কল্পনা চাকমার ডায়েরি, চিঠিপত্র ও ছবি
কল্পনা চাকমা অপহরণের বিচারের দাবি : রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও প্রতিরোধ
কল্পনা চাকমা অপহরণের প্রতিক্রিয়া : বিভিন্ন লেখকদের লেখা

আমার স্মৃতিতে কল্পনা চাকমা – প্রদীপন খীসা

আমার স্মৃতিতে কল্পনা চাকমা – প্রদীপন খীসা

১৯৮৭ সাল। কাচালং যাবার প্রবল ইচ্ছা জন্মে। তখন কল্পনা চাকমা’র সাথে কোন পরিচয় হয়নি। সবেমাত্র খাগড়াছড়ি সরকারী কলেজে পড়াশুনা করছি। আমরা ক’জন সহপাঠী বন্ধু-বান্ধবী নিয়ে নিয়মিত আড্ডা জমাতাম। কলেজ প্রাঙ্গনের দক্ষিণে জামগাছের নিচে নতুবা পশ্চিম দিকের কড়ই বা ফুলচোমরী গাছের নিচে। প্রতিদিন আড্ডা জমতো। আড্ডায় অনেক হালকা চতুর কথাবার্তা গল্প-কাহিনী ছাড়াও থাকতো পার্বত্য চট্টগ্রাম গণ- মানুষের সুখ-দুঃখের কথা। এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যত জীবনের কথা নিয়ে ভাবতাম আমরা সকলেই। ভাবতাম ১৯৮৬ সালে বিভিন্ন গণহত্যায় যারা সবস্ব হারিয়েছে। ঘরবাড়ি হারা- ভিটেমাটি ছাড়া আত্মীয়-স্বজনহারা শত হাজারো জুম্ম সর্বত্র। সেই বছরই সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে হাজার হাজার জুম্ম আশ্রয় নিয়েছে। শুরু হলো জুম্মদের শরণার্থী জীবন আর অনিশ্চিত ভবিষ্যত। অন্ধকার জীবন অসহায় করুণ কাহিনী নিয়ে তখন কারো মাথাব্যথা নেই। মানুষ মানুষের উপর নৃসংশতা চালায়। খুন, হত্যা, গুম, ধর্ষণ, অপহরণ, লুটপাট করে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। হাজারো জুম্ম গ্রাম পুড়ে শ্মশান। এসব করেছে কারা? যারা রক্ষক তারাই ভক্ষক। তার মানে— দেশেরই সেনাবাহিনী, পুলিশ, বি.ডি.আর এবং ভি.ডি.পি রাই করেছে। তাদের সাথে যোগ দেয় সেটেলার বাঙালীরা। এরা পার্বত্য চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশ করেছে। তা বেশি দিনের কথা নয়। তবুও তারা…। আড্ডায় কলেজে পড়তে আসা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় বেশ ক’জন সহপাঠী বন্ধু-বান্ধবী রীতিমত যোগ দিত। তাদের মধ্যে ২/৩ জন বন্ধু কাচালং-মারিশ্যা এলাকার। তাদের নিকট জানলাম কাচালং-রিজার্ভ ফরেস্টের কথা। বাঘ-ভাল্লুক-বন্যহাতি বিচিত্র রকম পশু-পাখি’র কথা। রির্জাভ ফরেস্ট হতে বাঁশ-কাঠ-বেত ইত্যাদি বনজ সম্পদ আহরণ ও বনজ সম্পদ অপব্যবহারের কথা। আরো জানলাম সেই পাহাড়ি এলাকার সহজ-সরল মানুষের জীবন- জীবিকার কাহিনী। কাচালং-এর প্রকৃতির বৈচিত্রের সবুজ শ্যামল রূপের কাহিনী।

তখন থেকেই কাচালং-মারিশ্যায় ঘুড়ে বেড়ানোর প্রবল ইচ্ছা হয় আমার। কিন্তু অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে সর্বত্র আর্মিদের অপারেশন ধরপাকড়, বিনা কারণে রামধোলাই, অন্ধকার গর্তে বন্দী, কারেন্টের শক, মরিচের পানি ইত্যাদির কথা ভেবে কোথাও যাওয়া হয় না। আজ মনে পড়ছে ১৯৮৫ সালের কথা। সেই এক অবর্ণনীয় ঘটনা। স্বৈরাচারী এরশাদের শাসনামল। দিনটি ছিল প্রথম উপজেলা নির্বাচন। খুব ভোরে আর্মিরা একই টাইমে ৪/৫ টি জুম্ম গ্রাম ঘিরে ফেলে। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাইকে ১ নং যৌথ খামারের অফিসের সামনে জড়ো করে। দু’দিন ভাইরাসের জ্বর আর ডায়রিয়ায় ভুগে কেবল সেদিনই একটু সুস্থ ছিলাম। জোর করে আমাকেও আর্মিরা নিয়ে যায়।

জনৈক মেজরের নির্দেশে আর্মিরা জড়ো করা লোকজনকে দু’ভাগ করে। একভাগে ছেলে আর অন্যভাগে মেয়েদের। ২০-৩০ জন সেনা জোয়ানরা একসাথে ১৫-২০ জন নিরীহ জুম্মকে নির্মম ভাবে শারীরিক নির্যাতন চালাতে শুরু করে। কাটাযুক্ত ফুলচোমরী গাছের কচি ডাল (শক্ত গাছের লাঠি) দিয়ে চলছে বেদম প্রহার। অসুখের কথা বলেও সেই দিন আমি রেহাই পাইনি। আমার মত সেইদিন নির্যাতনের শিকার হয় ২০০ জনের অধিক। অনেকে জ্ঞান হারায় আর্মিদের নির্মম নির্যাতনে। আমিও ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়ি। বিকেল ৪টার দিকে আমরা সবাই ছাড়া পেলাম। ছাড়া পেয়ে প্রায় ৩/৪ কিলোমিটার পথ হেঁটে এলাম। অনেক কষ্টে কোন রকম গ্রামে এসে পৌঁছলাম। হঠাৎ মাথা গরম হয়ে উঠলো, চোখ বুজে এল। আমি কখন জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম জানি না। জ্ঞান যখন ফিরলো তখন আমি ঘরের ভিতর বিছানায়। ডাক্তার লোকজনের ভীড়। অনেক কষ্টে চোখ মেলে দেখি দু’টি সেলাইন ঝুলানো। একটা শেষ আর একটা অর্ধেক হয়েছে। সেইদিনের ঘটনা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এবং গা হিম হয়ে আসে। সেই থেকে প্রায় সময় আর্মিদের নির্যাতনের ব্যথা-বেদনা বৃদ্ধি পায়। জ্বর হলে তো যন্ত্রণার সীমা থাকে না।

এমনি কঠিন-জটিল পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। স্কুল-কলেজে গড়ে তোলা হয় সংগঠন। তখনই দায়িত্ব পড়ে নারীদের সংগঠিত করে সংগঠন করার। মূলত তিন জনের ওপর দায়িত্ব পড়ে তখন। অন্য দু’জন অনেক আগেই চাকুরী ঘর-বাড়ি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তেমন কোন ভূমিকা তারা রাখতে পারেনি। যদিও অনেক কাজ করেছে। অবশ্য অন্য অনেক বন্ধু-সহযোগিতা দিয়েছে তখন।

১৯৮৮ সাল ৮ই মার্চ। অনেক চেষ্টায় দাঁড় করানো হল উপজাতীয় নারী কল্যাণ সংস্থা। নারীদের মধ্যে বেশ উৎসাহ প্রেরণা দেখা গেল। তখনই নারীদের সমস্যা নিয়ে নিয়মিত আড্ডা জমতো। অর্থনৈতিক সমস্যাই নারীদের-কে বেশী দুর্বল করে রাখতো। অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হবার নানা চেষ্টাও করা হলো। সমাজ কল্যাণ, উপজেলা চেয়ারম্যান, থানা নির্বাহী কর্মকর্তা মহিলা অধিদপ্তরের সাহায্য-সহযোগিতা চাওয়া হলো। কেউ কোন সাহায্য-সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসলো না। অনেক চেষ্টা করেও মহিলা অধিদপ্তরে উপজাতীয় নারী কল্যাণ সংস্থাকে রেজিষ্টারভুক্ত করা গেল না। এমনি করে চলতে লাগলো দু’এক বছর।

১৯৮৯ সাল। সেই এক কাণ্ড! জুম্মদের নিয়ে চলতো দিনরাত সমাবেশ। যেন যাত্রামঞ্চ। নায়ক, অভিনেতা, ভিলেন যাই বলুন সেই একক চরিত্রে খাগড়াছড়ির ব্রিগেড কমান্ডার সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম। তখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় সামরিক প্রধান জেনারেল হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ। এই দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী। তার মানে-রাষ্ট্রপতি। তার আমলে জনসংহতি সমিতি ও সেনাবাহিনীর মধ্যে বহুবার বৈঠক হয়। উভয় পক্ষ কোন ঐক্যমতে আসতে পারল না। সরকার একতরফা ভাবে নয় দফা রূপরেখা তৈরি করল। জনসংহতি সমিতির ৫ দফার বিপরীতে কিছু জুম্মো দালাল নিয়ে সরকার নয় দফা ভিত্তিতে চুক্তি করল। দেশে-বিদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান হয়েছে বলে ব্যাপক প্রচার করা হল। ‘৮৯ সালের মাঝামাঝিতে ভোটার বিহীন নির্বাচন হল। দেশে-বিদেশে ডাক-ঢোল পেটানো হল। যেন পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ মহাসুখে আছে। তাদের আর কোন সমস্যা নেই, নেই কোন অভাব অভিযোগ। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মরা কোন স্বর্গরাজ্যে আছে। অন্য দিকে জনসংহতি সমিতিও ৯ দফা তথা জেলাপরিষদ প্রত্যাখান করল। শান্তিবাহিনী ঘোষণা দিলো নির্বাচন বানচাল করবে। সর্বাত্মক সশস্ত্র তৎপরতা চালালো। কিছুই করতে পারল না। তারা কেবল হাজার হাজার জুম্মোকে ভারতের ত্রিপুরায় শরনার্থী করতে সক্ষম হল। ১৯৮৬ সালে আশ্রিত হাজার হাজার শরনার্থীর সাথে তারাও যোগ হল। ৬০-৭০ হাজার মানুষের জীবন ভবিষ্যত অন্ধকার-অনিশ্চিত হয়ে গেল। পঙ্গু হয়ে গেল জুম্মদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড। আর জনসংহতি সমিতি হারাল গণভিত্তি। পড়ে গেল বড় বেকায়দায়।

১৯৯০ সাল। স্বৈরাচারী এরশাদের পতন হল উত্তাল ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় এল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তখন কিছুটা সংগঠন করার অধিকার এবং গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছিল। ঠিক সেই সময়ে উপজাতীয় নারী কল্যাণ সংস্থা’র নাম পরিবর্তন করে হিল উইমেন্স ফেডারেশন করা হল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন এর উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ছিল সূদুরপ্রসারী। অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক কোন কাজেই সহযোগিতা পাওয়া গেল না। সরকারি ও বেসরকারি কোন মহল বা সংস্থা এগিয়ে এল না। তারপর হিল উইমেন্স ফেডারেশনের বেশ কিছু নেত্রী ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত পুরো সংগঠনই রাজনীতিতে জড়িয়ে যায় এবং বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে থাকে।

‘৯০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে সদরে আসে। তার আগে তারা ভারতের শরনার্থী শিবির সফর করে। কমিশন পার্বত্য জেলার খাগড়াছড়ি সফরে আসলে তখন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের পাশাপাশি ফেডারেশনের ভূমিকাও ছিল অত্যন্ত জোরালো। তারা কমিশনকে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে জানতে ও তথ্য সংগ্রহ করতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। তার পর ৯০-৯৬ সাল ছিল উত্তাল ছাত্র আন্দোলন। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিটি প্রোগ্রাম পাহাড়ী গণ পরিষদ, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন-এ তিন সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে হতো।

১৯৯৩ সাল। পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের দায়িত্বের সুবাদে কাচালং সফরের দায়িত্ব পড়ল। কাচালং কলেজ মাঠে ছাত্র পরিষদের ডাকে বিশাল ছাত্র-গণসমাবেশ হবে। তিন সংগঠনের ৬ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নিয়ে একটি টিম হল। টিমে কবিতা চাকমা (তখন জেলা কমিটির নেত্রী) নাম ছাড়া অন্য কারোর নাম আজ মনে পড়ছে না। সে দিনের তারিখ আজ মনে নেই। সকালে রক্তিম সূর্য চারদিক জ্বলমলে হয়ে উঠল। আমরা কাচালং যাবার জন্য প্রস্তুত হলাম। স্বনির্ভর হতে রিক্সায় চেপে শাপলা চত্বরে গেলাম। গাড়ির টিকেট নিলাম। যথা সময়ে চাঁদের গাড়ি (জিপ) ছাড়লো। গাড়ির চাকা খুব দ্রুত গতিতে ঘুরছে। প্রায় সময় রাস্তায় দাঁড়াতে হচ্ছে। রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে আর্মিরা বার বার চেক করছে। খুবই বিরক্তিকর কিন্তু করার কিছুই নেই। নেই বলার মত কোন কথাও। তার কারণ কিছু বললে সোজা সেনাক্যাম্পে নিয়ে যাবে। চালাবে নির্যাতন। তারপর শান্তিবাহিনীর মামলায় ঢুকাবে অন্ধকার মাটির গর্তে। সেখানেই খাওয়া-দাওয়া মল-মূত্র ত্যাগ আর ঘুমানো। গর্তের নীচেই থাকে হাটু পানি নতুবা কাঁদা আর বড় বড় জোঁক এসব থেকে বাঁচতে সবাই নীরব থাকে। কেউ কোন টু শব্দটি করে না। দিনের সূর্য মাথার উপর। বেশ গরম পড়েছে। তখন দিঘীনালা সদর থানা স্টেশন পেরিয়ে বাঘাইহাটের পথে যাচ্ছি। দিঘীনালা স্টেশনের আগে জামতলীতে দু’একটি সেটেলার বাঙালীর গুচ্ছগ্রাম দেখলাম। স্টেশনের একটু পরে রাস্তার দু’পাশে সেটেলার বাঙালীদের অগণিত বসতবাড়ি। তাছাড়া বড় বড় গুচ্ছগ্রাম। চলন্ত গাড়ী হতে সবই দেখলাম। সফর সঙ্গী এক বন্ধু বলল এরা আগে ছিল না। ৩/৪ বছর হলো বসতি করেছে। ১৯৮৬ সালে জুম্মদের উচ্ছেদ করে এরা আর্মিদের সহায়তায় জুম্মদের ঘর-বাড়ি-গ্রাম পুড়িয়ে দেয় এবং গণহত্যা চালায়। জুম্মরা বাধ্য হয়ে পালিয়ে গহীন অরণ্যে আশ্রয় নেয়। অবশেষে আশ্রয় নেয় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে।

জুম্মদের শুরু হয় মানবেতর জীবন যাপন। আর এদিকে তাদের জমি-জমা বেদখল করে সেটেলার বাঙালীরা। গড়ে তুলেছে গ্রামের পর গ্রাম। সবুজ-শ্যামল শস্য ক্ষেত নিয়ে তারা স্বর্গসুখেই আছে। যেন তাদের ভাগ্যে স্বর্গসুখ আর জুম্মদের ভাগ্যে নরক যন্ত্রণা। পাহাড়ের দুর্গম আঁকাবাকা পথ বেয়ে চাঁদের গাড়ি বড় বড় মোড় পেরিয়ে যাচ্ছে। গাড়ি প্রায় বাঘাইহাট বাজারের কাছে পৌঁছে গেল। থামল আর্মি চেকপোস্টের সামনে। চাইনিজ রাইফেল হাতে নিয়ে ২ জন সেনা জোয়ান গাড়ির কাছে এল। তন্ন তন্ন করে চেক করল। অন্য একজন সেনা জোয়ান গোল ঘরে বসেই খাতায় লিখে নিচ্ছে গাড়ির নম্বর, ড্রাইভারের নাম, গাড়ি স্টপের নাম, গাড়িতে যাত্রীর সংখ্যা, গাড়িতে কি মালামাল আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। চেক্ করতে সময় লাগলো প্রায় আধা ঘণ্টা। চেক্ শেষে সবাই গাড়িতে উঠে পড়লাম। ৩/৪ মিনিট পরই বাঘাইহাট বাজার স্টেশনে পৌঁছলাম। তার পাশেই বাঘাইহাট বাজার। ফরেস্ট অফিস, কে.পি.এম. ও বি.এফ.আই. ডি. সি, ডেপু স্টেশন। তার পাশেই উঁচু পাহাড়ে আর্মিদের জোন অফিস। ক্রেন দিয়ে বড় বড় গাছ ট্রাকে বোঝাই হচ্ছে। এক টুকরা গাছ এক ট্রাক। ২/১ জন লোকে আমাদের জানালো একটা গাছ ১০-২০ ট্রাক হয় তাছাড়া গাছের গোড়ায় থাকে ৩০/৪০ ফুট। কারণ গাছ কাটা হয় ‘সার” (মাচাং) বেঁধে। যা মাটি হতে ১৫-২০ ফুট উঁচুতে। আমরা ধরে নিলাম হয়ত তাই হবে। আগেও শুনেছি সেই কথা।

বাজারে বসে হাল্‌কা নাস্তা ছেড়ে নিলাম। সামান্য কেনা-কাটাও হলো। আগে থেকেই প্রোগ্রাম ছিল। ক’জন কর্মীবন্ধু আমাদের জন্য টেম্পো (কান্ট্রিবোট) নিয়ে অপেক্ষা করছে। আমরা সবাই টেম্পোতে উঠে পড়লাম। কাচালং নদীর বুক চিড়ে রূপালী পানির স্রোতে টেম্পো তীব্র গতিতে চলতে শুরু করলো। কিছুপরেই বাঘাইহাট বাজার। কাচালং নদীর আঁকেবাঁকে হারিয়ে গেল। নদীর দু’পারে ঘন সবুজ বন। মাঝে মধ্যে বড় গাছ দাঁড়িয়ে আছে। সবাই কৌতূহলি মন নিয়ে চারদিকে চোখ বোলাতে বোলাতে করেঙ্গাতলী বাজারের ঘাটে পৌঁছলাম। ঘাটেই আর্মিদের চেকপোস্ট। ক’জন সেনাজোয়ান বসে আছে। যদিও তাদের চাহনি বেশ কড়া আর রক্তচক্ষু। কিন্তু আমরা বেশ নির্ভীক ছিলাম।

[ছাপার অস্পষ্টতার জন্য এই প্যারাগ্রাফটি প্রুফরীড করা সম্ভব হয় নি : সবাই বাজারে গিয়ে উঠলাম। হালকা নাস্তা করা আর পড়লাম। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। নীল আকাশ আৰু উotien হল আবার যাত্রা। হঠাৎ চোখে পড়ল কাচালং নদীর উপর লম্বা ইा করার সেরা বুঝা গেল বেইলী ব্রীজ। বেশ লম্বা ও উঁচুতে। তার একটু পরের বাঘাইছড়ি উপজেলার অফিস-আদালত। দেখতে দেখতে রাজের নীচ উপরে উ ঘাটে পৌঁছে টেম্পো থামল। ঘাটে পরিচিত অনেকেই আমাদের জন্য অপেন করার চেনা-অচেনা সবার সাথে হাত মেলানো শেষ। উপরে উঠতেই দেখা গেল উন ম আর অফিস। তার উত্তরে কিছু দোকান পাট আর বসতবাড়ী। প্রতিভাবা সেই ি এগিয়ে নিল। একটি ছোট্ট চা-দোকানে আমরা সবাই বসলাম। দোকানে বসা বান্ধ ক’জনের সাথে সৌজন্য আলাপ হল। তাদের মধ্যে বেশ ক’জন বাঙালির আছে। এরার ডিপি হয়ে এসেছে। কাপ্তাই বাঁধের ফলে তারাও উদ্বাস্তু। কাচালং, মাইনী ও চেঙ্গা উপত্যকায় ৯০% ভাগ মানুষ কাপ্তাই বাঁধে উদ্বাস্তু হয়ে এসেছে। সবার কাছে এরা ডিপি নামে পরিচিত।]

আমরা সবাই জীবংগছড়ায় পৌঁছলাম। সন্ধ্যার দিকে যে বাড়িতে উঠলাম, সে বাড়ির একজন হচ্ছেন আমাদের এলাকার। তার সাথেও দেখা হল। রাত্রে কাচালং কলেজের প্রভাষক মি. দেবপ্রসাদ চাকমা ও কাচালং বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা মিসে গৈরিকা চাকমার সাথে সাক্ষাত আলাপ হল। পূর্বে তাদের সাথে পরিচয় ছিল। তারা দু’জনেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। তখন তারা প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। সেই সূত্র ধরে অনেক আলাপ হল। তারাও সেইদিন কল্পনা চাকমা’র কথা উল্লেখ করেছেন।

পরের দিন সকালে কলেজ মাঠের দিকে রওনা হলাম। আমাদের সাথে ৫০/৬০ জন ছেলে-মেয়ে হাঁটছে। সবাই ছাত্র পরিষদের সক্রিয় কর্মী-নেতা। রাস্তায় জন্মদের ঢল নেমেছে। সবাই দল বেঁধে সমাবেশে যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে কলেজ মাঠে পৌঁছলাম। তখন বিশাল মাঠের অর্ধেক এলাকা জুড়ে লোকজন বসে আছে। আরো দলে দলে মিছিল- ব্যানার-প্লেকার্ড এবং শ্লোগান সহকারে সমাবেশে লোকজন আসতে লাগল। ড্রেসসহ বিভিন্ন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরাও বজ্রকণ্ঠে গগন বিদারী শ্লোগান ধরে ব্যানার ও প্লেকার্ড নিয়ে সমাবেশে যোগ দিচ্ছে।

সকাল এগারোটার দিকে সমাবেশ শুরু হল। বেশ কড়া রোদ। কলেজ মাঠে তখন কম করে হলেও ১০/১২ হাজার মানুষ বসে পড়েছে। সবাই অধীর আগ্রহে বসে আছে। সুমিতা চাকমার উপস্থাপনায় পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ী গণপরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন এর কেন্দ্রীয় এবং বিভিন্ন শাখার নেতৃবৃন্দ একে একে বক্তব্য রাখল. সবার বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার একমাত্র সমাধান স্বায়ত্বশাসন কথাটিই বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত হল। সমবেত জনতা সংগ্রামী প্রেরণা নিয়ে ঘরে ফিরল।

সেই দিন বিকেলে আবার মতবিনিময় বৈঠকে এলাকার বিভিন্ন গ্রামের মু্রব্বী, ___, হেডম্যান, শিক্ষক ও জনপ্রতিনিধিরা খোলামেলা বক্তব্য রাখেন। আন্দোলন, সংগ্রাম দাবী- দাওয়া এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। বৈঠকে উপস্থিত সবাই সর্বাত্মক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেন। সমাবেশের পরের দিনই জীবংগছড়া বৌদ্ধ বিহারে সংগঠনের কর্মী সম্মেলন ছিল। স্কুল-কলেজ ও বিভিন্ন শাখা-কমিটি’র নেতা- কর্মীরাও সম্মেলনে যোগ দেয়। তারপর আলাদা ভাবে স্কুল-কলেজের ছাত্রী ও মেয়েদের সাথে বৈঠক হল। সেদিন কবিতা চাকমা হিল উইমেন্স ফেডারেশন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং আমিও সংগঠনের সংগ্রাম এবং নারী অধিকার নিয়ে বক্তব্য তুলে ধরলাম। উপস্থিত সকলেই অত্যন্ত প্রাণোজ্জ্বল ভাষায় মতামত রাখল এবং দৃঢ়তার সাথে কাজ চালাতে তারা হিল উইমেন্স ফেডারেশনের শাখা কমিটি গঠনের দাবী করল।

সেই দিনের বৈঠকে কল্পনা চাকমা অত্যন্ত দৃঢ় সাহসিকতা পূর্ণ সংগ্রামী বক্তব্য ও তার মতামত তুলে ধরল। তার বক্তব্যে জাতিগত বৈষম্য, নির্যাতন, আর্মি-পুলিশের অপতৎপরতা এলাকার গণ-মানুষের সুখ-দুঃখের কথা সমাজে ও রাষ্ট্রীয়ভাবে নারীরা লাঞ্চিত-বঞ্চিত এবং অবহেলিত হবার কথা অত্যন্ত সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় তুলে ধরে। সফরকারী টিমের মধ্যে সবাই কল্পনা চাকমাকে সম্ভাবনাময়ী প্রতিশ্রুতিশীল সংগ্রামী বন্ধু হিসেবে বেছে নিল।

সেদিন উপস্থিত সকলেই হিল উইমেন্স ফেডারেশনের আন্দোলনকে সময়ের দাবী বলে অভিহিত করে। কল্পনা চাকমাসহ অন্যান্যদের আগ্রহ এবং দাবী হল বাঘাইছড়ি থানায় ফেডারেশনের শাখা কমিটি গঠন করা। তাদের প্রেরণা উৎসাহ দেখে সেদিনই একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হল। সবাই আহ্বায়ক হিসেবে কল্পনা চাকমা-কে নির্বাচিত করল। সেই থেকে কল্পনা চাকমার সাথে পরিচয় এবং নিয়মিত যোগাযোগ হতো। সে নিজের কথা, এলাকার কথা এবং সংগঠনের কথা সুন্দরভাবে লিখত। আমিও তাকে প্রায়সময় বিভিন্ন ঘটনাবলী বিস্তারিত লিখে জানাতাম। সংগঠনের কর্মসূচিসহ সমাজ, জাতি, দেশ ও রাজনীতি নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নিয়ে লেখালেখি হতো। কল্পনা অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে সংগঠনের কাজ চালাত। এবং সংগঠনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করত। তাকে সহযোগিতা করত— জ্যোৎস্না, মিতা, চম্পা। এরা তিন বোন। কল্পনা সহ তারা একই গ্রামের। তাদের গ্রামের নাম নিউলাল্যাঘোনা। নিউলাল্যা নামে এক লোকের নামেই তাদের গ্রামের নামকরণ। অন্য এলাকায় যারা তাকে সহযোগিতা করত তারা হল- -লিপি, সুমিতা, জীতা, রূপ্তা, রেনিকা আরো অনেকে। সেই সময়ে তারাও অনেক অনেক ভূমিকা রেখেছে। কল্পনার নেতৃত্বে কলেজসহ বাঘাইছড়ি থানায় সকল স্কুলে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের শাখা কমিটি গড়ে উঠে। তার সহযোগিতায় বিভিন্ন এলাকায় এবং স্কুলগুলিতে ছাত্র পরিষদের শাখা কমিটি গড়ে উঠে। সংগ্রামী ভূমিকায় কল্পনা সবসময় প্রথম সারিতে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ী গণপরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় প্রোগ্রাম হলেই কল্পনা তার সহযোদ্ধাদের নিটে ছুটে আসত। প্রায়সময় দেখা যেতো। প্রতিটি প্রোগ্রামে সে দৃপ্ত কণ্ঠে প্রাণোজ্জ্বল ভাষায় সুন্দর বক্তব্য রাখত। সমাজের ও রাষ্ট্রের রক্ষণশীল ও রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নারীদের দাসত্ব শৃঙ্খল ভাঙ্গতে কল্পনা আহ্বান করত নারী সমাজকে। জুম্মদের উপর নির্যাতন, ধর্ষণ, জেল, ভূমি বেদখ, গুমহত্যা ___ এবং অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ছাত্র-জনতাকে উদ্ধাত্ত আহ্বান করত। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও শত্রুর মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহসী প্রেরণা যোগাত।

১৯৯৫ সাল। খাগড়াছড়িতে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের প্রথম কেন্দ্রীয় সম্মেলন হয়। এতে সে বড় দলবল নিয়ে সম্মেলনে যোগ দেয়। তারপর যোগ দেয় ২০শে মে ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে। ১৯৯৫ সালে ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সম্মেলন হয়। খাগড়াছড়িতে এই সম্মেলনে তার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং চমৎকার ছিল সংগ্রামের দাবিনামার মূলমন্ত্র, গঠনতন্ত্র সংশোধন ও সংযোজনে তার প্রস্তাবনা আলোচনা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সবার নিকট বেশ গ্রহণীয় এবং প্রশংসনীয় ছিল। তার ভূমিকায় সে সময় ফেডারেশনের কার্যক্রম বেশ শক্তিশালী হয়। সংগঠনের বিভিন্ন প্রোগ্রামে কল্পনার সাথে প্রায় দেখা-সাক্ষাত হতো। সাংগঠনিক কাজে প্রায় সময় দেখা হতো। যতবারই দেখা হয়েছে ততবারই তার অগ্রণী ভূমিকা দেখতে পেয়েছি। বাঘাইছড়ির প্রতিটি অনুষ্ঠানে সংগ্রামী নেত্রী কল্পনা চাকমার ভূমিকা ছিল অপরিসীম।

আজ সাল, তারিখ, সময় কোনটিই মনে নেই। ছাত্র পরিবদের সম্মেলন ও কাউন্সিল হয়েছে। সমাবেশটা হয়েছে বাঘাইছড়ি উপজেলা মাঠে। সমাবেশের শেষে কল্পনা ও জ্যোৎস্নাকে বললাম আজ তোমাদের গ্রামে যাওয়া হবে। হয়ত তারা বিশ্বাস করেনি আমরা সত্যি সত্যি তাদের গ্রামে যাব। তাদের গ্রামে গিয়ে কেউ গোটা বিকেল-সন্ধ্যা বেশ আড্ডা জমল। অনেক বিষয় আড্ডায় স্থান পেয়েছে সেইদিন তাদের সাথে পুরে গ্রাম ঘুরলাম। অনেকের সাথে পরিচয় হলো। সেদিন যাদের সাথে পরিচয় হয়েছে তারা আজ সবাই আছে। যে তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে সে আজ নেই। সেই সংগ্রামী নেত্রী কল্পনা চাকমা আজ নেই। আজ কোথায়? তার যোগ কেউ নিতে পারে না। শত চেষ্টা করেও তার খোঁজ পাওয়া যায়নি আজও।

১৯৯৫ সাল। খাগড়াছড়ি ব্রিগেডের সৃষ্ট মুখোশ বাহিনীর অপতৎপরতায় খাগড়াছড়ি লোকজন ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত। মুলত সন্তু লারমার অনুরোধে আর্মিরা এই মুখোশ বাহিনী গঠন করে। সমাজে যারা চোর-ডাকাত-বদমাইস, কুলাঙ্গার ও অধঃপতিত তাদের নিয়ে এই মুখোশ বাহিনী গঠন করে। এদের কাজ হল পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ী গণ পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেতা-কর্মীদের অপহরণ মারধর করে পুলিশে দেয়া। আর্মি ও পুলিশ বাহিনী মুখোশদের সকল প্রকার সাহায্য করতো। এমনকি স্কট দিয়ে বিভিন্ন থানায় নিয়ে মিছিল-মিটিং ও সমাবেশ করাতো। মুখোশদের পরিচালনার দায়িত্বে ছিল খাগড়াছড়ি ব্রিগেডের G-2 মেজর মেহবুব। সন্ত্রাসী মুখোশদের বিরুদ্ধে অনেক প্রোগ্রাম দিতে হয়। গ্রামে-গঞ্জে গড়ে উঠে প্রতিরোধ। একদিন পাহাড়ী গণপরিষদের নেতা বিম্বিসার খীসাকে মুখোশরা অপহরণ করে। তারপর তাৎক্ষণিক সড়ক অবরোধ শুরু হয়। তারই প্রেক্ষিতে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মোঃ ইসমাইল আইন শৃঙ্খলার বৈঠক ডাকে। সংগঠনের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করে জানিয়ে দেয়া হয় গণ পরিষদের নেতা বিম্বিসারকে মুক্তি দিতে হবে তারপর সড়ক অবরোধ প্রত্যাহার করা হবে। জেলা প্রশাসনের বাস ভবনে রাত ৯.০০ টায় মুখোশরা বিম্বিসারকে পৌঁছে দিয়ে যায়। তখন এস.পি ও ব্রিগেডের G-2 মেজর মেহবুব ছিলেন। এতে আরো পরিষ্কার হলো মুখোশদের চাবিকাঠি সবই মেজর মেহবুব-এর হাতে। সরকারি রাষ্ট্রযন্ত্র ও মুখোশদের প্রত্যক্ষ সাহায্যকারী। মুখোশরা ছাত্র গণ-পরিষদের শত শত নেতা-কর্মীকে অপহরণ করেছে, মারবোধ করেছে এবং মিথ্যা মামলা সাজিয়ে থানা পুলিশে দিয়েছে। তাদের সন্ত্রাসী অপতৎপরতা প্রতিরোধ করতে গিয়ে স্বনির্ভর এলাকায় পুলিশের গুলিতে অমর বিকাশ চাকমা (১৭) প্রাণ হারায়। পুলিশ সেদিন হাজার হাজার জনতার উপর বেপরোয়া ভাবে গুলি চালায় সন্ত্রাসী মুখোশদের রক্ষা করতে। সন্ত্রাসী মুখোশরা পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম পাঠাগার হুয়াঙ বোই-ও বা’র ভাঙচুর করে লক্ষাধিক জিনিষপত্র ও দুর্লভ বইপত্র নিয়ে যায়। তারা সবকিছু খাগড়াছড়ি ব্রিগেডের G-2 মেজর মেহবুব কে জমা দেয়। এলাকায় চরম অরাজকতা ও সন্ত্রাসী তৎপরতায় জনজীবন হলো অচল। গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নিকট স্মারকলিপি দেন। তারাও সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতা বন্ধের জন্য প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টি করেন। কিন্তু তেমন কোন ফল পাওয়া যায় না। এলাকার মানুষ অসহায় এবং চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে।

একদিন বড় সমাবেশ ডাকা হল। মুখোশদের বিরুদ্ধে। ঢাকা-চট্টগ্রাম হতেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং সাংবাদিক বুদ্ধিজীবি সমাবেশে যোগ দিয়েছে। পুলিশ-সেনা বাহিনী সমাবেশ বানচাল করতে নানা ষড়যন্ত্র চালায়। সমাবেশে আগত লোকজন ও গাড়ী ফিরিয়ে দেয়। পৌর এলাকায় যাতে লোক জমায়েত হতে না পারে সে চেষ্টা চালায় পুলিশ ও সেনাবাহিনী। তারপরও ৫-৬ হাজার লোক জড়ো হয়েছে। এ সমাবেশে কাচালং হতে কয়েকশত লোক যোগ দেয়। তাদের মধ্যে সংগ্রামী নেত্রী কল্পনা এবং জ্যোৎস্নাও এসে হাজির। অন্যকোন এলাকা থেকে কোন মেয়ে বা ফেডারেশনের কোন নেত্রী আসেনি। সে দিন কল্পনাও মিছিলে যেতে চেয়েছে বার বার। তাকে সরকারি ষড়যন্ত্র, সেনা-পুলিশের মতলবসহ ইত্যাদি বুঝিয়ে বলি। তারপর বুঝতে পারে কোন পরিস্থিতিতে কি অবস্থায় মিছিল হচ্ছে। তখনই সে মিছিলে যাবার ইচ্ছা বাতিল করে। সে দিনই তার দৃঢ়তা-সাহসিকতা কতটুকু, তা জানলাম। তার এমন দৃঢ়তা-সাহসিকতা সত্যিই অন্যদের বেশ সাহসী করবে, করেছেও। তারপর ২০ শে ‘৯৬ সাল। ঢাকায় ছাত্র পরিষদের ৭ম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী হল। বাঘাইছড়িসহ গোটা খাগড়াছড়ির সংগঠনের নেতা-কর্মীদের নিয়ে ১০টি কোস্টার একসাথে ঢাকায় রওনা হয়। সেদিন একই গাড়িতে ঢাকা গেলাম। আর সম্মেলন শেষে একই গাড়িতে করে ফিরলাম। সে কিছুদিন খাগড়াছড়িতে থাকল। তারপর বাড়িতে ফিরল। এটাই তার সাথে আমার শেষ দেখা। এটাই তার শেষ সফর কিম্বা খাগড়াছড়িতে আসা কেউ জানে না। জানেনা রাজনৈতিক অঙ্গনে সেই দিনই তার শেষ ভূমিকা। কেউ ভাবেনি হঠাৎ কল্পনা চাকমা হারিয়ে যাবে। কিন্তু তাই হয়েছে। তার মৃত্যু হয়নি, অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে যা হয় তাই হয়েছে।

১৯৯৬ সাল। ১২ জুন জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। নির্বাচনের প্রাক্কালে ১১ ই জুন মধ্যরাতের পর লেপ্টেনেন্ট ফেরদৌস তার দল-বল নিয়ে কল্পনা চাকমাকে অপরহণ করে। খুন করতে চায় তার আপন দু’ভাইকেও। সেই থেকে কল্পনা চাকমা আজো নিখোঁজ। এলাকার সাংসদ দীপংকর তালুকদার এবং তার দলীয় সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফিরিয়ে দিতে পারেনি নেত্রী কল্পনা চাকমাকে। অপহরণ ঘটনার তদন্ত হল। তার রিপোর্ট প্রকাশ করা হল না। এই সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকাশ করতে ব্যর্থ হল। বিরোধী দলীয় কোন নেতা এমন কি বেগম খালেদা জিয়াও টুশব্দ পর্যন্ত করেননি। হয়ত একটাই কারণ চোরে চোরে মামাত ভাই। হাসিনা-খালেদা-এরশাদ-গোলাম আজমের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের দ্বন্দ্ব থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসন-শোষণ নীতির ক্ষেত্রে তারা এক ও অভিন্ন। তারা মেজর জেনারেল মঞ্জু ও বঙ্গবন্ধু’র কথাই সাঁই দেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ নয় মাটিই তাদের প্রয়োজন আর সকল জুম্মকে তারা বাঙালীতে প্রমোশন দেন। বর্তমান সরকার তো বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে মহাব্যস্ত। তাই তারা অন্যায় ভাবে হাজার হাজার বাঙালীকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসন করছে। এবং জুম্মদের বাঙালী বানাতে সর্বাত্মক চেষ্টা তারা চালিয়ে যাচ্ছে। করছে শত-হাজারো জুম্মকে উচ্ছেদ। অপহৃত কল্পনা চাকমাকে উদ্ধারের চেষ্টা সরকার করেনি, করবেও না। বরং অন্য কৌশলে শত-হাজারো জুম্ম মেয়ের জীবন ধ্বংস করছে। কল্পনার মত অনেক মেয়ের জীবন ধ্বংস হচ্ছে এই সরকারের আমলে। অপরদিকে জুম্মদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে প্রত্যক্ষ মদত দিচ্ছে। ফলে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, মারামারি, খুনোখুনি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। জুম্মদের ভাগ করে শাসন করার নীতি সরকার সন্তু লারমার মাধ্যমে সফল বাস্তবায়ন করছে। শত নারীকে বিধবা আর শত মায়ের বুক খালি করে দিয়েছে। এটাই বর্তমান সরকারের চরিত্র। তার সাথে যোগ হয়েছে একই চরিত্রের অধিকারী তথাকথিত জন সংহতি সমিতি এবং সন্তু লারমা।

অপহৃত-নিখোজ নেত্রী কল্পনা চাকমার নামের সাথে আজ অনেকেই পরিচিত। কিন্তু তার পরিচিতি অনেকেরই অজানা। আমার জানা কিছু বিষয় সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরছি। কল্পনা চাকমা নিজের চোখে তার বাবাকে দেখেনি। তার জম্মের ক’মাস আগেই তার বাবা মারা যান। সে বিধবা মায়ের লালন-পালনে বড় হয়েছে। তার দু’ভাই প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে শিক্ষাই শিখতে পারেনি। পিতৃহারা ও বিধবা মায়ের চরম কষ্টে এবং নিজেদের পরিশ্রমেই তাদের জীবন-জীবিকা অতিবাহিত হতো। তাদের পরিবারে খুবই আর্থিক সংকট আর অনটন। তাদের আর্থিক অনটন থাকা সত্ত্বেও তারা কল্পনাকে শিক্ষায় শিক্ষিত করতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিল। ফলে কল্পনা চাকমা এইচএসসি পাস করে কাচালং কলেজে বি.এ. প্ৰথম বর্ষে ভর্তি হয়। এবং সে অত্যন্ত সচেতন, কঠোর পরিশ্রমী, সমাজ সেবি ও রাজনৈতিক কর্মী। তাই অল্প সময়ের মধ্যে হিল উইমেন্স ফেডারেশন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দৃঢ়তার সাথে ভূমিকা পালনে সে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল। তার দুই ভাই। কালিন্দীকুমার চাকমা (৩২) কালিচরণ ও লাল বিহারী চাকমা (২৬) ক্ষুদিরাম কৃষক। তাদেরকেও সে কৃষি কাজে নানাভাবে সাহায্য করত। সে সাহায্য করত মা ও ভাবীর গৃহস্থলীর কাজেও। সমাজে ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান হলে তার ভূমিকা ছিল অগ্রণী তাই গ্রামে ও বাঘাইছড়িতে কল্পনাকে প্রায় সবাই চেনে। আজ সেই কল্পনা চাকমা নিখোঁজ। নিজবাড়ী হতে গভীর রাতে সেনাবাহিনী (আর্মি) সদস্যদের কর্তৃক সে অপহৃত। কল্পনার দু’ভাই কেবল তার শেষ দেখা দেখেছে। এবং তার গলার শেষ কণ্ঠস্বর শুনেছে। আমরা কেবল তাদের কাছে বোন হারানোর করুণ কাহিনী শুনেছি।

আজ সেই কাহিনীর কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি। রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি থানার নিউলাল্যাঘোনা গ্রামের লোকজন সবাই গভীর ঘুমে মগ্ন। কল্পনা ও বাড়ির সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল। তখনই আমি, ভিডিপি’র লোকজন তাদের বাড়ি ঘিরে ফেলে এবং ঘর হতে বের হবার জন্য ডাকাডাকি করে। পরিবারের সবাই তখন জেগে গেছে। দরজা খুলতে দেরী হচ্ছে দেখে সেনা জোয়ানরা বাঁশের দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকে পড়ে। তারা বাড়ির সবাইকে বসার ঘরে জড়ো করে এবং আলো জ্বালাতে বাঁধা দেয়। তারা একে একে সবার নাম জিজ্ঞেস করে নেয়। হঠাৎ বাইরে থেকে কল্পনার ছোটভাই লাল বিহারীর নাম ডাকার সাথে সাথে জোড় করে টেনে-হেড়ে তাকে বাইরে নিয়ে যায়। তারা বলে স্যারের (বসের) নিকট নিয়ে যাচ্ছে। এ সময় তাকে সনাক্ত করতে তার মুখে বারবার টর্চের আলো ফেলছিল। তখনই লালবিহারী চাকমা ক্ষুদিরাম কিছু লোককে চিনতে পারে। সে যাদের চিনতে পারে তারা হল আর্মি পোষাক পড়া লেফটেনেন্ট ফেরদৌস (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কজইছড়ি আর্মি ক্যাম্পের কমান্ডার) খাকি সামরিক ড্রেস পড়া গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্লাটুন কমান্ডার নরুল হক এবং সদস্য সালেহ আহমেদ।

সেই রাতে লেফটেনেন্ট ফেরদৌসের নির্দেশে ক্ষুদিরামকে কল্পনার বাড়ির পশ্চিমে ছড়া ও পানির নিকট নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে তার চোখ ও হাত বাঁধা হয়। ১০-১২ মিনিট পর কল্পনা ও তার বড় ভাই কালিন্দী কুমার (কালিচরণ)কেও একই স্থানে নিয়ে যায়। কালিচরণের চোখ বাঁধা আর কল্পনা তার হাত ধরে ছিল। অতঃপর তাদেরকে আরো পশ্চিমে একটি জলাধারের কাপ্তাই লেকের দিকে নিয়ে যায়। তারা ধারণা করতে পেরেছে কোথায় আছে। ক্ষুদিরামকে হাঁটু পানিতে নামাল। এক সেনাজোয়ান শক্ত করে তার হাত ধরল এবং অন্য একজন গুলি করতে নির্দেশ দেয়। একথা শুনা মাত্রই ক্ষুদিরাম তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে। যদিও তাকে লক্ষ্য করে পরপর অনেক গুলি চালাচ্ছিল কিন্তু ক্ষুদিরাম অক্ষতভাবে পালাতে সমর্থ হয়। কালিচরণও গুলির শব্দ শুনে ধরেই নিয়েছে তার ভাই শেষ, লেকের পানিতে তার লাশ ভাসছে। সেও আর দেরি না করে কল্পনাকে ছেড়ে দিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে পালিয়ে যায় জীবন বাঁচাবার তাগিদে। শেষে একটি গুলির শব্দ হল এবং দাদা দাদা বলে কল্পনা’র আর্তচিৎকার শুনতে পেল। বিপদজনক ও নিরাপদ নয় ভেবে ক্ষুদিরাম এবং কালিচরণ সে রাতে আর বাড়ি ফিরল না। পরদিন বাড়ি ফিরল এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সাথে নিকটস্থ উগলছড়ি আর্মি ক্যাম্পে কল্পনার খোঁজ করতে যায়। লেফটেনেন্ট ফেরদৌস তাদেরকে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে এবং কড়া ভাষায় শাসিয়ে তাড়িয়ে দেয়। গ্রামের লোকজন দলে দলে এদিক সেদিক কল্পনার সন্ধান করছিল। অনেকেই ঘটনা স্থলে হাজির হল। লেকের মাঝে ক্ষুদিরামের লুঙ্গি এবং খাকি কাপড়ের ব্যান্ডেলে ভর্তি ৩০৩ রাইফেলের গুলি পেল। যা কালিচরণ থানা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জমা দিয়েছিল। থানা নির্বাহী কর্মকর্তাকে তার অফিসে কালিচরণ একটি লিখিত এফআইআর দেন। প্রাপ্ত গুলি ভর্তি ব্যান্ডেলও তাকে দেয়া হয়। সবকিছু গায়েব করে পরে থানা নির্বাহী কর্মকর্তা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। কালিচরণ চাকমা থানার ওসি-র নিকটও লিখিত একটি এফআইআর করেন। তা ছিল খুবই সাধারণ ভাবে লেখা। এতে অপহরণকারী লেফটেনেন্ট ফেরদৌস, নুরুল হক, সালেহ আহমেদ সহ অন্যকারো নাম ছিল না।

কল্পনা চাকমা অপহৃত হবার পর সরকার তাকে উদ্ধারের কোন চেষ্টাই করেনি। সরকারি কোন তৎপরতাও ছিল না। অপহরণকারীরা দিব্যি ঘুরে বেড়ায়। স্থানীয় লোকজন কে ভয়-ভীতি ও হুমকি দিয়ে বেড়ায়। গ্রামের মানুষ স্থানীয় সামরিক বেসামরিক প্রশাসনের কোন সাহায্য-সহযোগিতাই তারা পাননি। তখন কল্পনার মা বাধুনী চাকমা, ভাবী, দু’ভাই এবং গ্রামের লোকজন চরম ভয়-ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতায় অত্যন্ত উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকত। এমনি কঠিন বাস্তবতায় সবাই দিশেহারা। এলাকায় অনেক আলোচনা হল। সকলের অভিমত বড় ধরনের আন্দোলনের কর্মসূচী দেয়া। তাই পুরো বাঘাইছড়ি থানায় অবরোধ কর্মসূচীর পূর্ণপ্রস্তুতি সম্পন্ন করা হল।

১৯৯৬ সাল ২৭শে জুন। সকাল-সন্ধ্যা দিনব্যাপী অবরোধ কর্মসূচীর ডাক দেয়া হল। পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, গণ পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন সকল স্তরের নেতা-কর্মীরা অবরোধ সফল করতে নিজ নিজ দায়িত্বে ছড়িয়ে পরলে। এলাকার লোকজন কর্মসূচী সফল বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে থাকে। সর্বত্র স্বতঃস্ফুর্ত অবরোধ চলতে লাগল। দুপুরের দিকে একটা দুঃসংবাদ জানাজানি ও ছড়িয়ে পড়লো। সাথে সাথে স্থানীয় সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের জানানো হল। এবং সাহায্য চাওয়া হল। কোন সহযোগিতা পাওয়া গেল না। ঘটনার পাশে বিডিআর-১০ হেড কোয়াটারের সিও বা কমান্ডিং অফিসার-কে জানিয়ে সহযোগিতা চাওয়া হল। তার কোন সাহায্য বা সহযোগিতাই পাওয়া গেল না। সে নানা অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে গেল।

অবরোধের দিন যা ঘটেছে। মনোতোষ চাকমা, সুকেশ চাকমা ও সমর বিজয় চাকমা অবরোধ কর্মসূচীতে যোগ দিতে তুলাবান গুচ্ছগ্রাম হয়ে উপজেলা সদরে যাচ্ছিল। গুচ্ছ গ্রামে এসে পৌঁছা মাত্র গুচ্ছগ্রামের বাঙালীরা তাদের তিনজনকে ধাওয়া করে এবং ধরে ফেলে। তাদের বেদম প্রহার করে এবং অবশেষে রামদা দিয়ে হাত-পা কেটে দেয়। ফলে ঘটনাস্থলে তারা প্রাণ হারায়। পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সক্রিয় এই তিন সদস্যকে সেই দিন তুলাবান গুচ্ছগ্রামের বাঙালীরা অত্যন্ত নির্মম ও নৃশংশভাবে খুন করার পর গুম করে। এটা সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ মদত ছিল বলে পরে প্রকাশ পায়।

বাঘাইছড়ির সার্বিক পরিস্থিতি থমথমে। এমনি কঠিন ও জটিল পরিস্থিতিতে আমি আর দীপায়ন চাকমা কাচালং-এ পৌঁছলাম। তখন হাটবাজারে চলাচল বন্ধ। এদিক- সেদিন যাতায়ত বন্ধ। তাই বন-জঙ্গলের পথে পাহাড়-পর্বত বেয়ে কাচালং-এর জীবংগছড়ায় (বাবুপাড়ায়) আমরা পৌঁছলাম। তারপর এলাকার লোকজনের সাথে এলাকার পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা হল। তখন এলাকায় সর্বত্র টান টান উত্তেজনা ও থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। লোকজন চরম অনিশ্চয়তায় ভুগছে। এমনি সময় রাঙ্গামাটি থেকে নির্বাচিত সাংসদ দীপংকর তালুকদার বাঘাইছড়ি সফরে আসেন। ধুর্ত দীপংকর তালুকদার আমাদের উপস্থিতির খবর পেয়ে সাক্ষাতের জন্য সময় নেয়। আমরা সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হলাম। কল্পনা মনোতোষ, সুকেশ ও সমর বিজয়-এর ঘটনাবলী সবিস্তারে তাকে জানানো হল। সে তেমন কোন সন্তোষজনক পদক্ষেপ নেবার কথা বলেনি বা প্রতিশ্রুতিও দিতে পারেনি। কেবল বার বার বলেছেন— নেত্রী- শেখ হাসিনাকে সে বিস্তারিত জানাবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করবে। তাছাড়া তার কথাবার্তায় মনে হয়েছিল সে একজন জুম্ম নয়। সে একজন সরকার লোক আর অধিক আওয়ামী লীগ প্রীতি তার মধ্যে রয়েছে। সে বাঘাইছড়ির অফিস-আদালত ঘুরে রাঙ্গামাটি ফিরে গেল। সেই দিন সাংসদ দীপংকর তালুকদার এক মুহূর্তের জন্য কল্পনা চাকমার গ্রামের বাড়িতে গেল না। সময় পায়নি? আসলে যাওয়ার কোন প্রয়োজন বোধ করেনি। কন্যা হারানোর শোকে ম্রিয়মান কল্পনার বিধবা মা-কে একটুও খোঁজ নেয়নি। খবর নেয়নি ভাবী-ভাই ক্ষুদিরাম ও কালিচরণকে। দেখতে যায়নি গ্রামের অসহায় মানুষের অবস্থা। এই হচ্ছে জনদরদী সাংসদ দীপংকর তালুকদারের বাঘাইছড়ি সফর।

আজ অনেকদিন হল। তারিখটা ঠিক মনে পড়ছে না। ১৯৯৬ সালের শেষ দিকে হবে। কল্পনা চাকমা অপহরণের প্রতিবাদে উদ্ধারের দাবীতে এবং মনোতোষ-সুকেশ- সমর বিজয় হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ও বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির দাবীতে এক বিক্ষোভ- মিছিলের ডাক দেয়া হয়। এ বিক্ষোভ সমাবেশ বাঘাইছড়ি উপজেলা মাঠেই নির্ধারিত ছিল। সমাবেশের দিন আর্মি বাঁধ সাধলো। তারা এ সমাবেশ বানচাল করবে। বিডিআর, পুলিশ ও সেটেলার বাঙালীদের উপজেলা মাঠের কাছাকাছি জড়ো করল। বড় ধরনের গণহত্যা চালানোর প্রস্তুতি নেয় আর্মিরা এবং সরকার রাষ্ট্রযন্ত্র। এসব মতলব বুঝতে পেরে আমরা তাৎক্ষণিক ভাবে সমাবেশের স্থান পরিবর্তন করে কলেজ মাঠে সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আর্মিদের নির্দেশে পুলিশ বাধ সাধলো। তারা ভিডিপি ও সেটেলার বাঙালীদের নিয়ে মুসলিম ব্লকে অবস্থান নিলো। যখন কলেজ মাঠে আমরা জড়ো হচ্ছিলাম তখন পুলিশ ছাত্র-জনতার উপর ঝাপিয়ে পড়ে। বাঙালীরাও কিরিচ, রামদা, বল্লম, ধারালো অস্ত্র, লাঠি-সোটা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ল। বাধ্য হয়ে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলি। ইট- পাটকেল ছুঁড়ে প্রতিরোধের এক পর্যায়ে বাঙালীরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। তখন আবার পুলিশ-ভিডিপি সদস্যরা বাঙালীদের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেয়। এবং ব্যাপক গুলি চালাতে থাকে। ঘটনাস্থলে পুলিশের গুলিতে পিন্টু চাকমা (১৬) রূপন আহত হয়। পুলিশ তাকে ধরে সেটেলার বাঙালীদের নিকট তুলে দেয়। তারা রূপনকে বল্লম, কিরিচ, রামদা দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করে। তার লাশ নিয়ে যায় এবং গুম করে। অনেক চেষ্টা করেও তার লাশ ফেরত পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ রূপনের লাশ বিডিআর-১০ হেডকোটারের পাশেই মাটিতে পুতিয়ে রেখেছে। শেষ পর্যন্ত সেদিনের সমাবেশ আর হল না। আমরা হারালাম রূপনকে। কল্পনার জন্য প্রাণ দিলো কাচালং উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র রূপন চাকমা। সে ছাত্র হিসেবে বেশ মেধাবী ও ভালো ছিল। তার সংগ্রামী ও সাহসী ভূমিকার কথা সবাই জানে। সে দেশ, জাতি ও আন্দোলনের জন্য নিবেদিত প্রাণ ছিল।

সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রযন্ত্রের এমন ভূমিকায় এলাকার মানুষ হতবাক। বার বার খুন করে লাশ গুম করে যাচ্ছে। কাচালং এলাকাবাসীর সীমাহীন ক্ষোভ জন্ম দিল প্রতিশোধ নেবার স্পৃহা। কিন্তু কিভাবে?! রাষ্ট্রযন্ত্র, সেনাবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ বাহিনী তারা সবাই এক ও অভিন্ন। তারপর ডাকা হল বাঘাইছড়ি থানায় অসহযোগ আন্দোলন। মারিশ্য বাজার, উপজেলার সকল অফিস আদালত সম্পূর্ণ অচল হল। মারিশ্যা ও থানা সদরের কোন বাঙালী অন্য কোথাও যেতে পারছে না। তখনই বাঙালীরা বুঝতে শুরু করলো তাদের অপকর্মের ফল। সেনাবাহিনী কেবল তাদের ব্যবহার করছে। তারপর সরকারি রাষ্ট্রযন্ত্রও তৎপর হলো কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনা তদন্তের জন্য তিন সদস্য বিশিষ্ট বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করল। অন্যদিকে চট্টগ্রামের জিওসি, রাঙ্গামাটির ব্রিগেড কমান্ডার অসংলগ্ন বক্তব্য-বিবৃতি দিতে শুরু করে। তারা সামরিক হেলিকপ্টারে করে লোক দেখানো প্রচারপত্রও বিলি করে। তাতে ঘোষণাও দেয় কল্পনা চাকমার সন্ধান দাতাকে তারা মোটা অংকের টাকা দেবে। দেবে সরকারি সুযোগ-সুবিধা। এই হচ্ছে সেনাবাহিনীর কাণ্ড। কল্পনাকে অপহরণ করে তারা আবার সাধু বনে গেছে। তারা অপহরণকারী লেফটেনেন্ট ফেরদৌস, নুরুলহক, সালেহ আহম্মদ বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নিল না। গ্রেপ্তার কিম্বা শাস্তি দূরের কথা বরং তাদের সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে এবং প্রমোশন পেয়ে লে. ফেরদৌস হয়েছে মেজর ফেরদৌস। পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম খুন-অপহরণ, নারী ধর্ষণ করতে পারলেই আর্মিদের দ্রুত প্রমোশন হয়। তারই বড় প্রমাণ এটা। এছাড়াও রয়েছে আরো অনেক প্রমাণ। এই হচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গর্ব ও গৌরব। আর ‘৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সুফল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সোনার বাংলার রূপ। কারণ তারই কন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ দল রাষ্ট্র ক্ষমতার আমলে এ সব হচ্ছে।

১৯৯৭ সাল। ফেব্রুয়ারি/মার্চ মাসে রূপকারী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নির্মাণ করা হল স্মৃতিস্তম্ভ। যাঁরা কল্পনা চাকমার জন্য শহীদ হয়েছে। সেই বীর সাহসী-সংগ্রামী কর্মীদের স্মরণে এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত। এতে প্রতিবছর তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানানো হয় যখনই ২৭ মে জুন আসে। যারা এদের খুন করল তাদের হল না কোন বিচার। হল না কোন শাস্তিও। খুনিরা দিব্যি আজো ঘুরে বেড়ায়। সরকার এদের চিনে ও জানে। কিন্তু কিছুই করছে না। আদৌ কোন কিছু করবে এমন কোন লক্ষণও নেই। এটাই হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায় সরকার নীতি ও কৌশল।

আজ তারিখটা ঠিক মনে নেই। সময়টা বর্ষা মৌসুম সম্ভবত ৯৭ সালের জুলাই আগস্ট হবে। দেশের জাতীয় পত্রিকার তিনজন সাংবাদিক ঢাকা হতে খাগড়াছড়ি এসে পৌঁছল। তারা হল তৎসময়ে আজকের কাগজের বিপ্লব রহমান, ভোরের কাগজের সাগর সারোয়ার এবং সংবাদের মনির হোসেন। বিপ্লব রহমান বাদে অন্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামে একেবারে নতুন। পত্রিকার অফিস থেকে তাদের দায়িত্ব দিয়েছে। কল্পনা চাকমার উপর ফলোআপ রিপোর্ট করতে হবে। তাই ঘটনাস্থল সরেজমিনে তদন্ত করতে হবে। তাদের টার্গেট পার্বত্য চট্টগ্রামের সেই অখ্যাত পল্লীগ্রাম নিউলাল্যাঘোনা। যেখানে সংগ্রামী নেত্রী কল্পনা চাকমা অপহৃত হয়েছেন। যেখানে কল্পনা চাকমার জন্ম। যেখানে কন্যা হারানোর শোকে ম্রিয়মান কল্পনার মা বাধুনী চাকমা, বোন হারানোর শোকে ভাবি ও দু’ভাই এবং গ্রামে যারা আতংকের মধ্যে কাল যাপন করছে। কত রাত তাদের চোখে ঘুম নেই, বুক ফাটা যন্ত্রণায় যারা কাতর। কে হবে তাদের সুখ-দুঃখের ভাগী? কে শুনবে তাদের মরণসম যন্ত্রণার কথা? কে দেবে তাদের একটু সান্তনা? কে দেবে তাদের নিরাপত্তা? কোথায় পাবে তারা একটু সহানুভূতি। দুঃখের কথা মনপ্রাণ খুলে বলতে পারলে তারা একটু হলেও স্বস্তি পাবে। পাবে সান্তনা। হয়ত বা তাই হল। তার চেয়ে বেশী কি আর হবে। তারা আশায় বুক বাঁধলো তাদের সুখ-দুঃখের কথা সাংবাদিকরা ঢাকায় ফিরে পত্রিকায় লিখবে। এবং দেশবাসীকে জানাবে।

ঢাকা হতে আগত সাংবাদিকরা বাঘাইছড়ির পথ চেনে না। চেনে না ঐ এলাকার কোন লোকজনও। বাঘাইছড়িতে তারা কোন দিন যায়নি। তাই তারা আমাদের সহযোগিতা চাইল। তাদের সাথে আমি, সমারী চাকমা (বর্তমান HWF-এর কেন্দ্রীয় সম্পাদক), তরুণ বিকাশ চাকমা (বর্তমানে ডেইলী স্টার পত্রিকার খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি)। সমারী ও তরুণ বিকাশ তারাও বাঘাইছড়িতে একেবারে নতুন যাচ্ছে। তাদেরও পথঘাট, লোকজন তেমন চেনা নেই। মেঘলা আকাশ আমরা রওনা দিলাম বাঘাইছড়ির উদ্দেশ্যে। প্ৰথমে রিক্সায় তারপর চাঁদের গাড়িতে চেপে বসলাম। দীর্ঘ ২-৩ ঘন্টা পথ চাদের গাড়িতে করে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে বাঘাইহাট বাজারে পৌঁছলাম। আগের মত আর্মিদের চেক নেই। ঘন ঘন গাড়ি থামাতে হয়নি রাস্তায়। বাজারের চা-দোকানে হালকা নাস্তা ছেড়ে নিলাম। তারপর টেম্পো (কান্তিবোট)-তে চেপে রূপকারী গিয়ে পৌঁছলাম। তারপর লিপি চাকমা (তৎসময়ে HWF নেত্রী) ও ভুবন কান্তি চাকমা (তৎসময়ে ছাত্র নেতা) আমাদের সাথে যোগ হল। টেম্পোবোট ভাড়া করে পানি পথে সোজা বটতলা গিয়ে নামলাম। ২০-৩০ মিনিট পথ পায়ে হেটে কল্পনা চাকমার বাড়িতে পৌঁছলাম। তখন সন্ধ্যা হয়েছে। দ্রুত অন্ধকার নামছে। একটু একটু বৃষ্টিও হচ্ছে। যেন কল্পনা-কে হারানোর শোকে অশ্রু ঝড়ছে।

আমরা সাংবাদিকদের সাথে কল্পনার মা ভাবী ও ভাইদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। বসার ব্যবস্থা হল। দেরী না করে সাংবাদিকরা আলাপ শুরু করলো। ডায়রি ও নোটবুক খুলে হাতের বলপেন দ্রুত চালাতে লাগলো। দ্রুত গতিতে তারা ঘটনাবলী নোট করে নিচ্ছে। দেখতে দেখতে বেশ অন্ধকার নামলো। তাই কল্পনার ভাবী জ্বেলে দিল হারিকেন। বাইরে ২/১ জন লোক ঘুরছে। গোধুলী-সন্ধ্যায় আমাদের সাথে বাঙালী দেখে ছুটে এসেছে তারা। বেশ সন্দেহ ও আশংকা নিয়ে তারা এসেছে। তাদের সন্দেহ আর্মির নতুবা কোন সরকারি লোক হবে। বাইরে গিয়ে আমি পরিচয় দিলাম। তারা পরিচয় দিলো। পরিচরে জানলাম ৪-৫ জনের মধ্যে দুইজন শান্তিবাহিনীর সদস্য। তাদের হাতে কার্বাইন ও চাইনিজ বাইকের দেখলাম। গ্রামের পাশে অন্য কোথাও তাদের মূল গ্রুপ। আলাপ শেষে তারা ফিরে গেল নিজেদের আস্তানায়। তার কিছুক্ষণ পর সাংবাদিকরাও আলাপ শেষ করল। প্রয়োজনীয় ডায়রি-নোটপত্র গুছিয়ে নিল। এবার ফেরার পালা। বাইরে বেশ অন্ধকার। হাঁটতে হবে অনেক পথ। বৃষ্টি থামেনি বরং একটু বেড়েছে। রাতের থাকা ও ভাতের ব্যবস্থা থানা সদরের জীবংগছড়া গ্রামে। কাচালং-বাঘাইছড়ি প্ৰথম সফরে গিয়ে যে বাড়িতে ছিলাম। পরদিন সকালে ওসি ও টিএনও-এর সাথে সাংবাদিকরা সাক্ষাত করবেন। তাই ফিরতে হবেই। রওনা হলাম। কাঁচা পাহাড়ি রাস্তা। হাটু পর্যন্ত কাঁদা। হাটতে কষ্ট হচ্ছে সবার। আমাদের চেয়ে সাংবাদিকদের বেশি কষ্ট হচ্ছে। সবার চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে বিপ্লব রহমানের। তাকে ধরে ধরে হাটতে সহযোগিতা করছে তরুন, ভুবন ও লিপি। রাত ৯.০০টার দিকে গন্তব্যে পৌঁছলাম। সবাই বেশ ক্লান্ত। একটু বিশ্রাম নিয়ে সবাই গোসল করলাম। তারপর খেতে যাবো এমনি সময়ে বাইরে প্রবল ঝড়-বৃষ্টি এল। যেন আমাদের কথা ভেবেই তার আগে প্রবল ঝড়-বৃষ্টি হয়নি।

তারপর দিন সকালের নাস্তা ছেড়ে সোজা থানায় গেলাম। অনেক খোজা-খুঁজির পর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সাক্ষাত মিললো। সাংবাদিকরা আলাপ শুরু করল। টেবিলের কাছে আমরা নীরব শ্রোতা হলাম। সেখানে আমাদের পরিচয় সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী আর তাদের সহযোগী গাইড হিসেবে। থানার ওসি অনেক বিষয় কৌশলে এড়িয়ে গেল। সাংবাদিকরাও বুঝতে পারলেন। তখন ঘড়িতে প্রায় ১২ টা বাজে। অতঃপর থানা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসে যাওয়া হল। সাংবাদিকরা তার অফিস কক্ষে ঢুকলো। কি আলাপ হয়েছে তা আমরা জানি না। তাদের আলাপের সময় আমরা দোকানে ও কুটির শিল্পের শো রুমে ঘুরাফেরা করেছি। বাঘাইছড়িতে দু’দিন সফর শেষে খাগড়াছড়ি ফিরলাম। তারপর আমরা নিজেদের কাজে ব্যস্ত হলাম। আর সাংবাদিকরাও ঢাকায় ফিরে গেল। কিছুদিন পর পত্রিকায় কল্পনা বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হল। রাতারাতি সাংবাদিক তিন জনের কদর ও গুরুত্ব বাড়লো। তারা বেশ কিছুদিন CHT বিষয়ে পত্রিকায় লেখা-লিখি করলো। তারপর হঠাৎ করে সাগর সারোয়ার পত্রিকায় সরকারি বক্তব্য লিখতে শুরু করলো। বুঝতে বাকী রইলো না সরকারী টাকার ঠেলায় তার লেখালেখিতে বক্তব্য ও আকাশ-পাতাল পার্থক্য হয়েছে। তার মানে যার নুন খাই তার গুন গাই। কথায় বলে অভাবে স্বভাব নষ্ট। তার বিপরীতে আরো কথা আছে সেটাই বড় বেশি সত্য। সেই সত্যটা হল- যে যত পায় সে তত চায়। সাগর সারোয়ারের মত অনেক সাংবাদিক তাই করেছে। তার মানে CHT বিষয়ে অনেকেই ব্যবসা করেছে। এখনো করছে। অনেক সাংবাদিক হয়েছে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। দেশে অনেক এনজিও তাই হয়েছে। কল্পনা চাকমাকে নিয়ে অনেকেই অনেক কিছু করেছে। সত্যবাদীরা সত্য উচ্চারণ করেছে। এবং বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে। আর স্বার্থবাদীরা, সুযোগ সন্ধানীরা করেছে ব্যবসা। বাংলাদেশের মানবাধিকার নামধারী একটি সংগঠনের হত্যা-কর্তারাও কল্পনা অপহরণের বিষয়ে কাল্পনিক মনগড়া কথাবার্তা বলেছে। রিপোর্টও করেছে। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে কোন এক স্থানে তারা কল্পনার সন্ধানের কথাও বলেছে। এবং তার নামও উল্লেখ করে ব্যাপক প্রচার করেছে। তারা এসব তথ্য রিপোর্ট সংগ্রহ বা তৈরি করতে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার ব্যবহার করেছে। সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের অফিসাররা তাদের সাথে সবসময় ছিলেন। তারা রাজকীয় অতিথির বেশে CHT সফর করেছে। কল্পনা চাকমার গ্রামেও গিয়েছে। এই হচ্ছে তথাকথিত সেই মানবাধিকার সংস্থার মানবতা। পরিষ্কার ভাষায় বললে দাঁড়ায় মানবাধিকার হননের উৎকৃষ্ট পন্থা। মানবাধিকার নামে জমজমাট ভাবে ব্যবসা।

কল্পনা অপহরণ, লোগাং গণহত্যা, নানিয়াচর গণহত্যা, সন্তু লার্মাও বিতর্কিত বলেছেন। ১০ই ফেব্রুয়ারি ‘৯৮ সালে খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে সন্তু লার্মা অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পনের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এই বক্তব্য দেন। সন্তু লার্মার বক্তব্য এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। আশ্চর্যের কিছুই নেই। কারণটা হল সেও সফল আদম বেপারী। তার ব্যবসাটা পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের নিয়ে দীর্ঘ ২০-২৫ বছর আন্দোলনের নামে শ্রম বিনিয়োগ করেছেন। শেষে পানির দরে আন্দোলন আর অস্ত্র বিক্রি করেছেন সরকারের কাছে। সেই চুক্তি করেছেন ২রা ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে। তাইতো ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যদিও বা দক্ষিণ আফ্রিকার সমস্যা সমাধানের পর নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন নেলসন ম্যান্ডেলা। এটা কেন হল? সন্তু লারমা আর ম্যান্ডেলার মধ্যে পার্থক্য কোথায়? পার্থক্যটা সেখানে ম্যান্ডেলা কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য স্বাধীনতা এনেছেন আর সন্তু লারমা এনেছেন জুম্মদের জন্য দাসত্বের শৃঙ্খল ও পরাধীনতা। তাইতো আজ ম্যান্ডেলা স্বাধীন আর সন্তু লারমা পরাধীন। সন্তু লারমার ইচ্ছার কোনকিছু হয় না। শেখ হাসিনা ও তার সরকারের ইচ্ছায় সবকিছু করতে হয় তাকে। তাইতো সফল বাস্তবায়ন করছে জুম্ম দিয়ে জুম্ম ধ্বংসের নীতি। সন্তু লারমা এখন সরকারের আজ্ঞাবাহক। সরকার যা বলে সে ভাই করে। তাই আজ জুম্মরা হতবাক। হতবাক বিশ্ববাসীও। তারপরও খুনের নেশায় মেতে উঠেছে সন্তু লারমা। তার দলীয় নেতা-কর্মীরা প্রতিনিয়ত অপহরণ ও খুন করছে ইউ পি ডি এফ নেতা-কর্মী সমর্থক-শুভার্থীদের।

কল্পনা এখনো নিখোঁজ কেন? তার এই পরিণতি কেন? মনোতোষ-সুকেশ-সমর বিজয়-রূপন তাজা রক্ত দিলো কিসের জন্যে? তাছাড়া দীর্ঘ ২০-২৫ বছর আন্দোলন- সংগ্রামে শত হাজারো মানুষ প্রাণ দিয়েছে। রক্ত দিয়েছে অনেক নিবেদিত প্রাণ, বীর শান্তিবাহিনীর জুম্ম সৈনিকও। গণহত্যার শিকার হয়েছে হাজার হাজার জুম্ম। ৬০ হাজারের অধিক জুম্ম ভারতে এক যুগেরও বেশী মানবেতর শরণার্থী জীবন-যাপন করেছে। অর্থনৈতিকভাবে লাখো জুম্ম আজ পঙ্গু। পঙ্গু শত জুম্ম মা-বোন আর ভাই। আজ কন্যা হারানোর শোকে কল্পনার মা বাধুনী চাকমা ইহলোক ত্যাগ করলেন। তার ভাবী ও দু’ভাই স্মরণ করেন কল্পনাকে বার বার। কে দেবে কল্পনার সন্ধান? কে নেবে খোঁজ? আদৌ কি কল্পনা ফিরে আসতে পারবে?! আমাদের সাথে আগের মত করে কল্পনা মিছিলে নামবে না, দলবল নিয়ে সমাবেশে যোগ দেবে না, সভা-সমাবেশেও বলিষ্ঠ বক্তব্য দেবে না। তার কারণ লে. ফেরদৌস, নুরুল হক, ও সালেহ আহম্মদ তাকে সেই দিন অপহরণ করেছে। এতদিন তারা হয়ত সংগ্রামী কল্পনা চাকমাকে নৃশংস, নির্দয় নির্মমভাবে খুন ও গুম করেছে। নয়তো তারা অসহনীয় পৈশাসিক এবং অবর্ণনীয় নির্যাতনের পর খুন ও গুম করেছে। অজানা সত্য ভাবতে গা হিম হয়ে আসে। ঘৃণা হয় নরপিচাসদের হিংস্র আচরণ।

জুম্মোদের দুঃসহ যন্ত্রণা অনিশ্চিত ভবিষ্যত অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি এবং কল্পনা অপহরণের জন্য দায়ী-কে? নিশ্চয় এর জন্য দায়ী দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র, সেনাবাহিনী, পুলিশবাহিনী, সরকারী দল, বিরোধীদল এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংগ্রামী নেত্রী কল্পনাকে আমি ফিরে পেতে চাই। জীবিত কল্পনাকে না হলেও কল্পনার স্বপ্নকে ফিরে পেতে হবে। কল্পনার সেই স্বপ্ন হল জুম্মদের তথা দেশের নারীদের পূর্ণ স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার। এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। আর পার্বত্য চট্টগ্রামের নাম হতে জুম্মল্যান্ড। আজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। তারপরই ফিরে পাবো আমরা হারিয়ে যাওয়া এক কল্পনা চাকমার বদলে হাজারো কল্পনা চাকমা। কল্পনা অপহরণের ঘটনা আজ অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতীক হয়ে আছে। এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।

অপ্রকাশিত, জুন ২০০১

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *