আকাশের নিচে মানুষ – ৬

ছয়

কলালীর পর দু-চারটে টিনের চালা, পাঁচ-সাতটা ভাঙাচোরা মেটে বাড়ি। তারপর শুরু হয়েছে ছোটনাগপুরের আদিগন্ত ফসলের ক্ষেত। এই জষ্ঠি মাসে কোথাও ধান বা গেঁহুর একটা চারাও চোখে পড়ে না। ফাঁকা মাঠ একেবারে হা হা করতে থাকে।

রুপোর কটোরার মতো সেই চাঁদটা এখন আকাশের মাঝ-মধ্যিখানে উঠে এসেছে। গলানো চাঁদির মতো বহুকালের প্রাচীন জ্যোৎস্নায় বহুকালের পুরনো এই পৃথিবী ভেসে যাচ্ছে। আজন্মের চেনা ছোটনাগপুরের এই উঁচু-নীচু ঢেউ-খেলানো প্রান্তর। কিন্তু এই মুহূর্তে কেমন যেন অপরিচিত আর আশ্চর্য মায়াবী মনে হতে থাকে।

উত্তর থেকে দক্ষিণে এবং পুব থেকে পশ্চিমে হু-হু করে উল্টো-পাল্টা ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে চলেছে। এই হাওয়া বড় সুখের। কে বলবে এখানকার মাঠঘাট এবং ফাঁকা শস্যক্ষেত্র দিনের বেলা জ্যৈষ্ঠের গনগনে রোদে একেবারে আগুন হয়ে থাকে! জ্যোৎস্নাধোয়া এই পৃথিবীতে কী মধুর স্নিগ্ধতা!

গারুদিয়া বাজার ছাড়িয়ে ধর্মারা মাঠে চলে এসেছিল। তাদের মাথার ওপর দিয়ে এক ঝাঁক পরদেশী শুগা (বিদেশী টিয়াপাখি) বাতাসে ডানা ছড়িয়ে ভাসতে ভাসতে চলে যায়।

কিছুক্ষণের মধ্যে ধর্মা আর কুশী মাঠের মাঝখানে একটা গায়ে এসে পড়ে। গোয়ারদের (গোয়ালাদের) গাঁ। গোয়ালারা অবশ্য নিজেদের বলে যদুবংশীছত্রি।

যদুবংশী বা গোয়ারদের গাঁখানা কিন্তু চমৎকার। চারদিকে তক তকে ঝকঝকে টিন কি মাটির বাড়িঘর, সামনের দিকে ঢালা ‘আঙ্গন’। ‘আঙ্গনে’ ছোটখাটো ফুলের বাগান। এ গাঁয়ে হেন বাড়ি নেই যেখানে দশ বিশটা ভইস বা গাই নেই। বারোমাস দিনরাত গোয়ারদের এই গাঁয়ের বাতাসে একটা ভারি সুন্দর গন্ধ ভাসতে থাকে। ভয়সা ঘিয়ের সুগন্ধ। প্রতিদিনই কোন না কোন বাড়িতে এখানে ঘি জ্বাল দেওয়া হয়। সেই ঘি বড় বড় টিনে বোঝাই হয়ে চলে যায় ভারী ভারী টৌনে—রাঁচীতে, ডালটনগঞ্জে, ধানবাদে, পাটনায়, কলকাত্তায়।

এখন, এই রাত্রিবেলা ঘরে ঘরে লাল মিটি তেলের ডিবিয়া কি কাচ-বসানো লণ্ঠন জ্বলছে।

এখানে, এই মুহূর্তে চারদিকে টুকরো টুকরো ঘর-সংসারের ছবি চোখে পড়ে। ঘরের দাওয়ায় বসে কোন সুহাগিন আওরত এনামেলের থারিতে (থালায়) তার মরদ আর ছেলেপুলেকে খেতে দিচ্ছে। কেউ চুলহার ধারে বসে রোটি বা লিটি সেঁকছে আর তার ঘরবালা কাছে বসে চাকী-বেলনায় আটার গোল গোল ডেলা বেলে বেলে দিচ্ছে। কোথাও কোন ‘পুরুখ’ সারাদিন গতর চূরণ খাটুনির পর তার প্যারা দুলহানিয়ার গা ঘেষে বসে খুনসুটি করে যাচ্ছে।

কোথাও বসেছে গান-বাজনার আসর। একটা গোটা পরিবারের মেয়ে-পুরুষ কাচ্চাবাচ্চা ঢোলক এবং ঢাউস ঢাউস করতাল বাজিয়ে হোলির গান গেয়ে চলেছে।

‘খেলনে নিকালি অযোধাবালী—
হোলি খেলনে, কিনকার হাতে
আবীর কি ঝোলি, রামজীকি হাতে
কনক পিচকারী। লছমনকি হাতে
আবীরকা ঝোলি……..
হোলি খেলনে নিকালী অযোধাবালী
হোয় হোয় হোয়, আয়া রে হোলি
নিকালি অযোধাবালী—’

এবার সেই কোন চৈত্র মাসে হোলি হয়ে গেছে। এখন জেঠ মাহিনা চলছে। দু-আড়াই মাস পার হতে চলল কিন্তু ছোটনাগপুরের এই গাঁ থেকে হোলির তৌহারের দিনগুলো যেন আর কাটতে চায় না। শুধু গোয়ার বা যদুবংশীদের এই গাঁয়েই নাকি, ধর্মাদের নিজেদের মহল্লাতেও এখনও হোলির জের চলছে।

দুর্ভাবনাশূন্য এই সুখী স্বাধীন মুক্ত মানুষদের দেখতে দেখতে ধর্মা আর কুশীর চোখ লোভে চকচক করতে থাকে। যৌবনের শুরু থেকে এই রকম একটা কাম্য জীবনের স্বপ্নই তো তারা দেখে আসছে। কিন্তু ঐ স্বপ্ন পর্যন্তই।

রোজই গোয়ারপাড়ার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে বেশ খানিকটা সময় নেয় ধর্মারা। চোখ ভরে এই সব মানুষের ঘরকন্না এবং আদর সোহাগের ছবি যতক্ষণ দেখা যায়।

গাঁ টার নাম চৌকাদ। চৌকাদের সব মানুষই ওদের চেনে। রোজ এখান দিয়ে যাতায়াতের ফলে ভূমিদাস অচ্ছুৎ দোসাদদের এই ছেলেমেয়ে দুটোকে মোটামুটি সবাই স্নেহও করে। অবশ্য জলচর গোয়ারদের পক্ষে দূরত্ব রেখে এবং ছোয়াছুয়ি বাঁচিয়ে যতখানি স্নেহ দেখানো সম্ভব ততটুকুই দেখায়; তার একচুল বেশি না।

ওরা যখন চৌকাদের ভেতর দিয়ে যায় তখন রোজই গোয়ার আর গোয়ারিনরা ডেকে ডেকে কথা বলে। আজও তারা ডাকাডাকি করতে থাকে।

‘এ কোশিয়া, এ ধৰ্ম্মা—আ যা। বৈঠ ইহা—’

সবাই তাদের বসতে বলে; তবে ঘরে উঠতে দেয় না। উঠোনে বা ‘আঙ্গনে’র একধারে তাদের বসতে হয়।

ধর্মা বলে, ‘নায় জী, রাত বহোত হো গৈল—’

‘আরে বৈঠ না—’

‘নায় জী, আজ মাফি মাঙে। কাল বৈঠেগা।’

কেউ বলে, ‘চায় পীকে যা—’

ধর্মারা একই জবাব দেয়। রাত অনেক হয়ে গেছে। আর দেরি করা যাবে না। এমন কি চায়ের লোভেও না।

কেউ ঠাট্টার গলায় বলে, ‘কালাপন দুলহানিয়াকে নিয়ে তিন চার সাল সিরেফ চরকির মতো ঘুমছিস ফিরছিস। এবার সাদি করে ফেল—’

রোজ রাত্রিবেলা মাস্টারজীকে দিয়ে টাকা গুনিয়ে চৌকাদ গাঁয়ের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে এই বিয়ের কথাটা কম করে দশ বিশজনের কাছে শুনতে হয় ধর্মা এবং কুশীকে। অন্য দিনের মতো আজও তার মাথা লজ্জায় নীচু হয়ে যায়। পাশে দাঁড়িয়ে সে টের পায়, কুশীর মুখও আরক্ত হয়ে উঠেছে। ধর্মা আবছা কাঁপা গলায় বলে, ‘রামজীর কিরপা হলে সাদি জরুর হয়ে যাবে।’

আজ চৌকাদ গাঁয়ের মাঝামাঝি আসার পর ভিখুন গোয়ারের ঘরবালী বলে ওঠে, ‘তুই পুরুখ (পুরুষ) না কি রে? জোয়ানী মুরগীকে সাথ সাথ নিয়ে তিন চার সাল ঘুমছিস। সাদিউদির ফিকির নেই। তুরন্ত ছোকরির কপালে সিনুর (সিঁদুর) চড়িয়ে বিস্তারায় (বিছানায়) নিয়ে ফেল—’ বলে কোমরে লছক তুলে গা দুলিয়ে দুলিয়ে আর আঙুল মটকে মটকে অশ্লীল একটা ছড়া কাটে।

এই মাঝবয়সী মেয়েমানুষটার চুল আধাআধি সফেদ হয়ে গেছে। গায়ে চাপ চাপ চর্বি-মাখন। দাঁত তুরপুনে কুরে রুপো দিয়ে বাঁধানো। সেই বাঁধানো দাঁত মেলে হেন নোংরা অশ্লীল কথা নেই যা সে মুখ দিয়ে বার করতে পারে না। তা ছাড়া এ গাঁয়ের সব চাইতে দুর্ধর্ষ কুঁদুলে আর শ্রেষ্ঠ ঝগড়াটি সে। তার বাঁশ-ফাটা গলার আওয়াজে ভয় পায় না তেমন পুরুষ বা আওরত চৌকাদ গাঁয়ে এখনও জন্মায় নি। কাজে কাজেই ভিখুন গোয়ারের এই ঘরবালীকে দেখলে বুক শুকিয়ে যায় ধর্মার। জড়ানো গলায় কিছু একটা বলে কুশীকে নিয়ে লম্বা লম্বা পায়ে সে এগিয়ে যায়।

ঘুরতে ঘুরতে একসময় দু’জনে চৌকা গাঁয়ের দক্ষিণ দিকে এসে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে দুটো অত্যন্ত চেনা গলা শোনা যায়, ‘এ ধম্মা, এ কোশিয়া—’

ঘাড় ফিরিয়ে ধর্মা এবং কুশী দেখে সফেদ গোয়ারিন আর কালা গোয়ার ওদের উঠোনের এক কোণে বড় বড় চুল্হার পাশে বসে প্রকাণ্ড লোহার কড়াইতে ঘি জ্বাল দিচ্ছে। ভয়সা ঘিয়ের সুঘ্রাণে বাতাস এখানে ভারী হয়ে আছে।

চোখাচোখি হতেই সফেদ গোয়ারিন আর কালা গোয়ার হাত নাড়তে লাগল, ‘আ যা, আ যা—’

‘ওদের অবশ্য ঐ নাম নয়। কালা গোয়ারের আসল নাম মহাদেও; গায়ের রঙ কয়লার মতো ঝিম কালো বলে সে কালা গোয়ার অর্থাৎ কালো গয়লা নামে এ অঞ্চলে বিখ্যাত। তার ঘরবালী অর্থাং বউয়ের নাম বিজ্‌রী। বিজ্‌রীর গাত্রবর্ণ স্বামীর একেবারে উল্টো। মেমেদের মতো সে ধবধবে ফর্সা। রঙের গৌরবে সে মেম গোয়ারিন বা সফেদ গোয়ারিন। দুটো নামের মধ্যে শেষ নামটাই তার বেশি চালু।

অন্য গোয়ারদের বাড়ি না ঢুকলেও বিজ্‌রী আর মহাদেওর কাছে না গিয়ে পারে না ধর্মারা। তাই বলে কি ওরা মাস্টারজীর মতো জাতপাত মানে না বা তাদের ঘরে তুলে বিছানায় নিয়ে বসায়? কোনটাই না। অচ্ছুৎ ধর্মা আর কুশীকে তারা দূরে দূরেই রাখে। তবে অন্য গোয়ারদের মতো ওদের উঠোনে বসিয়ে নিজেরা উচু দাওয়ায় বসে কথা বলে না। নিজেরাও কাছে বসে গল্প করে, হাসে, রসালো ঠাট্টা করে। মহাদেও আর বিজ্‌রীর কথায় ব্যবহারে এমন একটা প্রাণখোলা ভালবাসা আর টান আছে যা এড়িয়ে যাওয়া যায় না।

বিজ্‌রীদের বাড়িটা অনেকখানি জায়গা জুড়ে। পুবে এবং পশ্চিমে দুই সীমানায় কাঁটাওলা পুটুস গাছের বেড়া; উত্তরের ভিটেতে পর পর তিনটে কাঠের দেয়াল আর টালির ছাউনির দক্ষিণ-মুখো ঘর। ঘরের পর বিরাট উঠোন। দক্ষিণ দিকটা একেবারে খোলা।

গাঁয়ের রাস্তা থেকে ধর্মা আর কুশী বাড়ির ভেতর ঢুকল এবং বিজ্‌রীদের কাছাকাছি এসে খানিকটা তফাতে বসল। অচ্ছুৎ ভূমিদাসদের সতর্ক করে দিতে হয় না। আজন্মের সংস্কারবশেই তারা উঁচু জাতের মানুষদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলে।

বিজ্‌রী বলল, ‘মাস্টারজীর কাছ থেকে পাইসা গিনতি করে এলি?’

ধর্মা মাথা নাড়ে, ‘হাঁ—’

এই পয়সা জমানোর ব্যাপারটা যে সামান্য ক’টি লোককে ধর্মারা জানিয়েছে তাদের মধ্যে বিজ্‌রী এবং মহাদেও-ও রয়েছে। ধর্মারা ওদের বিশ্বাস করে আর ‘আপনা আদমি’ বলেই ভাবে।

ধর্মারাই শুধু না, বিজ্‌রীরাও তাদের আপনজন মনে করে। দু তরফে এই রকম ভাবার যথেষ্ট কারণও আছে।

বিজ্‌রীর বয়েস তিরিশ বত্রিশ হবে; মহাদেওর বয়েস চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ। সাদি হয়েছিল তাদের পনের ষোল সাল আগে কিন্তু ছেলেপুলে আর হয় না। বিয়ের পর ছ সাল যায়, পাঁচ সাল যায়, দশ সাল বারো সালও পার হয় তবু বিজ্‌রী আর মহাদেও ছেলেমেয়ের জন্ম দিতে পারে না। চৌকাদ গাঁয়ের লোকেরা তাদের, বিশেষ করে বিজ্‌রীর মুখ দেখত না। বাঁজা আওরত পড়তি জমির (বন্ধ্যা জমি) মতোই অকেজো। তার মুখ দেখা পাপ, তার ছায়া মাড়ানো পাপ। চৌকাদ গাঁয়ে প্রায় একঘরে হয়েই ছিল বিজ্‌রীরা। পারতপক্ষে কেউ তাদের সঙ্গে কথা বলত না; কালা গোয়ারের হুক্কা-পানি একরকম বন্ধ হয়েই গিয়েছিল। ঠিক এই সময় ধর্মাদের সঙ্গে তাদের আলাপ। ধর্মারা তখন গারুদিয়া বাজারে বগেড়ি বেচে মাস্টারজীকে দিয়ে পয়সা গুনিয়ে চৌকাদ গাঁয়ের ওপর দিয়ে যাতায়াত শুরু করেছে।

একঘরে মনমরা বিজ্‌রীরা যখন চুপচাপ এক ধারে পড়ে থাকত সেই সময় ধর্মা আর কুশী অনেকক্ষণ তাদের কাছে বসে বসে গল্প করত। ওদের দুঃখের কারণ জানতে পেরে কুশী তার এক বুড়ী মাসিকে দিয়ে কী সব শেকড় বাকড় আনিয়ে বিজ্‌রীকে খাইয়েছিল। মাসি নানারকম ওষুধ বিষুধ এবং তুকতাক জানে। সেই ওষুধের গুণেই হোক বা অন্য কোন কারণেই হোক বিজ্‌রীর বাচ্চা হয়। সঙ্গে সঙ্গে তাদের সামাজিক মর্যাদা বাড়ে। মহাদেওর আবার হুক্কাপানি চালু হয়।  এই জন্য কুশীদের কাছে ওদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

.

মহাদেও বলে, ‘আর কত রুপাইয়া হলে তোরা রাজপুত সিংয়ের হাত থেকে ছাড়া পাবি?’

ধর্মা বলে, ‘মাস্টারজী বলেছে, আরো বহোত বহোত রুপাইয়া—’

বিজ্‌রী বলে, ‘জলদি জলদি রুপাইয়া জমিয়ে ফেল—’ তারপর কুশীর দিকে ফিরে বলতে থাকে, ‘তোর সাদিতে কী দেব জানিস?’

বিয়ের কথায় মুখ নীচু করে বসে থাকে কুশী; কিছু বলে না।

বিজ্‌রী ফের বলে, ‘সপরনার (সাজগোজের) সব জিনিস পাবি। চাঁদির কাকাই (চিরুনি), বিছিয়া, করণ ফুল (দুল), বঢ়িয়া কাপড়া, জুতুয়া—’

ওদিকে চুল্হার আগুনে পাক খেতে খেতে ভয়স৷ ঘি ক্রমশঃ ঘন হতে থাকে। আগে কুশীরা লক্ষ্য করে নি, ঘি যে চুল্হাতে জ্বাল হচ্ছে তার পাশের আরেকটা চুল্হায় শুখা লকড়ির উনুনে ভাত ফুটছে। দূরে, ছোট বাগানে অগুনতি সফেদিয়া আর রাতকি রানী ফুল ফুটে আছে। ঘিয়ের ঘ্রাণ, ফুলের আর ফুটন্ত ভাতের ম-ম খুশবুর সঙ্গে সফেদ গোয়ারিনের মুখে বিয়ে আর দামী দামী উপহারের নামগুলি মিশে গাঢ় স্বপ্নের মতো মনে হতে থাকে কুশীর।

এদিকে বিজ্‌রীর কথার মধ্যেই ওপাশের ঘর থেকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। বোঝা যায়, ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে ঘরে শুইয়ে রেখে ওরা ঘি জ্বাল দিতে বসেছিল। ছেলের কান্না কানে আসতেই বিজ্‌রী দৌড়ে ঘরের দিকে চলে যায়। একটু পর বাচ্চাকে বুকে চেপে ভোলাতে ভোলাতে ফিরে আসে, ‘মেরে বেটা রো মাত, রো মাত, মাত রোনা (কাঁদিস না)—’

কাঁচা ঘুমে ওঠার জন্য কান্না থামে না বাচ্চাটার। অগত্যা আড় হয়ে বসে বুকের কাপড় সরিয়ে তাকে দুধ খাওয়াতে থাকে বিজ্‌রী। আর সমানে বলে যায়, ‘মেরে সোনা, মেরে চাঁদি, মেরে হীরা, মেরে মোতি। কলকাত্তাসে মেমসাব বহু এনে দেব। রো মাত, রো মাত—’

মহাদেও হেসে হেসে বলে, ‘শুনা ধম্মা, শুনা হো কোশিয়া, সফেদ গোয়ারিনের খাইশ (বাসনা) শুনা? কলকাত্তাসে মেমসাব পুতহু (ছেলের বউ) আনবে। হোয় হোয় হোয়—’

বিজ্‌রী ঘাড় ফিরিয়ে বলে, ‘আনবই তো, জরুর লায়েঙ্গী।’

বুকের দুধ খেয়ে বাচ্চাটা ঠাণ্ডা হলে ফের এধারে ঘুরে বসে বিজ্‌রী। মাখনের দলার মতো দেড় দু’বছরের ছেলেটাকে আদর করতে করতে, নাক দিয়ে পেটে সুড়সুড়ি দিতে দিতে আর চুমু খেতে খেতে বলে, ‘এ বিল্লীবাচ্চা, মেরে বিল্লীবাচ্চা—’

মহাদেও মুখচোখে নকল দুঃখের ভঙ্গি ফুটিয়ে ধর্মাদের বলে, ‘দেখ দেখ, আপনা আঁখসে দেখ, ছেলেকে কেমন সুহাগ করছে। যাকে দিয়ে বিল্লীবাচ্চের মা বনেছে তাকে আর পাত্তাই দ্যায় না।’ বলে নিজের আওরতের দিকে তাকায়, ‘এ মেমসাব গোয়ারিন, হামনিকো থোড়া থোড়া সুহাগ কর—’

বিজ্‌রী ওপাশ থেকে একটা শুখা লকড়ীর টুকরা তুলে আপন মরদের পিঠে আস্তে করে ঘা বসিয়ে দেয়। বলে, ‘চুপ হো বেশরম কালা গোয়ার—’ পেয়ার উথলে উঠলে আপনা মরদকে সে মাঝেমধে কালা গোয়ার বলে।

এ সবই যে গাঢ় ভালবাসার প্রকাশ, বুঝতে অসুবিধা হয় না কুশীর। আওরত, মরদ আর তাদের বাচ্চা—এই নিয়ে কী সুন্দর সুখের সংসার বিজ্‌রীদের। দেখতে দেখতে উজ্জ্বল রুপোর পাতে রোদ ঝলকবার মতো তার চোখ চকচকিয়ে ওঠে। চোখের কোণ দিয়ে আড়ে আড়ে সে ধর্মার দিকে তাকায়। লক্ষ্য করে, ধর্মাও তাকে দেখছে। দু’জনের মুখে একটু মলিন হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে যেতে থাকে। 

.

আরো কিছুক্ষণ বাদে ধর্মা বলে, ‘অনেক রাত হয়ে গেল। বহোত দূর যেতে হবে। আভি চলে—’

বিজ্‌রী বলে, ‘নায় নায়, এখানে খেয়ে যাবি তোরা।’ চৌকাদ গাঁয়ে এলে মাস্টারজীর মতো তারাও ধর্মাদের না খাইয়ে ছাড়তে চায় না।

ধর্মারা আপত্তি করে। কিন্তু রাত বাড়ার দোহাই ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয় বিজ্‌রীরা। শেষ পর্যস্ত খেতে বসতেই হয়।

বিজ্‌রী জবরদস্ত খাটিয়ে আওরত। একা দশ হাতে কাজ করতে পারে। বাচ্চাটাকে মহাদেওর কোলে ছুঁড়ে দিয়ে চুল্‌হা থেকে ভয়সা ঘিয়ের কড়াই নামিয়ে ঘরে রেখে আসে। তারপর অন্য একটা চুল্‌হা থেকে ভাতের তসলা (হাঁড়ির মতো পাত্র) নামিয়ে ওধারের বাগান থেকে কলাপাতা কেটে এনে কুশীদের খেতে দেয় এবং খানিকটা তফাতে নিজেরাও খেতে বসে যায়।

খাওয়ার ব্যবস্থা সামান্যই। আগুন আগুন মাড়ভাত্তা (ফেনভাত), মেটে আলু সেদ্ধ, খানিকটা করে টাটকা ভয়সা ঘি, রহেড় ডাল আর পুদিনার চাটনি।

খেতে খেতে আর নানারকম এলোমেলো কথা বলতে বলতে হঠাৎ কী মনে পড়ে যায় মহাদেওর। সে বলে, ‘আরে ধম্মা, শুনলাম বড়ে সরকার রঘুনাথজীর মকানে আজ লাড্ডু বিলি হয়েছে।’

ধর্মা বলে, ‘হাঁ। কে বললে?’

‘রামলছমনজী সন্ধ্যেবেলা মুহ আন্ধেরার সময় এসেছিল। বড়ে সরকারের মকানে যেতে বলল—মুগের আর চানার লাড্ডু নাকি দেওয়া হবে। লেকেন বিশ সের ঘিউর অডার (অর্ডার) আছে। তাই যাওয়া হয় নি। লাড্ডু দিলে কেন? এখন তো কোন তৌহার নেই।’

‘বড়ে সরকার এম্লে বনেগা। পাটনা থেকে এম্লে বনার টিকস নিয়ে এসেছে। উসি লিয়ে—’

‘হাঁ?’

‘হাঁ।’

খাওয়া দাওয়ার পর নিজেদের এটোঁ পাতা বাইরে ফেলে দিয়ে, খাবার জায়গাটা জলে ধুয়ে ধর্মারা বিদায় নেয়।

আসার সময় বিজ্‌রী আরেক বার মনে করিয়ে দেয়, জলদি জলদি ধর্মা যেন কুশীর কপালে সিনুর চড়াবার (বিয়ের) ব্যবস্থা করে।

একসময় যদুবংশীছত্রিদের চৌকাদ গাঁ পেরিয়ে আবার ওরা আরেকটা গায়ে এসে পড়ে। সেখান থেকে আরেক গাঁয়ে। এইভাবে ছোটনাগপুরের মাঠের মাঝখানে একের পর এক গাঁ পার হয়ে যায় ধর্মারা। সব জায়গায় একই ছবি। সুপ্রাচীন আকাশের তলায় সুখী স্বাধীন মানুষেরা একই ছাঁচে স্নেহ-আনন্দ-সোহাগ-খুনসুটি দিয়ে বুনে বুনে কী সুন্দর এক সাংসারিক নক্শাই না গড়ে তুলেছে!

গাঁয়ের পর গাঁ পেরিয়ে যেতে যেতে অচ্ছুৎ ভূমিদাস এক যুবক আর এক যুবতী বুকের ভেতর গাঢ় তৃষ্ণা অনুভব করে। ভাবে, বড়ে সরকার রঘুনাথ সিংয়ের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে কবে তারা এরকম ঘর-সংসার পাততে পারবে।

এক সময় ধর্মারা ফের হাইওয়েতে এসে ওঠে। রাস্তাটা এখন একেবারে ফাঁকা। রাঁচী বা পাটনা, কোনদিকেই একটা ট্রাক বা বাসের চিহ্নমাত্র নেই। এমনকি মানুষজনও চোখে পড়ছে না।

আকাশ জুড়ে অগুনতি জরির ফুলের মতো নক্ষত্রমালা। এধারে ওধারে ঝোপেঝাড়ে এবং হাওয়ায় জোনাকি উড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে।

চাঁদের নরম মায়াবী আলো গায়ে মেখে কুশী আর ধর্মা পাশাপাশি হাঁটছিল। একসময় ধর্মা কুশীর কাঁধের ওপর হাতের বেড় দিয়ে তাকে কাছে টেনে আনল। গায়ের সঙ্গে তাকে মিশিয়ে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘গোয়ারলোগ, বামহনলোগ, কায়াথলোগ ক্যায়সা বঢ়িয়া ঘর বনাই—’

কুশী ঘরের ভেতর থেকে যেন বলে ওঠে, ‘হাঁ—’ চৌকাদ গাঁ পার হয়ে এসেছে তারা অনেকক্ষণ। কিন্তু এখনও বিজ্‌রীর কথাগুলো তার কানে যেন সুরে বেজে যাচ্ছে। বার বার ধর্মাকে সে ‘সিনুর চড়াবার’ জন্য তাগাদা দিয়েছে। তা ছাড়া বিয়ের সময় দামী দামী উপহার দেবার আশাও দিয়েছে। বিছিয়া, চাঁদির করণফুল, কাকাই, সপরনার (সাজগোজ) নানা জিনিস—

ধর্মা আস্তে করে এবার বলে, ‘অয়সা ঘর হামনিকো চাহে—’

কুশী গম্ভীর গলায় বলে, ‘হাঁ—’

রোজ রাতেই মাঠের মাঝখানের গাঁগুলো পেরিয়ে হাইওয়েতে আসার পর এই কথাগুলো একবার করে ওরা বলে যায়। ঘর-সংসারের স্বপ্ন দেখতে দেখতে সে সব পাওয়ার জন্য সঙ্কল্পও করে।

একটু পর আবছা গলায় কুশী ফের বলে, ‘থোড়ে জলদি বড়ে সরকারের করজটা শোধ করে দে—’

ধর্মা বলে, ‘হাঁ, দিতেই হবে।’

‘একেলী থাকতে আমার আর ভাল লাগে না।’

‘উরে কালাপন দুলহানিয়া—’ বলতে বলতে আচমকা কী হয়ে যায় ধর্মার। কুশীকে নিজের ঢালের মতো বুকটার ওপর টেনে এনে দু হাতে ঘন করে জড়িয়ে ধরে। কুশীর দুটো সতেজ লম্বা হাতও ধীরে ধীরে উঠে এসে ধর্মার গলা বেষ্টন করে তার মুখ নিজের মুখের ওপর নামিয়ে আনে। তারপর অসীম স্বাধীন আকাশের তলায় জ্যোৎস্নালোকিত প্রান্তরে মানুষের তৈরি নির্দয় পৃথিবীর এক ক্রীতদাস এবং এক ক্রীতদাসী মিথুনমূর্তির মতো অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে।

একসময় দু’জনের হাত আলগা হয়ে খসে পড়ে। ধর্মা আস্তে করে বলে, ‘চল—’

আরো খানিকক্ষণ পর দক্ষিণ কোয়েলের মরা খাতের ধারে সাবুই ঘাসের জঙ্গলে পয়সার কৌটোটা বালির তলায় পুঁতে ওরা দোসাদ-টোলায় ফিরতে থাকে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *