অধ্যায় দশ
গোপন সবই বলব তোমায়,
তবে অতীতের সব কথা শেষ হয় মিথ্যায়।
তাই বিদায় দাও আমায়, ঘুমাই অনন্তের তরে।
–টম ওয়াইটস, ‘ট্যাংগো টিল দে আর সোর’
.
লেকসাইডের প্রথম রাতে স্বপ্ন দেখল শ্যাডো। দেখল একটা জীবনের স্বপ্ন, যে জীবনে ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল অন্ধকার আর ময়লা। দেখল একটা বাচ্চার জীবনকে, অনেক দূরের কোনো দেশে…সমুদ্রের ওপারে…যেখানে সূর্য উদয় হয়। অথচ ওর স্বপ্নের জীবনটায় সূর্যোদয় নেই। দিনের বেলা রয়েছে আবছা আলো, আর রাতের বেলা ঘন অন্ধকার।
কেউ কথা বলে না ওর সাথে। বাইরে থেকে ভেসে আসা মানব কণ্ঠ শুনতে পায় বটে; কিন্তু পেঁচার হাহাকার বা কুকুরের চিৎকার যেমন বুঝতে পারে না, তেমন বুঝতে পারে না সেসব কণ্ঠও।
ওর মনে আছে, অন্তত সে তেমনটাই ভাবে, অর্ধ-জীবন আগের সেই রাতটার কথা। সেরাতে বড়োদের একজন এসে প্রবেশ করেছিল তার কক্ষে। নাহ, ওকে খাওয়ায়নি বা হাত শেকলে বাঁধেনি সেই বড়ো মানুষ। বরঞ্চ কোলে তুলে নিয়ে আলিঙ্গন করেছিল ভালোবেসে। অদ্ভুত সুন্দর একটা গন্ধ ভেসে আসছিল মহিলার গা থেকে। তার চেহারা থেকে ওর চেহারার উপর এসে পড়ছিল গরম ফোঁটা। ভয় পেয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল!
খড়ের উপর শুইয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি বিদায় নিয়েছিল সেদিন মহিলা। দরজা বন্ধ করে রেখে গেছিল।
সেই মুহূর্তের কথা আজও তৃপ্তির সাথে স্মরণ করে ও। যেমন করে স্মরণ করে প্রথম নেওয়া ফুলকপির স্বাদ, প্রথম সেই তালের মিষ্টতা, প্রথম আপেলের বিচি খাওয়ার অনুভূতি।
এখন…আগুনের আলোয় অনেক মানুষের চেহারা দেখতে পাচ্ছে ও। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। এই প্রথম আর সম্ভবত একমাত্র বারের জন্য কুঁড়েঘর থেকে সবাইকে পথ দেখিয়ে বাইরে এনেছে সে। ভাবছে, এই তাহলে মানুষ! অন্ধকারে বড়ো হয়েছে বলে আগে কখনও কারও চেহারা দেখেনি ও। সব কিছু নতুন…অদ্ভুত মনে হচ্ছে। অগ্নিকুণ্ডের আলোয় টাটাচ্ছে চোখ। ওর গলায় ফাঁস বাঁধল কেউ একজন, যেখানে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে।
ছুরির তীক্ষ্ণ ফলার উপর আগুনের আলো পড়ে যখন ঝকঝক করে উঠল, উপস্থিত সবার মুখে তখন শোনা গেল হর্ষ-ধ্বনি। অন্ধকার থেকে বাইরে আসা বাচ্চাটাও হেসে উঠল সেই সাথে। আনন্দে আর স্বাধীনতার স্বাদে।
পরক্ষণেই নেমে এলো ছুরি।
.
চোখ খোলা মাত্র শ্যাডো বুঝতে পারল, ক্ষুধা লেগেছে ওর। সেই সাথে ঠান্ডায় যেন কাঁপছে। অ্যাপার্টমেন্টের জানালার কাচগুলোতে জমতে শুরু করেছে বরফ। বিছানা ছাড়ল সে, নতুন করে জামা-কাপড় পড়তে হবে না ভেবে স্বস্তি পেল। এগোতে এগোতে নখ দিয়ে আঁচড় কাটল জানালায়, টের পেল-নখের নিচে জমা হচ্ছে বরফ, গলে পরিণত হচ্ছে পানিতে।
স্বপ্নটার কথা মনে করতে চাইল ও, কিন্তু অন্ধকার আর দুঃখ ছাড়া কিছু মনে পড়ল না।
জুতোয় পা গলাল শ্যাডো। শহরের কেন্দ্র পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে ফেরার পথে ব্রিজটা একটু ঘুরে এলে পুরো শহরটার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। পাতলা জ্যাকেটটা গায়ে চড়াল ও, পুরু একটা শীতবস্ত্র কিনবে-সেই প্রতিজ্ঞা মনে করিয়ে দিল নিজেকে। অ্যাপার্টমেন্টের দরজা খুলে পা রাখল কাঠের ডেকে। ঠান্ডা বাতাস যেন হাতুড়ি হয়ে আঘাত করল শ্যাডোর বুকে, বুক ভরে একবার শ্বাস নিতেই মনে হলো-নাকের সব লোম জমে গেছে! সামনের দৃশ্যটা মনলোভা, বরফ জমা হ্রদ তার পুরো সৌন্দর্য নিয়ে শুয়ে আছে।
শৈত্য-প্রবাহ হচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই। তাপমাত্রা শূন্যের খুব একটা বেশি হবার কথা না; হাঁটাটা বোকার মতো একটা সিদ্ধান্ত হয়েছে কি না, তাই ভাবল। মোটামুটি নিশ্চিত যে শহর পর্যন্ত যেতে কষ্ট হবে না। কিন্তু ফেরাটা সমস্যা হয়ে যেতে পারে। তবু দক্ষিণে এগিয়ে চলল শ্যাডো, ওর লক্ষ্য: ব্রিজ।
খুব দ্রুতই কাশিতে পেয়ে বসল ওকে, শুকনো কাশি। এর কারণ যে ফুসফুসে ঢোকা শীতল বাতাস, তা-ও বুঝতে পারল। দ্রুতই কান, চোখ আর ঠোঁট ব্যথা করতে শুরু করল ওর। এরপর এলো পা ব্যথা। হাত দুটোকে গরম রাখার জন্য কোটের পকেটে ঢুকিয়ে মুষ্টিবদ্ধ করে রাখল। মিনেসোটার শীতের ব্যাপারে লো কি লেস্মিথের ছাড়া বড়ো বড়ো বুলির কথা মনে পড়ে গেল শ্যাডোর। এক শিকারির গল্প বলেছিল লো কি। লোকটা ভালুকের ভয়ে উঠে বসেছিল গাছে। নামার আর কোনো উপায় না পেয়ে প্রস্রাব করেছিল ডালে বসা অবস্থাতেই। মাটিতে পড়ার আগেই জমে বরফে পরিণত হয়েছিল প্রস্রাব। সেটা বেয়ে নিচে নেমেছিল লোকটা। হাসিতে মুখ বেঁকে গেল শ্যাডোর, পরক্ষণেই ব্যথা পেয়ে মিলিয়েও গেল। একপা-একপা করে এগোচ্ছে, আর পিছু ফিরে ফিরে দেখছে শ্যাডো। অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংটাকে যতটা দূর বলে মনে হচ্ছিল, ততটা দূরে দেখতে না পেয়ে অবাক হলো।
বোকার মতোই কাজ হয়েছে, সিদ্ধান্ত নিলো। তবে এতক্ষণে চার-পাঁচ মিনিট হেঁটে এসেছে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে, ব্রিজটাও বেশি দূরে নেই। সামনে এগোলেও যা, পেছনে গেলেও তাই (ঘরে ফিরেই বা লাভ কী? খাবার নেই এক কণাও)।
তাই এগোতে লাগল ও, প্রতি পদে তাপমাত্রা মাপার প্রয়াস পেল। মাইনাস দশ? নাকি মাইনাস বিশ? হয়তো মাইনাস চল্লিশে নেমেছে পারদ। থার্মোমিটারের শূন্যের নিচে একটা বিন্দু আছে যেখানে সেলসিয়াস আর ফারেনহাইটের মান এক। সম্ভবত এখনও অত নিচে নামেনি। তবে আর্কটিক থেকে ভেসে আসা শৈত্য-প্রবাহ ওকে সেটার কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।
লরার দেওয়া সেই কেমিক্যাল প্যাডগুলোর কথা মনে পড়ে গেল শ্যাডোর। ইস, ওগুলোর বিনিময়ে যেকোনো দাম চুকাতেও আপত্তি থাকত না ওর।
আন্দাজে আরও দশ মিনিট হাঁটার পরও যখন ব্রিজটার কাছে পৌঁছাতে পারল না, তখন ঠান্ডায় কাঁপতে শুরু করল বেচারা। এখন এমনকী চোখও ব্যথা করছে। একে ঠান্ডা বলা যায় না, এমন শীতলতা কেবল কোনো সায়েন্স-ফিকশনের বইতেই থাকা সম্ভব।
পাশ দিয়ে চলতে থাকা গাড়িগুলোকে অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে এখন। ওগুলো যেন স্পেস-শিপ। ধাতু আর কাচ দিয়ে তৈরি এমন বাহন যাকে শীত ভেদ করতে পারে না। ভেতরে বসে থাকা লোকগুলোকেও ঈর্ষা হলো ওর, গরম কাপড় পরে বসে আছে। মায়ের পছন্দের একটা পুরাতন গানের কথা মনে পড়ে গেল, ‘ওয়াকিং ইন আ উইন্টার ওয়ান্ডারল্যান্ড।’ চেপে বসে ঠোঁট দিয়ে উচ্চারণ না করেই গুনগুন করে গাইতে শুরু করল শ্যাডো, গতি কমাল না হাঁটার।
পায়ে সার পাচ্ছে না, ওগুলো যে আছে তা বোঝার জন্য বার বার নিচের দিকে তাকাতে হচ্ছে। পাতলা মোজা আর কালো লেদারের জুতার দিকে তাকিয়ে ফ্রস্টবাইটের ভয় ঢুকল ওর মনে।
ব্যাপারটা আর হেসে উড়িয়ে দেবার পর্যায়ে নেই, অনেক বড়ো একটা ভুল হয়ে গেছে। পোশাক পরেও লাভ হয়নি, শীতল বাতাসের প্রকোপে নিজেকে নগ্ন মনে হচ্ছে ওর। হাড় তো জমে যাচ্ছেই, ভেতরের মজ্জাটাও যেন বরফ হয়ে যাচ্ছে। চোখের পাপড়ি খুলতে কষ্ট হচ্ছে এখন, ঠান্ডায় সংকুচিত হয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে ওর অণ্ডকোষ।
হাঁটতে থাকো, নিজেকে নির্দেশ দিল শ্যাডো। হাঁটতে থাকো সামনের দিকে। ঘরে ফিরে বুক ভরে শ্বাস নেওয়া যাবে। বিটলস ব্যান্ডের একটা গান ঘুরতে শুরু করল ওর মাথায়, সেই তালে তালে পা ফেলে এগিয়ে চলল ও। গানের যেখানে কোরাস আছে সেখানে এসে বুঝতে পারল শ্যাডো, বিড়বিড় করে ‘সাহায্য চাইছে! ব্রিজের কাছে প্রায় পৌঁছে গেছে ও, এখন কেবল পার হবার অপেক্ষা। তারপর আর মাত্র দশ মিনিট হাঁটলেই পৌঁছে যাবে নিরাপদ স্থানে…
কালো একটা গাড়ি ওকে অতিক্রম করে থমকে দাঁড়াল, ধোঁয়া বের করে পিছিয়ে এসে থামল ওর পাশে। একটা জানালা নেমে এলো, ‘সব ঠিক আছে?’ ভেতর থেকে একজন পুলিস জানতে চাইল।
শ্যাডো যেন অনেকটা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বলে উঠেছিল-হ্যাঁ, ঠিক আছে সবকিছু। ধন্যবাদ অফিসার। কিন্তু তা না বলে বলল, ‘আমি মনে হয় জমে যাচ্ছি, অফিসার। লেকসাইডে গিয়ে খাবার আর পোশাক কিনতে চেয়েছিলাম, কিন্তু দূরত্বটা আঁচ করতে পারিনি।’ পরক্ষণেই বুঝতে পারল, এসব আসলে মনে মনে বলেছে সে। মুখ দিয়ে বের হয়েছে, ‘জ-জ-জমে যাচ্ছি, ঠান্ডা।
গাড়ির পেছনের দরজাটা খুলে ধরল অফিসার। ‘এখুনি উঠে বসো, গরম হয়ে নাও।’ কৃতজ্ঞতার সাথে নির্দেশ পালন করল শ্যাডো, পেছনে বসে হাতে হাত ঘষল। পায়ের অবস্থা এখন চিন্তা করে লাভ নেই। ধাতব গ্রিলের পেছন থেকে সামনে বসা পুলিস অফিসারের দিকে তাকাল ও। শেষবার পুলিসের গাড়ির পেছনে ওঠার স্মৃতি মনে পড়ল শ্যাডোর। পেছনের দরজায় যে হ্যান্ডেল নেই, তা-ও না দেখার প্রয়াস পেল। সম্পূর্ণ মনোযোগ দিল হাত গরম করার কাজে। এখন আবার সার ফিরে এসেছে চেহারায়, লালচে হাতগুলোও ব্যথা করতে শুরু করেছে। উষ্ণতা যে আস্তে আস্তে শীতকে সরিয়ে পুনর্দখল করে নিচ্ছে পায়ের আঙুলগুলো, সেটাও টের পাচ্ছে পরিষ্কারভাবে। ব্যাপারটাকে ভালো লক্ষণ হিসেবেই ধরে নিলো।
চলতে শুরু করলো গাড়িটা। ‘কাজটা,’ শ্যাডোর দিকে না তাকিয়েই বলল পুলিস অফিসার। ‘কিছু মনে করো না, একেবারে বোকার মতো হয়ে গেছে। আবহাওয়ার খবর শোননি? এখনকার তাপমাত্রা মাইনাস ত্রিশ ডিগ্রি!’
‘থামার জন্য ধন্যবাদ,’ বলল শ্যাডো। ‘অনেক অনেক ধন্যবাদ।’
‘সকালের কথাই বলি। রাইনল্যান্ডারে এক মহিলা তার পাখিদেরকে খাবার দেবার জন্য কেবল চপ্পল আর রোব পরে বাইরে বেরিয়েছিলেন। একদম জায়গায় জমে গেছেন তিনি! বিশ্বাস হয়? এখন অবশ্য আইসিইউ-তে আছেন। সকালে খবরেও টিভিতে দেখিয়েছে। তুমি বোধহয় শহরে নতুন—’ এটা যে একটা প্রশ্ন, তা বুঝতে অসুবিধা হলো না শ্যাডোর। অবশ্য লোকটা যে প্রশ্নটার উত্তর জানে, তা-ও বুঝল।
‘গত রাতেই গ্রেহাউন্ডে করে এসেছি। ভাবলাম, গরম কাপড়, খাবার আর একটা গাড়ি কিনব আজ। এতটা ঠান্ডা হবে তা বুঝতে পারিনি।’
‘হুম,’ বলল পুলিস অফিসার। ‘আমিও অবাক! আসলে বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়েই বেশি দুশ্চিন্তা ছিল আমার। যাই হোক, আমি চ্যাড মুলিগান; লেকসাইডের পুলিস ডিপার্টমেন্টের প্রধান।’
‘মাইক আইনসেল।’
‘হাই, মাইক। এখন ভালো লাগছে একটু?’
‘কিছুটা।’
‘কোথায় যাবে প্ৰথমে?’
হিটারের উষ্ণ বাতাসে হাত রাখল শ্যাডো, আঙুল ব্যথা করতে শুরু করেছে। তারপর সরিয়ে নিলো; থাক, সময় নিয়েই গরম হোক। টাউন সেন্টারে নামিয়ে দিলেই হবে।’
‘না, না। তা করা যাবে না। ডাকাতির কাজে আমার গাড়ি ব্যবহার করা ছাড়া আর যেখানে নিয়ে যেতে বলো, আমার আপত্তি নেই। ধরো নাও, শহরের হয়ে তোমাকে আমি স্বাগতম জানাচ্ছি।’
‘তোমার কী পরামর্শ?’
‘গত রাতে এসেছ বললে?’
‘হ্যাঁ।’
‘নাস্তা হয়েছে?’
‘নাহ।’
‘তাহলে ওখান থেকেই শুরু করা যাক।’ বলল চ্যাড মুলিগান।
ব্রিজের উপর চলে এসেছে ওরা, এখান থেকে শহরের উত্তর-পশ্চিম দিকে যাওয়া যায়। ‘এটা শহরের প্রধান রাস্তা,’ চিনিয়ে দিল মুলিগান। ডানে মোড় নিয়ে বলল, ‘আর এই হলো তোমার টাউন স্কয়ার।’
এই তীব্র শীতেও দারুণ দেখাচ্ছে টাউন স্কয়ারকে। তবে শ্যাডো বুঝতে পারছে, জায়গা সাজানো হয়েছে গ্রীষ্মের কথা মাথায় রেখে। সন্দেহ নেই, তখন রঙের অদ্ভুত খেলা দেখা যাবে এখানে; পপি, আইরিশ আর প্রায় সব ধরনের ফুলের মেলা বসবে। কোনার ওই বার্চ গাছগুলো সাজবে সবুজ আর রুপালি সাজে। এখন অবশ্য সব রঙহীন। তারপরও দম বন্ধ করা সুন্দর। ঝরনাটাকে শীতের জন্য বন্ধ করে রাখা হয়েছে। সিটি হলটা মাথায় পরেছে বরফের টোপর। ‘…আর এই হলো,’ শেষ করল চ্যাড মুলিগান। একটা পুরাতন দালানের সামনে থামিয়েছে গাড়ি, ওটার সামনে আবার কাচের দেয়াল। ‘ম্যাবেলের দোকান।’
গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল লোকটা, শ্যাডোর জন্য প্যাসেঞ্জার সাইডের দরজা খুলে দিল। ঠান্ডা বাতাসকে অগ্রাহ্য করে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল দুজন। গরম ঘরটার ভেতরে পা রাখতেই নাকে এসে লাগল সুপ, সদ্য বেক করা রুটি, পেস্ট্রি আর বেকনের গন্ধ।
দোকানটাকে খালিই বলা চলে। একটা চেয়ারে বসল মুলিগান, শ্যাডো বসল তার উলটো দিকে। কেন যেন মনে হচ্ছে, ওকে বাজিয়ে দেখার জন্যই এত আতিথেয়তা। আবার কে জানে, সত্যি স্যতিই হয়তো বন্ধু-বাৎসল লোকটা!
এক মহিলা এগিয়ে এলো ওদের দিকে, মোটা বলা যাবে না; তবে দশাসই অবশ্যই। বয়স ষাটের কোঠায়, মাথায় তামাটে চুল। ‘হ্যালো, চ্যাড।’ বলল মহিলা। ‘কী খাবে বলো!’ বলে এগিয়ে দিল লেমিনেশন করা তালিকা। ‘ভাবতে ভাবতে হট চকলেট খেয়ে নেবে নাকি?’
‘ওপরে ক্রিম দিয়ো না কিন্তু,’ জানাল চ্যাড। ‘ম্যাবেল আমাকে খুব ভালোভাবেই চেনে,’ এবারের কথাটা শ্যাডোর উদ্দেশ্যে। ‘তুমি নেবে?
‘হট চকলেট চলতে পারে,’ বলল শ্যাডো। ‘ওপরে ক্রিম দিলেও সমস্যা নেই।’
‘আমিও তাই বলি,’ বলল ম্যাবেল। ‘ঠিকমতো যদি না-ই খেলাম তো বেঁচে থেকে লাভ কী? কিন্তু চ্যাড, পরিচয় করিয়ে দেবে না আমাকে? এই যুবক কি তোমার নতুন অফিসার?’
‘এখনও না,’ হাসিতে সাদা দাঁত বেরিয়ে গেল মুলিগানের। ‘এর নাম মাইক আইনসেল, গত রাতে প্রথম লেকসাইডে পা রেখেছে। একটু আসছি।’ বলে ঘরের অন্য মাথার রেস্টরুমে চলে গেল লোকটা।
তুমি নর্থরিজ রোজের অ্যাপার্টমেন্টটায় ওঠা নতুন ভাড়াটে!’ খুশি মনে বলল মহিলা। ‘আমি তোমার কথা জানি। আজ সকালেই হিনজেলমান প্যাস্টি খেতে খেতে তোমার কথা বলছিল। তোমরা দুজন কি শুধু চকলেট নেবে? নাকি সাথে অন্য কিছু?’
‘আমার নাস্তা চাই,’ বলল শ্যাডো। ‘কোনটা ভালো হবে?’
‘আমার এখানে খারাপ কিছু নেই,’ বলল ম্যাবেল। ‘নিজের হাতে বানাই সবকিছু। তবে হ্যাঁ, আশপাশে কোথাও প্যাস্টি পাবে না। আমার বিশেষত্ব ওটা, চেখে দেখতে পারো।’
প্যাস্টি যে কী জিনিস, সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই শ্যাডোর। তবে খেতে আপত্তি করল না। কয়েক মিনিটের মাঝে ফিরে এলো ম্যাবেল। মহিলার হাতে ধরা জিনিসটাকে দেখে ভাঁজ করা পাই বলে মনে হলো ওর, নিচের অর্ধেকটা টিস্যু পেপার দিয়ে ঢাকা। ন্যাপকিনসহ পুরোটাকে তুলে নিলো শ্যাডো, কামড় বসাল একটা। উষ্ণ খাবারে ভরে উঠল ওর মুখ; একই সাথে মাংস, আলু, গাজর আর পেঁয়াজের স্বাদ পেল। ‘এর আগে প্যাস্টি খাইনি,’ মহিলাকে জানাল সে। ‘দারুণ স্বাদ!’
‘ইয়ুপপি খাবার,’ জানাল মহিলা। ‘কর্নিশরা লোহার খনিতে কাজ করার সময় সাথে করে নিয়ে এসেছে।’
‘ইয়ুপপি?’
‘আপার পেনিনসুলা…ইউ-পি-পি-ইয়ুপপি।’
ঠিক তখনই ফিরে এলো পুলিস-চিফ। হট চকলেটের কাপটা তুলে নিয়ে চুমুক দিল। ‘ম্যাবেল,’ বলল সে। ‘তোমার প্যাস্টি খাওয়াচ্ছ নাকি বেচারাকে?’
‘খেতে খুব ভালো,’ বলল শ্যাডো। আসলেও তাই।
‘সরাসরি মেদ হিসেবে জমা হয় ওগুলো,’ নিজের ভুঁড়িতে চাপড় মেরে দেখাল চ্যাড মুলিগান। ‘পরে বোলো না যে সাবধান করিনি। ভালো কথা, গাড়ি লাগবে বললে না?’ পার্কা খুলে ফেলায় লোকটার আসল দেহ দেখতে পেল এতক্ষণে। লম্বা আর চিকন লোকটা, পেটের মাঝখানটা আপেলের মতো গোল। চেহারায় দক্ষতার ছাপ, না জানলে যে কেউ ইঞ্জিনিয়ার ভেবে ভুল করবে।
মাথা নাড়ল শ্যাডো, মুখ খাবারে ভরতি বলে কথা বলল না।
‘কয়েকজনকে ফোন করলাম। জাস্টিন লোবোউইটজ জিপ বিক্রি করবে, চার হাজার চেয়েছে। তবে তিন পেলেই ছেড়ে দেওয়ার কথা। গুন্থাররা অবশ্য ওদের ফোররানারটা বিক্রি করতে চাইছে আট মাস হলো। দেখতে একদম বদখত, তবে সম্ভবত এমনিতেই বিলিয়ে দেবার অবস্থা। গাড়ির চেহারা নিয়ে সমস্যা না থাকে তো নিতে পারো। মিসি গুন্থারকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি লেকসাইড রিয়েলিটিতে। এখনও আসেনি মহিলা, সম্ভবত শীলার দোকানে চুল ঠিক করছে।’
একটা প্যাস্টি খেয়েই পেট ভরে গেল শ্যাডোর, পূর্ণ মনোযোগ এখন খবরের দিকেই।
‘আমার মনে হয়,’ চিফ অভ পুলিস চ্যাড মুলিগান মুখ মুছতে মুছতে বলল। ‘প্রথমে হেনিংস ফার্ম অ্যান্ড হোম সাপ্লাইয়ে গিয়ে তোমার জন্য কাপড় কেনা দরকার। ডেভ’স ফাইনেস্ট ফুডে গেলে কিনতে পারবে খাবার। তারপর নাহয় তোমাকে লেকসাইড রিয়েলিটিতে নামিয়ে দেব। গাড়ির জন্য প্রথমে নগদ এক হাজার ডলার দিলেই হবে, এরপর চার মাস পাঁচশ করে দিয়ো। গাড়িটা দেখতে একদমই বাজে; তবে যদি ওদের ছেলেটা বেগুনি রং না করত, তাহলে কমপক্ষে দশ হাজার ডলার গুণতে হতো ওটা কেনার জন্য। এখনও ভালো অবস্থায় আছে। শীতে এদিক-ওদিক যেতে হলে গাড়ির বিকল্প নেই।’
‘অনেক অনেক ধন্যবাদ,’ বলল শ্যাডো। ‘কিন্তু তোমার তো উচিত অপরাধী ধরা। নবাগতের পেছনে একটু বেশিই সময় দেওয়া হয়ে যাচ্ছে না? অবশ্য আমার তাতে ভালোই হয়েছে।’
মুচকি হাসল ম্যাবেল। ‘আমরা সবাই ওকে তাই বলি।’
শ্রাগ করল মুলিগান। ‘শহরটা ভালো,’ বলল নম্রস্বরে। ‘সমস্যা হয় না খুব একটা। শহরে সাধারণত গতিসীমা ভঙ্গ ছাড়া আর কোনো অপরাধ হয় না। এতে অবশ্য আমারই লাভ, বেতনটা ওসবের জরিমানা থেকেই পাই কিনা। শুক্র- শনিবার রাতে কোনো কোনো হারামজাদা মাতাল হয়ে বউ পেটায়। কখনও কখনও স্বামী পেটায় স্ত্রীকে, আবার কখনও স্ত্রী স্বামীকে! বাকি সময়টা শান্তই থাকে শহর। আমার ডাক পড়ে যখন মানুষ ভুল করে গাড়ির চাবি ফেলে যায়, তখন। ঝোপের আড়ালে গাঁজাসহ কিছু কলেজ ছাত্র-ছাত্রী ধরি প্রতি বছর। গত পাঁচ বছরের সবচেয়ে ঝামেলার কেসটা কী ছিল শুনবে? ড্যান শোয়ার্টজ ট্রেইলার থেকে বন্দুক হাতে নেমে এসেছিল। হুইলচেয়ারে বসে চিৎকার করতে করতে জানাচ্ছিল-সামনে যে পড়বে, তাকেই খুন করবে। আমার ধারণা, ওয়াশিংটনে গিয়ে প্রেসিডেন্টকে খুন করার ইচ্ছা ছিল ড্যানের। দৃশ্যটা মনে পড়লেই হাসি ফোটে আমার মুখে। তোমার মনে আছে, ম্যাবেল?’
মাথা দোলাল মহিলা, হাসি ফুটে উঠেছে চেহারায়। তবে চ্যাডের মতো আনন্দ পাচ্ছে বলে মনে হলো না।
‘তো তুমি কী করলে?’ জানতে চাইল শ্যাডো।
‘ওর সাথে কথা বললাম…আমাকে শটগানটা দিয়ে দিল! জেলে একরাত কাটাতেই ঠান্ডা হয়ে গেল লোকটার মাথা। ড্যান ভালো মানুষ, তবে মাতাল হয়ে পড়েছিল সেদিন।’
নিজের নাস্তার দাম তো চুকালোই শ্যাডো, চ্যাড মুলিগানের হালকা প্ৰতিবাদ কানে না নিয়ে দিয়ে দিল চকলেটের দামও।
হেনিংস ফার্ম অ্যান্ড হোম সাপ্লাইজটা শহরের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত গুদাম- আকারের দালান। ট্রাক্টর থেকে শুরু করে খেলনা পর্যন্ত সবকিছু বিক্রি করে ওরা। ক্রিসমাসের কেনাকাটা করার জন্য ভিড় জমিয়েছে সবাই। শ্যাডো এক মেয়েকে চিনতে পারল, বাসে ওর সামনে বসেছিল সে। বাবা-মার পিছু পিছু ঘুরছে বেচারি। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল শ্যাডো, বিনিময়ে পেল নীল রাবার দেখানো হাসি। দশ বছর পর মেয়েটা দেখতে কেমন হবে, তাই ভাবল যুবক।
সম্ভবত দোকানটার ক্যাশিয়ার মেয়েটার মতোই সুন্দর হবে। শ্যাডোর কেনা জিনিসপত্রের দাম হিসাব করছে। ‘দশজোড়া আন্ডারওয়্যার?’ জিজ্ঞেস করল মেয়েটা। মুখে নায়িকাদের মতো হাসি। ‘জমাচ্ছ নাকি?’
শ্যাডোর মনে হলো, ওর বয়স যেন আবার কমে চোদ্দো হয়েছে। কিছু বলল না সে, নিজেকে কেন যেন বোকা বলে মনে হচ্ছে। একে একে থার্মাল বুট, গ্লাভস, সোয়েটার আর পুরু কোটের দাম তালিকায় যোগ করল মেয়েটা।
ওয়েনসডের দেওয়া ক্রেডিট কার্ডটা ব্যবহার করতে চায় না ও, অন্তত চ্যাড মুলিগানকে পাশে নিয়ে তো কখনওই না। সবকিছু নগদেই চুকিয়ে দিল শ্যাডো। এরপর ব্যাগগুলো নিয়ে রেস্টরুমে চলে গেল সে, বেরিয়ে এলো যখন তখন পরনে সদ্য কেনা পোশাক।
‘দেখে তো দারুণ লাগছে।’ বলল মুলিগান।
‘গরম তো অন্তত হচ্ছি,’ শ্যাডো হাসল। পোশাকগুলো ওকে গরম রাখছে, এমনকি পার্কিং লটে দাঁড়িয়েও শীত টের পেল না। কেবল উন্মুক্ত চেহারায় কামড় বসাচ্ছে ঠান্ডা। মুলিগানের পরামর্শ শুনে ব্যাগগুলো পুলিসের গাড়িটার পেছনে রেখে নিজে উঠে বসল সামনে।
‘তুমি কী করো, মাইক আইনসেল?’ জানতে চাইল পুলিস প্রধান। ‘তোমার মতো বিশালদেহীর এমন কী কাজ লেকসাইডে?’
লাফাতে শুরু করেছে শ্যাডোর হৃৎপিণ্ড, কিন্তু কণ্ঠ স্বাভাবিক। ‘চাচার হয়ে কাজ করি, দেশ জুড়ে অ্যান্টিক জিনিসপত্র বিক্রি করে সে। আমি একটু সাহায্য করি কেবল!’
‘টাকা ভালো দেয়?’
‘আমি পরিবারের সদস্য, চাচা জানে যে আমি ধোঁকা দেব না। আর তাছাড়া, আমারও ব্যাবসার ফাঁকফোকর শেখা হচ্ছে।’ আপনা-আপনি কথাগুলো ওর মুখ থেকে বেরোচ্ছে। এমন মসৃণভাবে মিথ্যা বলতে পারবে, তা ভাবেনি কখনও। সত্যি সত্যি যেন সে মাইক আইনসেল, আর আইনসেল লোকটাকে ওর পছন্দ হয়েছে। শ্যাডোর অগণিত সমস্যার একটাও মাইকের নেই। আইনসেলের কখনও বিয়ে হয়নি, কখনও মি. উড আর মি. স্টোন ওকে অত্যাচার করেনি। টেলিভিশন থেকে কেউ উঁকি দিয়ে মাইকের সাথে কথা বলে না (লুসির দুধ দেখতে চাও? প্রশ্নটা মনে পড়ে গেল ওর)! মাইক আইনসেল দুঃস্বপ্ন দেখে না, বিশ্বাস করে না যে ঝড় আসছে।
ডেভ’স ফাইনেস্ট ফুড থেকে হালকা খাবার কিনে নিলো শ্যাডো-দুধ, ডিম, পাউরুটি, আপেল, পনির, কুকি। ভারী খাবার পরে কেনা যাবে। চ্যাড মুলিগান সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল ওকে। ‘এ হচ্ছে মাইক আইনসেল, নর্থরিজ রোডে একটা অ্যাপার্টমেন্টে উঠেছে…পেছন দিকেরটায়।’ নতুন পরিচিত হওয়া লোকদের নাম মুখস্থ করার প্রয়াস পেল শ্যাডো। এর সাথে হাত মেলাল, ওর দিকে তাকিয়ে হাসল। দোকানের ভেতরটা একটু বেশিই গরম। আশ্চর্য হলেও সত্যি-ঘামতে শুরু করেছে সে!
চ্যাড মুলিগান গাড়ি চালিয়ে ওকে লেকসাইড রিয়েলটির অফিসে নিয়ে এলো। মিসি গুন্থারের সাথে আলাদা করে পরিচয় দেবার দরকার হলো না, মাইক আইনসেলকে ভালোভাবেই চেনে মহিলা। শ্যাডোর চাচা, মি. এমারসন বোরসন, খুব ভালো মানুষ। ছয় কি আট সপ্তাহ আগে ভদ্রলোক নর্থরিজ স্ট্রিটের পিলসেন প্লেসের একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেন। ওখান থেকে যে দৃশ্যটা দেখা যায়, সেটা মনকাড়া, তাই না? বসন্তে তো আরও সুন্দর রূপে সাজে লেকসাইড। সাধারণত পৃথিবীর এই দিকে গ্রীষ্ম হলেই পানিতে সবুজ শ্যাওলা জমে। কিন্তু লেকসাইডে তা হয় না। এই শহরের হ্রদের পানি চাইলে না ফুটিয়েই খাওয়া যায়। পুরো এক বছরের অগ্রিম ভাড়া দিয়ে গেছেন মি. বোরসন। টয়োটা ফোররানারের কথা যে এখনও চ্যাড় মুলিগান মনে রেখেছে, সেটা বিশ্বাসই হতে চাইছে না ওর। জিনিসটা বিক্রি করতে পারলে খুশিই হবে সে। সত্যি বলতে কী, আরেকটু হলেই ওটা হিনজেলমানকে এই বছরের ক্ল্যাংকার হিসেবে ব্যবহার করার জন্য দিয়ে দিত। আসলে গাড়িটা তার ছেলের, এখন গ্রিন বের একটা স্কুলে পড়তে গেছে। কেন যেন একদিন…খেয়ালের বসেই গাড়িটা বেগুনি রং করেছিল ছেলেটা। মিসি গুন্থারের আশা, মাইক আইনসেলের রঙটা পছন্দ হবে…
এই বাক্য-বর্ষণের মাঝখানেই ক্ষমা চেয়ে বিদায় নিলো মুলিগান। ‘আমার অফিসে ফিরতে হচ্ছে। তোমার সাথে পরিচয় হয়ে খুশি হলাম, মাইক।’ বলে শ্যাডোর বাজার-সদাই মিসির স্টেশন ওয়্যাগনে তুলে দিল সে।
নিজের গাড়িতে করে শ্যাডোকে বাড়িতে নিয়ে এলো মিসি। পথে একটা বয়স্ক এসইউভি দেখতে পেল ও। গাড়িটার রং বাদামি হলেও, বরফ জমে সাদা হয়ে গেছে। বাকিটা ক্যাটক্যাটে বেগুনি রঙা!
তবে দেখতে যেমনই হোক, প্রথমবারের চেষ্টাতেই চালু হয়ে গেল ওটার ইঞ্জিন। হিটারটাও কাজ করছে, তবে ভেতরটা গরম হতে হতে প্রায় দশ মিনিট লেগে গেল। যাই হোক, গাড়ি গরম হতে দিয়ে শ্যাডো চলে গেল মিসি গুন্থারের রান্নাঘরে। বাচ্চারা সারা ঘর জুড়ে খেলনা ছড়িয়ে রেখেছে। একটা লাল গাড়ি চেয়ারের উপর থেকে সরিয়ে তাতে বসল ও। মিসি জানতে চাইল, প্রতিবেশীদের সাথে দেখা হয়েছে কি না। যুবক জানাল, দেখা হয়নি
তাই মিসি প্রতিবেশীদের বর্ণনা দেয় শুরু করল। অ্যাপার্টমেন্টে আরও চারজন বাস করে। আগে যখন দালানটার নাম ছিল পিলসেন প্লেস, তখন পিলসেন পরিবার বসবাস করত দালানে। তারা একদম নিচ তালাটা নিজেরা ব্যবহার করে, ওপরের দুটো ভাড়া দিয়েছিল। মি. হোলজ আর মি. নেইম্যান নামের দুজন থাকত ওখানে। শ্যাডো বিশ্বাস করবে কি না জানে না মহিলা, কিন্তু ওরা নাকি আসলে দম্পতি! তারা অবশ্য শীতের সময়টা কী ওয়েস্টে থাকবে, এপ্রিলের দিকে ফেরার কথা। তখন অবশ্য শ্যাডো নিজেই দেখতে পাবে তাদের। লেকসাইড আসলে থাকার জন্য খুব ভালো। মি. আইনসেলের পাশের অ্যাপার্টমেন্টেই ছেলেকে নিয়ে বাস করে মার্গারিতা ওলসেন। মেয়েটা খুব মিষ্টি, তবে খুব কঠিন একটা জীবন কাটাতে হচ্ছে ওকে। লেকসাইড নিউজে কাজ করে মেয়েটা। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি বিক্রিত কাগজ না হলেও, এখানকার মানুষজন ওটাকে পছন্দই করে।
এসব বলতে বলতেই শ্যাডোর জন্য কফি ঢালল কাপে। জানাল: মি. আইনসেলের যেভাবেই হোক, শহরটাকে বসন্তে দেখা উচিত। তখন লাইলাক আর আপেল আর চেরি দেখা যায় গাছে। এরকম আর কিছু সারা দুনিয়াতেই নেই!
পাঁচশ ডলার জমা দিল শ্যাডো। গাড়িতে উঠে চালু করে দিল ইঞ্জিন, রাস্তায় উঠে পড়ল বাহনটা নিয়ে। তবে তার আগে মিসি গুন্থার ওকে একটা মোটা খাম দিতে ভুলল না। ‘আমাদের তরফ থেকে একটা ঠাট্টা বলতে পারো, আরেকটু হলেই ভুলে গেছিলাম। এখনই না দেখলেও চলবে।’
ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলো শ্যাডো, হ্রদের পাশ দিয়ে যাওয়া পথটা ধরে প্রবেশ করল শহরে। গ্রীষ্মে, বসন্তে, শরতে-তিন ঋতুতেই ওটাকে দেখার ইচ্ছা জন্মাল তার মনে। দৃশ্যটা যে দারুণ মনোলোভা হবে, তাতে সন্দেহ নেই।
দশ মিনিটের মাঝে বাড়িতে ফিরে এলো সে। গাড়িটা রাস্তায় পার্ক করে রেখে চলে এলো নিজের ঠান্ডা অ্যাপার্টমেন্টে। বাজার-সদাইগুলো বের করে নিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখল ফ্রিজ আর কাপবোর্ডে। মিসি গুন্থারের দেওয়া খামটা খুলল এরপর।
একটা পাসপোর্ট বের হয়ে এলো খাম থেকে। নীল একটা কভার খুলে দেখতে পেল, ভেতরে সুন্দর করে হাতে লেখা কয়েকটা লাইন-মাইকেল আইনসেলকে লেকসাইডের নাগরিক বলে সম্মাননা জানানো হয়েছে তাতে। পরবর্তী কয়েকটা পাতায় শহরের মানচিত্র আঁকা। অন্যগুলো শহরের নানা দোকানের ডিসকাউন্ট কুপন দিয়ে ভরতি।
‘জায়গাটা পছন্দ হবে বলেই তো মনে হচ্ছে,’ উঁচু গলায় বলল শ্যাডো। জমে যাওয়া হ্রদের দিকে নজর পড়লে যোগ করল, ‘এখন ঠান্ডাটা একটু কমলেই হয়।
.
দুপুর দুইটার দিকে সদর দরজায় টোকার আওয়াজ, শ্যাডোর পয়সা অনুশীলনে ব্যাঘাত ঘটাল। ঠান্ডায় হাত জমে যাচ্ছে যেন, তাই বারবার পয়সাটা ওর হাত থেকে পড়ে যাচ্ছে। নক শুনে আবারও তাই হলো। অনুশীলন বন্ধ করে দরজা খুলল সে।
ভয়ে যেন জায়গায় জমে গেল সে-দরজার ওপাশে দাঁড়ানো লোকটা কালো একটা মাস্ক পরে আছে। চেহারার নিচের দিকটা ঢেকে আছে মুখোশে, টিভিতে দেখা ব্যাংক-ডাকাতরা অমন মুখোশই পরে থাকে।
তবে মানুষটার দেহ শ্যাডোর চাইতে অনেক ছোটো, দেখে সাথে অস্ত্র আছে বলেও মনে হয় না। সেই সাথে পরনে একটা উজ্জ্বল কোট, ব্যাংক ডাকাতরা সাধারণত ওসব পরে না।
‘লাবি হিহেলহান।’ বলল লোকটা।
‘হাহ?’
ওর কথা শ্যাডো বুঝতে পারেনি ধরতে পেরে, মুখোশ খুলল লোকটা। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো হিনজেলমানের চেহারা। ‘বললাম, ‘আমি হিনজেলমান’। এই মুখোশগুলো আবিষ্কার হবার আগে মানুষ যে কী করত, তা বুঝেই পাই না। তবে আমরা কী ব্যবহার করতাম, তা মনে আছে। উল দিয়ে বোনা ক্যাপ পরতাম, সারা মুখ ঢাকা থাকত। সেই সাথে স্কার্ফও পরতে হতো। এখন যেগুলো পরি, সেগুলোকে আমার আশীর্বাদ বলে মনে হয়। আমি বুড়ো হতে পারি, কিন্তু তাই বলে নতুন আবিষ্কার দেখে নাক সিঁটকাই না!’ কথা শেষ করে একটা বাস্কেট এগিয়ে দিল লোকটা। স্থানীয়ভাবে বানানো পনির, বোতল, পাত্র আর অনেকগুলো সালামি দিয়ে ভরতি ওটা। ‘ক্রিসমাসের পরেরদিন শুভ হোক,’ বলল সে। লোকটার নাক, গলা আর কান লাল হয়ে আছে। ‘শুনলাম, এরইমাঝে নাকি ম্যাবেলের প্যাস্টির স্বাদ নিয়েছ? তাই আমাদের শহরের অন্যান্য নামকরা জিনিস নিয়ে এলাম।’
‘অনেক অনেক ধন্যবাদ।’ বলল শ্যাডো।
‘আরে না, ধন্যবাদের কী আছে? আর তাছাড়া, সামনের সপ্তাহে তোমাকে বেশ কয়েকটা লটারি টিকিট ধরিয়ে দেব। চেম্বার অভ কমার্স ওটার ব্যবস্থাপনায় আছে, আর আমি রয়েছি চেম্বার অভ কমার্সের ব্যবস্থাপনায়। গত বছর আমরা প্রায় সতেরো হাজার ডলার তুলেছিলাম, লেকসাইড হাসপাতালের শিশু বিভাগকে দিয়েছি সব টাকা।’
‘তাহলে এখনই দিন, কিনে নেই।’
‘ক্ল্যাংকার, মানে হ্রদের ওপরে গাড়িটা না রাখা পর্যন্ত আমরা টিকিট বিক্রি শুরুই করব না।’ বললেন হিনজেলমান। শ্যাডোর জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন তিনি। ‘বাইরে খুব ঠান্ডা, কাল রাতে সম্ভবত পঞ্চাশ ডিগ্রি কমেছে তাপমাত্রা।’
‘খুব দ্রুতই তাপমাত্রা কমতে শুরু করেছে।’ একমত হলো শ্যাডো।
‘প্রাচীনকালে কিন্তু এর চাইতেও বেশি ঠান্ডা পড়ত।’ বললেন হিনজেলমান। ‘বাবার মুখে শুনেছি।
‘এরচেয়েও ঠান্ডা!’
‘হ্যাঁ। আসলে তখন মানুষজন প্রার্থনা করত যেন অনেক বেশি ঠান্ডা হয়। বিশেষ করে সেটলাররা। হাজার হলেও, খাবারের অনেক কমতি ছিল তখনও। চাইলেই তো আর ডেভের দোকানে গিয়ে ইচ্ছামতো খাবার কেনা যেত না। আমার দাদার সময়কার গল্প বলি শোনো-এরকম ঠান্ডা পড়লে তিনি আমার দাদি, তাদের বাচ্চা মানে, আমার চাচা-বাবা-ফুপুকে নিয়ে চলে যেতেন ক্রিকের ধারে। সাথে অবশ্য তার কর্মচারী মেয়েটা আর ভাড়াটে কাজের লোকও যেত। সবাইকে রাম আর কিছু জড়িবুটি খেতে দিতেন তিনি। তারপর ক্রিকের পানি ঢালতেন সবার মাথায়। কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই জমে যেত সবাই, একদম আইসক্রিমের মতোই ঠান্ডা আর নীল বর্ণ ধারণ করোট। এরপর সবাইকে আগে থেকে খুঁড়ে রাখা গর্তে শুইয়ে খড় আর কাঠের গুঁড়ি ব্যবহার করে ঢেকে দিতেন। গর্তটার মুখে বিছিয়ে রাখতেন কাঁটাতার পেঁচানো কাঠের তক্তা দিয়ে। ইঁদুর, নেকড়ে আর ভালুককে দূরে রাখার জন্যই করতে হতো কাজটা। হোডাগের কথা নাহয় বাদই দিলাম, প্রাণিটাকে অনেকে অবশ্য পৌরাণিক বলে। তবে আমি বাজে গল্প বলার মতো মানুষ নই বলে তোমাকে সেসব শোনালাম না।
‘যাই হোক, কাজ শেষ করে আমার দাদা শীতের বাকিটা কাটিয়ে দিতেন আরামে। না খাবারের কমতি পড়ত, আর না আগুন জ্বালাবার উপকরণের। বসন্তের আগমন দেখতে পেলে তিনি চলে যেতেন গর্তটার কাছে। বরফ খুঁড়ে বের করতেন সবাইকে। এরপর আগুনের সামনে তাদেরকে রেখে দিতেন গলবার জন্য। কেউ আপত্তি করত না। তবে একবার কর্মচারী বেচারার কান ইঁদুরে খেয়ে নেওয়ায়, লোকটা কিছুটা অসন্তুষ্ট হয়েছিল। আসলে দোষটা আমার দাদার, কাঠের তক্তাগুলো দিয়ে আসলে ঠিকমতো গর্তের মুখটা ঢেকে দেননি সেবার। সত্যিকারের শীত ঋতু ছিল তখন। তাই এভাবে সহজেই জমিয়ে রাখা যেত মানুষকে। আজকের এইসব শীত আসলে কিছুই না।’
‘তাই নাকি?’ জানতে চাইল শ্যাডো। হিনজেলমানের বানানো গল্প শুনে মনে মনে হাসলেও মুখে হাসির লক্ষণ নেই।
‘সেই উনচল্লিশ সালের পর আর কড়া শীত দেখেনি আমরা। তুমি তখন একেবারেই বাচ্চা ছিলে, মনে করতে পারার কথা না। গাড়ি কিনেছ দেখলাম।’
‘হ্যাঁ, কেমন মনে হলো?’
‘সত্যি বলতে কী, আমার কখনওই ওই গুন্থার ছেলেটাকে পছন্দ হয়নি। এখন অবশ্য সে গ্রিন বেতে আছে, ফিরেও আসবে অতি দ্রুত। দুনিয়াতে ন্যায়বিচার বলে কিছু থাকলে, ওই ছেলেটাও শীতের সময়ে পালিয়ে যাওয়াদের দলে নাম লেখাত। কিন্তু আফসোস, ন্যায়বিচার বলে কিছু নেই পৃথিবীতে।’ শ্যাডোর বাস্কেটের জিনিসগুলো কাউন্টারের উপর সাজিয়ে রাখতে শুরু করলেন তিনি। ‘ক্যাথরিন পাউডারমেকারের ক্র্যাবঅ্যাপেল জেলি এনেছি। প্রতিবছর ক্রিসমাসের সময় একটা করে বোতল উপহার দেয় আমাকে। একটা বোতলও খোলা হয়নি কখনও। তাই ভাবলাম, তোমার জন্য একটা আনা যাক।’
‘শীতের সময় পালিয়ে যাওয়া মানে?’
‘উম,’ উলের ক্যাপটা ঠেলে কানের উপর ওঠালেন বৃদ্ধ। গোলাপি আঙুল দিয়ে কপাল ঘষতে ঘষতে বললেন। ‘লেকসাইডের বিশেষত্ব না কিন্তু ব্যাপারটা। আমাদের শহরটা ভালো, বেশ ভালো। কিন্তু সমস্যা যে একেবারেই নেই, তা নয়। শীতের সময় মাঝে-সাঝেই দেখা যায়, কোনো ছেলে বা মেয়ে একটু পাগল হয়ে গেছে। তখন এমন ঠান্ডা পড়ে যে বাইরে যাওয়াটা মুশকিল হয়ে যায়। তাই…’
‘ওরা শহর ছেড়ে পালায়?’
গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন হিনজেলমান। ‘আমি দোষ দেব টেলিভিশনকে ডালাস, ডাইনেস্টি…এসব দেখিয়ে দেখিয়ে ওদের মাথা খারাপ করে ফেলেছে। সেই তিরাশি সালের পর থেকে আমি বাসায় টিভি রাখিনি। একটা সাদা-কালো অবশ্য আছে। মাঝে মাঝে মানুষজন বাইরে থেকে এলে খেলা-টেলা দেখতে চায়। এছাড়া ক্লজিটেই থাকে।’
‘কিছু দেব?’
‘কফি লাগবে না, পেটে ব্যথা শুরু হয়। শুধু পানি দিলেই চলবে। মাথা নাড়লেন হিনজেলমান। ‘এদিককার সবচেয়ে বড়ো সমস্যাটা কী জানো? দরিদ্রতা। মহামন্দার সময়কার মতো খারাপ অবস্থা এখনও হয়নি…কিন্তু এখনকার দরিদ্রতার মধ্যে কী যেন অশুভ একটা ব্যাপার আছে। তেলাপোকার মতো…’
‘আচমকা, কিছু জানান না দিয়ে চলে আসে?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। ঠিক তেমন। কাঠ কেটে আয় করার উপায় নেই, খনিগুলোর অবস্থা ভালো না। এদিকে পর্যটকও আসে না। মাঝে-মধ্যে যে দু-একজন আসে, তারাও দেখা যায় শিকারি। বনের ভেতরেই থাকে। শহরে এসে টাকা উড়ায় না।’
‘লেকসাইডকে অবশ্য উন্নয়নশীল শহর বলেই মনে হয়।’
বৃদ্ধের নীল চোখের তারায় হাসি খেলা করে গেল। ‘অনেক কষ্ট করতে হয়েছে এর পেছনে,’ বললেন তিনি। ‘এখনও হয়। তবে শহরটা ভালো। সবাই মিলে তার উন্নতির জন্য কোনো-না-কোনো অবদান রাখছে। আমরা যখন ছোটো ছিলাম, তখনকার মতো গরীব পরিবার এখন আর দেখা যায় না।’
ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল শ্যাডো, হাসি চেপে রেখে ভাজা মাছটি উলটে খেতে পারে না এমন ভঙ্গিতে জানতে চাইল, ‘আপনি যখন ছোটো ছিলেন, তখনকার গরীব পরিবাররা কেমন ছিল, মি. হিনজেলমান?’
‘শুধু হিনজেলমান বললেই হবে, মাইক। আমরা এত গরীব ছিলাম যে আগুন ধরাবার কাঠ পর্যন্ত কিনতে পারতাম না! নিউ ইয়ার্স ইভে আমার বাবা ঝাল পেপারমিন্ট মুখে দিতেন। তারপর তা দেহ এমন গরম হয়ে যেত যে আমর, মানে বাচ্চারা, তাকে ঘিরে ধরে পোহাতাম!’
হাসি চাপতে গিয়ে পুরোপুরি সফল হলো না শ্যাডো, মৃদু শব্দ বেরিয়ে এলো। সন্তুষ্ট হিনজেলমান তার মুখোশ আর ভারী কোট পরে পকেট থেকে গাড়ির চাবি বের করে আনলেন। সবার শেষে হাতে গলালেন গ্লাভসজোড়া। ‘একা একা বিরক্ত লাগলে, দোকানে এসে আমার খোঁজ করো। আমার বড়শির কালেকশন দেখাব। এমন বিরক্ত লাগবে যে এরপর আর একা একা থাকতে কষ্ট হবে না।’
‘ঠিক আছে,’ হাসি মুখে বলল শ্যাডো। ‘টেসি কেমন আছে?’
‘শীতনিদ্রায় পাঠিয়ে দিয়েছি, বসন্তের আগে আর ওর ঘুম ভাঙাচ্ছি না। সাবধানে থেকো, মি. আইনসেল। দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
ধীরে ধীরে অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরের শীতলতা সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। কোট আর গ্লাভস পরে নিলো শ্যাডো। এরপর বুটজোড়া পায়ে দিয়ে তাকাল জানালা দিয়ে। ভেতরের কাচে এই পরিমাণ বরফ জমেছে যে বাইরের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে না। এমনকি ওর শ্বাসও বাতাসে মেঘের সৃষ্টি করছে!
কী ভেবে পাশের অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় নক করল ও। মহিলার কণ্ঠ ভেসে এলো ভেতর থেকে, ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে টেলিভিশনের আওয়াজ কমাতে বলছে। বাক্যের শব্দ আর কণ্ঠের সুর শুনে শ্যাডো বুঝতে পারল; কথাগুলোর উদ্দেশ্য কোনো বাচ্চা। প্রাপ্ত বয়স্করা আরেকজন প্রাপ্ত বয়স্কের সাথে এই সুরে কথা বলে না। দরজা খুলে ভেতর থেকে উঁকি দিল ঘন কালো আর অনেক লম্বা চুলঅলা এক মহিলা, চেহারায় ক্লান্তির ছাপ
‘বলো?’
‘কেমন আছ? আমি মাইক আইনসেল, পাশের অ্যাপার্টমেন্টে উঠেছি।’
এক বিন্দু পরিবর্তন এলো না মহিলার চেহারায়। ‘তো?’
‘ম্যাম, আমার অ্যাপার্টমেন্টটা যেন জমে গেছে। হিটার থেকে অল্প কিছুটা উত্তাপ আসছে বটে, কিন্তু কাজ হচ্ছে না।’
শ্যাডোর মাথা থেকে পা পর্যন্ত এক নজর বুলাল মহিলা, আস্তে আস্তে মুখে দেখা গেল হাসি। ‘তাহলে ভেতরে এসো, নইলে আমাদের অ্যাপার্টমেন্টেও উত্তাপ থাকবে না।’
আমন্ত্রণ পেয়ে ভেতরে প্রবেশ করল ও। প্রথমেই দেখতে পেল মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা রঙের প্লাস্টিকের গাড়ি। দেয়ালের সাথে কিছু র্যাপিং পেপারও দেখতে পেল, সেই সাথে দেখতে পেল একটা ছোট্ট ছেলেকে। টিভির মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে বসে এক মনে ডিজনির হারকিউলিস দেখছে সে। টিভির দিকে পিঠ দিয়ে বসল শ্যাডো।
‘কী করতে হবে বলছি,’ আন্তরিকতার আভাস পরিষ্কার টের পেল শ্যাডো। ‘প্রথমে জানালাগুলো সিল করে ফেলতে হবে। হেনিং-এর দোকানে গেলেই কিনতে পাবে প্রয়োজনীয় উপকরণ। ভালোমতো একবার করতে পারলেই, সারা শীত আর অসুবিধে হবে না। এরপর স্পেস হিটার কিনতে হবে, দুইটা হলে ভালো হয়। এই বিল্ডিঙের ফার্নেসটা অনেক পুরনো। ঠান্ডার সাথে তাল মিলাতে পারে না, তবে বিগত কয়েকটা শীতে খুব একটা কষ্ট হয়নি আমাদের। এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে হাত বাড়িয়ে দিল সে, ‘আমি মার্গারিতা ওলসেন।’
‘পরিচিত হয়ে খুশি হলাম,’ হাত থেকে গ্লাভস খুলে করমর্দন করল শ্যাডো। ‘কিছু মনে করো না ম্যাম, আমি জানতাম ওলসেনরা স্বর্ণকেশী হয়।’
‘আমার প্রাক্তন স্বামী তাই ছিল।’
‘মিসি গুন্থারের কাছে শুনলাম, তুমি স্থানীয় পত্রিকায় সাংবাদিকতা করো?’
‘মিসি গুন্থার সবাইকে সবকিছু বলে বেড়ায়। ও যেহেতু আছে, তাই স্থানীয় কাগজের দরকার আছে বলে মনে হয় না।’ মাথা নাড়ল মহিলা। ‘মাঝে-মধ্যে কিছু সাংবাদিকতা করি। তবে আমার সম্পাদক সাধারণত অধিকাংশ খবর লেখেন। আমি প্রকৃতি, বাগান আর মতামতের কলামে লিখি। প্রতি রবিবার একটা করে বিশেষ কলাম লিখতে হয়-স্থানীয় সংবাদ। আশপাশের পনেরো মাইলের মধ্যে কোনজনের সাথে কে ডিনার খেল, সেটাই লিখতে হয়। নাকি কার সাথে কে?’
‘কার সাথে কে,’ বলে ফেলল শ্যাডো। ‘ভালো শোনায়।’
কালো চোখজোড়া দিয়ে শ্যাডোর দিকে তাকাল মহিলা। শ্যাডোর কেন যেন মনে হলো, ওই চোখজোড়া আগেও কোথাও দেখেছে।
কার কথা যেন মনে পড়তে চাইছে ওর।
‘যাই হোক, অ্যাপার্টমেন্ট গরম রাখতে চাইলে কাজগুলো করতে পারো।’
বলল মহিলা।
‘ধন্যবাদ, কাজ শেষ হবার পর তোমার আর তোমার ছেলের দাওয়াত রইল।’
‘ওর নাম লিয়োন,’ জানাল মার্গারিতা। ‘তোমার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগল, মিস্টার…কী যেন নাম বললে?’
‘আইনসেল, মাইক আইনসেল।’
‘আইনসেল আবার কেমন নাম?’
শ্যাডোর কোনো ধারণাই নেই। ‘আমার নাম ওটাই। কেন এই নাম আমার ভাগ্যে জুটল, তা অবশ্য জানি না। পারিবারিক ইতিহাসে আমার আগ্রহ ছিল না কখনওই।’
‘নরওয়েজিয়ান হতে পারে।’ আন্দাজ করল মেয়েটা।
‘তা পারে, তবে একটু দূরত্ব ছিল পরিবারের সাথে।’ বলেই চাচা এমারসন বোরসনের কথা মনে পড়ে গেল ওর। ‘মানে মায়ের দিকের সাথে।’
.
মি. ওয়েনসডে যখন এলেন, তখন শ্যাডোর জানালা সিল করা শেষ। এমনকি শোবার ঘরটায় একটা আর বসার ঘরে আরেকটা স্পেস হিটার বসানোর কাজও খতম। এখন অ্যাপার্টমেন্টটাকে আরামদায়ক বলাই যায়!
‘ওই বাজে গাড়িটা কোথায় পেলে?’ প্রথমেই জানতে চাইলেন ওয়েনসডে।
‘আপনি আমার রদ্দিমাল দখল করলেন, তাই আমার আর কী-ই বা করার ছিল?’ পালটা প্রশ্ন করল শ্যাডো। ‘যাই হোক, আমারটা কই?’
‘ডালাসে বদলে নিয়েছি,’ জানালেন ওয়েনসডে। ‘সাবধানের মার নেই। চিন্তা করো না, তোমার ভাগ পেয়ে যাবে।
‘আমি এখানে কী করছি?’ জানতে চাইল শ্যাডো। ‘মানে, লেকসাইডে এলাম কেন?’
হাসলেন ওয়েনসড়ে, যে হাসি দেখলে তার মুখে ঘুসি বসাতে মন চায় শ্যাডোর…সেই হাসি। ‘তুমি এখানে আছ, কেননা তোমাকে এখানে কেউ খুঁজতে আসবে না। সবার নজর এড়িয়ে এখানে তোমাকে রাখতে পারব।’
‘কেউ বলতে কি ওই ‘কিম্ভূত’দের বোঝাতে চাইছেন?’
‘হ্যাঁ। হাউজ অন দ্য রকে এখন আর পা রাখা যাবে না। একটু সমস্যা হচ্ছে আমাদের, তবে সামলে নিতে পারব। এখন আসল খেলা শুরু হবার আগে কেবলই নাক ফোলানো আর পেশি দেখানোয় মন দিতে হবে। সত্যি বলতে কী, আমরা গোলমালটা আরও আগে শুরু হবে বলেই ধরে নিয়েছিলাম। যাই হোক, বসন্তের আগে বড়ো ধরনের কিছু হবে বলে মনে হয় না।’
‘কেন?’
‘কেননা মুখে ওরা যতই মাইক্রোমিলিসেকেন্ড আর ভবিষ্যতের গল্প শোনাক না কেন, থাকতে তো হয় এদেশেই। আর সেই সাথে মেনেও চলতে হয় বছরের ঋতু-পরিক্রমা। এই মাসগুলোকে ‘মরা মাস’ বললেও অত্যুক্তি হবে না। এখন না লড়াই করে লাভ হবে, আর না সেই লড়াইতে জিতে।’
‘আপনি কি বলছেন, তা কিছুই বুঝতে পারছি না।’ বলল শ্যাডো। কথাটা অবশ্য পুরোপুরি সত্যি নয়। তবে যা বুঝতে পারছে, তা মিথ্যা হোক এটা মনেপ্রাণে চাইছে ও।
‘শীতটা খুব খারাপ কাটবে। আমাদের সময়টাকে তাই খুব হিসাব করে খরচ করতে হবে। যুদ্ধের জন্য দল ভারী করতে হবে আমাদের।’
‘ঠিক আছে।’ ওয়েনসডে যে তাকে সত্যি…অন্তত অর্ধ-সত্য বলছেন সেটা ও বুঝতে পারছে। লড়াই অবশ্যম্ভাবী। নাহ ভুল হলো, লড়াই তো চলছেই। যুদ্ধের অপেক্ষা এখন। ‘পাগলা সুইনির কাছে শুনলাম, বারে যেদিন ওর সাথে আমার দেখা হয়, সেদিন নাকি আপনার আদেশই পালন করছিল?’
‘তোমার কি মনে হয়, ওরকম একটা মুষ্ঠিযুদ্ধে যে হারে, তাকে আমি দেহরক্ষী হিসেবে নিয়োগ দেব? তবে দুশ্চিন্তা করো না, তোমার ওপর আমার যে বিশ্বাস ছিল তা একেবারে অটুট আছে। ভালো কথা, কখনও লাস ভেগাসে গেছ?’
‘নেভাডার লাস ভেগাস?’
‘হুম।’
‘না।’
‘আমরা আজরাতেই ম্যাডিসন থেকে বিমানে উঠব। চার্টার করা বিমান, বুঝলে? বড়োলোকের কাজ-কারবার বলে কথা! আমার কথা শুনে বুঝতে পেরেছে ওই ফ্লাইটে তোমাকে-আমাকে তার রাখা উচিত।’
‘মিথ্যা বলতে কখনও ক্লান্ত লাগে না আপনার?’ জানতে চাইল শ্যাডো, সত্যিকার অর্থেই কৌতূহলবোধ করছে।
‘একদম না। আর তাছাড়া, মিথ্যা বলিনি তো। যাই হোক, রাস্তা পরিষ্কার আছে। ম্যাডিসনে যেতে বেশি সময় লাগবে না। দরজা বন্ধ করে হিটার অফ করে দাও। বেখেয়ালে পুরো দালান জ্বালিয়ে দাও—তা আমি চাই না।’
‘লাস ভেগাসে কার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি আমরা?’
জানালেন ওয়েনসডে।
হিটার বন্ধ করে একটা ব্যাগে কিছু কাপড় ভরে নিলো শ্যাডো। তারপর ওয়েনসডের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখুন, নিজেকে আমার বোকা মনে হচ্ছে। কার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি, তা বলেছেন। কিন্তু মনে করতে পারছি না! আজব! যাই হোক, নামটা আবার বলবেন?’
আবার বললেন ওয়েনসডে।
এবার প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছিল শ্যাডো, ঠোঁটের আগায় চলে এসেছিল নামটা। কিন্তু না, তা-ও পুরোপুরি মনে করতে পারল না। হাল ছেড়ে দিল বেচারা।
‘গাড়ি চালাবে কে?’ জানতে চাইল বরং।
‘তুমি।’ বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পার্ক করে রাখা লিংকন টাউন কারে চড়ে বসল দুজন।
তারপর গাড়ি চালিয়ে দিল শ্যাডো।
.
ক্যাসিনোর এক ধরনের আলাদা আকর্ষণ আছে, যা ওতে পা রাখা মাত্র বোঝা যায়। চারিদিক থেকে যেন প্রলোভন ঘিরে ধরে প্রবেশকারীকে। কেউ একইসাথে পাথর দিয়ে নির্মিত, হৃদয়হীন, পাষাণ আর একেবারে নির্লোভ না হলে সেই প্রলোভনের হাতছানিকে উপেক্ষা করতে পারে না। মেশিনগানের মতো স্লট মেশিন থেকে বের হতে থাকা পয়সার ঝনঝনানি কে অগ্রাহ্য করতে পারে? কে পারে রুলেট বা অন্য কোনো তাস খেলার টেবিল থেকে ভেসে আসা আনন্দধ্বনি শুনেও না শোনার ভান করতে? জুয়াড়িদের কথা নাহয় বাদই দেওয়া গেল!
এসব ক্যাসিনো কিন্তু আসলে একটা গোপন রহস্যের রক্ষক! যে গোপন কথাটা তাদের কাছে সবচেয়ে দামি, প্রাণ-ভোমরা। বিজ্ঞাপনে যা-ই বলা হোক না কেন আর যা-ই দেখানো হোক না কেন, প্রকৃতপক্ষে কোনো জুয়াড়িই জিতে ক্যাসিনো থেকে বেরোতে পারে না! এ কথা সম্ভবত জুয়াড়িরাও আঁচ করতে পারে, তবে প্রলোভন দেখানো দরজাগুলোর উদাত্ত আহ্বানের সামনে ভুলে যায়!
গোপন কথাটা হলো-মানুষ জুয়া খেলে টাকা খোয়াবার জন্য। ওরা ক্যাসিনোর বিশাল দরজা দিয়ে ভেতরে পা রাখে নিজের ভেতর প্রাণের স্পন্দন অনুভব করতে চায় বলে; টাকা দিয়ে তারা কেনে স্লট মেশিন বন্ধ হবার বা রুলেট টেবিলের ঘূর্ণন শেষ হবার মুহূর্ত উপভোগ করার আনন্দ! হয়তো ঘরে ফিরে এসব লোক গর্ব করে জানায়: ক্যাসিনোকে ধোঁকা দিয়েছে। কিন্তু এদের প্রত্যেকেই একটা মূল্যবান জিনিস দিয়ে আসে ক্যাসিনোকে-সময়। এক হিসেবে, এটাও এক ধরনের বলিদান।
টাকা এখানে প্রবাহিত হয় নদীর নিরবচ্ছিন্ন স্রোতের মতো। এক হাত থেকে অন্য হাত, জুয়ারি থেকে ডিলার হয়ে ক্যাশিয়ার, আর সব শেষে গণন কক্ষে। এখানে এসে বিশ্রাম পায় অর্থ; গোণা হয়, লিখে রাখা হয়, গোছানো হয়। অবশ্য আজকাল এই কক্ষের দাম ও গুরুত্ব, দুটোই কমে এসেছে। এখন টাকার হাত- বদল নোটে বা চিপসের আকারে হয় না, হয় বাইনারি কোডের শূন্য আর একের আদলে।
আমাদের আলোচ্য গণনা রুমে মানুষ তিনজন, টাকা গোনার কাজে ব্যস্ত সবাই। ক্যামেরা দিয়ে চোখ রাখা হচ্ছে তাদের ওপরে। এসব যন্ত্রের কয়েকটা আছে তাদের চোখের সামনে, আবার অনেকগুলোই আছে লুকিয়ে। শিফট মেনে কাজ করতে হয় এই তিনজনকে। একেক শিফটে যে পরিমাণ টাকা গুনতে হয়, সে পরিমাণ সম্ভবত সারা জীবন খেটেও এদের কেউ কামাতে পারবে না। স্বপ্নেও টাকা গোনে তারা, প্রতি সপ্তাহেই পরিকল্পনা করে-কীভাবে ক্যাসিনোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার চোখে ধুলো দিয়ে টাকা চুরি করা যায়। তবে হ্যাঁ, অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্বপ্নেই বুঝতে পারে—কাজটা করা তার পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব না! তাই কবর অথবা জেলের ফাঁদে পা না দিয়ে মাসিক বেতন নিয়েই খুশি।
আজ এখানে, এই গণনা কক্ষের নিরাপদ আশ্রয়ে, তিনজন মানুষ মাথা নিচু করে টাকা গোনায় মগ্ন। টাকা এনে দেয় কিছু প্রহরী, আবার ওরা ঠিকমতো কাজ করে কি না সেদিকেও নজর রাখে। আরেকজন আছে, যাকে উল্লেখ না করলেই নয়। কয়লা রঙের একটা স্যুট পরে থেকে সে, তার চুল কালো, দাড়ি কামানো…চেহারা আর অঙ্গভঙ্গিতে মনে রাখার মতো কিছুই নেই। লোকটা যে ঘরের ভেতরে আছে, সেটা অন্য কারও নজরেই পড়েনি। অথবা নজর পড়লেও, ভুলে গেছে পরমুহূর্তেই।
শিফট শেষ হলে খুলে গেল দরজা। কয়লা-রঙা স্যুট পরা লোকটা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। শক্ত কয়েকটা বাক্সে করে টাকাগুলো নিয়ে যাওয়া হলো ভেতরের একটা লোডিং বেতে। ওখান থেকে তাদের অবস্থান হলো একটা আর্মাড গাড়ির পেছনে। বাহনটা যখন লাস ভেগাসের রাস্তায় নেমেছে, তখন সবার অলক্ষ্যে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে ফুটপাতে পা রাখল কয়লা-রঙা স্যুট পরিহিত ভদ্রলোক; ডানে বা বাঁয়ে, কোনো দিকেই নজর নেই তার।
লাসভেগাস যেন গড়ে উঠেছে কোন বাচ্চা ছেলের স্কেচ-বুকের আদলে। এখানে গল্পের বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা একটা দুর্গ তো ওখানে স্ফিংক্স পাশে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পিরামিড, শহরজুড়ে যেন নিয়োন আলো আর সাইনবোর্ডের খেলা! আলোকবাজির একটা শহর লাস ভেগাস, ঘণ্টায় একবার করে আলো আর আগুন লাফিয়ে ওঠে আকাশ ছুঁতে।
ফুটপাতে খুব সহজেই এগিয়ে যাচ্ছে কয়লা-রঙের স্যুট পরা লোকটা, টাকার প্রবাহ যেন অনুভব করতে পারছে সে। গ্রীষ্মের সময়টায় রাস্তা যেন পরিণত হয়েছে উত্তপ্ত উনুনে, প্রতিটা দোকানের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসা ঠান্ডা বাতাস স্বস্তির পরশ বোলাচ্ছে দেহে। তবে হ্যাঁ, মরুভূমির রাতে যে ঠান্ডা পড়ে, তা ওর ভালোই লাগে। অর্থের প্রবাহ লোকটার মনে মাকড়সার জালের জন্ম দিয়েছে। মরুভূমির এই শহরটাকে ওর ভালো লাগে একটাই কারণে-গতি। অর্থ যখন শহরটায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায়, এক হাত থেকে আসে অন্য হাতে-তখন বেশ ভালো লাগে তার। কেমন যেন নেশা-নেশা ভাব হয়।
যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে একটা ট্যাক্সি লোকটাকে অনুসরণ করে চলছে। প্ৰথম প্রথম ওটাকে খেয়াল করেনি সে, কেউ যে ওকে অনুসরণ করতে পারে সেটা কল্পনাও করেনি। লোকজন তাকে কখনও খেয়াল করে না দেখে, আশপাশে নজর রাখার কথা সে কল্পনাও করে না।
ভোর চারটায় নিজেকে একটা হোটেল অ্যান্ড ক্যাসিনোতে আবিষ্কার করল লোকটা। অবশ্য স্থাপনাটা প্রায় ত্রিশ বছর আগেই পুরনো হয়ে গেছে। বন্ধ হব- হব করছে ওটা, তবে আরও ছয় মাস চালু থাকলেও অবাক হবার কিছু নেই। তখন ওটাকে ধ্বংস করে সে জায়গায় তোলা হবে বিশাল বড়ো দালান। এখানে কেউ চেনে না ওকে, কেউ মনে রাখে না। তবে লবির বারটা চুপচাপ, শান্ত। পুরনো সিগারেটের ধোঁয়ায় নীল বর্ণ ধারণ করেছে বাতাস। ওপরের একটা ঘরে পোকার খেলায় এক মিলিয়ন ডলার বাজি ধরতে যাচ্ছে এক জুয়াড়ি। বারে বসল লোকটা, ওয়েট্রেসরাও পর্যন্ত ওর দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না। গান বাজছে কোথাও, বসে বসে বারের টিভিতে ফুটবল খেলা দেখছে পাঁচজন ‘নকল’ এলভিস প্রিসলি!
তার পাশে এসে বসল হালকা ধূসর স্যুট পরিহিত বিশালদেহী এক মানব। নতুন আসা এক লোকটাকে দেখে এগিয়ে এসে তার কাছে এলো এক ওয়েট্রেস। মেয়েটা এতটাই চিকন যে তাকে খুব একটা সুন্দর বলা চলে না। কাজটা যে সে পছন্দ করে না, তা-ও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। মেয়েটাকে দেখে হাসল নবাগত। ‘তোমাকে আজ দেখে খুব ভালো লাগছে, প্রিয়ে।’ বড়ো অঙ্কের একটা বখশিশ পাবার আসায় দাঁত বের করে হাসল মেয়েটাও। সদ্য আগত লোকটা নিজের জন্য এক গ্লাস জ্যাক ড্যানিয়েল’স এবং অন্যজনের জন্য এক গ্লাস পানি মিশ্ৰিত ল্যাফোইগের অর্ডার দিল।
‘এই দেশের ইতিহাসে,’ মদ এলে বলল নবাগত। ‘সবচেয়ে সুন্দর পঙতি কোনটা ছিল, জানো? সেই ১৮৫৩ সালে কয়েকটা কথা বলেছিল কানাডা বিল জোনস, ব্যাটন রুঝে। পাতানো ফারো খেলায় লোকটার পকেট কাটা হচ্ছিল। কানাডা বিলের মতোই আরেকজন ছিল জর্জ ডেভল, তবে জুয়ায় তার মতো আসক্ত ছিল না। বিলকে এক পাশে সরিয়ে নিয়ে জানতে চেয়েছিল সে, খেলাটা যে পাতানো তা কি বিল বুঝতে পারছে না? দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটাই কথা বলেছিল লোকটা, ‘আমি জানি পাতানো। কিন্তু এই শহরে যে আর কোনো জুয়া নেই!’ আর কথা না বাড়িয়ে পাতানো খেলাতেই ফিরে গেছিল লোকটা।’
কালো একজোড়া চোখ অবিশ্বাস নিয়ে ধূসর স্যুট পরিহিত লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু একটা বলল কয়লা-রঙা স্যুটের লোকটা। নবাগত, লালচে দাড়ি ভরতি থুতনিটা নাড়াল।
‘দেখো,’ বলল সে। ‘উইসকনসিনের ব্যাপারটার জন্য ক্ষমা চাইছি। তবে ঝামেলা ছাড়াই কি আমি ওখান থেকে তোমাদেরকে বের করে আনিনি?’
উত্তর এলো না। তবে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর কিছুটা একটা জানতে চাইল লোকটা।
‘জানি না। সবকিছু আমার আশার চাইতে বেশি দ্রুত ঘটছে। আমি যে যুবককে ভাড়া করেছি, সবাই কেন জানি ওর পেছনে লেগেছে। ওকে বাইরে, ট্যাক্সিতে বসিয়ে রেখেছি। আমার প্রস্তাবে রাজি আছ?’
উত্তর দিল কয়লা-রঙা লোক।
নবাগত মাথা নাড়াল। ‘গত দুইশ বছরে কেউ মহিলাকে দেখেনি। হয় মারা গেছে সে, নয়তো আত্মগোপন করে আছে।’
কিছু একটা বলা হলো নবাগতকে।
‘দেখো,’ উত্তর দিল নবাগত। ‘আমাদের যখন দরকার হবে, তখন যোগ দেবে। বিনিময়ে তোমার যা চাই, তা পাবে। কী চাও? সোমরস? সত্যিকারের একটা বোতল দিতে পারি তোমাকে।’
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল লোকটা। এরপর মাথা নেড়ে কিছু একটা বলল।
‘অবশ্যই,’ উত্তর দিল নবাগত, হাসিটা এতই তীক্ষ্ণ যে ছুরিও হার মানবে। ‘এছাড়া আর কি? কিন্তু ব্যাপারটাকে এভাবে দেখ-এই শহরে যে আর কোনো জুয়া নেই!’ হাত বাড়িয়ে অন্য লোকটার বাহুতে চাপড় দিল লোকটা।
শুকনো ওয়েট্রেস এগিয়ে এলো ওদের দিকে, অবাক হয়ে লক্ষ করল-মাত্র একজন বসে রয়েছে টেবিলে। লোকটার পরনে কয়লা-রঙা স্যুট, মাথায় কালো চুল। ‘সব ঠিক আছে তো?’ জানতে চাইল মেয়েটা। ‘তোমার বন্ধু ফিরবে?
দীর্ঘশ্বাস ফেলল লোকটা। ওর বন্ধু যে আর আসবে না তা বলল, মেয়েটাকে হতাশ করে জানাল-বখশিশ অপেক্ষা করছে না ওর জন্য। মেয়েটার চোখে দুঃখ দেখে দয়া হলো বেচারার। অর্থের প্রবাহ কল্পনা করল মনে, একটা ফাঁকা স্থান দেখতে পেয়ে জানাল-ট্রেজার আইল্যান্ডের বাইরে, ঠিক সকাল ছয়টায় যদি মেয়েটা থাকতে পারে তো ডেনভার থেকে আগত এক ক্যান্সার চিকিৎসককে পাবে। লোকটা সদ্যই চল্লিশ হাজার ডলার কামিয়েছে। খরচ করার জন্য সাহায্যকারী খুঁজছে সে, আটচল্লিশ ঘণ্টা বাদে বিমানে ওঠার আগেই পুরোটা খরচ করে ফেলতে চায়।
শব্দগুলো প্রায় সাথে সাথেই ভুলে গেল মেয়েটা, তবে ভালোলাগার অনুভূতিটা রয়ে গেল। আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল, কালো রঙের স্যুট পরা লোকটা তাহলে বিল না চুকিয়েই ভেগে গেছে। ঠিক করল, শিফট শেষ হবার পর ট্রেজার আইল্যান্ডে যাবে ও। কেন, তা জানে না! জিজ্ঞেস করলেও বলতে পারবে না!
.
‘কার সাথে দেখা করতে গেছিলেন?’ ফেরার পথে জানতে চাইল শ্যাডো। শহরটা এমন…যে বিমান বন্দরেও আছে কয়েকটা স্লট মেশিন! এখনও ভোর, তবে ওগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে আছে অনেকেই, পয়সা খাওয়াচ্ছে মেশিনগুলোকে। এই বন্দরে সারাদিন পড়ে থাকে নাকি ওরা? ভাবল শ্যাডো। এমনও তো হতে পারে যে কেউ বন্দরে নেমে স্লট মেশিন নিয়ে মেতে গেল? সাথে আনা সব পয়সা শেষ করে বন্দর থেকেই ফিরে গেল বাড়িতে! হতে পারে না?
আচমকা উপলব্ধি করল, ওয়েনসডে কথা বলছেন এখনও। শ্যাডোর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তিনি, কিন্তু ও শোনেনি।
‘আমাদের দলে নাম লিখিয়েছে,’ বললেন ওয়েনসডে। ‘অবশ্য আমার এক বোতল সোমরস খরচ হবে।’
‘সোমরস কী?’
‘এক ধরনের পানীয়।’ ভাড়া করা বিমানটার দিকে এগিয়ে গেল ওরা। ওদের আর অন্য তিনজন খরুচে লোকের বিমান ছাড়া বন্দরটা খালি।
আরাম করে বিমানের আসনে হেলান দিলেন ওয়েনসডে, নিজের জন্য জ্যাক ড্যানিয়েল’সের অর্ডার দিলেন তিনি। ‘আমার মতো যারা আছে, তারা তোমাদের মতো মানুষকে ভাবে…’ ইতস্তত করলেন ওয়েনসডে। ‘…ব্যাপারটা অনেকটা মধু আর মৌমাছির মতো। প্রতি মৌমাছি অল্প, অল্প…বিন্দু বিন্দু করে মধু জমায়। তোমার নাস্তার টেবিলে মধু-ভরতি যে পাত্রটা আছে, সেটুকু জমা করতে হয়তো এরকম লাখ লাখ বিন্দুর প্রয়োজন পড়েছে। আমাদের জন্যও ব্যাপারটা অনেকটা সেরকম…আমরা তোমাদের বিশ্বাস, তোমাদের প্রার্থনা আর তোমাদের ভালবাসার উপর নির্ভর করে বেঁচে আছি।’
‘তাহলে সোমরস কী?’
‘বোঝাবার স্বার্থেই বলি, সোমরস হচ্ছে মধু দিয়ে তৈরি মদ।’ মুচকি হাসলেন তিনি। ‘ওটা একধরনের পানীয়। প্রার্থনা আর বিশ্বাসকে ঘন করে বানানো হয়েছে।’
বিমান এখন নেব্রাস্কার কোথাও আছে। আচমকা শ্যাডো বলল, ‘আমার স্ত্রী-’
‘তোমার মরহুমা স্ত্রী?’
‘লরা। ও আবার বেঁচে উঠতে চায়। কিম্ভূতদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করার পর তাই বলেছিল।
‘ভালো স্ত্রীর তেমনটাই হওয়া উচিত। তোমার আসলে নিজ স্ত্রীকে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরা উচিত, আইনসেল।
‘কাজটা কি সম্ভব? মানে ওকে বাঁচিয়ে তোলাটা?’
অনেকক্ষণ কিছু না বলে চুপ করে রইলেন ওয়েনসডে। ওর সন্দেহ হচ্ছে, ভদ্রলোক সম্ভবত কিছু শুনতেই পাননি। আর নয়তো ঘুমিয়ে পড়েছেন! ওকে চমকে দিয়ে আচমকা কথা বলে উঠলেন ওয়েনসডে। ‘আমি এমন এক মন্ত্ৰ জানি, যেটা ব্যথা মিটিয়ে দিতে পারে; সুস্থ করে দিতে পারে যেকোনো অসুস্থতা; অন্তর থেকে মিটিয়ে দিতে পারে দুঃখ।
‘আমি এমন এক মন্ত্র জানি, যেটা আরোগ্য এনে দিতে পারে কেবলমাত্র স্পর্শের মাধ্যমে।
‘আমি এমন এক মন্ত্র জানি, যেটা যেকোনো শত্রুর অস্ত্র নষ্ট করে দিতে পারে। ‘আরেকটা মন্ত্র আছে, যেটা উচ্চারণ করা মাত্র আমি মুক্ত হবো সব ধরনের বাঁধন থেকে।
‘পঞ্চম যে মন্ত্র জানি, সেটা পড়লে কী হবে বলব? বাতাস থেকে তুলে নিতে পারি ছুড়ে দেওয়া তির।’
অন্য রকম একটা গাম্ভীর্য খেলা করছে ভদ্রলোকের কণ্ঠে। একটু আগের আমুদে ভাব উধাও হয়ে গেছে। এমনভাবে কথা বলছেন তিনি, যেন পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বই থেকে পড়ছেন।
‘ছয় নম্বর মন্ত্রটা আমাকে ব্যথা দেবে না। উলটো ব্যথা পাবে আমার আঘাতকারী।
‘আমি এমন এক মন্ত্র জানি, মাত্র এক নজর তাকিয়েই সবকিছু নিভিয়ে দেওয়ার শক্তি আমাকে দিতে পারে।
‘আট নম্বর মন্ত্রটা পড়ার সাথে সাথে, আমাকে ঘৃণা করা লোকটাও পরিণত হবে খুব কাছের বন্ধুতে।
‘নয় নম্বর মন্ত্র বাতাসকে শান্ত করার জন্য, ঝড় থেমে যায় সেই মন্ত্ৰ শুনে। ‘ওই নয়টা মন্ত্র শিখেছি আমি সবার আগে। নয় দিন ধরে একটা গাছে ঝুলছিলাম, আমার পাশে ঢুকে ছিল একটা বর্শার ফলা। ঠান্ডা বাতাস আমাকে দুলিয়েছে, যেমন দুলিয়েছে গরম বাতাস! আমার পান করার মতো পানি ছিল না, ছিল না খাওয়ার মতো খাবার। নিজেকে উৎসর্গ করেছিলাম নিজেরই উদ্দেশ্যে। ফলশ্রুতিতে সারা দুনিয়া যেন খুলে গেছিল আমার সামনে।
‘দশম মন্ত্রটা আমি শিখেছিলাম ডাইনিদের তাড়িয়ে দেবার জন্য। ওদেরকে এমনভাবে ভুলিয়ে দিয়ে পারি সবকিছু যে নিজের ঘরের পথটাও চিনতে পারে না। ‘এগারো নম্বর মন্ত্র যদি আমি যুদ্ধের মাঝখানে গাই, তাহলে সৈন্যরা বিন্দুমাত্র আঘাত সহ্য না করেই ফিরে আসে তাদের ঘরে।
‘আমি এমন এক মন্ত্র জানি, যেটা আমাকে দেয় বিশেষ ক্ষমতা। ফাঁসি-কাষ্ঠ থেকে ঝোলা মানুষও আমাকে জানিয়ে দেয় মৃত্যুর ওপাশের গল্প।
‘তেরো নম্বর মন্ত্রটা পড়ে যদি কোনো বাচ্চার মাথার উপর পানি ছিটিয়ে দেই, তাহলে সে বড়ো হয়ে অপরাজেয় এক সৈনিক হবে।
‘চোদ্দো নম্বরটা আমাকে মনে রাখতে সাহায্য করে সব দেবতার নাম। এক্কেবারে সব!
‘আমি নিজে স্বপ্ন দেখি ক্ষমতা, শৌর্য, জ্ঞানের। আর পনেরো নম্বর মন্ত্রটা মানুষকে বাধ্য করে আমার স্বপ্নে বিশ্বাস করতে।’
ওয়েনসডের কণ্ঠ এতটা নিচু হয়ে গেছে যে বিমানের আওয়াজ ছাপিয়ে সেটা শুনতে কষ্ট হচ্ছে শ্যাডোর।
‘ষোলো নম্বরটার কথা বলি—চাইলে যেকোনো মেয়েকে পটাতে পারি।
‘সতেরো নম্বর, একবার আমার সাথে প্রেম করার পর আর কেউ সেই মহিলাকে সন্তুষ্ট করতে পারবে না।
‘আঠারো নম্বর যে মন্ত্রটা জানি, সেটা অন্য সবগুলোর চাইতে সেরা। এই মন্ত্রের ব্যাপারে কাউকে কিছুই বলা যাবে না। কেউ জানে না এই রহস্য, কেননা এরচেয়ে শক্তিশালী আর কোনো রহস্য নেই।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করলেন তিনি।
শিহরিয়ে উঠল শ্যাডো, মনে হলো যেন এতক্ষণ জানালা দিয়ে অন্য এক দুনিয়ার দিকে তাকিয়ে ছিল। এমন সেই দুনিয়া, যেখানে প্রতিটা চত্বরে বাতাসে ঝোলে কোনো-না-কোনো লাশ; যেখানে রাতের অন্ধকারে শোনা যায় ডাইনির চিৎকার।
‘লরা।’ কেবল এতটুকুই বলতে পারল শ্যাডো।
মাথা ঘুরিয়ে শ্যাডোর চোখে চোখ রাখলেন ওয়েনসডে। ‘কিন্তু আমিও তোমার স্ত্রীকে জীবিত করতে পারব না। কেন যে সে এখন হেঁটে-চলে-বেড়াচ্ছে, তাই তো জানি না।’
‘আমি জানি সম্ভবত,’ বলল শ্যাডো। ‘আমার দোষ।’
ভ্রু কুঁচকে তাকালেন ওয়েনসডে।
‘পাগলা সুইনি আমাকে একটা সোনার পয়সা দিয়েছিল। পরে দেখা হবার সময় হওয়া কথা থেকে যা বুঝলাম, ভুল পয়সাটা দিয়ে ফেলেছিল সে। অনেক বেশি ক্ষমতাবান কিছু একটা ওটা, যা আবার আমি দিয়েছি লরাকে।’
ঘোঁত করে উঠলেন ওয়েনসডে, বুকের কাছে থুতনি ফেলে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। ‘হুম, তাহলে হতে পারে! যাই হোক, আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারব না। ফাঁকা সময়ে তুমি কী করো, তা তোমার একান্ত ব্যাপার।’
‘এর মানে কী?’ জানতে চাইল শ্যাডো।
‘এর মানে, তুমি যদি ইগল স্টোন বা থান্ডারবার্ড খুঁজে বের করতে চাও, তাহলে ফাঁকা সময়ে সেটা করতে পারো। আমার আশা, তুমি চুপচাপ লেকসাইডেই সময় কাটাবে। কারও নজরে পড়বে না, কাউকে বিরক্ত করবে না। ঝামেলা শুরু হলে আমাদের সবাইকে দরকার হবে।’ খুব ভঙ্গুর আর দুর্বল দেখাল ভদ্রলোককে, চামড়াটা মনে হলো যেন স্বচ্ছ।
শ্যাডোর খুব করে ইচ্ছা হলো, ওয়েনসডের হাতে হাত রাখে। বলতে চাইল, সবকিছু ঠিক আছে। যদিও শ্যাডোর তা মনে হচ্ছিল না, কিন্তু ওয়েনসডেকে সান্ত্বনা জানাবার জন্য হলোও মিথ্যা বলত সে। জানে, দুনিয়াতে এখনও অপেক্ষা করছে ট্রেনে দেখা হওয়া ওই কিম্ভূতগুলো। জানে, হোঁতকা একটা ছেলে লিমোতে বসে টানছে সিগারেট। জানে, টেলিভিশন থেকে উঁকি দেয় এমন দেবতারা, যারা ওর ক্ষতি করতে চায় কেবল!
কিন্তু না, ওয়েনসডেকে স্পর্শ করল না ও। বলল না কিছুই।
সবকিছু শেষ হয়ে যাবার পর প্রায়ই ভাবত, হয়তো কাজটা করলে ভবিষ্যতের সব ঝামেলা কিছুটা হলেও কম হতো! জানে, হতো না। নিজেকেও তাই বোঝাত। কিন্তু তখনও আফসোস হতো ওর। ইচ্ছা হতো…অন্তত একটা ক্ষণের জন্যও যদি স্পর্শ করত ওয়েনসডের হাত!
.
ওয়েনসডে যখন শ্যাডোকে অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে নামিয়ে দিলেন, তখন দিনের আলো মরে যেতে শুরু করেছে। দরজা খোলা মাত্র ঠান্ডা বাতাস এসে কামড় বসালো ওর দেহে।
‘ঝামেলা পাকিয়ো না,’ বললেন ওয়েনসডে। ‘পারলে গর্তে মাথা ঢুকিয়ে রেখ।’
‘সবসময়! এমনকি খাবার সময়েও?’
‘আমার সাথে ঠাট্টা করার চেষ্টাও করো না, বাছা। তোমাকে এখানে নিরাপদে রাখতে আমার অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে। অন্য কোনো শহরে এক ঘণ্টাও টিকতে পারতে না।’
‘ঠিক আছে, মাথা নত করে সাবধানে থাকব। মন থেকেই কথাগুলো বলল শ্যাডো। এক জীবনের জন্য যথেষ্ট হয়েছে ঝামেলা। ‘আপনি ফিরছেন কখন? জানতে চাইল ও।
‘দ্রুতই,’ বলে লিংকন গাড়িটার এঞ্জিন চালু করে দিলেন ওয়েনসডে। জানালা তুলে দিতে হারিয়ে গেলেন রাতের আঁধারে।