আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে – সামিও শীশ
“কত দিনের সাধন ফলে মিলেছি আজ দলে দলে—
আজ ঘরের ছেলে সবাই মিলে দেখা দিয়ে আয়রে মাকে।”
—আমরা সবাই মিলব একদিন। কবে আসবে সেদিন? প্রশ্ন থেকে যায় আরও। আমরা কে?
তখনও স্কুলের গণ্ডি ছাড়িনি। রাস্তার পাশে একটি দেয়ালে লেখা দেখি ‘আমরা বাঙালি নই, আমরা বাংলাদেশী’। কথাটি তখন মনকে নাড়া দেয়নি, শুধু করোটির নিউরনে স্থান করে ছিল।
ক’দিন ধরে কথাটি নিয়ে ভাবছি। আমার যে বাঙালি পরিচয় আমাকে গৌরবান্বিত করেছে, আমার সংস্কৃতির শিকড় যেখানে মিশে আছে— তাকে অস্বীকার করার প্রয়াসে আমরা উদ্যত। আমার অহংকার খর্ব হয়, আমি নত হই।
এই নত হওয়ার সাথে অপরাধ বোধও আছে।
বাংলাদেশ কালের পরিক্রমায় অনেক উপজাতিও বাস করছে। বাংলাদেশ স্বাধীন, সার্বভৌম দেশরূপে বিশ্বের মানচিত্রে স্বীকৃত। ঐতিহ্যের মানদণ্ডে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বাঙালি। আবহমান কাল ধরে গড়ে ওঠা তার সংস্কৃতি, ইতিহাস তাই সমর্থন করে। রাষ্ট্রগতভাবে তার পরিচয় নির্ধারণ ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু এ কারণে তার আদি পরিচয় মুছে ফেলা যায় না।
কিন্তু আমরা তাই অস্বীকার করছি, প্রকাশ্যে, এই নির্লজ্জতা আমাকে ব্যথিত করে। সম্মান করি আমার দেশে বসবাসকারী উপজাতিদের। নাগরিক পরিচয় অর্জনের কারণে তাঁরা তাঁদের শিকড়কে ভুলে যাননি। তাঁরা অবশ্যই আমাদের দেশে নাগরিক, আমার সাথে তাঁদের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পার্থক্য থাকতে পারে। এ পার্থক্য বা তারতম্য কোন দ্বন্দ্ব নয়।
আমার বাঙালি পরিচয় আমি রক্ষা করব, তাঁর উপজাতি পরিচয় তিনি রক্ষা করবেন- এটি কোন বিভেদ নয়, আশ্রয় আর ঐতিহ্য লালনের তাগিদ।
আমরা গর্বিত হব আমরা এক দেশের নাগরিক। নাগরিক পরিচয়ে আমরা বাংলাদেশী। আমাদের ঐক্য ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি করবে এ পরিচয়। কোন আঘাত এলে আমরা একত্রিত হব, দৃঢ় হব আত্মরক্ষার প্রয়াসে।
আজ আঘাত এসেছে। কল্পনা চাকমা ১২ই জুন, ১৯৯৬ থেকে অপহৃত। ১৩ই জুলাই The Daily Star এ A Month after Abduction, Kalpana Chakma Yet to be Res- cued By Morshed Ali Khan’ এবং ১৪ জুলাই সংবাদ-এ ‘কল্পনা চাকমা,
তুমি কোথায় আছো, কেমন আছো?’ (এ, এন রাশেদা) লেখাগুলো পড়ে প্রশ্ন জেগেছে অপহরণের এক মাস পরে কল্পনা চাকমা আজ কোথায় আছেন, কেমন আছেন?
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কি এই অপহরণের সাথে যুক্ত? প্রশ্নটি অবান্তর নয়। কেননা, এ প্রশ্নটি বারবার এসেছে।
সেনাবাহিনী কর্তৃক আমরা অতীতে বহু নির্যাতিত হয়েছি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা এদেশে যে হত্যা, ধর্ষণ আর নির্যাতন করেছে, তা বিশ্বের ইতিহাসে মানবাধিকার লংঘনের নিকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত।
আজ আমরা অর্থাৎ বাঙালিরা স্বাধীন বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমাদের নিজস্ব সশস্ত্র সেনাবাহিনী আছে। কিন্তু এ দেশে যুগ যুগ ধরে সংখ্যালঘু এ উপজাতিরাও রয়েছে। তাঁরা অবশ্য অবশ্যই এ দেশের পূর্ণ নাগরিক।
তাঁদের রক্ষা না করে, পেষণ করা আর বাংলা মাতাকে অত্যাচার করা একই কথা। ইয়াসমিন হত্যায় আমরা যেমন ব্যথিত, কল্পনা চাকমা অপহরণেও তেমনি ব্যথিত। আমরা ক্ষুব্ধ। উপজাতিদের পূর্ণ নিরাপত্তার দাবি আমরা কেন অন্যান্য দাবির মত জোড়ালোভাবে করছি না?
দিনাজপুরের ইয়াসমিন হত্যায় সমগ্র দেশবাসী যে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছিল, কল্পনা চাকমার অপহণের এই ঝড় কেন উঠবে না? এটি কি আমার দেশে মানবাধিকার লংঘনের দৃষ্টান্ত নয়? অবশ্যই। এ দেশের শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সকলেই উপজাতির অধিকার আদায়ের দাবিতে আশা করি, সমবেত হবেন।
সংবাদ : ২৩ জুলাই ‘৯৬