আমি ও বিপাশা – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

আমি ও বিপাশা

মেয়েটির দিকে অবাক হয়ে চেয়েছিলাম কতক্ষণ। খুব চেনা লাগছিল, অথচ সাহস করে জিগ্যেস করতে পারিনি। তবে অবাক হবার কারণ, নির্জন নদীর ধারে সভ্যতা খুব কদাচিৎ দেখা যায়—যদিও খানিকদূরে একটা হাইওয়ে, বিশাল ব্রিজ আর উঁচু উঁচু বিদ্যুতবাহী ফ্রেম রয়েছে।

শরতে এই নদী এখন বেগবতী। কাশ ফুল ফোটা দুই পাড়ও ভারি চঞ্চল। বাঁধের জামগাছটার ছায়ায় দাঁড়িয়ে মেয়েটির মুখোমুখি হতেই চিনলুম।—বিয়াস নাকি? কখন এলে?

সে প্রথমটা একটু হকচকিয়ে পড়েছিল। পরমুহূর্তে চিনতে পেরে হেসে উঠল।—পারুদা! আমরা কাল এসেছি। তোমার শাটলেজও এসেছেন। দেখা হয়নি?

—না তো? কেমন আছ সব? বাবা-মা ভাল আছেন? সামাজিক প্রাণীর পক্ষে এসব বলার রীতি আছে বলেই অনর্গল কিছুক্ষণ বলে গেলুম!

সে ভুরু নাচিয়ে বলল—কিন্তু বিয়াস নামটা এখনও আপনার মনে আছে দেখছি।

—আছে। কত কী মনে আছে।

—যেমন?

—শুনবে? বলে গলার স্বর একটু চাপা করলুম। এক খরার দুপুরে ওই জামবনে তোমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলুম। তারপর কী ভীষণ কাণ্ড হল। তুমি মাছের মতো ছটফট করছিলে। অথচ সে যেন সুখ তোমার।

 তার মুখ রাঙা হয়ে গেল শুনতে শুনতে। মুখ ঘুরিয়ে শুধু বলল—যাঃ!

—লজ্জা পাবার কী আছে? সে বিয়াস তো আর তুমি এখন নও। রীতিমতো বিপাশা চৌধুরী!

বিপাশা হঠাৎ যেন সামলে নিল। তার সভ্যতাময় সপ্রতিভ চেহারায় হাসতে হাসতে বলল—আর দাদাও এখন শতদ্রু চাউড্রি হয়ে গেছেন জানেন তো?

—বল কী!

হবে না আবার? ওড়িশার একটা প্রজেক্টের বড়কর্তা হয়েছেন।

—জানতুম শতদ্রু উন্নতি করবে।

একটা মেটুলি ঝোপের পাতা ছিঁড়ে বিপাশা বলল—উন্নতি না হাতি! তোমার মনে নেই পারুদা, দাদা বলতেন—এয়ারফোর্সের পাইলট হবো? আকাশে আকাশে ঘুরব। আর নিচে নামবই না। মাটির ওপর গুলিগোলা বোমা ছুঁড়ে পৃথিবীর বারোটা বাজাব।

—হ্যাঁ, শতদ্রুদা তাই বলত বটে। তখন যেন তোমার বাবার সঙ্গে তোমার জ্যাঠার একটা মামলা চলছিল।

বিপাশা শান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল—হঠাৎ এখানে কোত্থেকে হাজির হলেন? জানেন—আপনাদের বাড়িতে খোঁজ নিয়েছিলুম এসেই। শুনলাম…

—শুনলে পারু মানুষ খুন করে ফেরারী হয়েছে?

বিপাশা চমকে উঠল। —যাঃ তা কেন বলবে? বলল—নেই। ব্যস।

—বলল নেই—আর হঠাৎ এই সকালে আমাকে নদীর ধারে দেখতে পেলে। এতে তোমার কিছু অবাক লাগছে না?

বিপাশা সরল মুখে বলল—না তো!

—আমার চেহারায় কিছু টের পাচ্ছ না?

 সে আমাকে কয়েক মুহূর্তে খুঁটিয়ে দেখে নিয়ে বলল—নাঃ!

—আমার ময়লা শার্ট, ভিজে ধুতি, খালি পা, লাল রুক্ষ চোখ দেখেও কিছু আঁচ করতে পারছ না?

বিপাশা এবার সন্দিগ্ধ স্বরে বলল—কিছু বুঝতে পারছি না পারুদা।

—বিপাশা, তুমি কি গ্রাম থেকে হেঁটে এতটা পথ এসেছ?

—না গাড়িতে। ওই যে ব্রিজে আমার গাড়ি।

—তুমি নিজে ড্রাইভ করো?

—উঁহু।

—বিপাশা, তোমার পরণের ওটাকে কী বলে যেন। বেলবটস?

বিপাশা একটু অপ্রতিভ হল। —হঠাৎ আমার পোশাক নিয়ে পড়লেন কেন? নিজের কথা বলুন।

—বিপাশা, তুমি সভ্যতার অন্তর্গত!

—ইস! আপনি যেন নন!

—আচ্ছা বিপাশা, তবু কেন তোমার এখানে আসতে ইচ্ছে করল? এখানে তো শুধু কাশফুল, নদীর ঘোলা জল, পাঁক, জঙ্গল, পোকামাকড়। …বিপাশা! সরে দাঁড়াও। ঝোপে একটা লাউডগা সাপ!

বিপাশা চমকে সরে এল। —কই? কোথায়?

ওকে দেখিয়ে দিলুম। তারপর বললুম—ভীষণ বন্যা হল তো! সব পোকামাকড় এসে বাঁধের ঝোপঝাড়ে আশ্রয় নিয়েছিল। এখনও ফিরে যায়নি যে যার এলাকায়। এমন কি শামুকগুলো এখানেই ডিম পেড়েছিল। আর…

—আপনি ওভাবে কথা বলবেন না পারুদা! কেমন ভয় করে।

—তবু তুমি এখানে এসেছ!

—বা রে! ছেলেবেলার চেনা সব জায়গা। মনে পড়ছিল, তাই এলুম। …ও কী! ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন?

—চুপ। লুকোচ্ছি। ব্রিজে পুলিশ যাচ্ছে।

বিপাশা ব্রিজটা দেখে নিয়ে বলল—ওরা সাইকেলে কোথাও যাচ্ছে। কিন্তু ওদের দেখে লুকোচ্ছেন কেন?

—বললুম না, ফেরারী আসামী, মানুষ খুন করেছি।

—তুমি…আপনি কি নকশাল, পারুদা?

—উঁহু। আমি কোন দলের মানুষ নই। পৃথিবীকে বদলানো দুঃসাধ্য।

সকৌতুকে বিপাশা বলল—ভাল। কাকে খুন করেছেন?

—শোননি? গ্রামে কেউ বলেনি?

—নাঃ। কেউ বলেনি। খুন-টুন করলে নিশ্চয় বলত।

—বিপাশা!

—উঁ?

—তুমি চলে যাও এখান থেকে। তোমাকে দেখে আমার ভীষণ লোভ হচ্ছে।

বিপাশা প্রায় হইচই করে বলল—এই! আপনি এখনও বড্ড অসভ্যতা করতে পারেন, সত্যি। যা ছিলেন, তাই একেবারে। যাঃ!

—বিপাশা, তুমি এত সুন্দর হয়ে উঠেছ!

—মেরে ফেলব পারুদা! একেবারে খুন করে ফেলব কিন্তু। বাজে কথা বলবেন না।

এগিয়ে গিয়ে ওর একটা হাত ধরলুম।—বিপাশা, চলো না ঐ জাম বনটায় গিয়ে কথা বলি। এখানে দাঁড়ানো নিরাপদ নয়। চলো না!

