আকাশের নিচে মানুষ – ২১

একুশ

গারুদিয়া-কোয়েল ফাগুরামের এখন নিঃশ্বাস ফেলার ফুরসত নেই। নাওয়া-খাওয়া ঘুম-বিশ্রাম কোন কিছুই তার ঠিক থাকছে না। সকালবেলা গলায় নতুন হারমোনিয়ামটা ঝুলিয়ে দোসাদটোলা থেকে সে বেরিয়ে পড়ে। রাতে কখন ফেরে কেউ টের পায় না। পাড়ার ভূমিদাসেরা তখন গভীর ঘুমে ডুবে থাকে।

কেননা এ ইদানীং ফাগুরাম সারাক্ষণই ব্যস্ত। না হয়ে উপায়ই বা কী। চুনাওর তারিখ যত এগিয়ে আসছে ততই বড়ে সরকার বিজুরি এবং গারুদিয়া তালুকের এ গাঁ সে গাঁ করে বেড়াচ্ছেন। প্রায় রোজই কোন না কোন হাটে বা গঞ্জে বা বাজারে মীটিং করছেন। মীটিং হলে ফাগুরামকে হাজির থাকতেই হয়। রঘুনাথ সিংয়ের প্রতিদ্বন্দ্বীদের নামে নিত্য নতুন রকমারি গান বাঁধছে সে আর মীটিংয়ে সেইসব গান গেয়ে আসছে।

সেই কতকাল আগে, বুকে তখনও তার দোষ হয় নি, রাতের পর রাত জেগে নৌটঙ্কীর আসরে গাইত ফাগুরাম। কিন্তু সে সব আসরের সঙ্গে মীটিংয়ের মঞ্চের রাতদিন ফারাক। ছেঁড়া বস্তা কি খড় বিছিয়ে নৌটঙ্কীর আসর বসত, মাথার ওপর জ্বলত টিমটিমে লণ্ঠন। ম্যাড়মেড়ে আলোয় লাখ লাখ মশা আর বারিষের সময় রানীপোকার কামড় খেতে খেতে গান ধরত ফাগুরাম। কিন্তু বড়ে সরকারের মীটিংয়ের ব্যাপারই আলাদা। এখানে থাকে লাল নীল শালু দিয়ে চমৎকার করে সাজানো মঞ্চ। ফাগুরাম গাইবে বলে আলাদা ফরাস বিছিয়ে দেওয়া হয়। গণ্ডা গণ্ডা ডে-লাইট, হ্যাজাক বা বিজলী বাতির ঝকমকানো আলোয় মাইকের সামনে বসে নতুন হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইতে গাইতে নেশা ধরে যায় তার। হোক না চুনাওর গান, হাজার হাজার শ্রোতা যখন শুনতে শুনতে মজা পেয়ে হাসতে থাকে বা তালিয়া বাজার তখন বুকে রক্ত ছলকাতে থাকে ফাগুরামের। নৌটঙ্কীর দল থেকে খারিজ হয়ে যাবার পর তার একসময় মনে হয়েছিল জনমটাই পুরা বরবাদ। সে গাইয়ে, সে নাটুয়া। নাচাগানা তার জীবন থেকে বাদ চলে গেলে রইলটা কী? বড়ে সরকার যে তাকে হারমোনিয়াম দিয়েছেন, সুসজ্জিত মঞ্চে বসে হাজারো শ্রোতার সামনে গাইবার সুযোগ করে দিয়েছেন, এ জন্য সে কৃতজ্ঞ। ফাগুরাম মরে যায় নি। এই বয়সে বুকের দোষ হওয়া সত্ত্বেও তার গলায় যে যাছ রয়েছে, এখনও সে যে হাজার লাখ আদমীকে মাতিয়ে দিতে পারে, সেটা জানতে পেরে নিজের ওপর বিশ্বাস বেড়ে যায়। মনে মনে ফাগুরামের একটা ধারণা হয়েছে, তারই গানের জোরে এবার বড়ে সরকার চুনাওতে জিতে যাবেন। এই ধারণার কারণও রয়েছে। আজকাল যখনই কোথাও মীটিং বসে, তার আগে রঘুনাথ সিংয়ের লোকেরা সাইকেল রিকশা কি বয়েল গাড়িতে ঘুরে ঘুরে জানিয়ে দেয়, বক্তৃতার আগে গারুদিয়া-কোয়েল নৌটঙ্কীবালা ফাগুরাম ‘চুনাওকা গীত’ গাইবে। সে নামী আদমী। কয়েক বছর আগেও নৌটঙ্কীর দৌলতে আশেপাশের পঞ্চাশ কি শও মাইলের মধ্যে সবাই তার নাম জানত। মাঝখানে কিছুদিন নৌটঙ্কীর আসরে না দেখলেও তাকে কেউ বিলকুল ভুলে যায়নি। তার টানেই যে গাঁওবালা দেহাতী মানুষেরা ঝাঁকে ঝাঁকে চুনার মীটিংয়ে হাজির হচ্ছে, ফাগুরাম তা বোঝে।

যেসব দিন মীটিং থাকে না, বড়ে সরকার তাকে হাটে গঞ্জে বা কোন গাঁয়ে পাঠিয়ে দেন। হারমোনিয়াম বাজিয়ে লোক জড়ো করে ফাগুরাম নিজের বাধা গানগুলো গাইতে থাকে। রঘুনাথ সিংয়ের এ-ও এক বড় চাল। চুনাওর লড়াইতে জেতার জন্য অনবরত যে বিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে যেতে হয়, এই কৌশলটা ভালই জানেন তিনি।

রঘুনাথ সিংয়ের উৎসাহ আর চুনাওর মীটিংয়ে শ্রোতাদের অনবরত তালিয়া বাজানো, এই দুটো ব্যাপার এই বয়েসে ফাগুরামকে একেবারে মাতিয়ে দিয়েছে যেন। সারাক্ষণ সে একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। পলকে পলকে তার বুকের ভেতর থেকে স্রোতের মতো তোড়ে নতুন নতুন গান এবং সুর বেরিয়ে আসতে থাকে। সেই সব গান ইদানীং বিজুরি আর গারুদিয়া তালুকের গাঁয়ে-গঞ্জে হাটে-বাজারে ছোটবড় কাচ্চাবাচ্চা বুড়াবুড়ির মুখে মুখে ফেরে।

.

আজ সকালে উঠে মনপত্থল বাজারে চলে গিয়েছিল ফাগুরাম। গারুদিয়া থেকে পাক্কী ধরে ‘কোশভর’ গেলেই বিজুরি তালুকের সীমানা। বিজুরিতে ঢুকে নাক বরাবর খানিকটা গিয়ে বাঁয়ে মাঠে নামলেই কাচ্চী। কাচ্চী দিয়ে রশিভর হাঁটলেই মনপত্থল বাজার। অনেকখানি জায়গা জুড়ে বাজারটা।

ওখানে পৌঁছতে পৌঁছুতে জেঠ মাহিনার রওদ চড়ে গিয়েছিল। এতটা আসার ধকলে এবং রোদের তেজে হাঁপিয়ে গেছে ফাগুরাম। চেনাজানা এক চায়ের দোকানের বাঁশের বেঞ্চিতে বসে খানিকক্ষণ জিরিয়ে নেয় সে।

তাকে দেখে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে দোকানদারটা। খাতির করে নতুন চা-পাত্তি দিয়ে চা বানিয়ে তাকে খাওয়ায়, সঙ্গে নিমকিন বিস্কুট। দাম দিতে গেলে জিভ কেটে কানে হাত দিয়ে দোকানদার বলে, ‘নায় নায়। তোমার মতো বড়া আদমী আমার দুকানে চায় খেতে এসেছ; সেটা আমার সৌভাগ।’

ফাগুরাম জোরজার করে তার হাতে দাম গুঁজে দেয়। বড়ে সরকারের কিরপায় তার পকেট আজকাল দশ বিশ টাকার নোট আর রেজগিতে বোঝাই থাকে। যাই হোক, এ অঞ্চলের তিরিশ বত্রিশটা গাঁও জুড়ে সে এখন সব চাইতে জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত মানুষ। সে যেখানে যায় সেখানেই তার জন্য প্রচুর খাতির, প্রচুর যত্ন।

ফাগুরামকে দেখে একজন দু’জন করে লোক আসতে শুরু করে। ক্রমশ রীতিমত একটা ভিড়ই জমে যায়।

চারদিক থেকে সবাই বলতে থাকে, ‘কা, ফাগ্‌গু ভাইয়া, গানা হবে তো?’

ফাগুরাম হাসে, ‘জরুর। তোমাদের গান শোনাব বলেই তো এসেছি।’

‘মজাদার গানা?’

‘শুনে তোমরাই বলো।’

এমনি কথায় কথায় বেলা বাড়তে থাকে। একসময় হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে উঠে পড়ে ফাগুরাম। তারপর মনপত্থল বাজারের মাঝখানে একটা ঝাঁকড়া-মাথা প্রকাণ্ড কড়াইয়া গাছের তলায় গিয়ে দাড়ায়। তার পেছন পেছন চায়ের দোকানের ভিড়টাও চলে এসেছে। শুধু তাই না, বাজারের নানা দিক থেকে আরো মানুষজন দৌড়ে আসতে থাকে।

ঘুরে ফিরে, নেচে নেচে, সরু সরু আঙুলে অনেকক্ষণ হারমোনিয়াম বাজায় ফাগুরাম। আসরটা তৈরি হয়ে গেলে সে বলে, ‘শুন ভাইয়ালোগ, পয়লা সুখন রবিদাস পর যো গানা বনায়া ও গাতা হ্যায়’ বলেই সুর ধরে:

ইয়ে কলযুগিয়া
রাজ ভাইয়া
ইয়ে কলযুগিয়া রাজ।
ভোট লড়ানকো সুখন আয়া
চোর চামার বাটমার ভাইয়া
চোর চামার বাটমার।
তাড়ি-দারু চোরচামারি ভোটনকে হাতিয়ার।
সুখনকো ঘর ছৌরি নাচে
মহিমা অপরাম পার ভাইয়া
মহিমা অপরাম—

সুখন রবিদাস সম্পর্কে গানে গানে যে কথাগুলো ফাগুরাম বলতে থাকে তার কোনটাই সত্যি না। কিন্তু মানুষ যেমনই হোক—গরীব-ভুখা, পয়সাওলা-অভাবী, জমিদার-ক্ষেতমজুর—অন্যের কুৎসা বা কেচ্ছা শুনতে ভালবাসে। ফাগুরামের মনপসন্দ মজাদার গান শুনতে শুনতে তারা হেসে হেসে ঢলে পড়তে থাকে।

সুখনকে নিয়ে বাঁধা গানটা শেষ করেই আবু মালেককে নিয়ে পড়ে ফাগুরাম।

গলি গলি শোর হ্যায়
আবুল মালেক চোর হ্যায়
রঘুনাথ সিংকো ভোট দো
আবুল মালেককো ফোঁক দো—

এইভাবে, এক এক করে রঘুনাথ সিংয়ের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সবার সম্পর্কেই পর পর গেয়ে যেতে থাকে ফাগুরাম। গান শেষ হতে হতে সূরয খাড়া মাথার ওপর উঠে আসে।

চারপাশে মনপত্থল বাজারের যে মানুষজন ভিড় করে আছে তারা বলাবলি করতে থাকে, ‘শুনা হ্যায় তো, ফাগুরাম নৌটঙ্কীবালা গানামে কা বোলা! সব কোঈ চোর-চোট্টা-বদমাস। সিরেফ রঘুনাথ সিং বাদ! চোর-চোট্টাদের বোট দিয়ে ফায়দা নেই।’

যে উদ্দেশ্যে এই সব মজার গান বাঁধানো বা গাওয়ানো তা রীতিমত সফল। মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখে তার আঁচ পাওয়া যায়। ফাগুরাম আর দাঁড়ায় না। ভিড় ঠেলে বাইরে এসে একটা সাইকেল রিকশায় ওঠে। আজ সে গারুদিয়ায় ফিরে সোজা দোসাদটোলায় চলে যাবে। বড়ে সরকারের চুনাওর গান যেদিন থেকে সে গাইতে শুরু করেছে সেদিন থেকে দুপুরে আর ঘরে ফেরা হয় না। হাটে বাজারে কি গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরতে ঘুরতে চায়-রোটি বা চায়-বিস্কুট বা ভাতের দুকানে গিয়ে ভাল-ভাত-সবজি আর শিকার খেয়ে নেয়। আজ দোসাদটোলায় গিয়ে নিজের হাতে রসুই চড়িয়ে দেবে। বয়েস তো কম হয়নি গানের নেশায় যতই বুদ হয়ে থাক, কিছুদিন ধরে অনবরত ঘোরাঘুরির ফলে শরীরে আর দিচ্ছে না। আজ খাওয়া-দাওয়ার পর সন্ধ্যে পর্যন্ত টানা ঘুম লাগাবে ফাগুরাম।

সাইকেল রিকশাটা মনপত্থল বাজার পেছনে ফেলে কাঁচা রাস্তা ধরে হাইওয়ের দিকে যখন সিকি রশির মতো এগিয়ে গেছে সেই সময় পেছন থেকে চিৎকার শোনা যায়, ‘সাইকেল রিকশ রুখ যা, রুখ যা—’

রিকশাওলা গাড়ি থামিয়ে দেয়। অবাক হয়েই ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকায় ফাগুরাম। পাঁচ ছ’টা গাট্টাগোট্টা চেহারার—পহেলবান য্যায়সা, চৌগাফাওলা লোক, হাতে পেতলের গুল বসানে লাঠি—হাঁই হাঁই করতে করতে ঝড় তুলে কাছে এসে পড়ে।

ফাগুরাম শুধোয়, ‘কা বাত?’

লোকগুলো অচেনা। পাথরের মতো শক্ত মুখ তাদের। ছোট ছোট গোল চোখ থেকে আগুন ঠিকরোচ্ছে যেন।

একজন বলে, ‘মরণে মাংতা চুহা কাঁহিকা—’

লোকগুলোর চেহারা, চাউনি এবং রকমসকম দেখে ভীষণ ঘাবড়ে যায় ফাগুরাম। সে হাসতে চেষ্টা করে, ‘কা হুয়া ভাইয়ালোগ?

‘কা হুয়া!’ সেই লোকটা লাঠি ঠুকে গর্জে ওঠে, ‘শালে গারুদিয়া কোয়েল হয়েছে! অ্যায়সা মারেগা, বিলকুল কৌয়া বন যাওগে।’

ফাগুরাম বলে, ‘ভাইয়া, হামনিকো কা কসুর? থোড়াকুছ সমঝা তো দো—’

‘এতক্ষণ মনপত্থল বাজারে হারমুনিয়া বাজিয়ে বড়ে বড়ে আদমীদের নামে কী বলে এলি? সব কোই চোর, চামার, বাটমার, ঘড়িয়াল-নায়?’

এবার চমকে ওঠে ফাগুরাম। তার গানগুলো তো গঙ্গাপানিতে ধোয়া নির্দোষ ব্যাপার না। রঘুনাথ সিংয়ের বিপক্ষে যারা চুনাওতে নেমেছে তাদের সবাইকে এইসব গানে হুল ফোটানো হয়েছে। বোঝা যায় এই হট্টাকাট্টা ডাকুমার্কা চেহারার লোকগুলো তাতে ক্ষেপে গেছে। ঢোক গিলে ফাগুরাম ফিকে মতো হাসে, ‘ও তো গানা ভাইয়া।’

‘গানা?’

‘মতলব তামাসা।’

‘ফির অ্যায়সা তামাসা করলে গলেকা নালিয়া ফেঁড়ে ফেলব। সমঝা?’

‘সমঝ গিয়া ভাইয়া, সমঝ গিয়া।’

‘যা ভাগ। লেকেন হোঁশিয়ার। ‘

‘হুঁ হুঁ, হোশিয়ার জরুর থাকব।’

সামনে থেকে সরে গিয়ে রাস্তা সাফ করে দেয় লোকগুলো সাইকেল রিকশা ফের চলতে শুরু করে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঠো রাস্তা থেকে পাক্বীতে এসে ওঠে।

জষ্টির গনগনে লু-বাতাস চিরে বিজুরি তালুকের দিকে যেতে যেতে আগাগোড়া গোটা ব্যাপারটা তলিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে ফাগুরাম। মজাদার তামাসার গান শুনে ঐ লোকগুলো এত ক্ষেপে গেল কেন? গানের মধ্যে অবশ্যই রঘুনাথ সিংয়ের বিরুদ্ধে যারা চুনাওতে নামছে তাদের সবাইকে খোঁচা দেওয়া হয়েছে। তবে কি তাদেরই কেউ মনপত্থল বাজারের ডাকু-য্যায়সা লোকগুলোকে তার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছে? কে লেলাতে পারে? নেকীরাম শর্মা, আবুল মালেক, প্রতিভা সহায় না সুখন রবিদাস?

আচমকা গণেরির হুঁশিয়ারি মনে পড়ে যায় ফাগুরামের। সে বলেছিল, বড়ে সরকারের বিপক্ষের লোকেরাও ঐরু-গৈরু-ভৈরু বা নাত্থুর দল না। তাদেরও পয়সা আছে, জনবল আছে। বহুদর্শী গণেরি ঠিকই বলেছে দেখা যাচ্ছে।

ফাগুরাম ঠিক করে ফেলে, এখন আর দোসাদটোলায় গিয়ে রসুই চড়াবে না; সিধা গারুদিয়ায় ফিরে রঘুনাথ সিংয়ের হাভেলিতে চলে যাবে। বড়ে সরকারকে খবরটা জানানো অত্যন্ত জরুরী। সে রীতিমত ভয় পেয়ে গেছে।

.

রঘুনাথ সিংকে তাঁর বাড়িতেই পাওয়া যায়। চুনাওর জন্য বিরাট কমপাউণ্ডের ভেতর তেরপল খাটিয়ে তিন চারটে ক্যাম্প বসানো হয়েছে। তাঁকে নির্বাচনে তরিয়ে দিতে যে সব ছোকরা হাটে-বাজারে আর গাঁয়ে গায়ে ঘুরে ‘রঘুনাথ সিংকো বোট দো, বোট দো—’ করে গলায় খুন তোলে, দুপুরে ফিরে তারা ওখানে খায়, জিরোয়, খবরের কাগজে ইস্তাহার লেখে, ভোটারদের লিস্টি ঠিক করে। চুনাও তো কথার কথা না, একসঙ্গে হাজারটা তোহারের মতো ব্যাপার।

এই মুহূর্ত চুনাও কর্মীরা কাতার দিয়ে খেতে বসে গেছে। বড়ে সরকার নিজে সামনে দাড়িয়ে খাওয়া তদারক করছেন। ফাগুরাম দৌড়তে দৌড়তে তাঁর কাছে চলে আসে।

অনেকটা রাস্তা গনগনে রোদের ভেতর দিয়ে এসেছে ফাগুরাম। তার গায়ের চামড়া ঝলসে গেছে যেন। তা ছাড়া ভেতরে ভেতরে যে উত্তেজনা এবং ভয়ের ব্যাপারটা চলছিল, মুখেচোখে সেটা ফুটে উঠেছে।

এক পলক ফাগুরামের দিকে তাকিয়ে রঘুনাথ সিং শুধোন, ‘কী রে, কোত্থেকে এলি?’

শ্বাস টেনে ফাগুরাম বলে, ‘মনপত্থল বাজার হুজৌর। চুনাওর গানা গাইতে গিয়েছিলাম।’

‘গানা কেমন হল?’

‘আপকি কিরপায় বহোত আচ্ছা। লেকেন—’

‘লেকেন কী?’

‘একটা বুরা খবর আছে।’

ভাল করে ফাগুরামকে লক্ষ্য করতে করতে রঘুনাথ সিং বলেন, কী বুরা খবর?’

এক নিঃশ্বাসে সেই লোকগুলোর শাসানির কথা জানায় ফাগুরাম। শুনতে শুনতে চোয়াল পাথরের মতো শক্ত হয়ে ওঠে রঘুনাথ সিংয়ের।

চোখের তারা থেকে আগুন ঠিকরোতে থাকে।

তিনি বলেন, ‘জানবরের বাচ্চাগুলো কারা? নাম বল? কোন গাঁওয়ের আদমী?’

ফাগুরাম বলে, ‘জানি না হুজৌর।’

‘আগে আর কখনও দেখেছিস?’

‘নেহী সরকার।’

চোখ কুঁচকে একটু চিন্তা করেন রঘুনাথ সিং। তারপর আস্তে করে বলেন, ‘এর একটা ব্যবস্থা করা দরকার। বলেই চুনাওর যে কর্মীরা খেতে বসেছে তাদের দিকে ঘাড় ফেরান, ‘মহেশ্বর, রামরতন, মুকলাল, বজরঙ্গী—তোমাদের চারজনকে এখনই একবার মনপত্থল বাজারে যেতে হবে। সেখান থেকে সিধা মিশিরলালজীর সাথ গিয়ে দেখা করবে।’

রঘুনাথ সিংয়ের মুখ থেকে কথা খসার সঙ্গে সঙ্গে খাওয়া ফেলে চারজন তৎক্ষণাৎ উঠে পড়ে। হাত নেড়ে তাদের ফের বসিয়ে দেন রঘুনাথ। বলেন, ‘আগে খেয়ে নাও। খেতে খেতে শোন, ওখানে গিয়ে কী করতে হবে।’

ফাগুরামের বর্ণনা অনুযায়ী চার হট্টাকাট্টা ডাকুমার্কা হারামজাদের কথা বলে রঘুনাথ নির্দেশ দেন, মনপত্থল বাজারে গিয়ে তাদের পাত্তা লাগাতে হবে। যদি তাঁদের খোঁজ পাওয়া যায় ভালই। পাওয়া যাক বা নাই যাক, সোজা বিজুরিতে নিয়ে মিশিরলালজীর সাঙ্গে দেখা করতে হবে। কেননা ঐ এলাকাটা তাঁরই। মিশিরলালঙ্গীকে জানাতে হবে, তাঁরই খাস তালুকে বড়ে সরকারের চুনাও কর্মী ফাগুরামকে শাসানো হয়েছে। তিনি যেন এর বিহিত করেন।

নাকেমুখে তুরন্ত ভাত-চাপাটি ডাল-সবজি গুঁজে রঘুনাথ সিংয়ের চার চুনাও কর্মী জীপ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। যতক্ষণ না বিকেল হয় আর ওরা মনপত্থল এবং বিজুরি থেকে ফিরে আসে ততক্ষণ বড়ে সরকার ফাগুরামকে আটকে রাখেন।

বিকেলে ওরা জীপ থেকে নামতেই রঘুনাথ সিং জিজ্ঞেস করেন, ‘হারামজাদ কুত্তাকা ছৌয়াগুলোর পাত্তা মিলল?’

‘নায়—’ চুনাও কর্মীরা একসঙ্গে মাথা নাড়ে।

‘মনপত্থল বাজারে ভাল করে খোঁজ নিয়েছিলে?’

‘জী। সবাইকে পুছেছি, লেকেন কেউ কিছু বলতে পারল না।’

কপালে ভাঁজ পড়তে থাকে রঘুনাথ সিংয়ের। ভুরু কুঁচকে তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছে, বাইরে থেকে কেউ গুণ্ডা আনিয়েছে।’

চার চুনাও কর্মী চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

রঘুনাথ সিং এবার জিজ্ঞেস করেন, ‘বিজুরিতে গিয়েছিলে?’

‘জী।’

‘মিশিরলালজীর সাথ দেখা হল?’

‘হয়েছে।’

‘তাঁকে সব জানিয়েছ?’

‘জী।’

‘কী বললেন মিশিরলালজী?’

‘আমাদের মুখে শুনে তখনই বদমাসগুলোকে তালাশ করতে লোক পাঠালেন। একবার ধরতে পারলে ওদের হাড্ডি থেকে মাংস সিরেফ আলাগ করে ফেলবেন। আপনাকে জানাতে বলেছেন, বিজুরিতে ঐ হারামীরা আর যাতে ঝামেলা বাধাতে না পারে সেদিকে তাঁর পুরা নজর থাকবে।’

রঘুনাথ সিং বেজায় সন্তুষ্ট। মিশিরলালজী সেদিন কথার কথাই শুধু বলেন নি; এই চুনাওতে সবরকমভাবে তাঁকে সাহায্য করতেও তিনি প্রস্তুত। বোঝা যাচ্ছে, তাঁর ‘বচনে’র দাম আছে।

রঘুনাথ সিং তাঁর চুনাও কর্মীদের বলেন, ‘ঠিক হ্যায়। তোমরা এখন জিরিয়ে নাও।’ কাল সজ্জনপুরার হাটিয়ায় আমাদের চুনাওর মীটিং আছে না?’

‘জী—’

‘সব বন্দোবস্ত হয়ে গেছে?’

‘জী।’

‘যাও—’

চুনাও কর্মীরা তেরপলের ছাউনির তলায় একটা ক্যাম্পে ঢুকে পড়ে। রঘুনাথ সিং এবার ফাগুরামের দিকে ফেরেন, ‘যা, তুইও তোদের মহল্লায় চলে যা। মনে রাখিস, কাল সজ্জনপুরায় মীটিং আছে।’ বলে সামনের দিকে দু’পা বাড়িয়ে কী ভেবে ঘাড় ফেরান।

কী আশ্চর্য, ফাগুরামের যাবার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না; চোখেমুখে খানিকটা উদ্বেগ নিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে।

রঘুনাথ সিং বলেন, ‘কী রে, ঘরে গেলি না; কিছু বলবি?’

ভয়ে ভয়ে ফাগুরাম বলে, ‘হুঁ হুজৌর।’

‘কী?’

‘বহোত ডর লাগতা—’

‘কেন?’

‘ওহী আদমীলোগন গলার নালিয়া ফেঁড়ে দেবে বলেছে।’ ফাগুরামের পিঠে সস্নেহে চাপড় মারতে মারতে রঘুনাথ সিং বলেন, ‘ডরের কিছু নেই। আমি তো আছি। যা এখন’

রঘুনাথ সিং ভরসা দেন বটে, তবু যেন পুরোপুরি জোর পায় না ফাগুরাম। কিন্তু এখন আর ফেরার রাস্তা নেই। চুনাওর গান বন্ধ করলে বড়ে সরকার গুসসা হবেন। আবার এই গান চালিয়ে গেলে তাঁর বিরুদ্ধ পক্ষের লোকেরা গুসসা হবে। রঘুনাথ সিংকে আজন্ম চেনে সে। খাতির করে তাকে ডাকিয়ে নিয়ে নয়া কাপড়া, নয়া হারমুনিয়া, টাকা পয়সা সবই দিয়েছেন বড়ে সরকার। মরুক বাঁচুক, তাঁর জন্য চুনাওর গান গেয়ে যেতেই হবে ফাগুরামকে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *