তেইশ
দুপুরে ভাত-ডাল-মাংস-সবজি-আচার এবং লাড্ডু-দহি দিয়ে উৎকৃষ্ট ‘ভোজন’ সেরে টিউমলের ভাবী সমধী-সমধীন আরো খানিকক্ষণ ‘গপসপ’ করেছে, হাল্কা মেজাজে ঠাট্টা-তামাসা করেছে। তারপর জষ্ঠি মাসের সূরয পশ্চিম দিকে অনেকখানি নেমে গেলে তারা তিলাই গাঁওয়ে রওনা হয়ে গেছে।
অন্যদিন দোসাদটোলাটা ভোর থেকে সেই সন্ধ্যে পর্যন্ত ফাঁকা পড়ে থাকে। এটা যে একটা মানুষের বসতি তখন তা একেবারেই মনে হয় না। অন্য দিন এখানে কারো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না, চারদিক নিঝুম হয়ে থাকে। আজ দোসাদটোলা একেবারে সরগরম। শিউমলের বিয়ে উপলক্ষে আচানক এক রোজ ছুটি পেয়ে যাওয়ায় এখানকার বাসিন্দারা বেজায় খুশী। এমন কি দোসাদটোলার যারা স্বাধীন মানুষ বা কমজোরি দুবলা বুড়ো-বুড়ী, তারা পর্যন্ত আজ আর খাবারের খোঁজে বেরোয় নি। এখন এই পড়তি বেলায় ফাঁকা জায়গাগুলোতে দড়ির চৌপায়া পেতে থোকায় থোকায় পুরুষ এবং মেয়েরা গপসপ করছে। কেউ কেউ আবার গানের আসর বসিয়ে দিয়েছে। গোটা দোসাদটোলা জুড়ে ঢিলেঢালা আলস্যের ভাব।
আচমকা দূর থেকে বহু গলার চিৎকার ভেসে আসে। আওয়াজটাই শুধু শোনা যায় কিন্তু লোকগুলো কী বলছে পরিষ্কার বোঝা যায় না। তবে দোসাদটোলার মানুষরা কথাবার্তা এবং গান-বাজনা থামিয়ে কান খাড়া করে থাকে।
কিছুক্ষণের মধ্যে টের পাওয়া যায়, চিৎকারটা এদিকেই আসছে। গলার স্বরগুলোও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
‘সুখন রবিদাসকো—’
‘বোট দো।’
‘সুখন রবিদাসকো—’
‘বোট দো, বোট দো’
‘উটকা পর—’
‘মোহর মারো, মোহর মারো।’
একসময় দোসাদটোলার তাবত মেয়েপুরুষ বাইরের ফাঁকা কাঁকুরে ডাঙায় বেরিয়ে আসে। ততক্ষণে হাইওয়ের দিক থেকে শ’খানেক মানুষের একটা দলও চিৎকার করতে করতে কাছে চলে এসেছে। সবার আগে আগে রয়েছে স্বয়ং সুখন রবিদাস।
বিজুরি এবং গারুদিয়া তালুকের, শুধু এই দুটো জায়গারই বা কেন, পঞ্চাশ-ষাট মাইলের মধ্যে যত গাঁ-গঞ্জ হাট-বাজার রয়েছে, সব জায়গার তাবত মানুষ সুখনকে চেনে। বিশেষ করে জল-অচল অচ্ছুতেরা। তারা শুধু সুখনকে চেনেই না, মনে মনে তার নামে পুজোও চড়ায়। চামারদের এই ছেলেটা বহুত তেজী। বামহন-কায়াথ-রাজপুত, সরকারী অফসর, থানার দারোগা কি মাজিস্টার, কাউকেই সে রেয়াত করে না। ঠাঁই ঠাঁই সবার মুখের ওপর কথা বলে। হাঁ, সিনায় সাহস আছে ছোকরার।
সুখেনকে যেমন এ তল্লাটের সবাই চেনে, সুখনও তেমনি অনেককেই চেনে। বিশেষ করে এই দোসাদটোলার গণেরি, বুধেরি, টিউমল থেকে শুরু করে মাধোলাল বৈজু পর্যন্ত অন্তত দশ বিশজন তার ‘জানপয়চান আদমী’।
হাত তুলে সুখন তার সঙ্গীদের থামিয়ে সোজা গণেরির কাছে এগিয়ে এল। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন আছ চাচা?’
গণেরির চোখমুখ দেখে বোঝা যায়, সুখনকে দেখে সে খুশী হয়েছে। সুখন এ অঞ্চলে বহু জনেরই প্রিয়। গণেরি খুব আন্তরিক গলায় বলে, ‘ভালো। তুমি কেমন আছ?’
‘আচ্ছা—’
এরপর ঘুরে ঘুরে দোসাদটোলার সবার কাছেই যায় সুখন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাদের নানা খবর নিয়ে ফের গণেরির কাছে ফিরে আসে। বলে, ‘চাচা, একটা দরকারী কাজে তোমাদের কাছে এসেছিলাম।’
সুখনের কাজের ব্যাপারটা মোটামুটি আন্দাজ করতে পারে গণেরি। তবু শুধোয়, ‘কী কাজ, বল—’
‘জরুর শুনেছ, আমি এবার চুনাওতে নেমেছি।’
‘শুনা হ্যায়।’
‘আমি তোমাদের কাছে কী জন্যে এসেছি, এবার বুঝতে পারছ তো?’
আধবুড়ো অভিজ্ঞ গণেরিকে এবার কেমন যেন বিপন্ন দেখায়। সে অন্যমনস্কর মতো আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে।
সোজাসুজি তার চোখের দিকে তাকিয়ে সুখন এবার বলে, ‘আমি এসেছি চুনাওতে তোমাদের ভোট চাইতে। বহোত আশা করে এসেছি। তোমাদের হর আদমীর ভোট আমার চাই। একটা ভোটও যেন আর কেউ না পায়।’
গণেরি চুপ করে থাকে।
সুখন বলে যায়, ‘আমার মার্কা হল উট। উটের পাশে মোহর মারবে। আমি জানি তুমি দোসাদটোলার সব। তুমি বললে আমাকে ভোট না দিয়ে কেউ পারবে না। কেন আমাকে চুনাওতে জেতানো দরকার সবাইকে বুঝিয়ে দিই, না কি বল চাচা?’
গণেরি এবারও উত্তর দেয় না।
সুখন খানিকটা পিছিয়ে ছোটখাট একটা টিলার মতো জায়গায় গিয়ে দাড়ায়। তারপর গলা চড়িয়ে বলতে থাকে, ‘ভাইয়া আর বহিনরা, তোমরা অচ্ছুৎ, দোসাদ। তার ওপর কমিয়া। বাপ-নানা কি নানাকা বাপের আমল থেকে পুরা জীবন পরের জমিনে বেগারি দিয়ে যাচ্ছ। আমিও অচ্ছুৎ—চামারকা বেটোয়া। আমাদের নাম শুনলে উচা জাতের লোকেরা দশ বার থুক দেয়। আমাদের ছায়া যেখানে পড়ে তার দশ মাইল তফাত দিয়ে হাঁটে।’
দোসাদটোলার বাসিন্দারা নিঃশ্বাস বন্ধ করে সুখনের কথা শুনতে থাকে; তাদের চোখের পাতা পড়ে না।
সুখন সমানে বলে যায়, ‘দেশমে চালু হ্যায় বামহনরাজ, কায়াথরাজ, উঁচা জাতোকা রাজ। তোমরা আমরা, মতলব চামার গঞ্জু ধোবি দোসাদ ধাঙড়েরা চাঁন্দা-সূরয যত কাল ধরে উঠছে সব কোই উঁচা জাতের জুতির নিচে পড়ে আছি। জানবরের মতো ওরা আমাদের খাটায়, জানবরের মতো আমাদের সাথ ব্যবহার করে। লেকেন এ নেহী চলেগা, নেহী চলেগা। তোমার আমার মতো অচ্ছুৎদের ভালাইয়ের জন্যে আমাকে জেতানো দরকার। চুনাওতে তোমরা যদি আমাকে জিতিয়ে দাও, আমরা সবাই যাতে মানুষের মতো বাঁচতে পারি তার কোসিস করব। কমসে কম পটনার বিধানসভায় গিয়ে দুনিয়ার মানুষকে তো জানাতে পারব আমরা অচ্ছুৎরা কী অবস্থায় আছি। তোমরা কামিয়ারা কীভাবে পরের জমিনে জান খতম করে দিচ্ছ। ইয়াদ রেখো আমার মার্কা হল উট। উট মার্কায় মোহর মারবে।’
সঙ্গে সঙ্গে সুখনের সঙ্গীরা চিৎকার করে ওঠে:
‘সুখখন রবিদাসকো—’
‘বোট দো, বোট দো।’
‘উটমে—’
‘মোহর মারো, মোহর মারো।’
‘সুখখন জিতনেসে—’
‘অচ্ছুৎ বাঁচেগা।’
‘সুখখন জিতনেসে—’
‘জমানা বদল যায়েগা।’
হাতের ইঙ্গিতে সঙ্গিদের থামিয়ে টিলা থেকে নেমে ফের গণেরির কাছে চলে আসে সুখন। তার বুকে একটা হাত রেখে বলে, ‘তোমার ওপর ভরোসা করে রইলাম চাচা।’
গণেরিকে খুবই চিন্তিত দেখায়।
সে বলে, ‘মগর—’
‘মগর-উগর কুছ নায়। দুসরা বাত নেহী শুনেগা। তোমার আদমীদের সবার ভোট আমার চাই, চাই, চাই।’
‘মগর—’
‘ফির মগর! ‘
গণেরি বলে, ‘আমি কী বলতে চাই, শুনেই নাও না—’
একটু ভাবে সুখন। কপাল কুঁচকে বলে, ‘ঠিক হ্যায়। বল—’
গণেরি যা বলে তা এইরকম। তারা বাপ-নানা কি তারও আগের আমল থেকে পুরুষানুক্রমে বড়ে সরকার রঘুনাথ সিংয়ের কাছে খরিদী হয়ে আছে। সেই বড়ে সরকার এবার চুনাওতে নেমেছেন। এদিকে সুখন রবিদাসও নেমেছে। সুখন তাদের আপনা আদমী; মনমে বহোত ইচ্ছা তাকেই ভোট দিয়ে চুনাওতে জিতিয়ে দিতে। কিন্তু মুসিবৎ হয়ে গেছে রঘুনাথ সিংয়ের জন্য। তাঁরই জনমদাস হয়ে, তাঁরই কাটানো কুয়োর জল খেয়ে, তাঁরই দেওয়া জায়গায় ঘর তুলে আজীবন বাস করে চুনার সময় তাঁর হাতী মার্কার বদলে উট মার্কায় মোহর মারলে ঘাড়ের ওপর মাথাটা কি আর খাড়া থাকতে দেবেন রঘুনাথ? পোষা পহেলবানদের লেলিয়ে জরুর তাদের ঘরে আগ লাগিয়ে দেবেন; জানে খতম করে লাশ গুম করে ফেলবেন।
সুখন বলে, ‘ঘাবড়াও মৎ চাচা। সবাই যদি বড়ে সরকারদের নামে ডরে যায় আমাদের হাল কী হবে? সারা জীওন আমরা উচা জাতের নাগরার নীচে পড়ে থাকব? তাদের জমিনে কামিয়া খেটে খেটে খতম হয়ে যাব? এ হবে না গণেরি চাচা, সিনার ভেতর থোড়েে তাকত আনো।’ বলে দু কাঁধ ধরে গণেরিকে ঝাঁকায় সুখন। খুব সম্ভব তার মধ্যে খানিকটা সাহস সঞ্চার করতে চেষ্টা করে।
ভীরু গলায় গণেরি জানায়, ‘তোমার কথাটা ভেবে দেখব।’
গণেরির কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে দুখন বলে, ‘ঠিক হ্যায় চাচা; আজ যাই। আবার আমি আসব।’ অন্য দোসাদদের দিকে হাত তুলে বলে, ‘চলি ভাইরা, বহিনরা—’ তারপর দলবল নিয়ে কাঁকুরে ডাঙা পেরিয়ে দূরে হাইওয়ের দিকে এগিয়ে যায়।
গণেরিরা খানিকটা দূরে চলে গেলে, ভিড়ের ভেতর থেকে নওরঙ্গী বেরিয়ে আসে। সুখনের চিৎকার শুনে সবার সঙ্গে সে-ও দোসাদটোলার বাইরে চলে এসেছিল। পরে তার কথা আর কারো মনে ছিল না।
নওরঙ্গী হাত-পা নেড়ে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে বলে, ‘ভূচ্চর জানবরটার মরার জন্যে ডানা গজিয়েছে। মরেগা, ও হারামী জরুর মরেগা, বিলকুল ফৌত হো যায়েগা।’
ভূচ্চর জানবর এবং হারামী—এই তিনটে বাছা বাছা উৎকৃষ্ট গালাগাল কার উদ্দেশে দেওয়া হল, দোসাদদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। সুখন যে এখানে ভোট চাইতে এসেছিল, এই খবরটা জানতে রঘুনাথ সিংয়ের খুব বেশি দেরি হবে না। নওরঙ্গী যখন তাকে দেখে ফেলেছে তখন নিশ্চয়ই সুখনের কথা হিমগিরি মারফত বড়ে সরকারের কানে উঠে যাবে।
এখানে সুখনের ভোট মাঙতে আসাটা যেন গণেরিদের মস্ত এক অপরাধ। নওরঙ্গীর নানা অঙ্গভঙ্গি দেখে বা তার মুখে সুখন সংক্রান্ত খিস্তিখেউড় শুনেও কেউ মুখ খোলে না; সবাই ভয়ে সিটিয়ে থাকে।
নওরঙ্গী ফের বলতে থাকে, ‘কুত্তাটার সিনায় বহোত তাকত। বড়া সরকারের আপনা আদমীদের কাছে ভোট মাঙতে এসেছে। ঘাড়ের ওপর দশটা শির গজিয়েছে হারামজাদার; শিরগুলো নামিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতে হবে।’
ভিড়ের মধ্যে দাড়িয়ে নওরঙ্গীর কথা শুনতে শুনতে রামলছমনের কথা মনে পড়ে যায় ধর্মার। সেদিন চাহাঢ়ের হাটে সুখনদের দেখে এই রকমই ক্ষেপে গিয়েছিল বগুলা ভকতটা দেখা যাচ্ছে বড়ে সরকারের পা-চাটা কুত্তারা তিনি ছাড়া আর যারাই চুনাওতে নেমেছে তাদের সবার ওপর ক্ষিপ্ত।
ওদিকে নওরঙ্গী আর দাঁড়ায় না, সুখনকে আরো কয়েক প্রস্থ খিস্তিখাস্তা করে লম্বা লম্বা পা ফেলে দোসাদটোলায় ঢুকে যায়। বাকী সবাইও ফিরে যেতে থাকে।
কিছুক্ষণ পর গোটা দোসাদটোলাটা অবাক হয়ে দেখে, সেজেগুজে নওরঙ্গী চলে যাচ্ছে। অন্য দিন সূর্যাস্তের অনেক পর রাত বেশ ঘন হলে তাকে হিমগিরির কাছে নিয়ে যাবার জন্য খামারবাড়ি থেকে গৈয়া গাড়ি আসে। আজ এখনও সন্ধ্যা পর্যন্ত নামে নি, পশ্চিম দিকের আকাশের গায়ে লাল রঙের সূরযটা আটকে আছে। এত তাড়াতাড়ি এত ব্যস্তভাবে স্রেফ পায়দল নওরঙ্গীর বেরিয়ে পড়ার কারণ কী, দোসাদটোলার বাসিন্দাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। তারা চুপচাপ বসে বসে নিজেদের ভীরু হৃৎপিণ্ডের ঢিপ ঢিপ শব্দ শুনতে থাকে। তবু তারই মধ্যে কে যেন ফিসফিসিয়ে গণেরিকে শুধোয়, ‘কা হোগা ভাইয়া? ও ছমকী রাণ্ডী আওরত জরুর মিশিরজীকা পাস সুখনকো খবর পৌঁছা দেগী—’
গণেরি আস্তে মাথা নাড়ে, ‘ঠিক বাত—’
‘মিশিরজী জরুর বড়ে সরকারকে জানাবে।’
‘ও ভি ঠিক।’
‘তব্—’
‘দ্যাখ কী হয়! কেউ আমাদের কাছে এলে কী করে ভাগাই!’
খুব বেশি সময় কাটে না। সূর্য ডুববার পর আকাশ থেকে মিহি অন্ধকার যেই নামতে শুরু করে, লম্বা লম্বা ঠ্যাং ফেলে রামলছমন এসে দোসাদটোলায় হাজির হয়। চনমন করে এদিক সেদিক দেখতে দেখতে বলে, ‘কী ভেবেছিস তোরা? একেবারে চৌপট হয়ে যাবি যে রে উল্লুর বেটোয়া-বেটিয়ারা।’
দোসাদরা ভয়ে ভয়ে শুধোয়, ‘কা হুয়া দেওতা?’
‘কা হুয়া?’ রামলছমন বলতে থাকে, ‘চল আমার সাথ। গেলেই বুঝতে পারবি। যত মরদ আছিস, উঠে পড়—’
‘কঁহা যায়গা হুজৌর?’
‘গেলেই মালুম পাবি। চল্—’ ধমকে চেঁচিয়ে গোটা এলাকাটা মাথায় তুলে ফেলে রামলছমন।
একটু পরেই দেখা যায়, দোসাদটোলার তাবত পুরুষরা বগুলা ভকতের পিছু পিছু হাইওয়ের দিকে চলেছে। রামলছমন তাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সে সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
তবে নওরঙ্গীর ওভাবে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়া, তারপরেই রামলছমনের এখানে আসা—সব কিছুর মধ্যেই একটা অনিবার্য ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। তবু দেখাই যাক।
শেষ পর্যন্ত রামলছমন দোসাদদের যেখানে এনে তুলল সেটা বড়ে সরকারের হাভেলি। রঘুনাথ সিং শ্বেত পাথরের ঢালা বারান্দায় তাঁর সেই গদিমোড়া বিরাট ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে পড়ে আছেন। তাঁকে ঘিরে তাঁর সর্বক্ষণের সহচরেরা। ডাগদরজী, ভকীলজী, মাস্টারজী ইত্যাদি ইত্যাদি। আর আছে তাঁর হয়ে চুনার জন্য যারা খাটছে সেই সব কর্মীরা।
এধারে ওধারে গণ্ডা গণ্ডা বিজলী বাতি জ্বলছে। রোশনিতে চারদিক দিনের মতো স্পষ্ট।
রামলছমন রঘুনাথ সিংকে বলে, ‘সরকার, সবাইকে ধরে নিয়ে এসেছি।’
আস্তে মাথা হেলিয়ে রঘুনাথ সিং হাতের ইসারায় তাকে চলে যেতে বলেন।
দোসাদদের কাছে এবার ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যায়। বড়ে সরকারই তাদের তলব করে এনেছেন। তারা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে থাকে।
কিন্তু রঘুনাথ সিংয়ের চোখমুখ দেখে মনেই হয় না তিনি গুসসা হয়েছেন। বরং তাঁর তাকানোর মধ্যে রয়েছে অগাধ স্নেহ এবং প্রশ্রয়। খুব মিষ্টি করে বলেন, ‘কা রে, সব দাঁড়িয়ে রইলি কেন? বসে পড়।’
নিচের ঘাসের জমিতে গা জড়াজড়ি করে দলা পাকিয়ে বসে পড়ে গণেরিরা। কী কারণে বড়ে সরকার ডাকিয়ে এনেছেন, সেটা না জানা পর্যন্ত বুকের কাঁপুনি তাদের থামে না।
রঘুনাথ সিং বলেন, ‘টিউমলের বেটার সাদির বাত পাক্কা হয়ে গেল?’
টিউমল কাঁপা গলায় জানায়, ‘হুজৌর বড়ে সরকারের কিরপায় পাকা কথা হয়ে গেছে।’
মেয়ের বাড়ি থেকে কথা পাকা করতে কারা কারা এসেছিল, কী কী কথা হল, নতুন কুটুমদের কী খাইয়েছে টিউমলরা, সমস্ত অনুষ্ঠানটা ভালভাবে চুকেছে কিনা, ইত্যাদি ইত্যাদি খুঁটিয়ে খুটিয়ে অনেক কিছু জেনে নিলেন রঘুনাথ সিং। তারপর ফস করে শুধোন, ‘শুনলাম তোদের ওখানে সুখন রবিদাস ভোট মাঙতে এসেছিল। লম্বে লম্বে বহোত লেকচার ভি দিয়া।’
টিউমলের ছেলের বিয়ের ব্যাপারে এত আন্তরিক কথাবার্তা বলছিলেন রঘুনাথ সিং যে ভয়টা অনেকখানি কেটে গিয়েছিল দোসাদদের। আচমকা সুখনের কথা উঠতেই সবাই ভেতরে ভেতরে গুটিয়ে গেল। চোখেমুখে আবার দুর্ভাবনার ছাপ পড়েছে তাদের গণেরিই শুধু দুর্জয় সাহসে উঠে দাড়িয়ে হাতজোড় করে বলে, ‘হঁ সরকার, আয়া থা, কুছ বাত ভি বোলা—’
‘ভোট মাঙা?’
‘হুঁ হুজোর।’ বলে জোরে জোরে শ্বাস টানে গণেরি। তারপর নতুন উদ্যমে ফের বলতে থাকে, ‘কা করে সরকার। কেউ আমাদের কাছে এলে ভাগাই কী করে? বহোত গরীব আদমী হামনিলোগ। আপ হামনিলোগনকো মা-বাপ—’
রঘুনাথ সিং বলেন, ‘কভি নায়। গণতন্তমে যে চুনাওতে নামবে তারই ভোট মাঙবার অধিকার আছে। তোদের কাছে আজ সুখন এসেছে, কাল প্রতিভা সহায় আসবে, পরশু আবু মালেক আসবে, নরশু শর্মাজী আসবে। তবে এর ‘বীচমে’ একটা লেকেন আছে—’
গণেরি শুধোয়, ‘কা হুজোর?’
‘যেই ভোট মাঙুক, তোরা হাতী মার্কায় মোহর মারবি। মনে রাখবি, হাতীতে মোহর মারলে ভোটটা আমিই পাব। আমি তোদের আপনা আদমী। আমাকে চুনাওতে জেতালে তোদের ভালাই হবে। সমঝা?’
গণেরির ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে; বুকের সেই ঢিপঢিপানি থামে। রঘুনাথ সিং তা হলে তাদের ওপর গুসসা হননি। গণেরি বলে, ‘সমঝ গিয়া হুজৌর।’ বলতে বলতে আচমকা একটা কথা মনে পড়ে যায় তার। শুধোয়, ‘একঠো বাত সরকার—’
‘হাঁ হাঁ, পুছ না।’
‘সেদিন আমাদের টোলাতে অবোধজী এসেছিল।’
‘অবোধজী কৌন?’
‘বিজুরি বাজারের বড়া ব্যওসাদার। ‘
‘সমঝ গিয়া; অবোধ পাণ্ডে। প্রতিভা সহায়ের হয়ে চুনাওতে খাটছে।’
গণেরি বলে, ‘পরতিভাজীর জন্যে ‘বোট’ মাঙতে এসেছিল।’
উদার ভঙ্গিতে রঘুনাথ সিং উত্তর দেন, ‘জনতাকে রাজ গণতন্তমে কারো ভোট চাইতে দোষ নেই।’
সাহস পেয়ে গণেরি ফের বলে, ‘আউর একঠো বাত বড়ে সরকার।’
‘কা?’
‘সাত-আট রোজের মধ্যে গারুদিয়া বাজারে পরতিভাজীর চুনাওকা মীটিন হবে।’
‘চুনাওতে নামবে আর মীটিং হবে না? জরুর মীটিং হবে। লেকেন আসল কথাটা কী?’
‘সেই মীটিনে অবোধজী আমাদের যেতে বলেছে। গাড়িতে চড়িয়ে আমাদের নিয়ে যাবে।’
‘কা গাড্ডি? গৈয়া না ভৈসা?’
‘হাওয়া গাড়ি সরকার।’
ওধার থেকে হেড মাস্টারজী বদ্রীবিশাল চৌবে বলে ওঠেন, ‘চুনাও আসাতে তোদেরই দেখছি বরাত খুলে গেল। কা সৌভাগ তোদের। হাওয়া গাড়িতে চড়িয়ে অচ্ছুতেয়াদের মীটিঙে নিয়ে যাবে। কলযুগের বাকি যেটুকু ছিল তাও ‘পূর্ণ’ হয়ে গেল।’
হাত তুলে তাঁকে থামিয়ে দেন রঘুনাথ সিং। বেলন, ‘অ্যায়সা না কহিয়ে চৌবেজী। গণতন্তুমে সব কোইকো হাওয়া গাড়ি চড়নেকো অধিকার হায়।’
গণেরির দিকে ফিরে বলেন, ‘যাবি, নিশ্চয়ই হাওয়া গাড়ি চড়ে তোরা প্রতিভা সহায়ের মীটিং শুনতে যাবি।’
গণেরির সাহস এবার চারগুণ বেড়ে যায়। সে বলে, ‘সরকার, অবোধজী বলেছে, যে পরতিভাজীর চুনাও মীটিনে যাবে তার তিনগো রুপাইয়া মিলবে। রুপাইয়া নেব?’
‘রুপাইয়া দিতে চাইছে আর নিবি না! গাধ্ধা কাঁহাকা! গণতন্তমে রুপাইয়া নিতে কোথাও মানা নেই। লেকেন—’
‘কা সরকার?’ দু চোখে প্রশ্ন নিয়ে দাড়িয়েই থাকে গণোরি।
‘চুনাওর মওকায় যত পারিস হাওয়া গাড়ি চড়ে নে, যত পারিস পাইসা কামাই কর, লেকেন ভোটটা আমার চাই। হাতী মার্কায় মোহর মারার কথা জান গেলেও ভুলবি না।’
‘নায় হুজৌর।’
ডান দিকে যেখানে তেরপল দিয়ে নির্বাচন কর্মীদের জন্য অস্থায়ী ক্যাম্প বসানো হয়েছে সেখান থেকে চিৎকার ওঠে।
‘আপনা ভালাইকে লিয়ে—’
‘রঘুনাথ সিংকো বোট দো, বোট দো।’
‘হাতী মার্কামে—’
‘মোহর মারো, মোহর মারো।’
চিৎকার থামলে রঘুনাথ সিং গণেরিদের বলেন, ‘অনেক রাত হল; তোরা ঘরে যা ‘
দোসাদরা ফিরে যায়।
রঘুনাথ সিংয়ের প্রধান কুত্তাদের একজন ভকীলজী এবার বলে ওঠেন, ‘কারখানাবালীর বহোত পাইসা হয়েছে। চুনাওতে খুব ছড়াচ্ছে।’
চৌরেজী বললেন, ‘চারদিকে সব গরীব মানুষ। রুপাইয়া পাইসার লালচে ভোট টোট কারখানাবালীকে না দিয়ে বসে।’
এতক্ষণ বেশ হাসিখুশিই ছিলেন রঘুনাথ সিং। এবার তাঁর মুখটা ভয়ানক গম্ভীর দেখায়। তবে তিনি আপাতত প্রতিভা সহায় সম্পর্কে কোনরকম মন্তব্য করেন না।
বাঙালী ডাগদর শ্যামদুলাল সেন বলেন, ‘আরো একটা কথা আছে রঘুনাথজী।’
রঘুনাথ সিং বিশাল শরীর কাত করে ডান পাশে শ্যামদুলালের দিকে তাকান।
শ্যামদুলাল বলেন, ‘এবার আমাদের এই জায়গায় চুনাওর ক্যারেক্টারটা বড়া আজীব।’
‘কী রকম?’
‘মোট ছ’জন চুনাওর লড়াইতে নেমেছে। প্রতিভা সহায়, নেকীরাম শর্মা, সুখন চামার, আবু মালেক, আপনি আউর ছে নম্বর যে আছে তাকে না ধরলেও চলে। নিজের ফ্যামিলির আট দশ জনের ছাড়া বাইরের আধখানা ভোটও সে পাবে না। ‘
রঘুনাথ বলেন, ‘চুনাওতে কোথাও পাঁচ ক্যাণ্ডিডেট লড়ে, কোথাও সাত ক্যাণ্ডিডেট, কোথাও দশ পন্দরভি। এর মধ্যে আজীব কেরেক্টারটা কোথায় পেলেন?’
হাত তুলে রঘুনাথ সিংকে থামিয়ে দেন শ্যামদুলাল। তারপর গারুদিয়া-বিজুরির চুনাওতে এবার যে আশ্চর্যজনক লক্ষ্যণীয় ব্যাপারটা ঘটছে সবিনয়ে এবং সংক্ষেপে তা বলে যান। এখানকার পাঁচ নির্বাচন প্রার্থীর ভেতর থেকে প্রথমেই রঘুনাথ সিংকে ধরা যাক। রঘুনাথ সিং হলেন জমির মালিক, সান অফ দি সয়েল—পুরুষানুক্রমে মিট্টিকা সন্তান। দু নম্বর প্রতিভা সহায়: বিজুরিতে তাঁর সসুরাল হলেও আসলে তিনি গাঁওকা আদমী নন; তিনি শহরের মানুষ— ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, কারখানাবালী। দেশের মিট্টিতে তাঁর ‘রুট’ নেই। তিন নম্বর হল সুখন রবিদাস। সে অচ্ছুৎ জল-অচলদের প্রতিনিধি। চার নম্বর আবু মালেক: মাইনোরিটিদের রিপ্রেজেন্টেটিভ। আর পাঁচ নম্বর নেকীরাম শর্মা উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণদের তরফ থেকে এই চুনাওতে নেমেছে। তা হলে দেখা যাচ্ছে জমি মালিক, ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, অচ্ছুৎ, মুসলিম মাইনোরিটি আর উঁচা জাতের হিন্দু—পাঁচ ক্লাসের রিপ্রেজেন্টেটিভ এই অঞ্চলের নির্বাচনে ভোটপ্রার্থী।
খুবই মনোযোগ দিয়ে শ্যামদুলালের কথ। শুনে যান রঘুনাথ সিং, তবে তেমন গুরুত্ব দেন না। হাল্কাভাবেই বলেন, ‘এর মধ্যে আজীব বা নয়া কিছু নেই। এসব আমাদের জানা। আগেও এই নিয়ে অনেক কথা হয়েছে।’
শ্যামদুলাল ব্যস্তভাবে বলে ওঠেন, ‘ও তো ঠিক বাত। লেকেন আমার আরো কথা আছে।’
‘কী?’
‘সোসাইটির পাঁচ ক্লাসের রিপ্রেজেন্টেটিভ যখন চুনাওতে নেমেছে তখন ভোট জরুর পাঁচ ভাগ হয়ে যাবে। সেটা কিন্তু চিন্তার কথা।’
রঘুনাথ সিং হাতের ভর দিয়ে উঠে বসতে বসতে এবার বলেন, ‘চিন্তার কথা কেন? থোড়াসে সমঝা দিজিয়ে।’
শ্যামদুলাল এবার যা বলেন তা এইরকম। গারুদিয়া-বিজুরিতে কমসে কম থার্টি পারসেন্ট অচ্ছুৎ আছে। সুখন চামার এই ভোটের প্রায় পুরাটাই টানবে। দুই তালুকে উঁচা জাতের হিন্দু আছে থার্টি ফাইভ থেকে ফর্টি পারসেন্ট। বিজুরি তালুকের মিশিরলালজী ভরসা দিলেও নেকীরাম জাতওয়ারি সওয়াল তুলে ব্রাহ্মণদের ভোট অনেকহাই পেয়ে যাবে। এখানে মাইনোরিটি মুসলিম রয়েছে ফিফটিন থেকে সেভেনটিন পারসেন্ট। আবু মালেক তাদের প্রায় সব ভোটটাই পাবে। আর কারখান্নাবালী প্রতিভা দশ হাতে পয়সা ছড়িয়ে প্রচুর ভোট কিনে নেবে। ফলে কেউ অন্যের চাইতে খুব বেশি একটা ভোট টানতে পারবে না। যেই জিতুক, সামান্য ভোটের মার্জিনে জিতবে।
রঘুনাথ সিংয়ের কপালে ভাঁজ পড়ে। শ্যামদুলালের কথাগুলো তাঁর মস্তিষ্কের ভেতর দ্রুত বসে যেতে থাকে। গম্ভীর মুখে তিনি বলেন, ‘চুনাওর এ দিকটা তো খেয়াল করি নি। করা উচিত ছিল।’
শ্যামদুলাল ছাড়া রঘুনাথ সিংয়ের অন্য পা-চাটা কুত্তারা নড়েচড়ে বসে। রঘুনাথ যখন শ্যামদুলালের কথায় পর্যাপ্ত গুরুত্ব দিয়েছেন তখন তাঁদেরও না দিলে চলে না। সব হাঁ-তে হাঁ মিলানোর দল। তাঁরা সমস্বরে বলে ওঠেন, ‘সাচমুচ করা উচিত ছিল।’
রঘুনাথ সিং বলেন, ‘বহোত চিন্তাকি বাত।’
‘হাঁ হাঁ—’
অস্বস্তির মধ্যে খানিকটা সময় চুপচাপ কাটে। তারপর বদ্রীবিশাল চৌবে বলে ওঠেন, ‘প্রতিভা সহায় কারখান্না ফারখান্না চালাচ্ছিল, তাই নিয়ে থাকলেই তো পারত। এই চুনাওর ভেতর কেন যে আওরতটা নাক ঢোকাল—’
শ্যামদুলাল নাকের ভেতর শব্দ করে বলেন, ‘ক্লাস ইন্টারেস্ট চৌবেজী, স্রিফ ক্লাস ইন্টারেস্ট—’
‘সুখন চামার, আবু মালেক আর নেকীরাম শর্মা এদের ইন্টারেস্টটা কীসের?’
‘এ তো জলের মতো সোজা ব্যাপার। জাতওয়ারি ইন্টারেস্ট। পলিটিক্যাল পাওয়ার হাতে থাকলে জোর কত বাড়ে, ভেবে দেখেছেন?’
রঘুনাথ সিংকে এবার চিন্তাগ্রস্ত দেখায়। তিনি বলেন, ‘আপনাদের কী মনে হয়, চুনাওতে আমি হেরে যাব?’
নির্বাচনের নানা দিক নিয়ে চুলচেরা হিসাব করলেও রঘুনাথ সিংয়ের হারের কথা বদ্রীবিশাল চৌবেরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। গিদ্ধড়ের মতো ঝাঁক বেঁধে তাঁরা চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘নেহী নেহী, কভী নেহী।’
‘এই পয়লা চুনাওতে নামলাম। হেরে গেলে কাউকে আর মুখ দেখাতে পারব না। এটা আমার ইজ্জৎকা সওয়াল।’
‘আপনার বেইজ্জতি পুরা গারুদিয়া তার বিজুরি তালুকের হর আদমীকা বেইজ্জতি। আমাদের গায়ে এক বুঁদ খুন থাকতে আমরা তা হতে দেব না।’ বলে একটু থামেন সবাই। পরমুহূর্তে দম নিয়ে নতুন উদ্যমে শুরু করেন, ‘আপনি যদি হারেন সূরয পছিমা আকাশে উঠবে।’
সর্বক্ষণের সঙ্গী এতগুলো মানুষের জোরালো মৌখিক মদতে রঘুনাথ সিংয়ের দুর্ভাবনা কিছুটা কাটে। তিনি বলেন, বিশ ত্রিশ পুরুষ ধরে আমরা গারুদিয়ায় পড়ে আছি। কোনদিন গাঁও ছেড়ে কোথাও যাই নি। আমি হলাম আসল মিট্টিকা সন্তান। ভোট চাইবার হক একমাত্র আমারই আছে।’
‘আলবত। আজীবচাঁদ মুনশী যে কথাটা বলে সেটা হাজার বার ঠিক। আপনি চুনাতে জিতলে গারুদিয়া-বিজুরিতে রামরাজ নেমে আসবে। এখানকার মানুষ বেঁচে যাবে।’
এ সব শুনে রঘুনাথ সিং গলার ভেতর এমন এক ধরনের শব্দ করেন যা শুনে আন্দাজ করা যায়, তিনি সন্তুষ্ট হয়েছেন।
চুপচাপ খানিকটা সময় কাটে। তারপর বদ্রীবিশাল চৌবে গলা ঝেড়ে একটু কেশে নেন। এক সময় শুরু করেন, ‘তবে একটা কথা রঘুনাথজী।’
চৌবের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে রঘুনাথ জিজ্ঞেস করেন, ‘কী কথা?’
‘আপনার জেতার ব্যাপারে পুরা নিশ্চিন্ত হওয়া দরকার।’
‘এ ব্যাপারে আপনার সন্দেহ আছে নাকি?’
হিক্কা তোলার মতো শব্দ করে চৌবেজী চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘নেহী নেহী। তবে কিনা সাবধানের মার নেই।’
রঘুনাথের কপালটা মসৃণ হয়ে গিয়েছিল। আবার সেখানে ভাঁজ পড়ে। স্থির চোখে বদ্রীবিশালকে দেখতে দেখতে বলেন, ‘আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।’
‘বলছিলাম ভোটগুলো পাঁচ ভাগ হয়ে গেলে অসুবিধা হলেও হতে পারে।’
‘ভাগাভাগি রুখবেন কী করে? আপনারাই একটু আগে বললেন, যারা চুনাওতে নেমেছে তারা সবাই ভাল ভোট টানবে।’
বদ্রীবিশাল বলেন, ‘ও তো ঠিক আছে। লেকেন এই পাঁচ ক্যাণ্ডিডেটের মধ্যে দু একজন যদি না দাঁড়ায়, অত ভাগাভাগি হবে না।’
রঘুনাথ সিংয়ের মতো প্রখর বুদ্ধিমান লোকেরও কেমন যেন সব গুলিয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘সরে দাঁড়াবার জন্যে ওরা চুনাওতে নেমেছে নাকি?’
‘সহজে কি কেউ সরে। তবে তার রাস্তা আছে।’
‘আপনি কি ওদের গুম করে দেবার কথা ভেবেছেন নাকি? লেকেন চৌবেজী আমার বাপ-নানার আমলের সেই পুরানা জমানা আর নেই। কান্ট্রিতে গণতন্ত্র চালু হয়েছে। চুনাওর ক্যাণ্ডিডেটের গায়ে হাত লাগালে কী হবে ভাবতে পারেন?’
দুই কান ধরে জিভ কাটতে কাটতে শিউরে ওঠার ভঙ্গি করেন বজ্বীবিশাল চৌবে; যেন মারাত্মক পাপের কথা শুনেছেন। সেই অবস্থাতেই বলেন, ‘ছিয়া ছিয়া ছিয়া, কী যে বলেন রঘুনাথজী! আমার কি নরকের ভয় নেই? গুম করা ছাড়া কাউকে কি সরানো যায় না?’
‘কীভাবে?’
বদ্রীবিশাল বাঁ চোখ কুঁচকে ডান হাতের বুড়ো আঙুল এবং তর্জনী দিয়ে টাকা বাজাবার ভঙ্গি করেন।
রঘুনাথ সিংকে তেমন উৎসাহিত হতে দেখা যায় না। নিরুৎসুক মুখে তিনি বলেন, ‘পয়সা দিয়ে কি সবাইকে কেনা যায়? তা ছাড়া—’
‘তা ছাড়া কী?’
‘সুখন চামারটা বড় ঠেটা; রুপাইয়া-পাইসা দিয়ে তার গর্দান নোয়ানো যাবে না। জান গেলেও চুনাওর লড়াই থেকে সে হটবে না। প্রতিভা সহায়কে কেনার কথাই ওঠে না; ওরা হল ক্রোড়পতি। বাকী রইল নেকীরাম শর্মা আর আবু মালেক। নেকীরাম সুদখোর, পয়সার লালচ এর আছে তবে আবু মালেকের পিঠের হাড্ডি শক্ত, ওকে বাঁকানোও সোজা হবে না।’
রঘুনাথ সিং যেভাবে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীদের চরিত্র বিশ্লেষণ করলেন তাতে কোথাও ফাঁক নেই। তাঁর পা চাটা কুত্তাদের খুবই চিন্তিত দেখায়।
কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটে।
তারপর রঘুনাথ সিংহ ফের বলে ওঠেন, ‘বড়া মুসিবত—’
আচমকা ভকীল গিরিধরলালজী রঘুনাথ সিংকে বলে ওঠেন, ‘যদি হুকুম দেন তো একটা কথা বলি।’
‘জরুর আপনি বলবেন। এক কথা কেন, শও কথা বলুন।’
‘সব দিক পুরা ভেবে দেখলাম, সুখন চামার আউর প্রতিভা সহায়কে হটানো যাবে না। তবে আবু মালেক আউর নেকীরাম শর্মাকে সরানোর একটা ফিকির হতে পারে।’
‘কী ফিকির?’
‘পয়সা রুপাইয়া হয়ত লাগবে। সাথ সাথ একটা কথাও ওদের জানাতে হবে।’
‘কী কথা?’
‘নেকীরামকে বলতে হবে, ব্রাহ্মণদের পুরা ইন্টারেস্ট আপনি দেখবেন। আবু মালেককে বলতে হবে, মুসলমান মাইনোরিটির স্বার্থ আপনি ছাড়া এখানে অন্য কেউ রক্ষা করতে পারবে না।’
রঘুনাথ সিং চোখ কুঁচকে খানিকক্ষণ চিন্তা করলেন। তারপর তারিফের গলায় বলেন, ‘আচ্ছা বাত। ঐদিকটা আমি ভেবে দেখিনি। মগর—’
‘মগর কী? ‘
‘বামহন আর মাইনোরিটির স্বার্থের কথা বলে ওদের না হয় হটানো গেল। তাতে ফায়দা ওঠানো যাবে কি?’
‘যাবে রঘুনাথজী।’
‘ক্যায়সে? ওরা চুনাওকা লড়াই থেকে সরে গেলে এদের ভোটগুলো আমি যে পার তার গিরান্টি (গ্যারান্টি) আছে?’
‘তা নেই।’
‘তব্?’
‘যাতে নেকীরাম আর আবু মালেকের ভোটাররা হাতীমার্কায় মোহর মারে তার ব্যবস্থা করতে হবে।’
‘ক্যায়সে?’
‘নেকীরাম আর আবু মালেককে আপনার সাপোর্টে ক্যাম্পেনে নামাতে হবে। বামহন আর মুসলিম মাইনোরিটিদের ওরা বোঝাবে, আপনাকে ভোট দিলে তাদের ইন্টারেস্ট পুরা রক্ষা করা হবে। নেকীরাম আর আবু মালেক চুনাওতে জিতলে তাদের যতটা ভালাই হবে, আপনি জিতলে ডবল ভালাই হবে।’
রঘুনাথ সিং নড়েচড়ে বসেন। মুখচোখ দেখে মনে হয়, তিনি খুশী হয়েছেন। নেকীরামেরা তাঁর হয়ে নির্বাচনী প্রচারে নামলে ব্রাহ্মণ আর মুসলমানদের ভোট যে প্রচুর পাবেন এবং ফলত চুনাওতে তাঁর জয় যে অবধারিত সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। রঘুনাথ বলেন, ‘তা হলে নেকীরাম আর আবু মালেকের কাছে আমাদের প্রস্তাব দিয়ে লোক পাঠাতে হয়।’
বদ্রীবিশাল চৌবে বলেন, ‘তা তো পাঠাতেই হবে।’
‘কাকে পাঠানো যায়?’
বিশাল কমপাউণ্ডের একধারে তেরপল খাটিয়ে যে অস্থায়ী নির্বাচনী ক্যাম্প বসানো হয়েছে সেখানে শিরদাড়া টান টান করে বসে এতক্ষণ রঘুনাথ সিংদের কথা শুনে যাচ্ছিল ঠিকাদার অযোধ্যাপ্রসাদ। এবার সে বলে ওঠে, ‘হুজৌর, হুকুম হো যায় তো হামনি চলা যায়েগা।’
ঘণ্টাখানেক গভীর পরামর্শের পর স্থির হয়, ঠিকাদার অযোধ্যাপ্রসাদ এবং বদ্রীবিশাল গোপনে রাতের অন্ধকারে নেকীরামের কাছে যাবেন; গিরধরলালজী এবং শ্যামদুলাল যাবেন আবু মালেকের কাছে।