বিপাশা অনিচ্ছাসত্বেও পা বাড়াল। যেতে যেতে ব্রিজে নিজের গাড়ীটা একবার দেখে নিল। টের পাচ্ছিলুম যে ও খুব সতর্কভাবে হাঁটছে। ইচ্ছা-অনিচ্ছার দ্বন্দ্বে চঞ্চল হয়েছে। তবু আমাকে এড়াতে পারছে না। কারণ, আমি ওর ছেলেবেলার এক ভয়ঙ্কর দিন। অন্তত বিগত সময়ের তের বছর বয়সের মেয়ের জীবনের একটি অমোঘ সত্য। আর ও যা অনুভূতিপ্রবণ মেয়ে! নিজের রক্তকে যে একবার বুঝেছে, তার মুক্তি নেই।

বাঁধটা নদীর পাশাপাশি ঘুরে জামবনে ঢুকেছে। এই জঙ্গলটা সিকি মাইল একটানা চলেছে। এক সময় দুপাশে বিশাল খড়ের জঙ্গল ছিল। এখন আবাদ হয়েছে। সবুজ ধানের মাঠ। অবশ্য সদ্য বন্যার গাঢ় ঘোলাটে জল নেমে গিয়ে সবুজ রঙটা হলদে দেখাচ্ছে। ভাগ্যিস শিগগির বন্যার জল নেমে গেল। তাই মাঠটার বিশেষ ক্ষতি হয়নি। কয়েকটি দিনের রোদেই ধান গাছগুলো আবার সামলে নিয়ে মাথা তুলেছে। কোথাও কোথাও একটুকরো পোড়ো জমির ওপর বাবলাবন। সেখানে দূরে, গয়লারা একদঙ্গল গরু মোষ নিয়ে গেছে। বাবলাফল পেড়ে খাওয়াচ্ছে প্রাণীগুলোকে। কোথাও কোন ধানের ক্ষেতে একটা চাষী হাঁটু দুমড়ে আগাছা ওপড়াচ্ছে। দূরে গাছপালার পায়ে ধোঁওয়াটে ভাব—কুয়াশার! শিশির শুকিয়ে যাবার পর ঘাসফড়িং লালপোকা নীলপোকারা দলে দলে বেরিয়ে পড়েছে। মাকড়সার জালগুলো এখন শুকনো। কোথাও সাপ দেখতে পেয়ে শালিক আর ফিঙ্গে পাখির ঝাঁক তুমুল চেঁচামেচি করছে। জামবনে ঢোকার পর ঘন ছায়া এসে আমাদের ঢাকল এবং আমরা দাঁড়িয়ে গেলুম।

বিপাশা সব দেখতে দেখতে বলল—এখানে কোথাও একটা বটগাছ ছিল যেন?

—সেটা কবে উপড়ে গিয়েছিল। তোমার জ্যাঠামশাই তার কাঠ বেচে অনেক টাকা পেয়েছিলেন! অবশ্য তোমার বাবার হিস্যেও ছিল।

বিপাশা হাসল।—দায় পড়েছে বাবার! সম্পত্তির লোভ থাকলে গ্রাম ছেড়ে যেতেনই না।

—তা ঠিক। তবে তুমি তখন ছোট ছিলে, জানো না। তোমার জ্যাঠার অত্যাচারেই চলে যান কলকাতা। তোমার মামাই প্ররোচিত করেন, জানতুম। মামা বেঁচে আছেন তো?

—ভীষণ বেঁচে আছেন। এখন তো পাড়ার কাউন্সিলার। রাজনীতির পাণ্ডা। নিউজ পেপারে ওঁর অনেক কীর্তির কথা পেতে পারেন—এখনও।

—খবরের কাগজ কতদিন পড়া হয় না। বনে জঙ্গলে লুকিয়ে বেড়াচ্ছি।

—যাঃ! ফের বাজে কথা।

—সত্যি বিপাশা, আমি খুনী আসামী।

—মেরে ফেলব পারুদা। আপনি করবে মানুষ খুন? ইস! …আচ্ছা পারুদা ফ্লাডের জল এই উঁচু জায়গাটা নিশ্চয় ডোবাতে পারে না?

—না। কেন?

জানেন? আমার হঠাৎ হঠাৎ ভারি ইচ্ছে করত—নদীর ধারে একটা বাংলো মতো বাড়ি থাকলে কী ভালো লাগত! অবশ্যি, ঘাটশীলা আর নেতারহাটে বাবা দুটো কটেজ কিনেছেন।

আমরা মাঝে মাঝে সেখানে গিয়ে থাকি। পাহাড়, পাহাড়, আর পাহাড়! অপূর্ব লাগে! তুমি গেছ কখনও নেতারহাট?

—না।

—এই! আবার তুমি এমন করে তাকাচ্ছ, পারুদা!

—আমাকে ‘তুমি’ বলছ, বিপাশা! সেই ছেলেবেলার মতো!

সে জিভ কাটল। —সরি! স্লিপ অফ টাং!

—তোমার অবচেতনা থেকে তের বছরের বিপাশা উঠে আসতে চেয়েছে। তুমি তাকে বাধা দিও না।

—কই দিচ্ছি?…বিপাশা সোৎসাহে বলে উঠল।—তাই তো এবার পুজোয় বাবার পিছনে লেগে লেগে গাঁয়ে নিয়ে এলুম। জানো, সারারাত ঘুমোইনি। শুধু ভেবেছি, কখন সকাল হবে—কখন নদীর ধারে যাবো!

—আশ্চর্য! তোমাকে সভ্যতা এতটুকু বদলাতে পারে নি!

—না, তা বললে ভুল হবে। পেরেছে বইকি। প্রায় সবটাই পেরেছে। এ একটা জাস্ট কৌতূহল বলতে পারেন। প্রিমিটিভ ব্যাপারগুলোর প্রতি কৌতূহল। সভ্যতা মাঝে মাঝে পিছু ফিরে তাকায়।

ওকে খুব সিরিয়াস মনে হল। বললুম—হুঁ। বলে যাও।

—কৌতূহল কী? শুধু স্মৃতির টানে একবার হাত বুলিয়ে দেখতে আসা —কতটা কী বদলেছে। তার মানে—কতটা এগোতে পেরেছি এবং ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছি।

—কোথায় দাঁড়িয়ে আছ, বিপাশা?

—কে জানে। কিছু বুঝতে পারছি না।

—বিপাশা, তোমাকে আমি ওই গাছটার তলায় এক খরার দুপুরে….

এবার যেন লজ্জায় রাঙা হল না। তবু বাধা দিল।—আমি ভাবিই নি যে আপনি ট্রেচারি করবেন। তা না হলে কি একলা আসতুম? ইস! কি ভয় না পেয়েছিলুম!

—আর কিছু যন্ত্রণাও।

সে মুখ ঘুরিয়ে বলল—হ্যাঁ। প্রথম কুমারীত্বের স্থলন। খুব কেঁদেছিলুম।

—আনলাকি তেরো! নাকি লাকি থারটিন!

—আপনি কী সাংঘাতিক ছেলে না ছিলেন! ভাগ্যিস, পালিয়ে গিয়েছিলুম।

—আবার আপনি বলছ?

—এ্যাঁ? সরি।…..জানেন—সরি, জানো পারুদা, যার হাতে কুমারীত্ব যায়—তামে মেয়েরা সারাজীবন মনে রাখে? না—সে ভাবে নয়, ইন দা সেন্স, যন্ত্রণায়—কতকটা গোপন পাপ কিংবা অসুখের ক্ষতচিহ্ন যেমন।

—তোমার সাথে পাপ করেছি সেই তো আমার পুণ্য!

—কী বললেন, কী বললেন?

—তোমার সাথে পাপ করেছি, সেই তো আমার পুণ্য!

—বাঃ! কার লাইনটা?

—নাম বললে তুমি চিনবে কি? তুমি তো হ্যারাল্ড রবিন্স পড়ো।

—মোটেও না। আমি বাংলা বই পড়ি। পারুদা, তুমি কবিতা লেখনা আর?

—না।…. বিপাশা, আমার ভীষণ লোভ জাগছে।

অন্যমনস্ক ভাবে সে বলল—কিসের?

—তোমাকে এখানে আবার একলা পেয়ে—সাতবছর পরে।

সে হঠাৎ জ্বলে উঠল। মুখ ঘুরিয়ে তীব্র দৃষ্টে তাকাল। বলল—তোমার লজ্জা করবে না? এখন তো তুমি বয়স্ক মানুষ! আমিও। সেন্স এবং রেশপনশিবিলিটি দুজনেরই প্রচণ্ড থাকা উচিত।

—তোমার কাছে আমার লজ্জা নেই। আর দায়িত্বজ্ঞান! আমি নির্বিকার—প্রকৃতির মধ্যে আছি, তাই।

মুখ ঘুরিয়ে নিল সে অন্যদিকে। তার নাসারন্ধ্র কাঁপছিল। ঠোঁটও। দীর্ঘ তিন মিনিট সে চুপ করে থাকল। আমিও, চুপচাপ তাকে লক্ষ্য করলুম—। তারপর বললুম—শুনেছি, মেয়েরা যাকে ভালোবাসে না, তাদের শরীর দিতে পারে না। ভাবে, শরীরই তাদের সব। পুরুষেরা তা কোনদিন ভাবে নি। আজও ভাবে না। অবশ্য মেয়েদের সন্তান ধারণ করতে হয়—সেটাই যা রিস্ক। প্রকৃতির রক্ষাকবচ। তবে আজকাল—প্রকৃতির নিয়মকে ফাঁকি দিতে মানুষ পারে। সভ্যতা মানেই তো তাই।

—তুমি আমার সব সুখ নষ্ট করে দিলে, পারুদা।

—কাঁদছ কেন? এতে কান্নার কি আছে?

—কেন? সেক্স ছাড়া কি আর কিছু পেলে না এখানে?

—তুমি কান্না থামাও, বিপাশা! আমার অসহ্য লাগছে!

—তুমি আজও তেমনি জানোয়ার! ব্রুট! কাওয়ার্ড! যাও, আমি তোমার কাছে থাকব না।

সে পা বাড়াল। আমি তার সামনে দাঁড়ালুম।—যেও না বিপাশা।

—গায়ের জোরে আজ আমাকে পাবে না! সরে দাঁড়াও।

—না।

—আমি চেঁচাব। লোক ডাকব।

—তোমার মুখ চেপে ধরব।

—তুমি এত অভদ্র আর নীচ হয়ে গেছ? ছিঃ!

—বিপাশা! আমি নিজেকে থামাতে পারছি না। কারণ, তুমি আমার ছিলে একদিন—আজ আবার আমার হাতেই এসেছ।

—না, না। আপনি সরুন।

ওর দু কাঁধে হাত রাখলুম। ছাড়বার চেষ্টা করল। পারল না। দৃষ্টি মাটির দিকে রেখে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল—এখনও বলছি, ছেড়ে দিন। বাঁদরামি করবেন না।

তারপর আচমকা আমার গালে চড় মারল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল প্রকৃতিতে একটা তুমুল হইচই পড়ে গেলে। লক্ষ লক্ষ পাখি, প্রজাপতি, ঘাসফড়িং, লাল-পোকা চঞ্চল হল। নীচে নদীর পাড় ভাঙল প্রচণ্ড শব্দে। একটা হাওয়া এসে পড়ল শনশন করে। দূরে মোষের ডাক শুনতে পেলাম—আঁ-ক, আঁক? আমার আদিম অবচেতন শ্রুতির তারে আরও হাজার হাজার শব্দপুঞ্জ প্রতিধবনিত হল। সারা শরীরে চোখ ফুটল। আমার দিকে তাকিয়ে অনেক কিছু টের পেতে পেতে বিপাশা অব্যক্ত বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেল। তারও ঠোঁট কাঁপতে থাকল। আমাকে সে দেখেছিল : একটা ঘনডালপালাওলা হিজল গাছ; পাতায় পাতায় পাখির গু পোকামাকড় আর জড়িয়ে থাকা সবুজ সাপ, খসখসে ধূসর গুঁড়ি—পলির হলুদ দাগে বিকীর্ণ—শিসের মতো চিরোল ফুলে প্রজাপতি উড়ছিল। এই গাছ বছরের পর বছর কোন গূঢ় প্রতীক্ষায় বেঁচে থেকেছে। মাটির তলায় শেকড়বাকড় শেকলের মতো তাকে বেঁধে ফেলেছে—তবু, হায়, বন্য আদিম বৃক্ষ, একটা কিছু ঘটবে বলে দাঁড়িয়ে আছে এবং দাঁড়িয়েই আছে :…

পরস্পর তাকিয়ে ছিলুম কতক্ষণ। তারপর বিপাশা নড়ে উঠল। কোত্থেকে একটা রুমাল বের করে চোখ মুছে বলল—দাদা আসছেন।

ঘুরে দেখলুম, গ্রামের বাঘা জোতদার সাবির আলির সঙ্গে বাঁধের পথে শতদ্রু আসছে। সাবির শতদ্রুর আগে আগে কথা বলতে বলতে আসছে। ওর হাতে একটা বন্দুক। শয়তানটা এই সময়ে মনিবের ছেলেকে শিকারে নিয়ে আসছে। কী করব, ভেবে পেলুম না।

শতদ্রুদাকে আমি শাটলেজদা বলতুম। বয়সে আমার চেয়ে অন্তত আট বছরের বড়। খুব ইচ্ছে করছিল তুমুল চেঁচিয়ে বলি—শাটলেজদা। আমি এখানে আছি। কিন্তু সঙ্গে ওই আপদ।

বিপাশা হাসতে হাসতে বলল—ওকী? লুকোচ্ছ যে আবার?

আশ্চর্য। কত সহজে ও হাসতে পারল। আমি ঠোঁটে আঙুল রেখে বললুম —চুপ। বলোনা যে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে।

একটু তফাতে ঘন ঝোপের আড়ালে গিয়ে দেখতে থাকলুম, কত সহজে মেয়েরা পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে। বিপাশা কোত্থেকে একটা ভিউফাউণ্ডার বের করল। চোখে রেখে ওপারের দূর মাঠে কী দেখতে থাকল। তারপর কথা বলতে বলতে এসে পড়ল লোক দুটি। শতদ্রুদা কী মারাত্মক ভোল ফিরিয়েছে। চেনাই যায় না। চুলে পাক ধরেছে দেখে অবাক হলুম। চমৎকার পোশাক পরেছে। স্বাস্থ্যে সভ্যতার রঙ জ্বলজ্বল করছে। শয়তান জোতদারটাও প্যাণ্ট বুশশার্ট পরেছে। মোটর সাইকেলেই এসেছে নিশ্চয়।

—হুঁ। গাড়ি দেখেই বুঝেছি, দিদি এখানে আছেন।…সাবির বলল।

শতদ্রু বলল—শিকারে যাবি তো চলে আয় বিয়াস!

বিয়াস! আমার দেওয়া নামটা এখনও ওরা চালু রেখেছে। গায়ে কাঁটা দিল।

সাবির বলল—এমন করে একাদোকা আসবেন না দিদি। জায়গাটা ভাল নয়।

বিপাশা কোন জবাব দিল না।

শতদ্রু বলল—সব জঙ্গল খতম দেখছি। ওই জমিগুলো কাদের সাবিরদা?

—আপনারা থাকলে আপনাদেরই হত। এখন আপনার জ্যাঠার—স্বনামে বেনামে। আমারও খানিকটা আছে। তবে ফসল ফলানোর রিস্ক আছে। বাঁধ ভাঙলেই তো গেল। দিদি, আসুন। হরিয়াল মারব দেখবেন।

বিপাশা বলল—না।

শতদ্রু বলল—তাহলে চলে যা। গাড়ি চুরি হয়ে যাবে।

বিপাশা দাঁড়িয়েই থাকল। কথা বলতে বলতে ওরা দুজনে চলে গেল। গাছপালার আড়ালে ওরা অদৃশ্য হলে বেরিয়ে এলুম। —এখনও দাঁড়িয়ে আছ, কেন বিপাশা?

—তোমার লাস্ট সিন যে বাকি।

—হুঁ। কিন্তু আমি মেক আপ মুছে ফেলেছি। পোশাক ফেলে দিয়েছি।

—তুমি কি কোনদিনই স্বাভাবিক হবে না পারুদা?

—আমি ভীষণ স্বাভাবিক। বরং তুমিই অস্বাভাবিক। আমাকে চড় মেরেছ।

—এস, গালে হাত বুলিয়ে দিই।

—থাক, তুমি চলে যাও বিপাশা।

—তুমি কোথায় যাবে?

—অজ্ঞাতবাসে। পরিচয়হীন দুর্গমতায়।

—আবার হেঁয়ালি করছ?

ঠিক এসময় আমাদের পিছনে শুকনো পাতার খসখস শব্দ হল। কার পায়ের চাপে একটা কাঠি ভাঙল। ঘুরে দেখি, একটা কাঠকুড়োনি মেয়ে। সে হাঁ করে তাকিয়ে বিপাশাকে দেখছিল।

বিপাশাও তাকে দেখছিল। মেয়েটি কাছে এসে বলে উঠল—বাবুদিদি, ইখেনে কী করছেন গো?

—দাঁড়িয়ে আছি।

—কার সঙ্গে কথা বলছিলেন যেন?

—এই যে এঁর সঙ্গে। কেন?

—কার সঙ্গে?

—এই তো। পারুদার সঙ্গে

—পারু… মেয়েটির চোখ বড় হয়ে উঠল। পারুবাবু! ও বাবুদিদি, কী বলছেন গো? পারুবাবু যে এই হিজলগাছে গলায় দড়ি দিয়ে মরেছিল! শোনেন নি?

আমি হাসবার চেষ্টা করলুম। পারলুম না। দেখলুম, বিপাশার ঠোঁট কাঁপছে আবার। হিজলগাছটার দিকে তাকিয়ে আছে নিষ্পলক। তার পা দুটো কাঁপছে, তাও দেখলুম। পার্থিব জড়তার বিপুল চাপে ওর চেতনার কালো স্নিগ্ধ নদী আঁটো হয়ে যাচ্ছে।

—হ্যাঁ গো। বিশ্বেস না হয়, জিগ্যেস করবেন। গত বছর এমনি মাসে বাড়ীতে ঝগড়া আর খুনোখুনি করে এসে আত্মহত্যে করেছিল। খুব দেমাকি লোক ছিল যে। বউয়ের সঙ্গে বনত না। দিনরাত অনাছিষ্টি কাণ্ড চলত। শেষ অবধি মনের দুঃখে বউকে খুন করে নিজের প্রাণটা নিলে।…ওকী বাবুদিদি, আপনার কি হল?

হো হো করে হেসে ফেললুম। কিন্তু আশ্চর্য, আমার হাসি আর মানুষের ভাষা পেল না। সে হাসি বাতাস হল। গাছপালা দুলে উঠল। কিছু হলুদ পাতা ঝর ঝর করে খসে পড়ল। নদীতে আবার পাড় ধসল। লক্ষ লক্ষ পোকামাকড় চঞ্চল হল।

আর বিপাশা টলতে টলতে গাছটা আঁকড়ে ধরল। বিড়বিড় করে বলল—আমি জানতুম! আমি জানতুম! তবু ভুল হয়।

—বাবুদিদি, আপনাকে ধরব?

—না। তুমি যাও।

—আপনি শিগগির বাড়ী যান গো!

—যাচ্ছি। তুমি যাও, চলে যাও তো এখান থেকে!

মেয়েটি তবু দাঁড়িয়ে রইল। আর বিপাশা হু হু করে নির্লজ্জের মতো কাঁদতে থাকল। তার কুমারীত্বের স্খলন ঘটেছিল এই বনে। আর সেই ঘটনার নায়কটিকে তার মনে জীবিত রেখেছিল। খুনী যেমন খুনের জায়গায় অনিবার্য অবচেতন টানে ফিরে আসে, আসতেই হয়—তেমনি ও এসেছে—আমিও যেমন এসেছিলুম। কিন্তু, এতক্ষণ পরে ওই কাঠকুড়োনি জংলী মেয়েটা আমাকে আবার মৃতদের চিরকালের অতীতে ঠেলে দিল।

বিপাশার অশ্রু আমি নিলুম সারা গায়ে। আমার ডালপালা আর শিসের মতো ফুল সুখে দুলতে লাগল। আমার শ্বাসপ্রশ্বাসে বিপাশার চুল উড়তে থাকল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *