আক্রান্ত – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

আক্রান্ত

তিন ডেসিমেল প্লট। মোটামুটি চৌকো। এককোণায় একটু খাঁজ। পৌর নর্দমার পচা জল মাটিকেও পচিয়ে দিয়েছে। তাই ওই ক্ষয়ের দাগ। দিলওয়ার হোসেন ক্ষয়টির দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবছিল। শ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল সে। বলেছিল ‘এখানটা…’

‘সামান্য ব্যাপার।’ হাসুমিয়াঁ দালাল তাকে থামিয়ে দিয়েছিল। ‘ওই দেখুন কত্তো ইট। বাঁধিয়ে ভরাট করে নেবেন। আজকাল এক ইঞ্চি মাটির দাম হিসেব করলে মাথা খারাপ হয়ে যায়।’

কিন্তু মাথা খারাপ করার আরও একটা জিনিস ছিল। সীমানার কাছে একটা পুরনো ইটের কবর। তার ওপর একটা ডালিম গাছ। কবরটার কথা বলতে গিয়ে দিলওয়ার হোসেন বলে ফেলেছিল, ‘বাঁজা, না ফল ধরে?’ কবরটা ডালিমগাছ হয়ে গিয়েছিল।

দালাল হেসে কুঁজো। ‘কথাটা আপনিও জানেন মাস্টারসায়েব! সবুরে মেওয়া ফলে। ফলবে। সবকিছুর সিজন আছে।’ সে মক্কেলকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল, যেদিকটাতে দু’ঘরের ছোট্ট বাড়ি। ইটের দেয়াল, অ্যাজবেস্টসের চাল। একটুকরো বারান্দা। ফাটলে শ্যাওলা, অবিশ্বাস্য ঘাস। ‘মেরামত করলেই ফিটফাট নতুন। আসুন, ভেতরটা দেখাই।’ বলে বারান্দায় পৌঁছে মুখে ও গলায় রহস্য এনে ফিসফিস করেছিল। ‘সময়মত ভেঙে দোতলা বানাবেন। মাছের তেলে মাছভাজা, বুঝলেন তো? একতলার আগাম সেলামির টাকায়….আজকাল যা হচ্ছে। সে ভাববেন না। আমি জুটিয়ে দেব।’ সে বুদ্ধিদীপ্ত হাসি হাসছিল। খুব হাসতে পারে হাসুমিয়াঁ। অথবা ঘরবাড়ি জমিজায়গার দালালদের এরকম হাসতে হয়।

কিন্তু ডালিমগাছটা মাথায় ঢুকে গেল দিলওয়ার হোসেনের। অথবা কবরটাই ওই প্রতীক হয়ে সেঁটে রইল। মালিক এক হিন্দু ভদ্রলোক। কাঠগোলার কারবারি। শহরের এই সম্পত্তি এবং মহল্লাটি মুসলমানের, দুটোই চিন্তাযোগ্য। আর চিন্তাযোগ্য বিষয় একটা কবর।

তহমিনা বেগমও স্বামীর মত স্কুল টিচার। বাসে চেপে পাঁচ কিলোমিটার দূরে একটা গ্রামের বা গ্রামনগরীর স্কুলে যাতায়াত করে। খুঁটিনাটি জেনে বলল, কবর, তাতে কী? আমাদের বাড়ির উঠোনেই দাদিমার কবর ছিল। পরে পাঁচিল তুলে পার্টিশন করে দিয়েছিল……..ও কিছু না। নিয়ে নাও।’

‘তুমি দেখবে না একবার? দিলওয়ার হোসেন একটু অবাক হল।

‘দেখার কী আছে?’ সহজভাবে কথাটি বলল তহমিনা বেগম। ‘মাটির যা অবস্থা আজকাল। পা রাখার জায়গা নেই কোথাও।’

অবিকল দালাল হাসুমিয়াঁর কণ্ঠস্বর। অবশ্য দিলওয়ার হোসেন জানে, তার বউ সব কিছুতে এমন শীতল। সহজে মেনে নেয় সব কিছুই স্কুলে কিছু ঘটলেও। এমনকি, একদা দিদিমণিদের মধ্যে একটা হাতাহাতি বা চুলোচুলির ঘটনাও না হেসে শীতলতার বর্ণনা করেছিল। দিলওয়ার হোসেন ভাবে, হয়ত এ এক ধরনের শক্তি।

চিন্তিত দিলওয়ার হোসেন একটু পরে বলল, ‘কবরটাতে একটা ডালিমগাছ আছে।’

‘ভালই তো!’ তহমিনা বেগম স্কুলের শাড়ি স্বামীর সামনে বদলে নিচ্ছিল। একটা মাত্র ঘর। অন্যায়রকমের ভাড়া। তবু পাওয়া গেছে, সৌভাগ্য। যদিও কিছু গোপন ও অনুচ্চারিত বিধিনিষেধ আছে। বাইরের লোকজন ঢোকানো চলবে না, এবং নিষিদ্ধ মাংস-টাংস। তাছাড়া এক বছরের চুক্তি। বাড়ির মালিকের মেয়ে তহমিনা বেগমের এক কলিগ। সেটাই সূত্র। কলিগটি মালিক মাকে সুপারিশ করেছিল, ‘ওদের যা ভাবছ, মোটেও তা নয়। দেখবে একেবারে আমাদের মতই। কথাবার্তা চালচলন।’ শোনা কথা একটা। তবে বাড়িওয়ালা বৃদ্ধা এই দম্পতিকে দেখে এবং কথাবার্তা বলে আশ্বস্ত হন। দিলওয়ার হোসেন বলেছিল ‘গণ্ডগোলটা কালচারের।’ পরে রমলা একদিন চুপিচুপি প্ররোচনা দেয়, ‘মা ওইরকমই। মিনু, কাবাব খাওয়াবে?’ অর্থাৎ সে ওসব মানে না।….

দিলওয়ার হোসেন দ্বিধান্বিত হেসে বলল, তোমার দাদিমার কবরটার মত পার্টিশনের আড়ালে রাখা যায়। কিন্তু….

‘কিন্তু কী? ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে তহমিনা চুলে চিরুনি দিল। ‘কিন্তু টিন্তু নয়। এমন চান্স ছাড়লে আর মাথা ভেঙেও পাবে না।’ সে দ্রুততায় চিরুনি টানছিল, যেন এখনই বাইরে যাবে। কিংবা একটা ছটফটানি।

‘না—মানে, কবরটার কথা বলছি।’ দিলওয়ার হোসেন একটা কাগজে স্কেচ করতে থাকল। সে মোটামুটি ছবি আঁকতে জানে। চিত্রকর হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল ছেলেবেলায়। এঁকে বলল, এই দেখ পজিশন।’

খাটে স্বামীর পাশে বসে স্কেচটা দেখতে দেখতে তহমিনা বেগম আস্তে বলল, ‘পার্টিশন পরে হবে। এখানে অনেকটা স্পেস, দেখছ? একটু গার্ডেনিং করব। বড্ড ইচ্ছে করে, জানো?’

‘রাতবিরেতে তুমি ভয় পাবে না তো!’ বউয়ের রঙিন ফুলবাগিচার ওপর একটু ছায়া দিল দিলওয়ার হোসেন। ঈষৎ দুষ্টুমি ছিল।

কিন্তু তহমিনা বেগম শীতল কণ্ঠস্বরে বলল, ‘মিলাদ দেব। মৌলবি এনে কোরান পড়াব।’

স্কুল শিক্ষক প্রেমবশে বউকে টানল। ‘কবরে যে আছে, সে যদি আমার মত হয়?’ বলে চুম্বনের চেষ্টা করতেই বাধা পেল। বউ উঠে গিয়ে সুইচ টিপে আলো দিল। চোখ জ্বলে গেল স্কুল শিক্ষকের।

তহমিনা বেগম ঘরের কোণায় কেরোসিন কুকারের কাছে বসল। ‘চা-টা খেয়ে এখনই হাসুমিয়াঁর বাড়ি যাও। ওকে নিয়ে কাঠগোলায় যাবে। বায়না করতে হলে তাও করে এস।’ এই কথাগুলিতে বিস্ময়কর উত্তাপ ছিল, অপ্রত্যাশিত এবং নতুন। অবশ্য শহরে একটি নিজস্ব বাড়ির স্বপ্ন তার আছে, দিলওয়ার হোসেন জানে।…..

এ ভাবেই তিন ডেসিমেল মাটি একটি দু’কামরার নিচু ঘর, একটি জীর্ণ কবর, একটি ডালিমগাছ সমেত কেনা হয়ে যায়। শিক্ষক দম্পতি সেখানে এসে ওঠে। অ্যাজবেস্টসের চালের তলায় সমতল কার্ডবোর্ডের মসৃণ সিলিং একটু আধটু ফাটল মেরামত ও রঙের কাজ পোড়ো বাড়িটিকে বাসযোগ্য এবং সুন্দর করে তোলে। মিলাদ মহফিল, টুপি পরা মুসলিমবৃন্দ এবং মাইক্রোফোনে এক বৃদ্ধ মৌলবীর রাতভোর পুরো কোরানপাঠ তাকে প্রচুর আধ্যাত্মিক শুচিতা ও রক্ষাকবচ দিয়েছিল।

কলিগ রমলাকে এক প্রাকসন্ধ্যায় স্কুল থেকে ফেরার সময় টেনে নিয়ে এল তহমিনা বেগম। তার অঙ্কুরিত ফুল-বাগানটি দেখাল। রমলা কবরটি খুঁজছিল, সে শুনেছিল। ‘মিনা, কবর আছে বলেছিলে?’ সে দেখতে চাইল।

তার কলিগ দ্বিধাহীন পা বাড়িয়ে বলল, ‘ওই তো!’

‘বাঃ!’

‘কী?’

‘ওই গাছটা!’

‘ডালিমগাছ!’ তহমিনা বেগম উজ্জ্বল মুখে বলল, একটি ঘোষণা। ‘এপ্রিলে ফুল ফুটবে। তুমি ডালিমফুল দেখেছ কখনও? অসাধারণ! ফলের কথাও ভাবো!’

রমলা অবাক হয়ে বলল, ‘গাছটা তো করবে। সেই ডালিম খাওয়া যাবে?’

হাসল তহমিনা বেগম ‘জানি না! আগে তো ধরুক, তখন দেখা যাবে।’

‘আচ্ছা শোনো।’ রমলা নার্ভাস একটু হাসল।’ ‘তোমার—তোমাদের ভয় করে না?’

‘কিসের ভয়?’ বলে তহমিনা বেগম ঠিক করল, তার হিন্দু কলিগকে ব্যাপারটা বোঝানো উচিত। ‘মুসলমানদের ভূত-টুত হয় না। কেন জানো? আমরা আত্মাকে বলি রুহ। মৃত্যুর পর রুহ বন্দী থাকে ইল্লিন-সিজ্জিন নামে একটা জায়গায়—কোনও একটা গ্যালাক্সিতে বলতে পারো। সেখানে থাকে। তারপর ডুমস-ডে-তে তাদের রেজারেকশন।

‘কিন্তু মামদোভূত ডিকশনারিতে দেখেছি মুসলমানদের প্রেতাত্মা।’

তার কলিগ খুব হাসতে লাগল। ‘ভুল ধারণা। এক্কেবারে ভুল। আমাদের ভূত হওয়ার চান্সই নেই।’

‘তা হলে তোমরা ভূত মানো না বলছ?’ রমলা চার্জ করল। ‘কতজনকে দেখেছি, তারা মুসলমান। ভূত মানে।’

তহমিনা বেগম সিরিয়াস হলে বলল, ‘ভূতটুত না, জিন। মুসলমানরা জিন মানে।’

‘একই কথা।’

‘উহুঁ! মানুষ মাটি থেকে তৈরি, আর জিন আগুন থেকে।’ তহমিনা বেগম ব্যাখ্যা করতে থাকল। ‘আসলে কী হয় জানো? মানুষের মতো কোনও-কোনও দুষ্টু জিনও আছে। তারা পৃথিবীতে এসে দুষ্টুমি করে।’

রমলা সন্দিগ্ধ দৃষ্টে কবরটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ধ;েরা যদি তেমন কেউ ওখানে ডেরা পাতে?’

তহমিনা বেগম জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, ‘নাঃ। সে তুমি বুঝবে না। ওটা হয় না। কবর শুধু মানুষদের জন্য রিজার্ভ প্লেস।’

‘কিন্তু কবরটা কার?’

‘জানি না।’ খুব আস্তে কথাটি বলল তার কলিগ। তারপর হাত ধরে টানল। ‘এস, ঘরে গিয়ে বসি। ও এখনই এসে যাবে। আজ কী যেন মিটিং আছে।……’

কবরটা কার, ওই গোপন ও অস্বস্তিকর অনুসন্ধিৎসা শিক্ষক দম্পতির মনে থেকে গিয়েছিল। মফস্বল শহরের এদিকটায় মুসলিমমহল্লা। কুটিরশিল্পী, রিকশচালক, ঠিকে মজুর, কিছু খুদে দোকানদার, আপিস আদালতের বেয়ারা, ‘মেহনতি জনগণ’ এবং কতিপয় উকিল ও ডাক্তার। যথেচ্ছ বৃক্ষলতার ভেতর ওতপ্রাোত, ঠাসাঠাসি, অসম্বন্ধ বাড়িসকল উঁচু বা নিচু। আর প্রহরে-প্রহরে মাইক্রোফোনে আজান। সব সময় নিঝুম পারিপার্শ্বিক হঠাৎ-হঠাৎ এভাবে গর্জন করে জানিয়ে দেয় একটি জোটবদ্ধ অস্তিত্বের স্বকীয়তা। এদিকে অনুসন্ধিৎসাটি খুব ভেতরে ঘাই মারে। কখনও পুরুষটি কখনও স্ত্রীলোকটি চমকে উঠে তাকায়, ‘কে ছিলে তুমি? পুরুষ না স্ত্রীলোক?’ ডালিমগাছটি শেষ চৈত্রের বাতাসে ছটফট করে। ক্রমে বিন্দু-বিন্দু লালচে ফুলগুলি ফুটতে থাকে। ক্রমে রক্তাক্ত, যন্ত্রণা মনে হয়। কোন কোটি কোটি আলোকবর্ষের দূরত্বে ‘ইল্লিন-সিজ্জিনে’ একটি মানবাত্মা নৈর্ব্যক্তিক হয়ে আছে ধ্বংসের দিন রোজ কেয়ামতের প্রতীক্ষায়, যখন সে নিজস্বতা ফিরে পাবে এবং আবার ব্যক্তি উঠবে! তহমিনা বেগমের এরকম চিন্তা হয়। দিলওয়ার হোসেনের অন্যরকম চিন্তাভাবনা। মানুষটি কি দুঃখী ছিল, যার কবর ফাটিয়ে ওই রক্তাক্ত অভ্যুত্থান? আসলে সে একটু রোমান্টিক। জ্যোৎস্নার রাতে তার খুব আশা হয়, সে কাউকে দেখতে পাবে, পরনে সাদা কাফন। সে কিছুতেই ভয় পাবে না। কাছে গিয়ে বলবে, কে তুমি?

খালপোলের ওপর এক বিকেলে দেখা হয়ে গেল হাসুমিয়াঁর সঙ্গে। ‘মাস্টার সায়েবের কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?’ বলে সে কপালে হাত ঠেকাল। মুখে দালালের মধুর হাসি।

দিলওয়ার হোসেন বলল, ‘খোঁজ নিয়েছিলেন?’

‘কিসের?’ বলে সে হাতের একটা ভঙ্গি করল, আশ্বাসের। ‘ভাববেন না। লোক মুখিয়ে আছে। বাজিয়ে দেখে তবে নিয়ে আসব। ইনশাল্লা! দোতালা বাড়ি করিয়ে দেবই। ওপরতলায় থাকবেন। সিনসিনারি দেখবেন।’

‘না, না।’ শিক্ষক বিরক্ত হলেন। ‘কবরটার কথা বলছি।’

দালাল কাঠের সাঁকো মচমচিয়ে হাসতে লাগল। ‘তাই! ও কিছু না। সেই পার্টিশনের সময়কার ব্যাপার! তখন আপনার জন্মই হয়নি। কে এক মিয়াঁসাহেব কালেক্টরিতে চাকরি করতেন। অপশন নিয়ে পাকিস্তানে যান। পরে এসে নারায়ণবাবুর বাবাকে বেচে গেলেন। জোর করে গছিয়ে যাওয়া বলতে পারেন। এ মহল্লায় তখন কেনার লোক নেই। সবাই ভাবছে পপুলেশন-এক্সচেঞ্জ হবে।….না, না। কিছু ভাববেন না।’

দালাল সিগারেট দিল। দিলওয়ার হোসেন কদাচিৎ খায়। নিল ধোঁয়ার সঙ্গে আস্তে বলল, কিন্তু কবরটা কার?

হাসুমিয়াঁ প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বের করে নোংরা জলেভরা খালের দিকে নাক ঝাড়ল। মুছে বলল, ‘হঠাৎ গরম পড়ে সর্দি। একটু বৃষ্টি-ফিষ্টি হলে….’ আবার সে শব্দ করে হাসতে লাগল। ‘পার্টিশন করে দেবেন বলেছিলেন। দেননি?’

‘না’। বউয়ের চেয়ে শীতল কণ্ঠস্বরে বলল দিলওয়ার হোসেন।

‘নতুন বাড়ি উঠলে দেবেন। ক হাত জায়গা ছাড়লে ক্ষতি কী?’ দালাল চোখে একটা ভঙ্গি করল। ‘হিসেব করলে নারায়ণদাকেও ছাড়তে হয়েছে কি না বলুন আপনি? টু পার্সেন্ট লেস। আমারও তাতে কিছু কমিশন লস। হিসেব করুন।’

অসহিষ্ণু স্কুলশিক্ষক বলল, ‘আহা! কবরটা কার?’

দালাল অগত্যা সিরিয়াস হল। ‘তা কে বলবে? মহল্লায় খুঁজতে হয় বুড়োটুড়োদের কাছে। তবে বাড়ির উঠোনে কবর। খুব…..খুবই আপনজন ছাড়া…..’ একটু নড়ে উঠল হাসুমিয়াঁ। ‘বরকত ডাক্তার মহল্লার পুরনো লোক। জিজ্ঞেস করবেন তা।’

বাড়ি ফিরে দিলওয়ার হোসেন দেখল, এক বুড়ি বারান্দার নিচে বসে থালা-হাঁড়ি ধুচ্ছে। মাথার কাপড় টেনে দিল নোংরা হাতে। তা হলে লোক পাওয়া গেছে। তারপর ঘুরেই একটু চমকে উঠল। তহমিনা বেগম কবরের খুব কাছে দাঁড়িয়ে ফুলবতী ডালিমগাছটি দেখছে। ‘ওখানে কী করছ?’—শুনে সে মুখ ফেরাল। মহল্লার গাছপালার ফাঁক গলিয়ে একটি নরম গোলাপি আলোর রেখা পলকে সেই মুখে এসে বিঁধল। যখন সে স্বামীর কাছে ফিরে আসছে, তখন তার স্বামী বুঝতে পারছিল না, চোখদুটি কি ভিজে দেখেছে, না ভুল দেখা?

তহমিনা বেগম একটু হাসল। গলাটা ঈষৎ ধরা। ‘নানি পাতিয়েছি। তুমিও কিন্তু নানি বলবে। বুড়ো মানুষ। দুবেলা এসে যতটুকু পারে, সাহায্য করবে।’

মহল্লায় কাজের লোক পাওয়া কঠিন। ঝিয়ের কাজ করতে চায় না। কুটিরশিল্প, নিজেদের ঘরকন্যা এসবেই দম ফেলার নাকি সময় নেই। অথচ একজন কাজের লোকের খুব দরকার হয়েছে ইদানীং। তহমিনা বেগমেক ডাক্তার বলেছেন, ভারী কাজকর্ম যেন না করে। ঝুঁকে কিছু করাও ঠিক নয়। তবু কুকার জ্বেলে চা করল। সুজি ও ডিম ভাজল। দিলওয়ার হোসেন যখন অন্যমনস্ক হাতে সেগুলি মুখে তুলছে, তখন তহমিনা বেগম বলল, ‘নানির কাছে সব শুনলাম, জানো? এক ভদ্রলোক এখানে—’

‘জানি। হাসুমিয়াঁ বলছিল। পার্টিশনের সময় বেচে দিয়ে যান নারায়ণবাবুর ‘বাবাকে’।

‘ভ্যাট!’ তহমিনা বেগম বলল। ‘গণি উকিলকে। টিনের চালে মরচে ধরেছিল। ফেলে দিয়ে অ্যাজবেস্টস চাপায়। গোডাউন করেছিল। চোরের জায়গা। শেষে নারায়ণবাবুকে বেচেছিল। তাই না নানি?’

বুড়ি আস্তে বলল, ‘হুঁ। এ মহল্লায় সব খালি জায়গা নারায়ণবাবু কিনেছে। কে জানে কী মাথায় আছে!’

দিলওয়ার হোসেন বুড়ির দিকে তাকাল ‘কবরটা কার, জানো?’

‘সন্ধেবেলা ওসব কথা থাক।’ ‘বুড়ি উঠে দাঁড়াল। সেই মুহূর্তে মাইক্রোফোনে আজানের শব্দ। ‘আল্লারসুলের নাম করো। আমি আসি, নাতনি!’ বলে বুড়ি বেরিয়ে গেল। সম্ভাষণে কোমল আত্মীয়তা ছিল।

তহমিনা গলায় ভেতরে বলল, ‘বলব। পরে শুনো।’…..

এ রাতে পাশাপাশি দুটিতে চুপচাপ শুয়ে ছিল। হাতে হাত, আঙ্গুলে আঙ্গুল। নিষ্পন্দ দুটি মানবশরীর। একসময় স্ত্রীলোকটি বলল, ‘শোনো!’ সে কনুই বালিশে রেখে উঁচু হল। ফিসফিসিয়ে বলতে থাকল, ‘যদি আমারও তেমন কিছু হয়….বাচ্চা হতে গিয়ে যদি আমিও অমনি করে…’ সহসা সে পুরুষটির বুকে মুখ গুঁজে দিল। ‘তুমি বলো! কথা দাও! আমাকেও উঠোনে কবর দেবে।’ সে ভালবাসার প্রার্থনায় বা একটি স্বপ্নের ব্যর্থতা আশঙ্কা করে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো। বারবার বলছিল, ‘কথা দাও, তুমি মুখ ফুটে বলো!’ ‘আমার কবরে অমনি ডালিমগাছ….’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *