লালচে মোম জ্বালাও?’ 

‘ঠাট্টা করছেন আপনি।’ বলল মেয়েটা। ‘আমরা ওসব কিছুই করি না।’ দীর্ঘ একটা শ্বাস টানল ওয়েট্রেস, শ্যাডোর মনে হলো মনে মনে দশ পর্যন্ত গুনছে বোধহয়। ‘আর কফি দেব? ম্যাম, আপনার আরেক কাপ এসপ্রেসো লাগবে?’ মেয়েটার মুখে সেই আড়ষ্ট হাসি ফিরে এসেছে। 

মাথা নাড়ল সবাই, আরেক গ্রাহকের দিকে এগোল ওয়েট্রেস। 

‘বুঝতে পেরেছ নিশ্চয়?’ বিজয়ীর সুরে বললেন ওয়েনসডে। ‘এবার তাহলে রাস্তায় যেতে চাও? ইস্টোরে অভ দ্য ডনের নামানুসারে যে ইস্টারেরনামকরণ করা হয়েছে, সেটা কজন জানে-বের করতে চাও? এসো, একটা বাজিও ধরে ফেলি। আমরা একশজনকে জিজ্ঞেস করব। যতজন সঠিক উত্তরটা দেবে, আমার ততগুলো আঙুল কেটে ফেলো তুমি। আর প্রতি বিশজন অজ্ঞকে পাবার বিনিময়ে আমার সাথে একরাত শোবে তুমি। এখানে, এই স্যান ফ্রান্সিসকোতে তোমার জন্য এরচেয়ে ভালো বাজির শর্ত হতে পারে না। এখানে রাস্তার মোড়ে মোড়ে খুঁজে পাওয়া যাবে পৌত্তলিক আর উইকানদের ‘ 

সবুজ একজোড়া চোখ স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল ওয়েনসডের দিকে। শ্যাডোর মনে হলো, সবুজ পাতার আড়াল থেকে বসন্তের সূর্যের উঁকি দেওয়া দেখতে পাচ্ছে। কিছুই বললেন না ইস্টার। 

‘যাবে?’ বলেই চলছেন ওয়েনসডে। ‘তবে ফলাফল কী হবে তা এখনই বলে দিতে পারি। আমার সবগুলো আঙুলই অক্ষত থাকবে। আর তোমাকে পাঁচ রাত গরম করতে হবে আমার বিছানা। তাই তোমার উদ্দেশ্যে সবাই ভেট দেয়, তোমার দিন উদযাপন করে—এসব আমাকে বলো না। ওরা তোমার নাম মুখে নেয় বটে, কিন্তু তার প্রকৃত অর্থ না জেনেই!’ 

ইস্টারের চোখে পানি দেখা গেল। ‘সে কথা জানি,’ বললেন তিনি। ‘বোকা নই আমি।’ 

‘না,’ একমত ওয়েনসডে। ‘তা তুমি নও।’ 

পৌঢ় একটু বেশিই বলে ফেলেছেন, ভাবল শ্যাডো। 

লজ্জিত ভঙ্গিতে নিচের দিকে তাকালেন ওয়েনসডে। ‘আমি দুঃখিত।’ বললেন তিনি। শ্যাডো তার কণ্ঠে সত্যতা খুঁজে পেল। আমাদের তোমাকে দরকার। তোমার প্রাণশক্তি দরকার, দরকার তোমার উচ্ছ্বাস। আসন্ন ঝড়ে আমাদের পাশে দাঁড়াবে?’ 

‘হ্যাঁ,’ কিছুক্ষণ ইতস্তত করে অবশেষে বললেন তিনি। ‘দাঁড়াব।’ 

আন্তরিকতা আর সততার ভান করা শিখে নিলে, আর কোন কিছুই একজন প্রতারককে আটকাতে পারে না-ভাবল শ্যাডো। পরক্ষণেই ওয়েনসডেকে প্রতারক ভাবায় অপরাধবোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল ওর মনে। 

আঙুলের ডগায় চুমু খেয়ে, ইস্টারের গাল স্পর্শ করলেন ওয়েনসডে। ওয়েট্রেসকে ডেকে এনে তাদের কফির দাম চুকালেন, নোটগুলো গুনলেন খুব সাবধানতার সাথে। এরপর বিলের কাগজের সাথে মুড়িয়ে তুলে দিলেন ওয়েট্রেসের হাতে। 

মেয়েটা চলে যাচ্ছিল, এমন সময় শ্যাডো বলল, ‘ক্ষমা করবেন মিস, গুনতে মনে হয় ভুল হয়েছে!’ মেঝে থেকে দশ-ডলারের একটা বিল তুলে ধরল সে। 

‘না তো!’ বলল মেয়েটা, হাতে ধরে রাখা নোটের তাড়ার দিকে তাকিয়ে আছে। 

‘আমি পড়তে দেখেছি, ম্যাম।’ ভদ্রভাবে বলল শ্যাডো। ‘আরেকবার গুনে দেখবেন?’ 

হাতের নোটগুলো গুনল মেয়েটা, অবাক হয়ে বলল, ‘হায় যিশু, আপনি ঠিক বলেছিলেন। দুঃখিত।’ শ্যাডোর হাত থেকে দশ ডলারের বিলটা নিলো সে। 

ওদের সাথে ফুটপাত পর্যন্ত হেঁটে এলেন ইস্টার। আলো মরতে শুরু করেছে, ওয়েনসডের দিকে তাকিয়ে নড করলেন তিনি, এরপর শ্যাডোর হাত স্পর্শ করে বললেন, ‘গতরাতে কী স্বপ্ন দেখেছিলে?’ 

‘থান্ডারবার্ড আর খুলির পাহাড়ের স্বপ্ন। 

মাথা নাড়লেন ইস্টার। ‘ওগুলো কার খুলি, জানো?’ 

‘স্বপ্নে একটা কণ্ঠ বলেছিল…’ 

কিছু না বলে অপেক্ষা করলেন ইস্টার। 

‘বলেছিল, খুলিগুলো আমার,’ জনালা শ্যাডো। ‘আমার পুরাতন খুলি। লাখ লাখ হবে সংখ্যায়।’

ওয়েনসডের দিকে তাকিয়ে ইস্টার বললেন, ‘আগলে রাখার মতো একজনকে পেয়েছ দেখছি।’ চারদিক উজ্জ্বল করে দেওয়া হাসিটা হাসলেন তিনি। এরপর শ্যাডোর হাতে আলতো করে চাপড় দিয়ে হেঁটে গেলেন ফুটপাত ধরে। মহিলার দিকে তাকিয়ে রইল শ্যাডো। চেষ্টা করল মহিলার দুই উরু ঘষা খাবার দৃশ্যটা কল্পনা না করতে, কিন্তু ব্যর্থ হলো। 

বিমান বন্দরে ফেরার পথে, ওর দিকে তাকিয়ে ওয়েনসডে বললেন। ‘দশ ডলার নিয়ে ঝামেলাটা করলে কেন?’ 

‘না করলে মেয়েটাকে নিজের বেতন থেকে টাকা দিতে হতো।’ 

‘তাতে তোমার কী?’ ওয়েনসডেকে বিরক্ত মনে হলো। 

একটু ক্ষণের জন্য ভাবল শ্যাডো, জবাব দিল, ‘আমি চাই না অমনটা আমার সাথে কেউ করুক। মেয়েটা তো কোন দোষ করেনি।’ 

‘করেনি?’ দূরে নজর দিলেন পৌঢ়। ‘সাত বছর বয়সে, একটা বিড়ালের বাচ্চাকে ক্লজিটে আটকে রেখেছিল মেয়েটা। কয়েকদিন চুপচাপ বসে মিউ মিউ করতে শুনেছে। যখন মিউ মিউ বন্ধ হলো, তখন ক্লজিট খুলে লাশটাকে একটা জুতার বাক্সে নিয়ে বাড়ির পেছনে কবর দিয়েছিল। কাজটা কেন করেছিল, জানো? কারণ ওর কিছু একটা কবর দেবার ইচ্ছা হয়েছিল। যেখানেই কাজ করে, সেখান থেকেই কিছু না কিছু চুরি করে, তবে খুব অল্প পরিমাণে। গত বছর যখন দাদিকে নার্সিং হোমে দেখতে যায়, তখন তার বিছানার পাশের টেবিল থেকে একটা সোনার অ্যান্টিক ঘড়ি চুরি করে আনে। তারপর আরও কয়েক বৃদ্ধ-বৃদ্ধার ঘরে গিয়ে চুরি করে টাকা আর কিছু দ্রব্য। ওগুলো নিয়ে কী করবে, তা বাসায় ফিরে বুঝতে পারেনি। তবে কেউ যদি ধরে ফেলে, এই ভয়ে নগদ বাদে বাকি সব ছুড়ে ফেলেছিল পানিতে।’ 

‘বুঝতে পেরেছি।’ বলল শ্যাডো। 

‘গনোরিয়াও আছে মেয়েটার, তবে তার লক্ষণ এখনও প্রকাশ পায়নি।’ বললেন ওয়েনসডে। ‘নিজের এই রোগ আছে বলে সন্দেহ করে বটে, কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেনি। মেয়েটার প্রাক্তন প্রেমিক যখন এ কথা বলেছিল, তখন নিজেকে অপমানিত মনে করে ছেলেটার সাথে সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলে সে।’ 

‘বুঝতে পেরেছি,’ জানাল শ্যাডো। ‘আর কিছু বলার দরকার নেই। চাইলে যে কারও ব্যাপারেই শুধু খারাপ দিকগুলো বলা যায়, তাই না?’ 

‘অবশ্যই। মানুষ সবসময় ভাবে, ওদের অপরাধ অনন্য। আগে কেউ কখনও তেমন কিছু করেনি। কিন্তু আসলে অপরাধ সবসময় একই থাকে। 

‘এজন্য আপনার দশ ডলার চুরি করা জায়েজ হয়ে গেল?’ 

ট্যাক্সির ভাড়া দিয়ে বিমান বন্দরের ভেতরে প্রবেশ করল দুজন। এখনও যাত্রী বোর্ডিং শুরু হয়নি। মুখ খুললেন ওয়েনসডে। ‘এছাড়া আর কী করতে পারি আমি? আমার উদ্দেশ্যে এখন আর ভেড়া বা মহিষ উৎসর্গ করা হয় না। খুনি আর দাসদের আত্মা ভেট দেয় না কেউ। আমার অস্তিত্বের জন্য দায়ী মানুষ, আর ওরাই কিনা আমাকে ভুলে গেছে? আমি ওদেরকে একটু শায়েস্তা করতে চাই, এই চাওয়াটা কি খুব বেশি কিছু? এটা কি অবিচার?’ 

‘আমার মা প্রায়ই বলতেন, ‘জীবনে অনেকসময় অবিচারের মুখোমুখি হতে হয়।’ 

‘মায়েরা এসব বলেই।’ বললেন ওয়েনসডে। ‘সেই সাথে এ-ও বলে, ‘তোমার বন্ধুরা যদি দল বেঁধে পাহাড় থেকে ঝাঁপ দেয়, তাহলে কি তুমিও দেবে?’ 

‘আপনি মেয়েটাকে ঠকাতে চেয়েছিলেন, আমি চাইনি।’ একগুঁয়ের মতো জবাব দিল শ্যাডো। ‘এটাই সঠিক কাজ ছিল।’ 

বিমান বন্দরের কেউ একজন ঘোষণা করল, ওদের বিমান শীঘ্রই ছাড়বে। উঠে দাঁড়ালেন ওয়েনসডে। ‘আসা করি সুবিচার আর অবিচারের এই দৃষ্টিভঙ্গি তোমার মাঝে অটল থাকবে।’ 

.

শ্যাডোকে যখন ওয়েনসডে পরেরদিন অ্যাপার্টমেন্টের সামনে নামিয়ে দিলেন, তখন দিনের আলো এখনও ভালোভাবে ফোটেনি। লেকসাইড এখনও ঠান্ডার চাদরে নিজেকে মুড়ে রেখেছে, তবে আগের মতো সেই তীব্র ঠান্ডা নেই। এম অ্যান্ড আই ব্যাংকের আলোকিত অংশটা একবার সময় দেখাচ্ছে ৩:৩০ এএম,একবার দেখাচ্ছে তাপমাত্রা -৫০ ফারেনহাইট। 

ঘড়িতে যখন সকাল সাড়ে নয়টা বাজে, তখন অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় নক করল পুলিস চিফ চ্যাড মুলিগান। শ্যাডোকে জিজ্ঞেস করল, ও অ্যালিসন ম্যাকগভার্ন নামে কোন মেয়েকে চেনে কি না? 

‘মনে পড়ছে না,’ ঘুম ঘুম গলায় জবাব দিল শ্যাডো। 

‘ছবিটা দেখো একবার।’ হাইস্কুলের পোশাক পরা একটা ছবি দেখাল চ্যাড। সাথে সাথে মেয়েটাকে চিনতে পারল শ্যাডো, দাঁতে নীল রাবারের ব্যান্ড পরা এই মেয়েটিই গ্রেহাউন্ড বাসে ওর সামনে বসেছিল। 

‘ওহ, চিনি তো। আমার সাথে বাসে ছিল।’ 

‘গতকাল তুমি কোথায় ছিলে, মিস্টার আইনসেল?’ 

শ্যাডোর মনে হলো, ওর দুনিয়া যেন পাক খেতে শুরু করেছে। অবশ্য বিবেকের দংশনে নীল হবার মতো কোন অপরাধ সে করেনি (তুমি পেরোল অমান্য করে ছদ্ম নামে এখানে আছ, ওর ভেতরের একটা কণ্ঠ বলল। এটাই কী আবার জেলে যাবার জন্য যথেষ্ট না?)। 

‘স্যান ফ্রান্সিসকো,’ বলল সে। ‘ক্যালিফোর্নিয়ায়। আমার চাচার সাথে ছিলাম।’ 

‘টিকিটটা রেখেছ?’ 

‘হ্যাঁ।’ বিমানের টিকিট আর বোর্ডিং পাসের অংশ পকেটেই ছিল শ্যাডোর, সেটা বের করে দিল। ‘কী হয়েছে?’ 

টিকিট পরীক্ষা করে দেখল চ্যাড মুলিগান। ‘অ্যালিসন ম্যাকগভার্নকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়েটা লেকসাইড হিউমেইন সোসাইটির সদস্যা ছিল। পশুদেরকে খাবার খাওয়াত, কুকুর হাঁটাতে নিয়ে যেত। ক্লাস শেষ হবার পর কয়েক ঘণ্টার জন্য বাইরে বেরিয়েছিল মেয়েটা। হিউমেইন সোসাইটির প্রধান, ডলি নফ, প্রতিদিন রাতে মেয়েটাকে বাড়িতে পৌঁছে দিত। সে-ও ওকে দেখেনি গতকাল। তাই, বুঝতেই পারছ!’ 

‘মেয়েটা উধাও হয়ে গেছে?’ 

হ্যাঁ। ওর বাবা-মা আমাদেরকে গতকাল জানিয়েছে। বোকা মেয়েটা লিফট নিয়ে নিয়ে যেত হিউমেইন সোসাইটি অফিসে। ওটা একটু নির্জন এলাকাতেই, কাউন্টি ডব্লিউতে। অ্যালিসনের বাবা-মা মানা করত…কিন্তু এদিকে যে মানুষজন দরজাই বন্ধ করে না রাতে। তাই মেয়েটাও কানে তোলেনি। আর এমনিতেও, এসব কমবয়সি বাচ্চা-কাচ্চারা কারও কথা শুনতেই চায় না। আরেকবার দেখ ছবিটা।’ 

ছবির অ্যালিসন ম্যাকগভার্ন দাঁত বের করে হাসছে, তবে দাঁতে লাগানো রাবারের ব্যান্ডটা লাল। 

‘সত্যি করে বলো, আসলেই কি তুমি এই মেয়েকে কিডন্যাপ করোনি? ধর্ষণের পর খুন করোনি তো?’ 

‘আমি গতকাল স্যান ফ্রান্সিসকোতে ছিলাম। আর তাছাড়া, ওসব করার কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না।’ 

‘আমিও তাই ভেবেছিলাম। যাই হোক, মেয়েটাকে খুঁজতে সাহায্য করবে?’

‘আমি?’ 

‘হ্যাঁ, তুমি। আজ সকালে আমরা কুকুর ব্যবহার করে খুঁজেছিলাম, পাইনি কিছুই। দীর্ঘশ্বাস ফেলল চ্যাড। ‘মাইক, আমার মনে হয় মেয়েটা কোনো মাদকাসক্ত প্রেমিক জুটিয়েছে। তার সাথে হয়তো পালিয়ে গেছে বড়ো শহরে।’ 

‘তোমার তাই মনে হচ্ছে?’ 

‘সম্ভাবনা আছে। আমার সাথে খোঁজে যোগ দেবে?’ 

হেনিংস ফার্ম অ্যান্ড হোম সাপ্লাইজে মেয়েটাকে দেখার কথা মনে পড়ে গেল শ্যাডোর। তখন মনে হচ্ছিল, বয়স হলে দারুণ সুন্দরী হবে মেয়েটা। ‘অবশ্যই।’ বলল সে। 

.

ফায়ার স্টেশনের লবিতে প্রায় দুই ডজন নারী-পুরুষের সাথে দেখা হলো ওর। হিনজেলমানকে চিনতে কষ্ট হলো না, আরও কয়েকজনের চেহারা পরিচিত বলে মনে হলো। দুজন পুলিস অফিসারও আছে, লাম্বার কাউন্টির শেরিফ ডিপার্টমেন্টের উর্দি পরাও আছে কয়েকজন। 

অ্যালিসন নিরুদ্দেশ হবার সময় কী পরে ছিল তা জানাল চ্যাড মুলিগান—একটা খয়েরি স্যুট, সবুজ গ্লাভস, নীল-রঙা উলের হ্যাট। স্বেচ্ছাসেবীদেরকে তিনটা দলে ভাগ করল চিফ। শ্যাডো, হিনজেলমান আর ব্রোগান নামের আরেকজনকে নিয়ে গঠিত হলো ওদের দলটা। সবাইকে মনে করিয়ে দেওয়া হলো, আজকাল দিনের আলো বেশি থাকে না। এটাও বলা হলো—ঈশ্বর না করুন, যদি অ্যালিসনের মরদেহ পাওয়া যায়, তাহলে যেন কিছু ধরা বা নাড়া-চাড়া না করা হয়। শুধু রেডিয়োতে জানালেই হবে। আর যদি জীবিত পাওয়া যায়, তাহলে সাহায্য আসার আগে দেহটাকে গরম রাখতে হবে। 

কাউন্টি ডব্লিউতে নামিয়ে দেওয়া হলো ওদের। 

শ্যাডোর দলটা একটা বরফে জমাট বাঁধা পর্বত-গাত্র বরাবর শুরু করল খোঁজা। প্রত্যেক দলকেই একটা করে ওয়াকি-টকি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। 

আকাশে নিচু হয়ে ভাসছে মেঘ, ধূসর বর্ণ ধারণ করেছে চারপাশ। লাগাতার প্রায় ছত্রিশ ঘণ্টা ধরে তুষারপাত হচ্ছে। মাটিতে পড়ে থাকা তুষারে পায়ের ছাপ পড়লেও, বেশিক্ষণ থাকার সুযোগ পাচ্ছে না। 

ব্রোগানকে দেখতে বয়স্ক, অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল বলে মনে হয়। সরু গোঁফ আর পাক ধরা চুল সেই ধারণাকেই আরও পোক্ত করে যেন। তবে শ্যাডোকে তিনি জানালেন, কর্মজীবনে ছিলেন স্কুলের প্রিন্সিপাল। ‘বয়স তো হচ্ছে, এখনও অল্প- সল্প পড়াই। স্কুল নাটকটা পরিচালনাও করি। সেই সাথে মাঝে-সাঝে শিকার করা আর পাইক হ্রদের পাশে কেবিন তো আছেই।’ চলতে চলতে আরও যোগ করলেন। ‘মেয়েটাকে পাওয়া যাক, সেটাই আমার আশা। কিন্তু সেই সাথে এ-ও আশা করি, আমরা যেন খুঁজে না পাই। বুঝতে পেরেছ?’ 

অন্তর্নিহিত অর্থটা পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে শ্যাডো। 

তিনজনের মাঝে কথা হলো না খুব একটা। চুপচাপ খুঁজে গেল ওরা। খয়েরি স্যুট বা সবুজ গ্লাভস বা নীল হ্যাটের খোঁজে। সেই সাথে চোখ খোলা রাখল সাদা একটা দেহের জন্যও। মাঝে মাঝেই ওয়াকি-টকিতে চ্যাড মুলিগানের সাথে যোগাযোগ করলেন ব্রোগান। 

দুপুরের খাবারের সময় দলের অন্যান্যদের সাথে একটা স্কুল বাসে বসে হট ডগ আর গরম স্যুপ খেল ওরা। খাবার ফাঁকে ফাঁকে দাদার ট্রাম্পেট নিয়ে গল্প শোনালেন হিজেলমান। শৈত্য-প্রবাহের সময় বার্নে গিয়ে বাজান শুরু করেছিলেন তিনি বাদ্যযন্ত্রটা, কিন্তু কোনো শব্দই বেরোয়নি! 

‘তারপর ঘরে ফিরে, ওটাকে গরম করা জন্য স্টোভের পাশে রেখে দিয়েছিলেন। পরিবারের সবাই রাতে যখন ঘুমিয়ে ছিল, ঠিক তখনই…একেবারে আচমকা, ট্রাম্পেট থেকে বেরোতে শুরু করল বাজনা। আমার দাদি তো ভয় পেয়ে আরেকটু হলে হার্টফেল করে মরতেন!’ 

বিষণ্ণ বিকালটা বিফলে গেল, আস্তে আস্তে মরে এলো দিনের আলো। দুনিয়া কিছুটা নীলচে বর্ণ ধারণ করা মাত্র শুরু হলো ঠান্ডা বাতাস, চেহারায় স্পর্শ করা মাত্র ব্যথার জন্ম দিতে শুরু করল সে। অন্ধকার গভীর হয়ে এলে মুলিগান রেডিয়োতে ওদের সবাইকে ফিরে আসার নির্দেশ দিল। একসাথে, একটা স্কুল-বাসে করে ফিরল সবাই ফায়ার স্টেশনে। 

ফায়ার স্টেশনের পাশেই একটা বার, নাম- দ্য বাক স্টপস হেয়ার। অনুসন্ধানকারীদের প্রায় সবাই সেখানেই ভিড় জমালো। সারাদিনের ব্যর্থ পরিশ্রমের পর ক্লান্ত সবাই। ঠান্ডার প্রসঙ্গে, অ্যালিসন ম্যাকগভার্নের প্রসঙ্গে কথা বলছে সবাই। তাদের ধারণা, দুই-একের মাঝেই এসে হাজির হবে মেয়েটা। ওর অকস্মাৎ আত্মগোপনের কারণে যে ঝামেলা হচ্ছে, সে সম্পর্কে মনে হয় কিছু জানেই না! 

‘আশা করি এ জন্য শহরের ব্যাপারে তোমার মনে বাজে চিন্তার উদ্রেক হয়নি, বলল ব্রোগান। ‘শহরটা বেশ ভালো।’ 

‘লেকসাইড,’ পাতলা একজন মহিলা বলল, শ্যাডোর সাথে পরিচয় হয়েছে সকালেই। তবে নাম ভুলে গেছে ও। ‘উত্তরের অন্যতম সেরা শহর। এখানকার কজন বেকার, জানো?’ 

‘না।’ বলল শ্যাডো। 

‘টেনে-টুনে বিশজন হবে কি না সন্দেহ।’ জানাল মহিলা। ‘অথচ এই শহর আর তার আশপাশে বাস করে কম করে হলেও বিশ হাজার মানুষ। আমরা ধনী না হতে পারি, কিন্তু বেকার বসে নেই কেউ। অথচ উত্তর-পূর্বের অধিকাংশ শহরের কথাই ধরো—ওদের অধিকাংশই এখন মরে গেছে। ফার্মের উপর ভরসা করে গড়ে ওঠা শহরগুলো মরে গেছে দুধের দাম বা শুয়োরের বাজারদর কমে যাওয়ায়। আমেরিকার মধ্য-পশ্চিম এলাকাগুলোতে কৃষকের সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় কী সে, বলো তো?’ 

‘আত্মহত্যা?’ আন্দাজ করল শ্যাডো। 

হতাশ দেখাল মহিলাকে। ‘হ্যাঁ। আত্মহত্যা।’ মাথা নাড়ল মহিলা। ‘এদিকের অনেক শহর কেবল মাত্র পর্যটক আর শিকারিদের উপর নির্ভর করে বসে আছে। ওদের কাছ থেকে টাকা নেয়, আর বিনিময়ে দেয় ট্রফি। আছে অনেকগুলো কোম্পানির উপর ভর করে টিকে থাকা শহর। ওই কোম্পানি অন্য কোথাও কারখানা নিয়ে গেলেই, ধসে যায় শহরটাও! মাফ করবে, তোমার নামটা ভুলে গেছি।’ 

‘আইনসেল,’ বলল শ্যাডো। ‘মাইক আইনসেল।’ হাতে ধরা বিয়ারটা স্থানীয় হলেও, দারুণ সুস্বাদু। ঝরনার পানি ব্যবহার করে বানানো। 

‘আমি কেলি নফ,’ নিজের পরিচয় আবারও দিল মহিলা। ‘ডলির বোন।’ ঠান্ডায় এখনও লাল হয়ে আছে তার চেহারা। ‘যেটা বলছিলাম, লেকসাইডের আসলে কপাল ভালো। আমাদের কিছু কিছু করে সবকিছুই আছে-ফার্ম, কারখানা, পর্যটন, হস্ত-শিল্প। ভালো স্কুলও আছে। 

বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে মহিলার দিকে তাকাল শ্যাডো। কেলির কথাগুলো কেমন যেন ফাঁপা ফাঁপা লাগছে। মনে হচ্ছে, দক্ষ এক সেলসম্যানের বয়ান শুনতে পাচ্ছে। কে জানে, সম্ভবত শ্যাডোর চেহারায় সেই বিভ্রান্ত ভঙ্গিটা দেখতে পেল মহিলা। ‘আমি দুঃখিত,’ বলল সে। ‘আসলে প্রিয় বিষয় নিয়ে একবার কথা বলা শুরু হলে, আর থামতে চাই না। যাই হোক, কী করো তুমি?’ 

‘আমার চাচা দেশজুড়ে অ্যান্টিক জিনিস-পত্র কেনা বেচা করে। বড়ো আর ভারী জিনিসগুলো নড়াচড়া করার সময় ডাক পড়ে আমার। কাজটা ভালো, তবে সবসময় ব্যস্ত থাকতে হয় না।’ একটা কালো বিড়াল, বারের মাসকট হবে, শ্যাডোর দুই পায়ের ফাঁকে এসে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ ওর বুটের সাথে মাথা ঘষে উঠে এলো ওর পাশে। বেঞ্চে শুয়ে আরাম করে ঘুমিয়ে পড়ল। 

‘অন্তত,’ বলল ব্রোগান। ঘুরে বেড়াবার সুযোগ তো পাও। আর কিছু করো না?’ 

‘তোমার কাছে কোয়ার্টার হবে আটটা?’ জানতে চাইল শ্যাডো। পকেট হাতড়ে মাত্র পাঁচটা কোয়ার্টার বের করে আনল ব্রোগান। কেলি নফ দিল বাকি তিনটা। 

আটটা পয়সা নিয়ে দুই সারিতে চারটা চারটা করে সাজাল শ্যাডো। টেবিলের নিচে বাঁ হাত রেখে, একটুও ইতস্তত না করে চারটা পয়সা নিচে নিয়ে এলো! 

এরপর আটটার আটটাকেই ডান হাতে নিয়ে নিলো ও। বাঁ দিকে থাকা একটা খালি গ্লাস ঢেকে দিল ন্যাপকিন দিয়ে। ডান হাত থেকে একটা একটা করে পয়সা ফেলল ও, আর ওগুলো গিয়ে জমা হলো গ্লাসের ভেতর। ডান হাত খুলে সবাইকে দেখাল সে-ভেতরটা একেবারে খালি। এরপর ন্যাপকিন সরানো মাত্র সবগুলো পয়সা গ্লাসের ভেতর দেখা গেল! 

পয়সাগুলো ফিরিয়ে দিল শ্যাডো-তিনটা কেলিকে, আর পাঁচটা ব্রোগানকে। এরপর আবার একটা নিয়ে নিলো ব্রোগানের হাত থেকে। ওটাকে ফুঁ দিয়ে বানিয়ে দিল একটা পেনি! ব্রোগানকে ওটা দেওয়ার পর লোকটা অবাক হয়ে গুনে দেখল, হাতে এখনও পাঁচটা কোয়ার্টারই আছে! 

‘তুমি তো দেখি,’ আনন্দিত কণ্ঠে বলল হিনজেলমান। ‘হুডিনির সাক্ষাৎ ছোটো ভাই!’ 

‘আমি শিক্ষানবিশ।’ বলল শ্যাডো। ‘এখনও অনেকদূর যেতে হবে।’ মুখে বললেও, ভেতরে ভেতরে গর্বিতবোধ করল ও। জীবনে এই প্রথম প্রাপ্তবয়স্ক একদল মানুষকে জাদু দেখাল। 

ফেরার পথে খাবারের দোকান থেকে এক কার্টুন দুধ কিনল ও। চেক-আউট কাউন্টারের মেয়েটা পরিচিত লাগছে খুব, কাঁদতে কাঁদতে চোখ লাল করে ফেলেছে সে। চেহারায় ফুটি-ফুটি দাগ। 

‘তোমাকে আমি চিনি।’ বলল শ্যাডো। ‘তুমি হলে-’ আরেকটু হলেই বলে বসেছিল—তুমি হলে আলকা-সেলটজার মেয়ে। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তুমি অ্যালিসনের বন্ধু। বাসে তোমাদেরকে একসাথে দেখেছি। আশা করি মেয়েটার কোনো বিপদ হয়নি।’ 

নাক টানল মেয়েটা, মাথা নেড়ে বলল, ‘আমিও তাই আশা করি। মেয়েটার বুকের কাছে একটা ব্যাজ লাগানো। ওতে লেখা—হাই! আমি সোফি। বিশ পাউন্ড ওজন কমাতে চাও? তাও আবার ত্রিশ দিনে? তাহলে আমাকে জিজ্ঞেস করো। 

সারাটা দিন ওকে খুঁজে বেরিয়েছি আমরা। কপাল মন্দ, পাইনি।’ 

আবার মাথা দোলাল সোফি, চোখ ছলছল করছে। দুধের কার্টুনটা একটা স্ক্যানারের সামনে ধরল ও, শ্যাডোকে দাম বলা মাত্র দুই ডলার এগিয়ে দিল সে মেয়েটার দিকে। 

‘আমি এই বালের শহরে আর থাকছি না,’ প্রায় বসে যাওয়া কণ্ঠে আচমকা বলে উঠল মেয়েটা। ‘অ্যাশল্যান্ডে আমার মার সাথে থাকব। এই বছর অ্যালিসন উধাও, গত বছর গেছিল স্যান্ডি ওলসেন। তার আগের বছর জো মিং। সামনের বছর যদি আমার পালা আসে তো?’ 

‘আমি তো ভেবেছিলাম, স্যান্ডি ওলসেন ওর বাপের সাথে চলে গেছে! 

‘হুম,’ তিক্ত কণ্ঠে বলল মেয়েটা। ‘আর জো মিং পালিয়েছে ক্যালিফোর্নিয়ায়। সারা লিভকুইস্ট রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে পথ ভুল করেছে, তাই না? যাই হোক, আমি অ্যাশল্যান্ডে যেতে চাই।’ 

লম্বা করে একটা শ্বাস নিলো মেয়েটা, তারপর শ্যাডোকে অবাক করে দিয়ে হাসল! অভিনয় বলে মনে হলো না শ্যাডো। সম্ভবত মেয়েটাকে নির্দেশ দেওয়া আছে, কেনাকেটা শেষ করলে ক্রেতার দিকে তাকিয়ে হাসতে হবে। বাকি দিনটা ভালো কাটুক, এই বলে খুচরা পয়সা ওর দিকে এগিয়ে দিল মেয়েটা। এরপর মন দিল লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা পরের ক্রেতার দিকে। 

দুধ নিয়ে ফিরতি পথ ধরল শ্যাডো। হ্রদের উপর দাঁড়িয়ে থাকা ক্ল্যাংকার আর ব্রিজ পার হয়ে এসে পৌঁছাল অ্যাপার্টমেন্টে। 

আমেরিকায় আগমন 
১৭৭৮ 

এক ছিল মেয়ে, যার মামা তাকে বিক্রি করে দিয়েছিল, নিখুঁত হাতের লেখায় কাগজে লিখল মি. আইবিস । 

 গল্পটা আসলে এতটুকুই, বাকিটা কেবল বিস্তারিত বর্ণনা। এমন অনেকগল্প আছে, যেগুলো মন দিয়ে শুনলে বা পড়লে আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হবে। একজন মানুষের গল্প বলি। ভালো মানুষ, বন্ধুদের প্রতি দয়ালু। স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ত, ছেলে-মেয়ে অন্ত:প্রাণ। দেশকে খুব ভালোবাসে, তাই দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে। দক্ষতার সাথে ইহুদিদের খুন করে লোকটা! তাদেরকে বলে: গোসল করতে যাবার সময় কিন্তু আইডেন্টিফিকেশন নম্বর ভোলা যাবে না। অনেকেই ভুলে যায়, আর তাই অন্যের পোশাক নিয়ে বেরিয়ে আসে ভুল করে। কথাটা শুনে সান্ত্বনা পায় ইহুদিরা, ভাবে-গোসলের পরেও বেঁচে থাকবে। আমাদের এই লোক খুব সতর্কতার সাথে গ্যাসে প্রয়োগে মৃত ইহুদিদের দেহগুলো চুল্লিতে ঢুকিয়ে দেয়। লোকটার একমাত্র দুশ্চিন্তা, নরকের কীটগুলোকে হত্যা করার সময় ওর মন খারাপ কেন হয়? নিজে সত্যি সত্যি ভালো মানুষ হলে তো ওর আনন্দিত হবার কথা! 

এক ছিল মেয়ে, যার মামা তাকে বিক্রি করে দিয়েছিল—গল্পটা তাই একদম সহজ…সরল! 

কোনো মানুষই, দাবি করেছিলেন ডন। আলাদা আলাদা ভাবে…দ্বীপের মতো বাস করতে পারে না। ভুল করেছিলেন তিনি। মানুষ যদি আলাদা দ্বীপ না হতো, তাহলে একে-অন্যের দুঃখের মাঝে ভরাডুবি হতো আমাদের। আমরা অন্যদের দুঃখ হতে ইনস্যুলেটেড (যে শব্দটার আভিধানিক অর্থ, দ্বীপে পরিণত করা)। আমাদের এই আলাদা দ্বীপে পরিণত হবার ক্ষমতা, আমাদের সবার গল্পের মিল-এসবই বাঁচিয়ে রেখেছে, সুস্থ রেখেছে সবাইকে। জীবনের গল্পের মূলটা কিন্তু একই—মানুষ জন্মায়, কিছুদিন বেঁচে থাকে আর তারপর একভাবে না একভাবে মারা যায়। বাকি বিরবরণটা ইচ্ছামত বসিয়ে নেওয়া যায়। অন্যদের মতো হলেও, গল্পটা আলাদা আলাদা। জীবনটা যেন তুষারের ছোটো ছোটো টুকরার মতো, একের সাথে অন্যে মিলে স্বাভাবিক…অথচ আলাদা আলাদা নকশা তৈরি করে। ঠিক যেন একই ঝাঁকের কই (কই এক ঝাঁক হলেও, ভালোমতো কয়েক মিনিট দেখলে প্রতিটাকে আলাদা করা সম্ভব)। 

ব্যক্তি কে ব্যক্তি হিসেবে কল্পনা না করলে, সে আসলে অনেক সংখ্যার ভিড়ে আরেকটা সংখ্যা কেবল-এক হাজার মৃত, এক লাখ মারা গেছে, ‘হতাহতের সংখ্যা দশ লাখ ছাড়াতে পারে।’ কিন্তু জীবনের গল্প সেই সংখ্যাটা পরিণত করে মানুষে। তবে হ্যাঁ, সেই মানুষে পরিণত হওয়াটাও আসলে মিথ্যা। কেননা তারপরেও মানুষের দুঃখ-কষ্টের পরিবর্তন আসে না। দুর্ভিক্ষে মারা যাওয়া বাচ্চার কথাই ধরা যাক, ফোলা পেট নিয়ে পড়ে থাকে তার মরদেহ। দেহের চারপাশে ভনভন করে উড়তে থাকে মাছি। তার নাম, পরিচয়, বয়স, স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্ন জানলে কি মৃত্যুর দুঃখ কম অনুভূত হবে? যদি হয়, তাহলে কি তার ভাই বা বোন, যে মরে পড়ে আছে তারই পাশে, তার প্রতি অবিচার করা হবে না। যদি দুজনের প্রতিই করুণা জন্মে মনে, তাহলে সেই দুর্ভিক্ষের ফলে মাছির খাবার হবার অপেক্ষায় আপেক্ষমান বাকি হাজারো বাচ্চার চাইতে কি তারা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাবে? 

এসব মুহূর্তগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য আমরা পরিণত হই একেকটা দ্বীপে, যেখানে দুঃখ আমাদেরকে স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারে না। এজন্যই হয়তো গল্পের দিকে ধাবিত হই আমরা। দুর থেকে অন্য মানুষের মস্তিষ্কে প্রবেশ করার, অন্য কোনো দ্বীপে যাবার সুযোগ হয় আমাদের। গল্পে আমাদের মৃত্যু হয়, অথবা অন্য কারও মৃত্যুর সাক্ষি হই। আর সেই দুনিয়ার বাইরে আসলে আমরা বন্ধ করে দিই বই। ফিরে যাই নিজের জীবনে। 

জীবন সে রকমই, এক-অথচ আলাদা আলাদা। 

আর সেই জীবনের সবচেয়ে সহজ সত্য হলো-এক ছিল মেয়ে, যার মামা তাকে বিক্রি করে দিয়েছিল। 

মেয়েটার জন্ম যেখানে, সেখানে একটা কথা প্রচলিত আছে: কোনো বাচ্চার পিতৃ-পরিচয় নিয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া অসম্ভব। তবে মায়ের পরিচয় ভুল করার সুযোগ নেই। তাই সম্পত্তি আর বংশধারা মাতৃ-তান্ত্রিকভাবে হাত বদল হয়। ক্ষমতার ব্যাপারটা ভিন্ন, সেটা পুরুষই কুক্ষিগত করে রাখে। বোনের ছেলেমেয়ের মালিকানা থাকে পুরোপুরি তার ভাইয়ের হাতে। 

আচমকা যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় দুই গ্রামের মাঝে। আসলে ওটাকে যুদ্ধ না বলে গ্রামের পুরুষদের মাঝে ঝগড়া বলাই ভালো। একদল জয়ী হয়, অন্যদল পরাজিত। জীবনে সেখানে পণ্য, মানুষ-পণ্য সম্পদ। ওখানকার হাজার বছরের সংস্কৃতিতে দাসত্ব জড়িয়ে রয়েছে আষ্টেপৃষ্ঠে। আরব ব্যবসায়ীদের হাতে পতন ঘটেছে পূৰ্ব আফ্রিকার মহান সব সাম্রাজ্য। অবশ্য পশ্চিম আফ্রিকানরা নিজেরাই নিজেদেরকে ধ্বংস করেছে। 

ওদেরকে এই বিক্রি করে দেওয়াটা খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। অবশ্য যমজ ভাই-বোনকে ধরা হয় স্বর্গীয় আর জাদুময় আশীর্বাদ হিসেবে। তাই ভয় পেয়েছিল মামা, এতটাই যে বিক্রি করে দেওয়াটার কথা জানায়নি ওদেরকে। পাছে তার ক্ষতি করে ফেলে দুজন! 

ভাই-বোনের বয়স ছিল বারো। মেয়েটার নাম ছিল উটুটু, দূত-পাখি। আর মৃত এক রাজার নাম অনুসারে ছেলেটার নাম রাখা হয়েছিল আগাসু। সুস্থ-সবল দুই বাচ্চা ছিল ওরা। যমজ বলে দেবতাদের নানা গল্প শোনানো হতো ওদেরকে। সেসব মন দিয়ে শুনত তারা, মনেও রাখত। 

মামা লোকটা ছিল মোটাসোটা আর অলস। যদি তার গোরু-ছাগল আরও বেশি থাকত, তাহলে হয়তো বাচ্চাদেরকে দাস বনতে হতো না। কিন্তু তা না থাকায়, ভাগ্নে-ভাগ্নিকে বিক্রি করে দিল সে। লোকটার কথা যথেষ্ট হয়েছে, এই গল্পে আর সে আসবে না। আমরা দুই যমজকেই অনুসরণ করব। 

আরও কয়েকজন দাসের সাথে বারো মাইল হেঁটে একটা ছোটো আউটপোস্টে এসে উপস্থিত হলো ওরা। এখানে আরও তেরোজনের সাথে বিক্রি করে দেওয়া হলো ওদের, কিনে নিলো ছয়জন মানুষ। হাতে বর্শা আর ছুরি নিয়ে ওদেরকে এই মানুষগুলো হাঁটিয়ে নিলো পশ্চিমে, সমুদ্রের দিকে। সাগর পার ধরে অনেক পথ হাঁটতে হলো ওদেরকে। পনেরো জন দাসের সবার হাত পিছমোড়া করে বাঁধা, একজনের গলার সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে আরেকজনের গলা। 

উটুটু তার ভাইকে জিজ্ঞেস করল, কী হবে ওদের? 

‘আমি জানি না,’ বলল আগাসু। ছেলেটার মুখে আগে হাসি লেগেই থাকত, সাদা-নিখুঁত দাঁতগুলো দেখা যেত সবসময়। ভাইয়ের হাসি দেখে আনন্দ পেত উটুটু নিজেও। এখন অবশ্য হাসছে না আগাসু। বোনকে সাহস দেবার জন্য মাথা উঁচু আর বুক ফুলিয়ে হাঁটছে। 

উটুটু পেছনে দাঁড়ানো লোকটা, যার গালে লম্বা ক্ষতের দাগ, বলল, ‘আমাদেরকে সাদা পিশাচের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হবে। তারা আমাদেরকে নিয়ে যাবে ওদের এলাকায়।’

‘কী করবে নিয়ে গিয়ে?’ জানার দাবি জানাল উটুটু। 

কিন্তু লোকটা আর কিছুই বলল না। 

বললে না?’ আবারও জানতে চাইল উটুটু। ঘাড়ের উপর দিয়ে প্রহরীদের দিকে তাকাবার প্রয়াস পেল আগাসু। হাঁটার সময় কথা বলা বা গান গাওয়া ওদের জন্য নিষিদ্ধ। 

‘সম্ভবত আমাদেরকে খেয়ে ফেলবে,’ বলল লোকটা। ‘অন্তত আমি তেমনটাই শুনেছি। এজন্যই ওদের এত দাস দরকার, সাদা পিশাচদের পেট কিছুতেই ভরে না। 

কেঁদে ফেলল উটুটু। আগাসু সান্ত্বনা দিলে বোনকে। ‘কেঁদো না বোন, সাদা পিশাচরা তোমাকে স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারবে না। আমি রক্ষা করব তোমাকে। আমাদের দেবতারা রক্ষা করবেন। 

কিন্তু কান্না থামল না উটুটুর, ভয়-রাগ-ব্যথা মনে নিয়ে হাঁটতে থাকল ও। এমন ভয় কেবল একজন বাচ্চাই অনুভব করতে পারে: নিখাদ, সর্বগ্রাসী। আগাসুকে সে বলতে পারল না, সাদা পিশাচদের খাদ্য হবার ভয়ে ভীত নয় ও যে করেই হোক, নিজে সে বেঁচে থাকবে। কাঁদছে কারণ ওর ভয়, ভাইকে খেয়ে ফেলবে পিশাচরা। আর আগাসুকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হবে সে নিজে 

একটা ট্রেডিং পোস্টে ওদেরকে দশ দিন রাখা হলো। দশম দিনের সকালে ওদেরকে বের করা হলো এ কদিন কয়েদ করে রাখা কুঁড়েঘর থেকে। শেষের দিকে আরও দাস আসায়, ভেতরটা একেবারে ভরে উঠেছিল। ওদেরকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো পোতাশ্রয় পর্যন্ত, ওখানে একটা জাহাজ দাসদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। 

জাহাজটা দেখে অবাক হয়ে গেল উটুটু, এত বড়ো জলযানও হয়! এরপর আবার চিন্তিত হয়ে ভাবল, এই জাহাজে তো ওরা সবাই আঁটবে না। পানিতে আলসে ভঙ্গিতে ভাসছে ওটা। ওখান থেকে একটা নৌকা এসে এসে নিয়ে যাচ্ছে দাসদের। নিচের ডেকে নাবিকরা গাদাগাদি করে ভরছে সবাইকে। নাবিকদের কারও কারও ত্বক লাল, আবার কারও কারও তামাটে। নাকগুলো তীক্ষ্ণ, দাড়ি দেখে জন্তু বলে মনে হয়। কয়েক নাবিককে দেখে নিজের মতোই কালো বলে মনে হলো উটুটুর, ঠিক ওদেরকে সাগর পার পর্যন্ত নিয়ে আসা লোকদের মতো। পুরুষ, নারী আর বাচ্চাদের আলাদা আলাদা তিনভাগে ভাগ করে ডেকের আলাদা আলাদা অংশে রাখা হলো। দাসের সংখ্যা বেশি হওয়ায়, এক ডজন পুরুষকে শিকল পরিয়ে ফেলে রাখা হলো উন্মুক্ত ডেকেই। 

উটুটুর স্থান হলো বাচ্চাদের সাথে, মেয়েদের সাথে না। শিকলও পরতে হয়নি ওকে, কয়েদ করে রেখেই নাবিকরা সন্তুষ্ট। তবে আগাসু, ওর ভাইকে মাছের মতো বেঁধে-ছেঁদে রাখা হলো পুরুষদের সাথে। নাবিকরা পরিষ্কার করলেও, নিচের ডেক থেকে ভেসে আসছে দুর্গন্ধ: ভয়, পিত্ত, ডায়রিয়া আর মৃত্যুর গন্ধ; আতঙ্ক, পাগলামি আর ঘৃণার ঘ্রাণ। অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে গরম হোল্ডে বসে রইল উটুটু। দুই পাশে বাচ্চাদের ঘামের স্পর্শ পাচ্ছে ও। ঢেউয়ের ধাক্কায় পাশে বসা একটা ছোট্ট ছেলে এসে পড়ল ওর গায়ের উপর। এমন এক ভাষায় মাফ চাইল ছেলেটা যা উটুটু বুঝতে পারল না। আধা-অন্ধকারে হাসার প্রয়াস পেল মেয়েটা। 

পানিতে ভাসল জাহাজ। 

সাদা মানুষেরা যেখান থেকে এসেছে, সেই জায়গার কথা চিন্তায় এলো উটুটুর (অবশ্য এখন পর্যন্ত আসল সাদা চামড়া দেখা হয়নি ওর, সমুদ্রের জলে ভিজে আর রোদে পুড়ে নাবিকদের চামড়া তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে)। ওদের কি খাবারের এতই অভাব যে উটুটুর এলাকায় এসে মানুষকে ধরে নিয়ে যেতে হবে? নাকি কালো চামড়ার মাংসের স্বাদ আলাদা…বিশেষ কিছু? যেটা খাবার কথা ভাবলেই তাদের জিভে জল আসে? 

দ্বিতীয় দিন ঝোড়ো বাতাসের পাল্লায় পড়ল জাহাজটা। ক্ষতি হলো না, তবে কেঁপে কেঁপে উঠল জলযান। ফলে বমির গন্ধের সাথে যুক্ত হলো প্রস্রাব আর পায়খানার গন্ধ। দাসদের ডেকে বাতাস চলাচলের জন্য রাখা ফুটো দিয়ে প্রচুর পরিমাণে পানি এসে ভিজিয়ে দিল সবাইকে। 

যাত্রা শুরু হবার এক সপ্তাহের মাথায়, যখন স্থলের আর চিহ্নও দেখা যায় না, দাসদের শিকল খুলে দেওয়া হলো। তবে সাবধানও করা হলো, অবাধ্যতার শাস্তি হবে ভয়াবহ। 

সকাল বেলা দাসদের খেতে দেওয়া হতো শিমের বিচি আর বিস্কুট। সেই সাথে লেবুর রস। খাবারগুলো এত বাজে যে চেহারা বিকৃত হয়ে যেত সবার। কয়েকজন তো তিতা রস খেয়ে বমি করে ফেলত প্রায়। তবে মুখ থেকে ফেলে দিতে পারত না। ধরা পড়লে এই কাজের শাস্তি স্বরূপ খেতে হবে চাবুক। 

রাতে খাবার বলতে ছিল নোনা মাংস। স্বাদ তো বাজে ছিলই, সেই সাথে ধূসর মাংসের উপর দেখা যেত রঙধনু রঙের আস্তর। এটা কিন্তু যাত্রা শুরুর দিকের কথা। আস্তে আস্তে আরও খারাপ হতে শুরু করল মাংসের অবস্থা। 

সুযোগ পেলেই উটুটু আর আগাসু দুই মাথা এক করত। নিজ ভূমির কথা, মায়ের গল্প আর খেলার সাথীদের স্মৃতিচারণ করে সময় কাটাত তারা। কখনও কখনও মায়ের মুখে শোনা গল্পগুলো ভাইকে আবার বলত উটুটু। এলেগবার গল্প, দেবতাদের মাঝে সবচেয়ে বুদ্ধিধর এই দেবতা হলেন দুনিয়াতে মহান মাওউ-এর চোখ আর কান। মাওউর দূত হিসেবে কাজ করেন তিনি। 

সন্ধের দিকে ভ্রমণের বিরক্তি কাটাবার জন্য নাবিকরা বাধ্য করত দাসদের নাচ-গান করতে। 

উটুটুর কপাল ভালো যে ওকে বাচ্চাদের সাথে আটকে রাখা হয়েছিল। একটা খাঁচায় পুরে নাবিকরা যেন ভুলে গেছিল ওদের। তবে মেয়েদের কপাল অতটা ভালো ছিল না। কিছু কিছু দাসবাহী জাহাজে নাবিকরা বারবার ধর্ষণ করত মেয়েদের, ব্যাপারটা যেন ডাল-ভাত! কিন্তু এই জাহাজটা সেরকম না। তাই বলে যে ধর্ষণের ঘটনা একেবারেই ঘটেনি, তা কিন্তু নয়। 

ডজনকে ডজন পুরুষ, নারী আর বাচ্চা ওই সফরে মারা গেছিল। তাদের মৃতদেহগুলো ফেলে দেওয়া হয়েছিল জাহাজ থেকে। আবার কিছু কিছু দাস মারা না গেলেও, মৃতপ্রায় বলে তাদের ছুড়ে ফেলা হয়েছিল সমুদ্রে। 

ডাচ একটা জাহাজে ভ্রমণ করছিল উটুটু আর আগাসু, কিন্তু সে কথা তখন জানা ছিল না ওদের। জাহাজটা ব্রিটিশ, পর্তুগিজ, স্প্যানিশ বা ফ্রেঞ্চ হলেও হতে পারত। 

জাহাজের কালো নাবিকেরা, যাদের ত্বক উটুটুর চাইতেও কালো, দাসদের নির্দেশনা দিত-কী করতে হবে, কোথায় যেতে হবে, এসব। একদিন সকালে উটুটু লক্ষ করল, এই কালো নাবিকদের একজন একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সকালে যখন ও খাচ্ছে, তখন লোকটা এগিয়ে এলো ওর দিকে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল ওর পাশে। 

‘এই কাজটা কেন করো?’ জানতে চাইল মেয়েটা। ‘সাদা পিশাচদের আদেশ পালন করো কেন?’ 

এমনভাবে হাসল লোকটা, যেন এরচাইতে মজার প্রশ্ন আগে শোনেনি! আচমকা ঝুঁকে এলো নাবিক, উটুটুর কানে নিজের ঠোঁট প্রায় স্পর্শ করিয়ে বলল, ‘আরেকটু বড়ো হলে তোমাকে দারুণ সুখ দিতাম আমি। কে জানে, আজ রাতে দিলে দিতেও পারি। আগে দেখি, কেমন নাচতে পারো তুমি। 

বাদামি চোখজোড়া দিয়ে লোকটার চোখে চোখ রাখল উটুটু। মুচকি হেসে জবাব দিল, ‘আমার নিচে আলাদা দাঁত আছে, ওখানে যদি তুমি প্রবেশ করো—তাহলে কেটে নেব। আমি ডাইনি মেয়ে!’ লোকটার চেহারায় ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল প্রায় সাথে সাথে, সেই ছাপ দেখে দারুণ আনন্দ পেল উটুটু। আর কিছু না বলে বিদায় নিলো নাবিক। 

শব্দগুলো উচ্চারণ করল বটে মেয়েটা, কিন্তু ওগুলো যেন ও নিজে বলেনি। আচমকা উপলব্ধি করতে পারল উটুটু, ধূর্ত এলেগবা ওর মুখ দিয়ে কথাগুলো বলেছেন। সে রাতে দেবতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ঘুমালো সে। 

দাসদের মধ্যে বেশ কয়েকজন খেতে অস্বীকৃতি জানালে, প্রচণ্ড প্রহার করা হলো তাদের; বাধ্য করা হলো খাবার খেতে। এত বেশি মারা হলো যে আঘাতের চোটে দুজন মৃত্যু বরণ করল পর্যন্ত! তবে কাজ হলো, জাহাজের আর কেউ না খাওয়ার ভুলটা করল না। একজন পুরুষ আর একজন মহিলা জাহাজ থেকে ঝাঁপ দেবার প্রয়াস পেল। মহিলা সফল হলেও, পুরুষের ভাগ্য এতটা ভালো ছিল না। তাকে উদ্ধার করে মাস্তুলের সাথে বেঁধে রাখা হলো, প্রায় একদিন ধরে ইচ্ছামতো পেটানো হলো তাকে। রাতেও ওখানেই রইল লোকটা, না খাবার পেল…আর না পান করার জন্য পানি। তৃতীয় দিনের মাথায় প্রলাপ বকতে শুরু করল সে। যখন সেটাও বন্ধ হয়ে গেল, তখন তাকে ছুড়ে ফেলা হলো সমুদ্রে। আত্মহত্যা প্রচেষ্টার পরবর্তী পাঁচ দিন সব দাসকে আটকে রাখা হলো শিকল দিয়ে। 

লম্বা একটা সফর ছিল ওটা, দাসদের জন্য প্রচণ্ড কষ্টকর; নাবিকদের জন্যও। যদিও নিজেদের হৃদয়কে ততদিনে শক্ত করে নিয়েছিল তারা। নিজেদেরকে তারা ভাবত কৃষক হিসেবে, আর দাসদেরকে গবাদি পশু। 

মন ভালো করা একটা দিনে ব্রিজপোর্ট, বার্বাডোজে এসে থামল ওদের জাহাজ। দাসদেরকে ছোটো ছোটো নৌকায় করে ফিরিয়ে আনা হলো সমুদ্রতটে। এরপর তাদেরকে দল বেঁধে নিয়ে যাওয়া হলো একটা মার্কেটে, লাইন ধরে দাঁড় করানো হলো তাদেরকে। আচমকা বেজে উঠল একটা ঘণ্টি, মার্কেটটা ভরে গেল মানুষে। লাল-মুখো অনেকগুলো মানুষ এসে খোঁচাতে শুরু করল ওদের। চিৎকার-চেঁচামেচি আর দর কষাকষির শব্দে ভরে উঠল চারপাশ। 

উটুটু আর আগাসুকে আলাদা করে ফেলা হলো। খুব দ্রুত ঘটে গেল ব্যাপারটা-একটা বিশালদেহী লোক এসে আগাসুর মুখ খুলে দেখল ভেতর। এরপর হাতের মাংসপেশি টিপে-টুপে দেখে মাথা নাড়ল একবার। অন্য দুজন লোক সরিয়ে নিয়ে গেল ছেলেটাকে। যাবার সময় উটুটুর দিকে তাকিয়ে ওর ভাই কেবল বলল, ‘সাহস রাখো।’ মাথা নাড়ল মেয়েটা, এরপর কেন যেন ঘোলা হয়ে গেল সবকিছু। বুক চিঁড়ে বেরিয়ে এলো চিৎকার! একত্রে ওরা যমজ, স্বৰ্গীয় আশীর্বাদ। আলাদা আলাদা হয়ে গেলে ওরা দুঃখ ভারাক্রান্ত দুই বাচ্চা ছাড়া আর কিছু নয়! 

বেঁচে থাকতে আর কখনও ভাইকে দেখেনি উটুটু। 

আগাসুর ভাগ্যে কী ঘটেছিল, তাই বলছি এখন। প্রথমে ওকে নিয়ে যাওয়া হলো মশলার একটা খামারে। সেখানে প্রত্যহ নিয়ম করে পেটানো হতো ওকে-যে সব অপরাধ ও করেছে, সেসবের জন্য তো বটেই; যেগুলো করেনি, সেগুলোর জন্যও। হালকা-পাতলা ইংরেজি শিখিয়ে ওর নাম দেওয়া হল ইনকি জ্যাক। একবার যখন ছেলেটা পালাবার চেষ্টা করল, তখন কুকুর লেলিয়ে দেওয়া হলো ওর পেছনে। ধরে নিয়ে এসে কেটে ফেলা হলো একটা আঙুল-আর কখনও যেন ভুল না হয় ওর, সেজন্য। না খেয়ে আত্মহননের চেষ্টাও করেছিল একবার, কিন্তু ওর সামনের দাঁতগুলো ভেঙে জোর করে নরম খাবার মুখে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো! 

তখনকার দিনেও, দাসীর গর্ভে জন্ম নেওয়া দাসদের পছন্দ করত মালিকরা। আফ্রিকা থেকে ধরে আনা দাসরা যেহেতু স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে আগে, তাই তাদেরকে পোষ মানানো কঠিন। তারা পালাবার চেষ্টা করে, আর তা না পারলে আত্মহননের। সফল হলেই, টাকা নষ্ট 

ইনকি জ্যাকের বয়স যখন ষোলো হলো, তখন আরও কয়েকজন দাসের সাথে একটা আখ প্ল্যান্টেশনের মালিকের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হলো তাকে সেন্ট ডমিনিগের দ্বীপে ওর নাম হলো হায়াসিন্থ। নিজের গ্রামের এক বুড়ির সাথে প্ল্যান্টেশনে দেখা হলো ওর-মহিলা আগে বাড়ির কাজ করত, এখন বাঁতে ধরেছে আঙুলগুলো। বুড়ি জানালো, সাদা চামড়ার লোকেরা ইচ্ছা করে দাসগুলোকে আলাদা আলাদা রাখে, যেন একই গ্রাম বা এলাকার কাউকে দেখতে না পায়। এতে করে বিদ্রোহের সম্ভাবনা কমে যায়। দাসরা যখন নিজেদের মাঝে অচেনা ভাষায় কথা বলে, তখন খেপে যায় মালিকরা। 

হায়াসিন্থ ফ্রেঞ্চ কিছু শব্দ শিখল, ওকে ক্যাথলিক চার্চের আদর্শ সম্পর্কেও শেখান হলো কিছু। প্রতিদিন সকালে আখ কাটতে যেতে হতো ওকে, সূর্য ওঠা থেকে ডোবা পর্যন্ত কাটত খেতেই। 

বেশ কয়েকটা সন্তান জন্ম নিলো ওর ঔরসে। অন্যান্য দাসদের সাথে রাতের আঁধারে বনে যাওয়া শুরু করল হায়াসিন্থ, যদিও কাজটা একেবারেই নিষিদ্ধ। ডাল্বালা-ওয়েডু, সর্প-দেবতার উদ্দেশ্যে গান গাইল আর কালিন্ডা নাচ নাচল। গান গাইল এলেগবা, ওগু, শ্যাংগো, জাকা আরও অনেকের উদ্দেশ্যে। এই দেবতাদের নিজের সাথে করে এনেছে দাসরা, গোপনে, হৃদয়ের মণিকোঠায়। 

সেন্ট ডমিনিগের আখ প্ল্যান্টেশনে কাজ করা দাসরা দশ বছরের বেশি খুব একটা বাঁচে না। ছুটি বলতে মধ্য দুপুরের দুই ঘণ্টা আর রাতের পাঁচ ঘণ্টা (রাত এগারোটা থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত)। এই সময়ের মাঝেই ওদের নিজস্ব খেতের যত্ন নিতে হতো (মালিকরা খাবার দিত না, দিত এক টুকরা জমি। ওখানে চাষ করে নিজের খাবার ফলাতে হতো দাসদের)। বিশ্রাম নেবার সময় বলতেও কেবল এতটুকুই, স্বপ্ন দেখলেও দেখতে হবে এর মাঝেই! তারপরও সময় বের করে একসাথে নাচ-গান-উপাসনা করত ওরা। সেন্ট ডমিনিগের মাটি অনেক উর্বর নাইজার, ডাহোমি আর কঙ্গোর দেবতারা তাই নতুন এই ভূমিতে শিকড় গাড়তে খুব একটা সময় নিলেন না। 

পঁচিশ বছর বয়সের কথা, হায়াসিন্থের ডান হাতের চেটোতে কামড় বসালো একটা মাকড়সা। দ্রুতই পচন ধরল জায়গাটায়, আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ল সারা হাত জুড়ে। পচা গন্ধ ছড়াতে শুরু করল হাতটা থেকে, ফুলে বেগুনি বর্ণ ধারণা করল ওটা। 

কড়া রাম খেতে দেওয়া হলো ওকে। এরপর মালিকপক্ষ একটা ম্যাচেটি নিয়ে আগুনে ফেলে গরম করল। লাল হয়ে গেলে, হাতটাকে কাঁধের কাছ থেকে কেটে ফেলল করাত দিয়ে। কাটা জায়গাটায় ঠেসে ধরা হলো উত্তপ্ত ম্যাচেটি। এক সপ্তাহ জ্বর নিয়ে পড়ে রইল লোকটা, তারপর ফিরল কাজে। 

১৭৯১ সালের দাস-বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল হায়াসিন্থ নামের এক-হাতি দাস! এলেগবা যেন নিজেই ভয় করলেন হায়াসিন্থের ওপরে, জঞ্জালে দখল করে নিলেন ওকে। হায়াসিন্থের মুখ থেকে নিজে উচ্চারণ করলেন শব্দ। কী বলেছিল, পরবর্তীতে তার খুব অল্প অংশই মনে করতে পারল সে। তবে সঙ্গীদের মুখে শুনতে পেল সবকিছু—ওদেরকে নাকি স্বাধীনতা এনে দেবার, দাসত্ব থেকে মুক্তি দেবার প্রতিজ্ঞা করেছে সে! হায়াসিন্থের কেবল মনে আছে তীব্র উত্তেজনার কথা, যে উত্তেজনার হাতে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছিল সে। আসল হাতটা আর সেই সাথে কেটে ফেলা হাতটাও চাঁদের দিকে তুলে ধরার কথা বাদে আর কিছুই মনে করতে পারছে না সে। 

হত্যা করা হলো একটা শুয়োর, প্ল্যান্টেশনের নারী-পুরুষ পান করল তার উষ্ণ রক্ত। একই সঙ্ঘের সদস্য বলে নিজেদেরকে ঘোষণা করল তারা। প্রতিজ্ঞা করল, ওরা হবে স্বাধীনতার যোদ্ধা; যেসব এলাকা থেকে ওদেরকে লুট করে আনা হয়েছে, সেসব এলাকার দেবতাদের প্রতি নিজেদেরকে উৎসর্গ করল। 

‘আমরা যদি সাদাদের সাথে যুদ্ধে মারা যাই,’ একে অন্যকে বলল তারা। ‘তাহলে পুনর্জন্ম হবে আফ্রিকায়। নিজের গোত্রে…নিজের বাড়িতে।’ 

হায়াসিন্থের বর্তমান নাম বিশালদেহী এক-হাতি। বিদ্রোহ করল সেন্ট ডমিনিগের দাসরা। লড়াই করল আগাসু, প্রার্থনা করল, বলি দিল, পরিকল্পনা করল। চোখের সামনে বন্ধু আর প্রেমিকাকে খুন হতে দেখল সে। কিন্তু লড়াই বন্ধ করল না। 

প্রায় বারো বছর ধরে চলল লড়াই। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ লড়ার জন্য ফ্রান্স থেকে সৈন্য নিয়ে আসা হলো। আর সবাইকে আশ্চর্য করে জয় হলো দাসদের। 

১৮০৪ সালের জানুয়ারি মাসের এক তারিখে, স্বাধীনতা পেল সেন্ট ডমিনিগ। দ্রুতই নতুন এক নাম পেল এলাকাটা-দ্য রিপাবলিক অভ হাইতি। অবশ্য বিশালদেহী এক-হাতি দেখতে পেল না তার জন্ম। সে মারা গেছিল ১৮০২ সালের আগস্টে, ফ্রেঞ্চ এক সৈন্যের বেয়োনেটের আঘাতে। 

ঠিক যে মুহূর্তে মারা গেল বিশালদেহী এক-হাতি (যাকে আগে ডাকা হতো হায়াসিন্থ নামে, তার আগে ইনকি জ্যাক আর যে নিজেকে পরিচয় দিত আগাসু পরিচয়ে), ঠিক সেই মুহূর্তে ওর বোনের (যার আদি নাম ছিল উটুটু, প্রথম প্ল্যান্টেশনে মেরি, এরপর ডেইজি আর ল্যাভের পরিবারে সুকি) মনে হলো, পাঁজরের ভেতর দিয়ে বেয়োনেট ঢুকিয়ে দিয়েছে কেউ। নিউ অর্লিয়ন্সের নদীর ধারে, ল্যাভের পরিবারের বাড়িতে অদম্য কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। ওর কান্নার দমকে জেগে উঠল দুই যমজ কন্যা। সুকির এই বাচ্চাদের ত্বক ক্রিম-আর-কফি রঙা, প্ল্যান্টেশনে থাকা অবস্থায় জন্ম নেওয়া বাচ্চাদের মতো কালো নয়। তখন সে নিজেও ছিল একটা বাচ্চা। যাই হোক একজনের বয়স পনেরো আর অন্য জন্যের বয়স দশ হবার পর আর দুজনকে দেখেনি ও। এই দুইজনের মাঝেও জন্মেছিল আরেকজন, সুকিকে দ্বিতীয়বার বিক্রি করার এক বছর আগেই। 

মাটিতে পা রাখার পর সুকিকে অগণিতবার বেত্রাঘাত করা হয়েছে। একবার তো লবণ মাখিয়ে দেওয়া হয়েছিল কাঁচা ক্ষতে, আরেকবার এতক্ষণ ধরে এত জোরে মারা হয়েছিল যে লম্বা সময় বসতে পারেনি সে; পিঠে ছোঁয়াতে পারেনি কিছুই। কম বয়সে অনেকবার ধর্ষিত হতে হয়েছে ওকে; কালো চামড়া, সাদা চামড়া-উভয়ের হাতেই। শিকল পরিয়ে রাখা হয়েছিল মেয়েটাকে। তখনও এক ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দেয়নি সুকি। ভাইকে ওর কাছ থেকে কেড়ে নেবার পর, মাত্র একবার কেঁদেছে সে। নর্থ ক্যারোলিনায় ছিল তখন, দাস বাচ্চা আর কুকুরদের খাবার ঢালা হয়েছিল একই পাত্রে। ওর নিজের ছোটো ছোটো বাচ্চাগুলো কুকুরের সাথে হুটোপুটি করে খাবার কেড়ে নিচ্ছিল। আগেও অনেকবার এই দৃশ্য দেখেছে সুকি, দেখেছে পরেও। কিন্তু সেদিনের সেই দৃশ্যটা ওকে কাঁদিয়েছিল। 

প্রথম কিছুদিন চেহারার কমনীয়তা ধরে রাখতে পেরেছিল মেয়েটা, পেরেছিল দেহের বাঁধন অক্ষুণ্ণ রাখতেও। কিন্তু তারপর বহু বছরের কষ্ট আর দুর্দশা ভেঙে দিয়েছিল ওকে। মেয়েটার চেহারা এখন ভাঁজ পড়া, বাদামি চোখে ব্যথা আর কষ্ট। এগারো বছর আগে, যখন ওর বয়স ছিল মাত্র পঁচিশ, ডান হাতটা আচমকা শুকিয়ে যায়। সাদা চামড়াদের কেউ কারণটা আন্দাজও করতে পারেনি। হাড়ের মাংস যেন শুকিয়ে গেছিল, হাতটা এখন লগব্যাগ করে ঝুলতে থাকে ওর দেহের সাথে-নড়ানো যায় না। এই ঘটনার পর, প্ল্যান্টেশনের কাজ ছাড়িয়ে ওকে গৃহ- দাসী হিসেবে ব্যবহার করা হতে থাকে। 

চেস্টারটন পরিবার, ওই প্ল্যান্টেশনের মালিক, ওর রান্না আর গৃহস্থালি কাজের দক্ষতায় সন্তুষ্টই ছিল। কিন্তু মিসেস চেস্টারটনের কেন যেন অথর্ব হাতটা একদম সহ্যই হতো না। তাই ল্যাভের পরিবারের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হলো ওকে। মাত্র এক বছর পরেই লুইজিয়ানায় ফিরে যাবার কথা ছিল পরিবারটার। মি. ল্যাভের মোটা-সোটা, হাসি-খুশি মানুষ। রাঁধুনি আর গৃহদাসীর দরকার ছিল তার, ডেইজির অথর্ব হাতটা নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না। এক বছর পর যখন তারা লুইজিয়ানায় ফিরে গেল, তখন সুকিও গেল তাদের সাথে 

নিউ অর্লিয়ন্সে পা রাখার সাথে সাথে পুরুষ আর মহিলারা ভিড় জমাতে শুরু করল ওর কাছে। কেউ চায় আরোগ্য, কেউ প্রেমিক বা প্রেমিকাকে পটাবার জিনিস। কালো চামড়ার লোক তো এলোই, এলো সাদারাও। ল্যাভের পরিবার দেখেও না দেখার ভান করল, হয়তো সবাই ভয় করে আর সম্মান দেয় এমন এক দাসীর মালিক হতে পেরে তারা খুশিই হয়েছিল। তবে, সুকিকে তার স্বাধীনতা কিনে নেওয়ার ক্ষমতা দেয়নি কখনও 

রাতের অন্ধকারে জলাভূমিতে যেতে শুরু করল সুকি। সেখানে কালিডা আর বামবুওলা নাচ নাচল মন ভরে। যেমনটা নেচেছিল সেন্ট ডমিনিগে দাসরা। জলাভূমিতে ওর সঙ্গী হলো বেশ কজন দাস। দেবতার অবতার হিসেবে তারা বেছে নিলো একটা কালো সাপকে। তবে আফ্রিকার দেবতারা কিন্তু সেই সেন্ট ডমিনিগের দেবতাদের মতো ওদের কারও উপর ভর করলেন না। অবশ্য বার বার তাদের নাম ধরে প্রার্থনা জানাল সুকি। সেন্ট ডমিনিগের বিদ্রোহ সম্পর্কে সাদাদের কাছ থেকেই শুনতে পেয়েছে সে। তাদের দাবি ছিল; অতি শীঘ্রই পতন ঘটবে সেন্ট ডমিনগোর (জায়গাটাকে এ নামেই ডাকত তারা)। ‘ভাবা যায়! অসভ্য, মানুষখেকোদের একটা দেশ!’ এরপর আচমকা, একদিন জায়গাটা নিয়ে বন্ধ হয়ে গেল ওদের কথা বলা। 

অচিরেই সুকি লক্ষ করল: এমন আচরণ করছে সাদারা, যে সেন্ট ডমিনগো বলে কোনো জায়গা কখনও ছিলই না। আর হাইতির নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি কেউ! পুরো আমেরিকা জাতি এক হয়ে ঠিক করেছে, বিশ্বাসের জোরেই একটা প্রমাণ আকারের ক্যারিবীয় দ্বীপকে মানচিত্র থেকে উধাও করে দিতে পারবে! 

সুকির মনে চমকপ্রদ সব গল্প শুনতে শুনতে বড়ো হলো ল্যাভেরদের একটা প্রজন্ম। একদম ছোটো বাচ্চাটা ‘সুকি’ উচ্চারণ করতে পারত না বলে, ওকে ডাকত মামা যু্যু বলে। নামটা টিকে গেল। ১৮২১ সালে মধ্য-পঞ্চাশে পা রাখল ও, কিন্তু দেখতে ওকে আরও বয়স্ক বলে মনে হয়। বুড়ো স্যান্তি ডিডি, যে ক্যালিবডোতে ক্যান্ডি বিক্রি করে, তার চাইতে অনেক বেশি রহস্য জানে মামা যুযু। বেশি জানে মেরি স্যালোপির চাইতেও, নিজেকে ভুডু রানি বলে দাবি করত সে। ওদের দুজনই কালো হলেও স্বাধীন ছিল, কিন্তু মামা যুযু দাস। মারাও যাবে দাস হিসেবেও, অন্তত ওর মনিব তেমনটাই জানিয়েছে। 

স্বামীর খোঁজ নেবার জন্য ওর কাছে যে মেয়েটা এলো, সে প্যারিস- বিধবার মতো পোশাক পরে ছিল। সুউন্নত বুক ছিল তার, ছিল যুবতী আর গর্বিত। মেয়েটার দেহে বইছিল আফ্রিকান রক্ত, সেই সাথে ভারতীয় আর ইউরোপিয়ান রক্তও। মেয়েটার ত্বক লালচে, চুল ঘন-কালো। মেয়েটার স্বামী, জাঁক প্যারিস, সম্ভবত মারা গেছে। হিসেব করলে বের হবে, লোকটা আসলে তিন-চতুর্থাংশ সাদা। গর্বিত এক পরিবারের জারজ সন্তান সে। সেন্ট ডমিনগো থেকে পালিয়ে আসা ইমিগ্রান্টদের মাঝে সে-ও ছিল একজন। যুবতী স্ত্রীর ন্যায় লোকটাও স্বাধীন। 

‘আমার জাঁক, ও কি মারা গেছে?’ জানতে চাইল মেয়েটা। কাজ করে দক্ষ নাপিতনীর, ঘর থেকে ঘরে গিয়ে। নিউ অর্লিয়ন্সের অধিকাংশ সম্ভ্রান্ত রমণীর ঘরে তার যাতায়াত। 

মামা যুযু সামনে রাখা হাড়গুলোর অবস্থান পড়ল। এরপর মাথা নেড়ে বলল, ‘লোকটা এখন একজন সাদা মেয়েমানুষের সাথে আছে, এখান থেকে অনেক উত্তরে কোথাও। মহিলার চুল লাল, বেঁচে আছে তোমার জাঁক।’ এজন্য অবশ্য জাদু করতে হলো না তাকে। নিউ অর্লিয়ন্সের সবাই জানে, জাঁক প্যারিস কার সাথে ভেগে গেছে। কিন্তু সদ্য আগত এই মেয়েটা তা জানে না বুঝতে পেরে, অবাক হলো মামা যুযু। নাকি জানে? এখানে ওর আসার পেছনে অন্য কারণ আছে? 

এরপর থেকে প্রতি সপ্তাহে এক বা দুইবার করে ওর কাছে আসত মেয়েটা। এক মাস পর, বৃদ্ধার জন্য উপহার নিয়ে এলো সে-চুলে বাঁধার ফিতা, কেক আর কালো একটা মোরগ। 

‘মামা যুযু,’ বলল সে। ‘আপনি যা যা জানেন, তা তা আমাকে শেখাবার সময় হয়েছে। 

‘হ্যাঁ,’ বলল মামা। ঘটনা কোন দিকে যাচ্ছে তা পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে অনেক আগেই। আর তাছাড়া, প্যারিস-বিধবা জানিয়েছে, ওর দুইটি আঙুল জালের মতো চামড়া দিয়ে একে অন্যের সাথে যুক্ত। এর অর্থটা মামা যুযুর কাছে দিনের আলোর চাইতেও পরিষ্কার-মেয়েটার একটা যমজ ছিল, যাকে মায়ের পেটেই খুন করেছে সে। তাই না শিখিয়ে মামা যুযুর কোনো উপায়ও ছিল না। 

মেয়েটাকে আস্তে আস্তে শেখাতে শুরু করল সে। জানাল দুটো নাগমেট একটা সুতায় ঝুলিয়ে গলায় পড়লে হূৎপিণ্ডের অসুখ দূর হয়। কখনও ওড়েনি, এমন একটা কবুতরের পেট কেটে রোগীর পাশে রাখলে, ভালো হয়ে যায় তার জ্বর। কীভাবে চাহিদা পূরণকারী থলে পাওয়া যায়, তা-ও শেখাল। একটা ছোটো চামড়ার ব্যাগে তেরোটা পেনি, নয়টা তুলার বিচি আর কালো শুয়োরের লোম রাখতে হবে। তারপর সেটাকে কীভাবে ঘষতে হবে, শেখাল সেটাও। 

মামা যুযু যা যা শেখাল, খুব মন দিয়ে শিখল প্যারিস-বিধবা। তবে দেবতাদের নিয়ে তার মাথাব্যথা ছিল না। ওর আগ্রহ ছিল পুরোটাই কাজ শেখা নিয়ে। বিশেষ করে কারও মনে প্রেম জন্মাবার জাদু শিখে দারুণ আনন্দ পেল সে। এজন্য প্রথমে একটা জীবন্ত ব্যাঙ চোবাতে হবে মধুতে। তারপর সেটাকে রেখে দিতে হবে পিঁপড়ার আস্তানায়। যখন হাড় থেকে মাংসগুলোও খেয়ে ফেলবে তারা; তখন একটা সমতল, হূৎপিণ্ড-আকৃতির হাড় পাওয়া যাবে। তার পাশেই থাকবে হুকঅলা আরেকটা হাড়। এই হুকঅলা হাড়টা লাগিয়ে রাখতে হবে যাকে প্রেমে ফেলতে চাও, তার পোশাকে। আর হূৎপিণ্ড-আকৃতির হাড়টাকে রাখতে হবে সাবধানে। কেননা ওটা হারিয়ে ফেললে, প্রেমিক বা প্রেমিকার ভালোবাসা পরিণত হবে ঘৃণায়! 

মেয়েটা আরও শিখল, সাপের দেহ থেকে বানানো শুকনো পাউডার যদি শত্রুর চেহারায় ব্যবহারের পাউডারের সাথে মিশিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে সে অন্ধ হয়ে যাবে। কাউকে চুবিয়ে মারতে চাইলে, তার অন্তর্বাসের একটা টুকরা উলটো করে মাঝরাতে পাথর চাপা দেওয়াই যথেষ্ট। 

এসবই মেয়েটাকে শেখাল মামা যুযু। লুক্কায়িত জ্ঞান, প্রকৃত সত্য- এসবও শেখাতে চাইল। কিন্তু প্যারিস- বিধবা (এখন তার জন্ম নাম ব্যবহার করছি, যে নামটা পরবর্তীতে বিখ্যাত…অথবা কুখ্যাত হয়েছিল-মেরি লেভিউ। তবে এই মেরি লেভিউ কিন্তু সবার পরিচিত সেই বিখ্যাত মেরি লেভিউ নয়, তার মা) অনেক দুরের স্থানীয় দেবতার ব্যাপারে জানতে একদমই আগ্রহী ছিল না। সেন্ট ডমিনগোর জমি যদি আফ্রিকান দেবতাদের জন্য উর্বর হয়, তাহলে এই এলাকাটা শুষ্ক আর মৃত। 

‘মেয়েটা শিখতেই আগ্রহী না,’ গোপন কথা যাকে বলে, সেই ক্লেমেনটাইনের কাছে অভিযোগ করল মামা যুযু। 

‘তাহলে না শেখালেই হয়।’ বলল ক্লেমেইনটাইন। 

‘আমি শেখাচ্ছি, কিন্তু মেয়েটা কেন যেন ওটার দাম বুঝতে পারছে না। ওর আগ্রহ সব কী করতে পারবে তা নিয়ে। আমি ওকে দিতে চাই হীরা, কিন্তু ওর মনোযোগ সব সুন্দর কাচের দিকে। খেতে দেই কোয়েল পাখি, কিন্তু ইঁদুর ছাড়া মেয়েটার মুখ কিছু রোচে না!’ 

‘তাহলে এত চেষ্টার দরকার কী?’ জানতে চায় ক্লেমেনটাইন। 

শ্রাগ করল মামা যুযু। উত্তর জানে, কিন্তু দিতে পারবে না। ওর বলা উচিত-বেঁচে থাকার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেই ওর দরকার শেখানো। অনেককে মরতে দেখেছে সে। স্বপ্ন দেখে, ‘ওই’ জায়গাটার মতো সবখানেই বিদ্রোহ করবে দাসরা। কিন্তু মনে মনে এ-ও জানে, আফ্রিকার দেবতা, এলেগবা আর মাউয়ো’র আশীর্বাদ ছাড়া সেটা সম্ভব হবে না কোনদিন। সাদাদের হাত থেকে মুক্ত হয়ে ফিরতে পারবে না নিজের বাসভূমিতে। 

সেই বিশ বছর আগে, যেদিন বেয়োনেটের শীতল স্পর্শ বুকের ভেতর অনুভব করে ঘুম ভেঙেছিল ওর, সেদিনই শেষ হয়ে গেছে ওর জীবন। এখন সে এমন একজন, যে এখন আর বেঁচে না, কেবল ঘৃণা করে। কেন, তা জানতে চাইতে পারেন আপনি। কিন্তু সেই বারো বছর বয়সি মেয়েটার গন্ধযুক্ত জাহাজে থাকা অবস্থায় মনের ভেতরে যে ঘৃণা জন্মেছিল, সেটার কথা কী করে জানাবে সে? কী করে বলবে অগণিত বার ধর্ষিত আর শাস্তি পাবার ইতিহাস? কী করে ব্যাখ্যা করবে শত শত রাত শিকল বাঁধা অবস্থায় কাটানো আর একের-পর-এক সবাইকে হারাবার কষ্ট? ছেলের কথা জানাতে পারে সে। যে লিখতে পড়তে জানে বোঝার পর, মালিক তার বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে নিয়েছিল। মেয়ের কথাও বলতে পারে, বারো বছর বয়েসে যে ছিল আটমাসের পোয়াতি। লাল মাটিতে সাবধানে একটা গর্ত খুঁড়ে তাতে উলটো করে শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল তার মেয়েটাকে, চাবুকের আঘাতে রক্ত বইতে শুরু করেছিল পিঠ থেকে। বাচ্চাটাকে তো হারিয়ে ছিলই, এক রবিবারের সকালে মারা গেছিল সে নিজেও। সাদারা তখন বসেছিল তাদের চার্চে… 

…এত শত দুঃখের কথা বলবে কীভাবে সে? 

 ‘ওদের উপাসনা করো,’ মামা যুযু বলেছিল মেরিকে। মাঝরাতের এক ঘণ্টা পর, জলাভূমিতে দাঁড়িয়েছিল ওরা তখন। উর্ধ্বাংগ ছিল অনাবৃত, ঘাম ঝড়ছিল ফোঁটায় ফোঁটায়। 

মেয়ের স্বামী, জাঁক (তিন বছর পর যার মৃত্যু ঘটেছিল অস্বাভাবিক কিছু আবহে), মেরিকে সেন্ট ডমিনগোর দেবতাদের ব্যাপারে অল্প কিছু বলেছিল বটে। তবে তাতে মন দেয়নি ও। মেরির বিশ্বাস, ক্ষমতা আসে আচারের মাধ্যমে-দেবতাদের কাছ থেকে না। 

মাম যুযু আর মেরি একসাথে নাচতে শুরু করল জলাভূমিতে। মিলেমিশে যেন একাকার হয়ে গেল বৃদ্ধ দাসী আর দোআঁশলা অথচ স্বাধীন এক যুবতী। 

‘এসবের মাঝে তোমার সফলতার চাইতেও অনেক বড়ো কিছু লুকিয়ে আছে।’ বলল মামা যুযু। 

আচারের গানে ব্যবহৃত অনেক শব্দ, যেটা একদা সে আর তার ভাই জানত, ভুলে গেছে বৃদ্ধা। সুন্দরী মেরিকে সে জানাল, শব্দে কিছু যায় আসে না। খেয়াল রাখতে হবে সুরের প্রতি। নাচতে নাচতে আচমকা দিব্য দৃষ্টি খুলে গেল ওর। বুঝতে পারল, এখানে…এই জলাভূমিতে থেকে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে আফ্রিকার দেবতাদের সুর। 

সুন্দরী মেরির দিকে ফিরল সে। যুবতীর চোখ দিয়ে যেন নিজেকে দেখতে পেল-দেখল এক কালো বৃদ্ধাকে, যার অথর্ব এক হাত ঝুলছে দেহের পাশে। যে একদা নিজের বাচ্চাকে দেখেছে কুকুরের সাথে লড়াই করে খাবার খেতে। বুঝতে পারল, মেয়েটা ওকে কতটা ঘৃণা করে! 

অট্টহাসি হেসে উবু হলো বৃদ্ধা, ভালো হাতটা দিয়ে তুলে নিলো জাহাজের দড়ির মতো মোটা আর চারাগাছের মতো লম্বা একটা সাপ । 

‘এই নাও।’ বলল সে। ‘এই সাপটা হবে আমাদের ভুডন। 

চুপচাপ শুয়ে থাকা সাপটাকে মেরির বহন করা বাস্কেটে রেখে দিল সে।

চাঁদের আলোয় যেন দ্বিতীয় বারের মতো খুলে গেল ওর দিব্য দৃষ্টি। ভাই, আগাসুকে দেখতে পেল ও। ছেলেটা এখন আর বারো বছরের তরুণ নেই। এখন সে বিশালদেহী এক যুবক, টাক মাথার আর হাসিতে ভাঙা দাঁত দেখাচ্ছে। এক হাতে একটা ম্যাচেটি ধরে রেখেছে, ডান হাতটা কাটা। 

নিজের ভালো হাতটা এগিয়ে দিল উটুটু। 

‘আরেকটু অপেক্ষা করো,’ বিড়বিড় করে বলল মেয়েটা। ‘আমি আসছি। শীঘ্রই আসছি। 

মেরি প্যারিস ভাবল, বৃদ্ধা ওর সাথেই কথা বলছে। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *