আট
দোসাদটোলায় অচ্ছুৎ ভূমিদাসদের জীবনে ঘটনা খুবই অল্প। চমক দেবার মতো বড় মাপের নাটকীয় ঘটনা দু-পাঁচ বছর পর ক্বচিৎ কখনও ঘটে; যেমন ঘটেছিল কাল সন্ধ্যেবেলায়। বড়ে সরকার রঘুনাথ সিং নিজের হাতে তাদের মতো অচ্ছুৎ জনমদাসদের খাঁটি ঘিয়ের তৈরি লাড্ডু বেঁটে দিলেন, এমন চোখ-ধাঁধানো আশ্চর্য ঘটনা দোসাদদের জীবনে আর কখনও ঘটেছে বলে কেউ শোনেনি। মহল্লার যারা পুরনো প্রাচীন মানুষ, যাদের বয়স ষাট সত্তর কি শ’য়ের কাছাকাছি তারাও এমন ঘটনা চোখে দ্যাখে নি বা তাদের বাপ-ঠাকুর্দার মুখে শোনেনি। রঘুনাথ সিংয়ের মিঠাইয়া বিলির ব্যাপারটা বেশ কয়েক মাস দোসাদদের উত্তেজিত করে রাখবে। তাদের যাবতীয় কথাবার্তায় এই ঘটনাটা বার বার এসে পড়বে।
যাই হোক, এ জাতীয় দু-চারটে ঘটনার কথা বাদ দিলে অচ্ছুৎ ভূমিদাসদের জীবন একেবারেই ম্যাড়মেড়ে এবং গতিশূন্য। উপমা দিয়ে বলা যায়, বালির চড়ার মধ্যে শুখা মরসুমের নদীর মতো। দেশ তো কবেই স্বাধীন হয়ে গেছে, পর পর কত পাঁচসালা পরিকল্পনা পার হয়ে যায়, কতবার চুনাও আসে এবং যায়, ভোটের লোকেরা আকাশ ফাটিয়ে আর গলায় রক্ত তুলে ‘ভোট দো ভোট দো’ করে চেঁচাতে থাকে, গত দশ বিশ বছরে পাটনা-রাঁচীর হাইওয়েতে বাস-ট্রাক-হাওয়া গাড়ির সংখ্যা বিশগুণ বেড়ে যায়, ভারী টৌনে (শহরে) কত অদল বদল ঘটতে থাকে, সেখানে কত আলো কত জেল্লা কত নতুন চমকদার মকান, ঝকঝকে দিশী এবং বিলাইতী গাড়ির স্রোত, কত দামী দামী পোশাক, কত দামী দামী খাদ্য কিন্তু গারুদিয়া তালুকের জল-অচল জনমদাসেরা আজাদীরা আগে যেখানে ছিল অবিকল সেখানেই পড়ে আছে। স্বাধীন ভারতের যেদিকে পর্যাপ্ত আলো, অজস্র আরাম, অঢেল প্রাচুর্য তার উল্টোদিকে এদের বাস। স্বাধীন উজ্জ্বল দীপ্তিমান ভারতের এতটুকু জলুস তাদের মহল্লায় এসে পড়ে নি। বিশ পঞ্চাশ কি একশো বছর আগে এদের পূর্বপুরুষেরা যেভাবে জীবন কাটিয়ে গেছে এরাও হুবহু সেই ভাবেই কাটিয়ে যাচ্ছে। জীবনযাত্রার প্যাটার্নে কোথাও এতটুকু পরিবর্তন নেই। এদের আজকের দিনটা কালকের মতো, কালকের দিনটা পরশুর মতো, পরশুটা তরশুর মতো। একটা দিনের সঙ্গে আরেকটা দিনের তফাত খুঁজে বার করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। প্রত্যেকটা দিন যেন একই ছাঁচ থেকে ঢালাই হয়ে বেরিয়ে এসেছে।
অন্য সব দিনের মতো আজও অন্ধকার থাকতে থাকতে দোসাদটোলার ঘুম ভাঙল। এদের জীবনে রাত যত তাড়াতাড়ি আসে, দিনও ঠিক তেমনি। সূর্যাস্তের পর সারা পৃথিবী যখন অনেকক্ষণ জেগে থাকে তখন তারা ঘুমিয়ে। সূর্যোদয়ের আগে অন্ধকারে বাকী পৃথিবী যখন বিছানায় তখন এই জনমদাসদের চোখ থেকে ঘুম ছুটে যায়। কেননা রোদ উঠবার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বড়ে সরকারের খামারবাড়িতে হিমগিরিনন্দনের কাছে হাজিরা দিতে হয়। এটুকু সময়ের ভেতর কিছু খেয়ে আর কালোয়া (দুপুরের খাদ্য) বানিয়ে নিতে হয়।
ঘরে ঘরে চুল্হা ধরে গেছে। শুকনো লকড়ি জ্বালিয়ে দোসাদরা মাড়ভাত্তা চড়িয়ে দিয়েছে। কেউ কেউ ভোরেই ভাত খেয়ে দুপুরের জন্য মকাই বা মাড়োয়া সেদ্ধ কিংবা চানার ছাতু, কাঁচা মরিচ, নুন আর খানিকটা তেঁতুলগোলা সঙ্গে করে মাঠে নিয়ে যায় দুপুরে খাবে বলে। কারো আদত একেবারেই উল্টো। ভোরে ছাতু বা মকাই, দুপুরে মাড়ভাত্তা, সঙ্গে সামান্য সবজি-টবজি।
ধর্মাদের ঘরের সামনের দাওয়ার এককোণে রান্নার জায়গা। সেখানে ওর মা চুল্হা ধরিয়ে ভাত বসিয়ে দিয়েছে। একটু দূরে বসে, থেকে থেকে কেশে যাচ্ছে তার বাপ। পুরনো শ্লেষ্মার কাশি। আর একধারে ঘুণে ধরা বাঁশের খুঁটিতে ঠেসান দিয়ে বসে আছে ধৰ্মা। এর মধ্যেই তার ‘নাহানা’ (স্নান) টাহানা হয়ে গেছে। নাহানা আর কী? রঘুনাথ সিংয়ের বাপ বা ঠাকুর্দা ভূমিদাসদের সুবিধার জন্য কোন জন্মে যেন একটা কুয়ো কাটিয়ে দিয়েছিলেন। বালি পড়ে পড়ে সেটার অবস্থা কাহিল, প্রায় বুজেই গিয়েছিল বার কয়েক। রঘুনাথ সিং বালি কাটিয়েদের দিয়ে সাফ করে দিয়েছেন তিন চার বার। শেষ বার যে করেছিলেন, তাও বছর দশেক আগে। নতুন করে বালি পড়ে ওটা আবার বুজতে বসেছে। কোনরকমে তলার দিকে একটু কালচে জল যে পড়ে থাকে এই গরমের সময়টায় কিন্তু দোসাদটোলার এতগুলো লোকের পক্ষে তা মোটেই পর্যাপ্ত নয়। তাই কারো ঘুম ভাঙার আগেই ধর্মা উঠে গিয়ে খানিকটা জল তুলে মাথায় ঢেলে আসে। অবশ্য এখান থেকে মাইল দুই হেঁটে দক্ষিণ কোয়েলের মরা খাতে বালি সরিয়ে জলবার করে গা-মাথা ভিজিয়ে আসা যায় কিন্তু ‘নাহানা’র জন্য অতদূর গেলে সূর্য ওঠার সময় খামারবাড়িতে হাজিরা দেওয়া অসম্ভব।
এখন এই জষ্ঠি মাসে শুখার সময়টা জলের বড় তখলিফ এখানে। কুয়োর বালি না কাটালেই আর নয়। মালিক বড়ে সরকারের কাছে যাবার সাহস তাদের নেই। কয়েক সাল ধরে হিমগিরিনন্দনের কাছে বালি কাটাবার জন্য প্রচুর আর্জি, প্রচুর কাকুতি মিনতি করে আসছে তারা। কিন্তু সব কিছুই হিমগিরির এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে গেছে।
দাওয়ায় বসে দূরে তাকিয়ে ছিল ধর্মা। কুয়োটার কাছে এতক্ষণে ভিড় জমে গেছে এবং জলের বখরা নিয়ে চিল্লাচিল্লি আর গালাগাল শুরু হয়েছে। ফী শুখা মরশুমে দোসাদপাড়ায় এ ঘটনা একেবারে দৈনন্দিন। ঝগড়া, গালাগাল এবং চিৎকার দিয়ে তাদের দিন আরম্ভ হয়।
.
কুয়োর দিক থেকে সরিয়ে চোখদুটো কুশীদের ঘরে এনে ফেলল ধর্মা। ওখানেও কুশীর মা ফেনাভাত চড়িয়ে দিয়েছে। আর কুশী নিজে সস্তা দু আনা দামের প্ল্যাস্টিকের কাকাই (চিরুনি) দিয়ে জট পাকানো চুল আঁচড়াচ্ছে। কুশীটার ভোরে ‘নাহানা’র অভ্যাস নেই; রাত্রে ধর্মার সঙ্গে ফিরে সে চান-টান করে।
পুব দিকটা ফর্সা হয়ে আসছে। এধার থেকে ধর্মা তাড়া লাগায়, ‘জলদি জলদি চুল আঁচড়ানো খতম করে খেয়ে নে। রওদ (রোদ) চড়তে বেশি দেরি নেই?’ কুশী একবার কাকাই হাতে পেলে সময়ের হুঁশ থাকে না। চুল আঁচড়ানোটা ওর প্রিয় বিলাসিতা। কিন্তু মেয়েটা বোঝে না, যাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত বড়ে সরকারের কাছে বিকিয়ে দেওয়া আছে তাদের চুলে বাহার তুলে সময় নষ্ট করা সাজে না।
রোজ সকালে কুশী ধর্মার সঙ্গে মাঠে যায়। এদিকে ফিরে খুব ব্যস্তভাবে সে বলে, ‘আভি হো যায়েগা—’ বলেই ঘন চুলের ভেতর জোরে জোরে কাকাই চালাতে থাকে।
ধর্মা আর কিছু বলে না।
ঘরে ঘরে এখন ফেনাভাত টগবগিয়ে ফুটতে শুরু করেছে। বড়ে সরকারের খামার বাড়ি থেকে খোরাকি বাবদ যে মোটা অরোয়া চালটা (আতপ) ধর্মাদের দেওয়া হয় তা বহুকালের পুরনো। ফুটন্ত আতপের গুমো গন্ধে দোসাদটোলার বাতাস ভারী হয়ে উঠতে থাকে।
ঘরের দাওয়ায় বসে থাকতে থাকতে রোজকার মতো আজও ধর্মা দেখতে পায়, আধবুড়ো মাঙ্গীলাল তার দুটো বাঁদর আর একটা বকরী নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। মাঙ্গীলাল এবং তার তিনটে পশুর গায়ে একই রকম পোশাক; রঙ-বেরঙের টুকরো টাকরা কাপড় দিয়ে বানানো জামা। বাড়তির মধ্যে মাঙ্গীলালের একটা ঠেঁটি তালিমারা প্যান্ট আর মাথায় পাগড়ি রয়েছে।
মাঙ্গীলালের কেউ নেই। না ছেলেপুলে, না জেনানা। দুনিয়ায় সে একা মানুষ। ধর্মাদের স্বজাত দোসাদ হয়েও সে রঘুনাথ সিংয়ের ‘খরিদী কিষাণ’ বা ভূমিদাস নয়। তার বাপ ছিল এক পুরুষের কেনা চাষী। রঘুনাথ সিংয়ের কাছ থেকে ঋণ নেবার সময় ‘করজ পাট্টা’ বা ঋণপত্রে লেখানো হয়েছিল যতদিন শারীরিক শক্তি সামর্থ্য থাকবে ততদিন মাঙ্গীলালের বাপ পেটভাতায় বেগার দিয়ে যাবে। তবে তার ছেলেমেয়ে বা বউকে বেগার দিতে হবে না। এদিক থেকে মাঙ্গীলাল স্বাধীন মানুষ এবং সৌভাগ্যবানও। তার পেশা হল গারুদিয়া বিজুরি কি আরো দূরের বাজারে-গঞ্জে ঘুরে বকরী-বাঁদর নিয়ে মাদারী খেল দেখিয়ে বেড়ানো। এতে যা রোজগার হয়, তিনটে পশু আর একটা মানুষের পেট মোটামুটি চলে যায়। স্বাধীন মাঙ্গীলালকে মনে মনে ঈর্ষা করে ধর্মা।
গুনগুনিয়ে চাপা গলায় গাইছিল মাঙ্গীলাল:
‘নাচ বান্দরী
পাকোল পুন্দরী
তুড়ুক তুন্দরী
হা রে গুগুনগুচা,হা রে গুগুনগুচা।’
.
বাঁদর নাচাবার গান। কিন্তু বিশ পঁচিশ সাল ধরে এক গান গাইতে গাইতে এমন আদত হয়ে গেছে যে নিজের অজান্তেই যখন তখন গলায় সুর উঠতে থাকে তার।
ধর্মা ডাকে, ‘এ মাঙ্গীচাচা—’
সুর ভাঁজা থামিয়ে মাঙ্গীলাল ঘাড় ফেরায়, ‘কা রে?’
‘আজ কোথায় যাচ্ছ?’
‘নজদিগ (কাছেই); চৌকাদে যাব।’
অর্থাৎ কাছাকাছি গোয়ারদের গাঁয়ে খেলা দেখাবে মাঙ্গীলাল। ধর্মা এবার শুধোয়, ‘ফিরবে কখন?’
এসব খুব দরকারী প্রশ্ন নয়। তা ছাড়া দু’জনের জীবনযাত্রা একেবারেই মেলে না। ধর্মা পরাধীন ভূমিদাস, মাঙ্গীলাল স্বাধীন মানুষ। পৃথিবীর সব স্বাধীন মানুষকেই ধর্মা ঈর্ষা এবং শ্রদ্ধা করে। সেদিক থেকে মাঙ্গীলাল তার কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মানুষ—একই সঙ্গে শ্রদ্ধেয় এবং ঈর্ষণীয়। তার সঙ্গে কথা বলতে সে গৌরববোধ করে।
মাঙ্গীলাল বলে, ‘সামকো। মুহ্ আন্ধেরা (মুখ আঁধারি) হলেই ফিরে আসব।’
‘কাল কোথায় যাবে?’
‘কাল নায় নিকলেগা। পরশু, তরশু, নরশুভি নায়। তবিয়ত আচ্ছা নেহি—’
পর পর চারদিন দোসাদটোলা ছেড়ে বেরুবে না মাঙ্গীলাল। এর জন্য কাউকে তার কৈফিয়ত দিতে হবে না বা হিমগিরি লোক পাঠিয়ে তার ঘাড় ধরে টেনে নিয়ে যাবে না কিংবা বরাদ্দ খোরাকিও কাটা যাবে না। গাঢ় দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধর্মা বলে, ‘তুমি ভালো আছ মাঙ্গীচাচা; বহোত সৌভাগ তুমহারা। আমাদের মতো বাঁধী নৌকর হয়ে যাওনি।’
এ জাতীয় কথা ধর্মার মুখে অনেক বার শুনেছে মাঙ্গীলাল। সে আর দাঁড়ায় না; নিজের পশুবাহিনী নিয়ে এগিয়ে যায়।
…
মাঙ্গীলাল চলে যাবার একটু বাদেই আসে ফাগুরাম। ফাগুরামও একজন স্বাধীন মানুষ। মাঙ্গীলালের মতো তার বাপ-ঠাকুর্দাও ছিল এক পুরুষের ভূমিদাস। পরে তাদের বংশে যারা জন্মেছে ‘করজপাট্টা’র দায়ে তাদের বেগার দিতে হয়নি। তবে আগেই বলা হয়েছে মালিক রঘুনাথ সিং বড়ই মহানুভব। ঋণের দায় থেকে মুক্তি পেলে কিংবা শারীরিক দিক থেকে অপারগ হয়ে খারিজ হয়ে গেলেও তিনি কাউকে দোসাদটোলা থেকে তাড়ান না, যার যতদিন ইচ্ছা এখানে থাকতে পারে।
ফাগুরাম এক কালে নৌটঙ্কীর দলে গাইত। বয়স হবার পর এমনিতেই দুব্লা কমজোরি হয়ে পড়েছিল। রাতের পর রাত আরা মজঃফরপুর পূর্ণিয়া আর ভাগলপুর জেলায় গান গেয়ে গেয়ে বুকে দোষ হয়ে গেল। তারপর পড়ল ভারী বোখারে। এখন তার রাত জাগার শক্তি নেই; আর নেই একসঙ্গে চার পাঁচ ঘণ্টা আসর জমিয়ে রাখার মতো দম। ফলে নৌটঙ্কীর দল থেকে বাতিল হয়ে গেছে।
শরীর ভাঙলেও, দম কমে এলেও ফাগুলালের গানের গলা এখনও অটুট; তার জোয়ান বয়েসের মতোই সুরেলা এবং মাদকতায় ভরা। যে তার গান শুনেছে সে-ই বলেছে ‘যাদু-ভরি’ গলা। কেউ বলে ‘গারুদিয়াকা কোয়েল’।
নৌটঙ্কীর দল থেকে বেরিয়ে আসার পর ফাগুরাম ইদানিং দু-তিন সাল নিজেই একা একা গেয়ে রোজগার করছে। রোজ ভোর হতে না হতেই দোসাদটোলা থেকে বেরিয়ে হাইওয়ে দিয়ে সোজা রেল স্টেশনে চলে যায়। প্ল্যাটফর্মের বাইরে একটা ছায়াওলা প্রকাণ্ড পীপর গাছের তলায় বসে পুরনো বেলো-ফাঁসা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গায়। আজকাল ট্রেনে লোক চলাচল অনেক বেড়ে গেছে। সারা দিনে কামাই ভালোই হয় ফাগুরামের।
ধর্মা বলল, ‘চললে?’
ফাগুরাম ঘাড় কাত করে, ‘হুঁ—’
মাঙ্গীলাল আর ফাগুরামের মতো স্বাধীন মানুষ দোসাদটোলায় আরো জনকয়েক আছে। বেঁচে থাকার জন্য তাদের নানা ধরনের পেশা। যেমন, বিরখু ঠিকাদারদের মাটি কাটে, মুঙ্গেরি বাসযাত্রীদের মাল বয় কিংবা লখিয়া গারুদিয়া বাজারে এক কাঠগোলায় কাঠ চেরাই করে। সবাই যে যার কাজে একের পর এক বেরিয়ে যেতে থাকে। ধর্মাদের ঘরটা একেবারে বড় রাস্তায় বেরুবার মুখ ঘেঁষে বলে এখান দিয়েই দোসাদটোলার লোকজনকে যাতায়াত করতে হয়। কাজেই ঘরের দাওয়ায় বসেই সবাইকে দেখতে পায় ধর্মা।
একের পর এক অনেকে বেরিয়ে যাবার পর বাকা একটা লাঠি ঠুকতে ঠুকতে বুড়ি সৌখী এল। ততক্ষণে ধর্মার মা চুল্হা থেকে মাড়ভাত্তা নামিয়ে ফেলেছে।
ধর্মা বরাবর লক্ষ্য করেছে, তার মা ভাত নামাবার সঙ্গে সঙ্গে সৌখী এসে হাজির হয়। একটু আগেও না, একটু পরেও না। বুড়ীর সময়জ্ঞান বেজায় টনটনে।
সৌখীর বয়েস সত্তর আশী না শ’য়ের কাছাকাছি, বোঝা মুশকিল। বুড়ীর কোমর পড়ে গেছে কবেই; খাড়া হয়ে সে দাঁড়াতে পারে না। দাঁড়াবার জন্য লাঠির ঠেকনো দরকার। গায়ের চামড়া কুঁচকে ঝুলে পড়েছে। চোখে তেজ নেই; পাতলা সরের মতো ছানি পড়েছে; দৃষ্টি ঘোলাটে। মাথার চুল শণের নুড়ি যেন; মাড়িতে একটা দাঁতও আর নেই।
রঘুনাথ সিংয়ের সিন্দুকে ভূমিদাসদের নামাবলীর যে বিরাট লিস্ট রয়েছে সৌখী সেখান থেকে কবেই খারিজ হয়ে গেছে। অথচ যখন শরীরে তাকত ছিল, বড়ে সরকারের জমিতে গতর ‘চূরণ’ করে দিয়েছে। তিনকুলে কেউ নেই সৌখীর। একটা ছেলে ছিল—গণেশ বা গণা। গণা ছিল রঘুনাথ সিংয়ের ভূমিদাস। বছরখানেক আগে একদিন রাতের অন্ধকারে গারুদিয়া ছেড়ে সে পালিয়ে যায়। এই নিয়ে রঘুনাথ সিংয়ের পা-চাটা কুত্তা হিমগিরিনন্দন কম হুজ্জুত আর ঝামেলা করে নি। ‘বাঁধি কিষাণ’দের এভাবে ভেগে যাওয়া যে কোন মালিকের পক্ষে অত্যন্ত অসম্মানজনক। হিমগিরির মতে এতে অন্য ভূমিদাসদের ওপর ‘কানটোল’ রাখা যায় না। গোটা দোসাদটোলা বার বার তোলপাড় করেও গণার পাত্তা মেলে নি।
গণা ভেগে যাওয়ার পর থেকেই হাল খারাপ হয়ে পড়ে সৌথীর। পেটই তার চলতে চায় না! এখন সে ভিখমাংনি; ভোরবেলা উঠে গারুদিয়া তালুকের যে ক’টা গাঁয়ে পারে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষে করে। কিন্তু কেউ চাল দ্যায় না। যা হ্যায় তা হল মকাই বা মাড়োয়া। ক্বচিৎ দু-চারটে পয়সা।
দাঁতহীন মাড়ি দিয়ে মকাইদানা চিবোতে বড় কষ্ট হয় সৌখীর। তাই দুটো ভাতের আশায় রোজ ভোরে ধর্মাদের ঘরে হানা দ্যায় বুড়ী। তার সম্বন্ধে ধর্মার যে খানিকটা সহানুভূতি আছে, সেটা কেমন করে যেন টের পেয়ে গেছে সে।
কিন্তু ভোরবেলা সৌখীকে দেখলে একেবারে ক্ষেপে যায় ধর্মার মা। এমনিতেই তাদের ঘোর অভাবের সংসার। একজনের বাঁধা খোরাকির সঙ্গে এটা-সেটা করে জোড়াতালি দিয়ে তিনজনের পেট চালাতে হয়। তার মধ্যে রোজ ভাতের বখরা দিতে হলে, তাদের চলে কী করে?
অন্য দিনের মতো আজও গলায় রক্ত তুলে চেঁচাতে থাকে ধর্মার মা, ‘বুড়ী ভিখমাংনী শরমের মাথা চিবিয়ে খেয়েছিস! গিধ কাঁহিকা। হর রোজ পরের ঘরে গিয়ে ভাত গিলতে শরম লাগে না! যা ভাগ—ভাগ—’
সৌখী এসব গালাগাল গায়ে মাখে না। নির্দাত মাড়ি বার করে নিঃশব্দে হাসে। তারপর দুলতে দুলতে বারান্দায় এসে লাঠি এবং ভিক্ষের কৌটোটা রেখে বসে পড়ে।
ধর্মার মা ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘বৈঠনে কৌন বোলা তুহারকে। যা, আভি নিকাল যা—’ লোকে যেভাবে কুকুর বেড়াল বা কাক তাড়ায় সেইভাবে সৌখীকে ভাগাতে চেষ্টা করে সে।
সৌখী উত্তর দ্যায় না। করুণ মুখে ধর্মার দিকে তাকিয়ে থাকে শুধু।
ধর্মা তার মাকে বলে, ‘রহ্নে দে।। বুড়হী, কোই নেহী—’
ধর্মার মা গলার স্বর আরেক পর্দা চড়ায়, ‘কোই নেহী তো হামনি কা করে? আমরা কী করব? হর রোজ এখানে মরতে আসে! কা, টোলামে আউর কোই নেহী? সেখানে যাক না বুড়হী—’
ধর্মা বলে, ‘কতদিন আর বুড়হী বাঁচবে! দে—ওকে ক’টা ভাত দে—’
ধর্মার মা গজ গজ করতে থাকে। এ বুড়ী এত সহজে মরছে না; গিধের মতো আরো বিশ পঞ্চাশ সাল নিশ্চয়ই বেঁচে থেকে আমাদের হাড় চুষে খাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। ক্ষেপে যায় বটে, তবে একমাত্র রোজগেরে ছেলের কথা অগ্রাহ্য করতে পারে না। একটা শালপাতায় খানিকটা ফেনাভাত আর নুন দিয়ে সৌখীর দিকে ছুঁড়ে দেয়। পরম যত্নে গুমো গন্ধওলা আতপ চালের সেই থকথকে গলা মণ্ড কোলের কাছাকাছি টেনে আনে সৌখী। খেতে খেতে তার ছানিপড়া ঘোলাটে চোখে আলো ফুটে ওঠে।
ধর্মা বলে, ‘সিরিফ (শুধু) মাড়ভাত্তা দিলি বুড়হীকে; কাল রাত্তিরে শিকার (মাংস) রেঁধেছিলি না—’
ধর্মার কথা শেষ হবার আগেই গলার শির ছিড়ে চেঁচিয়ে ওঠে ধর্মার মা, ‘আউর কুছ নায় দুঙ্গী (দেব)। ফির দেবার কথা বললে বুড়হীর মুহমে আগ (আগুন) চড়িয়ে দেব।’
এমনিতেই সৌখীকে ফেনাভাতের ভাগ দিয়ে যথেষ্ট মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছে তার মা। মাংস দেবার জন্য জোরাজুরি করতে আর সাহস হয় না ধর্মার।
ধর্মার মা এবার ছেলেকে জিজ্ঞেস করে, ‘কী খেয়ে ক্ষেতিতে যাবি—মাড়ভাত্তা না রাতের পানিভাত?’
কাল রাতে সফেদ গোয়ারিনদের বাড়ি খেয়ে আসার জন্য ধর্মার ভাগের যে ভাতটা বেঁচেছিল তা ভিজিয়ে রেখেছে তার মা। ধর্না একটু ভেবে জানায় এখন পানিভাত খাবে। মাড়ভাত্তা আর শিকার নিয়ে ক্ষেতিতে যাবে দুপুরে খাওয়ার জন্য।
ধর্মার মা কানাভাঙা তোবড়ানো সস্তা সিলভারের থালায় পান্তাভাত এবং বাসি সব্জিটজি বেড়ে ছেলেকে খেতে দিয়ে নিজের এবং ধর্মার বাপের জন্য মাড়ভাত্তা বেড়ে নেয়। এই ভোরবেলায় পেটে কিছু দিয়ে তাদেরও খাদ্যের খোঁজে বেরিয়ে পড়তে হবে।
নিঃশব্দে খাওয়া-দাওয়া চলছিল। জীবনের সবটুকু পরিতৃপ্তি মুখে ফুটিয়ে দুর্গন্ধওলা আধপচা আতপের ফেনাভাত খেতে খেতে সৌখী বলে, ‘আর বেশিদিন তুহারকে তকলিফ দেব না ধম্মার মাঈ—’
ধর্মার মা এ কথার উত্তর দেয় না; শুধু তীব্র বিরক্তিতে আর রাগে চোখ কুঁচকে সৌখীর দিকে তাকায়।
সৌখী ফের বলে, ‘হামনি গারুদিয়াসে চল যায়েগী।’
ধর্মার চমক লাগে। সে শুধোয়, ‘সচ?’
ধর্মার মা ওধার থেকে চিৎকার করে, ‘বুড়হী যাবে এখান থেকে! তাহলে আমাদের হাড্ডি চুষবে কে? বিলকুল ঝুটফুস (বাজে এবং মিথ্যে)।’
সৌখীর মুখ ফেনাভাতে ঠাসা। কোনরকমে গিলে হাত নেড়ে ব্যস্তভাবে বলে, ‘নায় নায় ধম্মাকি মাঈ— বিলকুল সচ্। হামনি ইয়াসে চলী যায়েগী।’
‘কব রে গিধি (শকুনি)?’
‘দো-চার রোজের ভেতর। কাল ভিখ মাংতে গিয়েছিলাম টিশনে (স্টেশনে)। ওখানে গণার সাথ দেখা হয়ে গেল।’
ধর্মা এবং ধর্মার মা চমকে ওঠে। শুধোয়, ‘গণা!’
সৌখী আস্তে আস্তে তার সরু লিকলিকে গলার ওপর মাথাটা নাড়তে থাকে, ‘ হুঁ, গণা—’
ধর্মার বাপ শিউলাল অল্প কথার লোক। বলে কম, শোনে বেশি।
এমন যে চুপচাপ আদমী সে পর্যন্ত নড়েচড়ে বসে। বলে, ‘তোর তো আঁখে তেজ নেই। ঠিক চিনতে পেরেছিস তো?’
‘হাঁ-হাঁ জরুর! আমার সাথ বাতচিত করল। আঁখ আন্ধা হয়ে গেলেও মা তার লেড়কাকে ঠিকই চিনবে রে ধম্মাকে বাপ—’
ধর্মা কী বলতে যাচ্ছিল, সেই সময় তার চোখে পড়ে কখন যেন তাদের অজান্তে বারান্দার সামনের রাস্তায় এসে দাড়িয়েছে নওরঙ্গী। কতক্ষণ নওরঙ্গী ওখানে দাঁড়িয়ে আছে কেউ টের পায় নি। তাকে দেখামাত্র বুকের ভেতরটা কেঁপে যায় ধর্মার।
নরওঙ্গী মাঝবয়সী আওরত। এত বয়সেও তার শরীরটি ডাঁটোই রয়েছে, কোমরে রয়েছে লছক, চোখে বিজ্রী। মেয়েমানুষটা ধর্মাদেরই স্বজাতি অর্থাৎ দোসাদিন। সাজগোজের বাহারও তার চোখ ধাঁধাবার মতো। পরনে জমকালো চড়া রঙের নক্সাওলা গাজীপুরী শাড়ি। চোখে সরু করে বাসি কাজলের টান। বাসি খোঁপা অনেকটাই ভেঙে গেছে, তবু তাতে গয়ার কাজ-করা জালিকাটা চাঁদির কাকাই আটকানো। গলায় রুপোর চওড়া তেতর পাতা (তেঁতুল) হার; বুকের কাছে মাছের আকারের লকিট (লকেট) ঝুলছে। কানে করণফুল, পায়ের আঙুলে বিছিয়া, নাকে নাকবেশর।
ত্রিভুবনে কেউ নেই নওরঙ্গীর। তিনবার স্বজাতের ঘরে তার বিয়ে হয়। কিন্তু বিবাহিত জীবনের ভিত একেবারেই মজবুত না; তিন বারই দু চার মাসের মধ্যে তার বিয়ে টুটে যায়। তেঘরিয়ার (তিন জনের ঘর করেছে যে মেয়েমানুষ) পর চৌঘরিয়া হওয়া তার কপালে জোটে নি। সে জন্য খুব একটা আপসোস নেই নওরঙ্গীর।
প্রথম বার যখন তার বিয়ে হয় তখন বয়েস তার কত? পন্দর কি ষোল সাল। তখনও নওরঙ্গীর মা-বাবা বেঁচে আছে। বিয়ে হলে কী হয়, আচমকা বড়ে সরকার রঘুনাথ সিংয়ের নজর এসে পড়ে তার ওপর। সঙ্গে সঙ্গে সফেদিয়া ফুলের মতো দেখতে এই মেয়েটার জন্য রোজ সন্ধ্যেবেলাইয় আট বেহারার রুপোর গুল-বসানো দামী পাল্কী পাঠিয়ে দিতে লাগলেন তিনি। দিনের বেলা দোসাদটোলাতেই থাকত সে কিন্তু সন্ধ্যে হলেই চলে যেত রঘুনাথ সিংয়ের হাওয়া মহলে। হাওয়া মহল রঘুনাথ সিংয়ের ফুর্তি লোটার জায়গা। মালিক বড়ে সরকার যখন অচ্ছুৎ দোসাদিনকে কৃপা করেছেন তখন গলা দিয়ে কারো টু শব্দটি বার করার উপায় নেই। দিনের বেলা নওরঙ্গী তার স্বামীর ঘরে কাটাতে পারে কিন্তু তার রাতগুলো রঘুনাথ সিংয়ের। গারুদিয়ার জমিজমা গাছগাছালি পশুপাখি নদীনহরের মতো অচ্ছুৎ ভূমিদাসেরা তাঁর খাস তালুকের সম্পত্তি। তাদের যাকে নিয়ে যখন খুশি যা ইচ্ছা তিনি করতে পারেন।
প্রথম বিয়েটা ছুটবার বছরখানেক বাদে আবার দু নম্বর বিয়ে হল নওরঙ্গীর, তার তিন বছর পর তিন নম্বর সাদি। তিনবার কেন, চোদ্দবার সাদি হলেও মালিকের আপত্তি নেই। দিনের বেলা যত খুশি সে তার স্বামীর অধীন থাক কিন্তু অন্ধেরা নামলেই চাঁদির কাজ-করা পাল্কীতে তাকে উঠতেই হবে।
বছর দশেক এভাবে চলার পর নেশা ছুটে যায় রঘুনাথ সিংয়ের। বগুলা চুনি চুনি খায় অর্থাৎ বক বেছে বেছে ভাল মাছটি খায়, এই বাক্যটি সার্থক করার জন্য তিনি তখন নতুন আওরত জুটিয়ে ফেলেছেন। পুরনো, বহুবার চটকানো, বহুবার ব্যবহৃত দোসাদিন সম্পর্কে তাঁর কোন আগ্রহ নেই। ততদিন মা-বাপ দু’জনেই মরে ফৌত হয়ে গেছে নওরঙ্গীর এবং তার তিসরী স্বামীর সঙ্গেও কাটান ছাড়ান হয়ে গেছে। তাতে বড় রকমের লোকসান হয় নি নওরঙ্গীর। রঘুনাথ সিং তাকে ছেড়ে দেবার পর এখন সে হিমগিরিনন্দনের রাখনি। হিমগিরি মোটামুটি অনেকখানিই ক্ষতিপূরণ করে দিতে পেরেছে তার।
পরের রক্ষিতাকে, বিশেষ করে রাজপুত ক্ষত্রিয়ের ভোগ করা মেয়েমানুষকে রাখা হিমগিরির পক্ষে খুব একটা সম্মানজনক ব্যাপার নয়। তবে মালিকের, সে যত নীচু জাতই হোক, উচ্ছিষ্টে খুব সম্ভব জাতের দোষ অর্শায় না। হিমগিরি মোটামুটি খুশীই। খুশী নওরঙ্গীও! মালিক বড়ে সরকারের কৃপা থেকে বঞ্চিত হলেও তাঁরই সব চাইতে বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিটি তাকে রেখেছে। রঘুনাথ সিংয়ের পরেই এই গারুদিয়া মৌজায় হিমগিরি সর্বাধিক ক্ষমতাবান মানুষ। মর্যাদার দিক থেকে খানিকটা নেমে গেলেও মুখে একেবারে চুনকালি লাগবার মতো কিছু ঘটে নি। বরং দোসাদটোলায় আগের মতো দাপটের সঙ্গেই সে আছে। হিমগিরির যে রাখনি তার গায়ে টোকা মারার সাধ্য কার!
রোজ সন্ধ্যেয় সাজগোজ করে মনরঙ্গোলি মেজুরটি হয়ে বসে থাকে নওরঙ্গী। রঘুনাথ সিংয়ের আমলে চাঁদির কাজ-করা পাল্কী আসত তার জন্য। হিমগিরিনন্দনের জিম্মায় যাবার পর আসে ভৈসা বা গৈয়া গাড়ি।
মালিক বড়ে সরকার বা উচ্চবর্ণের দেওতার রাখনি হওয়াটা দোসাদ সমাজে দোষের ব্যাপার নয়। পুরুষানুক্রমে এই প্রথা চালু রয়েছে। দাসখত দেওয়া ভূমিদাসদের সুন্দরী যুবতীরা চিরকালই মালিকদের ভোগের বস্তু। এ নিয়ে কেউ বড় একটা মাথা ঘানায় না। বরং ক্ষমতাবান মানুষদের সঙ্গে জুড়ে থাকার মধ্যে এক ধরনের সামাজিক মর্যাদা জড়িয়ে থাকে। স্বজাতের মানুষজন এ জাতীয় আওরতদের খানিকটা সমীহই করে থাকে। কিন্তু নওরঙ্গীর ব্যাপারটা উল্টো। তাকে দোসাদ মহল্লার প্রতিটি মানুষ একই সঙ্গে ঘেন্না এবং ভয় করে। মনে মনে দশবার করে তার নামে থুতু ফেলে। অবশ্য নিজেদের মনোভাব তারা গোপনই রাখে সে সব প্রকাশ করে কে আর নিজের বিপদ ঘনাতে চায়!
নওরঙ্গী সম্পর্কে ভয় আর ঘেন্নার কারণ এই রকম। সে রোজ রাত্তিরে দোসাদটোলার যাবতীয় খুঁটিনাটি খবর—যেমন কে কী ভাবছে, কে কী করছে—হিমগিরিকে দিয়ে আসে। গণা যে পালিয়ে গিয়েছিল, সে খবর প্রথম হিমগিরি পায় নওরঙ্গীর কাছে। রঘুনাথ সিং রাজপুতের এত বিশাল তালুক এবং এত অগুনতি ভূমিদাস চালানো মুখের কথা নয়। দিনকাল ক্রমশই খারাপ হয়ে আসছে যদিও তাদের এখানে কিছুই হয় নি, বিশ পঞ্চাশ কি শ বছর আগের মতোই এখানকার ভূমিদাসেরা ঘাড় গুঁজে জমি চষে চলেছে তবু সাবধানের মার নেই। ভোজপুর কি পূর্ণিয়া থেকে মাঝে মাঝে গোলমেলে খবর আসে। শহুরে লোকেদের উস্কানিতে এখানকার খরিদী কিষাণেরা বেশ কয়েক বার ক্ষেপে উঠেছে। তাই হিমগিরিকে ভূমিদাসদের সম্পর্কে আগাম খবর রাখতে হয়। যার মারফত এই খবর আসে সে হল নওরঙ্গী। সেই কারণে তার সামনে পারতপক্ষে কেউ মুখ খুলতে চায় না।
সৌখী তার ছানিপড়া ঘোলাটে চোখে নওঙ্গীকে দেখতে পায় নি। আগের ঝোঁকেই সে বলে যেতে লাগল, ‘আচ্ছা নৌকরি মিলেছে গণার; তলব শ’ও রুপেয়াসে জ্যাদা। দো-চার রোজের ভেতর সে আমাকে নিয়ে যাবে।’
নওরঙ্গীর সামনে এ সব কথা মুখ থেকে বার করা যে কতটা বিপজ্জনক, সৌখীকে কে বোঝাবে। চোখের ইশারা করলেও আবছা অন্ধকারে তার কমজোরি দৃষ্টিতে পড়বে না। কিছু করতে না পেরে ধর্মার উদ্বেগ ভেতরে ভেতরে বাড়তে থাকে। এমন যে ধর্মার মা, সৌখী যার দু চোখের বিষ, সে পর্যন্ত তার জন্য ভীষণ ঘাবড়ে যায়। ভগোয়ান রামজী আর ভগোয়ান কিষুণজীকে মনে মনে ডাকতে থাকে। দেওতাদের কিরপায় গণার যেন কোন বিপদ না হয়।
নওরঙ্গী আর দাড়ায় না। দামী একটা খবর যোগাড় করে হেলেতুলে দোসাদপট্টির রাস্তা ধরে কুয়োর কাছে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যায়।
নওরঙ্গী অনেকটা দূরে যখন চলে গেছে, সেই সময় ধর্মার মা চাপা গলায় গজগজিয়ে ওঠে, ‘বুড়হী গিধ, শয়তান আওরতটা দাঁড়িয়ে ছিল আর তুই গণার কথা বললি! নিজের বেটাকে তুই খতম করতে চাস!’
‘কৌন শয়তান আওরত?’ সৌখী মুখ তুলে তাকায়।
‘টোলামে শয়তান আওরত ক’গো (ক’জন) হ্যায়? বিলকুল এক—উ নওরঙ্গী!’
‘গণাকে বাত শুনা নওরঙ্গী?’ ভয়ে সৌখীর মুখ রক্তশূন্য ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
‘হাঁ রে বুড়হী আন্ধী। আপনা বেটাকে আপনা হাতসে খতম কর দিয়া?’
সৌখী এবার মাথায় চাপড় মেরে ফুঁপিয়ে ওঠে, ‘হামনি কা করল, গণাকো জিওনমে অফত লায়ী। হো রামজী’—তার কান্নার শব্দ ভোরের বাতাসে ভর দিয়ে দোসাদটোলায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে।