আকাশের নিচে মানুষ – ২৬

ছাব্বিশ

গাই-বকরি চরানিদের সঙ্গে লড়াইয়ের ঘটনাটা এবং রঘুনাথ সিংয়ের অপার মহানুভবতা ক’টা দিন ভূমিদাস দোসাদদের যুগপৎ উত্তেজিত এবং আপ্লুত করে রাখে। এর মধ্যে ভকিলগঞ্জের হাসপাতাল থেকে গণেরি ফিরে এসেছে। প্রচুর রক্তপাত হওয়ায় শরীর ভয়ানক কাহিল হয়ে গেছে। রঘুনাথ সিং এতই বিবেচক এবং দয়ালু যে স্বয়ং হিমগিরিকে খবর পাঠিয়ে গণেরিকে কাজ থেকে রেহাই করিয়ে দিয়েছেন। যতদিন না সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়, তাকে ক্ষেতিতে যেতে হবে না।

এটুকু ছাড়া দোসাদটোলার জীবন পুরনো নিয়মেই বয়ে চলেছে। তাদের দিন যেভাবেই কাটুক, চুনাওর তৌহার কিন্তু ক্রমাগত জমে উঠছে।

এর ভেতর পর পর দু’দিন সন্ধ্যেবেলা গারুদিয়া বাজারে হ্যাজাক জ্বালিয়ে নেকীরাম শর্মা এবং আবু মালেকের চুনাওর মীটিং হয়ে গেল। তাদের কথা শোনার জন্য লোকজনও ভালই হয়েছিল।

রোজকার মতো ক্ষেতির কাজ চুকিয়ে হাল-বয়েল রঘুনাথ সিংয়ের খামার বাড়িতে জমা দিয়ে ধর্মা আর কুশী চলে গেছে কোয়েলের মরা খাতের ধারে সাবুই ঘাসের ঝোপে। সেখান থেকে ফাঁদের বগেড়ি নিয়ে চলে গেছে ঠিকাদারদের কাছে। পাখি বেচে মাস্টারজীকে দিয়ে পয়সা গুনিয়ে গারুদিয়া বাজারের ভেতর দিয়ে আসতে আসতে চুনাওর মীটিং নজরে পড়েছে তাদের। ভিড়ের মধ্যে ওরা দাঁড়িয়ে গেছে।

প্রথম দিন ছিল নেকীরাম শর্মার মীটিং। রোগা পাকানো চেহারার হাড্ডিসার নেকীরামের পিঠ ধনুকের মতো বাঁকানো; চোখ দুটো গিধের মতো ধারালো। নাকের ফুটোয় এবং কানের লতিতে পর্যাপ্ত লোম। কপালে তার ত্রিপুণ্ড্রক, পায়ে লম্বা চটি।

মঞ্চের ওপর নিজের খুবসুরত শালীকে তুলেছে নেকীরাম। এটা বাড়তি আকর্ষণ। গদরা জওয়ানী যেখানেই ঘুরুক ফিরুক, মাছির মতো ভনভনে ভিড় জমে যায়।

মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে চিলের মতো তীক্ষ্ণ গলায় সে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বক্তৃতা দিয়েছে, ‘কলযুগ, ঘোর কলযুগ! বেদ-বরাম্ভনকে কেউ মানে না আজকাল। তাই দেশের এই হাল। কভী দেখা অ্যায়সা খরা, অ্যায়সা বাঁড়! কীসের জন্য এসব হচ্ছে? ঘোর অনাচার, ভ্রষ্টাচার চল রহা হ্যায়। বরাম্ভন কারা? জাতওয়ারি সওয়ালে তারা শ্রেষ্ঠ কেন? ইয়ে ভগোয়ানকা লীলা। স্বয়ম্ ব্রহ্মা ঔর বিষুণ বরাম্ভনকে শ্রেষ্ঠ জাত বানিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়েছে। এ কলযুগে তাকে সম্মান দেওয়া হচ্ছে না। রামায়ণ মহাভারত পড়ুন। রামচন্দজী থেকে যুধিষ্ঠির ভীম অর্জুন—সবাই বরাম্ভনকে পূজা চড়িয়েছেন। বরাম্ভনরাজই হল সেরা রাজ। তাদের হাতে দেশ গেলে আসল কল্যাণ হবে। শান্তি আসবে। খরা-বাঁড় বন্ধ হবে, মড়ক বন্ধ হবে। ভগোয়ানের তাই ইচ্ছা। তাই বলছিলাম, এবার চুনাওতে আপনারা আমাকে ভোট দিন। ভৈস মার্কায় মোহর মারুন।

অঞ্চলের প্রসিদ্ধ সুদখোর নেকীরাম শর্মার বক্তৃতা শেষ হতে না হতেই ভিড় ফুড়ে গারুদিয়া কোয়েল ফাগুরাম বেরিয়ে এসেছিল। তার মাথায় রঙীন পাগড়ী, পরনে হলুদ ধুতি, লাল জামা, পায়ে কাঁচা চামড়ার নাগরা। ইদানীং এই পোশাকেই সে চুনাওর মীটিংয়ে মীটিংয়ে গান গেয়ে বেড়ায়।

ঝড়ের বেগে হারমোনিয়ামের রিডের ওপর আঙুল চালিয়ে ফাগুরাম মজা করে নেচেকুঁদে লাফিয়ে তার যাদুভরি গলার গান ধরেছিল:

‘শর্মাজীকে লম্বী চটি
আউর তিলক ত্রিপুণ্ড
তিন লোককে পাপ বাটোরায় (টানে)
বাজায় ডমরু ডুং
ভোট লড়ানকো শবমা আয়ে
কীর্তনীয়া হ্যায় গুম।
শর্মাজীকে শালী দেখো নাগন যেইসী চাল
তিতলি বনকে উড়তি-ফিরতি –
ভোটনকে ব্যেপার।
ভাইয়া হো যাও হোঁশিয়ার,
ভাইয়া হো যাও হোঁশিয়ার।’

গান থামিয়ে একটা হাত আকাশে ছুঁড়ে ফাগুরাম চিৎকার করে ওঠে:

‘ভৈসকা টাং তোড় দো
নেকীরামকো ফোক দো!’

ফাগুরামের গান টান শেষ হতে না হতেই মীটিংয়ের ভিড়ে হাসির বান ডেকে গিয়েছিল। নেকীরামের চুনাও কর্মীরা ক্ষেপে গালাগাল করতে থাকে। কেউ কেউ ফাগুরামের দিকে তেড়ে যায়। হৈ-চৈ, চিংকার এবং হাসাহাসিতে চুনাওকা মীটিংয়ের বারোটা বাজে। সব মিলিয়ে একটা তুলকালাম কাণ্ড।

ধর্মা আর দাঁড়ায় নি; কুশীর একটা হাত ধরে ছুটতে ছুটতে কালানী পেরিয়ে আদিগন্ত মাঠে গিয়ে নেমেছে।

পরের দিন ছিল আবু মালেকের চুনাওকা মীটিং। যথারীতি মাস্টারজীকে দিয়ে পয়সা গুনিয়ে ভিড়ের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল ধর্মারা।

আবু মালেক বিশাল চেহারার মধ্যবয়সী আদমী। ইয়া লম্বা, ইয়া চওড়া।

গায়ের রঙ টকটকে। থুতনিতে কাঁচাপাকা ছুচলো দাড়ি। পরনে ধবধবে চুক্ত আর চিকনের কাজ করা পাঞ্জাবী। মাথায় রেশমের ফুলতোলা ফেজ।

বিরাট পাঞ্জা দিয়ে মাইকটা চেপে ধরে আবু মালেক গমগমে গলায় যা বক্তৃতা দিয়েছিল তা এইরকম:

মাইনোরিটি, মতলব সংখ্যালঘুর কথা কেউ ভাবে না। এ দেশে যো কুছ হোতা হ্যায়, সিরিফ সংখ্যাগুরুকে লিয়ে। লেকিন ইয়ে নায় চলেগা। সংখ্যালঘুদের কথা ভাবতেই হবে। তাদের অবহেলা করা চলবে না। তাদের জন্য সরকারী দপ্তরে, কলেজে, ইউনিভার্সিটিতে জায়গা রিজার্ভ রাখতে হবে। চাকরি-বাকরির গেরান্টি দিতে হবে।

এখন সংখ্যালঘু কারা? শুধু মুসলমানেরা? নেহী নেহী। যে সব অচ্ছুৎ হিন্দু রয়েছে, কিরিস্তান রয়েছে—তাদের সঙ্গে উচ্চবর্ণের আদমীরা জানবরের মতো ব্যবহার করে। কাজেই সংখ্যালঘুদের স্বার্থে আমাকে ভোট দেওয়া দরকার। ইয়াদ রাখবেন, আমার মার্কা হল হীরণ (হরিণ)। হীরণ মার্কামে মোহর মারবেন। শ্রিফ সংখ্যালঘুকা স্বার্থে।

বক্তৃতা শেষ হতে না হতেই আগের দিনের মতো ভিড় ফুড়ে উঠে দাঁড়ায় ফাগুরাম এবং হারমোনিয়ামে ঝড় তুলে যাদুভরি গলায় গাইতে থাকে। গানের কথাগুলোতে থাকে শানানো অস্ত্রের ধার। ঘুরে ফিরে নেচে লাফিয়ে গাইতে গাইতে ফাগুরাম বুঝিয়ে দেয়—আবু মালেক আসলে চোর, ফেরেববাজ, বাটমার।

গাওয়া শেষ করে যথারীতি চিৎকার করে বলে:

‘গলি গলি শোর হ্যায়,
আবু মালেক চোর হ্যায়।
হীরণকা শির তোড় দো,
আবু মালেককো ফোঁক দো।’

এইভাবেই দিন কাটতে থাকে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *