আকাশের নিচে মানুষ – ২৫

পঁচিশ

এখন বেশ রাত হয়ে গেছে। দক্ষিণ কোয়েলের পাড়ের সেই জঙ্গলে দোসাদটোলার বাসিন্দারা আর কিছু ওরাঁও-মুণ্ডা অগুনতি মহুয়া, পরাস, সীমার গাছ এবং নানা ঝোপঝাড়ের আড়ালে বসে আছে। কেউ লালটীন বা অন্য কোনরকম আলো টালো আনে নি। দূর থেকে রোশনি দেখলে চোরেরা সাবধান হয়ে যাবে, এদিকে আর ঘেঁষবে না। গণেরির ইচ্ছা চোরেদের একেবারে হাতেনাতে ধরে ফেলে। তার ধারণা, এটা নির্ঘাত সেই গাই-বকরি চরানিদের কাজ। রঘুনাথ সিংয়ের হুঁশিয়ারিতে ওরা দিনের বেলা আসে না; রাতে লুকিয়েচুরিয়ে মহুয়া গাছ ফাঁকা করে দিয়ে যায়।

আজ কী তিথি, জনমদাস বা ভূমিহীন ওরাঁও-মুণ্ডারা তার খবর রাখে না। জেঠ মাহিনার ঝকঝকে নীলকাশে ক্ষয়ে-যাওয়া চাঁদের একটা টুকরো দেখা যায়। মহুয়া পাতার ফাঁক দিয়ে চিকরি-কাটা আবছা জ্যোৎস্না এসে পড়েছে নীচে। চারপাশের ঝোপেঝাড়ে লক্ষ কোটি জোনাকি উড়ছে, জ্বলছে এবং নিভছে। তাদের গায়ের সবুজ আলো ছুচের মতো অন্ধকারের গায়ে ফোঁড় তুলে চলেছে যেন। ঝাঁকে ঝাঁকে জঙ্গুলে পোকা আর মশা অনবরত গণেরিদের চামড়ায় হুল ফুটিয়ে বিষ ঢালতে থাকে।

নাখুর চাচা রামখিলান অন্ধকারে এলোপাথাড়ি চাপড় মেরে মশার ঝাঁক নিপাত করতে করতে বলে, ‘কা রে গণেরিয়া, তোর মতলবটা কী?’

গণেরি বলে, ‘কীসের মতলব?’

‘মচ্ছড়দের দিয়ে আমাদের খাওয়াবার জন্যে এখানে নিয়ে এসেছিলি?’

‘আরেকটু সবুর কর।’

‘সেই সাম থেকেই তো সবুর করে আছি। কাঁহাতক আর থাকা যায়? নিদে আঁখ ভেঙে আসছে।’

‘পেটের ভুখ বড়, না আঁখের নিদ বড়?’ গণেরি চাপা গলায় প্রায় ধমকেই ওঠে।

রামখিলাওন এরপর আর গলা দিয়ে আওয়াজ বার করে না; একেবারে চুপ মেরে যায়।

তবে বুড়ো বজরঙ্গী শুধোয়, ‘তোর কি মনে হয়, শয়তানের ছৌয়াগুলো জঙ্গলে আসবে?’

গণেরি গলার স্বরে জোর দিয়ে বলে, ‘জরুর আসবে। আজ নায় আয়েগা তো কাল আয়েগা। কাল নায় তো পরশু, পরশু নায় তো নরশু।’

এবার অনেকেই গলা মেলায়। সমস্বরে জিজ্ঞেস করে, ‘রোজ রোজ আন্ধারাতে এসে আমরা এই জঙ্গলে পেহ্‌রাদারি করব?’

গণেরি বলে, ‘হুঁ; সিরিফ পেটকা লিয়ে। ভুগা যদি মরতে না চাও, আসতেই হবে।’

সবাই আবার কী বলতে যাচ্ছিল, আচমকা চোখে পড়ল, দূরে দক্ষিণ কোয়েলের মরা খাতের ওপর দিয়ে ক’টা মশাল ফ্যাকাশে অন্ধকারে দুলতে দুলতে এদিকেই এগিয়ে আসছে। বাদামী বালির দানাগুলো মশালের রোশনিতে চিকচিক করতে থাকে।

গণেরি হঠাৎ ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে ওঠে। তীব্র চাপা গলায় সে সবাইকে হুঁশিয়ার করে দেয়, ‘বিলকুল চুপ রহো।’

শিরদাঁড়া খাড়া করে সবাই টান হয়ে বসে। উত্তেজনায় তাদের বুকে শ্বাস আটকে আসে যেন; চোখে পাতা পড়ে না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই মশালগুলো জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়ে।

কাছাকাছি আসার জন্য চোখে পড়ে, মোট তিরিশ চল্লিশটা হট্টাকাট্টা চেহারার তাগড়া আদমী; তাদের হাতে পাকানো বাঁশের লাঠি আর চটের বোরা। বোঝা যায়, ওরা মহুয়ার গোটা পেড়ে বোরা বোঝাই করে নিয়ে যাবে।

লোকগুলো অচেনা নয়। এ অঞ্চলের ছোট বড় যত জমিমালিক আর পয়সাওলা মানুষ আছে, ওরা তাদের গাই-বকরি চরায়। এমন কি এদের মধ্যে বড়ে সরকার রঘুনাথ সিংয়ের গাই-ভয়েস চরানিরাও রয়েছে।

লোকগুলোা এক মুহূর্তও অপেক্ষা করে না। জ্বলন্ত মশালের নীচের দিকগুলো মাটিতে পুঁতে যেই তারা মহুয়াগাছে চড়তে যাবে সেইসময় আড়াল থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসে গণেরি। তার দেখাদেখি কয়েক শো অচ্ছুৎ জনমদাস এবং আদিবাসী ওরাঁও মুণ্ডা।

গণেরি গলার শির ছিঁড়ে চিৎকার করে ওঠে, ‘নায় নায়, কভী নায়।’

গাই-বকরি চরানিরা থমকে যায়। এই মাঝরাতে এত লোক জঙ্গলে বসে আছে, তারা ভাবতেও পারে নি।

গণেরি আগের মতোই আবার চেঁচায়, ‘মৌয়া কিছুতেই নিতে দেব না।’

তার সঙ্গীরাও তার সঙ্গে গলা মেলায়, ‘কিছুতেই না। কভী নায়—’

গাই-বকরি চরানিরা প্রথমটা হকচকিয়ে গেলেও পরে সামলে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে হুমকে ওঠে, ‘হট যা, হট যা ভূচ্চরের দল।’

গণেরি বলে, ‘নায় হটেগা। মৌয়া হামনিলোগনকা—’

আর সবাই চেঁচায়, ‘হামনিলোগনকা।’

‘তুহরকা বাপকা। হট যা কুত্তেকা ছৌয়ারা—’ মারমুখি গাই-বকরি চরানিরা তেড়ে আসে।

গণেরিও রুখে দাড়ায়, ‘তুলোগন হট যা। বড়ে সরকার এই মৌয়া আমাদের দিয়েছেন।’

‘তোদের বাপেদের দিয়েছেন রেণ্ডিকা ছৌয়ারা। ভাগ কুত্তা, ভাগ—’ বলেই একটা গাই-বকরি চরানি লোহার গুল-বসানো মোটা লাঠি সিধা গণেরির মাথায় বসিয়ে দেয়।

সঙ্গে সঙ্গে তার কপাল দু ফাঁক হয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে। চিৎকার করে গণেরি ঘুরে পড়ে যায়।

জনমদাসেরা পুরুষানুক্রমে বেগার দিয়ে দিয়ে জনমভীতু হয়ে আছে। কয়েক পা পিছিয়ে ভয়ার্ত গলায় তারা ফিসফিসিয়ে বলতে থাকে, ‘গণেরি চাচাকো খতম কর দিয়া রে।’

আদিবাসী-ওরাঁও-মুণ্ডারা কিন্তু পিছু হটে না; একই জায়গায় স্থির দাড়িয়ে থাকে। তাদের মধ্যে দু-একজন দৌড়ে গিয়ে গণোরিকে তুলে একধারে সরিয়ে নিয়ে যায় এবং তারই ঠোঁট কাপড়ের খুঁট ছিড়ে রক্তাক্ত কপালে ফেট্টি বাঁধতে থাকে।

গণেরির মাথা ফাটাবার মতো প্রয়োজনীয় কাজটি সমাধা করে একমুহূর্তও আর দাড়ায় না গাই-বকরি চরানিরা্‌ ফের মহুয়াগাছে চড়ার জন্য এগিয়ে যায়।

গণেরি পুরোপুরি বেহুঁশ হয় নি। নির্জীব দুর্বল গলায় সে তাদের বলে, ‘নায়, নায়—মৌয়া হামনিলোগনকা—’

তার কথার প্রতিধ্বনি করেই ভূমিহীন স্বাধীন আদিবাসীরা গর্জে ওঠে, ‘রুখ যা, রুখ যা—’

বাপ-মা এবং চোদ্দপুরুষ তুলে গালাগাল দিতে দিতে গাই-বকরি চরানিরা এবার ওরাঁও-মুণ্ডাদের দিকে দৌড়ে যায়। কিন্তু ডর বস্তুটা তাদের সিনায় নেই। ওদের বেশির ভাগেরই কাধে রয়েছে টাঙ্গি বা তীর ধনুক। সেগুলো বাগিয়ে তারা রুখে দাঁড়ায়।

জমিমালিকের লোকেদের লাঠি এলোপাথাড়ি পড়তে থাকে আদিবাসীদের ওপর। ওরাঁও-মুণ্ডাদের টাঙ্গির ধারাল ফলাগুলো মশালের আলোয় ঝিলিক মারতে থাকে। বাঁশের ধনুক থেকে ঝাঁক ঝাঁক তীর ছুটে যায়। দু পক্ষের দশ বারোটা লোক ধপাধপ মাটিতে পড়ে যায়। তাদের কারো মাথা কি কপাল চৌচির, কারো সিনা এফোঁড় ওফোঁড় করে তীরের ফলা বেরিয়ে গেছে। রক্তে মাটি ভেসে যাচ্ছে। চারদিকে গোঙানি, লাঠি এবং তীর ছোটার সাঁই সাঁই আওয়াজ। দক্ষিণ কোয়েলের পাড়ে নিঝুম মহুয়ার জঙ্গল জষ্ঠি মাসের মধ্যরাতে পৃথিবীর আদিম রণভূমি হয়ে উঠতে থাকে।

ডরপোক জনমদাসেরা জঙ্গলের ভেতর অনেকটা পিছিয়ে গিয়ে ভীত গলায় অনবরত চিৎকার করতে থাকে। কয়েক শো বছর ধরে পরের জমিতে লাঙল ঠেলতে ঠেলতে তাদের ওপর নির্বীর্য, ভীরু ক্রীতদাসের আত্মা যেন ভর করে আছে। নিজেকে বাঁচাবার জন্য তারা অস্ত্র ধরতে শেখে নি। কোনরকম যুদ্ধের পদ্ধতিই তারা জানে না।

কতক্ষণ মহুয়া জঙ্গলের এই মহাযুদ্ধ চলেছিল, কারো হুশ নেই। আচমকা দেখা যায়, দক্ষিণ কোয়েলের মরা খাতের ধু ধু বালির ওপর দিয়ে একটা তেজী ঘোড়া দৌড়ে আসছে। তাদের পেছনে অগুনতি মানুষ। লোকগুলোর হাতের উঁচু লাঠিতে হ্যাজাক বাঁধা, কারো কারো হাতে মশাল।

ঘোলাটে চাঁদের আলো আর হ্যাজাক ইত্যাদির রোশনিতে ঘোড়-সওয়ারকে চেনা যায়—বড়ে সরকার রঘুনাথ সিং। তার এক হাতে লাগাম, আরেক হাতে বন্দুক। মাঝে মাঝে বন্দুকটা আকাশের দিকে তুলে তিনি ফাঁকা আওয়াজ করছেন। পেছনের লোকগুলোকেও চিনতে অসুবিধা হয় না; ওরা তাঁর পোষা পহেলবানের দল। আর আছে তাঁর চুনাওকা এজেন্ট ঠিকাদার অযোধ্যাপ্রসাদ। লোকগুলো সমানে চিৎকার করে হুঁশিয়ারি দিয়ে যাচ্ছে, ‘রুখ যা, রুখ যা। না রুখলে গোলি চলবে—’

রঘুনাথ সিং কীভাবে মহুয়া জঙ্গলের এই হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের খবর পেয়েছেন, তিনিই জানেন। হয়ত হাইওয়ে দিয়ে যেতে যেতে গারুদিয়া তালুকের কোন লোক হৈচৈ চেঁচামেচি শুনে তাঁকে জানিয়েছে।

কেশরগুলা তেজী ঘোড়া, বন্দুক, পহেলবান এবং স্বয়ং বড়ে সরকার রঘুনাথ সিংকে দেখে লড়াই থেমে যায়। দু পক্ষের যে যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে।

ঘোড়া থেকে বন্দুকসুদ্ধ লাফ দিয়ে নেমে পড়েন রঘুনাথ সিং। যারা প্রচণ্ড রকমের জখম এবং রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে পড়ে ছিল তাদের দ্রুত এক পলক দেখে নেন তিনি। খুন-জখম-রক্তারক্তি এ সব তাঁর কাছে খুব একটা অচেনা বা অনভ্যস্ত ব্যাপার নয়। সব দেখা হয়ে গেলে মারাত্মক গম্ভীর স্বরে জানতে চান, ‘কা হুয়া?’

কেউ গলা দিয়ে আওয়াজ বার করে না।

রঘুনাথ সিং গর্জে ওঠেন, ‘কী রে, চুপ কেন? বাতা কী হয়েছে?’

দোসাদ ভূমিদাস থেকে ওরাঁও-মুণ্ডা পর্যন্ত সবাই চমকে ওঠে তাদের সামনে যে রঘুনাথ সিং তিনি ভোট-মাঙোয়া স্নেহশীল মহানুভব রঘুনাথ সিং নন। যে সরকার বড় মমতায় তাদের মতো অচ্ছুৎদের ঘিয়ের উৎকৃষ্ট লাড্ডু নিজের হাতে বিলিয়ে ছিলেন তাঁকে এর মধ্যে পাওয়া যাবে না।

এই রঘুনাথ সিং দোসাদদের চিরকালের চেনা—বন্দুকবাজ, হিংস্র, ভয়ঙ্কর।

গণেরি একধারে পড়ে ছিল। বুক টেনে টেনে সে রঘুনাথ সিংয়ের কাছে চলে আসে। বলে, ‘হুজৌরকা হুকুম হো যায় তো হামনি বাতায়গা—’

রঘুনাথ সিং বলেন, ‘হাঁ, বল—’

গণেরি কাঁপা কমজোরি গলায় শুরু করে, ‘বড়ে সরকার, ইয়ে হামনিলোগনকা পেটকা সওয়াল—’

বিরক্ত মুখে রঘুনাথ ধমকে ওঠেন, ‘বকবাস না করে আসল কথাটা বলে ফেল।’

গণেরি এবার যা বলে তা এইরকম। বড়ে সরকার স্বয়ং হুকুম দিয়েছেন, এ বছর এই মারাত্মক খরার সময়টা যখন গাঁকে গাঁ জ্বলে যাচ্ছে, কোথাও একদানা খাদ্য নেই, তখন বড়ে সরকার গরীবের মা-বাপ, বহোত কিরপা করে তাদের মতো ভুখানাঙ্গাদের এই জঙ্গলের মহুয়ার গোটা নেবার ব্যবস্থা করেছেন। গাই-বকরি চরানিদের হুকুম দিয়েছেন, তারা যেন মহুয়ার জঙ্গল থেকে তফাতে থাকে। লেকেন তারা হুজৌরের হুকুমের পরোয়া না করে মাঝরাতে এসে মহুয়ার ফল নিয়ে যায়।

তারপর কীভাবে আজ দোসাদ এবং আদিবাসীরা এখানে এসে পাহারা দিতে থাকে এবং কীভাবে গাই-বকরি চরানিদের সঙ্গে তাদের বিশেষ করে ওরাঁও-মুণ্ডাদের লড়াই বাধে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে যায় গণেরি!

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকেন রঘুনাথ সিং। চোখের কোণ দিয়ে গাই-বকরি চরানিদের লক্ষ্য করেন। এদের ভেতর তাঁর নিজের লোকেরাও রয়েছে।

আসলে চতুর পরিকল্পনাটা ছিল তাঁরই। চুনাওর দিকে নজর রেখে, বিপুল মহানুভবতা দেখিয়ে রঘুনাথ বাতিল ভূমিদাস আর ওরাঁও- মুণ্ডাদের মহুয়ার ফল নেবার ব্যবস্থা করে দেন। সবার সামনে গাই-বকরি চরানিদের হুঁশিয়ারও করে দেন, তারা যেন এ বছর মহুয়ার জঙ্গলে না যায়। কিন্তু তলায় তলায় তাদের জানান, রাত্তিরে দোসাদরা যখন ঘুমিয়ে থাকবে, তারা গিয়ে যেন মহুয়া পেড়ে আনে। এই ধূর্ত চালে সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না। ভোটদাতা জনমদাসেরাও থাকবে, আর নিজের এবং অন্য জমি-মালিকের গাই-বকরির জন্য মহুয়ার ফলও পাওয়া যাবে। এখন যা কিছু করণীয় সবই সুকৌশলে করা প্রয়োজন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ফন্দিটা শেষ পর্যন্ত খাটল না। হারামীর ছৌয়া দোসাদগুলো তাঁর চালটা হয়ত টের পায় নি, তবে মহুয়া যে কমে যাচ্ছে—সেটা ঠিকই ধরে ফেলেছে।

গণেরি ফের বলে, ‘হুজৌর, এবার বলুন জানবর বাঁচবে, না মানুষ বাঁচবে?’

রঘুনাথ সিং পরম উদারতায় ঘোষণা করেন, ‘মানুষ—’ তাঁর হিসেব ঠিক আছে। চুনাওর আর বেশি দেরি নেই। ভালয় ভালয় নির্বাচনটা একবার হয়ে গেলে কী করতে হবে, তিনি ভাল করেই জানেন। বৃহৎ লাভের জন্য আপাতত সামান্য স্বার্থত্যাগ বুদ্ধিমান-মাত্রেই করে থাকেন। এই আপ্তবাক্য রঘুনাথ সিংয়ের আজানা নয়। গাই-বকরি চরানিদের দিকে ফিরে বলেন, ‘কুত্তারা বচ্চেরা, এধারে আর কখনও আসবি না। যদি শুনি এসেছিস, কোয়েলের বালির তলায় তোদের লাশ পুঁতে দেব।’

রঘুনাথ সিংয়ের গোপন নির্দেশেই গাই-বকরি চরানিরা রাতে জঙ্গলে আসে। সুতরাং অকারণে এই গালাগাল যে তাদের প্রাপ্য নয়, এ কথা গলা দিয়ে বার করার হিম্মত কারো নেই। তারা সংয়ের পুতুলের মতো মাথা নেড়ে একই সঙ্গে বলে ওঠে, ‘জী হুজৌর।’

রঘুনাথ সিং এবার তাঁর ব্যক্তিগত সামরিক বাহিনী অর্থাৎ পহেলবানদের হুকুম দেন, ‘জখমী লোকগুলোকে নিয়ে ভকিলগঞ্জের হাসপাতালে চলে যা।’

‘জী হুজৌর—’ পহেলবানেরা দু পক্ষের আহত রক্তাক্ত মানুষগুলোকে কাঁধের ওপর তুলতে থাকে। এমন কি আধবুড়ো গণোরিও এই মওকায় একজনের কাঁধে চড়ার দুর্লভ সুযোগ পায়।

রঘুনাথ চারপাশের দোসাদ আর আদিবাসীদের দেখতে দেখতে বলেন, ‘যারা জখম হয়েছে তাদের বাপ-মা কি জরুরা কাল এসে মুনশী আজীবচাঁদের কাছ থেকে দশগো করে রুপাইয়া নিয়ে যাবি।’

রঘুনাথ সিংয়ের এও এক উৎকৃষ্ট চাল। মাত্র দশটা করে টাকা মাথাপিছু খরচ করে লোকগুলোকে যদি খুশী রাখা যায়, মন্দ কী। চুনাওর দিন এই চালটা যথেষ্ট কাজ দেবে।

ভুখানাঙ্গা লোকগুলো একেবারে কৃতার্থ হয়ে যায়। তারা অভিভূত গলায় বলে, ‘হুজোর মা-বাপ—’

রঘুনাথ সিং আর দাঁড়ান না; রেকাবে পা ঢুকিয়ে লাফ দিয়ে ফের ঘোড়ার পিঠে উঠে পড়েন। গোড়ালি দিয়ে পেটে একটা গুতো মারতেই তেজী জানোয়ারটা দৌড়তে শুরু করে। ঠিকাদার অযোধ্যাপ্রসাদ তার পেছন পেছন ছুটতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘোড়া এবং ঘোড়সওয়ার কোয়েলের বালির ওপর দিয়ে হাইওয়ের দিকে অদৃশ্য হয়ে যায়।

এদিকে জখমী লোকগুলো পহেলবানদের কাঁধে চড়ে সাত মাইল ওফাতে ভকিলগঞ্জের দিকে রওনা হয়। বাকী ওরাঁও-মুণ্ডা এবং দোসাদরা যে যার আস্তানায় ফিরতে থাকে।

এখন কত রাত, কে জানে। তবে ক্ষয়িত ঘোলাটে চাঁদ পছিমা আকাশের দিকে ঢলে পড়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *