আত্মজ
সোনাবাবুর বৃত্তান্ত শুনে গদীতে সবাই হেসে খুন। এ আর নতুন কথা কী, সবাই জানে শ্রীমান পাঁচু ওরফে পঞ্চানন্দ কী ছেলে। মাল ফেরত দিয়েছে এই যথেষ্ট। বোঝা যাচ্ছে, সোনাবাবুকে ভীষণ ভয় ভক্তি করে। তা না হলে এতক্ষণ দুতিনদিনের মতো কোথায় উধাও হয়ে যেত। ফিরে এসে মার খেলেই বা কী? ওর গায়ের চামড়া কালক্রমে দারুণ শক্ত হয়ে গেছে। পাঁচু বরং খুশি হয়ে বলে ভালো হল। অনেকটা খারাপ রক্ত জমেছিল—সব বেরিয়ে গেল! এখন আমার কী মজা!
সেই সঙ্গে দুহাত তুলে ধেই ধেই নৃত্য করাও ওর অভ্যাস। ফের তাড়া করলে দৌড়ে পালিয়ে যায়। সে-বেলার মত দুমাইল দূরে একটা ব্রীজে গিয়ে বসে থাকে। জলের দিকে তাকিয়ে নিজের প্রতিবিম্বকে ভ্যাংচায়। থুথু ফেলে। নাক ঝাড়ে। ঢিল ছোঁড়ে।
সোনাবাবু এটা আবিষ্কার করল বিকেলের দিকে। আচমকা পিছন থেকে জামার কলার ধরতেই পাঁচু তন্ময়তা ভেঙে বলে উঠল, আবার কী দাদু?
ও এত নির্বিকার। সেইজন্যে সোনাবাবুর মাথা খারাপ হয়ে যায়। উঠন্ত হাতের মুঠো খুলে অবশ শরীরে সোনাবাবু হাসে।… ব্যাটা জ্যান্ত মানুষ নয়, সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি।
তবে এই প্রতিমূর্তিটির চেহারা বড় সুন্দর। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকলে এবং ফরসা জামাকাপড় পরলে ওকে ভদ্রপরিবারের ছেলে মনে হওয়া স্বাভাবিক। বেথুয়াডহরির জ্যাঠশ্বশুর সেদিন সোনাবাবুর বাড়ি এসেছিলেন। পাঁচু তাকে কিংবা তিনি পাঁচুকে এমনভাবে গ্রাস করেছিলেন যে সামান্যতেই ‘সতী, তোর দেওরটি কোথা রে’ বলে সারাটি দিন হাঁক-ডাক। সোনাবাবু যথারীতি ততবার জানিয়ে দিচ্ছিলেন, ও আমাদের ইয়ে—বয়…মানে চাকর ফাইফরমাস খাটে। তার বউ সতী মুখ টিপে হাসছিল। আড়ালে সোনাবাবু তাকে ধমকেছিল—হেসোনা ত, গা জ্বালা করে! যেমন উনি, তেমনি এই শুয়ারটা, আর তেমনি হচ্ছ তুমি! আজই ওর ঘাড় ধরে বের করে দেব!
সেটা সম্ভব হয়নি। সোনাবাবুর পায়ে সবে বাত ধরেছে। রাত্রের দিকে পাঁচু হাঁটুর নীচে থেকে পায়ের আঙ্গুল অব্দি ম্যাসেজ করে দেয়। চোখ বুজে সোনাবাবু বলে, আঃ, বাঁচালি বাবা! রাত্তিরটা ঘুমুতে পারব মনে হচ্ছে।
ওদিকে সতীর কোমরে বেদনা আছে আজ সাত বছর। তার ওই জ্যাঠা আবার হোমিওপ্যাথির ডাক্তার। তিনি বলেছিলেন, পিকচঞ্চু অস্থিপ্রদাহ। ফস্ফরাস থেকে শুরু করা যাক। কিন্তু ফস্ফরাস থেকে সুরু হয়ে ফস্ফরাসেই শেষ হয়ে গেল। সোনাবাবুর বুকে এসে সতী দেখেছে, সেই টু হান্ড্রেড এক্স ফস্ফরাস (হোমিওপ্যাথি গুরু হ্যানিম্যান মতে) আচমকা ঝাঁকুনি খেয়ে শক্তি বাড়তে-বাড়তে থাউজেন্ড এক্স হয়ে উঠেছে। তুষের আগুন কোষে ধিকধিকি জ্বলে।
সে রাতে অন্য রাতের মতই সতী উপুড় হয়ে শুলে চিরকিশোর পঞ্চানন কোমরে পালোয়ানি করছে, সোনাবাবু আড়চোখে জুলজুল চোখে তাকিয়ে দেখছে—যেন সবুজ মখমল ঘাসের জমিতে চিতা বাঘের বাচ্চা খেলা করছে আপন মনে। রাগ হয়, ভয় করে আবার ভালোও লাগে।
মনসাতলা ব্রীজ থেকে ওকে নিয়ে যখন সোনাবাবু ফিরে এল, সতী ঘর বার করছিল এতক্ষণ যেন। বিকেলে পশ্চিমের আকাশে থাকে থাকে রাঙা মেঘ জমে আছে। ইট ভাটার ওদিকে খোলামেলায় মজুরনীরা উনুন জ্বেলেছে—সেই ধোঁয়া উঠছে সবুজ গাছপালায় মাখামাখি। খাল পোলের কাছে রেলিঙে হেলান দিয়ে রিকশোওলারা চায়ে গ্লাস হাতে জালে মাছ পড়া দেখছে। রাস্তার দুপাশে সারবাঁধা দোকান পাটে আশেপাশের গ্রামের লোকেরা আড্ডা দিচ্ছে। দত্তর গদির সামনে একটা লরি দাঁড় করানো। পাটের গাঁট বোঝাই করছে কুলিরা। দালাল হবিবুর সোনাবাবুকে দেখে বলল, পেলেন? যাবে আর কোথা? তবে সবই বরাতের ফের সোনাবাবু বুঝলেন? হয়ত কোন সদ্বংশের ছেলে—তার নসীবে কী ছিল দেখে নিন। …হবিবুর পানখেকো লাল বিচ্ছিরি মুখব্যাদান করে হাসল। ….চেষ্টা করে দেখুন, স্বভাব চরিত্তির শোধরায় নাকি। তবে সাবধান হতে ভুলবেন না কিন্তু।
সোনাবাবু গজগজ করে উঠল। …আমার দায় পড়েছে! যাদের দায়, তাদের হাতেই তুলে দেব ব্যাটাকে। রামধোলাই খেলেই ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। মানুষের আত্মাসুদ্ধ তারা ধুয়ে সাফ করে দেয়।
টের পেয়ে সুরসিক পাঁচু খিলখিল করে হাসল। …তাতেও পাঁচু মরবে না! আমার আত্মাটা খুব চালাক। আমিই হয়রান হয়ে যাই। বাপরে! বাপ!
সোনাবাবু ঘাড় ঘুরিয়ে বদরাগী মোষের মত পাঁচুর মুখটা দেখে নিয়ে বলল, ব্যাটা বিদ্যেদিগগজ। আত্মা! আত্মা কী দেখেছিস? জানিস?
পাঁচু তা জানে না। দেখতেও পায় না। শুধু বোঝে। বুঝতে পারে আত্মা আছে একটা। পাঁচু খুশি হয়ে বলল, দাদাবাবু হই যে—দেখুন, নিশানা করে দেখুন—দেখতে পাচ্ছেন—চাঁইপাড়ার কাছে খালের ওপারে একটা লঙ্কার ক্ষেত—দেখতে পেলেন?
হাঁ করে সোনাবাবু বলল, তা কী হয়েছে?
গম্ভীর—ঈষৎ বিষণ্ণ পাঁচু ভ্রূ কুঁচকে সেইদিকে তাকিয়ে বলল, এ্যাদ্দুর থেকে আমি দেখি দাদাবাবু—পষ্ট দেখি। কি না, একখানা লঙ্কার খেত। ঝাড়গুলো সব মস্তো বড়। থোকা থোকা লঙ্কা ধরেছে।
সোনাবাবু অবাক। এত অবাক যে কথা বলতে ভুলে যান।
পাঁচু বলে…এ্যাদ্দুর থেকে পষ্ট দেখছি। নোলায় জল ঝরছে দাদাবাবু। আঃ!
ব্যাটা হনুমান! সোনাবাবু ওর হাত ধরে টানেন। অদূরে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সতী। সেইদিকে চোখ গেছে। হাতে চিরুণী, এলানো চুল বুকের ওপর। কপালে লাল টিপ। সাদা ঝকঝকে তাঁতের শাড়ী পরেছে। হাতাকাটা লাল জামার দুপ্রান্তে দুটো নিটোল বাহুতে আগুন জ্বলছে। মাথা কাত করে চুলে চিরুণী চালিয়ে ঠোঁটটা চাপা হাসির বাঁকা ছাঁদে রেখে সতী এদের দেখছে। হঠাৎ সোনাবাবুর মনে হয়, জীবনের সব ব্যাপারেই সতী বড় নিশ্চিন্ত যেন। যেন কী কী হবে বা না হবে, সব জেনে বসে আছে ও।
দরজার মুখে এসে সোনাবাবু বলেন, লঙ্কাকাণ্ড করবে তোমার হনুমান। সামলে রেখো। ওখানে কোথায় কার লঙ্কাখেত রয়েছে—ওর দৃষ্টি এবার সেইখানে। দেখো, কাল আবার চাঁইপাড়া থেকে কেউ নালিশ না আনলে বাঁচি।
সতী জবাব না দিয়ে ভিতরে ঢুকল। একটুকরো উঠোন—দুকামরা সেকেলে একতালা ঘর, বারান্দায় দরমা-বেড়া দিয়ে তৈরী রান্নাঘর। পিছনে পেত্নীঝোপ নাটাকাঁটা ভাঁড়ুলে গাছে ভরা একটুকরো পোড়ো জমি পেরোলেই খাল। এখন সেচদপ্তরের দৌলতে খাল বলা হয়। আগে ছিল ছোট্ট নদী—বাঁকে বাঁকে চলে গঙ্গাবাহিনী দ্বারকায় মিশেছে বহু দূরে। উত্তরে দিগন্তবিস্তৃত বিল তেলকার থেকে জল নিষ্কাশনের জন্যে নদীটা ভদ্রচেহারা পেয়েছে একালে।
হাইওয়ের দুপাশে এমনি সব বাড়ি আর দোকানপাট। খুব বেশি নয়—ত্রিশ থেকে চল্লিশ বড় জোড় সংখ্যায়। ক্রমশ বাড়ছে বসতির সীমানা। এলাকার সেরা ব্যবসাকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এরা সবাই বাইরের লোক। অবাঙালীর সংখ্যা কম নয়। সোনাবাবু লছমনজীর গদীতে চাকরী নিয়ে এখানে এসেছে। বহরমপুরে মূল আড়ত—এখানে তার নতুন শাখা। খৈল তেল লঙ্কা ডাল—নানান পাইকারী কারবার। লছমনজীর ভাইপো নন্দলাল এখানে দেখাশোনা করে। সোনাবাবু সদর থেকে একরকম বদলী হয়েই এখানে এসেছে।
নন্দলালের জীপ আছে। বয়সে নবীন এবং খামখেয়ালী। মাঝে মাঝে প্রায়ই কোথায় উধাও হয়ে যায়। সব জিম্মা দিয়ে যায় সোনাবাবুকে। প্রবীণ বিশ্বাসী কর্মচারী। পাই পয়সাও গরমিল হয় না। সেই পুরস্কারে বাড়িভাড়া লাগে না তার। বাড়িটা কোম্পানী কিনেছিল পাশের গ্রামের রাজীব ডাক্তারের কাছে। ওটা ছিল তার ডিসপেনসারি। ডাক্তারের ছেলে ডাক্তার হয়নি। হয়েছে প্রাইমারি শিক্ষক। অভাবে বেচে ফেলেছিল।
বাড়ি ঢুকে সোনাবাবু বলল, নাও, মানিককে দেখ। আমি গদীতে যাই। আর…এবেলা কী রান্না করছ?
কয়েকমিনিট অপেক্ষা করেও কোন জবাব না পেয়ে বিরক্তমুখে সোনাবাবু চলে যান। এবার সতী আঁচড়ানো চুল গুছিয়ে খোঁপামত করে পাঁচুকে বলে, কী রে রাজপুত্তুর? দুপুরে খেলি কোথায়? হুঁ…মুখ দেখেই বুঝেছি, কোথায় কার ঘাড় ভাঙা হয়েছে।
আল্হহলাদিত পাঁচু কলতলায় সযত্নে হাত পা ধুতে ধুতে বলে, আমার মুখখানাই এরকম।
সতী একটু এগিয়ে আসে। …প্যাণ্টটা কী করেছিস রে! ছি, ছি! ধুলোয় ঘষেছিস হতভাগা?
চোঙা প্যাণ্টের পাছা ঝাড়ে পাঁচু—শশব্যস্তে। কাঁচুমাচু হাসে। তারপর পা ধুয়ে সাবধানে হাওয়াই স্লিপার তুলে নেয়। এবার তার আচরণে বেশ ভদ্রতার লক্ষণ ক্রমশ প্রকট হবে।
সতী হঠাৎ জামাটা খামছে ধরেছে।…কালকের কাচা জামার এ—ই ছিরি করেছিস? তুই কি কচি ছেলে, গাল টিপলে দুধ বেরোয়?
পাঁচু মাথা দুলিয়ে জানায়, বেরোয়।
জামা ছেড়ে মাথায় আলতো চাঁটি মারে সতী। বলে, ঘড়ি পরার খুব সখ হয়েছে তো বললেই পারতিস! মিছেমিছি মারধোর খেলি।
তুমি দিতে বুঝি? পাঁচু ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে বলে।
সতী হাসে মাত্র।
পাঁচু বলে, চুরি তো করিনি। আমি চুরি করি নে। চোর নই।
কী করিস তবে? সতী সকৌতুকে বলে।
পাঁচুর জবাব : ফক্কুরি।
সেটা অন্তত আজকের ব্যাপারে ঠিকই। ভোরবেলা থেকে বাড়ির জিনিসপত্র ওলটপালট করে ফেলা হচ্ছে, সোনাবাবু ষাঁড়ের মত সবখানে গুঁতো মেরে চলেছেন, হাতঘড়িটার পাত্তা নেই। হঠাৎ পাঁচুর দিকে চোখ যেতেই মনে পড়ে গিয়েছিল, আরে তাই তো! পাঁচু ছাড়া এ কীর্তি আবার কার? জীবন্তীবাজারে পাঁচু এ কারণে বিখ্যাত। জেনেশুনেই জায়গা দেওয়া হয়েছে তাকে—নিতান্ত মায়ার বশে। অত সুন্দর ছেলেটা শুধু মারধোর খায় আর টো টো করে ঘোরে! হয়ত নেয় তুচ্ছ সামান্য কিছু জিনিস—মার খায় অসামান্য। ও রাতের চোর নয়,—ওর প্রকৃতি ভিন্ন। যাকে বলে হাত-লপকা, কিঞ্চিৎ ছিঁচকেমি মাত্র। তার জন্যে দত্তরা ওর মুখে রক্ত তুলে দিচ্ছিল দেখে ঝোঁকের মুখে সোনাবাবু—কতকটা জেদেও বটে, ওকে নিজের বাড়ি এনে রেখেছিল। টুকিটাকি ফরমাস খাটবে আর থাকবে। অল্পস্বল্প সখআহ্লাদ বা সাজপোশাক যা লাগবে, দেবে। তিনকূলে কে আছে, হদিস নেই। ছেলেবেলায় কোন লরির ড্রাইভার ওকে কোত্থেকে এনে এখানে নামিয়ে দিয়েছিল, সেই থেকে এখানে ও বেঁচে আছে। মুখ দেখলে মায়া হয়—কী একটা আছে ওর মুখে। লোকে জ্বালায় পড়ে মারেও যত, ভালবাসেও ততখানি। আর পাঁচুও জীবন্তী ছেড়ে কোথাও যাবার নাম করে না। সোনাবাবু ভেবেছিল, মানুষের এই একটা ব্যাপার আছে। ঘর পাওয়ার ব্যাপার। মানুষের জীবনটা কেবল ঘর খোঁজার তালেই কেটে যায়। ভাগ্যে কারুর মিলে গেলে তার আর নড়া হয় না—গাছের মত শেকড় বসিয়ে স্থির থেকে যায় আমরণ। পাঁচু তার ঘর পেয়েছে। সেই ড্রাইভারকে তার প্রণাম করা উচিত। …আর আমি? আমি সোনাবাবু কি পেয়েছি? পেলাম ঘর? পাগল! ও ঘর তো সতীর। সতী তাই নিশ্চিন্ত—পাঁচুর মতই।
হ্যাঁ, পাঁচু ঘড়ি ফেরত দিয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে। হেসে না ফেললে হয়ত কবুল করানো যেত না। দিব্যি তলপেটের কাছে ঝুলিয়ে রেখেছিল প্যাণ্টের আড়ালে। বলল, মজা দেখছিলাম এতক্ষণ।
ওই কথাটা না বললে মার খেতো না সে। এমন কি সতীও দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখত না। সতীর হাতে ছিল ঝুলঝাড়াটা—সেই দিয়ে যতখানি পারা যায়, পাঁচুর খারাপ রক্ত বের করা হল। এক ফাঁকে পাঁচু উধাও। তখন খবর গেল গদীতে। সোনাবাবু এল। খুঁজতে বেরল। সতী চোখমুখ লাল করে বসে আছে।
জেনেশুনেই তো বিষ গিলছি। সোনাবাবু বলছিল। স্বগতোক্তি কতকটা। আর একটা ছড়া কাটল শেষে।…বেদের মরণ সাপের হাতে। নির্ঘাৎ!
সন্ধ্যার দিকে সতী যখন রান্না করছে, পাঁচু পাশে বসে ময়রামালির বাড়ি ফুলফলের গাছপালা দেখার কথা বলছে, কারণ ওখানে বসেই সে অবিকল সব দেখতে পাচ্ছে তার খুঁটিনাটি বর্ণনা—সেইসময় একবার হন্তদন্ত সোনাবাবু বাড়ি এল। সোজা ঘরে ঢুকে খুটখাট কী নাড়াচাড়া করে ফিরে গেল। সতীর ওপর তখন থেকে সম্ভবত কিঞ্চিৎ অভিমান—কী রাঁধবে বলেনি সে।
সোনাবাবুর চলে যাওয়া দেখে পাঁচু বলে, কী হল দাদাবাবুর?
সেদ্ধডিমের খোসা ছাড়াচ্ছিল সতী। চোখ তুলে তাকায়। কী হবে?
পাঁচু কেমন হাসে।… কেমন যেন! খুব তোলপাড়—জলে ঢিল পড়ে দেখেছ?
সতী গম্ভীরমুখে বলে, তুই দেখিস, তাহলেই হবে। আদিখ্যেতা।
এ বেলা খাঁকি একটা হাফপ্যাণ্ট পরেছে পাঁচু। গায়ে একসাইজ গেঞ্জী। উবু হয়ে বসে আছে—হনুমানের মত। ফরসা ঊরু বা হাঁটুর নীচে অব্দি কালচে লোম। সতী চোখ ফিরিয়ে নেয়। কোমর কটকট করছে সারাটা দিন। সকাল থেকে বিকেল ওই ঝামেলা—পাঁচুর পাত্তা ছিল না। রান্না হয়ে গেলে শোবে একবার। তখন টিপিয়ে নেবে। সতী হঠাৎ চমকে উঠল। পাঁচু তার দিকে তাকিয়ে আছে এতক্ষণ! কী দেখছে?
চাউনি দেখে পাঁচু আমতা হাসে। বলে, দাদাবাবুর কথা ভাবছি।
সতী ধমকায়।….খুব ভাবুক তুই!
হ্যাঁ। দাদাবাবুকে মোমবাতির মতন লাগছে। কেন গো বউদি?
কিসের মত?
মোমবাতি।
মুহূর্তে হেসে গড়াগড়ি সতী। বড় মজার-মজার কথা বলে ছোঁড়াটা। হাঁরে, এতসব শিখলি কোথায়?
গুরুমশায়ের পাঠশালায়। পাঁচুর সপ্রতিভ জবাব।
সে আবার কোথায়? সতীর সকৌতুক প্রশ্ন ফের।
পাঁচু বলে, জানো বউদি—আমি যা ইচ্ছে দেখতে পাই। এই যে তুমি বসে রয়েছ, কথা বলছ—পষ্ট দেখছি তোমার মনটা।
সতী বলে, ইস! কই, বল তো কী দেখছিস?
তুমি—তুমি আজ অনেকক্ষণ কোমর টেপাবে। কিন্তু আমার হাতের আঙ্গুল মেরে ফাটিয়ে দিয়েছ—এই দ্যাখো না—পাঁচু দেখায়। তারপর বলে, তাই ভাবছ। আর…
আর কী রে?
দাদাবাবু কাল একগাদা টাকা এনেছেন গদী থেকে—বালিশে ভরা আছে। ভাবছ, তাই তো পেঁচো রয়েছে…
কী বললি? সতীর হাতের কাজ কাজ থেমে গেছে।
হুঁ। আমি জানি।
জানিস? দেখেছিস?
হুঁউ।
সতী চুপ করে যায়। গত পরশু, নন্দলাল গদীতে নেই, ক্যাশের টাকা এনে রেখেছে সোনাবাবু। বুদ্ধি করে বালিশের ভিতর রাখাই সঙ্গত মনে করেছিল ওরা। কিন্তু তাও পাঁচু টের পেল কোন মন্ত্রবলে?
কিছুক্ষণ নিঃশব্দে ডিমের খোসা ছাড়িয়ে সতী ওঠে। পা বাড়াতে গিয়ে কি ভেবে এনামেলের গামলায় একটা থালা চাপিয়ে দেয়। তারপর বলে, গুঁড়ো হলুদ ফুরিয়েছে। এক্ষুনি এনে দে। এই নে পয়সা।
পাঁচু উঠে কাঁচুমাচু মুখে বলে, পাঁচটা পয়সা দেবে?
সিগ্রেট খাবি তো? সতী চোখ পাকায়।…ওই থেকে নিস। আর দ্যাখ, পটলীর মাকে একবার ডেকে দিস। বলিস, ভীষণ দরকার, বউদি ডাকছে। এক্ষুনি। কেমন?
কিছু সন্দেহাকুল দৃষ্টে তাকিয়ে থেকে পাঁচু বেরোয়। সতীর বুকে হাতুড়ি পড়ছিল। কী সুন্দর চাউনি—অথচ এ কী চোখ ছেলেটার? যেন হৃৎপিণ্ডটা দেখছে ধুকধুক করতে। আর তার হাত? সেও কম ডাকাত নয়। অনেক গভীরকে ছোঁয় যেন। সেই তো কোমর টেপার আরাম!
ঘরে ঢুকে আগে বালিশ নিয়ে পড়ে সতী। ওয়াড় খুলে ক্ষিপ্র হাতে তুলোর ওপরটা টেপে। এক…দুই…তিন…চার…পাঁচ! ঠিক সাজানো আছে বাণ্ডিলগুলো। ভাগ্যিস নেয়নি! বেডকভারের নীচে বালিশটা ঠেসে দিয়ে (ওটা সোনাবাবুর বালিশ) সে বেরিয়ে আসে। দরজায় তালা দেয়। চাবির গোছা ব্লাউজের ভিতর রাখে।
তবু অনেকক্ষণ বুক কাঁপে সতীর। জ্বরোভাব সর্বাঙ্গে—এ কী অচেনা আড়ষ্টতা—মাথা ধরা বমির উদ্রেক। বড় বিচ্ছিরি একটা অস্বস্তি!
একটু পরেই পাঁচু এল। নিজের মনে হলুদের কৌটো খুলে প্যাকেটের হলুদ ঢালে সে। ঢালতে ঢালতে বলে, পটলীর মাকে কেন? আবার বাবার বাড়ী যাবে নাকি? সর্বনাশ!
সতী মধ্যে মধ্যে বাবার বাড়ী গেলে পটলীর মা এসে থাকে। রান্না বান্না কাজ কর্ম করে। সোনাবাবু তো কুটো ভেঙ্গে দুটো করবে না—এমন গোঁফখেজুরে মানুষ। পাঁচুর প্রশ্ন শুনে সতী মুখ টিপে হাসছে। বলে, গেলে তোর খেতে দেতে কষ্ট হয় নাকি রে?
হাত দুটোয় বিকট গলাটেপা ভঙ্গী করে পাঁচু বলে, হাত নিসপিস করে। মাইরি বউদি!
নিসপিস করলে দাদাবাবু তো আছেন।
মাথা নাড়ে পাঁচু। বলে, ধুস! শুধু হাড়—মটমট করে যে!
সতী কেমন হাসে নিষ্পলক তাকিয়ে। কথা বলে না।
পাঁচু তিরিক্ষি গলায় বলে ওঠে, হেসো না—গলা জ্বলে যায়!
জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে সোনাবাবু দেখছে—টেবিল বাতির অল্প আলোর মৃদু আভা ঘরে, উপুড় হয়ে চোখ বুজে শুয়ে আছে সতী, পীঠে হাঁটু গেড়ে বসেছে অসুরের মত চিরকিশোর পঞ্চানন্দ, এবং ফাটা আঙ্গুলে সাবধানে পিকচঞ্চু অস্থিটিতে চাপ দিচ্ছে। ঘন ঘন করে নোংরা ফ্যানটা ঘুরছে বিছানার ওপর। শরতের প্যাচপ্যাচে গরম। নন্দলালের সবিশেষ অনুগ্রহ ছাড়া ঘুমানো দায় হত। আর ওই পেঁচোটা—চোর ছ্যাঁচোড় যাই হোক, না জুটলে অনেক অশান্তি থাকত জীবনে। এখন তো মোটামুটি সুখী সোনাবাবু। সুখী—তবে নিশ্চিন্ত নয়। হতে পারছে না নিশ্চিন্ত। ওই তো সতী আরামে ঘুমিয়ে গেল হয়ত, গভীর ঘুম তার—সোনাবাবুর ঘুম কুরে খায় সে এক অদ্ভুত ঘুণপোকা। কটাস কটাস শব্দ ওঠে মাথার ভিতর দিকে।
পা দুটো ক্রমশ অতিষ্ঠ। সোনাবাবু ডাকল, পাঁচু আয়। পাঁচু মুখ নামিয়ে বউদির মুখটা পরীক্ষা করে উঠে এল পাশের শরীরে। পায়ে হাত দিলে সোনাবাবুর চমক লাগছিল আজ। হাত-লপকা ছিঁচকে ছেলে—কত কী হাতিয়ে নিতে পটু। সতী যেমন, তেমনি তার স্বামীরও কত হালকা তুচ্ছ জিনিস মেরে দিচ্ছে কে না জানে!
কিছুক্ষণ পরে ভারী গলায় সোনাবাবু ডাকে, পাঁচু?
উঁ?
ধর, আমরা যদি কোথাও চলে যাই, তুই আমাদের সঙ্গে যাবি?
টেপা থামিয়ে পাঁচু একটু হাসে।…কোথায় যাবেন?
যেখানেই যাই—তুই কি যাবি?
কবে?
আজই। বলতে গলাটা কেঁপে যায় সোনাবাবুর। অতিকষ্টে ফের বলে, একটু পরেই।
পাঁচুর হাত চলে। শুধু মাথা নাড়ে।
সোনাবাবু চমকে ওঠে।…..যাবিনে তুই?
নাঃ।
একটু ইতস্তত করে সোনাবাবু বলে, যদি তোর বউদি বলে যেতে?
তাও না। পাঁচুর সোজা জবাব।
কেন যাবিনে বল তো?
পাঁচু নির্দ্বিধায় বলে, আপনারা টাকা মেরে পালাচ্ছেন যে। ওরে বাবা!
মুখের ওপর আচমকা মুগুর খেয়ে সোনাবাবু চুপ। ভোঁতা নাকে শ্বাসপ্রশ্বাসে কষ্ট হয়। রক্ত ঠাণ্ডা একেবারে। পা গুটিয়ে নিয়ে বলে, শো গে যা। তোর মন যাচাই করছিলাম—বুঝলি পাঁচু? তুই আমাদের কতটা ভালবাসিস—মেপে দেখছিলাম।
তবু বেজার মুখে পাঁচু চলে যায়। বাইরে বারান্দায় খাটিয়া আছে। সেখানেই শোবে সে। মশারিও দেওয়া আছে। পরস্পর দয়া করেই মানুষ বেঁচে আছে পৃথিবীতে।
দরজায় খিল এঁটে সোনাবাবু ডাকে—ঘুমোলে?
সতী ঘুমকাতুরে হলেও ঘুমোয়নি আজ। বলে, না।
শুনলে তো কথা?
শুনলাম। কিন্তু হঠাৎ ওকে এসব আজেবাজে কথা বলবার কী দরকার হল আবার?
ইচ্ছে গেল বলতে। যদি—ধরো যদি, তাই হত!
তার মানে? সতী সাপের মত ফণা তোলে।
আমতা জবাব দেয় সোনাবাবু—না, মানে—এমনি বলছিলাম। এমন হতেও তো পারত!
আদিখ্যেতা!…ব’লে সতী পাশ ফেরে। পাশ ফিরেও রাগ পড়ে না। ফের বলে, তুমি খুব নীচমনা! কান না করে সোনাবাবু বিষণ্ণকণ্ঠে বলে, থাক, কালই টাকাটা জমা দিয়ে আসব সদরের আড়তে। নন্দ তো আজও ফিরল না। এমন করে ব্যবসাতে লালবাতি জ্বলে যাবে। একা আর কতদিক সামলাই!
তারপর দুজনে পাশাপাশি শুয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এবার সতীর গলা শোনা যায়।…শুধু টাকা দিয়ে আসা নয়, কালই বিদেয় করো ছোঁড়াটাকে—নৈলে মাথা খুঁড়ে মরব বলে দিচ্ছি।
সোনাবাবু বলে, পাগল! ওকে একটু রয়েসয়ে নিও—ছেলেমানুষ তো! এবং মনশ্চক্ষে একখণ্ড সবুজ মখমল ঘাসে ঢাকা জমির ওপর একটা সুন্দর চিতাবাঘের বাচ্চাকে আপনমনে খেলা করতে দ্যাখে। গা ছমছম করে সোনাবাবুর। রাগ হয়—আবার ভালোও লাগে।