আমার চোখে তুমি
কাকভোরে উঠেই সংসারের কাজে হাত লাগিয়েছে অনন্যা৷ এ বাড়ির অল্পবয়সি বিধবা বউ৷ সুজয় অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাবার পর অনন্যা বাপের বাড়ি ফিরে যায়নি৷ শ্বশুর, শাশুড়ি, দুই জা, ভাসুরের সংসারেই রয়ে গিয়েছিলো৷ সুজয়কে বিয়েটা অনন্যা করেছিলো দুই বাড়ির অমতে৷ অনন্যা আর সুজয় সমবয়েসি বলেই আপত্তি ছিলো দুই বাড়িতেই৷ তবুও ওদের কলেজের ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দিতেই পালিয়ে বিয়ে৷ তারপর বোধহয় ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েই সুজয়ের মা, বাবা বিয়েটা নিমরাজি হয়েই মেনে নিয়েছিলো৷ অত কষ্টের বিয়ের সময়কাল কিন্তু মাত্র এক বছর৷ প্রথম অ্যানিভার্সারী পেরোনোর ঠিক তিনদিন পরেই সুজয়ের দোকান থেকে দুঃসংবাদটা এসেছিলো৷ ওষুধের দোকানে ঢোকার ঠিক আগেই নাকি বাইক সমেত সুজয়কে ওই মহাদানবের আকারের লরিটা…
সুজয়ের চালু ওষুধের দোকানটা গত তিনমাস বন্ধই পরে আছে৷ সুজয়ের দুই দাদাই চাকরি করে, বাবা স্কুল শিক্ষক… এই বছরই রিটায়ার করবেন৷ বাড়ির বউরা বাইরে চাকরি করুক এটা এ বাড়ির ছেলেরা মেনে নেবে না৷ অবশ্যই ব্যতিক্রম ছিলো সুজয়৷ বারবার বলতো, অনন্যা বাড়িতে বসে না থেকে দুটো পরীক্ষা দিলেও তো পারিস! তোর রেজাল্ট কত ভালো ছিলো৷ সবে সবে সকলের অমতে বিয়ে করে আসা অনন্যার তখন অতটাও সাহস হয়নি যে এ বাড়ির নিয়ম ভাঙতে ছুটবে৷ তার মধ্যেই ঘটে গেলে সেই দুর্ঘটনা, যেটা অনন্যাকে একেবারে নিঃস্ব করে দিয়ে গেলো৷ এখন অনন্যার বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়ায় পার্থক্য বিশেষ নেই বললেই চলে৷ তবুও মৃত্যু বড়ো কৃপণ৷ এত চাওয়ার পরেও অনন্যাকে বাঁচিয়েই রেখেছে সে৷ দিনরাত শুনতে হয়, অপয়া মেয়ের সিঁথির সিঁদুরে নাকি বিষ ছিলো৷ গত তিনমাস তিন লক্ষ বার শুনে শুনে কথাটা ইদানীং পুরোনো হয়ে গেছে অনন্যার কাছে৷
অনন্যা শুধু চেষ্টা করে চলেছে কোনোমতে সুজয়ের দেওয়া উপহারটাকে বাঁচিয়ে রাখতে৷ মাঝে মাঝেই মাঝরাতের নিস্তব্ধতায় পেটের উপর হাত রেখে বলে, এই তো সব পাঁচমাস… এখনো বেশ কিছু মাস লড়তে হবে আমাদের৷ অনন্যা মাত্র পাঁচমাসের প্রেগন্যান্ট৷ সুজয়ের কানে কানে পাখি ডাকা ভোরে খবরটা বলেছিলো অনন্যা৷ বাবা হতে চলেছে আনন্দে অনন্যাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরের মেঝেতেই এক পাক দিয়ে নিয়েছিলো ও৷
এ বাড়ি থেকে এখনো বিতাড়িত না হবার কারণ হয়তো সুজয়ের সন্তান৷ সুজয়ই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো অনন্যার বেঁচে থাকার উৎসের৷ তাই তো সুজয়ের এত এত জীবন্ত স্মৃতিতে ঘেরা মনটাকে টেনে টেনেও এগিয়ে চলছে ও৷
ভোরে উঠেই বাড়ির সব কাজ করে রাখার চেষ্টা করে অনন্যা৷ সংসার খরচ দিতে পারে না বলেই এই আপ্রাণ প্রচেষ্টা৷ না এ বাড়ির কেউ কখনো বলেনি, এই শরীরে এত পরিশ্রম করা ঠিক নয়৷ বরং আড়ালে আলোচনা শুনেছে, নিজের স্বামীর অমন মৃত্যুর পরেও যখন বেঁচে আছে ওই জাহাবেজে মহিলা, তখন মাগুর মাছের প্রাণ এত সহজে মরবে না৷
বড়ো জা প্রায় বলে, আজকাল যা দিন কাল পড়েছে তাতে একটা এক্সট্রা পেট চালাতেই হিমশিম খেতে হয়৷ সেখানে সুজয়ের সন্তানের দায়িত্বটা নেবেই বা কে?
এসব আলোচনা শুনলেই কেঁপে ওঠে ওর গর্ভের ভ্রূণটা৷ এত অবহেলা সহ্য করে কি আদৌ বাঁচবে সে?
যদি বাঁচে তবে অনন্যার খুব ইচ্ছে সে যেন সুজয়ের মতোই দেখতে হয়৷
অনন্যার শাশুড়িমা ওর মুখ দেখতেও চায় না৷ ওর মতো অপয়া মেয়ের মুখ দেখলেও নাকি তার দিন খারাপ যায়৷ অনন্যাও চেষ্টা করে সব কাজ শাশুড়ির আড়ালেই সারতে৷ যতটা কম সম্মুখীন হওয়া যায় আরকি৷ সেই কবে থেকে এ বাড়ির লোক অনন্যাকে অপছন্দ করতে শুরু করেছিলো৷ যবে থেকে তাদের ছোটো ছেলে সুজয় অনন্যার বারণ না শুনেই নিজের মৃত্যুর পরে শরীরের কিছু অংশ দান করে গেছে, তবে থেকে৷
অনন্যাও বারণ করেছিলো, মাত্র আঠাশে কেউ দেহদান করে না সুজয়৷ সুজয় মুচকি হেসে বলেছিলো, তোর কাছ থেকে… থুড়ি তোমার কাছ থেকে এমন কথা আশা করিনি অনন্যা৷ ওরা বিয়ের আগে কলেজে তুইই বলতো৷ শাশুড়ি মায়ের চোখ রাঙানির ভয়ে পরে তুমি হয়েছিল৷ তবুও আড়ালে, নিভৃতে তুই হয়ে যেত ওদের সম্ভাষণ৷ যখন অনন্যা আর সুজয়ের দুটো শরীর মিশে যেত ওদের ভালোবাসার জোরে তখন সুজয় কানে কানে বলতো, আমার একটা ছোট্ট অনন্যা চাই৷ আবেশে তৃপ্তিতে গলা বুজে আসতো অনন্যার৷ চোখ বন্ধ করেই বলতো, কিন্তু আমার যে সুজয় চাই৷ এত বড়ো মনের একটা সুজয়৷
ধুর পাগলি… বলেই নিজের লোমশ বুকে জড়িয়ে ধরতো অনন্যাকে৷
ঘরের কাজ করতে করতেই আঁচল দিয়ে চোখের জলটা নিঃশেষে মুছে নিলো ও৷ কেউ দেখলে বলবে, থাক আর আদিখ্যেতা করতে হবে না৷ যখন দেহদান করেছিলো তখন আটকালে না কেন?
অনন্যা কি করে বোঝাবে, দেহ দান করা মানেই মৃত্যুকে ডেকে আনা নয়৷ ওদের কলেজের সিনিয়র প্রফেসর দেহ দান করার পরেও আশি বছর পর্যন্ত বেঁচে আছেন৷
এসব কথা এদের বলতে যাওয়া বাতুলতা ছাড়া কিছুই নয়৷
শাশুড়ি মা থেকে বাড়ির সকলের ধারণা অনন্যার গ্রহের কু ফলেই নাকি সুজয় এই অকালে চলে গেলো৷ অনন্যার বাবা নেই, মা দাদাদের সংসারেই আছে৷ তবুও বড়দা বলেছিল, অনু তুই আমাদের কাছে চলে আয়৷ যায়নি অনন্যা, তাহলে যে সুজয়কে অপমান করা হতো৷ সুজয়ের বাড়ির বিরুদ্ধে গিয়ে অনন্যাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছিলো৷ এই বাড়ি, সুজয় আর ওর নিজস্ব বেডরুম,অনেক জীবন্ত স্মৃতিকে ফেলে কি করে যাবে অনন্যা৷ তাছাড়া ওর খুব ইচ্ছা সুজয়ের সন্তান ওর বাড়িতেই জন্ম নিক৷ তাই এত অপমান সহ্য করেই মাটি কামড়ে পড়ে আছে এ বাড়ির আঠাশ-এর সদ্য বিধবা বউ৷
দু জায়ের কথা শুনেই চলে অনন্যা৷ তবুও যেন কিছুতেই ওদের মনোরঞ্জন করে উঠতে পারবে না৷ ওরা সকলেই অনন্যার ওপর কোনো না কোনো কারণে বিরক্ত হয়েই থাকে৷ আসল কারণটা অনন্যা জানে৷ সুজয়ের উপার্জিত অর্থের জোগানটা বন্ধ হয়ে যাওয়াই বোধহয় সব চেয়ে বড়ো কারণ৷ তবুও গর্ভেরটা ধীরে ধীরে আকার নিচ্ছে৷ আর সুজয় একটু একটু করে স্মৃতির অতলে চলে যাচ্ছে এ বাড়ির সকলের৷ অনন্যা ! সেও কি ভুলতে বসেছে তার ভালোবাসাকে? হয়তো… ভুলতে পারা ছিলো বলেই না মানুষ পাগল না হয়ে গিয়ে বেঁচে আছে৷ না হলে মাত্র তিন চার মাসের সন্তানকে গর্ভে ধারণ করাকালীন সুজয়ের মৃতুই তো শেষ করে দিয়েছিলো অনন্যার জীবন!
বেশ কিছু দিন পরে আবার এ বাড়িতে একটু হলেও খুশির ছোঁয়া পৌঁছাতে পেরেছে অনন্যা ৷ সুজয়ের সন্তান এ পৃথিবীর আলো দেখেছে৷ অনন্যার একটি ফুটফুটে ছেলে হয়েছে৷
এই প্রথম শাশুড়ি মা সদ্যোজাতকে কোলে নিয়ে অনন্যাকে বললেন, বাকি দুজনেরই তো মেয়ে, যাহোক বংশরক্ষা হলো৷
দুই জায়েরই মেয়ে, তাই হয়তো অনন্যার ছেলেই এ বাড়ির প্রথম পুত্র সন্তানের খাতির পেলো৷ অনন্যা ছেলের মুখে আঁতিপাতি করে খুঁজছিলো সুজয়ের কিছু চিহ্ন৷ ধুর! এই কাদার ডেলায় কি বোঝা যায়, আদৌ কেমন দেখতে হয়েছে ও৷ বাড়ির লোক মন বোঝাতেই হয়তো বলছে, মুখটা পুরো সুজয় বসানো৷
দেখতে দেখতে অনন্যার সন্তান মাস তিনেকের হয়ে গেলো৷ বাড়ির সব থেকে ছোটো সদস্য বলে সে আদর পেলেও এতটুকু সম্মান বাড়েনি অনন্যার৷ এমনকী তার ছেলে সৃজন কি খাবে, কি পোশাক পরবে সেটুকু বলার অধিকারও অনন্যার নেই৷ শাশুড়ি মা কিছুতেই অপয়া বউ-এর হাতের ছোঁয়া পড়তে দিতে চান না বংশধরের ওপরে৷ মাঝে মাঝে কষ্ট হয় অনন্যার৷ যখন নিজের বুকের দুধে ব্যথা হয়, অথচ তার ছেলেকে বাইরের কেনা দুধ খাওয়ানো হয়৷
সেদিন বেশ সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিলো, অনন্যা যে কোথায় বেরিয়েছে কেউ জানে না৷
বড়ো বউ বেশ জোর গলাতেই বললো, বাড়িতে ছেলে দিয়েছে বলে তার তো সব দোষ মাপ হয়ে গেছে৷ অথচ দুপুর রোদে যখন গোটা বাড়ি ঘুমিয়ে তখন সে ঠিক কোথায় যায়, সেটা কি কেউ খোঁজ রাখে! আমাদের কাজের মাসি রেবা দি বলছিল, দত্ত পাড়ার গলির দিকে কোন বাড়িতে নাকি তাকে দু-দিন ঢুকতে দেখেছে সকলে৷ সেই বাড়িতে নাকি এক ডিভোর্সি ভদ্রলোক থাকে৷ দেখুন গিয়ে এ বাড়ির ছোটো বউ, তার স্বামীকে খেয়ে তারপর এখন কি করে বেড়াচ্ছে!
মেজোবউ, ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললো, আহা অমন বলো না… বড়দি, কত আর বয়েস! শরীরের চাহিদা বলেও তো কথা আছে নাকি?
শেষ কথাগুলো শুনতে শুনতে বাড়ির উঠোন পেরোলো অনন্যা৷
ওকে দেখেই প্রায় চিৎকার করে উঠলেন, শ্বশুর মশাই…
এ বাড়ির সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে নাকি তিনি দেবেন না৷
অনন্যা ধীর গলায় বললো, বাবা এবাড়িতে তো আপনার ছোটো ছেলেরও অধিকার ছিলো, তার স্ত্রী হিসাবে আমারও৷ অথচ আমার সন্তানকে আমাকে ছুঁতে পর্যন্ত দেয়া হয় না!
এগুলো কি অন্যায় নয়?
শাশুড়ি মা বললেন, নিজের সন্তানের ভালো চাইলে তুমি ওকে চাইতে না৷ আমার ছেলেটাকে তো ওপরে পাঠিয়েছ, তারপর আবার!
সেদিনের বাকবিতণ্ডা বন্ধ হলো ঠিকই, কিন্তু অনন্যার ওপর নজরদারিটা জারী রইলো ওর অজান্তেই৷
গুনে গুনে ঠিক চারদিন পর আবার ছটফট করছে অনন্যার মন৷ রাজেশের বাড়িতে যেভাবেই হোক ওকে পৌঁছাতেই হবে৷ খুব দেখতে ইচ্ছে করছে রাজেশকে৷ একবার অন্তত৷ লোকে হয়তো ওকে খারাপ চরিত্রের বলছে৷ কিন্তু ও নিরুপায়, ওকে যেতেই হবে রাজেশের কাছে৷ ওর কাছে কিছুক্ষণ বসলে তবেই অনন্যার মন শান্ত হবে৷ রাজেশ নিশ্চুপ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকবে তবেই অনন্যার এই উথালপাথাল হূদয়ের পূর্ণ শান্তি মিলবে৷
বিয়ের আগে অনন্যার একটা জন্মদিনে এই অলিভ শিফনটা গিফট করেছিলো সুজয়৷ অলিভ সুজয়ের ভীষণ পছন্দের রং ছিল৷ সেটাই আজ নিজের গায়ে জড়িয়ে নিলো অনন্যা৷ চুপি চুপি বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে৷ ও জানতেও পারলো না মেজোভাসুর আর মেজো জা খুব সন্তপর্ণে ওর যাত্রাপথ অনুসরণ করে চললো৷ ভাড়া ট্যাক্সির পিছনে আরেকটা ট্যাক্সী ফলো করছিলো ওকে৷
গেট খুলে ফুলের বাগান পেরিয়ে সাদা একতলা বাড়িটার ভিতরে ঢুকে গেলো অনন্যা৷ ভিতর থেকে একটা তানপুরার আওয়াজ ভেসে আসছে৷ উত্তেজনার বশেই হয়তো অনন্যা গেটটা বন্ধ করলো না আর৷
একমনে রাজেশ বাজাচ্ছে তানপুরাটা৷ বিভোর হয়ে৷
অনন্যা গিয়ে বসলো ওর ঠিক পায়ের কাছে৷ যেন ধ্যানগম্ভীর পর্বতের ধ্যানে কিছুতেই বিঘ্ন না ঘটে৷ তরঙ্গ বিহীন নদীর মতোই শান্ত হয়ে বসে আছে অনন্যা৷ সামনেই বসে আছে বছর চল্লিশ-বিয়াল্লিশের মধ্যবয়স্ক মানুষটি৷ পরনে সাদা পাঞ্জাবি৷
চোখ না খুলেই রাজেশ বললেন, অনন্যা তুমি আবার এসেছো?
আপনি কি করে বুঝলেন ?
তোমার পায়ের ভীত শব্দে৷ বহুদিন তো অন্ধকারে এই কানের ওপর ভরসা করেই জীবন কাটিয়েছি, তাই শব্দ শুনেই চিনতে পারি৷ আমার স্ত্রী লারা তো আমাকে ডিভোর্সই করলো আমার এই অন্ধত্বের জন্য৷
কিন্তু অনন্যা আমি তোমার সুজয় নই, আমি তো রাজেশ৷
অনন্যা ধীরে ধীরে বললো, আমি জানি আপনি রাজেশ৷ কিন্তু আপনার চোখদুটো তো সুজয়ের৷ মিথ্যে বলবেন না, বলুন সত্যি কিনা?
আমি অনেক কষ্টে আই ডোনেট সেন্টার থেকে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি,আপনার চোখদুটো সুজয়ের৷
বেশ না হয় মেনে নিলাম তাই৷ কিন্তু তাতেও তো আমি তোমার সুজয় হতে পারি না৷
অনন্যা বললো, তাহলে আমি যেদিন এ বাড়িতে প্রথম এলাম সেদিন আপনি ওইভাবে তাকিয়ে ছিলেন কেন? যেন আমি আপনার অনেক দিনের চেনা?
রাজেশ আরেকবার তানপুরার তারে জোরে টান দিল৷ বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে রাজেশ বললো, তোমার মুখটার মধ্যে বড্ড মায়া অনন্যা৷ তুমি যেন পথ হারা পথিককে সঠিক দিশা দেখাতে পারো, নিভে যাওয়া জীবনকে শক্তি দিতে পারো৷
তাই সেদিন তোমার দিকে তাকিয়েছিলাম অনন্যা৷ দীর্ঘ দু-বছর একটু একটু করে কাছের মানুষদের দূরে চলে যেতে দেখলাম৷ হঠাৎই অস্তগামী সূর্যকে নিভে যেতে দেখেছিলাম৷ আর তো উঠতে দেখিনি তাকে৷ আই ডোনেট সেন্টারে দীর্ঘদিন ধরে বলাই ছিলো৷ হঠাৎই ৪ঠা জুলাই ওরা ডাকলো৷
অনন্যা বললো, হ্যাঁ ওটাই সুজয়ের মৃত্যুদিন৷
কিন্তু রাজেশ, আমি কি করে ভুলবো যে আপনার চোখের তারায় আছে আমার সুজয়ের চোখ!
রাজেশ বললো, কিন্তু অনন্যা আমি তো সুজয় নই৷
আমাকে গ্রহণ করতে গেলে রাজেশ হিসাবেই করতে হবে অনন্যা৷ তোমার সুজয় হয়ে আমি বাঁচবো কি করে? দমবন্ধ হয়ে যাবে যে অন্যের পরিচয়ে বাঁচতে বাঁচতে৷
কোনো কথা না বলেই বেরিয়ে এলো অনন্যা৷ বুকের ভিতরে সব ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে৷ রাজেশ হয়তো এই কয়েকদিনে অনন্যাকে ভালোবেসে ফেলেছে৷ কিন্তু অনন্যা? সে তো শুধু সুজয়ের চোখ দুটো খুঁজতেই রাজেশের কাছে যায় গত কয়েকদিন ধরেই৷ রাজেশকে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে অনন্যার মনে হয়েছিল ওর সুজয় হয়তো রাজেশের চোখ দিয়েই দেখছে ওকে৷
একী ভুল করছে অনন্যা৷ কেন বারবার মানসম্মান তুচ্ছ করে রাজেশের কাছে ছুটে আসছে ও৷ সকলে ওকে কুলটা বলছে, তবুও যেন একটা স্বপ্ন ঘোরে বাস করছে ও৷ ফিরে আসতে আসতেই পিছন থেকে শুনতে পেলো,অলিভ আমার প্রিয় রং অনন্যা৷ তোমাকে ভারি মানিয়েছে৷ আবার থমকে দাঁড়িয়েছে অনন্যা৷ এই তো সুজয়৷ সুজয়ের পছন্দের রং ছিলো অলিভ৷
অনন্যা! রাজেশের গলাটা খুব ভারী হয়ে এসেছে৷ অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকা,মানসিক ভাবে প্রায় বিপর্যস্ত অনন্যাকে কেন যে এই কয়েকদিনেই এতটা আপন করে নিতে পেরেছে ও, সেটা রাজেশ নিজেও জানে না৷ রাজেশের থেকে প্রায় বারো তেরো বছরের ছোটো হবে অনন্যা৷ তবুও যেন মনে হয় রাজেশের এই ভগ্ন মনের দায়িত্ব একমাত্র অনন্যাই নিতে পারবে৷
ঘুরে দাঁড়িয়েছে অনন্যা৷
কান্নাভেজা গলায় বললো, আমার সুজয়ের অলিভ পছন্দ ছিল৷ আপনার নয়৷
উদভ্রান্তের মতোই ছুটে বেরিয়ে গেলো ও৷ রাজেশ জানে অনন্যা আর লারার মধ্যে বিস্তর ফারাক৷ রাজেশকে দেখে যখন নামী ডাক্তার ঘোষণা করে দিয়েছিলো, যে আপনি আর কখনো দৃষ্টিশক্তি ফেরত পাবেন না, একমাত্র যদি চক্ষু প্রতিস্থাপন না করা হয়! ঠিক তারপরেই প্রয়ান্ধ স্বামীকে ডিভোর্সের নোটিস ধরাতে লারার সময় লেগেছিলো মাত্র কয়েকটা মাস৷ অনন্যার মৃত স্বামীকে ভোলার জন্য প্রায় দেড় বছর সময় কিছুই নয়৷ ওর মনে এখনো ওর সুজয় যেন জীবন্ত৷
তবে রাজেশ জানে অনন্যা আবার আসবে৷ যেহেতু ও জেনে গেছে সুজয়ের মৃত্যুর পরে ওর চোখদুটোর অধিকারী রাজেশ৷ রাজেশও চায় অনন্যা আসুক৷ বারবার আসুক৷ ওর ক্ষতবিক্ষত হূদয়ে আরেকবার রক্তক্ষরণ হোক৷ আরেকবার এই চল্লিশে প্রেমে পড়ুক রাজেশ৷ হোক না সে প্রেম চির নীরব৷
বাড়ি ফেরার পরেই বুঝতে পারলো অনন্যা, বাড়িতে সকলে জেনে গেছে ওর গন্তব্য স্থান৷ কারণ মেজদা আর মেজদি ড্রয়িংরুমে বসে বেশ রসিয়ে রসিয়ে অনন্যা আর রাজেশের সম্পর্কের ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে চলছে খুব বিকৃত আঙ্গিকে৷
অনন্যা খুব ভালো করেই বুঝতে পারলো এ বাড়িতে তার বাস উঠলো৷
ঠিক তাই শ্বশুর মশাই ওকে দেখে খুব সহজ ভাবে শুনিয়ে দিলো ওর ফাঁসির হুকুম৷
এই প্রথম এ বাড়ির নিরীহ ছোটোবৌমার মুখে এমন আজব কথা শুনে বাড়িতে একটা বাজ পড়লো যেন৷
অনন্যা আজ কিছুটা জোর করেই শাশুড়ির কোল থেকে নিজের সন্তানকে এক প্রকার ছিনিয়ে নিয়ে বললো, পৃথিবীর কোনো আইন আমার সন্তানকে আমার কাছ থেকে আলাদা করতে পারবে না মা৷ সুজয় বহুবার বলেছিলো, অন্য কোথাও গিয়ে থাকার কথা৷ আপনারা যখন আমাকে মেনে নিতে পারেননি তখন প্রায় বলতো সুজয়৷ আমি ভেবেছিলাম, মায়ের কাছ থেকে সন্তানকে আলাদা করার পাপ করা হয়ে যাবে৷ তাই মুখ বুজে ছিলাম এই অপমানের সংসারে৷ সুজয় চলে যেতে সব থেকে বড়ো ক্ষতি যদি কারোর হয়ে থাকে তাহলে সেটা তার স্ত্রী, তার অনাথ সন্তানের৷ অথচ দিনরাত একমাথা সিঁদুর পরে তার মা হয়ে আপনার একটুও বলতে বাধে না যে, তুমিই আমার ছেলেকে খেয়েছো বউমা!
কেন মা, আপনার পুণ্য দিয়ে কেন আপনি আপনার ছেলেকে ধরে রাখতে পারলেন না? কেন এ বাড়ির সকলের পুণ্য দিয়ে তারা সুজয়কে বেশি পরমায়ু দিতে পারলো না?
একদিকে আপনারা এত জন, অন্য দিকে অপয়া কেবল আমি…! আমার ভাগ্যেই নাকি সুজয় চলে গেলো৷ দুই গাল দিয়ে গড়িয়ে পরা নোনতা জলকে আজ আর লুকিয়ে মুছে নিচ্ছে না অনন্যা৷ সৃজনকে বুকে জড়িয়ে ধরে এই প্রথম প্রতিবাদ করলো ও বিগত দু-বছরের অন্যায়ের৷
ফাইল ঘেঁটে বের করলো, সুজয়ের ওষুধের দোকানের লাইসেন্স৷ অনেক কাজ বাকি ওর ৷ আবার ‘আনন্দময়ী মেডিকেল হল’-কে চালু করতে হবে ওকে৷ সৃজনকে মানুষ করতে হবে৷
ব্যাগ গোছানো কমপ্লিট৷ সব কিছুর সাথে সুজয়ের বড়ো ছবিটা নিতে ভোলেনি অনন্যা৷ সুজয়ের দু-জন বিশ্বস্ত কর্মচারী ছিল, তাদেরও ফোন করেছে ও৷ তারাও সাহায্য করবে কথা দিয়েছে৷
ছোট্ট সৃজনকে বুকে জড়িয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো অনন্যা৷
ঝুল ঝেড়ে, চারিদিক পরিষ্কার করেই সুজয়ের ছবিটা টাঙিয়ে দিলো ওর নিজের দোকানে৷ একটা অদ্ভুত ভরসা৷ যেন সুজয় বারবার কানের কাছে বলছে,তুমি এতদিনে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছ অনন্যা৷ আমি সাথে আছি তোমার৷
প্রচুর ওষুধ এক্সপায়ার করেছে, সেগুলোকে বাছতে হবে৷ এসব কাজ অনন্যা তেমন কিছুই জানতো না৷ তবে বিয়ের আগে থেকে সুজয়ের কাছে শুনে শুনেই কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছিল ওর৷
বারবার এদিক ওদিক তাকিয়েও খুঁজে পাচ্ছিলো না ওয়েন্টমেন্টগুলো৷ কেউ যেন কানের কাছে বললো, তোমার বাঁদিকে ঠিক তৃতীয় তাকে দেখো৷ তাকাতেই দেখতে পেলো যাবতীয় ওয়েন্টমেন্টের প্যাকেটগুলো৷
রাজেশ দাঁড়িয়ে আছে দোকানের বাইরে৷
চমকে উঠেছে অনন্যা৷ তবে কি অনন্যাই ঠিক৷ রাজেশের চোখ দিয়ে কি সুজয় দেখতে পাচ্ছে৷ খেয়াল করেনি অনন্যা দোকানের গ্লাস দিয়ে ভিতরটা সবই প্রায় দেখা যাচ্ছে৷ ওর বার চারেক, ওয়েনমেন্টগুলো কোথায় গেল রে বাবা… শুনেই রাজেশ নিজেই খুঁজে বলেছে৷ তবুও রাজেশের ইচ্ছে করছিলো না আজ অনন্যার ভ্রান্ত বিশ্বাস ভাঙতে৷
রাজেশ বললো, তোমার শ্বশুর বাড়ির কয়েকজন এসে ভীষণ অপমান করে গেছেন আমাকে৷ আমার দেওয়া সাহসের জন্যই নাকি তুমি এমন একটা পদক্ষেপ নিয়েছ!
তবে অনন্যা, তুমি একেবারে ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছ… আমি পাশে আছি তোমার৷ সব রকম সাহায্যের জন্য৷
একটু আগেই, যখন রাজেশ ছিল না এখানে, তখনও অনন্যা এমনিই একটা কথা যেন শুনতে পেয়েছিলো সুজয়ের গলায়৷ তবে কি অনন্যাই ঠিক?
সেই মুহূর্তে কঁকিয়ে কেঁদে উঠলো দোকানের বেঞ্চে শুয়ে থাকা ছোট্ট সৃজন৷ ধুলো হাতেই ওকে কোলে নিতে যাচ্ছিলো অনন্যা৷ রাজেশ এসে বাধা দিলো৷ নিজেই সৃজনকে কোলে তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো৷
অনন্যার দুর্বল মনের এটাই ভ্রান্তি, সুজয় এই প্রথম তার সন্তানকে দেখলো নিজের চোখে৷
রাজেশ আপনমনে বললো, তবে তাই হোক অনন্যা, আমি না হয় সুজয়ের চোখ দিয়ে আর রাজেশের মন দিয়েই তোমাকে দেখবো সারাজীবন৷ তোমার প্রতি আমার সম্মান তাতেও কমবে না একফোঁটাও৷
অনন্যা, তুমি আর সৃজন যদি… আজ থেকে আমার বাড়িতেই থেকে যেতে…
উদভ্রান্ত অনন্যা বললো, নিশ্চয় থাকবো৷ সৃজনকে ওর বাবার চোখের আড়ালে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা নেই আমার৷
বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠলো রাজেশের৷ অনন্যা হয়তো ওকে ভালোবাসবে কিন্তু রাজেশের মৃত্যু ঘটিয়ে, সুজয়কে বাঁচিয়ে রেখে৷ ছোট্ট সৃজনের গালে নিজের গালটা রেখে, অস্ফুটে রাজেশ বললো, বেঁচে থাকুক পিতৃত্ব৷