আজ জ্যোৎস্না রাতে
১।
সন্ধ্যে ছ’টা নাগাদ যযাতি যখন অফিস থেকে বেরোলেন, কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছিল। যযাতি আকাশের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে কয়েকটা গালাগাল দিয়ে বাস স্ট্যান্ডের শেডে দাঁড়ালেন। উষ্ণায়নের ফলে বিশ্বের কী হাল জানা নেই, তবে বাস স্ট্যান্ডের উত্তাপ খানিকটা বেশি। এক জোড়া তরুণ তরুণী বেশ জোরে জোরে ইংরেজিতে ঝগড়া করে চলেছে। আর কেউ নেই বাস স্ট্যান্ডে।
যযাতি তাকালেন না। সারাক্ষণ কম্পিউটারের সামনে বসে মাথা ধরে ছিল, এদের কথোপকথনে মাথা গলালে সে মাথার ভিসুভিয়াস হয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল। একটা মিনি ছেড়ে দিলেন যযাতি। ওঠা সম্ভব না। মারাত্মক ভিড়।
শহরে বাসের তুলনায় মানুষের সংখ্যা প্রতিদিন মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। মেট্রো হচ্ছে, এসি বাস হচ্ছে, ক্যাবের সংখ্যাও নেহাত কম নয়, তবু রাস্তায় একবার বেরোলে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে করে বাড়ি ফেরা এক ঝকমারি।
এই অফিস পাড়ায় বেশিরভাগ লোকের গাড়ি আছে। কেউ অফিসের গাড়িতে যায়। যযাতির অফিসের গাড়ি নেই। বেশিরভাগেরই নিজস্ব গাড়ি আছে।
যযাতি অবশ্য ঠিক করেই রেখেছেন ক্যাব নেবেন না। বাসে ফিরবেন। গাড়ি কেনার টাকা আছে, মাইনেও যথেষ্ট পান। তবু কিনবেন না ঠিক করেছেন। পরিবেশ দূষণে কোনরকমভাবে যোগদান না করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সর্বদা। অফিসেও নিতান্ত প্রয়োজন না পড়লে অকারণ প্রিন্ট আউট নেন না। কাগজ বাঁচানো দরকার।
যযাতি চুপ করে দাঁড়িয়ে ছেলে এবং মেয়েটির কথা প্রাণপণে কানে না তোলার চেষ্টা করছিলেন, এমন সময় মেয়েটি তার দিকে এগিয়ে এসে বাংলায় বলল “আংকেল আমাকে আপনার ফোনটা দেবেন একটু? আমার একটা কল করার আছে”।
যযাতি এবারে মেয়েটার দিকে তাকালেন। সতেরো আঠেরো বছর বয়স হবে। লাল রঙের একটা টপ আর জিন্স পরা। ছেলেটা অদূরে দাঁড়িয়ে বেশ ক্ষিপ্ত চোখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে।
মেয়েটাকে যযাতি বললেন “আমার কাছে তো ফোন নেই”।
মেয়েটা অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল “সিরিয়াসলি? আপনার কাছে ফোন নেই? আজকালকার যুগে কোন মানুষের কাছে ফোন থাকে না?”
যযাতি বললেন “আমার কাছে থাকে না”।
মেয়েটা নাছোড়, “প্লিজ আংকেল, আমি ভীষণ একটা সমস্যার মধ্যে আছি। আমাকে ফোনটা দিন”।
যযাতি দেখলেন ছেলেটা বেশ কিছুক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে উল্টো দিকে হাঁটা দিল। মেয়েটা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল “স্কাউন্ড্রেল”, পরক্ষণেই যযাতির দিকে তাকিয়ে বলল “সরি আংকেল। ইটস আ ব্রেক আপ”।
যযাতি বললেন “ওহ। সরি”।
মেয়েটা বলল “আমি টাকা নিয়ে বেরোই নি। দ্যাট স্কাউন্ড্রেল, আমায় ডিচ করেছে জানেন আংকেল। আমার কাছে বাড়ি ফেরার টাকাটুকুও নেই। আমি বুঝতে পারছি ফোন দিতে আপনার কোন প্রবলেম আছে…”
যযাতি এবার হেসে ফেললেন “ট্রাস্ট মি আমার কাছে ফোন নেই। আমি মোবাইল ফোন ইউজ করি না। আপনি চাইলে আমি আপনাকে বাড়ি ফেরার টাকা দিতে পারি”।
মেয়েটা এবার খুশি হল “তাহলে তাই দিন। আমাকে আপনার পেটিএম নাম্বারটা দিয়ে দিন, আমি বাড়ি পৌঁছেই টাকা ফেরত দিয়ে দেব”।
যযাতি বললেন “আমি আপনাকে বললাম আমি ফোন ব্যবহার করি না। পেটিএম কীভাবে ব্যবহার করব?”
মেয়েটা ঠোঁট কামড়ে বলল “বিলিভ মি, আমি ভাবতেই পারছি না, এই সেঞ্চুরিতে এসে কেউ ফোন ব্যবহার করে না। ওকে, আমাকে আপনার অ্যাকাউন্ট নাম্বারটাই না হয় লিখে দিন, আমি মানি ট্রান্সফার করে দেব”।
যযাতি মাথা নাড়লেন “দ্যাটস বেটার”।
পকেট থেকে একটা একশো টাকার নোট বের করে যযাতি মেয়েটার দিকে এগিয়ে দিলেন।
মেয়েটা বলল “একশো টাকায় কিছু হবে না আংকেল। আমি সেই বেহালা যাব। পাঁচশো টাকা দেওয়া যাবে? ট্রাস্ট মি, আমি টাকা ফেরত দিয়ে দেব”।
যযাতি দ্বিধাগ্রস্থ হলেন। বাস স্ট্যান্ডে দুজন এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে।
এ মেয়ে ফ্রড নয় তো? পোশাক বা চেহারা দেখে কিছুতেই কিছু বোঝা সম্ভব নয় অবশ্য। তবে শহরে ফ্রডের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, তাতে পোশাক বা চেহারা দেখে যদি কোন মানুষ সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তাহলে বোকার স্বর্গে বাস করতে হয়। কেউ টাকা নিয়ে দৌড়ে চলে গেলে কিংবা ফোন নিয়ে পালালে কিছু করার উপায় থাকবে না।
যযাতিকে ইতস্তত করতে দেখে মেয়েটা বলল “আপনার কাছে ফোন থাকলে সমস্যাটা হত না বোধ হয়। আপনার বাড়ি থেকে কেউ ফোন করলে আপনি কী করেন? খোঁজ নেয় না? আপনার সম্পর্কে আমার কেমন যেন একটা কৌতূহল হচ্ছে।”
মেয়েটা হঠাৎ করে তার হাত ধরল।
যযাতি ছিটকে সরলেন এক হাত মত। বললেন “কী হচ্ছে?”
মেয়েটা খুব লজ্জিত হল, বলল “সরি সরি, এক্সট্রিমলি সরি আংকেল। আমার খুব ব্যাড হ্যাবিট এটা। চিনি না জানি না, এমন মানুষেরও হাত ধরে ফেলি”।
একটা এয়ারপোর্টের বাস এসে দাঁড়াল। যে দুজন বাস স্ট্যান্ডে ছিল সে দুজন সেটায় উঠে পড়ল। যযাতির অস্বস্তি হচ্ছিল। তিনি বললেন “আপনি দূরে থাকুন। আমার কাছে পাঁচশো টাকা নেই। তবে আর দুশো আছে। নিয়ে যান”।
মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে বলল “ভিক্ষা দিচ্ছেন আংকেল? ভিক্ষা তো চাই নি। আমি তো বলেছি, আপনার টাকাটা আমি ফিরিয়ে দেব”।
যযাতি বুঝলেন কোথাও একটা তাল কাটছে। কপাল ঘামতে শুরু করেছে। এইটুকু বয়সের একটা মেয়ে তার হাত ধরে ফেলল এভাবে? ঘেন্না, পিত্তি কিছুই হল না? বিয়ে হলে এত দিনে এই মেয়েটির বয়সী সন্তান হত তার। একটা বাস এসে দাঁড়াল। তার রুটের বাস না।
তবু যযাতি লাফ দিয়ে প্রচন্ড ভিড় বাসটায় উঠে পড়লেন। হৃদস্পন্দন বেশ খানিকটা বেড়ে গেছে তার।
বাসটা যখন ছাড়ল, ভিড়ের মধ্যেও যযাতি জানলা দিয়ে উঁকি মারলেন। মেয়েটা কেমন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে চোখে চোখ পড়ায় যেন এক রাশ প্রশ্ন। বলতে চাইছে ‘কী হল?’
যযাতি আবার দ্বিধায় পড়লেন। তিনি কি উল্টোপালটা ভেবে ফেলছিলেন আসলে? সত্যিই কি মেয়েটার কোন উদ্দেশ্য ছিল না? ঘামতে ঘামতে এবং পকেট বাঁচাতে বাঁচাতে তার লজ্জা হল। মেয়েটা একা আছে। সত্যিই তো! বাড়ি ফিরবে কী করে? অজানা অচেনা লোকের কাছে টাকা চাইলে যদি অ্যাডভান্টেজ নিয়ে নেয়? বাস স্ট্যান্ডটাও সুবিধের জায়গায় নয়। খুব বেশি লোকজন থাকে না। মেয়েটা বলল ব্রেক আপ হয়েছে। ছেলেটাও যদি কোন ভাবে মেয়েটার ক্ষতি করতে চলে আসে?
কাজটা মনে হয় ঠিক হল না ভাবতে ভাবতে যযাতি বিশ্বাস জীবনেও যেটা কোন দিন করেন না, সেটা করলেন। পরের স্টপেজেই নেমে, একটা ট্যাক্সি নিয়ে আগের বাস স্ট্যান্ডের দিকে রওনা দিলেন।
২।
যযাতি বুঝে উঠতে পারছেন না মেয়েটা ঠিক কী চায়।
প্রজন্মের পার্থক্য দিন দিন বেড়েছে।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন “আমরা নতুন যৌবনের দূত”।
এই লাইনটার সংজ্ঞা প্রতিটা যুগে একটু একটু করে পাল্টেছে। তাদের যৌবনে তারা যেভাবে পৃথিবীটা দেখেছিলেন, এই প্রজন্ম সেভাবে দেখে না। শরীর নিয়ে ছুতমার্গও এদের কম। নইলে যেভাবে হঠাৎ করে মেয়েটা তার হাত ধরে ফেলল, তাদের প্রজন্মে এটা সম্ভব ছিল না। এদের বুঝে ওঠা অত সহজ নয়। দুরকম ব্যাপারই হতে পারে। হতে পারে মেয়েটা সরলভাবেই তার হাত ধরেছে। অন্যদিকে হতে পারে, ভেবে নিয়েছে তার মত একজন মধ্যবয়স্ক লোক, কমবয়সী মেয়ের স্পর্শ পেয়ে টাকা বের করে দেবে। অনেক কিছুই হতে পারে। যযাতি আর বেশি ভাবতে পারলেন না। ট্যাক্সিটা বাস স্ট্যান্ডের কাছে পৌঁছলে যযাতি দেখলেন মেয়েটা তখনও একা একাই দাঁড়িয়ে আছে।
ট্যাক্সি থেকে যযাতি নামতেই মেয়েটা উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল “আরে আংকেল আপনি চলে গেছিলেন কেন?”
যযাতি ইতস্তত করে বললেন “বাসটা দেখে রিফ্লেক্স একশন হল আর কী। তারপর মনে হল আপনাকে টাকাটা না দিয়ে গেলে আপনি অসুবিধেয় পড়তে পারেন। আপনি এই ট্যাক্সিটা করে চলে যেতে পারেন। আমি টাকা দিয়ে দিচ্ছি”।
মেয়েটা বলল “ওরে বাবা, এটা তো ইয়েলো ট্যাক্সি, এদের জিপিএসও নেই। খুব রিস্ক হয়ে যাবে”।
যযাতি শ্বাস ছেড়ে বললেন “ঠিক আছে, উঠুন। আমি যাচ্ছি”।
মেয়েটা খুশি হয়ে মাথা নেড়ে বলল “থ্যাংক ইউ। আপনাকে বিশ্বাস করা যায়। আপনার মধ্যে বেশ একটা পারসোনিলিটি আছে”।
মেয়েটা ট্যাক্সিতে উঠল। যযাতিও উঠলেন। মেয়েটার কথায় হাসবেন, না কাঁদবেন বুঝলেন না৷ তার মধ্যে পারসোনালিটি দেখে ফেলল এ!
ট্যাক্সিচালককে বললেন “বেহালা”।
ড্রাইভার বেঁকে বসল “ওদিকে তো যাব না”।
যযাতি বিরক্ত গলায় বললেন “এখন আমি কোত্থেকে আর অন্য কোন গাড়ি পাব? চলুন, এক্সট্রা টাকা দেব না হয়”।
ড্রাইভার গজগজ করতে করতে গাড়ি স্টার্ট দিল।
মেয়েটা বলল “হতে পারে আপনি স্মার্ট ফোন ইউজ করেন না, বাট ইউ আর এ রেসপন্সিবল সিটিজেন। একজন মেয়েকে একা ফেলে চলে গিয়ে আপনার মনে অপরাধবোধ জেগেছে। অথচ দেখুন, আমি যে ছেলেটাকে ভালবাসতাম, সে জানোয়ারটা আমাকে কীভাবে একা ফেলে চলে গেল। ওর জন্য আমি বাড়িতে মিথ্যে বলে এতটা চলে এসেছিলাম”।
যযাতি বললেন “আপনার বাড়িতে চিন্তা করছে নিশ্চয়ই। কোন পিসিওতে দাঁড় করাতে বলব?”
মেয়েটা হাত নেড়ে বলল “তার দরকার নেই। চলে যাচ্ছি তো। কোথাও আটকে গেলে দেখা যেত। সব লোকের কাছে তো আর ফোন চাওয়া যায় না, তাছাড়া বাস স্ট্যান্ডটাও এমন জায়গায়, লোকই আসে না তেমন। সব মিলিয়ে এরকম পরিস্থিতি তো সব সময় হয় না…”
মেয়েটা একগাদা বক বক করে যেতে লাগল।
যযাতি চোখ বুজলেন।
একটা ফোন গোটা সভ্যতাকে পালটে দিয়েছে। আজ থেকে কুড়ি বছর আগেও তো মোবাইল সেভাবে ব্যবহৃত হত না। সে সময়টাতে তো এরকম দশা ছিল না! অথচ আজকাল একটা ফোন না পেলে বাড়ির লোক চিন্তায় মরে। সর্বক্ষণ মানুষ ডুবে আছে যন্ত্রটায়।
নিজে ফোন ইউজ করেন না বলেই দেখতে পান পাবলিক ট্রান্সপোর্টে প্রতিটা মানুষ ফোনে মুখ গুঁজে বসে আছে। এ এক অদ্ভুত মহামারী, ছড়িয়ে পড়ছে সেকেন্ডে সেকেন্ডে।
কিছুটা পথ গিয়েই ট্যাক্সিটা আটকে গেল। ভয়াবহ জ্যাম। গিজগিজ করছে গাড়ি। যযাতি অবাক হয়ে ড্রাইভারকে বললেন “কী হল আবার?”
ড্রাইভার উত্তর না দিয়ে ট্যাক্সি থেকে নেমে গেল।
“মোবাইল ফোন ব্যবহার করার সব থেকে বড় সমস্যা হল, আমরা আমাদের স্মৃতিশক্তিটাকেই ফোনকে সমর্পণ করে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে গেছি। অথচ আমার প্রায় সবার নম্বর মুখস্থ থাকে”।
কথাগুলো অস্ফূটে বলে চুপ করে গেলেন যযাতি।
মেয়েটা বলল “অথচ আপনার নিজের কাছেই ফোন থাকে না। ফোন নাম্বার মুখস্থ করে কী লাভ হয়?”
যযাতি বললেন “অফিসে ল্যান্ডলাইন আছে। আমার বাড়িতেও। প্রয়োজনে সেখান থেকে করি”।
মেয়েটা মুগ্ধ চোখে যযাতির দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বলল “আপনি সংরক্ষণযোগ্য। এখনো পৃথিবীর লোক আপনার দেখা পায় নি কেন? আপনাকে নিয়ে টিভি শো হওয়া উচিত”।
বাইরে উত্তেজনা বাড়ছে। তাদের ট্যাক্সির বাইরে একটা ভিড়ে গিজগিজে বাসে লোকজন তবু কেমন নির্লিপ্ত। এ দেশের সাধারন মানুষ। এদের নির্লিপ্ততা অভ্যাস করতে হয় না। প্রকৃতিতে ঢুকে যায়। জনবিস্ফোরণের ফলে জনের গুরুত্ব কমে যায় কি? যযাতি চিন্তিত হলেন। প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেছিলেন একটা তৃতীয়
বিশ্ব দেশগুলোর সুবিধে অসুবিধে নিয়ে।
প্রতিদিন মানিব্যাগ বাঁচিয়ে বাসে যেতে যেতে তৃতীয় বিশ্বের দেশের সমস্যাগুলো নিয়ে ভাবেন। একসময় কাগজে দেখলেন উত্তর সম্পাদকীয়তে প্রবন্ধ পাঠানো যায়। যযাতি ঠিক করলেন এই বিষয়েই কিছু লিখবেন। শুধু পড়লেই তো হবে না। বাস্তবটা নিজের চোখে দেখতে হবে। পুঁথিগত বিদ্যার প্রয়োজন আছে ঠিকই,তার থেকেও বেশি প্রয়োজন আছে সমস্যাগুলোকে নিজের চোখে দেখার, নিজের কানে শোনার, নিজ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করার। একটা সময় লিখতেন। লিখতে ভাললাগত বলেই লিখতেন। পরে লেখা বন্ধই করে দিলেন। বহু বছর বন্ধ ছিল। এক বছর হল আবার লিখতে শুরু করেছেন। আগে লিখতে বসলে শব্দের অভাব হত না। আজকাল হয়। শব্দগুলো পালিয়ে বেড়ায়। ভাষা খুঁজে পান না। তখন ভীষণ অসহায় মনে হয়। লেখা বন্ধ করে দিয়ে চুপ করে বসে থাকেন। নিজের ওপরেই প্রবল রাগ তৈরী হয়।
যযাতি আরও কিছু ভাববেন বলে ভাবছিলেন, এমন সময় মেয়েটা বলে উঠল “আপনি ঠিক কবে থেকে গুহামানব হবেন?”
যযাতি অবাক হয়ে বললেন “মানে?”
মেয়েটা বলল “মানে এভাবে মোবাইলহীন জীবন কাটাবেন?”
যযাতি বললেন “মোবাইলহীন জীবনের সঙ্গে গুহামানব হবার কোন সম্পর্ক নেই। মোবাইল তারা ব্যবহার করে, যাদের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করার প্রয়োজন পড়ে। আমায় অফিসের বাইরে কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয় না”।
মেয়েটা বলল “ইন্টারেস্টিং। ইউটিউব ভিডিও, গান শোনা, সিরিজ দেখা এটসেট্রা, এটসেট্রা করেন না? টিভি দেখেন না?”
যযাতি মাথা নাড়লেন “না”।
মেয়েটা হাঁ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল “তাহলে কী করেন?”
যযাতি বললেন “বই পড়ি”।
মেয়েটা মাথা নেড়ে বলল “তাহলে খুব ভাল। আমার বাবাও পড়তে খুব ভালবাসে। আই মিন, আমার নিজের বাবা না, আমাকে যে বড় করেছেন, সেই বাবা”।
যযাতি বললেন “বুঝলাম না। আপনার নিজের বাবা নেই?”
মেয়েটা বলল “আছে। তবে থাকে না এখানে। ছোট থেকে বেশি দেখি নি। ইদানীং আসে। আমার কথা মনে পড়ে নাকি। এসে এক গাদা জ্ঞান দেবে। কে শুনবে ওর জ্ঞানের কথা? যখন থাকার দরকার ছিল তখন তো থাকে নি”।
মুখ বাঁকাল মেয়েটা। যযাতির খারাপ লাগল। যেসব মানুষের শৈশব ডিস্টার্বড হয়ে যায়, তাদের জীবন বড় কষ্টকর হয়। অভাব ছিল তার জীবনেও। টাকার অভাব। অভাব মানুষকে এমন সব সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করায়, স্বাভাবিক অবস্থায় হয়ত মানুষ কিছুতেই সে সব সিদ্ধান্ত নিত না। মেয়েটার ক্রাইসিস যদি ছোটবেলা থেকেই শুরু হয়, তাহলে মেয়েটার জন্য খারাপ লাগা আসতে বাধ্য।
ট্যাক্সির কাঁচ নামানোই ছিল। মানুষের হৈ হৈ শোনা যাচ্ছে। যযাতি বুঝলেন না কী ব্যাপার। মিটিং মিছিল হচ্ছে? কোন রাজনৈতিক দলের মিছিলে ঝামেলা হচ্ছে কি? নেমে দেখাই যায়, যযাতির ইচ্ছা করছিল না শরীর এক অদ্ভুত বস্তু। যখন হাঁটার জন্য প্রস্তুতি নেয়, তখন মাইলের পর মাইল হাঁটলেও কোন সমস্যা হয় না। যখন ট্যাক্সির আরাম পায়, তখন আর নামতে ইচ্ছা করে না।
ঝামেলার কারণ জানা যেতে বেশিক্ষণ সময় লাগল না।
ট্যাক্সির ড্রাইভার এসে বলল “ব্রিজ ভেঙে পড়েছে স্যার”।
যযাতি অবাক হয়ে বললেন, “হোয়াট?”
ড্রাইভার বলল, “ফ্লাইওভার স্যার, যেটা তৈরী হচ্ছিল। ভেঙে পড়েছে”!
যযাতি হাঁ করে ড্রাইভারের দিকে তাকালেন। কথাটা বিশ্বাস হচ্ছে না। এটাও সম্ভব নাকি?
মেয়েটা বলল “শিট। যেই ভাবলাম ড্রাইভার কাকুর ফোন থেকে বাড়িতে ফোন করে জানাব, আমার বাবা আর মা, কারো নাম্বারই মনে পড়ছে না। আমার কিছুতেই ফোন বুক ছাড়া কারো নাম্বার মনে থাকে না। এবার কী হবে?”
যযাতি চমকে উঠে মেয়েটার দিকে তাকালেন।
খুব জোরে হইচইয়ের আওয়াজ আসছে। যযাতি এবার চিন্তায় পড়লেন। গাড়িটা ব্যাক করার জায়গাও নেই।
পুলিশের গাড়ির শব্দ আসছে। ট্যাক্সিচালক দৌড়ে ট্যাক্সিতে উঠে বলল “পুলিশ এসেছে। এবার শিওর লাঠি চার্জ হবে”।
৩।
অফিস থেকে গাড়ি নিয়ে বেরনোর পর বিম্বিসার এফ এম চালিয়ে দেখলেন চ্যানেলগুলো একটাও বাংলা গান বাজাচ্ছে না। বিরক্ত মুখে তিনি এফ এমটা বন্ধ করে দিলেন। হিন্দি ভাষার উপরে বিম্বিসারের বিন্দুমাত্র কোন রাগ নেই, তবে বাংলায় থেকে অন্তত একটা কেউ তো বাংলা গান চালাবে! কয়েকজন রেডিও জকি বাদে বাকি যারা আছে, তারা ভাঁড় ছাড়া কিছু না। যেন জোর করে হাসাবে। তার ওপর গানের থেকে বিজ্ঞাপন বেশি। কতগুলো পাঞ্জাবী গান, সারাদিন ধরে লুপে বেজে চলেছে। এত ভাল ভাল বাংলা গান থাকতে কলকাতার এফ এম চ্যানেলগুলো এই গান বাজায় কেন সারাক্ষণ? পাঞ্জাবী গান এত জনপ্রিয় হয়ে গেছে? অদ্ভুত সব সেক্সিস্ট গান, নইলে পুরনো গানের অর্থহীন রিমিক্স। এ গানগুলো শুনতে না চাইলেও সারাদিন শুনিয়ে শুনিয়ে এদের ট্রেন্ডিং করে তোলাই কাজ এদের।
রাস্তায় ভয়াবহ জ্যাম। বিম্বিসার চুপ করে বসে ছিলেন। গাড়ি এক ইঞ্চিও এগোচ্ছে না। শহরের ভার বাড়ছে প্রতিদিন। এসি চলছে বলে গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করেন নি।
ফোন বাজছে। বিম্বিসার দেখল বিভাবরী ফোন করছেন। ধরলেন “বল”।
বিভাবরী বললেন “তুমি কোথায়?”
বিম্বিসার বলল “তপসিয়া। জ্যাম আছে। আরো একঘন্টা ধরে রাখো”।
বিভাবরী একটু চুপ করে বললেন “সুপ্রিয় এসেছে”।
বিম্বিসার থমকে গেলেন। বললেন “কখন?”
বিভাবরী বললেন “একটু আগে। ড্রয়িং রুমে বসিয়ে এলাম। তাতানকে দেখতে চাইছে”।
বিম্বিসার বললেন “তাতান কোথায়?”
বিভাবরী বললেন, “কলেজ গেছিল, তারপর টিউশনে আছে। ফিরবে খানিকক্ষণ বাদে। তুমি কোনভাবে তাড়াতাড়ি এসো। সুপ্রিয় আবার কী সব বলবে তাতানকে, আবার সীন ক্রিয়েট হবে, আমি কেমন নার্ভাস ফিল করছি”।
এসি চলা সত্ত্বেও বিম্বিসারের ঘাম হতে শুরু করেছে বুঝলেন তিনি। এসির তাপমাত্রা আরো কমিয়ে বিম্বিসার বললেন “চেষ্টা করছি আসার। তুমি স্বাভাবিক থাকো। আরেকটা কাজ করতে পারো, তাতান যে বাড়ি পড়তে গেছে, সেখানে ফোন করে বল আমি ওকে যাবার সময় নিয়ে যাব। আপাতত তাতান যেন ওখানেই থাকে”।
বিভাবরী বললেন “আর আমি এখানে এতক্ষণ সুপ্রিয়কে নিয়ে একা বাড়িতে থাকব? তাতানকে নিয়ে একের পর এক প্রশ্ন করবে আর আমাকে উত্তর দিয়ে যেতে হবে?”
বিম্বিসার বললেন “তুমি ভেতরের ঘরে থাকো। ওকে চা পাঠাও। টিভি চালিয়ে দাও। বসে থাকুক”।
বিভাবরী একটু ভেবে বললেন , “ঠিক আছে। তুমি দেরী কোর না। চলে এসো শিগগিরি”।
ফোনটা কেটে দিলেন বিভাবরী। গাড়ি এগনো শুরু হয়েছে পার্ক সার্কাসের দিকে। বিম্বিসার বুঝতে পারছিলেন তার প্রেশার চড়ছে। সুপ্রিয়কে এখনই আসতে হবে? তাতান যখন ছোট ছিল তখন তো এত আসত না! বড় হলেই পিতৃত্ব ফলাতে আসতে হবে! মুখের ভিতরটা তেতো হচ্ছিল তার। তৃণা মারা যাবার পর থেকে তিনি আর বিভাবরীই তাতানকে বড় করলেন। সে সময়টা একেবারেই আসেন নি সুপ্রিয়। এদিক সেদিক ঘুরে বেরিয়েছেন। এক টাকাও পাঠান নি। বিম্বিসার সেসব চানও নি কোনদিন। নিঃসন্তান দম্পতির সন্তান কাছে আশীর্বাদস্বরূপ এসেছিল তাতান। এখনও তাতান সুপ্রিয়কে খুব একটা পছন্দ করে না। সুপ্রিয় এলে মেয়ে দেখাও করতে চায় না।
সুপ্রিয় এখন হিমাচল প্রদেশে থাকেন। অথচ মাঝে মাঝেই মেয়েকে দেখতে চলে আসছেন। এত দূর থেকে বারবার সব কাজ ফেলে আসছেন। বিম্বিসারের ভাল লাগছিল না। জীবন এত জটিল হবে কেন? তৃণা মারা যাবার পর সুপ্রিয় পাগল পাগল হয়ে গেছিলেন। রাজ্য ছেড়ে চলে গেল। বিম্বিসার আর বিভাবরী তাতান ছাড়া কিছু বোঝেন নি।
এখন হঠাৎ করে সুপ্রিয় এসে জটিলতা বাড়িয়ে যাচ্ছেন। এর আগের বারে এসে দুম করে তাতানের সামনেই বলে বসলেন মেয়েকে এত স্বাধীনতা দিয়ে ঠিক করছে না তারা। সন্ধ্যেবেলার মধ্যে ঘরে ফেরাটা রেগুলার মণিটরিং করে যেন বিভাবরী।
তখন কিছু বলেন নি বিভাবরী, কিন্তু পরে বিম্বিসারের সামনে কেঁদে ফেলেছিলেন। এখন এসব জ্ঞান দেওয়ার মানে কী? মেয়ের বয়ঃসন্ধি থেকে শুরু করে সবটা তো তারাই সামলালেন। এখন বাপগিরি করছে কেন? দখলদারি ফলাতে চাইছে? কী হাস্যকর!
তাতানও সুপ্রিয়কে পছন্দ করে না। তবু বাবা বলে কথা। তারাই বুঝিয়ে শুনিয়ে সুপ্রিয়র সঙ্গে তাতানের কথা বলায়।
গাড়ি আবার জ্যামে পড়েছে।
ফোনটা আবার বাজতে শুরু করেছে। বিভাবরীই, ধরলেন বিম্বিসার “বল”।
“তাতানের ফোন পাচ্ছি না। সুইচড অফ বলছে। টিউশনের ওখানে ফোন করে জানলাম আজ যায় নি। কী করব এবার?”
বিভাবরীর কথাটা আর্তনাদের মত শোনাল।
৪।
“আমার মেয়ে কোথায় বিভা?”
বিভাবরী ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই প্রশ্নটা করলেন সুপ্রিয়। বিভাবরী টিভির দিকে তাকালেন।
শহরে একটা একটা উড়ালপুল ভেঙে পড়েছে। খবরে বার বার দেখাচ্ছে।
সুপ্রিয় কেমন একটা তেড়িয়া ভঙ্গিতে বসে আছেন।
বিভাবরীর কান্না পাচ্ছিল। সামনে সুপ্রিয়। তিনি কীভাবে একা সব কিছু সামলাবেন? ওই দুজন কখন ফিরবে সেটা তো সুপ্রিয়র সঙ্গেও আলোচনা করা যাবে না! আরেক ঝামেলা লাগবে।
তিনি বললেন “তাতান শুধু তোমার মেয়ে সুপ্রিয়?”
প্রশ্নটা শুনে সুপ্রিয় কয়েক সেকেন্ড তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি এমনি এমনি এত দূর থেকে এখানে ছুটে আসি না বিভা। আমি গুরগাও যাচ্ছিলাম গত বছর। রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে হালকা হতে নেমেছি, দেখি একটা লাশ। চোদ্দ পনেরো বছরের মেয়ের। জামা কাপড় নেই। আমার মনে হচ্ছিল হৃদপিণ্ডটা বেরিয়ে আসবে। মনে হচ্ছিল, লাশটা তাতানের। তারপর থেকে আমি ঘুমাতে পারি না, বিশ্বাস কর। আমাকে হন্ট করে লাশটা। চোখ বুজলেই আমি মেয়েটাকে দেখতে পাই”।
সুপ্রিয় দু হাত দিয়ে মুখ ঢাকা দিলেন।
বিভাবরী চুপ করে বসলেন। তার নিজেরও প্রবল অস্বস্তি হচ্ছিল টিভির দিকে তাকালেই। তিনি বললেন, “এ শহরটা তো গুরগাও না সুপ্রিয়। এত ভয় পেও না”।
সুপ্রিয় ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে হাসলেন, “হাহ… এই শহর। তুমি বলছ এই শহর। পৃথিবীর কোন শহর মেয়েদের জন্য সেফ বল তো? মেয়েদের কেউ মানুষ বলে ভাবে নাকি?”
ভয়ংকর ভাবে একটা ফ্লাইওভার ভেঙে পড়েছে। তার ভেতরটা কুঁকড়ে যাচ্ছে। তাতানকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় গেল ও? ছেলেটার সঙ্গে আছে কি? নাকি…
নি। মেয়ের ওপর তার ভরসা আছে। জানেন, তাতান ঠিক পথেই আছে। কিন্তু মেয়েটা এখন ছেলেটার সঙ্গে থাকে যদি তাহলে ঠিক কী অবস্থায় আছে?
তিনি বললেন, “সন্তানের মা কি শুধু জন্ম দিলেই হওয়া যায় সুপ্রিয়? আমি কী অবস্থায় আছি সেটা বুঝতে পারছো? একটু অপেক্ষা কর না হয়”।
সুপ্রিয় অস্থির ভাবে মাথা নাড়লেন “করছি। অপেক্ষাই তো করছি। কীভাবে মেয়েটাকে দূরে ঠেলে দিয়েছি বলো? তোমরা না থাকলে যে কী হত! কতটা স্বার্থপর একটা জীবন কাটালাম। নিজের ওপরেই ঘেন্না হয়। মনে হয় নিজের গালে নিজেই চড় মারি। তবু বুঝতে চাই না। আমি থাকতে পারি না আর এত দূরে। সারাক্ষণ মনে হয় তাতানকে দেখি। মেয়েটা কী করছে, কত বড় হয়ে গেল আমার অলক্ষ্যেই। অথচ আমি বাবার কর্তব্য কিচ্ছু পালন করলাম না”।
সুপ্রিয় মাথায় হাত দিলেন।
বিভাবরী বললেন, “এভাবে ভেবো না আর। কী করবে বল? একটাই তো জীবন। যা হয়ে গেছে, সেটাকে তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তুমি এখন মাথা ঠান্ডা কর। নিজের শরীরটা খারাপ কোর না। তাতান আমাদের সবার মেয়ে। কিচ্ছু হবে না ওর”।
সুপ্রিয় বললেন “জানি। কিচ্ছু হবে না জানি। আমার ছুটি ছিল না। আমি দিল্লিতে একটা কাজে গেছিলাম। কী মনে হতে একগাদা টাকা খরচ করে কলকাতা চলে এলাম। কাল ভোরে চলে যাব। শুধু তাতানকে একটিবার দেখতে এসেছি। তোমরা ভেবো না, তাতানকে আমি তোমাদের থেকে ছিনিয়ে নিতে আসি না। রক্ত তো…”
সুপ্রিয় কেঁদে ফেললেন।
টিভিতে ভয়াবহ সব দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছে কীভাবে নির্মীয়মাণ ফ্লাইওভারটা ভেঙে পড়ল। ফ্লাইওভারের তলায় একটা পানের দোকান ছিল। দশ বারোজন আড্ডা মারছিল সেখানে। এখন তার কোন চিহ্ন নেই।
বিভাবরী উঠলেন। বিম্বিসারকে ফোন করতে হবে। বার বার ফোন করলে লোকটা বিরক্ত হবে ঠিকই, কিন্তু তিনি কী করবেন? চিন্তাটা তো আর আটকানো যাবে না!
সুপ্রিয় একা একা বসে থাকলেন। একজন হেরে যাওয়া মানুষ যেভাবে বসে থাকে।
৫।
ব্যারিকেড করা চলছে। ট্যাক্সি ড্রাইভার এসে ট্যাক্সিতে বসে বলল, “পুরো ফেঁসে গেলাম। এক কাজ করুন। আপনারা নেমে যান। হাঁটতে শুরু করুন। কিছুক্ষণ পরে ট্যাক্সি পেয়ে যাবেন। ঘুর পথ হবে, তবে বাড়ি পৌঁছে যাবেন। সামনের দিকটা কবে ঠিক হবে, কেউ জানে না। লোকে সেলফি তুলছিল ভাঙা ব্রিজের সঙ্গে, দিয়েছে পুলিশ লাঠি ঠুসে”।
খ্যাক খ্যাক করে হাসতে লাগল ট্যাক্সিচালক।
যযাতি ট্যাক্সি ভাড়া দিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে ট্যাক্সি থেকে নামলেন। মেয়েটা বলল, “এবার হাঁটতে হবে? আমার হাঁটায় খুব অ্যালার্জি”।
বাসগুলো থেকে লোকজন নেমে হাঁটতে শুরু করেছে। আরেকদল ভাঙা ফ্লাইওভার দেখতে যাচ্ছে। যযাতি ওদিকে তাকালেন না। ভাবতেও অস্বস্তি হচ্ছে।
মেয়েটাকে বললেন, “আপনি যে কোন একটা নাম্বার মনে করার চেষ্টা করুন। সিচুয়েশনটা ঘোরালো হচ্ছে”।
মেয়েটা বলল, “আমাকে আপনি তাতান বলে ডাকুন। ডাকনাম এটা। আর তুমি বলুন”।
যযাতি বললেন, “ঠিক আছে। তুমি বাড়ির যে কোন কারো নাম্বার মনে করার চেষ্টা কর। এখান থেকে বেহালা যাওয়াটা এখন আর অত সহজ নেই। যে কোন একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে”।
তাতান বলল, “বিলিভ মি আংকেল। আমি কোন নাম্বার মুখস্ত রাখি না”।
যযাতি বললেন, “ঠিক আছে। হাঁটো। দেখি কোন গাড়ির ব্যবস্থা করা যায় নাকি। এদিকে তোমার কোন আত্মীয় স্বজন থাকেন না?”
তাতান মাথা নাড়ল, “নাহ। থাকলেও এদিকে আমি কাউকে চিনি না”।
যযাতির হাঁটার অভ্যাস আছে। সমস্যা হল গাড়ি, ভিড়, চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার ভেতরে হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছিল।
তাতান বলল, “কী স্যাড না?”
যযাতি বললেন, “কোনটা?”
তাতান বলল, “এই যে, কত মানুষ মরে যাবে। ফ্লাইওভারটা তো আমাদের ট্যাক্সির ওপরেও পড়তে পারতো আর কিছুক্ষণ পরে এলে”!
যযাতি বললেন, “পারত। ঠিকই”।
তাতান হাসল, “আমারই ভুল ছিল। মার কথা শোনা উচিত ছিল। সব ছেলেকে বিশ্বাস করা যায় না। এত দূর আসা ঠিক হয় নি। পৃথ্বীকে বিশ্বাস করা আরো উচিত হয় নি। রক মিউজিক শুনলে আর ড্রাগস নিলেই কুল হওয়া যায় না। আমি কেন বুঝি নি?”
যযাতি শ্বাস ছাড়লেন, “সেটা আমি কী করে বলব?”
তাতান বলল, “ঠিকই তো। আপনি কী করে বলবেন? আপনি একটা ওল্ড জেনারেশনের লোক। আপনি বুঝবেন না”।
যযাতি বললেন, “তা ঠিক। সত্যিই আমি ওল্ড জেনারেশনের লোক”।
তাতান বলল, “আপনার ছেলে মেয়ের অশেষ দুর্গতি আছে। ফোন কিনতে আসবে, আপনি গম্ভীর গলায় বলবেন, ফোন ইউজ করবে না। বই পড়”।
চারদিকে তুমুল ঝঞ্ঝাটের মধ্যেও তাতান হাসতে লাগল। কেউ বিরক্তি, কেউ কৌতুক মাখানো দৃষ্টি নিয়ে তাতানের দিকে তাকাচ্ছে।
যযাতিও হাসলেন। ফায়ার ব্রিগেড আটকে গেছে। অ্যাম্বুলেন্সও। পুলিশ হয়ত কিছুক্ষণের মধ্যেই রাস্তা খালি করতে পারবে। অপেক্ষা করা কি ভাল হবে? না বোধ হয়। বরং জায়গাটা থেকে যত দূরে যাওয়া যায় ততই ভাল। কখন কী থেকে কী হয়ে যায়, বোঝা সম্ভব না।
সভ্যতা যত এগোবে, তত এ ধরণের জঞ্জাল বাড়বে।
সঙ্কীর্ণ রাস্তা, কংক্রিটের জঙ্গল, তার মধ্যেই ফ্লাইওভার তৈরী হচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসে মাঝে মাঝে।
যযাতি খরচ বাঁচিয়ে গ্রামের দিকে জমি কেনার কথা ভেবেছেন বহু দিন। এসব দেখে প্রতিজ্ঞা করলেন, এক মাসের মধ্যে শহর ছাড়তে হবে। এভাবে বেঁচে থাকা যায় না। শহরটা আর বাসযোগ্য নেই।
চাকরিটাও ছেড়ে দিতে হবে। যে টাকা জমেছে, সে টাকা দিয়ে বাকি জীবনটা কেটে যাবে।
তাতান বলল, “আর কত হাঁটব?”
যযাতি বললেন, “তোমার বাড়ির কোন নাম্বারই মনে পড়ছে না?”
তাতান বলল, “একটা ল্যান্ডলাইন ছিল। সেটা তো ডিসকানেক্টেড হয়ে গেছে বহুদিন। এই সব ফোন আসার পরেই। ওটার নাম্বার মনে আছে”।
রাস্তার বাঁক পেরিয়ে যযাতি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। শহরের সব গাড়ির কি আজকে এদিকেই আসার ছিল?
তাতান ফুটপাথে বসে পড়ল, “আমি আর পারছি না”।
যযাতি চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন।
ঠিকই, শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাওয়ার চিন্তা করা যাচ্ছে না এখন।
সড়কপথে গেলে কখন বেহালা পৌঁছে নিজের বাড়ি পৌঁছবেন চিন্তা করা যাচ্ছে না।
একটাই উপায় এখন। কাছাকাছি কোন মেট্রো স্টেশনে পৌঁছতে হবে!
এ ছাড়া আর কোন রাস্তা অবশিষ্ট নেই।
৬।
রাস্তার সমস্যা হল, একটা লাল সিগনাল এলে পর পর আসতে শুরু করে। বিম্বিসার যত তাড়াতাড়ি ড্রাইভ করার চেষ্টা করছেন, ততবার সিগনালের সামনে পড়ে যাচ্ছেন।
সুপ্রিয় এলে বিম্বিসারের মাথা ঠিক থাকে না। তখন মনে হয় তাতানকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে গেলেই হয়। সুপ্রিয়র অধিকার ফলানো দিন দিন অসহ্য হয়ে যাচ্ছে। সুপ্রিয়র কঠিন সময়ে তারা পাশে ছিলেন। এখন ওর বোঝা উচিত, তাদের পরিবারে এভাবে ঢুকলেও আসলে তিনি আউটসাইডার হয়ে গেছেন। তিনি যেমন নিজের মেয়েকে ভালবাসেন, বিম্বিসার-বিভাবরীও তার থেকে বিন্দুমাত্র কম ভালবাসেন না।
অফিস টাইমের জ্যামের মহাসমুদ্র পেরিয়ে বাড়ি ঢুকলেন তিনি। কীভাবে গাড়ি চালিয়ে এলেন, তিনিই জানেন। একটা বাইক গাড়ির পিছনটা ঘষে দিয়েছে। অন্য দিন হলে ক্ষতিপূরণ নিতে দাঁড়ালেন। এদিন সেটার কথা ভাবতেও পারলেন না। তড়ি ঘড়ি চালিয়ে এলেন। কত জায়গায় স্পিড লিমিট ক্রস করে গেছেন। নিশ্চয়ই কেস দেবে। দিলে দেবে। আবার সুপ্রিয়র মুখ দেখতে হবে ভাবলেই বিরক্ত লাগছিল।
বিভাবরী কাঁদো কাঁদো মুখে দরজা খুললেন।
বিম্বিসার বললেন, “তাতান ফেরে নি?”
বিভাবরী মাথা নাড়লেন, “দেখো না, ফ্লাইওভার ভেঙে পড়েছে বলছে। মেয়েটা যদি ওখানে থাকে!”
বিম্বিসার ভ্রূ কুঁচকালেন, “ওখানে কেন থাকতে যাবে? ওটা তো উল্টোদিক”।
বিভাবরী ফিসফিস করে বললেন, “তোমাকে বলি নি। ওর একটা ছেলের সঙ্গে অ্যাফেয়ার চলছে। টিউশন বাঙ্ক করে যদি ওদিকে যায়? আমার তখন থেকে মাথা কাজ করছে না”।
বিম্বিসার স্থির চোখে বিভাবরীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “চল। এখনই চল”।
বিম্বিসার এরকমই। তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত তিনি মুহূর্তের মধ্যে নিতে পারেন।
বিভাবরী বিস্মিত হয়ে বললেন, “কোথায় যাব?”
বিম্বিসার বললেন, “যেখানে ফ্লাইওভার ভেঙেছে। আমি এখন কী করে ঘরে বসে থাকব? সেটা সম্ভব?”
বিভাবরী বললেন, “আর সুপ্রিয়?
বিম্বিসার বললেন, “নিয়ে চল। সুপ্রিয়”!
গলা তুললেন বিম্বিসার।
সুপ্রিয় ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
বললেন, “তুই এলি? তাতান এল না কেন এখনো?”
বিম্বিসার একবার বিভাবরীর দিকে তাকিয়ে সুপ্রিয়র দিকে তাকালেন, “চল। বেরোতে হবে”।
সুপ্রিয় বললেন, “বেরোতে হবে মানে? কোথায় যেতে হবে? আমার মেয়েটা বেঁচে আছে তো রে?”
বিম্বিসার বললেন, “জন্ম দিলেই মেয়েটা তোর হয়ে যায় না। তাতান আমাদেরও মেয়ে”।
সুপ্রিয় বিম্বিসারের হাত দুটো ধরে কেঁদে ফেললেন, “কী হয়েছে বল প্লিজ। টিভিতে খবরগুলো দেখে মাথা ঠিক রাখা যাচ্ছে না। তাতান ঠিক আছে তো?”
বিম্বিসার বললেন, “তাতান পড়তে গেছিল। তারপর ওর ফোন সুইচড অফ বলছে। লো ব্যাটারি মে বি। যেখানে ফ্লাইওভার ভেঙে পড়েছে, সেদিকে গেছে নাকি জানি না। তবে এখনো ফেরে নি। খোঁজ করতে হবে। আপাতত বেরোতে হবে। ঘরে বসে কোন লাভ নেই। চল”।
সুপ্রিয় চিৎকার করলেন, “কেন? তাতানকে তোরা কেন ঠিক মত শাসন করিস নি? কেন ও নিজের ইচ্ছে মত ঘুরে বেড়াবে?”
বিম্বিসার প্রাণপণে নিজের মাথা ঠান্ডা রেখে যাচ্ছিলেন। বললেন, “তাতান এখন আর দু বছরের বাচ্চা নয়। আজকালকার জেনারেশনের ছেলে মেয়েদের হাতে পায়ে বেড়ি বেঁধে শাসন করা সম্ভব নয়। এখানে কথা বলে, চিৎকার চ্যাঁচামেচি না করে চল। সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ করতে হবে”।
সুপ্রিয় বিম্বিসারের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে, “ওহ” বলে বাড়ির বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে নার্ভাস ভঙ্গিতে সিগারেট বের করে ধরালেন।
বিভাবরী তালা চাবি নিয়ে এলেন। তার হাত পা কাঁপছিল।
বিম্বিসার বিভাবরীর হাত থেকে তালা চাবি নিয়ে গেট বন্ধ করে বললেন, “পাশের মিত্রদার বাড়িতে চাবি দিয়ে এসো। ওদের বলে দাও, এর মধ্যে তাতান ফিরে এলে সঙ্গে সঙ্গে যেন আমাদের ফোন করে জানায়। বেশি কিছু বলতে হবে না। তাহলে অযথা কৌতূহল দেখাতে শুরু করবে”।
গেটে চাবি দিয়ে বিম্বিসার বিভাবরীর হাতে চাবি দিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলেন।
সুপ্রিয় সিগারেট টেনে যাচ্ছিলেন।
বিম্বিসারকে গাড়িতে গিয়ে বসতে দেখে তিনি সিগারেট ফেলে বিম্বিসারের পাশের সিটে বসলেন।
বিম্বিসারের মাথা দপ দপ করছে। তাতানকে নিয়ে এমনিতেই সব সময় চিন্তায় থাকতে হয়, সুপ্রিয়র উপস্থিতিটা তাকে অপরাধী বানিয়ে দিচ্ছে। বিভাবরী পাশের বাড়ির মহিলার সঙ্গে কথা বলেই চলেছেন।
বিরক্ত হয়ে বিম্বিসার দুবার হর্ন দিলেন।
বিভাবরী তাড়াতাড়ি এসে গাড়ির পিছনের সিটে বসলেন।
বিম্বিসার গাড়ি স্টার্ট দিলেন।
সুপ্রিয় বললেন, “থানা যাওয়া ভাল না হাসপাতালে? বেঁচে আছে তো?”
বিম্বিসার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললেন, “কী বললি?”
সুপ্রিয় থতমত হয়ে বললেন, “কিছু না। কিছু না। চল। প্লিজ”।
বিম্বিসার বললেন “এমন কিছু কথা বলিস না যাতে আমার মাথা গরম হয়ে যায়। আমার মাথাটা ঠান্ডা রাখতে দে। জায়গাটায় আমাকে ড্রাইভ করে যেতে হবে। ভাবতে দে কী করলে তাতানের কাছে সব থেকে আগে পৌঁছনো যাবে”।
সুপ্রিয় ছটফট করতে শুরু করলেন।
বিম্বিসার ফোন বের করলেন। একটা জরুরি ফোন করতে হবে।
৭।
তাতান অধৈর্য হয়ে পড়েছে। বলল, “আর কত হাঁটতে হবে বলুন তো? আমি আর পারছি না। এত ভিড়ের মধ্যে একটা লোককেও চিনি না। চিনলে আড্ডা মারা যেত। একটা মজার জিনিস দেখা যাচ্ছে, যারা বাসে করে এসেছে, তারা বাস থেকে নেমে হাঁটতে পারলেই ছুটি পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যাদের নিজের গাড়ি আছে, তারা কেস খাবে। গাড়ি ফেলে তো যাওয়া যাবে না। পুরো জ্যাম মিটলে, তারপরে যেতে পারবে”।
যযাতি বললেন, “তোমার কোন চিন্তা হচ্ছে না? বাড়ির লোক চিন্তা করছে, নিশ্চয়ই মিথ্যে বলে বেরিয়েছো?”
তাতান বলল, “চিন্তা করে লাভ নেই। তুমুল ঝাড় ইজ ওয়েটিং ফর মি। ওসব ভেবে কী হবে? হিহি”।
একটা মোবাইলের দোকান খোলা আছে। যযাতি বললেন, “তোমার ফোনটা দাও। চার্জ দিয়ে নি”।
তাতান খুশি হল, “গুড আইডিয়া”।
যযাতি দোকানটার দিকে রওনা হতে না হতেই পাথর ছুঁড়ছে কেউ বা কারা। তাতানের হাত ধরে একটা সরু গলিতে ঢুকে গেলেন।
তাতান বলল, “শিট। এ আবার কী?”
যযাতি দেখলেন বেশ কিছু লোক স্লোগান দিতে দিতে ভাঙা ফ্লাইওভারের দিকে রওনা হয়েছে। তিন চারজন পুলিশের গায়েও ঢিল লেগেছে। তারা তেড়ে গেল। লোকগুলোর ছত্রভঙ্গ হতে বেশিক্ষণ লাগল না। বেশ কিছু গাড়ির কাঁচ ভাঙল।
গাড়ি চালকেরা গাড়ি থেকে বেরিয়ে হল্লা শুরু করেছে।
যযাতি বললেন, “চল। এখানে দাঁড়ানো যাবে না। এই জন্যই বেরিয়ে যেতে চাইছিলাম”।
তাতান বলল, “এটাকেই কি কেয়ামতের রাত বলে? আমি বাংলাদেশের একটা বই পড়ছিলাম। ওখানে কেয়ামতের দিন বা রাত টাইপের টার্ম চোখে পড়েছিল”।
যযাতি বললেন, “হতে পারে। শুনে ভাল লাগল, তুমি বই পড়”।
তাতান বলল, “মাঝে মাঝে পড়ি। প্রেম করার সময়গুলো বই পড়া হয় না। তখন বয়ফ্রেন্ডকে মেসেজ না করলে সে ভেবে নেয় আমি অন্য কারো সঙ্গে প্রেম করছি”।
যযাতি বললেন, “তাহলে সেটা প্রেম কেন হবে? এত ইনসিকিউরিটি থাকলে সেটা প্রেম হয় না”।
তাতান বলল, “হয়। আপনি প্রেম করেছেন কখনো?”
যযাতি থমকে দাঁড়িয়ে গিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলেন, “না। করা হয় নি”।
তাতান বলল, “শিওর করেছেন। এই যে চুপ করে গেলেন, এর মানে হল করেছেন”।
যযাতি বললেন, “করলেও আমার তোমার বয়সী একটা মেয়ে থাকত। বড়দের সঙ্গে এভাবে কথা বোল না। বাড়িতে বাবা মার সামনে বললে বকা খাও না?”
তাতান বলল, “খাই তো। তা বলে এখানে তো আমি স্বাধীন। এর এ কথার উত্তর না দেওয়ার কী আছে?”
যযাতি বললেন, “হতে পারে আমার এই প্রশ্নটার উত্তর দিতে কোন সমস্যা আছে। প্রশ্নটা আমার কমফোর্ট জোনের বাইরে”।
তাতান বলল, “তা হতে পারে। ঠিক আছে। এই ব্যাপারটা থাক”।
ক্রসিঙে পৌঁছে দেখা গেল একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। যযাতি গিয়ে ট্যাক্সিচালককে বললেন, “বেহালা যাবে?”
ট্যাক্সি ড্রাইভার খৈনি ডলতে ডলতে বলল, “তেল নেই। কোথাও যাবো না”।
যযাতি বলল, “এক্সট্রা টাকা দেব”।
ট্যাক্সি ড্রাইভার রেগে গিয়ে বলল, “বলছি তো তেল নেই”।
চারদিকে তাকালেন। এদিকটায় পুলিশ খানিকটা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। একজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে আছে। তার কাছে গিয়ে বললেন, “এখান থেকে মেট্রো স্টেশন কতদূর বলতে পারবেন? বেহালা যেতে হত।”
অফিসার বললেন, “মেট্রো বন্ধ করে দিয়েছে তো। গিয়ে লাভ নেই। ওদিকেও বিক্ষোভ চলছে। এদিক থেকে বেহালা যেতে পাঁচ ছ ঘন্টা লেগে যাবে”।
যযাতি হাল ছেড়ে দিলেন।
মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আর কোন উপায় নেই।
তাতানের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আরেকটু হাঁটতে পারবে? আমার পরিচিত একজনের বাড়ি আছে। তবে এখনো এক দেড় কিলোমিটার”।
তাতান ব্যাজার মুখে বলল, “ধুস। আর কত হাঁটব? আর পারছি না”।
যযাতি বললেন, “চল। এছাড়া আর কোন উপায় নেই বললাম তো”।
তাতান বলল, “এক দেড় কিলোমিটারটা একটু বেশি হয়ে যায় না? রিক্সা ম্যানেজ করা যায় না?”
যযাতি বললেন, “তুমিই দেখো। রিক্সা পাওয়া গেলে তো ভালোই। একটা দোকানপাটও খোলা নেই”।
তাতান বলল, “ধুস, সব কোথায় ভ্যানিশ হয়ে গেছে। আজকে দিনটাই খারাপ। পৃথ্বী স্কাউন্ড্রেলটার সঙ্গে এদ্দুর না এলেই ভাল হত। মিথ্যা বললাম বাড়িতে। কী যে ওয়েট করে আছে কে জানে”।
যযাতি বললেন, “তাহলে আজকের পর থেকে আর মিথ্যে বলবে না তো?”
তাতান বলল, “জানি না। না বলার চান্সই বেশি। একটা মিথ্যেতে কত বড় কেস হয়ে গেল বাপরে”।
যযাতি হাসলেন, “আমিও প্রতিটা রেজাল্টের পর ভাবতাম পরের বার থেকে ভাল করে পড়ব”।
তাতান মুখ বাঁকাল, “না আমি আপনার মত না। আমি মিথ্যে বলব না”।
যযাতি কাঁধ ঝাঁকালেন, “তাহলে তো ভালই। চল পা চালিয়ে”।
তাতান একটা বন্ধ চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসল, “যাচ্ছি, একটু বসে নি। কোন দিন এত হাঁটি নি আমি। বাড়ি থেকে বেরোই, অটো নি, ব্যস ঝামেলা খতম। মাঝে মাঝে বাবাও লিফট দেয়”।
যযাতি বললেন, “তোমার বাবার ব্যাপারে কী বলছিলে?”
তাতান বলল, “আমার মা ছোটবেলায় মারা যান। তারপর থেকে আমি আরেকটা ফ্যামিলিতে মানুষ। বায়োলজিকাল ফাদার যে, কোন কালে আসেন নি, এখন মাঝে মাঝে আসেন, আর পাতার পর পাতা জ্ঞান ঝাড়েন। আমার একটুও ভাল লাগে না”।
যযাতি বললেন, “হতে পারে তার কোন বাধ্যবাধকতা ছিল। যত বেশি মানুষের থেকে ভালোবাসা পেতে পারো, ততো ভালো তো ব্যাপারটা, তাই না?”
তাতান বলল, “একবারেই না। বেশি ভালবাসায় বদহজম হয়। ওই তো পৃথ্বী, আমার ফোনটা আপনাকে দেখালে বুঝতেন। সারাক্ষণ আই লাভ ইউ বেবি, আই কান্ট লিভ উইদাউট বেবি করত। এখন দেখি আমাকে লুকিয়ে অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে চ্যাট করে। এত ভালোবেসে যদি মানুষ আমাকে ডিচ করে, তাহলে সে ভালোবাসায় আমার দরকার নেই”।
যযাতি বললেন, “দুটো ভালোবাসার মধ্যে তফাৎ আছে কিন্তু। রক্তের সম্পর্কের ব্যাপারটা আলাদা”।
তাতান বলল, “মোটেও আলাদা না। আমায় যারা বড় করে তুলেছেন, তাদের দেখলে এই কথাটা আপনি বলতেন না। তাদের জন্যই কষ্ট হচ্ছে বেশি। মা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমি তাকেও এই পৃথ্বীর ব্যাপারে সব কিছু বলি নি। মনে হচ্ছে ভুল করেছি। উচিত ছিল বাকিটাও বলে দেওয়া”।
যযাতি বললেন, “বলতে পারতে। শহরটা তো আর এত সহজ সরল নেই। চল হাঁটতে শুরু করা যাক”।
তাতান উঠে বলল, “আমি একটানা হাঁটতে পারব না কিন্তু। মাঝে মাঝে রেস্ট নেব”।
যযাতি বললেন, “তাই কোর। এবার চল”।
৮।
কলকাতা পুলিশে বিম্বিসারের বন্ধু তথাগত আছেন। বিম্বিসার তাকে ফোন করলেন।
তথাগতর ফোন প্রথমে ব্যস্ত ছিল।
বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে পাওয়া গেল।
তথাগত বললেন, “খুব বিজি আছি রে। কিছু বলবি?”
বিম্বিসার বললেন, “তাতানের ব্যাপারে কথা ছিল”।
তথাগত বললেন, “কী হয়েছে?”
বিম্বিসার সবটা বললেন।
তথাগত বললেন, “শিট। মেয়েটা আর প্রেম করতে যাবার দিন পেল না? এত কন্ট্রোলে রাখিস তোরা, তারপরেও এই অবস্থা?”
বিম্বিসার চুপ করে খোঁচাটা হজম করলেন। তবে তথাগত ভুল তো কিছু বলেন নি। ছোট্ট তাতান কবে যে বড় হয়ে গেল, খেয়ালই করতে পারেন নি। বিভাবরীর থেকে কথাটা শোনার পর থেকে অন্য কিছু ভাবতে পারছেন না। অস্থির লাগছে। মেয়েটাকে যতক্ষণ না সামনে দেখতে পাবেন, মাথা কাজ করবে না।
বিম্বিসার বললেন, “তাতানের ছবি পাঠাচ্ছি। তুই যেভাবে হোক ওখানে এই ডেসক্রিপশনের কাউকে পেলে আমাকে জানা। মেয়েটা কোথায় আছে, কিছুই বুঝতে পারছি না”।
তথাগত বললেন, “এখনো উদ্ধারকাজ ঠিক করে শুরু হয় নি রে। একেকটা বাস, ট্যাক্সি সব কংক্রিটের চাইয়ের তলায় চাপা পড়ে গেছে। আর ঈশ্বর করেন, যদি এর মধ্যে না থাকে, তাহলে তুই চিন্তা করিস না। আমি সব থানায় খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমাদের ল্যান্ডলাইনগুলো কোন কারণে আউট অফ অর্ডার হয়ে গেছে। শুধু ওয়্যারলেসগুলো চলছে। টেলিফোন কোম্পানির লোকজন কাজ করছে। স্টেডি হয়ে যাবে আশা করি। আপাতত মাথা ঠান্ডা রাখ”।
বিম্বিসার ফোন রেখে দেখলেন পাশের সিটে সুপ্রিয় চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে আছেন।
তাকে ফোন রাখতে দেখে বললেন, “তাতানের ছেলে বন্ধু ছিল, তুই জানতিস না?”
বিম্বিসার বললেন, “আজকালকার দিনের ছেলেমেয়েদের বয়ফ্রেন্ড বা গার্ল ফ্রেন্ড আছে নাকি, সেটা বোঝা কি এতই সোজা? আমাকে না বললে আমি কী করে জানব? আর ছেলে বন্ধু থাকলেই যে সে লাভার হয়ে যাবে, সেটা বোঝা বাবা মায়েদের পক্ষে অসম্ভব। যুগটা পাল্টেছে।”
সুপ্রিয় বললেন, “রাতে বাড়ি ফেরার ব্যাপারে নিয়ম চালু করিস নি কেন? আমাদের সময় আমরা সন্ধ্যে ছ’টার পর বাড়িতে ঢুকলে কপালে লাঠির বাড়ি জুটত”।
বিম্বিসার বললেন, “জোর করে এই জেনারেশনকে আটকানো যায় না। এখন মোবাইলের যুগ ভুলে যাস না”।
সুপ্রিয় বললেন, “তাতে লাভ কী হয়? তাতান এখনো আমার ফোন সব সময় ধরে না। জানি না কোন বিষ ঢুকেছে ওর মনে”।
বিম্বিসার বললেন, “সে তো আমার ফোনও ধরে না। ক্লাসে বা সেমিনারে থাকলে কী করে ফোন ধরবে”?
সুপ্রিয় বললেন, “কিংবা প্রেম করলে! টিনেজ প্রেগনেন্সি কীভাবে দেশে বাড়ছে, তোর কোন আইডিয়া আছে?”
বিম্বিসার অনেক কষ্টে মাথা ঠিক রাখলেন। বললেন, “আমাদের মেয়ে ওসব করে নি। দয়া করে তুই এসব কথা বন্ধ কর”।
গাড়ি স্টার্ট দিলেন তিনি।
গাড়ির এফ এম চালু হল। ফ্লাইওভারের দুর্ঘটনার ধারাবিবরণী চলছে।
বিভাবরী বললেন, “প্লিজ বন্ধ কর। শোনা যাচ্ছে না”।
বিম্বিসার বললেন, “কিছু করার নেই। এর থেকেও যদি কিছু জানা যায়, তাই শুনে যেতেই হবে”।
বড় রাস্তার ক্রসিংয়ে তুমুল জ্যাম। বিভাবরী বললেন, “মেয়েটা যেন জ্যামে আটকে থাকে ঠাকুর। আমরা যেন সব থেকে খারাপটাই ভাবছি। মেয়েটার যেন কোন ক্ষতি না হয়”।
বিম্বিসার সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছিলেন।
সুপ্রিয় বললেন, “এখানেও মেট্রোর ফ্লাইওভারের কনস্ট্রাকশান চলছে। কোন দিন না এই ফ্লাইওভারও ভেঙে পড়ে”।
বিম্বিসার লুকিং গ্লাসে বিভাবরীকে দেখলেন। তীব্র অপরাধবোধে ভুগছেন বিভাবরী। সুপ্রিয় এলে বিভাবরী গুটিয়ে যান। তাদের মেয়ে যে আসলে অন্য কারো সন্তান, ভাবলে সিঁটিয়ে যান।
সুপ্রিয় বললেন, “ছেলেটা কী করে?”
বিভাবরী বলল, “তাতানদের সঙ্গেই পড়ে”।
সুপ্রিয় বললেন, “মানে ওরই বয়সী। স্বামী স্ত্রীর বয়সের ডিফারেন্স হওয়া উচিত কম করে পাঁচ বছর। কোত্থেকে এসব সম্পর্কে জড়ায় এরা কে জানে। বয়স কম, নিজেরা নিজেদের রোমিও জুলিয়েট ভেবে বসে আছে। ছোট থেকেই মাথায় ইনজেক্ট করে দিতে হয়, সমবয়সীদের সঙ্গে প্রেম করব না”।
বিম্বিসার বললেন, “তুই একটা ডায়েরীতে লিখে দিয়ে যাস কী কী ইনজেক্ট করতে হবে। আমি করে দেব”।
সুপ্রিয় বললেন, “মেয়েটা ফিরুক। সব করে দেব। চিন্তা করিস না”।
বিম্বিসার বললেন, “নেগেটিভ ভাবছিস কেন? ফিরবে না কেন? তোর কি মাথা টাথা একবারে গেছে?”
সুপ্রিয় বললেন, “আমার কিছু ভাল লাগছে না। তাতান ছাড়া আমার কে আছে বল?”
বিম্বিসার বললেন, “আমাদেরও তাতান ছাড়া কেউ নেই। দয়া করে চুপ কর। মাথা ঠান্ডা কর”।
সুপ্রিয় “বেশ” বলে চুপ করে গেলেন।
৯।
“যযাতি। আমার মেয়েটাকে দেখো। আমি হয়ত বেশিদিন আর…”
মাস্টারমশাই কেঁদে ফেলেছিলেন কথাটা বলে। ক্যান্সারে ভুগছিলেন।
সুভদ্রা ছিলেন না সেদিন।
যযাতির সামনে পরীক্ষা।
কথাটা শুনে বাড়ি ফিরে সারারাত আর ঘুমোতে পারেন নি যযাতি। চাকরি বাকরি নেই। বিয়ে করে ফেললেও বউকে তো খাওয়াতে হবে! কী খাওয়াবেন? মাস্টারমশাই দেখতে বলছেন মানে কি বিয়ে করতে বলছেন? কিছু কি বুঝে গেছেন? নাকি সুভদ্রা বলে দিয়েছেন তার বাবাকে সবটা? যদি বলে থাকেন, কেন বলবেন? তাদের তো একসঙ্গে বলার ছিল!
ভোরবেলা উঠে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ছিলেন যযাতি। শেষ মেশ ঠিক করলেন কিছুতেই আর সুভদ্রার মুখোমুখি হবেন না। স্বার্থপর হতে হবে।
ও বাড়িতে যাবেন না আর কিছুতেই। জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না।
সুভদ্রা নিশ্চয়ই কাউকে না কাউকে পেয়ে যাবে।
মাস্টারমশাই মারা গেছিলেন খবর পেয়েছিলেন। যযাতি আর সে বাড়িটার ধারে কাছে যান নি।
চাকরির কাগজটা নিয়ে বাড়িটার কাছে গিয়েও পালিয়ে গেছিলেন তিনি। সাহস হয় নি অতদিন পরে সুভদ্রার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর।
হয়ত বিক্রি হয়ে গেছে বাড়িটা। অন্য কেউ আছে। ঠিকানাটা তো চেনা। একবার গিয়েই দেখা যাক ভেবে হাঁটছিলেন যযাতি।
তাতান দু বার বিশ্রাম নিল রাস্তায়। বলল, “আর জীবনেও মার অবাধ্য হব না আমি। সত্যি সত্যি সত্যি। তিন সত্যি। প্রশ্নই আসে না অবাধ্য হবার”।
অনেকদিন পরে বাড়িটার দরজার সামনে দাঁড়ালেন তিনি।
তাতান বলল, “আপনার চেনা? উফ, বাঁচালেন। হেঁটে হেঁটে অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। আমার পা ব্যথা করছে। আমি আর কোথাও যেতে পারবো না”।
মেয়েটা সত্যিই অনেকটা পথ হেঁটেছে। তার হাঁটার অভ্যাস আছে। মাইলের পর মাইল হাঁটতে পারেন তিনি।
আজকালকার ছেলে মেয়েরা ওজন কমানোর কারণ না থাকলে এত হাঁটে না। অথচ হেঁটে আবিষ্কার করার মত কত কিছু আছে।
বাড়িটা একই রকম আছে। খুব বেশি পাল্টায় নি।
কলিং বেল বাজাতে যে দরজা খুললেন, তাকে দেখে যযাতির হার্ট বিট মিস করল।
কী আশ্চর্য!
সুভদ্রা!?
বিয়ে করে নি? একা একাই থেকে গেল? একের পর এক প্রশ্ন মাথায় আসতে শুরু করলেও যযাতি কিছু বললেন না।
পৃথিবীতে এভাবেই হয়ত সব বৃত্তেরা এসে কোথাও মিলে যায়।
যযাতি অপ্রস্তুত ভঙ্গীতে বললেন “ভাল আছো?”
সুভদ্রা তাতানকে দেখলেন। তাতান মাটিতেই বসে পড়েছে।
জিজ্ঞাসু চোখে যযাতির দিকে তাকালেন সুভদ্রা।
যযাতি বললেন, “ওর নাম তাতান। বেহালায় থাকে। ব্রিজ ভেঙেছে বলে বাড়ি যেতে পারছে না। ওকে পৌঁছতেই যাচ্ছিলাম…”
যযাতি চুপ করে গেলেন।
সুভদ্রা তাতানকে ধরে তুললেন, “এসো”।
যযাতি সুভদ্রার দিকে এক বার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলেন।
সুভদ্রা যযাতিকে বললেন, “ইচ্ছে হলে এসো”।
সেই হল ঘর। তাকে তাকে বই।
তাতান দেখে বলল, “ওরে বাবা। কত বই! উফ!!!”
সুভদ্রা তাতানকে যত্ন করে বসালেন।
যযাতি ঘরে ঢুকে তাতানকে বললেন, “তোমার ফোনটা ওকে দাও। ফোনটা চার্জ করে বাড়িতে ফোন কর”।
তাতান বলল, “ঠিক ঠিক। এখনই দিচ্ছি”।
ব্যাগ থেকে ফোন বের করে সুভদ্রাকে দিতে গিয়ে চমকে উঠল, “এ বাবা”।
যযাতি দেখলেন ফোনের স্ক্রিণটা ভেঙে বেরিয়ে গেছে।
তাতান কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “স্কাউন্ড্রেলটার সঙ্গে ঝগড়ার সময় ফোনটা পড়ে গেছিল। দেখিনি”।
সুভদ্রা যযাতির দিকে তাকালেন, “কোন স্কাউন্ড্রেলটা?”
তাতান তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা শুরু করল, “আমার একটা বয়ফ্রেন্ড ছিল বুঝলেন? আমাকে ডিচ করেছে। একদম জঘন্য একটা ছেলে। জেলে দেওয়া উচিত”।
সুভদ্রা তাতানের কাঁধে হাত রাখলেন, “ওহ। ঠিক আছে, অনেক ছেলেই এমন হয়। তোমার বাবা মাকে খবর দাও নি?”
তাতান বলল, “না তো। কী হবে এবার? আমি কী করে ফিরব?”
জানলার বাইরে হুটারের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সি এম যাচ্ছেন। রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
সুভদ্রা যযাতির দিকে তাকালেন, “কী প্ল্যান ছিল?”
যযাতি বললেন, “প্রথমে ভেবেছিলাম ট্যাক্সিতে তুলে দেব। পরে ভেবে দেখলাম একা ছাড়া ঠিক হবে না। বাড়ি দিয়ে আসতে গেছিলাম। রাস্তায় আটকে গেলাম”।
সুভদ্রা বললেন, “কারো কিছু খাওয়া হয় নি নিশ্চয়ই?”
তাতান বলল, “তাই তো! খাবার কথা একবারও ভাবি নি। আমার খিদেও পেয়েছে খুব”।
সুভদ্রা বললেন, “দেখছি”।
রান্নাঘরের দিকে রওনা দিলেন সুভদ্রা।
যযাতি চুপ করে বসে রইলেন। প্রবল একটা অস্বস্তি হচ্ছে। বুঝতে পারছেন এখানে চলে আসাটা একবারে উচিত হয় নি। কিছু করারও ছিল না। রাস্তাঘাটের অবস্থা ভাল নয়। এক দিকে ঝামেলা লেগে গেছে। মেয়েটাকে নিয়ে কোথায় যেতেন? এখানে না এলে সমস্যা আরো বেড়ে যেত। সামলানো যেতো না।
এক একটা দিন এমন আসে, যখন চেনা শহরটাও অচেনা হয়ে যায়।
মানুষ তো দূর, জড় বস্তুগুলোকেও অচেনা মনে হয়।
কয়েক মিনিট পর সুভদ্রা এসে বললেন, “ভাত বসিয়ে দিয়েছি। থানা সহ বেশ কয়েক জায়গায় ফোন করলাম। কোথাও যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। টোটাল ম্যাসাকার চলছে। তবু দেখছি কিছু করা যায় কিনা। আপাতত ক্রিম ক্র্যাকার চলবে?”
বিস্কুটের টিনটা তাতানের দিকে এগিয়ে দিলেন সুভদ্রা।
তাতান ক্ষুধার্তের মত বিস্কুটের কামড় দিল।
১০।
রেড জোনের তিন কিলোমিটার আগে রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ।
গাড়ি পার্ক করারও জায়গা নেই।
বিম্বিসার তথাগতকে বার বার ফোন করছেন। ফোন পাওয়া যাচ্ছে না।
সুপ্রিয় ছটফট করছিলেন। মিনিট পাঁচেক পর বললেন, “আমি যাচ্ছি”।
দরজা খুলে নেমে দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করলেন সুপ্রিয়।
বিভাবরী বললেন, “কী করব? যাব?”
বিম্বিসার রাগী গলায় বললেন, “কোথাও যেতে হবে না। যেতে দাও ওকে। সারাজীবন তো কোন কম্ম করল না। এখন অধিকার ফলাতে এসে গেছে”।
বিভাবরী বললেন, “তুমি এরকম করে বলছো কেন? তাতান তোমার মেয়ে না?”
বিম্বিসার বললেন, “তুমি আমাকে একবারও বলবে না তাতান কার না কার সঙ্গে কী করে বেড়াচ্ছে? মানে একবারও মনে হল না এইটুকু মেয়ে এসব করে বেড়াবে আর আমাকে ইনফর্ম করা দরকার?”
বিভাবরী বললেন, “আমি ভাবতে পারি নি যে ও টিউশন ফাঁকি দিয়ে এত দূর চলে যাবে”।
এফ এম বন্ধ করলেন বিম্বিসার। একদল চ্যাংড়া টাইপের ছেলে নিজেদের মধ্যে গালাগাল দিতে দিতে তাদের গাড়ি পেরোল।
কেউ মজা দেখতে এসেছে, কারো বা স্বজন বিয়োগ হয়েছে। গাড়িগুলোকে পুলিশ অন্য রাস্তায় ঘুরিয়ে দেওয়া শুরু করেছে। লাঠি পড়ছে গাড়িতে।
গাড়ি ঘুরছে। একজন সিভিক পুলিশ গাড়ির কাছে এসে চিৎকার করল, “গাড়ি ঘুরিয়ে নে, ওদিকে যাওয়া যাবে না”।
বিম্বিসার রেগে গেলেন, “এই, তোর বাপের বয়সী আমি, তুই তোকারি করছিস কেন?”
সিভিক পুলিশ ঝামেলায় গেল না। বলল, “গাড়ি ঘুরিয়ে নিন, যাওয়া যাবে না”।
বিম্বিসার বললেন, “আমি এখানে গাড়ি রাখব। আমার মেয়ে আটকে আছে”।
সিভিক পুলিশ বলল, “এখানে নো পার্কিং আছে। দূরে গাড়ি রেখে আসুন”।
বিম্বিসার বললেন, “দূর মানে?”
সিভিক পুলিশ বলল, “দেড় দু কিলোমিটার”।
বিম্বিসার রাস্তার বাঁ দিকে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিয়ে বিভাবরীকে বললেন, “নামো তো”।
সিভিক পুলিশ দৌড়ে এল। বলল, “কী হল?”
বিম্বিসার বললেন, “গাড়ি এখানেই থাকল। ক্রেন দিয়ে নিয়ে যাওয়ার হলে নিয়ে যেও। আমি কোথাও যেতে পারছি না। ইয়ার্কি হচ্ছে? আমার মেয়ের কী হয়েছে আমি জানি না, আর এখানে নিয়ম দেখাচ্ছে!”
সিভিক পুলিশ বলল, “আপনি গাড়িটা পিছনে রেখে আসুন। এখানে ঝামেলা হবার চান্স আছে। এত গাড়ি বেরোবে। অন্যের অসুবিধা হবে”।
বিম্বিসার বললেন, “হোক। থাকল গাড়ি। এই চল”।
বিম্বিসার হাঁটতে শুরু করলেন। তার পিছনে বিভাবরী।
সিভিক পুলিশ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
সুপ্রিয়কে দেখা গেল না।
অনেকটা এগিয়ে গেছে।
বিম্বিসার অফিস করে, এতটা ড্রাইভ করে ক্লান্ত হলেও হেঁটে যাচ্ছেন।
বিভাবরী পিছিয়ে পড়ছেন।
বিম্বিসার ভ্রুক্ষেপ করছেন না।
কিছুক্ষণ পরে যখন বিভাবরী অনেকটা পিছিয়ে গেলেন, বিম্বিসার দাঁড়ালেন। বললেন, “একটাই অ্যাফেয়ার তো? আর ছিল না তো? এখন এদিক সেদিক গাদা গুচ্ছের হোটেল হয়েছে। সেখানে যায় না তো?”
বিভাবরী থমকে দাঁড়িয়ে বিম্বিসারকে দেখলেন, “সেটা জানি না”।
বিম্বিসার রাস্তার মধ্যেই চিৎকার করে উঠলেন, “কী জানো তবে? মা হয়েছো আর এটা জানো না? মা হওয়া এত সোজা? আমারই ভুল হয়েছিল তাতানকে নিয়ে আসা। তুমি অপদার্থ, সুপ্রিয় এখন বাবা হয়ে গেছে, আর আমাকে এগুলো চোখের সামনে দেখে যেতে হবে”।
রাস্তার বাকিরা তাদের দেখছে।
বিভাবরী আর নিতে পারলেন না। কেঁদে ফেললেন।
বিম্বিসার বিভাবরীর হাত ধরে টানলেন, “চল। দাঁড়িয়ে থেকো না। আমার মাথা যে কোন মুহূর্তে ফেটে বেরিয়ে যাবে। আমি আর নিতে পারছি না”।
বিভাবরী কেঁদে উঠলেন, “প্লিজ ছাড়ো আমায়। আমার লাগছে”।
বিম্বিসার হাত ছেড়ে দৌড়তে শুরু করলেন।
সুপ্রিয় অনেকটা এগিয়ে গেছে। এতদিন পর পর এসে মেয়ের উপর অধিকার ফলাবে? কতটা এগিয়েছে?
জল দিচ্ছে রাস্তার পাশে। বিম্বিসার জলের পাউচ নিয়ে নিজের মাথায় ঢেলে দিলেন।
সবাই হাঁ করে তার দিকে তাকাচ্ছে। বিভাবরীও।
এতদিনের ঠান্ডা মাথার মানুষটা পাল্টে গেছে।
অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলেন বিম্বিসারের দিকে।
১১।
একটা পুরনো ম্যাগাজিন পড়ে আছে টেবিলের উপরে।
“শ্রুতকীর্তি”।
যযাতি চিনতে পারলেন।
বইটার দুটো ইস্যু বেরিয়েছিল। দুটোতেই তিনি প্রবন্ধ লিখেছিলেন।
একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন বঙ্কিমের লেখায় সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব নিয়ে। দ্বিতীয়টা মুঘল যুগ কেন ভারতবর্ষের উপর আশীর্বাদের মত এসেছিল, তা নিয়ে। সুভদ্রার সঙ্গে রীতিমত তর্ক বেঁধে যেত।
সেদিন মাস্টারমশাই বেরিয়েছিলেন কোথাও। যযাতি এসে দেখলেন সুভদ্রা একটা খাতায় হিজিবিজি কেটে যাচ্ছে।
তাকে দেখে বললেন, “একটা ম্যাগাজিনের নাম বল তো”।
যযাতি বললেন, “কত নাম আছে। বাজার চলতি ম্যাগাজিনগুলো তো মাস্টারমশাই সবই রাখেন”।
সুভদ্রা রেগে গেলেন, “ধুস, সেসব কে বলেছে? আমি বলছি নতুন কোন নাম বলতে”।
যযাতি বললেন, “কী করবে নতুন নাম দিয়ে?”
সুভদ্রা হাসলেন, “একটা নতুন ম্যাগাজিন করব। নামই ঠিক করতে পারছি না। একটা ভাল নাম চাই বুঝলে?”
যযাতি বললেন, “শ্রুতকীর্তি নামটা ভাল?”
সুভদ্রা লাফিয়ে উঠলেন, “দারুণ। এখনই ভাবলে?”
যযাতি বললেন, “হ্যাঁ। হঠাৎ করেই মাথায় এল?”
সুভদ্রা তাড়াতাড়ি নামটা লিখে বললেন, “এটাই বেস্ট। এটাই থাক। মাথা বটে তোমার এক খানা। সব সময় আইডিয়ার চাষ চলছে”।
যযাতি বললেন, “না না সেসব কিছু না। এমনি মাথায় এল”।
সুভদ্রা বললেন, “কিছু খেয়ে এসেছো? নিশ্চয়ই দুপুরে খাওয়া হয় নি? সোজা কলেজ থেকে চলে এসেছো?”
যযাতি বললেন, “মুড়ি খেয়েছি তো। অসুবিধা নেই”।
সুভদ্রা বললেন, “ওরে বাবা। বিরাট খাবার তো! মুড়ি! চল, চল, ভাত দিচ্ছি, খেয়ে নাও”।
ডাইনিং টেবিলে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গেলেন তাকে সুভদ্রা।
ডাল, ছোট মাছের ঝাল, ভাত।
যযাতি বললেন, “তোমাদের জন্য আছে তো?”
সুভদ্রা বললেন, “হ্যাঁ। কেন থাকবে না? না খেয়ে ঘুরে বেড়াবে, একবার বলতে পারো না?”
যযাতি চুপ করে গেলেন।
চেয়ে চিন্তে খেতে কোন কালেই পারেন না।
সুভদ্রা তার দিকে তাকিয়ে আছেন। যযাতি চুপ করে খেয়ে যাচ্ছেন। বললেন, “রান্না খুব ভাল হয়েছে। তুমি করেছো?”
সুভদ্রা বললেন, “এটা এমন কিছুই রান্না নয়। তুমি বাড়িয়ে বোল না তো”।
যযাতি বললেন, “আর কী কী পারো?”
সুভদ্রা বললেন, “অনেক কিছু পারি। পোস্ত বড়া করে খাওয়াবো একদিন। আচ্ছা শোন না। ম্যাগাজিনে কে কে লিখবে? বাবা বলল বড় লেখক না, যারা নতুন লিখছেন, তাদের খুঁজে খুঁজে বের করতে হবে। ম্যাগাজিনে শুধু তারাই লিখবেন। তুমি কাউকে চেনো?”
যযাতি খেতে খেতেই ভাবতে শুরু করলেন…
#
“খাবার দিয়েছি”।
সুভদ্রার কথায় ফ্ল্যাশব্যাকটা কেটে গেল যযাতির।
তাতান মন দিয়ে একটা বই পড়ছিল।
যযাতি বললেন, “তাতান। খেয়ে নেবে চল”।
তাতান উঠল, “হ্যাঁ। খুব খিদে পেয়েছে সত্যি”।
সেই টেবিল। ডাইনিং রুমের কিছু কিছু জিনিস পাল্টেছে। বাকি সব কম বেশি একই আছে।
আলুসেদ্ধ, ডিমসেদ্ধ, আর ভাত।
তাতান লাফিয়ে উঠল, “ঈশ, আমার ফেবারিট”।
যযাতি ইতস্তত করছিলেন।
সুভদ্রা বললেন, “বস। খেয়ে নাও”।
যযাতি বসলেন।
তাতান সুভদ্রাকে বলল, “একটু মেখে দেবে? আমি গরম ভাত মাখতে পারি না। মা মেখে দেয়”।
সুভদ্রা হেসে হাত ধুয়ে এসে ভাত মেখে দিলেন। বললেন, “মাখন দিই?”
তাতান ঘাড় নাড়ল, “দাও”।
সুভদ্রা ফ্রিজ থেকে মাখন বের করে দিলেন।
যযাতি মাথা নিচু করে খেতে শুরু করলেন।
সুভদ্রা যযাতিকে বললেন, “তুমি মাখন নেবে?”
যযাতি বললেন, “নাহ”।
সুভদ্রা বললেন, “কোলেস্টেরল বাঁধিয়েছো নাকি?”
যযাতি বললেন, “না না। আমার ওসব নেই। সকালে উঠে হাঁটি। ফিট আছি”।
সুভদ্রা বললেন, “তা ঠিক। তুমি আত্মসুখী মানুষ বরাবরই”।
যযাতি গুটিয়ে গেলেন। সুভদ্রার কথার তীর যে তার অভিমুখেই, সেটা বুঝতে ভুল হল না তার।
সুভদ্রা বললেন, “থানার ফোনে কোন সমস্যা হচ্ছে। বুঝতে পারছি না কী ব্যাপার। ফোন পাওয়া গেলে অন্তত তাতানের বাড়ির লোক খবর পেয়ে যাবেন। তোমার ফোন নেই?”
তাতান বলল, “উনি ফোন ইউজ করেন না। সবার নাম্বার মুখস্ত রাখেন। ওর মাথাটাই ফোন বুক। উনি একজন লিজেন্ড। ওর কথা বন্ধুদের বলতে হবে”।
সুভদ্রা সামান্য হেসেই হাসিটা লুকিয়ে ফেললেন, “লিজেন্ডই বটে”।
যযাতি তড়িঘড়ি কী বলবেন ঠিক করতে না পেরে বললেন, “অফিস টাইমে ফ্লাইওভার ভেঙে পড়ল। কী ভয়ংকর! ওদিকে তোমার কোন কাজ ছিল না তো?”
সুভদ্রা বললেন, “থাকলে খুশি হতে”?
তাতান খাওয়া থামিয়ে সুভদ্রার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বলল, “তুমি দেখি আমার মার মত কথা বল। মাও বাবাকে এভাবে টন্ট করে। তোমার কে হয় গো?”
সুভদ্রা তাতানের মাথায় হাত বুলিয়ে যযাতির দিকে তাকিয়ে বললেন, “কেউ না”।
১২।
রথের মেলার মত ভিড় হয়ে গেছে। পুলিশ ব্যারিকেড দিয়েও সামাল দিতে পারছে না। বিম্বিসার ব্যারিকেডের কাছ অবধি এগিয়ে গেলেন।
বিরোধী দলের লোকেরা এসে স্লোগান দিচ্ছে।
বিম্বিসার তথাগতকে আরেকবার ফোন করার চেষ্টা করলেন।
পাওয়া গেল না।
নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না।
সামনে ভয়াবহ ধ্বংসাবশেষ। বিভাবরী বিম্বিসারের হাত ধরলেন, বিম্বিসার হাত ছাড়িয়ে নিলেন।
বিভাবরী বললেন, “তুমি রেগে যাচ্ছো কেন?”
বিম্বিসার বললেন, “কী করব এখন আমি? এখান থেকে কাউকে উদ্ধার করা সম্ভব?”
হঠাৎ সুপ্রিয় দৌড়ে এসে বিম্বিসারকে ধাক্কা মারলেন, বিম্বিসার প্রস্তুত ছিলেন না। পড়ে গেলেন রাস্তার একজনের গায়ে। সুপ্রিয় চিৎকার করতে শুরু করলেন, “একটা কাজ নিয়েছিলি, সেটাও ঠিক করে করতে পারলি না। আমার মেয়েটার যদি কিছু হয়, তোকে আমি ছাড়ব না। মেরে ফেলব দেখিস”।
বিভাবরী সুপ্রিয়র এই রূপ দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন।
সুপ্রিয়কে কেউ আটকাল না। সুপ্রিয় ছুটে গিয়ে বিম্বিসারকে আবার মারতে গেলেন। বিম্বিসার এবার সুপ্রিয়কে আটকে পালটা আক্রমণ করলেন। সজোরে ঘুষি মারলেন সুপ্রিয়র মুখে।
সুপ্রিয়র নাক মুখ দিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করল।
বিম্বিসার বললেন, “জানোয়ার! বিয়ে করার পর নিজের বউকে দেখলি না ঠিক করে, মেয়েটাকে আমাদের উপর দিয়ে এদিক সেদিক ঘুরে এলি, এখন দখলদারি দেখানো হচ্ছে? তোর এত সাহস তুই আমার গায়ে হাত তুলিস?”
বিভাবরী বিম্বিসারের হাত ধরতে এলেন, “কী করছো তুমি? এরকম করছো কেন?”
কেঁদে ফেললেন বিভাবরী।
কাছে থাকা পুলিশেরা এগিয়ে এলেন, “কী হচ্ছে এখানে?”
বিভাবরী বললেন, “আমাদের মেয়ের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না”।
অফিসার বললেন, “তা বলে আপনারা এখানে মারপিট করবেন নাকি? চলুন। এদিকে আসুন আপনারা দুজন”।
বিম্বিসার হাত তুললেন, “দেখুন অফিসার, আমার মেয়ে নিখোঁজ, এখন আমাকে একা ছেড়ে দিন”।
অফিসার কোন দিকে না তাকিয়ে সরাসরি বিম্বিসারের পায়ে লাঠিচার্জ করলেন, “ইয়ার্কি হচ্ছে? আমাদের এমনিতেই ফেটে হাতে চলে এসেছে, তুই আমাকে অর্ডার দিবি? চল, চল, সাইড হ”।
জনগণ মজা দেখছিল।
সুপ্রিয় রাস্তায় বসে পড়ে হাঁফাচ্ছিলেন।
এবার চিৎকার করে উঠলেন, “তুই একটা জানোয়ার। একটা অমানুষ। আমি জানি, আমি যখন থাকতাম না্, তুই নিয়মিত তৃণার সঙ্গে দেখা করতে যেতিস। চরিত্রহীন!”
বিম্বিসারের পায়ে লেগেছিল, সে অবস্থায় তেড়ে যাচ্ছিলেন।
অফিসার বললেন, “দুটোই চল। চল চল। এখানে থাকলে ঝামেলা হবেই”।
বিভাবরী বললেন, “প্লিজ স্যার, আমাদের মেয়েকে খুঁজে পাচ্ছি না। টেনশনে ওরা এরকম করছেন। প্লিজ”।
অফিসার বাকিদের বললেন, “এই জায়গা খালি কর। ব্যারিকেড আরো পিছিয়ে দাও। আর এ দুজনের উপর নজর রাখো। কোন রকম ন্যুইসেন্স ক্রিয়েট করলে সঙ্গে সঙ্গে অ্যারেস্ট করবে। এত বড় একটা মিস হ্যাপ হয়ে গেছে, আর এরা রাস্তাঘাটকে বাড়ি পেয়েছে। চল”।
বিম্বিসারকে দূরে নিয়ে যাওয়া হল।
সুপ্রিয় হাঁফাচ্ছিলেন। বিভাবরীকে বললেন, “আমার মেয়ের কিছু হলে তোমাদের কাউকে আমি ছাড়বো না, মনে রেখো। বিভাবরী বিম্বিসারের দিকে তাকালেন। এই বিম্বিসারকে তিনি চিনতে পারছেন না। কিংবা পারছেন।
সন্তানের জন্য একটা সময় একটার পর একটা ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে এরকম মুখই থাকত বিম্বিসারের।
সব হারানো একটা মুখ।
মেয়েটাকে আঁকড়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন।
বিভাবরী কাঁদছিলেন। তারই দোষ।
কেন তাতানকে এত স্বাধীনতা দিয়েছিলেন তিনি? আগেই ছেলেটার ব্যাপারে বিম্বিসারকে বলা উচিত ছিল।
মা মেয়ে খুনসুটি চলত। মেয়ে বলত, বিভাবরী শুনতেন। কখনোই ভাবেন নি মজা থেকে ব্যাপারটা তাকে এই রাতে পৌঁছে দেবে। অসহায় এবং অভিশপ্ত একটা রাত। চারদিকে শুধু মানুষ আর হাহাকার। বিম্বিসার মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। সুপ্রিয় একা একা বিড় বিড় করে চলেছেন।
সুপ্রিয় বললেন, “আমার উচিত ছিল কোথাও না যাওয়া। শুধু মেয়েটাকে মানুষ করা। আমার ভুল। সব আমার ভুল। পালিয়ে গেছি সারা জীবন নিজের সন্তানের থেকে। ছি ছি, আমার জন্য আজ মেয়েটা… ভুল করেছি। বিরাট ভুল করেছি”।
বিভাবরী দেখলেন বিম্বিসার ফোন বের করেছেন। বার বার কাঁপা কাঁপা হাতে কারো একটা ফোন চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিছুতেই পাচ্ছেন না শত চেষ্টা করেও…
১৩।
“বাইরে অবস্থা ভাল না। ঝামেলা বাড়ছে। ফোনও পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। তাতান, তুমি আমার খাটে শুয়ে পড়। আমার মনে হয় আরেকটু রাত বাড়লে ফোন পাওয়া যাবে”।
সুভদ্রা বললেন।
তাতান বলল, “কাল থেকে আমার কাজ হবে আংকেলের মত সবার নাম্বার মুখস্ত করা। আর ফোন বুকের হেল্প নেব না”।
সুভদ্রা বললেন, “তাই নাকি? তোমার আংকেলের বুঝি সবার নাম্বার মুখস্ত? জিজ্ঞেস কর তো এই বাড়ির ল্যান্ডলাইনের নাম্বার কী ছিল?”
তাতান যযাতির দিকে তাকাল, “কী ছিল? পারবেন?”
যযাতি বই পড়ছিলেন। কারো দিকে না তাকিয়েই ল্যান্ডলাইনের নাম্বারটা বলে দিলেন।
তাতান সুভদ্রাকে বলল, “ঠিক বললেন?”
সুভদ্রা ঘাড় নাড়লেন, “তা ঠিকই বলেছেন। নাম্বারটুকু মনে রেখেছেন ফোন করাটুকু বাদ দিয়ে”।
তাতান বলল, “আমি একটা দারুণ লাভ স্টোরির গন্ধ পাচ্ছি। সত্যি করে বলবেন, আপনারা দারুণ জুটি ছিলেন, তাই না? তারপর হেব্বি ঝগড়া হল, ব্রেক আপ হয়ে গেল। সারাজীবন আর দেখা হল না। ঈশ! হাউ প্যাথেটিক”।
যযাতি তাতানের কথার উত্তর না দিয়ে বললেন, “তুমি ঘুমিয়ে পড়। আমি দেখছি কোথাও ফোন পাওয়া যায় কি না।“।
তাতান বলল, “আমি কোথাও যাব না। গল্পটা না শুনে আমি নড়বই না”।
যযাতি বই রেখে তাতানের দিকে তাকালেন, “তোমার মনে হয় না তুমি অন্যদের পার্সোনাল স্পেসে ঢুকে যাচ্ছো? তোমার প্রায়োরিটি এখন বাড়ি ফেরা। বাড়ির লোককে খবর দেওয়া। আমাকে বা সুভদ্রাকে কাউকেই তুমি চেনো না, কেন শুধু শুধু একটা অশান্তি তৈরী করতে চাইছো?”
তাতানের চোখে জল চলে এল। এত রূঢ়ভাবে কেউ তার সঙ্গে কথা বলে না। যযাতি এভাবে কথা বলবেন, সে আশা করে নি। সে উঠে ভিতরের ঘরে চলে গেল।
সুভদ্রা রাগী গলায় বললেন, “এইটুকু মেয়ের সঙ্গে এভাবে না কথা বললেই হচ্ছিল না? নিজের ছেলে মেয়ের সঙ্গেও বুঝি তুমি এভাবেই কথা বল?”
যযাতি বললেন, “এতদিন পরে চোখে পড়ল, ম্যাগাজিনটায় আমার প্রবন্ধে দুটো বানান ভুল ছিল। তুমি প্রুফ চেক কর নি আমার লেখাটা? প্রুফের দায়িত্বে তুমি ছিলে। উচিত ছিল চেক করা”।
সুভদ্রা বললেন, “বেশ করেছি চেক করি নি। বিরক্তিকর শক্ত শক্ত ভাষা লিখে গেছো। পড়তে ইচ্ছেও হয় নি”।
যযাতি বললেন, “এই বাড়িতে ভূতের মত একা থাকো? ভয় লাগে না?”
সুভদ্রা বললেন, “সকালে আরতি দি আসেন। রাতটুকু একাই থাকি। অসুবিধা হয় নি। তাছাড়া একজন আমাকে এক কালে বলেছিল, ভূত বলে কিছু হয় না। সবই ভ্রম”।
যযাতি বললেন, “বিয়ে করলে না কেন?”
সুভদ্রা বললেন, “দরকার পড়ে নি। কারো কারো চলে যাবার পর গোটা পুরুষ জাতটার উপরেই বিশ্বাস উঠে যায়। বিয়ে করার কথা ভাবি নি তার পর থেকে”।
যযাতি বললেন, “আমাকে ক্ষমা করে দেওয়া যায় না”?
সুভদ্রা অবাক হবার ভাব করলেন, “ক্ষমা? কেন ক্ষমা করার কথা আসছে কেন?”
যযাতি বললেন, “আমি দোষী। আমার উচিত ছিল মাস্টারমশাইয়ের দেওয়া দায়িত্ব পালন করা। আমি করি নি। ভয় পেয়ে গেছিলাম”।
সুভদ্রা বললেন, “বাবাও যেমন! আমাকে অবলা ভেবেছিল! এদিকে নিজেই শিখিয়ে গেছিল মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হয়। পরনির্ভরশীল হতে নেই। শিখেছি তো। খুব ভালভাবে থাকি, যথেষ্ট ভাল চাকরি করি, আমার কাউকে দরকার পড়ে নি কোন দিন। দিব্যি আছি। তুমি এসব ভেবো না। দোষী নির্দোষের কিছু নেই। আমি জানতাম। তুমি অরুণাকে ভালবাসো। ওকেই বিয়ে করেছো?”
যযাতি অবাক চোখে সুভদ্রার দিকে তাকিয়ে বললেন, “না। এটা তোমাকে কে বলেছিল? আমি বিয়ে করি নি কোন কালে। তাছাড়া অরুণাকে কেন ভালবাসতে যাব?”
সুভদ্রার ঠোঁটের কোণে একটা হাসি এসে মিলিয়ে গেল, “ভেবেছিলাম। কাজ ছিল না তো একটা সময়। রাত জেগে জেগে ভাবতাম। ভেবেছিলাম ঠকিয়ে চলে গেছো। বিয়ে কর নি? রান্না কে করে দেয়?”
যযাতি বললেন, “হোটেলেই খাই। অফিসে ক্যান্টিনে”।
সুভদ্রা বললেন, “ঠিক সময়ে খাওয়া হয়? বয়স তো ভালই হয়েছে। অর্ধেকের বেশি চুল পেকে গেছে। লিভারের রোগ বাধিয়েছো?”
যযাতি বললেন, “পেট খারাপ হয় মাঝে মধ্যে। অফিস ছুটি নিয়ে শুয়ে থাকি। ক’টা দিন আর? এভাবেই একদিন চোখ বুজব”।
সুভদ্রা রাগী গলায় বললেন, “তা তো বলবেই। বরাবরের এসকেপিস্ট। পালিয়ে পালিয়ে যে বাঁচা যায় না, সেটা আজ বুঝতে পারলে? তাও ভাল, মেয়েটাকে রাস্তায় একা ছেড়ে পালাও নি। তোমার যা বোধ বুদ্ধি!”
যযাতি ম্লান হাসলেন, “বয়স বেড়েছে তো। বয়সজনিত রেসপন্সিবিলিটিটা বেড়েছে বলতে পারো। শ্রুতকীর্তি আর প্রকাশ পায় নি?”
সুভদ্রা বললেন, “নাহ। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হল যে। ম্যাগাজিন করা তখন বিলাসিতা হয়ে গেল”।
যযাতি বললেন, “আমি ভেবেছিলাম খুব বড় কোন বাড়িতে তোমার বিয়ে হয়েছে। খুব সুখে সংসার করছো”।
সুভদ্রা বললেন, “তোমার কাছে একটা মেয়ের সুখের সংজ্ঞা কী? বরের টাকায় বসে ঠ্যাঙের উপর ঠাং তুলে রাজা উজির মারা?”
যযাতি বুঝলেন সুভদ্রা রেগে যাচ্ছেন। বললেন, “একবার থানায় ফোন করে দেখবে? এখন যদি পাওয়া যায়?”
সুভদ্রা বললেন, “বেঁচে যাও না এখান থেকে বেরোতে পারলে?”
যযাতি বললেন, “মেয়েটার বাড়ির লোকের কথা ভেবে বললাম। আমি কিছু বলছি না”।
সুভদ্রা বললেন, “সেই তো। তোমার আর কীই বা বলার আছে। দেখছি। ফোনটা মনে হয় বেডরুমে রেখে এলাম”।
সুভদ্রা তার বেডরুমে গিয়ে দেখলেন তাতান গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়েছে।
কোন কারণ ছাড়াই তার চোখে জল চলে এল…
১৪।
পূর্ণিমা রাত।
কোপাইয়ের তীরে দুই পরিবার মিলে রিক্সা করে গেছে।
রিক্সাওয়ালারা বলে দিয়েছে বেশি রাত না করতে। সাপ খোপ থাকতে পারে।
তৃণার ইচ্ছে সারারাত থাকার। সুপ্রিয় কিছুতেই রাজি নয়।
ক্ষীণ জলধারা বয়ে যাচ্ছে।
তৃণা হতাশ গলায় বলল, “এটা নদী? ঈশ! কী আশা করে এসেছিলাম!”
সুপ্রিয় বলল, “তুমি কী আশা করেছিলে? এই হয়, শহরের মানুষকে নিয়ে এলে”।
তৃণা বলল, “আমি শহুরে মোটেও নই। মফস্বলের মেয়ে। শহুরে খোঁটায় আমার কিছু যায় আসে না। বিভাকে বলতে পারো”।
বিভাবরী বলল, “থাম তো। এদের খালি পেছনে লাগা”।
বিম্বিসার সিগারেট ধরিয়েছে। বলল, “সুপ্রিয়, বহুদিন কোন গান শোনাস না। আজকে একটা গান হয়ে যাক”।
সুপ্রিয় বলল, “ধুস, এই মাঠের মধ্যে কী গান গাইবো?”
বিম্বিসার বলল, “গা গা। তোর হোনেওয়ালা বাচ্চাও শুনতে চাইছে”।
সুপ্রিয় বলল, “আমার গান আসবে না এখন। তুই গা বরং”।
বিভাবরী বলল, “তাহলেই হয়েছে। ও হেঁড়ে গলায় গাইবে, তারপর যত ভূত প্রেত দত্যি দানো আছে, চারদিক থেকে ছুটে এসে আমাদের গিলে খাবে। তুমি গাও”।
তৃণা বলল, “তোমায় গাইতে বললেই দেখেছি তোমার অহংকার বেড়ে যায়। বেশি গাই গুই না করে গাও তো”।
সুপ্রিয় বিম্বিসারের থেকে সিগারেটের কাউন্টার নিয়ে গান ধরল, “আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে”।
তৃণাও গাইতে শুরু করল।
চারপাশে কেউ নেই।
বিম্বিসার বিভাবরীর হাত ধরে রইল অনেকক্ষণ।
সুপ্রিয়র গান শেষ হতেই সবাই হাততালি দিল।
একজন রিক্সাওয়ালা বলে উঠল, “বাবু, খুব ভাল লাগল”।
বিম্বিসার বলল, “আর কলকাতা যেতে ইচ্ছে করছে না। কী ম্যাজিকাল অ্যাটমোস্ফিয়ার, তাই না?”
তৃণা বলল, “ঠিক তাই। প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না। এখন কী ভাল লাগছে। আর একটা প্রাণ জুড়ানো হাওয়া বইছে। তোমরা অফিস ছেড়ে দিয়ে শান্তিকেতনে বাড়ি কেনো তো। বেশি কিছু চাই না। মোটা চালের ভাত খেয়ে কাটিয়ে দেওয়া যাবে”।
সুপ্রিয় বলল, “আর তোমার ট্যা-এর কী হবে? তিনি পারবেন মোটা চালের ভাত খেতে?”
তৃণা লজ্জা পেল, “চুপ কর তো। সব সময় ইয়ার্কি ভাল লাগে না”।
বিম্বিসার প্যান্টের পকেটে একটা ছোট বোতল লুকিয়ে এনেছিল। বের করে চুমুক দিয়ে বলল, “খাবি নাকি সুপ্রিয়?”
সুপ্রিয় বলল, “আহা। তোর মনে ছিল? বাঁচালি? তৃণা বেচারি খেতে পারবে না। আপাতত দেখো”।
বিভাবরী রেগে গেলো, “ঠিক লুকিয়ে লুকিয়ে নিয়ে এসেছো? এই জন্য ভাল লাগে না। তোমরা আর মানুষ হলে না”। সুপ্রিয় বিম্বিসারের থেকে বোতলটা নিয়ে চুমুক দিয়ে বললেন, “আহা। এই তো জীবন। এই তো বেঁচে থাকা”।
বিভাবরী তৃণাকে বলল, “চল। আমরা রিক্সায় গিয়ে বসি। গিলুক ওরা। মাঝে মাঝে মনে হয় আমাকে না, ও মদকে বিয়ে করেছে”।
বিম্বিসার কান ধরল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, ঘাট হয়েছে। আর খাবো না। রাগ কোর না প্রাণেশ্বরী, চাও কি আমি প্রাণেই মরি?”
বিভাবরী বলল, “মরণ”!
সুপ্রিয় আর বিম্বিসার দুজনেই হেসে উঠল।
#
বিভাবরী চাঁদ দেখলেন। এই রাতটাও পূর্ণিমা মনে হয়। তফাৎটা হল, এখন তৃণা নেই, বক্সিং রিঙে দুই যুযুধান প্রতিদ্বন্দ্বীর মত বিম্বিসার আর সুপ্রিয় একে অপরের থেকে দূরে বসে আছে।
মাঝখান থেকে কেটে গিয়েছে কতগুলো বছর।
বিম্বিসারের ফোন বাজছিল।
বিম্বিসার দেখলেন তথাগত ফোন করছেন।
তড়িঘড়ি ধরলেন, “হ্যালো। উফ, কী ব্যাপার, কিছুতেই ফোন পাচ্ছিলাম না”।
তথাগত বললেন, “কিছু প্রবলেম ছিল। সমস্যা আছে। আচ্ছা, যেটা বলছি, তাতানের ঐ বয়ফ্রেন্ডের ব্যাপারে কিছু জানা গেল? ব্যাটার নাম্বার পেলেও কিছু বের করা যেত কোথায় গেছিল ইত্যাদি”।
বিম্বিসার বললেন, “নাহ। আমি ছেলেটার ব্যাপারেই তো আজ জানলাম। কী বলব আর?”
তথাগত বললেন, “চিন্তা করিস না। ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কতক্ষণ আর এসব মাল পালিয়ে বেড়াবে?”
বিম্বিসার বললেন, “অন্য কাউকে দোষ দিচ্ছি না তো। আমাদের মেয়েই তো কিছু বলে নি। অন্যের ছেলেকে বলে কী হবে? হাসপাতালগুলোয় খোঁজ নিয়েছিস?”
তথাগত বললেন, “এখনো পর্যন্ত নিউজ নেগেটিভ”।
বিম্বিসার শ্বাস ছাড়লেন, “ঠিক আছে। আমি জানি না এখন কী করব। বাড়ি ফিরতেও ইচ্ছা করছে না”।
তথাগত বললেন, “বেশি ভাবিস না। তুই কি এসে গেছিস? কোথায় আছিস বল? আমি আসছি”।
বিম্বিসার বললেন, “ব্যারিকেডের এদিকেই আছি। সাউথের দিকে। তোদের এক অফিসার পায়ে লাঠি চার্জও করেছে”।
তথাগত বললেন, “সেকি? ওহ। টোটাল ক্যালাসনেস চলছে। আমি আসছি। ওয়েট কর”।
বিম্বিসার ফোন রাখলেন। একেকটা অ্যাম্বুলেন্স যাচ্ছে, সুপ্রিয় ভীত চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকছেন।
কতজন আহত, কতজন নিহত, কেউ কিছু বলতে পারছে না।
মৃত্যু মিছিল শুরু হয়েছে যেন…
ভিড় ঠেলে তথাগত উদ্ধার করলেন বিম্বিসারকে।
ব্যারিকেডের ভিতরে বিম্বিসার আর বিভাবরীকে নিয়ে গেলেন। সুপ্রিয় চিৎকার করছিলেন।
বিম্বিসার ক্লান্ত গলায় বললেন, “ওকেও ডেকে নে। তাতানের বায়োলজিকাল ফাদার”।
জনগণ গালাগাল করছিল। কেন তাদের আলাদাভাবে দেখা হচ্ছে। তথাগত পাত্তা দিলেন না।
বললেন, “তাতানের ফোনের লাস্ট লোকেশন পাওয়া গেছে। নর্থের দিকেই ছিল। তারপরে অফ হয়ে যায়”।
সুপ্রিয় মাথায় হাত দিয়ে রাস্তায় বসে পড়লেন।
বিম্বিসার শূন্য চোখে বিভাবরীর দিকে তাকালেন।
সুপ্রিয় বললেন, “তোদের জন্য। তোদের জন্য। সব কিছু তোদের জন্য”।
তথাগত জিজ্ঞাসু চোখে বিম্বিসারের দিকে তাকালেন।
বিম্বিসার তথাগতকে বললেন, “আমরা এবার কী করব?”
তথাগত বিম্বিসারের কাঁধে হাত রাখলেন, “উদ্ধারকাজ শুরু হয়েছে। কিছু না কিছু খবর পাওয়া যাবে। ভাবিস না”।
সুপ্রিয় উঠে দৌড়তে দৌড়তে ধ্বংসস্তুপের দিকে চলে গেলেন।
কর্মরত কনস্টেবলরা বাধা দিতে যাচ্ছিলেন।
তথাগত বারণ করে দিলেন।
বিম্বিসার হতাশ গলায় বললেন, “আমরা দোষী হয়ে গেলাম মেয়েটার বাবার কাছে। আমাদের সব কিছু আজ তুচ্ছ হয়ে গেল”।
বিভাবরী মুখে আঁচল চাপা দিয়েছেন।
অনেক আটকেছেন। আর পারলেন না। কাঁদতে শুরু করলেন।
সামনের ধ্বংসস্তুপ দেখে বিম্বিসার বললেন, “মেয়েটাকে না নিয়ে আমাকে নিতে পারত। কী দোষ করেছিল মেয়েটা?”
বিভাবরী বললেন, “যদি বেঁচে থাকে? অনেকেই তো আটকে আছে। বের করলে বেঁচে যাবে না?”
তথাগত উত্তর না দিয়ে ব্যস্ততা দেখিয়ে অন্য দিকে চলে গেলেন।
কী বলে সান্ত্বনা দেবেন বুঝতে পারছিলেন না। কিছুক্ষণ আগেই একটা শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। দেখে তার নিজেরই হড় হড় করে অনেকখানি বমি হয়ে গেছে।
একরকম আশা ছেড়ে দিয়েই বসে পড়লেন তথাগত।
পুলিশে কাজ করা হল অভিশাপ। এই সব পরিস্থিতিতে মনে হয় সব কিছু ছেড়ে পালিয়ে কোথাও লুকিয়ে পড়লে ভাল হয়। তা আর সম্ভব হয় না।
ফোন বাজছিল তার।
তথাগত ধরলেন।
স্থানীয় থানা থেকে ফোন এসেছে, “হ্যাঁ স্যার। এই মাত্র একটা ফোন এসেছিল। মেয়েটির নাম কনফার্ম করেছে। আমাদের ফোন এই কয়েক মিনিট আগে ঠিক হল, প্রথম ফোনটা আপনার ব্যাপারেই এল”।
তথাগতর হৃদপিণ্ড যেন ফেটে বেরোচ্ছে, “বেঁচে আছে কিনা বলুন”।
“বেঁচে আছে স্যার। নর্থের দিকে এক বাড়িতে আছে। সেফ এন্ড সিকিওর”।
“ফটো পাঠাতে বলেছেন?”
“পাঠিয়েছে স্যার। আপনাকে পাঠাচ্ছি”।
“ওকে”।
ফোন কেটে হোয়াটস অ্যাপ খুললেন তথাগত।
নেটওয়ার্ক মারাত্মক স্লো। কিছুতেই ফটো লোড হচ্ছে না। রাগে ফোন ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে তথাগতর।
বার চারেক চেষ্টার পরে অবশেষে ডাউনলোড করা গেল।
তাতানের ছবি পাঠিয়েছে।
ঘুম ঘুম চোখে হাসছে। পাশে এক অচেনা ভদ্রমহিলা।
বিম্বিসার স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। বিভাবরী বমি করছেন রাস্তার উপরে।
তথাগত ছুটলেন বিম্বিসারের দিকে…
১৫ ।
“তাতানের তো ব্যবস্থা হয়ে গেল। তুমি কী করে ফিরবে?”
যযাতি “শ্রুতকীর্তি” পড়ছিলেন।
খবরে দেখাচ্ছে এখন অবধি কুড়িজনের মৃতদেহ বের করা গেছে। কিছুক্ষণ আগে বিভাবরীর সঙ্গে তাতানের কথা হয়েছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা এ বাড়িতে এসে তাকে নিয়ে যাবে।
তাতান বলল, “আচ্ছা আংকেল, তুমি তখন বাসে করে চলে না গেলে হয়ত আমরা ফ্লাইওভারের তলায় চাপা পড়ে যেতাম। তাই না?”
যযাতি কিছু বললেন না। মেয়েটা বড্ড বেশি কথা বলে, তবে বড্ড মায়াবী। এইটুকু সময়েই কেমন মায়া পড়ে গেল।
সুভদ্রা বললেন, “বাসে করে চলে গেছিল মানে?”
তাতান খিল খিল করে হেসে বলল, “আংকেল ভেবেছিল আমি বোধহয় কোন ছেলেধরা টরা হব। পালিয়ে গেছিল। পরে আবার দেখি ট্যাক্সি নিয়ে ফিরল”।
সুভদ্রা হেসে ফেললেন।
যযাতি রাগী চোখে তাতানের দিকে তাকালেন।
তাতান বলল, “আমি আরেকটু শুয়ে নি ওরা আসতে আসতে। আংকেল যেভাবে তাকাচ্ছে, আমাকে ভস্মই করে দেবে মনে হয়”।
সুভদ্রা বললেন, “আচ্ছা, যাও”।
তাতান বেডরুমে চলে গেল।
সুভদ্রা বললেন, “তুমি কী করবে বললে না?”
যযাতি বললেন, “আমি উঠব। যতটা পারি হাঁটা লাগাব। পৌঁছে যাব হয়ত ভোরের মধ্যে”।
সুভদ্রা বললেন, “এই মাঝরাতে বেরিয়ে যাবে?”
যযাতি বললেন, “আমি হাঁটি তো। হাঁটতে ভাল লাগে আমার। শুক্রবারগুলো অফিস থেকে হেঁটে বাড়ি ফেরা অভ্যেস করেছি। মন্দ লাগে না”।
সুভদ্রা বললেন, “ভাল। সাবধানে থেকো। আজকাল রাস্তাঘাটগুলো যেন মরণ ফাঁদ হয়ে গেছে। কারা ভেবেছিল, বাড়ি থেকে বেরোবে আর ফ্লাইওভার ভেঙে পড়বে? সেদিন চোখের সামনে দেখলাম একটা লোক বাসে চাপা পড়ল। লোকটার কোন দোষই ছিল না। রেষারেষি করছিল বাসটা আরেকটা বাসের সঙ্গে। চোখে দেখা যায় না, উফ”!
যযাতি বললেন, “আমার কাছে একটাও কপি নেই ম্যাগাজিনের। একটা করে পাওয়া যাবে?”
সুভদ্রা বললেন, “একটা করেই আছে। নিয়ে যেতে চাইলে নিয়ে যেও”।
যযাতি কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললেন, “শ্রুতকীর্তি যদি হত, তাহলে এই তাতানের বয়সীই হত, তাই না?”
সুভদ্রা থমকালেন।
যযাতির দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেন, “সাবধানে যেও। এখনো বেরিয়ে যেতে পারো। আমি তো থাকছিই। তাতানের বাবা মা এলে আমিই ওদের হাতে তাতানকে তুলে দেব। ভেবো না”।
যযাতি উঠে দাঁড়ালেন।
পিছুটানেরা ডাকলেও মাঝে মাঝে ফিরে তাকাতে নেই…
#
একটা বড় কংক্রিটের চাই তুলছে একটা ক্রেন। গ্যাস কাটার দিয়ে অন্য দিকের স্ট্রাকচার কাটা হচ্ছে।
সুপ্রিয় শূন্য চোখে দাঁড়িয়ে দেখছিলন।
তার কাঁধে হাত রাখলেন বিম্বিসার।
সুপ্রিয় বললেন, “এখানে মেয়েটা যদি চাপা পড়ে থাকে? কী করব আমি? আমার যেটুকু ছিল, তাও তো শেষ হয়ে যাবে”।
বিম্বিসার বললেন, “তাতানের খবর এসেছে সুপ্রিয়। ও ঠিক আছে”।
সুপ্রিয় চমকে ফিরে তাকালেন। মাটিতে শুয়ে পড়লেন।
সবাই তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সুপ্রিয়র সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। গুটি শুটি মেরে শুয়ে কেঁদে চলেছেন। বিম্বিসারও রাস্তায় বসে পড়লেন। সুপ্রিয়কে ধরে বসালেন।
সুপ্রিয় বিম্বিসারকে জড়িয়ে ধরলেন, “আমাকে ক্ষমা কর ভাই। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দে। সব দোষ আমার। আমি তোদের দোষ দিয়ে গেছি শুধু। আমি একটা পাষণ্ড। কী না কী বলে গেছি তোদের। ছি ছি, লজ্জা হচ্ছে। ঘেন্না হচ্ছে। আমি আর কোন দিন আসব না তোদের সংসারে। মেয়েটাকে নিয়ে ভাল থাক তোরা”।
বিম্বিসারও কাঁদছিলেন, সুপ্রিয়র পিঠ চাপড় মেরে বললেন, “ঠিক আছে। যা করেছিস, বেশ করেছিস। তোর জায়গায় থাকলে আমিও করতাম। হুইস্কি খাবি একটু? দেখব ব্ল্যাকে কোথাও পাওয়া যায় নাকি?”
সুপ্রিয় মাথা নিচু করে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললেন, “সব মিটে গেলে আরেকবার শান্তিনিকেতন যাবি? মেয়েটাকে আজকাল খুব কোপাই নদী দেখাতে ইচ্ছে করে। সেই জায়গাটায় যাবো”।
বিম্বিসার বললেন, “যাবো। কাঁদিস না। অনেক কেঁদেছিস। মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরিস”।
সুপ্রিয় মাথা নাড়লেন, “না রে। আগে বিভা ধরবে। তারপর আমরা। আমারই ভুল হয়েছিল। তাতান আগে বিভার মেয়ে। তারপর আমাদের”।
বিম্বিসার দাঁড়িয়ে হাত বাড়ালেন, “তাই হোক। চল। তথাগত গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের মেয়ের কাছে চল”।
সুপ্রিয় বিম্বসারের হাত ধরে উঠলেন।
দুই বন্ধু হাত ধরাধরি করে হাঁটতে শুরু করলেন।
ধ্বংসস্তুপ আর অসংখ্য হাহাকারকে পিছনে ফেলে…
#
“একী? উনি চলে গেলেন কেন”?
তাতান সুভদ্রাকে অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।
সুভদ্রা বললেন, “উনি তো থাকতে আসেন নি। ওকে ফিরতে হবে তো”।
তাতান বলল, “ওর নাম্বার আছে? আমি ফোন করব। বাবা মার সঙ্গে কথা বলাব। লোকটা একটু কেমন যেন। কিন্তু ভাল। বল?”
সুভদ্রা হাসলেন, “হ্যাঁ। ভাল তো। খুব ভাল”।
তাতান বুঝল না। তবে সুভদ্রাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমিও খুব ভাল। ভীষণ ভাল”।
সুভদ্রা নিরুত্তর রইলেন।
চোখের জল আটকানোর অভ্যাস সেই কবে থেকে করে চলেছেন…