চৌত্রিশ
সুতরাং বাপ-ঠাকুর্দা এবং তাদের বাপ-ঠাকুর্দার মতো আবার হাল-বয়েল নিয়ে বড়ে সরকার রঘুনাথ সিংয়ের জমিতে নামে ধৰ্মা। লাঙলের ফলায় ফলায় পাথুরে মাটি উপড়ে ফেলতে থাকে। তার পেছন পেছন আগাছা বাছতে বাছতে কুশীও অনবরত দৌড়তে থাকে।
এরই মধ্যে একদিন গারুদিয়া আর বিজুরি তালুকে ভোট হয়ে গেল। ভূমিদাসদের পাড়ার চার ঘর আর গণেরিরা বাদে বাকী সবাই লাইন দিয়ে চুনাওর কাগজে মোহর মেরে এল।
পাঁচ ঘরের ভোট না পড়াতে কিছুই যায় আসে নি। রঘুনাথ সিং শেষ পর্যন্ত সুখন রবিদাস আর প্রতিভা সহায়ক হারিয়ে জিতে গেলেন।
জেতার পর তাঁকে ঘিরে নতুন করে অকালে ফাগোয়া শুরু হল। আবীর আর গুলালে গোটা গারুদিয়ার আকাশ বাতাস লাল হয়ে যেতে লাগল। গলায় গোছা গোছা মালা পরে একটা জিপে উঠে হাতজোড় করে গাঁওয়ের পর গাঁওয়ে ঘুরতে লাগলেন বড়ে সরকার রঘুনাথ সিং। যারা তাঁকে ভোট দিয়েছে তাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে বেরিয়েছেন। তাঁর চুনাওকর্মীরা ‘রঘুনাথ সিং অমর রহে—’ করে করে আকাশ ফাটিয়ে ফেলছে। আর পা-চাটা কুত্তারা ‘হোয় হোয়, রামরাজ আ গিয়া রে’ করতে করতে গলায় রক্ত ওঠাচ্ছে।
ঘুরতে ঘুরতে শেষ পর্যন্ত ভূমিদাসদের পাড়ায় এলেন রঘুনাথ সিং। ভোটের রেজাল্ট বেরুবার পর তিনি আজ লাঙল চষা থেকে ছুটি দিয়েছেন ওদের।
রঘুনাথ সিং জীপে দাড়িয়েই বললেন, ‘তোদের জন্যেই আমি জিততে পারলাম। তোদের কী বলে যে ধন্যবাদ দেব! আর দেবই বা কেন? আমি তো তোদেরই একজন—তোদেরই লোক। তোদের ভালাইর-—’
ভিড়ের ভেতর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল ধর্মা আর দেখছিল। রঘুনাথ সিংয়ের কথা শেষ হবার আগেই চিৎকার করে উঠল, ‘ঝুট ঝুট ঝুট। তু হামনিকো আদমী নেহী। তুই আমাদের লোক না, আমাদের লোক না, আমাদের লোক না—’
আচমকা বাজ পড়লেও কেউ এত চমকাতো না। মুহূর্তে সমস্ত এলাকাটা স্তব্ধ হয়ে যায়। আর তার মধ্যেই বিস্ফোরণের মতো গারুদিয়া-বিজুরির সীমাহীন মাঠ প্রান্তরের ওপর দিয়ে ধর্মার কণ্ঠস্বর চারদিকে ছড়িয়ে যেতে থাকে, তুই আমাদের লোক না, তুই আমাদের লোক না।
এই একটা কথা উচ্চারণ করতে কয়েক পুরুষ আর কয়েক শো বছর কেটে গেছে তাদের।
***