আকাশের নিচে মানুষ – ৩৩

তেত্রিশ

দামটাম বুঝে ধর্মা যখন ফেরার বাস ধরল, তখনও অন্ধকার রয়েছে। গারুদিয়া তালুকে এসে হাইওয়ের ওপর নেমে দৌড়তে দৌড়তে দোসাদপাড়ার দিকে ছুটল সে। আজ সে ছ’জন মানুষের মুক্তি কিনে আনতে পারবে। জীবনে এত বিপুল আনন্দ কখনও তার হয়নি। আজ থেকে এই পৃথিবীতে সে আর কারো ভূমিদাস নয়, এক মহিমান্বিত স্বাধীন মানুষ।

প্রায় অর্ধেক রাত বাঘিনীর সঙ্গে লড়াই করে সে স্বাধীনতার দাম নিয়ে এসেছে।

দোসাদটোলায় ধর্মা যখন পৌঁছল, বিরাট সোনার থালার মতো সূর্যটা আকাশের তলা থেকে উঠে আসছে।

মহল্লায় পা দিয়েই সে থমকে গেল। কুশী গিধনী সোমবারী আর তিসিদের ঘরের সামনে গোটা পাড়া জড়ো হয়েছে! আর ঐ চারটে মেয়ের মা-বাপ কপাল চাপড়ে সমানে ডুকরে কেঁদে চলেছে। বাকী সবাই শোকাচ্ছন্ন বিষাদ-মাখা মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একটু দুরে আধবুড়ো মুরুব্বি গণেরি মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।

ধর্মার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। এক রাত সে এখানে ছিল না। তার ভেতর কেউ কি মরে গেল? আস্তে আস্তে ধর্মা গণেরির কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে, ‘কা হুয়া চাচা?’

‘সব খতম—’ বলে একটু থেমে গণেরি ভাঙা ভাঙা গলায় যা বলে তা এইরকম। কাল বিকেলে ধোঁকা দিয়ে মহল্লার চারটে মেয়েকে রামলছমন নিয়ে গিয়েছিল।

তাদের শেষ পর্যন্ত তুলে দেওয়া হয় মিশরীলালজীর হাতে। সারা রাত আটকে রাখার পর খানিকক্ষণ আগে তাদের পৌঁছে দিয়ে গেছে বড়ে সরকারের পহেলবানেরা।

শুনতে শুনতে হাত-পায়ের জোড় আলগা হয়ে যেতে থাকে ধর্মার। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। টলতে টলতে বসে পড়ল।

সেদিনই দুপুরের দিকে মুনশী আজীবচাঁদের সঙ্গে দেখা করে ধর্মা। সর্বনাশ যা হবার তা তো হয়েই গেছে। গারুদিয়া তালুকে সে আর একটা দিনও থাকবে না। পূর্ব পুরুষের করজে’র টাকা শোধ করে কুশীদের নিয়ে গারুদিয়া তালুক ছেড়ে চলে যাবে।

আজীবচাঁদ জিজ্ঞেস করে, ‘কি রে, কী খবর? তোর হাল এরকম হল কী করে?

প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ধর্মা বলে, ‘আমাদের ‘করজে’র কাগজ দিয়ে দিন। রুপাইয়া শোধ করে এখান থেকে চলে যাব।’

আজীবচাঁদ খাড়া হয়ে বসে।

চশমার ফাঁক দিয়ে ধর্মাকে দেখতে দেখতে বলে, ‘রুপাইয়া শোধ দিবি! পেলি কোথায়! চোরি করেছিস, না ডাকাইতি?’

‘যাই করি, আপনাদের রুপাইয়া নিয়ে নিন।’

‘কত রুপাইয়া হুঁশ আছে?’

‘আছে। কুশীদের আর আমাদের মিলে দো হাজার’ ধর্মা বলে। সঙ্গে করে পুরো টাকাটাই নিয়ে এসেছে সে। আসার আগে মাস্টারজীকে দিয়ে গুনিয়ে নিয়েছে।

আলমারি থেকে কী একটা কাগজ বার করে দেখতে দেখতে আজীবচাঁদ বলে, ‘দো হাজার তোকে কে বলল! পুরা পাঁচ হাজার।

ধর্মার মাথার ভেতরটা প্রচণ্ড শব্দ করে যেন চৌচির হয়ে যেতে থাকে। কাঁপা গলায় সে বলে, ‘আগে যতবার আপনাকে পুছেছি বলেছেন দো হাজার। এখন বলছেন পাঁচ হাজার!’

‘ঝুট! কক্ষনো তোকে দো হাজার বলি নি। যা, ভাগ। আমার জরুরী কাম আছে।’ 

রাগে ধর্মার গায়ের রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকে। হাতের কাছে টাঙ্গিটা থাকলে সে আজীবচাদের ঘাড়ে হয়ত বসিয়ে দিত। আজীবচাদ জানে না, এই মুহূর্তে একটি পরাধীন ভূমিদাসের বুকে কতখানি বিস্ফোরকের সৃষ্টি করল সে।

প্রায় টলতে টলতে বেরিয়ে আসে ধর্মা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *