দুই
হাইওয়েটা যেখানে গিয়ে বাক নিয়ে ডাইনে ঘুরেছে, সেখান থেকে খানিকটা গেলে একটা ধুলোবোঝাই মেটে রাস্তা পড়ে। এত ধুলো যে পায়ের গোছ অব্দি ডুবে যায়। রাস্তাটা বড় সড়কের গা থেকে বেরিয়ে বা দিকে চলে গেছে। এই রাস্তায় প্রথমে পড়ে রঘুনাথ সিংয়ের খামার বাড়ি। ঢেউ-টিনের চাল আর দশ ইঞ্চি ইটের দেওয়াল দেওয়া পঁচিশ-তিরিশটা বিরাট মাপের লম্বা লম্বা টানা ঘর পর পর দাঁড়িয়ে আছে। দেখেই টের পাওয়া যায়, এই ঘরগুলো নানারকম শস্যে বা ফসলের বীজে সারা বছর বোঝাই হয়ে থাকে। আগের বছরের ধান, গেঁহু, জনার, মকাই, ভিল, মুগ, মসুর, তিসি, সর্ষে, মাড়োয়া ইত্যাদি বিক্রি হয়ে যাবার পর নতুন বছরের ফসল তুলে গোলাঘরগুলো ভর্তি করে রাখা হয়।
ঘরগুলোর সামনের দিকে পনের-কুড়ি বিঘে জায়গা নিকিয়ে পরিষ্কার তকতকে করে রাখা হয়েছে। ওখানে ফসল শুকিয়ে ঝাড়াই বাছাই করা হয়। তারপর গোলায় তোলার পালা।
তকতকে জায়গাটার এক ধারে অনেকগুলো টিনের চালা। ঐ চালাগুলোর তলায় রঘুনাথ সিংয়ের শ-খানেক লাঙল-টানা বয়েল আর শ-খানেক গাড়ি-টানা মোষ থাকে। এতগুলো পশুর তদারকির জন্য রয়েছে বিশ-পঁচিশটা লোক। পশুগুলোকে দানাপানি দেওয়া, চান করানো, বোখার হলে দশ মাইল দূরের শহর থেকে ভিটিনারি (ভেটারিনারি) ডাগদর ডেকে এনে দাওয়াই কি সুই ফোটানো—যাবতীয় কাজই তাদের করতে হয়। এ বাবদে রঘুনাথ সিংয়ের কাছ থেকে পেটের খোরাকি আর সারা বছরের জন্য খানতিনেক করে মোটা সুতোর জামাকাপড় ছাড়া আর কিছুই পায় না ওরা। ধর্মাদের মতো ওরাও পুরুষানুক্রমে বেগার দিয়ে চলেছে।
গরু-মোষের চালাগুলোর গায়ে হাল-লাঙল আর গাড়ি রাখার জায়গা। ওখানে উঁচু উঁচু চালা বানানো হয়েছে।
খামারবাড়ির গায়ে কতকগুলো নীচু নীচু মাটির ঘর! ঘরগুলো এখন খালি পড়ে আছে। চাষের কাজের জন্য বছরে মাস তিনেকের জন্য যে মরসুমী ফুরণের কিষাণদের নিয়ে আসা হয়, এ-বছর তার এখনও আসেনি। ওরা এলে ওই ঘরগুলোতে থাকে।
ধর্মারা খামারবাড়িতে এসে দেখল অন্য দিনের মতো একেবারে সামনের ঘরটার দাওয়ায় পুরু গদির ওপর বসে আছে হিমগিরি নন্দন ঝা। রঘুনাথ সিংয়ের এই খামারটার পুরো দায়িত্ব তার ওপর। আর এই বারান্দাটা হলো তার সেরেস্তা। মর্যাদা বাড়াবার জন্য সে নিজে আংরেজি করে বলে কানটোল রুম (কনট্রোল রুম)। সকাল ছ’টা থেকে রাতের সিকি ভাগ পর্যন্ত এখানে বসে বসেই কিষাণ খাটানো, জমি চষার সময় হাল-বয়েল দেওয়া, সন্ধোয় তাদের খোরাকি মেপে দেওয়া, ফসল রোয়ার দিনে কিষাণদের ভাগে ভাগে বীজ বেঁটে দেওয়া থেকে কোন গোলায় কী জাতের ফসল থাকবে তার হেফাজত করা পর্যন্ত সব দিকে হিমগিরিনন্দনের কড়া নজর। এমনিতে আর সব মানুষের মতো তার এক জোড়াই চোখ। কিন্তু আদতে হিমগিরির চোখ হলো হাজার খানেক। দুটো ছাড়া বাকী সবই অদৃশ্য। তার চোখে ধুলো ছিটিয়ে কারো ফাঁকি দেবার উপায় নেই।
.
এই মুহূর্তে গদিতে বসে ধীর চালে অনবরত পা নাচিয়ে চলেছে হিমগিরি। এই পা নাচানোটা তার অনেককালের আদত। তার সামনে রয়েছে একটা উঁচু কাঠের ডেস্ক।
লোকটার বয়েস বাহান্ন-তিপান্ন।গোলগাল চেহারা ভারী ঘুমন্ত নাক, মোটা ভুরুর তলায় ঢুলু-ঢুলু চোখ। বাইরে থেকে ঢুলু-ঢুলু দেখলে কী হবে, এমন সজাগ তীক্ষ্ণ চোখ ভূ-ভারতে কারো নেই। মাথার কাঁচা-পাকা চুল প্রায় চামড়া ঘেঁষে ছাঁটা, পেছন দিকে এক গোছা লম্বা টিকির মাথায় ফুল বাঁধা। কপালে চন্দনের ছাপে দেবনাগরী হরফে লেখা ‘জয় রাম, জয় রাম, জয় কিষুণ, জয় কিষুণ।’ পরনে মোটা সুতোর পাড়হীন ধুতি আর কুর্তা।
মৈথিলী ব্রাহ্মণ এই লোকটার চামড়া খুবই মিহি, মসৃণ আর তেলতেলে। গারুদিয়া তালুকের মানুষেরা বলে, ‘ওর গা বেয়ে মাখন’ গড়িয়ে পড়ে। লোকেরা আরো বলে, ‘এই ঝা লোকটা হলো লাকড়া (নেকড়ে)। বড়ে সরকার রঘুনাথ সিং-এর অনেকগুলো পোষা জন্তু রয়েছে। তাদের মধ্যে একটা লাকড়া, একটা সিয়ার (শিয়াল)। একজন হিমগিরিনন্দন ঝা, আরেকজন মুনশী আজীবচাঁদ।’
পা নাচাতে নাচাতে ধর্মাদের দিকে তাকাল হিমগিরি। বলল, ‘এখনও তো সূরুয পুরা ডোবে নি, এর ভেতরেই কাম হয়ে গেল! হারামজাদাগুলো বহোত ফাঁকি দিচ্ছিস।’ লোকটার গলার স্বর যেমন সরু তেমনি চড়া, কানের পর্দায় ছুঁচের মতো বিঁধে যায়। ঐ রকম মোটা ভারী তেল চুকচুকে শরীরের ভেতর থেকে কী করে যে এমন স্বর বেরোয় সেটাই একটা আশ্চর্যের ব্যাপার।
.
ধর্মারা কেউ কিছু বলল না। জ্যৈষ্ঠ মাসের জ্বলন্ত আকাশের তলায় সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত জমি চষার পরও বছরের পর বছর, আবহমান কাল ভরা ফাঁকি দেবার কথাই শুনে আসছে। কিন্তু হিমগিরিনন্দনের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রতিবাদ করার সাহস কারো নেই।
হিমগিরি ফের বলল, ‘আজ যা করার করেছিস, কাল সূরুয ডোবার আগে জমিন থেকে হাল-বয়েল তুলে ফেললে খোরাকি কাটা যাবে। কানমে বাতঠো ঘুষল হো (কানে কথাটা ঢুকল)?
সবাই ঘাড় কাত করে জানালো—ঘুষেছে।
‘যা, আভি হাল ঔর বয়েলিয়া জমা কর—’ বলেই ডেস্কের তলা থেকে পেটমোটা একটা দুধের বোতল বার করে গলায় উপুড় করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে বগ বগ করে শব্দ উঠতে লাগল।
ধর্মারা জানে ঐ ডেস্কের তলায় দশ বারোটা দুধের বোতল সাজানো আছে। খাঁটি মোষের দুধ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খানিকক্ষণ পর পর দুধ খেয়ে যায় হিমগিরি। একেবারে বেড়ালের ধাত। বোতল বোতল স্নেহজাতীয় বস্তু গলা দিয়ে শরীরে ঢোকার ফলেই তার চামড়া এত মিহি, এত মোলায়েম আর জেল্লাদার।
বোতল শেষ করে একটা পেতলের ডিব্বা বার করে এক খিলি পান মুখে পুরল হিমগিরি। যতবার দুধ ততবার পান।
হিমগিরি যখন পান চিবুচ্ছে তখন ধর্মারা ওধারের বয়েল আর মোফ রাখার চালায় গিয়ে পশুগুলোকে জমা দিয়ে পাশের চালায় হাল-লাঙল রেখে এল। গরু মোষ এবং লাঙল-টাঙল বুঝে নেবার জন্য চালাগুলোতে অন্য লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। একটু এদিক ওদিক হলে তারা চেঁচিয়ে হিমগিরিকে জানিয়ে দেবে।
ধর্মা আর দেরি করল না। কোয়েলের খাতে সেই সাবুই ঘাসের জঙ্গলে কুশী দাঁড়িয়ে আছে। সে তার বয়েল দুটো আর লাঙল নিয়ে ওধারের চালাগুলোর দিকে এগিয়ে যায়।
সামনের চালাটায় বাজেপোড়া তালগাছের মতো চেহারার আধ-বুড়ো রামধনিয়া ক্ষুদে ক্ষুদে গোল চোখে এদিকে তাকিয়ে আছে। লোকটার হাত-পায়ের শিরাগুলো দড়ির মতো জট পাকানো। অস্বাভাবিক ঢ্যাঙা আর আখাম্বা সে। সকালে এর কাছ থেকেই হাল-বয়েল নিয়ে গিয়েছিল ধর্মা। এগিয়ে গিয়ে সে বলে, ‘এ লে, তুহারকা বয়েলিয়া আউর—’
রামধনিয়া লাঙলটা নিয়ে চালার একধারে খাড়া করে রাখে তারপর তীক্ষ্ণ চোখে বয়েল দুটোকে দেখতে থাকে। একটা বয়েলের আগাপাশতলা দেখা হয়ে যাবার পর একটা ছোকরাকে ডেকে পশুটাকে রাতের খাদ্য কিছু জাবনা দিতে বলে। তারপর দ্বিতীয় পশুটাকে লক্ষ্য করতে করতে আচমকা সেটার নাকে লম্বা কাটা দাগ দেখতে পায়। সঙ্গে সঙ্গে শ্লেষ্মা-জড়ানো চেরা গলায় চেঁচায়, ‘বয়েলিয়াকা নাক পর ক্যায়সা চোট হুয়া রে?
কেমন করে বয়েলটার নাকে চোট লাগল, ধর্মা জানে না। খুব সম্ভব লাঙল টানার সময় জমির কাঁটাগাছ খেতে গিয়ে বা শক্ত শেকড়-টেকড়ে লেগে কেটে থাকবে। কিন্তু সকালে সম্পুর্ণ সুস্থ অক্ষত একটি জন্তু দিয়ে সন্ধ্যেয় চোটলাগা অবস্থায় তাকে সহজে ফেরত নিতে চাইবে না রামধনিয়া। তাদের মতোই অচ্ছুৎ এই লোকটা এবং পেটভাতার ক্রীতদাস। তবু পুরুষানুক্রমে বড়ে সরকারের নৌকরগিরি করে করে তার আদতটাই খারাপ হয়ে গেছে। রঘুনাথ সিংয়ের জমিজমা, অচেতন এবং জীবন্ত তাবত সম্পত্তি সে প্রাণ দিয়ে রক্ষা করে। সবই অভ্যাস। রক্তের মধ্যে প্রবাহিত বহু জমানার প্রাচীন সংস্কার।
এখনই রামধনিয়া বয়েলের নাকের আঁচড় নিয়ে গলার স্বর সাত পর্দা চড়িয়ে চিৎকার জুড়ে দেবে। সঙ্গে সঙ্গে হিমগিরিনন্দন চেঁচামেচির কারণটা জেনে যাবে। তার ফলাফল কী হতে পারে ভাবতেই গল গল করে ঘামতে শুরু করল ধর্মা। কাঁপা ভীত গলায় সে বলে, ‘মালুম নায় রামধনিয়া ভাই—’
রামজীকা অসীম কিরপা, রামধনিয়া আজ কেন যেন চেঁচায় না। শুধু বলে, ‘বহোত হোঁশিয়ার রহনা ধম্মা! মনে রাখিস তোর চাইতে এই জানবরের দাম অনেক বেশি। তুই মরলে কুছু হবে না। মগর এই বয়েলটার কুছু হলে বড়ে সরকারের পান শো (পাঁচশ), হাজার রুপাইয়া বরবাদ।’
ধর্মা মাথা নাড়ে, মনে রাখবে। তারপর রামজীর পায়ে মনে মনে দশবার মাথা ঠেকিয়ে ভাবে, একটা ফাঁড়া কাটল। সে আর দাঁড়ায় না, রামধনিয়ার কাছ থেকে সরে আসে। ওদিকে বয়েলটা রামধনিয়ার হাত থেকে সেই ছোকরার জিম্মায় চলে যায় এবং জন্তুটা তার রাতের বরাদ্দ কুচনো খড়, খোল এবং ভেলিগুড়ের মিশ্রিত মণ্ড পেয়ে যায়।
ধর্মার পর অন্য সবাই বয়েল লাঙল জমা দিতে থাকে।
ৰয়েলটয়েল বুঝিয়ে ধর্মারা যখন চলে যাবে সেই সময় হিমগিরি তদের ডাকল, ‘শোন্—’
ধর্মারা কাছে এগিয়ে এলে হিমগিরির ঘুমন্ত ঢুলুঢুলু চোখ একেবারে বদলে গেল। চরকির মতো চোখ দুটো গণেরি, বুধেরি, ধর্মা থেকে শুরু করে সবগুলো মেয়ের মুখের ওপর দিয়ে ঘুরতে লাগল। খানিকক্ষণ দেখার পর ভুরু কুঁচকে বলল, ‘সবাইকে তো দেখছি, ওহী ছোকরিয়া কঁহা গৈল?’
গণেরি জিজ্ঞেস করল, ‘কৌন?’
‘কুশী।’
গুণেরি উত্তর দেবার আগে ধর্মা বলল, ‘কুশী আয়ী নহী। ক্ষেতিসে চলি গয়ী।’
তীক্ষ্ণ সরু গলায় হিমগিরি চেঁচিয়ে উঠল, ‘ঝুট। ছোকরিয়া কামমে নহী আয়ী। এক রোজ আদমী নহী ভেজা তো ব্যস কাম চৌপট। পেটের দানা এ্যায়সা এ্যায়সা মেলে!’
অন্য দিন সকাল থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দশবার করে জমিতে লোক পাঠায় হিমগিরি। নিজেও কখনও কখনও গিয়ে হানা দেয়। উদ্দেশ্য, কাজ ঠিকমত হচ্ছে কিনা, সেটা লক্ষ্য রাখা। আজ ইচ্ছে করেই লোক পাঠায় নি হিমগিরি। মাঝে মাঝে একটু ঢিলে দিয়ে সে দেখতে চায় কেউ ফাঁকি দিচ্ছে কি না।
ধর্মা বলল, ‘আয়ী সরকার। হামনিকো সাথ থী। পুরা রোজ কাম কিয়া থী।’
‘ঝুট, পুরী ঝুট। শুনা হ্যায় উয়ো ছোকরিয়াকো সাথ তুহারকো পেয়ার চালু হো গ্যয়া। উসকী বাঁচানেকো বাহানা। ছোকরির এক রোজের খোরাকি আমি কাটব।’
‘নায় নায় দেওতা, এ্যায়সা নায় করনা। উ আয়ী আ নহী আয়ী, সব কোইকো পুছো-এ গণেরি চাচা, এ বুধেরি চাচা, এ ঢোড়াইয়া, এ এতোয়ারী, এ শনচারী বোল্ তু লোগ, বোল্ না—সবার দিকে ঘুরে ঘুরে কাকুতি মিনতি করতে লাগল ধর্মা। সারাদিন ঝলসানো রোদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করেছে কুশী। তবু একটা ঝুটা অজুহাত তুলে তার খোরাকি কাটতে চাইছে এই মৈথিলী বামহনটা। কিন্তু কিছুতেই তা হতে দেবে না ধর্মা।
গণেরিরা এবার বলে উঠল, ‘হুঁ দেওতা, কুশী পুরী রোজ ক্ষেতিমে থী। আভি গৈল—ভগোয়ান রামজী কসম।’
হিমগিরি বলল, ‘ঠিক আছে, আজকের দিনটা ছেড়ে দিলাম। লেকিন এক বাত, কাল থেকে সুবে সবাইকে এখানে আসতে হবে, আবার সামকো কাম পুরা হবার পরও সবাই আসবি। কানমে ঘুষল?’
অর্থাৎ সত্যি সত্যি ধর্মারা হাজিরা দিচ্ছে কিনা সেটাই এভাবে দেখতে চায় হিমগিরি। সবাই মাথা কাত করে জানালো কাল থেকে তারা দু’বারই এখানে আসবে।
একটু চুপচাপ। সবাইকে দেখতে দেখতে শনিচারীর ওপর নজর আটকে গেল হিমগিরির। জাবর কাটার মতো চাকুম চুকুম করে পান চিবিয়েই যাচ্ছিল সে। শনিচারীকে দেখতে দেখতে তার ভুরু কুঁচকে যেতে লাগল। মেয়েটার পেটে পাঁচ-ছ মাসের বাচ্চা রয়েছে।
শনিচারী লজ্জায় মুখ তুলতে পারছিল না, একেবারে কুঁকড়ে জড়সড় হয়ে ঘাড় নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে ছিল।
বেশ খানিকটা সময় শনিচারীকে দেখার পর হিমগিরি গলার স্বর ঈষৎ চড়িয়ে বলে ওঠে, ‘হারামজাদী কুত্তী—’
সবাই চুপ করে থাকে।
হিমগিরি আবার বলে, ‘দো সাল আগে না একটা বাচ্চা হয়েছে তোর?’
শনিচারী উত্তর দেয় না। জগতের সবটুকু সঙ্কোচ সারা গায়ে মেখে নতচোখে দাঁড়িয়েই থাকে।
এদিকে হিমগিরি হঠাৎ ক্ষেপে উঠল যেন, ‘মুহু সে বাত নিকালতে নহী! বহোত শরমবালী; হাঁ কি নায়—বোল, বোল–’
শনিচারী সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে একবার চোখ তুলেই নামিয়ে নিল, ‘জী দেওতা—’
‘এখন তো বড়ী শরম। লেকেন মরদের সিনার ওপর সিনা চড়িয়ে না শুলে নিদ আসে না—ক্যা?’
শনিচারী চুপ।
অশ্রাব্য একটা খিস্তি দিয়ে হিমগিরি এবার বলে, ‘হর সাল বাচ্চা পয়দা করবি। বাচ্চার বাহানা করে দো মাহিনা করে কামে ফাঁকি মারবি-এ নহী চলেগি! নায় কাম তো নায় খোরাকি। কানমে ঘুষল?’
‘কানমে ঘুষল’ শব্দ দুটো হিমগিরির কথার মাত্রা। শনিচারীরা ঘাড় কাত করে জানায় কানে ঢুকেছে।
সোমবারী, গাংনী, কুঁদরী—এমনি জনকয়েক সাদী-হওয়া যুবতী মেয়ে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে ছিল। একটা চোখ ছোট করে এবার তাদের দিকে তাকায় হিমগিরি; সরু চাপা গলায় বলে, ‘তোদের মতলব কী রে জোয়ানী মুরগীরা?’
কেউ উত্তর দিল না।
হিমগিরি বলে, ‘একটা বাত মনে রাখিস। আপনা আপনা মরদদের সাথ জেয়াদা মজা লুটবি না। হর সাল মুরগীর মত যদি আণ্ডা পাড়িস আর ক্ষেতির কাম বন্ধ হয়ে যায় লাথ মারকে মারকে একেক জনের পাছার হাড্ডি তুড়ে দেব। কানমে ঘুষল?’ বলেই বোতল বার করে গলায় বগ বগ শব্দ তুলে আবার খানিকটা ভয়সা দুধ খেয়ে মুখ মোছে। তারপর পান চিবুতে চিবুতে ফের বলে, ‘আচ্ছা করকে শুনে রাখ, দশ সাল বাদ বাদ এক এক আণ্ডা। দো বাচ্চার পর ফুল ইস্টপ। গরমিন কানুন বানিয়ে দিয়েছে। কানমে ঘুষল?’ মাঝে মাঝে দু-একটা ইংরেজি শব্দ মিশিয়ে কথা বলে সে।
সবাই নিঃশব্দে মাথা নাড়ল।
দাঁতের ফাঁক দিয়ে পিচকিরির মতো পানের পিচ ফেলে হিমগিরি আবার বলে, ‘ভাদই (ভাদ্র) মাসের কুত্তীর দল। মওকা পেলেই পেট ফোলাবার ধান্দা!’
কুঁদরী নামের মেয়েটা—তার রুক্ষ লালচে চুল ঝুঁটিবাধা, বুক যেন জোড়া পাহাড়, পতলী কোমর, দেওদার গাছের গুড়ির মতো উরু—খুবই হাসিখুশি যে, তবে ডাকাবুকো। ভয়ডরটা তার কম। বামহন, অন্য উচা জাত, মুনশী কাউকেই বিশেষ রেয়াত করে না। তাদের সামনাসামনি মুখের ওপর কিছু বলে না, তবে আড়ালে যা বলে তাতে ভয়ে অন্যদের বুক কাপে। তা ছাড়া তার জিভ ভীষণ আলগা, মুখে কোন কথাই আটকায় না। সোমবারীর কানের ভেতর মুখ গুঁজে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, বুঢ়া লাকড়াটা ক্যা কহল রে! ছোকরিদের এহী সিনা, এহী কোমর, এই জোয়ানি নিয়ে মরদের পাশে শোবে আর ‘মরদ মেরে কালাপন দুলহানিয়া’ বলে তার সিনার ওপর যখন তার আওরতকে তুলে নেবে তখন এই বামহনটার কথা মনে থাকবে?’
সোমবারী খানিকটা কুঁকড়ে গিয়ে দ্রুত চারপাশ দেখে নেয় তারপর বলে, ‘বেশরম—’
কুঁদরী বলতে লাগল, ‘মরদ যখন আটার মতো ডলতে থাকে তখন শরম লাগে না? শুনলেই বেশরম—ও হো-হো-হো—’
‘চুপ তে! যা। কাই শুনেগা—’
‘শুনুক। দশ সাল বাদ বাদ এক এক আণ্ডা! তার আগে হলে বামহনটা পাছার হাড্ডি তুড়ে দেবে! ওহো-হো-হো, হাড্ডি তোড়নেবালা! বুঢ়া লাকড়ার মুখে তিন লাথ, তিন বার থুক—’ বলে গুনে গুনে তিনবার থুতু ফেলল কুঁদরী।
সোমবারাী ভয় পেয়ে গিয়েছিল। সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে সে বলে, ‘চুপ হো কুঁদরিয়া—চুপ হো যা—’
ঘুমন্ত হলে কী হবে, হিমগিরির চোখ হলো শকুনের চোখ আর কান দুটো কুকুরের কানা সে কুঁদরীদের দিকে তাকাল। কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘কা বাত? কী হয়েছে?’
কুঁদরীটার মুখ অলগা, দুম করে কিছু বলে ফেলতে পারে। তার ফলাফল হবে খুবই খারাপ। তাই সোমবারী দম আটকানে গলায় তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘কুছ নায় দেওতা, কুছ নায়। এয়সা—দুসরা বাত—’
ধারাল সন্দিগ্ধ চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে হিমগিরি। তবে আর কোন প্রশ্ন করে না। শুধু বলে, ‘কুঁদরী বহোত হারামী ঔরত।’
সন্ধ্যে হয়ে আসছিল। সূর্যটা মিনিট কয়েক আগে ডুবে গেছে। হাল্কা অন্ধকার ছোটনাগপুরের এই অঞ্চলটার গায়ে উলঙ্গবাহার শাড়ির মতো জড়িয়ে রয়েছে।
ধর্মা ভয়ে ভয়ে একসময় বলে, ‘বামহন দেওতা, আপহিকো হুকুম হো তো ঘর লৌট যায়—’ কুশী অনেকক্ষণ কোয়েলের খাতে সাবুই ঘাসের জঙ্গলে তার জন্য দাড়িয়ে আছে। মেয়েটার জন্য ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠছিল সে।
তা ছাড়া আজ তাদের খোরাকি নেবার দিনও না। রঘুনাথ সিংয়ের চাষের জমিতে পেটভাতায় কাজের বদলে তাদের জন্য যে খাদ্য বরাদ্দ তা তারা রোজ পায় না; একদিন পর পর পায়। কাল দু’দিনের খোরাকি তারা হিসেব করে নিয়ে গেছে। আবার আসছে কাল সারাদিন ক্ষেতিতে কাজের পর দু’দিনের খাদ্য পাবে।
হাল-লাঙল রাখার যে টানা টিনের চালাগুলো রয়েছে তার ওধারে যে তালাবন্ধ লম্বা চালাটা, সেখান থেকে ধর্মাদের ভাগের খাদ্য মেপে দেওয়া হয়।
যা বলার বলা হয়ে গেছে। হিমগিরি বলে, ‘যা—কিন্তু ধর্মারা যখন ফিরে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছে সেই সময় কী মনে পড়ে যেতে খুব ব্যস্তভাবে ডেকে ওঠে, ‘আরে শুন শুন্—’
সবাই ঘুরে দাড়ায়, ‘জী—’
‘ঘরে লৌটবার আগে একবার বড়ে সরকারের মকান হয়ে যা।’
বড়ে সরকার অর্থাৎ রঘুনাথ সিংয়ের সঙ্গে ধর্মাদের এমনিতে সরাসরি কোন সম্পর্ক নেই। অত উঁচুতে যাবার সাহসও তাদের কোনদিনই হয় না। তাদের যাবতীয় কাজ-কারবার হিমগিরিনন্দনের সঙ্গে। হঠাৎ বড়ে সরকারের মকানে কেন তাদের যেতে হবে, সেটা ভেবে পায় না তারা। ধর্মারা মনে করতে পারে না, বড়ে সরকার রঘুনাথ সিং কখনও তাদের নিজের মকানে ডেকেছেন কিনা। শুধু তাদেরই না, রঘুনাথ সিংয়ের বাপ-ঠাকুরদা ধর্মাদের বাপ-ঠাকুরদাকে কখনও ডেকেছেন বলে তারা শোনেনি। একই সঙ্গে ভয় এবং কৌতূহল তাদের পেয়ে বসে।
হিমগিরি এবার ব্যাপারটা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেয়। বড়ে সরকার এবার ‘এম্লে’ হতে যাচ্ছেন। তাই নিজের লোকেদের সঙ্গে দু-একটা কথা বলবেন। পাটনা থেকে ফিরেই তিনি খবর পাঠিয়েছেন, বছরের পর বছর যারা তার কাছে কাজ করছে সেই সব আপনা আদমীরা জমিন থেকে ফিরলেই যেন তাঁর মকানে পাঠিয়ে দেয় হিমগিরি।
হিমগিরি আরো জানায়, বড়ে সরকার নিজে ধর্মদের সঙ্গে কথা বলতে চাইছে, এটা তাদের চোদ্দ পুরুষের ভাগ্য। খুবই খুশনসীব তারা। তাড়া লাগিয়ে বলে, যা যা, চলা যা—’
ধর্মার অস্থিরতা বাড়ছিলই। বড়ে সরকারের বাড়ি যাওয়া মানে আরো খানিকটা সময় বরবাদ। আবার না গেলে ও নয়। তার ঘাড়ের ওপর এমন শক্ত মাথা নেই যাতে বলতে পারে—যাবে না। অগত্যা ঘাড় গুঁজে অন্য সবার সঙ্গে সে বড়ে সরকারের কোঠির দিকে এগিয়ে যায়।