সাতাশ
আজ দুপুরে কালোয়া খাওয়ার পর সীসম গাছের রুগ্ন ছায়ায় ধর্মারা জিরিয়ে নিচ্ছিল। হাইওয়ের দিক থেকে আচমকা টিরকে এসে হাজির। পাশে বসে কপালের ঘাম কাঁচাতে কাঁচাতে সে বলে, ‘কা রে, চিতিয়ার বাচ্চার কী হল?’
ধর্মা মুখ কাচমাচু করে বলে, ‘জঙ্গলে যেতে পারি নি ভাইয়া। দু-এক রোজের ভেতর জরুর যাব।’
‘লেট নায় করনা।’
‘নায় নায়।’
‘আমরিকী সাব বিশ বাইশ রোজের মধ্যে রাঁচী ফিরে আসবে চিতিয়ার বাচ্চা না পেলে মুসিবত হো যায়েগা। আণ্ডারস্ট্যাণ্ড?’
ধর্মা বলে, ‘ঘাবড়াও নেহী ভাইয়া। চিতিয়া বাচ্চা জরুর মিল যায়েগা।’
তাগাদা দেবার জন্যই রাঁচী থেকে এতদূর ছুটে আসা। আরো কিছুক্ষণ চিতার বাচ্চা সম্পর্কে ঘ্যানর ঘ্যানর করে টিরকে হাইওয়ের দিকে ফিরে যায়। তারপরও কিছুক্ষণ জিরোতে থাকে ধর্মারা।
সূর্য পছিমা আকাশের দিকে চলতে শুরু করলে জনমদাস এবং মরসুমী আদিবাসী কিষাণরা যখন ফের ক্ষেতিতে নামতে যাবে সেইসময় বড় সড়কের দিক থেকে চিৎকার ভেসে আসে।
‘প্রতিভা সহায়কো—’
‘ভোট দো, ভোট দো।’
‘ঘোড়েকা পর—’
‘মোহর মারো, মোহর মারো।’
চুনাওর তারিখ যত এগিয়ে আসছে ততই হাইওয়ে ধরে ভোটের গাড়িগুলোর যাতায়াত বেড়ে যাচ্ছে। কখনও জীপ হাঁকিয়ে রঘুনাথ সিং কি প্রতিভা সহায়ের চুনাও কর্মীরা যায়, কখনও টাঙ্গা হাঁকিয়ে নেকীরাম এবং আবু মালেকের লোকেরা যায়। তবে পায়দল যায় সুখন রবিদাসের দল। গাড়ি করে যাবার মতো পয়সার জোর ওদের নেই।
শান্ত কৌতূহলশূন্য চোখে প্রতিভা সহায়ের চুনাওর গাড়িগুলোর দিকে তাকাতেই হঠাৎ চমক লাগে ধর্মাদের। গাড়িগুলো পাক্কীর কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়েছে। আর একটা জীপ থেকে অবোধনারায়ণ পাণ্ডে নেমে নয়ানজুলির গাড্ডা পেরিয়ে এদিকেই আসছে। অবোধনারায়ণ প্রতিভা সহায়ের নির্বাচন দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত এজেন্ট।
ধর্মাদের কাছ থেকে খানিক দূরে একটা কড়াইয়া গাছের তলায় বসে ছিল গণেরি। তার মাথায় এখনও তিন পরল পুরু ব্যাণ্ডেজ বাঁধা রয়েছে। বড়ে সরকারের হুকুমে এবং মহত্ত্বে তাকে এখন আর লাঙল ঠেলতে হচ্ছে না, তবে রোজই অন্য সবার সঙ্গে ক্ষেতিতে আসে, সারাদিন কড়াইয়া কি সীসম গাছের তলায় বসে থাকে। সূর্য ডুবে গেলে সবার সঙ্গেই আবার দোসাদটোলায় ফিরে যায়।
আস্তে আস্তে উঠে দাড়িয়ে ভুরুর ওপর একটা হাতের ছাউনি দিয়ে রোদ ঠেকাতে ঠেকাতে হাইওয়ের দিকে গণেরি তাকায়। বলে, ‘অবোধজী আসছে না?’
আশপাশ থেকে সবাই বলে ওঠে, ‘হঁ।’
একটু পর অবোধনারায়ণ কাছে এসে পড়ে। দোসাদটোলার মাতব্বর হিসেবে গণোরিকে বেছে নিয়ে বলে, ‘কা রে, সেদিন তোদের যা বলেছিলাম, মনে আছে তো?’
গণেরির মনে পড়ে যায়। সেদিন রাত্তিরে অত্যন্ত লোভনীয় প্রস্তাব নিয়েই অবোধনারায়ণ দোসাদটোলায় হানা দিয়েছিল তবু খুব একটা উৎসাহিত হয়ে ওঠে না গণেরি। নিরুৎসুক গলায় বলে, ‘আছে।’
‘কাল গারুদিয়া বাজারে প্রতিভাজীর চুনাওর মীটিন। তোরা কাজকাম চুকিয়ে সিধা ঘরে চলে যাবি। আমি গাড়ি নিয়ে তোদের আনতে যাব। যাদের ভোট আছে তাদের তো জরুর, যাদের ভোট নেই তাদেরও মাথাপিছু তিন রুপাইয়া করে দেব। জবান দিয়ে এসেছিলাম; তা তো রাখতেই হবে। বলে একটু থামে অবোধনারায়ণ। পরক্ষণে ফের শুরু করে, ‘কাল গাড়িতে উঠবার আগে তোদের হাতে নগদনারায়ণ দিয়ে দেব।’
গাড়িতে চড়ে প্রতিভা সহায়ের মীটিংয়ে যাওয়া এবং তিনটে করে রুপাইয়া নেওয়ার বাবদে রঘুনাথ সিংয়ের কাছ থেকে আগাম হুকুম নিয়ে রেখেছে গণেরি। তবু এই ব্যাপারটার মধ্যে কোথায় যেন একটা অস্বস্তি থেকেই যায়।
গণেরি খুব একটা উৎসাহ দেখায় না; নিতান্ত সাদামাঠাভাবে বলে, ‘ঠিক হ্যায় দেওতা –’
‘কথাটা তোদের মনে করিয়ে দেবার জন্যে এলাম। এখন যাই; কাল ফির দেখা হবে।’
.
পরের দিন ধর্মা এবং কুশীর সাবুই ঘাসের জঙ্গলে যাওয়া হয় না। নগদ তিনটে করে টাকা পাওয়া যাবে। সেটা তাদের মতো হা-ভাতে জনমদাসদের কাছে খুব সামান্য ঘটনা নয়।
সূর্য ডুবতে না ডুবতেই খামার বাড়িতে হাল-বয়েল জমা দিয়ে অন্য সবার সঙ্গে দোসাদটোলায় ফিরে আসে ধর্মারা এবং নিজের নিজের ঘরে শিরদাঁড়া খাড়া করে দূর সড়কের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। কখন অবোধনারায়ণ আসবে, তারই দমবন্ধ প্রতীক্ষা।
সন্ধ্যা নামার কিছুক্ষণ পরেই সামনের রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে পঁচিশ তিরিশটা দামী ঝকঝকে লাক্সারী বাস এসে কাতার দিয়ে দাঁড়ায়। একটা গাড়ি থেকে স্বয়ং অবোধনারায়ণ নেমে সোজা দোসাদটোলায় ঢোকে। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে তাড়া লাগাতে থাকে, ‘চল্ সব, চল্। তোদের জন্যে গাড়ি নিয়ে এসেছি, তুরন্ত উঠে পড়।’
দোসাদ ভূমিদাসরা যে যার ঘর থেকে মুহূর্তে বেরিয়ে আসে এবং লাক্সারি বাসগুলোর দিকে দৌড়ে যায়। এমন গাড়িতে চড়া দূরের কথা, বাপের জন্মে তারা চোখেও দ্যাখে নি। কাছাকাছি এসে সবাই থমকে যায়। হাজামজা চেহারা তাদের, গায়ের ফাটা খসখসে চামড়ার ওপর জমাট ময়লা, পরনের কাপড়গুলো কমসে কম দু মাস ধোয়া হয় নি। এরকম নোংরা শরীরে এবং নোংরা পোশাকে অত দামী গাড়িতে চড়তে তাদের সাহসে কুলোয় না।
পেছন থেকে অবোধনারায়ণ সস্নেহে তাড়া লাগায়, ‘কী হল রে, উঠে পড়, উঠে পড়।’
প্রতিটি গাড়ির দরজার মুখে দুটো করে লোক দাঁড়িয়ে। একজনের হাতে স্টীলের পাতলা পরাতে কাঁচা টাকার পাহাড় সাজানো রয়েছে। অনবরত তাড়া খেয়ে খেয়ে শেষ পর্যন্ত দোসাদরা গাড়িতে উঠতে থাকে। উঠবার মুখে দ্বিতীয় লোকটা পরাত থেকে তিনটে করে টাকা গুনে প্রত্যেকের হাতে দেয়। বাচ্চাদের জন্য বরাদ্দ টাকাটা পায় তাদের মা-বাপেরা।
একটা লোকও বোধ হয় আর ঘরে পড়ে নেই। গোটা দোসাদ- টোলা ফাঁকা করে কাচ্চাবাচ্চা থেকে শুরু করে বুড়ো হাবড়া পর্যন্ত সবাই লাক্সারি বাসগুলোতে উঠে পড়েছে।
অন্য সবার মতো আরামদায়ক নরম গদীতে অতি সন্তর্পণে বসে ধর্মা ভাবতে থাকে, এমন সৌভাগ্যের কথা তাদের চোদ্দ পুরুষের কেউ কখনও চিন্তাও করতে পারে নি। চুনাওর তৌহার কেন যে হর সাল দু-চার বার করে আসে না?
এদিকে অবোধনারায়ণ নীচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ সব তদারক করছিল।
এবার সামনের দিকে একেবারে প্রথম বাসটায় উঠে ড্রাইভারকে যেই স্টার্ট দেবার কথা বলতে যাবে, আচমকা দোসাদটোলার ভেতর থেকে কারা যেন চিৎকার করে ওঠে, ‘রুখ যাও, রুখ যাও—’
জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে অবোধনারায়ণ দেখতে পায়, একশো বছরের বুড়ো অথর্ব গৈরুনাথকে কাঁধে করে তার ছেলে ধনপত আসছে। ওদের পেছনে গৈরুনাথের পুতহু এবং নাতিনাতনীরা। যে গৈরুনাথের দিকে ছেলে, ছেলের বউ ফিরেও তাকায় না, যার পায়ে শোথ, দিনরাত সংসারের সবাই যার মৃত্যুকামনা করে, চুনাওর দৌলতে আজ সে চিতায় ওঠার আগেই একবার ছেলের কাঁধে চড়ে নেয়। নগদ তিনটে টাকা পাওয়া তো সহজ ব্যাপার নয়!
যতই বয়স হোক, যতই পঙ্গু হয়ে যাক, চামড়া ফেটে কষ পড়ুক, গৈরুনাথ তো চুনাওর চোখে একটা মানুষ নয়—আস্ত একটা ভোট। নির্বাচনের যখন আর বারোটা দিনও বাকী নেই তখন গৈরুনাথকে অবহেলা করা যায় না। অবোধনারায়ণ দ্রুত নেমে এসে সসম্ভ্রমে বলে, ‘আও আও—’ নগদ তিনটে করে টাকা গুনে দিয়ে একটা বাসে গৈরুনাথ, তার ছেলে, পুতহু এবং নাতিনাতনীদের আরামে বসার ব্যবস্থা করে দেয়।
একসময় লাক্সারি বাসগুলো ধুলো উড়িয়ে চলতে শুরু করে।
গারুদিয়া বাজারের সেই বড় মাঠটায় এসে ধর্মাদের চোখের তারা একেবারে কপালে চড়ে যায়। জায়গাটাকে আজ আর চেনাই যায় না। যেদিকে যতদূর তাকানো যায়, শুধু রোশনি আর রোশনি। প্রতিভা সহায়ের চুনাও কর্মীরা বারো চোদ্দটা বিরাট বিরাট জোরালো জেনারেটর এনে চারদিকে আলোর বান ডাকিয়ে দিয়েছে। জেনারেটরগুলো থেকে অনবরত ভট ভট আওয়াজ উঠছে।
মাঠের শেষ মাথায় বিশাল সাজানো মঞ্চ। মঞ্চের সামনে মানুষ আর মানুষ। ডাইনে রাস্তার ধার ঘেঁষে সারি সারি ট্রাক, লাক্সারি বাস এবং নতুন নতুন ঝকঝকে প্রাইভেট কার। বোঝা যায়, এই গাড়িগুলো করেই বিজুরি এবং গারুদিয়া তালুকের তিরিশ চল্লিশটা গাঁ সাফ করে সব মানুষ তুলে আনা হয়েছে।
ভিড়ের ভেতর চারদিকে অগুনতি বাঁশের খুঁটি পোঁতা। সেগুলোর গায়ে লাউড স্পীকারের লম্বা লম্বা চোঙা আটকানো রয়েছে।
আগেও গারুদিয়া বাজারের এই মাঠে নেকীরাম শর্মা, আবু মালেক, এমন কি স্বয়ং রঘুনাথ সিংও চুনার মীটিং করে গেছেন। রঘুনাথ চারদিকের গাঁগুলোতে অগুনতি গৈয়া এবং ভৈসা গাড়ি পাঠিয়ে প্রচুর লোকজন জুটিয়ে এনেছিলেন কিন্তু প্রতিভা সহায়ের এই মীটিংয়ের কাছে সে মীটিং একেবারেই কিছু না।
ধর্মা তার অল্প অভিজ্ঞতা এবং তার চাইতেও কম বুদ্ধি দিয়ে টের পায়, মাথাপিছু নগদ তিনটে করে টাকা আর দামী হাওয়া গাড়িতে চড়ার লোভটা নাকের সামনে ঝুলিয়ে না দিলে প্রতিভা সহায়ের চুনাও কর্মীরা এত লোকজন জোটাতে পারত না। বাপ ভাল না, ভালা ভাইয়া, সবসে ভালা রুপাইয়া। এটাই হল জগতের সার সত্য। এর ওপরে আর কিছু নেই।
মঞ্চের ওপর সারি সারি চেয়ার এবং টেবল পাতা। সেখানে প্রতিভা সহায়কে মাঝখানে রেখে বিজুরি এবং গারুদিয়া তালুকের বহু বড়া বড়া আদমী বসে আছেন। রঘুনাথ সিংয়ের চারপাশের ভকিল ডাগদর, বড় স্কুলের মাস্টারজী জমা হয়েছেন। ওঁরা ছাড়াও এই দুই মৌজায় আরো অনেক ডাগদর, ভকিল, মাস্টারজী, পণ্ডিতজী আছেন। তাঁরা প্রতিভা সহায়ের কাছে জড় হয়েছেন। ভুখানাঙ্গা জনমদাসেরা জানে না, যেখানে রুপাইয়া-পাইসা আর রাজনৈতিক ক্ষমতার গন্ধ সেখানেই মানুষের ভিড়। চিটেগুড়ের গায়ে যেমন মাছির ঝাঁকের ভনভনানি।
প্রতিভা সহায়ের নির্বাচনী এজেণ্ট অবোধনারায়ণ ধর্মাদের মীটিংয়ে পৌঁছে কোন ফাঁকে বিশাল শরীর টেনে দৌড়ুতে দৌড়ুতে মঞ্চে গিয়ে উঠেছিল, কেউ টের পায় নি। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে সে-ই মীটিংয়ের কাজ পরিচালনা করতে থাকে। লোকটার সাংগঠনিক ক্ষমতা বিপুল।
অত্যন্ত সুচারুভাবে বিজুরির বড় ভকিলকে আজকের মীটিংয়ের সভাপতি করা হয়। একটা বাচ্চা মেয়ে এসে তাঁর এবং মঞ্চের অন্যান্য মান্যগণ্য মানুষগুলোর গলায় টাটকা গোলাপের মালা পরায়। পর্যাপ্ত হাততালির মধ্যে এই আনুষ্ঠানিক পর্বটি সমাধা হয়। তারপর অবোধনারায়ণের ইসারায় পাটনা এবং অন্য ভারী টৌনের ঢংয়ে প্রতিভা সহায়ের চুনাও কর্মীরা আকাশে হাত ছুঁড়তে ছুড়তে চিৎকার করতে থাকে।
‘পরতিভা সহায়—’
‘জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ।’
‘পরতিভা সহায়কি—’
‘বোট দো, বোট দো।’
‘ঘোড়াকা পর—’
‘মোহর মারো, মোহর মারো।’
প্রতিভা সহায়ের নির্বাচনী প্রতীক হল ঘোড়া।
শ্লোগানে শ্লোগানে চুনাওর মীটিং সরগরম হয়ে ওঠে। তারপর একে একে প্রতিভা সহায়ের সমর্থক এবং পৃষ্ঠপোষক, দুই তালুকের মানী লোকেরা গলার শির ছিঁড়ে এবং মাইক ফাটিয়ে বক্তৃতা করে যায়। তাঁদের সবার বক্তব্যই মোটামুটি এক। ভাইয়া এবং বহিনরা প্রতিভাজীকে আপনারা সবাই ভোট দিন। তিনি জিতলে এখানে রামরাজ এসে যাবে। দুঃখ কষ্ট অভাব গরীবী—কিছুই থাকবে না। নহরে নহরে দুধের বান ডেকে যাবে। সবার পাকা মকান হবে। কেউ ভুখা থাকবে না, নাঙ্গা থাকবে না। ইত্যাদি ইত্যাদি।
একজন তো বলেই ফেললেন, ‘ভাইয়া আউর বহিনরা, একটা ব্যাপার আপনারা নজর করে দেখেছেন? এই কেন্দ্র থেকে এবার যাঁরা চুনাওর লড়াইতে নেমেছেন তাঁদের কারো সিম্বল, মতলব প্রতীক চিহ্ন হল উট, কারো হাতী, কারো হীরণ, কারো ভৈস। হাতী বহোত দামী জানবর। কথায় বলে হাতী মরলেও লাখো রুপাইয়া। মগর এত বড় জানবর কোন উপকারে লাগে? কোন কিছুতেই না। উপকার দূরের কথা, সিরিফ বসে বসে খাওয়া ছাড়া এর দুসরা কাম নেই। হাতীকে আপনারা নাকচ করে দেবেন। উটও আমাদের এখানে অচল। হীরণ বহোত উমদা জানবর। মগর সে-ও কোন কাজে লাগে না। ভৈস কামে লাগে বটে, মগর বড়া স্লো জানবর। তার চাল বহোত ধীরা। ইস যুগ হ্যায় প্রগতিকা যুগ। যা কিছু ধীর, স্লো—সেসব বাতিল হয়ে যাবে। আপনারা জানেন, লাখো লাখো বরষ আগে দুনিয়ায় হাতীর চাইতেও বড়া বড়া জানবর ছিল। তারা ডাইনোসর, ম্যামাল। সব খতম হয়ে গেছে। এখন চাই স্পীড, মতলব গতি। যো কুছ করনা, তুরন্ত করনা। ইস লিয়ে প্রতিভাজী ঘোড়াকা প্রতীক নিয়েছেন। একবার এঁকে জিতিয়ে দিন, দেখবেন প্রতিভাজী গারুদিয়া বিজুরীর সড়ক সোনাচাঁদী দিয়ে বাঁধিয়ে দেবেন।’
বিজুরি এবং গারুদিয়া তালুকের তিরিশ বত্রিশটা গাঁয়ের আধ-ন্যাংটো ক্ষুধার্ত আনপড় লোকগুলো হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। নানা বক্তার জ্বালাময়ী ভাষণের শতকরা দশভাগ হয়ত তাদের মাথায় ঢোকে, বাকী নব্বই ভাগ দুর্বোধ্যই থেকে যায়। তবে এটুকু তারা বোঝে, সব বক্তাই প্রতিভা সহায়ের নির্বাচনী প্রতীক ঘোড়া চিহ্নে মোহর মারতে বলছেন।
যাই হোক, সবার বক্তৃতা হয়ে যাবার পর প্রতিভা সহায় স্বয়ং সামনে উঠে দাড়ান। তিনি এভাবে শুরু করেন, আমাদের বংশের কেউ কোনদিন রাজনীতি করে নি, চুনাওতে নামে নি। তবে আচানক আমি কেন এতে এলাম? ভাইয়া আউর বহিনরা, আপনারা জরুর এই প্রশ্ন আমাকে করতে পারেন। তার উত্তরে আমি বলব, বিজুরি আমার সসুরাল। আপনারা জানেন আওরতের কাছে সসুরালই হল আপনার ঘর।
‘আমরা থাকি বড় শহরে। গাঁও ঘরে খুব একটা আসা হয় না। দো সাল চার সাল বাদে একবার হয়ত আসি। যেবারই আসি, নজরে পড়ে গাঁওয়ের হাল আরো বুরা হয়ে গেছে। গরীব আরো গরীব হয়ে গেছে, নাঙ্গা আরো নাঙ্গা। এবার গাঁওয়ে এসে সব দেখে আমার আঁশু এসে গেল। ভাবলাম, কিছু একটা করা দরকার। গাঁও না বাঁচলে দেশ বাঁচবে না। গাওবালাদের যেমন করে হোক রক্ষা করতেই হবে। বিজুরি আমার সসুরাল, তাই এই জায়গার ওপর আমার কর্তব্য আছে।’
‘ভাইয়া আউর বহিনরা, আপনারা জানেন আমার নিজের কোন অভাব নেই। আমার স্বামী শ্বশুর ফ্যাক্টরি আর কয়লাখাদান থেকে যা টাকা পান তাতে আমার পরও বিশ-পঁচিশ পুরুষ পায়ের ওপর পা তুলে আরামে কাটিয়ে যেতে পারবে। মগর আমি একটা মানুষ; আপনাদের মতোই আমার গায়ে লাল খুন রয়েছে। এখানে এসে দেখলাম হাজারো লাখো আদমী করজের ফাঁদে আটকে আছে। কামিয়া প্রথা, বেটবেগারি, জাতপাতের সওয়াল নিয়ে অত্যাচার সমানে চলছে। মগর এ আমি চলতে দেব না। গরীবী, কামিয়াগিরি, ছুয়াছুত ভারতকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এ চলতে দেওয়া যায় না। মগর হাতে যদি রাজনৈতিক ক্ষমতা না থাকে এ সব জখন্য নিয়ম ঠেকাবো কী করে? তাই এবার চুনাওতে নেমেছি। এখন সবই আপনাদের হাতে, আপনাদের কিরপা। আপনারা যদি আমাকে ভোট দিয়ে জেতান, প্রাণ দিয়ে আপনাদের সেবা করতে চেষ্টা করব। মনে রাখবেন আমার প্রতীকচিহ্ন ঘোড়া।’
প্রতিভা সহায়ের কথা শেষ হবার পর তাঁর চুনাও কর্মীরা যখন শ্লোগান দিয়ে মীটিংটাকে শেষবারের মতো গরম করতে যাবে সেই সময় একটা কাণ্ড ঘটে যায়। ভিড়ের ভেতর কোথায় হারমোনিয়াম নিয়ে ঘাপটি মেরে বসে ছিল ফাগুরাম নৌটঙ্কীবালা, কেউ টের পায় নি। আচমকা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঝড়ের বেগে হারমোনিয়াম বাজাতে বাজাতে, নেচে কুঁদে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে তার মক্তাদার গান শুরু করে দেয়:
‘কায়থ কুলশিরোমণি
পরতিভা সহায়!
ভোট মাঙনে আয়ী হ্যায়
হাম দুখিয়ানকে পার
হাম দুনিয়ানকে পার।
পরতিভাদেবী বড়ী সয়ানী
ঠম্মক ঠম্মক চাল,
ভোট মাঙ্তী রোতী ফিরতী
ও য্যায়সা ঘড়িয়াল
য্যায়সা ঘড়িয়াল।’
.
নেকীরাম শর্মা বা আবু মালেকের চুনাওর মীটিংয়ে যেমন হয়েছে, এখানেও হুবহু তাই ঘটে। ভিড়ের লোকজন মজাদার গান শুনে হেসে হেসে গড়িয়ে পড়তে থাকে।
আর সমঝদারদের প্রতিক্রিয়া দেখে উৎসাহ দশগুণ বেড়ে যায় গারুদিয়া-কোয়েল ফাগুরামের। সেই সঙ্গে নাচন কোঁদন এবং লাফ- ঝাঁপও। গলার স্বর কয়েক পর্দা চড়িয়ে সে নতুন উদ্যমে গাইতে থাকে:
‘কায়াথকুল শিরোমণি
পরতিভা দেবী সহায়
ভোট মানে আয়ী হ্যায়’
গানটা আর শেষ করতে পারে না ফাগুরাম। আচমকা মাটি ফুঁড়ে হট্টাকটা ডাকু-য্যায়সা চেহারার ক’টা লোক উঠে আসে। তাদের হাতে লোহার গুল-বসানো লাঠি।
‘হারামজাদকা ছৌয়া, কুত্তেকা বাচ্চা—’ অকথ্য খিস্তিখেউড় করতে করতে লোকগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ে ফাগুরামের ওপর। এলোপাথাড়ি লাঠি পড়তে থাকে তার মাথায় পিঠে ঘাড়ে কাঁধে। একটা চোট খেয়ে নতুন হারমোনিয়ামটা ভেঙে ছেতরে যায়। আর দু-হাত দিয়ে মুখ মাথা আড়াল করতে করতে চিৎকার করতে থাকে ফাগুরাম, ‘বঁচাও, বঁচাও—’ ঘা খেতে খেতে তার তিন চারটে দাঁত উপড়ে যায়। মাথা মুখ কপাল, সব জায়গা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটতে থাকে। একসময় বুকফাটানো চিৎকার করতে করতেই রক্তাক্ত বিধ্বস্ত ফাগুরাম মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
‘শালে গারুদিয়া কোয়েল বনেছে; গলার নলিয়া একেবারে ফেরে ফেলব—’ লোকগুলোর লাঠি সমানে পড়তেই থাকে।
প্রথমটা মিটিংয়ের লোকজন, বিশেষ করে দোসাদটোলার ভূমি-দাসেরা ভয়ে একেবারে সিঁটিয়ে গিয়েছিল। কী করবে, ভেবে উঠতে পারছিল না কেউ। হঠাৎ উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়ে যায় গণেরি। মা-পাখি যেভাবে ডানা মেলে ছানা আগলায় অবিকল সেইভাবে দু-হাত ছড়িয়ে লাঠির ঘা থেকে ফাগুরামকে বাঁচাতে বাঁচাতে চেঁচাতে থাকে, ‘মারো মাত, মারো মাত—’
এদিকে চারধারে গোটা মাঠ জুড়ে চেঁচামেচি হৈ চৈ শুরু হয়ে গেছে। লোকজন ভয় পেয়ে ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। মঞ্চ থেকে মাইকে কারা যেন অনবরত কী বলতে থাকে। সে সব কিছুই বোঝা যায় না।
হাট্টাকাট্টা লোকগুলো কী ভেবে আর লাঠি চালায় না। হয়ত ভাবে, আপাতত এই পর্যন্তই থাক। একটা বেয়াড়া গান গাওয়ার পরিণাম হিসেবে মারটা মোটামুটি মন্দ হয় নি। তারা ফাগুরামকে ফেলে রেখে চোখের পলকে ভিড়ের ভেতর উধাও হয়ে যায়।
প্রথমে কলিজা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছিল ফাগুরাম। ক্রমশঃ তার স্বর নির্জীব হয়ে আসে। গলার ভেতর থেকে থেমে থেমে গোঙানির মতো একটা আওয়াজ বেরুতে থাকে। ফাগুরাম পুরোপুরি বেহুশ হয়ে গেছে।
একটু দূরে দোসাদটোলার বাসিন্দারা পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দিকে ফিরে গণেরি ধমকে ওঠে, ‘বুরবাকরা, তুরন্ত এখানে আয়। ফাগুকে নিয়ে আভী অসপাতাল যেতে হবে।’
প্রথমেই দৌড়ে আসে ধৰ্মা। তার পেছন পেছন মাধোলাল শিউমল নাটুয়া ধানো, এমনি আরো অনেকে।
মুহূর্তে ফাগুরামের রক্তাক্ত বেহুশ দেহ ধর্মার কাঁধে ওঠে। ধর্মা নাটুয়া শিউমল ধানো এই চারটে জোয়ান ছোকরাকে থাকতে বলে বাকী সবাইকে দোসাদটোলায় ফেরত পাঠিয়ে দেয় গণেরি। এত লোকজন নিয়ে অসপাতাল যাওয়াটা কাজের কথা নয়; অকারণ ঝঞ্ঝাট শুধু।
কিছুক্ষণ পর দেখা যায়, মীটিংয়ের জায়গাটা পেছনে ফেলে গারুদিয়া বাজারের উত্তর দিকের সেই কালালীটার পাশ দিয়ে গণেরিরা আদিগন্ত ফাঁকা মাঠে গিয়ে নামে। মাঠের ওপর দিয়ে কোণাকুণি রশিভর হাঁটলে হাইওয়ে।
এখান থেকে সব চাইতে কাছের শহর ভকিলগঞ্জ। তাও কমসে কম মাইল ছয়েক তফাতে। এতটা রাস্তা কোন একজনের পক্ষে একটা বেহুঁশ লোককে কাঁধে করে যাওয়া অসম্ভব। তাই চারটে ছেলেকে সঙ্গে নিয়েছে গণেরি। পালা করে তারা ফাগুরামকে বইতে পারবে।
অন্ধকারে নিঃশব্দে মাঠ ভাঙছিল ওরা। কেউ কারো মুখ দেখতে পাচ্ছিল না। হঠাৎ ধর্মা ডাকে, ‘গণেরিচাচা—’
গণেরি সাড়া দেয়, ‘কা?’
‘ফাগগুচাচার এ কী হল?’
অন্ধকারের ভেতর থেকে গণেরির অলৌকিক বিষণ্ণ গলা উঠে আসে যেন, ‘এ আমি জানতাম, আমি জানতাম।’
ধর্মার মনে পড়ে, এমন একটা ভয়াবহ পরিণামের কথা গণেরি বহুবার দোসাদটোলায় সবাইকে জানিয়েছে।
হাইওয়েতে ওঠার পর আচমকা কী মনে পড়তে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে ওঠে গণেরি। বলে, ‘ডাইনা নহী, বাঁয়ে চল্ –’
ধর্মারা অবাক। পাক্কী ধরে ডাইনে না গেলে ভকিলগঞ্জে যাওয়া যাবে না।
ধর্মাদের মনোভাব মুহূর্তে বুঝে ফেলে গণেরি। বলে, ‘অসপাতাল যাবার আগে একবার বড়ে সরকারের কোঠিতে যেতে হবে। হুজৌরকে ফাগগুর খবরটা দিতে হবে। তার কী হাল হয়েছে, সেটা দেখানো দরকার।’
কেউ আর কোন প্রশ্ন করে না। সবাই হাইওয়ে ধরে বাঁ দিকে হাঁটতে থাকে।