ত্রিশ
ইদানীং ক’দিন ধরে ধর্মা ক্ষেতের কাজকর্ম সেরে কাঁধে একটা টাঙ্গি ফেলে চলে যাচ্ছে দূর জঙ্গলের ভেতরে। আর কুশীকে পাঠাচ্ছে সাবুই ঘাসের জঙ্গলে—যদি মেয়েটা দু-চারটে বগেড়ি ধরে ঠিকাদারদের কাছে বেচে এক-আধটা টাকা আনতে পারে—এই আশায়। চিতার বাচ্চা ধরে দেবার জন্য আগাম টাকা নেওয়া আছে টিরকের কাছ থেকে। তা ছাড়া বাকী টাকাটা না পেলে জনমদাসের জীবন থেকে মুক্তি নেই। কাজেই চিতার বাচ্চা তাকে ধরে আনতেই হবে।
চিতা, লাকড়া, দাঁতাল শুয়োর এবং অন্য সব ভয়ানক জানোয়ারে ঠাসা ঐ জঙ্গলটায় একা একা ধর্মা যাক, এটা একেবারেই চায় না কুশী। সে বলে, ‘ওহী জঙ্গলমে খতারনাক জানবর হ্যায়। নায় যা, নায় যা—’
কুশীর কথা কানে না তুলে আগে কয়েক বার ওখানে গেছে ধর্মা। এখনও যেতে লাগল। ধর্মা তাকে বোঝায়, একবার চিতার বাচ্চা দুটো সে যোগাড় করে আনুক। তারপর আর ওখানে যাবে না।
কুশীর মন খারাপ হয়ে যায়। তার মুখচোখ দেখে টের পাওয়া যায়, ভীষণ ভয় পেয়েছে। ভীত গলায় কুশী বলে, ‘তাহলে আমাকেও নিয়ে চল।’
ধর্মা বোঝায়, তার জন্য ভয় নেই। হাতে যতক্ষণ টাঙ্গি রয়েছে, কোন জানোয়ারের সাধ্য নেই গায়ে একটা আঁচড় কাটতে পারে। বরং সঙ্গে একটা আওরত থাকলে অনেক ঝামেলা। আচমকা কোন জানোয়ার ঝাঁপিয়ে পড়লে তখন নিজেকে বাঁচাবে, না কুশীকে বাঁচাবে!
রোজই সূর্যাস্তের সময় খামারে হাল-বয়েল জমা দিয়ে কাঁধে টাঙ্গি ফেলে দক্ষিণ কোয়েলের মরা খাতের স্তূপাকার বালির ওপর দিয়ে দৌড়তে থাকে ধর্মা। তার পেছন পেছন কুশী। বিশাল আকাশের তলায় ধু-ধু ফাঁকা বালির ডাঙার ওপর এক ক্রীতদাস যুবক আর এক ক্রীতদাসী যুবতী স্বাধীনতার দাম যোগাড় করার জন্য রোজ এইভাবে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে থাকে।
সাবুই ঘাসের বন পর্যন্ত ওরা একসঙ্গে যায়। ওখানে পৌঁছুলেই ধর্মা বলে, ‘ফাঁদে বগেড়ি পড়েছে কিনা দ্যাখ, আমি যাই।’
কুশী থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। মুখটা তার করুণ হয়ে যায়। আস্তে করে সে বলে, ‘দের নায় করনা। তুরন্ত চলে আসবি।’
ধর্মা দাঁড়ায় না। দিনের আলো থাকতে থাকতেই সে জঙ্গলে জঙ্গলে ঢুকতে চায়। রাত নামা আর অন্ধ হয়ে যাওয়া এক কথা।
দৌড়তে দৌড়তেই সে বলে, ‘হুঁ, আসব—’
কুশী কিন্তু তক্ষুণি সাবুই ঘাসের বনে ফাঁদ দেখতে ঢোকে না, দক্ষিণ কোয়েলের মরা খাতের বালির ওপর যতক্ষণ ধর্মাকে দেখা যায়, তাকিয়ে থাকে। শেষ বেলার আলোয় ধর্মার বিশাল কাঁধে টাঙ্গির ফলাটা জ্বলতে থাকে। দেখতে দেখতে মনে হয় ও পারবে, নিশ্চয়ই চিতার মুখ থেকে তার বাচ্চাদের উঠিয়ে নিয়ে আসতে পারবে। পরমুহূর্তেই ভয় হয়, জঙ্গল বড় বুরা জায়গা আর চিতা ভীষণ খতারনাক জানোয়ার। আশায় এবং ভয়ে তার বুকের ভেতরটা দুলতে থাকে।
দক্ষিণ কোয়েলের শুকনো খাত অনেক দূরে যেখানে বাঁক ঘুরেছে একসময় সেখানে অদৃশ্য হয়ে যায় ধর্মা। তখন কুশী বিড় বিড় করে বলতে থাকে, ‘হো রামজী, হো ভগোয়ান, তেরে কিরপা, তেরে কিরপা—’ ধর্মার যাতে কোনরকম ক্ষতিটতি না হয় সে জন্য ঈশ্বর রামচন্দজীর কাছে তার এই প্রার্থনা। নিজের মনে ধর্মার মঙ্গল কামনা করতে করতে সে ঘাসবনে ঢুকে যায়।
ওদিকে আরশির মতো জলের ধারে শাল-পরাস-কড়াইয়া আর কেঁদের জঙ্গলে ধর্মা গিয়ে যখন ঢোকে তখন সন্ধ্যে নামতে শুরু করে। কান খরগোশের মতো খাড়া করে সতর্ক চোখে চারদিক দেখতে দেখতে পা টিপে টিপে জঙ্গলের গভীরে যেতে থাকে সে।
.
দিন তিনেক এইভাবে কেটে যায়। এ ক’দিনে জঙ্গলে একটা লাকড়া, গোটা দুই দাঁতাল, আখছার হরিণ খরগোশ ছাড়া চিতা দুরে থাক, তার গায়ের একটা ফুটকিও চোখে পড়েনি। যা-ও দু-একটা জন্তু-জানোয়ার তার চোখে পড়েছে তা দূর থেকে। তবে একদিন সাপের মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিল ধর্মা। টাঙ্গির কোপে সেটার মুণ্ডু উড়িয়ে দিয়েছিল সে।
জঙ্গলে চিতার খোঁজে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরির পর ক্লান্তিতে শরীর যখন টলতে থাকে সেই সময় বেরিয়ে আসে ধর্মা। দক্ষিণ কোয়েলের মরা খাত ধরে আবার সে ফিরে যায়।
কোয়েলের বালি ভাঙতে ভাঙতে সাবুই ঘাসের জঙ্গল পেরিয়ে খানিকটা আসার পর রোজই ধর্মার চোখে পড়ে, হাইওয়ের কাছে উঁচু বালির স্তূপের ওপর কুশী দাঁড়িয়ে আছে। রোজই তার জন্য ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকে মেয়েটা। রাত তখন নিঝুম হয়ে যায়, আশেপাশে কেউ কোথাও নেই। ধু-ধু শস্যক্ষেত্রে, আদিগন্ত মাঠ, ঝাপসা আকাশ, সব একেবারে ফাঁকা। সুবিশাল আকাশের তলায় আবছা চাঁদের আলো গায়ে মেখে যে মানবীটি দাড়িয়ে আছে তাকে দেখতে দেখতে স্বপ্নের কোন পরীর মতো মনে হয়। হঠাৎ চিরকালের ক্রীতদাস ধৰ্মা আশ্চর্য এক ঘোরের মধ্যে তার দিকে ছুটতে থাকে।