আটবিক

আটবিক

(একত্ৰিশ) সাধ্বী

রাত শেষ হয়ে আসছে। আকাশে তারাদের ফেলে রেখে অন্তিম প্রহরে ডুবে গেছে নিশানাথ চাঁদ। সূর্যোদয় হতে তিন দণ্ড বাকি। তার আগে ভোররাতে অন্ধকার এখন প্রগাঢ়।

চুপিপায়ে প্রাসাদের থেকে নিয়তি-তাড়িতের মতন বেরিয়ে এল ওরা দুজন। বহির্দ্বারে নিঃশব্দে অর্গল দিল। দ্বারকপাটে খোদিত গাভী, ছাগশিশু আর রাজহংসের মূর্তি—যারা চিরকাল এই দ্বার-সংলগ্ন হয়ে সপ্রেমে খেলা করে চলেছে—একবার যেন অবাক হয়ে তারা পাথরের চোখ তুলে দেখল ওদের। ভাবল বুঝি, এই জনবিরল প্রত্যূষে ছায়ামূর্তির মতো নিঃশব্দ চরণে কোথায় চলে যাচ্ছেন এ গৃহের কর্তা ও কর্ত্রী ?

কয়েক মাসের অগ্রিম পারিশ্রমিক সহ সমস্ত কর্মীদেরই ছুটি দিয়ে দিয়েছে কন্নকী । পরিচারক-পরিচারিকারা প্রাসাদ ছেড়ে চলে গেছে আগেই। তারা জানে, কন্নকী-কোভালন তীর্থে যাবে। তারা জানে না, কন্নকী ও কোভালন এ গৃহে কোনোদিন ফিরে আসবে না আর।

ভোরের আলো ফুটে উঠছে ধীরে ধীরে। অন্ধকার লঘু হচ্ছে ক্রমশ। বিনিদ্র সাধকের ব্যাকুলতামাখা অক্ষিপত্রের মতন অরুণ ঊষাকিরণ ফুটে উঠছে পুব-আকাশে ধীরে ধীরে। সেই আলো-আঁধারিমাখা পথ দিয়ে চলতে চলতে কোভালন ও কন্নকী এসে পৌঁছোল মণিবন্নন বিষ্ণুর মন্দিরে। আদিশেষনাগের শয্যায় নীলকান্তমণিখচিত স্বয়ং নারায়ণ সে-মন্দিরে শায়িত আছেন সুগভীর যোগনিদ্রায়। সুপ্তিমগ্ন তিনি, কিন্তু মায়ারচিত নিদ্রায় অভিভূত নন, কেননা তিনিই মায়াধীশ। অতীত-বর্তমান-অনাগত সমস্তই তাঁর কল্পনা, তাঁরই স্বপ্ন। একমাত্র তিনিই জানেন, কী হয়েছে, আর এর পর ঠিক কী হবে!

অনন্তশায়ী নারায়ণকে প্রণাম জানিয়ে বিষ্ণুমন্দির প্রদক্ষিণ করে ওরা এসে পৌঁছোল ইন্দ্ররচিত সপ্ত বিহারের সমীপে। লোকশ্রুতি আছে, স্বয়ং দেবেন্দ্র নাকি সুদূর অতীতে নির্মাণ করেছিলেন পুষ্পহারের এই নয়নাভিরাম সঙ্ঘারাম। সুগতপন্থীদের সেই বিহারসমূহের ঊর্ধ্বাকাশে আজ বিলীয়মান কয়েকটি নক্ষত্র এখনও অন্তিম দীপ্তি ছড়াচ্ছে। আসলে হয়তো ওরা ভোর-আকাশের তারা নয়। হয়তো স্বর্গলোক থেকে দেবতারা নক্ষত্রের ছদ্মবেশ ধরে নেমে এসেছেন আজ পুষ্পহারের প্রভাতী আকাশে। ধ্যানমন্দ্রস্বরে তাঁরা আবৃত্তি করছেন সেই সব আলোকিত ধর্মসূক্ত, সুদূর অতীতে বোধিদ্রুমতলে ধ্যানবলে যা কখনও কোনো একদিন আবিষ্কার করেছিলেন মহাকারুণিক তথাগত।

পার হয়ে যাচ্ছে বৌদ্ধ বিহার, পার হয়ে যাচ্ছে সেই প্রসিদ্ধ শিলাতল, যেখানে উৎসবের দিনে কিংবা নববর্ষায় কাবেরীর প্রথম স্ফীতি উদযাপন উপলক্ষ্যে নানা দিক থেকে আসে জৈন চারণের দল, সোনালি ফুলের ভারে অবনত অশোকতরুর তলায় উজ্জ্বল কালো পাথরের চারিদিকে যেখানে সমবেত হন অর্হৎ, সিদ্ধ, আচার্য, উপাধ্যায়, সাধ্বীরা—তপস্যা, অহিংসা, সত্য, সংযমের দ্বারা যাঁরা নির্ধতকল্মষ হয়েছেন, যাঁরা সত্যকে চিনেছেন উপলব্ধির গহনতম আলোকে।

এ নগর ছেড়ে চিরতরে চলে যাচ্ছে কোভালন, কন্নকী। কোনোদিন ভাবেনি এভাবে চলে যেতে হবে। ওরা দুজনেই জন্মেছে এই নগরীতে; এর পথে পথে, মন্দিরে, তড়াগে, নদীঘাটে ছড়িয়ে আছে তাদের কৈশোর আর যৌবনের কত গণনাতীত স্মৃতি। কত নিদাঘ প্রাবৃট, কত শরদ হিমঋতু, কত শীতঋতু বসন্তকাল, কত প্রভাত সায়ম্ জুড়ে এ নগরীর ধুলায়, অনিলে, আকাশে, বীথিকায় মিশে থেকেছে ওরা দুজন। এখানেই তাদের পূর্বরাগ, প্রণয়, বিবাহ, সংসার… এ নগরী জড়িয়ে আছে তাদের প্রতিটি স্নায়ুতন্ত্রীর স্পন্দনের সঙ্গে। আর ফিরে আসবে না কোনোদিন—আর কোনোদিন দেখবে না এই নগরীর মুখ—এই কথা মনে জেগে উঠছে বারবার এই খোলা পুথির পৃষ্ঠার মতো সরল ভোরবেলায়। দুর্মর স্মৃতির সূত্র বারবার জড়িয়ে যাচ্ছে অনিচ্ছুক বেদনাতুর পায়ে পায়ে। জীবনে এত ঝড়বৃষ্টির রাত আসবে, এতটা বিপর্যয়ের মধ্যে এমন নির্বাসন মেনে নিয়ে চলে যেতে হবে—কখনও দূরতর দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি ওরা। সংসার থাকলেই বিপদ আসে, আর্থিক বিপর্যয় আসে কখনও, পতি-পত্নীর সম্পর্কের মধ্যে এসে হাত রাখে কখনও কখনও কোনো ছায়ামানুষ, আবার এসব কাটিয়েও ওঠা যায় অনেক ক্ষেত্রেই। কিন্তু কোভালন-কন্নকীর জীবনে দুর্ঘটনার অনুক্রম এমনই যে, প্রথমে এল বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের অভিঘাত, তারপর আর্থিক বিপর্যয়ের সূত্রেই তারা স্বামী-স্ত্রী বাঁধা পড়ল আবার, দুঃখ দিয়ে গ্রথিত হল যেন দুটি আহত প্রাণ। অথচ ঠিক যে-মুহূর্তে তাদের মিলনের মুহূর্ত রচিত হল, ঠিক সেই মুহূর্তেই রচিত হয়ে গেল এই আজন্মলব্ধ নগরীর সঙ্গে তাদের চিরবিচ্ছেদ, তাদের চিরপ্রস্থান । সব থেকে বড়ো বেদনার কথা এই, দুটি অত্যন্ত সম্পন্ন পরিবারের সন্তান তারা; আজ ভাগ্যবিপর্যয়ে নিঃশব্দে পালিয়ে যেতে হচ্ছে তাদের এ নগর ছেড়ে হতদরিদ্রের মতো । সহায়হীন, সম্বলহীন, ভাগ্যবিপর্যস্ত মানুষের নিজেদের দেশ-গাঁ ছেড়ে অন্য কোনো উপনিবেশের দিকে আশ্রয়প্রার্থী হয়ে চলে যাওয়ার এই বিপন্ন ছবি যেন বারবার অভিনীত হয়ে চলেছে সময়ের আবর্তিত চক্রনেমি বেয়ে…

ভালো করে সূর্য ওঠার আগেই তারা পেরিয়ে যাচ্ছে নগর-তোরণ; দুপাশে উঁচু প্রাচীর, মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়ার একহারা পথ; সে-পথে সোনালি আবিরের মতো ছড়িয়ে পড়ছে দিনের প্রথম আলো। প্রাচীরের ওদিকে বিত্তবান মানুষদের শৌখিন বাগান, সে-বাগানে বসন্ত এনেছে অজস্র পুষ্পরাগ–বাগানের প্রাচীরের উপর দিয়ে রক্তপলাশ, শিমুল, কৃষ্ণচূড়ার পুষ্পিত শাখা উপচে পড়ছে, সমুদ্রের বাতাসে ঝুরুঝুরু কাঁপছে তাদের পর্ণ, পুষ্প। সেই সমৃদ্ধির স্বপ্নময় চিত্ররূপের মধ্য দিয়ে নিঃস্ব দুটি মানুষ নীরবে মাথা নীচু করে হেঁটে চলে যাচ্ছে হয়তো আরও কোনো নিঃস্বতর ভবিষ্যতের দিকে, নৈরাশ্যপীড়িত দারিদ্র্যের দিকে, নিয়তি-তাড়িত রূঢ়তর হয়তো কোনো বাস্তবতার অভিমুখে….

প্রশস্ত একটা ধুলামলিন রাস্তা, সেই রাস্তা গিয়ে শেষ হচ্ছে কাবেরীর ঘাটে… সেখানে স্নানার্থী মানুষের ভিড় এখন এই অমলিন প্রভাতবেলায়…. কাবেরীর সেই ঘাট পেরিয়ে যাচ্ছে কন্নকী, কোভালন। এই সেই নদীঘাট, যেখানে একদিন প্রথম যৌবনে কন্নকীকে দেখেছিল কোভালন। চকিত সেই প্রথম দর্শনেই ভালোবাসা হয়েছিল কন্নকীর প্রতি কোভালনের। এখানে পৌঁছে তাই সেই প্রণয়সূচনার স্মৃতি অতর্কিতে জেগে উঠছিল দুজনার মনেই। কিন্তু সেসব কথা তারা এ ওকে মুখ ফুটে বলতে পারল না আজ কোভালন শুধু তাকাল একবার কন্নকীর দিকে, অনুচ্চারিত সব কথা বুঝতে পেরে বেদনায় কন্নকী মুখ নামিয়ে নিল। যে-স্থানকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে মানুষের প্রথম প্রেমের মধুর স্মৃতি, সেই স্থানটিকেই যদি ভাগ্যের বিপর্যয়ে পিছনে ফেলে চলে যেতে হয় একদিন, তাহলে প্রণয়ের মধুরতম স্মৃতির সঙ্গে মিশে যায় যে-বিচ্ছেদের ছায়া, তাকে শব্দে সম্পূর্ণ রূপ দিতে পারেনি কোনো যুগে পৃথিবীর কোনো কবি বা কোনো কথাকার। কনকী মনে মনে বলল, এই নদীঘাটে চিরকালের জন্য রয়ে গেল স্নানার্থিনী একটি মেয়ে ও তার রূপমুগ্ধ এক যুবকের ছবি; তারা এখানেই চিরদিন থাকবে, বয়েস বাড়বে না কোনোদিন তাদের, কোনো বিপর্যয় এসে তাদের সেই রূপোজ্জ্বল চিত্রের গায়ে স্থূল প্রয়োজনের হাত লাগাতে পারবে না, কোনো অভাবের মালিন্য এসে নষ্ট করতে পারবে না কোনোদিন তাদের অমলিন চিত্ররূপ।

হাঁটতে হাঁটতে বেলা হল, রোদ উঠল বেশ। পথের দুপাশে ছায়াঘন বনস্পতিরা ছিল বলেই তবু কোনোমতে হাঁটতে পারছিল কন্নকী। সেই পথও ঘুরে গেল পশ্চিমদিকে, কাবেরীর উত্তরতটে ঘন বনের মধ্য দিয়ে হাঁটতে লাগল ওরা। এসব স্থান প্রতি বছর কাবেরীর বন্যায় ভেসে যায়, বন্যার জল সরে গেলে পলল মৃত্তিকার বুকে আবার জেগে ওঠে অরণ্যভূম। বনের মধ্যে এক স্থানে ওরা বিশ্রাম নিতে বসেছিল, বিশেষত কন্নকী হাঁটতে পারছিল না আর। সঙ্গের পুঁটুলিতে সামান্য চিপিটক, তক্র ও গুড় ছিল; তাই দিয়ে মধ্যাহ্নবেলায় ওরা আহার সমাধা করল। তারপর আবার হাঁটতে আরম্ভ করল। এসব অরণ্য ঘন হলেও শ্বাপদসংকুল নয়। তবু খুব সাবধানে হাঁটতে হচ্ছে ওদের, কন্নকী তার কটিবস্ত্রের মধ্যে তাদের শেষ সম্বল সেই নুপুরজোড়া সন্তর্পণে বেঁধে নিয়েছে। রাত্রে কোনোমতেই পথ চলা যাবে না এই জন্যেই। শ্বাপদসংকুল না হলেও এ পথে দুর্বৃত্তদের উৎপাত অসম্ভব নয়। দিবাভাগেই যতটা পারা যায় হেঁটে পথ অতিক্রম করে যেতে হবে।

বনের মধ্যে কোথাও আলো, কোথাও গাঢ় অন্ধকার। কোথাও অনড় স্তব্ধতা, কোথাও ঝিঁঝিপোকাদের ছেদহীন ডাক, কোথাও শৃগাল বা বেজির চলে যাওয়ার আচম্বিত সর-সর শব্দ, কোথাও-বা পাখিদের অবিশ্রান্ত ডাকাডাকি। বনপথের মাথায় কোথাও দুপাশ থেকে বনস্পতিদের পত্রসম্ভার এগিয়ে এসে যেন সবুজ চন্দ্রাতপ রচনা করেছে, কোথাও আবার শাখাপ্রশাখা দুপাশে হঠাৎ সরে যাওয়ায় আকাশের থেকে তির্যক রৌদ্ররেখা চকিতে পথের উপর নেমে এসে ঘনান্ধকারে আলোকপ্রপাত রচনা করে রেখেছে। সারা দিনমান ধরে ওরা দুজন এ পথ দিয়ে চলতে লাগল । কোভালনের মনে হচ্ছিল, মানুষের জীবন কী অদ্ভুত ! দুদিন আগেও সে জানত না, এমন কোনো বনের পথ ধরে অজানা কোনো নগরীর দিকে যেতে হবে তাদের নিঃস্ব পায়ে পায়ে, পিছনে পড়ে থাকবে পরিচিত নগর, পরিচিত মুখ, যাপিত জীবনের আবাল্য স্মৃতি… এই সব পেরিয়ে পেরিয়ে কোথায় যে চলে যাচ্ছে তারা? সেই নতুন পৃথিবী কেমন লাগবে? মন বসবে সেখানে? আবার কি উঠে দাঁড়াতে পারবে? কন্নকীর মুখে হাসি ফোটাতে পারবে?

অপরাহ্ণ শেষ হয়ে আসছিল, কন্নকী হাঁটতে পারছিল না আর কোনোমতেই । শ্বাসবায়ু ফুরিয়ে আসছে, সমস্ত শরীর ঘর্মাক্ত, ক্লান্তিতে শ্লথ হয়ে গেছে গতি, দুটি চরণ তার ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত। তবু আশা সে ছাড়েনি, কোভালনের সঙ্গে গতি বজায় রেখে হাঁটবার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। এক জায়গায় এসে বন্য পুষ্পে ঢাকা একটি স্থানে কয়েকটি কুটির, কুটিরের পাশে একটি ক্ষুদ্র পুষ্করিণী চোখে পড়ল। কোনো তপস্বীর আশ্রম হবে বোধহয়। কোভালন বলল, ‘এখানে কারা থাকেন, খোঁজ নিয়ে দেখি। রাত্রিটা এখানেই যদি আমরা অতিবাহন করতে পারি….’

কন্নকী ম্লান হেসে কম্পিত স্বরে জিজ্ঞাসা করল, ‘কতদূর এলাম, বলো তো গো? মাদুরাই আরও কত দূরে ?’

কোভালন শ্রান্ত কণ্ঠে উত্তর দিল, ‘এক কাদম্ মাত্র এসেছি পুষ্পহার ছেড়ে, কন্নকী । মাদুরাই কি তোমার এখানে? এখনও এখান থেকে ত্রিশ কাদম্ দূর!’ একথাটা কন্নকীকে জানাতে মনে মনে বেশ খারাপই লাগছিল কোভালনের। তবু এত দীর্ঘ পথের কথা ভেবে কন্নকী যেন অযথা উদ্বিগ্ন না হয়, তাই তাড়াতাড়ি যোগ করল, ‘পথিমধ্যে আমাদের থেমে থেমে যেতে হবে। বেশ কিছুদিন লাগবে মাদুরাই পৌঁছোতে। এখন ওকথা বাদ দাও। সামনে দেখি চলো, এই বনমধ্যস্থ কুটিরে কে বা কারা থাকেন!’

কন্নকী বলল, ‘হ্যাঁ, সেই ভালো। চলো দেখি, যদি কোনোমতে রাতের আশ্রয় জুটে যায়!’

ক্ষুদ্রাকৃতি একটি স্থান, সেই স্থানটির চারিদিক থেকে অরণ্য যেন সরে গেছে অল্প দূরে পর্ণকুটির একটি মধ্যস্থলে। কুটিরের চারিপাশে বুনোফুলের ঝোপ। একটি প্রবৃদ্ধ রসাল দাঁড়িয়েছে বঙ্কিম ঠামে। অতিমুক্তলতা সেই আমগাছটিকে বুড়ি ঠাকুমার মতো সমাদরে জড়িয়ে ধরেছে। একটি অর্জুন গাছ একা মাথা তুলেছে যেন কর্তব্যনিষ্ঠ ধীরোদাত্ত কোনো ক্ষত্রিয় বীর। তার সুবৃহৎ কাণ্ডের উপর বসে রক্তিম মুকুট পাটল দেহ একটি কাঠঠোকরা কয়েক পল অন্তর অন্তর নিয়মিত ছন্দে চঞ্চু অবঘাত করছে। বনের নৈঃশব্দ্য ভেঙে ক্রমাগত সেই ‘আখেট্, আখেট্’ শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। এ অঞ্চলে পনস বৃক্ষ প্রচুর। কুটিরটির দক্ষিণদিকে তেমনই একটি রসিক পনস খর্বাকৃতি বিদষকের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার সারা গাত্র হতে বহু লম্বোদর কাঁঠাল ফল ঝুলে আছে। ওই পনস বৃক্ষেরই পাশে আয়তকৃষ্ণ নয়নের মতো শান্ত সলিলে পূর্ণ একটি জলাভূমি, তার জলের উপর দিয়ে অর্জনের ডাল থেকে উড়ে যাচ্ছে একটি শিকারপ্রত্যাশী পানকৌড়ি। শিরীষ, গামহার, শিংশপা, শাল্মলী, অশোক, সপ্তপর্ণী বৃক্ষেরা অন্তর্মুর্খ শ্রমণের মতো কায়োৎসর্গ ভঙ্গিমায় মাথা তুলে নীরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে বনের আকাশে। সমস্ত স্থানটির নীরবতা, গাম্ভীর্য ও ধ্যানময়তা চিত্তদ্ৰাবী।

বন্য পুষ্পের ঝোপঝাড় পার হয়ে শুষ্ক পত্ররাশিতে পদশব্দ তুলে ওরা এসে দাঁড়াল কুটিরটির পরিষ্কৃত সম্মুখভাগে। মাথার উপর শিস দিয়ে উড়ে গেল বুনো পাখি। কিছুক্ষণ পর ওদের উপস্থিতি টের পেয়ে কুটিরের আগড় সরিয়ে এক প্রৌঢ়া বাহির হয়ে এলেন । তাঁর পরনে একটি শ্বেতশুভ্র বস্ত্র। ঊর্ধ্বাঙ্গ শ্বেত উত্তরীয়ে আবৃত, মাথা ও মুখের চারিধারে সেই শুভ্র উত্তরীয়েরই অবগুণ্ঠন। মুখমণ্ডল অরুণবর্ণ, যেন সিন্দুরারুণ কোনো দেবীবিগ্রহের মুখশ্রী। দীর্ঘ পদ্মযুক্ত চোখ দুটি বড়ো বড়ো, নাসা উন্নত, সুদৃঢ় অধরোষ্ঠে বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের আভাস। কপাল বলিরেখাহীন মসৃণ, অথচ কপোলের ত্বক ঈষৎ লোল; ফলত মুখশ্রীতে কমনীয় স্নেহের আভাস ফুটে উঠেছে। প্রৌঢ়া অতি সুমধুর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে তোমরা, বাছা? কোথা থেকে আসছ ?’

কোভালন উত্তর দিল, ‘আমরা পুষ্পহারের লোক, সেখান থেকেই আজ প্রভাতে বাহির হয়েছি। আমার নাম কোভালন ও ইনি আমার স্ত্রী কন্নকী। আপনি কে, মা? এমন নির্জন বনভূমিতে কুটির বেঁধে আছেন !

প্রৌঢ়া মাথার চারিদিকে অবগুণ্ঠনটি একবার ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে উত্তর দিলেন, ‘আমি আর্যিকা কাভুন্দি। এখানে একান্তে বসবাস করি।’

কোভালন ও কন্নকী নতজানু হয়ে তাঁকে প্রণাম নিবেদন করল। আশীর্বাদের ভঙ্গিমায় দক্ষিণ করতল উত্তোলন করে তিনি বললেন, ‘সুমঙ্গল হোক! পুষ্পহার থেকে? সে যে অনেক দূর ! তোমরা দেখছি দীর্ঘ পথশ্রমে বড়ো ক্লান্ত হয়ে পড়েছ। বিশেষত ক্লেশকর পথে চলতে চলতে এই কন্যাটির কোমল পদপাত ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। পুষ্করিণীতে হস্তপদ প্রক্ষালন করে তোমরা কুটিরের মধ্যে এসে বোসো।’

হাতমুখ ধুয়ে কুটিরের মধ্যে এসে বসল কোভালন, কন্নকী। বৃদ্ধা দুটি পলাশপর্ণের পুটিকায় সত্তু ও আর্দ্র মুগসিদ্ধ পরিবেশন করে বললেন, ‘এটুকুই আছে। তোমরা খেয়ে নাও। আমার কাছে আর তো কিছু নেই।’

কন্নকী চমকিত হয়ে বলে উঠল, ‘মা, আপনি খাবেন কী রাত্রে?’

‘আমি সূর্যাস্তের পরে কিছু আহার করি না,’ এই বলে তিনি কী কাজে কুটিরের বাহিরে গেলেন।

পর্ণপুটিকায় সত্তু মেখে খেতে খেতে কুটিরের ভিতরটা কেমন, দেখছিল কোভালন । মাটির তৈরি ঘরখানি, পৰ্ণাচ্ছাদিত ছাদ, দেওয়ালে অনেকগুলি সীমিত পরিসর গবাক্ষ। গবাক্ষে পাকা বাঁশের দণ্ড পাশাপাশি ও আড়াআড়ি স্থাপন করে জালক নির্মাণ করা হয়েছে। মেঝে নিকোনো; এত পরিষ্কার যে সিঁদুরের গুঁড়ো পড়লেও বুঝি তুলে নেওয়া যাবে। একপাশে দুয়েকটি শ্বেত বস্ত্র ও উত্তরীয় সুসজ্জিত। একটি পাথরের পিলসুজের উপর মাটির প্রদীপ; সেই প্রদীপের চারিপাশে আবার কাচাবরণ—উজ্জ্বল শিখার প্রতি আকৃষ্ট পতঙ্গ যেন আগুনে এসে না পড়ে, তারই ব্যবস্থা। প্রদীপ অবশ্য এখন নিৰ্বাপিত, ঘৃতেন্ধন থেকে উত্থিত সলিতাটির প্রান্তমুখ ও দীপাঙ্কুর অগ্নিসংসর্গে গূঢ়কৃষ্ণ বর্ণ ধারণ করে রয়েছে। কক্ষের আরেকপাশে দুয়েকটি পুথি উৎপীঠিকার উপর রক্ষিত। পুথির আবরণের উপর দুয়েকটি বুনো ফুল। উৎপীঠিকার নীচে একটি ময়ূরপুচ্ছের দ্বারা নির্মিত পাখা মাটিতে একপাশে পড়ে আছে। ওই ময়ূরপাখাটি দেখে ইলাঙ্গো আডিগলের কথা মনে পড়ল কোভালনের। জলের কলস কক্ষের এক কোণে রক্ষিত, কলসের মুখে একখণ্ড শ্বেত বস্ত্ৰ বিছানো; সম্ভবত তপস্বিনী ওই বস্ত্রের সাহায্যে জল পরিশ্রুত করে পান করেন। এ কক্ষে আর তেমন কিছুই নেই। নিতান্ত সহজ, সরল, অনাড়ম্বর, তপোপৃত জীবনযাপনের চিহ্ন কক্ষের সর্বাঙ্গে পরিস্ফুট হয়ে রয়েছে।

কিছুক্ষণ পরে আর্যিকা কাভুন্দি কক্ষে ফিরে এলেন। দীপাধারের কাছে মেঝেতে বসতে বসতে বললেন, ‘এত অল্প আহার্যে তোমাদের বোধহয় খুব কষ্ট হচ্ছে, বাছারা । দেখে মনে হয়, তোমরা উচ্চবংশের সন্তান—সুদর্শন ও সদাচারসম্পন্ন। এত দূরের দেশ থেকে এত দুর্গম পথ দিয়ে তোমরা কোথায়ই-বা যাচ্ছ? কেনই-বা যাচ্ছ?’

কোভালন বলল, ‘আপনার অনুমান নির্ভুল, মা। আমি ও আমার স্ত্রী উভয়েই উচ্চবংশজাত ও বিত্তবান পরিবারেরই সন্তান। কিন্তু ভাগ্যের বিপর্যয়ে আজ আমরা পথে নেমেছি। বলার মতো গল্প আমাদের তেমন কিছুই নেই। আপাতত, মাদুরাই যাচ্ছি, দেখি যদি ভাগ্য ফেরে।’

মাদুরাই যাচ্ছে শুনে কাভুন্দি আপনমনে কী যেন ভাবতে লাগলেন। কিন্তু ক্ষণপরেই নিজের সে-চিন্তাস্রোতকে যেন আপাতত স্থগিত রেখে বললেন, ‘ভাগ্য ফেরে, নাকি অবশ্যম্ভাবী কর্মের প্রবাহ আমাদের অমোঘ ভবিতব্যের দিকে ঠেলে দেয়, সে বড়ো শক্ত কথা, বাবা ! তোমার স্ত্রী—এই মেয়েটি বড়ো কোমলা। ও কি পারবে এতটা পথ হেঁটে যেতে? কী জানি! আমি নিষেধ করলেও তোমরা তো আর আমার কথা শুনবে না । বেরিয়ে পড়েছ যখন জেদ করে, মাদুরাই তোমরা যাবেই। নিয়তি কেন বাধ্যতে!’ এই বলে কাভুন্দি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন।

ইতোমধ্যে ওদের খাওয়া শেষ হয়ে গেল। পর্ণপুটিকাগুলি মেঝে থেকে তুলে নিয়ে ওরা পার্শ্ববর্তী পুষ্করিণীতে মুখহাত ধুতে গেল। বাইরে সন্ধ্যার অন্ধকার ক্রমশ ঘনায়মান । বৃক্ষের অন্তরাল হতে শীতল বাতাস চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। কক্ষে ফিরে এসে ওরা দেখল, কাভুন্দি প্রদীপ জ্বেলেছেন। দীপের চারিধারে সন্তর্পণে কাচাবরণ পরাচ্ছেন। কন্নকী-কোভালনকে ফিরে আসতে দেখে তিনি বললেন, ‘কাল প্রভাতে যা হোক কিছু করা যাবে। আজ রাতে তোমাদের এই কক্ষেই বিশ্রাম নিতে হবে। কিন্তু তোমাদের বুঝি খুব কষ্ট হবে। খুব! এই কক্ষের রুক্ষ মেঝেতেই ঘুমোতে হবে। আমি তো ভূশয্যাতেই শয়ন করি । জানি না, তোমরা পারবে কি না !

কন্নকী বলল, ‘আমাদের কোনো কষ্ট হবে না, মা। আমরা সব পারব। আপনি কিছু চিন্তা করবেন না।

গবাক্ষপথে দেখা যায়, বনের গাছগুলোর গায়ে কুয়াশা জড়িয়ে আছে। সেই কুহকমিশ্রিত অন্ধকারের মধ্যে অপরিসীম নৈঃশব্দ্য থমথম করছে। মাঝে মাঝে শুধু গাছেদের নড়াচড়ার শব্দ। কী একটি কীর্ণ পতঙ্গ মাঝে মাঝে থেমে থেমে ডেকে উঠছে। তাতে নৈঃশব্দ্য লঘু হচ্ছে না, আরও বেশি গাঢ়তা পাচ্ছে। এই সন্ধ্যাকালেই যদি এমন গম্ভীর পরিবেশ, তাহলে মধ্যরাতে এখানে না জানি কোন ত্রাসসঞ্চারী নীরবতার আবির্ভাব হয় !

সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কন্নকী বলল, ‘আপনি এমন নির্জন স্থানে বনপ্রান্তে থাকেন; ভয় করে না ?’

কন্নকীর কথা শুনে কাভুন্দি হাসলেন। বললেন, ‘ভয়? ভয় তারই হয়, যার জীবনে আশা আছে, আকাঙ্ক্ষা আছে। কিন্তু যে-ব্যক্তি জীবনের সমস্ত আকাঙ্ক্ষাকে নিঃশেষে ত্যাগ করেছে, সে একেবারে নির্ভয় হয়ে যায়। এমনকি যে-ব্যক্তি অশুভ আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলিকে জয় করার প্রচেষ্টাটুকুও করে চলে, তাকেও ভয় ক্রমে ক্রমে ছেড়ে চলে যায় । এখান থেকে আধক্রোশ দূরে গ্রাম। দিনের বেলায় গ্রামের লোক বনে কাঠ কুড়োতে আসে। রাতে অবশ্য কেউ এদিকে পা মাড়ায় না। প্রথম প্রথম আমারও ভয় করত। তারপর কী জানি, বোধহয় এ পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, তাই ভয় লাগে না ।’

কোভালন জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে কত বছর আছেন ?’

বৃদ্ধা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, হবে তা প্রায় বিশ-বাইশ বছর !

‘কুটির কি আপনিই নির্মাণ করেছেন ?’

‘না, না। আমি এখানে আসার আগেও এ কুটির ছিল। তখন এখানে এক বৃদ্ধ বৌদ্ধ ভিক্ষু বাস করতেন, শুনেছি। তাঁর দেহান্ত হলে এ কক্ষে নিষাদরা তাদের ধনুর্বাণ, কুঠার, ভল্ল ইত্যাদি রাখত।

তারপরে আমি এখানে এলে তারা কক্ষটির সংস্কার-সাধন করে আমাকে থাকতে দেয় ।’

কোভালন মনে মনে ভাবছিল। এই কক্ষটির ইতিহাসও কী বিচিত্র! মধ্যে এ কক্ষ সহিংস নিষাদরা ব্যবহার করত। সেই কালের আগে একজন অহিংস বৌদ্ধ ভিক্ষু এখানে বাস করতেন। আবার সহিংস নিষাদদের পরে এ কক্ষে সম্প্রতি কাভুন্দির মতো একজন নিরীহ, অহিংস জৈন সন্ন্যাসিনী ধ্যান, তপস্যা নিয়ে বসবাস করছেন। কক্ষটি নিষ্প্রাণ – হিংসা বা অহিংসার কথা কিছুই জানে না। কোভালনের মনে পড়ল, পুষ্পহারে কাবেরীতীরে অতীতে এক স্থানে চোলসৈন্যদের একটি স্কন্ধাবার ছিল। এখন সেই স্কন্ধাবারটি সেখানে আর নেই, অন্যত্র সরে গেছে। স্কন্ধাবারের স্থলে এখন সেখানে একটি শিবের মন্দির হয়েছে। কোনো স্থানে কিছু নেই, সেই স্থানকে কীভাবে ব্যবহার করা হবে, তাতেই সেই স্থানের স্থান-মাহাত্ম্য।

কোভালনকে চিন্তামগ্ন দেখে কাভুন্দি বললেন, ‘কিছু কি ভাবছ ?’

কোভালন আত্মমগ্নতা থেকে জেগে উঠে বলল, ‘ন-না, না! কিছু না। ভাবছি…. আপনি কি এ কক্ষে ধ্যান করেন ?’

কাভুন্দি বললেন, ‘আমি ধ্যান করার চেষ্টা করি, বাবা। কিন্তু আমি সামান্য মানুষ ধ্যান আমার হয় না। ধ্যান তো অনেক দূরের অবস্থা। আমি এখনও ধ্যান করার যোগ্য হয়ে উঠিনি। এখনও আমি পঞ্চ মহাব্রত নিয়েই আছি।’

কন্নকী জিজ্ঞেস করল, ‘পঞ্চ মহাব্রত? সে কেমন ?’

কাভুন্দি বললেন, ‘প্রথমত, কায়মনোবাক্যে সত্যের অনুশীলন করা। আমি পারতপক্ষে কখনও অসত্য বাক্য উচ্চারণ করি না। মনে মনেও মিথ্যা কল্পনাকে প্রশ্রয় দিই না । দ্বিতীয়ত, বচনে, আচরণে বা চিন্তায় কারও প্রতি হিংসা না করার প্রাণপণ চেষ্টা করি ৷ কাউকে আঘাত না দেওয়ার চেষ্টা করি। তৃতীয়ত, আমি অহৎদের সেই সংশুদ্ধ অবস্থার কথা কল্পনা করার চেষ্টা করি, যে-অবস্থায় কোনো কামচিন্তা বা কাম্যবস্তুর কল্পনা তাঁদের শান্ত মনকে বিচলিত করে না। চতুর্থত, আমি কখনও চুরি করি না। আমি মৌমাছিদের মতো ফুলের মধু অপহরণ করি না। মধুকরদের দ্বারা নির্মিত মধুচক্র থেকে ভল্লুকের মতো মধু লুণ্ঠনও করি না। বানর বা বায়সের মতো গাছ থেকে ফল কেড়ে খাই না । মাছেদের মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পতঙ্গের প্রাণ হরণও করি না। আমি শুধু ময়ূরের মতো বৃক্ষ থেকে পতিত ফল বা পাতা আহার করি, তাও বৃক্ষ যখন যেমন ভিক্ষা দেয়, তেমনই। ততটুকুই। পঞ্চমত, আমি কারও কাছ থেকে কখনও কোনো উপহার বা উপঢৌকন গ্রহণ করি না। কারণ উপঢৌকন গ্রহণ করলে দাতার কাছে আজীবন ঋণী হয়ে থাকতে হয়। এই আমার পঞ্চ মহাব্রত। এরই অনুশীলন মাত্র করছি। নিখুঁত হতে পারিনি । ধ্যান তো অনেক দূরের ব্যাপার, বাছা! অর্হৎ, সিদ্ধ, আচার্য, উপাধ্যায়রা ধ্যান করতে পারেন। আমি নিতান্ত সামান্য মানুষ, আমার কোনো অলৌকিক ক্ষমতা বা ঋদ্ধি নেই। ধ্যানে আমি এখনও সমর্থ নই। তবে সময় এলে আমিও হয়তো পারব।’

কোভালন ও কন্নকী মুগ্ধ হয়ে আর্যিকা কাভুন্দির কথাগুলি শুনছিল। ভাবছিল কোভালন, কত সহজ কথাগুলি অথচ কত প্রত্যয়ী। এমন নির্লোভ, সহজ, সুন্দর জীবন এর আগে সে কখনও দেখেনি। কখনও স্বপ্নেও কল্পনা করেনি । এত শান্তি এই অনাড়ম্বর জীবনে !

আচ্ছা, আর্যিকা কাভুন্দি এখানে আসার আগে কোথায় ছিলেন? তিনি কি সংসার করেছিলেন? সেখান থেকে এখানে এলেন কীভাবে? কেমন ছিল তাঁর আগের জীবন? এই সমস্ত কৌতূহলী প্রশ্ন কোভালনের মনে জাগলেও, এসব প্রশ্ন করা সঙ্গত হবে কি? যে-জীবন কাভুন্দি পরিত্যাগ করে চলে এসেছেন, সেই জীবনের কথা তাঁকে মনে করিয়ে দেওয়া আর উচিত নয়।

কন্নকী ভাবছিল, ইনি বলছেন, ইনি ধ্যান করতে পারেন না। এঁর কোনো অলৌকিক ক্ষমতা নেই। সত্যিই তো, কাভুন্দি তো আর শাক্যসিংহ বুদ্ধ বা জিনেন্দ্র মহাবীর নন। এমনকি কোনো সিদ্ধ অর্হৎও নন। আর্যিকা কাভুন্দি একজন সাধিকা তপস্বিনী, আধ্যাত্মিক জীবনের একেবারে প্রাথমিক অবস্থায় তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সেকথা তিনি নিজমুখেই বলেছেন। তাহলে যে-মহাজীবনের একেবারে প্রারম্ভ দশাতেই এত শান্তি, এত সৌন্দর্য পাওয়া যায়, সেই অধ্যাত্মজীবনের পরিণত দশায় বা অন্তিমে কোন অপার্থিব অনুভব, কোন কৃতকৃত্যতা নিশ্চিতভাবে অপেক্ষা করে রয়েছে, ভাবলে বিস্ময়ের অবধি থাকে না ।

ওদের দুজনেরই এমন উদাসী ভাব দেখে কাভুন্দি অন্য কথা পাড়লেন। বললেন, ‘তোমরা তো বললে মাদুরাই যাবে? তাই না ?’

কোভালন বলল, ‘হ্যাঁ, মা। মাদুরাই যাব বলেই তো বেরিয়েছি !”

খানিক কীসব চিন্তা করে কাভুন্দি বললেন, ‘মাদুরাই আমি অনেক আগে গিয়েছি। তখনও আমার মন তৈরি হয়নি। মাদুরাই বড়ো পুণ্যক্ষেত্র, সেখানে আমাদের তীর্থংকরের পাট। কত অকামাহত সিদ্ধ অর্হৎ সেখানে তপস্যা করে সিদ্ধ হয়েছেন, মনের সমস্ত মলিনতা থেকে নির্মুক্ত হয়েছেন, লোকসাধারণের মধ্যে ধর্মপ্রচার করেছেন। আমার তো বড়ো সাধ ছিল, একবার মাদুরাই যাব। সেখানে তীর্থংকরদের উপাসনা করব। সিদ্ধ অর্হৎদের ধর্মবাণী শুনব। তবে সে আর হয়ে উঠল না। এ শরীরের বয়েস হয়ে গেছে, বাবা। উপযুক্ত সময় চলে গেছে।’

কথাটা শুনে কোভালনের মনে একটা পরিকল্পনা এল। সে বলল, ‘আপনি আমাদের সঙ্গে মাদুরাই চলুন না কেন, মা! আমরা তো সেখানেই যাচ্ছি। আমরা সঙ্গে থাকলে পথে আপনার কোনো অসুবিধে হবে না। আর আপনি সঙ্গে থাকলে পথিমধ্যে আমাদেরও কোনো বিপদে পড়তে হবে না ।’

বৃদ্ধা ভাবতে লাগলেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে তিনি বললেন, ‘ভালো বলেছ তো ! আমিও তো তাহলে কাল ভোরে তোমাদের সঙ্গে যাত্রা করতে পারি। বেশ, তাই করব। কিছুদিন তাহলে মাদুরাই থেকেই ঘুরে আসি!’

কোভালন ও কন্নকীর মুখ আনন্দোৎফুল্ল হয়ে উঠল। এত সহজে যে কাভুন্দি রাজি হবেন, ওরা তা ভাবেনি। আসক্তিশূন্য মন কত অনায়াসে সিদ্ধান্ত নিতে পারে !

বৃদ্ধা বললেন, ‘কিন্তু তার আগে পন্থা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। মাদুরাই যাওয়ার তিনটি পন্থা। প্রথমটি বনপথ ধরে। দ্বিতীয়টি মাঠের পথ ধরে। আর তৃতীয়টি কিছুটা বনপথ দিয়ে, কিছুটা আবার মেঠোপথ দিয়ে। সমস্ত পথই বেশ কঠিন ও শ্রমসাধ্য। কন্নকীর খুবই কষ্ট হতে পারে। কোন পথ দিয়ে যাব আমরা, কোন পথে তুলনামূলকভাবে কম কষ্ট হবে, সেটা আগে ঠিক করা দরকার।’

কোভালন একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘আমার মনে হয়, তৃতীয় পন্থাই উত্তম। বন আর মাঠ মেশানো। তাতে যাত্রাপথের ক্লান্তি ও একঘেয়েমিও দূর হতে পারে। প্রতিদিন এক কাদম্ পথ আমরা স্বচ্ছন্দে অতিক্রম করতে পারব।’

কাভুন্দি বললেন, ‘ঠিক বলেছ। যথার্থ নির্ণয়। তাহলে এখন আর কালক্ষেপ না করে আমরা বিশ্রাম নিই, চলো। কাল সূর্যোদয়ের আগেই যাত্রা আরম্ভ করব।’

প্রদীপ স্তিমিত করে কক্ষের একদিকে ভূমির উপর কাভুন্দি প্রার্থনায় বসলেন । প্রার্থনান্তে সেখানেই শয়ন করবেন তিনি।

কক্ষের অপরদিকে ভূশয্যায় কোভালন ও কন্নকী শয়ন করল। কন্নকী প্রথমে ভূমিতে শয়ন

করে তার আধখানা আঁচল মাটিতে পেতে কোভালনকে সেই আঁচলের উপর শুতে বলল।

শব্দহীন নিশীথকাল। শুয়ে শুয়ে ওরা দেখছিল, প্রদীপের স্তিমিত আলোয় কক্ষের অপরপ্রান্তে শুভ্রবস্ত্রা কাভুন্দি প্রার্থনানিরত। ধীরে ধীরে ওদের চোখে ঘুম নেমে এল। কোনো চিন্তা নয়, কোনো স্বপ্ন নয়, নিশ্চিন্ত গভীর নিদ্রা ।

অনেক দিন পরে আজকের এই রাত্রিটির কথা মনে পড়বে ওদের। এমন আশ্চর্য শান্তিময়ী রাত্রি ওদের জীবনে আর কখনও আসেনি। দুজনে দুজনার প্রতি ওরা এত ভালোবাসাও কখনও কোনোদিন অনুভব করেনি সমস্ত জীবনে ।

(বত্রিশ) যাত্রারম্ভ

পরের দিন ভোরে ঘর পেছনে ফেলে বেরিয়ে এল পথে ওরা তিনজন। মৌন কুটিরটিকে মন্দিরের মতো চারিধারে প্রদক্ষিণ করে প্রণাম জানিয়ে যাত্রা আরম্ভ করল। ঘন বনপথ । রাতে বোধহয় বনমধ্যে কখনও মৃদু বৃষ্টিপাত হয়েছিল, জলের বিন্দু শিশিরের মতো থমকে আছে গাছের পাতায়। এ বনাঞ্চলে বুনো ফুলেদেরই রাজত্ব । অজস্র নাম-না-জানা বুনো ফুল। তাদের কত যে বিচিত্র রং। ক্ষুদ্রাকৃতি হালকা বেগনি রঙের রোমশ ফুল, চার-পাঁচ হলুদ পাপড়িযুক্ত পাটল কর্ণিকার আনন্দবাহার, অগণ্য বিন্দুবৎ শ্বেতদল অটবীকুসুম বনের শীর্ষদেশ ভাস্বর করে রেখেছে। প্রাচীন বনস্পতি সব, তাদের গায়ে গায়ে জড়িয়ে জড়িয়ে উঠেছে উজ্জ্বল স্বর্ণলতা। কোথাও বনের মধ্যে অপরিসর জলাশয়—মনুষ্যনির্মিত নয়—ভূভাগের উচ্চাবচতা এখানে প্রকৃতিসিদ্ধ; অবচ ভূমিতে বৃষ্টির জল জমে জমে এই সব প্রাকৃতিক জলাশয়ের জন্ম। জলের উপরিতল শুকনো পাতা পড়ে পড়ে পাটল হয়েছে। শৈবালের দাম, ঝাঁঝি ও অন্যান্য বনজ লতায় জলতল আকীর্ণ।

কোথাও ঘন বাঁশের বন চারিপাশে নত হয়ে আছে, বাঁশবনের নীচে ঝুপসি হয়ে আছে অন্ধকার । কত সহস্র সহস্র বৎসর এসব বাঁশবনে মনুষ্যকুল প্রবেশ করেনি, মানুষ হাত রাখেনি কখনও এদের গায়ে, বারবার জন্মে মরে গেছে এরা, আবার পুনর্জাত হয়েছে। কখনও কাবেরীর প্লাবিত জল ঢুকে পড়েছে এসব বাঁশবনের ভিতর, সেই জলের মধ্যে কতকাল মুখ ডুবিয়ে রেখেছে এরা নিঃশব্দে। আবার জল সরে গেলে পলল মৃত্তিকার স্নেহে মাথা তুলেছে নীলাকাশে। হাজার হাজার বছরের অন্ধকার জমে আছে এসব বাঁশঝোপের নীচে। সেই দিকে তাকিয়ে কোভালনের মনে পড়ছিল ইন্দ্রপুত্র জয়ন্তর কথা—স্বর্গ থেকে শাপভ্রষ্ট হয়ে বিন্ধ্যারণ্যে এক জীবন তিনি বেণুজন্মে অতিবাহিত করেছিলেন, এমন লোকশ্রুতি আছে। সবাই বলে, উর্বশীমুগ্ধতাই ছিল তাঁর অভিশপ্ত জীবনের হেতু। কিন্তু খুবই অভিশপ্ত কি? কোভালন মনে মনে ভাবে। এমন নির্জন বনতলে নীল নক্ষত্রমেঘের নীচে একটা জীবন মর্মরশব্দে বেণুদণ্ডরূপে বনের বাতাসে দুলতে দুলতে কাটিয়ে দেওয়াই যায়—সৌন্দর্যমুগ্ধ যুবকের এই পরিণতি কি এতই করুণ ?

এই শান্তি, এই মৌন—এই কি নয় সমস্ত কবিজীবনের অতিকাঙ্ক্ষিত পরিণতি? মাধবীকে ভালোবাসার অপরাধে কোভালন নিজে যদি এসব বাঁশের ঝোপে নির্বাসিত হত, যদি মাধবী স্বয়ং তাকে এই নির্বাসন দিত, মধুরবিষাদবিষে ভরে যেত না কি তার তনুপ্রাণমন ? সে তখন তার প্রেমের কথা, মিলনের আনন্দকথা, বিরহের বেদনাগাথা অবশিষ্ট জীবন ধরে শুনিয়ে যেত অন্ধকারকে, বুনো ফুলেদের, আকাশপথে উড়ে আসা মেঘেদের, বনের বাষ্পাকুল বাতাসশিশুদের, নৈশ আকাশের নীলমণি নক্ষত্রদের… কী এমন তাতে ক্ষতি হত তার ?

বনবায়ে মর্মরিত নির্জন বেণুবনে মানুষের হাত না লাগলেও, এ বন যে নিতান্ত মনুষ্যবর্জিত নয়, তার প্রমাণ মিলল কিছু পরেই। বন্য পন্থার পাশে কোনো কোনো গগননিষ্ঠ উত্তান তরুমূলে সিন্দূরলিপ্ত প্রস্তরখণ্ড দেখা গেল। বনেচর মানুষ কখনও এসব পাথরের খণ্ডে দেবতার আরাধনা করেছে নিজ নিজ বিশ্বাসমতো। হয়তো সেই একবারই পূজা করেছে অরণ্যচর মানুষ এখানে, তারপর ভুলে চলে গেছে। এখন সেসব সিঁদুর মাখা পাথরের গায়ে সকালের আলোয় নাম-না-জানা সোনালি ফুলের পাপড়ি ঝরে ঝরে পড়ছে। রাঙা সিঁদুরে, শ্যাম শৈবালে, স্বর্ণালি কুসুমরেণুতে প্রায়াচ্ছাদিত সে-সমস্ত কৃষ্ণ প্রস্তর যেন পার্বতীসহিত পরমেশ্বরের মতো বিজন তরুমূলদেশে কোনো অজ্ঞাতপরিচয় উপাসকের শ্রদ্ধার স্মারক হয়ে পড়ে আছে এখন। যুবতী কন্নকীর সেই মনোন্মথনকারী সৌন্দর্যের প্রতি তার প্রথম প্রণয়োপাসনাকেও কাবেরীঘাটে সেও কি রেখে আসেনি এই সব স্মারকপ্রস্তরের মতন—ভাবছিল মনে মনে কোভালন। এই সব অরণ্যচারী মানুষের সরল শ্রদ্ধার্ঘ্য আর তার নিজের মনের বিমুগ্ধ উপাসনা, এই দুই কোথাও গিয়ে যেন অব্যবহিতভাবে মিশে যাচ্ছিল।

কন্নকীর প্রতি এখন আর সেই তীব্র সংরাগসর্বস্ব অনুরক্তি সে অনুভব করে না । আসক্তিপূর্ণ প্রেমের ভাব, আসঙ্গলিপ্সা তার মন থেকে চিরদিনের জন্য চলে গেছে। হয়তো মাধবীই নিয়ে চলে গেছে কোভালনের হৃদয় থেকে তার সমস্ত রূপারতি। কনকীর প্রতি তার এখন গভীর স্নেহের ভাবই হয়। কীভাবে সে কন্নকীকে রক্ষা করবে প্রতি মুহূর্তে, কীভাবে কন্নকীর সুখকে, দুঃখকে গভীরভাবে অনুভব করতে পারবে, কীভাবে এই সুনির্জন, সুদুর্গম বনমার্গ দিয়ে পথপীড়িতা কন্নকীকে সে নিয়ে যাবে কোনো আশাশীল নগরীর সুস্থ জীবনের দিকে—এখন সে এই সবই ভাবে। একেই প্রেম বলে কি না, ভালোবাসা বলে কি না—সে জানে না। আর ওসব জেনেই-বা কী হবে ?

একটি শালযষ্টি হাতে নিয়ে কোভালন সম্মুখে চলেছে। কন্নকী আসছে তার পেছন পেছন। একেবারে পেছনে আরেকটি শালযষ্টি হাতে আসছেন আর্যিকা কাভুন্দি। ধীরে ধীরে রোদ বনশীর্ষে উঠে গেছে। ছায়াঘন বনপথ দিয়ে যাচ্ছে, এই তো সৌভাগ্য । এমন না হলে প্রখর সূর্যতাপে কন্নকী খুব কষ্ট পেত ।

ক্রমশ বনের রূপ পরিবর্তিত হচ্ছে। পথের দুপাশে সারি সারি চাঁপাগাছের বন।

চম্পকের সৌরভে দীর্ঘ বনপথ আমোদিত। এতক্ষণ যে-পথ ধরে তারা এসেছে, তাতে বিহগকাকলি বেশি শুনতে পায়নি। সে ছিল প্রায় নীরব এক বনভূমি। কিন্তু এখন এই চম্পকতরুবীথিকার কাছে এসে বিহগকূজন ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে। আসলে বনভূমি যখনই কাবেরীর তটভাগ থেকে দূরে যাচ্ছে, তখনই তা বিহগবিরল হয়ে উঠছে। আবার যখন বনাঞ্চল কাবেরীর তট ঘেঁষে সরে আসছে, পাখিদের ভিড় তখনই বেড়ে উঠছে সেই বনে । কোভালন মন দিয়ে দেখছিল, কত রকমের পাখিই না রয়েছে এখানে। কত বর্ণের, কত সুরের পাখি !

তাম্রাক্ষ পরভৃৎ কোকিল ডেকে উঠছে মুহুর্মুহু। আত্মঘোষ কাকেরও অভাব নেই । মাঝে মাঝে কাবেরী-সন্নিকটবর্তী বনভূমিতে গাছের পাতার আড়ালে এসে বসছে জলবায়স মদ্‌গু। দূরে কলহংসমুখর বালিহাসের ওড়াউড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে। বন একটু নির্জন হয়ে এলেই কাঠঠোকরার চঞ্চু-অবঘাতের সেই ‘আখে আখে’শব্দ। কন্নকীর চোখের মতন কালো খঞ্জন বনপথের পাশে চাঁপা গাছের সবুজ পাতার মধ্যে থেকে উঁকি দিচ্ছে। চাতক, চক্রবাক, টিট্টিভ, ডাহুকের কলতানে, শুক-শারিকার প্রেমালাপে আর কলহপ্রিয় চটক-চটকার তর্কবিতর্কে মুখর হয়ে উঠছে বনের আকাশ। এ জায়গাটায় এত পাখি ডাকে, পরস্পর কথা বলা যায় না, কথাতে বাধা পড়ে ।

কিন্তু পাখিদের গান শোনায় আর গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে পাখি খুঁজে বেড়ানোতে বিপদ আছে এখানে। সেকথা কাভুন্দি বারবার করে মনে করিয়ে দিচ্ছেন। নদীতীরবর্তী এসব স্থানে এক ধরনের উদ্ভিদ জন্মায়, যারা জন্মে এক বছরের মধ্যেই বন্যার জলে নষ্ট হয়ে যায়। অথবা হয়তো তাদের স্বাভাবিক আয়ুই এক বৎসরব্যাপী। তারা মরে যায়, কিন্তু মাটির নীচে ওই সব বীরুৎজাতীয়দের মূল রয়ে যায়, তাকে বলে ‘বল্লী’। বনেচর মানুষেরা এসব স্থানে মাটি খুঁড়ে ওই বল্লীমূল বের করে আনে। তারা বল্লী খায়। কিন্তু বল্লী বের করে নেওয়ার পর বিবরগুলি আর মাটি দিয়ে বুজিয়ে দিয়ে যায় না তারা। কালক্রমে গাছের শুকনো পাতা পড়ে বিবর ঢাকা পড়ে, তার উপর আবার এসে পড়ে শুকিয়ে যাওয়া ম্লান চাঁপাফুল। উপর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই, পথিমধ্যে স্থানে স্থানে পাতার স্তূপের নীচে লুক্কায়িত গর্ত আছে। তাই পক্ষিকূজনমুগ্ধ অন্যমনস্ক পথিক প্রায়শই বুঝতে না পেরে এই মৃৎকন্দরে পা ফেলে সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কখনও এমন দুর্ঘটনায় পা মচকে যাওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল।

কাভুন্দির সতর্কতায় ত্রস্তা কন্নকী শুকনো পাতায় ঢাকা মাঝপথ ছেড়ে পথের ধার ধরে হাঁটার চেষ্টা করছিল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছিল তাতেও। পথের একেবারে ধার ঘেঁষে সারি সারি পনসতরু। সেই সব তরুর গা দিয়ে স্ফীতোদর কাঁঠালের ফল লম্বিত। খুব ধার দিয়ে গেলে মুখে মাথায় সেই বিশালাকার কণ্টকিত ফলগুলির আঘাত পেতে হবে। এই সব দেখে কোভালন তাই আপাতত পাখির খোঁজ ছেড়ে দিয়ে পথের উপর শালযষ্টি ঠুকে ঠুকে সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা করে করে সামনে এগোচ্ছিল — পথিমধ্যে শুষ্কপত্রের -স্তূপের নীচে কোথাও কোনো লুক্কায়িত বিবর আছে কি না। কন্নকী আসছিল তার পরে । পথশ্রমে সে ঘেমে উঠছিল বারবার, তার কপালের উপর স্বেদবিন্দু মুক্তার মতো টলমল করছিল।

কাভুন্দি এগিয়ে এসে কন্নকীর পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘আরেকটু এগোলেই আমরা মেঠোপথ পাব, মা। রোদটাও তখন পড়ে আসবে। এ পথের কষ্টও শেষ হয়ে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। এখানে কোথাও বসে এখন বিশ্রাম নিয়ে মধ্যাহ্নের আহার সমাধা করি চলো!’

একটি চম্পকতরুর নীচে বসে কাভুন্দি তাঁর পুঁটুলি থেকে কিছু লাজ, পৃথক, খণ্ডগুড় ও কদলী বের করলেন এবং কন্নকী শালপত্র দিয়ে পুটিকা রচনা করতে লাগল । পানীয় জল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কাবেরীতটের দিকে গেল কোভালন ৷

(তেত্রিশ) প্রিয়দর্শনা

আহার সমাধা হলে পুনরায় তিনজন যাত্রা আরম্ভ করল। বন ফুরিয়ে এল ধীরে ধীরে। কাবেরীতীরস্থ কৃষিক্ষেত্রসমূহ দেখা দিল। দিকচক্রবাল অবধি বিস্তারিত চাষের ক্ষেত, জমির মধ্য দিয়ে শীর্ণ আলপথ। দুপুরের রোদ পড়ে এসেছে এতক্ষণে। আকাশে হালকা মেঘ থাকায় সূর্যরশ্মির তাপও এখন আর তত পীড়াদায়ক নয় ।

পুরোভাগে কোভালন, মধ্যে কন্নকী ও পশ্চাতে কাভুন্দি ধীরগতিতে চলতে লাগলেন। এক স্থানে ক্ষুদ্রাকার কী এক উদ্ভিদের ব্যাপক চাষ হচ্ছে এবং উদ্গত বীরুতের সমান্তরাল সারির মধ্য দিয়ে জলসেচের উপযোগী নালা পরিপাটি নির্মিত হয়েছে দেখে সরলা কন্নকী প্রশ্ন করল, ‘এই গুল্মগুলি কী জাতীয়, মা?’

কাভুন্দি একটু হাসলেন। বললেন, ‘রূপচর্চায় ব্যবহার করো আবার রান্নাতেও ব্যবহার করো, চিনতে পারছ না?’

কন্নকী অপ্রতিভ মুখে উত্তর দিল, ‘না তো !’

‘তা চিনবেই-বা কী করে? ওর যা সম্পদ, সবই তো মাটির তলায়। হরিদ্রা গো, হরিদ্রা ! আর ওই দ্যাখো, ওই দিকে আর্দ্রকের চাষ করা হয়েছে। এমনকি প্ৰসাধনকলা যে-কস্তুরীহলুদ ব্যবহার হয়, তারও চাষ এখানেই আছে। এই যে ভালো করে দ্যাখো, এদের পাতা কিন্তু একটু আলাদা। উঁহুহু, সাবধানে, সাবধানে! বেশি ঝুঁকলে ক্ষেতের উপর পড়ে যাবে, মা !’

আদা-হলুদের গুল্ম দেখতে গিয়ে কন্নকীর পায়ে শক্ত, ভোঁতামতো কী যেন ফুটল । ব্যথায় ‘উঃ’করে উঠে তখনই পা সরিয়ে নিল কন্নকী। কোভালন সেই জায়গাটা শালযষ্টি দিয়ে খোঁচাতে একটা কাঁঠালের বীজ বেরিয়ে এল মাটির নীচ থেকে। কাভুন্দি বললেন, ‘দেখেছ, বাছা? রাখাল ছেলেরা কাঁঠাল ছাড়িয়ে খেয়ে বীজগুলো কেমন মাটিতে ফেলে গেছে! সাবধানে চলো ! পায়ের পাতায় তেমন তেমন ব্যথা লাগলে কিন্তু এগোনো মুশকিল হয়ে যাবে।’

কাবেরীর তীরবর্তী এসব ভূমি অত্যন্ত উর্বর; কৃষিকার্যের উপযোগী। আদা-হলুদের ক্ষেত পেরিয়ে গিয়ে ওরা দেখল অনেক দূর পর্যন্ত ইক্ষুচাষ করা হয়েছে। ঘনসন্নিবিষ্ট আখের ক্ষেত নীল হয়ে আছে। দীর্ঘ সবুজ পাতার মধ্য দিয়ে স্বর্ণাভ ইক্ষুদণ্ডগুলি সতেজ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে মনের মধ্যে পুরোনো একটা স্মৃতি ভেসে এল, আনমনে হাসল কোভালন। ইক্ষুদণ্ড দিয়ে কামদেবের ধনুক নির্মিত—এমনই কল্পনা করা হয়। বিবাহের পরে পরে কন্নকীর উন্মুক্ত কাঁধে, গলায় স্বেদবিন্দুর উপর আঙুল বুলিয়ে বুলিয়ে কোভালন ইক্ষুদণ্ড আঁকত রতিক্রিয়ায় ঔৎসুক্য বোঝাতে। কী ছেলেমানুষই যে ছিল তারা তখন ! কত দিন আগের কথা সেসব !

আখের ক্ষেতে মৌমাছিরা গুনগুন করছে। ক্ষেতের ভিতর মৌচাক বানিয়েছে বোধহয় । ক্ষেতের চারপাশ দিয়ে জলনিকাশী নালা, সেই নালা দিয়ে কুলকুল করে জল বইছে। তাই দেখে জলতৃষ্ণা পেল কোভালনের। বলল, ‘এই জল তো বেশ নির্মল ৷ পান করা যায় না এক কোশ ?’

কন্নকীও বলে উঠল, “হ্যাঁ, বেশ স্বচ্ছ জল। খেলে কী আর হবে?’

কাভুন্দি কিন্তু উত্তর দিলেন, ‘না, এ জল খেও না, মা, তোমরা। সামনে কোথাও জলাশয় পেলে তেষ্টা মিটিও। আমারও তেষ্টা পেয়েছে খুব। কিন্তু উপায় নেই ।’

কোভালন জিজ্ঞেস করল, ‘এ জল কি তবে খারাপ?’

‘হ্যাঁ, বাবা। দেখছ না কেমন জোর হাওয়া দিচ্ছে? কাবেরীর হাওয়ায় যখন অমনি আখের ক্ষেত দুলতে থাকে, তখন অনেক সময় ওই মৌচাকগুলো আখের গা থেকে এই নালার উপর খসে পড়ে। তখন মধু আর মৌমাছি এই জলের সঙ্গে মিশে যায়। জল বিষাক্ত হয়ে যায়। ওই দ্যাখো না, চাষীরা ক্ষেত থেকে আগাছা পরিষ্কার করে নালার পাড়ে রেখেছে। শাপলা, কল্মীলতা, ঘাসের চাপড়ার মধ্যে এই দেখছ ফড়িংগুলো কেমন পড়ে আছে ?’

কন্নকী বলল, ‘এরা মরে গেছে নাকি ?’

কাভুন্দি বললেন, ‘না-না, মরেনি। নালার মধু মেশানো জল খেয়ে বাছারা নেশার ঘোরে মূর্ছা গেছে!’

দুজনেই হো-হো করে হেসে উঠল নেশাতুর ফড়িঙের কাণ্ড দেখে আর কাভুন্দির সরস ব্যাখ্যা শুনে।

সবুজে সোনালিতে মেশানো আখের ক্ষেত পার হয়ে কিছু দূর যেতেই টলটলে জলের পুষ্করিণীর দেখা মিলল। পুষ্করিণীর চারিধারে ছোটো ছোটো ঝোপঝাড়, তবু জল কিন্তু স্বচ্ছ, পরিষ্কার। কাভুন্দি তাঁর ভিক্ষাপাত্রটি কোভালনের হাতে দিয়ে জল আনতে বললেন । পুকুরের ঢালু পাড় দিয়ে কোভালন আর কন্নকী জল আনতে পুকুরে নামছে, এমন সময় ঝোপের ভিতর থেকে ক্ষুদ্রাকার কী একটা জন্তু লাফ দিয়ে বের হয়ে এসে কন্নকীর পাশ দিয়ে বিদ্যুতের বেগে জলে নামল, আবার ত্বরিত গতিতে জল থেকে উঠে বিপরীত দিকের জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে সেঁধুল। ঘটনার আকস্মিকতায় ভয় পেয়ে কোভালনকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠল কন্নকী, ‘ও মা গো ! কেমন দানোর মতো দেখতে কী ওটা? সড়াৎ করে চলে গেল আমার পায়ের ওপর দিয়ে ! আরেকটু হলেই কামড়ে দিত !’ কন্নকীর কাণ্ড দেখে কাভুন্দি হেসে আকুল হচ্ছিলেন। বললেন, ‘ও কিছু নয়, মা । নিরীহ জীব। ওকে বলে উদ্‌বিড়াল। পুকুরের ধারে ঝোপে-ঝাড়ে থাকে। পুষ্করিণীতে অনেক মাছ আছে—মৃগেল, কাতলা, রুই—এমন কতো-ও! উদ্‌বিড়ালেরা ওই সব মাছ ধরে খায়। ভালাই মাছ আছে, লম্বা লেজ। সাপের মতন দেখতে এক ধরনের মাছ আছে—মালসু মাছ। ভালাই মাছ মালঙ্গু মাছের সঙ্গে খেলা করে। খেলতে খেলতে ওরা পুকুরের একদিক থেকে আরেকদিকে লাফ দেয়। আর ঠিক তখনই ঝোপঝাড় থেকে উদবিড়াল বেরিয়ে এসে ঝাঁপ দিয়ে ভালাই মাছ মুখ দিয়ে ধরে আবার ঝোপের মধ্যে ঢুকে যায়। এখনও তাই-ই করছিল। ও কিছু করবে না। তোমরা জল নিয়ে এসে খাও । আমি এখানে একটু বসছি।’

ধীরে ধীরে ক্ষেত, বন, মাঠ, পুকুর পার হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। সারাদিন পথশ্রমে ক্লান্ত কাভুন্দি বললেন, ‘প্রায় এক কাদম্ এসেছি আজ, কী বলো কোভালন ? কোভালন বলল, ‘হ্যাঁ, মা। এক কাদমের কিছু বেশিই হবে। সামনে কি কোনো গ্রাম আছে?’

কাভুন্দি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, বাছা। আমার চেনাপরিচিত গৃহস্থই । দেখা যাক।’

গ্রামের নাম—কালভীরাল। আকারের দিক দিয়ে দেখলে সার্থকনামা গ্রামটি, শিশুর পায়ের গোড়ালির মতোই ক্ষুদ্রায়তন। গ্রাম ছোটো হলেও সে-গ্রামের মানুষের মন কিন্তু বড়ো। কাভুন্দির পরিচিত গৃহস্থবাড়িতে তিনজনের রাতের আশ্রয় জুটল।কাভুন্দি সূর্যাস্তের পরে আহার করেন না, অগত্যা কোভালন ও কন্নকীকেই পরিতোষ সহকারে ভোজন করালেন গৃহস্বামী। দু-দিন পরে ভাত খেতে পেল ওরা। নৈশ-আহারের পর অতিথিশালার একটি কক্ষে বিশ্রাম করছিল কন্নকী, কোভালন। এ কক্ষেই একপাশে কাভুন্দিও রাতে শোবেন। টিমটিম করে প্রদীপ জ্বলছিল কক্ষের ভিতর। মেঝেতে প্রসারিত শয্যার উপর বসেছিল ওরা তিনজন। কোভালন বালকের মতো আবদার ধরল, ‘মা, আখ্যান বলুন।’ কাভুন্দি হেসে বললেন, ‘কী আর আখ্যান বলব, বাছা? আখ্যান তো তেমন জানি না। বলতে গেলে সব এলোমেলো হয়ে যাবে।’

কন্নকী বলল, ‘তবে আপনি আপনার ছোটোবেলার কথা বলুন।’

কোভালন অমনি সাগ্রহে কন্নকীর কথায় যোগ দিল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। বলুন, মা। সেই বনের ধারে যে-কুটিরে আপনি বসবাস করেন দেখলাম, ওখানে আসার আগে কোথায় ছিলেন ? কীভাবে এলেন? কেন এলেন এই জীবনে? এই কথাগুলি জানার বড়ো সাধ ।

কিন্তু প্রশ্ন শুনেই সহসা কাভুন্দি সামান্য গম্ভীর হয়ে গেলেন। মুখমণ্ডলে চিন্তার ছাপ ফুটে উঠল। কোভালন ভাবছিল, এ প্রশ্ন করা হয়তো সমীচীন হল না। নিজেকে সংশোধন করে নিয়ে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘যদি আপত্তি থাকে, তাহলে বলার দরকার নেই, মা,

থাক । আসলে আপনাকে আমাদের একথা জিজ্ঞাসা করা ঠিক হয়নি। আপনি আমাদের অবোধ সন্তান ভেবে ক্ষমা করবেন !’

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কাভুন্দি মুখ খুললেন। বললেন, ‘না-না, এ প্রশ্ন তো নির্দোষ । তোমরা ছেলেমানুষ, জানার কৌতূহল হওয়াই স্বাভাবিক। বেশ, বলছি শোনো।’

কাভুন্দি ধীরে ধীরে তাঁর পূর্বজীবনের কথা বলতে লাগলেন। বড়ো অদ্ভুত সেই জীবনকথা। রাত হয়ে আসছিল। বাইরে নৈশ স্তব্ধতা অনড় পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থেকে ঘরের ভিতরের উচ্চারিত শব্দগুলি শুনছিল যেন। আর শুনছিল কোভালন-কন্নকী। এমন কাহিনি তারা কখনও শোনেনি।

কাভুন্দি বলছিলেন, ‘গুর্জরদেশে এক প্রখ্যাত জনপদে সম্পন্ন পরিবারে আমি জন্মেছিলাম। আমার পিতামাতা ছিলেন জৈন শ্বেতাম্বর সম্প্রদায়ের উপাসক। বাল্যাবধি দেখতাম, গৃহে জৈন তীর্থংকরদের মূর্তি উপাসিত হয়। আমাদের চব্বিশজন তীর্থংকর, জানো তো? এঁদের মধ্যে চব্বিশ তথা অন্তিম তীর্থংকর বর্ধমান মহাবীরের প্রতি আমি বিশেষভাবে আকৃষ্ট ছিলাম। কিন্তু কী কারণে যে এত টান অনুভব করতাম, তা জানতাম না। তখন আমি এত ছোটো ছিলাম—কে মহাবীর, কী তাঁর শিক্ষা, কিছুই জানতাম না। অথচ তখন থেকেই কেমন জানি মনে হত, তিনি আমার খুব আপনজন। পরে সামান্য বড়ো হয়ে স্থির করেছিলাম, আমি বিবাহ করব না। আজীবন ব্রহ্মচারিণী থেকে তীর্থংকর মহাবীরের সেবা করব। কিন্তু আমার সে-সংকল্প সত্য হল না।’

কন্নকী প্রশ্ন করল, ‘কেন? আপনার পিতামাতা সেকথা মেনে নেননি, নিশ্চয়ই।’

কাভুন্দি বললেন, “না, মেনে নেননি। যৌবনপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা আমার বিবাহযোগ্য পাত্রের অনুসন্ধান করতে আরম্ভ করেন। অবশেষে এক সুযোগ্য পাত্র পেলেন । তিনি রাজপণ্ডিত । জৈন শাস্ত্রগ্রন্থে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। আমি ভাবলাম, মা-বাবা বিবাহ যখন আমাকে দেবেনই, তখন এই জৈন পণ্ডিতকেই বিবাহ করি না কেন? তাতে অন্তত আমার ধর্মানুরক্তির কোনো হানি হবে না। আমি সম্মত হলাম। কিন্তু এই সম্মতিই হয়ে উঠল আমার জীবনে বিপত্তির সূত্রপাত! ‘

কোভালন ও কন্নকী সচকিত দৃষ্টিতে কাভুন্দির দিকে তাকাল। কোন বিপত্তির কথা বলছেন কাভুন্দি?

কাভুন্দি বলে চললেন, ‘রাজপণ্ডিতের সঙ্গে বিবাহ হল। আমি স্বামীর ঘর করতে গেলাম । প্রথম প্রথম তাঁর সপ্রেম ব্যবহার, কল্পসূত্রে তাঁর প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য, শাস্ত্রব্যাখ্যার অনুপম কৌশল—এই সমস্ত কিছুতেই আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। কিন্তু পরে দেখলাম, অন্য ব্যাপার। পণ্ডিত মুখে যা বলেন, কাজে তা করেন না। শাস্ত্র যেন তাঁর কাছে এক বৌদ্ধিক ব্যসন, যেন চিন্তার বিলাস। কার্যক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত ক্রূরকর্মী। আমার নিজের ধর্মজীবন যাপনেও তাঁর আপত্তি; যেন ক্রমাগত তিনি আমাকে ভোগসর্বস্ব সংসারজীবনে টেনে এনে ধর্মপথ থেকে বিচ্যুত করতে চাইছেন। সেসব উপেক্ষা করেও চলছিলাম, কিন্তু পরে দেখলাম, আমার স্বামী পরনারী-আসক্ত, ব্যভিচারী, অত্যন্ত লম্পট প্রকৃতির লোক। আমি স্থির করলাম, যে-পুরুষ আমাকে নিয়ে, আমার ভালোবাসাকে নিয়ে, আমার ধর্মজীবনকে নিয়ে, তাঁর প্রতি আমার সরল বিশ্বাসকে নিয়ে এতদূর ছিনিমিনি খেলেছেন, আমি তাঁর সঙ্গে থাকব না—সে তিনি আমার স্বামীই হোন আর যাই হোন। একদিন মধ্যরাত্রে পুণ্যশ্লোক তীর্থংকরদের নাম নিয়ে আমি গৃহত্যাগ করে পথে নামলাম।’

কোভালন-কন্নকী রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় কাভুন্দির কথা শুনছিল। ভাবছিল, এক যুবতী নারীর পক্ষে এভাবে গৃহত্যাগ করা কতখানি বিপজ্জনক। প্রায় অবমানিত মৃত্যুবরণেরই শামিল।

কাভুন্দি তাদের মনের কথা বুঝতে পেরে বললেন, ‘হ্যাঁ, যে-জীবন আমি বেছে নিয়েছিলাম সেই রাত্রে, তা যে বিপদসংকুল হবে, তা আমি জানতাম। কিন্তু সত্যকে আশ্রয় করে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে আমি পথ চলতে লাগলাম। কোথায় যাচ্ছি, কী করছি, তখন কোনো খেয়াল নেই আমার। মাঝে মাঝে বিপদেও যে পড়িনি, তা নয়। কিন্তু সব সময়েই শেষ রক্ষা হয়ে গেছে। আবার অনেকেই আমাকে সাধুসংকল্পযুক্ত জেনে শ্রদ্ধাও করেছে। কেউ কেউ আবার উন্মাদ ভেবে উপেক্ষাও করেছে। সে যাই হোক, এইভাবে সম্মুখে চলতে চলতে কয়েক বৎসর পর নানা স্থানে ঘুরে, নানা তীর্থের ধুলো গায়ে মেখে আমি মাদুরাই নগরীতে এসে পৌঁছোই। সেখানে এক সিদ্ধ অহতের সঙ্গে আমার দেখা হয় । তিনি আমাকে সাধ্বীব্রতে দীক্ষিত করেন ও নতুন নাম দেন কাভুন্দি। আগে আমার নাম ছিল দৃষদ্বতী। দীক্ষার পরে আচার্যদেব আমাকে আমার সম্পর্কে এমন একটি অদ্ভুত রহস্যের কথা বলেন, যা শুনে আমি তো স্তম্ভিত হয়ে যাই !’

কোভালন জিজ্ঞেস করল, ‘কী বলেছিলেন তিনি?’

কাভুন্দি বললেন, “আমাদের জৈন শ্বেতাম্বর মতে ত্রিশ বৎসর বয়সে বর্ধমান মহাবীর সন্ন্যাসী হয়ে যান। কিন্তু সেই জীবনের আগে তিনি রাজপুত্র ছিলেন ও অল্প বয়সে যশোদা-নাম্নী এক পরমা সুন্দরী রাজকন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। তাঁদের বিবাহের ফলস্বরূপ এক কন্যার জন্ম হয়। কন্যাটির নাম প্রিয়দর্শনা। আমার আচার্যদেব বলেছিলেন, পূর্বজন্মে আমিই ছিলাম সেই কন্যা—প্রিয়দর্শনা। বর্ধমান মহাবীর ছিলেন আমার পিতা। এই জন্যেই এই জন্মে আমি বর্ধমান মহাবীরের প্রতি এমন আন্তরিক টান নিয়ে জন্মেছি। *

শুনতে শুনতে কোভালন-কন্নকী বিস্ময়ে শিহরিত হল। এ কী অদ্ভুত কথা!

কাভুন্দি বলে চললেন, “হ্যাঁ, বাবা। কথাটা শুনে আমিও খুব অবাক হয়েছিলাম। আমার আচার্যদেব আমাকে সাধননিষ্ঠ হতে বলেছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, জাগতিক সুখ আমার এ শরীরে অসম্ভব। আমি যেন একটি নির্জন স্থান খুঁজে নিয়ে অবশিষ্ট জীবন তপস্যায় অতিবাহিত করি। এবং বর্ধমান মহাবীরকে আমার পিতারূপে জেনে প্রতিদিন যেন আমার প্রাণের অর্ঘ্য নিবেদন করি। আচার্যের নির্দেশ অনুসরণ করেই আমি মাদুরাই থেকে হাঁটতে হাঁটতে ওই বনে উপস্থিত হয়েছিলাম। বনের নিষাদরা সহিংসক, কিন্তু অত্যন্ত সরলপ্রাণ ও পবিত্র। তারা আমাকে ‘মা’-বলে ভক্তি করত, ভালোবাসত। তারাই তাদের অস্ত্র রাখার কক্ষটিকে আমার বসবাসের উপযোগী করে আমাকে থাকতে দিয়েছিল। পরে শুনলাম, অনেক আগে ওই কক্ষে নাকি এক বৌদ্ধ ভিক্ষু থাকতেন। সেই থেকেই ওই বনের প্রান্তদেশস্থ কুটিরটিতে আমি রয়েছি। এখনও সেই নিষাদরাই আমার ভালোমন্দ দেখাশোনা করে থাকে।”

এই পর্যন্ত বলে কাভুন্দি এক গাল হেসে বললেন, ‘সব শুনলে তো? এই হচ্ছে আমার গল্প।’

অভিভূত কোভালন ও কন্নকী ভূমিতে মাথা ঠেকিয়ে কাভুন্দিকে বারবার প্রণাম জানিয়ে বলতে লাগল, ‘মা, আমরা ধন্য! আমরা ধন্য!’ কাভুন্দি তাদের অমন করতে দেখে খুব হাসতে লাগলেন ।

কন্নকী জিজ্ঞেস করল, ‘তাই বুঝি আপনার আচার্যদেব অর্থাৎ সেই অর্হৎ মহাপুরুষকে দর্শন করবেন বলেই আপনি আমাদের সঙ্গে মাদুরাই চলেছেন ?’

কাভুন্দি বললেন, ‘না, তা নয়। তাঁর অনেকদিন আগেই দেহান্ত হয়েছে। তবে তাঁর স্মৃতিপূত স্থানগুলি তো এখনও রয়েছেই। সেসব স্থান আরেকবার দেখার বড়ো সাধ হল। তাই তোমাদের সঙ্গ নিয়েছি।’

কোভালন অমনি বলে উঠল, ‘না, মা। আপনি আমাদের সঙ্গ নেননি। আমরাই আপনার সঙ্গ পেয়ে কৃতার্থ হয়েছি। আপনি না থাকলে এত দীর্ঘ বিপদসংকুল পথ আমরা কীভাবে যে যেতাম !’

কাভুন্দি কোভালনের শিরোদেশে হাত দিয়ে কুন্তলপাশ ঘেঁটে আদরভরে বললেন, ‘পাগল ছেলে!’

(চৌত্ৰিশ) আবাদ

এই সব মাঠ-ঘাট-গ্রাম, এই সব শস্যশালিনী কৃষিক্ষেত্র, এমন অপরিমেয় বৈভবে সমৃদ্ধ ভূভাগ—এ সমস্তই পুণ্যতোয়া কাবেরীর অবদান। অপরাজেয় কাবেরীর স্রোত, আকাশের গ্রহতারার বিরূপ অবস্থানও তার স্রোতোবেগকে মন্দীভূত করতে পারে না। মেষ, মীন বা সিংহরাশিতে পদার্পণ করে শনি যখন ধরণীর দিকে তার কুপিত দৃষ্টিপাত করেন, কিংবা উজ্জ্বল শুক্র গ্রহ যখন আকাশের দক্ষিণদিকঘনিষ্ঠ হয়, অথবা যখন আকাশে ধূমকেতু ওঠে—এ সমস্তই জ্যোতিষশাস্ত্রমতে অশুভ লক্ষণ; এসব সময়ে খরা হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল, অথচ এ সব লক্ষণ কিছুই কাবেরীকে প্রভাবিত করতে পারে না। কুর্গ পর্বতশ্রেণীর উপরে দুরন্ত বাতাসে ধাবমান মেঘমালায় বিদ্যুতের কশাঝটিকায় উৎপন্ন অন্তহীন ঝরোঝরোঝরো বরিষণধারায় নিত্যসমৃদ্ধ কাবেরীর এ বিপুল সলিলসম্ভার চলেছে পর্বত থেকে উদ্গত হয়ে লীলাময় গমনে, সমতলভূমি পেরিয়ে সমৃদ্ধ জনপদের জন্ম দিতে দিতে সুদূর সমুদ্রসঙ্গমে। সমুদ্রের অন্য নাম রত্নোদধি বা রত্নাকর–সঙ্গমের পর সে তার রত্নবীজ কাবেরীর গর্ভে গোপনে রেখে দিয়ে যায়। কাবেরীর অববাহিকায় দুর্মূল্য রত্নসম্ভার সঞ্চিত, বৈদেশী বণিকের দৃষ্টিও তাই ওইখানেই। আর এ নদীর গতিবেগও কী যে প্রচণ্ড ! চলার পথে বাধা এসে পড়লে প্রমত্তা যুবতীর মতো দুরন্ত বেগে সগর্জনে লাফ দিয়ে সে বাধা পার হয়ে যায়; ভীষণা কাবেরীকে তখন রোখে কার সাধ্য ? কাভুন্দি-কোভালন-কন্নকী এই সব ঘাট-মাঠ-গ্রাম-ক্ষেত পার হতে হতে দেখছিল, কী সবুজ মায়াময় এই সব দেশ ! কৃষিকার্যে সমৃদ্ধ এ উর্বরা ভূমি—অথচ কোথাও তারা শুনতে পেল না একবারও কূপে জলপাত্র নামানোর ঝনৎকার, জল তোলার কিলি কিলি রব অথবা তালপাতার পেখা, কাষ্ঠল সেঁউতি কিংবা ডোঙার মর্মরধ্বনি। এসব প্রচলিত পদ্ধতিতে সেচকার্য এখানে নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়; কাবেরী নিজেই এখানে ভূভাগ-সেচনের সমূহ দায়িত্ব নিয়েছে ।

লি লি করতে থাকে চারিপাশে রোদ, মেঠোপথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আপনমনে চোখ দুটো আধ বুজে কোভালন ভাবে, এ পথ কী অপরিসীমভাবে ধ্বনিময় ! ধান বা আখের ক্ষেতের ধারে, পদ্মপুকুরের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া ধুলাপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কত রাজহাঁসের ক্রেংকার, কত জলপিপির তীক্ষ্ণ রব, কত সারসের মিলিত কলতান, কত বনমোরগের তীব্র স্বনন, জলের মধ্যে মুগ্ধ মাছেদের ঝিলিৎ-মিলিৎ, ঝোপঝাড়ে লুক্কায়িত ঝিঁঝিপোকার ছেদহীন ঝনঝন ঝিংঝিমি—পরের পর সব কানে ভেসে আসতে থাকে কোভালনের। নিসর্গপ্রকৃতির এমন স্বরময় সত্তা নগরজীবনে আজন্মবর্ধিত কোভালন বা কন্নকী এতটা প্রাণভরে অনুভব করতে পারেনি তো এযাবৎ-কালাবধি !

এই শব্দানুবিদ্ধ আত্মবিস্মৃতির ঘোরে পথ হাঁটছিল কোভালন। হঠাৎ কিছু মানুষের সম্মিলিত ‘ধর, ধর, নিয়ে গেল রে, নিয়ে গেল রে’উচ্চ ধ্বনিতে সেই ঘোর কেটে গেল । চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল, অদ্ভুত এক দৃশ্য। উচ্চাবচ জমির উপর দিয়ে কয়েকজন গ্রামীণ মানুষ একটা বিশালাকার কাড়া মহিষের পেছনে সশব্দে ছুটে চলেছে। মহিষটার আকারই শুধু বৃহৎ নয়, কাদামাখা গায়ের রং ঘোর কালো, বাঁকানো ভীষণ শিং, চোখ দুটো রক্তবর্ণ—সব মিলে ভীমদর্শন। ব্যাপার কী?

ওরা তিনজন এগিয়ে গিয়ে দেখল, মাঠের শেষে একটা একহারা গ্রাম, তারই প্রান্তদেশে কোনো এক চাষীর ঘর। সেখানে খড় বেত দিয়ে বানানো ধানের গোলার গায়ে মহিষটা বোধহয় তার পৃষ্ঠদেশ ঘষে আরাম করতে গিয়েছিল, অমনি গোলা ভেঙে ভেতর থেকে ধান হুমড়ে পড়তে লেগেছে, সদ্যকর্তিত ধানের গোছাগুলো নুয়ে আছে পশুলোমে নির্মিত চামরের মতন। এমন সুপক্ক ধান দেখতে পেয়ে লোভাতুর মহিষ অমনই একগোছা মুখে তুলে নিয়ে পালাচ্ছে। চাষীরা ধাওয়া করছে তারই পিছনে মুখে নানান আওয়াজ করতে করতে। কিন্তু যতই তেড়ে যাক আর যতই হুররর্ হুররর্ আওয়াজ করুক, ও যমদর্শন মহিষকে ওরা ধরতেও পারবে না; এতক্ষণে মাঠঘাট ভেঙে বিশালাকার জন্তুটা বহু দূরে আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। সমস্তটা মিলে ভীষণ একটা কৌতুক জমে উঠেছে এ মধ্যাহ্নবেলায়।

ধীরে ধীরে গ্রামের ভিতর দিয়ে যেতে লাগল ওরা। এখানে গ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প পথও নেই। কোভালনরা দেখল, এ গ্রামের লোকগুলো বেশ রগুড়ে বটে! রগুড়ে এবং সঙ্গীতপ্রিয়। পুকুরের ঘাটে ডোমেদের মেয়েরা সারা গায়ে কাদা মেখে অচেনা মিষ্টি সুরে গান গাইছে। চওড়া কাঁধ, উন্নত স্তন—সর্ব শরীরে কাদার প্রলেপন, মাথার থেকে সুগন্ধি ফুল খুলে কেশে পরেছে ধানের শিষ। এ ওর গায়ে কাদা ছুড়ে ফুর্তি করছে, মুখে অশালীন অথচ নির্দোষ গালিগালাজের ফোয়ারা, হিহিহি করে হাসতে হাসতে এ ওর গায়ে ঢলে পড়ছে মেয়েগুলো, আবার ফিরে যাচ্ছে সেই মিষ্টি চড়া সুরের লোকগানে। পুকুরের জল, পাড়ের ঝোপঝাপ, উপরে নীলাকাশ সব যেন মুখ টিপে টিপে হাসছে ওদের রঙ্গকৌতুক দেখে।

ছাড়া ছাড়া ঘরবাড়ি আবার চাষের ক্ষেত—মাঠ। পুবমুখো একটা ক্ষেতে বোধহয় হলকর্ষণ হবে, তার আগে জমিপুজো করা হচ্ছে। মাটির উপর ধানের ছড়ার মালা, অরুগু ঘাস আর অজস্র শালুক ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে জমি। কয়েকজন কৃষক পুবমুখো হয়ে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে সুস্বরে এরমঙ্গলম গান গাইছে। ভূদেবীর উদ্দেশে নিবেদিত সরল ভূমিজ পুত্রের ঐকান্তিক ভক্তিপূরিত প্রার্থনা-সঙ্গীত।

‘ধরিত্রী মা, ধাত্রী মা গো, আমাদের পূজা নাও। আমাদের অপরাধ নিও না, মা গো! আমরা তোমার বুক কর্ষণ করব। ব্যথা পেও না মা গো! আমরা যে অসহায় সন্তান তোমার ! তুমি না দিলে খাব কী মা, আমরা খাব কী? ‘

কী সহজ, কী সরল, কী অনাবিল তাদের সুর, কী সহজ ভাষা, কী নির্মল প্রাণের আকুতি ! আন্তরিক মর্মস্পর্শী সুরে তারা নিবেদন করছে মা-কে নিজেদের হৃদয়মথিত সংবেদনা। কন্নকীর মনে হচ্ছিল, এর থেকে পবিত্র প্রার্থনা শুনেছে কোথাও? এই মাটি, এই চাষের ক্ষেতের থেকে পবিত্র মন্দির দেখেছে কোথাও সমস্ত জীবনে ?

সুরগুলো শোনা শেষ হওয়ার পরেও ফুরিয়ে যাচ্ছিল না। মনের মধ্যে গুঞ্জরন তুলছিল কোভালনের। আশৈশব সঙ্গীতপ্রিয়, তবু তার সুরের কান তৈরি করে দিয়েছিল সেই মেয়েটি—মাধবী! কিন্তু মাধবীর সুর- সেসব তো শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সুর। আর এদের সুর মাটির। তবু এই সুর শুনে কেন যে সেই সুরের স্মৃতি মনে আসে? এখনও মাধবীর কথা মনে এলে বুকের ভিতরে একটা অব্যাখ্যাত যন্ত্রণা… কেন? কেন? কেন ?

কোথাও আবার ধানঝাড়া হচ্ছে। সে-কাজটাও সুরবিবর্জিত নয়। বলদগুলোকে তাড়া দিয়ে ধান ঝাড়তে ঝাড়তে মানুষগুলো গাইছে মুহাভি লোকগান, হাসির হররা উঠছে মুহুর্মুহু । কাদামাখা বিশাই ঢোল বাজাচ্ছে কেউ কেউ, তাদের ঢোলের আওয়াজের মাঝখানে এ ওকে ঠেলা মেরে হইহই করে ফুর্তি করে নিচ্ছে বাকি লোকজন। *

এই সব সুর, এমন যত জমাট রগড়ের মধ্য দিয়ে চলতে চলতে মন ভালো হয়ে উঠছিল ওদের। কাভুন্দি বললেন, ‘দ্যাখো কী সরল এই মানুষগুলি! কত আনন্দ, কত ভালোবাসা! এরাই তো আমাদের খাওয়ায়, এদের শ্রমের উপরেই নির্ভর করে সমাজ চলছে, রাজার বিজয়রথ গড়াচ্ছে, সব মন্দিরের দেবতাদের থানে পূজা চড়ছে। কিন্তু এদের সেই দানের কথা কেউ মনে রাখে? কেউ মনে রাখে না। মানুষের লিখিত ইতিহাসে এদের উল্লেখ কোথায়? লিখিত যত ইতিহাস, সব তো মূর্তিমান তাঁবেদার লোকেদের লেখা ! স-অ-ব তাঁবেদার—নানান যুগের তাঁবেদার—ভিন্ন ভিন্ন রাজশক্তির, শাসনক্ষমতার বশংবদ লোভী তাঁবেদারের দল! কোথাও এই কৃষিজীবীদের কথা পাও? কোথাও না । এদের ভূমিপূজা, এদের পুকুরঘাটে কাদাখেলা কিংবা এদের এই ধানঝাড়ার কৌতুক, যার উপরে পুরো সমাজ নির্ভর করছে, এসব কথা কোনো নথিতে থাকবে না, কোনো শিলালেখে লেখা থাকবে না।’

….মুচকি হেসে ইলাঙ্গো আডিগল মনে মনে বলে উঠলেন, ‘আমি লিখে রাখব।

(পঁয়ত্রিশ) স্বরূপরহস্য

এখন অনেক মাঠ, অনেক বন। এখন এমন অনেক আখের গুড়ে জ্বাল দেওয়া উনুন থেকে ঝিমিঝিম ধোঁয়া ওঠা চাষার গ্রাম। অনেক অগ্নিহোত্রী ব্রাহ্মণের যজ্ঞকুণ্ড থেকে উদ্গীরিত ধূমে আচ্ছন্ন গ্রামের আকাশ। এমন অনেক পথ বহু দিন ধরে পেরিয়ে পেরিয়ে ওরা তিনজন অবশেষে এক মধ্যাহ্নে শ্রীরঙ্গমে উপনীত হল।

শ্রীরঙ্গম অতি প্রাচীন নগরী। এইখানে এসে কাবেরী নগরীর অন্তরালে সাময়িক লুকিয়ে পড়েছে। নগরীর বহির্দেশে এক মনোমুগ্ধকর বনাঞ্চল দেখা গেল। চারিপাশে ঘন আনত বাঁশের বন, সেই বন পেরোলে অনেক উন্নতশীর্ষ বনস্পতির জটলা, সেই জটলা পেরোলে আবার অগাধ বন্যপুষ্পের সম্ভার। যেন এক দেবভোগ্য বনস্থলী। একপাশে স্বচ্ছ জলের হ্রদ। স্থানটি বড়ো মনোরম। কাভুন্দি একটি আমগাছের তলা দেখিয়ে বললেন, ‘এখানে চলো একটু বেশি। খানিক বিশ্রাম নিয়ে আবার যাত্রা আরম্ভ করা যাবে।’

আমগাছের তলায় তিনজন বসে আছে, পথশ্রমে সকলেই ক্লান্ত, কেউ কোনো কথা বলছে না। এমন সময় ওরা দেখল, বাঁশবন পেরিয়ে বনস্পতিনিম্নে ছায়াভরা পথ বেয়ে কে একজন আসছেন। আগন্তুক পুরুষ উন্নতদর্শন, পরনে একটি শ্বেত বস্ত্র, ঊর্ধ্বাঙ্গও শ্বেত উত্তরীয়ে আবৃত—শ্রমণদের মতো উত্তরীয়ের প্রান্ত একদিকের কাঁধের উপর বিলম্বিত, অন্যদিকের কাঁধ উন্মুক্ত। অথচ শ্রমণদের মতো মস্তক তাঁর মুণ্ডিত নয়, কৃষ্ণকজ্জল কুন্তলভার কাঁধের উপর বিনানো। গৌর মুখমণ্ডল ক্ষৌরিত। মানুষটির দেহকাণ্ড বেশ বলিষ্ঠ ও মুখভাব দিব্য প্ৰসন্ন ।

তাঁকে দেখে কাভুন্দি সশ্রদ্ধায় উঠে দাঁড়ালেন। কাভুন্দিকে অনুসরণ করে কন্নকী-কোভালনও দণ্ডায়মান হল। যুক্তকরে অভিবাদন জানিয়ে কাভুন্দি বললেন, ‘আপনি কে, মহাত্মন? কোথা থেকে আসছেন ?’

আগন্তুক পুরুষের কণ্ঠে যেন উত্তর হাওয়ার গান বেজে উঠল। তিনি বললেন, ‘আমি একজন নামহীন চারণ । আপাতত শৈলম্ থেকে আসছি!’

কাভুন্দি পুনরায় আনত অভিবাদন জানিয়ে বললেন, ‘আমাদের অতীত জন্মের সকল অকুশল কর্মফল নির্বাপিত হোক।’ কন্নকী ও কোভালনও চারণের উদ্দেশে অভিবাদন জানাল।

কাভুন্দির কথা শুনে চারণ কিন্তু অল্প সময়ের জন্য তৃষ্ণীম্ভাব ধারণ করলেন। তারপর আপনমনে স্মিত হাসলেন। তাঁর মনের মধ্যে কী যে চলছে, বাইরে থেকে দেখে তখনই তা বোঝা গেল না ।

কাভুন্দি পুনর্বার বললেন, ‘আমাদের বিগত জন্মের কর্মফল বিধৌত হবে তো, মহাত্মন ?’

চারণ এবার মুখ খুললেন। প্রত্যভিবাদন জানিয়ে বললেন, ‘হে সাধ্বী ! আপনি এই কর্মের তত্ত্ব সম্যক অবগত আছেন। এই কর্মচক্র অমোঘ। থামাতে চাইলেই তা থেমে যায় না। যেমন অশুভ কর্মের ফল অবধারিত, তেমনই অবধারিত শুভ কর্মের ফলও। মৃত্তিকায় যেমন যেমন বীজ রোপিত হয়, ফসল তেমন তেমনই ফলে। আর এই দেহপ্রদীপে প্রাণের শিখা—এ তো সতত কম্পমান, কখন নিভে যাবে, কেউ বলতে পারে না। একে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা যেন দুর্গের ছাদে দাঁড়িয়ে দুরন্ত বাতাসের মধ্যে প্রদীপশিখা জ্বালিয়ে রাখার প্রাণান্ত প্রয়াসের মতোই নিষ্ফল। এক লহমায় তা দপ্ করে নির্বাপিত হয়ে যায় । আসলে আমরা কেউই অন্য কারও কর্ম নিতে পারি না। অন্য কারও কর্ম যোজনাও করতে পারি না আমরা। প্রত্যেকেই নিজ নিজ কর্মফলবশে যাপনের দায়ভার বহন করে চলে । আপনি শতচেষ্টা করলেও আপনার সঙ্গীদের ভবিতব্য পালটাতে পারবেন না।’

বিষণ্ন কাভুন্দি কাতর স্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘তবে কি এই অবধারিত কর্মফলচক্র থেকে নিষ্কৃতির কোনো উপায় নেই, মহাত্মন?’

চারণ এক মুহূর্ত স্থির অন্তর্মুর্খ হয়ে রইলেন। তারপর দৃঢ় স্বরে বললেন, ‘আছে। এমন একজন আছেন, যিনি পরতত্ত্বের মূর্তিমান প্রকাশ। তিনি জিনেন্দ্র, পারগামী, দীনবন্ধু, কৃতকৃত্য, ভগবান। তিনিই ধর্মমূল, প্রভু, আগমসার। অর্থৎ, পরম গুরু, পবিত্র পরম ধাম—তিনিই তীর্থংকর। তাঁর শিক্ষাই তমসাবিদারী জ্যোতিস্বরূপ। সেই জ্যোতির যে অনুসরণ করে, একমাত্র সে-ই এই আঘূর্ণিত কর্মচক্র থেকে মুক্তি পায়। সে আর ফিরে আসে না। না-না। সে আর কখনও এখানে ফিরে আসে না। ‘

কথাগুলো তিনি যেন বলছিলেন না। শব্দসমূহ তাঁর ভিতর থেকে যেন আগুনের ফুলকির মতো ফুটে ছিটকে বাইরে বেরিয়ে আসছিল। কোনো লিখিত শাস্ত্রের নিছক পুনরুক্তি নয় এসব। যেন কোন অনুভূত সত্যের উত্তাপে জ্বলছিল সমূহ শব্দরূপ।

অভিভূত কাভুন্দি নিজ শিরোপরি কৃতাঞ্জলিবদ্ধ দুটি করপুট স্থাপন করে বলতে লাগলেন, ‘যথার্থই বলেছেন, মহাত্মন! এটিই সারভূত সত্য। কাঙ্ক্ষা, ক্রোধ, মোহ যিনি জয় করে জ্ঞানভূমিকায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, তাঁর অমৃত বাণী ছাড়া অন্য কিছুই আমার শ্রোত্রেন্দ্রিয় আর শুনবে না। কামজিৎ সেই অহতের পাবন নামমালা ছাড়া অন্য কিছুই উচ্চারণ করবে না আর আমার এই বাক। সেই জিতেন্দ্রিয়ের রাতুল চরণকমল ছাড়া অন্য কিছুই দর্শন করবে না আর আমার এই দুটি চোখ। অর্হৎদিগকে যিনি ধর্মপথ প্রদর্শন করে থাকেন, সেই জিনেন্দ্র ছাড়া অন্য কাউকে অভিবাদন জানাবে না আমার এই করপুট। উপলব্ধির পুষ্পে পুষ্পে চরণচিহ্ন ফেলে যিনি লোকোত্তর মার্গে পরিভ্রমণ করেছেন, তাঁর চরণপদ্ম ছাড়া অন্য কোনো কুসুমে সাজাব না আমি আমার শিরোদেশ। অবাধিত আনন্দের প্রতিমূর্তি সেই বর্ধমান তীর্থংকরের দেশনামালা ছাড়া অন্য কোনো মন্ত্রই আর ধারণ করবে না আমার স্মৃতিকোশ !’

কথাগুলি বলতে বলতে কাভুন্দির দুটি গাল ভেসে যাচ্ছিল আত্মনিবেদনের অশ্রুজলে।

চারণ বললেন, ‘যা ঘটবার, তা ঘটবেই। আপনি স্নেহ দিতে পারেন, করুণা দিতে পারেন, ভালোবাসা দিতে পারেন। কিন্তু অন্যের ভবিতব্য পালটাতে পারেন না।’

কোভালন ভাবছিল, কার বা কাদের ভবিতব্য পরিবর্তনের অসম্ভাব্যতার কথা বলছেন চারণ? কাভুন্দিই-বা কাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য প্রার্থনা জানিয়েছেন তাঁকে মনে মনে? তবে কি কোভালন-কন্নকীই এখানে উদ্দিষ্ট? সামনের দিনে আরও বড়ো কোনো বিপর্যয় অপেক্ষা করে আছে তাদের ভাগ্যে?

চোখের জল মুছে কাভুন্দি যেন নিজেকে একটু সামলে নিলেন। তারপর বললেন, ‘হে চারণ! আপনি আজ আমাদের সঙ্গে এই মধ্যাহ্নবেলায় আহার করুন। পথে আসতে আসতে আমি সামান্য কিছু ভিক্ষা পেয়েছি। এই অধীনার আমন্ত্রণ আপনি দয়া করে অস্বীকার করবেন না !’

চারণ সম্মত হলেন। আমগাছের তলায় আহারের ব্যবস্থা করতে লাগল কন্নকী । আহারের পরে কাভুন্দি কোভালনের হাতে ভিক্ষাপাত্রটি দিয়ে নিকটস্থ হ্রদ থেকে জল আহরণ করতে পাঠালেন।

হ্রদের জল এত স্বচ্ছ যে, পাঁচ হাত উপর থেকে হ্রদের তলদেশ দেখা যায়। তীরস্থ ঝোপঝাড়, ঊর্ধ্বস্থিত আকাশ, আকাশের ধীরসঞ্চরণশীল মেঘ—সমস্তই স্বচ্ছ মুকুরবৎ জলতলে স্পষ্ট প্রতিবিম্বিত হচ্ছে। কোভালন জলে দুই পা নেমে ভিক্ষাপাত্রটি জলে ভরে নিল। হ্রদ থেকে জল নিয়ে উপরে উঠে আসছে, এমন সময় দেখল, তিনি তীরে দাঁড়িয়ে আছেন। হয়তো হস্তমুখ প্রক্ষালন করতে এসেছেন।

কোভালনকে দেখে সস্নেহে হাসলেন চারণ। প্রশ্ন করলেন, ‘আপনিই কি পুষ্পহার নিবাসী কোভালন?’

কোভালন নিতান্ত অবাক হল। তার নাম জানলেন কী করে চারণ? মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ, আমিই কোভালন। আর বৃক্ষতলে যিনি আমাদের আহারের আয়োজন করলেন, তিনি আমার স্ত্রী কন্নকী।’

উত্তর শুনে মানুষটি যেন প্রীত হলেন। তাঁর মুখ দেখে মনে হল, যা তিনি অনুমান করেছিলেন, তা যেন হুবহু মিলে গেছে।

চারণ স্মিত হেসে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সঙ্গমন নামে কারও কথা আপনার মনে পড়ে?’

সঙ্গমন? না এমন কোনো ব্যক্তিকে তো কোভালন চেনে না। বিহ্বল স্বরে কোভালন উত্তর দিল, ‘কই, না তো !’

চারণ আবার প্রশ্ন করলেন, ‘সঙ্গমনের স্ত্রী নিলিকেও কি মনে পড়ে না আপনার ?’

কোভালনের মনে হল, চারণ কিছু ভুল করছেন। মাথা নেড়ে বলল, ‘না, মহাত্মন ! সঙ্গমন… নিলি… এমন নামের কারও সঙ্গে আমার তো কখনও দেখা হয়নি!’

চারণ এবার বেশ গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, ‘ভরত? ভরতের কথাও মনে নেই?’

কোভালনের এবার হাসি পেল। কে ভরত? চারণ নিশ্চয়ই তার সঙ্গে অন্য কাউকে মিশিয়ে ফেলে ভ্রমে পড়েছেন। কোভালন এবারও সংক্ষেপে উত্তর দিল, ‘না।’

যেন কোন গভীর বিষাদে নিমজ্জিত হয়ে চারণ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। তারপর আত্মগতভাবে উচ্চারণ করলেন, ‘অদ্ভুত! মনে নেই, সে ঠিক আছে। কিন্তু মনে করালেও ও আর মনে পড়ছে না—এই তো আশ্চর্য! স্বপ্নের কী প্রচণ্ড আবরণী শক্তি!’

তার পরমুহূর্তে সেই গম্ভীর ভাব পরিত্যাগ করে তিনি উদ্দীপ্ত স্বরে বললেন, ‘সে যাক গে। শুনুন । আপনি কি আমার একটি কাজ করে দিতে পারবেন?’ তাঁর বলার ভঙ্গীতে আন্তরিক অনুরোধ ফুটে উঠল।

কোভালন বলল, ‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আপনি বলুন। সাধ্যের মধ্যে হলে আমি আপনার যেকোনো সেবা করতেই প্রস্তুত আছি।’

চারণ বললেন, ‘বেশ। তবে শুনুন। কিছুদিনের মধ্যেই পুষ্পহার থেকে এক ব্যক্তি আপনার কাছে একটি পত্র নিয়ে আসবে। সেই পত্রের উত্তর লিখে তার হাতেই আপনাকে তা ফিরিয়ে দিতে হবে। এ পর্যন্ত নির্বিবাদ। কিন্তু তারই সঙ্গে আরও একটি পত্র লিখে কি পাঠাতে পারবেন আপনি ?’

ব্যাপারটা বুঝতে কিছুটা সময় লাগল কোভালনের। ইনি বলছেন, পুষ্পহার থেকে কোভালনের জন্য একটা পত্র নিয়ে কেউ আসবে। সেই পত্রের উত্তর দিতে হবে কোভালনকে। বেশ কথা। কিন্তু তার সঙ্গে আরও একটি অতিরিক্ত পত্র লিখে ওই পত্রবাহকেরই হাতে দিয়ে দিতে হবে! কোভালন জিজ্ঞেস করল, ‘এই দ্বিতীয় পত্রের উদ্দিষ্ট ব্যক্তি কে, মহাত্মন?’

চারণ বললেন, ‘দ্বিতীয় পত্রটির উদ্দিষ্ট ব্যক্তির নাম দেবান্দী। এই দেবান্দীও পুষ্পহারেই থাকেন।’

কিছুদিন আগে বনপথ ধরে আসতে আসতে দেবান্দীর কথা কন্নকীর কাছ থেকে শুনেছিল বটে কোভালন! কিন্তু ইনি দেবান্দীকে পত্রপ্রেরণের কথা বলছেন কেন? কোভালন বলল, ‘বেশ। কিন্তু এই দ্বিতীয় পত্রে আমি লিখবটা কী?’

চারণ উত্তর দিলেন, ‘বলছি। আপনি লিখবেন, দেবান্দীর স্বামী বীরমণি সুস্থ আছেন। তিনি দেবান্দীকে জানিয়েছেন, সময় সম্পূর্ণ হয়েছে। আগামী আষাঢ়ী পূর্ণিমা-নিশীথে দেবান্দী যেন গৃহত্যাগ করে পুষ্পহারের বহির্বর্তী কাবেরীঘাটে আসেন। বীরমণি সেখানে অপেক্ষা করবেন ও দেবান্দীকে তিনি কাবেরীঘাট থেকে নিয়ে আসবেন। মনে থাকবে কথাগুলো? পারবেন ?’

কোভালন ঘাড় নেড়ে জানাল, সে পারবে। তারপর চারণ সম্পর্কে তার সামান্য কৌতূহল হল। জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার কথা শুনে মনে হল, আপনি জৈন সম্প্রদায়ভুক্ত। আপনি কি অর্হত্ত্ব লাভ করেছেন ?’

চারণ হাসলেন। উত্তর দিলেন, ‘আমি কোনো সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত নই, কোভালন । তাই অহৎ বা বোধিসত্ত্ব বা ঋষি—কিছুই আমি নই। আমি মানুষের প্রকৃত স্বরূপ অনুসন্ধান করছিলাম। দীর্ঘ সাধনায় তার উত্তর পেয়েছি। কোনো সম্প্রদায়ে আবদ্ধ নই, তাই সমস্ত সম্প্রদায়েরই প্রতি আমি সহানুভূতিশীল।’

কোভালন বলল, ‘তাহলে কাভুন্দির কাছে আপনি যে তীর্থংকরের বন্দনা করছিলেন, সে কি তবে কাভুন্দিকে প্রভাবিত করার জন্যে?’

চারণ তির্যক হেসে উত্তর দিলেন, ‘তোমার এই সন্দেহপ্রবণতা এখনও সেই একই মাত্রায় রয়ে গেছে, ভরত!’

ভরত? ভরত কে? কোভালন ভেবে পাচ্ছিল না, চারণ তাকে ভরত নামে সম্বোধন করছেন কেন?

কিন্তু কোভালনের চিন্তাস্রোতে বাধা দিয়ে চারণ বলে উঠলেন, ‘সন্দেহ, সংশয়—এবার পরিত্যাগ করো, ভরত! এর পরিণাম ভয়ংকর। শোনো! কোনো অভিসন্ধি নিয়ে কাভুন্দিকে প্রভাবিত করার জন্য আমি তীর্থংকরের বন্দনা করিনি। সত্য কী, তা আমি জেনেছি। সত্য এই যে, যাঁকে শৈবরা শিবরূপে উপাসনা করেন, বেদান্তবাদীরা ব্রহ্মরূপে অনুসন্ধান করেন, বৌদ্ধরা বুদ্ধরূপে অর্চনা করেন, প্রমাণপটু নৈয়ায়িকেরা জগৎ-কর্তা ঈশ্বররূপে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন, মীমাংসক দার্শনিকরা যাঁকে অবধারিত কর্মের নীতিরূপে নির্দেশ করেন এবং জৈন-মতাবলম্বীরা যাঁকে তীর্থংকররূপে পূজা করেন—সেই সত্য এক, অদ্বয়, অখণ্ড। একেক সম্প্রদায়ে তাঁর একেক নাম, এই মাত্র। সেই সত্যকে কাভুন্দি তীর্থংকররূপে জানেন, তাই তাঁর ভাবে আঘাত না দিয়ে আমি সেই রূপেরই বন্দনা করেছি। আর কিছু নয় ।

বলতে বলতে হ্রদে নেমে হস্তমুখ প্রক্ষালন করতে লাগলেন চারণ। তারপর হ্রদতীরে উঠে এসে কোভালনকে বললেন, ‘আমি এখন আসি । বিদায় !’

বনপথ ধরে চলেই যাচ্ছিলেন চারণ। কিন্তু তাঁর পথরোধ করে দাঁড়াল কোভালন । চরণবন্দনা করে বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করবেন, মহাত্মন! আমার প্রগল্ভতা মার্জনা করবেন। আপনি কে? দয়া করে আপনার পরিচয় দিয়ে যান। আমি যে আপনাকে চিনেও চিনতে পারছি না!’

কোভালনের শিরোদেশে আশীর্বাদ করে বনপথ ধরে দ্রুতপাদবিক্ষেপে চলতে লাগলেন চারণ। চলতে চলতেই উদাত্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, ‘সম্প্রতি আমার কোনো নাম নেই। তবে যদি সামাজিক পরিচয় জানতে চাও, তাহলে বলি, আমি পুষ্পহারনিবাসী দেবান্দীর গৃহপরিত্যাগী স্বামী। আমার নাম বীরমণি!’

(ছত্ৰিশ) স্থান বিনিময়

সঙ্গমন। নিলি। ভরত। নামগুলো বারবার মনে মনে উচ্চারণ করছিল কোভালন। কিন্তু এসব নামের কোনো ব্যক্তির কথা তার আদৌ মনে পড়ছিল না। এতৎনামীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে জীবনের কোনো পর্বে তার কদাপি দেখা হয়েছে, এমনও মনে হচ্ছে না। এরা কারা? এসব কী বলছিলেন চারণ? তাকে বারবার ‘ভরত’ নামে তিনি সম্বোধনই-বা করছিলেন কেন? ‘তোমার এই সন্দেহপ্রবণতা এখনও সেই একই মাত্রায় রয়ে গেছে, ভরত!’ এমন কথারই-বা অর্থ কী? হ্যাঁ, কোভালন চারণকে সন্দেহ করেছিল—সেকথা ঠিক। কিন্তু চারণের ওই কথায় যেন কোভালনের মনের আজকের সংশয় বা সন্দেহের প্রতি তিরস্কারটুকুই নেই। যেন বহুকাল ধরে কোভালনকে ও কোভালনের মনের এই সন্দেহপ্রবণতাকে চারণ সম্যকরূপে চেনেন। কাভুন্দি ও চারণের কথোপকথনের মধ্যেও যেন একটা আসন্ন বিপর্যয়ের আভাস আছে। কী সেই বিপর্যয়, কাদের সেই বিপর্যয়, কাভুন্দি কীভাবে সেই বিপর্যয়ের হাত থেকে বিপর্যস্তদের বাঁচাতে চাইছেন, কেনই-বা চারণ সেই বিপর্যয়কে অবধারিত বলছেন—এসব রহস্যময় প্রশ্নের সুষ্ঠু উত্তর কিছুতেই প্রতিভাত হচ্ছিল না কোভালনের চেতনায়। একটা কথা শুধু স্পষ্ট হয়েছে—এই চারণই দেবান্দীর স্বামী বীরমণি; সেকথা তিনি নিজমুখেই প্রকাশ করেছেন। শুধু এইটুকু ছাড়া সমস্তই অস্পষ্ট, সমস্তই কুয়াশাচ্ছন্ন ।

হয়তো এসবের কোনো অর্থ নেই। চারণ আসলে কোভালনের সঙ্গে অন্য কাউকে মিশিয়ে ফেলেছেন। অথবা, এমন চমকপ্রদ কথাবার্তা বলা চারণের মুদ্রাদোষ। কিংবা দীর্ঘকাল স্ত্রীসঙ্গ না করলে, সাধুসন্ন্যাসী হয়ে গেলে মাথা কিছুটা হলেও খারাপ হয়ে যায় । তখন মানুষ ভুলভাল দেখে, ভুলভাল বকে। এসব নিয়ে অত কিছু ভাবার দরকার নেই। এইভাবে মনকে যতই সরলীকৃত ব্যাখ্যার দ্বারা সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করছিল কোভালন, মন ততই বেঁকে বসছিল, কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারছিল না এতাদৃশ স্তোকবাক্যে ।

আবার বনপথ ঘন হয়ে উঠছে। শ্রীরঙ্গম পরিত্যাগ করে নৌকাযোগে কাবেরী অতিক্রম করেছে ওরা। নদীপথ দিয়ে আসতে আসতে দেখেছে, কাবেরীঘাটের উত্তর-পারের পুষ্পসমাকুল বনভূমির উপর ঝুঁকে পড়েছে আকাশের বৃষ্টিসম্ভব কৃষ্ণ মেঘ। কাবেরীর দক্ষিণ ঘাটে এসে ওরা নৌকা থেকে নামল। এ পারেও ঘনসমাচ্ছন্ন বনস্থলী, একটি সমুন্নত বৃক্ষের নীচে পুষ্পাস্তীর্ণ ভূমিতে আশ্রয় নিল তিনজন এক রাত্রিকালে। আবার প্রভাতবেলায় চলতে আরম্ভ করল। এখানে বনের মধ্যে স্থানে স্থানে অতি প্রাচীন সব মন্দির। এখনও পূজা হয়, তবু কতকালের শৈবালশিশির যে জমেছে সেসব মন্দিরের গায়ে ! একটি পুষ্পিত অশোকতরুর তলায় আসন পেতে কাভুন্দি তার প্রভাতী উপাসনা সেরে নিলেন।

ঘননিবিড় অশোকবীথির মধ্য দিয়ে পথ গিয়েছে বেঁকে। বনভূমি এখানে শান্ত, স্তব্ধ, নিরুপদ্রব। এমনকি ঝিঁঝিপোকাও ডাকছে না আর। কখনও গাছেদের ব্যবধান দিয়ে গায়ে এসে লাগছে কাবেরীর বায়ুবাহিত সুখস্পর্শ। হাঁটতে হাঁটতে মনের প্রশ্নগুলো সব এক এক করে ঝেড়ে ফেলে দিতে লাগল কোভালন। এখন তার ওসব ভাবলে চলবে না। যেভাবে হোক, অল্পকালের মধ্যে মাদুরাই পৌঁছোতে হবে কন্নকীকে নিয়ে। সেখানে জীবিকার উপায় দেখতে হবে। ওসব স্বপ্ন, কল্পনা, কবিতা, ভবিষ্যৎ দর্শন, সাধুসন্ন্যাসীর প্রহেলিকাময় কথাবার্তা অনেক হয়েছে। জীবনে বাস্তবোচিত সিদ্ধান্ত নেওয়াই এবার জরুরি। ওসব কল্পবিশ্বের মোহ আর নয়, এখন প্রখর, নির্মোহ বাস্তব।

ইতিমধ্যে পথে চলতে চলতে ওদের তিনজনের আপেক্ষিক অবস্থান পরিবর্তিত হয়েছে। সবার সামনে দীর্ঘ যষ্টি হাতে কাভুন্দি চলেছেন। মধ্যে কন্নকী। কন্নকীর পশ্চাতে আরেকটি যষ্টিহস্তে কোভালন সন্তর্পণে পথ চলছে।

মাদুরাই যাওয়ার পথ এত দীর্ঘবিসর্পিত, এত ক্লান্তিকর, এত ক্লেশকর হবে—সেকথা যাত্রারম্ভে ভাবতেও পারেনি কন্নকী। এখন অনুভব করতে পারছে কী নিদারুণ পথশ্রম ! তবু এই শ্রমকে উপেক্ষা করে আশায় বুক বেঁধে পথ হাঁটছে সে। কাভুন্দি সঙ্গে আছেন বলে অন্তত এই সুদীর্ঘ পথযাত্রা সহনীয় হচ্ছে। কটিসংলগ্ন বস্ত্রপ্রান্তে সে সঙ্গোপনে বেঁধে রেখেছে তার মূল্যবান নূপুর দুটি। এই তাদের অন্তিম সম্বল ।

আজ সারাদিন বনপথে চলতে চলতে অতীতের অনেক কথা বারবার মনে ভেসে আসছে। পিতৃগৃহে যাপিত সেই ঊষাচঞ্চল কৈশোর, সখীদের কলতান, প্রিয় সখী কুরিঞ্জি। কুরিঞ্জিরও বিবাহ হয়ে গেছে বহুদিন হল। পুষ্পহারেরই অপরপ্রান্তে তার শ্বশুরগৃহ। তা সত্ত্বেও তার সঙ্গে এখন আর যোগাযোগ নেই। কুরিঞ্জির বিয়ে হয়েছে এক চিত্রশিল্পীর সঙ্গে। আলোকপ্রাপ্তা, বিদুষী, প্রগল্ভা কুরিঞ্জির সঙ্গে তার স্বামীরত্নের কেমনতরো ভাব হয়েছে কে জানে! ভাবতে ভাবতে কন্নকীর ঠোঁটে এত কষ্টের মধ্যেও আনমনা হাসির রেখা ফুটে উঠল।

মনে পড়ছে কোভালনের সঙ্গে তার নিজের বিবাহের কথা। বিয়ের পর নৌকায় করে উরায়ুর যাওয়ার কথা। আহা, সেই সব মধুচ্ছন্দা দিন! তারপর কোভালনের পিতা মাশাত্তুবান, কন্নকীর পিতা মানাইক্কনের দেহান্তের কথা। কোভালনের মতিভ্রম… মাধবী…কোভালনের বাড়ি না-ফেরা… কোভালনের গৃহ-সংলগ্ন সেই পুষ্পাচ্ছাদিত উদ্যান, স্বচ্ছনীর তড়াগ… সমস্তই মনে আসছে একে একে। অতীতের সেসব দিন কোথায় গেল? সব যেন ভোজবাজির মতো নিঃশেষে মিলিয়ে গিয়েছে। যা কিছুকে সে এত নিরেট বাস্তব, এত জ্যান্ত বলে মনে করত একদিন—সে সবই এখন স্মৃতি, শুধুই স্মৃতি। সবই যেন ছায়া, রাতের স্বপন কেবল। শুরুতেও ছিল না, শেষেও নেই, মাঝখানে শুধু ক-দিনের প্রত্যক্ষতা। তাহলে কি তার স্বামী কোভালন যা বলে, তাই-ই ঠিক? সমস্তই আমাদের কল্পনার ফেনা, আমাদের মনের ছবি? বাইরে দেখা যাচ্ছে মাত্র? আসলে নেই ?

ইদানীং কাভুন্দিকে কাছ থেকে দেখতে দেখতে কন্নকীরও ওই কথাটাই মনে হয় । কাভুন্দি আছেন, অথচ যেন নেই। কাভুন্দির অনেকটাই যেন অন্য কোনো ভুবনে আছে । বহুযুগ আগের মহাবীরকন্যা সেই প্রিয়দর্শনাই কি তাহলে এ জন্মে কাভুন্দি? জন্মান্তর কি সত্য তবে? দুয়েকদিন আগে যে-চারণের সঙ্গে দেখা হল, তিনিও যেন এমনই। এখানকার, অথচ এখানকার নন। ভালো করে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না কন্নকী। তবু তার আজন্মলালিত বাস্তববোধ যেন ক্রমাগত বিধ্বস্ত হচ্ছে এ পথ ধরে চলতে চলতে। মনে হচ্ছে, কোথাও কোনোভাবে এই বাস্তব পৃথিবীর অতীত কল্পবিশ্বেরও হয়তো একপ্রকার বাস্তবতা আছে।

আপেক্ষিক অবস্থান পালটে গেছে তবে? আগে সামনে ছিল কোভালন, তার পেছনে কন্নকী। এখন কন্নকী সামনে, পেছনে কোভালন। সমস্তই সময়ের সাথে সাথে পালটে যায়।

এই অশোকবীথিকার উপান্তে জৈন-মতাবলম্বীদের এক মনোহর আশ্রম। দিনান্তে এই আশ্রমেই আশ্রয় নিলেন কাভুন্দি ওদের নিয়ে। সেখানেই সে-রাত্রি অতিবাহিত হল । পরের দিন ভোরের আলো ফোটার আগেই কাভুন্দি কন্নকী-কোভালনকে নিয়ে আশ্রম ছাড়লেন। চলতে চলতে মধ্যদিনে এসে পৌঁছোলেন এক পুকুরের ধারে। এখানে চারিপাশে অনেক নবোদ্গত তরুশ্রেণী, মধ্যে একটি সুদৃশ্য মণ্ডপ। কাভুন্দি বললেন, ‘এখানেই মাধ্যাহ্নিক আহার সেরে নেওয়া যাক। এর পরে লোকালয়ে উপনীত হতে আরও অনেকটা পথ অতিক্রম করতে হবে।’

আহারের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল কন্নকী, কোভালন পুষ্করিণী হতে পাত্র ভরে জল নিয়ে এল। কাভুন্দি স্থানটিকে পরিষ্কার করার কাজে ব্যাপৃত আছেন, এমন সময় সেই পথ দিয়ে একজন পুরুষ ও এক নারীকে আসতে দেখা গেল। তাদের বেশবাস বেশ সংক্ষিপ্ত, হাবভাব ও চালচলনে একটা স্থূল চটুলতার ভাব প্রকাশ পাচ্ছে। পথ দিয়ে আসতে আসতেই তারা পরস্পরের প্রতি কেমন একটা লঘু আচরণ করছিল। হাসতে হাসতে অমার্জিত ব্যবহারে এ ওর গায়ে ঢলে পড়ছিল বারবার। আরেকটু কাছে আসতেই মনে হল, তারা অল্পাধিক মদ খেয়েছে। পুরুষটি সম্ভবত স্থানীয় হাট থেকে মেয়েটিকে ক্রয় করেছে। মেয়েটিও বেশ নির্লজ্জ, চটকদার ধরনের।

মণ্ডপের কাছে এসে ওরা দুজন কন্নকী ও কোভালনকে দেখে পরিহাসভরে হাসতে লাগল ও নিজেদের মধ্যে কীসব বলাবলি করতে লাগল । কোভালন ও কন্নকী পরস্পর মুখোমুখি বসেছিল। কাভুন্দি একটু দূরে গাছের তলায় বসেছিলেন।

মেয়েটি কাভুন্দিকে অতি চটুল স্বরে প্রশ্ন করল, ‘হে সাধ্বী ! অনেকদিন উপোস-টুপোস করে আপনি তো শুকিয়ে গ্যাচেন মনে হচ্চে। তা আপনার সঙ্গে এ দুজন তো দিব্যি ফুলকুমার ফুলকুমারী—তা এঁরা কারা? দেখে তো মনে হোচ্চে, আপনি আপনার তপস্যায় যে একেবারে স্বগ্‌গো থেকে সাক্ষাৎ কামদেব ও রতিসুন্দরীকে নামিয়ে এনেচেন !’

কাভুন্দি গম্ভীর স্বরে উত্তর দিলেন, ‘ওরা কাম বা রতি নয়। ওরা আমার ছেলেমেয়ে । ওদের সম্বন্ধে কোনো খারাপ কথা বোলো না।’

কথাটা শুনে পুরুষটি হো-হো করে হেসে মেয়েটার কাঁধের উপর গড়িয়ে পড়ল। তারপর মেয়েটাকে ঠেলা মেরে বলে উঠল, ‘শুনছিস লা? সাধ্বী কী বোলচে? এরা নাকিওর ছেলেমেয়ে ! অদ্ভুত কলিকাল, বাওয়া ! সন্নিসিনিরও ছেলেমেয়ে হচ্চে আজকাল ! আবার সেই ছেলেমেয়েরা একই মায়ের গর্ভো থেকে জন্মে পরস্পর বে-থা কচ্চে, আসনাই কোচ্চে! শুনিচিস কখনো অ্যামোনধারা ?’

কথাটা বলেই সেই নারী-পুরুষ বনপথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যেতে লাগল। কিন্তু ততক্ষণে কাভুন্দি বৃক্ষতল থেকে উঠে দাঁড়িয়েছেন। এতদিনে এই প্রথম কাভুন্দিকে ক্রুদ্ধ হতে দেখল কন্নকী-কোভালন। তিনি দুই হাতে কান চেপে দু-চোখ বন্ধ করে ক্রোধে থরথর করে কাঁপছিলেন। তাঁর গণ্ডদেশ রাগে অরুণবর্ণ ধারণ করেছে। হঠাৎ মাটি থেকে যষ্টিদণ্ডটি তুলে নিয়ে কাভুন্দি উত্তেজিত স্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘তোরা আমার বাছাদের দুর্বাক্য বলেছিস। অথচ ওরা তো তোদের কোনো ক্ষতি করেনি। তা সত্ত্বেও তোরা বনের শেয়াল-কুকুরের মতো আচরণ করলি। যেমন ব্যবহার করেছিস, তেমনই হয়ে যা তোরা। বনে বনে শৃগাল-শৃগালীর মতো ঘুরে বেড়া!’

এক লহমা শুধু, তারপরেই কন্নকী-কোভালন দেখল, সে দুজন নারী-পুরুষ আর নেই। তাদের পরিবর্তে একটা শৃগাল আর একটা শৃগালী বনপথ দিয়ে উল্লাপন করতে করতে ছুটে পালাচ্ছে!

এ কী হল? কাভুন্দির অভিশাপে ওই দুই নারী-পুরুষ শেয়াল-শেয়ালি হয়ে গেল? কন্নকী অনুনয় করে কাভুন্দিকে বলল, ‘শান্ত হোন, মা, শান্ত হোন! এ ক্রোধ যে আপনাকে সাজে না !’

কাভুন্দি ধীরে ধীরে স্বস্থ হলেন। সামান্য একটু জলপান করে কন্নকী-কোভালনের নিকটে এসে বসলেন। বললেন, ‘আমার কিছু করার ছিল না। আমরা সদুদ্দেশ্যে মাদুরাই যাচ্ছি। ওদের কোনো ক্ষতি করিনি আমরা। সম্পূর্ণ সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে শ্রমসাধ্য কর্মে কেউ ব্রতী হলে, যখন অন্য মানুষেরা শৃগাল-কুকুরের মতো তার পেছনে লাগে, তখন সেই সব নিন্দুক-সমালোচকদের ঠিক এই দশাই হয়। মানুষজন্ম পেয়ে যারা মানুষের মতন আচরণ করতে শেখে না, তাদের কুকুর বা শৃগাল হয়ে যাওয়াই ভালো !’ আরও কিছুক্ষণ পরে কাভুন্দি স্বাভাবিক হতে কন্নকী বলল, “মা, এদের কী হবে? এরা এখানে এই বনের মধ্যে শৃগাল-শৃগালী হয়েই বাকি জীবনটা কাটাবে ?’

কাভুন্দি হাসলেন। বললেন, ‘না, তা নয়। সৎ মানুষকে অপমান করার অপকর্ম করেছে ওরা। এক বছর পরে সেই অপকর্মের ফল সমাপ্ত হয়ে যাবে। তখন আবার মানুষ হবে। কোনো কর্মেরই ফল অনন্ত নয়।’

কন্নকী একটু সাহস পেয়ে প্রশ্ন করল, ‘তবে যে মা আপনি বলেছিলেন, আপনার কোনো অলৌকিক ক্ষমতা নেই?’

‘নেই-ই তো! আমার কোনো অলৌকিক ক্ষমতার বলে ওরা শৃগালে রূপান্তরিত হয়নি তো ! ওদের পাপেই ওরা শৃগাল হয়ে গেছে।…আমার আহার হয়ে গেছে । আমি উঠছি। তোমরা আস্তে সুস্থে খেয়ে এসো, বাছা!’ বলতে বলতে উচ্ছিষ্ট পাত্রটি হাতে তুলে নিয়ে কাভুন্দি পুষ্করিণীর দিকে চলে গেলেন।

কোভালনকে একা পেয়ে কন্নকী বলল, ‘দেখলে? কী আশ্চর্য ব্যাপার! যেই না কাভুন্দি ওরা শৃগাল হয়ে যাক, এই চিন্তা করলেন, অমনি ওরা শৃগাল হয়ে গেল ! সত্যিই, মনের ক্ষমতা অপরিসীম!’

কলাপাতার উপর সত্তুর মণ্ডটি মাখতে মাখতে কোভালন বলল, “তাই কি?’ কন্নকী বড়ো বড়ো চোখ তুলে বলল, ‘তাই নয় ?’

মুখে গ্রাস তুলে নিয়ে কোভালন উত্তর দিল, ‘এমন নয় বলেই আমার মনে হচ্ছে । নিন্দাকারী ওই নারী-পুরুষ তো আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরেই চলে গেছিল। এ দুটো শৃগাল-শৃগালী হয়তো বনের মধ্যে আশেপাশেই ছিল। কাভুন্দির গর্জন শুনে ঝোপঝাড় থেকে বেরিয়ে এসেছে। ওই নারী- -পুরুষ দুজনই শৃগাল হয়ে গেছে বলে আমার মনে হয় না।’

কন্নকী বিস্মিত হয়ে বলল, ‘তু-তুমি—তুমি একথা বলছ? যে-তুমি কি না বলতে এই সমস্ত জগৎ আমাদের মনেরই বহিঃপ্রক্ষেপ? বলতে, আমাদের কল্পনাই বাইরে জগতের রূপ ধরে আছে, সেই তুমিই কি না আজ বলছ… ?’

কোভালন তক্র পান করতে করতে বলল, ‘হ্যাঁ, বলছি। আমার ওসব কল্পনার অসুখ ভালো হয়ে গেছে, কন্নকী। আমি এখন নিতান্ত বাস্তবদৃষ্টি দিয়েই জগৎকে দেখি। … তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। আমাদের আবার বেরিয়ে পড়তে হবে।

(সাঁইত্রিশ) চেতোদর্পণম্‌

ঘটনা—যা ঘটে, তা আমাদের চোখের সামনেই। কিন্তু সেই ঘটনার ব্যাখ্যা করে মন। যার মন যখন যে-ভূমিতে থাকে, সে তখন ঘটনাকে তেমন করেই ব্যাখ্যা করে থাকে । মন সব সময়ে একই ভূমিতে থাকে না। কূপ থেকে জল তোলার ঘটিযন্ত্রের মতন মন বিভিন্ন ভূমির ভিতর দিয়ে ওঠানামা করে। মন যখন ভাববাদের ভূমিতে থাকে, তখন মানুষ ঘটনার ভাববাদী ব্যাখ্যা দেয়—এই যেমন কন্নকীর মনে হল, অপশব্দ-উচ্চারণকারী নারী-পুরুষ কাভুন্দির শাপে শৃগাল-শৃগালীতে রূপান্তরিত হয়েছে। মন যখন বস্তুবাদের ভূমিতে থাকে, তখন মানুষ ঘটনার বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে—যেমন, কোভালনের মনে হল, এ সমস্তই চোখের ভুল ।

এই উভয়বিধ ব্যাখ্যার কোনোটিই একেবারে ভুল নয়। আবার কোনোটিই একেবারে ঠিকও নয়। সত্য যে কী, তা পূর্ণত কেউ বুঝতে পারে না। ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রত্যেকেই অংশত ব্যাখ্যা করে। তাই সত্যকে ‘অনেকান্ত’ বলা হয় ৷

মানুষের মন একই ভূমিতে দীর্ঘক্ষণ থাকতে পারে না। আজ থেকে মাত্র কয়েক মাস আগে কন্নকী যেকোনো ঘটনার বস্তুবাদী ব্যাখ্যা খুঁজত, এখন সে ভাবের দিক দিয়ে ঘটনার অর্থ খুঁজছে। এবং মাত্র কয়েক মাস আগে অবধি কোভালন ছিল ভাববাদী, অথচ এখন সে সমস্ত ঘটনারই বাস্তবিক অর্থ বের করতে চাইছে।

এই সব বস্তুবাদ, ভাববাদ… সত্যি কথা বলতে কী, যেকোনো মতবাদই আসলে মনের একেকটা ভূমি; এ ছাড়া আর কিছুই নয়। সেই যে কত বছর আগে পুষ্পহারে এসেছিল মিশরীয় পুরোহিত আমেনহোটেপ। সে মানুষকে শরীর বলে জানত বলেই শরীরটাকে স্থায়ী করার প্রাণান্ত প্রয়াস করেছিল। আর নটী ইন্দুমুখী তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বুঝেছিল, মানুষ শরীর নয়—মানুষ আত্মা । কিন্তু মানুষ আসলে যে ঠিক কী, তা কে বলে দেবে? মানুষকে বুঝতে গিয়েই, মানুষকে ব্যাখ্যা করতে গিয়েই পৃথিবীর সব শাস্ত্র, সব দর্শন-বিজ্ঞান, সমস্ত মনস্তত্ত্ব উজাড় হয়ে গেছে। মানুষের ইতি করতে পারেনি।

তাতেও তেমন বিরাট কিছু সমস্যা ছিল না, যদি না মানুষের স্মৃতিশক্তি এমন প্রবল হত। মনের এক ভূমি থেকে আরেক ভূমিতে মানুষের মন চড়ুই পাখির মতো লাফিয়ে লাফিয়ে টুক টুক করে ওঠে আবার লাফিয়ে লাফিয়ে টুক টুক করে নামে। কিন্তু এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় যাওয়ার পরেও পূর্বতন অভিজ্ঞতার স্মৃতি মাথার মধ্যে দগদগে ঘায়ের মতন জ্বলতে থাকে। যদি আগের কথা মানুষ একটু পরেই ভুলে যেতে পারত, যেমনটা হয়তো দোয়েল বা ফিঙে পাখিরা পারে, তাহলে গোল মিটে যেত। কিন্তু মানুষের স্মৃতি প্রবল হওয়ায় আগেকার অনুভব এসে পরেরকার অনুভবকে ক্রমাগত গুলিয়ে দিতে থাকে। কেউ যদি বলে, এখন থেকে আমি এমন করে ভাবব, আগেকার চিন্তাধারার আর অনুসরণ করব না—সেটি অত সহজে হওয়ার জো নেই। মানুষ সব সময় ঘুরছে; বাস্তব থেকে কল্পনায়, জাগরণ থেকে স্বপ্নে, স্বপ্ন থেকে গভীর ঘুমে, গভীর ঘুম থেকে আবার জাগরণে, এক মতবাদ থেকে অন্য মতবাদে, এক গোষ্ঠী থেকে অন্য গোষ্ঠীতে, এক সময়কাল থেকে অন্য সময়কালে, এক দেশ থেকে অন্য দেশে, শৈশব থেকে যৌবনে, যৌবন থেকে বার্ধক্যে, এক জন্ম থেকে হয়তো অন্য জন্মে—ঘোরার শেষ নেই । কিন্তু তারই সঙ্গে এক ভূমি থেকে অন্য ভূমিতে নিয়ে যাচ্ছে সে স্মৃতির দুর্বহ বোঝা; মাঝে মাঝে বিস্মৃতির শক্তি এসে সে-বোঝা সামান্য হালকা করে দেয় তাই রক্ষে, তা না হলে প্রত্যেকটি মানুষ অন্তিমে পাগল হয়ে যেত। এই ভয়ানক স্মৃতির অত্যাচার থেকে কারও রেহাই নেই, যতই সে ক্লান্ত হোক, শ্রান্ত হোক, পথ চলতে চলতে যতই রক্তাক্ত হোক তার পদপাত, যতই তার পথশ্রান্ত শরীর নুয়ে আসুক ঘুমে, তবুও তার নিষ্কৃতি নেই, স্মৃতি ফুটে উঠবে স্বপ্ন হয়ে, তাকে লোভাবে, জ্বালাবে, পোড়াবে, চূর্ণবিচূর্ণ করবে….

কাভুন্দি বললেন, ‘আর তো চলতে পারছি না, কোভালন। পা অসাড় হয়ে আসছে। এখানে এবার একটু বসি।’

বসে তিনি ততক্ষণে পড়েইছেন। পাশে কন্নকীও দ্বিতীয়ার চাঁদের মতন শ্রমক্লান্ত ম্লান শরীর নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়েছে। চারণ যেদিন এসেছিলেন, তারপর চার-পাঁচ দিনরাত একাদিক্রমে হেঁটে হেঁটে এখানে এসে পড়েছে তারা। পথিমধ্যে কোনো আশ্রয় জোটেনি, খাদ্য-পানীয় সব ফুরিয়ে এসেছে। পা কেটে রক্তাক্ত হয়ে ঘায়ের মতন হয়েছে । আর চলার শক্তি নেই। কাভুন্দি কত কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনে অভ্যস্ত, কিন্তু তিনিও আর চলতে পারছেন না । কোভালনও অত্যন্ত ক্লান্ত, নিঃশেষিত হয়ে আসছে শরীরের শক্তি, তবু সে জানে, একবার বসলে আর রক্ষে নেই, উৎসাহ সংগ্রহ করে তারপরে আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না। এদিকে এই দুই নারীকে নিয়েই সমস্যা। একজন বৃদ্ধা, অন্যজন চলচ্ছক্তিহীনা যুবতী। কন্নকীকে দেখে মনে হচ্ছে, সে এখনই জ্ঞান হারাবে। এদের এখনই সুশ্রূষা করা দরকার। কাভুন্দির পুঁটুলিতে ভিক্ষাপাত্র কোথায় বাঁধা আছে, সে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কোভালন দেখল, বনের মধ্য দিয়ে তৃণাস্তীর্ণ শুঁড়ি পথ একটা জলাশয়ের দিকে নেমে গেছে। যদি পদ্ম বা শালুকের পাতায় করে জল এনে এদের মুখে-চোখে ছেটানো যায়, যদি একটু জলপান করানো যায়, তাহলে হয়তো ফের এদের সুস্থ করে তোলা যাবে। আর অধিক চিন্তা না করে কোভালন ওই শুঁড়ি পথ দিয়ে জলাশয়ে নামতে লাগল ৷

ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর কোভালনের তখন মাথা ঘুরছে। মনে হচ্ছে, ঢালু পথ দিয়ে নামতে গিয়ে সে পা ফসকে পড়ে না যায়। এ মুহূর্তে সে ভুলে গেছে সে মানুষ নাকি জন্তু, কী তার নাম, কোথায় আবাস, কোথায় যাচ্ছে সমস্তই। শুধু মনে আছে, পুষ্করিণীতে নেমে জলপান করতে হবে, পদ্মপাতায় করে কিছুটা জল কোনোমতে তুলে নিয়ে ফিরে যেতে হবে মূর্ছিতপ্রায়া দুই নারীর কাছে।

আকণ্ঠ তৃষ্ণা নিয়ে সে জলাশয়ে নামল, দুই করপুটে যতটা জল ধরে, ততটা তুলে মুখে দিল সে। অমনই কী একটা পাখি তীক্ষ্ণ স্বরে শিস দিয়ে টেনে টেনে ডাকতে ডাকতে উড়ে যেতে লাগল তার মাথার উপর দিয়ে। চমকে একবার ঊর্ধ্বমুখে চাইল কোভালন, তারপরেই সেই পাখির ডাক উপেক্ষা করে নিকটবর্তী একটা বড়োসড়ো পদ্মপাতা সবলে টেনে ছিঁড়ল সে। দুই করতলে পদ্মপাতা ধরে খানিকটা জল নিতে গেল নীচু হয়ে ….

আর তখনই সে দেখতে পেল, সেই পুষ্করিণীর জলতলদেশ থেকে কে একজন তার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। বড়ো বড়ো চোখের পাতায় সুরমা টানা । ভালো করে চোখ মেলে একবার তাকিয়ে দেখতে গেল কোভালন। এ কে তার দিকে এমনভাবে মায়াময় দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে আছে পুকুরের তলা থেকে ? কেমন যেন পরিচিত মুখ…

বসন্তমালা ! মাধবীর প্রধানা সখী দুখিনী বসন্তমালা ! জলের নীচে বসন্তমালার মুখ শ্যাওলাপাতার মতন থিরথির করে কাঁপছে। কিন্তু বসন্তমালা এখানে এল কীভাবে? এই পুষ্করিণীর নীচে? এত অন্ধকারের ভিতর?

চোখ সরিয়ে নিতে চাইল কোভালন, কিন্তু পারল না। বসন্তমালার কাজল পরা দুটি চোখ তার দৃষ্টিকে বিঁধে রেখেছে যেন। জলের ঢেউয়ের মধ্যে প্লবমান শব্দ তুলে বলতে লাগল বসন্তমালা, ‘সখী মাধবী আমাকে বিশ্বাস করেনি। সে ভেবেছে, আমার কোনো কথায় আহত হয়ে আপনি তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। মাধবী খায় না, পরে না, শুকনো লতার মতো নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে মাধবী। আমি সখীর এ দশা সহ্য করতে পারিনি । নিজের হাতে নিজের জীবন শেষ করে দিয়েছি। কিন্তু তাতেও তো আমার নিষ্কৃতি নেই, কোভালন। আমার সমস্ত শরীর কামনা-বাসনার আগুনে জ্বলছে। আমাকে আপনি তৃপ্ত করুন, কোভালন, একবার তৃপ্ত করুন…’

বলতে বলতে দুই জলবাহু দিয়ে বসন্তমালা কোভালনকে জড়িয়ে ধরতে লাগল। কোভালন সেই বজ্রকঠিন বন্ধন থেকে নিজেকে কোনোমতেই ছাড়াতে পারছে না । হাত থেকে পদ্মপাতাটা খসে পড়ে গেছে। চেঁচিয়ে কাউকে ডাকবার প্রয়াস করল কোভালন, কিন্তু গলা থেকে আওয়াজ বেরোলো না। তীব্র আশ্লেষে কামার্তা বসন্তমালা কোভালনকে জড়িয়ে ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আরও অতল গভীর জলের দিকে… নিতান্ত অসহায়ের মতো কোভালন সেই অতলে ডুবে যাচ্ছে… শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে… আর উপায় নেই…. সমস্ত অন্ধকার !

হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে নিজেকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে তুলল কোভালন । মনে মনে নিজেকে ধমক দিয়ে বলে উঠল, এসবই আমার স্মৃতির অত্যাচার, আর কিছুই নয় ।

সমস্তই আমার কল্পনার অসুখ ! শব্দগুলোর মধ্যে কী অমিত শক্তি ছিল, কী জানি। কিন্তু মনে মনে ওই কথাগুলো উচ্চারণ করামাত্রই অমনি সমস্তই এক লহমায় থেমে গেল। কোভালন দেখল, সে আধগলা জলের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে আছে। পুকুরের মধ্যে কীভাবে এতটা চলে এসেছে, সে জানে না। বসন্তমালা, তার সেই চোখ, দুর্দম বাহুর আশ্লেষ—কোথাও কিচ্ছু নেই । শুধু হাত থেকে পড়ে জলতলে ভাসতে ভাসতে অনেক দূরে চলে গেছে স্খলিত পদ্মপাতাটা পুকুরের জল থরথর করে কাঁপছে। তীরের ঝোপঝাড় মধ্যাহ্নের রৌদ্রের ভিতর চিত্রার্পিত, স্থির, নিস্তব্ধ !

বসন্তমালা এখানে আসতেই পারে না। সব, স-অ-ব, মুখে-মাথায় জলের স্পর্শ দিল কোভালন। ধীরে ধীরে জল থেকে উঠে এল । অন্য একটা পদ্মপাতা ছিঁড়ে জল তুলে নিয়ে ফিরে যেতে লাগল প্রায়-সংজ্ঞারহিতা দুই অপেক্ষমাণা নারীর কাছে।

(আটত্রিশ) ভীষণা

সেদিন জলপানের পরে সামান্য সুস্থ হয়ে আধক্রোশ প্রায় পথ হেঁটে ওরা একটি ছোটো গ্রামে আহার্য ও আশ্রয় পেয়েছিল। দিন তিনেক লেগেছিল নিজেদের সুস্থ ও চলনক্ষম করে তুলতে। তারপর আবার হাঁটতে আরম্ভ করল ওরা।

এবারের পথ বড়ো অদ্ভুত; ক্রমশ কাবেরীতট থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল মার্গ। ধীরে ধীরে এমন একটি স্থানে উপস্থিত হল কোভালনরা, যেখানে ভূমিভাগ প্রকৃতির কৃপাবারিকশা থেকে বঞ্চিত। রুক্ষ, ঊষর মৃত্তিকা; স্থানে স্থানে উচ্চাবচ পোড়ো জমি, স্থানে স্থানে অবিন্যস্ত জঙ্গল। জঙ্গল তেমন ঘন নয় একেবারেই, তৃণশূন্য ধূসর পথ শ্রীহীন বৃক্ষদের মাঝবরাবর ছন্নছাড়া হয়ে চলে গেছে। পথে কঙ্কর, কণ্টকেরও অভাব নেই । কাভুন্দি, কন্নকী, কোভালন বহু ধৈর্য ধরে সেই ক্লান্তিকর দুর্গম পথ দিয়ে হেঁটে চলেছিল।

পথটা যেখানে একটি বৃহৎ শালতরুর সমীপে গিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে, ঠিক সেখানেই লম্বমান একটি বৃহৎ মৌচাক। চারিপাশে দংশনপ্রখর মৌমাছিরা ইতস্তত উড়ছে। তাদের প্রকোপ বাঁচিয়ে কাভুন্দি ও কন্নকীকে সন্তর্পণে পার করিয়ে দিতে সামনে এগোতে গেল কোভালন ।

আর ঠিক তখনই হঠাৎ কোথা থেকে একটা কালো তির উড়ে এসে ঠিক তার মাথার উপর দিয়ে সাঁই করে বেরিয়ে গেল। তারপর আবার পরের পর অনেকগুলো তির শ শন্ শব্দ করে তাদের চারপাশ দিয়ে ছুটে যেতে লাগল। ভয় পেয়ে কন্নকী চমকে উঠে কোভালনকে জড়িয়ে ধরল। কোভালনও ভয়ে চোখ বুজে ফেলেছে তৎক্ষণাৎ। একমাত্র কাভুন্দিই ধাবমান তিরগুলোর দিকে তাকিয়ে ব্যাপারখানা কী ঘটছে, তা বুঝবার চেষ্টা করতে লাগলেন।

কিন্তু সেসব বোঝাবুঝির আগেই শালবনের অন্তরাল হতে পাঁচজন ধনুর্ধারী মূর্তিমান কালসর্পের মতন বের হয়ে এল। তাদের চেহারা ভীষণ, অমারাত্রির অন্ধকারের মতন তাদের গাত্রবর্ণ, মাথার রুক্ষ চুলগুলো উপরে ঝুঁটি করে বাঁধা, পরনে মলিন বস্ত্র ও ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। প্রত্যেকেই ধনুর্বাণ উদ্যত করে রেখেছে।

পাঁচদিক থেকে তারা ওদের ঘিরে ধরল। কাভুন্দি ভাবলেন, এরা যেই হোক, যদি মেরে ফেলার ইচ্ছা থাকত, তাহলে তো অরণ্যের অন্তরাল থেকে শরনিক্ষেপ করে এতক্ষণে তাঁদের মেরেই ফেলত। কিন্তু তা যখন করেনি, তাহলে উদ্দেশ্য কিছু ভিন্ন। লোকগুলোর ভাবভঙ্গিমা থেকে মনে হল, হাতের পুঁটুলিগুলো মাটির উপর নামিয়ে রাখতে বলছে ইঙ্গিতে। ওরা তিনজন সেকথা বুঝতে পেরে হাত থেকে যষ্টি, পুঁটুলি ইত্যাদি নামিয়ে রাখল, কিন্তু তাতেও এই সহসা-আবির্ভূত ধনুর্ধরেরা ধনুক নামাল না। কী চায় এরা ? ফিরে যেতে বলছে? তবে কি ভুলবশত আটবিকদের নিজস্ব বনাঞ্চলে দুই সঙ্গী সহ কাভুন্দি ঢুকে পড়েছেন ?

কিন্তু এবার দেখা গেল, ধনুর্ধারী আগন্তুকরা ধনুকের জ্যা সবলে আকর্ষণ করতে লেগেছে। তবে তো মেরে ফেলাই এদের উদ্দেশ্য! আর এক মুহূর্ত—তারপরেই ওদের লক্ষ করে বিষাক্ত তির ছুটে আসবে! কোভালন-কন্নকী চোখ বুজে ফেলল… এই তবে শেষ…

কিন্তু এরই মধ্যে কে একজন হঠাৎ হো-হো করে হেসে উঠে লোকায়ত উচ্চারণে বলল, ‘আহোহো আম্মাম্মা! ই যমদুয়ারে কী কোচ্চিস তুই ?’

কোভালন চোখ খুলে দেখল, পাঁচ আক্রমণকারীই সহসা ধনুক নামিয়ে নিয়েছে। এদের মধ্যে একজন সহাস্যে কাভুন্দির দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হল, ওই লোকটাই কাভুন্দির উদ্দেশে কথাগুলো বলে উঠেছে।

মাটিতে তির-ধনুক সশব্দে ফেলে দিয়ে সেই লোকটা কাভুন্দির কাছে এসে বলল, ‘মোকে চিনলি নাই, আম্মাম্মা? মুই উখি ! উখিয়াথং! সিই যে মুই মৈলগিরিদের সাতে গ্যালো বচ্ছর জাড়ের দিনে তুর কুঠিয়ায় গেছলম ! মনে নাই ?’

এতক্ষণে কাভুন্দির মুখেও হাসি ফুটে উঠল। মনে হল, তাঁর পুরোনো কথা কিছু কিছু মনে পড়েছে। তিনি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ও, উখি ! তা তুমি বাবা এখানে কী করছ?’

‘ইটা তো আমাদের বন,ইটা তো আমাদের গাঁ, আম্মাম্মা! মোরা তো ইখানেই থাকি । তা তুই যাচ্ছিস কোতা? ই ব্যাটাবিটিছেলা তুর সাতে কে?’

কাভুন্দি বললেন, ‘এর নাম কোভালন। আর এর নাম কন্নকী। এদের নিয়ে আমি মাদুরাই যাচ্ছি। এরা আমার ছেলেমেয়ের মতো।’

উখিয়াথং নামের লোকটা কোভালন-কল্পকীকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আপাদমস্তক দেখতে লাগল। তারপর হেসে উঠে বলল, ‘বাব্বা! ইয়ারা যে বেবাক ঠাকুর-ঠাকরুনের মতন দেকতে রে, আম্মাম্মা! ঠাকুরটির হাত দুটি নাম্বা-নাম্বা। ঠাকরুনটির বুক দুটি উঁচা উঁচা ! খুব সুন্দর দেকতে রে, আঈ !’

তার কথায় কন্নকী খুব লজ্জা পেল ঠিকই, কিন্তু কেমন শিশুর মতো সরল দৃষ্টি লোকটির ! সে-দৃষ্টিতে কোনো কলুষতা নেই । লোকটাকে তাদের বেশ লাগছিল।

কাভুন্দির দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে উখিয়াথং বলল, ‘খুব ভালো দিনে এস্যে পড়িচিস, আম্মাম্মা! আজ মোদের পরব। চল, তুরা মোদের গাঁয়ে চল। তুদের পরব দেখাব।’ কাভুন্দি বলল, “কিন্তু তাতে যে আমাদের দেরি হয়ে যাবে, উখি। লোকখি বাবা আমার, আমাদের যেতে দাও।’

কিন্তু ততক্ষণে উখিয়াথং ওদের পুঁটুলিগুলো নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। নাছোড় সুরে সে বলল, ‘উসব হবেনি, আম্মাম্মা! আজ পরব দেকবি, তারপর কাল বিহানে যেথাকে যাবার সেথাকে যাবি । ‘

অগত্যা ওরা তিনজন উখিয়াথঙের পেছনে গুটি গুটি পায়ে চলতে লাগল। ইতিমধ্যে বাকি চারজন ধনুর্ধর কখন যেন বনের মধ্যে হাওয়ার মতো মিলিয়ে গিয়েছে।

যেতে যেতে কাভুন্দি বললেন, ‘তা তুমি তো বাবা কথা রাখোনি! হিংসার কাজ, পাপের কাজ ছাড়োনি তো তুমি এখনও ?’

উখিয়াথং সেই শিশুর মতই সশব্দে হেসে উঠে বলল, “উ হবে লাই রে, আম্মাম্মা ! চেষ্টা করিচিলম। হয় নাই। উ যাবার লয়। কী করব, বল ? মোরা হলাম মারাভার জাত! শিকার, দস্যুগিরি মোদের রক্তে। চুপ করে বস্যে থাকলে কিচুদিন পরে পরেই রক্ত ছটপট করে উঠে !”

কিছু দূর যাওয়ার পর বনের ভিতর ডুব ডুব ডুব ডুব্‌ শব্দে দুন্দুভিনাদ শোনা গেল । ধীরে ধীরে বন শেষ হয়ে মারাভারদের গ্রাম এসে পড়ল। উখিয়াথং ওদের গ্রামের মন্দিরে নিয়ে গেল কোভালনদের।

মন্দির বলতে সাধারণত যা বোঝায়, এ মন্দির তেমন নয়। কুসুমগাছের তলায় খড়ের একচালার নীচে এক ভীষণাকৃতি দেবীমূর্তি। ঘোর কৃষ্ণবর্ণা, দ্বিভুজা, ত্রিনেত্রা। দেবীর চক্ষুত্রয় অগ্নিবর্ণ ও কেশপাশ জটাজটিল। ওষ্ঠাধর আরক্তভীষণ, উজ্জ্বল দশনপক্তি প্রকাশিত। কণ্ঠদেশ বিষনীল, বিষাক্ত সর্পের চর্ম দেবীর বক্ষের কাঁচুলি, হস্তীচর্ম উত্তরীয় ও সিংহচর্ম অধোবাস। এক হস্তে তীক্ষ্ণমুখ ত্রিশূল। অন্য হস্ত অভয়দানে উত্তোলিত। দুই ধড়যুক্ত এক ভয়ানক অসুরের মাথায় দেবী চরণ স্থাপন করে দাঁড়িয়ে আছেন। চরণদ্বয় অলক্তরাগ ও রুপার নূপুরে সমালংকৃত ।

উখিয়াথং ভক্তিভরে দেবীকে নমস্কার নিবেদন করে বলল, ‘ইটি মোদের মা বিটি মোদের মারাভারদের দেবী—আইয়াই কুমারী! মোরা উয়ার পূজা করে ডাকাইতি কোত্তে যাই। তুরা পেন্নাম কর।’

কাভুন্দি-কোভালন-কন্নকী সভয়ে দেবীকে প্রণাম জানাল ।

মন্দিরের চারিদিকে কিছুটা জায়গা অত্যন্ত সুচারুরূপে পরিষ্কৃত। সেই জায়গাটির চারিদিকে কুরব, কদম্ব, কোঙ্গু ও ভেঙ্গাই গাছের বন। উখিয়াথং বলল, “ই জায়গাকে বলে মানরম। ইখানে মোরা সবাই একসাতে বোসে খাই। ইটা এইনার-বংশের মানরম। অ্যামন আরও অনেক মানরম আচে। এইনার-বংশ মারাভারদের সদ্দার-বংশ। দেকবি এখুনি সব আসবে।’

কথাটা বলতে বলতেই বনের ভিতর থেকে শাঁখ-ঘণ্টা ঢাক-ঢোলের তুমুল শব্দ ভেসে এল। বহু মানুষের সম্মিলিত হো-হো আওয়াজে মুখর হয়ে উঠল বনের আকাশ-বাতাস। কিছুক্ষণের মধ্যেই কালো কালো অজস্র নারী-পুরুষের ভিড় বনপথ দিয়ে এই মানরমের দিকে আসতে লাগল । তাদের পরনে ধুলামলিন বস্ত্র, কারও হাতে শিঙা, কারও হাতে শঙ্খ। কেউ কেউ আবার গলায় বিশাল আকারের ঢাক কিংবা ঢোল ঝুলিয়ে প্রাণভরে বাজাচ্ছে। জগঝম্পও আছে দুয়েকজনের সঙ্গে।

সেই তুমুল কোলাহলের ভিতর অস্পষ্ট মানুষের ভিড় ধুলা উড়িয়ে মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ ধরে বাদ্যযন্ত্র সহ উচ্চৈঃস্বরে তারা গান গাইতে লাগল দুর্বোধ্য ভাষায়। তারপর মানরমের মধ্যে সকলে বৃত্তাকারে বসে পড়ল। বৃত্তের কেন্দ্রে রইল শুধু নধর একটা বুনো হরিণের পিঠে উপবিষ্ট এক রহস্যময়ী নারী।

এতক্ষণ মেয়েটি ভিড়ের মধ্যে ছিল বলে আলাদাভাবে কোভালনদের চোখে পড়েনি। মেয়েটির বয়স আনুমানিক আঠেরো কি উনিশ হবে। কটিদেশে চিতাবাঘের চামড়া পরে আছে মেয়েটি, বক্ষস্থল উন্মুক্ত ও লাল লাক্ষারসে তার উত্তুঙ্গ কুচযুগ প্রলিপ্ত। শিরোদেশ জটাজুটসমাযুক্ত; সেই জটাপাশে একটি রৌপ্যনির্মিত সর্পালংকারও চন্দ্রকলার আকৃতিযুক্ত বন্য শূকরের দত্ত শোভা পাচ্ছে। শিকারী বাঘের তীক্ষ্ণ দাঁত দিয়ে মালা তৈরি করে সে গলায় পরেছে। হাতে একটা ধনুক আছে; মানুষ বা অন্য কোনো পশুর পঞ্জরাস্থি দিয়ে সেই তির-ধনুক বানানো।

হঠাৎ বিদ্যুৎগতিতে হরিণের পিঠ থেকে নেমে পড়ল মেয়েটি, পিঠে চাপ্পড় মেরে হরিণটাকে বনের দিকে চালিত করল। তারপর মানরমের কেন্দ্রে ধুলার উপর বসে সে তার জটাসমেত শিরোদেশ বৃত্তাকারে ভয়ানকভাবে ঘোরাতে লাগল ও সারা শরীর তালে তালে দোলাতে লাগল ।

ইতিমধ্যে কারা যেন অগুরুমিশ্রিত ধুনা ধরিয়েছে এবং তার থেকে প্রচুর ধূম উদ্‌গীরিত হচ্ছে। মেয়েটিকে অমন মাথা চালতে দেখে চারিপাশে বসে থাকা নারী-পুরুষ বাদ্যযন্ত্র বাজাতে আরম্ভ করল, মেয়েরা কেউ কেউ বিপুল শব্দ করে উলু দিতে লাগল। চতুর্দিকে কেমন একটা থমথমে ভয়ের পরিবেশ!

কোভালন দেখল, বনের উপরের আকাশ মধ্যাহ্নের সূর্যের তেজে লাল হয়ে উঠেছে। মারাভারদের গ্রামের সমস্ত মানুষ দেবীর থানে এসে বসেছে। ধুনার ধোঁয়া এত প্রবল যে, সমবেত লোকগুলিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কিনাই ঢোল ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ, উলুধ্বনি, পুরোবর্তী ভয়ংকরী দেবীমূর্তি এবং জনতার কেন্দ্রে বসে থাকা বিচিত্রদর্শন অর্ধনগ্ন যুবতীর উপস্থিতি—সমস্তটা মিলিয়ে যেন আসন্ন এক মহানাটকের রোমাঞ্চকর অঙ্ক অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। সম্মুখের দৃশ্যাবলী যেন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তব নয়, আবার নিতান্ত কল্পনার ফলাফল রূপেও একে চিহ্নিত করা চলে না।

উখিয়াথং নীচু গলায় কাভুন্দি-কোভালন-কন্নকীকে বলল, ‘ইমেয়্যাটার নাম শালিনী। এইনার-বংশের বিটিছেলা। উয়ার ভর হইঞ্চে। অ্যাকন উয়ার ভিতরখে মা আইয়াই কতা কইবে !’

মাথা দোলাতে দোলাতে মেয়েটি একসময় হঠাৎ কাঠের মতন নিঃস্পন্দ হয়ে গেল । চক্ষুদুটি স্থির, জবাফুলের মতন রক্তলাল। সঙ্গে সঙ্গে লোকেদের চিৎকার, হইচই, বাদ্যযন্ত্রের আস্ফোট, উলুধ্বনি সমস্ত এক লহমায় থেমে গেল। স্থানটি এখন একেবারে নিঃস্তব্ধ।

সেই স্তব্ধতার ভিতর সহসা শালিনীর কণ্ঠস্বর উচ্চগ্রামে বেজে উঠল। পুনরায় মাথা দোলাতে দোলাতে ভরগ্রস্তা শালিনী চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ‘নাগর হইচিস, হ্যাঁ? সব মাদুরাইয়ের লোকেদের সঙ্গে মিশে মিশে ভদ্দ হইচিস? রক্তের ত্যাজ কমে গ্যাচে তুদের ? অ্যাকন শিকার ভাল লাগে না? ডাকাইতি ভাল লাগে না? শত্তুরের গোয়ালে গোরু বাড়ছে, শত্তুরের ঘরে ছাগল বাড়ছে। আর তুরা ইদিকে নিকম্মার ঢেঁকি হয়ে বইসে আচিস? তাড়ি খেয়ে মাতাল হয়ে্যঁ ঘুমায়ে আচিস? মানরম ফাঁকা পড়ে থাকে। মানরমে ধুলা গড়ায়, ছিঁড়া পাতা গড়ায়। মুকে খাবার নাই। গায়ে কাপড় নাই। ছ্যাঃ! থুঃ ! তুদের হাতে ধনুক নাই, তির নাই? ছেল্যামেয়্যাঁ ভুকের জ্বালায় বাঁচতে লারচে। মোকে পূজা না দিলে তুরা কিচুই কোত্তে লারবি। মোকে পূজা দে। আমি রক্ত খাব! মাংস খাব!’ এই বলে সে এক ভয়ংকর হুংকার সহকারে লম্ফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের লোকজন আবার শিঙা, ঢাক, ঢোল, জগঝম্প, শাঁখ বাজাতে আরম্ভ করল, উলু দিতে লাগল।

সেই সব তুমুল হট্টগোলের ভিতর শালিনী টলতে টলতে হাঁটতে লাগল। কোভালনারা যেখানে বসে আছে, সেইদিকে পা ঘসটাতে ঘসটাতে এগিয়ে আসতে লাগল শালিনী । তার চোখে যেন আগুনঝরা দৃষ্টি। মুখ থেকে অবিরত লালারস ঝরছে। আরক্তভীষণ চক্ষু অক্ষিকোটরের ভিতর ভাটার মতো ঘুরছে। ভয়ে কোভালনের পিঠের মধ্যে মুখ লুকোনোর চেষ্টা করছিল কন্নকী ।

কিন্তু তার সে-চেষ্টা সফল হল না। কন্নকীর সামনে এসে দাঁড়িয়ে শালিনী চিলচিৎকার দিয়ে বলে উঠল, ‘ই যে মেয়্যাঁটা ইখ্যানে এসেচে, ই কঙ্গুনাড়ু থিকে এসেচে। ই মেয়্যাঁ যে-সে মেয়্যাঁ লয়, ইরানি-কুড়ামালাই তামিল দেশের রানি। ইয়ারে তুরা দেকে রাক । ই মেয়্যাঁ অনেক সোহাগ দিয়েচে, নিজের পুরুষের অনেক সোহাগ লিয়েচে, দেহের তাপ অনেক জুড়াইচে। ই মেয়্যাঁ অনেক মাথাকাটা তপিস্যে করেচে; ই বিটি তিরম্মামণি— রত্ন মেয়্যাঁ; কালে কালে বহু লোকের পজা পাবে রে ই মেয়্যাঁ, বহু লোকের পূজা পাবে!’

কথাগুলো বলতে বলতেই হঠাৎ উন্মাদিনীর মতো নাচতে আরম্ভ করল শালিনী। সে যে কী ভীষণ নৃত্য ! যেন তার ভীম চরণনিক্ষেপে থরথর করে কাঁপতে লাগল মানরমের মাটি। তার করচরণের মুদ্রায়, নৃত্যবিভঙ্গে যেন সে প্রচণ্ড ঝড়কে ডেকে আনতে লাগল চারিদিক থেকে। ঘূর্ণিত চক্ষের সমুষ্ণ কটাক্ষে যেন আগুন হয়ে জ্বলে উঠল বনের বাতাস।

তার ভীষণ শ্বাস নেওয়ার শব্দে আকুল হতে লাগল বনস্পতি, ধুলা, মাটি, পাথর । এইভাবে নাচতে নাচতে নাচতে হঠাৎ সশব্দে হুংকারধ্বনি তুলে মাটির উপর কর্তিত বৃক্ষের মতন সহসা আছড়ে পড়ে জ্ঞান হারাল শালিনী।

অমনি চারপাশ থেকে বাদ্যযন্ত্র সহকারে লোকগুলো গান গেয়ে উঠল :

“তুর চরণ পূজি, মা রে !

দেব মুনি দুখ ভুল্যে স্মরণ করে যারে।

মাথা কাটি রক্ত দিয়্যাঁ ধুয়াবো তুর পায়,

বীরের লোহু বনের মাটি পুণ্যি হয়ে যায়।

তুর চরণ পূজি, মা রে !

দেব মুনি দুঃখ ভুল্যে স্মরণ করে যারে !’

নীলমণি দেবীরতন লালমণি পা,

মোদের রক্তে তিষনা মিটুক, ও কুমারী মা।

হাড় দিলম, মাস দিলম, তিরিপ্ত হয়ে যাও

মোদের পানে নয়ন তুলে্যঁ বাঁকা চোকে চাও ।

পুণ্যি হব ধন্যি হব চাউনিতে তুর মা রে !

দেব মুনি দুঃখ ভুল্যে স্মরণ করে যারে !

বাঘের মতো রুদ্ররূপী মোরা তো তুর ছেল্যে।

শত্রু জিনি আনব টেইন্যে বিপদ অবহেলে।

ও চরণ ছুঁয়ে যুদ্ধে যাব ভীষণ বাদ্যরোলে

শিঙার রবে ফাঁড়ব আকাশ, আনব তারা খুল্যে,

ও মা ! পরিয়ে দিব আদর করে তুমার মাথার চুলে।

ছিন্ন করি আনব অরি তীক্ষ্ণ অসির ধারে।

দেব মুনি দুঃখ ভুলে স্মরণ করে যারে,

ও তুর চরণ পূজি, মা রে ! ”

গাইতে গাইতে নাচতে নাচতে মানুষগুলি আইয়াই দেবীর সামনে এসে গোল হয়ে দাঁড়াল। তির দিয়ে নিজেদের বক্ষস্থল চিরে রক্ত বের করতে লাগল তারা। তারপর সেই রক্ত দেবীর চরণে নিবেদন করল একে একে। নীল মেঘবর্ণ দেবীর চরণপদ্ম রক্তে রাঙা হয়ে ভেসে যেতে লাগল । যেন নীল জলে ফুটে উঠল অগণিত আরক্তকুসুম।

একজন বৃদ্ধ মারাভার, সম্ভবত এদের পুরোহিত, যষ্টির উপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

তাঁর সঙ্গে গলা মিলিয়ে অন্যরা বলতে লাগল সমস্বরিত উচ্চারণে :

“তুই-ই শান্তি, মা, তুই-ই মোদের নিয়তি।

নীলমণি মা গো, শঙ্করী, অন্তরী গো!

তোর কালো চুলে সাপের লাল চোখ আর বনের নীল জোসনা।

মোদের পূজা লে মা !

         

মোদের তির-ধনুতে ধার হোক, মোদের গাঁয়ে বেবাক লোক,

         

মোরা বীরের মতো যুদ্ধ করে মরি ।

দেবতারা অমৃত খেয়ে মরে। আর তুই বিষ খেয়ে অমর হইচিস। তুর মরণ লাই ।

মোদের বুকের রক্ত খেয়ে লে, মা ।

আমাদের জয় দে মা, মরণছ্যাঁচা জয় ।

মোদের তির-ধনুতে ধার হোক, মোদের গাঁয়ে বেবাক লোক,

মোরা বীরের মতো যুদ্ধ করে মরি ।

নীলমণি মা গো তুই শকটকে নাখি মেরে শেষ করিচিস,

তরুরূপী নলকুবেরকে মুক্তি দিচিস,

কংসকে তুই নিধন করিচিস মা,

মোদের রক্তে ধুয়া পূজা লে! মোদের শক্তি দে, মা!

মোরা যেথা যাব, সেথা যেন ঝড় উঠে, যেন হাহাকার পড়ে যায় সেথা।

মোদের তির-ধনুতে ধার হোক, মোদের গাঁয়ে বেবাক লোক,

মোরা যেন বীরের মতো যুদ্ধ করে মরি!”

সেই অদ্ভুত প্রার্থনার মধ্যে উখিয়াথং উঠে দাঁড়াল কৃতাঞ্জলিপুটে। কাভুন্দিকোভালন-কন্নকীও স্থির হয়ে বসে থাকতে পারল না আর। যেন নিয়তিতাড়িত হয়ে উঠে দাঁড়াল ওরাও। এক নীলা ভয়ংকরীর আকর্ষণে আনতশির তিনজন পথিক বীরের প্রার্থনায় যোগ দিল মুগ্ধবৎ।

(উনচল্লিশ) আশাঙ্কুর

সেদিন রাত্রে মারাভারদের গ্রামে উখিয়াথঙের পর্ণকুটিরে ওদের আশ্রয় মিলল। রাত্রি যখন এক প্রহর অতীত হল, পরবের ঢাক-ঢোলের আওয়াজ আর শিঙার রব কিছুটা স্তিমিত হয়ে এল, তখন বিনীতভাবে কাভুন্দিকে বলল কোভালন, ‘মা! দিনের বেলা রোদের তাপ বড়ো প্রখর আর এ ভূমিও বেশ পাথর-কাঁকরে ভরা। কন্নকীর পা দুটো ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে, ভালো করে চলতেও পারছে না রোদের ভিতর তপ্ত মাটিতে পা ফেলে। তাই বলছিলাম, যদি আজ রাত থাকতে থাকতে বেরিয়ে পড়ি, তবে এই চাঁদের আলোয় অনেকটা পথ চলে যেতে পারি ভোরের আগে।’

কাভুন্দি বললেন, “তা কী করে হবে, বাবা? বনপথ জন্তুজানোয়ারে সমাকুল, তারপর দেখলেই তো মারাভাররা তির-কাঁড় নিয়ে পথ আটকাল। এমন যদি আরও হয়, তাহলে তো প্রাণসংশয় অনিবার্য!”

উখিয়াথং এতক্ষণ একপাশে বসে ওদের কথা শুনছিল। এখন সে বলে উঠল, ‘সি তুই ভাবিস নাই, মা ! তুরা যুদি যেতে চাস, আমি মারাভারদের বলে দিব, তারা তুদের উপর চড়াও হব্যে নাই। উলটে বনের ভিতর ঝোপেঝাড়ে লুক্যে থাকবে, লজর রাকবে যাতে জন্তুজানোয়ার কুনো খেতি না করে তুদের। কতাটা ঠাকুর ভালই বল্যেঞ্চে, দিনের বেলা রোদের ভাপে যাস যুদি, কষ্ট হব্যে খুব ।’

অতএব, রাত্রির তৃতীয় প্রহরের একটু আগে মারাভারদের গ্রাম ছাড়ল ওরা। আজ রাতে আকাশে থালার মতো চাঁদ। সেই চাঁদের আলো বনস্পতির পত্রান্তরাল ভেদ করে মাটির উপর এসে পড়েছে এখানে-ওখানে। রাত্রির অন্ধকারের সঙ্গে মিশে আছে বনজ আঘ্রাণ। কাভুন্দি, কন্নকী ও কোভালন বনজ্যোৎস্নার ভিতর পথ চিনে চিনে এগিয়ে চলেছিল।কন্নকী কোভালনের কাঁধের উপর ভর দিয়ে কোনোমতে হাঁটছে। কেমন ঘুমঘুম মায়াময় পরিবেশ। মাঝে মাঝে বনের গাছপালা এলোমেলো করে দিয়ে গায়ে এসে লাগছে রাত্রির সান্দ্র বাতাস।

যেন ঘুমিয়ে পড়ার আগে পৃথিবী কন্নকীর দিকে তন্দ্রাতুর দৃষ্টি মেলে বলে যাচ্ছেন, ‘কতদিন মেয়ে তোর সুবিপুল স্তনকলস পীড়িত হয়নি রত্নহারে, কতদিন চন্দনের প্রলেপে শীতল হয়নি তোর কুচযুগ! কতদিন ফুলরেণু দিয়ে সাজাসনি তোর বেণীবন্ধ, ও কমনীয় তনুলতা সাজাসনি ফুলহারে তুই, সুচারুহাসিনি, কতদিন! এই যে বাতাস ভেসে আসছে বনপথে, এর জন্ম মলয় পর্বতে, মাদুরাই নগরীর কবিদের করুণ কবিতার সুরে এ বাতাস আজ আতুর, এখন এই ছন্নছাড়া বাতাস তোকে আদর করবে কতক্ষণ, স্তনগলিপথে বয়ে গিয়ে মুছিয়ে দেবে স্বেদবিন্দু, বনগগনের চাঁদ তোর উপর ঢেলে দেবে তার অমৃতসুধা…’

কে এসব কথা তন্দ্রাচ্ছন্ন পৃথিবী বলছিলেন, নাকি কন্নকীই মনে মনে ভাবছিল এসব জানে! তবু মেয়েটির মনে হচ্ছিল, আদরিণী ধরিত্রী জননীই যেন বলে চলেছেন তাকে এসব কথা। বাইরে কি কেউ কথা বলে? নাকি মানুষের মনই বাইরেকে কথা বলায় ?

কোভালন প্রমোদছলে বলল কন্নকীকে, ‘এ পথে কিন্তু কখনও বাঘ ডেকে উঠবে, কখনও চিতাবাঘ পথ পেরিয়ে যাবে আমাদের সামনে দিয়ে, পেঁচা ডেকে উঠবে হঠাৎ, ঘুৎকার শোনা যাবে ভল্লুকের, দূর থেকে শোনা যাবে বজ্রধ্বনি…’ ,

আরও কীসব বলতে যাচ্ছিল কোভালন। কিন্তু কাভুন্দি তাকে নিষেধ করে বললেন, ‘ওসব বলে তুমি ওকে ভয় দেখিও না, বাছা! ও এমনিতেই ভয়ে ভয়ে এতটুকু হয়ে আছে। খুবই দৃঢ়চিত্তের মেয়েটি আমার, কিন্তু এমন বিপদসংকুল পথ দিয়ে কখনও তো হাঁটেনি। তার থেকে গল্প বলি, শোনো !’

কাভুন্দি গল্প বলতে লাগলেন। সেসব গল্প শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক হয়ে অন্য একটা কথা ভাবছিল কোভালন। একদিন ভয় ছিল তারও নানা বিষয়ে। এখন সেসব ভীতি চলে যাচ্ছে। আজই দুপুরে মারাভারদের মানরমে যে ভয়ংকরী দেবীমূর্তি সে দেখেছে শালিনীর মধ্যে, ওই ভয়ানক রূপের ভিতরেই সব ভয়ের মৃত্যু। বস্তু নয়, ভাব নয়, মৃত্যুর ওই রূপই সত্য। ওই মৃত্যুরূপা জননী সবই খাচ্ছেন। শুধু মারাভারদের বুকের রক্তই নয়, সুখ-দুঃখ, আশা-হতাশা, সাফল্য-বিপর্যয়, বস্তু-ভাব-সমস্তই মুহুর্মুহু চর্বণ করে গ্রাস করে নিচ্ছেন। তিনি তথাকথিত বাস্তবও নন কিংবা কারও ইচ্ছে-মাফিক কল্পনাও নন—তিনি এ দুয়েরই অতীত এক ধারণাতীত বিভাবরী। পথ শেষ হয়ে যায়, আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে আসে, জীবন বলি দিতে হয় তাঁরই পাদপীঠে। এ জীবনযাত্রাপথে কেবল তাঁরই চরণমঞ্জীরের মূর্ছনা। যে সেই মূর্ছনা শুনতে পায়, সে ধন্য হয়ে যায় ।

পথ চলতে চলতে রাত শেষ হয়ে এল, বেণুবনের আড়াল থেকে শেষ রাতের পেঁচা উড়ে গেল ভোরের কুয়াশায়। দিনের প্রথম আলো এসে ছুঁলো বনশীর্ষদেশ। বনও ফুরিয়ে এল হঠাৎ, একটা গ্রাম এসে পড়ল। কাভুন্দি বললেন, ‘এ একদল অম্বনভর ব্রাহ্মণের গাঁ। এরা বেদপাঠ করে না, গানবাজনার চর্চা করে। তাই সমাজে ব্রাত্য হয়ে পড়েছে।’

গ্রামপ্রবেশে এক গাছের তলায় কন্নকী ও কাভুন্দিকে বিশ্রাম করতে বলে কোভালন বেরোল আশ্রয় ও আহার্যের সন্ধানে। গ্রামের ভিতর দিয়ে শীর্ণ মাটির পথ, পথের দুপাশে খোড়ো ঘর কতগুলো, এখনও কুয়াশা থমকে আছে সেসব ঘরের খোড়ো চালের উপর । কতিপয় গৃহাবাসের রন্ধনশালা হতে সবেমাত্র ধূম উদ্‌গীরিত হচ্ছে, কোথাও গোরুর বাথান থেকে হাম্বারব ভেসে আছে, কোনো কোনো গৃহপ্রাঙ্গণ হতে জেগে উঠছে প্রভাতী সঙ্গীতের আলাপ, তত্যন্ত্রের সুর কিংবা আনদ্ধের বোল। কাভুন্দির কথাটা মনে পড়ল কোভালনের, এ গ্রাম সঙ্গীতসেবী ব্রাহ্মণদের গ্রাম; বেদপাঠ না করে সুরসাধনা করায় এদের জাত গিয়েছে।*

এত সকালে ভিক্ষা বা আশ্রয় চাওয়া সমীচীন নয়, কোভালন ভাবল। সবেমাত্র গৃহস্থের ঘুম ভাঙছে। এখনই কিছু চেয়ে বসলে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক। পর্যাপ্ত জল কাভুন্দি ও কন্নকীর কাছে আছে, আরও কিছুক্ষণ ওরা না হয় গাছতলাতেই থাকুক। প্রভাতের প্রথম প্রহর বিগত হলে কোনো সম্পন্ন গৃহস্থবাড়িতে আশ্রয় যাচ্ঞা করা যাবে, এই কথা ভেবে গ্রামের একপাশে একটি ঝোপের ছায়ায় কোভালন বসে বসে রোদ উঠবার অপেক্ষা করতে লাগল ।

এই দীর্ঘ, ক্লান্তিকর পদযাত্রার কথা মনে আসছিল তার বারবার। এ পথ তাকে বাস্তবতা চিনিয়েছে। আজন্ম ধনীর ঘরে মানুষ হয়েছে সে, বাস্তব জীবন কী কঠিন, এতদিন জানত না। তবু পথের এই ক্লেশকর অভিজ্ঞতা এবার শেষ হওয়া দরকার, ক্রমশই পথক্লেশ দুর্বহ হয়ে উঠছে।

এইভাবে বসে থাকতে থাকতে কোভালন দেখল, কে একজন পথিক তারই মতন এদিকে সেদিকে তাকাতে তাকাতে এই ঝোপের দিকে এল। লোকটির পরনে বাসন্তী রঙের বসন ও কণ্ঠদেশে শ্বেত উত্তরীয়। লোকটি ব্রাহ্মণ; বক্ষ উন্মুক্ত থাকাতে উপবীত দৃষ্টিগোচর হচ্ছে।

আগন্তুক ব্রাহ্মণ ঝোপের ধারেই আরেকপাশে বসল। কোভালনের দিকে চেয়ে বলল, ‘মহাশয় কি এ গ্রামেরই লোক নাকি?’

কোভালন উত্তর দিল, ‘না। আমি একজন পথচারী। আপাতত এ গ্রামে এসে পড়েছি। আশ্রয় খুঁজছি। জানি না, এ গ্রাম সুভিক্ষ কি না ! আপনার কি নিকটবর্তী কোনো গ্রামে অধিবাস ?’

আগন্তুক ব্রাহ্মণ মাথা নেড়ে বলল, ‘না-না । আমিও পথিক মাত্রই। কাল রাতে এখানে আশ্রয় পেয়েছি।’

কোভালন প্রশ্ন করল, “তা মহাশয়, মাদুরাই এখান থেকে আর কতদূরে বলতে পারেন ? ” প্রশ্ন শুনে লোকটি কেমন একটা যেন সন্দেহাকুল দৃষ্টিতে একবার কোভালনকে দেখল তারপর উত্তর দিল, ‘মাদুরাই যাচ্ছেন নাকি আপনি?’

কোভালন বলল, ‘হ্যাঁ, তেমনই তো ইচ্ছা ছিল। কিন্তু জানি না, এখনও কতদূর হাঁটতে হবে।’

আগন্তুক হেসে বলল, ‘বেশি দূর নয়। মাদুরাই এসে পড়েছে। বাতাসে কি মাদুরাইয়ের ঘ্রাণ পাচ্ছেন না, মহাশয় ?’

‘মাদুরাইয়ের ঘ্রাণ?’ কোভালন অবাক হল আগন্তুকের কথায়।

‘হ্যাঁ তো! এই যে একটা মিশ্রিত আঘ্রাণ পাচ্ছেন না হাওয়ায়? এই যে সুখস্পর্শ দক্ষিণী বাতাসের মধ্যে কেমন যেন একটা কুঙ্কুম, চন্দন, কস্তুরী আর রাত্রিচর গন্ধগোকুলের গাত্রঘ্রাণ মিশে আছে ! পাচ্ছেন না? আবার জোরে হাওয়া দিলে তাতে কেমন কুমুদিনী, চম্পক, মল্লিকা, মুল্লাই ফুলের বিমিশ্র ঘ্রাণ! আবার শুঁকে দেখুন, কেমন একটা ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধও পাবেন। এর মধ্যে মাদুরাই নগরের গেরস্থবাড়ির পাকশালার ধোঁয়া তো আছেই, তারই সঙ্গে কেমন বিপণির হালুইকরের কটাহ থেকে ওঠা ধোঁয়া, ব্রাহ্মণদের যজ্ঞশালার ধোঁয়া সবই মিশে আছে। আবার দেখুন, হাওয়ার মধ্যে পাণ্ড্যরাজার বক্ষশোভা ফুলমালার গন্ধও মিশে আছে বেশ। তাই তো বলছি, মশাই, মাদুরাই আর বেশি দূরে নেই, হবে প্রায় ক্রোশখানেক!’

লোকটির কথা শুনতে শুনতে তার দিকে অপাঙ্গ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কোভাল মনে মনে বলছিল, বাব্বা ! এ যে দেখি গন্ধসর্বস্ব গন্ধবণিক এক এসে হাজির হয়েছে! মুখে বলল, ‘তা মহাশয়ের নামটি কী ?’

লোকটি বলল, ‘আমার নাম? আমার নাম কৌশিকন,’এই বলেই সে অদূরে একটা মাধবীলতার ঝাড়ের দিকে উদাস নেত্রে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ সেই দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আপনমনে বিড়বিড় করে লোকটি বলতে লাগল, ‘ও মাধবীলতা! তোমার ফুলগুলি সব গেছে ঝরে, রোদের তাপে শুকিয়ে গেলে তুমি ! তোমার মতোই কোভালনের বিরহসন্তাপে শুকিয়ে গেল আয়তলোচনা আরেক মাধবী! তা মাধবী নামটাই বুঝি এমন—যার ওই নাম হয়, বিচ্ছেদে সে শুকিয়ে মরে—এমনই নিয়তি!’

লোকটার মুখে মাধবীর আর নিজের নাম শুনে সাংঘাতিকভাবে চমকে উঠল কোভালন । অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, ‘আশ্চর্য! আপনি কী করে আমার নাম জানলেন? সঙ্গে সঙ্গে উৎফুল্ল মুখে ফিরে তাকাল কৌশিকন। সাগ্রহে বলল, ‘আপনিই কি তবে পুষ্পহার-নিবাসী বণিক মাশাত্ত্ববানতনয় কোভালন ? মাদুরাই চলেছেন ? কোভালন বলল, ‘হ্যাঁ, তা ঠিক। কিন্তু আপনি কীভাবে আমার…. ?’

উজ্জ্বল মুখে কোভালনের হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল কৌশিকন, ‘অহহ! মশাই, আমি আপনাকে যে কীভাবে আজ এক মাস ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছি… ! মাদুরাই যাচ্ছেন শুনে তখন আমার ঠিকই সন্দেহ হয়েছিল…’ এই পর্যন্ত বলেই শঙ্কাকুল চিত্তে এদিক-ওদিক তাকিয়ে সে বলে উঠল, ‘কিন্তু আপনার তো সস্ত্রীক যাওয়ার কথা ! আপনার স্ত্রী কোথায় গেলেন?’

কোভালন উত্তর দিল, ‘তিনি আছেন কাছে-পিঠেই। কিন্তু আপনি কীভাবে…. ?’

‘আরে মশাই, আপনার পরিচারকদের মুখে শুনলাম, সস্ত্রীক তীর্থে বেরিয়েছেন। কবে ফিরবেন, তার ঠিক নেই। তো দূরের তীর্থ বলতে এখানে মাদুরাই। সেকথা মাধবীকে জানাতে…’

‘মাধবী? তার সঙ্গে আপনি কী… ?’

‘আরে, মাধবীই তো আমাকে একাজে নিয়োগ করল। বলল, তার একখানা পত্র আপনার হাতে পৌঁছে দিতে হবে। আমি কত জায়গায় গেলাম। কোন পথ দিয়ে গেছেন, কী করে জানব ? মাদুরাইতে গেছেন, তারই-বা নিশ্চয়তা কী? শেষে খুঁজে না পেয়ে ধরে নিয়েছিলাম, আমার অনুমান ভুল ছিল। মাদুরাই নয়, আপনি অন্য কোথাও গেছেন হয়তো-বা । শেষে বিফল মনোরথ হয়ে পুষ্পহার ফিরে যাব, ভাবছিলাম। এমন সময় এভাবে যে…’

উৎসাহভরে কৌশিকন আরও কীসব বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার সেই অনর্গল বাক্যস্রোত থামিয়ে কোভালন বলল, ‘মাধবী আপনার হাতে পত্র দিয়েছে?’

আবার কৌশিকনের বাক্যপ্রবাহ কাবেরীর ফেনায়িত স্রোতোধারার মতো বইতে শুরু করল, “মাধবীর যে কী দশা হয়েছে মশাই, চোখে না দেখলে বুঝতে পারবেন না। পুষ্পহার ছেড়ে চলে যাওয়ার সংবাদ পেয়ে মাধবী তো স্তম্ভিত। রংজ্বলা পুতুলের মতো হয়ে গেছে সুন্দরী মেয়েটা। বারবার জ্ঞান হারিয়ে শয্যায় পড়ে থাকে। বিশুষ্ক ব্রততীর মতো হয়ে গিয়েছে, মাধবী। আমি তাকে সান্ত্বনা দিতেই গিয়েছিলাম। মাধবীর মা ইন্দুমুখীর আমল থেকেই ও গৃহে আমার যাতায়াত ছিল। মাধবীকে আমি এইটুকুনই দেখেছি। তো মাধবী আমাকে বলল, ‘বিপ্র, আমি আপনার চরণের দাসী। আপনি দয়া করে কোভালনকে খুঁজে বের করে ফিরিয়ে আনুন। সে যে আমার চোখের মণি ! তাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। আর যদি তাকে ফিরিয়ে আনতে নাও পারেন, তাহলে অন্তত আমার এই পত্রটি তার হাতে পৌঁছে দিন!’

‘ও বাড়িতে আরও একটা বড়ো দুর্ঘটনা ঘটেছে কি না…’

আবার তাকে থামিয়ে কোভালন বলল, ‘কই, কী পত্র দিয়েছে মাধবী? দেখি !’

কটিদেশে গ্রন্থিত একটি তালীপত্র মুক্ত করে এনে কোভালনের হাতে দিয়ে বলল কৌশিকন, ‘এই যে…এই… এইটি….’

তালীপত্রটি গালা দিয়ে বন্ধ করা। পত্রটি হাতে নিয়ে একটা বিষণ্নমেদুর ঘ্রাণ পেল কোভালন। বড়ো পরিচিত ঘ্রাণ। মাধবী তার কেশপাশে বিশেষ এক ফুলের নির্যাস মাখত । এ পত্রে মাধবীর চুলের সেই গন্ধ…

এক লহমায় কত কথা যে মনে পড়ে গেল কোভালনের। কিন্তু এ মুহূর্তে সেসব ভাবনা মনের মধ্যেই তালাবন্ধ রেখে পত্রটির মুখ খুলল সে। দীর্ঘ পত্র। বনঝোপের বড়ো বড়ো ঘাসের ছায়ায় হস্তধৃত তালীপত্রটি নিয়ে গিয়ে নিঃশব্দে পড়তে লাগল ….

‘প্রিয়তম কোভালন,

আমার কোন কথায় আঘাত পেয়ে তুমি পুষ্পহার ছেড়ে তোমার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেছ, জানি না। তোমাকে অজান্তে দুঃখ দিয়েছি, তাই নিশ্চয়ই এত কষ্ট পাচ্ছি আমি। কিন্তু একবার বিশ্বাস করো, কোভালন, আমি বিশ্বাসঘাতিনী নই। তুমি ছাড়া আজও অবধি অন্য কোনো পুরুষকে আমি জানি না। সেদিন সমুদ্রতীরে যেকথা তোমাকে

বলতে চেয়েছিলাম, বলতে পারলাম না… আমার মনোবেদনা আমার সহচরী হতভাগিনী বসন্তমালাকে নিয়েই… অন্য কিছু নয়… বসন্তমালা আধান নামে এক যুবককে ভালোবাসত । ওরা বিয়ে করবে, ঠিক ছিল। এরই মধ্যে রাজা কারিক্কালের সভাসদ যশস্করণ বসন্তমালাকে রক্ষিতা করে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। এই সংবাদ শুনে আধান পালিয়ে যায়। তার কোনো খোঁজ পাচ্ছিলাম না বলেই তোমার পরিচিত সূত্র ধরে আধানের অনুসন্ধান করতে চেয়েছিলাম আমি । এসব কথা পূর্বপত্রে লিখতে পারিনি… অবলা বসন্তমালার হাত থেকে পত্র রাজপ্রহরীরা ছিনিয়ে নিতে পারে, এই ভয়ে। ভেবেছিলাম, তুমি আমার গৃহে এলে সমস্ত কথা খুলে বলব। কিন্তু তা আর হল না আমার ভাগ্যে ।

বসন্তমালাও আমাকে চিরতরে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে, কোভালন। আমাকে নিরুপায় দেখে, কোথাও বেঁচে থাকার, কোথাও নিষ্কৃতির কোনো উন্মুক্ত দ্বার না দেখতে পেয়ে, বসন্তমালা গত পূর্ণিমায় কাবেরীতে ডুবে নিজের হতভাগ্য জীবনে ছেদ টেনে দিয়েছে। তার আত্মহননের মনোভার নিয়ে মৃতবৎ পড়ে আছি আমি ।

তুমি কি আর ফিরতে পারো না, কোভালন? আমার যদি কিছু ভুল হয়ে থাকে, একবার দিতে পারো না সংশোধনের সুযোগ ? আমি তো শুধু তোমার প্রণয়িনীই ছিলাম না, তোমার বান্ধবী, তোমার স্নেহার্থিনীও ছিলাম। আমার মাত্র উনিশ বছর বয়স। চপলতা করে কী বলেছি, ক্ষমা করতে পারো না, কোভালন? একবার, শুধু একবার ?

এরই সঙ্গে আরও একটি সংবাদ তোমাকে দিতে চাই। বিশ্বাস করো, এতে আমার কোনো গূঢ় অভিসন্ধি নেই। পত্রবাহক ব্রাহ্মণ কৌশিকন আমার মায়ের আমলের বিশ্বস্ত লোক, তাই একথা পত্রে লিখে তাঁর হাতে দিতে পারছি। জানি না, এই কথা শুনে তুমি রুষ্ট হবে না আনন্দ পাবে…

আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি। বৈদ্য আমার চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন। তিনি পরীক্ষা করে বললেন, আমি সন্তানসম্ভবা…..

এই সন্তানের দায় আমি নিজেই নেব, কোভালন। তোমার-আমার এই সন্তানকে আমি মনের মতো করে মানুষ করব। দয়া করে ভেবো না, তোমাকে এর জন্যে ফিরে আসতে বলছি। তুমি শুধু এমনিই ফিরে এসো এই নগরীতে। সুখে সংসার করো কনকীকে নিয়ে। পথে পথে ঘুরে বেড়িও না, কোভালন, আমার কথায় আঘাত পেয়ে। আমার সঙ্গে যদি আর কোনো সম্পর্ক নাও রাখতে চাও, তাও আমি মেনে নেব। শুধু এই নগরীতে তুমি ফিরে এলে আমি মনকে বোঝাতে পারব, তুমি কাছেই আছ। আমার জন্য নিজেকে নষ্ট করোনি। আমি শুধু এইটুকুই চাই। আর কিছু না, আর কিচ্ছু না। ফিরে এসো, কোভালন, ফিরে এসো। একদিন যাকে ভালোবেসেছিলে, সেই মাধবীকে আজ একটু দয়া করো।

ইতি,

       অভাগিনী মাধবী।

 

পত্রটি পাঠ করতে করতে কখন যে দু-চোখের সীমান্ত ভেঙে জল নেমেছিল, টের পায়নি কোভালন ৷ কী এই এক জীবন মানুষের ! কোনো সুষ্ঠু অর্থ নেই, কোনো তাৎপর্য নেই, কোনো চরিতার্থতা নেই। বুকের মধ্যে শোকাশ্রুকে পাথর করে জমিয়ে আমৃত্যু এই কঙ্করময় উপত্যকা ধরে উপলবিক্ষত চরণে হেঁটে চলা। কেবল ভুল করা, ভুল বোঝা, শুধু এক ভুল থেকে আরেক ভুলের দিকে অন্ধের মতন পথহাঁটা। বসন্তমালার এই তথ্যটি যদি কোভালন সেদিন সমুদ্রতীরে জানতে পারত…. ! তাহলে এই নিদারুণ পরিণতি হত না কারওই।

শুধু মনগড়া কতকগুলো ভুলের মালা গেঁথে গলায় পরেছে সে সারা জীবন। শোধরানোর সুযোগ নেই। সব অসংশোধনীয় ভুল।

কৌশিকনের কাছ থেকে লিখন সামগ্রী চাইল কোভালন । সেই ঝোপের কাছে বসতে বলে কোথায় যেন কিছুক্ষণ চলে গেল কৌশিকন। তারপর তালীপত্র, মস্যাধার আর লেখনী এনে দিল।

কোভালন বলল, ‘আমি আপনার হাতে কিন্তু দুটি পত্র দেবো। প্রথমটি আপনি পুষ্পহার নিবাসিনী দেবান্দীকে দেবেন। তিনি প্রত্যহ শাস্তার মন্দিরে যান। সেখানেই তাঁকে পাবেন । আর দ্বিতীয় পত্রটি আপনি মাধবীর হাতে দেবেন।’

অবাক হয়ে ভাবছিল কোভালন, বীরমণি তবে এই পত্রবাহক কৌশিকনের আগমনের কথাই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। অদ্ভুত সব মানুষ! কে জানে কোন অতীন্দ্রিয় শক্তির অধিকারী এঁরা !

বীরমণি যেমন বলে দিয়েছিলেন, সেসব কথাই আনুপূর্বিক লিখল কোভালন প্রথম পত্রটিতে দেবান্দীর উদ্দেশে। লিখল, বীরমণি ভালো আছেন। আগামী আষাঢ়ী পূর্ণিমার রাত্রে দেবান্দী যেন কাবেরীঘাটে আসেন। সেখান থেকেই বীরমণি তাঁকে নিয়ে আসবেন । কাল পূর্ণ হয়ে এসেছে।

প্রথম পত্র লেখা শেষ করে দ্বিতীয় পত্র লিখতে আরম্ভ করল কোভালন ৷ বহু যন্ত্রণায় নিজের ক্ষতবিক্ষত হৃদয়াবেগকে অবরুদ্ধ করে সে কোনোমতে লিখতে পারল:

‘মাধবী সুচরিতাসু,

আনন্দ আর বেদনা একই সঙ্গে মানুষের হৃদয়ে উপস্থিত হলে কীভাবে মানুষ নিজেকে প্রকাশ করে, আমি জানি না। একটি শিশুর আবির্ভাব আর বসন্তমালার এই করুণ পরিণতি! তুমি যদি একবার আমাকে বসন্তমালার বিপন্নতার কথাটা বলতে পারতে, তাহলে বসন্তকে এই নিদারুণ আত্মহননের পথ বেছে নিতে হত না। জানি, সে-সুযোগটুকু আমিই তোমাকে দিইনি। দোষ তোমার নয়, তুমি সাগরতলের মুক্তার মতন অকলঙ্ক, নির্মল। দোষ এই কোভালনের, যে কেবল কল্পনা আর সন্দেহের বশীভূত হয়ে জীবনে ভুলের পরে ভুল করে গেছে।

তবে তোমার কোনো কথায় ব্যথা পেয়ে যে আমি পুষ্পহার ত্যাগ করেছি, তা কিন্তু নয়। আমার পৈতৃক ব্যবসা নষ্ট হয়ে গেছে, মাধবী। তাও আমারই অমিতব্যয়িতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্যেই। আমি প্রায় নিঃস্ব এখন। তাই আমি সস্ত্রীক মাদুরাই যাচ্ছি, সেখানে যদি ভাগ্য ফেরে। এ মুহূর্তে আমি মাদুরাই নগরীর দ্বারপ্রান্তে। জানি না, সেখানে কী অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্যে ।

তোমার গর্ভে আমার সন্তান এসেছে, এত দুঃখের কুয়াশার মধ্যেও এ সংবাদ আমার বুকের মধ্যে আজ একখণ্ড দীপ্ত মণিকার মতো আশার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। যত শীঘ্র সম্ভব আমি মাদুরাইতে জীবিকার একটা সংস্থান করে পুষ্পহারে ফিরবার প্রাণপণ চেষ্টা করব। শুধু আমার সন্তানের মুখ দেখার আশায়। বিধাতার কাছে প্রার্থনা করি, তিনি আমার এ আশা পূরণ করুন। তোমাকে আমি চিরকাল ভালোবেসেছি, মাধবী । আজও বাসি। তোমার কাছে আমি চিরঋণী। দয়ার কথা বলে আমাকে আর কষ্ট দিও না ।

দীপ্ত মণির মতন আশার আলো নিয়ে যে আসছে, সে কন্যা নাকি পুত্র, আমি জানি না। যদি আমাদের পুত্র হয়, তবে তার নাম রেখো—মণিমেঘ। আর যদি কন্যা হয়, তবে তার নাম রেখো—মণিমেখলা।

ইতি,

        তোমার ভাগ্যবিড়ম্বিত কোভালন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *