পাঁচ
রোজই ঠিকাদারবাবুদের আস্তানায় বগেড়ি দিয়ে ধর্মা আর কুশী সোজা চলে যায় মাস্টারজীর কাছে। আজও তারা সেদিকে চলল।
গারুদিয়া বাজারের এক ধারে ‘গরমিন’ রেস্টহাউসে দু’খানা কামরা নিয়ে ঠিকাদাররা থাকে, বাজারের আরেক দিকে ‘গরমিন’ একটা স্কুল খুলেছে। মাস্টারজী সেখানে পড়ান।
সমাজকল্যাণ দপ্তরের যে কারিক্রম (কার্যক্রম) রয়েছে, এই স্কুলটা তার মধ্যে পড়ে। উদ্দেশ্য হলো, সমাজের একেবারে নীচু স্তরে দারিদ্র্য-সীমার অনেক তলায় নানা দুরবস্থার মধ্যে যারা রয়েছে তাদের মধ্যে শিক্ষাদীক্ষার প্রসার। কিছুটা লেখাপড়া শিখে গ্রামীণ নিরক্ষর গরীব মানুষদের যাতে চোখ ফোটে, তারা যাতে নিজের বুঝ নিজে বুঝে নিতে পারে, সেজন্য এটা একটা সরকারী উদ্যোগ।
কিন্তু এত সব লম্বা-চওড়া কথা ধর্মা বোঝে না।
কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা বাজারের আরেক মাথায় নয়া স্কুলের টালির চাল দেওয়া বাড়িটার সামনে এসে পড়ল।
স্কুলের একপাশে একখানা ছোট টালির ঘরে থাকেন মাস্টারজী বদ্রীবিশাল পাণ্ডে। একাই থাকেন। নিজের হাতে রান্না করে খান। তাঁর রুগ্ন অসুস্থ স্ত্রী এক পাল ছেলেপুলে নিয়ে থাকেন দেশের বাড়ি মোতিহারিতে। এখান থেকে ট্রেন বা বাসে যেভাবেই মোতিহারিতে যাওয়া যাক, দু-তিন বার গাড়ি বদলাতে হয়। সময়ও লাগে অনেকটা।
মাস্টারজী তাঁর ঘরের দাওয়ায় একটা সস্তা কাপড়ের ইজি চেয়ারে বসে দুলে দুলে কী একটা বই পড়ছেন। এই দোল খাওয়াটা তাঁর অভ্যাস। ঘরের চালের বাতা থেকে একটা লাইট ঝুলছে। দাওয়ার তলায় উঠোন। উঠোনের একধারে ছোটখাটো ফুলের আর সব্জীর বাগান। মাস্টারজী নিজের হাতে এই বাগানটা করেছেন।
উঠোন থেকে ধর্মা ডাকল, ‘মাস্টারজী—’
মাস্টারজী ঘাড় ফেরালেন। সস্নেহে বললেন, ‘ওপরে উঠে আয়।’
ধর্মা আর কুশী দাওয়ায় উঠে এক কোণে জড়সড় হয়ে বসে।
মাস্টারজীর বয়স পঞ্চাশ-বাহান্ন। পাতলা দুবলা শরীর। মাথার চুল আধাআধি কালো, আধাআধি সাদা। লম্বাটে মুখ, চশমার পুরু কাচের ওপাশে দুটি স্নেহময় চোখ। গালে প্রায় সব সময়ই দু-তিন দিনের না-কামানো কাঁচা-পাকা দাড়ি। পরনে ঢলঢলে আধময়লা পাজামা আর মোটা খেলো ছিটের কুর্তা। ধর্মারা জানে এবং মাঝে মাঝেই টের পায় এই হাল্কা পলকা মাস্টারজীর মধ্যে একজন অত্যন্ত শক্তিমান জবরদস্ত মানুষ রয়েছে।
মাস্টারজীর সঙ্গে তাদের আলাপ তিন চার সাল আগে। তখন সবে এই নয়া ‘গরমিন’ স্কুলটা খোলা হয়েছে। মাস্টারজী আরো দু-একজন মাস্টার সঙ্গে করে এটার দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন। অন্য মাস্টারজীরা এখনও আছেন। গারুদিয়া বাজারের ওধারে ঘর ভাড়া করে ছেলেপুলে আর জেনানা নিয়ে থাকেন।
এখানে এসে ছাত্রের খোঁজে গায়ে গায়ে ঘুরেছেন মাস্টারজী, ক্ষেতিতে ক্ষেতিতে হানা দিয়েছেন। সবার হাত ধরে বলেছেন, ‘থোড়াসে লিখাপড়ী কর, পেটে দু-চারটে কালির অক্ষর ঢোকা। উপকার হবে, আঁখ ফুটবে। দুনিয়ার মানুষ তোদের ঠকাচ্ছে। ‘লিখিপড়ী’ আদমী হলে কেউ তোদের ঠকাতে পারবে না।’
মাস্টারজীর কথা শুনে তাদের মহল্লার বুড়োবুড়ি থেকে ছোকরা- ছুকরিরা পর্যন্ত সবাই দাঁত বার করে হেসেছে, ‘মাস্টারজী ক্যা কহল্ হো? হামনিকো ‘পড়িলিখী’ আদমী বনাই? জজ ম্যাজিস্টার দারোগা ভকিল বনাই? হো রামজী, তেরে ক্যা তামাসা! হো রামজী’
মাস্টারজী নাছোড়বান্দা। তিনি কোন কারণেই দমেন না। অপরিসীম তাঁর ধৈর্য এবং সহিষ্ণুতা। হাল না ছেড়ে দিনের পর দিন পুরনো সাইকেলে চেপে ঝক্কর ঝক্কর আওয়াজ তুলে ছাত্র ধরতে বেরিয়েছেন।
এত পরিশ্রম আর সদিচ্ছা বিফলে যায় নি। ছোটনাগপুরের নানা দেহাত থেকে তিনি ভূমিদাস, কিষাণ, গেঁয়ো মজুর মজুরনী—এমনি কিছু কিছু ছাত্র জুটিয়ে ফেলেছেন। এদের বেশির ভাগই জীবনের আধাআধি কি তিনকাল পার করে দিয়েছে। সারাদিন মাঠে হাল-বয়েল ঠেলার পর তাদের কাছে প্রথম পাঠের বর্ণমালা জটিল ধাঁধার মতো মনে হতে থাকে। অথচ এগুলো না শিখলে নাকি ‘লিখিপড়ী’র দুনিয়ায় ঢোকা যাবে না। ‘অ আ’ কী ক খ’ ইত্যাদি শব্দ আওড়াতে আওড়াতে তাদের চোখ ঘুমে ঢুলে আসে।
যাদের ঢের উমর তারা একদিন আসে তো সাতদিন না-পাত্তা হয়ে যায়। যাদের বয়স কম তারাও রোজ আসে না।
তবে একটা কাজ করেছেন মাস্টারজী। এইসব গরীব গাঁবালা কিষাণ বা ভূমিদাসদের ঘরের ছোট ছেলেমেয়েদের দুপুরের দিকে তিনি স্কুলে টানতে পেরেছেন। তবে তাও খুব একটা নিয়মিত ব্যাপার না। বাপ-মাদের সঙ্গে যেদিন ওদের ক্ষেতিবাড়িতে যেতে হয় সেদিন ওরা আর স্কুলে ঘেঁষে না।
অনেককে জোটাতে পারলেও ধর্মা আর কুশীকে লেখাপড়ার জন্য টানতে পারেন নি মাস্টারজী। ওরা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, সারা-দিন বড়ে সরকারের ক্ষেতিবাড়ি কি খামারে হাড্ডি চুর চুর করে কাজের পর পয়সার ধান্দায় তাদের ঘুরতে হয়। কেননা বড়ে সরকারের কাছে কাজের জন্য তারা পায় শুধু পেটের খোরাকি আর হর সাল দু খানা করে মোটা বনাতের হেটো কাপড় এবং দুটো করে জামা আর কিছু মিট্টি তেল। এদিকে মুক্তির জন্য তাদের পয়সা চাই-ই চাই। যেভাবে হোক তাদের পয়সা কামাই করতেই হবে।
এই মুক্তির বিষয়টা একটু পরিষ্কার করে বলা দরকার। ধর্মা এবং কুশীরা কয়েক পুরুষ ধরে বড়ে সরকার রঘুনাথ সিংদের ভূমিদাস। ধর্মার আর কুশীর বাপ, ঠাকুরদা, ঠাকুরদার বাপ রঘুনাথ সিংয়ের বাপ, ঠাকুরদা, ঠাকুরদার বাপ এবং ঠাকুরদার বাপের বাপের জমিতে শুধু খোরাকির বদলে লাঙল ঠেলে আসছে। কত সাল আগে ধর্মাদের কোন পূর্বপুরুষ রঘুনাথ সিংয়ের কোনো পূর্বপুরুষের কাছ থেকে নাকি অঙ্গুঠার টিপছাপ দিয়ে টাকা ‘করজ’ নিয়েছিল। ধারের সেই টাকাটা ফুলে-ফেঁপে পাহাড় প্রমাণ হয়ে উঠেছে। সেই টাকা শোধ করার জন্যই পুরুষানুক্রমে তারা বেগার দিয়ে যাচ্ছে।
তারপর কবে নাকি এর মধ্যে জমিদারি প্রথা-ট্রথা উঠে গেছে। কেউ নাকি অনেক বেশি জমিজমার মালিক থাকতে পারবে না। বাজারে-গঞ্জে নানা লোকের মুখে এইরকম কথাবার্তা কিছু কিছু যে ধর্মারা শোনে নি তা নয়। তবে ব্যাপারটা স্পষ্ট করে বুঝতে পারে নি।
কয়েক মাস আগে মুনশী আজীবচাঁদজী তাদের ডেকে নিয়ে ‘গরমিনে’র ছাপানো কাগজে (স্ট্যাম্পড পেপারে) দু-দু’বার অঙ্গুঠার ছাপ নিয়ে বলেছিল, ‘এবার থেকে তোরা জমিজমা ক্ষেতখামারের মালিক বনলি। বড়ে সরকার কিরপা করে তোদের নামে জমিন লিখে দিলেন। আর বেশি দিন তোদের বড়ে সরকারের জমিনে খাটতে হবে না। তব্ এক বাত—’
ধর্মাদের মহল্লার বয়স্ক মুরুব্বিরা খুশিতে ডগমগ হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ক্যা বাত মুনশীজী?’
‘এ্যায়সা এ্যায়সা তো দুনিয়ায় কিছু হয় না। থোড়ে থোড়ে দাম দিতে হয়। বড়ে সরকারের ক্ষেতিতে আগের মতো কামকাজ করে যা। এক রোজ জমিন-উমিন মিলে যাবে।’
তারপর এক সাল যায়, আরেক সাল আসে। আরেক সাল যায়, তার পরের সাল আসে। কিন্তু জমির মালিক হওয়া দূরের কথা, ভূমিদাসের জীবন থেকেই তারা মুক্ত হতে পারে না। ক্রমে ধর্মারা জানতে পারে বড়ে সরকার তাঁর বেশির ভাগ জমিজমা তাদের নামে বেনামা করে নিজে অনেক টাকার ঋণে বাধা রেখেছেন। যে দুটো কাগজে তাদের আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়েছে তার একটা ‘জমি’ বেনামা করার জন্য। অন্যটা মিথ্যে ঋণের দায়ে জমি বাঁধা রাখার জন্য। প্রচুর টাকা দিতে পারলে তবেই জমিগুলো পেতে পারবে ধর্মারা। কিন্তু অত টাকা তারা কোথায় পারে? ফলে জমির মালিক হওয়ার স্বপ্নটা তাদের অনেক কাল আগেই উবে গেছে। তা ছাড়া রাগের মাথায় রঘুনাথ সিংয়ের ক্ষেতখামার ছেড়ে যাবেই বা কোথায়? প্রথমত, রঘুনাথ সিংয়ের পোষা মাইনে-করা পহেলবান (পালোয়ান) রয়েছে। কেউ এখান থেকে ভাগতে চাইলে মেরে তাদের হাড়গোড় ভেঙে দেবে। দ্বিতীয়ত তাদের বাপ-ঠাকুরদারা অনেক টাকা নাকি আগে থেকেই রঘুনাথ সিংয়ের বাপ-ঠাকুরদার কাজ থেকে কর্জ নিয়েছে। সেই টাকা সুদে-আসলে কোন অঙ্কে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, কে জানে। টাকা শোধ না করে এখান থেকে তারা এক পা-ও নড়তে পারবে না। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর শুধু খোরাকির বদলে খেটে খেটে পূর্বপুরুষের ঋণ তাদের শোধ করে যেতেই হবে।
কিন্তু এই পরাধীন পশুর জীবন ধর্মা আর কুশীর কাছে একেবারেই কাম্য নয়। সেই কোন ছেলেবেলা থেকে পরের জমিতে বেগার দিতে দিতে তারা পাশাপাশি দুটি সতেজ গাছের মতো বড় হয়ে উঠেছে তারপর কবে একদিন স্বাভাবিক নিয়মেই তারা বুঝেছে একজনকে ছাড়া আরেক জনের চলবে না। আর তা বুঝতে বুঝতেই নিজেদের মতো করে এক বাঞ্ছিত জীবনের স্বপ্ন দেখেছে। ঘৃণ্য লাঞ্ছিত ক্রীতদাসের জীবন থেকে অন্য ভেবেছে সুযোগ পেলেই এই কোথাও গিয়ে ঘর বাঁধবে।
একদিন ভয়ে ভয়ে ধর্মা মুনশী আজীবচাঁদজীর কাছে গিয়ে বলেছিল, ‘মুনশীজী একগো বাত—’
আজীবচাঁদ কানে পালক গুঁজে সুড়সুড়ি দিতে দিতে বলেছিল, ‘বাতা না—’
‘মুনশীজী, হামনিকো বাপ-নানা আউর কুশীকো বাপ-নানাকে। বড়ে সরকারকে পাশ কিতনা উধার (ধার) হ্যায়?’
আজীবচাঁদ নড়েচড়ে খাড়া হয়ে বসেছিল। দু আঙুল গর্তে ঢোকানো তার চোখ দুটো একেবারে স্থির হয়ে গিয়েছিল। ভুরু কুঁচকে শিয়ালের মতো ছুঁচলে৷ মুখ আরো ছুঁচলো করে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘বহোত রুপাইয়া। শোধ করে দিবি নাকি?’
ধর্মা আজীবচাঁদের চোখের দিকে তাকাতে পারে নি। ঘাড় নীচু করে পায়ের বড়ো আঙুল দিয়ে মাটিতে লম্বা লম্বা আঁচড় কাটতে কাটতে আবছা গলায় বলেছিল, ‘নায়। রুপাইয়া কঁহা মিলি! অ্যায়সাই জানতে ইচ্ছা হলো।’
‘তাই বল।’
‘বহোত রুপাইয়া উধার—এক হাজার।’
এক হাজার যে কত টাকা সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই ধর্মার। প্রতিধ্বনির মতো করে শুধু বলেছিল, ‘এক হাজার!’
টেনে টেনে বিদ্রূপের ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে আজীবচাঁদ বলেছিল, ‘জী মহারাজ।’
‘কুশীকো বাপ-নানাকো কিতনা উধার?’
‘ওদেরও হাজার রুপাইয়া।’
তার মানে তাদের এবং কুশীদের মুক্তির দাম দু হাজার টাকা! ধর্মা কিন্তু এতটুকু দমেনি। সেদিন থেকেই মুক্তির দাম যোগাড় করার জন্য কুশীকে নিয়ে সে দক্ষিণ কোয়েলের খাতের দু ধারের জঙ্গলে আর প্রান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনও সাবুই ঘাসের জঙ্গলে গিয়ে ফাঁদ পেতে বগেড়ি ধরছে। কখনও ঘন শাল বা কেঁদের জঙ্গলে কুকুর নিয়ে ঢুকে শুয়োর মেরে আনছে। কখনও সাপ বা হরিণ মেরে সেগুলোর চামড়া খুলে নিচ্ছে। পাখি, শুয়োরের মাংস, সাপ বা হরিণের ছালের প্রচুর খদ্দের রয়েছে চারদিকে। প্রকৃতির চার ধারে প্রাণী এবং উদ্ভিদজগতে যা কিছু আছে সবই মূল্যবান এবং মানুষের কাছে প্রয়োজনীয়। সে সব ধরে বা হত্যা করে মানুষের হাতে তুলে দিলে তার জন্য পয়সা পাওয়া যায়। পয়সা তো নয়, ধাতুর কিছু রেজগি আর কাগজে ছাপানো কিছু নোট এ সবই তাদের স্বাধীন জীবনের দাম। যেমন করে হোক ছোটনাগপুরের সমস্ত পশু আর পাখির জীবনের বিনিময়েও নিজেদের মুক্তি কিনে আনবে ধর্মারা।
মাস্টারজীর স্কুলে ঢুকে ‘পড়িলিখী’ আদমী না বনলেও রোজই ধর্মারা তাঁর কাছে আসে। তাঁর মতো সৎ নির্লোভ মানুষ আগে আর কখনও তারা দ্যাখে নি।
.
মাস্টারজী বললেন, ‘তোদের জন্য কখন থেকে বসে আছি। এত দেরি করলি কেন?’
দেরির কারণটা সংক্ষেপে জানিয়ে দিল ধৰ্মা।
মাস্টারজী বললেন, ‘বাহ্ বাহ্ রঘুনাথ সিংয়ের মতো আদমী এম-এল-এ হবেন। বাহ্—’
ধর্মা বলল, ‘উসি লিয়েই মিঠাইয়া দিল।’
‘বাহ্— ‘
‘এবার হামনিকো পাইসা গিনতি করে দে’ বলে ধর্মা কুশীর কা থেকে টাকার কৌটোটা নিয়ে মাস্টারজীর হাতে দিল।
মাস্টারজী বললেন, ‘এত জলদি কিসের। এই কুশী ঘরে যা। বড় কটোরার তলায় কী আছে, নিয়ে আয়।’
কুশী মাস্টারজীর শোবার ঘরে ঢুকে অ্যালুমিনিয়ামের কটৌরার তলা থেকে দুটো আতা ফল আর দুটো শসা নিয়ে এল।
মাস্টারজী বললেন, ‘তোদের জন্যে রেখেছি। খা—’
কুশী বলল, ‘তুহারকে লিয়ে—’ অর্থাৎ মাস্টারজীর জন্য আতা-টাতা আছে কিনা তা জানতে চাইছে সে।
‘আমি খেয়েছি।’
মাস্টারজীর ছাত্রছাত্রীরা কেউ না কেউ প্রায় রোজই ‘পেয়ারসে’ তাদের গাছের ফল-ফলারি তাঁকে দিয়ে যায়। গরীব মানুষদের কাজ থেকে এ সব নিতে ভাল লাগে না মাস্টারজীর। অনেক বারণ করেছেন তিনি, রাগারাগি করেছেন, কিন্তু গারুদিয়া বা বিজুরি তালুকের দিনমজুর, বেগারখাটা কিষাণ আর ভূমিহীন মানুষেরা যে সময়ের যে ফল, মাস্টারজীকে তা দিয়ে যাবেই। না নিলে ওরা মনে মনে খুব কষ্ট পায়। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও হাত পেতে নিতে হয়।
ছাত্রছাত্রীরা যা দিয়ে যায় তার থেকে মাঝে মাঝে দু-একটা ফলপাকুড় ধর্মাদের জন্য রেখে দেন মাস্টারজী।
আতা এবং শসা ভাগাভাগি করে ধর্মারা খেতে লাগল। আজ তাদের পাওয়ার বরাত। বড়ে সরকারের মকানে মিঠাইয়া পাওয়া গেল, ঠিকাদারবাবুর কাছ থেকে বগেড়ির জন্য বেশি পয়সা পাওয়া গেল, তারপর মাস্টারজীর কাছে এখানে এসে মিলল গাছপাকা সুস্বাদু আতা আর শসা। আজকের দিনটা ভালই গেল। রোজ যদি এমন যেত!
খেতে খেতে কথা হচ্ছিল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নানা খবর নিচ্ছিলেন মাস্টারজী। রঘুনাথ সিংয়ের হাজার হাজার একর জমির কতটা চষা হয়েছে, ধর্মাদের মহল্লায় কে কেমন আছে—এমনি টুকরো টুকরো নানা খবর। কথায় কথায় রঘুনাথ সিংয়ের ‘এম্লে’ হওয়ার কথা উঠল। আজ লাড্ডু বিলির সময় তাঁর মকানে কারা কারা ছিল, সেখানে কী কী করা হয়েছে—সব জিজ্ঞেস করতে লাগলেন মাস্টারজী। প্রচুর গুলাল মাখামাখি হয়েছে এবং বড়ে সরকার রঘুনাথ সিং স্বয়ং নিজের হাতে ধর্মাদের মিঠাইয়া বেঁটে দিয়েছেন, তাদের সঙ্গে বহোত মিঠি গলায় ‘আপনা’ আদমীর মতো কথা বলেছেন—এসব শুনতে শুনতে চোখ কুঁচকে যেতে লাগল মাস্টারজীর। পরক্ষণেই তিনি হেসে ফেললেন। ইজিচেয়ারে বসে দুলে দুলে বলতে লাগলেন, ‘ভোটের তৌহার (পরব) তা হলে এসে গেল!’
মাস্টারজীর কথাটা ঠিক বুঝতে না পেরে ধর্মারা তাঁর মুখের দিকে তাকাল।
মাস্টারজী ফের বললেন, ‘বড়ে সরকার আপনা হাতে তোদের মিঠাইয়া দিল, মিঠাইয়ার থেকে বেশি মিঠি কথা বলল। তোদের কী বরাত রে!’
‘হাঁ–’ ধৰ্মা কুশী, দু’জনেই মাথা নাড়ল। বড়ে সরকারের আজকের এই আপনজনের মতো ব্যবহারে তারা অভিভূত।
‘দ্যাখ, এই সৌভাগ তোদের কপালে কদ্দিন টেকে!’ মাস্টারজীর স্বরে খানিকটা সূক্ষ্ম বিদ্রূপ যেন মেশানো। ধর্মা আর কুশী অবশ্য তা বুঝতে পারে না।
একটু চুপচাপ। তারপর মাস্টারজীই ফের বললেন, ‘একটু চা খাবি নাকি?’
মাস্টারজীর কাছে এলে রোজ রোজ ফল-ফলারি না মিললেও চা’টা মেলে। মাস্টারজীর এই চায়ের ওপর ধর্মাদের বড় লোভ। যেমন তার গন্ধ তেমনি স্বাদ। প্রচুর দুধ চিনি দিয়ে মাস্টারজী নিজের হাতে চা’টা এমনভাবে তৈরি করেন যা গারুদিয়া এবং বিজুরি তালুকের আর কেউ পারে না। এখানে এলে এক ‘গিলাস’ করে না খেয়ে ধর্মারা যায় না। তবে চায়ের কথা মুখ ফুটে বলতে রোজ রোজ শরম লাগে কিন্তু মাস্টারজী তাদের মনের কথাটা কীভাবে যেন রোজই টের পেয়ে যান।
ধর্মা কুশী দু’জনেই লাজুক মুখে হেসে ঘাড় কাত করল। অর্থাং চা নিশ্চয়ই খাবে।
মাস্টারজী বললেন, ‘যা, ঘর থেকে সব এখানে নিয়ে আয়।’
সব বলতে ‘মিট্টি তেলকা চুল্হা’ (কেরোসিনের স্টোভ), পাত্তি চা আর চিনির কৌটো, দুধের কড়া, কেটলি, এনামেলের গেলাস ইত্যাদি ইত্যাদি সাজ-সরঞ্জাম। দৌড়ে গিয়ে কুশী সেগুলো ঘরের ভেতর থেকে নিয়ে আসে।
মাস্টারজী স্টোভ ধরিয়ে চা চাপিয়ে দিলেন। তারপর কুশীকে বললেন, ‘তোকে একটু খাটাব।’
খাটুনিটা কিসের, কুশী জানে। মাস্টারজী একা মানুষ। নিজের হাতে রাঁধাবাড়া করে খান। কিন্তু এ ব্যাপারটায় তাঁর ভীষণ আলসেমি। ইচ্ছে হল তো দু’খানা রোটি বা লিট্টি সেঁকে নিলেন, নইলে চালে আলু ডাল কি অন্য সবজি ফেলে ফুটিয়ে নিলেন। ঘরে ভয়সা ঘি আর হরা মিরচি মজুদই থাকে। আর যেদিন ইচ্ছে হয় না সেদিন চাট্টী চিড়ে-মুড়ি চিবিয়ে বা ছাতু গুলে খেয়ে নেন। তবে কিছুদিন ধরে কুশীরা আসছে। ওরা এলেই তিনি কুশীকে চালটাল ধুয়ে স্টোভে চড়িয়ে দিতে বলেন। ওরা বেশীক্ষণ থাকলে কুশীকে দিয়ে ভাত নামিয়ে ফেন গালিয়ে নেন। অচ্ছুৎ দোসাদদের মেয়েটা প্রথম প্রথম কিছুতেই বামহনের জন্য ভাত বসাতে চাইত না। কিন্তু মাস্টারজী নাছোড়বান্দা। এমনিতে তিনি উদার মানুষ, ছোয়াছুয়ি মানেন না, জাতওয়ারি সওয়াল নিয়ে মাথা ঘামান না। ছোটখাট কিছু সংস্কার থাকলেও তিনি মানুষকে মানুষের মর্যাদা দিতে জানেন। আগে আগে ভাত বসাবার জন্য কুশীকে ধমকধামক দিতে হত, জোরজারও করতে হত। এখন আর ওসব কিছুই করতে হয় না। মাস্টারজীর মুখ থেকে কথা খসবার সঙ্গে সঙ্গে কুশী চাল এবং আলু-টালু ধুয়ে নিয়ে আসে। মানুষ যেভাবে দেওতার ভোগ সাজায় মাস্টারজীর জন্য ভাত বসাবার ব্যাপারে কুশীর ঠিক তেমনই যত্ন আর ভক্তি মেশানো থাকে।
মাস্টারজী আবার বললেন, ‘চা খাওয়া হয়ে গেলে আমার ভাত চাপিয়ে দিস—’
কুশী কিন্তু চা খাওয়া পর্যন্ত বসে থাকে না। চাল এবং আনাজের খোঁজে তক্ষুনি উঠে যায়। খানিকক্ষণ পর সিলভারের ছোট্ট হাঁড়ি রুপোর মতো ঝকঝকে করে মেজে তাতে চাল ডাল আলু ধুয়ে পরিমাণমতো জল দিয়ে নিয়ে আসে। এর মধ্যে চা হয়ে যায়।
চা ছেঁকে গেলাসে গেলাসে ঢেলে দুধ চিনি মেশাতে থাকেন মাস্টারজী। এই ফাঁকে স্টোভে ভাতের হাঁড়ি চড়িয়ে দেয় কুশী।
মাস্টারজীর চা হয়ে গিয়েছিল। গেলাসে গেলাসে ঢেলে ধর্মাদের দেবার পর নিজেও একটা গেলাস নিলেন।
পাছে চট করে ফুরিয়ে যায়, সেজন্য চায়ে লম্বা-চুমুক দেয় না ধর্মারা। চুক চুক করে একটু একটু খায়। যতক্ষণ চায়ের স্বাদটা জিভে ধরে রাখা যায়।
চা খেতে খেতে ধর্মা বলে, ‘মাস্টারজী আব পাইসা গিনতি কর দেখ আজ ঠিকাদারকো পাস তিশ রুপাইয়া মিলল। সব কোই জোড়কে দেখ কিতনা হৈল—’ বলে পয়সার সেই ঢাউস কৌটোটা এগিয়ে দেয়।
মাস্টারঙ্গী হাত বাড়িয়ে কৌটোটা নিতে নিতে বললেন, ‘তোদের কতবার বলেছি থোড়েসে ‘পড়িলিখি’ বন। তা হলে অন্যের কাছে পয়সা গোনাতে যেতে হবে না।
ধর্মা বলল, ‘নায় নায় মাস্টারজী, আভি নায়। আগে বড়ে সরকারের পাইসা শোধ করি, উসকে বাদ পড়িলিখি বনব।’
রোজ একই কথা বলেন মাস্টারজী আর ধর্মারা একই উত্তর দেয়। মাস্টারজী কৌটোর ঢাকনা খুলে নোট এবং রেজগিগুলো বারান্দায় ঢেলে ফেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে গুনতেও শুরু করেন। মোট দুশো দশ টাকা সত্তর পয়সা।
মাস্টারজী জানেন এই টাকাটা ধর্মাদের মোট দু-আড়াই বছরের সঞ্চয় এবং আরো জানেন, এটা ছোটনাগপুরের কয়েক হাজার বগেড়ি পাখি, কয়েক ডজন সাপ শুয়োর এবং হরিণের জীবনের দাম। অগুনতি পশু আর পাখির মৃত্যুর বিনিময়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ স্বাধীন জীবন কেনার জন্য তাদের এই সঞ্চয়।
ধর্মা জিজ্ঞেস করল, ‘দো শো দশ রুপাইয়া সত্তর পাইসা কিতনা পাইসা? বহোত নায়?’
মাস্টারজী হাসলেন। কিছু না বলে আস্তে আস্তে চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন।
ধর্মা আবার বলল, ‘দো হাজার পুরা হোনেসে আউর কিতনা লাগি?’
অর্থাৎ রঘুনাথ সিংয়ের কাছে পূর্বপুরুষের সেই দু হাজার টাকা ঋণের কতটা কাছাকাছি তারা আসতে পেরেছে? মাস্টারজী কি করে বোঝাবেন, যে পরিশ্রমে যে কষ্টে এবং যেভাবে তারা পয়সা জমাচ্ছে তাতে রঘুনাথ সিংয়ের কর্জ শোধ করতে তাদের আয়ু কেটে যাবে। কিন্তু উজ্জ্বল স্বাধীন জীবনের স্বপ্ন দেখছে যারা তেমন দুটি আশাবাদী নিষ্পাপ সরল আনপড় যুবক-যুবতীকে হতাশ করতে ইচ্ছা হয় না। মাস্টারজী বলেন, ‘জমিয়ে যা। একদিন ‘করজ’ ঠিক শোধ হয়ে যাবে।’
ধর্মা বলে, ‘বহোত রাত হো গৈল। হামনিকো যানা পড়ি—’
‘হাঁ, যা।’
‘কাল ফির আয়েগা।’ যাবার সময় এই কথাটা ধর্মারা রোজই বলে।
মাস্টারজী বলেন, ‘হাঁ, নিশ্চয়।’
ধর্মারা উঠে পড়ে।
গারুদিয়া বাজারে মাস্টারজীর ঘর থেকে বেরিয়ে কোন দিনই ওরা হাইওয়ে দিয়ে নিজেদের মহল্লায় ফেরে না। বাজারের উত্তর দিকে খানিকটা গেলেই মাঠের মাঝখানে এলোমেলো ছড়ানো দেহাত। সেই সব দেহাতের ভেতর দিয়ে ওরা ঘুরতে ঘুরতে যায়।
গাঁ-টা ঘোরার পর দক্ষিণ কোয়েলের মরা খাতটার পাশে সাবুই ঘাসের জঙ্গলে গিয়ে ওরা পয়সার কৌটোটা বালির তলায় পুঁতে রাখে, তারপর পাখি ধরার ফাঁদগুলো পেতে তবে ঘরে ফেরে।
গারুদিয়া বাজারের উত্তর দিকটায় দক্ষিণ আর পুব দিকের মতো জমজমাট ভাব নেই। এখানে দোকানপাট খুব কম। যা আছে সবই এলোমেলো ছড়ানো। তবে এ অঞ্চলেই রয়েছে কলালী (দিশী মদের দোকান)।
অন্য দোকানগুলো এত রাতে বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু কলালী এখন সরগরম। কোশ, দু কোশের মধ্যে যত গাঁ আছে সব জায়গা থেকে নেশাখোরেরা সাঁঝের আঁধার নামলেই এখানে জমা হতে থাকে। রাত যত বাড়ে, এখানকার আসর ততই জমে ওঠে। কলালীর গাহেকদের বেশির ভাগই দেহাতী তাতমা, দোসাদ, ধোবী, গঞ্জ, গোয়ার, আদিবাসী সাঁওতাল, কুৰ্মী, মুণ্ডা ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে নেশার কোন জাতপাত নেই। লুকিয়ে চুরিয়ে উচ্চবর্ণের দু-একজন বামহন-কায়াথও এখানে হানা দেয়।
মাস্টারজীর ঘর থেকে বেরিয়ে কলালীর পাশ দিয়ে যেতে যেতে রোজ রাতেই শরাবীদের ভিড় চোখে পড়ে ধর্মাদের। গলা পর্যন্ত দারু গেলার পর তাদের জড়ানো গলার হৈ-হল্লা কানে আসে। কলালীর এই পথটুকু ওরা দু’জনে লম্বা লম্বা পা ফেলে ঝড়ের বেগে পার হয়ে যায়।
আজও যেতে যেতে দারুখানার আড্ডায় আচমকা নেশাখোরদের মধ্যে রামলছমনকে দেখতে পেল ধর্মারা। আজীবচাঁদ যেমন বড়ে সরকার রঘুনাথ সিংয়ের পা-চাটা কুত্তা, রামলছমন তেমনি খামারবাড়ির কর্তা হিমগিরিনন্দনের পা-চাটা কুত্তা। বয়েস পঞ্চাশ বাহান্ন। বকের মতো চেহারা, বাঁকানো পিঠ, বাঁকানো নাক, লম্বা লম্বা লিকলিকে হাত-পা, গোল গোল চোখ, উঁচু কপালে পাতলা চুল, কপালে আর কানের লতিতে চন্দনের ফোঁটা। পরনে হাঁটুঝুল ধুতি আর কুর্তা, পায়ে কাঁচা চামড়ার নাগরা।
লোকটার আওরতের দোষ রয়েছে। বিল্লী যেমন মাছের গন্ধ পেলে ছোক ছোক করে, তেমনি কম বয়েসের ছিরিছাঁদওলা মেয়ে বা ছমকি আওরত দেখলেই রামলছমন ঘাড় গুঁজে হামড়ে পড়ে।
কুশী ভয়ের গলায় বলল, ‘কলালীমে বগুলা ভগত!’ গারুদিয়ার মানুষজন, বিশেষ করে দোসাদ মহল্লার লোকেরা বিদ্রূপ করে রামলছমনকে বলে বগুলা ভকত অর্থাৎ বকধার্মিক। তার কারণও আছে। সে কথা পরে।
দু-আড়াই বছর ধরে শীত-গ্রীষ্ম বারোমাস কলালীর পথ ধরে ধর্মারা বাড়ি ফেরে। কিন্তু আগে কোনদিনই দারুখানায় রামলছমনকে তারা দেখতে পায় নি। ধর্মা বলল, ‘চুহাটা দারুও খায়! তুরন্ত ভাগ ইহাসে। বলেই আরো জোরে পা চালিয়ে দেয় সে। বলা যায় না, কুশীকে দেখলেই বগুলা ভকত কলালী থেকে দৌড়ে চলে আসতে পারে।