আমরা কেউ আর আসব না

আমরা কেউ আর আসব না

প্রমোটারের লোক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অনুকুলবাবুকে বলল, ‘এই নিন আপনার চাবি৷ তাহলে এবার দরজা খুলে দুগ্গা দুগ্গা বলে ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ুন৷ আমাদের লোক কাল এসে সব ঠিকঠাক করে দিয়ে গেছে৷ কল খুললেই জল, সুইচ টিপলেই বাতি জ্বলবে৷ আর, কোনো অসুবিধা হলে আমাদের অপিসে ফোন করলেই সঙ্গে সঙ্গে লোক চলে আসবে৷’ অনুকুলবাবু তার কথা শুনে মৃদু হেসে চাবি নিয়ে একশো টাকা তাকে মিষ্টিমুখ করার জন্য দিলেন৷ লোকটা চলে গেল৷

চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরের ভিতর পা রাখতেই অনুকুলবাবুর বুক আনন্দে ভরে গেল৷ প্রমোটারের লোকদের সাথে এর আগে দু-দিন এ ঘরে, এ ফ্ল্যাটে পা রেখেছিলেন তিনি৷ কিন্তু যখন তিনি দেখতে এসেছিলেন, এটা তাঁর নিজের ঘর ছিল না৷ এটা এখন তাঁর নিজের ঘর৷ নিজের ‘ফ্ল্যাট’-একথা ভাবতেই কেমন যেন রোমাঞ্চ বোধ হচ্ছে তাঁর৷ অনুকুলবাবু এমনি একটা দিনের জন্য বহুবছর ধরে অপেক্ষা করছিলেন৷ একটা ছোটো সংস্থায় সামান্য বেতনে চাকরী করেন তিনি৷ এই ফ্ল্যাটটা কেনার জন্য তিলতিল করে পয়সা জমিয়েছেন৷ শ্যামবাজার থেকে শিয়ালদহ হেঁটে অপিস করেছেন, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের বিয়েতে সোনার বদলে শাড়ী দিয়ে কাজ সেরেছেন, মেয়েকে স্ক্রিনটাচ মোবাইল দিতে পারেননি, ছেলেকে লাপটপ দিতে পারেননি, আরও কতকিছু কষ্ট ও ‘না’-এর বিনিময়ে এই ফ্ল্যাট৷ যদিও এই সাতশো স্কোয়ারফিটের ফ্ল্যাটটা শহরে নয়, শহরতলীতে৷ ফ্ল্যাটটাও চার তলায় এবং লিফটও নেই, তবুও এ ফ্ল্যাটটা তাঁর নিজের৷ শ্যামবাজারে যে বাড়িতে তিনি ভাড়া থাকেন সেখানকার মতো ভোর হলেই অন্য ভাড়াটিয়াদের সাথে ধাক্কাধাক্কি করে টাইমকলের লাইনে দাঁড়াতে হবে না, রাত বারোটার পর কোনো ঘরে বাতি জ্বললে পরদিন সকালে বাড়িওলা দেখা হলে বলবেন, ‘ইলেকট্রিক চার্জ এখন বেড়ে গেছে সেটা আপনি জানেন তো অনুকুল বাবু?’ এখানে তেমন সব ব্যাপার নেই৷ এখানে কল খুললেই জল, সুইচ টিপলেই আলো, কেউ এখানে কিছু বলতে আসবে না৷

একটা ড্রইং, দুটো বেডরুম, একটা কিচেন, বাথরুম, আর একটা ছোটো ব্যালকনি৷ অনুকুলবাবু প্রথমে একবার পুরো ফ্ল্যাটটা ঘুরে নিলেন তারপর কোনো ঘরের দরজা খুলতে লাগলেন, কোনো ঘরের জানলা বন্ধ করতে লাগলেন, কখনও বাতি জ্বালাতে নেভাতে লাগলেন, কখনও বা আবার জলের কল খোলা বন্ধ করতে শুরু করলেন৷ এ কাজগুলো তিনি যতটানা করতে লাগলেন সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা তা পরখ করার জন্য, তার চেয়েও বেশি করতে লাগলেন মনের আনন্দে৷ তাঁর নিজের বাড়ি বলে কথা! অনেকটা বাচচা ছেলেদের মতোই তিনি কাজগুলো করে চললেন৷

অনুকুলবাবু তখন তৃতীয়বারের মতো ড্রইং সংলগ্ন বেসিনের কলটা খুলতে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময় পিছন থেকে একটা গলার শব্দ শুনতে পেলেন— ‘দাদা নিশ্চই এ ফ্ল্যাটটা নিলেন?’

অনুকুলবাবু মৃদু চমকে উঠে পিছনে তাকিয়ে দেখলেন খোলা দরজা দিয়ে ড্রইংরুমের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছেন এক ভদ্রলোক৷ বয়স অনুকুলবাবুর মতোই বছর পঞ্চাশ হবে৷ শীর্ণকায়, চোখে চশমা, পরনে ধুতি-পাঞ্জাবী৷ বেশ নিরিহ গোছের চেহারা৷

অনুকুলবাবু বললেন, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷ আপনার পরিচয়টা?’

ভদ্রলোক হাত জোড় করে নমস্কার করে বললেন, ‘আমার নাম সীতাংশু বাগ৷ আমি এই ফ্লোরেই থাকি৷ আগেও দু’দিন আপনাকে ঢুকতে দেখেছি৷ আজ যখন প্রমোটারের লোক আপনার হাতে চাবি তুলে দিল তখনই অনুমান করলাম যে ফ্ল্যাটটা আপনি কিনে নিয়েছেন৷ তাই পরিচয় করতে এলাম৷’

অনুকুলবাবুও তাঁকে প্রতিনমস্কার জানিয়ে বললেন, ‘তার মানে আপনি আমার প্রতিবেশী৷ আপনি নিজে পরিচয় করতে এলেন বলে ভালো লাগল৷ প্রমোটারের লোক ছাড়া এখানে আমার সাথে আর কারও চেনাজানা নেই৷’

সীতাংশুবাবু হেসে বললেন, ‘এখানে এখনও খুব বেশি লোকের দেখা পাবেন না৷ ফ্ল্যাটগুলো সব বিক্রি হয়ে গেছে ঠিকই, তবে পয়সাওলা লোকরা ফ্ল্যাটগুলো কিনে তালাবন্ধ করে ফেলে রেখেছে৷ এ জায়গা আরো বেশি ডেভলপ্ট হলে ফ্ল্যাটগুলো আরো বেশি দামে বেচে মুনাফা করবে বলে৷’

তাঁর কথা শুনে অনুকুলবাবু বললেন, ‘আমি কিন্তু পয়সাওলা লোক নয় মশাই৷ ছাপোষা মানুষ৷ অনেক কষ্ট করে ফ্ল্যাটটা কিনেছি৷ তাও কিনতে পারলাম কিছুটা সস্তায় পেলাম বলে৷ কিছুদিন বাদেই স্ত্রী পরিবার সমেত উঠে আসবে এখানে৷

সীতাংশুবাবু শুনে বললেন, ‘আমিও মশাই আপনারই মতো ছাপোষা মানুষ৷ গড়িয়াতে একটা বইয়ের দোকান ছিল৷ ওর থেকেই সংসার চালিয়ে পয়সা জমিয়ে ফ্ল্যাটটা কিনেছি৷ অনেক কষ্ট করতে হয়েছে এর জন্য৷’

অনুকুলবাবু হেসে বললেন, ‘তাহলে বলা যায়, আমরা একই নৌকার যাত্রী৷’

এরপর ভদ্রলোক চারপাশে তাকিয়ে বললেন, সারা বিল্ডিং-এর মধ্যে আপনার এই ফ্ল্যাটটা সবথেকে ভালো৷ চারতলা বলে উঠতে একটু কষ্ট ঠিকই, কিন্তু দক্ষিণ খোলা, বাইরে তাকালেই দূরে কী সুন্দর সবুজ চোখে পড়ে; চারতলা বলেই কেবেল টিভি, টেলিফোন বা ইলেকট্রিকের তার চোখের সামনে নাচবেনা৷ আকাশের চাঁদ, শরতের মেঘ, এই সব তারে আটকাবে না৷ জানলার পাশে শুয়ে উন্মুক্ত আকাশ দেখতে পারবেন৷’

অনুকুলবাবু বললেন, ‘ঠিক তাই৷ এ সবের জন্যই তো এ ফ্ল্যাটটা পছন্দ হল৷’

ভদ্রলোক জানতে চাইলেন, ‘তা কিছুদিন মানে ক-দিনের মধ্যে আসবেন এখানে?’

অনুকুলবাবু বললেন, ‘আমি যেখানে থাকি মশাই সেখান থেকে আজ উঠে আসতে পারলেই ভালো ছিল৷ তবে সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই চলে আসব৷ তার আগে ফ্ল্যাট কিছু খুচরো কাজ বাকি আছে৷ এই ধরুন এই ড্রইং-এ একটা প্লাইউডের দেওয়াল আলমারী বসাব, কিচেনে, বাথরুমে কিছু কাজ আছে, ইলেকট্রিকেরও আছে৷ এসব মিটলে তারপর মালপত্তর গুলো তো আনতে হবে, সাজাতে হবে, পুরানো দিনের ভারী ভারী জিনিস সব৷ কাল থেকেই এসব কাজের জন্য লোক লাগাব৷ কাঠ মিস্ত্রিও আসার কথা এখনই৷

তার কথা শুনে ভদ্রলোক বললেন, ‘হ্যাঁ, এ সব কাজ আপনারা আসার আগেই একেবারে করিয়ে নেওয়া ভালো৷’ তাঁর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই একটু শব্দ করে ঘরে ঢুকল একজন৷ তাকে দেখে অনুকুলবাবু বললেন, ‘এই যে কাঠের কাজের লোক এসে গেছেন৷’

সীতাংশুবাবু বললেন, ‘আপনি তবে কথা বলুন, আমি এখন আসি৷’

অনুকুলবাবু বললেন, ‘খুব ভালো লাগল আপনার সাথে কথা বলে৷ মিস্ত্রিরা কাজ করবে৷ কিন্তু আমি তো রোজ আসতে পারব না৷ অপিস আছে৷ সম্ভব হলে মাঝে মাঝে ওদের কাজ দেখে যাবেন৷ নিজের কাজ ভেবে দয়া করে প্রয়োজনে পরমামর্শ দেবেন৷ এখানে তো আর আমার আর অন্য কেউ পরিচিত নেই৷’

সীতাংশুবাবু বললেন, ‘আপনি এসব নিয়ে ভাববেন না, আমি নিশ্চই আসব৷’ এই বলে তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন৷

সীতাংশুবাবু চলে যাবার পর বেশ কিছুক্ষণ ধরে কাঠের কাজের লোককে কোথায় কী করতে হবে বুঝালেন৷ মালপত্র সমেত কাজের ফুল কনট্রাক্ট লোকটার৷ কাজ বুঝে নিয়ে সে চলে যাবার পর দরজা জানলা বন্ধ করে অনুকুলবাবু যখন নীচে নামলেন তখন বাইরে অন্ধকার নেমে গেছে৷ শহরতলীর এ জায়গা এখন বেশ ফাঁকা ফাঁকা৷ জলাজমি বুজিয়ে এই উপনগরী গড়ে তোলা হচ্ছে৷ শীতের বেলা, বাড়ি ফেরার বাস ধরার জন্য তাড়াতাড়ি বড়ো রাস্তার দিকে এগোলেন তিনি৷

কিছুটা এগোতেই রাস্তার পাশে একটা চায়ের দোকান৷ হেরিকেন জ্বলছে সেখানে৷ অনুকুলবাবু সে জায়গাতে আসতেই হঠাৎ দুজন লোক গুমটি ছেড়ে বেরিয়ে এল৷ তাদের একজন অনুকুলবাবুর উদ্দেশ্যে বলল, ‘দাদা কী ওই চারতলার ফ্ল্যাটটা কিনলেন?’

অনুকুলবাবু প্রশ্ন শুনে একটু থতোমতো খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে তাকালেন লোক দুটোর দিকে৷ তাদের পরনে চোঙা প্যান্ট, গায়ে টাইট শার্ট৷ একজনের হাতে বেশ কয়েকটা আংটি, আর অন্য জনের এক কানে একটা দুলও আছে৷ অনুকুলবাবু জবাব দিলেন, ‘হাঁ, কিনলাম৷ কিন্তু আপনাদের তো ঠিক চিনতে পারলাম না? দয়া করে যদি পরিচয়টা দেন?’

আংটি পরা লোকটা হেসে বলল, চিনবেন কী করে? আপনি নতুন এসেছেন৷ তবে এখানে আমাদের সবাই চেনে৷ আমি হলাম বঙ্কু, আর এ হল কেষ্ট৷ আমরা হলাম বিশিষ্ট সমাজসেবী সনাতন হালদারের লোক৷ পাড়ার ভালো মন্দের খবর রাখতে হয় তো, তাই জানতে চাইলাম আপনি ফ্ল্যাটটা কিনেছেন কিনা৷

কেষ্ট বলে লোকটা এরপর বলল, ‘দাদা, একটু চা খাবেন?’

অনুকুলবাবু হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘না, ভাই, আজ নয়, অন্য দিন খাব৷ বাসটা নইলে মিস হয়ে যাবে৷ খুব ভালো লাগল আপনাদের সাথে পরিচিত হয়ে৷ আবার নিশ্চই দেখা হবে৷ আমি তো আর কদিনে মধ্যেই চলে আসছি এখানে৷’

লোকদুটো এবার একসঙ্গে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেখা হবে৷ নিশ্চই দেখা হবে৷’

বাড়ি ফেরার তাড়া আছে৷ তাই অনুকুলবাবু আবার হন হন করে এগোলেন রাস্তার দিকে৷

মাঝে দু-দিন ফ্ল্যাটে আসতে পারেননি অনুকুলবাবু৷ এক সেট চাবি মিস্ত্রিদের কাছে দেওয়া৷ কাজ করছে তারা৷ এদিন শনিবার৷ অফিস ফেরতা বিকাল বেলা মিস্ত্রিরা কেমন কাজ করছে দেখার জন্য বিকালবেলা ফ্ল্যাটে এলেন অনুকুলবাবু৷ দিনের শেষে মিস্ত্রিরা তখন যন্ত্রপাতি গোছাচ্ছে বাড়ি ফেরার জন্য৷ ড্রইংরুমে ঢুকেই দেয়ালের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হয়ে মিস্ত্রিদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘দেওয়াল আলমারির ফ্রেম ডান দিকের দেওয়ালের বদলে বাঁ দিকের দেওয়ালে কেন! আমি তো তোমাদের বুঝিয়ে দিয়েছি কোথায় কী লাগাতে হবে?’

হেড মিস্ত্রি জবাব দিল, আপনি ডান দিকে বলেছিলেন ঠিকই, কিন্তু প্রথম দিন আপনার সাথে যে বাবু ছিলেন, যাকে আপনি আমাদের কাজ দেখতে বলেছিলেন, তিনি এসে বললেন, ওটা বাঁ দিকে লাগানোই ঠিক হবে৷’

তাদের কথা শুনে অনুকুলবাবুর এবার মনে পড়ে গেল সীতাংশুবাবুর কথা৷ অনুকুলবাবু তাকে প্রায় ভুলেই গেছিলেন৷ কিন্তু হঠাৎ এ সিদ্ধান্ত দিতে গেলেন কেন? মনক্ষুন্ন হলেন অনুকুলবাবু৷ কিন্তু মিস্ত্রিদের তিনি কিছু বললেন না৷ সে অর্থে তাদের কোনো দোষ নেই৷ প্রথম দিনতো তাদের সামনেই তিনি ভদ্রলোকে মিস্ত্রিদের কাজ দেখতে বলেছিলেন৷ তবে এখন আর ফ্রেমটা খোলা যাবে না৷ দেয়াল ফুটো করা হয়েছে৷ রঙ চটা হয়ে যাবে জায়গাটা৷ কাজেই ওটা ওখানেই করতে হবে৷ এরপর সামান্য কিছু কথা বলে মিস্ত্রিরা ফ্ল্যাট থেকে বেড়িয়ে গেল৷ আর তার পরপরই সীতাংশুবাবু ফ্ল্যাটে ঢুকলেন৷

অনুকুলবাবুর দিকে তাকিয়ে হেসে তিনি বললেন, ‘আপনি নিশ্চই অবাক হয়ে গেছেন যে আমি কেন দেওয়াল আলমারিটা বা দিকে লাগাতে বললাম বলে? মিস্ত্রিরা বলল, ‘কাঁচ বসানো পাল্লা হবে৷ ভেবে দেখুন জানলা দিয়ে কিন্তু সোজা রোদ এসে পড়ে ডানদিকের দেওয়ালে৷ ভিতরে কোনো রঙিন জিনিস থাকলে রোজ রোদ পড়ে তার রঙ ঠিক নষ্ট হয়ে যাবে৷ বাঁ দিকে সে সমস্যা হবে না৷’ ঠিকইতো বলেছেন ভদ্রলোক৷ এ ব্যাপারটা চিন্তা করেননি অনুকুলবাবু৷ তিনি বললেন, ‘ভালোই করেছেন ওদের ব্যাপারটা বলে৷ এটা আমার মাথায় আসেনি৷’

সীতাংশুবাবু প্রথমে তাঁর কথা শুনে আত্মপ্রসাদের হাসি হাসলেন৷ তারপর বললেন, ‘ড্রইংটা কী ভাবে সাজাবেন বলি৷ ড্রইং এর মাঝখানে একটা পাঁচ ফুট বাই চারফুট ছোটো কার্পেট, তার ওপর একটা কাঠের টি টেবিল৷ আর তাকে ঘিরে একটা সোফাসেট৷ পূব দিকের দেওয়ালে একটা এলসিডি-টিভি, পশ্চিমের দেওয়ালে একটা যামিনী রায় বা রবীন্দ্রনাথের পেন্টিং৷ কাঁচের দেওয়াল আলমারীর দুটো র‌্যাকে বই, সোপিস, ফটোফ্রেম ইত্যাদি৷ দরজার কোণে একটা বাঁকুড়ার ঘোড়া, অথবা ধাতুর তৈরি একটা পরি বা গণেশ৷ বেশ ছিমছাম একটা ড্রইংরুম৷’

ভদ্রলোক এমন ভাবে কথাগুলো বললেন, যেন তিনি নিজের ড্রইংরুম সাজানোর কথা বলছেন!

সীতাংশুবাবুর কথা শুনে অনুকুলবাবু বললেন, ‘আপনি ভালোই বলেছেন, কিন্তু আগে একান্ত প্রয়োজনীয় যে কাজগুলো করতে হবে সে ধাক্কা সামলে নেই৷ এ সবের জন্যই ধার করতে হবে বলে মনে হয়৷ তারপর কী হবে দেখি?’

সীতাংশুবাবু বললেন, ‘হবে, হবে, ধীরে ধীরে সব হয়ে যাবে৷ অতো ভাববেন না, ফ্ল্যাটটাই যখন হল, তখন ধীরে ধীরে সব হবে৷’

সীতাংশুবাবু এরপর বললেন, ‘তাহলে এবার আমি আসি? আবার দেখা হবে৷’

অনুকুলবাবু বললেন, ‘আচ্ছা আপনার ফ্ল্যাট কোনটা? আর আপনার ফোন নম্বরটা যদি দেন?’

সীতাংশুবাবু কয়েকমুহূর্তে চুপ থেকে জবাব দিলেন, ‘আপনার ফ্ল্যাটের ঠিক উল্ট দিকের ফ্ল্যাট৷ তবে সেটা সারাদিন তালাবন্ধই থাকে৷ আমি তো সারাদিন বাইরে বাইরে থাকি৷ আমার পরিবার আসেনি এখানে৷ আর কোনো ফোনও আমার নেই৷ তবে যোগাযোগের কোনো অসুবিধা হবে না৷ আমি আসব৷ এ কথা বলে অনুকুলবাবুকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেলেন তিনি৷ অনুকুলবাবু তারপর দরজাটা বন্ধ করে ফ্ল্যাটটা ঘুরেঘুরে দেখতে দেখতে কোথায় কী করা যায় ভাবতে লাগলেন৷ পরদিন থেকে ইলেকট্রিক মিস্ত্রিরাও কাজ করবে৷ কাল রোববার তাদের নিয়ে সকালের দিকে একবার অনুকুলবাবু ফ্ল্যাটে আসবেন কাজ বোঝাতে আসবেন৷ তারপর আবার তিনি আসবেন তিন দিন পর ইলেকট্রিকের কাজ বুঝে নিতে৷

অনুকুলবাবু মনে মনে এসব পরিকল্পনা করছিলেন৷ হঠাৎ দরজাতে টোকা দেবার শব্দ হল৷ সীতাংশুবাবু আবার ফিরে এলেন নাকি?

অনুকুলবাবু দরজা খুললেন৷ না, সীতাংশুবাবু নয়, দাঁড়িয়ে আছে দু-জন লোক৷ কেমন যেন চেনা লাগছে তাদের?

অনুকুলবাবুর সন্দেহ কাটিয়ে একজন লোক বলল, ‘চিনতে পারছেন? সেদিন সন্ধ্যায় চায়ের দোকানের সামনে দেখা হল? আমি বঙ্কু আর এ কেষ্ট৷ আপনার খোঁজ নিতে এলাম৷ এটা আমাদের সামাজিক কর্তব্যর মধ্যে পড়ে৷ আপনার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো? তেমন কিছু হলে আমদের জানাবেন৷’

অনুকুলবাবু এবার তাদের চিনতে পেরে হেসে বললেন, ‘না, কোনো অসুবিদা হচ্ছে না৷ এখানে নতুন আসছি, আপনারাইতো ভরসা৷ তেমন কিছু হলে অবশ্যই জানাবো৷’

কেষ্ট বলে লোকটা এরপর বলল, ‘একটা কথা ছিল দাদা৷ জানেনতো আমার সমাজসেবা করি৷ এই ধরুন গিয়ে বেলাড ডোনেশন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, দুস্থদের জামাকাপড় বিলি…৷ এ জন্য কিছু চাঁদা দিতে হবে আপনাকে৷’

অনুকুলবাবু এবার তাদের আসার আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারলেন৷

তা নতুন পাড়ায় এলে এমন দু-পাঁচশো টাকা চাঁদা দিতে হয় বলে শুনেছেন অনুকুলবাবু৷ তাই তিনি একটু ভেবে নিয়ে বললেই, ‘আপনারা যখন সমাজসেবার কাজ করেন তখন অবশ্যই দেব৷ আমি এদিকটা একটু সামলে নেই৷ মিস্ত্রি কাজে লেগেছে৷ আপনারা বরং বিষ্যুৎবার বিকালে আসুন৷ তখন দেব৷’

বঙ্কু বলে লোকটা অনুকূলবাবুর কথা শুনে পানমশালা খাওয়া দাঁত বার করে হেসে বলল, ‘ঠিক আছে আমাদের কোনো তাড়া নেই৷ আপনি তো আর পালিয়ে যাচ্ছেন না৷ আর আমরাও পালাচ্ছি না৷ বিষ্যুৎবারই আমরা আসব৷ গুড বাই দাদা৷’

পরিকল্পনা মাফিক রবিরার সকালে ইলেকট্রিক মিস্ত্রিদের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে গেছিলেন অনুকুলবাবু৷ তারপর তিনি আবার এসে হাজির হলেন বৃহস্পতিবার৷ কিন্তু ঘরে ঢুকে ইলেকট্রিক মিস্ত্রিদের কাজ দেখে অবাক হয়ে গেলেন তিনি৷ দেওয়ালের যেখানে বাকেট, সুইচবোর্ড ইত্যাদি লাগাবার কথা, বাথরুমে, কিচেনে সে সবজায়গাতে প্ল্যাগ পয়েন্ট ইত্যাদি করার জন্য তিনি দেখিয়ে দিয়ে গেছিলেন, তা সব অন্যদিকে, অন্য জায়গাতে বসানো হয়েছে!

বিস্মিত অনুকুলবাবু ইলেকট্রিক মিস্ত্রিকে বললেন, ‘তোমাদের তো কোথায় কী করতে হবে তা দেখিয়ে দিয়ে গেছিলাম৷ তোমরা তোমাদের খেয়াল খুশি মতো সব লাগিয়েছো কেন?’

মিস্ত্রি বলল, ‘এক বাবুতো রোজ দুপুরবেলা এসে আমাদের কাজের তদারকি করতেন, আজ দুপুরেও তিনি এসেছিলেন৷ তিনি বললেন, আপনি তাঁকে আমাদের কাজের তদারকি করতে বলেছেন৷ তিনি যখন যেমন বলেনে, তেমন তেমনই আমরা করেছি৷’

আবার সেই দেওয়াল আলমারীর মতো ঘটনা! এবার স্পষ্টতোই সীতাংশুবাবুর ওপর অসন্তুষ্ট হলেন অনুকুলবাবু৷ বাড়িটাতো অনুকুলবাবুর, সীতাংশুবাবুর নয়৷ এ ধরনের নির্দেশ দেবার আগে সীতাংশুবাবুর ব্যাপারটা মাথায় রাখা উচিত ছিল৷ আর এখন কিছু করা নেই৷ কাজ শেষ মিস্ত্রিদের৷

আর এরপরই ইল্কেট্রিক মিস্ত্রি বলে উঠল ‘এইতো বাবু চলে এসেছেন, ওনাকে জিজ্ঞেস করুন যে আমরা ওনার কথা মতো কাজ করেছি কিনা?’

অনুকুলবাবু ফিরে তাকিয়ে দেখলেন সীতাংশুবাবু ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন৷ মুখে একগাল হাসি৷ মিস্ত্রিদের সামনে তাঁকে কিছু বলা সমিচিন হবে না মনে করে তিনি তাদের বললেন, ‘ঠিক আছে তোমরা এখন যাও৷’

মিস্ত্রিরা ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে যাবার পর অনুকুলবাবু বেশ একটু উষ্মা প্রকাশ করে সীতাংশুবাবুকে বললেন, ‘আপনি আমাকে না জিজ্ঞেস করে মিস্ত্রিদের এ ভাবে কাজ করতে বলেছেন কেন?’

অনুকুলবাবু যেন তার উষ্মা গায়েই মাখলেন না, তিনি হেসে বললেন, ‘ভেবে দেখুন, আপনি যদি সুইচবোর্ডটা ওই পূব দিকে জানলার পাশে বসান, তবে অসতর্ক মুহূর্তে সুইচ টিপতে গিয়ে জানলার কোণায় বাড়ি খেতে পারেন, লাইটের বাকেট যেখানে বসাতে বলেছিলেন সেখানে রান্না ঘরের ধোঁয়া লেগে ঝুল জমবেই৷ আর গিজারের প্ল্যাগ পয়েন্টটা? আপনার দেখানো জায়গাতে বসালে, শাওয়ার খুললে সেখানে জলের ছিটা পড়তই পড়ত…৷

বেশ কিছুক্ষণ ধরে সীতাংশুবাবুর যুক্তি সাজিয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে গেলেন কেন তিনি ওই সব নির্দেশ মিস্ত্রিদের দিয়েছেন সে প্রসঙ্গে৷ তারপর অনুকুলবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী আমি ঠিক বললাম কিনা?’

সীতাংশুবাবু হয়তো সঠিক কথাই বলছেন, তবে তা অনুকুলবাবুকে জানান উচিত ছিল৷ বাড়িটা তো অনুকুলবাবুর৷ মনে একটু ক্ষোভ হলেও অনুকুলবাবু কাউকে চট করে কটু কথা বলতে পারনে না৷ তাছাড়া এখন যা হবার হয়ে গেছে৷ তাই তিনি মনের অসন্তাোষ আর তেমনভাবে প্রকাশ না করে শুধু বললেন, ‘ঠিক আছে৷ তবে আপনার পরিকল্পনা আমাকে আগাম বললে ভালো করতেন৷’

অনুকুলবাবু এরপর এই ভেবে মনেমনে আশ্বস্ত হলেন যে কাঠের কাজ, ইলেকট্রিকের কাজ শেষ, সীতাংশুবাবু এ ব্যাপারে আর কোনো নির্দেশ দিয়ে গোলোযোগ পাকাতে পারবেন না৷

সীতাংশুবাবু কিন্তু তারপর আর দাঁড়ালেন না৷ যেমন হট করে এসেছিলেন তেমনই হট করে ‘যাই’ বলে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেলেন৷ অনুকুলবাবু মনে মন ভাবলেন, লোকটা বড়ো অদ্ভুত! নইলে পরের ফ্ল্যাট নিয়ে কেউ এমন মাথা ঘামায়!’

আর এর কিছুক্ষণের মধ্যে দরজায় ঠোকা দেবার শব্দ শুনে তিনি দরজা খুলে দেখলেন সেই বঙ্কু আর কেষ্ট বলে দুজন এসে হাজির হয়েছে৷ বঙ্কু তাঁর উদ্দেশ্যে বলল, ‘আজ আপনি আমাদের আসতে বলেছিলেন, আমরা কথার খেলাপ করি না৷’

অনুকুলবাবু হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ আমার খেয়াল আছে৷ তারপর হেসে পকেট থেকে দুটো পাঁচশো টাকার নোট বার করে তাদের দিকে এগিয়ে দিলে বললেন, ‘এই নিন আপনাদের টাকা৷’

লোকদুটো টাকা দেখে একবার পরস্পরের মুখ চাওয়াচায়ি করার পর বলল, ‘এ কী দিচ্ছেন দাদা! এতে তো শ্মশানযাত্রার ধূপকাঠিও কেনা যাবে না৷’

অনুকুলবাবু তাদের কথায় বিব্রত বোধ করে বলল, ‘ইয়ে মানে কত দিতে হবে তাহলে?’

বঙ্কু বলল, ‘টপ ফ্লোরতো, তার ওপর লিফট নেই৷ আমরা অবিবেচক নই, দশ হাজার দিলেই হবে৷ গ্রাউন্ড ফ্লোর হলে বিশ হাজার নিতাম৷’

দশ হাজার! কী বলছে এ লোকগুলো! অনুকুলবাবু বিস্মিত হয়ে গেলেন তাদের কথা শুনে৷ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললেন, ‘কিন্তু দাদা, আমার তো অতো টাকা দেবার সামর্থ নেই৷ আমি সামান্য চাকরি করি৷ সারা জীবন টাকা জমিয়ে অনেক কষ্টে এই ফ্ল্যাটটা কিনেছি৷’

এ কথা শোনার পর কেষ্ট বলল, ‘বেশি তো চাইনি দাদা৷ মাত্র ওয়ান পার্সেন্ট৷ দশলাখের ফ্ল্যাটে দশ হাজার ওয়ান পার্সেন্টই হয়৷ আমরা তো শুনেছি দশলাখ নয়, আসলে আপনি সাত লাখে কিনেছেন ফ্ল্যাটটা৷ ওদিকে তিনলাখ বেঁচে গেছে আপনার৷ ধরে নিন ওই বেঁচে যাওয়া টাকা থেকে দশ হাজার টাকা আপনি সমাজ সেবায় দান করছেন৷ লোক দুটো যে খবরাখবর নিয়েই এসেছে তা বুঝতে পারলেন অনুকুলবাবু৷ ফ্ল্যাটটা অনেকদিন পড়ে ছিল বলে সত্যিই প্রমোটার সাতলাখে ছেড়ে দিয়েছে ফ্ল্যাটটা৷ অনুকুলবাবু তাদের কী বলবেন বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলেন৷ তাকে চুপ দেখে বঙ্কু এবার বলল, ‘ঘাবড়াবেন না দাদা৷ দরকার হলে বারোমাস ধরে হাজার টাকা করে ইনস্টলমেন্টে দেবেন৷ সেক্ষেত্রে দু-হাজার টাকা বেশি দিতে হবে আপনাকে৷ আপনার জন্য এটুকু আমরা করতে পারি৷ অনুকুলবাবু বিড়বিড় করে বললেন, ‘আমার যা ছিল সবই এই ফ্ল্যাট কিনতে ঢেলেছি৷ এখনও অনেক খরচ বাকী৷ অত টাকা দেবার ক্ষমতা আমার নেই৷’

কেষ্ট বলল, ‘টেনশন করবেন না দাদা৷ ওতে শরীর খারাপ হবে৷ ধরে নিন প্রমোটারের কাছে দশ হাজার বাকি আছে আপনার৷ সেটাই আপনি দিচ্ছেন৷’

বঙ্কু বলল, ‘গ্রাউন্ড ফ্লোরের সাহা বাবুকে জিজ্ঞেস করে দেখুন একবার৷ আমরা বিশ চাইতেই উনি ঝক্কাস করে তিরিশ বার করে দিয়েছিলেন৷ অবশ্য তার লাভটাও হাতেনাতে পেয়েছিলেন কিছুদিনের মধ্যে৷ সাহাবাবুর লোহার ব্যবসা৷ অকশনে লোহা কেনেন৷ সেবার যখন কানকাটা কানুর দলবল ওর ওপর রাস্তার মোড়ে হামলা চালাল তখন পাড়ার শান্তি বজায় রাখতে, প্রতিবেশীকে বাঁচতে আমরাই তো এগিয়ে এলাম৷ দুটো পেটো সব পাতলা৷ পানু আর ভয়ে এ পাড়ায় ঢোকেনা৷’

তাদের কথা শুনে অনুকুলবাবু ঢোক গিলে বললেন, ‘আমার কাছে সত্যি টাকা পয়সা তেমন নেই৷ তবু আমি একবার ভেবে দেখি, আপনাদের সমাজসেবায় আমি কী সাহায্য করতে পারি…’

বঙ্কু তার ডান কানের সোনার দুলে হাত বুলিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, ভাবুন৷ টেনশন লেনে কা নেহি৷ দেনে কা হ্যায়, ভালো থাকবেন৷ আমরা, পরে একদিন আসব৷’— এই বলে ল্যান্ডিং ছেড়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেল তারা৷ অনুকুলবাবু দরজার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন৷ তারপর তার হঠাৎ মাথায় এল সীতাংশুবাবুকে ব্যাপারটা জানালে কেমন হয়? তিনি তাকালেন উলটো দিকের ফ্ল্যাটের দরজার দিকে৷ কিন্তু সে দরজা বাইরে থেকে তালাবন্ধ৷ ভদ্রলোকের আবার ফোন নম্বরই নেই৷ কাজেই তাকে ধরতে পারলেন না অনুকুলবাবু৷

মাঝে তিনদিন কেটে গেল৷ ফ্ল্যাটে কাঠ আর ইলেকট্রিকের যা কাজ ছিল তা শেষ হয়ে গেছে৷ এবার ফার্নিচারগুলো পাঠাবার পালা৷ অনুকুলবাবুর সাথে আর যোগাযোগ হয়নি সীতাংশুবাবুর৷ তথাকথিত সেই সমাজ সেবক, যাদের ‘দুটো পেটোতে সবপাতলা’ তাদের ব্যাপারে দু-জারজন অফিস কলিগ, আর পরিচিতজনদের সাথে অলোচনা করেছিলেন অনুকুলবাবু৷ সবাই তাঁকে পরামর্শ দিয়েছেন নতুন জায়গাতে গিয়ে ওধরনের লোকদের সাথে ঝামেলা করে লাভ নেই৷ তবে দশ হাজার নয়, ওরা অমন বেশি ডিমান্ড করে থাকে, ওদের সাথে ঠিকমতো দর কষাকষি করতে পারলে শেষ পর্য্যন্ত নাকি ওরা চার পাঁচেই রাজী হয়ে যাবে৷ এইতো সীতাংশুবাবুর ভায়রা যখন সোনারপুরে বাড়ি কিনেছিল তখন স্থানীয় ক্লাবের ছেলেরা এল সিডি টিভি চেয়েছিল, শেষ পর্যন্ত রফা হল পোর্টেবল টিভিতে৷ অনুকুলবাবু ঠিক করেছেন তিনি চার, খুব বেশি হলে পাঁচ হাজার পর্যন্ত উঠবেন৷ এ টাকা দেবার জন্যই অবশ্য অপিসের কো-অপারেটিভ থেকে লোন করতে হবে তাঁকে, মন না চাইলেও বাধ্য হয়ে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি৷

একদিন সকালে অনুকুলবাবু ‘প্যাকার্স’ নামে এক কোম্পানীকে দিয়ে একটা খাট আর কিছু আসবাবপত্র পাঠিয়ে দিলেন তাঁর ফ্ল্যাটে৷ আজকাল প্যাকার্সের মতো বেশ কিছু কোম্পানী গড়ে উঠেছে কলকাতাতে৷ যারা শিফটিং-এর সময় মালপত্র একবাড়ি থেকে নিয়ে অন্য বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে৷ জিনিসগুলোকে নির্দিষ্ট স্থানে বসিয়েও দেয়৷ ঝামেলা এড়াতে তাই প্যাকার্সের শরণাপন্ন হয়েছিলেন অনুকুলবাবু৷ দুপুরবেলা প্যাকার্সের লোকজন চাবি ফেরত দিয়ে পেমেন্ট নিয়ে যাবার সময় জানিয়ে দিয়ে গেলে যে অনুকুলবাবুর কথা মতো তার ফ্ল্যাটে গিয়ে জিনিসগুলো তারা যথাস্থানে বসিয়ে এসেছে৷ বিকালবেলা তাঁর জিনিসপত্রগুলো সত্যিই ঠিকঠাক পৌঁছেছে কিনা তা দেখার জন্য তার ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন অনুকুলবাবু৷

রাস্তা জ্যাম ছিল৷ অনুকুলবাবু যখন ফ্ল্যাটের দরজায় পৌঁছলেন ঠিক তখনই বাইরে ঝুপ করে শীতের সন্ধা নামল৷

অনুকুলবাবু দরজা খুলে ফ্ল্যাটের ভিতরে ঢুকলেন৷ ড্রইংরুমে আপাতত তিনি একটা বুক সেলফ রাখবেন৷ সেটা তার বলে দেওয়া জায়গা মতো ঠিকঠাক লোকগুলো বসিয়েছে বলে অনুকুলবাবু বেশ খুশি হলেন৷ ছোটো বেডরুমের দরজার পাশে স্টিলের আলমারিটাও ঠিকমতো রেখেছে তারা৷ কিন্তু বড়ো বেডরুমে ঢুকেই অনুকুলবাবু থমকে গেলেন৷ খাটটাকে উত্তর দিকের জানলার পাশে রাখতে বলেছিলেন তিনি৷ সেটা লোকগুলো রেখে গেছে দক্ষিণের দেওয়ালের গায়ে! মূহূর্তের মধ্যে অনুকুলবাবুর মনে একটা সন্দেহ উঁকি দিল৷ সঙ্গেসঙ্গে তিনি মোবাইল বার করে ফোন করলেন প্যাকার্সে৷ অনুকুলবাবু যা ভেবে ছিলেন ঠিক তাই৷ কোম্পানীর লোক বলল, ‘খাটটা আমরা জানলার পাশেই বসাতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু আপনার বাড়ির একজন লোক এসে বললেন খাটটা জানলার পাশে নয়, দক্ষিণের দেওয়ালের গায়ে বসাতে৷’

অনুকুলবাবু বললেন, ‘আপনাদের সাথে আমার কথা হয়েছে, আপনারা একবার আমাকে জিজ্ঞেস করবেন তো?’ প্যাকার্সের লোক জবাব দিল, আমরা ভেবেছি আপনি ব্যাপারটা জানেন৷ ওই ভদ্রলোক আবার এও বললেন যে তাঁর নাকি ব্রঙ্কাইটিসের ধাত আছে৷ শীতকালে উত্তরের জানলার পাশে খাট থাকলে তাঁর সে সমস্যা বাড়বে৷ আপনাদের পারিবারিক সমসা আপনারা নিজেরা মিটিয়ে নিন৷’ এই বলে সম্ভবত বিরক্ত হয়েই ফোনের লাইন কেটে দিল প্যাকার্সের লোকটা৷

ফোন হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো খাটের দিকে চেয়ে রইলেন অনুকুলবাবু৷ জিনিসটাকে খাট বলা হলেও সেটা আসলে অনুকুলবাবুর ঠাকুরদার আমলের একটা বিশাল ভারী পালঙ্ক৷ সেটাকে ঠেলে সরানো দু-চারজন লোকের কম্ম নয়৷ খোলা, সেট করতেও অনেক হাঙ্গাম৷ তার জন্যও লোক ডাকতে হবে৷ এদিকে অনুকুলবাবুর স্ত্রী আবার বাস্তুশাস্ত্র মানেন৷ তিনি অনুকুলবাবুকে পইপই করে বলে দিয়েছিলেন পালঙ্ক যেন দেওয়াল ঘেষে না রাখা হয়৷ গৃহপ্রবেশের দিন এ ব্যাপারটা তার চোখে পড়লেই ঝামেলার এক শেষ! অনুকুলবাবু এবার সত্যিই চটে গেলেন সীতাংশুবাবুর ওপর৷ অনেক হয়েছে, আর নয়, লোকটা শেষে তার বেড়রুমেও হানা দিচ্ছে! এ রকম কিছু লোক থাকেন যারা অন্যের ব্যাপারে নাক গলাতে ভালোবাসেন৷ আর কদিনের মধ্যেই অনুকুলবাবুর পুরো পরিবার উঠে আসছে ফ্ল্যাটে৷ হয়তো তখন তিনি অযাচিত ভাবে এমন কিছু করে বসবেন যাতে তাঁর পরিবারে অশান্তি শুরু হবে৷ তার আগেই লোকটাকে থামাতে হবে৷ এসব কথা ভাবতে ভাবতে উত্তেজিত হয়ে উঠলেন অনুকুলবাবু৷ আর এর কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন সীতাংশুবাবু৷

সীতাংশুবাবু প্রতিদিনের মতোই অনুকুলবাবুর উদ্দেশ্য প্রথমে হাসলেন৷ অনুকুলবাবু কিন্তু তাঁকে দেখে হাসলেন না৷ ভদ্রলোক তা দেখে জানতে চাইলেন, ‘আপনার মুখ এত গম্ভীর কেন? কিছু হয়েছে নাকি?’

অনুকুলবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, হয়েছে৷ আপনি যারা ফার্নিচার সাজাতে এসেছিল তাদের পালঙ্কটা দেওয়াল ঘেষে রাখতে বলেছিলেন?’

‘ও এই ব্যাপার৷ আমি ভাবলাম অন্য কিছু হয়েছে৷ জানলার পাশে খাট রাখলে শীতকালে উত্তরের বাতাস লাগবে যে৷’ এই বলে হাসলেন সীতাংশুবাবু৷

কিন্তু সীতাংশুবাবুর এই হাসিটাই মনে হয় আগুনে ঘৃতাহুতির কাজ করল৷ অনুকুলবাবু উত্তেজিত ভাবে বলে উঠলেন, ‘আপনি মশাই কী ভেবেছেন বলুন তো? আপনি এসব নির্দেশ দেবার কে? কেন এভাবে অন্যর ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছেন?’

একথা শুনে হাসি মিলিয়ে গেল সীতাংশুবাবুর৷ তিনি আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করলেন, ‘আমি তো এ ফ্ল্যাটটাকে নিজের মতো ভেবেই, যাতে ভালো হয় তাই করতে বলেছি…

এতে অনুকুলবাবু আরও ক্ষেপে চিৎকার করে উঠলেন, ‘অন্যের বাড়িকে নিজের বাড়ি ভাবলেই হল? এ বাড়িটা আপনার নয়, আমার৷ অনেক কষ্ট করে নিজের পয়সা খরচ করে কিনেছি৷ দোহাই আপনার, আপনি আর আমার ব্যাপারে নাক গলাতে আসবেন না৷ মনে রাখবেন এ বাড়িটা আমার আমার…’ এই শেষ ‘আমার’ শব্দটা বেশ জোর দিয়ে বললেন অনুকুলবাবু৷

সীতাংশুবাবুর মাথাটা বুকের কাছে নেমে এলো৷ একবার যেন তিনি অস্পষ্ট ভাবে বললেন, ‘হ্যাঁ, তাইতো, বাড়িটাতো আপনারই… তারপর ধীরে ধীরে পা ফেলে বাইরের ব্যালকনির অন্ধকারে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি৷

একটা থমথমে পরিবেশের সৃষ্টি হল৷ এর আগে কোনো ভদ্রলোকের সাথে এমন রুঢ় ব্যবহার করেননি অনুকুলবাবু৷ নিজের ব্যবহারেও বেশ হতভম্ব তিনি৷ সীতাংশুবাবু অন্ধকারে দাঁড়িযে আছেন৷ তাঁকে এরপর কী বলা উচিত ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না অনুকুলবাবু৷ ঠিক এই সময় দরজায় ক্যাঁচ করে একটা শব্দ হল৷ দরজা ঠেলে ড্রইংরুমে প্রবেশ করল সেই সমাজসেবীদ্বয়৷ বঙ্কু নামের লোকটা অনুকুলবাবুর উদ্দেশ্যে হেসে বলল, ‘দাদা আমরা এসে গেছি৷’

অনুকুলবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, আসুন৷ তারপর আর বাক্য ব্যায় না করে পকেট থেকে টাকা বার করে এগিয়ে দিলেন৷

বঙ্কু টাকাটা হাতে নিয়ে গুনে বলল, ‘ও বুঝেছি, চার হাজার করে বছরে তিনটে ইনস্টলমেন্টে বারো হাজার, তাইতো?’

অনকুলবাবু বললেন, ‘না, ইনস্টলমেন্ট নয়৷ ওটাই দিলাম৷’

কেষ্ট বলল, ‘কী দিচ্ছেন দাদা! মাত্র চার হাজার!’

অনুকুলবাবু লোকগুলোর সাথে বেশি কথা বলতে ইচ্ছা করছে না৷ তিনি পকেট থেকে আর একটা হাজার টাকার নোট বার করে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এটাই আমার শেষ সামর্থ৷ এটা রাখুন৷ আর সম্ভব নয়৷’

বঙ্কু বলল, ‘কিন্তু আমাদের রেট দশ হাজার৷ ওটা দিতে হবে আমাদের৷’

অনুকুলবাবু বললেন, ‘বললাম তো আর সম্ভব নয়৷’

তাঁর কথা শুনে বঙ্কুর পাশে দাঁড়ানো কেষ্ট বঙ্কুর উদ্দেশ্যে বলল, ‘দেখছিস কী ভিখারী পার্টিরে বাবা!’

সীতাংশুবাবুর ব্যপারটায় এমনিতেই মেজাজটা খারাপ হয়ে ছিল অনুকুলবাবুর৷ ‘ভিখারী’ শব্দটা কানে যেতেই তিনি আর নিজেকে সামলাতে না পেরে বলে উঠলেন, ‘ভিখারী আমি না আপনারা? আপনারাইতো ভিক্ষা করতে বেড়িয়েছেন৷ সমাজসেবা করতে হলে নিজেদের পয়সাতে করুন৷ ও টাকা নিলে নিন, নইলে যান এখান থেকে, আমাকে শান্তি দিন৷’

তাঁর কথা শুনে বঙ্কু বলে উঠল, ‘আপনাকে শান্তি দেবার জন্যই তো টাকা চাচ্ছি৷ দশ হাজার না দিলে বরং এখন অশান্তি শুরু হবে৷’

অনুকুলবাবুও উত্তেজিত ভাবে বলে উঠলেন, ‘আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন? কী অশান্তি হবে শুনি?’

বঙ্গু আর তার সঙ্গী কেষ্ট এবার হেসে উঠল৷ আর এরপরই হঠাৎ কেষ্টর হাতে কোমড়ের নীচ থেকে উঠে এল একটা লম্বা ছুরি! সে ছুরিটা অনুকুলবাবুর নাকের ডগায় নাচিয়ে বলল, ‘কী অশান্তি হবে তা টাকা না দিলে বুঝবেন৷ টাকা বার করুন৷’

অনুকুলবাবু এবার ভয় পেয়ে গিয়ে বললেন, ‘আপনারা এসব কী করছেন? আমি কিন্তু চেঁচিয়ে লোক জড়ো করব৷’

বঙ্কু নামের লোকটা হিসহিস করে বলে উঠল, ‘চেঁচান৷ এ ফ্লোরে কেউ থাকে না৷ আপনাকে কেউ বাঁচাতে আসবে না৷’ এই বলে সে খামচে ধরল অনুকুলবাবুর জামার কলার৷ অনুকুলবাবু আতঙ্ক চিৎকার করে উঠলেন, ‘এ সব আপনারা কী করছেন?’

বঙ্কু অট্টহাস্য করে বলে উঠল, ‘যত জোরে ইচ্ছা চেঁচান, বললাম না কেউ আসবে না৷’

ঠিক এই সময় একটা গলা শোনা গেল— ‘কেউ একজন আসবে৷’

বারান্দা ছেড়ে ঘরে ঢুকেছেন সীতাংশুবাবু৷ অনুকুলবাবু এতক্ষণ তার উপস্থিতির ভুলেই গেছিলেন৷ তাঁর গলা শুনে কেষ্ট বলে উঠল, ‘কেরে তুই? তারপর পিছন ফিরে তাকাল সীতাংশুবাবুর দিকে৷

কিন্তু তার পরমুহূর্তেই একটা বিস্ময়ের ভাব ফুটে উঠল তার মুখে৷ বঙ্কুও ফিরে তাকাল সীতাংশুবাবুর দিকে৷ তার চোখে মুখেও ফুটে উঠল একই রকম ভাব৷ আর এরপরই সীতাংশুবাবু ধীরে ধীরে এগোতে লাগলেন তাদের দিকে৷

বঙ্কুর হাতটা খসে পড়ল অনুকুলবাবুর কলার থেকে৷ বিস্মিত অনুকুলবাবু খেয়াল করলেন, বিস্ময় নয়, কেমন যেন একটা আতঙ্কর ভাব ‘জেগে উঠতে শুরু করেছে বঙ্কু আর কেষ্টর মুখে৷ তারা দরজার দিকে পিছু হঠাতে শুরু করেছে৷ কিন্তু এরপরই সীতাংশুবাবু ক্ষীপ্র গতিতে গিয়ে দরজা আগলে দাঁড়ালেন৷ কেষ্ট এবার একটা ভয়ঙ্কর কাজ কল৷ অনুকুলবাবু তা দেখে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠেলেন৷ কেষ্ট ছুরিটা সজোরে ছুড়ে মারল সীতাংশুবাবুকে৷ সেটা তাঁর পাঁজরে গিয়ে আমুল বিদ্ধ হল!

অনুকুলবাবু ভয় পেয়ে গেলেও সীতাংশুবাবু কিন্তু হেসে উঠলেন৷ তারপর কিছুই যেন হয়নি এমনভাবে ছুরিটা পাঁজর থেকে টেনে খুলে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে এগোতে লাগলেন বঙ্কু আর কেষ্টর দিকে৷ এবার উলটে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল তারা দুজন৷ দুজনেরই মুখ যেন ভয়ে রক্তশূন্য হয়ে গেছে! সীতাংশুবাবু এগাচ্ছেন তাদের দিকে৷ তিনি তখন তাদের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন এমন সময় তারা দুজন প্রবল আতঙ্কে ছুটল অন্ধকার ব্যালকনির দিকে৷ তারপর ব্যালকনির রেলিং টপকে চারতলা থেকে সটান ঝাপ মারল নীচে৷ ব্যালকনির অন্ধকার থেকে ভেসে এল তাদের আর্তনাদ৷

অনুকুলবাবু হতভম্ব৷ ব্যাপারটা কী হল তার বোধগম্য হচ্ছে না! সীতাংশুবাবু ফিরে তাকালেন অনুকুলবাবুর দিকে৷ তারপর বললেন, ‘একটা মানুষ কত কষ্ট করে, কত আশা নিয়ে ঘরবাড়ি করে তা জানি৷ আর এই লোকগুলো তাদের শান্তি কেড়ে নেয়৷’

আর এরপর তিনি হেসে বললেন, ‘আপনাকে আমি অনেক বিব্রত করেছি৷ আসলে আমিও ফ্ল্যাটটাকে সত্যিই নিজের বলে ভাবতে শুরু করেছিলাম৷ তাই কিছু ভুল করে ফেলেছি৷ ক্ষমা করবেন আমাকে৷ এবার আপনি পরিবার নিয়ে এখান শান্তিতে থাকুন৷ আমি চলি৷ ভয় নেই, ওরা আর আসবে না৷ আমরা কেউ আর আসব না৷

বিস্মিত হতভম্ব অনুকূলবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওই গুন্ডাগুলো আপনাকে দেখে এমন ভয় পেল কেন বলুন তো? আপনি কী ম্যাজিশিয়ান, নাকি কোনো ভেলকি জানেন যে ছুরিতে কিছু হল না! জামার নীচে কিছু পড়া আছে নাকি?’

দরজা ঠেলে বাইরে যাবার আগে কয়েক মুহূর্তের জন্য থেমে সীতাংশুবাবু বললেন, ‘ওরা ভয় পেল ওদের কৃতকর্মের জন্য৷ না, আমি ম্যাজিশিয়ান বা ওই ধরনের কোনো লোক নই৷’

‘সীতাংশুবাবু ও সীতাংশুবাবু’— এই বলে তাঁর পিছনে ডাকতে ডাকতে অনুকুলবাবুও বাইরে বেরিয়ে এলেন৷ কিন্তু বাইরের ল্যান্ডিং, সিঁড়ি কোথাও সীতাংশুবাবু নেই৷ তিনি যেন হাওয়ার মতন মিলিয়ে গেছেন!

সীতাংশুবাবুর আর দেখা পেলেন না অনুকুলবাবু৷ পুরো ঘটনায় ধাতস্থ হতে বেশ কয়েক দিন সময় লাগল তাঁর৷ পুরো ব্যাপারটাই কেমন যেন অদ্ভুত, রহস্যময় লাগছে তাঁর কাছে৷ দিন চারেক পর তিনি হাজির হলেন তাঁর প্রমোটারের কাছে৷ টুকটাক নানা কথা বলার পর তিনি বেশ কায়দা করে প্রমোটারকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, আপনি সীতাংশু বাগ নামের কোনো ভদ্রলোককে চেনেন?’

নামটা শুনে সে প্রমোটার মৃদু বিস্মিত হয়ে অনুকুলবাবু প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি এই নাম জানলেন কী ভাবে?’

অনুকুলবাবু তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন, ‘তার মানে আপনি তাঁকে চেনেন?’

প্রমোটার ভদ্রলোক একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি তাঁকে চিনতাম৷ সত্যি কথা হল, আপনার ফ্ল্যাটটা উনিই প্রথমে বুক করেছিলেন৷ টাকা দেয়া প্রায় কমপ্লিট হয়ে গিয়েছিল৷ পজেশন না নিয়েও তিনি আনন্দে রোজ একবার আমার কাছে এসে চাবি নিয়ে ওই ফ্ল্যাটটা দেখে আসতেন৷ একটা এমন ফ্ল্যাটের বহুদিনের শখ ছিল তাঁর৷ অনেকদিন ধরে তিনি টাকা জমিয়ে ছিলেন এ জন্য৷ রোজ ফ্ল্যাটটা দেখে যখন আমাকে চাবি ফেরত দিতে আসতেন তখন আমাকে বলতেন ফ্ল্যাটের ভিতরটা সাজাবার জন্য কী কী পরিকল্পনা তিনি করছেন৷ সবই ঠিকঠাকই চলছিল, তখন আর সপ্তাহখানেকর মধ্যে বকেয়া টাকা শোধ করে তাঁর ফ্ল্যাটটা পাকাপাকি ভাবে নিয়ে নেবার কথা, কিন্তু বছরখানেক আগে ঠিক তখনই একদিন…

‘তখনই একদিন কী? থামলেন কেন?’ উত্তেজিত ভাবে প্রশ্ন করলেন অনুকুলবাবু৷

একটু থেমে প্রমোটার ভদ্রলোক বললেন, আজ আর ব্যাপারটা বলতে আমার ভয় নেই৷ একটা শয়তান মারা গেছে৷ অন্যটার শিরদাড়া ভেঙেছে৷ আপনি হয়তো শুনেছেন যে কদিন আগে আপনাদের বিল্ডিং থেকে রাতের বেলায় দু-জন নীচে পরে গেছিল৷ বঙ্কু আর কেষ্ট৷ নাম কার দুই গুণ্ডা৷ ওরাই এসে সেদিন ধরেছিল সীতাংশুবাবুকে৷ কুড়ি হাজার টাকা দাবী করে তাঁকে ছুরি দেখিয়ে ভয় দেখিয়েছিল৷ চাবি ফেরত দিতে এসে তিনি ব্যাপারটা জানিয়ে ছিলেন আমাকে৷ কিন্তু ওই চাপটা নিতে পারেননি ভদ্রলোক৷ বাড়িতে ফিরেই হার্ট অ্যাটাক৷ হাসপাতালে নিয়ে যাবার পথেই সব শেষ৷

অনুকুলবাবু তার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন৷ তার কানে বাজতে থাকল সীতাংশুবাবুর সেদিনের কথাগুলো ‘এবার আপনি পরিবার নিয়ে এখানে শান্তিতে থাকুন… আমরা কেউ আর আসব না…

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *