সাত
দক্ষিণ কোয়েলের মরা খাতটার পাশে সাবুই ঘাসের জঙ্গল। জঙ্গলটা বায়ে ফেলে খানিকটা এগুলে যতদূর চোখ যায়, শক্ত পাথুরে অনাবাদী মাটির ডাঙা। এখানে বলে ‘পড়তি জমি’। এ জমি এমনই কর্কশ আর কাঁকর এবং পাথরে মেশানো যে মরা মরা হলদেটে ঘাস, দু-চারটে খেজুর, সিমর, গামায়ের, কোমরবাঁকা সীসম আর আগাছা ছাড়া কিছুই জন্মায় না।
এই ডাঙা জায়গাটা বড়ে সরকার রঘুনাথ সিংয়ের খাস তালুকের মধ্যেই পড়ে। এরই একধারে গা জড়াজড়ি করে বেঁটে বেঁটে দমচাপা অনেকগুলো মেটে ঘর কোনরকমে দাঁড়িয়ে আছে। বেশির ভাগ ঘরেরই দেয়াল থেকে মাটি খসে পড়েছে। দেয়ালের গায়ে যে ছোট ছোট বেঢপ ফোকর রয়েছে সেগুলোর নাম হয়ত জানালাই কিন্তু তাতে না আছে গরাদ, না পাল্লা। দরজা বলতে পেটানো টিন বা খেলো কাঠের একটা করে পাল্লা। দরজার জায়গাটা এত ছোট যে ঘাড় গুঁজে ভেতরে ঢুকতে হয়।
এই হল ধর্মাদের দোসাদটোল। পৃথিবীতে এক ফাঁকা জমি, এত অফুরন্ত মৃত্তিকা কিন্তু এখানকার বাসিন্দাদের জন্য মাথা পিছু হাত পাঁচেক জায়গার বেশি পড়েনি। পৃথিবীর যে যে জায়গায় ঘন বসতির চাপ সব চাইতে বেশি তার মধ্যে ধর্মাদের এই দোসাদটোলাও হয়ত পড়বে।
এখানকার ঘরগুলো এমনই যে আলো-হাওয়া পর্যন্ত ভাল করে ঢোকে না। পৃথিবীর সেই আদিম যুগে অর্ধপশুগঠন মানুষদের উপনিবেশ যেমন ছিল, এ অনেকটা সেইরকম। বহু কাল, পঞ্চাশ ষাট কি এক দেড়শো বছর আগে রঘুনাথ সিংয়ের বাপ, ঠাকুর্দা বা ঠাকুর্দার বাপ ধর্মার বাপ, ঠাকুর্দা বা ঠাকুর্দার বাপেদের জন্য এই মহল্লা বানিয়ে দিয়েছিলেন। বাজার-গঞ্জ আর ভারী ভারী টৌন থেকে অনেকদূরে অচ্ছুৎ ভূমিদাসেরা পৃথিবীর সবটুকু ঘৃণা গায়ে মেখে বংশ পরম্পরায় এখানে পড়ে আছে।
ধর্মা এবং কুশী দূর থেকে দেখতে পেল, তাদের দোসাদটোলাটা এখনও ঘুমিয়ে পড়ে নি। ঘরে ঘরে মিটি তেলের ডিবিয়া জ্বলছে। ওখান থেকে চিৎকার চেঁচামেচি এবং হল্লার আওয়াজ ভেসে আসছে। মনে হয়, কোন কারণে তুমুল ঝগড়াঝাটি বেধেছে। এই দোসাদপাড়ায় সামান্য, অসামান্য বা নিতান্ত অকারণেই প্রচণ্ড ধুন্ধুমার লেগে যায়। তখন অশ্লীল খিস্তির আদান-প্রদানে রাজ্যের কাক চিল দশ মাইল তফাতে পালিয়ে যায়।
মহল্লার কাছাকাছি আসতেই চোখে পড়ে, ঘর-দুয়ার ফেলে কুশীর মা-বাপ আর ধর্মার মা-বাপ অর্থাৎ চার বুড়োবুড়ী মেঠো রাস্তায় এসে দাড়িয়ে আছে। কুশীদের দেখে চার মা-বাপ একসঙ্গে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে গলা মিলিয়ে মড়াকান্না জুড়ে দিল। ধর্মা আর কুশী চমকে উঠে একসঙ্গে শুধোয়, ‘কা হৈল, কা হৈল? চিল্লাচ্ছিস কেন?’
চার বুড়োবুড়ীর বয়েস যথেষ্ট। গায়ের চামড়া কুঁচকে জালি জালি হয়ে গেছে; মাড়িতে বেশির ভাগ দাঁতই নেই। পাটের ফেঁসোর মতো চুল। বুড়ো দুটোর পরনে কোমর ঢাকা চিটচিটে সামান্য টেনি। বুড়ীদুটোর আচ্ছাদন আরেকটু বেশি। নিচের দিকে হাঁটু পর্যন্ত আর ওপরে বুকটা কোনরকমে ঢাকা পড়ে।
একসঙ্গে কান্না-মেশানো গলায় হড়বড় করে বলার জন্য তাদের কথা দুর্বোধ্য ঠেকে কুশীদের কাছে। ধর্মা এবং কুশী দু’জনেই এবার চেঁচিয়ে ওঠে, ‘চিল্লাবি না বুড়হা বুড়হী। ধীরেসে বল কী হয়েছে—’
ধমকানিতে কাজ হয়। কান্নার শব্দটা মিইয়ে আসে। তবে একেবারে থামে না। বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই গলা সাফ করে চার বুড়োবুড়ী বলতে থাকে, ‘কঁহা হামনিকো মিঠাইয়া? বড়ে সরকারকো কোঠিসে দিয়া—’
এতক্ষণে বোঝা যায়, লাড্ডু বিলির খবরটা দোসাদটোলায় পৌঁছে গেছে। যাবারই কথা। ধর্মাদের সঙ্গে আর যারা বড়ে সরকারের হাভেলিতে গিয়েছিল তাদের তো বগেড়ি বেচে পয়সা জমাবার ফিকির নেই। তারাই লাড্ডু নিয়ে মহল্লায় ফিরে খবরটা দিয়েছে।
আজ দু সাল কুশীর এবং ধর্মার চার মা-বাপ রঘুনাথ সিংয়ের ক্ষেতিতে আবাদের কাজে যাচ্ছে না। বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিশ্রমের সেই শক্তি আর নেই। তাকত না থাকলে সেই অকেজো লোককে খোরাকি এবং কাপড় দিয়ে পোষার মানে হয় না। জান-বুঝ হবার পর থেকে প্রায় গোটা জীবন পেটভাতায় পিতৃপুরুষের ঋণশোধের জন্য রঘুনাথ সিংয়ের জমিতে খেটে গেছে ধর্মা এবং কুশীর মা-বাপেরা। এর ভেতর কখন যৌবন এসেছে আর গেছে, প্রৌঢ়ত্ব এসেছে আর গেছে, টেরও পায় নি। ছোটনাগপুরের কঠিন নির্দয় মাটি নিজেদের রক্তে আর ঘামে উর্বর করে রঘুনাথ সিংদের জন্য বছরের পর বছর ফসল ফলিয়ে গেছে তারা। তারপর শেষ বয়সে শরীরে সারবস্তু বলতে যখন আর কিছুই নেই তখন একেবারেই খারিজ হয়ে গেছে।
.
কিন্তু বড়ে সরকার রঘুনাথ সিং বড়ই মহানুভব। ক্ষেতির কাজ থেকে বাতিল করে দিলেও তিনি ওদের ভোলেন নি। মনে করে প্রত্যেকের জন্য গুনে গুনে লাড্ডু পাঠিয়ে দিয়েছেন; ভয়সা ঘিয়ে বানানো বড় বড় উৎকৃষ্ট লাড্ডু। চার বুড়োবুড়ী নিজেরা গিয়ে বড়ে সরকারের হাত থেকে লাড্ডু নিতে পারে নি, তাতে কী! তাই বলে ভাগের মিঠাই তো আর ছাড়া যায় না।
দোসাদটোলার মানুষজনের বেশির ভাগই সারাদিন ক্ষেতখামারে জীবনীশক্তির অনেকটা ক্ষয় করে আসার পর সন্ধ্যে হতে না হতেই ঘরে ফিরে নাকেমুখে গুঁজে মড়ার মতো ঘুমিয়ে পড়ে। পরের দিন ভোরের আগে সে ঘুম ভাঙে না।
কিন্তু আজ যে গোটা পাড়াটা ডিবিয়া জ্বালিয়ে জেগে আছে আর ধর্মা এবং কুশীর মা-বাপেরা ঘর ছেড়ে রাস্তায় এসে দাড়িয়ে রয়েছে তার একমাত্র কারণ বড়ে সরকার রঘুনাথ সিংয়ের ঐ লাড্ডু বিতরণ। তাদের জীবনে রঘুনাথ সিংয়ের হাত থেকে মিঠাইয়া পাওয়া একটা বড় রকমের তৌহারের ব্যাপার; দুর্দান্ত উত্তেজক এক ঘটনা। সেই উত্তেজনাই এত রাত পর্যন্ত কাউকে ঘুমোতে দেয় নি।
ধর্মা বলে, ‘বড়ে সরকার মিঠাইয়া দিয়েছে, তোদের কে জানালো?’
মা-বাপেরা চেঁচাতে চেঁচাতে বলে, ‘সব কোই। এক এক আদমিকো দো দো লাড্ডুয়া। তুহারকে লিয়ে বৈঠে বৈঠে বড়ে সরকারকে মকান গৈল। মুনশীজী বাতাওল, হামনিকো মিঠাইয়া তুহারকে হাতমে দে দিয়া। খুদ বড়ে সরকার আপনা হাতসে বাঁট দিয়া—’
ধর্মা এবং কুশী অনেকক্ষণ হাঁ হয়ে থাকে। লাড্ডু বিলির খবর পেয়ে চার বুড়োবুড়ী যে বড়ে সরকারের বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করতে পারে, এতটা তারা ভাবতে পারে নি।
মা-বাপেরা আবার চিৎকার করে ওঠে, ‘কঁহা হ্যায় হামনিকো মিঠাইয়া? কঁহা রে?’
ধর্মারা জানায় দুর্ভাবনার কারণ নেই, মিঠাই তাদের সঙ্গেই আছে।
মা বাপেরা খুব একটা যে আশ্বস্ত হয়, এমন মনে হয় না। তারা চেঁচাতেই থাকে, ‘আভি নিকাল হামনিকো লাড্ডুয়া, আভি নিকাল—’
‘আরে বুড়হা বুড়হিয়া মিঠাইয়া মিলবে; আগে ঘরে তো চল। লাড্ডুয়াকে লিয়ে মরতা হ্যায়—’
‘কায় নায় মরোগে—অ্যাঁ? কেন মরব না? আমাদের ভাগের লাড্ডুয়া!’
ঘরের দিকে যেতে যেতে মথুরা লচ্ছু ফির্তুলাল, এমনি অনেকের ঘর থেকে তুমুল চিৎকার শোনা যেতে লাগল। নিশ্চয়ই লাড্ডুর ভাগ নিয়ে ঝগড়া চলছে।
দোসাদটোলার একেবারে মুখের দিকে রাস্তার কাছে পাশাপাশি দুটো ঘরে ধর্মা আর কুশী তাদের মা-বাপদের নিয়ে থাকে। এত পাশাপাশি যে এ ঘরে নীচু গলায় কথা বললে ও ঘরে পরিষ্কার শোনা যায়।
ঘরে এসে ম্যাচিস ধরিয়ে ওরা ডিবিয়া জ্বালায়। তারপর ধর্মা এবং কুশী তাদের মা-বাপের প্রাপ্য মিঠাই বুঝিয়ে দেয়। এতক্ষণে চার বুড়োবুড়ীর মুখে হাসি ফোটে। দামী দুর্লভ লাড্ডুগুলো ডিবিয়ার আলোয় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লুব্ধ চকচকে চোখে খানিকক্ষণ তারা দ্যাখে; তারপর খেতে শুরু করে। খাওয়া হয়ে গেলে কুশীর মা-বাপ কুশীকে এবং ধর্মার মা-বাপ ধর্মাকে বলে, ‘আভি খা লে—’ অর্থাৎ রাতের খাওয়ার কথা বলছে তারা।
ধর্মা এবং কুশী জানায়, চৌকাদ গাঁয়ে সফেদ গোয়ারিন আর কালা গোয়ারের বাড়ি থেকে তারা খেয়ে এসেছে। এখন আর খাবে না।
এ খবরটা দু’জনের মা-বাপের কাছে নতুন কিছু না। সপ্তাহে দু-এক দিন চৌকাদ গাঁ থেকে তারা রাতের খাওয়া চুকিয়ে আসে। তবু চার বুড়োবুড়ী জানায়, আজ একটু বঢ়িয়া রান্নাবান্না হয়েছে। ছেলেমেয়ে না খেলে কি মা-বাপের ভালো লাগে।
পাশাপাশি দুই ঘরে কুশী আর ধর্মা জানতে চায়, ‘কী রেঁধেছিস?’
মা-বাপেরা জানায়—ভাত, সুথনির তরকারী আর শিকার।
শিকার অর্থাৎ মাংস। মাংসের নামে এ ঘরে কুশীর, ও ঘরে ধর্মার চোখ লোভে ঝকমকিয়ে ওঠে। তারা শুধোয়, ‘কিসের শিকার?’
‘বন পেরোয়ার (পায়রা)।’
‘মিলি কিধরি? (কোথায় পাওয়া গেল)?’
‘জঙ্গলে সুথনি তুলতে গিয়ে। কোন জানবর কি বদমাস চিড়িয়া (বাজপাখি) জখম করেছিল। পেরোয়াটা উড়তে পারছিল না। ধরে নিয়ে এলাম।’
রঘুনাথ সিংয়ের কাছ থেকে খারিজ হয়ে গেলেও ধর্মার মা-বাপ আর কুশীর মা-বাপের খিদে-তেষ্টা তো আর শেষ হয়ে যায় নি। পেট আছে কিন্তু বড়ে সরকারের কাছ থেকে একদানা খোরাকি মেলে না। অথচ না খেলে বাঁচে কী করে? ধর্মা আর কুশী বড়ে সরকারের খামার বাড়ি থেকে যে খোরাকি পায় তাতে নিজেরা খাওয়ার পর এমন কিছু বাড়তি থাকে না যা দিয়ে বাপ-মাকে বাচানো যায়। কাজেই চার বুড়োবুড়ীকে নিজেদের খাদ্য নিজেদেরই যোগাড় করে নিতে হয়।
ধর্মার মা-বাপ আর কুশীর মা-বাপ এই চারজনের মধ্যে প্রচুর মিল, প্রচুর খাতির। কখনও কোন কারণেই তাদের ঝগড়াঝাটি নেই। এই বনিবনার জন্য দোসাদটোলার অনেকেই তাদের হিংসে করে।
যাই হোক, খাদ্যের খোঁজে এখান থেকে তিন মাইল তফাতে দক্ষিণ কোয়েলের পাড়ের জঙ্গলে রোজই চলে যায় ওরা। কন্দ, কচু, মেটে আলু, লতাপাতা, এমনি সব জিনিস যোগাড় করতে করতে ক্বচিৎ কখনও তারা এক-আধটা খরগোস কি পাখি টাখি পেয়ে যায়। যেমন আজ একটা বন পেরোয়া বা বনপায়রা পেয়েছে। যেদিন শিকার মেলে সেদিন বাড়িতে যেন তৌহার লেগে যায়।
ধর্মা আর কুশী বিজ্রীদের বাড়ি থেকে পেট ভরে খেয়ে এসেছে। তবু কি আর মাংস দিয়ে দু-চার গরাস ভাত খেতে পারে না? খুবই পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খায় না। দু’জনে তাদের দুই মাকে ভাগের মাংস আর ভাত তরকারি রেখে দিতে বলে। বলে, ‘ভাতে পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখ। কাল সবেরে খেয়ে জমিনে যাব।’
দুই পরিবারে দু’জনের একবেলার করে খোরাকি বেঁচে যায়। দোসাদদের জীবনে এ ঘটনা সামান্য নয়।
দোসাদটোলার সব ঘরেরই চেহারা প্রায় এক রকম। খানকয়েক করে খেলো সিলভারের তোবড়ানো থালা, মাটির হাঁড়িকুড়ি, দু-চারটে ময়লা ঠেটি জামাকাপড়, ছেঁড়া বালিশ, চট, কাঁথাকানি, ধুলো-বোঝাই ইদুরে-কাটা ধুসো কম্বল। ক্বচিৎ কারো ঘরে বাঁশের ফ্রেমে নারকোল দড়ি দিয়ে বোনা চৌপায়া চোখে পড়ে। ধর্মা আর কুশীদের ঘর-দুয়ারেরও এই একই হাল। তবে কুশীদের চৌপায়া নেই, ধর্মাদের একটা আছে। রাতে সেটায় তুলো-ওড়া ফাটা বালিশ পেতে শোয় ধর্মা। এটুকুই তার জীবনে মহার্ঘ সৌখিনতা।
খানিকটা পর দুই ঘরে চার বুড়োবুড়ী রাতের খাওয়া সেরে ডিবিয়া নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। তাদের আগেই ধর্মা আর কুশী শুয়ে পড়েছিল।
রাত এখন অনেক। দোসাদপাড়া খানিকটা ঝিমিয়ে পড়লে একেবারে ঘুমিয়ে পড়ে নি। দূর থেকে নাথুয়ার বউর গুনগুনানি ভেসে আসে:
‘বাবু হমার নিন্দ (ঘুম) করে,
সারি শহর বাবু ঘুরত রহে,
আ যা রে নিন্দ, তু আ যা,
বাবু হমার শুলা যা রা—
বাবু হমার নিন্দ করে।
সারি শহর বাবু ঘুরত রহে
আ যা সৈয়া তু আ যা
বাবুকে দুধ পিলাহা যা রা—’
.
বোঝা যায়, নাথুয়ার বউ গান গেয়ে গেয়ে বাচ্চাকে ঘুম পাড়াচ্ছে।
ওধারে মঙ্গেরি, ভিরগুলাল, গুলাবীদের ঘর থেকেও কথাবার্তার আবছা শব্দ ভেসে আসে। তবে সব চাইতে স্পষ্ট করে যা শোনা যায় তা হল গঞ্জুরামের মায়ের একটানা বিনিয়ে বিনিয়ে কান্নার আওয়াজ।
ধর্মা দড়ির চৌপায়ায় চিত হয়ে শুয়ে ছিল। এবার খানিকটা কাত হয়ে অন্ধকারে ঝাপসাভাবে দেখল, দেয়ালের গা ঘেঁষে তাঁর মা-বাপ শুয়ে আছে, তবে ঘুমিয়ে পড়েনি। ধর্মা জিজ্ঞেস করে, ‘গঞ্জুর মা কাঁদে কেন?’
ধর্মার মা বলে, ‘গঞ্জু ওর মায়ের ভাগের লাড্ডু খেয়ে ফেলেছে।’
গঞ্জটা এরকমই, মা-বাপকে দ্যাখে না। ঘোর স্বার্থপর। ধর্মা বলে, ‘হারামী জানবর।’ সে জানে আজ বাকী রাতটা গঞ্জুর মায়ের একটানা বিলাপ চলতে থাকবে।
কিছুক্ষণের মধ্যে শ্বাস ওঠার মতো অদ্ভুত এক শব্দ করতে করতে ধর্মার মা-বাপ ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু সারাদিন ‘হাড্ডি তোড়’ খাটুনির পরও ঘুম আসে না ধর্মার। সে জানে দশ হাত তফাতে আরেকটা ঘরে কুশীর মা-বাপ অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে কিন্তু তাদের মেয়ে ঠিকই জেগে আছে।
শুয়ে থাকতে থাকতে অন্য সব দিনের মতো আজও ঠিকাদার আর গোয়ারদের, বিশেষ করে বিজ্রী এবং মহাদেওর কথা মনে পড়ে যায় ধর্মার। ওরা কালাপন দুলহানিয়া অর্থাৎ কুশীর কপালে ‘সিনুর চড়ানো’র জন্য রোজ তাগাদা দেয়। সাদির সময় কী কী উপহার দেবে তাও রোজ একবার করে শোনায়।
ধর্মা ভাবতে থাকে, কবে রঘুনাথ সিংয়ের কাছে তাদের ‘খরিদী’ জীবন শেষ হবে, কবে তারা পূর্বপুরুষের করজ শোধ করে স্বাধীন হতে পারবে, কে জানে। মুক্তি না পেলে সাদির কথাই ওঠে না। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস পড়ে ধর্মার। হয়ত তার মতোই দশ হাত তফাতে আরেকটা ঘরে এক ক্রীতদাসী দোসাদ যুবতী চোখের পাতা মেলে একই কথা ভেবে যায়।
ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে ধর্মা। তাদের জীবনের একটা দিন এভাবেই কেটে যায়।