আকাশের নিচে মানুষ – ২৯

 ঊনত্রিশ

রঘুনাথ সিং সেদিন তাঁর পরামর্শদাতা, চামচা এবং গণেরিদের কাছে ঘোষণা করেছিলেন, ফাগুরামকে মারার বদলা অবশ্যই নেবেন। প্রতিভা সহায়কে তিনি ছাড়বেন না। কিন্তু ফাগুরামের মৃত্যুর পর তিন চার দিন কেটে গেল, এ ব্যাপারে তাঁর কোনরকম গরজ দেখা যাচ্ছে না। হয়ত ভেবেছেন, চুনাওর মুখে এ নিয়ে হুজ্জত করতে গেলে এমন ঝামেলায় জড়িয়ে যাবেন যেটা তাঁর নির্বাচনী ফলাফলের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। তা ছাড়া একটা নগণ্য দোসাদের জীবন গারুদিয়া বিজুরিতে এমন কিছু অমূল্য নয় যা নিয়ে রঘুনাথ সিংয়ের মতো মানুষকে সমস্ত কাজকর্ম ফেলে ভেবে ভেবে সময় অপচয় করতে হবে।

বড়ে সরকার চুনাও নিয়ে এখন সর্বক্ষণ ব্যস্ত। গারুদিয়া বিজুরির গাঁয়ে গাঁয়ে তাঁর জীপ প্রায় সারাদিনই ধুলো উড়িয়ে ছুটতে থাকে। বাজারে-গঞ্জে নিয়মিত মীটিং করে চলেছেন তিনি। ইদানীং প্রতিটি মীটিংয়েই তাঁর সঙ্গে আবু মালেক আর নেকীরাম শর্মাকে দেখা যায়। তারা আগামী নির্বাচন থেকে নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছে। নেকীরাম এবং আবু মালেক আজকাল প্রতিটি উচ্চবর্ণের হিন্দু এবং মাইনোরিটিকে রঘুনাথ সিংকে ভোট দেবার জন্য আবেদন জানাচ্ছে। বোঝাচ্ছে, রঘুনাথজীকে ভোট দিলেই তাদের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ থাকবে; তাদের নিরাপত্তা একেবারে ‘গিরান্টিড’।

প্রতিভা সহায় বা সুখন রবিদাসও বসে নেই। তারাও গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে চুনাওর মীটিং করে যাচ্ছে।

যে যা খুশি করে যাক, ফাগুরামের বেঘোরে এই মৃত্যু গণেরিদের দোসাদটোলাটাকে কয়েকটা দিন বিমর্ষ করে রাখে।

আজ সকালে খামারবাড়ি থেকে হালবয়েল নিয়ে ক্ষেতির দিকে যেতে যেতে হঠাৎ অবাক হয়ে যায় ধৰ্মা। হাইওয়ের তলায় নীচু পড়তি জমিতে যেখানে কিছুদিন আগে আদিবাসী ওরাঁও-মুণ্ডারা এসে চট বাঁশ ইত্যাদি দিয়ে অস্থায়ী ছাউনি তুলে নিয়েছিল তার গা ঘেঁষে সারি সারি গৈয়া এবং বয়েল গাড়ি দাড়িয়ে আছে। আর সেই লোকদুটো, চাহাঢ়ের হাটিয়ায় যারা আদিবাসীদের আসাম না আগরতলা কোথায় নিয়ে যাবার জন্য অনবরত ফোসলাচ্ছিল—তাদের দেখা যায়। তারা হাঁকডাক করে তাড়া দিয়ে দিয়ে ওরাঁও-মুণ্ডাদের গাড়িগুলোতে তুলছে।

আচানক কী মনে পড়তে থমকে দাড়িয়ে যায় ধর্মা। একেবারে সামনে যে জোয়ান মুণ্ডাটাকে পায় তাকে শুধোয়, ‘কোথায় যাচ্ছিস তোরা?’

মুণ্ডাটা বলে, ‘আসাম।’

জোরে শ্বাস ফেলে ধর্মা। আড়কাঠি দুটো বলেছিল, আসাম বা আগরতলায় গেলে পেট ভরে খেতে পাবে, পাইসা মিলবে, জামা- কাপড় মিলবে। আদিবাসীগুলো তো বেঁচে গেল। কিন্তু তাদের মতো জনমদাসদের আমৃত্যু হয়ত বড়ে সরকারের ক্ষেতিতে লাঙল ঠেলেই যেতে হবে।

পেছন থেকে বুধেরি বলে, ‘কা রে ধর্মা, পাক্কীতেই দাঁড়িয়ে থাকবি, না জমিনে যাবি?’

ধর্মা উত্তর দেয় না। ঘাড় গুঁজে বিষণ্ণ মুখে ফের হাঁটতে থাকে।

ক্ষেতিতে আসার পর দুপুর পর্যন্ত আর কোন দিকে তাকাবার ফুরসত পায় না কেউ। দুপুরে সূর্যটা যখন খাড়া মাথার ওপর এসে ওঠে সেই সময় অন্য সবার সঙ্গে গামছায় মুখ মুছে কালোয়া খেতে বসে ধর্মা, কুশী। আর তখনই দেখা যায় হাইওয়ের দিক থেকে টিরকে আসছে। এই ঝাঁ-ঝাঁ জ্যৈষ্ঠের দুপুরে যখন লু-বাতাস চারদিকে আগুন ছড়াচ্ছে সেই মুহূর্তে তার আসার উদ্দেশ্য বুঝতে অসুবিধা হয় না ধর্মার। টিরকে কাছাকাছি এসে গেলে সে বলে, ‘দো-চার রোজকা অন্দর জঙ্গলমে যায়েগা টিরকে ভাইয়া। ইডভান্স পাইসা নিয়েছি; চিতার বাচ্চা ঠিক এনে দেব। চিন্তা করো না।’

টিরকে বলে, ‘ও তো ঠিক আছে। মগর বাচ্চা দুটো তাড়াতাড়ি চাই। আমরিকী সাব আগেলা উইকমে আয়েগা। সাত রোজ থাকবে। তার ভেতর যেভাবে পারিস যোগাড় করে দে।’

‘ঠিক হ্যায়। মগর—’

‘কা?’

খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে ধর্মা। তারপর বলে, ‘ভাইয়া আউর দোশো রুপাইয়া দিতে হবে।’

টিরকে চমকে ওঠে প্রথমটা। তারপর স্থির চোখে ধর্মাকে দেখতে দেখতে বলে, ‘তোর সাথ তো সেদিনই দাম ফাইনিল হয়ে গেল। আবার টু হানড্রেড চাইছিস যে?’

‘এটা দিতে হবে। না হলে তোমার ইডভান্স ওয়াপস নিয়ে যাও।’ ধর্মা বলে। আসলে মাস্টারজীকে দিয়ে সে গুনিয়ে দেখেছে ঐ বাড়তি দুশো টাকা না হলে বড়ে সরকারের করজটা শোধ করা যাবে না। আন্দাজে সেদিন দেড় হাজারের কথা বলেছিল সে।

টিরকে বলে, ‘এ বহোত জুলুমকা বাত।’

ধর্মা কাচুমাচু মুখে বলে, ‘তুমি ইস টেইন রুপাইয়াটা দাও। পরে তোমাকে বিনা পয়সায় অন্য জানবর জুটিয়ে এনে দেব।’

লাভ কিছুটা কম হবে। কিন্তু এখন আর ফেরার রাস্তা নেই। আমেরিকান সাহেবের কাছ থেকে আগাম বহু টাকা নিয়ে ফেলেছে টিরকে। সন্দিগ্ধ গলায় সে বলে, ‘পরে আবার দামটা চড়াবি না তো?’

‘নায় নায়, রামজী বিষ্ণুণজী কসম—’

‘ঠিক হ্যায়। টু হানড্রেড জ্যাদাই দেব—মগর জঙ্গলে দু-এক রোজের মধ্যে চলে যা।’

‘হুঁ, জরুর।’

টিরকে আর বসে না, নিরানন্দ মুখে চলে যায়। বাড়তি দুশো টাকা দিতে কার প্রাণই বা খুশিতে নেচে ওঠে!

.

পছিমা আকাশে সূর্য যখন আধাআধি ডোবে, সেই সময় ভূমিদাসেরা জমিন থেকে হালবয়েল তুলে অন্য দিনের মতোই খামার বাড়িতে ফিরতে থাকে। হাইওয়ে ধরে যেতে যেতে ধর্মা দেখতে পায়, নীচের সেই পড়তি জমিটা এখন একেবারে ফাঁকা। ওরাঁও মুণ্ডাদের একজনকেও কোথাও দেখা যায় না। এমন কি তাদের আস্তানার এক টুকরো বাঁশ বা এক ফালি চটও পড়ে নেই। ক্ষণস্থায়ী আস্তানার সমস্ত চিহ্ন মুছে দিয়ে তারা চলে গেছে।’

হালবয়েল জমা দেবার পর দৈনন্দিন কর্মসূচী অনুযায়ী সাবুই ঘাসের জঙ্গলে চলে যায় ধর্মা এবং কুশী। সেখান থেকে ঠিকাদারদের কাছে। তারপর মাস্টারজীকে দিয়ে পয়সা গুনিয়ে বেশ রাত করেই কালালীর পাশ দিয়ে যখন তারা জ্যৈষ্ঠের ফাঁকা শস্যক্ষেত্রে নামে সেই সময় আচমকা দূর থেকে বহু মানুষের চিৎকার ভেসে আসতে থাকে। ধর্মা এবং কুশী থমকে দাড়িয়ে যায়। হৈ চৈ এবং চেঁচামেচিটা কোন দিক থেকে আসছে, বোঝার জন্য এধারে ওধারে তাকাতে তাকাতে চমকে ওঠে। গারুদিয়া বাজারের পেছন দিকে কোণাকুণি দক্ষিণের গোটা আকাশ লাল হয়ে উঠেছে।

চাপা ভয়ার্ত গলায় কুশী বলে ওঠে, ‘আগ—’

ঠিক এই কথাটাই ভাবছিল ধর্মা। ঐ দিকটায় কোথাও আগুন লেগেছে। সে আস্তে মাথা নাড়ে, ‘হুঁ।’

‘ওধারে গঞ্জুদের দোগো গাঁও—’

‘হঁ। চামার লোগনকা গাঁও ভি হ্যায়–’

ধর্মা এবং কুশী জানে ঐ দক্ষিণ দিকটায় পর পর খান কয়েক অচ্ছুৎদের গা গা জড়াজড়ি করে পড়ে আছে। ধর্মা বলে, ‘কাদের গাঁওয়ে আগ লাগল কে জানে।’

কুশী উত্তর দেয় না।

কতক্ষণ দু’জনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সুদূর রক্তবর্ণ আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল, নিজেরাই জানে না।

হঠাৎ পায়ের শব্দে তাদের চমক লাগে। দেখতে পায়, সাত আটটা হট্টাকট্টা চেহারার লোক দৌড়ে আসছে। পাশ দিয়ে ওরা যখন চলে যাচ্ছে সেই সময় অন্ধকারেও চিনে ফেলে ধর্মারা। লোকগুলো রঘুনাথ সিংহের পোষা পহেলবান। তাদের হাতে লাঠি এবং মিটি তেলের টিন।

ওরাই কি তা হলে অচ্ছুৎদের গাঁ-গুলোতে আগুন লাগিয়ে এল? কথাটা মনে হতেই হাড়ের ভেতর পর্যন্ত ভয়ে হিম হয়ে যায় ধর্মাদের।

ওদের ছাড়িয়ে খানিকটা এগিয়েই আবার ফিরে আসে লোকগুলো। ধর্মা এবং কুশীকে ভয়ঙ্কর চোখে দেখতে দেখতে বলে, ‘তোরা এই অন্ধেরাতে দাঁড়িয়ে কী করছিস?’

ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে ধর্মা বলে, ‘মাস্টারজীর কাছে এসেছিলাম। এখন ঘরে ফিরছি।’

‘আমাদের যে দেখেছিস, কাউকে বলবি না। যদি বলিস্ গলার নালিয়া ফেঁড়ে ফেলব।’

জিভের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত শুকিয়ে খরখরে হয়ে গেছে ধর্মার। কোন রকমে গলার ভেতর থেকে দুটো মাত্র শব্দ বার করতে পারে, ‘নায়, নায়—’

‘হোশিয়ার!’

ধর্মা এবং কুশীকে সতর্ক করে দিয়ে চলে যায় লোকগুলো।

অনেক রাতে দোসাদটোলায় ফিরে ধর্মা এবং কুশী গণেরিকে কাঁচা ঘুম থেকে তুলে ফিসফিসিয়ে অচ্ছুৎদের গাঁয়ে আগুনের এবং রঘুনাথ সিংয়ের পহেলবানদের কথা জানায়।

সব শুনে অনেকক্ষণ স্তব্ধ বসে থাকে গণেরি। তারপর বলে, ‘যা দেখেছিস মুহ্‌ দিয়ে কখনও তা বার করবি না। হোঁশিয়ার।’

পরের দিন সকালে খামার বাড়িতে এসে তাজ্জব বনে যায় ধর্মারা। স্বয়ং রঘুনাথ সিংকে সেখানে দেখা যায়। একটা প্রকাণ্ড চেয়ারে তিনি বসে আছেন। তাঁর সামনে একান্ত বশংবদ ভঙ্গিতে শিরদাড়া টান টান করে দাঁড়িয়ে আছে হিমগিরি। খানিকটা দূরে হাত জোড় করে বসে আছে কয়েক হাজার ধোবি, গঞ্জু এবং রবিদাস। গারুদিয়া বাজারের দক্ষিণে এদের গাঁগুলো কাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সমানে ওরা কেঁদে যাচ্ছে আর বলছে, ‘মর গিয়া হুজৌর, মর গিয়া।’

ধর্মারা জানে না, ভোর রাত্তিরে গঞ্জ ধোবিদের লোক পাঠিয়ে খামারে ডাকিয়ে এনেছেন রঘুনাথ সিং। অপার স্নেহে মধুর গলায় তিনি বলেন, ‘কেন মরবি! আমি আছি না? আমি তোদের নিজের লোক, মেরে আপনে। আমি তোদের গাঁ নতুন করে বানিয়ে দেব।’ হিমগিরির দিকে ফিরে বলেন, ‘এদের যার যা লাগে, বাঁশ, খড়, নয়া টিন—সব দেবে। আর হাঁ, দশ রোজ খোরাকির জন্য গেঁহু, বাজরা, মকাই, মিট্টি তেল, নিমুকও দেবে।’

অচ্ছুৎরা অভিভূত হয়ে যায়। কৃতজ্ঞ আপ্লুত মানুষগুলো রুদ্ধ গলায় বলতে থাকে, ‘হুজৌর হামনিকো মা-বাপ। আপনার কিরপায় হামনিলোগ বঁচ যায়েগা। হুজৌর ভগোয়ান।’

যেন কতই বিব্রত হয়েছেন এমন ভঙ্গিতে রঘুনাথ সিং বলেন, ‘এ সব বলতে নেই। মনে রাখিস আমি তোদের আপন জন সিরিফ মেরে আপনে।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *