আকাশের নিচে মানুষ – ২৮

আটাশ

এখন বেশ রাত।

রঘুনাথ সিংয়ের হাভেলিতে সেই পাথর বসানো বিশাল বারান্দায় নির্বাচন সংক্রান্ত কথাবার্তা চলছে।

এটা কোন প্রকাশ্য অধিবেশন নয়। যেদিন কোথাও চুনাওর মীটিং থাকে না সেদিন সন্ধ্যের পর একান্ত নিজস্ব এবং বিশ্বস্ত ক’জন বন্ধুবান্ধব, পরামর্শদাতা এবং চামচাকে নিয়ে রঘুনাথ নিগূঢ় ও গোপন আলোচনায় বসেন। চামচা শব্দটা হিন্দী সিনেমার দৌলতে ইদানীং এ অঞ্চলে বেশ চালু হয়ে গেছে। যাই হোক, এটাকে ইংরেজিতে ইনার সার্কেলের মীটিং বলা যেতে পারে। এখানে বসেই চুনাও নামক লড়াইয়ের নানা সূক্ষ্ম এবং চতুর চাল ঠিক করা হয়।

আজও ইনার সার্কেলের সেই মীটিং চলছে। রঘুনাথ সিংকে মাঝখানে বসিয়ে অন্য সবাই তাঁকে ঘিরে রয়েছে। রঘুনাথের সেই চিরস্থায়ী পা-চাটা কুত্তার দল অর্থাৎ মাস্টারজী, ডাগদর সাহেব, ভকীলজী—এঁরা তো রয়েছেনই। সেই সঙ্গে নতুন দুটি মুখও দেখা যাচ্ছে—নেকীরাম শর্মা এবং আবু মালেক। রাতের অন্ধকারে বিশ্বাসী এজেন্টদের পাঠিয়ে নেকীরাম আর মালেক সাহেবের সঙ্গে সমঝোতা করে ফেলেছেন রঘুনাথ! তবে খালি হাতে না। এ বাবদে তাঁকে বেশ কিছু খরচও করতে হয়েছে। ব্যাপারটা এখনও জানাজানি হয় নি, তবে ঠিক হয়েছে নেকীরাম আর আবু মালেক এবারের চুনাও থেকে নাম প্রত্যাহার করে নেবে এবং রঘুনাথ সিংয়ের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে নামবে। তারা বোঝাবে, উচ্চবর্ণের হিন্দু এবং সংখ্যালঘুদের স্বার্থ একজনই রক্ষা করতে পারেন। তিনি আর কেউ নন—রঘুনাথ সিং। আশা করা যাচ্ছে, এর ফলাফল ভালই হবে। নেকীরাম আর আবু মালেকের ভোটের যে হিস্যা পাবার কথা, সেগুলো তিনিই পেয়ে যাবেন। গারুদিয়া-বিজুরির জনগণ কাল-পরশুর মধ্যেই চুনাওর মীটিংয়ে সুসজ্জিত মঞ্চে রঘুনাথ সিংয়ের সঙ্গে আবু মালেক এবং নেকীরাম শর্মাকে পাশাপাশি দেখতে পাবে।

রঘুনাথ সিং বললেন, চুনাওর লড়াইটা শেষ পর্যন্ত তা হলে তিনজনের মধ্যেই হচ্ছে–প্রতিভা সহায়, সুখন চামার আর আমার।’

সবাই ঘাড় নাড়ে। ডাক্তার শ্যামদুলাল ইংরেজি করে বলেন, ‘ট্র্যাঙ্গুলার ফাইট।’

‘আপনাদের কি মনে হয়, এই লড়াইতে বেরিয়ে যেতে পারব?’

সবাই সমস্বরে বলে ওঠে, ‘নিশ্চয়ই।’

নেকীরাম শর্মা বলে, ‘আপনি যে ভোটটা পেতেন তার সঙ্গে আমার আর মালেক সাহেবের ভোটটা জুড়ে নিন। জরুর জিতবেন।’

তবু পুরোপুরি সংশয় কাটে না রঘুনাথ সিংয়ের। তিনি বলেন, ‘প্রতিভা সহায় দশ হাতে পয়সা ছড়াচ্ছে। আমার মনে হয় ও আওরত জরুর ভাল ভোট টানবে। সুখন রবিদাসের কথা যদি বলেন—’

সবাই বিপুল আগ্রহ এবং উৎকণ্ঠা নিয়ে রঘুনাথের দিকে তাকায়। তিনি বলতে থাকেন, ‘ঐ চামারের ছৌয়াটাও যথেষ্ট ভোট পাবে। আমরা ক’জন দোসাদ কিষাণ বাদ দিলে গারুদিয়া-বিজুরির সব অচ্ছুতিয়ারা ওকেই ভোট দেবে।’

সবাই সমস্বরে হাঁ-হাঁ করে ওঠে, ‘কভী নায়, কভী নায়—’

গলার স্বরে যথেষ্ট জোর দিয়ে রঘুনাথ বলেন, ‘নিশ্চয়ই দেবে।’

সবাই থতিয়ে যায়। একটু চুপ করে থেকে বলে, ‘কী করে বুঝলেন?’

এ ক’দিন চুনাওর ব্যাপারে গারুদিয়া আর বিজুরি তালুকের গায়ে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে ঘুরে ঘুরে ভোট মাঙতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তার আদ্যোপান্ত নিখুঁত বিবরণ দিয়ে রঘুনাথ বলেন, ‘অচ্ছুতিয়াদের কাছে যখনই ভোট দেবার কথা বলেছি, কুত্তাগুলো চুপ করে গেছে। বিলকুল যেন গুংগা! যারা ভোট দেবে তাদের মুহ্‌ দেখলে বোঝা যায়।’

রঘুনাথ সিংয়ের পর্যবেক্ষণ শক্তির সবাই উচ্ছ্বসিত তারিফ করে কিন্তু তাতে সমস্যার সুরাহা হয় না। এ অঞ্চলের হরিজন ভোটের ভাল একটা অংশ কীভাবে পাওয়া যাবে, সেই প্রশ্নটাই সবার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। ইনার সার্কেলের পরামর্শ সভাটা নিঝুম হয়ে যায়। এখন একটা পাতা খসে পড়লেও আওয়াজ পাওয়া যাবে।

একসময় রঘুনাথ হঠাৎ বলে ওঠেন, ‘আমার মাথায় একটা শতরঞ্জের চাল এসেছে। দেখুন আপনাদের কীরকম লাগে?’

‘কী চাল?’ চোখে মুখে অনন্ত কৌতূহল নিয়ে সবাই রঘুনাথের দিকে তাকায়।

চাপা নীচু গলায় ফিস ফিস করে রঘুনাথ সিং তাঁর দাবার চাল সম্পর্কে বিশদভাবে বলে যান। রাতের আন্ধেরাতে পাঁচ-সাতটা হরিজন গাঁ মিট্টি তেল দিয়ে প্রথমে জ্বালিয়ে দিতে হবে। তারপর অচ্ছুৎদের বন্ধু সেজে ওদের নয়া ঘর বানাবার জন্য ঢালাও টিন খড় বাঁশ এবং নগদ টাকা বিলোতে হবে। এতে স্বাভাবিক নিয়মেই গঞ্জ-ধোবি-ধাঙড়েরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে থাকবে। তার ফল পাওয়া যাবে ভোটের বাক্সে।

পরিকল্পনার চমৎকারিত্বে সবাই মুগ্ধ হয়ে যায়। চুনাও শতরঞ্জের খেলায় এর চাইতে ভাল এবং দামী চাল নাকি কেউ আর কখনও ভাবতে পারে নি।

রঘুনাথ সিং জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনারা তা হলে এটা মঞ্জুর করছেন?’

‘অবশ্যই!’

তবে কাজটা বহোত হুঁশিয়ারিসে করতে হবে।

অচ্ছুৎদের গায়ে আগুন লাগাবার ব্যবস্থাটা পাকা হয়ে যায়। কীভাবে কোন কোন গাঁ জ্বালানো হবে তাই নিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আলোচনার মধ্যে ঠিকাদার অযোধ্যাপ্রসাদ এসে হাজির।

অযোধ্যাকে দেখে হঠাৎ রঘুনাথের মনে পড়ে যায়, বিকেলে তাকে গারুদিয়া বাজারে প্রতিভা সহায়ের চুনার মীটিংয়ের খবর আনতে পাঠিয়েছিলেন। তিনি শুধোন, ‘কী রকম দেখলে?’

অযোধ্যাপ্রসাদ মেঝেতে বসতে বসতে বলে, ‘বহোত ভারি মীটিন রঘুনাথজী।’

‘কেমন লোকজন হয়েছিল?’

‘কমসে কম লাখো আদমী হবে। তিন সাল এখানে চুনাও দেখছি। মগর এত বড় মীটিন আর নজরে পড়ে নি।’

রঘুনাথ সিংয়ের মুখ ভয়ানক গম্ভীর হয়ে যায়। সেটা লক্ষ্য করে বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে অযোধ্যা প্রসাদের। রুদ্ধশ্বাসে দ্রুত এবার সে বলে ওঠে, ‘হবে নাই বা কেন? লাখো লাখো রুপাইয়া ওড়াচ্ছে যে আওরতটা। পাইসার লালচে ভুখা হাভাতের দল দৌড়ে গেছে। মাংসের একটা টুকরা ফেঁকলে বিশটা কুত্তা দৌড়ে আসে না? মীটিনে গেছে বলেই কি ঐ আওরতটাকে ওরা ভোট দেবে নাকি? কভী নেহী।’

কথাটা যুক্তিসঙ্গত মনে হয় রঘুনাথ সিংয়ের। মনে পড়ে, তিনিও নিজের খরিদী কিষাণদের প্রতিভা সহায়ের মীটিংয়ে যাবার হুকুম দিয়ে ছিলেন। তাতে গরীব লোকগুলো ক’টা করে পয়সা পাবে।

একটু ভেবে রঘুনাথ এবার জিজ্ঞেস করেন, ‘ওরা কী বলল?’

অযোধ্যাপ্রসাদ বলে, ‘মামুলী বাত। এই করব সেই করব। আসমান থেকে স্বরগ পেড়ে এনে গারুদিয়া-বিজুরিতে বসিয়ে দেব।’ প্রতিভা সহায়দের বক্তৃতার সারমর্ম আশ্চর্য দক্ষতায় পেশ করতে থাকে সে। করতে করতে মাঝখানে হঠাৎ থমকে যায়।

‘কী হল? চুপ করে গেলে যে?

অযোধ্যাপ্রসাদ বলে, ‘একটা বুরা খবর আছে রঘুনাথজী।’

‘কা বুরা খবর?’ রঘুনাথ সিংয়ের ভুরু কুঁচকে যায়।

‘ফাগুরামকে নিয়ে মীটিনে গণ্ডগোল হয়েছে।’

রঘুনাথ সিং শিরদাঁড়া খাড়া করে বসেন। বলেন, ‘কীসের গগুগোল?

অযোধ্যাপ্রসাদ কী বলতে যাচ্ছিল, সেই সময় বড় ফটকের বাইরে থেকে কার গলা শোনা যায়, ‘হুজৌর—’

ঘাড় ফিরিয়ে রঘুনাথ সিং এবং তাঁর পা-চাটা কুত্তারা দেখতে পায় গণেরি দোসাদ দাঁড়িয়ে আছে। ওখানে আলোটালো নেই। অন্ধকারে গণেরির পেছনে আরো কয়েকজন আবছা ভাবে চোখে পড়ে।

রঘুনাথ সিং এই মুহূর্তে তাঁর খরিদী কিষাণদের এখানে আশা করেন নি। অন্য সময় হলে নৌকর দিয়ে ভাগিয়ে দিতেন। কিন্তু চুনাওর তারিখ দ্রুত এগিয়ে আসছে। এ সময় হঠকারিতা কোন কাজের কথা না। ভেতরে ভেতরে ক্ষেপে উঠলেও মুখে দেখন হাসি ফুটিয়ে রঘুনাথ বলেন, ‘কা রে, এত্তে রাতমে?’

বড়ে সরকারের ডাক না এলে তাঁর কোঠিতে ঢোকার সাহস নেই গণেরিদের। আগে যে এসেছে, তখনও রঘুনাথ সিংয়ের তলব পেয়েই। গণেরি ভয়ে ভয়ে বলে, ‘হুজৌরের হুকুম হলে আমরা অন্দরে আসি।’

‘আয়—’

গণেরিরা ভেতরে ঢুকতেই ধর্মার কাঁধে রক্তাক্ত বেহুশ ফাগুরামকে দেখে রঘুনাথ সিং চমকে ওঠেন, ‘ফাগগুর এ হাল হল কী করে?’

গণেরি প্রতিভা সহায়ের চুনাও মীটিংয়ে ফাগুরামকে ঘিরে যা যা ঘটেছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে বিমর্ষ মুখে বলে, ‘মার দিয়া সরকার। ফাগুয়াকে বিলকুল খতম করে দিয়েছে পরতিভাজীর পহেলবানেরা। হাসপাতাল নিয়ে যাবার আগে আপনাকে দেখিয়ে নিয়ে গেলাম।’

ধর্মা এমনিতে চুপচাপ থাকে। আচমকা তার মধ্যে কী যেন ঘটে যায়। সে বলে ওঠে, ‘হুজৌর, আপনার জন্যে চুনাওর গানা গাইতে গিয়ে ফাগ্‌গুচাচা মরতে চলেছে।’

পোকামাকড়ের চাইতেও তুচ্ছ একটা অচ্ছুং জনমদাস যে এভাবে কথা বলতে পারে, এটা রঘুনাথ সিংয়ের ধারণার বাইরে। ধর্মার সীমাহীন স্পর্ধায় তিনি স্তম্ভিত হয়ে যান। তাঁর চোখমুখ ভয়ঙ্কর দেখায়। চোয়াল পাথরের মতো শক্ত হয়ে ওঠে। জুতিয়ে অথবা চাবুক চালিয়ে দোসাদটার মুখের চামড়া ছিড়ে নেবেন কিনা, ভাবতে গিয়ে মনে পড়ে, চুনাওয়ের বেশি দেরি নেই। নিজেকে দ্রুত সামলে নিতে নিতে দাঁতে দাঁত চেপে রঘুনাথ সিং বলেন, ‘ওই বাজা কারখান্নাবালী কুত্তেকা বেটিয়াকে আমি দেখে নেব। গারুদিয়ায় এসে আমার আপনা আদমীকে পিটিয়ে যাবে, এ আমার অপমান। এর বদলা যদি তুলতে না পারি তো আমি ক্ষত্রিয় রাজপুতের ছৌয়া নই।’ তাঁর ভেতর থেকে সামন্ততান্ত্রিক যুগের এক বর্বর প্রতিনিধি যেন বেরিয়ে আসে।

প্রতিভা সহায়ের ওপর বদলা নেবার ব্যাপারে দোসাদরা কতটা সান্ত্বনা পায়, তারাই জানে। গণেরি কাঁপা গলায় বলে, ‘হুজৌরকা হুকুম হো যায় তো হামনিলোগন অসপাতল চলে–’

রঘুনাথ বলেন, ‘নেহী। আমার গান গাইতে গিয়ে ফাগুয়ার এই হাল। আমিই ওকে হাসপাতাল পাঠাব। হাঁকডাক করে তক্ষুনি চুনাওর জন্য নির্দিষ্ট একটি জীপ বার করান। ফাগুরামকে হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা হয়ে যায়। রঘুনাথ সিংয়ের মহানুভবতায় গণেরিরাও তার সঙ্গে যেতে পারে।

কিছুক্ষণ পর জীপটা হাইওয়ে দিয়ে ভলিগঞ্জ হাসপাতালের দিকে ছুটতে থাকে। পাঁচ দোসাদ স্তব্ধ হয়ে ফাগুরামের ক্ষতবিক্ষত শরীর আগলে বসে থাকে। চূনাত্তর মীটিং থেকে রঘুনাথ সিংয়ের হাভেলির দিকে যাবার সময় ফাগুরামের গলা দিয়ে গোঙানির মতো একটা আওয়াজ বেরুচ্ছিল। এখন আর কোন শব্দই নেই।

হাসপাতালে পৌঁছুবার পর ডাক্তার সাব ফাগুরামের নাড়ি ইত্যাদি দেখে ঘোষণা করেন, অন্তত ঘণ্টাখানেক আগে তার মৃত্যু হয়েছে।

বহুদর্শী আধবুড়ো গণেরি দু হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে জড়ানো গলায় বলতে থাকে, ‘এ আমি জানতাম, এ আমি জানতাম।’

চুনাওর জন্য এ অঞ্চলে প্রথম প্রাণ দেবার স্বর্গীয় গৌরব অর্জন করে অচ্ছুৎ নৌটঙ্কীবালা ফাগুরাম দোসাদ।  

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *